Bangla - কল্পবিজ্ঞান

ভিনগ্রহের অতিথি

Spread the love

অনিন্দ্য মুখাৰ্জী


অধ্যায় ১ : অচেনা আলো
শিলিগুড়ির শহর তখনও পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েনি। পাহাড়ি হাওয়ায় মিশে ছিল চায়ের গন্ধ, দূরে ট্রেনের হুইসেল বাজছিল, আর আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই সময়েই ঘটে গেল অদ্ভুত ঘটনা। অর্ণব, বয়সে মাত্র চৌদ্দ, তখন জানালার পাশে বসে খাতা-কলমে আঁকাআঁকি করছিল। হঠাৎই তার চোখে পড়ল, আকাশে যেন এক বিশাল আগুনের গোলা ছুটে আসছে। প্রথমে মনে হলো কোনো বিমান হয়তো দুর্ঘটনায় পড়েছে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা আরও কাছে আসতে থাকলে স্পষ্ট হলো—এটা একেবারেই অন্যরকম। সেই গোলার চারপাশে ছিল নীল-সবুজ আলোর আভা, যা কোনোদিন কোনো আতশবাজিতেও দেখা যায়নি। মুহূর্তের মধ্যে পুরো আকাশ কেঁপে উঠল, আর সেই অচেনা বস্তুটি ভেঙে পড়ল শিলিগুড়ির উপকণ্ঠের জঙ্গলে। প্রবল শব্দে মাটি কেঁপে উঠল, পাখিরা ভয় পেয়ে উড়ে গেল, আর চারদিক যেন থমকে গেল। অর্ণব স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতরে ভয় আর কৌতূহল একসাথে খেলে গেল। বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে দেখল, কয়েকজন গ্রামবাসীও দূরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ চিৎকার করছে—“প্লেন পড়েছে, প্লেন পড়েছে!”
কিন্তু অর্ণবের মনে হচ্ছিল, এটা কোনো প্লেন নয়। সেই আলো তার চোখে এক অদ্ভুত দাগ কেটে গেছে। ভয়ের স্রোত সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও তার মনে হচ্ছিল, ঘটনাটা কাছ থেকে না দেখলে শান্তি পাবে না। তাই সে একাই বেরিয়ে পড়ল জঙ্গলের দিকে। চারপাশে তখনো ধোঁয়া ছড়িয়ে আছে, মাটির গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ সে এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। সামনে বিশাল এক ধাতব বস্তু মাটিতে অর্ধেক বসে আছে, তার চারপাশে মাটি পোড়া, গাছগুলো ভেঙে পড়েছে। বস্তুটার গায়ে অচেনা সব নকশা, যেগুলো হালকা নীল আলো ছড়িয়ে জ্বলছিল। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল—এটা পৃথিবীর কোনো যন্ত্র নয়। সে ধীরে ধীরে এগোতে যেতেই বস্তুটির একদিক খুলে গেল, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো এক অদ্ভুত আকৃতি। প্রথমে অর্ণব ভয় পেয়ে গা-ছমছম করে উঠল, কিন্তু যখন স্পষ্ট দেখল, তখন তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
এটা ছিল একটি শিশু। তবে মানুষের শিশু নয়, তার চেহারা অদ্ভুত—গায়ের রং হালকা নীলাভ, চোখ দুটি বড় আর উজ্জ্বল, মুখে কোনো ভয় নেই, বরং এক অদ্ভুত কৌতূহল। সে ধীরে ধীরে চারপাশ তাকাল, তারপর অর্ণবের দিকে এগিয়ে এলো। অর্ণব ভয়ে পেছনে সরে গেল, কিন্তু শিশুটি তার দিকে হাত বাড়াল। সেই মুহূর্তে অর্ণবের মনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত ছবি—একটি ঘর, তার ভেতরে আলোর রেখা, আর দূরে অসংখ্য তারা। অর্ণব হতভম্ব হয়ে গেল। এ তো তার নিজের চিন্তা নয়! বুঝতে পারল, এই শিশু কথা বলে না, কিন্তু মনের ভেতর ছবি এঁকে যোগাযোগ করছে। বুকের ভেতর ভয় ধীরে ধীরে কেটে গিয়ে জায়গা নিল এক অদ্ভুত টান। সে শিশুটির হাত ধরল, আর মনে হলো, এক নতুন যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। দূরে তখন গ্রামবাসীর চিৎকার আর কোলাহল ভেসে আসছিল, কিন্তু অর্ণব জানত—এই রহস্যময় অতিথিকে লুকিয়ে রাখতে হবে, নইলে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না।
অধ্যায় ২ : গোপন আশ্রয়
