রঞ্জিনী পাল
১
রাত্রি তখন প্রায় গলগল করে গলে পড়ছিল গাছের পাতার নিচে। জ্যোৎস্না ছিল না, কুয়াশাও নয়। যেন আলোটা থেমে গিয়েছে দূরে—চুপিচুপি। আর সেই আলোর ফাঁক গলে, ডুয়ার্সের এক পাহাড়ঘেরা ছোট গ্রাম, চিলাপাতা জঙ্গলের পাশের জনপদ, অন্ধকারের ঘুমে ঢলে পড়ছিল ধীরে ধীরে।
তখনই সিঁদুরে রঙের এক পালকি ঢুকেছিল বনের ভেতর, তার ভিতর বসেছিলেন সাহেব সাহেবি দল। সঙ্গে খাস পিয়ন, বন্দুকধারী, আর এক বিদেশিনী নারী—মিস কনস্ট্যান্স হিলডা। তার চোখে ছিল আগুন। একরাশ রুক্ষতা মেখে সে বলেছিল, “This soil shall now bear the empire’s favourite leaf.”
১৮৬০ সালের ১২ জুন রাত। ব্রিটিশরা প্রথম চা-গাছ পুঁতে দেয় ডুয়ার্স অঞ্চলে—মার্চ পাড়ার উপত্যকায়। ঘুমন্ত পাহাড়ি মানুষেরা তখন জানতও না, ঠিক ঐ মুহূর্তেই তারা চিরকালের জন্য জমি হারাতে চলেছে।
আর ঠিক সেই রাতেই, গাছপোঁতা আর বন্দুকের আওয়াজের ঠিক এক ঘণ্টা পরে, জন্ম নেয় এক কন্যাশিশু—এক আদিবাসী পরিবারে। তার মা, বাঁধি, রক্তাক্ত শরীর নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলছিলেন। পিতা, মাদল বাজানো ঋষি পুরুষ হালাম, চুপচাপ তার স্ত্রীর মৃত শরীরের পাশে বসে ছিলেন। শিশুটি তখনও কেঁদে ওঠেনি।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, আকাশ হঠাৎ গর্জে উঠেছিল। ঝিঁঝিঁ পোকা চুপ করে যায়। জঙ্গলের একপাশ থেকে এক বুনো দাঁড়কাক উড়ে এসে বসে ওই শিশুর মাথার পাশে। তারপর কাঁদে সে—একবার, দুবার, তিনবার।
সেই কান্নার শব্দ ঢুকে যায় জঙ্গলের বাতাসে।
চিলাপাতার বুড়োরা বলে, সেই রাতে জন্মানো মেয়েটিকে এক যাত্রা-পথিক দেখেছিল—তার শরীরটা যেন গড়া আলো আর ছায়ার মিশেলে। সে নাকি রাতে হেঁটে বেড়াত একাই, চোখে ছিল ঘুমহীন আগুন। কে জানে, আদৌ সত্যি ছিল কি না, কিন্তু পরের বছর থেকেই ডুয়ার্সের নানা চা-বাগানে ঘটতে থাকে আজব ঘটনা।
সাহেবদের ঘোড়া হঠাৎ থেমে যায় মাঝপথে। এক চা-শ্রমিকের গলা কেটে পাওয়া যায় চা-গাছের গোড়ায়। কুয়াশা ঘেরা সকালে গাছের পাতা ঝরার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে যেন কাঁপা কাঁপা আওয়াজ ভেসে আসে—“তোমরা যার শরীর কেটেছ, সে এই মাটিতে শেকড় গাড়ে না।”
ব্রিটিশরা তার নাম দেয় “The Tea Witch”। শ্রমিকেরা চুপ করে থাকেন। তারা তাকে ডাকেন—আকাশতলীর কন্যা।
আর তখন থেকেই শুরু হয় এক অলিখিত উপকথার যাত্রা।
সময় কেটে গেছে।
তারপর… প্রায় দেড়শো বছর পেরিয়ে গেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, গারুলির একটা চা-বাগানে ঢোকেন একজন শহুরে গবেষক—ঐত্রি সেন। বয়স তিরিশের কাছাকাছি, শান্ত স্বভাবের। শান্তিনিকেতনে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা, এখন একটি প্রোজেক্টে সরকারি অনুদান পেয়ে খুঁজতে এসেছেন “প্রথম মহিলা চা-শ্রমিকের ইতিহাস”।
চিলাপাতার মেঠো রাস্তা পেরিয়ে যখন ঐত্রি সেই পুরনো ব্রিটিশ বাগানের মধ্যে প্রবেশ করলেন, তখন সকালের সূর্য কুয়াশা ঠেলছে। পাখিদের সুরের মধ্যে, তার নিজের বুকেও কেমন এক অনামিকা সুর বাজে। যেন এই মাটিতে কোনও শব্দ চুপ করে বসে আছে—উঠতে চায়। ফিরে আসতে চায়।
সে নিজের নোটবুকে লিখে রাখে:
“Is history only what the British documented? What about the whispers of leaves, the pulse of soil, the blood in the tea?”
— Field Note: Day 1
প্রথম দিনটা তার কেটেছিল নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহে—শ্রমিক তালিকা, মৃতদের নাম, ১৯০৭ সালের রেজিস্ট্রার, সাহেবদের চিঠিপত্র। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই তার শোনার মধ্যেই আসে এক মৃদু কান্নার শব্দ। যেন এক নারী কাঁদছে, জঙ্গলের গা ঘেঁষে। অথচ সবাই বলে—এখানে আজ আর কেউ থাকে না।
ঐত্রি ঘরে ফেরার আগে দাড়িয়ে পড়ে বাগানের এক পুরনো পাথরের গেটের সামনে। সেটা আধভাঙা, পাশে খোদাই করা আছে অদ্ভুত এক ছবি—এক হাতে চায়ের পাতি, আরেক হাতে ছুরি ধরা এক নারী। নিচে লেখা:
“She bleeds, the garden grows.”
ঐত্রির শরীর কাঁপে না। বরং, সে হেঁটে এগিয়ে যায়। যেন কারও ডাক শুনেছে।
এদিকে বহু দূরে, চিলাপাতার জঙ্গলের সীমানায় এক বৃদ্ধা তখন তাকিয়ে আছেন দূরের চায়ের আলোয়। চোখে নেই আলো, মুখে নেই কথা, তবুও সে বোঝেন—“সে ফিরে এসেছে। আবার।”
এই গল্প এখন শুরু। ইতিহাস নয়, কাহিনির ছায়া, যেখানে নারী হয়ে ওঠে মাটি, প্রতিশোধ, আর এক হারানো ভাষার মুখপত্র।
এখানে চা শুধু পাতা নয়, এক ধরনের রক্তস্নাত উত্তরাধিকার।
২
দুপুরের রোদ পেরিয়ে চা-বাগানে যখন নরম ছায়া নামে, তখন গাছেদের গায়ে গায়ে গুনগুন আওয়াজ বয়ে যায়—মনে হয়, পাতারাও কথা বলে, যদি শোনার কান থাকে।
ঐত্রি সেন দ্বিতীয় দিনের কাজ শুরু করেন পুরনো দলিলপত্র ঘেঁটে। ইংরেজ আমলের রেকর্ড আর বাংলা ওরাল হিস্টোরির ব্যবধান কেমন যেন অদৃশ্য দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার কাজ সেই দেয়ালকে ভেঙে পেরোনো, খুঁজে পাওয়া সেই কন্যাটিকে—যার নাম নেই, শুধু কাহিনি আছে।
পোড়া গন্ধমাখা পুরনো অফিসঘরে ঐত্রির সঙ্গে দেখা হয় এক বৃদ্ধার। গাল ধবধবে, চুল সাদা, চোখে মেঘ। নাম—ধুপা হাঁসদা। বয়স প্রায় নব্বই ছুঁইছুঁই। কথা বলেন না তেমন, কিন্তু তার চোখদুটো অতীতের পাতা উল্টে দিতে পারে।
ঐত্রি তাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার মা-ঠাকুমারা কি কিছু বলতেন, সেই সময়ের কথা? যখন প্রথম চা-বাগান তৈরি হয়?”
ধুপা প্রথমে চুপ ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
“সব গাছ কাঁদে না… কিন্তু চা-পাতা কাঁদে। শুনলেই বুঝবি।”
ঐত্রি অবাক। সে লেখেনোটে সেই কথা তুলে রাখে।
“চা-পাতার কান্না—What could it mean? Could pain be inherited by nature?”
তারপর ধুপা একটি ভাঙা পাথরের কাপ এনে দিলেন। কুঁজো হয়ে নীচু হয়ে বললেন,
“এই কাপ আমার ঠাকুমার ঠাকুমির। ওরা বলত, একবার এই কাপের মধ্যে জল পড়লে, ভোরবেলা রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়।”
ঐত্রি কাপটা নিয়ে তাকিয়ে দেখল—অদ্ভুত এক পাথর। হালকা ছাইরঙা, মাঝে একটা ফাটল। কাপটার ভিতরে যেন পাতলা লাল দাগ চিরকাল লেগে আছে, মুছেও যায় না।
ধুপা বললেন, “তুই যদি সত্যিকারের গল্প খুঁজিস, তাহলে ফুলবাতির পেছনের খোলা রাস্তা ধরে গিয়ে বাঁক নে। সেখানে এক বউদি আছে—মিলি। ওর ঠাকুমির মুখে শোনাছিল প্রথম মেয়েটার কথা। সেই যে, রক্তমাখা গাছের পাশে জন্মেছিল।”
ঐত্রির বুকের মধ্যে যেন পাতা খসে পড়ল। “রক্তমাখা গাছ”?
তাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে রওনা দেয়।
চিলাপাতা জঙ্গলের কিনারায় ছোট একটা কাঁচা ঘর।
সেখানে থাকে মিলি দাস। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, স্থানীয় চা-বাগানের সাপ্লাই ইউনিটে কাজ করে। মুখে চওড়া হাসি, কিন্তু চোখে সারাক্ষণ একপ্রকার সতর্কতা।
ঐত্রিকে দেখে একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, “আপনি কি ওই ‘City Madam’? যিনি পুরোনো মেয়েদের খোঁজ করেন?”
ঐত্রি মাথা হেঁট করে বলল, “আমি শুধু একটামাত্র মেয়েকে খুঁজছি। যার জন্ম হয়েছিল চা গাছের রক্তের পাশে।”
মিলির চোখ মুহূর্তে বদলে যায়।
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “জানেন, দিদি, আমরা ছোটবেলায় শুনতাম, এক মেয়ে নাকি রাত হলে বাগানে হাঁটত। মুখ দেখা যেত না, কাঁধে চুল ঝোলানো, ছায়ার মতো। কেউ বলে ভূত, কেউ বলে দেবী। কিন্তু আমার ঠাকুমা বলতেন, সে আসলে একজন—‘পাহাড়তলার মেয়ে’। তার গলা ছুঁয়ে দিলে গাছ মরে যেত। আর সাহেবদের ঘোড়া ভয় পেত।”
ঐত্রি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি বিশ্বাস করো এইসব?”
মিলি হাসল। “আমি তো নিজে একবার দেখেছিলাম। খুব ছোট ছিলাম, তাও মনে আছে। এক গরমের রাতে, যখন সবাই ঘুমোচ্ছে, আমি জল আনতে বেরোই। হঠাৎ দেখি, বাগানের শেষ লাইনের পাশে, এক গাছের ছায়ায় একটা মেয়ে বসে আছে। তার হাত একদিকে লম্বা হয়ে মাটিতে ছুঁয়ে আছে, আর চোখ যেন আমাকে দেখছে। কিন্তু তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তার পাশে পাতা গাছগুলো হঠাৎ শুকিয়ে যেতে লাগল।”
ঐত্রির গলা শুকিয়ে আসে।
“তারপর?”
“তারপর আমি চেঁচিয়ে উঠি, আর মা বেরিয়ে আসে। বলে, ওই মেয়ের নাম কেউ মুখে আনতে নেই। কারণ সে না আছে, না নেই। সে মাটির স্পর্শ, গাছের প্রতিশোধ, নারীর ঘুমহীন কান্না। সে চা-বাগানের অভিশাপ।”
ঐত্রি নোটবুকে কাঁপা হাতে লেখে:
“She who has no name. No record. No grave.
Yet she moves like wind and shadow.
History refuses her, but the land remembers.”
সন্ধ্যা নামতে শুরু করে। ঐত্রি যখন আবার ফিরে আসে গেস্ট হাউসে, তখন তার মনে হয় কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। সে থেমে দাঁড়ায়, চারদিকে তাকায়।
নিঃশব্দ।
তবু, কোথাও একটা পাতার নিচে পদচিহ্ন পড়েছে। কাদা মেখে আঁকাবাঁকা হয়ে একটাই ছাপ—চপ্পলের নয়, খালি পায়ের। মেয়েলি।
ঐত্রি গেট খুলে ঢোকার ঠিক আগে পেছন ফিরে চাইল—দূরে চা-পাতার ভিতর থেকে যেন একটা সাদা ছায়া সরে যায়।
সেই রাতে ঐত্রি ঘুমাতে পারে না। তার কানে ঘুরে ফিরে বাজতে থাকে এক অদ্ভুত সুর। যেন মাদল নয়, কিন্তু মাদলের সুরের ছায়া। অদ্ভুত এক ছন্দ:
“ভোরের আগে, পাতার ভেতর
কেউ আসে, কেউ যায়
সে মেয়ে, সে মা, সে মৃত্যু
তার কথা কে শুনে চায়?”
ঐত্রি চমকে ওঠে। দরজা খুলে বাইরে আসে।
আকাশে চাঁদ নেই, বাতাস কাঁপছে।
আর গেস্ট হাউসের জানলার পাশে সেই কাপটা রাখা—ধুপা হাঁসদার দেওয়া পাথরের কাপ।
তার ভিতরে কে যেন ফিসফিস করে বলল—“আমাকে খুঁজছো?”
৩
ঘুমে ভেজা রাত ছিল না সেটা, বরং ঘুমকে যেন গিলে খাওয়া এক দৃষ্টি ছিল চারদিকে—জ্যোৎস্নাহীন, নিরব, অথচ নির্জন নয়। ঐত্রি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাথরের কাপটার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেখানে কেউ যেন ফিসফিস করে বলেছিল, “আমাকে খুঁজছো?”
সে কাপটা হাতে তুলে দেখে। কিছু নেই তাতে। কিন্তু শীতল পাথরের গায়ে যেন নরম আঙুলের ছাপ লেগে আছে—একটানা ঘোরানো রেখা, যেন কেউ কাপের গায়ে বারবার ঘষেছে আঙুল, চুপচাপ।
ঐত্রি আলো জ্বালায় না। জ্বালালে, হয়তো সেই ছাপ মিলিয়ে যেত। আলো অনেক সময় সত্যি ঢেকে দেয়।
পরদিন সকালবেলা সে হাজির হয় চা-বাগানের পুরনো নথিপত্র ঘরে—যেটা একসময় সাহেবদের লাইব্রেরি ছিল। সেখানকার কেয়ারটেকার রঞ্জনবাবু, যিনি কিছুটা কবি, কিছুটা ইতিহাসরক্ষক, তাঁর কাছেই ঐত্রি জানতে চায়: “আপনার কাছে কি এমন কোনও ব্যক্তিগত ডায়েরি আছে? বিশেষ করে যাঁরা প্রথম দিকের সাহেব ছিলেন এখানে?”
রঞ্জনবাবু হেসে বলেন, “যাঁরা চা চাষ করতেন, তাঁরা অনেকেই লিখতেন। কিন্তু বেশিরভাগ পুড়েছে—১৯৭১-এ, যখন বাগানের ওপর আক্রমণ হয়েছিল। তবে একটা খাতা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। জানি না আপনি কী খুঁজছেন, কিন্তু এটা এক সাহেব ডাক্তারের ছিল। নাম ছিল—ড. টমাস এল্ড্রিচ। ওঁর লেখাগুলো কেমন যেন… অদ্ভুত। যেন বিজ্ঞানের বাইরে কিছু খুঁজতেন।”
ঐত্রি খাতা খুলে দেখে প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা:
“It is not the leaf that heals or poisons—it is the memory it carries. In the tea garden near Chilapata, I have found a girl whose presence wilts plants and terrifies horses. I believe she is not born of normal flesh.”
— 13 July 1861
ঐত্রির হৃদয় দ্রুত কাঁপতে থাকে।
সে পাতা উল্টায়। আরেকটি এন্ট্রিতে লেখা:
“She appeared again today. At twilight. Her feet did not seem to touch the soil. Her eyes bore no pupil. When I tried to speak, my voice disappeared. I feel… I am being watched.”
ঐত্রি লিখে রাখে তার ফিল্ড নোটে:
“There was a girl. Not myth, but real. Real enough to be noted by a colonial doctor. What if she wasn’t merely a legend—but the beginning of protest?”
চা-বাগানের শেষ মাথায় পুরনো সাহেব কোয়ার্টারের ধ্বংসস্তূপ আছে—দেয়াল পড়ে গেছে, জানালায় শিক নেই, দরজা নেই। ঐত্রি সিদ্ধান্ত নেয় দুপুরবেলা সেখানে যাবে।
পথে তার সঙ্গী হয় মিলি।
মিলি হেসে বলে, “আপনি ভয় পান না বুঝি?”
ঐত্রি মৃদু হেসে বলে, “ভয় পাই। কিন্তু ভয় না পেলে ইতিহাস জেগে ওঠে না।”
দু’জনেই পৌঁছায় এক পাথর ঘেরা স্থানে, যেখানে একসময় বসবাস করতেন সাহেবেরা। এখন শুধু ইঁদুর, ধুলো আর খসে পড়া মাটি। ঐত্রি খেয়াল করে, মেঝেতে জমে থাকা শ্যাওলার উপর হঠাৎ একটি স্পষ্ট ছাপ—খালি পায়ের, মেয়ের।
“এটা কার ছাপ হতে পারে?”—ঐত্রি ফিসফিস করে।
মিলি চুপ। সে একটা দেয়ালের গায়ে হাত রাখে—চোখে আবছা ঘোর।
“আমার ঠাকুমি বলত, এই ঘরের পেছনে একসময় রাখা হত কফিন। কারণ অনেক সাহেব হঠাৎ করে হারিয়ে যেতেন, বা মারা যেতেন। একবার এক সাহেব না কি চায়ের পাতার গোড়ায় বসে আত্মহত্যা করেছিলেন, আর এক নারীকে দেখেছিল, যিনি তার হাতে একটা শুকনো লাল পাতা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পাতা চিবোতেই নাকি সে গলায় ফাঁস দেয়।”
ঐত্রির গায়ে কাঁটা দেয়।
সে দেয়ালের ফাটল দিয়ে আলো ফোটে এমন একটি স্থানে এসে দাঁড়ায়, যেখানে দেয়ালে লাল রঙের দাগ—কোনো শিশুর হাতের ছাপের মতো। পাঁচটি আঙুল, কিন্তু অসম। যেন সেগুলো ছায়ার মতো।
সে দেয়ালের গায়ে ক্যামেরা তোলে, ছবি তোলে। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিন ব্ল্যাক হয়ে যায়।
বারবার চেষ্টা করেও কিছু দেখা যায় না।
ফিরে এসে ঐত্রি তার ল্যাপটপে কাজ করতে বসে। কিন্তু মন যেন রয়ে গেছে সেই আঙুলের ছায়ার কাছে। রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই আবার বাজে সেই মাদলের মতো সুর—এবারে একটু দ্রুত, যেন কেউ দৌড়চ্ছে পাতার মধ্যে দিয়ে।
তারপর হঠাৎ সে দেখতে পায়—দরজার নিচে দিয়ে কেউ কাপটা আবার ঠেলে দিয়েছে ঘরে। সেই পাথরের কাপ, যার ভিতর এক ফোঁটা লাল জল।
এইবার সে কাঁপে না।
বরং কাপটা হাতে নেয়, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলে:
“আমি এসেছি তোমার গল্প লিখতে। তুমি যদি আছো, আমাকে বলো তোমার নাম।”
এক মুহূর্ত, দুই, তিন…
তারপর বাতাস কাঁপে। কাপের ভিতর থেকে ভেসে আসে এক নাম—“হাঁদামা”।
ঐত্রি আবার ফিল্ড নোট খোলে। লিখে রাখে—
“First name heard. Handama. Unknown language.
Not registered in any list.
But she’s the one.
She’s the first woman of tea.”
চা-বাগান তখন নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু ঐত্রির মন জানে—এই ঘুমের গভীরে কোথাও ইতিহাস জেগে উঠছে।
আর হাঁদামা—সে কি একজন? না এক প্রতীক?
এই প্রশ্ন তার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলে—চায়ের পাতার গন্ধের ভিতর দিয়ে, ছায়া আর সত্যির মাঝামাঝি এক অদ্ভুত প্রান্তরে।
৪
ডুয়ার্সের সকালের আলো একরকম ধুলোমাখা সোনালি, যা পাতার ডগায় জমে থাকে আর ফুঁপিয়ে ওঠে মাটির গন্ধে। ঐত্রি সেনের কানে সেই সকালেও ঘুরছিল সেই একটি নাম—হাঁদামা।
সে নাম ইতিহাসের কোনও বইতে নেই, কোনও খতিয়ানে নেই, নেই সাহেবদের রিপোর্টে। অথচ যেন নামটি ছিল… স্মৃতির চা-পাতায় লুকিয়ে রাখা এক দীর্ঘশ্বাস।
ঐত্রি কাপটা বারান্দার ধারে রেখে আবার নোট খোলে।
সেই অদৃশ্য কণ্ঠের উচ্চারণ কীভাবে ভেসে এল, সে জানে না। অলীক? কল্পনা? না ইতিহাসের কোনো বিস্মৃত খোঁজ? সে বুঝতে পারে না।
কিন্তু সে জানে, হাঁদামা আছে।
সে ঠিক করে, আজ সে আরও গভীরে যাবে। মানুষের মুখের ইতিহাস খুঁজবে—লোকগান।
স্থানীয় লাইব্রেরিতে কাজ করেন এক ব্যক্তি—রাহুল তামাং। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, শান্ত অথচ ভিতরে আগুনধরা চোখ। সে কবিতা লেখে, আর মাঝে মাঝে কিশোরদের গান শেখায়। ঐত্রির কথা শুনে সে বলে,
“হাঁদামার নাম আমি শুনেছি, কিন্তু কেবল গানেই। ছোটবেলায় এক ঠাকুমা গাইতেন। শোনাব?”
ঐত্রির গলা কেঁপে ওঠে—“হ্যাঁ… দয়া করে। প্লিজ শোনান।”
তামাং মাটিতে বসে, দু’হাত পাঁজরের পাশে রেখে ধীরে ধীরে গুনগুন করে গাইতে শুরু করে:
“চা না চায়, খালি শরীর
মাটি চায় হাঁদামার শির
পাতায় রক্ত, পাতায় ক্ষয়
হাঁদামার চোখে রাত বই।”
ঐত্রি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। পেটানো ছন্দ নয়, সুরেও তেমন শিল্পিতা নেই। কিন্তু তবুও গানটি তার হৃদয়ে কাঁপুনি তোলে।
সে ফিসফিস করে বলে, “এই গান কোথা থেকে এসেছে?”
রাহুল একটু চুপ করে থেকে বলল,
“আমাদের আদিম লোককথার গানগুলো ইতিহাস নয়, আবার নিছক কল্পনাও নয়। হাঁদামা একজন নারী—জন্মেছিল এমন এক রাতে, যেদিন মাটি আর রক্তের মধ্যে ভাগ বাঁধা হয়েছিল। সে ছিল আমাদের শরীরের প্রথম ঘাম, প্রথম ঘৃণা, প্রথম না বলা প্রতিবাদ।”
ঐত্রি হাত কাঁপতে কাঁপতে তার মোবাইলে রেকর্ড করে গানটি।
তারপর প্রশ্ন করে, “তুমি কি বিশ্বাস করো সে ছিল?”
তামাং হাসে। “তুমি কি বিশ্বাস করো সে নেই?”
বিকেল গড়িয়ে রাত নামছে। ঐত্রি গেস্ট হাউসে ফিরে আসে। এবার সে জানালার পাশে না দাঁড়িয়ে কাপটা নিয়ে আসে লেখার টেবিলে। সে নিজের ল্যাপটপ খুলে টাইপ করে তার গবেষণার রূপরেখা:
Proposed Title:
The First Woman of Tea: Handama and the Folklore of Resistance
Abstract:
“This paper explores the intersection of colonial tea plantation history and indigenous feminine resistance through the undocumented yet persistent legend of Handama. Based on oral narratives, songs, and supernatural testimony, the study argues that Handama is a mythic consolidation of protest, memory, and gendered exploitation.”
লিখতে লিখতে ঐত্রির মনে পড়ে যায় তার ছোটবেলার কথা। ঠাকুমার মুখে ‘জলের মেয়ে’ নামক এক গল্প শুনত সে—যে মেয়ে নাকি নদীর মধ্যে জন্মে, কারও কথা শোনে না, আর একদিন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। সে এখন হাঁদামার মধ্যে যেন সেই মেয়েকে খুঁজে পায়—নারীর দুঃখ, ত্যাগ, বিদ্রোহ ও নির্মোহ স্পর্ধার এক ছায়াচিত্র।
রাতের খাবার শেষ করে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দূরে চা-বাগান এখন চুপচাপ। কিন্তু গাছেদের মধ্যে যেন নড়াচড়া হয়। কেউ যেন পাতার নিচে হাঁটে, বাতাসের থেকে ধীরে, শব্দের থেকেও নিঃশব্দ।
ঐত্রি এবার আর চমকে ওঠে না। সে ফিসফিস করে বলে,
“তুমি যদি থাকো, আমি লিখব তোমার কথা। কেউ বিশ্বাস না করুক, আমি করব। কারণ ইতিহাস শুধু সাহেবদের কলমে তৈরি হয় না।”
জবাবে বাতাস একটু জোরে বয়ে যায়।
পরদিন সকালে সে মিলির কাছে যায়। তাকে জানায় হাঁদামার নাম ও গান। মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
“তুমি কি জানো হাঁদামা কবে শেষবার দেখা গিয়েছিল?”
“না,” ঐত্রি বলে।
“আমার মা বলত, শেষবার হাঁদামাকে দেখা গিয়েছিল ১৯৭২ সালে—যখন এক সাহেব চা-বাগান বিক্রি করে পালাতে চাইছিল। তার ঘোড়া একটানা চেঁচাতে থাকে, আর সে দেখেছিল পাতার ভেতর দিয়ে আসছে এক মেয়ে। সাদা কাপড়, খালি পা, আর হাতে একটা শুকনো পাতা। সাহেব বলে, তার হৃদয় তখনই বন্ধ হয়ে যায়।”
ঐত্রির শরীরে হিমস্রোত বয়ে যায়। সে ভাবে—শুধু একটা চরিত্র নয়, হাঁদামা যেন একটা সময়ের ছায়া, যার ভিতর দিয়ে হাজার হাজার না বলা কাহিনি কথা বলে।
সন্ধ্যাবেলা ঐত্রি আবার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। সেই জায়গা, যেখানে প্রথম কাপ রাখা ছিল, যেখানে লেখা ছিল—“She bleeds, the garden grows.”
সে এবার পাথরের কাপটা গেটের পাদদেশে রেখে দেয়। কাপের মধ্যে সে রাখে একটা সাদা কাগজে লেখা এক লাইন:
“তুমি ছিলে, তাই আমরা আজ আছি।”
সে জানে, এই কাজ হয়তো পাগলামির মত, হয়তো কেউ এই চিঠি পড়বে না। তবুও সে রেখে আসে, কারণ হাঁদামা শুধু ইতিহাস নয়—সে এক রকম প্রতিশ্রুতি।
চা-বাগানের পাতার নীচে কেউ ফিসফিস করে বলে—“ভোর আসছে।”
আর ঐত্রি জানে, তার লেখা আর থামবে না।
৫
ডুয়ার্সের আকাশ অনেক সময় অপ্রস্তুত বৃষ্টির মতো—জানিয়ে দেয় না, কবে ভিজবে মাটি। ঐত্রি সেন সকালবেলা বাগানে হাঁটতে হাঁটতে দেখে গাছের পাতায় ঝরেছে ছোট ছোট হলুদ ফুল—কাঞ্চন ফুল নয়, কাঞ্জি ফুল, যা স্থানীয়রা বলে একরকম বিষের গন্ধ রাখে।
সে পাতার গোড়ায় একটা চিঠি কুড়িয়ে পায়—আধপোড়া কাগজ, ইংরেজিতে লেখা, ফাউন্টেন পেনের কালি ফেটে ছড়িয়ে আছে। মনে হয় অনেক পুরনো, তবে বৃষ্টি বাঁচিয়ে রেখেছে অদ্ভুতভাবে।
কাগজের এক কোণে লেখা:
Lady Edith Mary Elkins to her sister Josephine
Date: 4 October 1861
“Chilapata Residency, Dooars”
ঐত্রি চিঠি পড়তে শুরু করে—মাথার ভেতর যেন দুলে ওঠে উনিশ শতকের এক নারীর কণ্ঠস্বর, যার গলায় ক্লান্তি, ভয় আর বিস্ময়ের ছায়া।
“Dearest Josephine,
Today I saw something I cannot put in plain words. The garden, as you know, is beautiful, but something in its soil feels cursed. I walked alone near the northern rows while Thomas had gone to the dispensary. It was a misty morning, yet I felt watched. Suddenly, I saw a girl—no, not quite a girl, more like a figure of ash and bone.
She stood beside a tea bush, unmoving. Her eyes, Josephine… they were not human. Black, without center. No sclera, no whites. Just the full, round black of night. And her hair was long, soaking, though there had been no rain. I tried to speak. She raised her hand, and in it was a leaf—not green, but deep red, like blood-drenched velvet.
Then I heard it, ever so faintly. A humming, or was it a tune? I cannot describe it well. It was both terrifying and… terribly beautiful.
I ran. I do not know if Thomas will believe me. But I swear, the air around her smelt like crushed kanji flowers and gunpowder.
—Your loving sister, Edith”
ঐত্রি চিঠির শেষ লাইন পড়েই দাঁড়িয়ে পড়ে।
“Crushed kanji flowers and gunpowder.”
এটি কি কাকতালীয় যে, একই গন্ধ আজও পাতার কাছে অনুভব করে সে?
সে নিজের নোটবুকে লেখে:
“The legend of Handama lives not only in the mouths of locals, but it even breached the fear of the colonial wives. If Lady Elkins documented her sighting, she must have seen something. Something unexplainable by logic.”
ঐত্রি সেই চিঠির নিচে নীচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। হঠাৎ পাতার নীচে দেখে একটি ছোট ছাঁটা শিকড়, যা যেন মানুষের আঙুলের মতো মোচড়ানো।
তার মুখের ভেতরে শুকিয়ে আসে। সে কাপটা একবার নাড়ায়—ভেতরে লাল পাতা নেই, কিন্তু গন্ধটা যেন সামান্য রয়ে গেছে।
কাঞ্জি ফুল আর কামানের গন্ধ। এক নারীর ভয়।
ঐত্রি সেদিন বিকেলে যায় রঞ্জনবাবুর কাছে। তাকে দেখায় চিঠিটি।
রঞ্জন বলেন, “Lady Elkins ছিলেন সাহেব ড. টমাস এল্ড্রিচের স্ত্রী। ইতিহাসের পাতায় ওঁর নাম তেমন ছিল না। শুধু জানা যায়, তিনি এক বছর পরেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে ইংল্যান্ড ফিরে যান।”
ঐত্রি বলে, “তাহলে কি হাঁদামাকে দেখার পর তিনি…?”
রঞ্জনবাবু তাকিয়ে বলেন, “কেউ দেখলে পালাত। কেউ দেখলে পাগল হতো। কেউ দেখেও বিশ্বাস করত না। কিন্তু হাঁদামা থেকে যেত—শান্তভাবে, সব জেনেও। ও ছিল এক ধরণের প্রতিরোধ, যা নারী হয়ে জন্মেও দেবীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।”
ঐত্রির মন যেন ছুঁয়ে যায় এই কথায়। সে ভাবে—ঐতিহাসিক দলিল যতই চুপ থাকুক, যদি এক সাহেব স্ত্রী নিজে কাঁপা হাতে লিখে যায় “She had no human eyes,” তাহলে নিশ্চয়ই কেউ ছিল, এক নারী, যার অস্তিত্ব মাটির চেয়েও বেশি দৃঢ়।
রাতে ঐত্রি তার ল্যাপটপে নতুন অধ্যায় যোগ করে:
Chapter: “Eyes Without Whites: The Colonial Fear of Handama”
A study of feminine presence as psychological threat and political anomaly in early plantation narratives.
তার লেখার ভিতর গাঁথা হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, কল্পনা, এবং সেই সুর যা বারবার বাজে—চুপচাপ।
সে একসময় জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, দেখে আকাশে পূর্ণিমার আলো। কিন্তু পাতার ওপর আলো পড়ে না।
গভীর রাতে হঠাৎ সে দরজার নিচে আবার কিছু ঠেলে দেওয়ার শব্দ পায়।
সে দৌড়ে যায়।
দেখে, এইবার কাপ নেই।
বরং এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে। পুরনো পাতার উপরে আঁকা একটা ছবি—এক কিশোরী মেয়ের মুখ। চোখ বড়ো, চুল খোলা, গায়ে এক টুকরো কাপড়। চোখের মধ্যে আঁকা নেই কোনো মণি—শুধু কালো গোলাকার রেখা।
কাগজের নিচে লেখা—”She sees what others forget.”
ঐত্রি জানে, গল্প কেবল খুঁজে পেতে হয় না—অনেক সময় গল্প নিজেই এসে হাজির হয়, যখন কেউ সত্যিই শোনে।
আর হাঁদামা?
সে কি অলৌকিক?
না, সে তো এই মাটির রক্ত-গন্ধে ভিজে থাকা এক আদিবাসী মেয়ে—যাকে ইতিহাস লিখতে ভুলে গেছে, কিন্তু চা-পাতা ভোলেনি।
৬
সকালে বৃষ্টি পড়েনি, কিন্তু চা-বাগানের জমি জলের মতো ভিজে। গাছের গোড়ায় লতানো আগাছা, আর পাতার ফাঁকে কুয়াশার টান। ঐত্রি সেন হাঁটছে একজোড়া স্নিকার পরে, কিন্তু তবুও তার পায়ে মাটি লেগে যাচ্ছে—ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে, যেন মাটির নিচেই কেউ শুয়ে।
আজ সে যাচ্ছিল বাগানের সেই পুরনো অংশে, যেটাকে স্থানীয়রা বলে “মৃতভূমি”। ব্রিটিশ আমলে যে অংশটিতে শ্রমিকদের কবর দেওয়া হত, নাম ছাড়াই। চুন-ছড়ানো জমি, কোনও ফলক নেই, কোনও সমাধিস্তম্ভও নয়—শুধু একরকম অসমাপ্ত স্তব্ধতা।
পথ দেখাচ্ছে মিলি। হাতে মশাল-আকৃতির লাল রঙের ছাতা, মাটির দিকে তাকিয়ে চলেছে।
ঐত্রি জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে এর আগে এসেছো?”
মিলি চুপ করে থাকে একটু। তারপর বলে,
“আমার ঠাকুমা বলতেন, এখানে যারা কবর পায়নি, তারা পাতার ভেতরে থাকে। মাঝেমাঝে কেউ পাতা তুললে—একটা হাত দেখা যায়, একটুকরো আঙুল, কখনও খালি চোখ।”
ঐত্রির শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। কিন্তু ভয় নয়—এই জায়গাটা যেন তার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
অবশেষে পৌঁছে তারা। চারদিক নির্জন। গাছ কম, পাতাও কম, কিছু ঝুপঝারে ঢেকে থাকা উঁচু জমি। বৃষ্টির পানি জমে ছোট ছোট ডোবা হয়েছে।
ঐত্রি নিচু হয়ে মাটি ছোঁয়। কাদা নয়, কিন্তু কঠিন মাটির মধ্যে কী যেন আটকে আছে—এক টুকরো কাপড়। টেনে বের করতেই দেখা যায় লাল রঙের এক কাপড়ের ছেঁড়া অংশ, যেন কারও কোমরের গেরো ছিল একদিন।
তখনই মাটির এক পাশে পাতা নড়ে ওঠে।
ঐত্রি সোজা হয়ে তাকায়।
পাতার নিচে স্পষ্ট একটা দাগ দেখা যাচ্ছে—একটা হাত, বাম হাত, কাঁটাগাছের পাশে পড়ে আছে। কিন্তু তা আস্তে আস্তে পাতার ভেতর মিলিয়ে যায়। যেন পাতারা নিজেই ঢেকে দেয় তাদের মৃতদের।
মিলি ফিসফিস করে বলে, “আজকে পাতারা কথা বলছে না। ওরা চুপ। কারণ ওরা জানে তুমি আসছ।”
ঐত্রি এক ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ে। সে মাটির ওপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে।
তার মনে হয়—মাটির নিচে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। না অভিশাপ নিয়ে, না করুণা নিয়ে—শুধু নির্জনে।
সে আবার ফিল্ডনোটে লেখে:
“Unnamed graves. Female. Handama, perhaps, wasn’t buried.
But maybe she lives in this rhythm—leaf, death, silence, return.”
সন্ধ্যায় সে ফিরে আসে বাগানের রেস্ট হাউসে। দরজা খোলার আগেই দেখে, বারান্দার উপর কাপটা নেই।
অথচ সে স্পষ্ট মনে রেখেছিল, কাপটা টেবিলে রেখেছিল ঘরে ঢোকার আগে।
বাতাস থেমে আছে। আলো নিভু নিভু।
ঘরে ঢুকে ঐত্রি দেখে, টেবিলের ওপর রাখা একটা ছোট্ট গাছপাত্র—মাটিভর্তি, তার মধ্যে লাগানো একটা লাল পাতা। পাতা শুকনো, কিন্তু তার রঙ টকটকে।
তলার দিকে ছোট কাগজের টুকরো। হাত দিয়ে তুলে পড়ে:
“আমরা যারা ছিলাম, তারা কোথাও যাইনি।”
ঐত্রি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
তখনই দরজা হালকা ঠেলতে ঠেলতে হাওয়া ঢোকে। একটা চিৎকার নয়, কিন্তু একটা শব্দ বাজে কানে—জল ভেজা মাটি চেপে হাঁটার মতো শব্দ।
সে দৌড়ে বারান্দায় আসে।
দূরে—চা-বাগানের দিকে—একটা ছায়া সরে যাচ্ছে। ধীরে। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু চুলের রেখা আর হাঁটার ছন্দ বলে দেয়—সে কোনো গল্প নয়। সে আসল।
পরদিন সকালে ঐত্রি আবার যান রাহুল তামাং-এর কাছে। তাকে দেখায় কাপড়ের টুকরো, মৃতভূমির ছবি, আর কবরের গাছের পাতার নমুনা।
রাহুল একবার দেখে বলে,
“এই কাপড়ের ডিজাইনটা আগে দেখেছি। চা-বাগানের নারীরা যে কাপড় বাঁধত কোমরে—তাতে এমন সূক্ষ্ম নীল পাড় থাকত, শুধুমাত্র বিবাহিত নারীরা পরত। কিন্তু যারা কুমারী অবস্থাতেই মারা যেত, তাদের সে কাপড় দেওয়া হত না।”
ঐত্রি জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এই কাপড়…?”
“কারও দেওয়া নয়। সে নিজেই পরেছিল। মানে, সে নিয়ম মানেনি। সে নিয়ম ভেঙেছিল। হয়তো হাঁদামা!”
ঐত্রির মনে হয়, হাঁদামা কেবল একজন নয়। সে এক ভঙ্গী, এক অসন্তোষ, এক অদৃশ্য সত্তা—যে পাতার নিচে থেকে মুখ তোলে কেবল তখনই, যখন কেউ তাকে সত্যি করে খুঁজে পায়।
সন্ধ্যাবেলায় ঐত্রি তার কাগজের নতুন অধ্যায় লেখে:
“Unmarked and Unclaimed: The Graves of Women Who Protested by Dying Quietly”
তার লাইন গুলো চলে আসে যেন নিজে নিজেই—
“They had no names.
No graves.
No history.
Yet their scent lingers in the tea.”
রাত বাড়ে। ঐত্রি এবার ঘুমাতে যাওয়ার আগে জানালায় এসে দাঁড়ায়।
চা-বাগানের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়—পাতাগুলো থেমে নেই। তারা নিশ্বাস নিচ্ছে।
আর পাতার ফাঁক দিয়ে যেন কেউ চেয়ে আছে।
তার মুখে হাসি।
সে ফিসফিস করে বলে, “আমি আছি, হাঁদামা। আমি লিখে যাচ্ছি।”
৭
ডুয়ার্সের সকালে বাঁশির শব্দ শোনা যায় না। এখানে পাখি ডাকে, চা-পাতা ঝরে, কিন্তু বাঁশির সুর? না। সে একান্তই মানুষের, অথবা অতীতের।
তবুও ঐত্রি সেন সেই সকালে ঘুম ভাঙার আগেই একটা বাঁশির সুর শুনলেন। নরম, নিঃসাড়—একটা পুরনো সুর, যেন হারিয়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেলের মতো।
সে জানালার পাশে গিয়ে দেখে—চা-বাগানে কুয়াশা গাঢ়। পাতার ফাঁকে কোনও ছায়া নেই, কিন্তু সুরটা বাতাসে রয়ে গেছে।
সে সেদিন যাত্রা করল একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে—খুঁজে বের করতে হবে সেই সংযোগ যা হাঁদামাকে কেবল এক আদিবাসী নারী নয়, বরং এক প্রতিরোধের প্রতীক করে তোলে।
পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে সে পৌঁছায় হেমরাজ রবিদাস নামের এক প্রবীণ ব্যক্তির কাছে, যিনি একসময় স্থানীয় ইউনিয়ন নেতার সহকারী ছিলেন।
রবিদাসবাবু গায়ে লুঙ্গি, মুখে পাতলা হাসি, কিন্তু চোখে ইতিহাসের ছায়া। তিনি শুনে অবাক হন না। হাঁদামার কথা বলতেই বলেন,
“হাঁদামা ছিল আগুন। সবাই ভাবত ভূত, কেউ ভাবত দেবী। আমি জানতাম, সে ছিল বিপ্লব।”
ঐত্রি অবাক হয়ে বলে, “আপনি কি কখনও তাকে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ। ১৯৬৮ সালের জুন মাস। আমি তখন মাত্র ছাব্বিশ। এক রাত্রে আমাদের ট্রেড ইউনিয়নের গোপন বৈঠক চলছিল—কীভাবে বোনেদের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা যায়, তাই নিয়ে। সবাই ভয়ে চুপ। কেউ সাহস পাচ্ছিল না। তখন হঠাৎ দরজা খুলে দাঁড়াল এক মেয়ে—চুল ছড়ানো, চোখে আগুন।
সে শুধু বলল, ‘তোমরা কথা বলছো, আমি রক্ত দিয়েছি।’
তারপর হাতে দিল একটা বাঁশি—লোহার বাঁশি, যেখানে বাঁধা ছিল একটা শুকনো পাতা। আর বলল,
‘যখন তোমরা চুপ হয়ে যাবে, আমি বাঁশির সুরে ফিরে আসব।’”
ঐত্রির গলা শুকিয়ে আসে। “আর সেই বাঁশি…?”
রবিদাস মাটি খুঁড়ে এক জায়গা থেকে বের করে আনেন লোহার তৈরি বাঁশির মতো একটা যন্ত্র—ধূলিধূসর, কিন্তু এক পাশে খোদাই করা আছে হরফ: “Handama”।
ঐত্রি হাত কাঁপতে কাঁপতে সেটি হাতে নেয়। গায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়।
সে ফিল্ডনোটে লেখে:
“She was not just myth.
She was armed.
A weapon, a word, a woman.”
ঐত্রি সেই রাতে বাঁশিটা নিয়ে রেস্ট হাউসে ফেরে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সে বাঁশিটার উপর আঙুল বোলাতে থাকে। হঠাৎ বাতাস জমে যায়। অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা।
সে বাঁশিতে নিঃশব্দে ফুঁ দেয়। কোনও আওয়াজ হয় না। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে—
দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এক ছায়া।
ছোট, কিশোরী মেয়ের ছায়া। সে দাঁড়িয়ে, ঘরের বাইরে। হাতে একটা পাতা।
ঐত্রি তার দিকে এগিয়ে যায়, দরজা খুলে।
কিন্তু কেউ নেই।
তবে মাটিতে পড়ে আছে একটা ছোট পত্র—লালচে পাতার মতো, যার মধ্যে হালকা লেখা:
“তুমি যদি লিখো, আমিও থাকব।”
পরদিন ঐত্রি আবার যায় রাহুল তামাং-এর কাছে। বাঁশিটা দেখায়।
রাহুল প্রথমে কিছু বলে না। পরে বলে,
“আমার দাদুর মুখে শুনেছিলাম, ব্রিটিশদের সময়ে এক গোপন মহিলা সংগঠন তৈরি হয়েছিল, যারা চা-বাগানে সুর আর শরীর, দুটো দিয়ে প্রতিবাদ করত। বাঁশি তাদের সিগন্যাল ছিল।
যখন কোনও নারী নিখোঁজ হত, বাঁশি বাজতো। চা গাছের ছায়ায় এক নারী দাঁড়িয়ে থাকত। হাঁদামা!”
ঐত্রি বলে, “তাহলে সে একজন নয়। সে অনেকজনের গল্প?”
রাহুল মাথা নাড়ায়। “সে এক, কিন্তু সে ছিল ভাষাহীন হাজার নারীর মুখপাত্র। সে এক দেহের ভেতর দিয়ে কথা বলত যাদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”
ঐত্রি সেদিন রাতে একটি অধ্যায় যোগ করে তার গবেষণায়:
Chapter 6: “When Women Whistled”
The legacy of sonic resistance and the myth of Handama as a collective revolutionary force in Dooars plantations.
“In the silence of the night, when no man dared speak, a woman whistled. That whistle was a call to memory.”
সেদিন রাতে ঘুমের আগে ঐত্রি চা-বাগানের দিকে তাকিয়ে ভাবে—হাঁদামা কি আসবে?
হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুৎ।
আর পেছনে পাতার ছায়ায় সে দেখে, একজন দাঁড়িয়ে আছে। খুব ধীরে, হাত তোলে।
ঐত্রির ঠোঁটে নিজের অজান্তেই একটি শব্দ উঠে আসে—“আসো।”
আর গাছের পাতায় বাজে সেই বাঁশির সুর—
ভাঙা, তবুও পরিচিত। পুরোনো, তবুও জীবন্ত।
৮
চা-বাগান যখন নিঃশব্দ হয়, তখন তা নিছক রাত নয়—তা এক অজানা ভাষার শরীর হয়ে ওঠে। পাতারা কাঁপে না, বাতাস থামে না, তবুও কিছু একটা অপেক্ষা করে থাকে এই মুহূর্তে—ভোরের আগে, যাকে সময় ছুঁতে পারে না।
ঐত্রি সেন জানালার ধারে বসে ছিলেন। হাতে পাথরের কাপ, কোলে খোলা নোটবুক, চোখে সারারাত না ঘুমোনোর লালচে রেখা। তার চারপাশে ঘরে বাতাস ঘন হয়ে উঠছিল, যেন দেয়ালগুলো নিশ্বাস নিচ্ছে।
পিছন থেকে ভেসে এলো বাঁশির এক চেনা সুর।
সে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে রওনা দিল। একবারের জন্যও সে পেছন ফিরে চায়নি। আজকের রাত, সে জানত, হবে শেষ সাক্ষাৎ—তার ও হাঁদামার মধ্যে, শব্দ আর ছায়ার মধ্যে।
চা-বাগানের ভিতর দিয়ে সে হাঁটছিল। কুয়াশা ঘনিয়ে উঠছিল গলা পর্যন্ত, পাতার ফাঁকে ভেজা মাটি, ঘাস, আর ভোরের আগের হিমশীতল নীরবতা।
তখনই দেখা যায়—এক গাছের নিচে, দাঁড়িয়ে আছে এক নারী।
খুব স্বাভাবিকভাবে। যেন এই মাটির মধ্যেই সে জন্মেছে, পাতার নীচে ঘুমিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
চুল ঝুলে পড়েছে কাঁধে, চোখ গভীর। গায়ে একটি লাল কাপড়, কোমরের কাছে বাঁধা। হাতে শুকনো পাতা, আর কপালে এক বিন্দু কাদা।
ঐত্রি তার দিকে এগিয়ে যায়।
মুখোমুখি হতেই হাঁদামা কোনো শব্দ করেন না। শুধু এগিয়ে এসে তার হাতে ধরা নোটবুকের ওপর রাখেন তার আঙুল। একটি লাইন নিজে নিজে লেখা হয়ে যায়:
“আমি ছিলাম, আমি থাকব, যদি কেউ আমাকে মনে রাখে।”
ঐত্রির কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। সে ফিসফিস করে,
“তুমি কি একজন? নাকি সবাই?”
হাঁদামা হেসে ওঠেন না। কেবল চোখের ইশারায় বাগানের দিক দেখান।
ঐত্রি সেই চোখের দিক অনুসরণ করে দেখেন—চা গাছের পাতার নীচে বসে আছে আরও কিছু কিশোরী মেয়ে, কেউ মাটি ছুঁয়ে গাইছে গান, কেউ কাপড় বুনছে, কেউ দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে। সকলেই যেন হাঁদামার প্রতিচ্ছবি—ভিন্ন রূপ, একই সত্তা।
তাদের চোখে জল নেই, কিন্তু ভাষা আছে। ঐ ভাষা উচ্চারিত হয় না—তা লেখা হয়, হাঁটা হয়, চুপ করে থাকা হয়।
ঐত্রির কাঁধে এসে হাত রাখেন হাঁদামা।
একটা অনুচ্চারিত বার্তা।
একটা দৃশ্য—যেখানে শতাব্দীর প্রতিরোধ ফুটে উঠছে এক নারীর আঙুলের ছোঁয়ায়।
তখনই আকাশে হালকা রঙ ফোটে।
ভোর আসছে।
চা-বাগানের প্রথম আলো পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। ঐত্রি একা ফিরছে, কিন্তু আর একা নয়।
তার ফাইল ভর্তি হয়ে গেছে। গবেষণার কাগজে কেবল পরিসংখ্যান নয়—এখন সেখানে গান আছে, গন্ধ আছে, মৃতদের নামহীন কবর আছে, আর আছে হাঁদামা—এক চরিত্র, এক প্রতীকের মতন।
সে শান্তিনিকেতনে ফিরে যায়, তার গবেষণাপত্র জমা দেয়।
প্রথমে অধ্যাপকরা বলেন—“ভৌতিকতা, অলীক কল্পনা!”
কিন্তু পরের বার যখন সে একটানা পড়ে শোনায় হাঁদামার গান, হাঁদামার গল্প, হাঁদামার চোখের বিবরণ, আর ফিল্ড নোটের শেষ পাতায় বলে:
“Handama is the voice of every woman who was buried without a name, every girl whose blood watered the tea, and every silence that was stronger than a scream.”
—তখন কেউ আর প্রশ্ন করে না।
বছর দুয়েক পরে ঐত্রি তার গবেষণা বই আকারে প্রকাশ করে। নাম দেয়—
“ভোরের আগে চা: হাঁদামা ও চুপ করে থাকা বিদ্রোহের কাহিনি”
বই ছড়িয়ে পড়ে। কেউ প্রশ্ন করে, কেউ হাসে, কেউ আবার চোখে জল নিয়ে বলে—“আমার দিদিমা-ও এক চা বাগানে কাজ করত।”
আর অনেক বছর পর, এক চা-বাগানে এক নতুন শ্রমিক মেয়ে পাতা তুলতে তুলতে গুনগুন করে গায়—
“পাতা নেবে, রক্ত নেবে
কিন্তু আমার গল্প কে নেবে?”
তখন তার পাশের বুড়ো মেয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই গান কোথা থেকে শিখলি রে?”
সে বলে, “আমার দিদি বইয়ে লিখে গেছে—হাঁদামার কথা।”
আর হাঁদামা?
সে এখনও চা-বাগানে হাঁটে। পাতার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েদের পাশে বসে গান গায়। কখনও বাঁশি বাজায়। কখনও পাতার মধ্যে দিয়ে এক কাপ রাখে দরজার নিচে।
সে জানে, কেউ একজন লিখে ফেলেছে তাকে।
আর সে থাকবে—ভোরের আগের ঠিক সেই সময়টায়—যখন মাটি এখনও ঘুমিয়ে, পাখিরা জাগেনি, কিন্তু পাতারা শুনছে।
তখন হাঁদামা আসে। আবার।
শেষ