Bangla - কল্পবিজ্ঞান

ভৈরব তন্ত্র

Spread the love

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গা-ছমছমে সেই পুরোনো গবেষণা রুমটা দিনের আলোতেও যেন কিছুটা অন্ধকারময়। তারই এক কোণে বসে রেখা সেনগুপ্ত চোখ গুঁজে পড়ছিল পুরনো এক সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি—জীর্ণ, পোড়া পাতাগুলো যেন শতাব্দী প্রাচীন রহস্যের সাক্ষ্য বহন করছে। বেশ কিছুদিন ধরেই সে খুঁজছিল এমন এক প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থ যা তন্ত্রশাস্ত্রের অপ্রকাশিত ধারার অন্তর্ভুক্ত। লাইব্রেরির পুরাতন ক্যাটালগে হঠাৎ করেই তার চোখে পড়েছিল ‘ভৈরব তন্ত্র’ নামক একটি অচেনা শিরোনাম। কোনো কাগজে তার উল্লেখ নেই, কোনো অনুবাদ নেই, এমনকি কেউ এটি সম্পর্কে জানেও না। আজ সকালে প্রাচীন গ্রন্থসংগ্রহ থেকে লাইব্রেরিয়ান তার জন্য এক মোটা কাঠের বাক্স এনে দেয়। রেখার হাত কাঁপছিল উত্তেজনায়। সাদা তুলোর ভেতর পেঁচানো পাণ্ডুলিপি খুলতেই কাঁচা ধূপের গন্ধের মতো এক ধোঁয়াটে ঘ্রাণ ভেসে আসে, আর তাতে যেন কেঁপে ওঠে তার শরীরের ভেতরের কোথাও। প্রথম পাতায় লেখা: “জানার আগে ভাবো—কার জন্য জানছো, কেন জানছো, আর কি ভুলে যেতে পারবে!” এই লেখার নিচেই ছোট করে লাল কালিতে আঁকা ছিল এক ত্রিনয়ন দেবতা—ভৈরব। রেখার কৌতূহল তখন যুক্তির সীমা পেরিয়ে গেছে। সে বুঝতে পারেনি, এই লেখার মধ্য দিয়েই সে নিজের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়ের দরজা খুলে ফেলেছে।

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা রুমে আর কেউ ছিল না। বাইরের ঝোড়ো হাওয়া জানালার কাঁচে ধাক্কা দিচ্ছিল, আর তাতে মাঝে মাঝে আলো-আঁধারিতে রেখার মুখে অদ্ভুত এক ছায়া পড়ছিল। সে পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় পাতায় চোখ রাখল—সেখানে শুধুই অদ্ভুত সব সংস্কৃত শব্দ, যেগুলো সে আগে কখনও দেখেনি। অনেকটা মন্ত্রের মতো, আবার অনেকটা ধাঁধার মতো। প্রথম শব্দটাই ছিল—“ভৈরবং চেতস্য প্রবেশয়”—যার আক্ষরিক মানে দাঁড়ায়, “ভৈরব মনের মধ্যে প্রবেশ করুক।” এই বাক্যটি পড়ার পর পরই একটা অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভব করে রেখা, যেন তার চারপাশে কোনো এক অদৃশ্য উপস্থিতি ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎই আলোটা একটু ঝিমিয়ে গেল, যদিও সে সেটা বৈদ্যুতিক গোলমাল বলেই ধরে নেয়। কিন্তু তখনও সে জানত না—তার মন তখন শুধুই পাঠক নয়, সেই পাণ্ডুলিপির অন্ধকার বার্তার বাহক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছিল, আর সে গভীরভাবে পড়ে যাচ্ছিল পাতার পর পাতা—প্রাচীন তন্ত্রমন্ত্র, মানব মন নিয়ন্ত্রণের তত্ত্ব, অশরীরী আত্মার আমন্ত্রণ, এবং আত্মত্যাগের শর্তাবলি—সব মিলিয়ে যেন এক অন্ধ জগতের ভাষা।

তখনই তার ফোনে মেসেজ আসে—তার গবেষণা গাইড ড. বসু লিখেছেন, “রেখা, কোনো পাণ্ডুলিপির উচ্চারণ নিয়ে সাবধান থেকো। অনেক সময় শব্দ নিজের প্রাণ তৈরি করে ফেলে।” রেখা হেসে ফেলে—এসব কথা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু যুক্তিবাদী মন মানে না। কিন্তু সে বোঝে না, সেই পাণ্ডুলিপির শব্দগুলো আসলে কেবল শব্দ নয়, একেকটা মনের ভেতর প্রবেশ করার জন্য তৈরি যন্ত্রণা-সূচক সূক্ষ্ম তরঙ্গ। সেই রাতেই, ঠিক ১টা ৪৫ মিনিটে, যাদবপুরের কাছের একটি বাড়িতে এক তরুণী সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে। আত্মহত্যার আগে তার ডায়েরিতে লেখা শেষ লাইন ছিল: “ভৈরব ডাকছেন, আমি ফিরছি ঘরে।” রেখা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তার টেবিলে খোলা ‘ভৈরব তন্ত্র’ আর মনের গহীনে গেঁথে যাওয়া কিছু ধোঁয়াটে শব্দ—যার আসল মানে, সে নিজেও আর বোঝে না।

শহরের উত্তরে, শ্যামবাজারের এক শান্ত গলিতে হঠাৎ ভোরের নিস্তব্ধতা চিরে এক নারীকণ্ঠের আর্তনাদ শোনা যায়। আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে দেখে, ২১ বছর বয়সী একটি মেয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে। নাম—রিমঝিম পাল। পাশে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু পাতা, তার নিজের লেখা। তবে সবচেয়ে অস্বাভাবিক ছিল দেয়ালের ওপরে রক্ত দিয়ে আঁকা একটি বাক্য: “ভৈরব জেগে উঠেছেন”। স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টর দেবাশীষ রায় ঘটনাস্থলে পৌঁছেই বুঝে যান, এটি আত্মহত্যা হলেও কিছু অদ্ভুত অসংগতি রয়েছে। মেয়েটির পরিবার জানায়, রিমঝিম সম্পূর্ণ সুস্থ, মানসিকভাবে স্থিত, এবং সামনের মাসে তার বিয়ে ঠিক ছিল। তার এমন মৃত্যু অকল্পনীয়। তবুও, তদন্তে কোনো বায়বীয় কারণ পাওয়া যায় না। পুলিশ লিপিবদ্ধ করে: “Personal mental stress suspected.” কিন্তু রক্তের সেই লেখা যেন শীতল নিঃশ্বাস ফেলে যায় পুরো ঘরে।

এদিকে, মানিকতলা থানার পক্ষ থেকে অনুরোধ আসে বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক ড. অনিরুদ্ধ মিত্রকে এই ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে। ড. মিত্র শহরের অন্যতম শ্রদ্ধেয় সাইকোথেরাপিস্ট, যিনি হিপনোথেরাপি, ট্রমা ডিসঅর্ডার ও সাবকনশাস অ্যাক্টিভেশন নিয়ে বহু কাজ করেছেন। তিনি ঘটনাস্থলে এসে প্রথমেই খেয়াল করেন, আত্মহত্যার ধরন খুব ‘ritualistic’—ঘরের সমস্ত আয়না কালো কাপড়ে ঢাকা, বিছানার পাশে এক ধূপকাঠি এখনও জ্বলছে, আর মেয়েটির চোখ খোলা, কিন্তু তার দৃষ্টি ফাঁকা। যেন মৃত্যুর আগে সে কিছু “দেখে” ফেলেছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ড. মিত্র মৃতার টেবিলের ডায়েরি পড়ে দেখেন, তার শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠায় শুধু একটি নাম বারবার লেখা: “ভৈরব, ভৈরব, ভৈরব”। কোনো নির্দিষ্ট যুক্তি খুঁজে না পেয়ে তিনি স্বীকার করেন—মেয়েটি হয়তো একধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংক্রমণের শিকার, কিন্তু সেটি কোন উৎস থেকে ছড়ালো তা এখনো অজানা।

সন্ধ্যায় নিজের চেম্বারে ফিরে এসে অনিরুদ্ধ বহু পুরোনো রোগীর ফাইল খোলেন—গত ৩ মাসে এমন তিনটি কেস এসেছে যারা “কারো ডাক শুনছে”, “ঘুমে কালো মুখ দেখতে পাচ্ছে”, অথবা “একটি নাম মনের মধ্যে ঘোরে”—এইরকম বর্ণনা দিয়েছিল। এই কেসগুলো কোনো ডায়াগনস্টিক স্কেলে ফেলা যায় না। সে যখন এ নিয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই তার ফোনে একটি নাম্বারহীন মেসেজ আসে: “ভৈরব তন্ত্রের পাতা থেকে শুরু হয়েছে, শেষ পৃষ্ঠা এখনও লেখা হয়নি।” মেসেজটি অদৃশ্য হয়ে যায় মুহূর্তে। অনিরুদ্ধ তখনও জানতেন না—এই রহস্যের শিকড় শুধু মানসিক নয়, এই শিকড় গেঁথে আছে অতীতের তান্ত্রিক রক্তের ভিতরে, যে অতীত আবার মূর্ত হয়ে জেগে উঠেছে আধুনিক শহরের বুকেই। শ্যামবাজারের সেই রক্তলেখা আর রিমঝিমের ফাঁকা চোখ তখন তাকে চুপিসারে বলছিল, “এটা শুরু মাত্র।”

ড. অনিরুদ্ধ মিত্র সারারাত ঘুমোতে পারেননি। বারবার রিমঝিমের চোখের ফাঁকা দৃষ্টি, সেই রক্তলেখা, আর “ভৈরব তন্ত্রের” নাম বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সকালে অফিসে পৌঁছে তিনি সরাসরি নিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট দীপ্তিকে বলেন—“আমার সমস্ত পারসোনাল কেসের নোটস এনে দাও, যেগুলোতে রোগীরা ‘অদৃশ্য কণ্ঠ’, ‘অভ্যন্তরীণ ডাক’, বা ‘নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর’ কথা বলেছে।” নোটস ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি দেখতে পান, অন্তত সাতজন রোগী গত তিন মাসে একরকম উপসর্গে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের সকলের মধ্যেই ছিল এক চেনা প্যাটার্ন—এক নাম, এক উপস্থিতি, এবং এক ভয়। তাদের কেউ কেউ বলেছে—“ঘুমের মধ্যে আমি একটা অদ্ভুত মুখ দেখি, তিনটে চোখ, জিভ লাল, আর সেই চোখটা আমার মাথার ভিতরে ঢুকে যায়।” অন্য কেউ বলেছে—“সে আমাকে নাম ধরে ডাকে, আর বলে আমি তার ‘বাহক’ হবো।” এই সমস্ত কেসগুলিকে আগে তিনি স্কিজোফ্রেনিয়া বা সাইকোসিস ভেবেছিলেন, কিন্তু আজকের ঘটনার পর তিনি বুঝতে পারছেন, এটা শুধুই মনস্তাত্ত্বিক নয়—এটা যেন শব্দের মধ্য দিয়ে ছড়ানো একধরনের সংক্রমণ।

বিকেলে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যান রেখা সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি জানেন, রেখাই সম্ভবত ‘ভৈরব তন্ত্র’ পড়া প্রথম ব্যক্তি, এবং সেই পাণ্ডুলিপির মাধ্যমেই শুরু হয়েছে এই সংক্রমণ। রেখা প্রথমে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেয়—সে বলে, “আমি শুধু অনুবাদ করছি, তাও ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের জন্য। আপনি যদি এসব প্রাচীন তন্ত্রের মধ্যে অলৌকিক কিছু খুঁজে পান, সেটা আপনার ব্যাপার।” অনিরুদ্ধ ঠান্ডা গলায় উত্তর দেন, “বিষ কোনো খাবারে পড়লে খারাপ হয় না, পড়ে একফোঁটা কথাতেও। তন্ত্র মানে শুধু ধর্ম নয়, তন্ত্র মানে একধরনের শব্দচক্র। আর শব্দ মানেই মনস্তাত্ত্বিক কমান্ড।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এই বইয়ে এমন কোনো শব্দ বা মন্ত্র আছে, যেটা পড়ার সময় তোমার অস্বস্তি হয়?” রেখা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “হ্যাঁ, একটা মন্ত্র আছে, যেটা উচ্চারণ করার সময় মনে হয়, যেন কেউ পেছন থেকে তাকিয়ে আছে।” সে শব্দটি পড়ে শোনায়—“ভৈরবং চেতস্য গমনং”। অনিরুদ্ধ নোট নেন, এবং পরদিন নিজের ক্লিনিকে এক হিপনোথেরাপি সেশনে শব্দটির মানসিক প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করতে চান।

