Bangla - প্রেমের গল্প

ভালোবাসা বনাম সামাজিক বাঁধা

Spread the love

শ্রাবণী বসু


অধ্যায় ১: অচেনা পরিচয়
শহরের ব্যস্ততম রাস্তায়, যানজট আর মানুষের ভিড়ে ডুবে থাকা এক বিকেলে, অরণ্যের চোখ হঠাৎ আটকে যায় এক অপরিচিত মুখে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডের কোণে, লাল-সাদা শাড়ি পরা, কাঁধে বইভরা ব্যাগ, আর চোখে যেন এক অদ্ভুত শান্তি। গরমে ক্লান্ত সবাই যখন বিরক্তিতে কুঁকড়ে আছে, মেয়েটির মুখে তখনও একরকম প্রশান্ত ভাব। অরণ্য জানে না কেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে—যেন বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া কাউকে আবার খুঁজে পেল। মেয়েটির চুল এলোমেলো হয়ে কপালে লেগে আছে, বাতাসে দুলে পড়ছে গাল ছুঁয়ে, আর সে এক অচেনা জগতে হারিয়ে যেতে চাইছে। অরণ্য থেমে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকে, নিজের অজান্তেই, আর সময় যেন গলে যেতে থাকে সেই এক ফ্রেমে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস আসে, মানুষ হুড়োহুড়ি করে ওঠে, আর মেয়েটি ভিড়ের সঙ্গে এগিয়ে যায়। হঠাৎ হঠাৎ পিছনে তাকায় সে, যেন কারও খোঁজ করছে, আর সেই খোঁজের দৃষ্টিতেই অরণ্য বুঝতে পারে—এটাই সেই সংযোগ, যা অচেনা হলেও ভেতরে ভেতরে চেনা লাগে। মেয়েটি বাসে ওঠে, জানালার পাশে বসে, আর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। অরণ্যর মনে হয়, এই দৃষ্টি শুধু তার জন্য, যদিও মেয়েটি হয়তো তাকে দেখেইনি সেভাবে। তবুও সেই এক মুহূর্ত, সেই অচেনা দৃষ্টির সংযোগ অরণ্যের মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন তোলে। মনে হতে থাকে, যদি নামটা জানত, যদি কথা বলতে পারত, তবে হয়তো পৃথিবীটাই বদলে যেত। কিন্তু ভিড়ের চাপ আর সময়ের অভাবে সে কিছুই করতে পারে না, কেবল দাঁড়িয়ে থাকতে থাকে ফুটপাথে, আর বাসটি দূরে মিলিয়ে যায় ধোঁয়ার রেখা ফেলে।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ হয় না। কয়েকদিনের মধ্যে ভাগ্য যেন আবার খেলা দেখায়। অরণ্য তার বন্ধুর সঙ্গে কলেজ রোডে হাঁটছে, হঠাৎ চোখ পড়ে পরিচিত এক ছায়ায়। সেই মেয়েটিই, হাতে বই, একটু তাড়াহুড়ো করে চলেছে, আর এবার অরণ্য বুঝতে পারে, এ কেবল কাকতাল নয়, এ এক নিয়তি। বুকের ভেতরে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যায় সে, আর সামনের মুহূর্তে তাদের চোখে চোখ পড়ে। মেয়েটির চোখে প্রথমে বিস্ময়, তারপর একরকম নীরব হাসি। হয়তো সে-ও চিনে নিয়েছে সেই ফুটপাথের অচেনা দৃষ্টিকে। ব্যস্ত রাস্তায়, ভিড়ের কোলাহলে, তারা দু’জন দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড, যেখানে সময় থেমে যায়, আর জন্ম নেয় এমন এক অনুভূতি, যার শুরু হয় অচেনা পরিচয় থেকে, কিন্তু যার শেষ কোথায়—তা তখনও তারা কেউ জানে না।
অধ্যায় ২: নিষিদ্ধ আকর্ষণ
পরদিন থেকেই অরণ্যের ভেতর এক অদ্ভুত টান কাজ করতে শুরু করে। দিনের বেলায় সে ক্লাসে থাকলেও কিংবা বন্ধুর সঙ্গে গল্প করলেও, মনের অজান্তেই সেই অচেনা মেয়েটির মুখ ভেসে ওঠে। চোখের দৃষ্টি, ঠোঁটের নীরব হাসি, আর লাল-সাদা শাড়ির সরল সৌন্দর্য—সবকিছুই যেন তাকে গ্রাস করে নেয়। অরণ্য চেষ্টা করে নিজেকে বোঝাতে, হয়তো এটা সামান্য মুগ্ধতা, কিন্তু অন্তরের গভীরে জানে, এটা মুগ্ধতার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। হঠাৎ কোথা থেকে যেন সাহস আসে, আর সে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটিকে খুঁজে বের করার। কলেজ রোডে প্রতিদিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, বই হাতে হাঁটে, যেন কাকতালীয়ভাবে আবার দেখা হয়ে যায়। কয়েকদিনের মধ্যে তার অপেক্ষা সফল হয়—মেয়েটিকে দেখে ফেলে আবার, এবার কফিশপের সামনে দাঁড়িয়ে। সে জানে না কেন, কিন্তু বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি নিয়ে এগিয়ে যায়, আর প্রথমবারের মতো বলে ফেলে—“হাই, আমি অরণ্য।” মেয়েটি চমকে ওঠে, কিন্তু চোখে কোনো বিরক্তি নেই, বরং কৌতূহল মাখা দৃষ্টি। ধীরে ধীরে উত্তর দেয়—“আমি মীরা।” সেই মুহূর্তে, নামটি অরণ্যের মনে এমনভাবে বাজতে থাকে যেন বহুদিন ধরেই সে এই নামের জন্য অপেক্ষা করছিল।
সেই এক পরিচয় যেন অনেক পুরোনো বন্ধুত্বের মতো দ্রুত বেড়ে ওঠে। তারা দেখা করতে শুরু করে—প্রথমে ক্যাম্পাসে, তারপর বইয়ের দোকানে, কফিশপে, এমনকি শহরের নির্জন লেকপাড়েও। প্রতিটি মুহূর্তে অরণ্য আবিষ্কার করে মীরার মধ্যে এক অদ্ভুত মাধুর্য, যার সঙ্গে মিশে আছে জেদ আর সরলতা। মীরা বই ভালোবাসে, গান শোনে, আর কথায় কথায় সমাজ আর নিয়মকানুন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু এর মাঝেই সে স্বীকার করে, তাদের এই ঘনিষ্ঠতা সহজে মেনে নেবে না চারপাশ। মীরার পরিবার খুব রক্ষণশীল, তারা প্রেম-ভালোবাসাকে কেবল পর্দার আড়ালে ফিসফিস করা অপরাধ বলে মনে করে। আর অরণ্যের পরিবার চায়, সে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে ঢুকুক, কোনো সম্পর্কের ঝামেলায় জড়াক না। তবুও, প্রতিটি নিষেধাজ্ঞার ভেতর দিয়ে আরও গভীর হয় তাদের আকর্ষণ। তারা জানে, এ পথে পা বাড়ানো মানে ঝুঁকি নেওয়া, কিন্তু তবুও তারা থামতে পারে না। যেন সমাজের সমস্ত নিয়ম ভেঙে একে অপরের কাছে টেনে নেয় তাদের হৃদয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেখা আরও ঘন হয়। ক্লাস শেষে লুকিয়ে হাঁটতে বের হয়, রাতে ফোনে নীরব কথা বলে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মীরা বলে—“আমরা কি ঠিক করছি অরণ্য? সমাজ যদি জানে, তাহলে কি আমাদের সহ্য করবে?” অরণ্য উত্তর দেয়—“ভালোবাসা কখনো ভুল হতে পারে না, মীরা। ভুল তো সমাজ, যে বাঁধা দেয়।” এই কথাগুলো শুনে মীরার চোখে জল এসে যায়, তবুও ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করে, এই বাঁধন ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। তারা দু’জনেই জানে, পথ যতই কঠিন হোক, তারা একে অপরকে ছাড়তে পারবে না। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় নিষিদ্ধ এক আকর্ষণ—যা তাদের একদিকে টানে আবেগের গভীরে, অন্যদিকে ঠেলে দেয় ভয় আর অস্থিরতার অন্ধকারে।
অধ্যায় ৩: বাঁধার দেয়াল
দিনগুলি যত এগোয়, অরণ্য আর মীরার সম্পর্কও তত গভীরে গেঁথে যেতে থাকে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার মাঝেই ধীরে ধীরে সামনে আসে সমাজের কঠোর বাস্তবতা। প্রথমে পরিবারকে কিছু বুঝতে দেওয়া হয়নি, তবুও আশেপাশের মানুষের চোখ এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয় না। একদিন কফিশপ থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ মীরার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাদের একসঙ্গে দেখে ফেলে। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে সে আর কিছু না বললেও, অরণ্য আর মীরা দু’জনেই বুঝতে পারে, এখন আর নিরাপদ নয় তাদের এই সম্পর্ক। মীরা সেদিন কাঁপা কণ্ঠে বলে—“তুমি জানো না, আমার বাড়িতে যদি এ খবর পৌঁছায়, আমার জীবনে কি ঘটবে।” অরণ্য চুপ করে থাকে, কিন্তু অন্তরে একরাশ ভয় চেপে বসে। সেই প্রথমবার সে বুঝতে পারে, ভালোবাসা যতই গভীর হোক, সমাজের দেয়াল ভাঙা তত সহজ নয়।
ধীরে ধীরে চারপাশের চাপ বাড়তে থাকে। মীরার পরিবার তার বিয়ে নিয়ে আলাপ শুরু করে, এক আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য চাপ দিতে থাকে। মীরা অজুহাত খুঁজে খুঁজে এড়িয়ে যায়, কিন্তু মনের ভেতর আতঙ্কে ভরে ওঠে প্রতিটি দিন। অন্যদিকে অরণ্যের বাড়িতেও শুরু হয় চাপ—তার বাবা বারবার বলে, “এখন প্রেমে না ভেসে পড়াশোনায় মন দাও, না হলে জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে।” অরণ্য জানে, তারা যদি জানতে পারে মীরার কথা, তাহলে সম্পর্কটিকে কোনোদিন মেনে নেবে না। মীরার সঙ্গে কথা বলার সময় দু’জনেই বারবার একই ভয় শেয়ার করে—যদি ধরা পড়ে যায়, যদি তাদের আলাদা করে দেওয়া হয়? তবুও, যতই ভয় বাড়ে, ততই বেড়ে ওঠে টান। কারণ তারা দু’জনেই জানে, একে অপর ছাড়া তারা অসম্পূর্ণ।
এই বাঁধার দেয়াল যেন প্রতিটি মুহূর্তে আরও উঁচু হয়ে উঠতে থাকে। প্রতিটি দেখা যেন চুরি করা সুখ, প্রতিটি আলিঙ্গন যেন ঝুঁকির অন্ধকারে পা বাড়ানো। তবুও তারা থামে না। এক বিকেলে লেকপাড়ে দেখা করার সময় মীরা ফিসফিস করে বলে—“আমরা কি কখনো মুক্ত হবো, অরণ্য? এই সমাজের হাত থেকে কি পালাতে পারবো?” অরণ্য দৃঢ়ভাবে উত্তর দেয়—“আমরা পালাবো না, মীরা। আমরা লড়বো।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও চোখে স্পষ্ট ভয়, কারণ সে জানে না লড়াইটা কতটা কঠিন। বাঁধার দেয়াল যতই উঁচু হোক, তারা দু’জনই সিদ্ধান্ত নেয় ভালোবাসার জন্য লড়বে, যদিও ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারে, এই লড়াইয়ের শেষ সহজ নয়।
অধ্যায় ৪: গোপন পথচলা
বাঁধার দেয়াল যত উঁচু হতে থাকে, অরণ্য আর মীরা তত বেশি শিখে নেয় লুকিয়ে বাঁচতে। তাদের প্রতিটি দেখা যেন হয়ে ওঠে এক এক টুকরো চুরি করা সময়, যা তারা বুকের ভেতর জমিয়ে রাখে অমূল্য ধন হিসেবে। ক্লাসের ফাঁকে হঠাৎ হেঁটে যাওয়া, লাইব্রেরির কোনায় বইয়ের আড়ালে কয়েক মিনিটের কথোপকথন, অথবা ভিড়ের মধ্যে হাত ছোঁয়া—সবকিছুই যেন হয়ে ওঠে গোপন আনন্দের উৎস। শহরের রাস্তায় তারা আর সেভাবে হাঁটে না, বরং বেছে নেয় অচেনা গলি, ফাঁকা পার্ক কিংবা নির্জন লেকপাড়। মীরার ভয় সবসময় কাজ করে—কেউ যদি দেখে ফেলে? তবুও, অরণ্যের চোখে চোখ পড়লেই সব ভয় মুছে যায়। তারা দু’জনেই জানে, এই গোপন পথচলাই তাদের একমাত্র আশ্রয়, যেখানে সমাজের দৃষ্টি পৌঁছাতে পারে না।
এই গোপন জীবনের মাঝেই জন্ম নেয় অসংখ্য মধুর স্মৃতি। এক বিকেলে তারা যায় শহরের বাইরে, ধানক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট এক মাটির পথ ধরে হাঁটে। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ, বাতাসে ধানের গন্ধ, আর মাথার ওপরে সোনালি আলো ছড়িয়ে থাকা আকাশ। সেখানে দাঁড়িয়ে মীরা প্রথমবার অরণ্যের হাত শক্ত করে ধরে বলে—“এখানেই যদি আমাদের জীবন কাটাতে পারতাম, কত শান্ত হতো।” অরণ্য হাসে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুক কেঁপে ওঠে, কারণ জানে, বাস্তবতা এত সহজ নয়। তবুও সেই মুহূর্তে দু’জনেই ভুলে যায় ভয়, ভুলে যায় বাঁধা, কেবল নিজেদের ভালোবাসার ভেতরে ডুবে থাকে। এভাবেই তাদের প্রতিটি দেখা, প্রতিটি মুহূর্ত, হয়ে ওঠে গোপন অথচ অবিস্মরণীয় স্মৃতি, যা আর কেউ জানে না, শুধু তারা দু’জন।
কিন্তু গোপন পথচলার এই আনন্দের মাঝেই ঢুকে পড়ে ভয়ের ছায়া। যতই লুকিয়ে থাকুক, তবুও তাদের সম্পর্ক দীর্ঘদিন গোপন রাখা সম্ভব নয়—এটা তারা দু’জনেই বোঝে। তবুও কেউ থামে না। কারণ প্রতিটি দেখা না হলে বুকের ভেতর অস্থিরতা গ্রাস করে, প্রতিটি দিন দূরে থাকলে মনে হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা ঝুঁকি নিয়েই এগিয়ে যায়, বুঝতে পারে না এই পথে যতই সুখ থাকুক, সামনে অপেক্ষা করছে আরও বড় পরীক্ষা। গোপন পথচলা তাদের ভালোবাসাকে গভীর করে তোলে, কিন্তু একইসঙ্গে আরও জটিল করে তোলে ভবিষ্যতের সমীকরণ।
অধ্যায় ৫: ভয়ের ছায়া
গোপন পথচলার নেশা যত বাড়ে, ততই ভয়ের ছায়া ঘনিয়ে আসে অরণ্য আর মীরার জীবনে। প্রতিদিন দেখা করার জন্য তারা নতুন অজুহাত খোঁজে—ক্লাসের কাজ, বন্ধুর সঙ্গে প্রোজেক্ট, বা বাজারে যাওয়া—কিন্তু মনের গভীরে সবসময় কাজ করে ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। একদিন বিকেলে, কলেজ শেষে লেকপাড়ে বসে তারা দু’জন আড্ডা দিচ্ছিল, হঠাৎই পাশের বেঞ্চে বসা এক চেনা মুখ তাদের চেনার মতো তাকিয়ে থাকে। মীরার বুক কেঁপে ওঠে, অরণ্য দ্রুত বিষয়টা সামাল দিতে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করে, কিন্তু সেই মুহূর্তের চাপা ভয়ের অনুভূতি দু’জনকেই দীর্ঘসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। যেন সমাজের চোখ সবসময় তাদের পিছু নিচ্ছে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে আছে বিপদের ইঙ্গিত।
মীরার পরিবারও সন্দেহ করতে শুরু করে। তার মা প্রায়ই প্রশ্ন করে—“তুমি এত দেরি করে ফিরছ কেন?” বা “মোবাইলে এত কথা বলো কার সঙ্গে?” মীরা কোনোভাবে উত্তর এড়িয়ে যায়, কিন্তু একসময় সে অনুভব করে, পরিবার যেন ধীরে ধীরে তার চারপাশে বেড়া টেনে দিচ্ছে। অরণ্যের দিকেও চাপ কম নয়। তার বাবা লক্ষ্য করেন, ছেলে পড়াশোনায় মন দিচ্ছে না, আর রাতে দীর্ঘসময় মোবাইল হাতে বসে থাকে। একদিন রাগ করে বলে ওঠেন—“তুমি যদি নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করো, তাহলে আমাদের মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না।” সেই কথাগুলো শুনে অরণ্যের ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সে জানে, বাবা-মায়ের স্বপ্ন ভেঙে দিতে চায় না, কিন্তু মীরাকে ছাড়া জীবনও তার কল্পনায় অসম্ভব।
এই টানাপোড়েনের মাঝেই তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে ওঠে। ভয়ের ছায়া যতই ঘন হয়, ততই তারা আঁকড়ে ধরে একে অপরকে। মীরা প্রায়ই বলে—“অরণ্য, যদি আমাদের আলাদা করে দেয়, তুমি কি আমাকে ছেড়ে দেবে?” অরণ্য শক্ত গলায় উত্তর দেয়—“কোনোদিন না, মীরা। মৃত্যুর আগেও না।” কিন্তু সে জানে, প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তবতা অনেক কঠিন। এই ভয়, এই চাপা উদ্বেগ তাদের প্রতিটি মুহূর্তকে একদিকে করে তোলে উত্তেজনাপূর্ণ, অন্যদিকে করে তোলে অনিশ্চিত। যেন প্রতিটি হাসির আড়ালেই লুকিয়ে আছে কান্নার সম্ভাবনা, প্রতিটি আলিঙ্গনের ভেতরেই বাজছে বিচ্ছেদের অদৃশ্য ঘণ্টাধ্বনি। তবুও তারা থেমে যায় না, কারণ ভালোবাসার শক্তি তাদের ঠেলে নিয়ে যায় আরও অজানা গভীরতার দিকে।
অধ্যায় ৬: আবেগের ঝড়
দিন যতই এগোয়, অরণ্য আর মীরার সম্পর্ক ততটাই আবেগে ভরে ওঠে। ভয়, চাপা উত্তেজনা, আর গোপন আকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে একসময় এমন অবস্থায় পৌঁছায় যেখানে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায়, শহরের ভিড় থেকে দূরে নির্জন এক বাড়ির ছাদে বসে তারা কথা বলছিল। চারদিকে মৃদু হাওয়া বইছে, আকাশে ম্লান চাঁদ, আর দূরে ঝলমলে আলো যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক ভিন্ন জগৎ তৈরি করেছে। কথার ভেতরে হঠাৎ এক নীরবতা নেমে আসে, আর সেই নীরবতার মধ্যেই তাদের দৃষ্টি একে অপরের চোখে আটকে যায়। কোনো শব্দের প্রয়োজন ছিল না, শুধু নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আসা আর হৃদয়ের ধকধকানিই বলে দিচ্ছিল—কিছু বদলে যেতে চলেছে।
মীরা প্রথমে চমকে ওঠে, কিন্তু অরণ্যের চোখের গভীর আকাঙ্ক্ষায় সে নিজের ভেতরের লুকানো আবেগটাকে থামাতে পারে না। ধীরে ধীরে দু’জন কাছে আসে, হাতের মুঠোয় মুঠো জড়ানো থেকে শুরু হয় এক অদ্ভুত কাঁপুনি, যা শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মুহূর্তে সমাজ, পরিবার, বাঁধা—সবকিছু যেন হারিয়ে যায়, কেবল থাকে দু’জনের ভেতরের অগ্নিস্রোত। অরণ্যের কণ্ঠ কাঁপা সুরে ফিসফিস করে—“মীরা, আমি তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।” মীরার চোখ ভিজে ওঠে, কিন্তু ঠোঁটে ধরা থাকে নীরব হাসি, যেন সে নিজেকেও অর্পণ করে দিচ্ছে অরণ্যের কাছে। আবেগের ঝড় তখন আর থেমে থাকেনি, বরং তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায় যেখানে সময়ের অস্তিত্বও মুছে যায়।
সেই রাত তাদের জীবনে প্রথমবার এমন এক অভিজ্ঞতার সূচনা করে, যেখানে ভয় আর নিষেধাজ্ঞার মাঝেও ভালোবাসার তীব্রতা তাদের বেঁধে ফেলে। তারা জানে, সমাজ এই সম্পর্ক মানবে না, তারা জানে সামনে অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর পরিণতি, তবুও সেই মুহূর্তে দু’জনেই মনে করে—যদি পৃথিবী ভেঙে যায়, তারা তবুও একসঙ্গে থাকতে চায়। আবেগের ঝড় শুধু শরীরের নয়, হৃদয়েরও—যেখানে তারা একে অপরের ভেতর ডুবে গিয়ে খুঁজে পায় নিজেদের অর্ধেক। সেই ঝড় হয়তো সাময়িক, হয়তো অনিশ্চিত, কিন্তু সেটাই তাদের ভালোবাসাকে নিয়ে যায় নতুন এক পর্যায়ে, যেখানে ভাঙা কঠিন, আর ফেরার পথ নেই।
অধ্যায় ৭: প্রথম মিলন
আবেগের ঝড়ের পর কয়েকদিন অরণ্য আর মীরা একে অপরের সামনে এসে যেন নতুনভাবে লজ্জা পায়, তবুও তাদের চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য আকর্ষণ। প্রতিটি দেখা যেন আগের চেয়ে আরও বেশি তীব্র, প্রতিটি স্পর্শ যেন বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে তোলে। অবশেষে একদিন, শহরের বাইরে অরণ্যের এক বন্ধুর খালি বাড়িতে আশ্রয় নেয় তারা। বাড়িটি ফাঁকা, চারপাশে নীরবতা, আর জানালার বাইরে কেবল বাতাসে দুলছে গাছের ডালপালা। মীরা প্রথমে দ্বিধায় ভুগছিল, চোখে ভেসে উঠছিল সমাজের বাঁধা আর পরিবারের কঠোর মুখ, কিন্তু অরণ্যের আশ্বাস তার ভয়কে ধীরে ধীরে গলিয়ে দেয়। অরণ্য ফিসফিস করে বলে—“এখানে আমরা শুধু দু’জন, কেউ নেই আমাদের আলাদা করার জন্য।” মীরার চোখে জল আসে, কিন্তু সেই জলে ভেসে ওঠে গভীর ভালোবাসা আর আত্মসমর্পণের আলো।
সেই মুহূর্ত থেকে তাদের চারপাশ যেন সম্পূর্ণ থেমে যায়। অরণ্যের হাত মীরার হাত ধরে ধীরে ধীরে কাছে টেনে আনে, আর মীরা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সঁপে দেয়। প্রথম আলিঙ্গনের উষ্ণতায় তাদের শরীর কেঁপে ওঠে, যেন বহুদিনের জমে থাকা আকাঙ্ক্ষা একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। ঠোঁটের স্পর্শ, নিঃশ্বাসের মিশ্রণ, আর অস্থির হাতের ছোঁয়ায় তাদের চারপাশের বাস্তবতা গলে যায়। ভয়, অপরাধবোধ, দ্বিধা—সবকিছু মিলিয়ে যায় এক অচেনা আবেশে। মীরা কাঁপা গলায় বলে ওঠে—“অরণ্য, আমরা কি ঠিক করছি?” অরণ্য তার চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়—“ভালোবাসা কখনো ভুল হতে পারে না, মীরা।” সেই কথার মধ্যেই তারা ভেঙে ফেলে শেষ বাঁধাটুকুও, আর মিলনের মাধ্যমে তারা খুঁজে পায় এমন এক ঘনিষ্ঠতা, যা শুধু দেহ নয়, আত্মাকেও একসূত্রে বেঁধে ফেলে।
প্রথম মিলনের সেই রাত তাদের জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে যায়। মীরা অনুভব করে, অরণ্যের স্পর্শে শুধু আবেগ নয়, নিরাপত্তাও আছে, এমন এক বিশ্বাস যা তাকে সাহস দেয়। অরণ্যও বুঝতে পারে, মীরার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল শারীরিক নয়, বরং এর ভেতরে লুকিয়ে আছে অদম্য ভালোবাসা আর একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি। ভোরের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লে তারা বুঝতে পারে, তারা বদলে গেছে। হয়তো সমাজের চোখে এটা অপরাধ, কিন্তু তাদের কাছে এটা এক পবিত্র মুহূর্ত—যেখানে দুইটি হৃদয়, দুইটি দেহ, আর দুইটি আত্মা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এই প্রথম মিলন কেবল ভালোবাসাকে গভীর করে না, বরং তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথকেও আরও জটিল আর অনিবার্য করে তোলে।
অধ্যায় ৮: অপরাধবোধ ও আনন্দ
প্রথম মিলনের পরদিন সকালটা অরণ্য আর মীরার জন্য ভিন্নরকম হয়ে ওঠে। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় তারা যখন একে অপরের দিকে তাকায়, তখন চোখে ঝরে পড়ে আনন্দের ঝিলিক, কিন্তু অন্তরের গভীরে চাপা পড়ে থাকে এক অদ্ভুত অপরাধবোধও। মীরা বিছানায় বসে চুলে আঙুল চালায়, তার চোখে স্পষ্ট দ্বিধা—সে ভাবে, যদি পরিবারের কেউ জানতে পারে তবে কি তাকে ক্ষমা করবে? সমাজের কঠিন চোখের সামনে তারা যদি দাঁড়ায় তবে কি টিকে থাকতে পারবে? অরণ্য পাশে বসে তার হাত ধরে বলে—“ভয় পেও না, মীরা। আমরা একসাথে আছি।” কিন্তু মীরার মুখে তখনও ছায়া—সে জানে, তারা এমন এক পথে পা বাড়িয়েছে যেখান থেকে ফেরার উপায় নেই। তবুও সেই অপরাধবোধের আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর সুখ, কারণ প্রথমবার সে অনুভব করেছে প্রকৃত ভালোবাসার ছোঁয়া, যা তাকে ভেতর থেকে পূর্ণ করেছে।
অরণ্যর ভেতরেও একই দ্বন্দ্ব চলে। একদিকে মনে হয়, সে মীরাকে জীবনের সবকিছু দিয়ে দিয়েছে, তাকে নিজের কাছে সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে, তার মাথায় বাজতে থাকে বাবার কথা, পরিবারের আশা, সমাজের কড়া দৃষ্টির ভয়। কলেজে ফিরে যখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, মনে হয় যেন চোখে চোখ রাখতে পারছে না। নিজের গোপন সুখটুকু বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে হয়, আর সেই লুকোনোটা কখনো কখনো বোঝা হয়ে ওঠে। তবুও, মীরার সঙ্গে দেখা হলেই সব ভয় মিলিয়ে যায়। তাদের সম্পর্ক যেন দ্বিমুখী ধারালো তলোয়ার—একদিকে অপরাধবোধ, অন্যদিকে অনাবিল আনন্দ। প্রতিটি আলিঙ্গনে, প্রতিটি স্পর্শে তারা আবারও ফিরে যায় সেই মিলনের গভীরে, আবারও ডুবে যায় আবেগের উষ্ণতায়, যদিও ভেতরে ভেতরে জানে এ সুখ চিরস্থায়ী নয়।
এই দ্বন্দ্ব তাদের প্রতিদিনের জীবনে আরও প্রকট হয়ে ওঠে। একদিকে তারা কাঁপতে থাকে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে, অন্যদিকে আবার মনে হয়, একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ছাড়া জীবন অর্থহীন। মীরা প্রায়ই বলে—“আমরা কি ভুল করছি, অরণ্য?” আর অরণ্য তাকে বুকে জড়িয়ে উত্তর দেয়—“ভুল যদি এটাই হয়, তবে আমি বারবার এই ভুল করব।” তাদের মধ্যে জন্ম নেয় এমন এক শক্তি, যা সব বাঁধাকে অস্বীকার করে, কিন্তু একইসঙ্গে তাদের আরও দুর্বল করে তোলে সমাজের কাছে। অপরাধবোধ আর আনন্দের এই দ্বন্দ্বই তাদের সম্পর্ককে নতুন রূপ দেয়—এটা আর শুধু প্রেম নয়, এটা এক অনিবার্য সত্য, যা তাদের টেনে নিয়ে যায় আরও দূরে, আরও গভীরে, এমন এক ভবিষ্যতের দিকে যার রঙ তারা এখনও কল্পনা করতে পারে না।
অধ্যায় ৯: প্রতিজ্ঞা
অপরাধবোধ আর আনন্দের টানাপোড়েনের মাঝেও অরণ্য আর মীরা বুঝতে শুরু করে, সম্পর্ককে আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। বারবার ভয় আর লুকোচুরি তাদের ক্লান্ত করে তোলে, কিন্তু একইসঙ্গে ভালোবাসার আগুন নিভে যায় না। এক রাতে ফোনে কথা বলার সময় মীরা হঠাৎ চুপ হয়ে যায়, তারপর ধীরে বলে—“অরণ্য, আমরা কি এভাবে সারাজীবন লুকিয়ে থাকব? একদিন না একদিন সব ফাঁস হয়ে যাবে।” অরণ্যের বুক কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে দৃঢ় গলায় উত্তর দেয়—“তাহলে আমরা লড়ব, মীরা। যেভাবেই হোক, আমরা একসঙ্গে থাকব।” সেই মুহূর্তে তারা দু’জনেই অনুভব করে, তাদের ভালোবাসাকে আর গোপন খেলার মতো চালানো যাবে না। তাই জন্ম নেয় এক প্রতিজ্ঞা—সব বাধা, সব বাঁধন, সব সমাজের চোখ এড়িয়ে নয়, বরং সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার জন্য লড়াই করবে তারা।
পরদিন লেকপাড়ে দেখা হলে অরণ্য মীরার হাত ধরে বলে—“যা-ই ঘটুক না কেন, আমি তোমাকে ছাড়ব না। পরিবার যদি বাধা দেয়, সমাজ যদি বিরোধিতা করে, তবুও আমি তোমার পাশেই থাকব।” মীরার চোখে তখন জল, কিন্তু সেই জলে ভয় নেই, আছে একরাশ দৃঢ়তা। সে ফিসফিস করে উত্তর দেয়—“আমিও তোমাকে ছাড়ব না, অরণ্য। তুমি আমার পৃথিবী। যদি লড়াই করতে হয়, আমি তোমার সঙ্গেই লড়ব।” সেই প্রতিজ্ঞা যেন তাদের ভেতরে নতুন সাহস জাগায়। তারা জানে সামনে পথ খুব কঠিন, কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস জন্মায়—যত বড় বাধাই আসুক, ভালোবাসা তাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞার মুহূর্তে তারা প্রথমবার উপলব্ধি করে, সম্পর্কটা শুধু আবেগ নয়, এটা দায়িত্বও—একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর শপথ।
সেই প্রতিজ্ঞার পর থেকে তাদের দেখা করার ধরন বদলে যায়। আর শুধু চুরি করা মুহূর্ত নয়, বরং প্রতিটি দেখা যেন ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় ভরা। তারা স্বপ্ন দেখে, একদিন হয়তো সমাজকেও জয় করা সম্ভব হবে। যদিও ভয় রয়ে যায়, তবুও প্রতিজ্ঞা তাদের বুকের ভেতর শক্তির আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মীরা মাঝে মাঝে বলে—“অরণ্য, আমাদের এই লড়াইয়ে হারলেও আমি খুশি হব, যদি তোমার হাতটা আমার হাতে থাকে।” আর অরণ্য উত্তর দেয়—“আমরা হারব না, মীরা। আমরা জিতব, কারণ ভালোবাসা কখনো হারে না।” সেই মুহূর্তগুলোতেই তারা বুঝতে পারে, তাদের সম্পর্ক এখন কেবল প্রেম নয়, এটা এক যাত্রা—যেখানে প্রতিজ্ঞাই তাদের পথের আলো, যা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে অজানা ভবিষ্যতের দিকে।
অধ্যায় ১০: অজানা ভবিষ্যৎ
প্রতিজ্ঞার পরদিনগুলোতে অরণ্য আর মীরার জীবন যেন নতুন অর্থ পায়। তারা আর শুধু ভয়ে ভয়ে সময় কাটায় না, বরং স্বপ্ন আঁকে ভবিষ্যতের। তবুও, সমাজের বাঁধন যে হুট করে উধাও হয়ে যাবে তা তারা জানে। প্রতিদিনের ব্যস্ততার ফাঁকে, পরিবার আর বন্ধুদের অগোচরে তারা গোপনে বসে ভবিষ্যতের ছবি আঁকে—কোথায় একসাথে থাকবে, কেমন জীবন কাটাবে, কিভাবে লড়াই করবে। মীরার চোখে তখন স্বপ্নের ঝিলিক, কিন্তু মাঝে মাঝে সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয় বাস্তবতার ভয়। “অরণ্য, যদি একদিন আমাদের আলাদা করে দেয়?”—সে প্রশ্ন করে কাঁপা গলায়। অরণ্য তার হাত চেপে ধরে বলে—“তাহলে আমরা পালাবোও, যদি প্রয়োজন হয়। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।” সেই কথার ভেতরে দৃঢ়তা থাকলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, পথটা কাঁটার মতো কঠিন হতে চলেছে।
এদিকে চারপাশে চাপ আরও বাড়তে থাকে। মীরার বাড়িতে বিয়ের আলাপ জোরালো হয়ে ওঠে, আর অরণ্যের পরিবারও তার পড়াশোনা আর চাকরির দিকে নজর দিতে বাধ্য করে। এই দুই দিকের চাপ মিলিয়ে তাদের ভালোবাসা যেন ভেসে যায় অজানা স্রোতের দিকে। তবুও, প্রতিটি দেখা, প্রতিটি স্পর্শ তাদের ভেতরে সাহস জাগায়। তারা বুঝতে পারে, ভবিষ্যৎ হয়তো অনিশ্চিত, হয়তো সমাজ তাদের মেনে নেবে না, কিন্তু ভালোবাসা যদি সত্য হয়, তবে কোনো শক্তিই তাদের আলাদা করতে পারবে না। সেই বিশ্বাসই তাদের টিকিয়ে রাখে, যদিও অন্তরে বারবার দোলা দেয় ভয়ের ঢেউ। তারা জানে, সামনে হয়তো বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে—যা পাল্টে দেবে তাদের জীবন।
অজানা ভবিষ্যতের এই দোটানার মাঝেই তাদের গল্প যেন খোলা প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। ভালোবাসা আর সামাজিক বাঁধা—দুটো শক্তি টেনে নেয় ভিন্ন ভিন্ন দিকে। তারা জানে না শেষটা কেমন হবে, কিন্তু এক জিনিসে তারা নিশ্চিত—একে অপরকে ছাড়া তারা অসম্পূর্ণ। তাই সমস্ত ভয়, অপরাধবোধ, আনন্দ আর স্বপ্ন মিলিয়ে তারা পা বাড়ায় অদৃশ্য এক পথে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই ঝুঁকিপূর্ণ, তবুও আবেগ আর প্রতিজ্ঞায় ভরা। অরণ্য আর মীরা বুঝতে পারে, জীবনের আসল সৌন্দর্য হয়তো এই অনিশ্চয়তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে। তাদের ভালোবাসার কাহিনি তাই থেমে যায় না, বরং খোলা আকাশের নিচে নতুন অধ্যায়ের দিকে ছুটে যায়—অজানা, তবুও অদম্য বিশ্বাসে ভরা।
শেষ

1000066250.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *