Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

ভূতের গলি

Spread the love

অরুণাভ মৈত্র


কলকাতার উত্তর শহর মানেই পুরনো দিনের ছাপ, সময়ের ধুলো জমে থাকা মেঝে, কাঠের জানালার ফাঁকে ঢুকে পড়া রোদের রেখা, আর সেইসব রাস্তা—যেগুলো একসময় কুচকাওয়াজ দেখেছে, আবার অন্যদিকে ত্রাস হয়ে উঠেছে নিঃসঙ্গ রাতে। এমনই এক গলির নাম ‘বটতলা লেন’। নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় বইয়ের পাতা, নাটকের পোস্টার, কিম্বা উনিশ শতকের বিপ্লবীদের গা ঢাকা দেওয়ার কাহিনি। কিন্তু এই গলির ইতিহাস শুধু কাগজে-কলমে নয়—এখানে অলৌকিকতার এক অদৃশ্য ছায়া যেন ছায়ার মতো ঘোরে। লোকে মুখে মুখে বলে, “এই গলিতে কিছু একটা আছে।” কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না কী—কেউ বলে রাত্তিরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর, কেউ বলে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে এক জোড়া চোখ, আবার কেউ সরাসরি বলে—“ওই গলির ভিতর ভূত থাকে।” অথচ পুরসভা কার্ডে এখনও লেখা থাকে—বটতলা লেন। কিন্তু এলাকাবাসী জানে, এ নামটা শুধু মানচিত্রের জন্য, আসল নাম—ভূতের গলি।

ঋদ্ধিমান চৌধুরী একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলকাতার পুরনো অলিগলি, লোককথা, কিংবদন্তি নিয়ে লেখেন। নেহাতই পেশাগত উদ্দেশ্যে নয়, এইসব কাহিনির মধ্যে তার একধরনের রোমাঞ্চকর মগ্নতা আছে। তার বিশ্বাস, প্রতিটি পুরনো গলিরই একটা গল্প আছে, আর সেই গল্পগুলো খুঁড়ে তুলে আনাই যেন তার কাজ। বেশ কিছুদিন ধরেই সে ‘ভূতের গলি’ নামটা শুনছিল, বিশেষ করে এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু একদিন মজার ছলেই বলেছিল—“তুই ভূতের গল্প লিখিস তো? বটতলা লেন চিনিস? ওখানে গিয়ে এক রাত কাটাতে পারলে তোকে আমি সত্যিকারের সাংবাদিক মানব!” সেই চ্যালেঞ্জটা এতটাই হালকা ভাবে বলা হলেও ঋদ্ধিমানের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। তিনি ঠিক করলেন, এই গলিটাই হবে তার পরবর্তী প্রবন্ধের বিষয়। গলির ইতিহাস, পুরনো বাড়িগুলো, সেখানে বসবাসকারী বৃদ্ধ মানুষজন—সব কিছুর মধ্যে থেকেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে এমন কিছু, যা সময়ের গভীরে হারিয়ে গেছে। ভোরবেলায় প্রথমবার সে যখন গলির সামনে দাঁড়ায়, তখনই তার মনে হয়, এখানকার বাতাস অন্যরকম। শব্দহীন, নরম অথচ চাপা টানটান চুপচাপতা। যেন কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই গলির পরিবেশে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য ধরা পড়ে। একদিকে গলির দুই ধারে থাকা দোতলা-তিনতলা বাড়িগুলোর দেওয়ালে জমে থাকা শ্যাওলা, কাঠের দরজা, লোহার কপাট—সব কিছুই যেন সময়কে আটকে রেখেছে। অন্যদিকে, গলির ভিতরটা নিঃশব্দ, অথচ সেই নীরবতায় একটা চাপা শব্দ যেন মিশে থাকে। যেন এক সুদূর অতীত থেকে ভেসে আসে কারও নিঃশ্বাস, কিম্বা কান্না। এক বাড়ির বারান্দা থেকে নিচে ঝুলছে পুরনো এক হলুদ রঙের ঝুড়ি, অন্যদিকে একটা জানালায় অদ্ভুত লাল কাপড় নড়ছে হাওয়ায়, অথচ বাতাস নেই। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেও তারা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়, কেউ কেউ সরাসরি বলে, “ওখানে ঢোকার দরকার কী?” বা “আপনার ওসব লেখা-টেখার জায়গা এটা নয়।” এমনকি পাশের চায়ের দোকানদারও তাকে সতর্ক করে—“বাবু, ওই গলির কথা কেউ এখন আর মুখে আনে না। এক সময় এক ছেলেটা ওখানে মারা যায়… তারপর থেকেই কেমন কেমন যেন… আজকাল তো রান্নার গন্ধও আসে না ওইপাশ থেকে!” ঋদ্ধিমান এসব কথাকে প্রাথমিকভাবে গুজব ভেবেই কাটিয়ে দেন। তবে সে বুঝতে পারে—মানুষ ভয় পায়, আর ভয় যখন দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকে, তখন সেটা গুজব না হয়ে এক সামাজিক চেতনায় রূপ নেয়। সেই চেতনার মধ্যে ঢুকে পড়াটাই এখন তার লক্ষ্য।

একদিন দুপুরবেলায়, ঋদ্ধিমান গলির একপ্রান্তে এক বৃদ্ধের সঙ্গে পরিচয় হয়—বিমল চক্রবর্তী। বয়স ষাটের উপর, কিন্তু চেহারায় এখনও স্থিরতা আছে। বিমলবাবু প্রথমে কথা বলতে চান না, তবে সাংবাদিক পরিচয় শুনে একটু নরম হন। তিনি বলেন, “এই গলিতে অনেক কিছু buried আছে বাবু… শুধু মাটি না, স্মৃতিও।” ধীরে ধীরে ঋদ্ধিমান জানতে পারে, আশির দশকে এই গলিতে এক দুর্ঘটনা ঘটে—এক ছেলের রহস্যময় মৃত্যু, আর তারপর থেকে গলির বাতাসই পালটে যায়। বাড়িগুলো ফাঁকা হতে থাকে, নতুন কেউ ভাড়া নিতে চায় না, পুরনোরা মুখ বুজে দিন গোনে। অথচ কোনো পাকা অভিযোগ, কোনো রিপোর্ট, কিম্বা পুলিশি হস্তক্ষেপ নেই। শুধু একটা আতঙ্ক। এই গলির নামটা তাই আজও কেউ জোরে বলে না, কেউ রাত আটটার পর এর মধ্যে ঢোকে না, আর সবচেয়ে অদ্ভুত—প্রতিটি বাড়ির মূল দরজায় কিছু না কিছু প্রতিরক্ষামূলক প্রতীক ঝুলে থাকে—লাল সুতো, রুদ্রাক্ষ, লেবু-লঙ্কা বা পেঁয়াজ রসুন। যেন গলি নয়, এক অভিশপ্ত পরিধির ভিতর বাস করছে সবাই, কিন্তু সেই গন্ডি কেউ ভাঙতে সাহস পায় না। ঋদ্ধিমান জানে, এখানেই আছে তার লেখার আসল রসদ। সে ঠিক করে, রাতের এই গলি নিজে হেঁটে দেখবে, শোনার চেষ্টা করবে—আসলেই কি কিছু ঘটে? নাকি সবটাই ভয়ের গল্প?