রাতে তিনি বাড়ি ফেরার পর বইয়ের সেই মন্ত্রটি বারবার তার মনে গুনগুন করতে থাকে—“ভৈরবং চেতস্য গমনং… ভৈরবং চেতস্য…”। হঠাৎ সে দেখে, তার আলনার পাশের আয়নাটির প্রতিবিম্বে যেন আরেকটি মুখ। তার নিজের নয়, কিন্তু মিল আছে। তিনটি চোখের ছায়া। তিনি তড়িঘড়ি করে আলো জ্বালান—কিছুই নেই। তবু আয়নার ভেতর যেন এখনো কিছু রয়ে গেছে। সেই রাতে প্রথমবার অনিরুদ্ধ স্বপ্নে শোনেন সেই কণ্ঠস্বর—ধীরে ধীরে, ভারী কণ্ঠে—“মন তোমার নয়, মন আমার। তুমি শুধু বাহক।” ঘুম ভেঙে তাঁর শরীর ভিজে ঘামে, আর মাথার ভিতর যেন বাজতে থাকে কোনও অদৃশ্য ধ্বনি। সকালে উঠেই তিনি বুঝতে পারেন—এই সংক্রমণ, এই ভয়, এই পাণ্ডুলিপি—সব কিছুর কেন্দ্রে আছে এক অদৃশ্য কমান্ড—মন্ত্রের মাধ্যমে মন দখল।

হিমাচলের কুলু উপত্যকার এক ভগ্ন শ্মশানে প্রায় দুই যুগ ধরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসেছিলেন এক সাধু—স্বামী ঋতম্ভরানন্দ। সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করার আগে তাঁর নাম ছিল আশুতোষ সেন, কলকাতার এক সময়কার খ্যাতনামা তান্ত্রিক গবেষক, যিনি হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান ২০০২ সালের পর। তাঁকে শেষ দেখা গিয়েছিল বারাণসীর এক তান্ত্রিক কনফারেন্সে, যেখানে তিনি বলেছিলেন—“ভৈরব তন্ত্রের অস্তিত্ব যদি সত্যি হয়, তবে মানবচেতনাকে বদলাতে আর ঈশ্বর লাগবে না, একটা শব্দই যথেষ্ট।” অনেকেই ভেবেছিল তিনি পাগল হয়ে গেছেন। কিন্তু সেই ঋষিসদৃশ মানুষটি হঠাৎ এক রাতের ধ্যানে ভয়াবহ কিছুর স্পর্শ অনুভব করেন—অন্ধকারের গহ্বরে যেন কে যেন ধ্বনি তোলে, “উৎপন্নমি পুনরায়… ভৈরবং চেতস্য গমনং…”। ধ্যান ভেঙে ঋতম্ভরানন্দ বুঝতে পারেন—যে গ্রন্থ তিনি ২০ বছর আগে নিজে নিষিদ্ধ করাতে চেয়েছিলেন, সেই ‘ভৈরব তন্ত্র’ আবার জেগে উঠেছে। তাঁর ধ্যানে বারবার ভেসে আসে আগুনে পুড়ে যাওয়া মুখ, সন্ন্যাসে বসা মানুষের চিৎকার, আর একটা নারী কণ্ঠ—যে ধীরে ধীরে ‘ভৈরবের বাহক’ হয়ে উঠছে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—তাঁকে ফিরতেই হবে কলকাতায়, শেষ বার, শেষ যজ্ঞে।

কলকাতায় পৌঁছে তিনি প্রথমেই খোঁজ নেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কে “তন্ত্র-পাঠ” করছে। অধ্যাপক ড. বসু নামটি বলেন—রেখা সেনগুপ্ত। পরের দিন ভোরে ঋতম্ভরানন্দ দেখা করেন ড. অনিরুদ্ধ মিত্রর সঙ্গে। অনিরুদ্ধ প্রথমে এই সন্ন্যাসীকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখেন—এই শহরের রাস্তায় প্রায়ই নানান ভণ্ড গেরুয়া লোক ঘোরে। কিন্তু এই মানুষের চোখের গভীরতা আর তার বলার ধরণ অনিরুদ্ধকে থমকে দেয়। তিনি বলেন, “আপনি বিশ্বাস করেন, শব্দে সংক্রমণ হয়?” ঋতম্ভরানন্দ চুপচাপ উত্তর দেন—“নিশ্চয়ই। শব্দই তো সৃষ্টি করেছে জগৎ, আবার শব্দই ধ্বংস ডেকে আনে। তন্ত্র শুধুই আচার নয়, তন্ত্র শব্দচক্র। শব্দ ঠিকভাবে বললে দেবতা, ভুলভাবে বললে দানব জাগে।” এরপর তিনি তার পুঁটলির ভেতর থেকে একটি ছেঁড়া, পোড়া পাতার অংশ বের করেন—যেখানে লেখা: “অজ্ঞেয়ো ভৈরবঃ – না মন্ত্রে, না আচারে, সে জাগে মনে।” তিনি বলেন, “তুমি হয়তো মানবে না, কিন্তু যে কণ্ঠস্বর শুনছ, তা সত্য। কারণ আমি নিজে একসময় তা জাগিয়েছিলাম।” অনিরুদ্ধ এবার পুরো মনোযোগে তাঁর কথা শোনেন। কণ্ঠস্বরটা পরিচিত, কারণ তিনিও গত রাতে সেই একই বাক্য শুনেছেন নিজের স্বপ্নে।

ঋতম্ভরানন্দ বোঝাতে থাকেন, ‘ভৈরব তন্ত্র’ আদতে ছিল এক অচর্চিত বামাচার তন্ত্র, যা শব্দের মাধ্যমে ‘চেতনার প্রবেশাধিকার’ সৃষ্টি করত। এই তন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল—একজন মানুষের মনে ঢুকে পড়া, তার অনুভূতি, ইচ্ছা, চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা। “এই যে তুমি রোগীদের বলো, ভয় কেবল ভ্রম, ভুল,”—সন্ন্যাসী বলেন,—“আসলে সেই ভ্রমই তো আসল অস্ত্র। ভয় যখন ভাবনার মধ্যে স্থায়ী হয়, তখন সে নিজেই এক মন্ত্র। আর ‘ভৈরব’ সেই ভয়ের মূর্ত প্রতীক, যে শুধু মনে নয়, আত্মায় প্রবেশ করে।” অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, এই মন্দিরবিহীন ঈশ্বর আসলে কোনো দেবতা নয়—এক ধ্বনি, এক সংক্রামক মন্ত্র, যা রেখার মতো কাউকে বাহক বানিয়ে এক শহরজুড়ে মৃত্যুর ঢেউ তুলতে সক্ষম। ঋতম্ভরানন্দ বলেন, “তোমাকে আমার সঙ্গে রাখতে হবে, কারণ তুমি যুক্তি বোঝো। আর আমিই জানি, কীভাবে বন্ধ করা যায় এই শব্দচক্র। কিন্তু তার জন্য সময় কম, রেখা তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। এবার তার মুখ দিয়েই ভৈরব কথা বলবে।”

কলকাতার শরৎকালীন আকাশে মেঘের আনাগোনা চলছিল, সেই সন্ধ্যাবেলায় যখন ড. অনিরুদ্ধ সেন ফিরে এলেন বৌবাজারের সেই পুরনো লাইব্রেরিতে, যেখানে এক মাস আগে তিনি ‘ভৈরব তন্ত্র’ নামক প্রাচীন গ্রন্থটি খুলেছিলেন। লাইব্রেরি তখন বন্ধের মুখে, কিন্তু একান্ত অনুরোধে কর্মচারী ভীষণ দ্বিধার মধ্যেও তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দেয়। ঝুলে থাকা ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করলেন বইয়ের গন্ধ—পুরনো, কাঠ-চেরা পৃষ্ঠার গন্ধ, যেন বইগুলো নিজেরাই এক একটা চেতনাসম্পন্ন সত্তা। তিনি ধীরে ধীরে গিয়ে বইয়ের তাকের একদম নিচের দিকের শেলফে হাত রাখেন, যেখানে সেই গ্রন্থটি ছিল। কিন্তু এবার তাঁর শরীরে একটা ঠান্ডা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। সেই গ্রন্থটি আর নেই। এর বদলে রয়েছে একটি কালচে ধূসর মোড়ানো পুরাতন কাপড়ের বাণ্ডিল, যার উপরে লেখা এক অচেনা ভাষার মন্ত্র। হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দে তাঁর মনোযোগ টানল—সেই লাইব্রেরির সবচেয়ে ভেতরের ঘরে যেন কারও পায়ের আওয়াজ। সাহস করে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। ভিতরের ঘরের দরজা খুলতেই দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন—স্বয়ং সাধু গম্ভীরনন্দ, যাঁর সম্পর্কে সবাই জানত যে তিনি আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছেন। তাঁর চোখ দুটো ছিল লালচে, কণ্ঠস্বর ছিল ঘোলাটে। “ভৈরব জেগে উঠেছে, ডাক্তারবাবু… তুমি একে বন্ধ করার চেষ্টায় যে ভুলটি করেছিলে, তা এখন শোধরানোর সময়,”—বলেই তিনি চলে গেলেন অন্ধকারের ভিতরে। অনিরুদ্ধ দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, পিছনে পড়ে থাকা কাপড়ের বাণ্ডিলের দিকে তাকিয়ে, যার থেকে এবার একটা গন্ধ আসছিল—চন্দন, ধূপ আর কিছু একটা পোড়া গোশতের মতো।

এক রাতের মধ্যেই শহরে শুরু হয় আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা—এইবার একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি, যিনি মৃত্যুর আগে তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, “আমার মাথার ভিতর কে যেন কথা বলছে, কে যেন আমাকে বলে, আত্মা মুক্তি চায় ভৈরবের।” সংবাদপত্রে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই শহরজুড়ে আতঙ্কের সঞ্চার হয়। মানুষ এখন শুধুমাত্র মনোরোগের রোগীকেই সন্দেহ করছে না, বরং কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি শহরের উপর ভর করেছে। অনিরুদ্ধের মাথায় তখন ঘুরছে সাধু গম্ভীরনন্দের কথা। তিনি খোঁজ শুরু করেন পুরনো তন্ত্রজ্ঞ পাণ্ডুলিপি ও পাণ্ডিত্যের। সেই খোঁজ তাঁকে নিয়ে যায় শহরের বাইরে, সোদপুরের এক পরিত্যক্ত আশ্রমে। সেখানে দেখা মেলে এক বৃদ্ধার, নাম রমাকান্তা, যিনি বহু বছর আগে সাধু গম্ভীরনন্দের চেলা ছিলেন। রমাকান্তা বলেন, “ভৈরব তন্ত্র শুধু একটি বই নয়, এটি এক জীবন্ত মন্ত্রময় সত্তা। একে জাগানো মানে নিজের মানসিক সত্তাকে বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাওয়া। গম্ভীরনন্দ এক সময় চেষ্টা করেছিলেন এর পূর্ণ জাগরণ ঘটাতে, কিন্তু মাঝপথে থেমে যান। কিন্তু কেউ যেন আবার সেই কাজ শুরু করেছে।” অনিরুদ্ধ বুঝে যান, শহরের মধ্যে কোনও এক অদৃশ্য মঞ্চে চলছে এক অন্ধকারের আরাধনা, যার ফলস্বরূপ মানুষ একের পর এক আত্মঘাতী হচ্ছে।

তাঁর মাথায় তখন ঘুরছিল একটি মাত্র নাম—অর্পিতা। সেই ছাত্রী, যার প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা থেকেই শুরু হয়েছিল সব কিছু। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি, কিন্তু মাঝেমধ্যে বকছে এক অচেনা ভাষায়। অনিরুদ্ধ তাঁকে দেখতে গেলে হঠাৎ একটি মুহূর্তে সে বলে ওঠে—“ভৈরব তোমাকে খুঁজছে, ডাক্তার সেন। তোমার রক্তের মন্ত্রেই সে পূর্ণ হবে।” এরপরেই ছাত্রীটি আবার নিস্তেজ হয়ে যায়। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারেন, ঘটনা কেবলমাত্র মানসিক ব্যাধি নয়, এটি এক জাগ্রত চেতনার প্রভাব। এদিকে শহরের পলাশী অঞ্চলে একদল তরুণ রাতের অন্ধকারে এক ছায়াময় লোককে দেখে যার মাথায় ছিল ধূমায়িত পাগড়ি, আর সে মন্ত্রপাঠ করতে করতে বলছিল, “আত্মা পুড়িয়ে সারা শহর ভৈরবময় হবে।” পুলিশ কিছুই করতে পারে না, কারণ তারা এই ঘটনাগুলোকে অলীক বলেই উড়িয়ে দিচ্ছে। অনিরুদ্ধ এবং রমাকান্তা বুঝতে পারেন, এই সময়ে আবার সাধু গম্ভীরনন্দের সহায়তাই একমাত্র পথ। কিন্তু তিনিও যে এখন এক ‘ভিন্ন মানুষ’ হয়ে গেছেন, তা অনিরুদ্ধ বুঝতে পারেন সেই রাতে, যখন তিনি স্বপ্নে দেখেন গম্ভীরনন্দ তাঁকে বলছেন—“ভৈরব তন্ত্র বন্ধ হয় না, সে কেবল এক দেহ ছেড়ে অন্য দেহে যায়।” সেই ভয়াবহ স্বপ্ন থেকে উঠে বসেন অনিরুদ্ধ, বুঝতে পারেন, এবার তাঁকেই আত্মা নয়, চেতনার রক্ষা করতে হবে—ভৈরবের আগমনের আগেই।

সন্ধ্যা নামার অনেক আগে থেকেই শহরের আকাশে যেন এক অদৃশ্য অন্ধকার জমতে শুরু করেছিল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রজনীশ মুখার্জি আজ প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন, তাঁর ক্লিনিকের দেয়ালে ঝোলানো চিত্রগুলো যেন তাকিয়ে আছে তাঁকে লক্ষ্য করে, নিঃশব্দ কোনো সাবধানবাণী শোনাতে চায়। এদিন সকালে শহরের আরেকজন যুবক নিজের চোখ উপড়ে আত্মহত্যা করেছে—এটা নিয়ে গত তিন সপ্তাহে একাদশ আত্মঘাতী ঘটনা। প্রতিটা মৃত্যুই অস্বাভাবিক, এক রকম Ritualistic! খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো গরম, কিন্তু প্রশাসন কুলকিনারা করতে পারছে না। রজনীশ বুঝতে পারছেন, এই ঘটনাগুলো নিছক প্যাথলজিক্যাল নয়, এদের পেছনে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। তিনি ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে ফোন করলেন তাঁর নবপরিচিত সহযোগী সন্ন্যাসী ভৃগু নাথকে। ভৃগু জানালেন, তাঁর প্রাচীন লিপি বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে—‘ভৈরব তন্ত্র’ নামক গ্রন্থটি শুধুমাত্র তন্ত্রচর্চার দলিল নয়, বরং এটি একধরনের ‘মানসিক সংক্রমণ’। এই গ্রন্থে যে মন্ত্র ও ভাবনার বীজ দেওয়া আছে, তা পাঠকের মনে আত্মঘাতী অনুপ্রেরণা বপন করে। আর এই বীজ শুধু মস্তিষ্কে নয়, স্বপ্নেও বিস্তার লাভ করে।

ভৃগু নাথ রজনীশকে নিয়ে গেলেন শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এক জরাজীর্ণ, ফেলে রাখা লাইব্রেরিতে—‘সরস্বতী পাঠাগার’। এখানে এককালে নানা প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল, এখন সবই ধ্বংসপ্রায়। লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকতেই রজনীশ অনুভব করলেন, বাতাসে যেন এক অদ্ভুত হিমেলতা—যেন চোখে দেখা যায় না, অথচ ত্বকে অনুভব করা যায় এমন এক শীতল স্রোত। ভেতরের দেয়ালে লাল কালিতে আঁকা এক ত্রিভুজ আকৃতির চিহ্ন দেখে ভৃগু থমকে গেলেন—এটি ছিল ‘ভৈরব তন্ত্র’-এর প্রাথমিক প্রতীক, যাকে তন্ত্রচক্রের ভাষায় বলা হয় “ত্রিনয়ন বন্ধন”। এই চিহ্ন যখন কোথাও প্রাকৃতিক নিয়মে তৈরি না হয়ে ইচ্ছাকৃত আঁকা হয়, তখন বুঝতে হয়—কেউ এই শক্তিকে জাগ্রত করেছে। লাইব্রেরির এক কোণে একটি অগ্নিদগ্ধ বইয়ের ছিন্ন পাতায় রজনীশ আবিষ্কার করলেন একটি ভয়ংকর ছবি—চোখহীন এক পুরুষ বসে আছে মাটিতে, আর তার সামনে ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়ে এক ভৈরবসদৃশ ছায়াচ্ছবি। ভৃগু বললেন, “এ ছবি নয়, এ হলো এক মৃতের দর্শন, যে এই গ্রন্থের কারণে আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। তার অভিজ্ঞতা যেন এই পাতার রঙে লেগে আছে।”

রজনীশ ও ভৃগু এরপর সিদ্ধান্ত নেন, এবার সরাসরি চলে যেতে হবে সেই প্রথম ঘটনার উৎসে—যেখানে ‘ভৈরব তন্ত্র’ প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। সেখানেই হয়তো মিলে যাবে উত্তর, অথবা শুরু হবে আরও বড় কোনো সংকট। সেদিন রাতে রজনীশ ঘুমোতে পারেননি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি দেখতে পেলেন এক অদ্ভুত স্বপ্ন—এক দীর্ঘ অন্ধকার গুহা, যার শেষ প্রান্তে বসে আছে এক কঙ্কালসদৃশ সাধক, চোখ দুটি যেন গহ্বর, আর সেই চোখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অজস্র পিপঁড়ের মতন মন্ত্র। হঠাৎ সেই সাধক বলল, “তুমি যাকে বোঝো মানসিক রোগ, তা আসলে এক তান্ত্রিক ছায়া, যা মনে প্রবেশ করলে আর নিজস্বতা থাকে না।” ঘুম ভাঙতেই রজনীশ বুঝলেন—স্বপ্ন নয়, এটি ‘সংক্রমণ’। ‘ভৈরব তন্ত্র’-এর সংস্পর্শে এসে তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন। এখন আর শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক নয়, তিনি নিজেও এক পরীক্ষাগার, যেখানে প্রাচীন তন্ত্র বিদ্যার মানসিক ছায়া ধীরে ধীরে শরীর ও চেতনায় বসে যাচ্ছে। তাঁদের হাতে সময় কম, কারণ ভৃগু বলেছে—পরবর্তী পূর্ণিমার রাতে এই সংক্রমণ এক সম্মিলিত আত্মঘাতী স্রোত তৈরি করতে পারে শহর জুড়ে। এই শহরের বুকে শুরু হতে পারে এক নিঃশব্দ গণবিস্ফোরণ—জায়গায় জায়গায় আত্মহনন, অথচ অস্ত্রহীন।

রাত তখন দুইটা কুড়ি। উত্তর কলকাতার গলির ভিতরে অবস্থিত বেহাল পুতুলবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অমিতাভ ও স্বামী নিস্কলঙ্কানন্দ। বাতাস ভারী, যেন ধূলিধূসর ছায়া নিয়ে ঘোরাফেরা করছে চারপাশে। বাড়িটার গায়ে গা ঘেঁষে থাকা বটগাছটি অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে—যেন নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছে। অমিতাভ বলল, “এই বাড়ির ইতিহাস আমি খুঁজে পেয়েছি। ১৯৩৩ সালে একজন সাধক এখানে ‘ভৈরব যজ্ঞ’ করেছিল, তারপর থেকে আত্মহত্যার ঘটনা শুরু হয়।” নিস্কলঙ্ক মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করলেন, ঠোঁট নাড়ছেন—মন্ত্র জপের মতো। তারা জানতেন, এই বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর আর কিছুই আগের মতো থাকবে না। দরজা খুলতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে দুজনকে আঘাত করল, যেন প্রাচীন কোনো আত্মা স্বাগত জানাচ্ছে। ভেতরের ঘরটা অন্ধকার, কেবল মাঝখানে ছড়িয়ে থাকা ছাই আর রক্তমাখা কাগজগুলো কিছু একটা বলছিল। হঠাৎই দেওয়ালের এক কোণে অদ্ভুত আঁকিবুঁকি নজরে পড়ল—লাল কালি দিয়ে লেখা একটা বৃত্ত, যার ভিতরে একটা চোখ। নিস্কলঙ্ক বললেন, “এইটা তন্ত্রমুদ্রা, ভৈরবের চক্ষু। ওর উপস্থিতির নিদর্শন।”

দ্বিতীয় তলায় উঠতেই অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল—মাথা ঠোকার আওয়াজ, আবার থেমে যাওয়া, আবার শুরু হওয়া। একটা ঘরের দরজার কাছে গিয়ে তারা দেখলেন একজন বৃদ্ধা বারবার নিজের কপাল দেওয়ালে ঠুকছে। চুল এলোমেলো, চোখ অনুপস্থিত—শুধু ফাঁকা, শূন্য চোখের গহ্বর। নিস্কলঙ্ক ধীরে ধীরে মন্ত্র জপ করতে করতে সামনে এগোলেন। বৃদ্ধা হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “সে আসছে… আবার… তুমি প্রস্তুত তো, ব্রাহ্মণ?” অমিতাভ রক্তশূন্য মুখে তাকিয়ে ছিল। বৃদ্ধার গলার আওয়াজ ধাতব—যেন মানবিক নয়। হঠাৎ করেই ঘরটা ঘুরপাক খেতে লাগল, দেয়ালের মধ্যে হিন্দি-সংস্কৃতের মিশ্রত ভাষায় লিপি উঁকি মারল—“ভৈরব পুনর্জাগরণে, বলি চাও।” নিস্কলঙ্কনন্দ চিৎকার করে মন্ত্রপাঠ করলেন—“ওঁ কৃপাণ্ডকায় নমঃ!” মুহূর্তেই একটা কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল, “মিথ্যা মন্ত্র, মিথ্যা ব্রাহ্মণ!” ঘরটা অন্ধকার হয়ে এল, মনে হচ্ছিল—সমস্ত বাড়ি গভীর কিছুর মধ্যে গিলে যাচ্ছে।

ঘটনার পর তারা দুজন চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে এলেন। পেছনে বাড়িটা তখন আগের চেয়ে স্থির, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু নিস্কলঙ্ক বললেন, “ওনারা চোখ খুলেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।” অমিতাভ থরথর করে কাঁপছিল। তার হাতে ধরা নোটবুকে লেখা হলো—“ভৈরব তন্ত্রের ষষ্ঠ পৃষ্ঠা উদ্ধার, কিন্তু প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আত্মা খুঁজছে নতুন শরীর, আত্মাহুতি চাই।” শহরে আরও দু-তিনটি আত্মহত্যার খবর তখন আসতে শুরু করেছে, একই প্যাটার্ন—চোখ উপড়ে নেওয়া, পেট ফাটা, পিঠে তন্ত্রমুদ্রা আঁকা। অমিতাভ জানতেন, মানসিক ব্যাখ্যা দিয়ে সব কিছু বোঝানো যাবে না। তিনি স্বীকার করলেন, এই রহস্য গভীর, ভয়ঙ্কর এবং একান্তই অতিলৌকিক। এখন তাদের সামনে একটাই পথ—তন্ত্রগ্রন্থের সব পৃষ্ঠা উদ্ধার করে তাকে নিরপদ জায়গায় স্থাপন করা, না হলে শহর ধ্বংস অনিবার্য।

রাত তখন প্রায় আড়াইটা। গোটা শহর নিস্তব্ধ, কিন্তু ভবানীপুরের মল্লিকবাড়ির ভেতরে আলো জ্বলছে একমাত্র বৈঠকখানায়। অচিন্ত্য, শুদ্ধানন্দ এবং পুলিশ অফিসার দিব্যেন্দু বসু—তিনজনই বসে আছেন গোল টেবিল ঘিরে। সামনে ছড়ানো একাধিক পৃষ্ঠা, যেখানে ‘ভৈরব তন্ত্র’ গ্রন্থের ফটোকপি করা কয়েকটি মন্ত্র, অচিন্ত্যর হাতে লেখা কিছু নোট, আর শুদ্ধানন্দর দাদা মহারাজের পুরোনো রেকর্ড। বাহ্যিক ভাবে সবাই শান্ত হলেও ভিতরে ভিতরে এক অজানা উত্তেজনা কাজ করছে সকলের মধ্যে। কারণ, মাত্র কিছু ঘণ্টা আগেই সল্টলেকের একটি বহুতলে ফের আত্মহত্যা করেছে এক গৃহবধূ—তার হাতে ছিল তন্ত্রগ্রন্থের পাতার ছেঁড়া অংশ, আর ঠোঁটে ছিল ফিসফিসে একটা মন্ত্র, “ভৈরবং চিন্ময়ং ধ্যায়েৎ…”। অচিন্ত্য সেই ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং দেখে চমকে উঠেছে, কারণ মহিলা মৃত্যুর আগের মুহূর্তে যেভাবে নড়াচড়া করছিল, তা দেখে তার মনেও প্রথমবারের মতো অস্বীকারযোগ্য ভয়ের জন্ম হয়েছে। শুদ্ধানন্দ ব্যাখ্যা দিলেন, “ভৈরব তন্ত্র কোনও সাধারণ গ্রন্থ নয়। এটি একটি ‘উচ্ছিষ্ট’ সাধনার গ্রন্থ, যেখানে জীবনীশক্তিকে আত্মবিনাশে রূপান্তর করার এক অদ্ভুত তন্ত্রশক্তি ব্যবহৃত হয়।” দিব্যেন্দু সন্দিগ্ধভাবে বললেন, “আপনারা বলতে চাইছেন, এ একধরনের হিপনোসিস?” শুদ্ধানন্দ উত্তর দিলেন না, কেবল বললেন, “তন্ত্র নিজের ভাষায় কাজ করে। বিজ্ঞান তাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না সব সময়।” ঘরের আলো তখন হঠাৎ কমে আসে, আর একটি মৃদু শব্দ শোনা যায় জানালার বাইরে—মনে হয় যেন কেউ হেঁটে যাচ্ছে ছায়ার মধ্যে।

সেই রাতেই, অচিন্ত্য প্রথমবারের মতো তার নিজের মনেও এক অদ্ভুত পরিবর্তনের আভাস পায়। সে বুঝতে পারে, বারবার গ্রন্থের প্রতি তার টান বাড়ছে। কোনও এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই পাতাগুলোর গভীরে। সে ভাবে, এসব হয়তো মানসিক ক্লান্তি বা উদ্বেগের ফল, কিন্তু গভীর রাতে সে ঘুম ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বইয়ের তাকে গিয়ে। তন্ত্রগ্রন্থের কপি তুলে নেয় সে, চোখ আটকে যায় এক নতুন পাতায়, যেখানে লেখা আছে—“সপ্তম সূক্ষ্ম শূন্যতায় প্রবেশের কৌশল”। সেখানে এক বিশেষ ধ্যানপদ্ধতির কথা বলা আছে, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের চেতনাকে অন্যদের মনস্তত্ত্বে প্রক্ষিপ্ত করতে পারে। অচিন্ত্যর মনে পড়ে যায় তার দু’জন রোগীর কথা যারা একই ধরণের স্বপ্ন দেখার কথা বলেছিল—এক নিঃসঙ্গ শ্মশান, এক পোড়া মুখোশধারী সাধু, আর এক ছায়াঘেরা কুঠির। তার নিজের ঘাড়ে ঠান্ডা বাতাস অনুভূত হয়, কিন্তু জানালা বন্ধ। সে বোঝে, সে নিজেই সেই শূন্যতায় প্রবেশ করছে—গ্রন্থের অদৃশ্য হাত তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ধীরে ধীরে। সেই মুহূর্তে ফোন বাজে—শুদ্ধানন্দ। তিনি কেবল বলেন, “তোমার সময় শুরু হয়েছে, অচিন্ত্য। নিজেকে বাঁচাতে চাইলে এই মন্ত্র এখনই বন্ধ করো।” ফোন কেটে যায়, কিন্তু অচিন্ত্য ঘোরে যেন বন্দি।

ভোরের আলো ফুটতেই পুলিশ পৌঁছায় দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটে একটি পুরোনো ভাড়া বাড়িতে, যেখানে আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু এখানকার চিত্র কিছুটা ভিন্ন—এখানে মৃত ব্যাক্তি তার রক্ত দিয়ে প্রাচীরজুড়ে কিছু লিখে রেখে গেছে। লেখা: “ভৈরব এসেছে। তোমরা কেউ রক্ষা পাবে না।” এই ঘটনায় শহরের মিডিয়াতে শোরগোল পড়ে যায়। অচিন্ত্য, শুদ্ধানন্দ ও দিব্যেন্দু একসাথে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে পৌঁছে অচিন্ত্য এক ঝলক দেখে কিছুটা অবসন্ন হয়ে পড়ে। দেয়ালের এক চিত্রে আঁকা রয়েছে তার নিজের মুখ! তার পেছনে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মুখোশধারী অন্ধকার সন্ন্যাসী, যার চোখ দুটি যেন গর্ত—কিন্তু যেন অচিন্ত্যর আত্মা চুষে নিচ্ছে। শুদ্ধানন্দ গম্ভীর স্বরে বলেন, “ভৈরব তন্ত্র এখন নিজের উৎসের দিকে ফিরে যাচ্ছে। সে তার ধারককে খুঁজে পেয়েছে। অচিন্ত্য, সময় হয়েছে তোমাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার—তুমি ওর হাতিয়ার হবে, না ওকে দমন করবে?” চারদিকে যেন বাতাস থেমে যায়। কলকাতার গায়ে এখন ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় প্রেতবিদ্ধ রাত্রি—আর সেই ছায়ায় চিহ্নিত একজন অচিন্ত্য রায়।

হাসনাবাদের সেই নির্জন গ্রাম, যেখানে তাপসজি আশ্রম করেছিলেন, সেইখানেই পৌঁছেছিল সৌম্য আর তাপসজি। ঘন জঙ্গল ঘেরা, পাখির ডাক আর রাতের পোকামাকড়ের শব্দে মুখর — যেন এখানেই লুকিয়ে আছে কোনও শতাব্দীপ্রাচীন চক্রান্ত। সেই পুরোনো আশ্রমে পৌঁছে তাপসজি বললেন, “ভৈরব তন্ত্র এখানে শেষবার পাঠ করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। তখনও আমি অল্প বয়সী ছিলাম, গুরুদেব বাঁচতেন। তারপর এই আশ্রম বন্ধ হয়ে যায়, কারণ এক রাতে গুরুদেবের অদ্ভুত মৃত্যু ঘটে।” সৌম্য আশ্রমে প্রবেশ করতেই যেন অনুভব করল — এই জায়গাটা নিঃশব্দ নয়, বরং তার ভেতর লুকিয়ে আছে কোনো অলৌকিক করুণ সুর, এক ধরণের মৃতপ্রায় আর্তনাদ। তারা আশ্রমের পুরনো কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকল। ধুলো জমে থাকা ঘর, একপাশে ভাঙা কল্পত্রি, অন্যদিকে পুরনো তালপাতার পুঁথি রাখা — কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মাঝের চৌকাঠে জ্বলছে মৃদু প্রদীপ। যেন কেউ এখনও এখানে পূজা চালিয়ে যাচ্ছে। তাপসজি বললেন, “কারও অনুমতি ছাড়া কেউ এখানে ঢুকতে পারে না। প্রদীপ নিজেই জ্বলে থাকে কখনও কখনও। গুরুদেব বলতেন, এটি মৃতের ইচ্ছায় চালিত।”

সন্ধে নামতেই হঠাৎ আশ্রম চত্বরের চারদিক ঘিরে কুয়াশা জমতে থাকে। সৌম্য জানে, এই পরিবেশ আর অস্বাভাবিক স্তব্ধতা, সবটাই মস্তিষ্কের সঙ্গে খেলতে পারে। কিন্তু তখনই সে আবিষ্কার করল আশ্রমের ভিতরে রাখা এক আয়না, যেটা যেন তাকে তার অতীতের কিছুর দিকে টানছে। আয়নায় সে দেখতে পেল ছোটবেলার দৃশ্য, মা-বাবার সঙ্গে তার কথা, সেই ট্রেন দুর্ঘটনা যেখানে সে বেঁচে ছিল, কিন্তু মা মারা গিয়েছিলেন। কাঁপতে কাঁপতে সে পিছিয়ে এল, চোখে জল। তাপসজি তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ভৈরব তন্ত্র শুধু আত্মার ওপর কাজ করে না, মনকে ভেঙে দেয়, চেতনার স্তরে স্তরে ঢুকে পড়ে। তাই এটার জোর একমাত্র সেই বুঝতে পারে, যে তার অতীতের মধ্যে কোনো অপূর্ণতা বহন করে।” ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে থেকে কে যেন তিনবার ধাক্কা দিল। দরজা খুলে কেউ ছিল না। শুধু দেখা গেল, দরজার নিচ দিয়ে সাদা কাগজে লেখা একটি শব্দ ঢুকে এসেছে — “স্মরণ করো।”

রাত গভীর হতেই তাপসজি ও সৌম্য চেষ্টা করলেন ভৈরব তন্ত্রের সেই পুরনো সংস্করণকে আবার খোঁজার। হঠাৎ সৌম্য পুরোনো বাক্সের নিচে একখানা লুকোনো তাম্রপত্র খুঁজে পায়। সেখানে উৎকীর্ণ ছিল একটি মন্ত্র — “ভৈরবং শরণং গচ্ছামি” — আর নিচে নির্দেশ, “এই মন্ত্র পাঠ করে মৃত আত্মার নির্দেশ গ্রহণ করো।” তাপসজি বলেন, “এটি গুরুদেবের চূড়ান্ত নির্দেশ। যদি কোনও আত্মা বেঁচে থাকে, তার কাছে আমরা এখন প্রশ্ন করতে পারি।” সৌম্য মন্ত্র পাঠ করল। আশ্রমজুড়ে এক গা ছমছমে স্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল, যেন বাতাসও থমকে গেছে। ঠিক তখনই পেছনের ঘর থেকে এক মৃদু কণ্ঠ ভেসে এল — “তোমরা দেরি করেছ। শহর দখল নিয়েছে সে। শ্মশানে যাবে। সেখানেই শেষ নির্দেশ।” তাপসজি ও সৌম্য চমকে উঠল। কে কথা বলল? কে জানে! তবে সেই স্বর নিশ্চয়ই জীবিতের নয়। শ্মশানের নাম শুনে সৌম্যর বুকটা ঠেলে উঠল — সেখানেই শুরু হয়েছিল সবকিছু, সেই প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা। এবং সেখানে ফিরলেই মিলবে সেই আত্মার নির্দেশ… এবং হয়তো, ভৈরব তন্ত্রের শেষ গোপন রহস্য।

১০

বৃষ্টিভেজা কাশী নগরীর প্রাচীন অলিগলি আর শূন্য শ্মশানঘাটের মধ্যে দিয়ে ভোরের কুয়াশা ছিঁড়ে আসা আলোয় দাঁড়িয়ে ছিলেন সন্ন্যাসী ত্রিলোকানন্দ ও মনোচিকিৎসক অনির্বাণ। তাঁদের চোখের সামনে পড়ে থাকা ছিল একটি ভগ্ন, কালচে আয়না—ভৈরব তন্ত্রের শেষ দিকের একটি ‘তান্ত্রিক যন্ত্র’। মায়াবী সেই আয়নাটি ছিল এমন এক প্রবেশদ্বার, যেখানে সময়, মৃত্যু ও মানসিক অস্তিত্বের সীমানা মুছে যায়। গত রাতের সংঘর্ষে ভৈরব তন্ত্রের গ্রন্থটি ছিঁড়ে গেছে—অর্ধেক পুড়ে ছাই, অর্ধেক জলে গলে গিয়েছে। কিন্তু এই আয়নাটি থেকে এখনও ছড়াচ্ছিল এক ধূসর দৃষ্টির কুয়াশা, এক অদৃশ্য আকর্ষণ যা মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। অনির্বাণ তাকিয়ে ছিলেন সেই আয়নার দিকে। তাঁকে দেখে ত্রিলোকানন্দ বললেন, “এই আয়নায় তাকালে দেখা যায় নিজের অন্তর্জগতের ত্রুটি, যা মানুষ সহ্য করতে পারে না। তাই আত্মঘাতী প্রবণতা।” অনির্বাণ মৃদু কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিলেন, “তা হলে কি আমরা কেউ এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে পারব না?” ত্রিলোকানন্দ উত্তর দিলেন না। তিনি ধ্যানে বসে পড়লেন, আর ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন—ভৈরব তন্ত্রের বিপরীত শক্তির জন্ম দেওয়ার এক রহস্যময় ধ্যান, যা শুধু আত্মত্যাগের বিনিময়ে সম্ভব।

ত্রিলোকানন্দের কণ্ঠ ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকল। চারিদিকে বাতাসের গতি বেড়ে গেল, গঙ্গার ঢেউ যেন ক্রমশ উথালপাথাল হয়ে উঠল। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল, যেন প্রাচীন কোনো দেবতা জেগে উঠছে। আয়নার উপর ফাটল ধরতে লাগল, এবং এক অন্ধকার ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে উঠে এল তার মধ্য থেকে—এ যেন অনির্বাণের ছায়া, কিন্তু চোখে মৃত মানুষের মত শূন্যতা। ছায়া বলল, “তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছো, অনির্বাণ। আমি তোমার সেই অংশ, যাকে তুমি সারা জীবন চাপা দিয়ে রেখেছো। তুমি আমাকে স্বীকার না করলে, তুমি মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ হবে না।” অনির্বাণ নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই ছায়ার দিকে। আয়নার সামনে পৌঁছে সে বলল, “আমি তোমাকে অস্বীকার করি না। কিন্তু আমি তোমার দাস নই।” সেই মুহূর্তে, একটা প্রচণ্ড শব্দে আয়নাটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, আর ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল ছায়ামূর্তি। ত্রিলোকানন্দ চোখ খুললেন। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। ঝড় থেমে গেছে। গঙ্গার ঢেউ শান্ত। কিন্তু তাঁদের চারপাশে পড়ে আছে একাধিক আত্মঘাতী মানুষের মৃতদেহ, যারা এই জাদুবিদ্যার শিকার হয়ে উঠেছিল।

ঘটনার পরে পুলিশ এবং প্রশাসন ঘটনাস্থলে আসে। শহরে প্রচার হয়, এক প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থের কারণে মানসিক বিকারগ্রস্ততা ছড়িয়ে পড়েছিল। ভৈরব তন্ত্রের অস্তিত্ব সরকার অস্বীকার করে। অনির্বাণ মনোচিকিৎসক হিসেবে তার পেশায় ফিরে যান, কিন্তু তিনি বদলে গেছেন—তিনি জানেন মানুষের অবচেতন কতটা বিপজ্জনক, আর মনের গভীরে কত প্রাচীন ভয় লুকিয়ে থাকে। ত্রিলোকানন্দ আবার ফিরে যান হিমালয়ে, ধ্যানের মধ্যে হারিয়ে যেতে। কিন্তু শহরের কিছু প্রাচীন মন্দির, কিছু পুরনো অলিগলি, এখনও রাতে ধোঁয়াটে আলোয় কাঁপে, আর কারও কারও কানে আজও ভেসে আসে এক পাগলাটে হাসির শব্দ—যেন ভৈরব তন্ত্র এখনও কোথাও বেঁচে আছে, এক নতুন জন্মের অপেক্ষায়।

[শেষ]

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *