কলকাতার উত্তরে অবস্থিত “চন্দ্রমোহন কলেজ”-এর হোস্টেলটা শহরের মধ্যে হলেও একেবারে বাইরের অংশে পড়ে। চারদিকের কোলাহলের মধ্যেও হোস্টেলের গেট পেরোনোর পরেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা আচ্ছন্ন করে রাখে জায়গাটাকে। পুরনো লাল ইটের বিল্ডিং, জংধরা লোহার গ্রিল, আর হোস্টেলের চারপাশে ছড়ানো অশ্বত্থ ও কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো যেন দিনের বেলাতেও ছায়া ফেলে রাখে আশপাশে। সোহম মুখার্জি, সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্র, বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে উঠল ওই হোস্টেলে। তার সঙ্গে একই ঘরে থাকবে রাহুল দে, ওর স্কুলজীবনের বন্ধু, আর তুষার সাহা — এক আধুনিক, সদ্য দেখা হওয়া ফেসবুক-বন্ধু। রুম নম্বর ৭ — তিনতলার এক কোণে, যেটা দেখে মনে হয় অনেক বছর কেউ পরিষ্কার করেনি। সিলিং থেকে ঝুলছে ধুলো জমা পাখা, জানালার কাচ ঘোলা, আর দরজায় পুরনো একটা তালা — যেটা খুলতেই যেন হালকা একটা গন্ধ নাকের সামনে এসে পড়ে, পুরোনো কাঠের, বা হয়তো ধুলো জমা সময়ের। রাহুল বলল, “বাহ, একদম ভূতের সিনেমার সেটিং!” — আর তুষার সেটা শুনে মোবাইল বের করে বলল, “সেলফি তোল! ক্যাপশন হবে — ‘ঘোস্টে ভর্তি হোস্টেল’!”
হোস্টেলে প্রথম দিনটা ছিল ব্যস্ততায় ভরা — জিনিসপত্র গোছানো, হালকা পরিচিতি, সিনিয়রদের ঘুরে ঘুরে নাম বলা আর সেই অদ্ভুত নিয়মের মুখোমুখি হওয়া, যা নতুন ছেলেদের সবসময় একটু ভয়ে রাখে। সন্ধের পরেই সোহম, রাহুল আর তুষার নিজেদের ঘরে ঢুকে একরকম ঘুমিয়ে পড়ে, ক্লান্তিতে। কিন্তু রাত একটা নাগাদ, রাহুল ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যায়। করিডোরটা নির্জন, দেওয়ালে হলুদ আলোর ঝাপসা ছায়া। পা ফেললে আওয়াজ হয় “ঠক ঠক ঠক”, যেন কেউ পেছনে হাঁটছে! রাহুল হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, পেছনে তাকায় — কেউ নেই। বাথরুমে ঢুকে কল ঘোরায়, জল পড়ে না। কিন্তু পাশের কল নিজে থেকেই ঘুরে যায় — জলের টপটপ আওয়াজে তার হৃদস্পন্দন আটকে যায় যেন। সে ভয়ে চিৎকার না করে দৌড়ে চলে আসে রুমে, চাদর মুড়ি দিয়ে গা ঢেকে কাঁপতে থাকে। সকালে এই ঘটনা সোহম আর তুষারকে বলতে গেলে তারা হেসে ওঠে। তুষার বলে, “ভুতের ভিডিও অনেক দেখেছিস মনে হচ্ছে!” — আর সোহম বলে, “এত রাতে ঘুমচোর হলে এসব হ্যালুসিনেশন হয়।” তবে রাহুল বুঝতে পারে সে ভুল দেখেনি। ওই কল নিজেই খুলেছিল। ওর চোখের সামনেই।
সন্ধে নামার আগেই তারা তিনজন হোস্টেলের করিডোরে হাঁটতে বেরোয়। এবার তারা হোস্টেলের লাইব্রেরির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেয়ালের ওপর ঝাপসা একটা হাতের ছাপ দেখতে পায়। সেটা যেন রক্ত বা কাদামাটি দিয়ে আঁকা, অনেকদিনের পুরনো হলেও স্পষ্ট বোঝা যায় পাঁচটি আঙুলের ছাপ। কেউ মজা করেছে ভেবে তুষার ছবি তোলে। তখন হঠাৎ করেই ওদের পিছনে দাঁড়ানো একজন বলে ওঠে, “ওটা ঠিক এক বছর আগেও ছিল… তখন কেউ নামতে চায়নি এই ফ্লোরে।” চমকে ফিরে দেখে, একজন উঁচু লম্বা, চশমা পরা ছেলেকে — সিনিয়র অনিরুদ্ধ ঘোষ। গলায় গম্ভীর সুরে সে বলে, “তোমরা ৩ নম্বর ঘরের গল্প শুনেছ?” তার গলায় এমন এক টান ছিল, যা রাহুলের শরীর ঠান্ডা করে দিল, কিন্তু সোহম শুধুই কৌতূহলী হলো। অনিরুদ্ধ আর কিছু না বলে হেঁটে চলে গেল, শুধু একটা কথা ছুঁড়ে দিয়ে — “সব ঘর ঘুমায় না ভাই… কিছু কিছু ঘর স্বপ্ন দেখে।” আর ঠিক সেই সময়, করিডোরের এক প্রান্তের আলোটা হঠাৎ নিভে গেল একসাথে… যেন সময়টা আটকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সোহম তখনও জানত না, সেই রাত থেকেই শুরু হয়েছে তাদের জীবনের সবচেয়ে রহস্যময়, ভয়ের, কিন্তু একইসঙ্গে মজার এক অধ্যায় — ভূতের হোস্টেলের আসল কাহিনি।
–
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে হোস্টেলের করিডোরে যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে। দিনভর ছাত্রদের চলাফেরায় সরব যে জায়গা, রাত দশটার পরেই যেন নিঃশব্দে জেগে ওঠে অন্য এক রূপে। তুষার হালকা গুনগুন করতে করতে হেডফোন কানে দিয়ে ইনস্টাগ্রামে ভিডিও এডিট করছিল, আর রাহুল চুপচাপ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। সোহম তখন পড়ার ভান করে আসলে অনিরুদ্ধের বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবছিল — “সব ঘর ঘুমায় না ভাই… কিছু কিছু ঘর স্বপ্ন দেখে।” এর মানে কী হতে পারে? ও কি আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল, নাকি সত্যিই কিছু লুকিয়ে আছে এই হোস্টেলের ভেতরে?
রাত বাড়তে লাগল। বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো হালকা টিপটিপ শব্দে। জানালার কাঁচে জলের ফোঁটার ছাপ, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানো — পুরো পরিবেশটাই যেন হঠাৎ করে এক অজানা নাটকের পটভূমি তৈরি করছিল। ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১টা ৫৫ মিনিট ছুঁই ছুঁই। তুষার তখন ঘুমিয়ে পড়েছে, সোহম আধো ঘুমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে রাহুল — ওর পেট খারাপ হয়েছে, তাই তাকে বাথরুমে যেতে হচ্ছে। হাতে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে পা রাখে করিডোরে, আর সাথে সাথে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগে। করিডোরে থাকা টিউবলাইটগুলো ঠিকঠাক জ্বলছে না — এক একটা ফ্লিকার করছে, যেন কেউ প্রতি মুহূর্তে সুইচ অন-অফ করছে। রাহুল গুনগুন করতে থাকে — “হে মা দুর্গা, আমার পিছু পিছু কেউ আসিস না প্লিজ।” সে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। পাশের কলে হালকা আওয়াজ হচ্ছে — জলের টুপটাপ পড়ার শব্দ। সে ভাবে, “সেদিনের মতো আবার কিছু শুরু না হয় যেন।”
ঠিক যখন সে নিজের কাজ শেষ করে সবে হাত ধুতে যাবে, তখন পাশের কলটা নিজে থেকেই খুলে যায় — এক ঝাঁক জল ছুটে এসে ছড়িয়ে পড়ে বেসিনে। রাহুল থেমে যায়। তার চোখের সামনে কল ঘুরল… কিন্তু তার হাত সেখানে নেই। সে মোবাইলের আলো ধরে কলটার নিচে ঝুঁকে দেখে, কেউ নেই। আবার একবার সেই ঠাণ্ডা হাওয়া আসে — এবার যেন একটু বেশি তীব্র। মাথার ওপরের টিউবলাইট এক ঝটকায় নিভে যায়। রাহুল আর থাকতে পারে না। দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে, জুতো না পরেই ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ে নিজের ঘরে, সোজা চাদরের নিচে ঢুকে পড়ে। তুষার বিরক্ত হয়ে উঠে বসে — “আরে কি হলো?” সোহমও জেগে ওঠে — “রাহুল তুই আবার কী করলি?” রাহুল কাঁপা গলায় বলে — “কলটা… আপনাআপনি খুলে গেল… আর আবার সেই ঠাণ্ডা বাতাস… আর আমি শুনলাম কেউ যেন আমার পাশ দিয়ে হাঁটল… আমি শুনেছি ভাই… আমি পাগল না!” সোহম চুপ করে যায় কিছুক্ষণ। এবার সে ভাবে, হয়তো ব্যাপারটা হালকাভাবে নেওয়ার দরকার নেই। তুষার যদিও হেসে বলে, “ভাই, এটা না হইল জলের ভূত। কল খোলার ভূত! হে হে হে!” কিন্তু হাসির মধ্যে থেকেও ওর চোখের কোনায় একটুখানি শঙ্কা ফুটে ওঠে। সোহম উঠে গিয়ে জানালার কাচ মুছে দেখে বাইরে কেউ আছে কিনা — পুরো করিডোর নিঃশব্দ, আলো ঝাপসা, আর ছায়া যেন নিজেই নিজের সঙ্গে খেলে যাচ্ছে। এরপর সোহম শুধু একটা কথাই বলে — “আগামীকাল আমরা তিনজন একসাথে ওই বাথরুমে যাব, রাতে। আর ক্যামেরা বসাব। দেখি, ভূত আছে না বানানো গল্প।”
আর তখনই জানালার বাইরে আবার বিদ্যুৎ চমকে ওঠে — আলোর ঝলকে মনে হয়, যেন কেউ বাইরের করিডোরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে… তিনজনের ঘরের দিকেই।
–
পরদিন সকালটা অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল না। রাহুল একেবারেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, আর তুষার অস্বীকার করলেও ওর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সোহম অবশ্য রাহুলের কথাগুলো সহজে উড়িয়ে দেয়নি। সকালের নাস্তার পর তিনজন মিলে কলেজের ক্লাস সেরে আবার দুপুরে ফিরে আসে হোস্টেলে। তখন হঠাৎ তুষার বলে, “তুই না ক্যামেরা বসাতে চেয়েছিলি? আমার কাছে একটা অ্যাকশন ক্যাম আছে। একে GoBhoot বলি আমরা — ghost দেখার জন্য, হে হে।” কথা শুনে রাহুল আঁতকে ওঠে, “তুই কি পাগল? আবার রাত্তিরে সেই বাথরুমে যাবি?” সোহম হালকা হেসে বলল, “ভয় না পেলে কখনও সত্যি সামনে আসে না রাহুল। তুই থাক, আমি আর তুষার যাচ্ছি। ক্যামেরা বসাব, একটা রাত অন্তত দেখে নিই কী হয়।”
রাত আটটার সময় হালকা বৃষ্টি শুরু হয় আবার, আর হোস্টেলের করিডোরে অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে আসে — ভেজা মাটির গন্ধের সঙ্গে যেন কিসের পুরোনো সোঁদা গন্ধ মিশে আছে। সোহম, তুষার ও রাহুল একসাথে ২ নম্বর বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। তুষার ক্যামেরা সেট করে দেয় জানালার কার্নিশে — যাতে পুরো বেসিন, কল আর দরজা ভালোভাবে দেখা যায়। ক্যামেরা অন করে সবাই ফিরে আসে নিজেদের ঘরে। রাত এগারোটার পর থেকেই রাহুল ভয়ে কাঁপতে থাকে। মাঝরাতে ঘড়ির কাঁটা যখন ২টা ছুঁয়েছে, তখন হঠাৎ করেই করিডোরে একটানা হাসির শব্দ ভেসে আসে — মিহি গলা, যেন একটা মেয়ে হেসে উঠছে নরমভাবে। রাহুল সোজা উঠে বসে, “সোহম… তুই শুনছিস?” সোহম ইতিমধ্যে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। এবার হাসির সঙ্গে একটা ঠকঠক শব্দ — কেউ যেন করিডোরে হাঁটছে ধীরে ধীরে। তুষার মোবাইল তুলে রেকর্ডিং চালু করে, আর ক্যামেরার লাইভ ফিডে চোখ রাখে। ক্যামেরায় দেখা যায় — বাথরুমের দরজা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে, অথচ সেখানে কেউ নেই। সেই সময়েই হঠাৎ করেই দেওয়ালের এক পাশে — ঠিক লাইব্রেরির সামনে, একটা হাতের ছাপ ফুটে ওঠে ধীরে ধীরে — লালচে, যেন তাজা রক্ত নয়, কিন্তু পুরনো হয়ে যাওয়া দাগ।
তাদের তিনজনের গা ঘামতে থাকে, কেউ কিছু বলে না। রাহুল চোখ বন্ধ করে জপতে থাকে, “ওঁ নমঃ শিবায়, ওঁ নমঃ শিবায়…” আর তুষার মুখ দিয়ে ফিসফিস করে বলে, “ভাই… এটা এডিটেড কিছু না। এটা লাইভ…” ঠিক তখনই হোস্টেলের সাউথ করিডোরের আলো একসাথে নিভে যায় — একটা ঝনঝন শব্দ, তারপর নিঃশব্দ। হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়ে — টক টক টক। সবাই চুপ। কেউ বলল না “কে?” কেউ এগিয়ে গেল না দরজার দিকে। কয়েক সেকেন্ড পরে দরজার নিচ দিয়ে সাদা কাগজের একটা টুকরো গড়িয়ে আসে — তাতে লেখা শুধু এক লাইন, লাল কালি দিয়ে —
“তোমরা কেন ক্যামেরা বসিয়েছো?”
সোহম কাগজটা হাতে তুলে নেয়, আর বাকিরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। তুষার ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে, “এটা কি সেই নীলুর লেখা?” রাহুল তো একেবারে চাদরের নিচে ঢুকে পড়ে। পরদিন সকালে, তারা ক্যামেরার ফুটেজ দেখে — বাথরুমের দরজা ঠিক রাত ২:১১ মিনিটে খুলেছে, কল নিজে থেকে ঘুরেছে, দেওয়ালে দাগ তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে… আর তখনই ক্যামেরার এক কোণায় একটা ছায়া দেখা গেছে — দাঁড়ানো, এক পা একটু সামনে, মাথা নিচু… কিন্তু মুখ দেখা যায়নি।
এইবার সোহমের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হয় — হোস্টেলের মধ্যে কিছু আছে। এবং সেটা যে কেবল নিছক ভয় দেখানোর জন্য নয়, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই লাল হস্তাক্ষরের শেষ লাইনে —
“আমি এখনো এখানেই আছি।”
–
পরদিন সকালে হোস্টেলের খাবার ঘরে ভিড় কম ছিল, কিন্তু টেবিলের আড়ালে বসে সোহম, তুষার আর রাহুল নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। আগের রাতের সেই কাগজের টুকরো, দেওয়ালে ফুটে ওঠা হাতের ছাপ, আর ক্যামেরায় দেখা ছায়ামূর্তি—সব মিলিয়ে এবার আর মজা বা দুঃস্বপ্ন বলে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। রাহুলের চোখের নিচে কালি, ঘুম হয়নি রাতে একটুও। তুষার যদিও মোবাইলে ভিডিওর রেকর্ডিংটা কয়েকবার প্লে করে, নিজের মতো করে ‘এডিটিং গ্লিচ’ বলে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু ওর কণ্ঠে আর স্বরে আত্মবিশ্বাসের অভাব স্পষ্ট। আর সোহম— সে যেন এই রহস্যে একেবারে তলিয়ে গিয়েছে। সে মনে মনে ঠিক করে, এখন আর বসে থাকা চলবে না।
দুপুরবেলা লাইব্রেরিতে ঢুকে পুরনো নথিপত্র খুঁজতে শুরু করে সোহম। কলেজ ম্যাগাজিন, হোস্টেলের পুরনো রেজিস্টার, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের তালিকা, এমনকি দশ বছরের পুরনো ফটোর অ্যালবাম—সব ঘেঁটে বের করতে থাকে কোনও সূত্র। তখনই লাইব্রেরির এক কোণে ধুলো জমা একটা রেজিস্টার খুঁজে পায় সে। সেটি ছিল হোস্টেলের বোর্ডারদের নাম ও কক্ষ নম্বর সংক্রান্ত পুরনো তালিকা। ২০১৯ সালের পাতায় এসে চোখ আটকে যায় একটি নামে — “নীলাঞ্জন সেন, রুম নম্বর ৩”। পাশে লেখা — “ছাত্র নিখোঁজ — তদন্ত চলেছে।” তারিখ দেওয়া ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০। ঠিক নিচেই হাতে লেখা একটা ছোট্ট মন্তব্য — “ঘরটি তালাবদ্ধ, বিশেষ অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ নিষেধ।” সোহম শিউরে ওঠে। নামটা যেন বাতাসের মধ্যে কেমন ভারী হয়ে থাকে — নীলু।
সেদিন সন্ধেবেলা, সোহম সাহস করে অনিরুদ্ধর ঘরে গিয়ে বসে। “দাদা,” সে বলে, “আপনি কি নীলু সম্পর্কে কিছু জানেন?” অনিরুদ্ধ চুপ করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ায়। হালকা গলায় বলে, “তুমি তো জানতেই চাইবে একদিন। তো শোনো। নীলাঞ্জন সেন, বা নীলু, ২০১৯ সালের শেষদিকে হোস্টেলে উঠেছিল। রেজাল্ট ভালো, শান্ত স্বভাব, তবে খুব একটা মিশুক ছিল না। ও থাকত রুম নম্বর ৩-এ — ও ঘরটা তখন সাধারণ ঘরের মতোই ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ছেলেরা খেয়াল করে ও মাঝরাতে কার সঙ্গে যেন কথা বলে, দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। আমরা ভাবতাম মানসিক সমস্যা। একদিন হঠাৎ করেই, সকালবেলায়, নীলু হোস্টেল থেকে উধাও হয়ে যায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। আমরা যখন দরজা ভেঙে ঢুকি, দেখি ঘরে কেউ নেই, শুধু বিছানার চাদরে লালচে রঙের ছোপ, আর একটা ছেঁড়া কাগজ — তাতে লেখা, ‘আমি থাকব, কিন্তু চোখে পড়ব না।’ সেইদিন থেকে ঘরটা বন্ধ করে দেওয়া হয়।” অনিরুদ্ধ থামে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “মজার বিষয় জানো? এরপর থেকে প্রতি বছর ঠিক ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাতে কিছু একটা হয় ও ঘরের সামনে — কখনো আলোর ঝলকানি, কখনো শব্দ, কখনো দরজা খুলে যাওয়া। কেউ কিছুর প্রমাণ পায়নি, কিন্তু কেউ ও ঘরের সামনে দাঁড়ায়ও না।”
সোহম স্তব্ধ হয়ে যায়। এতদিন সে ভূতের গল্প শুনেছে মজা করে, ভয় পেয়ে। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে, হোস্টেলের অন্ধকার করিডোরে শুধু গল্পের ছায়া ঘোরে না — অতীতও পা টিপে টিপে হেঁটে বেড়ায়। রাহুল ও তুষারকে নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, আর কিছু অপেক্ষা নয় — এবার ৩ নম্বর ঘরের তালা ভেঙে সেখানে ঢোকা দরকার। সত্যি যাই হোক, তারা দেখতে চায়, “নীলু” ছিল একটা নাম, না কি সেই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য উপস্থিতি, যে এখনো অপেক্ষা করে, বছরের পর বছর… ঠিক সেই পুরনো কাঠের দরজার আড়ালে।
–
সোহমের ভিতরে এখন আর ভয় নয়—বরং উত্তেজনা কাজ করছিল। অনিরুদ্ধের মুখে শোনা সেই নীলুর রহস্যময় উধাও হয়ে যাওয়ার গল্প, রেজিস্টারে লেখা “ছাত্র নিখোঁজ”, ঘরের বাইরে দেওয়ালে লালচে হাতের ছাপ, মাঝরাতে হাসির শব্দ আর সেই ছায়ামূর্তি—সব কিছু যেন একসাথে মাথার ভেতর শব্দ করে চলছিল। রাহুল একবার সাফ জানিয়ে দেয়, “আমি এসবের মধ্যে নেই ভাই! আমি ভিজিটর হয়ে থাকব, তোমরা যা খুশি করো!” কিন্তু তুষার, যাকে যতই হাসি-ঠাট্টার ছেলে মনে করা হোক, এবার যেন একটু সেরিয়াস হয়েছে। ও বলল, “সত্যিই যদি কিছু থাকে, সেটা রেকর্ডে আনতে পারলে চ্যানেল খুলে ভাইরাল হতে পারব, বুঝলি?” সোহম কড়া গলায় বলল, “ভাইরাল হবার জন্য নয়, সত্যিটা জানতেই হবে। ভূত থাকলে থাকুক, না থাকলে না থাকুক। কিন্তু ৩ নম্বর ঘরের দরজা এবার খুলতেই হবে।”
তাদের পরিকল্পনা ছিল একেবারে নির্দিষ্ট—রাত ১টার সময় তারা তিনজন মিলে হোস্টেলের করিডোরে গিয়ে ৩ নম্বর ঘরের তালা ভাঙবে। সোহম লাইব্রেরি থেকে একটা পুরনো স্ক্রু ড্রাইভার এনেছে, তুষার এক্সট্রা ব্যাটারির সঙ্গে ক্যামেরা চার্জ করে তৈরি রেখেছে, আর রাহুল—তাকে বোঝাতে শেষ পর্যন্ত হোস্টেলের পুজোর পুরোহিত থেকে একটা গঙ্গাজল ভর্তি বোতল এনে রাখা হয়েছে। “এটা মাথায় ঢেলে যদি ভূত না ছুটে যায়, তবে কিছুতেই যাবে না,” বলেছিল রাহুল। রাত ১২টা ৫৫ মিনিট—তারা তিনজন ধীরে ধীরে করিডোরে এগিয়ে যায়। চারপাশ নীরব। সবাই ঘুমিয়ে। শুধু হালকা বাতাসের শব্দ আর মাঝে মাঝে টিকটিকির ডাকে রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছে। হোস্টেলের আলো তখনো জ্বলছে, কিন্তু ৩ নম্বর ঘরের সামনের আলোটা বারবার ফ্লিকার করছে, যেন সে নিজেই ঠিক করে নিচ্ছে কখন জ্বলে থাকবে আর কখন নিভবে।
তাদের তিনজনের মধ্যে সোহমই প্রথম এগিয়ে গিয়ে তালার সামনে দাঁড়ায়। তালাটা অনেক পুরনো—ধুলো জমে আছে, মরচে পড়েছে। একটা ঘূর্ণি দিয়ে সে তালা খুলে ফেলতে চায়, কিন্তু তালা নিজের ইচ্ছায় যেন টনটন শব্দ করে নড়ে ওঠে। রাহুল গলা কাঁপিয়ে বলে, “ভাই… তালা যদি নিজে থেকেই খুলে যায়, তখন আমায় ডেকো না, আমি নিচে নামব।” কিন্তু তালাটা শেষ পর্যন্ত সোহমের হাতেই খুলে যায়। দরজা খুলতেই এক ঝাঁক গন্ধ বেরিয়ে আসে—পুরনো, স্যাঁতসেঁতে, মরা কাঠ আর কিছুর পোড়া গন্ধের মিশ্রণ। ঘরের ভেতর অন্ধকার। তুষার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকে। তিনটে খাট, একটা ভাঙা টেবিল, আর দেয়ালে একটা পুরনো ক্যালেন্ডার—২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসে আটকে আছে। টেবিলের ওপরে একটা নোটবুক, যার পাতা আধা ছেঁড়া। সোহম সেটা খুলে দেখতে যায়, আর সেই সময়েই হঠাৎ টেবিলের পাশের চেয়ারটা আওয়াজ করে সরে যায় একাই। রাহুল চিৎকার করে ওঠে, “আমি বলেছিলাম! আমি বলেছিলাম!” এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের লাইট নিজে থেকে জ্বলে ওঠে।
এক ঝলকে দেয়ালের এক কোণায় ছোপ ছোপ লাল দাগ চোখে পড়ে—যা দেখে মনে হয় কেউ হাত রেখে উঠে গিয়েছে। নোটবুকের প্রথম পাতায় লেখা—“যদি আমি না ফিরি, জেনে রেখো, আমি এখনো এখানে আছি। দেখবে আমাকে—কিন্তু ছুঁতে পারবে না।” সোহম ও বাকিরা সেই লেখা পড়তেই, হঠাৎ দরজার দিক থেকে একটা দমকা বাতাস ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে যায় প্রবল শব্দে। ঘরের আলো নিভে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলের আলোও নিভে গেছে। শুধু শোনা যায় — টুকটাক শব্দ… যেন কেউ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে। কেউ যেন হাঁটছে রুমের ভেতর, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এমন মুহূর্তে রাহুল হঠাৎ তার গঙ্গাজলের বোতল ছুঁড়ে মারে বাতাসে। অদ্ভুতভাবে তখনই আলো আবার জ্বলে ওঠে, দরজাও খুলে যায় ধীরে ধীরে। তিনজন এক দৌড়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঘরের বাইরে এসে রাহুল বলল, “আমি না বলেছিলাম না তোদের… ও এখানে আছে… আমি দেখেছি ছায়া… আমি শুনেছি ওর গলা!”
তাদের কেউ কেউ বলতে পারছিল না আসলে কী ঘটেছিল—ভয়? অলীক কল্পনা? নাকি বাস্তব? কিন্তু সোহম ঠিক করল, এখানেই থেমে যাওয়া যাবে না। ৩ নম্বর ঘর যে কিছু লুকিয়ে রেখেছে, সেটা নিশ্চিত। এবার দরকার, সেই লুকোনো সত্যিটাকে সামনে নিয়ে আসা। এবং এর একমাত্র উপায়—নীলুর অতীতকে খুঁজে বার করা। কে ছিল সে? কেন হারিয়ে গেল? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—আজও কেন সে ফিরে ফিরে আসে?
–
৩ নম্বর ঘরের সেই রাতের অভিজ্ঞতা যেন তিনজনের মনেই গভীর এক ছায়া ফেলে গেল। পরদিন সকালবেলা মুখ থমথমে করে চা খাচ্ছিল সোহম, তুষার আর রাহুল। চা-ওয়ালাও তাকিয়ে বলল, “কি রে, কাল রাতে জ্বর এসেছিল নাকি তিনজনের?” তুষার তার স্বভাবসুলভ হেসে জবাব দিলেও মুখে সেই হাসির আলো ছিল না। একে একে অনেক কথা আলোচনায় এল—সে রাতের দরজা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া, আলো নিভে যাওয়া, নিঃশ্বাসের শব্দ, আর সেই ছায়ামূর্তি যেটা রাহুল দেখেছে। তুষার বিশ্বাস করতে পারছিল না পুরোটা, কিন্তু ক্যামেরায় ধরা পড়া ছায়া, চেয়ারের নাড়াচাড়া, নোটবুকে লেখা—সবকিছুই যেন একটা অদৃশ্য যুক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল ওদের।
এইসব চিন্তা মাথায় নিয়ে সোহম সোজা হোস্টেলের ওয়ার্ডেন ম্যাডাম “মীরা সেন”-এর অফিসে গেল। তিনি একজন কড়া, গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা যাকে ছাত্ররা আড়ালে ডাকে “মিস হিমালয়”। ঘরে ঢুকতেই মীরা ম্যাডাম তাকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ সোহম, কী ব্যাপার?” সোহম সরাসরি বলল, “ম্যাম, আমরা কাল রাতে ৩ নম্বর ঘরে গিয়েছিলাম। আমরা… মানে কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। আমি জানতে চাই… সত্যিই কি ওই ঘরে কেউ মারা গিয়েছিল?” ম্যাডাম প্রথমে চুপ করে রইলেন, চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকালেন। তারপর ধীরে বলে উঠলেন, “তোমাদের কেউ কিছু বলেছে?” সোহম মাথা নাড়ল। মীরা ম্যাডাম একটু থেমে, গলা নামিয়ে বললেন, “নীলাঞ্জন সেন, হ্যাঁ… সে এখানে থাকত। খুব ভালো ছেলে ছিল। মেধাবী, ভদ্র। কিন্তু ওর কিছু মানসিক সমস্যা ছিল। পরিবারের সাথে তেমন যোগাযোগও রাখত না। আমি জানতাম ও মাঝেমধ্যে কথা বলত একা একা, কাগজে লেখালেখি করত অদ্ভুত সব কথা। আমরা একবার ওকে সাইকোলজিস্টের কাছে পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও রাজি হয়নি।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মীরা ম্যাডাম আবার বললেন, “সেই রাতে… ওর রুম বন্ধ ছিল। কিন্তু সকালে খুলে দেখি ও নেই। ঘরে শুধু ওর ডায়েরি আর একটা উল্টে পড়া চেয়ার ছিল। পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কিছুই পায়নি। অনেকেই ভাবে ও আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু…” ম্যাডাম হঠাৎ থেমে গেলেন। “কিন্তু?” — জিজ্ঞেস করল সোহম। ম্যাডাম মুখ ঘুরিয়ে শুধু বললেন, “কিছু কিছু রাত এমন হয়, যখন মনে হয়, কেউ হয়তো এখনও হাঁটছে করিডোরে… কিন্তু সেটা কি আসলেই কেউ, নাকি আমার কল্পনা, সেটা আজও জানি না।”
ওয়ার্ডেনের কথায় সোহমের মনের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়ে গেল। হোস্টেলের এই পুরনো দালানে সত্যিই কিছু আছে। কিন্তু সে কি সত্যিকারের আত্মা? নাকি নীলুর মানসিক সমস্যার কোনো অবশিষ্ট ছায়া? তার মস্তিষ্কে এখন এই রহস্যের ছক কষা শুরু হয়ে গেল। সেদিন রাতে তারা তিনজনে আর হোস্টেলের মধ্যে চুপ করে ঘুমোল না। বরং সোহম নিজের ডায়েরিতে সব লিখতে লাগল — ঠিক যেন নীলুর লেখা ডায়েরির উত্তর দিতে চাইছে। রাহুল একদিকে মন্ত্রপাঠ করছিল, আর তুষার হেডফোন কানে দিয়ে ইউটিউবে সার্চ করছিল — “ঘোস্ট হান্টিং ফর স্টুডেন্টস – ফ্রি ভার্সন”। কিন্তু এমন সময় রাত ১টা ৩৪ মিনিটে আবার এক নতুন ঘটনা ঘটল — তাদের ঘরের দরজার নিচ দিয়ে ধীরে ধীরে আবার এক টুকরো কাগজ গড়িয়ে এল।
সোহম দ্রুত কাগজটা তুলে নিল। এবার সেখানে লেখা ছিল এক সরল কিন্তু কাঁপা হাতে লেখা লাইন —
“যদি পাগল হতাম, তাহলে কি তুমি আমাকে দেখতে পেতে?”
তারা তিনজন একসাথে কাগজটা পড়ল, তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে একে অপরের দিকে তাকাল।
রাহুল ফিসফিস করে বলল, “এবার আমি সিরিয়াসলি বলছি, আমি কালীঘাটে যাচ্ছি কাল। ওখানে মা কালীকে বলব — হোস্টেল ছাড়ার বর চাই।”
সোহম জানত, এটা আর শুধু ভয় পাওয়ার জিনিস নয় — এটা এখন একটা বাস্তব তদন্ত, যেটার মূল কোথাও একটা গভীরভাবে লুকিয়ে আছে। আর সেটা বের করতেই হবে।
পাগল না ভূত? সত্যিই কি নীলু বেঁচে নেই? নাকি সে এখনও… হোস্টেলের অন্ধকার করিডোরে… ঘুরে বেড়াচ্ছে চুপচাপ?
–
সোহম, তুষার ও রাহুল — তিনজনেই এখন জানে, তারা এমন এক জালে জড়িয়ে গেছে যার গা ছমছমে রেশ শুধু অলৌকিকতায় আটকে নেই; বরং এর ভিতরে আছে মানসিক চাপ, অতীতের চাপা ইতিহাস আর এক রহস্যময় ছেলের জীবন, যাকে সবাই চিনত ‘নীলু’ নামে। আগের রাতের সেই কাগজে লেখা কথাটা — “যদি পাগল হতাম, তাহলে কি তুমি আমাকে দেখতে পেতে?” — এই একটি লাইন যেন নীলুর অস্তিত্বের ব্যথা আর অস্তিত্বের প্রমাণ একইসঙ্গে বলে দেয়।
সোহম ঠিক করল, এবার পুরনো ফাইল নয় — ওর দরকার নীলুর নিজের লেখা ডায়েরি। ওটা যেভাবে হোক খুঁজে বের করতেই হবে। লাইব্রেরির বৃদ্ধ কর্মচারী মৃণাল কাকুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারল, হোস্টেল থেকে যেসব ছাত্র নিখোঁজ হয় বা মারা যায়, তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কলেজের “রক্ষণাগার” ঘরে সিল করে রাখা থাকে কিছুদিন। জায়গাটা মূল বিল্ডিংয়ের পিছনে এক পুরনো ঘরে — কলেজ স্টোররুম। দরজায় তালা, ধুলো জমা, আর কেউ কখনও যেতে চায় না। দুপুরের ক্লাস শেষে সোহম আর তুষার সেই ঘরে গিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। ঘরের ভেতর শেলফ ভর্তি পুরনো কাগজ, ফাইল, ছেঁড়া ব্যাগ, ছাত্রীদের পুরনো প্রজেক্ট ফাইল, ধুলো ধূসরিত খবরের কাগজ। হঠাৎ এক কোণায়, লাল কাপড়ে মোড়া একটি বাক্সের উপর লেখা দেখতে পায় — “Room No. 3 — N. Sen”। তারা বুক ধুকপুক করতে করতে বাক্সটা টেনে বের করে।
বাক্স খুলতেই ভেতরে ছিল একটা পুরনো, নীল রঙের ডায়েরি — নীলুর হাতের লেখা। পাতা ওল্টাতেই নীলুর মনোজগৎ যেন প্রকাশ পেতে শুরু করল। প্রথমদিকের লেখাগুলো ছিল সাধারণ — কলেজ জীবন, নতুন বন্ধুরা, হোস্টেলের খাবার কেমন, বই পড়ার অভ্যাস এসব। কিন্তু কয়েক পাতা পরে লেখাগুলো ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক হতে শুরু করে।
“রাত বাড়লেই দরজার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে।”
“আমার খাটের নিচ থেকে কেউ নিশ্বাস ফেলে।”
“আমি কথা বলি ওর সঙ্গে… ও আমাকে বোঝে। কিন্তু কেউ দেখছে না।”
“ও বলে, আমি থাকব… কিন্তু কেউ আমাকে ছুঁতে পারবে না।”
ডায়েরির শেষ পাতায় একটা শব্দ লিখে রেখেছে সে বারবার করে — “আছি… আছি… আছি…”
এই ডায়েরি যেন তার অস্তিত্বের প্রমাণ। তার ভয়, বন্ধুত্ব, অব্যক্ত যন্ত্রণা — সবই লুকিয়ে আছে এই পাতাগুলোর মাঝে। সোহম ধীরে ধীরে পাতাগুলো গুটিয়ে ফেলল। ও জানে, এই জিনিস এখন প্রকাশ্যে আনা উচিত নয়। কিন্তু এখন যতটা স্পষ্ট, নীলু পাগল ছিল না। অন্তত সে যেমন অনুভব করত, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সেই রাতে তিনজন আবার একসাথে নিজেদের ঘরে বসে ডায়েরির লেখা নিয়ে আলোচনা করছিল। হঠাৎ হোস্টেলের ঘণ্টা বেজে উঠল — রাত ২টা। সোহম উঠে জানালার কাচ সরাল — বাইরে করিডোরে কেউ নেই। কিন্তু তখন হঠাৎ করেই করিডোরের লাইটগুলো একে একে নিভতে শুরু করল। একটা… দুইটা… তিনটা… ধীরে ধীরে, যেন কারও নির্দেশে। রাহুল তো চিৎকারই করে উঠল, “এই সব হরর সিনেমার সিন আমি মেনে নিতে পারছি না রে!” তুষার আবার মোবাইল ক্যামেরা অন করে দরজার দিকে তাক করল। আর ঠিক তখনই — দরজার বাইরে স্পষ্ট করে ভেসে এল সেই মিহি মেয়েলি গলা —
“আমার কথা কেউ বুঝত না… কিন্তু তুমরা বুঝছ।”
ঘরের ভিতর শীতল হাওয়া ঢুকে পড়ল, দরজা একটু একটু খুলে গেল নিজের থেকেই, আর দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি — মাথা নিচু, চুল সামনে ঝুলে, দু’হাত ঝুলে আছে পাশে, পায়ের আঙুল খালি, আর গায়ে একটা পুরনো হোস্টেলের জামা। মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু শরীরটা একেবারে নিথর। সোহম ধীরে ধীরে ক্যামেরা তুলে ধরল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়ামূর্তিটা হঠাৎ গলিত হয়ে গেল এক ধোঁয়ার মতো… মিলিয়ে গেল বাতাসে।
তিনজন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এই প্রথমবার ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে আর তর্ক রইল না। ভয় আর উত্তেজনার মাঝেও একটা প্রশ্ন তখনও ঝুলে রইল বাতাসে—
নীলু কি মরেনি? নাকি সে এখনও বাঁচতে চাইছে… কারও শরীরের মধ্যে দিয়ে ফিরে আসতে?
এই হোস্টেল কি কেবল একটা থাকার জায়গা? নাকি এটা এমন একটা জায়গা — যেখানে অতীত জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে… নিষিদ্ধ রাতের গন্ধ মেখে?
–
রাত পেরিয়ে সকাল হল, কিন্তু সেই ছায়ামূর্তির উপস্থিতি যেন ঘুমের ঘোরে থেকেও পিছু ছাড়ল না। রাহুল রাতের পর থেকেই একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছে। বারবার ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে — যেন ভেতরে কেউ বসে আছে কিনা বুঝতে চাইছে। তুষার যতই মজার ভিডিও এডিট করতে বসে, ঠিক ২ মিনিট পর পর পিছনে তাকায়, মোবাইলের ক্যামেরার রিফ্লেকশনে কেউ থাকছে কিনা খেয়াল করে। আর সোহম — সে যেন এক নীরব অনুসন্ধানীর ভূমিকায় ঢুকে গেছে। ও বুঝে গেছে, ব্যাপারটা কেবল ‘ভূত’ বা ‘ভয়’ নয় — এটা অনেক গভীর, অনেক জটিল কিছু।
ডায়েরির শেষ পাতায় “আছি… আছি…” কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। সোহম ভাবছিল, “যদি কেউ নিজেকে অস্তিত্বহীন ভাবত, তবে কি সে আয়নাকে ভয় পেত না?” সেদিন বিকেলে সে হোস্টেলের পুরনো কমন বাথরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় — যেটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। সেখানে একটা ছেঁড়া আয়না আছে — মাঝখান দিয়ে ফাটল। ফ্রেমে মরচে জমে গিয়েছে, তবু কিছুটা রিফ্লেকশন ধরে রাখে। সোহম নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে আয়নায়। ঠিক তখন, পাশে হেঁটে যাওয়া এক সিনিয়র হেসে বলল, “আরে ভাই, নিজের প্রেমে পড়লি নাকি?” সোহম হাসল না। সে উত্তর দিল, “প্রেম নয় দাদা… ভয়।”
সেই রাতে আবার করিডোরে হালকা শব্দ শোনা যায় — এবার যেন হাঁটার নয়, বরং কাঁচে হাত বোলানোর মতো শব্দ। তারা তিনজন আবার তৈরি — এবার ক্যামেরা ছাড়াও সোহম একটা পুরনো আয়না রেখে দেয় ঘরের দরজার পাশে, এমনভাবে যাতে করিডোরের প্রতিবিম্ব তাতে পড়ে। ঘড়ির কাঁটা রাত ২টায় পৌঁছোতেই সেই আয়নায় এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল — কেউ করিডোরে দাঁড়িয়ে, কিন্তু দরজার বাইরে তাকালে কিছু নেই। ঠিক তখনই আয়নাটার গায়ে ভেসে উঠল আঙুল দিয়ে আঁকা একটি শব্দ —
“আমি”
তাদের হৃদকম্পন বেড়ে গেল। আয়নার সামনে একটাও মানুষ নেই, কিন্তু গায়ে লেখা হয়ে গেল সেই শব্দ — “আমি”। আয়নার চারপাশে জল জমে উঠল, যেন কেউ হাত ভিজিয়ে লিখে দিয়েছে। রাহুল ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল — “ভাই, এবার আমি পটল তুলতে চলেছি! আমাকে মা দুর্গার মন্দিরে পাঠিয়ে দাও প্লিজ!” কিন্তু ঠিক তখনই আয়নায় ধীরে ধীরে আরেকটি শব্দ যুক্ত হল সেই “আমি”-র পাশে —
“আমি ছিলাম”
এই লেখাটা দেখে সোহম বলল, “ও চাইছে আমরা বুঝি, ও নিখোঁজ হয়নি, মরে গেছে। কিন্তু সে অস্তিত্ব রেখে গেছে।” সেই মুহূর্তে আয়নার মধ্যেই দেখা গেল — একটা মুখ, তীব্র চোখ, লালচে গাল, আর তীক্ষ্ণ এক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা… নীলু! তবে সেটা এক সেকেন্ডের জন্য। তারপরই আয়না ফাটল আর শব্দ করে চুরমার হয়ে গেল। গা শিউরে উঠল রাহুলের — “ভাই, ও আমার শরীরে ঢুকবে না তো? আমি কিন্তু ওর মতো মোবাইল ফেলে ঘুরে বেড়াতে পারব না!” তুষার হেসে ফেলল, “তুইও তো রিল বানাস… ভূতের রিল বানাবি, হোস্টেল থেকে লাইভ!”
কিন্তু সোহমের মাথায় তখন অন্য চিন্তা। তার মনে হলো, নীলুর আত্মা শুধু তাদের সামনে প্রমাণ দিতে চাইছে না — সে কিছু বলতে চাইছে। কিছু এমন, যেটা কেউ শুনতে চায়নি।
তাদের ঘরের দেওয়ালে পরদিন সকালে দেখা গেল এক লাল দাগ — লেখা একটাই লাইন, যেন কেউ নিজের হাত দিয়ে লিখেছে:
“তোমরা আমায় শেষবার দেখো… তারপর আমি চলে যাব।”
এই ঘটনার পর হোস্টেলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে — “রুম ৩ আবার খুলেছে”, “আয়নার মধ্যে নাকি এক ছেলে থাকে”, “রাত দুটোয় গলায় ফিসফিস করে কেউ ডাকে” — কিন্তু সেই রাতের পর আর নীলুর ছায়া দেখা যায়নি। আয়না ভেঙে যায়, দরজাটা বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে, আর সেই পুরনো নোটবুকের পাতা আর নড়েনি।
তবুও… সোহম জানে, নীলু চলে যায়নি। সে ছিল, সে আছে, শুধু হয়তো এখন আর করিডোরে হাঁটে না…
বরং আয়নার ভিতরে, অথবা স্মৃতির অলিগলিতে…
চুপচাপ থেকে যায়।
–
সোহম, তুষার ও রাহুল — এই তিনজনের জীবনে হোস্টেল আর “নীলু” এখন শুধুমাত্র ভূতের গল্প নয়, বরং এক জটিল মানসিক ও আত্মিক অনুসন্ধানের নাম। আয়নার ভিতরে সেই মুখ, দেওয়ালে লেখা বার্তা আর প্রতিটি মধ্যরাতের অদ্ভুত উপস্হিতি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে — কিছু সত্য লুকানো থাকে শুধু অন্ধকারে নয়, সমাজের নীরবতাতেও।
সোহম ঠিক করে, এইবার সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে নীলুর পরিবারের খোঁজ করতেই হবে। কলেজের পুরনো ভর্তি ফর্ম থেকে সে পায় একটা ঠিকানা — বরাহনগর, কলকাতা ৭০০০৩৬। ওদের ছুটির দিন ছিল শুক্রবার, সেদিন তিনজন মিলে রওনা দিল। ব্যাগে ক্যামেরা, নোটবুকের কপি আর সেই ছেঁড়া আয়নার একটা টুকরো, যা এখনও সোহম বাঁচিয়ে রেখেছে। একটা সময়ের পর বরাহনগরের পুরনো গলিতে তারা পৌঁছায়, দেখে বাড়িটা এখন প্রায় পরিত্যক্ত — এক বৃদ্ধা থাকেন শুধু, যিনি জানান তিনিই নীলুর ঠাকুমা।
তিনি প্রথমে কথা বলতে চাননি, বললেন, “তোমরা আবার আমার পোতার নাম নিয়ে এসেছো কেন রে? অনেক কষ্টে ভুলে থাকতে পারছিলাম।” কিন্তু সোহম নম্রভাবে নীলুর ডায়েরির পাতা দেখিয়ে বলল, “ওর শেষ কটা কথা… কেবল আপনি আর আমরা জানি। আপনি বলুন, সত্যি কী হয়েছিল ওর সঙ্গে?”
বৃদ্ধা একটু থেমে, চোখে জল নিয়ে বলতে শুরু করলেন —
“নীলু ছোট থেকেই একটু অন্যরকম ছিল। খুব ভালো ছবি আঁকত, লেখালিখি করত। কিন্তু কারও সঙ্গে তেমন কথা বলত না। বাবা-মা ছিল না, আমিই মানুষ করেছিলাম। একসময় কলেজে উঠল, হোস্টেলে থাকত। মাঝে মাঝে চিঠি লিখত আমাকে। শেষের দিকে চিঠিগুলো ভীষণ অদ্ভুত ছিল — ‘আমি কারো সাথে কথা বলি, কিন্তু ওর নাম নেই’, ‘আমার মাথার ভেতরে কেউ থাকে’, ‘আমি আর আমি নেই’ — এসব লেখে। আমি ভয় পেয়ে কলেজে গিয়েছিলাম ওকে দেখতে। কিন্তু ছেলেরা বলল ও খুব চুপচাপ, খারাপ কিছু করে না। ওর বন্ধুরা কেউ ওর ঘরে যেত না।”
তিনি হঠাৎ থামলেন, চোখ মুছলেন। তারপর ধীরে বললেন,
“শেষ চিঠিটা আমি এখনও রেখে দিয়েছি। ও বলেছিল — ‘ঠাম্মি, আমি হারিয়ে গেলে ভয় পেও না। আমি চলে যাব, কিন্তু আমার শব্দগুলো থেকে যাবে।’”
চিঠিটা কাঁপা হাতে বের করলেন তিনি। সেখানে স্পষ্ট হাতে লেখা ছিল —
“আমার মাথার ভিতরের লোকটা বলছে, আমি যদি একবার হারিয়ে যাই, তাহলে সবাই আমায় দেখতে পাবে। কিন্তু তখন আর কেউ ডাকবে না। কারণ আমি থাকব, শুধু মানুষ হয়ে নয়।”
রাহুল বলল, “মানে… ওর মাথার ভিতরে কেউ ছিল?”
সোহম বলল, “মানে নীলু স্কিৎজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ছিল হয়তো। কিন্তু সেই একাকীত্ব, সেই মানসিক বিচ্ছিন্নতা… ও যা লিখে গেছে, তা কেবল ‘রোগ’ বললে ছোট করা হয়।”
তুষার ফিসফিস করে বলল, “ভাই, তাহলে যেটা আমরা দেখছিলাম… ও কি নিজের কল্পনার মধ্যেই তৈরি হয়েছিল?”
সোহম চুপ করে রইল। উত্তর হয়তো নেই।
তারা বৃদ্ধার থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলো হোস্টেলে। ৩ নম্বর ঘর তখনও তালা বন্ধ। কিন্তু রাত্রি নামতেই, দরজার নিচ দিয়ে আবার এক টুকরো কাগজ গড়িয়ে এল।
তাতে লেখা —
“তোমরা ওকে খুঁজেছ, এখন আমি ঘুমোতে পারি।”
পরদিন ৩ নম্বর ঘরের দরজা খুলে দেখা গেল — ঘর ফাঁকা। দেয়ালে কোনও লাল দাগ নেই, খাটের নিচে কোনও ছায়া নেই, আয়নার ফাটল যেন নিজে থেকে মেরামত হয়ে গেছে। এমন শান্ত একটা ঘর, যেন কোনওদিন কিছুই ঘটেনি। রাহুল হাঁপ ছেড়ে বলল, “ভাই, ও ঘুমিয়ে পড়েছে মানে এখন আবার ঘুম না ভাঙায় যেন থাকে!”
তুষার হেসে বলল, “ভূতের হোস্টেল এখন কি ‘শান্ত হোস্টেল’ হয়ে গেল?”
সোহম জানত — সত্যি ভূত নেই, থাকতে পারে না হয়তো। কিন্তু নীলু ছিল, ওর ব্যথা ছিল, আর সেই ব্যথা অন্ধকার ঘরে, আয়নার ছায়ায়, দেওয়ালের ফিসফিসে থেকে গিয়েছিল… যতদিন না কেউ ওকে দেখতে চেয়েছিল।
–
সন্ধ্যা নেমেছে হোস্টেলে। পাখির ডাক থেমে গেছে, করিডোরে বাতি জ্বলছে নিয়মমতো। ৩ নম্বর ঘরের দরজাটা আজ খোলা, জানালা দিয়ে হালকা হাওয়া ঢুকছে। রাহুল, তুষার আর সোহম একসাথে বসে আছে ঘরের ভিতর — কোনও ভয় নেই, কোনও ব্যাখ্যার খোঁজ নেই — শুধু এক নিঃশব্দ শ্রদ্ধা এক ছেলেকে ঘিরে, যে কোনওদিন হিরো হয়নি, তবু এক অপূর্ব সত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সোহম আজ ডায়েরির শেষ পাতাটা আবার পড়ল। সাদা কাগজ, কোনও লেখা নেই। তবু যেন সেখানে একটা উপস্থিতি আছে। সে নিচু গলায় বলে,
“নীলু, তোর গল্পটা আমরা শুনেছি। এবার তুই শান্তিতে থাক।”
রাহুল হঠাৎ বলল, “ভাই, একটা কথা বলি?”
তুষার: “এই আবার ভূতের নতুন সংস্করণ শোনাবি?”
রাহুল মাথা নেড়ে বলল, “না রে, সিরিয়াসলি… যদি একটা মানুষকে কেউ না বোঝে, যদি তার একাকীত্ব কেউ না শোনে, তাহলে সেই মানুষটা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যায় না?”
সোহম চুপ করে বলল, “হয়তো যায়… কিন্তু যদি কেউ ওর ডায়েরি পড়ে, ওর লেখা বোঝে, ওকে খুঁজে ফেরে, তাহলে সে মানুষটা আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসে।”
তুষার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভূতের হোস্টেলটা এবার মেমোরি হোস্টেল হয়ে গেল রে ভাই।”
তারা তিনজন উঠল। দরজা বন্ধ করল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল। ঘরের এক কোণে যেন আলো একটু বেশি উজ্জ্বল ছিল, আর সেই আলোয় চোখে পড়ল — দেয়ালে পেনসিল দিয়ে লেখা একটা শব্দ —
“ধন্যবাদ।”
তারা আর কিছু বলল না। শুধু হাঁটতে হাঁটতে করিডোরে এসে দাঁড়াল। হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্ররা তখন টিভির সামনে, কেউ মোবাইলে ব্যস্ত, কেউ পড়ার টেবিলে। কিন্তু তারা জানত — এই হোস্টেল শুধু লোহার খাট, আলমারি, আর দেয়াল দিয়ে তৈরি নয় — এই হোস্টেল জুড়ে ছড়িয়ে আছে কারও শূন্যতা, কারও না বলা কথা, আর কয়েকটা এমন রাত, যা শুধু গা ছমছম করে না, মনটাও নরম করে দেয়।
তারপর দিন, রেজিস্ট্রার অফিস থেকে ঘোষণা আসে — “রুম ৩ আবার নতুন ছাত্রদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।”
তুষার বলল, “যারা থাকবে, তারা বুঝতেই পারবে না, কতকিছু ঘটে গেছিল এই ঘরটায়।”
রাহুল হাসল, “হয়তো ভূত আবার রুম সার্ভিসে ফিরবে রে!”
তিনজনের মুখে হাসি ছিল, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন একটা ঘন নীরবতা কাজ করছিল — সেই ছায়া, সেই গলা, সেই আয়নার শব্দ, আর সেই মানুষটা — নীলু।
তাদের জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হল। তবে…
প্রতি বছর, ঠিক ১৭ই ফেব্রুয়ারি, রাত ২টা বাজলে — করিডোরের বাতিগুলো একটু কাঁপে।
আর কখনও যদি আয়নার ধারে কুয়াশা জমে, যদি দেওয়ালে পেনসিল দিয়ে আঁকা কোনও শব্দ দেখা যায় —
তাহলে জেনে নিও, নীলু এখনও আছে।
***
				
	
	