বিমল চক্রবর্তী, বয়স প্রায় সত্তরের কোঠায়, কিন্তু চোখে-মুখে এক অদ্ভুত স্থিরতা। যেন দীর্ঘদিন এক গভীর কিছু দেখে এসেছেন—না বলা কোনো গোপন কথা বুকের ভেতর পাথরের মতো জমে আছে। ঋদ্ধিমান তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা করে এক সন্ধ্যায়, গলির এক কোণে রোদে পোড়া কাঠের বেঞ্চিতে বসে। চারপাশ তখন আধো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে, গলির বাতিগুলো টিম টিম করছে। বিমলবাবু প্রথমে একটু অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু ঋদ্ধিমানের আগ্রহ দেখে ধীরে ধীরে নরম হয়ে ওঠেন। “তুমি লেখো? তাহলে লিখে রেখো—ভয়, ওটা কোনো গল্প না… ওটা একটা জীবন্ত বস্তু,”—এই কথা বলে তিনি ধীরে ধীরে নিজের ঘরের ভেতর থেকে একটা পুরনো চামড়ার বাঁধাই ডায়েরি নিয়ে আসেন। পাতা পোকা কাটা, কিছু জায়গায় কালির ছোপ, আর তার মাঝেই ঠাসা হাতের লেখা। ডায়েরির ওপর প্রথম পাতায় লেখা—”ব্যক্তিগত স্মৃতি: ১৯৭৭—”। বিমলবাবু বললেন, “এইখানে যা লেখা আছে, তার সবটাই ঘটেছে, আমি নিজে চোখে দেখেছি।”

১৯৭৭ সালের বর্ষাকাল, সেই সময় গলিতে বেশ কয়েকটি পরিবার বাস করত। আশপাশের লোকজন মিলে একেবারে ছোট্ট এক সমাজ তৈরি হয়েছিল। বিকেলবেলা ছেলেমেয়েরা খেলত, মায়েরা বারান্দায় বসে গল্প করত, আর পাড়ার মোড়ে এক ভদ্রলোক বেহালা বাজাতেন সন্ধেবেলা। কিন্তু এক রাতে সবকিছু বদলে যায়। ওই বছর আগস্ট মাসের এক রাতে, বিকট চিৎকারে ঘুম ভাঙে গোটা গলির। ছোট্ট এক ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না—নাম ছিল মধু। বয়স হবে আট কি নয়। সন্ধ্যায় সবার সঙ্গে খেলছিল, রাতের খাওয়ার পর খাটে ঘুমিয়ে পড়ে—তারপর নিখোঁজ। বিমলবাবু বললেন, “মধুর বাবা-মা পাগলের মতো ছুটছিল, আমরা সবাই মিলে খুঁজলাম, ছাদ, দোতলা, পুকুরঘাট—কোথাও নেই। ঠিক ভোরবেলা এক বৃদ্ধা বাড়ির পিছনে বাগানে গিয়ে দেখে, এক জায়গায় মাটি ভেজা… আর ওর ছোট্ট হাতটা একটু বাইরে বেরিয়ে আছে।” সেই জায়গাটা আজও খালি পড়ে আছে, সেখানে কেউ গাছও লাগায় না। পুলিশ এল, রিপোর্ট করল, ময়নাতদন্তে বলা হলো—窒息, অর্থাৎ শ্বাসরোধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কে করল? কীভাবে করল? কে ওকে সেই বাগানে টানল? আর সবচেয়ে ভয়ানক—মধুর শরীরে কোনও ঘা ছিল না, কাদামাটি ছাড়া কিছুই না। আর সেই রাতেই শুরু হয় গলির অশান্তি।

মধুর মৃত্যুর এক সপ্তাহের মাথায়, গলির আরও তিনজন লোক উধাও হয়ে যায়। একজন বৃদ্ধ, একজন কিশোর মেয়ে আর একজন অন্ধ ভিক্ষুক। কারোর কোনো খোঁজ মেলেনি আজও। পুলিশ এসে তদন্ত করে, স্থানীয় থানায় রিপোর্ট জমা পড়ে, কিন্তু কিছুই সামনে আসে না। বিমলবাবু বলেন, “তখন থেকেই আমরা বুঝতে পারি, এটা আর স্বাভাবিক কিছু নয়।” গলির বাতাস পাল্টে যায়, পাখির ডাক শুনতে পাওয়া বন্ধ হয়, আর রাতে জানালা খুললে মনে হতো, কেউ দমবন্ধ করে কাঁদছে… হ্যাঁ, ঠিক কাঁদছে—কিন্তু কান্নাটা যেন মানুষের নয়, যেন কুকুর বা বিড়াল নয়—কী যেন অদ্ভুত। সেই সময় তিনি নিজেই প্রতিরাতে ডায়েরিতে সব লিখতেন, প্রত্যেক রাতে তিনি শব্দ শুনতেন—ছায়ার নড়াচড়া, দরজার হালকা ঠেলা, ঘড়ির কাঁটার উলটোদিকে ঘোরা। সেই সময় থেকেই এলাকার লোকেরা বাড়ির সামনে তাবিজ ঝুলিয়ে দিতে শুরু করে, কেউ কেউ পাড়াছাড়া হয়ে যায়, বাকিরা চুপ করে থাকে। “ভয়ে গলা শুকিয়ে আসত, অথচ কেউ মুখ খুলত না,”—বিমলবাবুর গলা কেঁপে ওঠে। ডায়েরির একটি পাতায় লেখা, “আজ তিনদিন হলো বাতি নিভে যাচ্ছে ১২টার সময়। কোনো শব্দ নেই, শুধু জানালার কাঁচে যেন কেউ আঙুল দিয়ে ঘষে… ঘষে… ঘষে…”

ঋদ্ধিমান পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, এগুলো কি পুরোটাই এক মানসিক ভয়ের সৃষ্টি? নাকি এমন কিছু সত্যি ঘটেছিল যা সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে গেছে? লেখার মধ্যে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার হয়েছে—”ছায়া”, “জমাট কান্না”, “পায়ের শব্দ”—যা সচরাচর বাস্তব কাহিনির চেয়ে বেশি অনুভূতিমূলক বা অলৌকিক ঠেকে। কিন্তু বিমলবাবুর চোখে কোনো বাড়াবাড়ি নেই, নেই নাটকীয়তা—বরং ভয় ও গ্লানির মিশ্র অভিব্যক্তি। তিনি বলেন, “তুমি যখন প্রথম এসেছিলে, আমি ঠিক বুঝতে পারি, তুমি খুঁজবে… কিন্তু সাবধান থেকো। এই গলি এখন আর শুধু রাস্তা না… এটা এক স্মৃতি… আর স্মৃতির ভিতর ভূত থাকে।” এই কথা শুনে ঋদ্ধিমান বুঝতে পারে, সে শুধু পুরনো গলি নিয়ে লেখার জন্য আসেনি, সে আসছে এক ইতিহাসের দরজায়, যার চাবি আছে এই বৃদ্ধের ডায়েরির পাতায়, আর সেই চাবি ঘুরলেই খুলে যেতে পারে এমন এক কাহিনি—যা হয়তো সময়ের অতলে থেকে গেছে। বাইরে তখন সন্ধ্যার আলো আর অন্ধকারের মাঝে গলি যেন আরো চুপচাপ, আরো স্থির। অথচ সেই স্তব্ধতার ভিতর যেন শোনা যায়, পাতার নড়াচড়া নয়—জমে থাকা কোনো না বলা শব্দ… হয়তো দীর্ঘশ্বাস।

রানু, বছর বারোর এক শান্ত স্বভাবের কিশোরী, গলির সবচেয়ে রহস্যময় অস্তিত্বের সঙ্গে অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে। সে মালতী দির ভাইঝি, মাসখানেক আগে গ্রামের স্কুল ছুটি থাকায় কয়েক সপ্তাহের জন্য শহরে এসেছে। মুখচোরা স্বভাব, কম কথা বলে, সারাদিন ঘরের কোণে বসে ছবি আঁকে। কিন্তু তার আঁকা ছবি যেন ধীরে ধীরে বাস্তবতার গণ্ডি পেরিয়ে অলৌকিক জগতের ছায়া হয়ে উঠছে। প্রথমদিকে মালতী দি এটাকে সাধারণ শখই ভেবেছিলেন, মেয়েটার মনের জগতটা একটু আলাদা, তাতে দোষ নেই। কিন্তু যেদিন সে আঁকল এক খালি চোখের সাদা অবয়ব—একটা ঝাঁকড়া চুলের ছায়া, যার মুখে মুখ নেই, শুধু ফাঁকা কালো গহ্বর, আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে এক ছোট ছেলে—তখনই মালতী দির গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। রানু সেই ছবি আঁকার সময় কিছু বলেনি, কিন্তু আঁকার পর হঠাৎ চোখ বন্ধ করে বলে উঠেছিল—”সে আজ রাতে আসবে। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকবে…” মালতী বুঝতে পারেন, এটা আর শুধু শখ বা শিশুর কল্পনা নয়। এর পেছনে কোনও গভীর, অদৃশ্য টান আছে, যা রানুকে অজান্তেই টেনে নিচ্ছে অন্য এক জগতে।

ঋদ্ধিমান এই ঘটনা শোনার পর প্রথমে কিছুটা সন্দিহান ছিল। তার মনে হয়েছিল, হয়তো রানু শুধু গল্প শুনে প্রভাবিত হয়েছে। তবে সে নিজে মালতী দির বাড়িতে গিয়ে রানুর ছবিগুলো দেখার পর চমকে ওঠে। প্রতিটি ছবিতে একটা নির্দিষ্ট থিম—একই ছায়ামূর্তি বারবার ফিরে আসে, পেছনে ঝাপসা পটভূমিতে গলির আবছা অলিগলি, মাঝেমধ্যে কাঁটাতারের বেড়া, আর মাঝে মাঝে আঁকা সেই বাড়ির বাগান, যেখানে একসময় মধুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় ছিল, রানুর এই ছবি আঁকার অভ্যেস শুরু হয়েছে এই গলিতে আসার পর থেকেই। এর আগে সে এমন কিছু আঁকেনি, এমনকি আঁকতে শেখেনি বলেও মালতী দি জানালেন। আর এক রাতে, মালতী দি যখন রানুর ঘরে ঢোকেন, তখন দেখে মেয়েটি নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গলির দিকে হাঁটছে, কিন্তু তার চোখ পুরোপুরি বন্ধ। ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটা, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘সোমনাম্বুলিজম’—তবে এখানেও ব্যতিক্রম। রানুর ঠোঁটে তখন অস্পষ্ট স্বরে বেরোচ্ছে কিছু শব্দ—“আমি তাকে দেখতে পাই… সাদা… খুব সাদা… তার মুখ নেই… কিন্তু সে হাসে…”। এই অদ্ভুত ঘটনার পর থেকে মালতী দি আরও বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি রানুর ছবিগুলো এক কাপড়ে মুড়ে পেছনের আলমারিতে রেখে দেন, যেন চোখের আড়ালে রাখলেই বিপদও দূরে সরে যাবে। কিন্তু শিশুমনের এমন গভীর সংযোগ, তা কি কেবল চাহনি বা চিন্তার ফল? নাকি রানুর মধ্য দিয়ে সত্যিই কেউ কথা বলছে?

ঋদ্ধিমান ঠিক করেন, রানুর সঙ্গে একটু সময় কাটাতে হবে। দুপুরবেলা, যখন মালতী দি রান্না নিয়ে ব্যস্ত, তখন সে রানুর পাশে বসে। মেয়েটি তখন জানালার পাশে বসে, কাগজে পেনসিল ঘষে চলেছে। ঋদ্ধিমান তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এইসব আঁকো কী ভেবে? স্বপ্নে দেখো?” রানু উত্তর দেয় না, কিন্তু হাত থামে না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বলে, “আমার মাথার ভেতর সে আসে… আমি যখন ঘুমোই, সে দরজা ঠেলে ঢোকে।” এই সহজ, অথচ গা ছমছমে উত্তর শুনে ঋদ্ধিমান চুপ করে যায়। রানু আরেকটু পরে বলে—“সে বলেছে, আমি ছাড়া কেউ তাকে দেখতে পায় না। সবাই ভয় পায়, কিন্তু সে খারাপ না। সে হারিয়ে গেছে… তাই খুঁজছে।” এই শিশুসুলভ বাক্যের মধ্যে যেন এক অসমাপ্ত আত্মার আর্তনাদ লুকিয়ে থাকে। ঋদ্ধিমান তখন জানে, রানু হয়তো শুধুই মিডিয়াম—তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে সেই প্রেতাত্মা, যে ১৯৭৭ সালে হারিয়ে গিয়েছিল। সে কি মধু? নাকি অন্য কেউ? রানুর আঁকা এক ছবিতে দেখা যায় ছায়ামূর্তি, আর তার পাশে লেখা কিছু বর্ণ—”ফিরে এলাম, কিন্তু কেউ ডাকে না…”। এত ছোট একটি মেয়ের পক্ষে এমন অনুভূতির প্রকাশ ভাবাই যায় না, যদি না সেটি তার ভিতরে ঢুকে থাকা কোনো শক্তির দিক থেকে আসে।

পরদিন রাতে আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। রানুকে তার বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর মালতী দি হঠাৎ রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে ওঠেন। রানুর ঘরে আলো নিভে গিয়েছিল, দরজা খুলতেই দেখা যায় মেয়েটা আবার বিছানার উপর বসে আঁকছে, কিন্তু পুরো ঘর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, যেন জানালার বাইরে তুষারপাত হয়েছে। রানুর সামনে একটা সাদা পাতা, আর সে আঁকছে—একটি মুখহীন মূর্তি, গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে, আর চারপাশে আগুনের রেখা। সেই আগুনে পোড়া ঘর, আর ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে আসছে—মুখে কান্না আর চোখে শূন্যতা। ঋদ্ধিমান সে ছবিটা পরে দেখে আর স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ এই একই চিত্র তিনি বিমলবাবুর নোটবইতেও পড়েছেন—যেখানে বলা ছিল, মধুর মৃত্যুর পর এক রাতে সবাই একসঙ্গে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়, গলির কিছু অংশে আগুন লেগে যায়, আর কেউ বলতে পারে না—আগুনটা কোথা থেকে এলো। সে ছবি হয়তো রানু নিজের চোখে দেখেনি, কিন্তু তার ভিতরে সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ঢুকে পড়েছে—যা কোনও শিশুমনে থাকা সম্ভব নয়। সেই রাতের পর থেকে রানু জ্বরে পড়ে, ঘুমে ঘুমে চিৎকার করে ওঠে—“ফিরে এসো না, দয়া করে ফিরে এসো না…”।

পুরনো কলকাতার গলিগুলো অনেকটা আয়নার মতো—যত গভীরে তাকাও, তত পিছিয়ে যাওয়া যায় অতীতে। বটতলা লেনের একদম শেষ প্রান্তে এমনই এক বাড়ি, যেটা আশেপাশের অন্য বাড়ির চেয়ে আলাদা—কাঠের জানালা বন্ধ, বারান্দা ধ্বস্ত, ছাদে আগাছা গজিয়ে উঠেছে, আর দরজার রঙ অদ্ভুত লাল—নির্জন দুপুরেও সে দরজার দিকে তাকালে বুক ধড়ফড় করে ওঠে। এলাকাবাসীরা বাড়িটিকে বলে ‘বউঠানের বাড়ি’। কারণ এখানকার প্রাক্তন বাসিন্দ্রী ছিলেন এক বিধবা প্রৌঢ়া, লক্ষ্মীমণি দেবী, যিনি তার একমাত্র ছেলে অনিরুদ্ধকে নিয়ে এখানে থাকতেন। প্রায় ২০ বছর আগে, এক বর্ষার রাতে, রহস্যজনকভাবে মা-ছেলের মৃত্যু হয় এই বাড়িতেই। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, মা আত্মহত্যা করেছিলেন, আর ছেলে নাকি হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়—কিন্তু সেই ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে অজস্র কাহিনি, অসংখ্য গুজব। কেউ বলে ছেলেটি গান গাইত, মাঝরাতে গান শুনে গলির লোকের ঘুম ভেঙে যেত। আর কারও কারও দাবি, মৃত্যুর পরেও সেই গান আজও মাঝেমধ্যে শোনা যায়, বিশেষ করে যেদিন ভরা চাঁদ ওঠে আকাশে।

ঋদ্ধিমান এই বাড়ির কথা জানতে পারে বিমলবাবুর কাছ থেকে। তিনি বলেন, “ওই বাড়ির লাল দরজাটা কিছুদিন পরপর নিজে থেকেই খুলে যায়, বিশেষত রাত বারোটার পর। আর ভিতর থেকে একটা গান ভেসে আসে—একটা মেয়েলি কণ্ঠে ঠুমরি, যেমন বেনারসে গাওয়া হয়।” প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও, কৌতূহলের বশে এক বিকেলে ঋদ্ধিমান বাড়িটার কাছে যায়। দরজায় ধুলো জমে, অথচ হাত রাখলেই মনে হয় কেউ একটু আগেই স্পর্শ করে গেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, দরজায় কোনও তালা নেই, শুধু একটি কাঠের আলগা সিটকিনি। দরজাটা হালকা ঠেলতেই অল্প খিঁচ ধরে খুলে যায়। ভিতরে অন্ধকার, কিন্তু ভেতরের বাতাসে একরকম বদ্ধ গন্ধ—পুরনো কাপড়, ছাঁচ ধরা কাঠ আর ধূপ-ধুনোর মিশ্র গন্ধ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে যেন অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়—প্রতিটি ধাপে কারও ভারী নিঃশ্বাস, অথবা ছায়ার মতো একটি অনুচ্চারিত উপস্থিতি অনুভূত হয়। উপরতলায় উঠেই দেখা যায়, ডানদিকের এক ঘরের দরজাটা লাল রঙে রাঙানো, যেন রক্তের ছোপ মিশে গেছে কাঠের ফাঁকে ফাঁকে।

ঋদ্ধিমান প্রথমে হাত রাখে দরজায়, ঠাণ্ডা কাঠ, কিন্তু যেন ধ্বংস নয়—বরং জ্যান্ত কিছু ছুঁয়েছে সে। সেই রাতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, ওই ঘরের ভেতরে যাবে, তবে রাত বারোটার সময়। মালতী দির কাছ থেকে চাবি জোগাড় করে সে নির্ধারিত রাতে আবার ফিরে আসে বাড়িটিতে, সঙ্গে রেকর্ডার, টর্চ আর নিজের নোটবুক। চারপাশে তখন নিঃশব্দ, গলি নিস্তব্ধতায় ডুবে। বারোটা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। ঋদ্ধিমান তখন ওই লাল দরজার সামনে বসে, অপেক্ষা করে। হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা বারোটায় পৌঁছাতেই দরজার সিটকিনি নিজে থেকেই খসে পড়ে, আর দরজাটা অল্প ফাঁক হয়ে যায়—ঠিক যেন কেউ ভিতর থেকে ঠেলে দিয়েছে। আর তখনই ভেসে আসে সেই সুর—নরম, অথচ ব্যথাভরা এক কণ্ঠ, “কহি এক শাম, বেনারস কি গলি সেঁ…”, গলার কম্পনে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা, কিন্তু একই সঙ্গে গা শিরশিরে অনুভূতি। ঋদ্ধিমান রেকর্ডার চালু করে, কিন্তু বিস্ময়ে দেখতে পায়—রেকর্ডারে শুধু একটানা ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে, কোনও গান ধরা পড়ছে না। ঘরে ঢুকে সে দেখে একটা পুরনো হ্যান্ডহারমোনিয়াম, যার উপর জমে আছে ধুলোর আস্তরণ। আর এক কোণে ছেঁড়া একটা শাড়ি রাখা, আরেক পাশে একটি ছেঁড়া পুতুল, যেটার চোখ নেই।

সেই ঘর থেকে বেরোনোর সময় ঋদ্ধিমান অনুভব করে, যেন কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে না কিছু, কিন্তু হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। দরজার পাশে একটা ভাঙা আয়না, তাতে হঠাৎ সে দেখতে পায়—নিজের প্রতিবিম্বের পিছনে অন্ধকারে একটা আবছা সাদা মুখ। সঙ্গে সঙ্গে সে পিছনে তাকায়, কিন্তু কেউ নেই। গলি থেকে হালকা হাওয়া ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে, হারমোনিয়াম নিজে থেকেই এক টানা সুর তুলতে থাকে। ঋদ্ধিমান বুঝতে পারে, এই জায়গাটা নিছক পরিত্যক্ত বাড়ি নয়, এখানে এখনও কেউ থাকে, কেউ অপেক্ষা করে, কেউ গায় গান—যার শরীর নেই, শুধু স্মৃতি আছে, যন্ত্রণা আছে, আর অভিমান আছে। বাইরে বেরিয়ে আসার সময় সে আবার একবার পেছনে তাকায়, দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে যায়, এবার কোনও শব্দ ছাড়াই। ভোরবেলা বাড়ি ফিরে সে আবিষ্কার করে, তার রেকর্ডারে কিছুই ধরা পড়েনি, কিন্তু তার গলার ভেতর যেন কাঁটার মতো আটকে আছে সেই সুর—আধো হিন্দি, আধো কান্না মেশানো গানের এক টুকরো, যা হয়তো কেউ মৃত হয়েও গেয়ে চলে… শুধুমাত্র তারা শুনতে পারে, যারা সত্যিই খোঁজে।

চিৎপুর থানার পুরনো কাগজপত্রের ঘরে বসে ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর মিত্র একের পর এক ধুলো জমা ফাইল উল্টে দেখছিলেন। তাঁর টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে হলুদ হয়ে যাওয়া রিপোর্ট, ঝাপসা ছবি, এবং অস্পষ্ট সাক্ষ্যপত্রের কপি। বাইরের কলকাতার কোলাহল থেমে গেছে, সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে রাতের দিকে। বিদ্যুৎচালিত আলোয় ধরা পড়ছে পুরনো সময়ের গন্ধমাখা কালি-কলমে লেখা কিছু রিপোর্টের ছায়া। ১৯৭৭ সালের সেই রহস্যময় শিশুমৃত্যু, গলির নিরুদ্দেশ কিছু মানুষ, আর বটতলা লেনের প্রাচীন কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া মামলার সমস্ত ফাইল তার চোখের সামনে খুলে ধরা পড়ছিল। কিন্তু যা তাঁকে অস্থির করে তুলছিল, তা হল একটা নাম — অফিসার প্রদ্যোৎ মিত্র। দীপঙ্করের বাবা। যিনি সেই কেসে তদন্তকারী ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়। বাবা কোনোদিন এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেননি, শুধু একবার বলেছিলেন, “সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দরকার হয় না, দীপু।”

কিন্তু দীপঙ্কর সেই উত্তর খুঁজতেই আজ এখানে। ফাইলের একটা পাতায় লেখা ছিল— “রাত্রি ১২টা ২০ মিনিট। ৫ বছরের শিশু অনিরুদ্ধর আকস্মিক মৃত্যু। ডাক্তারি পরীক্ষায় অস্বাভাবিক শ্বাসরোধ। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার দিদিমা, যা জানিয়েছে সে– ছায়া এসে গলায় হাত রাখে।” এমন রিপোর্টে পুলিস সাধারণত কল্পনার তকমা লাগায়। কিন্তু দীপঙ্করের বাবার হ্যান্ডনোটে লেখা ছিল– “ছায়ামূর্তি নয়, সম্ভবত কোনো মানুষ অথবা অলৌকিক উপস্থিতি।” হঠাৎ করেই দীপঙ্করের মেরুদণ্ড দিয়ে শিহরণ বয়ে গেল। তিনি দেখলেন আরও একটি নোট, যেখানে লেখা— “আমার আর কিছু বলার নেই। এই কেস আমি ছেড়ে দিচ্ছি।” তারপর কেসটা ‘বন্ধ’ ঘোষিত হয়। এভাবে একজন সৎ পুলিশ অফিসার কেন হঠাৎ হাত গুটিয়ে নিলেন, সেটাই দীপঙ্করের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

দীপঙ্কর বুঝলেন, এর পেছনে আছে এমন কিছু, যা শুধু প্রমাণ দিয়ে ধরা যায় না। তাই পরদিন সকালে তিনি গেলেন তার বাবার পুরনো সহকর্মী হাবিলদার মনোরঞ্জন দত্তর কাছে, যিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত। মনোরঞ্জনবাবু প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। বহুক্ষণ চা খেতে খেতে, নীরবতা ভেঙে বললেন, “প্রদ্যোৎদা খুব বদলে গিয়েছিল সেই সময়। রাতে ঘুমোতে পারত না, হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠত চিৎকার করে। একদিন বলল, বটতলা লেনটা ‘জ্যান্ত’! আর কিছু বলেনি, শুধু তদন্ত ছেড়ে দিয়ে বদলির আবেদন করেছিল।” দীপঙ্করের চোখে এক রহস্যের পর্দা আরও গাঢ় হল। হয়তো তার বাবার মনের ভিতরে এমন কিছু ঢুকে গিয়েছিল, যা তাকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছিল। এই ‘ভূতের গলি’ যেন এক জীবনগ্রাসী চক্র, যেখানে যে ঢোকে, সে পুরোপুরি আগের মানুষ থাকে না।

ফিরে এসে দীপঙ্কর আবার তার টেবিলের সামনে বসলেন। এবার তিনি শুধুমাত্র রিপোর্ট পড়লেন না, ছবি দেখতে লাগলেন। ১৯৭৭ সালের সেই শিশুর ছবি, শিশুর মা-বাবার কান্নার ছবি, সেই গলির ভেতরের দৃশ্য— সবকিছু এক অদ্ভুত নিস্তব্ধ বার্তা বহন করছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল এক ছবি— একটি লাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রদ্যোৎ মিত্র। দরজাটি যে বাড়িটির, সেটা ঋদ্ধিমানও সাম্প্রতিক কালে অনুসন্ধান করেছে। মানে, অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা রয়েছে এই ‘লাল দরজা’। দীপঙ্করের মনে হল, তাঁকে শুধু কেসের ফাইল পড়ে নয়, সেই বাড়িতে গিয়ে বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে দেখতে হবে— ঠিক কী ঘটেছিল সেই রাতে? এক অলৌকিক রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর বুঝলেন, এই তদন্ত কেবল পেশার দায়িত্ব নয়, এটি তাঁর ব্যক্তিগত উত্তরাধিকারও। হয়তো এইবার, সে সেই দরজা খুলে ফেলবেই, যেটা তার বাবা চিরতরে বন্ধ করে রেখেছিলেন।

ঋদ্ধিমানের দিনগুলো যেন ক্রমেই গাঢ় অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে। কলকাতার গলির পুরনো ঘ্রাণ, শীতল বাতাসে ভেসে আসা ছাদের ফিসফিসে শব্দ, আর মাঝেমাঝেই রাতের বেলা সেই লাল দরজার ওপার থেকে আসা সুরেলা গান— সব মিলিয়ে সে যেন বাস্তব আর অবাস্তবের সীমানায় দাঁড়িয়ে। একদিন, পুরনো অ্যান্টিক জিনিসের দোকান খুঁজতে খুঁজতে বউবাজারের এক সিঁড়িঘর ঘেরা গলির ভেতর সে ঢুকে পড়ে। একটা অন্ধকার দোকান— ধুলো জমা পেতলের প্রদীপ, কাঠের পুতুল, আর একপাশে কিছু ছেঁড়া পত্রিকা আর রেকর্ড। হঠাৎ একটা রেকর্ড ডিস্ক তার চোখে পড়ে, যার গায়ে হাতে লেখা— “মৌসুমি: রাত বারোটার গান”। দোকানের মালিক বয়স্ক মানুষ, চুপচাপ বসে ছিলেন। তিনি রেকর্ডটি দেখে শুধু বললেন, “এইটা কেউ কেনে না বাবু, রাতে বাজলে কেমন অদ্ভুত কান্নার মতো লাগে। তুমি নেবে?” ঋদ্ধিমান বিনা বাক্যব্যয়ে রেকর্ডটি নিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে, এই নামটা— “মৌসুমি”— যেন কোথাও শুনেছে সে, অচেনা হয়েও বড়ো চেনা লাগে।

সেই রাতে ঠিক বারোটার সময়, সে রেকর্ড প্লেয়ারে ডিস্কটি বসায়। প্রথমে অস্পষ্ট শব্দ, তারপর আস্তে আস্তে ভেসে আসে একটি ঠুমরি— বেনারস ঘরানার শুদ্ধ রাগে বাঁধা, নারীকণ্ঠে গাওয়া এক করুণ সুর: “মোর নিদিয়া চুরাইলি গিরিধারী…”। ঋদ্ধিমানের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। গানটা যেন কেবল শুনতে নয়, ছুঁয়ে যেতে চায়— তার মগজের ভেতর, হৃদয়ের অতলে। গান চলাকালীন ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন হালকা সুগন্ধ ভেসে আসে কোথা থেকে— পুরনো আতরের ঘ্রাণ, সঙ্গে একধরনের বিষণ্ণতা। গান থামার পর প্লেয়ারটি থেমে গেলেও, গানটা যেন ঘরে থেকে যায়। পরদিন সকালে রানু, তার বাড়ির গৃহপরিচারিকা, আচমকাই বলে ওঠে— “এই গানটা তো ‘মৌসুমি দি’র ছিল! ছোটবেলায় অনেক শুনেছি। খুব ভালো গাইতো। সেই যে আমাদের পাড়ার পুরনো গলির দিদি, যে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেলো?” ঋদ্ধিমানের মনে হল, সে যেন কোনও অতীতের কুয়োয় পড়ে যাচ্ছে— একখানা গানের রেকর্ড যেন খুলে দিচ্ছে সময়ের দরজা।

রানুর কাছ থেকে জানা যায়, ‘মৌসুমি দিদি’ ছিলেন আশির দশকের এক বিখ্যাত সংগীতপ্রেমী, যার গলার জাদুতে মুগ্ধ ছিল গোটা পাড়া। কিন্তু হঠাৎই একদিন নিখোঁজ হয়ে যান, কেউ বলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কেউ বলে পাগল হয়ে বাগানবাড়ির পেছনের পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অথচ মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। গানটা সেই সময়ই শেষবার শোনা গিয়েছিল, তারপর থেকে শুধুই গুজব। কেউ কেউ বলত, গভীর রাতে সেই গান আবার বাজে, শুধু যারা শোনার ‘ক্ষমতা’ রাখে, তাদের কানেই আসে। ঋদ্ধিমানের মনে সন্দেহ জাগে— তবে কি এই রেকর্ড কোনো সাধারণ জিনিস নয়? হয়তো কোনও অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা, কিংবা হারিয়ে যাওয়া আত্মার আর্তি, যেটা শব্দে রূপ নিয়েছে। কিন্তু তারও ভয় করতে লাগলো— কেন সে এই গান শুনতে পাচ্ছে? কি তার যোগসূত্র এই ‘মৌসুমি’র সঙ্গে?

ঋদ্ধিমান খুঁজতে শুরু করল পাড়ার পুরনো লোকজনদের। এক বৃদ্ধা জানান, “মৌসুমি ছোট থেকেই একটু অন্যরকম ছিল। খুব মিষ্টি, কিন্তু মাঝে মাঝে ছাদে একা একা গান গাইত আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। কেউ কেউ বলত, ওর চোখে ‘পুনরাগমনের ছাপ’ ছিল, যেন আগেও এমন কিছু ঘটেছে ওর জীবনে।” এই কথাটা চমকে দেয় ঋদ্ধিমানকে। তার নিজের স্বপ্নেও মাঝেমাঝে এক নারীকণ্ঠ তাকে ডাকতে থাকে— “ফিরে এসো… তুমি কথা দিয়েছিলে…”। সে অনুভব করে, এই গান, এই রেকর্ড, মৌসুমির স্মৃতি— সব কিছু যেন কোনো না কোনোভাবে তার নিজের সঙ্গে জড়িয়ে। তবে কি এটা পুনর্জন্মের বার্তা? হয়তো পূর্বজন্মে তার কোনো অপূর্ণ প্রতিজ্ঞা ছিল, কোনো অসমাপ্ত সম্পর্ক, যেটা এখনকার জীবনে ফিরে এসেছে এই ভূতের গলির ছায়া হয়ে। রাত যত বাড়ে, গান যত বাজে, ঋদ্ধিমান বুঝতে পারে— এই শুধু রহস্য নয়, কোনো হৃদয়ের ইতিহাস, যেটা সময় পেরিয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে।

কলকাতার পুরনো গলিগুলো যেন পূর্ণিমার রাতে অন্যরকম হয়ে ওঠে—বিশেষ করে সেই গলিটি যেখানে ঋদ্ধিমান এখন থাকছে। বাড়ির পেছনের রাস্তার মাথায় যে পেতলের ল্যাম্পপোস্ট আছে, তা পূর্ণিমার রাতে হঠাৎ নিভে যায়। বাতাস থেমে আসে, শব্দ থেমে যায়, আর একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে—যেন শহরটা হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। সেই রাতে, রেকর্ডটা বাজছিল না, রেডিও বন্ধ, এমনকি কুকুরগুলোও চুপ। রানু বারান্দায় বসে ছিল, ঠিক রাত ১২টার সময় সে উঠে গিয়ে বলে, “আমি একটু সামনের দোকান থেকে ফিরি”—অথচ সেই সময় আশপাশে কোনো দোকান খোলা থাকার কথা নয়। ঋদ্ধিমান তখন নিজের রুমে বসে ছিল, লিখতে লিখতে সে হঠাৎ লক্ষ্য করে, বারান্দা দিয়ে হালকা একটা সাদা আলো ঢুকছে। সে এগিয়ে গিয়ে দেখে, গলির একপ্রান্তে সাদা কাপড়ে জড়ানো এক নারীমূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে—কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। চুলগুলো যেন বাতাসে ভাসছে না, বরং নিস্তরঙ্গভাবে গড়িয়ে পড়ছে দুই কাঁধ বেয়ে। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে সে বুঝতে পারে—রানু ফিরে আসেনি।

রাত কেটে যায়। রানুর কোনো খোঁজ মেলে না। ঋদ্ধিমান প্রথমে ভাবে—হয়তো সে পাশের বাড়িতে গেছে বা হঠাৎ কোথাও চলে গেছে। কিন্তু বাড়ির দরজা খোলা, রানুর চপ্পল বারান্দায় পড়ে রয়েছে। এক ধরনের শীতল ভয় ঋদ্ধিমানের শরীরকে জেঁকে ধরে—এ যেন কোনো অপার্থিব অভিজ্ঞতা, কল্পনার নয়, অথচ বাস্তবের চেয়েও বেশি জীবন্ত। সে পাড়ার দু-একজনকে ডেকে আনে, খোঁজাখুঁজি শুরু হয় আশপাশে, এমনকি পুলিশেও খবর দেওয়া হয়। কিন্তু রানুর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। রাত ভোর হয়ে যায়, পূর্ণিমার আলো কমে আসতে থাকে। ঠিক তখনই বাড়ির উঠোন থেকে এক বাচ্চার চিৎকার শোনা যায়—“ওই তো, ওখানে কেউ শুয়ে আছে!” সবাই ছুটে আসে। রানুকে পাওয়া যায়, তার নিজের বাড়ির উঠোনে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে, সাদা ধুলোয় মাখামাখি শরীর, চোখ বন্ধ, ঠোঁট শুকনো। আশ্চর্যের বিষয়—তার ডান হাতে মোটা হরফে আঁকা—“ফিরে এলাম”।

রানুকে ঘরে এনে জলপানি দেওয়া হয়। ডাক্তার এসে দেখে যায়, শরীরে তেমন চোট নেই, কিন্তু মানসিকভাবে সে যেন এক গভীর ধাক্কা খেয়েছে। চোখ খোলার পর রানু প্রথমে কাউকে চিনতে পারে না। কয়েক ঘণ্টা পর সে ফিসফিস করে বলে—“একটা আলোয় ভরা জগৎ… আর এক মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, আমি যেন ফিরে যাই, সময় এখনও আসেনি।” রানু আরও বলে, “সেই মহিলার মুখটা ছিল না, শুধু চোখ… আর চুলগুলো ছিল ভেজা, লম্বা, যেন সদ্য স্নান করে উঠেছেন। আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু তার কণ্ঠ ছিল মায়ায় মোড়া।” সবাই থমকে যায়। এক বৃদ্ধা মহিলা তখন বলে ওঠেন—“এই তো সেই গলির অভিশাপ! পূর্ণিমার রাতে সেই মেয়ে ফিরে আসে, যাকে সবাই ভুলে গেছে, কিন্তু সে কাউকে ভোলে না।” এরকম কথা আগে শোনা যায়নি। রানুর হাতে সেই লেখা কীভাবে এল—কেউ জানে না। কেউ লিখে দেয়নি, কেউ আঁকেনি। অথচ হিন্দিতে মোটা হরফে স্পষ্ট: “FIR WAPAS AAYI HOON”। ঋদ্ধিমান বুঝতে পারে, এ যেন কোনো এক পুনর্জাগরণের আভাস—এক মৃত্যু-অতিক্রম করা আত্মা যা ফিরে এসেছে কিছু অসমাপ্ত কাজ নিয়ে।

ঋদ্ধিমানের ঘুম আর আসে না। সে বুঝে গেছে, রানু শুধু কোনও এলোমেলো জায়গায় হারিয়ে যায়নি, বরং সে কিছু সময়ের জন্য অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছিল—যেখানে ছায়া, গান, আর আত্মার অতীতময় স্মৃতি ঘিরে থাকে মানুষকে। সেই ‘সাদা ছায়া’ হয়তো মৌসুমি—হয়তো অন্য কেউ, কিন্তু সে কিছু বলতে চাইছে, বার্তা দিতে চাইছে। রানু ছিল শুধুমাত্র মাধ্যম। সেই বার্তা হল—“ফিরে এলাম।” প্রশ্ন হচ্ছে, কে ফিরে এল? কেন এল? আর কী চায় সে? ঋদ্ধিমান জানে, এই ভয় শুধুমাত্র আতঙ্ক নয়, বরং এমন এক বোধের জন্ম দেয় যা যুক্তিকে অতিক্রম করে। এই রাতের পর সে বুঝে যায়, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। গানের রেকর্ড, রক্তলিখা বার্তা, আর পূর্ণিমার রাতে ছায়ার আগমন—সব মিলিয়ে এই বাড়ির অতীত এখন তার বর্তমানকে গিলে খাচ্ছে। সে নিজেই হয়তো ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে সেই ছায়ার জগতে—যেখান থেকে ফিরে আসা সহজ নয়।

সকালটা ছিল অস্বস্তিকর। রানুর ঘটনার পরদিন, গলির প্রত্যেকটি মানুষের চোখে ছিল অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ—যেন সবাই কিছু না কিছু জানে, কিন্তু বলতে চায় না। ঋদ্ধিমান ভাবছিল, এতগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটছে, কিন্তু কেন? ঠিক তখনই, বাড়ির পিছনের গলির ধারে চুপচাপ বসে থাকা বৃদ্ধ বিমলবাবু ডাক দিলেন। বিমলবাবু ছিলেন এই গলির সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা, বয়সে প্রায় আশির কাছাকাছি, কিন্তু চাহনিতে একধরনের স্থিরতা ছিল, যা সহজে ধরা পড়ে না। আগে যতবারই ঋদ্ধিমান তার কাছে গিয়েছে, উনি শুধু ঠোঁট নেড়ে বলেন—“জানতে নেই, বাবা, এসব জানলে ঘুম হারিয়ে যায়।” কিন্তু আজ, রানুর ফিরে আসার পরদিন, তিনি নিজে ডাকলেন। ঋদ্ধিমান যখন তার কাছে গিয়ে বসল, বিমলবাবুর চোখে ছিল এক ধরনের অভিমান, এক গভীর ক্লান্তি। তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—“তুই যা দেখেছিস, যা শুনেছিস, সব তার ছায়া মাত্র। ও যা চায়, তা এখনও পায়নি। আর পাবে কী করে? আমরা ওকে… আমরা সবাই মিলে ওকে বলি দিয়েছিলাম…”

ঋদ্ধিমান প্রথমে ভেবেছিল বৃদ্ধ হয়তো আবোলতাবোল বলছেন, হয়তো বয়সজনিত ভ্রান্তি, কিন্তু বিমলবাবুর কথাগুলো একে একে গাঁথা হতে লাগল, যেমন গহিন রাতে জলের তলায় ঢেউয়ের শব্দ ওঠে। তিনি বলতে শুরু করলেন প্রায় তিরিশ বছর আগের এক গল্প—যখন গলির অধিকাংশ মানুষ আজকের মতো ছিল না, গলি ছিল আরও নির্জন, অন্ধকারে মোড়া, আর বিশ্বাসে ডুবে থাকা। সে সময় এই পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল এক অদ্ভুত রোগ—মানুষ ঘুমাতে গিয়ে আর জেগে উঠত না। এক মাসে মারা গিয়েছিল দশজন। কারও মুখে ব্যথা ছিল না, শরীরে আঘাত ছিল না, তবু যেন ঘুমের মধ্যেই আত্মা বেরিয়ে যেত। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ের সুর, এবং তখনই এক সাধুবাবার আগমন হয় গলির শেষ মাথায়—যিনি বলেছিলেন, “এই রোগ প্রেতবাহিত। এক আত্মা এই জায়গায় ঘর বানিয়ে ফেলেছে, তার বিনাশ না করলে শান্তি আসবে না।” তার কথায়, বলি দিতে হবে এক শিশুকে—নির্বোধ, নির্দোষ, অবোধ একটি প্রাণকে। তখনই, এক সদ্য আগত দরিদ্র দম্পতির মেয়েকে বেছে নেওয়া হয়—মৌসুমি। মাত্র ছ’বছরের শিশু, কথা কম বলত, সারাদিন একটা কাঠের পুতুল নিয়ে খেলত। তাকে এক পূর্ণিমার রাতে বাড়ির পেছনের বটগাছের নীচে নিয়ে যাওয়া হয়—সেই বৃদ্ধ সাধুর মন্ত্রপাঠের সময়।

বিমলবাবুর গলা কেঁপে উঠছিল। তিনি বললেন, “আমি চুপ করে ছিলাম। কেউ বাধা দেয়নি। আমরা ভেবেছিলাম—এক শিশুর মৃত্যুতে যদি দশজনের প্রাণ বাঁচে, তবে সেটাই শ্রেয়।” সে রাতে মৌসুমি চিৎকার করেছিল কিনা, মনে নেই বিমলবাবুর। তিনি শুধু মনে করতে পারছিলেন শিশুটির চোখ—দুটি বিস্ময়ভরা চোখ যা শেষ মুহূর্তে সবাইকে দেখে বলেছিল, “আমি কিছু করিনি।” বলির পরপরই গলির রোগ থেমে যায়। সাধু চলে যান, আর মৌসুমির কথা ধীরে ধীরে ভুলে যায় সবাই। তবে একটাই পরিবর্তন ঘটে—প্রতিটি পূর্ণিমার রাতে গলির বাতি নিভে যেত, আর কেউ কেউ দেখত এক সাদা কাপড়ে মোড়া মেয়েকে, তার হাতে কাঠের পুতুল, আর চোখে অভিমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকে বলে, “ভ্রম,” “মনগড়া গল্প,” অথবা “পুরনো কুসংস্কার”—কিন্তু বিমলবাবু জানতেন, সেই শিশুর আত্মা গৃহত্যাগ করেনি। তার প্রতিশোধ, তার যন্ত্রণার দাহ, এখনও এই গলির প্রতিটি ইটে লুকিয়ে আছে। রানুর ‘ফিরে এলাম’ লেখা ছিল সেই মৌসুমির প্রতিচ্ছবি—সে ফিরে এসেছে, মনে করাতে, ক্ষমা না পাওয়া সেই পাপীদের।

ঋদ্ধিমানের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে কিছু বলতে পারছিল না। পাপের যে স্তর এত গভীর, তার অভিঘাত এত বছর পরও টিকে থাকে, তা সে কল্পনাও করেনি। রানু তো মৌসুমি নয়, তাহলে কেন তার মধ্যে সেই আত্মা প্রবেশ করল? বিমলবাবু ধীরে ধীরে বললেন, “কারণ শিশুদের মন এখনও নির্মল, তাই আত্মারা তাদের মাধ্যমে কথা বলে। কিন্তু এবারে সে কেবল ফিরে আসেনি, সে তার কথা বলেছে—সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সে মুক্ত নয়। আমাদের ক্ষমা চায় না সে, সে চায়—আমরা বুঝি কী করেছি।” গলি যেন ধীরে ধীরে আরও ভারী হয়ে উঠছিল। পূর্ণিমার রাত শেষ হলেও ছায়া রয়ে গেছে। ঋদ্ধিমান বুঝল, রানুর ঘটনার পর এই স্বীকারোক্তি কেবল একটি গল্প নয়, বরং ইতিহাসের পুনর্জাগরণ। অতীত পাপ যতই চাপা পড়ুক না কেন, তার সুর কখনও হারিয়ে যায় না—সে ফিরে আসে ছায়া হয়ে, শব্দ হয়ে, নিঃশব্দ চিৎকার হয়ে। বিমলবাবু তার মাথা নিচু করে বললেন, “আমি আর বাঁচব না, বাবা। কিন্তু ওর আত্মা যতদিন মুক্ত না হবে, ততদিন কেউ শান্তি পাবে না।”

ঋদ্ধিমান ঘরে ফিরে এসে দেখে রানু শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে, পাশে পড়ে আছে একটি কাঠের পুতুল—ঠিক সেইরকম, যেমনটা বিমলবাবুর বর্ণনায় ছিল। সে বুঝে যায়, মৌসুমি এখনও ফিরে আসে। শুধু ফিরে আসে না, বরং এই গলির বুক চিরে সেই শিশু বলে ওঠে—“আমি কিছু করিনি।” বিমলবাবুর স্বীকারোক্তি একটা দরজা খুলে দিয়েছে, যেখান দিয়ে অতীত ঢুকতে শুরু করেছে বর্তমানের ঘরে। এখন প্রশ্ন একটাই—এই পাপ কি শুধুমাত্র স্বীকারোক্তিতে শেষ হবে? নাকি এর জন্য চাই আরও কিছু—ক্ষমা, মুক্তি, কিংবা হয়তো কিছু আরও বড় বলি?

ঋদ্ধিমান সেই পুরনো লাল দরজার বাড়িটায় আবার ফিরে এল। দিনের আলোয় সবকিছুই যেন সাধারণ, নির্বিষ, কিন্তু সে জানে—এই দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা দীর্ঘকাল নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। সে এবার নিয়ে এসেছিল একটি টর্চ, মোটা খাতা, আর একটি হ্যান্ড গ্লাভস। বাড়িটার পেছনের ঘরটার দেয়ালে তার আগে কিছু অদ্ভুত ফাটল লক্ষ করেছিল, আর হালকা খোঁচা দেওয়ায় যেন কিছু নড়ে উঠেছিল ভিতরে। এবার সে পুরো দেয়ালটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। অনেকখানি ধুলো আর জঞ্জাল সরানোর পর, একটি পুরনো কাঠের প্যানেলের আড়ালে সে দেখতে পেল কয়েকটি ছোট ছোট অক্ষরে লেখা: “আমায় ক্ষমা করো মা, আমি ফিরব…”। লেখাগুলো রক্তের মতো লাল হয়ে জমে আছে, যেন দেওয়ালের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া রক্তস্মৃতি।

এই বার্তাটা দেখে ঋদ্ধিমানের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এত বছর ধরে দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি শিশুর শেষ আর্তি, তার মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা—এটা নিছক কোনও অলীক কথন নয়, বরং একটা আত্মার কষ্ট, ঘৃণা, আর প্রতিশোধের পূর্বাভাস। রানু যেদিন অজ্ঞান অবস্থায় উঠোনে পড়ে ছিল, সেদিন তার হাতে লেখা ছিল “ফিরে এলাম”—ঋদ্ধিমান এবার দুইটিকে জুড়ে দিতে পারল। সে অনুভব করল, রানু হয়তো সেই শিশুটির মাধ্যম হয়ে উঠেছে। হয়তো সে-ই এখন সেই অসমাপ্ত আর্তির ধারক। রানু মাঝে মাঝেই কিছু বলে, যা তার বয়সের ছাঁচে পড়ে না—যেমন, পুরনো ছায়ামূর্তির বর্ণনা, সুনির্দিষ্ট তারিখ, এমনকি ১৯৭৭ সালের পুরনো ঘটনার উল্লেখ, যা একমাত্র সেই মৃত শিশুটিই জানত।

ঋদ্ধিমান ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেল মালতী দির কাছে, যিনি বহু বছর ধরে রানুকে বড় করেছেন। তিনি জানালেন, রানুর মা গলির আরেক প্রান্তের বাসিন্দা ছিলেন, যিনি মৃত্যুর আগেই বারবার বলতেন—এই গলি তার মেয়েকে ছাড়বে না। রানু ছোট থেকেই কিছু “দেখে” ফেলে, মাঝেমাঝে বলে ওঠে এমন সব নাম, যা আর কেউ জানে না। রানুর আঁকা ছবিগুলো খুলে দেখাতেই, একটি ছবিতে ঋদ্ধিমান দেখে সেই দেয়ালে লেখা বার্তাটি—অবিকল একই ভাষা, একরকম হস্তাক্ষর! শিশুর মতো হাতে আঁকা হলেও তার গভীরতায় ছিল এক অলৌকিক ভার, যেন কোনো চেতনা রানুর ভেতর দিয়ে কথা বলছে। রানু এখন আর শুধু একটা কিশোরী নয়—সে হয়ে উঠেছে অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র। তার চোখে এখন অন্য আলো, অন্য ভয়।

এখন আর কোনও সন্দেহ নেই—ঋদ্ধিমান বুঝতে পারে এই পুরো ‘ভূতের গলি’র রহস্য একটি আত্মার, একটি অকালমৃত শিশুর, যে ফিরে এসেছে নিজের ভাষায়, নিজের যন্ত্রণা নিয়ে। দেয়ালের সেই শেষ বার্তা যেন সময়কে চিরে এসে উপস্থিত হয়েছে বর্তমানের দেহে। আত্মাটা কিছু চাইছে—শুধু প্রতিশোধ নয়, বরং মুক্তি। আর এই মুক্তি দিতে পারবে একমাত্র যারা তাকে বলি দিয়েছিল—তাদের স্বীকারোক্তি, তাদের অনুশোচনা দরকার। রানুর ওপর সেই আত্মার প্রভাব বেড়ে চলেছে, তার ঘুম কমছে, শরীর দুর্বল হচ্ছে। ঋদ্ধিমান জানে, সময় খুব কম। তাকে খুঁজে বার করতে হবে সেই রাতের সমস্ত সত্য, সমস্ত নাম, সমস্ত পাপের চিহ্ন—আর দিতে হবে সেই শিশুটিকে চূড়ান্ত উত্তর… সে ফিরেছে, এবার তার বিদায়ের পালা… অথবা আরও ভয়ংকর কিছু?

১০

ভোররাতের নিঃস্তব্ধতা যেন আরও ঘনিয়ে উঠছিল, যখন ঋদ্ধিমান, দীপঙ্কর আর মালতী দি মিলে সেই গলির কেন্দ্রে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করল। চারদিক থেকে কুয়াশা জমে আসছিল, আর বাতি গুলো একে একে নিভে যাচ্ছিল। অদ্ভুত এক নিঃশব্দতা যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল—এমন, যেন গলিটাই নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। মাটি নরম ছিল, অনেক বছর আগের কোনও রক্ত যেন তাকে আলগা করে রেখেছিল। দীপঙ্করের হাতে লণ্ঠন, ঋদ্ধিমানের হাতে কোদাল আর মালতী দির চোখে জল—এই তিনজন সাক্ষী হতে চলেছে এক গোপন পাপের, যা এতদিন গলির নিচে ঘুমিয়ে ছিল। আধঘণ্টার মধ্যে মাটি সরিয়ে তারা দেখতে পেল এক ক্ষয়িষ্ণু কাঠের বাক্স। খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো গন্ধ বেরিয়ে এল—মৃত শিশুর দেহাবশেষ আর তার পাশে এক পিচবোর্ডে মোড়ানো প্রাচীন গ্রামোফোন রেকর্ড।

হঠাৎ, রানুর ঘর থেকে ভেসে এল এক মৃদু সুর—ঠুমরির সুর, যেটা ঠিক রাত বারোটায় বাজত সেই রেডিওতে। কিন্তু এই ভোরবেলা রানু গাইছে? তারা তিনজনই ছুটে গেল তার ঘরে। রানু অচেতন, কিন্তু মুখে নিঃসৃত হচ্ছে নিখুঁত বেনারসী ঠুমরি, যেটা একশো বছর আগের গায়িকারা গাইত। তার ঠোঁট নড়ে, চোখ বন্ধ, কিন্তু গলার ভঙ্গিমা এত নিখুঁত যে কোনও প্রশিক্ষিত শিল্পীকেও হার মানায়। মালতী দি কাঁপা গলায় বলে ওঠেন, “ও তো কোনওদিন গান শেখেনি… ও তো রেডিওতেই ভয় পায়।” এই গান, এই স্বর, এই মুহূর্তে রানু যেন আর রানু নেই—সে হয়ে উঠেছে সেই আত্মার জীবন্ত প্রতিরূপ। সে শিশু, যে বলি হয়েছিল, যে আর কোনওদিন কথা বলতে পারেনি, সে যেন এই গান দিয়ে তার শেষ বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।

ঋদ্ধিমান ধীরে ধীরে গ্রামোফোন রেকর্ডটা তোলার সময় লক্ষ করল, তাতে লেখা—“মৌসুমি দে, ১৯৭৭, শেষ রেকর্ডিং।” সে হতবাক। রানু বলেছিল এই নামটা আগেই, সে বলেছিল গানটা ‘মৌসুমি দির’। এই নাম, এই রেকর্ড, আর এই গান—সব একসাথে মিলে যাচ্ছে। আত্মাটা শুধু শিশু নয়, সে ছিল এক সংগীতপ্রাণ আত্মা, যাকে বলি দেওয়া হয়েছিল ‘উপশমের’ নামে। সে তার শেষ গানটাও শেষ করতে পারেনি। রানু যেন আজ সেই অসমাপ্ত গান শেষ করছে, সেই আত্মার জীবনে অপূর্ণতা পূর্ণ করছে। রানুর গলায় সেই করুণ, বিষণ্ন ঠুমরি যেন শুধু একটি সঙ্গীত নয়, বরং একটি মুক্তির চাবিকাঠি।

গান শেষ হতেই রানুর শরীর এক ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে, এবং সে নিঃশব্দে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু তার মুখে তখন এক প্রশান্তির ছায়া, এক অভ্যন্তরীণ মুক্তির হাসি। দীপঙ্কর চোখ মুছতে মুছতে বলে, “শেষমেশ শান্তি পেল… হয়তো এবার সত্যিই গেল।” ঋদ্ধিমান মাথা নোয়াল, তার মনে হচ্ছিল, এক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়েছে, কিন্তু তার নিজের ভেতরটা যেন এক অদ্ভুত শুন্যতায় ভরে উঠছে। গলি আবার নীরব হয়ে গেল, বাতাসে কোনও সুর নেই, দরজাগুলো নিঃশব্দে বন্ধ, আর কুকুরগুলো শান্ত। কিন্তু সে জানে, এই নীরবতা অস্থায়ী। এই গলি, যার পেটের নিচে এত ইতিহাস, এত অপরাধ আর পাপ—এখন কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দ, কিন্তু একদিন আবার কোনও কান্না, কোনও ভুল, বা কোনও অসমাপ্ত আত্মা—এখানে ফিরে আসবে। এবং আবার কেউ, রাত ১২টার রেডিও চালু করে শুনবে সেই একই গান…

সমাপ্ত

1000050258.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *