রবীন ঘোষ
অধ্যায় ১:
রাত তখন একটার ঘর পেরিয়ে গেছে, আকাশের বুকজোড়া ছড়ানো পূর্ণিমার চাঁদ নীচের ভাগীরথীর গায়ে রূপোর মত আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। হরিপদ মাঝি সেই রাতে একা ফিরছিল জলপথে, তার কাঠের নৌকাটা খালি, গলার লুঙ্গিটা গুটিয়ে কোমরে বাঁধা, হাতে হ্যাজাক জ্বলছে ক্ষীণ আলো নিয়ে। সে যখন ‘ঘাটনিঘাট’ মোড় পেরোচ্ছে, হঠাৎ চোখে পড়ল—নদীর উপর ভেসে আছে কিছু একটা, যেন মানুষ, যেন একটা দেহ। প্রথমে সে ভাবল পাট বা খড়ের পুতুল হবে, কিন্তু হ্যাজাকের আলোটা বাড়িয়ে যখন নৌকা কাছে টানল, তার বুকের মধ্যিখানে যেন ঠাণ্ডা কাঁপুনি বয়ে গেল। শব! নদীর গায়ে ঠাস করে মুখ থুবড়ে ভেসে আছে একটি মৃতদেহ, আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার—তার ঠোঁট দুটো সূক্ষ্ম কালো সুতো দিয়ে সেলাই করে দেওয়া। হরিপদ দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াল, চিৎকার করে উঠতে গিয়েও গলায় যেন শব্দ আটকে গেল। কেমন এক অভিশপ্ত শূন্যতা তাকে গ্রাস করল সেই মুহূর্তে, চারপাশে নিস্তব্ধ নদীর গা বেয়ে বয়ে চলেছে অলৌকিক বাতাসের গুঞ্জন। বহু বছর ধরে সে নদীতে নৌকা চালালেও এমন কিছুর মুখোমুখি কখনও হয়নি।
সকালে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে খবর—ভাগীরথীর বুকে শব ভেসেছে, আর সেটার মুখ সেলাই করা। লোকজন ভিড় করে ঘাটে, কেউ সেলফি তোলে, কেউ ভয় পেয়ে মাথায় গঙ্গাজল ছোঁয়ায়। ডাক পড়ে গ্রামের চিকিৎসক রুদ্রপ্রতাপ রায়ের। তিনি দীর্ঘকায়, গম্ভীর ও কাণ্ডজ্ঞানী মানুষ, চোখে পুরোনো চশমা, হাতে এক চামচ কাঠের বাঁকা ছড়ি। শবটি ঘাটে তোলা হয়েছে, শরীর এখনো কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা, মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগেও জীবিত ছিল। তিনি দেহটি পরীক্ষা করে বুঝলেন, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিঃসন্দেহে শ্বাসরোধ বা দমবন্ধ—কিন্তু ঠোঁটের এই সূক্ষ্ম সেলাই কৌশল তাকে কাঁপিয়ে তোলে। সাধারণ কবরস্থ বা পঞ্চভূতে মিশে যাওয়া শব নয়, একে যেন ইচ্ছে করে বাকরুদ্ধ করা হয়েছে। গ্রামের পুরোহিত অম্বিকা ঠাকুর কাঁপা কাঁপা হাতে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বলেন—”ও কথা বলতে চায়… কিন্তু কেউ শুনছে না…” তার গলার স্বর যেন অতল গম্ভীর নদীর নিচ থেকে ভেসে আসা শব্দের মত শোনায়। এদিকে, বিকেলের মধ্যেই আরও দুটি শব ভেসে ওঠে একই ভাবে—তাদের মুখও সেলাই করা। একজন মহিলার দেহ, আরেকজন বয়সে যুবক। এবার সন্দেহ থেকে আতঙ্কে রূপ নেয় মহেশপুরের বাতাস। কেউ বলে, এটা কোন ডাইনি বিদ্যার কাজ, কেউ বলে ভাগীরথীর অভিশাপ আবার ফিরে এসেছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শহর থেকে আসে পলাশী নামের এক তরুণ সাংবাদিক। ‘মুর্শিদাবাদ বার্তা’ নামের ছোট পত্রিকায় কাজ করে সে, কিন্তু আগ্রহ তার লোকগাথা, লোকবিশ্বাস আর অলৌকিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন নিয়ে সে পৌঁছায় ঘাটে, ছবি তোলে, রেকর্ড করে হরিপদের বিবৃতি, রুদ্রপ্রতাপের মন্তব্য। তার প্রশ্ন—“এই মৃতেরা কি কিছু বলতে চায়?” অম্বিকা ঠাকুর একপলক তাকিয়ে বলে ওঠেন—“তুই বুঝবি না ছেলে… কথা জমে গেলে নদীও একদিন কান্না করে।” রাত নামার আগেই শোনা যায়—এক বৃদ্ধা বলেন, বছর পঁচিশ আগে এমন এক শব ভেসেছিল, তখনও ঠোঁট ছিল সেলাই করা… কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেয়নি। গ্রামের মেঠোপথে আলো নিভে আসে, ঘাটের ধার শ্মশানের মত চুপচাপ হয়ে ওঠে। সেই রাতে আবারও নদীতে দেখা যায় এক মৃত নারীর দেহ—পায়ের নুপুর বাজে না, চোখ খোলা, ঠোঁট সেলাই করা, কপালে ছোট্ট একটি পদ্মফুল আঁকা। মৃণাল, রুদ্রপ্রতাপের ছাত্র, ক্যামেরায় ভিডিও তোলে, এবং বলে ওঠে—“ওর চোখ যেন আমার দিকে চাইছিল…” এরপর সেই ভিডিও কেউ আর খুলে দেখতে পারে না, কারণ ফাইলটাই যেন কোথাও মিলিয়ে যায়। মহেশপুরে শুরু হয় এক অলক্ষ্য শঙ্কা, কারণ সবার মনে একটাই প্রশ্ন—এরা কারা? আর কেনই বা চায় মুখে তালা লাগিয়ে কিছু বলতে?… নদীজুড়ে রয়ে যায় এক রুদ্ধশ্বাস নীরবতা।
অধ্যায় ২:
ভোরবেলা রুদ্রপ্রতাপ রায় বসেছিলেন তার কাঠের উঠোনে, পাশে ধোঁয়া উঠছিল কড়াইয়ে ফুটন্ত তুলসীপাতা আর লবঙ্গ মেশানো চায়ের। রাতের ঘটনায় তার চোখে ঘুম নেই। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি যখন পূর্ব দিকে তাকালেন, দেখলেন দূরে ভাগীরথীর ধারে ভিড় জমেছে—তৃতীয় শবটির ছবি তুলছে পলাশী, এবং হরিপদ তার নৌকা ধুয়ে পরিষ্কার করছে, যেন কোনো অশুভ স্পর্শ মুছে ফেলতে চাইছে। সে মুহূর্তে রুদ্রপ্রতাপ বুঝলেন, এটা কেবল একাধিক মৃত্যুর প্রশ্ন নয়, বরং কোনো গভীর, পুরনো, চাপা পড়ে যাওয়া ইতিহাস মুখ তুলে দাঁড়াতে চাইছে। অম্বিকা ঠাকুর এসে জানালেন, “আমি এই দৃশ্য বহু বছর আগে দেখেছি… ১৯৫১ সালে।” তখন সে ছিলেন এক উঠতি পুরোহিত, বয়স মাত্র বিশ। বললেন, “এক রাতে পাঁচটি শব একসাথে ভেসেছিল ঘাটে, প্রতিটির ঠোঁট ছিল সেলাই করা। সে সময়ের মহন্তদের আদেশে সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল, কেউ জানত না কেন।” তার চোখে শূন্যতা, স্মৃতির ভারে নুয়ে আসা কণ্ঠে মিশে ছিল এক গোপন কষ্ট। “কিন্তু তখন আমি শুনেছিলাম—এই মৃতেরা নাকি কথা বলতে এসেছিল… যারা জীবনে মুখ খুলতে পারেনি।”
এই কথার পর পলাশী গভীর অনুসন্ধানে নামে। সে স্থানীয় পুরোনো পঞ্চায়েতের রেকর্ড ঘেঁটে বের করে—১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে মহেশপুর গ্রামে ‘পদ্মঘাট উৎসব’ বলে এক নদীবন্দনার রীতি চলত, যেখানে নদীকে ‘মা’ হিসেবে পুজো করা হত। উৎসবের অন্যতম কেন্দ্রীয় অনুষঙ্গ ছিল সাতজন বিধবার একত্র পদ্মবিসর্জন। কিন্তু ১৯৫১ সালে এই উৎসব হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে লেখা ছিল—”অশুচিতা ও অনর্থক কুসংস্কার রোধ”। অথচ সেই উৎসবেই অন্তর্নিহিত ছিল এক গোপন নারীকেন্দ্রিক নিধন-প্রথা—পবিত্রতা বজায় রাখার নামে সাতজন নারীর বলি। সেই নারীরা হয়তো বিধবা ছিল, হয়তো অপবিত্র আখ্যা পাওয়া একাকিনী, হয়তো কোনো পুরুষের ‘সম্মান’-এর বলি। তাদের জোর করে মুখ সেলাই করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা জীবনের অন্তিম মুহূর্তে চিৎকারও করতে না পারে। এই তথ্য শুনে রুদ্রপ্রতাপ স্থির হয়ে যান। তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় তার ঠাকুরমার বলা কাহিনি—“নদী সব কথা ধরে রাখে। শীতল মনে হলেও, ওর ভিতরে আগুন গুমরে ওঠে।”
সন্ধ্যেবেলা রুদ্রপ্রতাপ, পলাশী এবং মৃণাল একসাথে নদীর ধারে সেই পুরোনো ‘পদ্মঘাট’ ঘাটে যান, যেখানে এখন কাঁশবনের ভিতরে হারিয়ে যাওয়া পাথরের সিঁড়িগুলো অর্ধেক ডুবে আছে জলে। পলাশী তার ড্রোন ক্যামেরা চালিয়ে দেখে—জলের নিচে অস্পষ্ট ভাঙা মূর্তি, যেন কোনো নারীমূর্তি পদ্মফুল হাতে দাঁড়িয়ে। মৃণাল বলে ওঠে, “দেখুন না… যেন কেউ বসে আছে ওখানে!” সেই রাতে পলাশীর ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য—নদীর বুক চিরে এক মৃতদেহ ধীরে ধীরে জলের উপরে উঠছে, কিন্তু এবার সে চোখ খোলা অবস্থায় উঠে আসে… আর চোখে ভয় নয়, বরং তীব্র অভিমান। রুদ্রপ্রতাপ চিৎকার করে ওঠেন, “ওরা কথা বলতে চাইছে! ওদের ঠোঁট খুলতেই হবে!” সেই মুহূর্তে হাওয়ার ঝাপটা এসে কাঁশবন দুলিয়ে তোলে, আর নদীর বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক গা ছমছমে গন্ধ, যেন শুকনো আতর আর পোড়ানো ফুলের মিশ্র সুবাস। গ্রামের বৃদ্ধারা বলে—এই গন্ধ ‘ভাসমান পদ্ম’-এর আতর, যা একসময় উৎসবে ব্যবহার হত। পরদিন সকালে ঘাটে দেখা যায়, নতুন আরও দুটি শব, এবারও মুখ সেলাই করা, কিন্তু একটি শবের কপালে রক্ত দিয়ে লেখা—“আমরা ফিরে এসেছি।”
অধ্যায় ৩:
পাঁচ নম্বর শবটি যখন ঘাটে ভেসে আসে, তখন অর্ধেক গ্রাম নদীমুখো হয়ে দাঁড়ায়, যেন উৎসুক কোনো পূজোর দৃশ্য। কিন্তু এই শব আর পাঁচটির মতো নয়—এটি একটি যুবতীর দেহ, গায়ে আধুনিক পোশাক, হাতে এখনো লাল নেলপালিশের চিহ্ন, অথচ ঠোঁট সেলাই করা! পলাশী যখন তার ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলে, তখন ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে দেখা যায়, মেয়েটির চোখ ফাঁকা অথচ সরলভাবে সোজা তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে, একেবারে সজীব দৃষ্টিতে। মুহূর্তে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ যেন কেটে যায় বাতাসে, পলাশী কেঁপে ওঠে। সে রাতেই, মৃণাল হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখে, আশ্রমের ঘরের জানালার বাইরে ঘাটে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। সে ক্যামেরা হাতে ছুটে যায়, দূর থেকে দেখে—একটি শব নদীর জলের কিনারে উঠে এসে শুয়ে আছে, এবং তার হাতটা ধীরে ধীরে নড়ছে। ভিডিওতে ধরা পড়ে, হাতের আঙুল একভাবে বাকছে, বারবার… যেন কিছু বলতে চাইছে। ভয় আর বিস্ময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মৃণাল বুঝতে পারে—ওরা কেবল মরা দেহ নয়, ওরা কিছু প্রকাশ করতে চাইছে।
এই ভিডিও দেখেই গ্রামের মধ্যেই ভাঙন শুরু হয়। অম্বিকা ঠাকুর বলেন, “ওরা আত্মা নয়, ওরা শরীর… কিন্তু তাদের আত্মা বেরোয়নি এখনো, কারণ তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর মুখ বন্ধ মানেই কথা বন্ধ নয়।” শ্যামল চ্যাটার্জী, গ্রামের ওসি, প্রথম থেকেই এই ঘটনার বিরুদ্ধে যুক্তির কাঠামো সাজাতে ব্যস্ত ছিলেন—কেউ হয়তো খুন করে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, অথবা জেলপলাতক কোনো চক্রের কাজ। কিন্তু ভিডিও দেখে তিনিও স্তব্ধ হয়ে যান। তাঁর নিজের ছোটবেলার স্মৃতি ফিরে আসে—১৯৮৭ সালে তার বাবার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, যে কিনা একরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি; নদীর ধারে তার রুমাল পাওয়া গেছিল, কিন্তু দেহ কখনো মেলেনি। সেই স্মৃতি এখন যেন এই শবদের সঙ্গে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। শ্যামল নিরুত্তর হয়ে পড়েন, মুখে কোনো যুক্তির কথা আসে না। তার বিশ্বাস ভেঙে পড়তে শুরু করে।
রুদ্রপ্রতাপ এবার সিদ্ধান্ত নেন, এই দেহগুলোর একটি শব নিজের আশ্রমে রাখবেন, এবং এর ঠোঁটের সেলাই সাবধানে কাটবেন। অম্বিকা ঠাকুর প্রথমে বিরোধিতা করলেও শেষে সম্মতি দেন। গভীর রাতে, পলাশী, মৃণাল এবং হরিপদকে সঙ্গে নিয়ে রুদ্রপ্রতাপ একটি মৃত নারীর ঠোঁট থেকে সূচ-সুতো সরিয়ে নেন। কিন্তু ঠিক সেলাই কাটা মাত্র ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন হঠাৎ অক্সিজেন কমে গেছে। নারীর ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে থাকে, এবং সেই ফাঁক থেকে বের হয় একটা পোড়া কাগজের টুকরো, তার গায়ে পোড়া কালিতে লেখা—“আমাদের কথা শোনো… নয়তো আমরা ফিরে আসব।” সবাই স্তব্ধ, কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। পলাশী ফাইলটিকে হাতে নিয়ে শহরে পাঠানোর কথা ভাবে, কিন্তু পরদিন সকালে দেখা যায়—সে ফাইলের সমস্ত ভিডিও, রেকর্ড, ছবি ডিলিট হয়ে গেছে। এমনকি কাগজটিও ছাই হয়ে গেছে ঘরের মাঝে, কোনো অগ্নিকাণ্ড ছাড়াই। শ্যামল চ্যাটার্জী বলেন, “এ যেন কেউ চাইছে না… আমাদের জানা হোক।” সেই রাতে আবার ঘাটে একটা নতুন দেহ ভেসে আসে, এবং এই দেহটা অন্যদের মতো নয়—মুখে সেলাই থাকলেও কপালে রক্তে আঁকা পদ্মচিহ্নের মাঝখানে লেখা, “এখনো সময় আছে।” মহেশপুর বুঝতে পারে—এই ঘটনা আর থামবে না, যতক্ষণ না কেউ সত্যি শোনার সাহস দেখায়। নদী, একসময় যাকে পবিত্র বলে মনে করা হত, আজ সেই নদী-ই যেন জীবন্ত বিচারক হয়ে দাঁড়িয়ে।
অধ্যায় ৪:
সকালে গ্রামের আকাশ যেন অস্বাভাবিকভাবে স্তব্ধ হয়ে থাকে। কুকুরেরা ঘেউঘেউ করছে না, পাখিরাও নিস্তব্ধ। ঘাটের কাছে পুরোনো কাশফুলের ঝোপগুলো হাওয়ায় দুলছে না—যেন কারও অদৃশ্য উপস্থিতি জমে বসেছে গোটা নদীপাড়ে। রুদ্রপ্রতাপ ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন পাথরের ঘাট ধরে, কাঁধে গামছা, হাতে কফির কাপ। তার চোখে শঙ্কা নেই, কিন্তু গভীর কিছু দোল খাচ্ছে ভেতরে। হঠাৎ তিনি দেখেন, ভবানী দাসী—গ্রামের এক প্রাচীন নারী, দীর্ঘদিন একা থাকা এক রহস্যময় মানুষ—ঘাটের ধারে বসে আছেন, তাঁর চোখ সরলভাবে নদীর দিকে স্থির। রুদ্রপ্রতাপ কাছে যেতেই তিনি বললেন, “এতদিন ওরা চুপ ছিল, কারণ আমরা চুপ করিয়ে রেখেছিলাম। এখন ওরা কথা বলবে… কোনো দেবতা নয়, কোনো ভগবানের দূত নয়—ওরা মানুষ ছিল। ওদের আমরা মেরে ফেলেছিলাম।” রুদ্রপ্রতাপ বুঝতে পারলেন, সময় এসেছে আরও গভীরে যাওয়ার।
পলাশী ও মৃণাল মিলে আরও কিছু রেকর্ড ঘাঁটতে থাকে, পুরোনো মঠ, জমিদারদের দলিল আর গাঁথা খুঁজে বেড়ায়। তারা জানতে পারে—মহেশপুর একসময় ছিল ‘পদ্মঘাট বন্দনা’-র কেন্দ্র। এই উৎসবের মূল ছিল ‘সতীত্ব পূজা’—যেখানে সাতজন নারীকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে নদীতে পদ্ম নিবেদন করা হতো। কিন্তু আসল সত্য ছিল ভয়ঙ্কর: এই সাতজন নারীকে গ্রামের প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ আর জমিদারদের সম্মিলিত রোষানলে বলি দেওয়া হতো, কারণ তারা ছিল সমাজের চোখে ‘অযোগ্য’ নারী—বিধবা, নির্জন, প্রতিবাদী অথবা প্রেমে পড়া। তাদের মুখ সেলাই করে নদীতে ফেলে দেওয়া হত, যেন তারা জীবিত অবস্থায় শেষ আর্তনাদটুকুও করতে না পারে। এই ভয়ংকর প্রথা বন্ধ হয় ১৯৫১ সালের পর, কিন্তু কারো কোনো বিচার হয়নি। আর ভাগীরথী—যাকে সবাই মা বলে মানে—তার বুকেই চাপা পড়ে থাকে সেই অন্যায়, সেই দোষ, সেই হাহাকার। এখন সেই নদীই যেন বিচার চায়, প্রতিশোধ নয়—শুধু সত্যের স্বীকৃতি।
সন্ধ্যেবেলা অম্বিকা ঠাকুর এক আশ্চর্য সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘোষণা করেন—“পদ্মঘাট উৎসব আবার হবে। এবার সত্যের জন্য।” বহুদিন পর, গ্রামের পুরোহিত, চিকিৎসক, মাঝি, সাংবাদিক আর সাধারণ মানুষ মিলে একসঙ্গে বসে নদীর পাড়ে অস্থায়ী ঘাট তৈরি করে। সাতটি পদ্মফুল জোগাড় হয়, প্রতিটি মৃত নারীর স্মরণে একটি করে। ভবানী দাসী বলেন, “এই ফুল কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে নয়… এই ফুল শুধুই ওদের জন্য, যাদের মুখ আমরা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিলাম।” সেই রাতে ঘাটে বসে সাতজন নারীকে প্রতীক করে প্রদীপ জ্বালানো হয়, তাদের নাম কেউ জানে না, চেহারাও নয়—তবু তারা আজ সবার মধ্যে। হরিপদ মাঝি প্রথম পদ্মফুলটি জলে ছাড়ে, তার চোখে জল, “আমি নদীতে সব চালিয়েছি, কিন্তু ওদের কখনো দেখিনি। অথচ ওরা ছিল… আমি অন্ধ ছিলাম।” তারপরে একে একে সব ফুল ভেসে যায়, কিন্তু এবার নদীর বুক থেকে একটা শান্ত বাতাস উঠে আসে—না গন্ধ, না শব্দ—শুধু একটা নরম হাত যেন কাঁধে ছুঁয়ে দিয়ে বলছে, “আমরা শুনেছি… এবার শান্তি…” সেই রাতেই প্রথমবারের মতো নদী শান্তভাবে বয়ে যায়, কোথাও কোনো ঢেউ নেই, কোনো শব নেই, শুধু নিস্তব্ধ জলে সাতটি পদ্ম ফুল ভেসে থাকে সারারাত।
অধ্যায় ৫:
পরদিন সকালে, গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছানো খবরগুলো বেশ অদ্ভুত ছিল। পলাশী তার রিপোর্টে লিখেছিল: “আজ সকালেও নদী থেকে শব ভেসে এসেছে, তবে এবার একটি পার্থক্য রয়েছে—এই শবের ঠোঁটের সেলাই সম্পূর্ণ খুলে গেছে। তার চোখ, যা আগের শবগুলোর তুলনায় আরও জীবন্ত ছিল, যেন কিছু বলতে চাচ্ছিল।” শহরের সংবাদপত্রে এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, এবং প্রতিটি তাতে লেখা ছিল, “নদী কি সত্যিই আমাদের কথাগুলো শোনাতে চায়?” শ্যামল চ্যাটার্জী, থানার ওসি, বিষয়টিকে কোনোভাবে থামানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি তার টিমকে নির্দেশ দেন মৃতদেহের একে একে পরীক্ষা করার জন্য, যেন এটি কোনো ধরনের অপরাধমূলক কার্যকলাপ হতে পারে। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ, অম্বিকা ঠাকুর ও হরিপদ মাঝির মত মানুষদের একত্রিত হয়ে কিছু ঘটেছিল যা পুলিশ-প্রশাসনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সবাই জানতো, এটা আর একটি সাধারণ হত্যা বা অপরাধের ঘটনা নয়। এটা ছিল কিছু অন্যরকম, যা মানুষের ধ্যান ধারণার বাইরে ছিল।
ঘাটে, সাতটি পদ্মফুলের পর একদিন ভেসে আসে নতুন মৃতদেহ। এবার, তার ঠোঁটের সেলাই খোলার পর দেখা যায়—তার শরীরের পেছনে একটি বড়ো সেলাইয়ের চিহ্ন। সেখানে যেন একটি সুতো জড়িয়ে কিছু লেখা ছিল। রুদ্রপ্রতাপ দ্রুত কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট একটি চিরুনি বের করে, সেলাই খুলে ফেলেন। সেখানে একটি ছোট্ট কাগজ বের হয়ে আসে। রক্তমাখা কাগজটি অত্যন্ত পুড়ে যাওয়া ছিল, তবুও কিছুটা পড়া সম্ভব হয়। লেখা ছিল, “ওরা সবাই জানে—এটা কেবল শুরু। আমাদের ইতিহাস, আমাদের কষ্ট, আমাদের চুপ থাকার সময় শেষ। এবার কেউ আর আমাদের থামাতে পারবে না।” এই কাগজটি পড়ে রুদ্রপ্রতাপ চমকে ওঠেন। এটি কোনো সাধারণ শবের বার্তা নয়, বরং যেন একটি ডাকে সাড়া দেওয়ার চেষ্টার অন্তর্নিহিত আভাস ছিল। তার পরের সিদ্ধান্তে তিনি বুঝতে পারেন—এবার আসল শিকার অপেক্ষা করছে। যারা এতদিন নিঃশব্দে শিকার করেছিল, তাদের মুখ খুলতে হবে।
তবে সত্যি বলতে, এই ঘটনা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ছিল। অম্বিকা ঠাকুর আগেই সাবধান করেছিলেন, “এটা একটা সতর্কতা। নদী আমাদের পুরোনো দিনের পাপের শোধ চাইছে। যদি আমরা নিজেদের ভুল বোঝাপড়া না করি, তাহলে আরও খারাপ হবে।” কথাগুলো শুনে শ্যামল চ্যাটার্জী তার পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা কাঁপছিলেন। তিনি তখন বুঝতে পারছিলেন, আসলে কী কিছু গভীর রহস্য বয়ে যাচ্ছে, যা সাধারণ পুলিশি তদন্ত দিয়ে আর সুরাহা করা সম্ভব নয়। তাঁর স্মৃতি ফেরৎ চলে যায় ১৯৮৭ সালে, যখন তার বাবার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ঘটনার পর তিনি আর কখনো নদীকে স্বাভাবিকভাবে দেখেননি। এখন, সেই স্মৃতি ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি জানান, “কেউ একজন নিশ্চয়ই এ ঘটনার শিকড় পর্যন্ত পৌঁছাতে চাইছে। হয়তো এই মৃতদেহগুলো, এই ঠোঁট সেলাই করা শবগুলো, আমাদের জন্য একটি বড়ো বার্তা। যদি আমরা ইতিহাস ভুলে যাই, তাহলে নদী আর থামবে না।”
এদিকে, মৃণাল আর পলাশী ঘাটের দিকে ফিরে গিয়ে আরও এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পান। নদীর জলে ভেসে থাকা শবগুলো যেন নিজেরাই ধীরে ধীরে নড়াচড়া করতে শুরু করে। মৃতদেহগুলির শরীরে কোনো অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি ছিল, যেন তারা কথা বলছিল, কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। সেগুলির ঠোঁট একে অপরের দিকে একটু একটু করে নড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন একে অপরকে কিছু বলছে, তবে কেউ শোনার চেষ্টা করছিল না। মৃণাল ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও তুলতে থাকে, কিন্তু তখনই মনে হয়, সমস্ত দৃশ্য হঠাৎ এক সঙ্গে বিকৃত হয়ে যায়, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ক্যামেরাকে ব্যাহত করছে। পলাশী দেখে, ভিডিওর কোনো ফ্রেম ঠিকঠাক থাকে না, সব কিছু নড়াচড়া করছে, যেন সেই মৃতেরা নিজের অভিশাপ ও ভাষার মাধ্যমে জীবিতদেরকে ডেকে নিতে চায়।
এটি ছিল সেই মুহূর্ত, যখন গ্রামবাসী বুঝতে পারল—এরা শুধু মৃতদেহ নয়, বরং তারা সেই সময়ের স্পর্শ, যেগুলি কখনো অতীত থেকে মুক্তি পায়নি। জীবিতদের চুপ থাকার কারণেও অতীত ফিরে আসছে, আর সেই অতীতের ‘ভূত’রা তাদের মুখ খুলতে চাচ্ছে। এখন তারা আর শুধুমাত্র মৃত্যুর মুখে নয়, জীবিতদের চিত্তাকর্ষণ ও বিশ্বাস অর্জন করতে চায়।
অধ্যায় ৫:
ভাগীরথীর তীরের গাঢ় অন্ধকার যেন কিছু একটা গোপন করে রাখে, এমন একটা অনুভূতি শচীনাথ ঠাকুরের দীর্ঘজীবনে এই প্রথম নয়। কিন্তু এবার যে অনুভূতিটা ধীরে ধীরে পাক খেতে খেতে মনের গভীরে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা যেন একেবারে নতুন—অচেনা আর ভয়ংকর। তিন রাত ধরে টানা নদীতে শব ভেসে আসছে, আর প্রত্যেকটি শবের ঠোঁট কাটা সেলাই করে দেওয়া। গ্রামের লোকেরা দিনের আলোয় কথা বললেও, সন্ধ্যা নামতেই তালা লাগিয়ে দেয় বাড়ির দরজা। রাধাবল্লভ মন্দিরের সামনে, যেখানে একসময় সন্ধ্যারতির ঘন্টা বাজত, এখন সেখানেও নেমে এসেছে মৃত নিস্তব্ধতা। শচীনাথ যখন মন্দিরের মূলগর্ভে প্রবেশ করলেন, তখন বাতাসে কাঁপন ধরানো এক ঠান্ডা ছিল। তিনি ধূপ জ্বালানোর আগেই শুনলেন এক ফিসফিস শব্দ, যেন কেউ ধীরে ধীরে কিছু বলছে—কিন্তু ঠোঁট না খুলেই। পিছন ফিরে কিছু না পেয়ে তিনি আবার পায়ে পায়ে এগোলেন, কিন্তু সেই ফিসফিস ধ্বনি এবার গাঢ় হয়ে উঠল, যেন বহু গলা একসাথে নিঃশব্দে আর্তনাদ করছে। তখনই তিনি বুঝলেন—নদীতে ভেসে আসা শবগুলো শুধু মৃতদেহ নয়, তারা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠোঁট সেলাই হয়ে থাকায়, তারা সেই কথাগুলো গলায় ধরে রাখছে, যেন কোনও অদৃশ্য অভিশাপ তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছে।
ওপারে কাশতলা গ্রামের ঘাটের পেছনে মাটির উঁচু ঢিপিতে এককালে একটি পুরনো শ্মশান ছিল, যার নাম আজ আর কেউ উচ্চারণ করে না। সেই শ্মশানে এককালে নাকি তান্ত্রিকেরা পূর্ণিমা রাতে মৃতদেহ নিয়ে সাধনা করত। আর যারা সেই সাধনায় ব্যর্থ হতো, তাদের আত্মা নাকি নদীতেই বন্দি হয়ে যেত। এই কিংবদন্তি এখন বাস্তবের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে—এমনটাই অনুভব করছে গ্রামের তরুণ স্কুল শিক্ষক রুদ্র। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়েছে, আর খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছে—এই তিন রাতের প্রতিটি পূর্ণিমা রাতে শব এসেছে, আর সেই শবগুলোর মুখে দেখা গেছে অদ্ভুত আঁকিবুঁকি—যা রুদ্রর মতে কোন এক মৃত ভাষার ছাপ। শচীনাথ যখন রুদ্রকে ডেকে পাঠালেন মন্দিরে, তখন আকাশের মাঝখানে জ্যোৎস্না ঝরছিল। রুদ্র তার খাতা, কলম, আর মোবাইলে তোলা মৃতদেহের ছবি নিয়ে হাজির হল। শচীনাথ ছবি দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠলেন—প্রতিটি শবের ঠোঁটের সেলাই যেন কোনও নিদির্ষ্ট রকমের বিন্যাসে করা হয়েছে। যেন মৃতেরা সম্মিলিতভাবে কিছু লিখতে চাইছে, অথবা কোনও ছন্দে গাইতে চাইছে। সেই মুহূর্তেই মন্দিরের মেঝেতে এক ঝাপসা ছায়া নেমে এল—দুজনেই ঘুরে দেখল, সেখানে কেউ নেই। কিন্তু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল এক অপার্থিব গন্ধ, যেন ভেজা চিতা কাঠ আর শবের চুল একসাথে পুড়ছে।
রুদ্র তখন বুঝল, শুধু গবেষণা বা বিশ্বাস নয়—এটা এখন বাস্তব। শচীনাথ বললেন, “এই মৃতেরা শান্তি চায়, তারা কথা বলতে চায়। কিন্তু তাদের ভাষা কেউ বোঝে না।” রুদ্র প্রস্তাব দিল—এই মৃতদের ঠোঁটের সেলাই যদি কেটে ফেলা যায়, যদি তাদের কণ্ঠ মুক্তি পায়, তবে হয়তো তাদের অভিশাপের থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু কে করবে এই কাজ? শচীনাথ জানালেন, এমন এক তান্ত্রিক আছেন যিনি এক সময় এই ভাষার গবেষণা করতেন—গঙ্গেশ্বরী নামের এক নদীপারের গ্রামে থাকেন তিনি। তখনই ঠিক হয়, পরদিন সূর্য ওঠার আগেই রুদ্র রওনা দেবে গঙ্গেশ্বরীর দিকে, আর শচীনাথ যাবেন কাশতলার সেই পুরনো শ্মশান ঘাটে—অতীতের ধুলো খুঁড়ে দেখতে, আজকের রহস্যের উৎস কোথায়। বাইরে তখন পূর্ণিমার আলোয় ভাগীরথী উথলে উঠছে, আর দূরে ভেসে আসছে নতুন একটা মৃতদেহ—যার ঠোঁটে আগের চেয়েও গভীর সেলাই।
অধ্যায় ৬:
অন্ধকারে মোড়া ভোরের আলো গোপনে নদীর বুক ছুঁয়ে উঠে আসে, কিন্তু সেই আলোয় এখনও পাপ ধুয়ে যায়নি। পরের দিন সকালে ভাগীরথীর পাড়জুড়ে লোকজনের ভিড় জমে যায়। গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় পুলিশ অফিসার অশোক বেরা, তাঁর চোখের কোণায় জেগে থাকা আতঙ্ক তখনও মিলিয়ে যায়নি। তিনটি নতুন শব ভেসে উঠেছে। ঠোঁট সেলাই করা, চোখ খোলা, ঠিক যেন কারও দিকে চেয়ে কথা বলতে চাইছে তারা। আশেপাশে ভিড় করা মানুষগুলোর মুখেও আতঙ্ক, কৌতূহল আর নিঃশব্দ জিজ্ঞাসা। পুরোহিত বীরনাথ চক্রবর্তী, যিনি প্রথম থেকেই সাবধান করে আসছিলেন, আজ আরও গম্ভীর। তিনি বললেন, “ওরা কথা বলতে চাইছে। ওদের ব্যথা আমরা বুঝতে পারছি না। এই নদী এখন আর নিঃশব্দ নয়, এর ঢেউয়ের নিচে কেউ চিৎকার করছে।” তাঁর এই কথায় আরও হিম পড়ে যায় জনতার মুখে। এমন সময়ে গ্রামে আসে এক নতুন চরিত্র—ইতিহাস গবেষক তীর্থজিত রায়, যিনি নদী ও লোককথা নিয়ে গবেষণা করেন। পুরোনো পুরনো কাগজ, নথি আর রেকর্ড ঘেঁটে তিনি সন্ধান করতে থাকেন এমন এক ঘটনার, যার শিকড় হয়তো এই ভাসমান শবদলের গভীরে প্রোথিত।
তীর্থজিত তার গবেষণায় উঠে আসা একটি পুরনো কাহিনির কথা বলেন—১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকালে মুর্শিদাবাদের কাছে একটি নদীতীরবর্তী গ্রামে হঠাৎ করেই অদ্ভুত মৃত্যু ঘটেছিল বেশ কিছু মানুষের। লোকমুখে শোনা যায়, সেইসব মৃতরা নদীতে ডুবে যায়নি, বরং কারও হাতে বলি হয়। ইতিহাস বলছে না, কিন্তু নদী জানে সত্যি কী ঘটেছিল। পুরোহিত বীরনাথ বলেন, “পুরোনো নদীর জলও কথা মনে রাখে। ভেবো না, এটা কেবল জল, এ এক জীবন্ত ইতিহাস।” তীর্থজিত তাঁর পুরোনো মানচিত্র ও দলিলপত্র নিয়ে নদীর গতিপথের পরিবর্তনের হদিস পেতে থাকেন। তিনি খুঁজে পান, ঘাট থেকে একটু দূরে এক পুরনো ঘূর্ণিপাক ছিল, যেখানে নদীর স্রোত হঠাৎ গভীর আর বেপরোয়া হয়ে উঠত। তিনি মনে করেন, এই স্থানই কোনও এক প্রাচীন উৎসর্গস্থল ছিল, যেখানে মানুষের বলি দেওয়া হতো ধর্মের নামে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, রাতে সেই নির্দিষ্ট ঘূর্ণিপাকের জায়গায় গিয়ে সরাসরি খোঁজ চালাবেন।
সেই রাতে, পূর্ণিমার আলোয় আলোয় নদীর জলে বয়ে চলেছে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। তীর্থজিত, পুরোহিত বীরনাথ এবং অশোক বেরা মিলে একটি ছোট নৌকা নিয়ে বের হন সেই রহস্যময় ঘূর্ণিপাকের দিকে। বাতাস ভারী, যেন কোনও অদৃশ্য কিছুর উপস্থিতি তাদের পিছু নিচ্ছে। নৌকা যখন ঠিক সেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছায়, আচমকা নদীর স্রোত যেন রেগে যায়। ঢেউ ক্রমে বেড়ে ওঠে, হাওয়া চিৎকার করে ওঠে, আর তারপর—তীর্থজিত নদীর জলে দেখতে পান অসংখ্য মুখ, সেলাই করা ঠোঁট, যাদের চোখ কাঁদছে। এক তীব্র শব্দে পুরোহিত চিৎকার করে বলেন, “ওরা কথা বলার চেষ্টা করছে! শুনতে হবে! চুপ করো সবাই!” কিন্তু ঠিক তখনই ঘূর্ণিপাক আরও তীব্র হয়ে ওঠে, আর সেই স্রোতের টানে নৌকা টলতে টলতে জলের উপর বসে থাকা কোনও অদৃশ্য কিছুর মুখোমুখি হয়। তীর্থজিত বুঝতে পারেন—এই নদীর নিচে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এক ভয়ানক সত্য, যাকে চাপা দেওয়া হয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। সেই সত্যই আজ ঠোঁট সেলাই করা মৃতদেহ হয়ে ফিরে এসেছে, কথা বলার জন্য, বিচার চাওয়ার জন্য।
অধ্যায় ৭:
রাত্রি তখন গভীর, পূর্ণিমার চাঁদের আলো নদীকে যেন এক জাদুকরি আভায় ভরে দিয়েছে। ঘূর্ণিপাকের জায়গা থেকে ফিরে এসে তীর্থজিত, পুরোহিত বীরনাথ এবং অশোক বেরা একত্রিত হয়ে নদীর পাড়ে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মগ্ন। তারা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কীভাবে নদী এতটা অদ্ভুতভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পুরোহিত বীরনাথ বললেন, “এই নদী কখনো ভুলে যায়নি, তবে আমরা ভুলে গিয়েছি। মায়ের কৃপায় আমরা নিজের পাপের বিচারকে এড়াতে পারি না। এই শবগুলো শুধু মৃতদেহ নয়, এই শবগুলো আত্মার বার্তা। একটা ভয়ংকর ইতিহাস রয়েছে এর পেছনে, যা বহু বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল।” তীর্থজিত মাথা নেড়ে বলেন, “আমরা ইতিহাসের ভুল অধ্যায়কে নতুনভাবে খুলছি, কিন্তু কি হবে পরিণতি? যে জল এতদিন শব গ্রহণ করেছিল, সেই জল আজ আমাদের কাছে দাবির মুখে এসেছে।”
তীর্থজিত তখন নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেন, তারা যদি সত্যি সত্যি ওই শবগুলোর ভাষা বুঝতে চান, তাহলে তাদের গভীরভাবে সেই ঐতিহাসিক জায়গার খোঁজ করতে হবে—যে স্থানে নদী তার গর্ভে একসময়ের নিঃশব্দ হত্যাকাণ্ডগুলো ধারণ করেছে। ইতিহাসের এই গোপনীয়তা শুধু নদী জানে। তাঁর চিঠি, তাঁর কষ্ট, তাঁর নিঃশব্দ শব্দ—এসব কিছু এখন পুছে যাওয়া, কিন্তু যেহেতু নদী কখনো ভুলে যায় না, সে আজ ফিরে এসেছে সমস্ত কিছু চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করতে।
পরের দিন, পুরনো জেলেরা, যাদের কাছ থেকে অনেক সময় নদী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, তাদের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন তীর্থজিত। তারা জানান, কিছুদিন আগে নদীর তীর থেকে একটি অদ্ভুত কাঠের ভেসে আসা জাহাজের কাটা টুকরা পাওয়া গিয়েছিল—যা পুরনো পুরাণে উল্লেখ করা হয়। সে কাঠের টুকরা ছিল মূলত একটি ভাসমান মন্দিরের অংশ—এটি প্রায় একশো বছর পুরনো হতে পারে। এটি ছিল কোনও ধরনের তান্ত্রিক পুরাণের অংশ, যেখানে বলি দেওয়ার জন্য মৃতদেহ তলিয়ে দেওয়া হত। এরপর, সেই মন্দিরের কাঠ গুলি নদী থেকে ভেসে আসার পর থেকেই, মরণের পর মৃতদের ঠোঁট সেলাই করার ঘটনা শুরু হয়।
তীর্থজিত তার গবেষণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন, তারা এই সেলাই করা ঠোঁটের ঘটনা এবং কাঠের টুকরা পরীক্ষা করবেন। সেক্ষেত্রে, সেই মন্দিরের অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, নদী আসলে সেই মন্দিরের একটি অবশেষ—যেখানে একসময়ের নিষ্ঠুরতা, তান্ত্রিক আচার-ধর্ম ও সমাজের প্রভাব নিয়ে যে অভিশাপ এসেছিল, তা এখনও টিকে আছে। একদিকে চাঁদ, অন্যদিকে প্রাচীন ইতিহাসের জটিলতা, তীর্থজিত দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন যে তাদের এখন আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে, সেই মন্দিরের কাঠের অবশেষ থেকে নদীর গভীর রহস্য বের করতে হবে।
পাশাপাশি, গ্রামবাসীরা যারা আগেও ভয়ে আত্মগোপন করেছিল, তারা এখন সাহস জোগাতে শুরু করেছে। হরিপদ মাঝি এবং তার বন্ধুদের এক নতুন দল তৈরি হয়। তারা পুরনো নথি নিয়ে পরীক্ষা করে, এবং মন্দিরের আগের অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু, তারা যেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল, সেখানে দেখা দেয় এক অজানা বাধা—ঘন কুয়াশা, শীতল বাতাস, এবং রাস্তার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। হরিপদ মাঝি বলেন, “নদী আজো আমাদের শাস্তি দিতে চাইছে, আমরা যতদূর এগোব, ততদূর পথ বন্ধ হয়ে যাবে।”
গ্রামবাসীদের চরম নির্ভরতার প্রেক্ষিতে, রুদ্রপ্রতাপ এবং পলাশী এই বিষয়ে আরও গভীরভাবে কাজ করতে শুরু করে। তারা বুঝতে পারে, শবগুলোর ঠোঁট সেলাই করার আচারটি শুধু পুরনো পুরাণের কথা নয়, বরং এটি এক ধরনের অজানা অভিশাপ—যা শুধু অতীতকে মনে রেখে বর্তমানের বিচার চায়। নদী আর শব তাদের শিকড়গুলো খুঁজে ফিরে পায়, এবং এখন শুধু তাদের কথাটি শোনা বাকি।
অধ্যায় ৮:
ভাগীরথীর পাড়ে রাত গভীর হয়ে এসেছিল। টাঁসা ঘাটের দিকে তাকালে মনে হত, অন্ধকারের মধ্যে কেবল নদীটাই যেন জীবিত—বাকি সব নিস্তব্ধ, নিশ্চল। ওই অদ্ভুত রাতেই অচিন্ত্য, অনিমেষ, শিবু ও পুরোহিত ঠাকুরমশাই আবার ফিরলেন সেই রহস্যময় চরে, যেখানে আগের রাতে মিলেছিল আরও তিনটি সেলাই-করা মৃতদেহ। এবার সঙ্গে ছিল একটি পুরনো গামছায় মোড়া ধাতব পিতলের কলসি, পুরোহিতের পৈতৃক সংগ্রহ থেকে। তিনি বলেছিলেন, “যদি সত্যি ওরা কথা বলতে চায়, তবে পঞ্চাশ বছরের নীরবতা আজ ভাঙবে।” ঘাটের ধারে বসে তিনি জলভাগীতে কিছু মন্ত্র পড়লেন, আর কলসির মুখ খুলে নদীতে নামিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল—দূরের কুয়াশা যেন এগিয়ে এসে চরের বুক জুড়ে বসে পড়ল। অন্ধকারের ভিতর একে একে ভেসে উঠল সাতটি শব—প্রত্যেকের মুখে সেই সেলাই, তবে এবার তাঁদের চোখে ছিল জল। হ্যাঁ, মৃতদেহর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
পুরোহিত কাঁপা গলায় মন্ত্র উচ্চারণ করতেই হঠাৎ করেই নদীর জলে এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল—একসঙ্গে অনেকগুলো গলা, যেন কান্নার সুরে উচ্চারণ করছে, “আমাদের কথা শোনো…”। চমকে উঠল সবাই। অচিন্ত্য হাত দিয়ে ধরল অনিমেষের কাঁধ, শিবুর মুখ তখন পাথরের মত জড়। মৃতদেহগুলোর মুখের সেলাই যেন ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসছে, আর সেই সঙ্গে খুলে যাচ্ছে তাঁদের নীরবতা। একজন বৃদ্ধার শব এগিয়ে এল একটু বেশি কাছে—তাঁর মুখের সেলাইটা সম্পূর্ণ খুলে গেছে এখন, আর ঠোঁট কাঁপছে ধীরে ধীরে। “সেই ১৯৭৫… আমরা সবাই ছিলাম নদীপারের বৈষ্ণব আশ্রমের সন্ন্যাসিনী। এক রাত, এক দুষ্কর্ম… আটজন যুবক এসেছিল। আমরা বাধা দিয়েছিলাম, ওরা আমাদের গলা টিপে মেরেছিল, তারপর আমাদের মুখ সেলাই করে নদীতে ফেলে দেয়। সবাই ভাবল আমরা নিখোঁজ। কেউ খুঁজল না…”। বাতাস যেন দাঁড়িয়ে গেল, নদীর জল থেমে গিয়েছে এমন লাগল—শুধু সেই বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর। “আমরা শুধু চাই, কেউ জানুক আমাদের কথা। কেউ জানুক, এই মাটিতে কী পাপ চাপা পড়েছিল। আমাদের মুখ সেলাই ছিল, কিন্তু মন চিরকাল জেগে ছিল…”।
সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। পুরোহিত হালকা কাঁপা গলায় বললেন, “তোমাদের সত্যের জন্য আমরা জপ করব, তোমাদের কথা ছড়িয়ে দেব—ভগবানের নামে বলছি…”। বৃদ্ধার মৃতদেহ মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিল, আর তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল নদীর ধোঁয়ার মধ্যে। বাকি মৃতদেহগুলোও একে একে সরে যেতে লাগল, যেন অন্তিম স্বস্তি পেয়েছে তাঁরা। কুয়াশা ফিকে হয়ে আসছে। বাতাস আবার চলেছে, নদী আবার ঢেউ তুলছে। শিবু চোখ মুছে বলল, “এতদিনের চুপ থাকা আজ ভাঙল… কেউ তাঁদের কথা শুনল…”। পুরোহিত চোখ বন্ধ করে প্রণাম জানালেন নদীর দিকে, যেন চুপিচুপি বলে উঠলেন—”আজ নদী কথা বলেছে, এবার পালা মানুষের।”
—-