১
নদীর ধারে নৌকো এসে ভিড়ল যখন, তখন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। গোধূলির আলো মিশে আছে মেঘলা আকাশের গায়ে, আর দূরে জলপাখিদের দল ভেসে যাচ্ছে মেঘের মতো। অর্ণব সেন নৌকার গা থেকে ক্যামেরার ব্যাগ নামালেন, তাঁর চোখে এক ধরনের উজ্জ্বল উত্তেজনা—যে উত্তেজনা কেবল নতুন জঙ্গল, নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। ভিতরকনিকা ন্যাশনাল পার্কের নাম তিনি বহুবার শুনেছেন, বহু বইয়ে পড়েছেন, নানা নেচার ডকুমেন্টারিতেও দেখেছেন। কিন্তু এই প্রথমবার, নিজ চোখে, নিজ ক্যামেরা হাতে তিনি প্রবেশ করছেন সেই রহস্যময় ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভেতরে, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লবণাক্ত জলের কুমিরেরা থাকে। চারপাশে নদীর খালবিল, কাদাজল, আর শ্বাসমূলের অদ্ভুত বন যেন তাঁকে অদ্ভুত এক জগতে নিয়ে গেল। হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটায় পাখিদের ঝাঁক উড়ে গেল ওপরে, অর্ণব অবাক হয়ে তাকালেন—এই শব্দ, এই দৃশ্য, শহরের কংক্রিটের দেয়ালে আটকে থাকা জীবনের সঙ্গে কোনো মিল নেই। তাঁর মন এক মুহূর্তে হালকা হয়ে উঠল, যেন শহরের ক্লান্তি, অফিসের চাপে জমে থাকা ধুলো এখানে এসে ধুয়ে যাচ্ছে।
নৌকা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে জুতোর তলায় নরম কাদা টের পেলেন তিনি। চারপাশে নীরবতা, শুধু দূরে কোথাও বক ডাকছে, আর বাতাসে মিশে আছে লোনা জলের ঘ্রাণ। এ এক অদ্ভুত গন্ধ—কখনো কটু, কখনো মাটির মতো পবিত্র। ক্যামেরার লেন্সে চোখ নিয়ে তিনি আশেপাশের দৃশ্য ধারণ করলেন। ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল মাটির ওপর থেকে সুঁইয়ের মতো উঠে এসেছে, যেন প্রকৃতি এখানে নিজের অন্যরকম নিয়ম বানিয়ে রেখেছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো নদীর ওপর ছড়িয়ে পড়েছে, জলে প্রতিফলিত হচ্ছে এক অচেনা রহস্য। অর্ণব জানতেন, এখানে আসা সহজ নয়। ভিতরকনিকা একদিকে অতি সংবেদনশীল পরিবেশব্যবস্থা, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনকও। এখানে একবার ঢুকলে বাঘ, কুমির, সাপ—কোনো কিছুর মুখোমুখি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবু এই বিপদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ছবি তোলার সম্ভাবনা। তাঁর ক্যামেরা যেন এক যোদ্ধার অস্ত্র, আর তিনি নিজে সেই যোদ্ধা, যে খুঁজছে সময়ের গহনে হারিয়ে যাওয়া এক মুহূর্ত।
ঠিক সেই সময়, একটি ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল পেছন থেকে—“আপনি নতুন এসেছেন বুঝি?” ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন এক মধ্যবয়সী মানুষ, ধূসর দাড়ি, রোদে পোড়া চামড়া, চোখে অদ্ভুত গভীরতা। গায়ে খাকি রঙের ইউনিফর্ম, হাতে লাঠি। এ যে বনের রক্ষী, তা বুঝতে দেরি হলো না। লোকটি এগিয়ে এসে বলল—“আমি বীরেন মহান্তি। বহু বছর ধরে এই জঙ্গলে কাজ করছি। সবাই আমাকে বীরেন দা বলে ডাকে।” অর্ণব হাসিমুখে পরিচয় দিলেন, আর বললেন—“আমি অর্ণব সেন, ফটোগ্রাফার। বিশেষ করে কুমিরদের ছবি তুলতে এসেছি।” বীরেন মহান্তি ঠোঁট বাঁকিয়ে এক চিলতে হাসলেন, কিন্তু সেই হাসির ভেতর যেন এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে ছিল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন—“কুমির তো পাবেনই। কিন্তু মনে রাখবেন, ভিতরকনিকায় সবকিছু চোখে দেখা যায় না। অনেক কিছু আছে, যা লেন্সেও ধরা পড়ে না।” কথাটা শুনে অর্ণব কিছুটা কৌতূহলী, কিছুটা অবাক হলেন। “মানে?”—জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলেন, কারণ বীরেন আর কিছু বললেন না, শুধু দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেই দৃষ্টিতে যেন ছিল শতাব্দীর অভিজ্ঞতা, অজানা গোপনীয়তা, আর সতর্কবার্তা।
অর্ণব তাঁর ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ টের পেলেন। তাঁর আসার উদ্দেশ্য স্পষ্ট—বিরল প্রজাতির কুমিরের ছবি তুলে তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে চান। হয়তো কোনো নামী সাময়িকীর প্রচ্ছদে ছাপা হবে তাঁর তোলা ছবি। কিন্তু এই মুহূর্তে, জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে, তিনি যেন বুঝতে পারলেন—ভিতরকনিকা শুধুই একটি জায়গা নয়, এটি এক রহস্যময় জগৎ। এখানে প্রতিটি বাতাসে, প্রতিটি পাতার নড়াচড়ায় লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা মানুষকে একই সঙ্গে টানে আর ভয় দেখায়। তিনি ক্যামেরা হাতে আরও কিছু ছবি তুললেন—ঝুঁকে থাকা গাছ, অদ্ভুত লতাগুল্ম, শ্বাসমূলের জঙ্গল, আর নদীর ওপর ভেসে থাকা শেষ বিকেলের আলো। দূরে কোথাও একটা ভারী শব্দ হলো, যেন জলের নিচে কোনো বিশাল দেহ নড়ল। অর্ণব তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু কিছু দেখতে পেলেন না। মুহূর্তেই মনে হলো, বীরেন মহান্তির কথাই যেন সত্যি—ভিতরকনিকায় সবকিছু দেখা যায় না। সেই প্রথম দিনের সেই মুহূর্তে, অর্ণব অনুভব করলেন, তিনি প্রবেশ করেছেন এক অনিশ্চিত অভিযাত্রায়, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ তাঁকে অজানা কোনো সত্যের দিকে নিয়ে যাবে।
২
প্রথম রাত কাটল অর্ণবের জন্য এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতায়। ভিতরকনিকায় রাত মানেই ঘন অন্ধকার, নদীর জল কালো কালি হয়ে যায়, আর বাতাসে মিশে থাকে অজানা শব্দ—কখনো পাখির ডানা ঝাপটানো, কখনো হঠাৎ ভেসে আসা চিঁহিঁ করার আওয়াজ, আবার কখনো এমন নিস্তব্ধতা, যা শহরের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। পরদিন ভোরে, যখন আকাশ ফিকে কমলা রঙে রাঙাচ্ছিল, অর্ণব তাঁর ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সূর্যের আলো ম্যানগ্রোভের পাতায় লুকোচুরি খেলছে, জলের ওপর ঝিলিক দিচ্ছে। তিনি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে লেন্স সেট করতে শুরু করলেন, চোখে এক ধরনের শিকারির একাগ্রতা। তাঁর লক্ষ্য স্পষ্ট—কুমিরের ছবি, বিশেষ করে বিরল বড় কুমিরের, যা সাধারণত সহজে দেখা যায় না। তিনি মনোযোগ দিয়ে লেন্সের ফ্রেম সাজাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই হঠাৎ জলে অদ্ভুত আলোড়ন। তিনি চোখ কচলালেন—হ্যাঁ, ওটা নিশ্চয়ই এক বিশাল কুমির, কিন্তু পরের মুহূর্তেই তাঁর বুক ধক করে উঠল। কারণ কুমিরের কালো-সবুজ শরীরে অদ্ভুত নীলচে আভা খেলা করছে, যেন জলের ভেতর থেকে কোনো অলৌকিক আলো বেরোচ্ছে। অর্ণব দ্রুত ক্যামেরার শাটার টিপতে শুরু করলেন, মুহূর্তগুলো ধরে রাখলেন, কিন্তু তাঁর হাত কাঁপছিল। কারণ এটা কি কেবল সূর্যের প্রতিফলন, নাকি সত্যিই এমন কোনো প্রজাতি, যা তিনি এর আগে কখনো দেখেননি?
ফটোগ্রাফারের অভ্যাস হলো নিজের চোখের দেখা বিশ্বাস করার আগে ক্যামেরায় ধরা মুহূর্তকে প্রমাণ হিসেবে দেখা। অর্ণব তাই বারবার ছবিগুলো চেক করলেন। প্রতিটি ফ্রেমে সেই বিশাল ছায়া স্পষ্ট, আর কোথাও কোথাও কুমিরের গায়ের ওপর নীলচে আলো যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি জানেন, কুমিরের শরীর কখনো এমন আলো প্রতিফলিত করতে পারে না, বিশেষ করে এমনভাবে নয়। তাঁর বুকের ভেতর উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ও জন্ম নিল—এ কি তবে নতুন কোনো প্রজাতি? নাকি প্রকৃতির লুকোনো রহস্য? চারপাশের নদীর জল তখন শান্ত, কোনো সাড়া নেই। যেন কিছুই হয়নি। অর্ণব ঘেমে উঠলেন, কিন্তু তাঁর ঠোঁটে লেগে রইল এক রহস্যময় হাসি। হয়তো এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। তবে একই সঙ্গে তিনি জানতেন, এমন কিছু অন্যকে বোঝানো সহজ নয়। এ যেন সেই ধরনের অভিজ্ঞতা, যা ক্যামেরা ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, ছবিগুলো কাউকে দেখাবেন—কিন্তু কাকে? তখনই মনে পড়ল, ভিতরকনিকায় কুমির নিয়ে গবেষণা করছেন যে তরুণী, অপরাজিতা দাস, সবাই যাকে অপি বলে ডাকে। সে বাস্তববাদী, বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। যদি কেউ তাঁকে কিছুটা হলেও গুরুত্ব দেয়, তবে সে-ই দিতে পারে।
সেদিন দুপুরে, গরম আর আর্দ্রতায় ঘামে ভিজে যাওয়ার পর, অর্ণব ক্যামেরা হাতে নিয়ে অপরাজিতার তাঁবুর দিকে গেলেন। অপি তখন ল্যাপটপে কিছু ডেটা এন্ট্রি করছে, পাশে খোলা বই, কুমির সংরক্ষণ নিয়ে নোট। অর্ণব প্রবেশ করতেই সে মুখ তুলে তাকাল, সামান্য বিরক্ত মুখে বলল—“এই গরমে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? সাবধান, এখানে সব জায়গা নিরাপদ নয়।” অর্ণব কিছু না বলে সোজা ক্যামেরাটা তাঁর সামনে ধরলেন। “এগুলো দেখো,”—তিনি বললেন, কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। অপি কপাল কুঁচকে ছবিগুলো দেখতে লাগল। প্রথম ফ্রেমগুলো দেখে তার মুখে বিশেষ কোনো পরিবর্তন এল না। কিন্তু যেখানে কুমিরের গায়ে নীলচে আলো স্পষ্ট, সেখানে সে একটু থেমে গেল। তবুও ঠোঁটে এক ব্যঙ্গভরা হাসি ফুটে উঠল—“আচ্ছা, এটাকেই এত বড় আবিষ্কার মনে করছেন? আমি বলছি, এ একেবারেই আলো আর প্রতিফলনের খেলা। সকালবেলার রোদ, নদীর ওপর মিশে থাকা কুয়াশা—এসব মিলে এমন বিভ্রম তৈরি করতেই পারে।” অর্ণব হতাশ হলেন, কিন্তু সহজে হার মানার মানুষ তিনি নন। তিনি বললেন—“তুমি ঠিক বলছ, প্রতিফলন হতে পারে। কিন্তু সব ফ্রেমে? আর এতটা স্পষ্ট? বিজ্ঞান বলে প্রতিটি প্রজাতির অস্তিত্ব আছে। হতে পারে আমরা এখনও কিছু আবিষ্কার করিনি।” অপি মাথা নেড়ে হেসে উঠল—“বিজ্ঞান তো কুসংস্কারকে সত্যি করতে আসেনি, মি. ফটোগ্রাফার। আপনাকে হয়তো এই জঙ্গলের রহস্য ভীত করেছে। কিন্তু আমার কাছে এ কেবলই আলোর খেলা।” তার গলায় দৃঢ়তা ছিল, তবু চোখে অল্প এক ঝলক কৌতূহলও দেখা গেল, যা সে লুকোতে চেষ্টা করল।
অর্ণব তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁর উত্তেজনা থামছিল না। অপি বিশ্বাস না করুক, তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি জানেন তিনি কী দেখেছেন, জানেন তাঁর ক্যামেরা কী রেকর্ড করেছে। চারপাশে জঙ্গল তখন বিকেলের আলোয় ভিজে উঠছে। কোথাও পাখি ডেকে উঠল, আবার কোথাও বাতাসে পাতার খসখসানি। অর্ণব আকাশের দিকে তাকালেন—নীলচে আলোয় ভরে যাচ্ছে চারদিক। তাঁর মনে হলো, প্রকৃতি যেন তাঁকে ডাকছে, বলছে—“খুঁজে বের করো আমাকে, আমার ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন সত্য, যা মানুষ এখনও জানে না।” তাঁর হাতের ক্যামেরা তখন যেন আর শুধু যন্ত্র নয়, হয়ে উঠেছে এক দরজা, যেখান দিয়ে তিনি প্রবেশ করবেন বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝখানে। বীরেন মহান্তির সেই রহস্যময় সতর্কবার্তা আবার মনে পড়ে গেল—“সব দেখা যায় না, সব তোলা যায় না।” হয়তো সত্যিই তাই। তবু অর্ণব স্থির করলেন, এই নীলচে আভাটিকে তিনি আরও কাছ থেকে দেখবেন, আরও প্রমাণ সংগ্রহ করবেন। ভিতরকনিকায় তাঁর অভিযান কেবল শুরু হয়েছে, আর প্রথম শিকারই তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক এমন রহস্যে, যার গভীরতা তিনি এখনও কল্পনাও করতে পারেন না।
৩
সন্ধ্যার ঠিক পরের সময়টা ভিতরকনিকায় অন্যরকম। তখন আকাশ গাঢ় বেগুনি, চারপাশে নেমে আসে এক গভীর নিস্তব্ধতা। নদীর পাড়ে মশালের আলো জ্বলে ওঠে, আর দূরে কোথাও পাখিদের শেষ ডাক মিলিয়ে যায় কাদাজলে। অর্ণব সেই সময় বসে ছিলেন গ্রামের ঘাটের পাশে, হাতে ক্যামেরা, পাশে নোটবুক। দিনভর তিনি নানা দৃশ্যের ছবি তুলেছেন, কিন্তু মাথায় ঘুরছে সকালবেলার সেই অদ্ভুত নীলচে কুমিরের ছায়া। চোখ বন্ধ করলেই বারবার ভেসে উঠছে সেই আলো। হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াল এক কিশোর, বয়স চৌদ্দ কিংবা পনেরো। গায়ের রং পাকা খয়েরি, চুল এলোমেলো, চোখে ঝিলিক। হাতে একটা ছোট্ট মাছ ধরার বাঁশি, কাঁধে ছেঁড়া ব্যাগ। সে নিজে থেকেই অর্ণবের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিল। নাম বলল—গোপাল নায়ক। সে স্থানীয় মৎস্যজীবীর ছেলে, দিনের বেশিরভাগ সময় নদীর ধারে কাটায়। অর্ণব হেসে বললেন—“তুমি একা এত রাতে নদীর ধারে?” গোপাল মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল—“আমি নদীকে ভয় পাই না। ও আমাদের মা।” এই উত্তর শুনে অর্ণব অবাক হলেন। শহরের চোখে নদী মানে শুধু জল আর মাছ, কিন্তু এখানে নদী যেন এক জীবন্ত চরিত্র, এক রক্ষক।
গোপাল বসে পড়ল তাঁর পাশে, তারপর হঠাৎ বলল—“আপনি আজ সকালে কিছু দেখেছেন, তাই না? একটা নীলছায়া?” অর্ণব চমকে উঠলেন। তিনি কাউকে কিছু বলেননি, শুধু অপরাজিতাকে ছবি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এ ছেলে কীভাবে জানল? গোপাল হালকা হাসল, তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল এক পুরনো গল্প। “আমাদের গ্রামে সবাই জানে, নদীর ভেতর আছে এক রক্ষক আত্মা। ওর রূপ কুমিরের মতো, কিন্তু শরীর থেকে নীল আভা বেরোয়। ওকে বলে ‘নীলছায়া কুমির’। অনেকে ভাবে এটা আসল প্রাণী নয়, আত্মা। নদী আর জঙ্গলকে যারা আঘাত করে, ওদের শাস্তি দেয়। রাত হলে কেউ নদীর ধারে যায় না, কারণ বলে, তখনই নীলছায়া জেগে ওঠে।” অর্ণব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তিনি লোককথার মায়া বুঝতেন, কিন্তু বিশ্বাস করতেন না। তবুও গোপালের চোখের উজ্জ্বলতায় তিনি অনুভব করলেন, এ কেবল গল্প নয়—গ্রামবাসীর কাছে এটা জীবনের অংশ। প্রতিদিনের ভয়ে, বিশ্বাসে, আর অভ্যাসে এই কাহিনি গেঁথে গেছে।
অর্ণব নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—“তুমি নিজে কখনও দেখেছো?” গোপাল কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল—“আমি একবার দেখেছিলাম। বর্ষাকালে নদী ফুলে উঠেছিল, এক রাতে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে গেছিলাম। তখন জলের ভেতর থেকে নীল আলো উঠছিল। বাবার মুখ একদম সাদা হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে টেনে নিয়ে চলে এসেছিল। তারপর থেকে বাবা বলে দিয়েছে, রাতে নদীর কাছে যাওয়া মানা। আমি জানি, অনেকেই বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমিও সেই আলো দেখেছি।” ছেলেটির কণ্ঠে কোনো ভান ছিল না, তার শরীরের হালকা কাঁপুনিও চোখ এড়িয়ে গেল না অর্ণবের। শহুরে মানুষ হিসেবে তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে চাইলেন—হয়তো ফসফরাসের আলো, হয়তো নদীর কোনো অদ্ভুত রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া। তবু তাঁর ভেতরের কোথাও এক শিহরণ জেগে উঠল। কারণ সকালে তিনি নিজেই কিছু অদ্ভুত দেখেছেন, যা সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। গোপাল আরও বলল—“গ্রামের বুড়োরা বলে, যেদিন কেউ নদীকে অসম্মান করে, বা গাছ কেটে ফেলে, সেদিন নীলছায়া রাগ করে ওঠে। তখন দুর্ঘটনা ঘটে। তাই সবাই সাবধান থাকে।” অর্ণব অবাক হয়ে শুনলেন—কুসংস্কার হোক বা না হোক, এই বিশ্বাসই মানুষকে প্রকৃতির ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখে।
রাত তখন গাঢ় হয়ে এসেছে। গোপাল বিদায় নিয়ে চলে গেল, অন্ধকারে মিশে গেল তার ক্ষুদ্র অবয়ব। অর্ণব একা বসে রইলেন ঘাটের ধারে। নদীর জল কালো আয়নার মতো, তার ভেতর থেকে যেন উঠে আসছে গোপালের বলা গল্পের ছায়া। তিনি জানেন, বৈজ্ঞানিকভাবে এই কাহিনির কোনো প্রমাণ নেই। তবু মনে হলো, হয়তো সত্যিই এই জঙ্গলের প্রাণ আছে, যে নিজেকে রক্ষা করে গল্পের আকারে। তাঁর মনে পড়ল অপরাজিতার অবিশ্বাসী মুখ, আর বীরেন মহান্তির সেই রহস্যময় সতর্কবার্তা। সব যেন এক সুতায় বাঁধা হয়ে উঠছে—নীলচে কুমির, লোককথা, আর বাস্তবের অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। তাঁর হাতের ক্যামেরা তখন ভারী মনে হচ্ছিল, যেন সেটিই একমাত্র মাধ্যম, যার ভেতর দিয়ে এই রহস্য ধরা যেতে পারে। কিন্তু অর্ণব জানতেন, এই লোককথার ছায়া কেবল ক্যামেরায় ধরা পড়বে না। এ এক যাত্রা, যেখানে বাস্তব আর কল্পনা মিশে যায়, যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। তাঁর মনে দৃঢ় সংকল্প জাগল—তিনি এই কাহিনির গভীরে যাবেন, কারণ সত্য যতই অদ্ভুত হোক, তাকে খুঁজে বের করাই তাঁর কাজ।
৪
ভোরের কুয়াশা সরে গেলে ভিতরকনিকায় যেন একেবারেই নতুন রূপ নেয়। বাতাসে লবণাক্ত জলের গন্ধ, কোথাও দূরে কাদার ভেতর কাঁকড়ার ছুটোছুটি, আর পাখিদের ডাক মিশে গিয়ে এক ধরনের কোলাহল তৈরি করে। সেদিন সকালটা অন্য দিনের থেকে আলাদা হয়ে উঠল কারণ, রাজীব নায়ক—একজন অভিজ্ঞ প্রাণিবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদ—শহর থেকে এসে পৌঁছলেন পার্কে। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে আছে, বিশেষ করে জলজ প্রাণীদের ওপর গবেষণার জন্য। তাঁকে ঘিরে স্থানীয় গবেষকরা ভিড় জমাল, অনেকে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বাগত জানাল। অপরাজিতা দাসও সেই দলের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল, তাঁর চোখে স্পষ্ট উত্তেজনা—কারণ রাজীব স্যার তাঁর পুরনো শিক্ষক এবং পরামর্শদাতা। অর্ণব একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। তাঁর মনে হলো, এ মানুষ হয়তো তাঁর ছবিগুলোর রহস্য বোঝার একটা সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তাই সুযোগ বুঝে তিনি ক্যামেরা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
তাঁবুর ভেতরে বসে রাজীব যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন, অর্ণব সাবধানে ক্যামেরার স্ক্রিনে সেই ছবি খুললেন। “স্যার, এটা গতকাল সকালে তোলা,” তিনি বললেন গম্ভীর গলায়। রাজীব প্রথমে সাধারণ মনোযোগে দেখলেন। ছবিতে কুমিরের বিশাল ছায়া, আর শরীরে এক অদ্ভুত নীলচে আভা স্পষ্ট। তিনি ভ্রু কুঁচকালেন, তারপর একেবারে হেসে উঠলেন। “এ তো স্পষ্ট প্রতিফলন। জলের রঙ, সূর্যের কোণ, আর হয়তো ক্যামেরার লেন্সে রশ্মি ভেঙে এমন হয়েছে। প্রকৃতিতে নীল কুমির বলে কিছু নেই, অন্তত আমি তো শুনিনি।” তাঁর কণ্ঠে অবহেলা মেশানো নিশ্চয়তা ছিল। অপরাজিতা পাশে দাঁড়িয়ে দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিল। “আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম, আলো আর প্রতিফলনের খেলাই এটা। প্রকৃতির রহস্য আমরা অনেক সময় বড় করে দেখি, কিন্তু আসলে এর পেছনে থাকে সাধারণ কারণ।” দু’জনের আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যে তাঁবুর ভেতরটা যেন হঠাৎ হালকা হাসি আর আশ্বাসে ভরে উঠল। সবাই যেন স্বস্তি পেল যে অজানা কোনো প্রাণী বা অদ্ভুত বিপদের আশঙ্কা নেই।
কিন্তু অর্ণবের ভেতরে তখন দ্বন্দ্বের ঝড় বইছে। তিনি ক্যামেরার ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবলেন—এ কি সত্যিই কেবল আলো আর প্রতিফলনের খেলা? তিনি তো নিজের চোখেও দেখেছিলেন সেই নীল আভা, যা ছবির চাইতেও বেশি স্পষ্ট ছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল, রাজীব আর অপরাজিতা তাঁকে সহজভাবে উড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষকদের জগৎ যে এতটুকুতে থেমে থাকে না, তা তিনি জানেন। কিন্তু তাঁদের এই অস্বীকার যেন তাঁকে একেবারেই একা করে দিল। বিজ্ঞান যেমন সব ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে চায়, তেমনি অর্ণবের অভিজ্ঞতা বলছে এখানে এমন কিছু আছে যা এখনও ধরা পড়েনি। তাঁর মনের ভেতর দ্বিধা আরও তীব্র হয়ে উঠল—তিনি কি ভুল দেখেছেন? তাঁর চোখ কি প্রতারণা করেছে? না কি সত্যিই প্রকৃতি তাঁকে এমন এক সত্যের সামনে দাঁড় করিয়েছে, যা অন্যরা দেখতে পাচ্ছে না? তিনি বুঝতে পারলেন, এই লড়াই কেবল বাহ্যিক নয়, এটা তাঁর নিজের ভেতরের যুদ্ধ।
তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চারপাশে নদীর জল ঝিলিক দিচ্ছে, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা। মনে পড়ল গোপাল নায়কের সেই গল্প—নীলছায়া কুমির, নদীর রক্ষক আত্মা। রাজীব আর অপরাজিতা এটাকে গল্প বলেই উড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু অর্ণবের মনে হলো, লোককথা হয়তো সবটাই মিথ্যে নয়। হয়তো মানুষের অজ্ঞতার ফাঁকে ফাঁকেই প্রকৃতির কিছু সত্য লুকিয়ে আছে। তিনি জানেন, একদিন এই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে হবে। হয়তো প্রমাণ করতে হবে সবাইকে যে তাঁর দেখা অভিজ্ঞতা কেবল বিভ্রম নয়। আর এর জন্য তাঁকে আরও গভীরে যেতে হবে, আরও ঝুঁকি নিতে হবে। ভিতরকনিকায় তাঁর যাত্রা এখন কেবল ফটোগ্রাফির অভিযান নয়, হয়ে উঠছে এক সত্য অনুসন্ধানের যুদ্ধ। একদিকে বিজ্ঞান আর যুক্তি, অন্যদিকে অজানা আর অলৌকিক—এই দ্বন্দ্বের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছেন অর্ণব, আর নদীর হাওয়া যেন ফিসফিস করে বলছে, “তুমি যা দেখেছো, তার উত্তর পাবে শুধুই অরণ্যের গভীরে।”
৫
বীরেন মহান্তির সঙ্গে অর্ণবের যাত্রা শুরু হয় ভোরবেলায়, যখন আকাশে প্রথম আলো ফোটার আগেই জঙ্গল জেগে উঠতে শুরু করেছে। চারদিকে ঘন কুয়াশা, বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসে ভিজে পাতার গন্ধ, আর পাখিদের অদ্ভুত সব ডাক মিশে আছে সেই পরিবেশে। বীরেন যেন অর্ণবকে এমন এক পথে নিয়ে চলেছে, যা মানচিত্রে নেই—একটি অচেনা পথ, যেখানে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচে শেকড়ের আঁকাবাঁকা ধরন পায়ের গোড়ালিতে বিঁধে যায়, শ্বাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে বুনো গাছের রসালো গন্ধ। অর্ণব প্রথমে কিছুটা কৌতূহলী হলেও ধীরে ধীরে তার ভেতরে এক অজানা ভয়ের আবহ জমে উঠতে থাকে। বীরেন মাঝে মাঝে থেমে চারপাশে কান পাতছে, যেন বাতাসের ভেতরেও কোনো অচেনা সুর বা সংকেত খুঁজছে। অর্ণব লক্ষ্য করে, তার চোখে ভয় নেই, বরং এক ধরনের অভিজ্ঞ সতর্কতা আছে—যেন এ জঙ্গলের প্রতিটি ছায়ার সঙ্গে তার পুরনো পরিচয়। বীরেনের হাতের লাঠির শব্দ আর ঝিঁঝিঁর ডাক মিলেমিশে এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি করছে, যা অর্ণবকে জঙ্গলের গভীরে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
দিনের আলো ফুরোতে না ফুরোতেই তারা পৌঁছে যায় এক কাদামাখা জলা অঞ্চলে। চারপাশের গাছগুলো পানির ভেতরে শেকড় ছড়িয়ে দিয়েছে, পানির গাঢ় সবুজ রঙে সূর্যের শেষ আলো প্রতিফলিত হয়ে এক ভয়াবহ আবেশ তৈরি করছে। অর্ণব ভাবছিল, সাধারণত এখানে হয়তো সাপ-ব্যাঙ, কুমির কিংবা মাছ ছাড়া আর কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু সে হঠাৎই টের পায়—পানির ভেতর থেকে অদ্ভুত এক আলোড়ন উঠছে। জলের ভেতর কিছু যেন নড়ছে, কিন্তু সেটার ভঙ্গি কুমির বা মাছের মতো নয়। পানির নিচে যেন এক বিশাল ছায়া ঘুরছে, কাদাজল ভেদ করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে আবার ডুবে যাচ্ছে। অর্ণব কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠল, “ওটা কী? কুমির?” কিন্তু বীরেন কোনো উত্তর দেয় না, বরং স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে সেই আলোড়নের দিকে। তার গলায় এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ত সুরে ভেসে আসে, “সব জীবকে রেকর্ড করা যায় না।” এই উত্তর অর্ণবকে আরও অস্থির করে তোলে। তার মনে প্রশ্ন জমে—কোন জীবের কথা বলছে বীরেন? তবে কি এ জঙ্গলে এমন কিছু আছে, যার অস্তিত্ব মানুষ জানে না, কিন্তু এখানে সে নিঃশব্দে টিকে আছে বহু বছর ধরে?
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের ভেতরের ভয় আরও তীব্র হতে থাকে। তারা একটি শুকনো উঁচু জায়গায় বসে বিশ্রাম নেয়। চারপাশে শুধু কাঁকড়া, ব্যাঙের ডাক, আর অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যাচ্ছে, যেগুলো অর্ণব আগে কখনো শোনেনি। বীরেন আগুন জ্বালালেও তার চোখ সবসময় কাদাজলের দিকে আটকে থাকে। অর্ণব বারবার তাকায় সেই দিকে, যেখানে সে আলোড়ন দেখেছিল। কিন্তু এখন সব নিস্তব্ধ—শুধু অন্ধকারে মাঝে মাঝে জলের ভেতর ছোট মাছের ছটফটানি শোনা যাচ্ছে। তবুও অর্ণবের মনে হচ্ছিল, কেউ বা কিছু তাদের ওপর নজর রাখছে। বীরেন হঠাৎ বলল, “ভয় পেও না, এখানে ভয় পেলে টিকে থাকা যায় না। যে জিনিসটা দেখেছ, ওর নাম কেউ জানে না। ও সবসময় আসে না, তবে যখন আসে, তখন এই জঙ্গল অন্য রকম হয়ে ওঠে।” অর্ণব কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার মনে হচ্ছিল, বীরেন অনেক কিছু জানে, কিন্তু সবকিছু বলছে না। সেই অদৃশ্য রহস্যই অর্ণবকে আরও গভীরে টেনে নিচ্ছে।
রাতের আকাশে তারা ভরা, কিন্তু গাছের মাথা এত উঁচু যে ওপরে তাকালেও তারা দেখা যায় খুব কম। অর্ণব শুয়ে পড়লেও তার ঘুম আসছিল না। একসময় তার কানে এলো পানির ভেতর আবার এক অদ্ভুত শব্দ—যেন ভারী কোনো শরীর নড়ছে কাদার নিচে। সে উঠে বসে, চোখ আটকে গেল অন্ধকারে ভেসে ওঠা ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে। হঠাৎই সে দেখতে পেল, এক মুহূর্তের জন্য পানির ওপর ভেসে উঠল এক অচেনা আকার—না মাছ, না কুমির, বরং মানুষের মতো কোনো ছায়া, যার চোখ জ্বলজ্বল করছে আগুনের মতো। অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল, বুক ধকধক করতে লাগল। সে বীরেনকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারল না, যেন গলা শুকিয়ে গেছে। ঠিক তখনই বীরেন ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “দেখেছ তো? এ জঙ্গলের সব গল্প বইয়ে পাওয়া যায় না।” সেই কথার পর রাত আরও গভীর হয়ে যায়, আর অর্ণব অনুভব করে—সে এমন এক যাত্রার শুরুতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই তাকে নিয়ে যাবে এক অজানা সত্যের মুখোমুখি।
৬
গভীর রাত, আকাশে চাঁদ আধখানা, তার আলো মিশে গিয়ে নদীর জলে সৃষ্টি করছে এক ভৌতিক পরিবেশ। কাদার গন্ধ, স্যাঁতসেঁতে বাতাস আর নিস্তব্ধতার ভেতর মাঝে মাঝে শুধু রাতচরা পাখির ডাক বা দূরে কোনো অজানা প্রাণীর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। অর্ণব এবার একা আসেনি। তার সঙ্গে রয়েছে গোপাল, স্থানীয় কিশোর, যে এই অরণ্যের অজানা রহস্য ও লোককথা ছোটবেলা থেকে শুনে বড় হয়েছে। গোপালের চোখে ভয় আছে, কিন্তু সেই ভয় তাকে জঙ্গলের সঙ্গে একাকার করে দিয়েছে—যেন এই ভৌতিক পরিবেশ তার শরীরের রক্তে মিশে গেছে। অর্ণব ক্যামেরা হাতে প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক হয়ে এগোচ্ছিল, অথচ ভেতরে ভেতরে তার মধ্যে এক অদম্য কৌতূহল জাগছিল। সে জানত, আজ রাতের জন্যই সে এতদিন অপেক্ষা করেছে—যদি সত্যিই সেই নীলছায়া প্রাণী থাকে, তবে আজই সে তাকে দেখবে। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “দাদা, নদীর ধারে দাঁড়ালে চুপ করে থাকবেন। শব্দ করলে ওরা ভেসে ওঠে না।” অর্ণব মাথা নাড়িয়ে রাজি হলো, আর দু’জনে মিলেমিশে চুপচাপ বসে পড়ল ম্যানগ্রোভ গাছের শেকড়ের ফাঁকে।
সময় যেন থেমে গেছে। নদীর জল স্থির, শুধু মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় ঢেউ তৈরি হচ্ছে। অর্ণবের ক্যামেরা প্রস্তুত, লেন্স স্থির করে রেখেছে নদীর মাঝখানে। মিনিট দশেক কেটে গেলে, হঠাৎই জলের তলদেশে এক অদ্ভুত আলোড়ন দেখা দিল। প্রথমে মনে হচ্ছিল, কোনো বড় কুমির হয়তো ভেসে উঠতে চাইছে। কিন্তু অর্ণব বুঝতে পারল, এই আলোড়নের ভেতর অন্য রকম একটা স্পন্দন আছে—জল যেন ভেতর থেকে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। পরক্ষণেই দেখা গেল, পানির ভেতর থেকে ভেসে উঠছে এক বিশাল দেহ, তার গায়ে এক রহস্যময় নীলচে আভা। সেই আভা চাঁদের আলোয় প্রতিফলিত হয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। গোপাল নিঃশব্দে কেঁপে উঠল, তার মুখ শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। অর্ণবের চোখ স্থির হয়ে গেল, আর ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে সে নিশ্চিত হলো—এটা কোনো প্রতিফলন নয়, কোনো কল্পনা নয়। বিশাল চওড়া চোয়াল, অদ্ভুত শক্তিশালী লেজ, আর শরীরের গায়ে শিরার মতো উজ্জ্বল নীল রেখা জ্বলছে—এমন প্রাণী সে কখনো কল্পনাও করেনি।
অর্ণব দ্রুত শাটার টিপল। একের পর এক ছবি তুলতে লাগল, যেন কোনো সুযোগ হাতছাড়া না হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সে লক্ষ্য করল, ছবিগুলো একেবারেই স্পষ্ট আসছে না। ক্যামেরার স্ক্রিনে শুধু দেখা যাচ্ছে ঝাপসা রেখা, পানির ঢেউ, আর এক অচেনা আলো। নীলছায়া প্রাণীর অবয়ব যেন ক্যামেরার ভেতর ঢুকলেই মিলিয়ে যাচ্ছে। যতবার সে ফ্রেম করতে চাইছে, ততবার ছবি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি প্রযুক্তিকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। অর্ণবের বুক ধকধক করছে, ঘামে ভিজে গেছে তার হাত। সে বুঝতে পারছে, এখানে কোনো বৈজ্ঞানিক নিয়ম কাজ করছে না। তার চোখে যা স্পষ্ট, ক্যামেরায় তা বন্দি করা যাচ্ছে না। গোপাল ফিসফিস করে বলল, “দাদা, বলেছিলাম তো, ওদের রেকর্ড করা যায় না। এরা নদীর রক্ষক, মানুষ চাইলে ধরতে পারবে না।” অর্ণব উত্তর দিতে পারল না, শুধু স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল সেই অবয়বের দিকে। নীলছায়া প্রাণী মুহূর্তের জন্য নদীর মাঝখানে উঠে দাঁড়াল, তারপর ধীরে ধীরে জলের ভেতর মিলিয়ে গেল, যেন কোনোদিন ছিলই না।
দু’জন অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। চারপাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, শুধু জলের হালকা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। অর্ণবের হাত কাঁপছে, বুকের ভেতর ঝড় বইছে। সে জানে, আজ সে যা দেখল, তা কেবল তার জীবনের নয়, পুরো প্রকৃতির এক অভাবনীয় সত্য। কিন্তু প্রমাণ কোথায়? ক্যামেরায় ধরা পড়েনি, ছবি অস্পষ্ট। কেউ তাকে বিশ্বাস করবে কি? রাজীব নায়ক আবার হেসে উড়িয়ে দেবে, অপরাজিতা বলবে প্রতিফলনের ভুল। অথচ অর্ণব জানে—সে ভুল করেনি, সে কল্পনা দেখেনি। সে সত্যিই দেখেছে এমন এক প্রাণী, যা বিজ্ঞান এখনও চিনতে পারেনি। গোপাল তখন তাকে স্থির গলায় বলল, “দাদা, সবকিছু সবাইকে বোঝানো যায় না। কিছু জিনিস শুধু যারা দেখে, তারাই বিশ্বাস করে।” এই কথায় অর্ণবের মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব জন্ম নিল। একদিকে সত্যের সাক্ষাৎ সে পেয়েছে, অন্যদিকে প্রমাণ তার হাতে নেই। নীলছায়া প্রাণী যেন তাকে ডাক দিচ্ছে—আসো, আমাকে খুঁজে বের করো, আমার অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচন করো। আর এই ডাকই অর্ণবের যাত্রাকে আরও গভীর করে দিল, যেখানে বাস্তব আর অবাস্তবের সীমারেখা প্রতিদিন আরও ঝাপসা হয়ে উঠছে।
৭
ভোরের আলো আসতেই ভিতরকনিকায় চারদিকে এক অন্যরকম আবহ ছড়িয়ে পড়ল। রাতের ভয়াবহ নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে পাখির ডাক, বানরের চিৎকার আর হালকা বাতাসে গাছের দোল এক প্রাণবন্ত দৃশ্য তৈরি করেছে। কিন্তু অর্ণবের মনে কোনো শান্তি নেই। রাতের অভিজ্ঞতা তাকে ভিতরে ভিতরে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সে স্পষ্ট জানে, তার চোখে যা ধরা দিয়েছে, তা কল্পনা নয়। অথচ ক্যামেরার ফ্রেমে সেই দৃশ্য বন্দি হয়নি। এই অদ্ভুত ব্যর্থতা তাকে আরও অস্থির করে তুলেছে। সকালের নাস্তার টেবিলে বসেই সে অপরাজিতার সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা শুরু করে। গোপাল তখন দূরে বসে ছিল, মুখে কোনো কথা নেই, শুধু চোখে বিস্ময়ের ছাপ। অর্ণব বলল, “অপি, আমি গতরাতে দেখেছি। নীলছায়া কুমির বাস্তবেই আছে। এটা নতুন কোনো প্রজাতি, হয়তো বহু যুগ ধরে লুকিয়ে আছে এই জঙ্গলে। আমাদের শুধু সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।” তার গলায় দৃঢ় বিশ্বাসের সুর স্পষ্ট। অপরাজিতা ভুরু কুঁচকে তাকাল, তার চোখে অবিশ্বাস আর বৈজ্ঞানিক সন্দেহ ভাসছে।
“অর্ণব, তুমি যতই দৃঢ়ভাবে বলো না কেন, প্রমাণ ছাড়া এই কথা বিশ্বাস করা যায় না,” অপরাজিতা ঠান্ডা স্বরে বলল। “বিজ্ঞানে এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, যা পরীক্ষাগারে বা পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না। তোমার চোখে যা দেখেছ, সেটা আলো, ছায়া, প্রতিফলন—এর যেকোনো কিছু হতে পারে। তুমি যেটাকে রহস্য মনে করছ, সেটা হয়তো প্রকৃতির সাধারণ খেলা।” অর্ণব হতাশ হয়ে বলল, “না, আমি ভুল করিনি। তোমাকে বোঝানো যাচ্ছে না। এতদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, বিজ্ঞান মানে অনুসন্ধান, প্রশ্ন করা। কিন্তু যখন সত্যিই অজানা কিছু সামনে আসে, তখন কেন সেটা অস্বীকার করছ?” অপরাজিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বিজ্ঞান প্রশ্ন করতে শেখায়, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর হতে হবে পরীক্ষাযোগ্য। যা প্রমাণ করা যায় না, তা সত্যি হতে পারে না। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বিজ্ঞান তৈরি হয় না।” তার গলার সুরে এক ধরনের কঠোরতা ছিল, যা অর্ণবের বুককে আরও ভারী করে দিল।
তর্ক ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠল। অর্ণবের চোখে যেন এক ঝলক রাগ, হতাশা আর আঘাত মিলেমিশে আছে। সে বলল, “তুমি কি ভাবছ আমি গল্প বানাচ্ছি? তোমার সঙ্গে শেয়ার না করলে ভালো হতো। আমি দেখেছি, নিজের চোখে দেখেছি। প্রমাণ যে সবসময় যন্ত্র দিয়ে মাপা যায় না, সেটা কেন মানছ না?” অপরাজিতা টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল, তার মুখ গম্ভীর। “অর্ণব, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি না, আমি শুধু বলছি, তোমার অভিজ্ঞতা বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। আমি গবেষক, আমার কাছে ব্যক্তিগত অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। আমি যদি বলি নীল কুমির আছে, তাহলে আমাকে ডেটা, ডিএনএ, ছবি—এগুলো দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। শুধু চোখের দেখা দিয়ে কোনো থিসিস তৈরি হয় না।” অর্ণবের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, “তাহলে তুমি বলছ আমার দেখা মিথ্যে?” অপরাজিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বলল, “হয়তো না মিথ্যে, কিন্তু প্রমাণহীন।” এই কথাটা অর্ণবের বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধল। সম্পর্কের ভেতরে প্রথমবারের মতো এমন এক দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল, যেখানে বিজ্ঞান আর বিশ্বাস একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।
সকালের সেই তর্কের পর দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এল। একসঙ্গে তারা নদীর ধারে গেলেও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলল না। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, সে যেন একা হয়ে গেছে এই অনুসন্ধানে। তার বিশ্বাস কেউ ভাগ করতে চাইছে না। অপরাজিতার মনে হচ্ছিল, অর্ণব ক্রমশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে, আর এই আবেগ তার গবেষণার নিরপেক্ষতাকে নষ্ট করছে। দু’জনের চোখে চোখ পড়লেও সেখানে শুধু অস্বস্তি আর অপ্রকাশিত রাগ ভেসে উঠছে। সেই মুহূর্তে গোপাল এসে ফিসফিস করে বলল, “দাদা, আজ রাতে আবার গেলে হয়তো ওকে দেখতে পাবেন। কিন্তু অপি দিদিকে নিয়ে যাবেন না। তিনি বিশ্বাস করেন না, তাই দেখলেও মানবেন না।” এই কথার মধ্যে অদ্ভুত সত্যতা ছিল। অর্ণব জানত, বিশ্বাসহীন চোখ দিয়ে দেখা যায় না। আর অপরাজিতা বুঝতে পারছিল, তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো অর্ণবকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ভিতরকনিকায় প্রকৃতি শুধু মানুষকে পরীক্ষা করছে না, তাদের সম্পর্ককেও নতুন এক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে—বিজ্ঞান আর বিশ্বাস কি কোনোদিন একে অপরের হাত ধরে চলতে পারবে?
৮
অর্ণব সেই রাতেও জেগে বসে ছিল নদীর ধারে, হাতে ছোট্ট টর্চ আর পাশে নোটবুক। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল দূরের ঝিঁঝিঁ পোকাদের একটানা ডাক। হঠাৎ জলের ভেতর ঢেউ খেলতে শুরু করল, যেন ভেতরে কোনো বিশাল কিছু নড়ছে। অর্ণব নিশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড পর দেখা দিল সেই রহস্যময় নীলছায়া কুমির—তার শরীরের গায়ে এক অস্বাভাবিক নীল আভা, যেন জলের ভেতরে জ্বলছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কুমিরের দেখা মিলতেই মাছেদের আচরণ পাল্টে গেল। তারা হঠাৎ দল বেঁধে ঘুরতে শুরু করল, কেউ কেউ পানির ওপর উঠে আসতে লাগল, আবার কেউ একেবারে নিচে ডুবে গেল, যেন ভয়ের বশে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে। অর্ণব খেয়াল করল, পানির গায়ে অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে, যেন চারপাশের পরিবেশ অজানা সংকেত দিচ্ছে। সে ভেবেছিল হয়তো এটা কেবল মায়া, কিন্তু প্রতিবার কুমির আসলেই এই অস্বাভাবিকতা ঘটছে। তার মনে প্রশ্ন জাগল—এটা কি কেবল প্রকৃতির খেলা, নাকি নদীর ভেতরে কোনো অদৃশ্য পরিবর্তনের প্রতিফলন?
পরদিন সকালে সে বিষয়টি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে চাইল। সারা দিন ধরে নদীর ধার ঘুরল, পানির তাপমাত্রা মাপল, জালের মধ্যে ছোট মাছ ধরে তাদের নড়াচড়া লক্ষ করল। বিস্ময়করভাবে দেখা গেল, কুমিরের দেখা না মিললেও মাঝে মাঝে জলের ভেতর হঠাৎ হাওয়া ওঠে, পানির রঙ কিছুটা মলিন হয়, আর মাছেরা চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন সেই নীলছায়া কুমির জলে ঢোকে, তখন পরিবর্তন আরও তীব্র হয়ে যায়। যেন সেই প্রাণীই পরিবেশে এক অজানা স্পন্দন ছড়িয়ে দেয়। অর্ণব খেয়াল করল, মাছের গায়ে কিছু কালচে দাগ পড়ছে, যেন দূষণের ছাপ। এ যেন প্রকৃতি তাকে কিছু বলতে চাইছে—কোনো সংকেত পাঠাচ্ছে, যেটা মানুষ চোখে দেখে না, কিন্তু প্রাণীরা আগে থেকে টের পায়। তার মনে পড়ল পুরোনো কাহিনি—“প্রকৃতি সবসময় সতর্ক করে, শুধু মানুষই তাকে অগ্রাহ্য করে।” হয়তো এই কুমিরই সেই অগ্রাহ্য সংকেতের প্রতীক।
রাতে ডায়েরিতে লিখতে গিয়ে অর্ণবের মাথায় আরও স্পষ্ট হলো ধারণাটা। নদী হয়তো দূষণে ভরে উঠছে, অজানা রাসায়নিক কিংবা গোপন বর্জ্যের কারণে প্রাণীরা অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন কেবল কুমির এলেই তা দৃশ্যমান হয়? হয়তো কুমিরের শরীর থেকেই নির্গত হচ্ছে কোনো আলো বা রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, যা অন্য প্রাণীদের ওপর প্রভাব ফেলছে। অথবা, কুমিরের উপস্থিতিই পরিবেশের গোপন চাপকে উদঘাটন করছে। হঠাৎ তার মনে এক ভয়ানক আশঙ্কা এলো—যদি এই কুমির কেবল এক প্রাণী না হয়ে প্রকৃতির গভীর ক্ষতের প্রতীক হয়? হয়তো নদীর ভেতর এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যেটা ধীরে ধীরে ভেতর থেকে পরিবেশকে ধ্বংস করছে, আর কুমির হলো সেই সংকেত—অদৃশ্য বিপদের দূত। সে ভেবেছিল গ্রামে সবাইকে জানাবে, কিন্তু জানে, কেউ বিশ্বাস করবে না। গ্রামবাসীর কাছে কুমির মানেই কেবল ভয় আর অশুভ লক্ষণ।
অর্ণবের ভেতরে তখন দ্বন্দ্ব চলতে লাগল। একদিকে সে বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজছে—জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া; অন্যদিকে তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই অতিপ্রাকৃত নীল আলো। সে নিজেকে বোঝাল—প্রকৃতি যখন সংকেত পাঠায়, মানুষকে তা পড়তে শিখতে হয়। কিন্তু তার প্রশ্নের শেষ নেই—এই সংকেত কি কেবল প্রাণীদের সতর্ক করছে, নাকি মানুষকেও সাবধান হতে বলছে? নদীর জল, তার প্রবাহ, তার ভেতরে থাকা প্রতিটি প্রাণী যেন মিলিত কণ্ঠে তাকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু সে ভাষা অর্ণবের কাছে অজানা। একা বসে থাকতে থাকতে তার মনে হলো—সে যেন কোনো অদ্ভুত বার্তা পেয়েছে, যেটা ডিকোড করা তার দায়িত্ব। হয়তো এ শুধু এক গবেষণার বিষয় নয়, বরং জীবনের গভীর কোনো সত্য। নীলছায়া কুমির আর তার চারপাশের অস্বাভাবিকতা কেবল ভয় নয়, এক অদৃশ্য সতর্কবার্তা—যা না বোঝা গেলে হয়তো গ্রাম, নদী, এমনকি পুরো পরিবেশ একদিন মারাত্মক বিপদের মুখে পড়বে।
৯
রাতটা ছিল অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ। গ্রামে যেন সব শব্দ হঠাৎ থেমে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকও কেমন ক্ষীণ, কুকুরের ডাকার সুরও মিলিয়ে গেছে। হঠাৎ ভোররাতের অন্ধকারে গোপালের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, হয়তো পাশের ঘাটে গিয়ে বসেছে, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে মেতেছে। কিন্তু মিনিট পেরোতেই যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, তখন অর্ণবের মনে এক অজানা আতঙ্ক দানা বাঁধতে লাগল। গোপালকে সে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করত; তার অনুপস্থিতি মানে যেন ঘরের বাতাসও ভারী হয়ে যাওয়া। গ্রামের কয়েকজন ঘাটে গিয়ে ডাকাডাকি করল, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। নদীর কালো স্রোত কেবল গম্ভীর গর্জনের মতো শব্দ তুলছিল, আর তাতে গ্রামের সবাই আরও অস্থির হয়ে উঠছিল। অর্ণব এক মুহূর্তও আর বসে থাকতে পারল না—সে সিদ্ধান্ত নিল নিজেই খুঁজে বের করতে হবে। হাতে একটা লণ্ঠন নিয়ে একা নদীর দিকে দৌড়াতে লাগল, বুকের ভেতর আতঙ্কের ঢেউ একটার পর একটা উঠতে লাগল।
নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই অর্ণবের গায়ে কাঁটা দিল। গাঢ় কালো জল, তার ওপর ঝুলে থাকা কুয়াশা, আর দূরের অরণ্য থেকে আসা মৃদু হাহাকার—সব মিলিয়ে যেন অন্য এক জগৎ। অর্ণব লণ্ঠন উঁচু করে ডাকল, “গোপাল! কোথায় তুই?” তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনির মতো ফিরে এল, কিন্তু কোনো উত্তর নেই। হঠাৎ নদীর ঢেউয়ের ফাঁকে একটা ফিকে আলো যেন ভেসে উঠল। অর্ণব ভাবল, হয়তো লণ্ঠনের প্রতিফলন, কিন্তু পরমুহূর্তেই দেখল—ওটা গোপালের লাল গামছা, স্রোতের ভেতরে পাক খাচ্ছে। আতঙ্কে সে আর ভেবে উঠতে পারল না, পা পিছলে গড়িয়ে পড়ল নদীর জলে। ঠান্ডা স্রোত তার বুক চেপে ধরল, শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল। অর্ণব আপ্রাণ চেষ্টা করল উপরে উঠতে, কিন্তু নদীর স্রোত তাকে টেনে নিচ্ছিল। ডুবে যাওয়ার আতঙ্কে তার চোখের সামনে অদ্ভুত অন্ধকার ঘনিয়ে এল, কিন্তু হঠাৎই সে অনুভব করল—কিছু একটা বিশাল আকারের বস্তু তার নিচ দিয়ে সরে যাচ্ছে।
সেই মুহূর্তে লণ্ঠনের আলো জলে দপদপ করে কাঁপল, আর অর্ণব চোখ মেলে দেখল—তার সামনে উঠে এসেছে এক বিশাল নীলছায়া কুমির। স্রোতের ভেতরে দাঁত বের করা ভীষণ এক ছায়ামূর্তি। অর্ণবের বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন যেন বিস্ফোরিত হতে লাগল। সে জানত, এ মুহূর্তে এক ঝাঁপে প্রাণটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। নদীর কিংবদন্তি নীলছায়া—যার গল্প সে ছোট থেকে শুনেছে—এবার যেন বাস্তব হয়ে উঠেছে। তার শরীর অবশ হয়ে এল ভয়ে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, কুমিরটা কোনো আক্রমণ করল না। বরং ধীরে ধীরে তার বিশাল লেজ সরিয়ে অর্ণবকে স্রোতের ভেতর থেকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে ভাসিয়ে দিল। অর্ণব শ্বাস নিতে হিমশিম খাচ্ছিল, তবুও বুঝতে পারল—এ কোনো সাধারণ প্রাণীর আচরণ নয়। যেন প্রকৃতি নিজেই তাকে কিছু জানাতে চাইছে, কিছু সত্য প্রকাশ করতে চাইছে। নদীর বুক চিরে নীলচে আলো ছড়াতে ছড়াতে সেই কুমির আবার অদৃশ্য হয়ে গেল, আর অর্ণব অসহায়ভাবে ভেসে উঠল ঘাটের কাছে।
অর্ণব শ্বাসকষ্টে ভিজে শরীর নিয়ে যখন ঘাটে উঠল, তখন তার চোখ কেবল গোপালের খোঁজে ছুটছিল। গ্রামবাসীরা ততক্ষণে খবর শুনে দৌড়ে এসেছে, কিন্তু কেউ গোপালকে খুঁজে পায়নি। অর্ণব কাঁপা গলায় বলতে লাগল—সে যা দেখেছে, তা কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো বিভ্রম নয়। নীলছায়া কুমির তাকে মেরে ফেলতে পারত, কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না, কেউ বা শিউরে উঠছিল। তাদের কানে এতদিন ধরে ঘুরে বেড়ানো কিংবদন্তি এভাবে বাস্তব হয়ে উঠবে, তা ভাবতেও পারেনি কেউ। কিন্তু অর্ণব নিজের ভিতরে বুঝতে পারছিল—এই ঘটনার ভেতরে কোনো গভীর রহস্য আছে। গোপালের হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, নদীর বুক ফুঁড়ে নীলছায়ার উদয় হওয়া, আর তাকে প্রাণে বাঁচানো—সব মিলিয়ে যেন কোনো অদৃশ্য সংকেত দিচ্ছে। প্রকৃতি তাকে বোঝাতে চাইছে—যে রহস্যের পথে সে হেঁটে চলেছে, তা এখনো শেষ হয়নি; বরং তারই অংশ হয়ে গেছে সে। সেই রাতে অর্ণবের মনে প্রথম স্পষ্ট হলো—গোপালের হারিয়ে যাওয়া নিছক দুর্ঘটনা নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে নদীর গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকা অদেখা সত্য।
১০
ভোরের আলো ধীরে ধীরে ম্যানগ্রোভ বনের অন্ধকার ছাপিয়ে উঠছিল। রাতের ভেজা কুয়াশা এখনও নদীর বুক জড়িয়ে আছে, যেন জল আর আকাশ একাকার হয়ে গেছে। অর্ণব ক্লান্ত দেহে ঘাটের ধারে বসে ছিল। গোপালের কোনো সন্ধান এখনও মেলেনি, কিন্তু তার ভেতরটা কেমন যেন হালকা লাগছিল—যেন সে জানে, কোথাও না কোথাও গোপাল বেঁচে আছে, নদী তাকে নিজের আঙিনায় লুকিয়ে রেখেছে। আগের রাতের অভিজ্ঞতা তার ভেতরের বিশ্বাসকে পাল্টে দিয়েছে। বহুদিন ধরে যে দ্বন্দ্বে সে ছিল—বাস্তব বনাম কল্পনা, বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস—আজ তা এক অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে। নীলছায়া কুমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝেছিল, প্রকৃতিকে কেবল লেন্সের ভেতরে বন্দী করা যায় না। প্রকৃতির প্রতিটি অস্তিত্বই একেকটি ভাষা, একেকটি সংকেত, যা মানুষ হয়তো আজও পুরোপুরি পড়তে শিখতে পারেনি। সে উপলব্ধি করল, নীলছায়া আসলে কোনো দৈব অলৌকিকতা নয়; আবার একে নিছক ভ্রম বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটা প্রকৃতির এক সতর্কবার্তা, এক নীরব চিৎকার, যা অর্ণবের মতো অন্বেষকের চোখে ধরা দিয়েছে।
অর্ণব মনে করতে লাগল সেই অদ্ভুত মুহূর্তগুলোর কথা—যখন নদীর জল হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠেছিল, যখন মাছেরা আচমকা উল্টে ভেসে উঠেছিল, কিংবা যখন গাছের পাতাগুলো রাতের আঁধারেও অস্বাভাবিক কাঁপতে শুরু করেছিল। সবকিছু যেন একসঙ্গে মিলে ইঙ্গিত দিচ্ছিল, প্রকৃতির ভেতরে কোনো বড় বিপর্যয় আসন্ন। নীলছায়া কুমির হয়তো কেবল একটি রূপক, প্রকৃতির ভেতরে জন্ম নেওয়া কোনো জিনগত পরিবর্তনের প্রতীক। হয়তো কোনো অচেনা দূষণ নদীর জলে মিশে গেছে, হয়তো জলবায়ুর ভারসাম্য এতটাই নষ্ট হয়েছে যে জীবেরা নিজেদের অজান্তেই নতুন রূপ নিচ্ছে। আবার হয়তো এ এক চিরন্তন লোককথার পুনর্জন্ম—নদীর আত্মা, যে মানুষকে সাবধান করছে, যাতে তারা নিজেদের লোভে প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে। অর্ণবের মনে হলো, বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে বা লোককথার আবেগ দিয়ে এই নীলছায়াকে মাপা সম্ভব নয়। এর মানে হলো—প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আসলে এক চিরন্তন সংলাপ, যেখানে প্রশ্ন ও উত্তর দুটোই একসঙ্গে মিশে থাকে।
সে ক্যামেরা বের করে আবার নদীর দিকে তাকাল। বহুদিন ধরে সে ভেবেছে, লেন্সই সত্যকে ধরে রাখতে পারে, ছবি মানেই প্রমাণ। কিন্তু আজ লেন্স যেন তার কাছে কেবল এক প্রতীক হয়ে উঠল—বাস্তবকে ধরা যায়, কিন্তু তার গভীরতা ধরা যায় না। সে বারবার ফোকাস করছিল, কিন্তু প্রতিটি ফ্রেমেই নীলছায়ার ছবি ভেসে উঠছিল ঝাপসা আভায়। আলো কাঁপছিল, নদীর জলে ছড়িয়ে যাচ্ছিল এক মায়াবী দীপ্তি। ছবিগুলো স্পষ্ট নয়, কিন্তু সত্যিই তো—প্রকৃতির সতর্কবার্তা কি কখনো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়? অর্ণব হঠাৎ অনুভব করল, হয়তো এটাই আসল উত্তর—সবকিছু প্রমাণ করতে হবে না, কিছু কিছু সত্য কেবল অনুভব করার জন্য। হয়তো এটাই ছিল নদীর আত্মার উদ্দেশ্য, এটাই ছিল নীলছায়ার বার্তা।
শেষবারের মতো শাটার চাপতে চাপতে অর্ণব জানত, এই ছবি কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না। কেউ বলবে আলো আর প্রতিফলনের খেলা, কেউ বলবে ফটোগ্রাফারের কল্পনা। কিন্তু তার নিজের কাছে এ ছবিই হলো চূড়ান্ত প্রমাণ—যে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় বিশ্বাসের মাধ্যমে, প্রমাণের মাধ্যমে নয়। নীলছায়া কুমিরের ঝাপসা আলোয় সে দেখল, বাস্তব আর অলৌকিকের সীমারেখা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। হয়তো সত্যি কোনো নতুন প্রজাতি জন্ম নিয়েছে, হয়তো এ কেবল নদীর পুরোনো লোককথার ছায়া। কিন্তু যেভাবেই হোক, অর্ণব বুঝে গেল—মানুষের দায়িত্ব প্রকৃতিকে শাসন করা নয়, তাকে বোঝা, তাকে রক্ষা করা। সেই উপলব্ধি নিয়েই সে দাঁড়িয়ে রইল ভোরের কুয়াশার ভেতরে, আর তার ক্যামেরার ফ্রেমে ভেসে উঠতে থাকল এক নীলচে আলো—যা সময়ের স্রোতে চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে।
সমাপ্ত