অর্ণব জানত, এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দূরে গ্রামবাসীরা ইতিমধ্যেই দৌড়ে আসছিল, কেউ আলো হাতে, কেউ চিৎকার করে খবর দিচ্ছিল পুলিশকে। যদি তারা এখানে এসে এই অদ্ভুত শিশুটিকে দেখে ফেলে, তবে আর তাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। অর্ণব দ্রুত হাত ধরে টেনে নিল শিশুটিকে, ফিসফিস করে বলল, “চলো, আমার সঙ্গে এসো।” যদিও শিশুটি তার ভাষা বোঝে না, তবু মনে হলো কথার সুরই যথেষ্ট ছিল। শিশুটি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল এবং অর্ণবের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। দুজন গাছপালার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এগোল। রাত তখন গভীর, চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর ধোঁয়ার গন্ধ। কোনোভাবে গ্রামের পথ এড়িয়ে অর্ণব তাকে নিয়ে পৌঁছে গেল নিজের পুরনো ঘরে। ঘরের ভেতরে একটি গোপন ঘর ছিল, যেটা সে ছোটবেলা থেকে বানিয়ে রেখেছিল—বন্ধুদের আড্ডা আর নিজের আঁকাআঁকির জন্য। এবার সেই ঘরই হয়ে উঠল সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
ভেতরে ঢুকতেই শিশুটি চারপাশে তাকিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠল। কাঠের দেওয়ালে টাঙানো অর্ণবের আঁকা ছবি, খাতার পাতায় আঁকা রঙিন নকশা দেখে তার চোখে যেন ঝিলিক জ্বলে উঠল। হঠাৎ সে হাত বাড়াল অর্ণবের দিকে, আর মুহূর্তেই অর্ণবের মনে ভেসে উঠল রঙিন ছবি—এক বিশাল গোলকধাঁধা ভরা আকাশ, যেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে অচেনা গ্রহগুলো, আর একটি ছোট্ট জাহাজ দৌড়ে যাচ্ছে অজানা আলোয় ভরা পথে। অর্ণব হতভম্ব হয়ে গেল। সে বুঝল, এই শিশুটি কেবল ছবি দেখাতে পারে না, বরং তার মনের গভীর কল্পনাও শেয়ার করতে পারে। অর্ণবের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস তৈরি হলো। মনে হলো, এতদিন যে আঁকাআঁকি সে শুধু কল্পনায় করত, এবার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সত্যিকার কল্পনার প্রাণী। কিন্তু একইসঙ্গে ভয়ও ঢুকে পড়ল মনে। যদি সরকারি লোকজন এ খবর জানতে পারে, তবে শিশুটিকে নিয়ে যাবে পরীক্ষাগারে, আর সে হয়তো আর কোনোদিন মুক্তি পাবে না।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে আবার চিৎকার শোনা গেল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে অর্ণব দেখল, কয়েকজন পুলিশ আর সরকারি কর্মচারী টর্চ নিয়ে ঘুরছে। তারা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আলোচনা করছে, কেউ বলছে, “নিশ্চয়ই কোনো বিমান ভেঙে পড়েছে,” আবার কেউ বলছে, “না, আমি দেখেছি, সেটা অন্য কিছু।” অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল, শিশুটিকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। শিশুটি তার দিকে নির্ভরতার দৃষ্টিতে তাকাল, আর মনের ভেতর আবার আঁকল এক ছবি—দুই হাত একে অপরকে শক্ত করে ধরে আছে, চারপাশে অন্ধকার হলেও মাঝখানে জ্বলছে এক ক্ষুদ্র আলো। সেই ছবি যেন প্রতিজ্ঞার মতো মনে হলো। অর্ণব গভীর শ্বাস নিল, আর মনে মনে বলল, “যা-ই হোক, তোমাকে আমি লুকিয়ে রাখব।” বাইরে ততক্ষণে কোলাহল বেড়েই চলছিল, কিন্তু গোপন ঘরের ভেতর জন্ম নিল এক নতুন বন্ধুত্ব, যার শুরুটা হলো অন্ধকার আর ভয়ের মধ্যেই।
অধ্যায় ৩ : অনুসন্ধানের ছায়া
পরদিন সকালেই শিলিগুড়ি শহরে হইচই পড়ে গেল। স্থানীয় সংবাদপত্রে খবর বেরোল—“রাতের আকাশে অদ্ভুত আলোর ঝলকানি, জঙ্গলে ভেঙে পড়েছে অচেনা বস্তু।” কেউ বলল এটি উল্কাপিণ্ড, কেউ বলল গোপন সামরিক পরীক্ষা। তবে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলল সরকারের আকস্মিক আগমন। সকালবেলা থেকেই কয়েকটি কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল গ্রামের রাস্তায়, সঙ্গে ভারী অস্ত্র হাতে কিছু সেনা। তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট চাপা উত্তেজনা। তারা চারপাশে খোঁজখবর শুরু করল, মানুষজনকে জেরা করতে লাগল। অর্ণব দূর থেকে সবকিছু দেখছিল। বুকের ভেতর তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল, কারণ সে জানত সত্যিটা—যে অচেনা বস্তুটা তারা খুঁজছে, সেটি আসলে সেই স্পেসশিপ, আর যার খোঁজ তারা করছে, সে এখন তার গোপন ঘরের ভেতরে লুকিয়ে আছে। তবু কাউকে কিছু না জানিয়ে স্বাভাবিক ভান করল, যেন ঘটনাটার সঙ্গে তার কোনো যোগই নেই।
তবে বিপদ আরও বাড়ল যখন সন্ধ্যার দিকে গোপন সামরিক বাহিনীর কয়েকজন অফিসার গ্রামে এসে উপস্থিত হলো। তাদের চোখ ছিল শিকারীর মতো ধারালো, যেন সামান্য ইঙ্গিত পেলেই আঁকড়ে ধরবে। তারা গোপনে গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়ে তথ্য বের করতে চাইছিল। কেউ কেউ বলছিল, “আমরা শুধু আলো দেখেছি,” আবার কেউ বলল, “জঙ্গলে কিছু একটা পড়েছিল, কিন্তু পরে আর কিছু পাইনি।” অর্ণব জানত, এভাবেই ধীরে ধীরে তারা সত্যের কাছে পৌঁছে যাবে। সে তাই রাতের বেলা আবার শিশুটির কাছে গেল। ছোট্ট সেই ভিনগ্রহী তখন কোণায় বসে অর্ণবের খাতার পাতায় আঁকা ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছিল। অর্ণব তাকে ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের আরও সাবধান হতে হবে। ওরা তোমার খোঁজ করছে।” শিশুটি হয়তো কথাগুলো বুঝল না, তবে চোখ বন্ধ করে তার মনের ভেতর এঁকে দিল এক ভয়াবহ ছবি—কালো পোশাকের মানুষরা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে, আর মাঝখানে সে নিজে খাঁচার ভেতরে আটকে আছে। অর্ণবের বুক শিউরে উঠল। সে বুঝল, শিশুটি বিপদের আঁচ পেয়ে গেছে।
এখন আর দেরি করা চলবে না। অর্ণব সিদ্ধান্ত নিল, কেবল ঘরে লুকিয়ে রাখলে হবে না, বরং আরও শক্ত পরিকল্পনা করতে হবে। পরের দিন থেকে সে অজুহাত বানিয়ে বারবার জঙ্গলে যেতে শুরু করল, যাতে বাইরের লোকজন ভাবে—সে কেবল কৌতূহল মেটাচ্ছে। আসলে সে প্রতিবারই ঘুরে ঘুরে সম্ভাব্য নিরাপদ জায়গা খুঁজছিল। একইসঙ্গে শিশুটির সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হতে লাগল। মনের ভেতর ছবি আঁকার মাধ্যমে শিশুটি ধীরে ধীরে তার গ্রহের টুকরো টুকরো স্মৃতি দেখাতে শুরু করল—অচেনা আকাশ, অদ্ভুত গাছপালা, আর নীল রঙের সমুদ্র। কখনো সে দেখাত নিজের পরিবারের ছায়ামূর্তি, যাদের চোখেও একইরকম উজ্জ্বল আলো। অর্ণব বুঝল, এই শিশু শুধু অচেনা নয়, সে ঘর ছেড়ে আসা একাকী প্রাণী, যে হয়তো আর ফিরে যেতে পারবে না। এই উপলব্ধি তার মনে এক গভীর দায়িত্ববোধ জাগিয়ে দিল। বাইরে যখন অনুসন্ধানের ছায়া ঘন হয়ে আসছে, তখন ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক অটুট বন্ধন, যা তাকে আরও দৃঢ় করে তুলল শিশুটিকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞায়।
অধ্যায় ৪ : সন্দেহের চোখ
দিন যত এগোতে লাগল, পরিস্থিতি তত জটিল হয়ে উঠল। শিলিগুড়ির আশেপাশের গ্রামগুলোতে সেনাদের টহল বেড়ে গেল। সকাল থেকে রাত অবধি কালো গাড়িগুলো ঘুরে বেড়াত, আর অফিসাররা লাউডস্পিকারে ঘোষণা করত—“যদি কেউ অদ্ভুত কোনো বস্তুর খোঁজ পান বা অচেনা কোনো জীব দেখতে পান, সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। লুকানোর চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” গ্রামবাসীদের মনে ভয় ঢুকে পড়ল। অনেকে নিজেদের চোখে দেখা আলো কিংবা শব্দের কথা স্বীকার করতে দ্বিধা করল। কিন্তু কিছু কৌতূহলী যুবক আবার ইচ্ছে করেই জঙ্গলের দিকে যাওয়া শুরু করল, ভেবে নিল যে কিছু পেলে নাম হবে কিংবা পুরস্কার মিলবে। অর্ণবের ভেতরে তখন একটাই দুশ্চিন্তা—যদি কেউ সত্যিই শিশুটিকে খুঁজে পায়?
এই অবস্থায় তার চারপাশের মানুষও বদলাতে শুরু করল। পাশের বাড়ির মিষ্টার দত্ত, যিনি সবসময় খবরের কাগজ হাতে নিয়ে রাজনীতি আলোচনা করতেন, হঠাৎ একদিন অর্ণবকে প্রশ্ন করে বসলেন, “রে অর্ণব, তুই তো ওই রাতেই বাড়ির ছাদে ছিলি, তাই না? কিছু দেখেছিস?” অর্ণব অবাক হয়ে গেল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নাড়ল, “না কাকু, কেবল আলো দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আতশবাজি।” মিষ্টার দত্ত তখনও সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকলেন। একইভাবে স্কুলে গিয়েও অর্ণব দেখল, কিছু বন্ধুর চোখে কৌতূহল আর অদ্ভুত দৃষ্টি। যেন সবাই খুঁজছে, কে কিছু লুকোচ্ছে। অর্ণব বুঝল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ এখন নজরে রয়েছে। সে তাই আরও সাবধানে চলতে শুরু করল।
তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল রাতে। অর্ণব যখন শিশুটিকে দেখতে গেল, তখন সে কোণায় বসে হঠাৎ ভয়ে কুঁকড়ে ছিল। চোখে উজ্জ্বলতা থাকলেও মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। অর্ণব কাছে যেতেই শিশুটি তার মনে আঁকল একটি দৃশ্য—অর্ণবের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালো গাড়ি, আর কিছু লোক দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকছে। অর্ণবের শরীর কেঁপে উঠল। এ কি ভবিষ্যতের ছবি? নাকি কেবল কল্পনা? সে শিশুটির কাঁধে হাত রেখে ধীরে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমি আছি।” তবু তার নিজের বুকের ভেতরে ভয় ঢুকে পড়ল। যদি সত্যিই এমন হয়, তবে কোথায় নিয়ে যাবে সে শিশুটিকে? কেমন করে রক্ষা করবে? বাইরে সন্দেহের চোখ যত ঘনীভূত হচ্ছে, ভেতরে ততই দৃঢ় হচ্ছে অর্ণবের প্রতিজ্ঞা—যে কোনো মূল্যে এই ভিনগ্রহী বন্ধুকে আড়াল করে রাখতে হবে। কিন্তু সে জানত না, সন্দেহের এই আগুন ক্রমেই আরও বড় হতে চলেছে।
অধ্যায় ৫ : ধাওয়ার শুরু
এক সকালে পুরো গ্রাম হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। খবর এলো, জঙ্গলের ভেতরে সেনারা অদ্ভুত কিছু চিহ্ন পেয়েছে—মাটি পুড়ে যাওয়া দাগ, গাছের ডালপালা ভেঙে যাওয়া, আর ধাতব টুকরোর মতো কিছু ছড়িয়ে আছে চারদিকে। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সবাই বুঝে গেল, সরকার যেটা উল্কাপিণ্ড বলে চালিয়ে দিচ্ছিল, সেটা নিছক প্রলেপ। আসলেই এখানে ঘটেছে কোনো রহস্যময় ঘটনা। অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কারণ সে জানত এর মানে কী—সেনারা খুব শিগগিরই আরও কাছে চলে আসবে। স্কুলে গিয়েও সে স্বাভাবিক থাকতে পারল না। ক্লাসে বসে শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল, আর মনে মনে প্রার্থনা করল যেন শিশুটি নিরাপদে থাকে। দুপুরের পরপরই বাড়ি ফেরার পথে সে দেখল, গ্রামের রাস্তায় গাড়ির ভিড় বেড়েছে, সেনাদের মুখে কঠোরতা স্পষ্ট। যেন সারা গ্রামটাই পরিণত হয়েছে অনুসন্ধানের ফাঁদে।
সেদিন রাতে হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। অর্ণব চমকে উঠল, ভেবেছিল হয়তো সেনারা এসেছে। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখল, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয় দাঁড়িয়ে আছে। জয় ফিসফিস করে বলল, “আমি জানি তুই কিছু লুকোচ্ছিস। কাল তোকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছি। বল, কী হচ্ছে?” অর্ণব এক মুহূর্ত থমকে গেল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না, তুই ভুল দেখেছিস।” কিন্তু জয় এত সহজে থামল না। তার চোখে কৌতূহল আর বন্ধুত্বের টান একসঙ্গে কাজ করছিল। “দেখ, আমি তোকে ধরিয়ে দেব না। কিন্তু তুই চাইলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারিস।” অর্ণবের মন দ্বিধায় পড়ে গেল। সত্যি বলতে চাইছিল, কিন্তু ভয় করছিল—যদি জয় বিশ্বাসঘাতকতা করে? তবু শিশুটির আঁকা ছবিগুলো মনে পড়ে তার হৃদয়ে নরমতা এল। সে সিদ্ধান্ত নিল, এখনও কাউকে সত্যি বলবে না। জয়কে এড়িয়ে গিয়ে সে দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
ভেতরে ঢুকে দেখল, শিশুটি জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ভয় আর উদ্বেগ মিশে আছে। অর্ণব কাছে যেতেই শিশুটি তার মনের ভেতরে এঁকে দিল আরেকটি ছবি—ঘন জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াচ্ছে তারা দুজন, আর পিছনে কালো গাড়ি আর টর্চের আলো তাড়া করছে। অর্ণব বুঝল, বিপদ আসন্ন। সে গভীর শ্বাস নিয়ে শিশুটির কাঁধে হাত রাখল, বলল, “আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।” সেই রাত থেকেই তারা দুজন মিলে পালানোর পরিকল্পনা করতে লাগল। কোথায় যাবে, কীভাবে লুকোবে—সবকিছু ভেবে দেখা শুরু হলো। কিন্তু এর মধ্যেই গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আরেকটি খবর—কেউ একজন নাকি রাতে অদ্ভুত আকৃতির ছোট্ট প্রাণীকে জঙ্গলের মধ্যে ছুটতে দেখেছে। এই খবর যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল। সেনারা আরও সক্রিয় হয়ে উঠল, টহল বেড়ে গেল, আর গ্রামবাসীরা অস্থির হয়ে পড়ল। অর্ণব বুঝল, সত্যিই ধাওয়ার শুরু হয়ে গেছে। এখন সময় অল্প, ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।
অধ্যায় ৬ : অরণ্যের অন্তরালে
পরদিন ভোরেই অর্ণব সিদ্ধান্ত নিল, আর দেরি করা যাবে না। চারদিকে সেনাদের তল্লাশি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, গ্রামবাসীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, এমনকি স্কুলেও অফিসাররা হঠাৎ ঢুকে ছাত্রদের জেরা করছে। এ অবস্থায় শিশুটিকে ঘরে রাখা মানেই ধরা পড়ার ঝুঁকি। তাই অর্ণব গোপনে কিছু শুকনো খাবার, পানি আর একটা ছোট্ট কম্বল নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম আলো উঁকি দিচ্ছিল, আকাশে তখনও কুয়াশার চাদর ঢাকা। শিশুটিকে ইশারা করে সে বাইরে বেরিয়ে এলো, আর দুজনে মিলিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটা শুরু করল। চারদিক তখন নিস্তব্ধ, কেবল পাখিদের ডাকে ভোর ভাঙছিল। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতেই শিশুটির চোখে কৌতূহল জ্বলে উঠল। সে মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখত, কখনো ঘাসের গন্ধ নিয়ে হাসত। অথচ তার মনে অর্ণব স্পষ্ট দেখল এক অদ্ভুত ছবি—এক বিশাল গাছ, যার পাতাগুলো অচেনা রঙে জ্বলছে, আর তার নিচে খেলছে তার মতো আরও কিছু শিশু। অর্ণবের বুক হালকা হয়ে এলো, মনে হলো অন্তত এখানে এসে সে শিশুটিকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ দিতে পারছে।
কিন্তু বিপদ যেন তাদের পিছু ছাড়ছিল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই জঙ্গলের ভেতর ভেসে এলো মানুষের আওয়াজ—সেনাদের দল ঢুকে পড়েছে। তাদের হাতে ওয়াকিটকি, টর্চ আর বিশেষ যন্ত্র, যা দিয়ে তারা মাটির তাপমাত্রা পর্যন্ত মাপছে। অর্ণব আর শিশুটি তখন লুকিয়ে পড়েছিল এক বিশাল গাছের ফাঁপা কোটরে। ভিতরে আঁধার, কিন্তু নিরাপত্তার আশ্বাসও ছিল। শিশুটি অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরে তার মনে আঁকল এক ছবি—অন্ধকার গুহার ভেতরে আলো ঝলমল করছে, আর বাইরে দাঁড়িয়ে ভয়ংকর ছায়ারা খুঁজে ফিরছে। অর্ণব শিশুটির ভয়ের আঁচ বুঝতে পারল। সে তার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “আমি আছি, ভয় পেও না।” বাইরে তখন সেনাদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ কাছে আসছিল। এক অফিসার বলছিল, “তাপমাত্রা বলছে, এখানেই কিছু আছে।” অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। যদি তারা এই গাছের ভেতরে তাকায়, তবে সব শেষ।
ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে বজ্রপাত শুরু হলো। প্রবল বৃষ্টিতে টর্চের আলো নিভে যেতে লাগল, সেনারা গুলিয়ে গেল। প্রকৃতি যেন হঠাৎ তাদের হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সুযোগ বুঝে অর্ণব শিশুটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়ল। ভিজে কাদায় পা পিছলাচ্ছিল, তবু তারা থামল না। জঙ্গলের গভীরে গিয়ে এক জায়গায় পৌঁছাল, যেখানে পাহাড়ি ঝরনা বয়ে চলেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে শিশুটি প্রথমবার অর্ণবের দিকে হেসে তাকাল। তার চোখে আলো জ্বলে উঠল, আর মনে এঁকে দিল এক ছবি—দূর আকাশের ওপারে বিশাল এক নদী, যার ধারে দাঁড়িয়ে সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। অর্ণবের চোখে জল এসে গেল। সে জানত, এই পথ সহজ নয়, তবু প্রতিজ্ঞা করল, “আমি তোমাকে তোমার ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।” কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না, এ প্রতিজ্ঞা তাকে কত বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ বাইরে সেনারা তাদের গন্ধ পেয়ে গেছে, আর অরণ্যের অন্তরাল যতই তাদের ঢেকে রাখুক, ধাওয়ার ছায়া আরও গভীর হয়ে উঠছে।
অধ্যায় ৭ : বিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতা
জঙ্গলের গভীরে আশ্রয় নেওয়ার পর ক’দিন অর্ণব আর শিশুটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। বৃষ্টিতে সেনাদের তল্লাশি কিছুটা কমে গিয়েছিল, আর গ্রামবাসীরাও ধীরে ধীরে ঘটনাটির প্রতি উদাসীন হয়ে উঠছিল। তবে গোপন সামরিক বাহিনী হাল ছাড়েনি। তারা রাতদিন ড্রোন উড়িয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ করছিল, কখনো হেলিকপ্টার ঘুরে বেড়াত আকাশে। অর্ণব এই সময়গুলোতে শিশুটিকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রাখত। তবে তাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠল। অর্ণব যখন ক্লান্ত হয়ে গাছের গুঁড়ির উপর বসত, শিশুটি তার মনে এঁকে দিত শান্তির ছবি—সবুজ প্রান্তরে দুই বন্ধু হাঁটছে, আকাশে রঙিন আলো ছড়িয়ে আছে। অর্ণবের মনে হতো, এ যেন ভয়ের মধ্যেও আশার আলো। তবু তার ভেতরে একটাই দুশ্চিন্তা—এই গোপনটুকু চিরদিন আড়ালে রাখা সম্ভব হবে তো?
এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হলো তখনই, যখন জয় আবার তার সামনে হাজির হলো। এক সন্ধ্যায় জঙ্গলের প্রান্তে খাবার আনতে যাওয়া অর্ণব হঠাৎ জয়কে দেখে থমকে গেল। জয় বিস্মিত চোখে বলল, “তুই সত্যিই কিছু লুকোচ্ছিস! ওটা কে?” দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটিকে দেখে জয় হতবাক হয়ে গেল। অর্ণব বোঝানোর চেষ্টা করল, “শোন, এটা বিপদের মধ্যে আছে। ও কারও ক্ষতি করবে না।” কিন্তু জয় তখন দ্বিধায় ভুগছিল। একদিকে তার বন্ধুত্ব, অন্যদিকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া ভয় আর সরকারি পুরস্কারের লোভ। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বলল, “আমি তোকে ধরিয়ে দেব না… তবে আমাকে সব জানাতে হবে।” অর্ণব কিছুটা স্বস্তি পেল, কিন্তু শিশুটি তার মনে এঁকে দিল এক ভীতিকর ছবি—জয় সেনাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, আর অর্ণব আর সে হাতকড়া পরা অবস্থায় বন্দি। অর্ণব হতচকিত হয়ে তাকাল জয়ের দিকে, মনে হলো এই বন্ধুত্বের আড়ালেই হয়তো লুকিয়ে আছে আসন্ন বিশ্বাসঘাতকতা।
সেই রাতে অর্ণব ঘুমোতে পারল না। একদিকে জয়ের প্রতি ভরসা, অন্যদিকে শিশুটির আঁকা আশঙ্কাজনক ছবি তাকে দ্বিধায় ফেলল। শেষমেশ সে ঠিক করল, যতক্ষণ না প্রমাণ পাচ্ছে ততক্ষণ কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না। শিশুটিকে নিয়ে সে আরও গভীরে, পাহাড়ি পথ ধরে জঙ্গলের অচেনা অংশে চলে গেল। তবে এই পালানোয় নতুন বিপদ তৈরি হলো। ড্রোনগুলো ক্রমে তাদের পথ অনুসরণ করতে শুরু করল, আকাশে সার্চলাইট জ্বলতে লাগল। অর্ণব বুঝল, হয়তো কোথাও কোনো খবর ফাঁস হয়ে গেছে। তার বুক কেঁপে উঠল—জয় কি সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করল? উত্তর সে তখনও জানত না, তবে বুঝে গিয়েছিল, বিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার সীমানা পার হয়ে তাদের যাত্রা এখন আরও ভয়ঙ্কর পথে এগোচ্ছে।
অধ্যায় ৮ : ধরা পড়ার প্রহর
জঙ্গলের গভীরে যতই তারা আশ্রয় নিচ্ছিল, ততই যেন বিপদ ঘনীভূত হচ্ছিল। দিন কেটে যাচ্ছিল আতঙ্ক আর পালানোর মধ্যে। অর্ণব প্রতিদিনই শিশুটিকে নিয়ে নতুন জায়গায় সরে যাচ্ছিল, কিন্তু সেনাদের খোঁজ যেন তাদের পিছু ছাড়ছিল না। হেলিকপ্টারের শব্দ প্রায় প্রতিরাতে শোনা যেত, কখনো আবার সার্চলাইট কেটে যেত ঘন অরণ্যের মাথা। শিশুটি তখন অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরে তার মনে আঁকত আতঙ্কের ছবি—কালো পোশাকের মানুষের ছায়া, বন্দুকের ঝলক, আর তার নিজের বন্দিত্ব। অর্ণব তাকে শান্ত করতে চাইত, কিন্তু নিজেই জানত না, কতোদিন এভাবে পালিয়ে থাকা সম্ভব।
এক রাতে হঠাৎই সবকিছু বদলে গেল। হালকা বৃষ্টির পর অরণ্যে কুয়াশা নেমে এসেছিল। অর্ণব আর শিশুটি একটি পাথরের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। ঠিক তখনই দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ভেসে এলো, আর তার সঙ্গে ভেসে এলো মানুষের চিৎকার—“ওরা এই দিকেই আছে!” অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে শিশুটিকে কোলের কাছে টেনে নিল, আর দৌড় শুরু করল পাহাড়ি পথ ধরে। শিশুটি তার মনে আঁকতে লাগল ভয়ের স্রোত—তাদের পিছনে আসছে আগুনের মতো ছুটে চলা আলো আর মানুষ। অর্ণব যত দ্রুত দৌড়াচ্ছিল, ততই চারপাশ অন্ধকারে ভরে উঠছিল। কিন্তু কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর মানুষের পদশব্দ ক্রমেই কাছে চলে আসছিল। এ যেন এক নিঃশ্বাসরুদ্ধকর ধাওয়া।
শেষ পর্যন্ত একসময় তারা এক পাহাড়ি খাদে এসে পৌঁছাল। নিচে গভীর অরণ্য, উপরে ধাওয়া করা মানুষের ছায়া। অর্ণব বুঝল, আর কোনো পথ নেই। ঠিক তখনই শিশুটি তার হাত ধরে মনে এঁকে দিল এক ছবি—তারা দুজন উড়ে যাচ্ছে আকাশে, নিচে ফেলে রেখে যাচ্ছে অন্ধকার আর ভয়। অর্ণব অবাক হয়ে গেল, কিন্তু জানত বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তবু শিশুটি হঠাৎ চোখ বন্ধ করে অদ্ভুত আলো ছড়াল, আর মুহূর্তের মধ্যে তাদের চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে গেল। সেনারা টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজে ফিরল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। অর্ণব আর শিশুটি তখন কুয়াশার আড়ালে নেমে পড়ল পাহাড়ের ঢালে, আর অন্ধকার তাদের ঢেকে দিল। তারা আপাতত বেঁচে গেল, কিন্তু অর্ণব বুঝল—এই ধরা পড়ার প্রহর একদিন না একদিন সত্যিই তাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। আর তখন হয়তো কেবল পালিয়ে বাঁচা সম্ভব হবে না।
অধ্যায় ৯ : চূড়ান্ত সংঘর্ষ
কুয়াশার আড়ালে পালানোর পর অর্ণব আর শিশুটি কয়েকদিন ধরে পাহাড়ি জঙ্গলের আরও ভেতরে আশ্রয় নিল। তারা প্রায় খাবার শেষ করে ফেলেছিল, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, কিন্তু আশা ছেড়ে দেয়নি। অর্ণব বারবার ভাবছিল, কীভাবে শিশুটিকে তার জগতে ফেরত পাঠানো যায়। হয়তো সেই ভেঙে পড়া স্পেসশিপের ভেতরে কোনো সূত্র আছে। শিশুটিও মাঝে মাঝে তার মনে ভেসে তুলত সেই জাহাজের ছবি—নীল আলোয় ভরা ককপিট, অচেনা বোতাম, আর দূর আকাশের পথে উড়ে চলা। অর্ণবের মনে দৃঢ় হলো, শেষবার হলেও তাকে সেই জায়গায় ফিরতে হবে। তাই এক গভীর রাতে দুজন বেরিয়ে পড়ল সেই দুর্ঘটনাস্থলের দিকে।
কিন্তু ওরা জানত না, একই সময়ে সেনারা ওখানেই ডেরা বেঁধে আছে। ভাঙা স্পেসশিপ ঘিরে রাখা হয়েছে লোহার ব্যারিকেডে, চারপাশে অস্ত্র হাতে প্রহরীরা দাঁড়িয়ে। ওরা গোপনে ঝোপের আড়াল থেকে তাকাতেই অর্ণবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ঠিক তখনই পিছন থেকে শব্দ এলো। তারা ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল—জয়! তার চোখে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। জয় ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাদের থামাতে আসিনি। কিন্তু এখানে বিপদ আছে, সেনারা তোমাদের খুঁজছে।” অর্ণব হতবাক হয়ে গেল। এতদিনের সন্দেহ সত্ত্বেও এবার মনে হলো জয় সত্যিই সাহায্য করতে চাইছে। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ প্রোজেক্টরের আলো তাদের উপর পড়ল, আর মুহূর্তে চারপাশ ভরে গেল চিৎকারে—“ওরা এখানে!”
সেনারা দৌড়ে এলো, বন্দুক তাক করল। অর্ণব শিশুটিকে আঁকড়ে ধরল। ঠিক তখনই শিশুটি চোখ বন্ধ করে এক প্রবল আলোকরেখা ছড়িয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে সেনারা দিশাহারা হয়ে গেল, কেউ মাটিতে পড়ে গেল, কেউ চোখ ঢাকল। অর্ণব এই সুযোগে শিশুটিকে নিয়ে স্পেসশিপের ভাঙা অংশের দিকে দৌড় দিল। জয়ও তাদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই তারা বুঝল, জাহাজটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কেবল কয়েকটি যন্ত্র এখনো জ্বলজ্বল করছে। শিশুটি কাঁপা হাতে একটি বোতামের দিকে ইশারা করল। অর্ণব দ্বিধা না করে বোতাম চাপল। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ থেকে এক তীব্র কম্পন বেরোল, আকাশে নীল রশ্মি ছুটে গেল, আর চারপাশ যেন কেঁপে উঠল। সেনারা আবার আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু জাহাজের সেই আলো যেন তাদের পিছু হটিয়ে দিল। এ এক চূড়ান্ত সংঘর্ষ—যেখানে অর্ণব, শিশুটি আর জয় দাঁড়িয়ে আছে অজানা ভবিষ্যতের সামনে।
অধ্যায় ১০ : বিদায় ও নতুন ভোর
জাহাজের ভেতরে দাঁড়িয়ে অর্ণব অনুভব করছিল পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা শক্তির কম্পন। শিশুটি তার চোখে তাকিয়ে মনে এঁকে দিল এক শেষ ছবি—তার নিজ গ্রহের, যেখানে নীল আকাশের নিচে রুপালি আলো ছড়িয়ে আছে, আর অচেনা ফুলে ভরা পাহাড় ঝলমল করছে। অর্ণব হঠাৎ বুঝতে পারল, এই শিশু আর এখানে বেশিদিন থাকতে পারবে না। হয়তো সেই বোতামের শক্তিই তাকে তার গ্রহে ফেরানোর পথ খুলে দিয়েছে। বাইরে তখনো সেনাদের চিৎকার, হেলিকপ্টারের গর্জন, বন্দুকের শব্দ কানে আসছিল, কিন্তু জাহাজের ভেতরে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এসেছিল। শিশুটি অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরে কেবল একটাই ছবি আঁকল—বিদায়।
হঠাৎই জাহাজ কেঁপে উঠল। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল নীল আলোয় ঘেরা একটি গোলক। শিশুটি তার ভেতরে পা রাখতেই গোলক আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অর্ণবের চোখ ঝলসে যাচ্ছিল, তবু সে এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরাতে পারছিল না। জয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখে মিশ্র অনুভূতি—আশ্চর্য, ভয় আর বিস্ময়। গোলক থেকে এক ঝলক আলো ছুটে গেল আকাশের দিকে, তারপর মুহূর্তের মধ্যেই শিশুটি অদৃশ্য হয়ে গেল। জাহাজের ভেতরে রয়ে গেল কেবল শূন্যতা আর নিস্তব্ধতা। অর্ণব হঠাৎ টের পেল, বুকের ভেতরে যেন শূন্য হয়ে গেছে কিছু একটা, ঠিক যেমন অচেনা বন্ধুকে হঠাৎ হারানোর বেদনা।
বাইরে যখন আলো মিলিয়ে গেল, সেনারা জাহাজের ভেতরে ঢুকতে পারল, কিন্তু কিছুই খুঁজে পেল না। তাদের সামনে কেবল ভাঙা ধাতব কাঠামো, নিস্তব্ধতা আর এক কিশোর—অর্ণব। সেনারা হতবাক হয়ে তাকে দেখল, কিন্তু অর্ণবের চোখে তখন কেবল একটিই দৃশ্য ঘুরছিল—শিশুটি তার গ্রহে পৌঁছে গেছে। পরদিন সকালবেলায়, সূর্যের আলো যখন পাহাড়ের মাথায় ঝলমল করছিল, অর্ণব আর জয় নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল ভাঙা জায়গার পাশে। জয় ধীরে বলল, “তুই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলি।” অর্ণব শুধু হেসে মাথা নেড়ে বলল, “ও ফিরে গেছে বাড়ি। এটাই সবচেয়ে বড় জয়।” আকাশে তখনো এক টুকরো অচেনা আলো ভাসছিল, যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল—কখনো কখনো ভিনগ্রহের অতিথিও পৃথিবীতে এসে বন্ধুত্ব রেখে যায়, আর সেই স্মৃতি থেকে যায় মানুষের হৃদয়ে চিরদিনের মতো।
শেষ

1000066728.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *