Bangla - ভূতের গল্প

ভূতের WhatsApp Group

Spread the love

প্রিয়ম সাহা ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টায় বিছানায় গড়াগড়ি করছিল, যখন ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১২টা ছুঁলো। জানলার ওপারে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আশেপাশে নিস্তব্ধতা, আর ফোনের নোটিফিকেশন টুং টুং শব্দে হঠাৎ রাতটা কেমন অদ্ভুত ঠেকতে লাগল। গড়িয়াহাটের পুরনো বাড়ির দোতলার ঘরটায় আজ একা সে, ঠাকুরদা গত বছর মারা যাওয়ার পর তার পরিবার এখন উপরের ফ্ল্যাটে থাকে, সে নিচে নিজের মতো করে কাজ আর একলা সময় কাটায়। তখনই ফোনে ভেসে উঠল এক অচেনা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নোটিফিকেশন — “You’ve been added to the group: Dead But Chatty”। মনে হলো কেউ নিশ্চয়ই প্র্যাঙ্ক করছে, এমন নাম কে রাখে! কিন্তু যখন সে গ্রুপ খুলে দেখল, সেখানে লেখা ‘Members: 7’ — তখন কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল তার ঘাড়ের পেছনে।

প্রথম মেসেজটা আসে একজনের কাছ থেকে যার নাম “Tiklu Da 👻” — সে লিখেছে, “এইবার একটা ফানি স্ট্যাটাস দে রে ভাই, তুই নতুন এসেছিস!”। তারপর একের পর এক মেসেজ আসতে থাকে — কেউ একটা ধাঁধা পাঠায়, কেউ মিম শেয়ার করে যেখানে ভূতদের পিকনিক চলছে, আর কেউ আবার শুধু একটা চোখের ইমোজি পাঠায় বারবার। প্রিয়ম প্রথমে ভাবে, এটা নিশ্চয়ই তার বন্ধুদের কোনো পাগলামি, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গ্রুপে থাকা কারও নাম তার পরিচিত নয়। দ্বিতীয় অদ্ভুত ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করে যখন টিকলু দা তাকে বলে — “আমরা সবাই বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছি ভাই, তুইই তো একমাত্র জিন্দা!” প্রথমে সে হেসে ফেলে, ভাবে কেউ ভূতের চরিত্রে অভিনয় করছে। কিন্তু তখনই গ্রুপের এক সদস্য ‘Hemanta Bose’ নামের এক ভদ্রলোক লিখেন — “আমি মরেছি ১৯৮৭ সালে, রেলের চাকরি করতাম। তুই চেক করে দেখ আমার নাম!” আর সাথেই সে প্রিয়মকে একটা পকড়া-ধরা পুরোনো ছবি পাঠায়, যেটা আশ্চর্যজনকভাবে সত্যি — ছবিতে থাকা লোকটা গুগলে খুঁজলে রীতিমতো খবরে উঠে আসে — ১৯৮৭ সালের এক রেল দুর্ঘটনায় নিহত এক কর্মচারী, হেমন্ত বোস।

প্রিয়মের হাত ঘেমে ওঠে। সে ভয় আর কৌতূহলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে — এ কি শুধু ডিজিটাল প্র্যাঙ্ক, না কি সত্যিই এমন কিছু যা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো যায় না? গ্রুপের আরেক সদস্য ‘চুমকি দিদি’ লিখে ফেলে, “তুই কি জানিস তোর ঠাকুরদা এই গ্রুপেই ছিল একসময়? ওর অ্যাকাউন্টটা আর খুলছে না, মানে হয়ত এবার মুক্তি পেয়ে গেছে…”। এইবার প্রিয়ম স্তব্ধ হয়ে যায়। তার ঠাকুরদা যিনি কয়েক মাস আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান, তার ফোনে আগে সে কিছু আজব মেসেজ পেয়েছিল — তখন পাত্তা দেয়নি। হঠাৎ ফোনটা নিজে নিজে থরথর করে কাঁপে, এবং স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সেই অদ্ভুত এক নম্বর — “913XXXXXXX added you to the group”। এই নম্বরটি প্রিয়মের কাছে চেনা নয়, আর এই ব্যবহারকারীর নাম নেই — শুধু একটার পর একটা চোখের ইমোজি পাঠাচ্ছে সে, যেন গভীর নজর রাখছে। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে, বাইরের হাওয়া থেমে যায়, আর প্রিয়মের মনে হয়… এটা কেবল শুরু।

ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টা ২০। ঘরের মধ্যে নিঃশব্দ নিস্তব্ধতা যেন হঠাৎ করে কানের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। প্রিয়ম সাহা হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে — “Dead But Chatty” গ্রুপের সদস্যদের প্রোফাইল পিকচার আর স্ট্যাটাসগুলো একে একে খুলে দেখতে শুরু করল সে। সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছে ‘চুমকি দিদি’র ছবি — পুরোনো সাদাকালো টিন টাইপ ছবি, মুখে অদ্ভুত নিষ্পাপ হাসি, চোখে একরাশ দুঃখ, আর স্ট্যাটাসে লেখা: “Not all heartbreaks kill instantly”। Tiklu Da-এর প্রোফাইল পিকচারে সে নিজেকে বডিবিল্ডারের পোজে এডিট করে বসিয়েছে, আর স্ট্যাটাস — “খাই-দাই-ঘুরি, মরেও আছি ঝারি দিই”। কিন্তু যে জিনিসটা একেবারে গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দিল, তা হলো অদৃশ্য সদস্য — যার নাম নেই, শুধু একটা নম্বর (913XXXXXXX) আর প্রোফাইল পিকচার নেই — সাদা স্ক্রিনে শুধু এক ফাঁকা মুখের ছায়া।

প্রিয়ম সাহা এবার সিরিয়াস হয়ে যায়। ও হঠাৎ উঠে পড়ে খাট থেকে, ডেস্কে বসে ল্যাপটপ অন করে, সেই হেমন্ত বোস-এর ছবি গুগল ইমেজে দিয়ে রিভার্স সার্চ করল। ফলাফলে সত্যিই সেই একই নামের এক রেলকর্মীর মৃত্যুর খবর আসে — ঘটনাস্থল: ১৯৮৭ সালের বর্ধমান লোকাল দুর্ঘটনা। তার মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় তার ঠাকুরদা তাকে সেই দুর্ঘটনার গল্প বলেছিলেন — বলেছিলেন এক বৃদ্ধ সহযাত্রী কীভাবে তাকে ধাক্কা মেরে জানলার পাশে বসতে দিয়েছিল, আর নিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে সেই বৃদ্ধ ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান। প্রিয়ম ভাবে, “হেমন্ত বোস কি সেই বৃদ্ধ? তা হলে এই গ্রুপে ঠাকুরদাও ছিল!” তার গলা শুকিয়ে যায়, ঠোঁট চেটে নেয়। ঠিক তখনই তার ফোন আবার কম্পন করে, গ্রুপে একটা নতুন মেসেজ আসে — “প্রিয়ম, তুই আজ না ঘুমিয়ে থাকলে তোর ঠাকুরদার পুরোনো ফোনটা খুলে দে। তাতে একটা ভয়েস রেকর্ডিং আছে, যা তোর জন্য রেখে গিয়েছিল।” প্রিয়ম তো হতবাক!

দুই বছর আগে ঠাকুরদার স্মার্টফোনটা বন্ধ করে তুলে রাখা হয়েছিল একটা ড্রয়ারে। সেই ফোনটা এখন তুলে এনে চার্জে বসায় সে। স্ক্রিন অন হতে বেশ সময় লাগে। হঠাৎ ডিভাইসটা জ্বলে ওঠে, এবং সব পুরোনো ডেটা লোড হয়ে যায়। গ্যালারিতে গিয়ে দেখে একটা নাম — “Record for Priom.mp3″। গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা কেমন যেন ধুকধুক করতে থাকে। সে কানে হেডফোন গলায় লাগিয়ে সেই ভয়েস ক্লিপটা চালায়। ঠাকুরদার কণ্ঠস্বর — দুর্বল, কিন্তু স্পষ্ট:
“প্রিয়ম, যদি কোনোদিন ‘Dead But Chatty’ নামে একটা গ্রুপে ঢুকে পড়িস, ভয় পাস না। এই গ্রুপ আমারই খোঁজার ফল। মৃতরা গল্প করতে ভালোবাসে, আর কিছু কিছু মৃত্যুর পেছনে রহস্য থাকে। যদি তুই শুনতে পারিস, বুঝবি — কিছু অপরাধ জীবনে ধরা না পড়লেও, মৃত্যুর পরও রয়ে যায় প্রশ্ন… তুই খুঁজে নিস। তারা তোর সাহায্য চায়।”

পরদিন সকালে প্রিয়ম সাহা দেরিতে ঘুম থেকে উঠে একটা অদ্ভুত ভার অনুভব করে। যেন সারারাত তার ঘাড়ের ওপর কেউ বসেছিল। ঘুম ঠিক হয়নি, মাথাটা ভার, কিন্তু মনটা চঞ্চল। তার ঠাকুরদার ভয়েস রেকর্ডিংয়ের প্রতিটি শব্দ এখনও মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরছে — “মৃতরা গল্প করতে ভালোবাসে”। একসময় সে হাসে — কে ভাবতে পারত, WhatsApp এখন ভূতেদের সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠবে! তবে হাসির আড়ালেই সে জানে, এটা কেবল প্র্যাঙ্ক নয়। এই ‘Dead But Chatty’ গ্রুপটা, তার সদস্যরা — এরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও অসমাপ্ত গল্প বয়ে বেড়াচ্ছে। এবং এখন তারা প্রিয়মকে চাইছে সেই গল্পের সমাপ্তি করতে।

গ্রুপে ঢুকে প্রিয়ম বার্তা দেয় — “আমি কিছু জানার চেষ্টা করছি। তোমাদের মধ্যে কে আগে চায় নিজের কাহিনি বলতে?” সঙ্গে সঙ্গে Tiklu Da চিৎকার করে ওঠে CAPS LOCK-এ, “আমি আমি আমি! আমি মরেছিলাম ভুল চিকিৎসায়। হস্টেলে পেট ব্যথা নিয়ে গেলাম, ডাক্তার বলল গ্যাস — আসলে অ্যাপেন্ডিক্স ছিল! তারপর হুল্লোড় আর চিৎকার, সোজা হাসপাতালের মর্গ!” প্রিয়ম ভাবে, “ভয়ংকর হলেও, টিকলু দার গল্পটা তদন্তযোগ্য। তার কলেজ, হাসপাতাল, সব কিছু এখনও আছে।” টিকলু দা বলে দেয় তার কলেজের নাম — জগন্নাথপুর কলেজ অফ সায়েন্স, ২০০২ সাল, হস্টেল রুম নম্বর ১৩। প্রিয়ম ঠিক করে, আজ বিকেলেই সে কলেজটা খুঁজে যাবে।

বিকেলে সে স্কুটিতে চড়ে পৌঁছে যায় জগন্নাথপুর কলেজে। বাইরে দাড়িয়ে পুরোনো রঙচটা বোর্ড দেখে মনে হয়, সময় এখানে থমকে আছে। কলেজের গেটে দারোয়ানকে বলে, সে যেন প্রাক্তন ছাত্র — কিছু ছবি তুলতে এসেছে। হস্টেল ভবনটা খুঁজে বের করে, কেমন যেন শীতল বাতাস বইছে। রুম ১৩-র সামনে দাঁড়িয়ে ওর পা কাঁপে — দরজা আধখোলা। ভিতরে ঢুকে দেখে, সবকিছু ধুলোমাখা, কিন্তু দেয়ালের কোণে এখনও টিকলু দার লেখা একটা লাইন আছে — “জীবন মানে ঝুঁকি, নয়তো ফাটাফাটি!” প্রিয়ম ছবিটা তোলে। হঠাৎ পেছনে কার যেন পদশব্দ — ঘুরে দেখে কেউ নেই। তখনি ফোনে WhatsApp মেসেজ আসে — টিকলু দা লিখেছে, “এই জায়গা আমার শেষ হাসি ফোটানোর জায়গা ছিল… এবার তুই যদি চাস, আমার সেই ‘ডাক্তারবাবু’-কে খুঁজে বের কর।”

কলেজ হস্টেল থেকে ফিরে আসার পর রাত পর্যন্ত প্রিয়ম সাহা ঘরের দরজা বন্ধ করে, ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে। এখন তার লক্ষ্য, ২০০২ সালে জগন্নাথপুর কলেজের ছাত্রাবাসে টিকলু দার মৃত্যুর সময় যিনি চিকিৎসা করেছিলেন সেই ডাক্তারকে খুঁজে বের করা। তার মনে পড়ে, টিকলু বলেছিল তাকে প্রথমে স্থানীয় মেডিকেল ক্লিনিকে নেওয়া হয়েছিল, সেখানেই ভুল চিকিৎসা হয় — ব্যথা পেটে হলেও ওষুধ দেওয়া হয়েছিল বুক জ্বালার। গুগল ঘেঁটে, পুরোনো হাসপাতাল রেকর্ডের ব্লগ, ফোরাম, সরকারি রিপোর্ট ঘেঁটে সে একটি নাম পায় — ডাঃ অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, তৎকালীন চিকিৎসক, যিনি “সেবা নিকেতন” নামের একটি ছোট নার্সিং হোমে কর্মরত ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত, থাকেন সোদপুরে।

পরদিন সকালে প্রিয়ম সরাসরি সোদপুর রওনা দেয়। সঙ্গে করে সে নিয়ে যায় হেমন্তবাবু আর টিকলু দার মেসেজের স্ক্রিনশট, যাতে প্রয়োজনে প্রমাণ দেখাতে পারে — যদিও এখনও ভাবছে, একজন জীবিত মানুষের সামনে গিয়ে কীভাবে বলবে “আপনার রোগী একটা ভূতের WhatsApp গ্রুপে আছে”। সোদপুরের অদূরে এক পুরোনো বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে আসেন একজন বৃদ্ধ — চোখে মোটা চশমা, হাতে লাঠি, কিন্তু গলার স্বরে হুকুম। প্রিয়ম বলে, সে টিকলু ঘোষের বিষয়ে জানতে চায় — ২০০২ সালে এক ছাত্র যার পেটের ব্যথাকে গ্যাস বলে উপেক্ষা করা হয়েছিল। শুনেই ডাঃ অমল থমকে যান। তারপর ধীরে ধীরে বলেন, “ও ছেলেটা… আজও আমার ঘুম আসে না… আমি শুধু গ্যাস বলিনি, আমি একটা প্রেসক্রিপশনও লিখেছিলাম যা ওর অ্যালার্জি ছিল — সেটা তার রুমমেট জানত, কিন্তু সময়মতো বলেনি।”

এই কথায় প্রিয়ম কেঁপে ওঠে। টিকলু দা তো বলেছিল, ডাক্তারই দায়ী। এবার জানা গেল, হয়তো আরও কেউ দায়ী — হয়তো তার ঘনিষ্ঠ রুমমেট, যে হয়তো ইচ্ছে করেই চুপ করেছিল। ফিরে এসে প্রিয়ম আবার গ্রুপে মেসেজ করে টিকলু দাকে — “তোর রুমমেট কে ছিল রে?” উত্তর আসে সাথে সাথে, কিন্তু এক অদ্ভুতভাবে লেখা — “জয়ন্ত… ও-ই আমার inhaler লুকিয়ে রেখেছিল। আমি সেটা জানতাম না। কিন্তু মরার পর জেনেছি সব।”
এরপরেই মেসেজ আসে সেই ভয়ঙ্কর নম্বর থেকে — 913XXXXXXX। এবার সে শুধু ইমোজি নয়, এক কথার মেসেজ পাঠায় — “তুই কি নিজে প্রস্তুত সব জানার?”

প্রিয়মের মাথার ভেতর যেন বজ্রপাত হয়। এই নম্বরটা, যে একা কিছু লেখে না, শুধু তাকিয়ে থাকে… সে কি এই জয়ন্ত? না কি সে আরও বড় কিছু? সে কি এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রক?
ঠিক তখনই তার ঘরের জানলা হঠাৎ সশব্দে বন্ধ হয়ে যায়। বাতি দপ করে নিভে যায়। অন্ধকারের মধ্যেই তার ফোন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নতুন মেসেজ —
“পরবর্তী মৃত্যু কার ছিল জানিস?”
সাথে একটা ছবি — চুমকি দিদির মৃত্যুর আগের রাতের একটি অদ্ভুত ভিডিও ক্লিপ।

ঘরের বাতি জ্বলে ওঠে হঠাৎই, কিন্তু সেই আলোতে প্রিয়ম সাহার চোখে পড়ে এক বিভীষিকা — ফোনের স্ক্রিনে চলে আসা সেই ভিডিও ক্লিপ। ২০০১ সালের মার্চ মাসে, সম্ভবত কলেজের হোস্টেলের কোনো ঘরে মোবাইল ক্যামেরায় তোলা। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক তরুণী — সাদাসিধে সালোয়ার পরে, জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তার চুল এলোমেলো, চোখে জল, আর কণ্ঠে একটা মৃদু গান — যেন রবীন্দ্রনাথের “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…”। মুহূর্তখানেক পরে ভিডিওটা ঝাঁকুনি খায়, ক্যামেরার ফোকাস নড়ে যায়, আর তারপর চুপচাপ অন্ধকার। স্ক্রিনে ফিরে আসে WhatsApp গ্রুপের বার্তা — এইবার ‘চুমকি দিদি’ নিজেই লিখছে:
“আমি মারা গেছি প্রেমে প্রতারণার কারণে। কিন্তু শুধু প্রতারণা নয়… সেটা ছিল পরিকল্পিত লজ্জা। আমার গায়ে মোবাইল ক্যামেরা ফোকাস করেছিল যে, সে এখনো বেঁচে আছে। আর তুই, প্রিয়ম, তুই ওর কাছে যাবি?”

প্রিয়মের চোখ কাঁপছে, কিন্তু সে থামে না। সে চুমকি দিদির সঙ্গে কথা বলে, বোঝার চেষ্টা করে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে এক শোকঘন ইতিহাস। চুমকি সরকার ছিল তৎকালীন কলেজের সাহিত্যের ছাত্রী, লেখাপড়ায় দারুণ, তবে বেশি কথা বলত না। একজনের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল — কলেজের ফটোগ্রাফি ক্লাবের সভাপতি, নাম অর্কজ্যোতি সেন। তারা বন্ধু থেকে প্রেমিক, তারপর সব বদলে যায়। একদিন কলেজ ফেস্টের পর, চুমকি দিদি তার রুমমেটের কাছে জানিয়েছিল — অর্কজ্যোতি তার ব্যক্তিগত মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছে। ভয় দেখিয়ে বলেছিল যদি ব্রেকআপ করে, সেই ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। পরদিন চুমকি নিখোঁজ হয়। এক সপ্তাহ পর তার মরদেহ কলেজ হোস্টেলের পেছনের পুকুরে ভেসে ওঠে — পুলিশ বলেছিল আত্মহত্যা। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

প্রিয়ম এবার ঠিক করে, সে যাবে অর্কজ্যোতির খোঁজে। গুগলে তার নাম খুঁজতেই পাওয়া যায় — এখন সে একজন বিয়ে-ফটোগ্রাফার, কাজ করে “অর্ক ফটোগ্রাফি ওয়ালাস” নামে এক এজেন্সিতে, থাকেন নিউ আলিপুরে। ঠিক সেই সময়, আবার ফোনে মেসেজ আসে সেই 913XXXXXXX নম্বর থেকে —
“তুই যদি চুমকির ন্যায়ের জন্য কাজ করিস, এই ভিডিওটা প্রিন্ট করে থানায় দিবি। কিন্তু সাবধান — অর্ক এখন আর শুধুই ফটোগ্রাফার নয়।”

প্রিয়ম ঘামে ভিজে যায়। সে জানে না এই নম্বরটা কাকে বলে, বন্ধু না শত্রু — কিন্তু তার নির্দেশগুলো কাজে লাগে। পরদিন সে সেই ভিডিও ক্লিপ থেকে স্টিল ইমেজ বের করে প্রিন্ট করে, ফাইলে ভরে থানায় জমা দেয় — কিন্তু পুলিশ অফিসার হাসে, বলে, “ভূতের গল্প শোনাতে এসেছো?”
প্রিয়ম হতাশ, কিন্তু ফোনে তখন আসে চুমকি দিদির একটা শেষ মেসেজ:
“ধন্যবাদ। তুই যদি না আসতিস, আমার আত্মাটা খাঁচার পাখির মতো থেকে যেত। তবে সাবধান… এই গ্রুপে আমরা সবাই যেমন তোর বন্ধু… তেমনি কেউ কেউ…”

মেসেজটা অসমাপ্ত থেকে যায়। আর ঠিক সেই সময়, তার জানালার বাইরে কোনো একটা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ — কেউ যেন ছবি তুলে পালিয়ে গেল।

নিউ আলিপুরের গলির মধ্যে একটা কালো সাইনবোর্ড — তাতে সাদা হরফে লেখা “Ork Photography Walas | Wedding • Events • Portraits”। বাইরে থেকে দেখতে আধুনিক স্টুডিওর মতো হলেও ভেতরের কাঁচের জানালায় কেমন যেন ধুলো লেগে, আলো প্রবেশ করে না ঠিকঠাক। প্রিয়ম সাহা রাস্তার এদিক থেকে দাঁড়িয়ে দেখে, ভিতরে একজন পুরুষ সাদা শার্ট পরে সামনে বসে আছে — গলা অবধি ধরা বোতাম, নিখুঁত চুল, কিন্তু মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না। যেন অন্ধকারের চাদরে ঢাকা। সাহস করে দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে গলার আওয়াজ, “আসুন, অপেক্ষা করছিলাম আপনাকে।” মুহূর্তেই প্রিয়মের গা শিউরে ওঠে — সে তো তার নাম জানায়নি, কেউ বলেওনি সে আসছে।

ভিতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে প্রিয়ম দেখতে পায় অসংখ্য ফ্রেম — সাদা-কালো ছবি, সবগুলোতেই মানুষের মুখ… কিন্তু মুখগুলো অস্বাভাবিকভাবে নিস্প্রাণ। যেন সবাই মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালের কোণে একটা বড় ক্যানভাসে ফ্রেমবন্দি একজন মেয়ের ফ্যাকাশে মুখ, চোখ বন্ধ, চুল ভেজা — আর হ্যাঁ, প্রিয়ম বুঝে যায় — ওটাই চুমকি সরকার। তার গলা শুকিয়ে আসে। টেবিলের ওপারে বসে থাকা লোকটি তখন বলে ওঠে, “তুমি কি তার বন্ধু? তার আত্মা এখনও আমাকে দেখে যায়, চুপ করে, ক্যামেরার পিছন থেকে। কিন্তু আমি তো শিল্পী — আমি তো কেবল সুন্দর মুহূর্ত ধরে রাখি…”

প্রিয়ম বলে, “আপনি কীভাবে চুমকির ভিডিও করলেন সেই রাতে? আপনিই তো তাকে ব্ল্যাকমেল করেছিলেন!”
অর্কজ্যোতির ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি খেলে যায়, “ভালবাসলে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে, না? আমি তো ওকে শুধু আমার করে রাখতে চেয়েছিলাম।” তারপর সে উঠে দাঁড়ায়, হাতে তুলে নেয় একটি পুরোনো DSLR। ক্যামেরাটা তার দিকে তাক করে বলে, “তুমি জানো এই ক্যামেরাটা দিয়ে আমি শেষ ছবিগুলো তুলে রাখি… যারা আমাকে ফেলে চলে যেতে চায় তাদের… বা সত্যি জানতে চায় তাদের।”

হঠাৎ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে — প্রিয়ম চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর চোখ খুলতেই সে দেখতে পায়, সে একা নেই। স্টুডিওর দেওয়ালজুড়ে সেইসব মৃতদের ছবি যেন নড়ছে, মুখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। চুমকি দিদির মুখ থেকে ফ্রেম ভেঙে বেরিয়ে আসে কুয়াশার মতো এক অবয়ব — মুখে রাগ, চোখে যন্ত্রণা। এবং ঠিক তখনই অর্কজ্যোতির মুখ বিকৃত হয়ে যায় — সে হাঁপাচ্ছে, চোখ লাল, চেঁচিয়ে ওঠে, “তুই ওকে ডেকেছিস! ও ফিরে এসেছে! ও আমার ছবি ভেঙে দিচ্ছে!”

মূহুর্তেই বিদ্যুৎ চলে যায়, ঘর অন্ধকার। শুধু একটা কাঁচের চিঁড়চিঁড় আওয়াজ — কেউ যেন ফ্রেম ভেঙে ফেলছে।
কিছুক্ষণ পর আলো ফিরে আসে।
স্টুডিওতে কেউ নেই।
অর্কজ্যোতির চেয়ারে শুধু পড়ে আছে তার ক্যামেরা, আর তার ভিতরের মেমোরি কার্ড গলে গেছে।

WhatsApp গ্রুপে নতুন মেসেজ আসে চুমকি দিদির তরফ থেকে:
“আমি মুক্ত। কিন্তু অর্ক এখন শুধু ক্যামেরায় নয়, অন্য কোথাও বন্দি হয়ে আছে… এবং সে একা নেই।”

গ্রুপে এবার একটি নতুন সদস্য অ্যাড হয় — নাম: অর্কজ্যোতি (Muted)।
তার প্রোফাইল পিকচার — এক ভাঙা ফ্রেমের ভেতরে আবছা মুখ।

দুপুরের রোদ জানালার পর্দা ভেদ করে ঢুকছে, কিন্তু প্রিয়ম সাহার ঘরে কেমন যেন আলো নেই। স্টুডিও থেকে ফেরার পর থেকে তার মনে হচ্ছে, কোনো এক অদৃশ্য উপস্থিতি তার ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলটা হাতেই রেখেছিল, হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে টুং করে শব্দ। সে দেখে — “Dead But Chatty” গ্রুপে নতুন সদস্য অ্যাড হয়েছে। নাম: “Subhojit (🩸Muted)”। প্রোফাইল পিকচার — কালো পটভূমিতে সাদা চোখ, আর একটা আঁচড়ে লেখা “HELP ME”। আর মেসেজ? কিছু নেই। শুধু একটি ভয়ংকর ভয়েস মেসেজ — কাঁপা গলায়, যেন কারও নিশ্বাসের ফাঁকে বলা, “আমায় ওরা মেরে ফেলেছে… কিন্তু আমার দেহ এখনও পাওয়া যায়নি।”

গ্রুপ নিস্তব্ধ। চুমকি দিদি, টিকলু দা, হেমন্তবাবু — কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু সেই 913XXXXXXX নম্বর আবার সক্রিয় হয়। মেসেজ আসে, “এই মৃত্যুর দায় কার? তুই কি জানিস, এবার যা জানতে যাচ্ছিস তা শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যৎও বদলে দেবে?”
প্রিয়ম ফোনে উত্তর দেয়, “Subhojit কে? ও কোথায় মারা গেছে?”
জবাব আসে, “তুমি থাকো গড়িয়াহাটে, না? তোমার পাড়ার দক্ষিণ দিকের ফাঁকা ফ্ল্যাটটা মনে আছে, যেটা গত বছর হঠাৎ করে সিল করে দেওয়া হয়েছিল?”

প্রিয়মের শরীর হিম হয়ে যায়। সে জানে ফ্ল্যাটটার কথা — সাউথ উইং, ফ্ল্যাট 3B। একসময় সেখানেই থাকে এক সদ্য চাকরিপ্রাপ্ত যুবক — শুভজিৎ রায়, বয়স ২৫, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। হঠাৎ করে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। পুলিশ তদন্ত করে, বলে “আত্মগোপন”, কেউ কেউ গুজব ছড়ায় প্রেমঘটিত বিষণ্নতা। কিন্তু কিছুদিন পর, পাড়ায় গন্ধ ছড়ায়, জল পড়তে থাকে ফ্ল্যাটের সিলিং থেকে — অথচ ফ্ল্যাট বন্ধ। অবশেষে পুলিশ এসে ফ্ল্যাট সিল করে দেয়। কেউ কিছু জানে না, বা জানতে চায় না।

প্রিয়ম এবার ঠিক করে সে ওই ফ্ল্যাটে যাবে। সন্ধ্যায় সে ফ্ল্যাট 3B-র সামনে দাঁড়ায়। চারপাশ নিস্তব্ধ, দরজায় পুলিশি সিল এখনও ঝুলছে। কিন্তু দরজায় ছোঁয়া মাত্র, তালা খুলে যায় নিজে থেকেই। ঘরের ভেতর ঢুকতেই চিমনি ধরা গন্ধ, পচা কাগজের আওয়াজ, আর এক দেয়ালে লেখা লাল কালি দিয়ে — “I know what they did”। হঠাৎই বাথরুমের দিক থেকে জলের ধারা শব্দ, কিন্তু পাইপ বন্ধ। প্রিয়ম ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, তার পায়ের নিচে কিছু যেন নড়ছে — প্লাস্টিকের ব্যাগ, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা একটা পুরোনো হাতঘড়ি। সে ঘড়ি চিনে ফেলে — শুভজিৎ সেই ঘড়িটাই পরত, যেটা তার জন্মদিনে মা দিয়েছিলেন।

ফোনটা তখনই কাঁপতে থাকে, WhatsApp-এ নতুন মেসেজ আসে Subhojit (🩸Muted)-এর থেকে —
“ওরা তিনজন ছিল। অফিস কলিগ। ওরা আমার কোড চুরি করেছিল, আমি ধরা পড়ে গেলে… তারা বলে আমি পাগল। তারপর এক রাতে… আমাকে ওরা… সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। তুই যদি চাইস, আমি তোকে ওদের নাম দিতে পারি।”

প্রিয়ম ভয় পায়, আবারো চমকে ওঠে। সে জানে এবার সে জড়িয়ে পড়ছে এমন কিছুর মধ্যে, যা শুধুই ভূতের ন্যায় চাওয়ার কাহিনি নয় — এটা খুন, ষড়যন্ত্র, এবং কিছু অদৃশ্য শক্তির ছায়া…
ঠিক তখনই গ্রুপে মেসেজ আসে সেই 913XXXXXXX নম্বর থেকে —
“এবার তুই সিদ্ধান্ত নে — আদালতের কাছে নাকি পরলোকে বিচার হবে?”

ফ্ল্যাট 3B থেকে ফিরে এসে প্রিয়ম সাহা এক অদ্ভুত দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত। সে বুঝতে পারছিল— শুধু ভূতের কথা নয়, এখানে সত্যিই একটা ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। শুভজিৎ রায়ের হত্যাকারীরা এখনও পলাতক, আর ‘Dead But Chatty’ গ্রুপের মৃতরা বিচার চাইছে। গ্রুপে সে মেসেজ করল— “তিন খুনির নাম দাও, আমি পুলিশের কাছে যাব।” মেসেজ আসল, একের পর এক, কিন্তু একটাও নাম নয়, বরং খুনির চারটি শিরোনামের নাম: “তোমার অফিসের গোপনতা, তোমার বিশ্বাসঘাতক বন্ধু, তোমার ভুল সিদ্ধান্ত, তোমার সময়।” প্রিয়ম বুঝতে পারল, এটা কেবল ব্যক্তিগত বিচার নয়, এক রকম পরলোকের খেলা।

তিনদিন পর প্রিয়ম পুলিশের সাথেও যোগাযোগ করে, কিন্তু কেউ তাকে গুরুত্ব দেয়নি। তখন সে ঠিক করে নিজের হাতেই বিচার করবে। এক এক করে সে শুভজিৎ রায়ের অফিস কলিগদের খোঁজ করতে শুরু করে। প্রথমজন, “রবিন” — যার ফোন বন্ধ, অফিসেও পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়, “মোহন” — যিনি হঠাৎ করেই বিদেশে চলে গেছেন। আর তৃতীয়, “সুভাষ” — যিনি বাড়ি পরিবর্তন করে গেছেন। সেই সময় হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা আসে গ্রুপের নামহীন সদস্য থেকে — “তুই সিদ্ধান্ত নে, বিচার করবি নাকি বিচার বহিষ্কার করবে?”। প্রিয়ম বুঝতে পারল, পরলোকের বিচার মানেই জীবিতদের বিচার।

এক সন্ধ্যায় প্রিয়ম বাড়ি ফিরতেই তার মোবাইলে এক অনিচ্ছাকৃত ভিডিও আসে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, অফিসের একটি ঘর যেখানে রবিন ও মোহন এক অদ্ভুত নীল আলোয় দাঁড়িয়ে আছে, মুখোমুখি। তাদের শরীর যেন কাঁপছে, আর মোহনের হাতে এক বড় চاقু। ভিডিও শেষ হবার আগেই মোহন ছুঁড়ে দেয় চاقুটি, আর রবিন মাটিতে পড়ে যায়। প্রিয়ম চমকে যায়, বুঝতে পারে এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং এক ভবিষ্যতের ঝলক।

পরের দিন গ্রুপে মেসেজ আসে — “পরলোকে বিচার শুরু হয়েছে, তুই তৈরি কি?”। প্রিয়মের জানলা বাইরে থেকে কেউ টোকা দেয়, সে তাকায়, কিন্তু কেউ নেই। তার ফোন তখন হঠাৎ সাদা স্ক্রিন দেখায়, আর তারপর নীল আলোতে ডুবে যায়।

প্রিয়ম সাহার জীবন এখন এক অদ্ভুত দোলায় ফেঁসে গেছে। “Dead But Chatty” গ্রুপের মৃতরা শুধু বন্ধু নয়, তারা এখন তার পরিবার। তাদের বিচার সে শেষ না করলেই শান্তি নেই। গ্রুপের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে নতুন অস্থিরতা, নতুন সংকেত। তিন খুনির রহস্যে প্রিয়ম নিজেই যেন একটা পাজলের টুকরা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিন রাতে, যখন সে নিজের ঘরে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, হঠাৎ মোবাইলে এল এক মেসেজ — “আজ শেষ বিচার। তুমি রেডি তো?”। তার হাত কাঁপতে লাগল। সে জানত, আজকের রাতটা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার রাত।

রাতের অন্ধকারে প্রিয়ম চলে গেল সেই সাউথ উইং ফ্ল্যাট 3B-তে। পাশে নিয়ে গেছে একটি ছোট ল্যাপটপ, আর সঙ্গে স্ট্যান্ডবাই মোবাইল। ফ্ল্যাটের দরজা নিজে নিজে খুলে গেল, ভিতরে ঢুকতেই কেঁপে উঠল সে। একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে, দেয়ালে ছায়ার মতো অদ্ভুত মুখগুলো ঝাপসা হয়ে উঠছে। হঠাৎ, মোবাইলে চালু হলো ‘Dead But Chatty’ গ্রুপের ভিডিও কল। মৃতদের মুখ তার সামনে ভেসে উঠল, কেউ কাঁদছে, কেউ চিৎকার করছে।

ভিডিওতে দেখা গেল সেই তিন খুনির ছায়া— রবিন, মোহন, আর সুভাষ। তারা এক এক করে নিজের অপরাধ স্বীকার করল, আর বলল, “তোমার তদন্তে আমাদের মুক্তি মিলল। এখন তুমি চাইলে শান্তিতে থাকতে পারো।” প্রিয়ম বুঝল, বিচার হয়েছে, কিন্তু এর বিনিময়ে সে যেন অন্য এক জগতের দায়িত্ব নিয়েছে। আর সেই রাত থেকে, প্রিয়ম হয়ে গেল “Dead But Chatty” গ্রুপের একমাত্র জীবন্ত বন্ধু, যারা মৃতদের জন্য ঝুঁকি নেবে, এবং তাদের অসমাপ্ত কাহিনি শেষ করবে।

মরণোত্তর বিচার শেষ হলেও, প্রিয়ম সাহার জীবন আর আগের মতো হয়নি। “Dead But Chatty” গ্রুপের সবাইকে মুক্তি দিলেও, তারা এখন যেন তার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে— বন্ধু, পথপ্রদর্শক, আর কখনো কখনো সতর্ককারী। প্রতিদিন রাত ১২টা বাজলেই তার ফোনে মেসেজ আসে, যেখানে ভূতেরা তাদের নতুন গল্প, নতুন রহস্য শেয়ার করে। এইবার কেউ কাঁদছে, কেউ সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছে, আবার কেউ নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে— তাদের দুঃখ-দুর্দশার ভাণ্ডার যেন এখন প্রিয়মের কাঁধে।

একদিন প্রিয়ম সিদ্ধান্ত নেয়, সে শুধু মৃতদের বিচারই করবে না, তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করবে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সে ছুটে বেড়ায়, এমন পরিবার ও মানুষের সন্ধানে যারা হারিয়ে যাওয়া আত্মার জন্য অপেক্ষা করছে। তার জীবনে আসে নতুন এক শান্তি— ভয়ের মাঝে সাহস, অন্ধকারের মাঝে আলো। তবে এই যাত্রা সহজ নয়। এক রাতে, গ্রুপে আসে এক অজানা সদস্যের বার্তা, যার নাম “The Watcher”। সে জানায়, “তুমি এখন শুধু বন্ধু নও, তুমি পাল্টে গেছ একটি সেতু— জীবিত আর মৃতের মধ্যে।”

প্রিয়ম বুঝতে পারে, এই সেতু ধরে থাকাই এখন তার মিশন। একদম নতুন অধ্যায় শুরু হলো, যেখানে বন্ধুত্বের এক অন্যরকম রূপ, দায়বদ্ধতার এক গভীরতা অপেক্ষা করছে তার জন্য। আর সে প্রস্তুত, কারণ সে জানে— এই গ্রুপের সবাই তার পাশে আছে, আজীবন।

***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *