Bangla - ভূতের গল্প

ভূতের প্রেমে চার পাগল

Spread the love

রক্তিম জানা


বাড়িটা একটু বেশিই ঠান্ডা

বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই চারজন দাঁড়িয়ে ছিল পাণ্ডুগ্রামের পুরনো ‘সিংহবাড়ি’র সামনে। সাদা রঙের ছোপ ছোপ দেয়াল, বড় বড় কাঠের জানালা, আর ছাদের কিনারা দিয়ে বেয়ে নামা আগাছা দেখে মনে হচ্ছিল বাড়িটা কাঁদছে।

“এই বাড়িতেই না তোর মামাবাড়ি ছিল, বুদু?”— প্রশ্ন করল চঞ্চল, যার চশমার কাঁচের পেছন থেকে সবসময় একটা অবিশ্বাস ফুটে বেরোয়।

“হ্যাঁ রে… কিন্তু তোরা জানিস না, আমার মামারা কেন এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে গেল,”— গলায় অদ্ভুত এক থমথমে ভাব এনে বলল বুদু।

“ভূতের গল্প করিস না,”— বলল তোতন, যার বুকের মধ্যে বাঘ থাকলেও পোকা দেখলে চেঁচিয়ে উঠে।

“ভূত হলে তো মজা, আমাদের নতুন গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাবে,”— হেসে উঠল সোমা, যার ভাষা ও মুখ কখনো একরকম নয়।

চার বন্ধু— বুদু, চঞ্চল, তোতন আর সোমা— কলেজে থিসিস করতে এসে এই ভাঙাচোরা বাড়ি বেছে নিয়েছে, কারণ এখানে ‘ভাড়া লাগে না’। বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা মানেই গরিব ছাত্রদের স্বর্গ।

বাড়ির মূল দরজা ছিল ধাতব লোহার, হাত দিলে ঠান্ডা লাগে, যেন বরফে হাত দিচ্ছ। সোমা দড়াম করে দরজাটা খুলল। একটা কাঁকড়ানো শব্দ হল, যেন কেউ ভেতর থেকে বিরক্ত হয়ে বলল, “ধীরে কর, হে!”

ঘরে ঢুকে ওরা সবাই থমকে দাঁড়াল। বাড়িটা সত্যিই অদ্ভুত। দেয়ালে পুরনো ছবি, কাঠের মেঝে, আর কোণায় একটা সেলাই মেশিন— সবকিছু মিলিয়ে যেন সময় থেমে আছে।

“আমি ডান পাশের ঘরটা নেব,”— তোতন হঠাৎ জোর গলায় বলল।

“না না! জানিসই তো, ওই ঘরেই নাকি একবার একটা মেয়ের আত্মা দেখা গিয়েছিল,”— বলল বুদু চোখ গোল করে।

“তাই বলিস! তাহলে আমি সেই ঘরটাই নেব!”— বলল সোমা, “মেয়ে ভূতের প্রেমে পড়তে চাই, রে!”

সবাই হেসে উঠল। তবে তোতন মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমার ঘর জানলার পাশে চাই। আর একটা কথা, রাতে কেউ আমার পাশে আসবি না, ঘুম ভেঙে গেলে আমি নিজেকে ভূত ভেবে নিজেকেই মেরে ফেলতে পারি।”

রাত নামল ধীরে ধীরে। অন্ধকারে বাড়িটা আরও ভয়ানক দেখাচ্ছিল। চঞ্চল নিজের ব্যাগ থেকে ল্যাম্প বার করে ঘরের মাঝখানে রাখল। আলোটা মৃদু মৃদু জ্বলছে, যেন ভূতের সঙ্গে রোমান্স করার উপযুক্ত পরিবেশ।

বুদু একটা পুরনো আলমারি খুলে দেখল— ভেতরে একজোড়া লাল শাড়ি রাখা, আর পাশে পুরনো একটা কাঁচের বোতলে কিছু শুকনো গোলাপ।

“ভাই রে, কেউ কি এখানে এখনও থাকে?”— ফিসফিস করে বলল চঞ্চল।

“মালিকের নাতনি ছিল, নাম ছিল মাধবীলতা। সবাই বলে ওর আত্মা এই বাড়িতে ঘোরে,”— বুদু গম্ভীর গলায় বলল, যেন ভূতের এজেন্ট।

রাত বাড়ল। তোতন ঘুমিয়ে পড়েছে। বুদু আর চঞ্চল একসঙ্গে তাস খেলছে। হঠাৎ, রান্নাঘর থেকে একটা শব্দ এল— টুং!

“কে গেল রান্নাঘরে?”— চঞ্চল ধপ করে উঠে দাঁড়াল।

“আমি তো না,”— বলল বুদু।

“আমি তো একঘণ্টা আগে মরে গেছি,”— হেসে বলল সোমা, “এইবার ভূত নিজে এসে বলুক ওনার পরিচয়!”

তিনজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনল। আবার একটা শব্দ— এ বার মনে হল কিসে যেন ঝাঁকুনি দিল।

“আসছি রে!”— সোমা বলে হাঁটতে শুরু করল রান্নাঘরের দিকে।

তখনই হঠাৎ বাতাস যেন ভারি হয়ে গেল। রান্নাঘরের দরজা হালকা ফাঁক, আর ওদের চোখের সামনে, দরজার ফাঁক দিয়ে যেন একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু, চুল খোলা, হাত দুটো পাশে ঝুলে আছে।

“ভূত!”— তোতন হঠাৎ চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

“দাঁড়া দাঁড়া দাঁড়া!”— বলল সোমা। সে আগাল সেই মেয়েটার দিকে।

মেয়েটি মাথা তুলল। একজোড়া গভীর চোখ। তাতে ভয় নেই, বরং একরাশ বিষণ্ণতা।

“তুমি কে?”— সোমা জিজ্ঞেস করল।

“আমি মাধবীলতা… এই বাড়ির মেয়ে…”— মেয়েটি ধীরে ধীরে বলল।

চঞ্চল আর বুদু তখন পেছনে লুকিয়ে আছে সোফার পাশে। তোতন বাইরের বাগানে গিয়ে গাছকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সোমা আর মাধবীলতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।

মাধবীলতার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। সে বলল, “তোমাদের ভয় পেতে বলিনি। আমি শুধু একা থাকতে থাকতে ক্লান্ত। কেউ যদি… কথা বলে…”

সোমা হেসে ফেলল। “তুমি ঠিক জায়গায় এসেছো। আমরা চারজনের মধ্যে অন্তত একজন তোমাকে ভালোবেসে ফেলবই। আমি সেই একজন হতে পারি না?”

মাধবীলতা তাকিয়ে রইল… আর গল্পটা এখানেই শুরু হল।

 ভয় আর প্রেমের মাঝখানে

বাড়ির বাতাসটা যেন হঠাৎ একটু গাঢ় হয়ে গেল। যেন স্যান্ডেল কাঠের সুগন্ধের সঙ্গে মিশে আছে অদ্ভুত এক ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সোমা আর মাধবীলতা— একজন জীবিত, অন্যজন… হয়তো না। কিন্তু দৃশ্যটা এতটাই শান্ত, যেন কোনও রোমান্টিক সিনেমার দৃশ্যের মতো।

“তুমি কি প্রতিদিন এখানে আসো?”— জিজ্ঞেস করল সোমা, আরেকটা পদক্ষেপ নিল সামনের দিকে।

“না, শুধু তখনই আসি, যখন কেউ… মন দিয়ে শুনতে চায়।” মাধবীলতার কণ্ঠ ছিল মিঠে, তবু যেন তার প্রতিটি শব্দ বয়ে আনে পুরনো কোনও দীর্ঘশ্বাস।

বুদু, চঞ্চল আর তোতন তখন অন্য ঘরে, গলা নামিয়ে আলোচনা করছে।

“দেখলি তো! ভূত একেবারে লাইভ!”— চঞ্চল চোখ বড় করে বলল।

“তবে খুব সুন্দর ভূত, তাই না?”— বলল বুদু, “মানে… মাধবীলতা তো গল্পে যে ছিল ঠিক সেই রকম।”

“এই সোমার মাথা গেছে রে! ভূতের সঙ্গে রসিকতা করছে!”— তোতন এখনও কাঁপছে।

এদিকে, রান্নাঘরে সোমা বলছে, “তুমি ভয় পাওনি আমাকে দেখে?”

“ভয়? না। কারণ যারা ভয় পায়, তারা আমায় দেখে না। তুমি সাহসী। তুমি হাসো, কথা বলো… আর, জানি না কেন, তোমাকে দেখে আমার অতীতটা মনে পড়ে যায়।”

“তোমার অতীত? মানে?”— সোমার কণ্ঠে কৌতূহল।

“আমি এই বাড়ির মেয়েই ছিলাম। ১৯৫৩ সালের দুর্গাপুজোর সময় হঠাৎ… আমার মৃত্যু হয়। সবাই ভাবে দুর্ঘটনা। কিন্তু…” মাধবীলতার চোখে ঝিকমিক করে উঠল, যেন অতীতের আগুনে আবার জ্বলে উঠেছে কিছু।

“কিন্তু?”— সোমা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।

“আমি মরিনি… আমাকে মারা হয়েছিল।” কণ্ঠটা এবার যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। রান্নাঘরের জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল হালকা করে।

সেই মুহূর্তে হুট করে বুদু দৌড়ে এসে বলল, “সোমা! তুই পাগল! ও ভূত! ও কিছু একটা করে বসবে!”

সোমা হেসে ফেলল, “চুপ বুদু! ও আমায় কিচ্ছু করেনি। বরং তোদের থেকেও বেশি সভ্য। আর ওর গল্পটা শুনছিস?”

মাধবীলতা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল হাওয়ার সঙ্গে। “তোমরা থাকো। আমি আবার আসব… কাল রাতে। কিন্তু আমার কথা কাউকে বলো না… বিশেষ করে এই বাড়ির মালিককে না।”

সেদিন রাতের বাকি সময়টা চারজন ছাদের রেলিঙে বসে কাঁথা মুড়ে কাটাল। কেউ হাসছিল, কেউ ভাবছিল, কেউ একটু একটু করে ভূতের প্রেমে পড়ছিল। বিশেষত সোমা।

“সোনা রে,”— হঠাৎ তোতন বলল, “তুই যদি সত্যিই ভূতের প্রেমে পড়িস, তাহলে তো তোদের রিসেপশনে আমরা সবাই দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকব!”

“তবে রিসেপশন ক্যান্ডল লাইটে হবে,”— বলল চঞ্চল, “আর খাবার থাকবে নিরামিষ, কারণ প্রাণী মারলে তো তোমার হবু বউ রাগ করবে!”

“ভয় পেয়েছিলাম প্রথমে,”— বলল বুদু, “কিন্তু সত্যি বলতে, মাধবীলতার চোখে যা ছিল, সেটা কোনও ভূতের চোখে হয় না। খুব জীবন্ত, খুব দুঃখী।”

“ভূতেরও তো অনুভূতি থাকতে পারে, তাই না?”— বলল সোমা, হালকা হেসে।

তারপর সবাই একে একে ঘরে চলে গেল, শুধু সোমা একা ছাদে থেকে গেল। তার মনে হল, হাওয়ার মধ্যে কোনও শব্দ আসছে, মাধবীলতার কণ্ঠে—
“ভালো থেকো… আমি আসব… তোমার জন্যই…”

টিনের ছাদ আর টিপসই চিঠি

সকালে উঠেই বুদু বাথরুম থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “কে আমার সাবান দিয়ে শ্যাম্পু করেছে রে!”

চঞ্চল ফিক করে হেসে বলল, “ভূত বৌ তোকে স্নান করিয়ে দিয়েছে, বুঝে নিস!”

সোমা তখনও ঘুমিয়ে। আসলে ঘুমিয়ে নয়—সে চুপচাপ জানালার পাশে বসে ছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরের নারকেল গাছগুলো আর এক টুকরো রোদে ভেসে থাকা একজোড়া পাখির গল্প। কিন্তু সোমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল অন্য কথা—মাধবীলতা।

গত রাতের কথোপকথন তার ভেতরে গেঁথে গেছে। ভূতের চোখে এতটা দুঃখ! আর তার কথা বলার ভঙ্গি, সেই পলক না ফেলা চাহনি—এটা কি সত্যিই ভয় পাওয়ার মতো?

চঞ্চল এদিকে বুদুর পাশে বসে ঘনঘন কফি খাচ্ছিল। “দেখ, আমার মনে হচ্ছে ও মাধবীলতা ভূত নয়, ভূতের মতো অভিনয় করছে। হয়তো এই বাড়ির পুরনো মালিকদের কেউ, যে নাটক করে আমাদের ভয় দেখাতে চায়।”

“তাহলে এত বছর কেউ এখানে এল না কেন?”— বলল তোতন। “আর আমার জানলায় যে লাল ফুল ফোটে, সেটাও কি কেউ ফটোশপ করেছে?”

সেই সময়, সোমা উঠে এসে বলল, “কাল রাতে ও বলেছিল, ওকে কেউ খুন করেছিল। বাড়ির মালিকের নাম কিছু বলেছিল না, কিন্তু ওর ভয়—আমরা যেন তাকে কিছু না বলি।”

চঞ্চল ফিসফিস করে বলল, “এই বাড়ির মালিক তো খোকনবাবু। পাণ্ডুগ্রামের সবাই ওকে ভয় পায়। লোকটা নিজেই অদ্ভুত। বিশাল দাড়ি, গলা খাঁকারি দিয়ে কথা বলে। আর বলেও না, ফোঁস করে ফিসফিস করে।”

সেই সময় দরজার নিচে কিছু একটা ঠক করে পড়ে গেল।

তোতন দৌড়ে গিয়ে সেটা তুলল—একটা সাদা কাগজ। খোলার পর দেখা গেল সেটা একটা হাতে লেখা চিঠি—

“আমার গল্প তোমাদের জানাতে চাই।
আজ রাত বারোটায় ছাদের টিনের নিচে এসো।
একটা গোপন কথা বলব।
– মাধবীলতা”

“গল্প?”— চঞ্চল চোখ কুঁচকে বলল।

“রোমান্স!”— ফিসফিস করে বলল সোমা।

“খুন!”— আতঙ্কে বলে উঠল বুদু।

“চলো যাওয়া যাক,”— বলল তোতন, “যা আছে কপালে।”

রাত বারোটায় চারজন ছাদের টিনের নিচে দাঁড়িয়ে। আকাশে হালকা মেঘ, চাঁদ অর্ধেক, যেন ভূতের চেহারায় প্রাকৃতিক স্পটলাইট। হঠাৎ ঠাণ্ডা হাওয়া এসে টিনের ছাদ কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। একটা সাদা আলো এসে পড়ল তাদের সামনে—আর সেই আলোর মাঝখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল মাধবীলতা।

আজ তার চেহারায় একটু অন্যরকম চঞ্চলতা। কপালে লাল টিপ, ঠোঁটে গোলাপি হাসি, আর গলায় একটা ছোট্ট মুক্তোর মালা।

“তোমরা এসেছো… খুব ভালো করেছো।” তার গলায় যেন শুকনো হাওয়া আর একটা পুরনো লজেন্সের সুবাস।

“তুমি বলেছিলে তোমায় খুন করা হয়েছিল?”— সাহস করে বলল বুদু।

“হ্যাঁ,”— বলল মাধবীলতা। “আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল গ্রামের মোড়লের ছেলের সঙ্গে। আমি রাজি ছিলাম না। আমি ভালোবাসতাম আমাদের বাড়ির চাকর ধনঞ্জয়কে। একদিন সেটা জানাজানি হয়ে যায়। সেই রাতেই আমি… ছাদের টিনের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম… যেমন এখন দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কেউ আমাকে ঠেলে ফেলে দেয় নিচে।”

সোমার গলা শুকিয়ে গেল। “তুমি কি জানো কে করেছিল?”

মাধবীলতা চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তখন ধনঞ্জয়কেও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর বাড়ির লোকেরা বলে দেয়, আমি দুর্ঘটনায় মারা গেছি। কিন্তু… আমার আত্মা জানে কে আমার মৃত্যু চেয়েছিল।”

তোতন ফিসফিস করে বলল, “ভাই রে, CSI খুলে গেছে!”

মাধবীলতা আবার বলল, “আমার একটাই ইচ্ছা—যে আমাকে ঠেকাতে চেয়েছিল ভালোবাসা থেকে, আমি যেন তাকে সামনে দাঁড় করাতে পারি। আর তোমরা আমাকে সেই সাহস দাও।”

চঞ্চল তড়িৎ করে বলে ফেলল, “তাহলে তদন্ত শুরু হোক! ভূত-পাচার নয়, এবার ভূতের পক্ষেই বিচার!”

মাধবীলতা হেসে ফেলল। তার হাসি শুনে কেমন যেন বুকের ভেতর টনটন করে উঠল।

আর সোমা? সে চুপচাপ তাকিয়ে রইল মাধবীলতার চোখে। ওর মনে হল, এই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে না বলা হাজারটা গল্প… আর হয়তো, একটা প্রেমও।

ভূতের কেস খুলল আদালত!

সকালের আলোয় যখন চারজন একসঙ্গে রান্নাঘরের ডালপুরি-আলুর দম গিলছিল, তখন তাদের কথা শুধুই একটা—মাধবীলতার খুন! ভূত যদি সত্যিই বলে, তাহলে সেই খুনটা ছিল পরিকল্পিত।

“আমরা তাহলে কী?”— বলল বুদু, “ভূতের গোয়েন্দা?”

“না রে,”— হেসে উঠল চঞ্চল, “আমরা ভূতের বন্ধু। এবার আমরা প্রমাণ খুঁজব যে ওকে খুন করা হয়েছিল।”

“শুনছো সোমা?”— বলল তোতন। “তোর প্রেমিকা কিন্তু মিশন দিয়েছে। সাফল্য পেলে, রিসেপশনে আমায় মাইক্রোফোন ধরার কাজটা দিস।”

সোমা হালকা হেসে বলল, “ও শুধু একটা বিচার চায়। আমি যদি ওকে ভালোবাসি—তাহলে সেটা ওর প্রতি সম্মান দেখানোই হয়, তাই না?”

চঞ্চল বইয়ের খাতায় একটা কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “তাহলে আমাদের দরকার তথ্য। বাড়ির ইতিহাস, পরিবারের খোঁজ, ধনঞ্জয়ের খোঁজ… আর সবচেয়ে বড় কথা, কারা তখন বাড়িতে ছিল।”

বুদু বলল, “এই সিংহবাড়ির পুরনো কেয়ারটেকার এখনও থাকে পাশের গ্রামে। নাম মোহনলাল। ওকে পাওয়া গেলে অনেক কিছু জানা যাবে।”

বিকেলেই ওরা বাইসাইকেলে চেপে গেল পাশের ‘চাঁদপাড়া’ গ্রামে, যেখানে মোহনলাল থাকেন। কুঁড়েঘরের সামনে বুড়ো লোকটা বসে চা খাচ্ছিল।

“চাচা, আপনি তো সিংহবাড়িতে কাজ করতেন?”— চঞ্চল বিনীতভাবে প্রশ্ন করল।

“হুঁ, অনেক বছর… মালিকের বাবার সময় থেকে।”

“মাধবীলতার কথা মনে আছে?”— বুদু হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল।

মোহনলাল হঠাৎ চুপ মেরে গেল। তার চোখদুটো ঘোলা হয়ে এল।

“সে মেয়ে… শান্ত, স্নিগ্ধ। আর ভালোবাসতো ধনঞ্জয়কে। কিন্তু মালিকের ছেলের লোভ… মেনে নেয়নি সে।”

“আপনার কি মনে হয়, তাকে কেউ খুন করেছিল?”— সোমা সামনে এগিয়ে এল।

“সেটা তো কেউ বলতে চায় না। সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছে। কিন্তু আমি দেখেছিলাম, একদিন সন্ধ্যেবেলা মাধবীলতা ধনঞ্জয়ের হাতে একটা খাম দিচ্ছিল। তারপর… ধনঞ্জয় হারিয়ে গেল, আর পরদিন জানা গেল মাধবীলতা ছাদ থেকে পড়ে গেছে।”

“খাম?”— সবাই একসঙ্গে বলল।

“হ্যাঁ। বলা হয় ওটা ছিল একটা চিঠি—ভবিষ্যতের জন্য লেখা কিছু কথা। হয়তো কারো নামে কিছু ছিল… আমি জানি না।”

ফেরার সময় চঞ্চল বলল, “তাহলে এই খামটাই আমাদের ক্লু!”

“আর ধনঞ্জয়?”— বলল তোতন।

“ধনঞ্জয় এখন কোথায় থাকে, জানেন?”— সোমা চাচাকে জিজ্ঞেস করল।

চাচা বললেন, “শেষবার খবর এসেছিল উনি শ্মশানঘাটের পাশে একটা হর্ম্যর মতো ঘরে থাকেন, নিরালায়। কেউ যায় না ওদিকটায়।”

সেদিন রাতেই তারা ফিরে এসে ছাদে অপেক্ষা করল মাধবীলতার জন্য। যথারীতি, সে এল। আজ তার পরনে হালকা সবুজ শাড়ি, আর হাতে একটা গোলাপ ফুল।

“তোমরা কিছু জানতে পেরেছো?”— মাধবীলতা ফিসফিস করে বলল।

সোমা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “তোমার দেওয়া সেই খামের কথা মোহনলাল কাকা বলেছে। কী ছিল তাতে?”

মাধবীলতা একটু থেমে বলল, “আমার লেখা… আমার ভয়, আমার প্রেম, আর… আমার মৃত্যুর কারণ। আমি জানতাম ওরা আমায় মারতে পারে। সেইজন্যই চিঠিটা ধনঞ্জয়কে দিয়েছিলাম, যেন সত্যিটা কখনও না হারায়।”

চঞ্চল উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল, “তাহলে আমরা খুঁজে বের করব সেই চিঠি! কালই যাব ধনঞ্জয়ের খোঁজে!”

মাধবীলতার চোখে একটা গভীর কৃতজ্ঞতা ভেসে উঠল। কিন্তু সে শুধু বলল, “সাবধানে থেকো… কারণ যারা তখন আমাকে মারতে চেয়েছিল, তারা আজও আছে…”

এই বলে সে মিলিয়ে গেল রাতের বাতাসে।

চার বন্ধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এ যেন আর মজার অ্যাডভেঞ্চার নয়, এ যেন কোনও পুরনো বিচারসভা আবার খুলে যাচ্ছে… ভূতের প্রেম থেকে শুরু করে সত্যের আদালত!

শ্মশানঘাটের ঘরে গোপন চিঠি

সকালটা যেন একটু বেশি নিস্তব্ধ। চারজন রুটি-সুজি মুখে দিয়েও যেন ঠিক গিলতে পারছিল না। বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাচ্ছিল। কারণ আজ তাদের গন্তব্য—শ্মশানঘাটের পাশে সেই হর্ম্যঘর, যেখানে থাকে মাধবীলতার প্রাক্তন প্রেমিক ধনঞ্জয়।

“তোরা নিশ্চিত তো?”— তোতন একটু কাঁপা গলায় বলল, “ভূতের প্রেমের জন্য আমি শ্মশানে যাচ্ছি! এই কথা আমার মা শুনলে আমার পিণ্ড দিয়ে দেবে।”

“ভয় পাচ্ছিস?”— চঞ্চল হাসল, “তাহলে ভূতের সঙ্গে প্রেম করার লাইসেন্স বাতিল!”

সোমা মাথা নিচু করে বলল, “ধনঞ্জয় যদি এখনও সেই চিঠি রাখে, তাহলে সব রহস্য খুলে যাবে।”

বিকেলবেলা ওরা চারজন পৌঁছাল পাণ্ডুগ্রামের পাশের ছোট্ট একটা গলি ধরে একজোড়া বড় গাছের ছায়ায়। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ছেঁড়া বেড়া ঘেরা একটা ছোট টিনের ঘর। দরজার পাশে লটকে আছে একটা ঘোলা লণ্ঠন।

ধীরে ধীরে তারা দরজায় টোকা দিল।

একটু পর দরজাটা খুলল এক বৃদ্ধ—দু’চোখে ক্লান্তি, মুখে এক অদ্ভুত হালকা হাসি, আর হাতে একটা কাঠের লাঠি।

“আপনার নাম ধনঞ্জয়?”— চঞ্চল জিজ্ঞেস করতেই বৃদ্ধ থমকে গেল।

“হ্যাঁ… তোমরা কে?”— কণ্ঠে ধোঁয়াসা একটা সতর্কতা।

সোমা সামনে এগিয়ে এসে বলল, “আমরা সিংহবাড়িতে আছি কিছুদিন। মাধবীলতার… আত্মা এখনও ওখানে আছে।”

এই কথা শুনে ধনঞ্জয়ের চোখ দুটো ভিজে উঠল।

“ও এখনও… আছে?”— সে ফিসফিস করে বলল, যেন নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে লড়ছে।

“হ্যাঁ,”— এবার বুদু বলল, “আর ও আমাদের বলেছে, আপনি ওকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। আপনি সেটা এখনও রেখেছেন?”

ধনঞ্জয় ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকল। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে সে একটা ছোট কাঠের বাক্স দিল সোমার হাতে।

“এই বাক্সে ওর চিঠি রেখেছিলাম। কখনও খোলার সাহস হয়নি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সময় এসেছে।”

বাক্সটা খুলতেই সবাই নিঃশ্বাস চেপে ধরল। ভিতরে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া খাম, যার ওপরে লেখা—
“যদি আমি আর না থাকি—তবে এই চিঠি আমার হয়ে কথা বলবে।”

চঞ্চল খামটা খুলল। ভিতরে একটা দুই পাতার চিঠি।

সোমা পড়ে শোনাতে লাগল—
“আমি মাধবীলতা, এই চিঠি লিখছি জানার পরেও, যে আমি হয়তো আগামী পূর্ণিমা দেখব না। আমি ভালোবাসি ধনঞ্জয়কে। কিন্তু আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে মদনলালর সঙ্গে, আমাদের জমিদার পরিবারের বড় ছেলের সঙ্গে। আমি তাঁকে বিয়ে করতে চাই না। আমার মা আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবার গর্জনে থেমে গিয়েছিলেন।
আমি overheard করেছিলাম—এক রাতে, আমার বাবা আর মদনলাল মিলে বলছিলেন, ‘ও যদি কথা না শোনে, ঠেলে ফেলতে হবে।’
আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু ভাবিনি সত্যিই শেষ হয়ে যাব এক ছাদের কিনারায়। যদি আমি মারা যাই, জানবেন এটা দুর্ঘটনা নয়—এটা খুন। আমার প্রেমে আমার প্রাণ গিয়েছিল।”

বাকিদের যেন গলা শুকিয়ে গেল। চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিল—

“যদি কোনওদিন কেউ এসে এই সত্যি প্রকাশ করে, আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব… কারণ প্রেম মরলেও, ভালোবাসা ন্যায় চায়।”

ধনঞ্জয়ের চোখ ভিজে গিয়েছিল। সে বলল, “আমি কিচ্ছু করতে পারিনি… সাহস ছিল না। আজ এতদিন পরে, তুমিই সাহস দিয়েছো। ও যদি এখনও থাকে… ওর জন্য আমি আদালতে যেতে রাজি।”

তোতন বলল, “ভাইরে, ভূতের প্রেম এমন জিনিস—মানুষকেও সত্যি বানিয়ে ফেলে।”

সেদিন রাতে তারা চারজন ছাদে মাধবীলতার জন্য অপেক্ষা করল, হাতে সেই চিঠি।

বাতাসে একটা আলো ফুটে উঠল। মাধবীলতা ধীরে ধীরে ভেসে উঠল, চোখে জল… আর ঠোঁটে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

“চিঠিটা… এখনও আছে? ধনঞ্জয় কী বলেছে?”— তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল।

সোমা এগিয়ে গিয়ে তার দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিল।

মাধবীলতা চিঠির দিকে তাকিয়ে রইল… আর তারপর ধীরে ধীরে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার গাল বেয়ে… অদৃশ্য বাতাসে মিলিয়ে গেল… কিন্তু সেই চোখে ছিল প্রশান্তি।

আর সেই রাতে, প্রথমবার, সিংহবাড়ির বাতাসে কেউ ভয়ের বদলে ভালোবাসার ঘ্রাণ পেল।

ভূতের প্রেম, পাড়ার শোরগোল আর পুলিশের প্যাঁচাল

সিংহবাড়ির পর্দা সরতেই পাড়ার কৌতূহলী চোখগুলো জড়ো হয়ে গেল। সকালের কাগজের চায়ের দোকানে খবর রটেছে—
“ভূতের প্রেমে পড়েছে এক ছেলে, আর চার বন্ধু মিলে ভূতের খুনের কেস খুলেছে।”

চঞ্চল বাজার থেকে ফেরার পথে একজন বলল, “এই যে দাদা, ভূতের গার্লফ্রেন্ড কেমন আছে?”

আরেকজন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ভূত কি তাড়াও না, প্রেমও করো?”

চঞ্চল হাসিমুখে বলল, “ভূতের প্রেমে পড়া মানে চিরকালীন সম্পর্ক, ‘তিল মৃত্যু না করো আমাদের আলাদা’—মানে এই মৃত্যুর পরও!”

এদিকে সোমা খোলা জানালার পাশে বসে। হাতে সেই চিঠি, আর মনে ভেসে আছে গত রাতের মাধবীলতার মুখ—অশ্রুসিক্ত, কিন্তু মুক্ত।

বুদু বলল, “চিঠিটা যদি সত্যিই আদালতে যায়, তাহলে মালিকপক্ষের অবস্থা খারাপ। জমিদার মদনলাল আর তার পরিবার এখনও আছে পাণ্ডুগ্রামে।”

“তখন তো মধুরাজবাবু বলেছিল, ওর মৃত্যু দুর্ঘটনা,”— বলল তোতন। “এখন সেটা খুন প্রমাণ হলে, সেটা হবে কলঙ্ক।”

“আর মজার কথা, ভূতের চিঠিই হবে প্রমাণ!”— চঞ্চল হেসে উঠল।

কিন্তু মজা বেশিক্ষণ টিকল না। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই সিংহবাড়িতে হাজির হল দু’জন পোশাক পরা লোক—একজন পুলিশের পোশাকে, আর একজন কালো চশমা পরা সিভিল ড্রেসে।

“তোমরাই কি এই বাড়িতে থাকো?”— পুলিশ বলল।

বুদু একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “জি হ্যাঁ, কিন্তু কেন?”

“তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ভূতের নামে এলাকায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা, মানুষের মনে কুসংস্কার ছড়ানো… আর… জমিদার পরিবারের সম্মানহানি।”

চঞ্চল ফিসফিস করে বলল, “ভাইরে, ভূতের প্রেম এখন ফৌজদারি আইনে পড়ছে!”

পুলিশ অফিসার চিঠিটা দেখতে চাইল। সোমা সেটা সামনে আনল।

চিঠি পড়ার পর সিভিল ড্রেসের লোকটা মুখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে বলল, “ভূতের লেখা চিঠিকে তো আদালত মেনে নেবে না। এটা যদি তোমাদের বানানো হয়?”

সোমা বলল, “তবে ধনঞ্জয়জীর সাক্ষ্য আছে। উনি বলেছেন, বহু বছর আগেই এই চিঠি পেয়েছিলেন।”

ঠিক তখনই দরজায় ধনঞ্জয়ের প্রবেশ। মাথা উঁচু করে বললেন, “এই চিঠি আমি নিজের হাতে নিয়েছি, ওর মৃত্যুর ঠিক আগের রাতে। আমি কাউকে বলতে পারিনি। কিন্তু এখন আমি বলতে চাই। ওর মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল না, পরিকল্পিত খুন ছিল।”

পুলিশ একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, তদন্তে রাখা হবে। তবে তোমরা মিডিয়া-ড্রামা কোরো না, নইলে আইনি ঝামেলা হবে।”

পুলিশ চলে যাওয়ার পর চারজনে হাঁপ ছাড়ল।

“মাথায় টুপি, হাতে রুমাল, মুখে হাসি—ভূতের কেসে পুলিশও এখন থতমত!”— বলল চঞ্চল।

“ভাই রে, ভূতের সঙ্গে প্রেম করতে গেলে প্রেমের টেস্ট দিতে হয়,”— বলল তোতন।

রাতে ছাদে মাধবীলতা এল না। বাতাসটা যেন একটু চুপচাপ। সোমা জানে, এখন শুরু হয়েছে একটা নতুন অধ্যায়। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু কোথাও যেন বুকের ভেতরে একটা শূন্যতা।

সে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“তুমি কোথায় মাধবী? আজ এলেনা কেন?”

বাতাসে হালকা ফিসফিসানি ভেসে আসে—
“আমি আছি… তোমাদের আশেপাশেই… কিন্তু এখন কথা কম, অপেক্ষা বেশি।”

সেই মুহূর্তে হঠাৎ পেছন থেকে চঞ্চল বলে ওঠে, “ভাই, আজ রাতে ভূতের বদলে পাড়ার দু’টো মেয়ে খোঁজ নিচ্ছিল, ‘যে ভূতের প্রেমে পড়েছে, তার ফোন নম্বর কত?’ বল!”

সোমা হেসে ফেলল। মনে মনে বলল—
“যদি সত্যিই প্রেম হয়… তবে সে ভূতের হলেও, অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করব না।”

আদালতের চৌকাঠে ভূতের কাহিনি

পাণ্ডুগ্রাম পঞ্চায়েত ভবনের বাইরে আজ এক অদ্ভুত দৃশ্য। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে চার বন্ধু—চঞ্চল, তোতন, বুদু আর সোমা। পাশে ধনঞ্জয়। আর তাদের হাতে, যত্ন করে রাখা একটা হলুদ খাম, যার ভেতরে রয়েছে এক মৃত মানুষের কণ্ঠ—মাধবীলতার চিঠি।

“তোরা ভেবেছিস?”— তোতন ফিসফিস করে বলল, “এটা কি আদৌ কেউ বিশ্বাস করবে? ভূতের লেখা চিঠি!”

চঞ্চল বলল, “ভাই, সিংহবাড়ি যদি না থাকত, এই প্রেম হতো না, আবার এই কেসও হতো না। ভূতের প্রেমেই তো আসল সত্যি বেরিয়ে আসছে!”

ধনঞ্জয় শান্ত গলায় বলল, “আমি সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। এত বছর চুপ থেকেছি, এখন আর নয়।”

পঞ্চায়েত অফিসের ছোট্ট ঘরে হাজির হয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার, একদল গ্রামবাসী আর জমিদার পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরি মদনলালের ছোট ভাই—মধুরাজ ঘোষাল।

মধুরাজ ঢুকে সোজা বলল, “ভূতের কথা নিয়ে মামলা? এটা কি পুতুলখেলা? এই ছেলে-মেয়েগুলো এলাকাজুড়ে নাটক করছে!”

পাশেই থাকা সোমা মাথা তুলে বলল, “এটা কোনও নাটক নয়। এটা একজন মেয়ে, একজন মানুষ, একজন প্রেমিকার শেষ চিঠি।”

সবার সামনে ধনঞ্জয় দাঁড়িয়ে বলল, “মাধবীলতা আর আমি একে অপরকে ভালোবাসতাম। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আমি নিজে ওর কাছ থেকে এই চিঠি পেয়েছিলাম ওর মৃত্যুর আগের রাতে।”

পঞ্চায়েত সদস্য চশমা নামিয়ে বললেন, “চিঠিটা দিন তো দেখি।”

চঞ্চল এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই চিঠি ওর নিজের হাতে লেখা। তাতে ওর মৃত্যুর দিন, সময়, আর খুনের ইঙ্গিত সব আছে।”

চিঠি পড়ে সবাই স্তব্ধ।

পাশে বসা এক বয়স্ক লোক বলল, “আমি তখন বাড়ির বাবুর্চি ছিলাম। সেদিন রাতে আমি শুনেছিলাম কিছু চেঁচামেচি। কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম বলে কাউকে বলিনি।”

মধুরাজ চেঁচিয়ে উঠল, “এইসব নাটক! ও নিজে আত্মহত্যা করেছিল, আমরা সবাই জানি!”

তখনই পঞ্চায়েত সদস্য বললেন, “কিন্তু এখন চিঠি আছে, সাক্ষী আছে, আর এই অভিযোগ গুরুতর। বিষয়টা থানায় জানানো হবে। নতুন করে তদন্ত শুরু হবে।”

এই ঘোষণা শুনেই পাড়াজুড়ে শোরগোল। কেউ বলছে, “ভূতের কেস এবার থানায়”, কেউ বলছে, “ভূতের প্রেমিকের জবানবন্দি চলবে!”

বাহিরে বেরিয়ে এসে সবাই হাঁফ ছাড়ল। চঞ্চল বলল, “ভাই, এ যেন Netflix সিরিজ চলছে! ভূতের খুন কেস, প্রেমিকের প্রত্যাবর্তন, আর চিঠির চমক!”

তোতন বলল, “শেষে হয়তো কেউ আমাদের বলবে, ‘আপনাদের গল্পের রাইটস আমরা কিনতে চাই।’”

সেই রাতে বাড়িতে ফিরে সোমা ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। তার কণ্ঠে কেবল একটা ফিসফিস:

“তুমি শুনলে তো, মাধবী? আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।”

বাতাসে সেই মিষ্টি গন্ধটা ফিরে এল। আর একটুকরো আলোর মধ্যে মাধবীলতা দেখা দিল।

“ধন্যবাদ… আমি জানি না কীভাবে শোধ দেব… কিন্তু একদিন, কোনও এক জন্মে, তোমার এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেব।”

সোমা হেসে ফেলল। তার চোখে জল, মুখে হাসি—
ভূতের প্রেমেও যদি এতটা সত্য থাকে, তাহলে সেটাই তো সবচেয়ে জীবন্ত প্রেম।

বিয়ে বাড়ি, ভূতের বার্তা আর বন্ধুত্বের বাঁধন

পাণ্ডুগ্রামে আজ সাজ সাজ রব। পাশের বাড়ির রাজু কাকার মেয়ের বিয়ে—তাই চটকদার আলো, বাজনার শব্দ, আর বিরিয়ানির গন্ধে বাতাস ভারী। কিন্তু সিংহবাড়ির চার বন্ধু এই চমক-ধমকের মাঝে একটু আলাদা।

“ভাই, এই বিয়েতে গিয়ে যদি ভূত খেয়ে ফেলে?”— তোতনের আশঙ্কা।

চঞ্চল গম্ভীর হয়ে বলল, “ভূতের প্রেমিক বলে যদি আমায় বরের পাশে বসতে দেয়?”

সোমা একটা গোলাপি পাঞ্জাবি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ওর চোখে এখন আগের মত দুষ্টুমি নেই—বরং একটা নরম আলো, যেন মাধবীলতার ছোঁয়ায় একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে।

বুদু বলল, “তোর চেহারাটা এত মায়াবী লাগছে যে ভয় হচ্ছে—তুইও ভূতে বদলে যাচ্ছিস না তো?”

সোমা হেসে বলল, “ভালোবেসে যে কেউ বদলে যেতে পারে, তুই কবে বুঝবি?”

সন্ধের বিয়েতে চারজনই হাজির হল। হাসি-ঠাট্টা, খাবারের কাউন্টারে ঢল। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও সোমা বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে—কেন যেন মনে হচ্ছে, কেউ দূর থেকে দেখছে।

বিয়ে শেষের ঠিক পরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

সিংহবাড়ির সামনে রাখা একটা মাটির প্রদীপ হঠাৎ নিজে থেকেই জ্বলে উঠল। কেউ দেখল না, কেউ জানল না—কিন্তু সেই আলোয় বাড়ির দেয়ালে ছায়া পড়ে, আর সেই ছায়ায় লেখা ভেসে ওঠে—
“আমি পাশে আছি।”

সেই মুহূর্তে, সোমা ছাদে গিয়ে দাঁড়াল।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে ভেসে উঠল।

“তোমাকে দেখে খুব শান্ত লাগছে আজ,”— বলল সোমা।

“কারণ আজ আমি জানি, আমার কণ্ঠ কেউ শুনেছে। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা… কেউ আমাকে ভালোবেসেছে।” মাধবীলতার চোখে ভেসে উঠল এক স্বর্গীয় হাসি।

“আমি জানি, তুমি ফিরে আসবে না। কিন্তু যদি কোন এক জন্মে… আমরা আবার একসঙ্গে থাকি?”— সোমার গলা কেঁপে উঠল।

মাধবীলতা শুধু বলল, “ভালোবাসা কখনও জন্ম-মৃত্যু মানে না। তুমি আমায় যে ভালোবেসেছো, সেটাই আমার মুক্তি।”

তাদের চারপাশে বাতাস হালকা সোনালি হয়ে উঠল। যেন আত্মার আভা ছড়িয়ে পড়ে গিয়েছে।

তখনই তোতন ছাদে উঠে এসে বলল, “ভাই রে! নিচে দু’জন বলছে, সিংহবাড়ির মেয়ে নাকি ভূতের সঙ্গে ডেট করে!”

চঞ্চলও যোগ দিল, “আর একজন বলেছে—‘আজকাল ভূতেরাও ভালোবাসা বোঝে, শুধু আমার গার্লফ্রেন্ডটাই বেমানান!’”

সবাই হেসে উঠল।

সোমা বলল, “তোমরা জানো তো, বন্ধুরা… এই ক’দিনে আমরা শুধু ভূতের প্রেম নয়, জীবনের সবচেয়ে খাঁটি সত্যিটাও বুঝেছি—যে ভালোবাসা কখনও মরে না, আর বন্ধুত্বই সবচেয়ে বড় সঙ্গী।”

চারজন দাঁড়িয়ে রইল ছাদে—একটা অদ্ভুত আত্মিক নীরবতা, আর একটাই অনুভব:
ভূতের প্রেম, কেস, হাসি-ঠাট্টা সব ছিল… কিন্তু সবথেকে বড় ছিল—একটা অসমাপ্ত গল্পের শেষ বাক্যটা লিখে ফেলা।

শেষরাতের চিঠি আর মাধবীলতার বিদায়লিপি

সিংহবাড়ির আকাশে আজ নতুন চাঁদ নেই, নক্ষত্রও ঝিমিয়ে। কিন্তু বাতাসে এমন এক শান্তি, যেন অনেকদিন পরে কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

রাত বারোটা পেরোতে না পেরোতেই সোমা উঠে এল ছাদে। একটা ছোট খাতায় সে কিছু লিখছিল—নাম না থাকা সেই চিঠি, যেটা কাউকে পাঠানো হবে না। শুধু মাধবীলতাকে মনে রেখে।

“আমার প্রিয় অদৃশ্য প্রেয়সী,” সে লিখছিল, “তোমার ছায়া যেমন জানালায় এসে বসে থাকত, তেমনি তুমিও আমার ভিতরটা দখল করে নিয়েছো। আমি জানি, তোমায় ছোঁয়া যাবে না, রাখা যাবে না… তবু তুমিই আছো আমার চারপাশে।”

ঠিক সেই সময়, এক ঝলক শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেল ওর মুখ। সোমা জানত—সে এসে গেছে।

মাধবীলতা আজ অন্যরকম। তার পরনে সাদা নয়, হালকা মাটির রঙের শাড়ি, আর চোখে এক রকম আলো—যেন মুক্তি আর বিদায়ের একসঙ্গে মিশেল।

“তুমি কী এবার… চলে যাচ্ছ?”— সোমার কণ্ঠে কাঁপন।

মাধবীলতা ধীরে মাথা নাড়ল। “তোমাদের ভালোবাসা, সাহস, বন্ধুত্ব… সব আমার আত্মাকে শান্তি দিয়েছে। আমি আর আটকে নেই, সোমা। আমার সময় শেষ… এবার বিদায়।”

“কিন্তু…” সোমা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার হাতে এক চিঠির মতো কিছু এসে পড়ে—হাওয়ার মতোই হালকা, কিন্তু লেখা আছে কালি দিয়ে।

চিঠিতে লেখা—

“তোমাকে ধন্যবাদ… আমাকে কথা বলতে দিয়েছো, ভালোবাসতে দিয়েছো, বাঁচতে দিয়েছো। এই গল্পটা তোমার, শুধু আমার নয়। আর আমি কথা দিচ্ছি, যদি পৃথিবী নামে কোনও ফেরার ট্রেন থাকে, আমি একদিন ফিরব… অন্য নামে, অন্য রূপে… কিন্তু খুঁজে নেব… তোমাকে।
– মাধবীলতা”

সোমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে বলল, “আমি অপেক্ষা করব। কোনও জন্মে, কোনও সন্ধেয়… আবার আমরা চায়ের কাপের পাশে বসব।”

তখনই বুদু, তোতন আর চঞ্চলও উঠে এলো ছাদে।

চঞ্চল ফিসফিস করে বলল, “শেষবার দেখা করতে এল বুঝি।”

তোতন বলল, “যাবার আগে তো প্রপার বিদায় নিতে হয়।”

মাধবীলতা সবাইকে একবার করে দেখল। চোখে এক বিন্দু জল, তবু হাসি ঠিকরে পড়ছে।

“তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি। আমার জীবনের শেষ সত্যিটুকু তোমরা এনে দিয়েছো। এখন আমি মুক্ত…”

তারপর ধীরে ধীরে সে মিশে গেল আকাশের অন্ধকারে। বাতাসে হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—গোলাপ, মাটি আর ভেজা দুঃখের এক আশ্চর্য মিশেল।

সকালে চারজন মিলে সেই শেষ চিঠিটা একটা কাঁচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে বাড়ির বারান্দায় ঝুলিয়ে দিল।

সেইদিন থেকে, সিংহবাড়ির নাম হয়ে গেল—”ভালোবাসার বাড়ি”। আর কেউ ওখানে ভূতের ভয় পেত না—শুধু বিশ্বাস করত, ভালোবাসা ঠিক একদিন ফিরে আসে, যেকোনও রূপে।

এক কাপ চা, একটা খালি দোলনা, আর এক অমর প্রেমের গল্প

সিংহবাড়ির আঙিনায় বসে চার বন্ধু চা খাচ্ছে। সামনে একটা খালি দোলনা, যেটা এক সময় হালকা বাতাসে দুলত। এখন সে চুপচাপ, স্থির।

সোমা আজ চুপচাপ। মুখে কোনও শব্দ নেই, চোখে সেই একই ছায়া—মাধবীলতার শেষ দেখা চোখ।

চঞ্চল বলল, “তোর প্রেমিকা বিদায় নিয়ে গেছে, কিন্তু তোদের গল্পটা তো এখনও জিইয়ে আছে, বুঝলি?”

তোতন মুখে বিস্কুট গুঁজে বলল, “যদি ও সত্যি বলে থাকে, যে ও একদিন ফিরে আসবে—তাহলে তোকে আবার প্রেমে পড়তে হবে। রেডি রাখিস।”

বুদু হেসে বলল, “এই গল্পটা লিখে ফেলি না কেন? ভূতের সঙ্গে প্রেম, তদন্ত, বন্ধুত্ব, মুক্তি—সবই তো আছে! নাম হোক, ‘ভূতের প্রেমে চার পাগল’। কেমন?”

সোমা হেসে ফেলল, দীর্ঘদিন পর এমন এক হাসি—যেটা নিজের সঙ্গে মিশে যায়, ভিতর থেকে উঠে আসে।

সে বলল, “হ্যাঁ, লিখতেই পারি। শুধু ভূতের গল্প নয়, এটা মানুষের গল্পও—ভালোবাসা, সাহস, বিশ্বাস আর মুক্তির গল্প।”

তখনই হাওয়ায় হালকা একটা আওয়াজ—চেনা সেই হিমেল গন্ধটা, আর দোলনা হঠাৎ একটু দুলে উঠল, একবার, নিঃশব্দে।

চারজন একসঙ্গে তাকাল। কেউ কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল—
ও এখনো আছে।

এরপর অনেক বছর পেরোল। চার বন্ধু চারদিকে ছড়িয়ে গেল, কিন্তু সিংহবাড়ি রয়ে গেল ঠিক আগের মতো। শুধু একটাই পার্থক্য—এখন বাড়িটার নামের ফলকে লেখা আছে:

“ভালোবাসা কখনও মরে না”
– মাধবীলতা ও সোমার স্মৃতিতে”

আর বাড়ির ভেতরে, জানালার পাশে, একটা ছোট দোলনায় মাঝে মাঝে বাতাসে কেউ বসে থাকে—নিভৃতে, নিরালায়। হয়তো সে মাধবীলতা নয়, হয়তো সে কেবল একটা অনুভব—
একটা অমর প্রেম।

আর তখন, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন চায়ের কাপ হাতে ফিসফিস করে বলে—
“তুমি ফিরে এসেছো?”

কোনও উত্তর আসে না।

তবু একটুকরো গোলাপি আলো জানালায় পড়ে। আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক হাসির গল্প—
ভূতের প্রেমে পড়েছিল চার পাগল।

সমাপ্ত

1000024554.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *