Bangla - প্রেমের গল্প

ভালোবাসা প্রতিশোধ নয়

Spread the love

ঋত্বিক চৌধুরী


পর্ব ১

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে যখন দেব বেরোলো, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কলকাতার বাতাসে পুরনো ধুলো আর সাম্প্রতিক বৃষ্টি মিশে এক ধরনের অভিমানী গন্ধ ছড়াচ্ছে—যেটা সে খুব ভালো করে চিনত, আবার ভুলেও গিয়েছিল অনেকদিন। ট্যাক্সিতে বসে সে ফোন বের করে একটা ঠিকানা দেখে নিল—বালিগঞ্জ প্লেস। এই শহরে ফিরে আসার পেছনে কারণ একটা নয়, অনেকগুলো। কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রে আছে একজন—অনন্যা সরকার।

দশ বছর আগের সেই ঝড়, যেটা তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিল, সেটা আজও থেমে যায়নি। শুধুমাত্র রূপ পাল্টেছে। সেই বোর্ডিং স্কুল, সেই গেটের সামনে দাঁড়ানো কিশোর বয়সের দেব আজ আর নেই। এখন সে দেবরাজ মুখার্জী, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার, নামী কোম্পানির অ্যাসোসিয়েট পার্টনার, কোটিতে খেলছে টাকা। কিন্তু তার ভিতরটা আজও কেমন একটা অস্থির। এবং সেই অস্থিরতার নাম—অনন্যা।

ট্যাক্সিটা থেমে গেল এক পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে। নামplate-এ লেখা—”Sarkar Residence”. দরজায় কলিং বেল বাজাতেই একজন বৃদ্ধ কাজের লোক দরজা খুলল। চোখে ঘোলা চশমা, মুখে চুপচাপ বিষাদ।

“আমি দেবরাজ মুখার্জী। ম্যাডামকে বলবেন, অরুণাভ রায় পাঠিয়েছেন আমাকে।”

লোকটা মাথা নেড়ে ভিতরে চলে গেল। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সে—অনন্যা।

দেবের শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য।

অনন্যা এখন আরও সুন্দর, আরও কঠিন। তার চোখে সেই আগুন নেই, কিন্তু জমাট একটা হিম। চুল কাঁধ ছুঁই ছুঁই, একটানা গভীর চোখ, আর ঠোঁটে অদ্ভুত একটা সংযমের হাসি। যেন সবকিছু জানে, তবুও কিছুই বলে না।

“তুমি?” অনন্যার গলায় বিস্ময় আর কিছুটা অবিশ্বাস।

“আমি,” দেব শান্তভাবে বলল, “তোমার ইনভেস্টর হিসেবে। তোমার স্টার্টআপে এখন আমার কোম্পানির ৪২% শেয়ার।”

অনন্যার চোখ ঠান্ডা, ঠোঁটে সামান্য বাঁক। “তুমি বদলাওনি। সবকিছু পাওয়ার জন্য এখনো আগের মতোই ছক তৈরি করো?”

“না,” দেব বলল, “এবার ছকের বাইরে খেলতে এসেছি।”

অনন্যা চুপ করে গেল। তারপর সরে দাঁড়াল দরজা থেকে। “এসো। এক কাপ কফি হয়তো অতীত ভুলিয়ে দিতে পারবে না, কিন্তু বাস্তবটা ঝাপসা করে দিতে পারে।”

বসার ঘরে ঢুকে দেব তাকাল দেয়ালে টাঙানো পুরনো ছবিগুলোর দিকে। সাদা-কালো কিছু পারিবারিক মুহূর্ত। মাঝখানে একটা ছবি—দু’জন স্কুল ইউনিফর্মে, হেসে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। একটা ছিল অনন্যা, আর আরেকজন… সে নিজে।

“তুমি রেখেছিলে ওটা?” দেব মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল।

“সবকিছু ফেলা যায় না,” অনন্যা বলল, “কিছু কিছু জিনিস রাখা হয় মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য—কে কী করেছে, কেন করেছে।”

দেব কফির কাপ হাতে নিয়ে বসলো। “তবে শুরু হোক?”

“তুমি জানো না, তুমি কী শুরু করতে যাচ্ছো,” অনন্যা চোখ সরিয়ে বলল।

“জানি,” দেব হাসল, “একটা যুদ্ধ। কিন্তু এবার আমি হেরে আসিনি।”

ঘরের মধ্যে হঠাৎ একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা আবার শুরু হয়েছে—ছাদে, গাছের পাতায়, দরজার ধাতব হ্যান্ডলে।

দেব তাকিয়ে রইল অনন্যার দিকে। এই বাড়িটা, এই শহরটা, এই চেনা গন্ধ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত বিষণ্ন আনন্দ। কিন্তু সে জানে, এগুলো তার ফিরে আসার আসল উদ্দেশ্য নয়।

তার আসল যুদ্ধটা এখনো শুরু হয়নি।

আজ সে এসেছে কেবল তার আগমন জানাতে।

আর কাল থেকে শুরু হবে প্রতিশোধ।

অতীতের ভুলের প্রতিশোধ?

না—অথবা হ্যাঁ।

একটা উত্তর অনন্যার কাছ থেকে পাওয়ার ছিল—সে কী ইচ্ছে করে তাকে ফাঁসিয়েছিল?

না কি সেটাও ছিল তার নিজের কোনো বাঁচার চেষ্টা?

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দেব উঠে দাঁড়াল।

“কাল দেখা হবে, অফিসে,” সে বলল, “নতুন বোর্ড মিটিংয়ে আমার প্রথম দিন।”

“অবশ্যই,” অনন্যা বলল। “নতুন অংশীদারকে তো বরন করে নিতে হয়।”

দেব চলে গেল।

পিছনে অনন্যা দাঁড়িয়ে রইল—চোখে একধরনের অস্থির প্রতিচ্ছবি।

কারণ সেই অনন্যাও জানে—এই খেলা আর সহজ থাকছে না।

এবার হৃদয় দিয়ে খেলতে হবে।

যে খেলা শেষ হয় না কেবল জয়-পরাজয়ে।

পর্ব ২

বৃষ্টিটা থামেনি। কলকাতার আকাশ যেন আজ ইচ্ছা করে ভিজিয়ে দিচ্ছে শহরটাকে। দেবরাজ মুখার্জী লালবাজারগামী গাড়িতে বসে থাকলেও তার মন আটকে আছে অন্যদিকে—অনন্যার চোখে। সেই চোখ, যেগুলো একসময় তাকে পড়ে ফেলত, এখন শুধু আটকে রাখে। ঠান্ডা, অচেনা, ধোঁয়াটে।

আসলে অনন্যা সরকারকে সে কখনো ঠিক চিনতেই পারেনি। শুধু ভেবেছিল, জানে। অথচ দশ বছর আগে যেটা সে হারিয়ে এসেছিল, তা শুধু একটা প্রেম নয়, একটা পরিচয়ও ছিল। বোর্ডিং স্কুলের সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় যে অভিযুক্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে শুধু দেব নয়, এক অপমানিত ছেলেমানুষ হয়ে বেঁচে থাকা নাম।

“তুমি জানো না, তুমি কী শুরু করতে যাচ্ছো”—অনন্যার সেই কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বাজছে।
দেব জানে, এবার আর পিছু হটার জায়গা নেই।

সকালে অফিসে ঢুকেই বদলে গেল দেব। কর্পোরেট সভ্যতায় তার মুখ একটা মুখোশ। সুইডিশ কফি, কাচের জানালার ওপাশে নেমে আসা ছায়া, এবং স্যুটে মোড়া বুদ্ধিমান বাক্য—এই জগতটা তার পরিচিত।

“Welcome, Mr. Mukherjee,”—বলল সিক্রেটারি, একজন দক্ষ, পাতলা কণ্ঠের মেয়েটি, যার চোখে প্রশিক্ষিত হাসি।

“Board room?” দেব শুধালো।

“Second floor, right wing. Ms. Sarkar is already inside.”

অবশ্যই। অনন্যা আগে থেকেই থাকবে, নিজের ক্ষমতার পরিসরটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। দেব চুপচাপ লিফটে চড়ে ওঠে।

বোর্ডরুমের কাঁচের দরজা খুলতেই অনন্যা তাকাল তার দিকে। সাদা শার্ট, হালকা মেকআপ, একজোড়া সোনালী দুল—শান্ত অথচ দৃঢ়। তাকে ঘিরে ছয়জন পুরুষ ও একজন বৃদ্ধ মহিলা সদস্য।

“Ah, Mr. Mukherjee,” অনন্যা বলে উঠল, “Just in time. Shall we begin?”

দেব মৃদু হাসল, বসে পড়ল।

মিটিং শুরু হতেই বোঝা গেল, দেব যে শুধু নতুন অংশীদার নন, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীও। একের পর এক প্রস্তাব, নতুন পলিসি, বাজেট কাটছাঁট, CSR রূপান্তর—সবকিছুর মাঝে দেব এমনভাবে কথা বলল, যেন সে এই কোম্পানির রক্তনালীতে আগেই ছিল।

অনন্যা শুধু শুনল, মাঝেমধ্যে মাথা নাড়ল, কখনো বিরোধিতা করল না—তবে তার চোখ, যেন প্রতিটি শব্দ ছুরি দিয়ে কেটে নিচ্ছে।

মিটিং শেষে সবাই একে একে বেরিয়ে গেল। শুধু দেব আর অনন্যা বসে রইল।

“Impressive,” অনন্যা বলল। “তুমি তো পুরো কোম্পানিটার সেন্টার শিফট করে দিলে এক ঘণ্টায়।”

“আমি এসেছি এই কাজেই,” দেব বলল, “এবং তুমি জানো, আমি থামি না।”

“তবে খেয়াল রেখো,” অনন্যা ধীরে বলে উঠল, “খেলোয়াড় বদলালে খেলার নিয়মও বদলে যায়।”

দেব চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “নিয়ম আমি লিখতে শিখেছি, অনন্যা। এবার তোমার পড়ার পালা।”

সেদিন বিকেলে অনন্যা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়ির পাশের ছাদে দুটো পায়রা বসে ছিল পাশাপাশি, ভিজে পালক গুছিয়ে নিচ্ছিল। তার মনের মধ্যে বহুদিনের জমে থাকা একটা ঝড় ধীরে ধীরে মাথা তুলছিল।

দেবরাজ ফিরে এসেছে।

সে শুধু ফিরে আসেনি, সে প্রতিশোধ নিয়ে এসেছে। কিন্তু অনন্যা জানে না—সে সত্যিই প্রতিশোধ নিতে এসেছে, না নিজেকে প্রমাণ করতে। কিংবা সে বুঝতেও পারছে না—দেব কি এখনো তাকে ভালোবাসে?

কিন্তু ভালোবাসা? এই শব্দটার মানে তো বহু আগেই পাল্টে গেছে।

রাত দশটা নাগাদ অনন্যা একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন পেল।

“হ্যালো?”

“আসতে পারো?”—দেবের কণ্ঠস্বর।

“কোথায়?”

“প্রিন্সেপ ঘাট। নদীর ধারে।”

“এখন?”

“এখনই। তোমার সাথে কিছু কথা আছে, যা বোর্ডরুমের আলোয় বলা যায় না।”

অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমি আসছি।”

প্রিন্সেপ ঘাটের বাতাসে হালকা শীত পড়েছে। দেব পেছন ফিরে তাকাল—অনন্যা আসছে। একটানা হেঁটে এল তার পাশে।

“বলো,” সে বলল।

দেব নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে?”

অনন্যা চমকে তাকাল। “এই প্রশ্ন এখন?”

“হ্যাঁ। এখন। কারণ যা ভুল ছিল, তা নিয়ে চলতে চাই না আর। জানতে চাই—তুমি সত্যিই ফাঁসিয়েছিলে আমাকে? সেই চুরি যা আমি করিনি, সেই অপমান… সেই নিষ্কাশন…”

অনন্যা চোখ বন্ধ করল।

“তোমার দোষ ছিল না,” সে ধীরে বলল। “তবু আমি চুপ ছিলাম। কারণ আমার সামনে দুটো পথ ছিল—তোমাকে বাঁচানো, বা আমার বাবার সম্মান। আমি বেছে নিয়েছিলাম দ্বিতীয়টা।”

দেব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

“তুমি আমার বিরুদ্ধে ছিলে না,” সে বলল, “তুমি কেবল আমার পাশে দাঁড়াওনি।”

“হ্যাঁ,” অনন্যা স্বীকার করল, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, দেব। আমি একা ছিলাম। এবং তুমি তো জানো না, সেই ঘটনার পরে আমাকেও বোর্ডিং থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি তোকে খুঁজেছিলাম…”

“তখন খুঁজে পেলে না,” দেব বলল, “এখন আমিই এসে পড়েছি। ফিরে এসেছি, অতীতের ধোঁয়াটে গন্ধ নিয়ে। কিন্তু এবার আমি সরব। আর তুমি?”

অনন্যা তাকিয়ে রইল তার চোখে।

“আমিও,” সে বলল, “এবার আমি চুপ থাকব না।”

পর্ব ৩

প্রিন্সেপ ঘাটের বাতাসে সেই রাতে কী হয়েছিল, হয়তো কেউ জানবে না। শব্দের চেয়ে বেশি বলা হয়েছিল নীরবতায়। নদীর জলের মতোই সবকিছু বয়ে গিয়েছিল, ধীরে অথচ গভীরভাবে।

দেব আর অনন্যা পাশাপাশি বসেছিল একটা সাদা পাথরের বেঞ্চে। দূরে হুগলি ব্রিজের আলো জল ছুঁয়ে কাঁপছিল, আর সেই আলোয় তাদের মুখদুটি যেন একে অপরকে পুরনো দিনের ছায়ার মতো দেখছিল—পরিচিত অথচ অপরিচিত, কাছের অথচ দূরের।

“তুমি জানো,” অনন্যা বলল, “তোমার বিরুদ্ধে সেদিন কেউ দাঁড়ায়নি, শুধু আমি না। এমনকি যারা জানত তুমি নির্দোষ, তারাও চুপ ছিল। স্কুলের হাউস মাস্টার, আমাদের ক্লাসমেটরা… সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আমি যদি চাইলেই পারতাম না?”

“পারতে,” দেব বলল। “তুমি পারতে। কিন্তু তুমি করো নি।”

অনন্যা চুপ করে গেল। সেই নীরবতা আসলে একটা দুঃখভরা স্বীকারোক্তি।

দেব বলল, “তোমার বাবার কোম্পানি আজকের ‘Sarkar Ventures’ হয়নি যদি আমি সেই বোর্ডিং স্কুল থেকে বের না হতাম। আমি জানি, অনন্যা। আমি জানি যে তুমি ‘চুপ’ থাকার জন্য ছাড়পত্র পেয়েছিলে। সেই শান্ত চুপ থাকা তোমার বাবার ব্যবসার সিঁড়ি হয়ে উঠেছিল।”

অনন্যা এবার জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তুমি ঠিক। আমি চুপ ছিলাম কারণ আমার বাবার তখন ব্যাংক্রাপ্সি নোটিশ এসেছিল। সেই চুরির কেস থেকে তোমার নাম সরলে তাদের নাম আসত। আমি শুধু তোমাকে নয়, নিজেকেও হারিয়েছিলাম সেদিন।”

দেব উঠে দাঁড়াল। নদীর জলে তাকিয়ে থাকল।

“তাহলে আমার ফিরে আসার মানে বুঝছ তো? আমি শুধু আমার সম্মান ফেরত চাই না। আমি চাই তুমি আমাকে মুখোমুখি হও। প্রতিটা সিদ্ধান্তের, প্রতিটা নীরবতার।”

অনন্যা আস্তে বলল, “তাহলে শুরু করো। এই শহরে অনেক হিসেব জমে আছে।”

পরের দিন অফিসে সব কিছুই ছিল স্বাভাবিক, অন্তত বাইরের দিক থেকে। দেব কাজ করছিল, আর অনন্যা তার কেবিনে একের পর এক মিটিং সারছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেউ কিছু বলেনি, তবু তাদের সহকর্মীরা টের পেয়েছিল—বাতাসে নতুন কিছু ভাসছে।

দেব এবার অঙ্কের খেলা শুরু করল। কোম্পানির কিছু প্রজেক্টে তীক্ষ্ণ পরিবর্তন আনল। CSR ফান্ডিং কেটে দিল সেই NGO-র যেটা অনন্যার মা চালান। এই একটিমাত্র পদক্ষেপেই যেন সে বুঝিয়ে দিল—সে প্রতিশোধ শুরু করেছে।

অনন্যা সেটা জানত। সে প্রতিক্রিয়া দিল না। কিন্তু তার চোখের নিচে ক্লান্তির রেখা আরও স্পষ্ট হল।

সন্ধ্যায় দেব যখন কফি মেশিনে দাঁড়িয়ে ছিল, অনন্যা পাশে এসে দাঁড়াল।

“তুমি আমার মা’র এনজিও বন্ধ করতে চাও?”

“না,” দেব ঠান্ডা গলায় বলল। “আমি শুধু চাই দেখাতে—ক্ষমতা কার হাতে। তুমি যখন চুপ ছিলে, তখনও তুমিই নিয়ন্ত্রণে ছিলে। এখন আমার পালা।”

অনন্যা মৃদু হাসল। “তুমি বুঝতে পারছো না, প্রতিশোধ কখনও সম্পূর্ণ হয় না। তুমি যতই চাও, আমি সেই মেয়েটা নই আর। যে তোমাকে ফাঁকি দিয়েছিল।”

“আর আমি?” দেব চাইলেঞ্জ করল। “তুমি জানো না, আমি কে হয়ে উঠেছি। আমি তোমার জীবনটা কেমন করে সাজিয়েছিলাম, আর কেমন করে ভাঙতে পারি।”

এক মুহূর্ত নীরবতা।

তারপর অনন্যা বলল, “তুমি কি এখনও আমাকে ভালোবাসো?”

প্রশ্নটা ছুরি হয়ে কাটল।

দেব স্থির দাঁড়িয়ে রইল। কফি মেশিনের বাষ্প উঠছিল পাশে।

“ভালোবাসি না,” সে বলল। “কিন্তু তোমার চোখ আজও আমাকে ডোবাতে পারে।”

সেদিন রাতে অনন্যা বাড়ি ফিরে জানলার ধারে দাঁড়াল। শহরের আলো-আঁধারির মাঝে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল—দেব তাকে শুধু দোষী ভাবছে না, তাকে নিজের মতো করে চেনার চেষ্টা করছে। আর সেই চেষ্টার মধ্যে এমন কিছু আছে যা কখনও কফির মেশিন, CSR, কিংবা পুরনো স্কুলের ফটোতে ধরা পড়ে না।

সে জানে, দেব তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসা এখন অভিমানে, রাগে আর ক্ষমতার খেলায় ভরে গেছে।

আর সে নিজেও জানে—সেই বোর্ডিং স্কুলের সেই অনন্যা সে নিজেও আর নয়। জীবনের পথ তাকে গড়ে তুলেছে কঠিন, নীরব, এবং অনেকটা একা।

পরদিন হঠাৎ অফিসে এল এক চিঠি—“Annual Boarder’s Reunion”—সেই স্কুলের বার্ষিক পুনর্মিলনী। একই দিনে কলকাতার একটি হোটেলে বসবে সেই অনুষ্ঠানের আসর। এবং এক অদ্ভুতভাবে, অনন্যা আর দেব—দুজনেই আমন্ত্রিত।

দেব চিঠি হাতে নিয়ে হাসল।

“পুনর্মিলনী,” সে ফিসফিস করে বলল, “পুরনো ভুল গুলো সোজা করে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত দিন।”

পর্ব ৪

কলকাতার রাস্তা তখন সন্ধ্যার আলোয় মোড়ানো। দক্ষিণ কলকাতার একটা পাঁচতারা হোটেলের সামনে গাড়ি থেমে দাঁড়াতেই, নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। দেবরাজ মুখার্জী ধীরে নেমে এল গাড়ি থেকে, গাড়ির দরজায় ভেসে উঠল তার ছায়া—কালো ব্লেজার, সাদা শার্ট, চোখে স্পষ্ট উদ্দেশ্যের রেখা। আজ রাতটা কেবল পুরনো স্কুলের পুনর্মিলনী নয়, এটা তার পরিকল্পনারও অংশ।

হোটেলের গেট পেরোতে গিয়ে এক মুহূর্ত থেমে গেল সে। মনে পড়ল সেই লাল ইঁটের বোর্ডিং স্কুলের গেট। ঠিক এইরকমই সন্ধ্যায়, দশ বছর আগে, তাকে পেছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। সেদিন তাকে কেউ থামায়নি।

আজও কেউ থামাবে না। কিন্তু আজ সে পেছনে তাকিয়ে ফিরবে—পিছনের মানুষের চোখে চোখ রেখে।

ভিতরে ঢুকতেই শব্দ, আলো আর পরিচিত মুখের ঢেউ এসে ধাক্কা দিল। একেকটা মুখ তার ছেলেবেলার অংশ। কেউ চুপচাপ পাশ কাটিয়ে গেল, কেউ তাকিয়ে হাসল—সেই জড়তা নিয়ে, যা থাকে অপরাধবোধ আর অস্বস্তির মাঝখানে।

“দেব?”
চেনা কণ্ঠ।

সে ঘুরে তাকাল।

অভিষেক। সেই পুরনো হোস্টেল রুমমেট। এখন কর্পোরেট দুনিয়ার লোক, কিন্তু চোখে এখনও সেই আগের দুষ্টু জ্বলজ্বল ভাব।

“তুই তো ভাবতেই পারিনি আসবি,” অভিষেক এগিয়ে এসে বলল। “এত বছর পর?”

“আসতেই হত,” দেব শান্তভাবে বলল। “কিছু অসমাপ্ত জবাব পেতে হয় মুখোমুখি হয়ে।”

অভিষেক চুপ করে গেল। তারপর চোখ নামিয়ে বলল, “তুই তো জানিস, আমরা সবাই জানতাম তুই দোষী না। কিন্তু তখন… সাহস ছিল না কিছু বলার।”

“জানি,” দেব মাথা নাড়ল। “তোমাদের সাহস না থাকাটা আমার সব হারানোর কারণ হয়েছিল।”

হঠাৎই চারপাশে ফিসফিস শুরু হল।

অনন্যা এসে গেছে।

সে ঢুকেছে হলঘরে—নীল সিল্কের শাড়িতে, চুল খোলা, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে সেই একই স্থিরতা। যেন কোনোকিছু তাকে নাড়া দেয় না। কিন্তু দেব জানে—তাকে এই ঘরে ঢুকতে হলে কতোটা শক্ত হতে হয়েছে অনন্যাকে।

দেব ধীরে এগিয়ে গেল।

“সুন্দর লাগছে,” সে বলল।

“ধন্যবাদ,” অনন্যা বলল, চোখে চোখ রাখল। “তুমি প্রস্তুত?”

“কোনটার জন্য?”

“যে সত্যি এতদিন ছায়ার মতো পেছনে ছিল। আজ হয়তো আলোয় বেরিয়ে আসবে।”

দেব কিছু বলল না। কিন্তু তার ভিতরে যেন একটা বেল বাজল।

সত্যি?

এই এতদিনের রহস্যের পর্দা কি সত্যিই আজ সরবে?

কিছুক্ষণ পর শুরু হল মঞ্চে ‘Remembrance Speech’। প্রাক্তন হেডবয়, প্রিন্সিপাল, কয়েকজন সফল প্রাক্তনী বক্তব্য রাখল। অনন্যা ডায়াসে উঠল একসময়, সংক্ষেপে বলল স্কুলের প্রতি কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব, স্মৃতি আর শেখার কথা।

তারপর মাইক্রোফোনে ডাক পড়ল—”Mr. Devraj Mukherjee, would you like to say a few words?”

এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা।

সবাই জানে সে কে। এবং সবাই জানে, সে কেন এতদিন পর এসছে।

দেব উঠে দাঁড়াল।

ডায়াসে উঠে মাইক্রোফোনটা সামলে নিল। ভিড়ের ভেতর চোখ রাখল অনন্যার ওপর। তারপর বলল,

“আমি স্কুলে ফিরে এসেছি, কারণ এই স্কুল আমায় গড়ে তুলেছিল। আবার ভেঙেও দিয়েছিল। এখানে আমি প্রথম বন্ধুত্ব পেয়েছিলাম, প্রথম বিশ্বাসঘাতকতাও।”

কিছু লোক অস্বস্তিতে চুপ করে গেল।

“দশ বছর আগে, একটা ঘটনায় আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আমি কিছু চুরি করিনি, তবু আমার নামে সেই দাগ লেগেছিল। আমি চুপ ছিলাম। সবাই চুপ ছিল।”

ভিড় নিস্তব্ধ।

“আজ আমি ফিরে এসেছি, কারণ চুপ থাকাটা আমার অস্তিত্বকে বদলে দিয়েছিল। আমি ফিরে এসেছি সেই শৈশবের চুপ থাকা ভাঙতে।”

হঠাৎ করেই অনন্যা উঠে দাঁড়াল।

সবাই তাকাল তার দিকে।

“আমি বলব কিছু,” সে বলল।

সে ডায়াসে উঠল।

“হ্যাঁ,” অনন্যা বলল, “আমি চুপ ছিলাম। এবং আমি জানি, আমি ভুল করেছিলাম। দেব নির্দোষ ছিল। আমি জানতাম। কিন্তু আমার পরিবারের স্বার্থ আমাকে চুপ করিয়েছিল।”

দেব নিচে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল।

“তবে আজ,” অনন্যার কণ্ঠ দৃঢ়, “আমি সেই দায় স্বীকার করছি। আমি দেবের কাছ থেকে শুধু ক্ষমা চাইছি না, আমি চাই সবাই জানুক—সে যা ছিল, তা নির্দোষ, সম্মানিত, এবং সাহসী।”

ঘরে নিঃশব্দে টিপ টিপ হাততালি শুরু হল। ধীরে ধীরে সেটাই বড় ঢেউ হয়ে উঠল।

দেব কিছু বলল না। কেবল মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে, একবার চোখ বন্ধ করল।

এই তো সে চেয়েছিল।

সত্যি।

একবার অন্তত কেউ বলুক—সে দোষী ছিল না।

পুনর্মিলনী শেষে সবাই যখন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে, অনন্যা এসে দাঁড়াল দেবের পাশে।

“এইটা কি শেষ?” সে জিজ্ঞেস করল।

“না,” দেব বলল, “এটা শুধু একটুখানি আলো। আমার ভিতরের অন্ধকারটা এখনও ভরাট হয়নি।”

“আমি থাকলে কি হবে?”

দেব তাকাল। তার চোখে আজ হিংসা নেই। রাগ নেই।

শুধু ক্লান্তি আর অবশিষ্ট একরাশ অনুভব।

“তুমি থাকলে,” সে বলল, “হয়তো আমি আবার বিশ্বাস করতে শিখবো।”

পর্ব ৫

রাত তখন অনেক। হোটেল থেকে ফিরে এসে অনন্যা আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু ঘুম তার চোখ ছুঁয়েও যায়নি। ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই মনে হচ্ছিল, যেন জীবনটা হঠাৎ করে এক নতুন মোড় নিয়েছে। সেই মোড়ে দেবরাজ মুখার্জী আবার ফিরে এসেছে—কেবল নামে নয়, মনেও।

সে আজ নিজের দায় স্বীকার করেছে। সবার সামনে, নিজের মুখে, স্পষ্টভাবে বলেছে—“আমি চুপ ছিলাম, আমি ভুল করেছিলাম।” সেই অনন্যা, যে একসময় সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেত, আজ এতটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ভাবতেই তার নিজের ভিতরে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে।

কিন্তু এত বছর পর কেন এতটা বলার সাহস এল? কারণ সে জানে, দেব এখন আর সেই কিশোর ছেলেটা নয়—যে কেবল ভেঙে পড়ত। সে এখন দাঁড়িয়ে থাকে, হিসেব কষে, রক্ষা নয়, জবাব খোঁজে। আর অনন্যা এবার বুঝে গিয়েছে—এই সম্পর্কটা কেবল অতীত নয়, এটা এখনও বর্তমানের দাবিদার।

অন্যদিকে, দেব সেই রাতে নিজের ফ্ল্যাটে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। বৃষ্টি আবার পড়ছিল হালকা করে। পুরনো বোর্ডিং স্কুলের ঘটনাটা যেমন করে তার জীবনকে রুখে দিয়েছিল, আজ যেন সেভাবেই তাকে ছুঁয়ে গেছে অনন্যার স্বীকারোক্তি।

সে জানে, স্বীকার করে নিলে দুঃখ কমে না, বরং দায় বেড়ে যায়। কিন্তু অনন্যার কণ্ঠে আজ সেই সত্যি শুনে, তার ভিতরের এক জমে থাকা রাগ ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছে। সেই গলনের মধ্যে কোথাও যেন একটা আলোর রেখা।

সে জানে, প্রতিশোধ দিয়ে সব কিছু মেটানো যায় না।

কখনো কখনো এক ফোঁটা দুঃখ—আর একটা ‘আমি দুঃখিত’—সবচেয়ে বড় জবাব।

কিন্তু দেব এখনও দ্বিধায়। সে কি সত্যিই পারবে আবার বিশ্বাস করতে? আবার সেই পুরনো চোখে ফিরে তাকাতে?

পরদিন অফিসে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সবাই মিটিং নিয়ে ব্যস্ত, প্রেজেন্টেশন চলছে, প্রজেক্ট আপডেট আসছে ইনবক্সে। কিন্তু অনন্যা আর দেব—তারা যেন একই ঘরে থেকেও দূরে।

লাঞ্চের সময় হঠাৎ দেব এগিয়ে এল অনন্যার কেবিনে।

“লাঞ্চ করেছ?” সে জিজ্ঞেস করল।

“না,” অনন্যা বলল, “ব্যস্ত ছিলাম।”

দেব বলল, “চলো, বেরিয়ে একটু খেয়ে নিই। অফিস ক্যান্টিনে নয়। বাইরে। একটু হাওয়া দরকার আমাদের দুজনেরই।”

অনন্যা থমকাল। এক মুহূর্ত ভাবল।

তারপর মাথা নাড়ল। “চলো।”

তারা গিয়েছিল রাসবিহারী মোড়ের এক ছোট রেস্তোরাঁয়—চুপচাপ, ছিমছাম, পুরনো দিনের গান বাজছে। এক কোণার টেবিলে বসে তারা চা আর মুড়ি ঘুগনি অর্ডার করল। বড় কিছু নয়—কিন্তু অনেক কিছু।

দেব তাকাল অনন্যার দিকে। “তুমি জানো? আমি এই শহর ছেড়ে গেছিলাম ভাঙা হয়ে। কিন্তু আমি ফিরেছি গড়ে ওঠা মানুষ হয়ে। তবুও আজ মনে হচ্ছে, সব অর্জন মিলিয়ে এই চা’টা অনেক বেশি সত্যি।”

অনন্যা হাসল। “তোমার সঙ্গে কথা বলা মানেই যেন কোনো পুরনো চিঠি পড়া। যেটা বন্ধ ছিল, এখন খুলে ফেলা হচ্ছে।”

“তুমি কি আমাকে আবার চিনতে চাইছ, অনন্যা?” দেব প্রশ্ন করল।

“চিনে নিতে চাই,” সে বলল। “পুরনো ভুল থেকে নতুন ঠিক তৈরি করতে চাই।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা।

তারপর দেব আস্তে বলল, “তাহলে শুরু হোক। কোনো প্রতিশোধ নয়, কোনো বোঝা নয়। কেবল কথা, কেবল আমরা।”

অনন্যা তার দিকে তাকিয়ে রইল।

তার চোখে এবার কুয়াশা নেই।

পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তাদের সম্পর্কের ছায়া ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল। অফিসের করিডোরে ছোট ছোট কথোপকথন, মিটিং শেষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেজেন্টেশন শেষে চোখের সংযোগ—সবকিছুতেই যেন জমে উঠছিল নতুন এক গল্প। প্রতিশোধের শীতলতা সরে গিয়ে তার জায়গায় আসছিল উষ্ণতা।

একদিন বিকেলে, অফিস শেষে, দেব হঠাৎ অনন্যাকে জিজ্ঞেস করল, “আজ একটু হাঁটবে? ভিক্টোরিয়া যাব?”

অনন্যা কিছু না বলেই হেসে সম্মতি জানাল।

সন্ধ্যের আলোয় তারা পাশাপাশি হাঁটল ভিক্টোরিয়ার পথ ধরে। ফোয়ারা, পাখি, জলভরা গাছ, আর ইতিহাসের গায়ে লেগে থাকা অস্থিরতা। সব মিলিয়ে একটা শান্তি।

দেব বলল, “তুমি কি জানো? এখনও অনেক সময় রাতের বেলা আমি ঘুমাতে পারি না। তখন বোর্ডিং স্কুলের সেই দিনটা ফিরে আসে। সেই কনফারেন্স রুম, সেই হেডমাস্টারের চোখ, তোমার না বলা মুখ। কিন্তু আজকাল একটা জিনিস বদলেছে।”

“কি?” অনন্যা জিজ্ঞেস করল।

“তোমার মুখটা এখন রাগে নয়, শান্তিতে আসে মনে। আর সেই মুখেই আমি আবার আশ্রয় খুঁজি।”

অনন্যা এবার তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

“আমিও চাই, আমরা আবার শুরু করি,” সে বলল। “নতুনভাবে। কেবল আমি আর তুমি। অতীত নয়, প্রতিশোধ নয়, কেবল সত্যি।”

দেব হাত ধরল।

দুই জোড়া হাত—যারা একসময় ছুটে গিয়েছিল বিপরীত দিকে—আজ আবার এক হয়ে গেল।

এভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের দ্বিতীয় অধ্যায়।

পর্ব ৬

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রাঙ্গণে। দেব আর অনন্যা একসাথে হেঁটে চলেছে, দুজনের মধ্যে এক ধরনের নীরব শান্তি। হাতে হাত, অথচ মনে এত কথা—যা এক দশক অপেক্ষা করে ছিল উচ্চারিত হওয়ার।

দেব বলল, “আমরা যখন স্কুলে ছিলাম, তখন জানতাম না যে জীবনে বিশ্বাসটাই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা।”

অনন্যা আস্তে বলল, “বিশ্বাস ভাঙলে শব্দ হয় না, দেব। কেবল একটা শূন্যতা জন্মায়। একটা নীরব শূন্যতা, যেখানে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতে হয়—আমি কি ভুল করেছিলাম?”

দেব থামল। “আমিও সেই শূন্যতার মধ্যে কতো রাত কেটেছি। নিজের ওপর সন্দেহ করতে করতে একটা সময় বিশ্বাস করেই ফেলেছিলাম, হয়তো সত্যিই আমি ভুল ছিলাম।”

অনন্যা এবার সামনে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো, সেদিনের পর আমার বাবাও আর আগের মতো ছিল না। তিনি বলেছিলেন—‘তুমি যা করেছো, তা পরিবারের সুরক্ষার জন্য।’ কিন্তু আমি জানতাম, আমি একজন ভালো বন্ধুকে, একজন ভালোবাসার মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি।”

দেব একটু এগিয়ে গেল। “তবে আজ, তুমি যা করেছো… সেটা অনেক সাহসের।”

“তুমি যা দিয়েছো, ক্ষমা—তাও।”

তারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল প্রাঙ্গণ থেকে। বাইরের রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলছে, মানুষের ভিড়, হর্ণ, আলো—কলকাতা তার চেনা ছন্দে।

কিন্তু দেব আর অনন্যার ভেতরের ছন্দ বদলে গেছে।

পরদিন অফিসে নতুন চুক্তির আলোচনা ছিল। দেব আর অনন্যা পাশাপাশি বসে ছিল কনফারেন্স রুমে। বিনিয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা এসেছে, বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হতে চলেছে।

প্রেজেন্টেশন চলাকালীন দেব অনন্যার দিকে একবার তাকাল—তার চোখে ছিল আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটে মৃদু হাসি। অনন্যা ফিরতি হাসি দিল।

মিটিং শেষে বিনিয়োগকারী একজন বলল, “আপনাদের বোঝাপড়া দেখে মনে হচ্ছে আপনারা কেবল পেশাগতভাবে না, ব্যক্তিগতভাবেও খুব সুরে রয়েছেন।”

দেব মুচকি হেসে বলল, “আমরা একে অপরকে খুব ভালোভাবে চিনি। এবং সবচেয়ে বড় কথা—আমরা জানি, আমরা কী ভুল করেছি, আর কী শেখা উচিত।”

সবার হাসির মধ্যে অনন্যার চোখে পানি এসে গেল। কেউ দেখেনি—কেবল দেব ছাড়া।

সেই রাতেই অনন্যা ফোন করল দেবকে।

“তুমি ব্যস্ত?”

“তুমি বললে, আমি ফাঁকা।”

“একটু দেখা যাবে?”

“এইমাত্র বারান্দায় দাঁড়ালাম। এসো।”

কিছুক্ষণের মধ্যে অনন্যা পৌঁছে গেল। দেবের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে শহরের আলো দেখা যায়। টেবিলে দুই কাপ চা, আর একটা প্লেট মোড়ানো চপ।

“তুমি জানো?” অনন্যা বলল, “এত বছর পর আমি প্রথমবার নিজেকে হালকা লাগছে।”

দেব চুপ করে ছিল। তারপর বলল, “তুমি কি এখন ভালোবাসতে পারো?”

অনন্যা তাকিয়ে রইল।

“ভালোবাসা আবার শুরু হয়?” সে জিজ্ঞেস করল।

“হয়,” দেব বলল। “যখন তুমি বুঝো, ওই মানুষটাই—যে তোমায় একসময় ভেঙেছিল, সেও তোমার সবচেয়ে সঠিক আশ্রয়।”

অনন্যা বলল, “তুমি কি সেই আশ্রয় দিতে পারবে?”

দেব আস্তে তার হাত ধরল।

“তুমি যদি চাও… তবে আমি সারা জীবন তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব।”

চুপচাপ চোখে চোখ।

তারপর অনন্যা দেবের কাঁধে মাথা রাখল।

সেই মাথা একসময় সরে গিয়েছিল, ভুলের ভারে।

আজ ফিরে এসেছে, সত্যির শক্তিতে।

দিন কেটে যায়। অফিস, কাজ, ক্লায়েন্ট মিটিং—সব চলছে স্বাভাবিক ছন্দে। তবে এই ছন্দের ভিতরেই একটা নতুন কম্পন। দেব আর অনন্যা এখন সহযোদ্ধা—কেবল কাজের নয়, জীবনেরও।

একদিন সন্ধ্যাবেলা, অনন্যা বলল, “তুমি তো জানো না, আমি এখনো সেই স্কুলের একটা পুরনো ডায়েরি রেখে দিয়েছি।”

“যেটা তুমি প্রতিদিন লিখতে?” দেব চোখ বড় করল।

“হ্যাঁ,” অনন্যা বলল, “আজও মাঝে মাঝে পাতা খুলে দেখি। সেইসব দিন, সেইসব কথা…”

“আমার নাম আছে তাতে?” দেব হেসে জিজ্ঞেস করল।

“প্রায় প্রতি পাতায়,” অনন্যা বলল।

“আমাকে একদিন পড়াবে?”

“তুমি শুনতে পারবে?”

“তুমি বললে, আমি সব শুনব। এমনকি যদি তাতে আমার জন্য অভিশাপও থাকে।”

অনন্যা হাত ধরল।

“তবে শুনবে, আমি কীভাবে তোমাকে হারিয়েছিলাম… আর কীভাবে আজও ফিরে পেয়েছি।”

দেব বলল, “আর আমি শুনব, তুমি কীভাবে আমার হৃদয়ে থাকলে—যখন আমার হাত খালি ছিল।”

তাদের গল্প আবার শুরু হয়েছে।

তবে এবার অতীত ছাড়িয়ে, ভবিষ্যতের দিকে।

তবে কি এই গল্পের শেষে আছে স্থায়ী কিছু?

তা বলা এখনই সম্ভব নয়।

কিন্তু এই মুহূর্তে তারা জানে—তারা পাশে আছে।

যা হারিয়েছিল, তা আরেকবার গড়ে তুলছে।

একটা সম্পর্ক, একটা বিশ্বাস, আর একটা গল্প—

যা কখনো ভোলা যায় না।

পর্ব ৭

কলকাতার বসন্ত হালকা গরম আর হালকা রঙে ভরে উঠছে। রাস্তার ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটেছে, বাতাসে নতুন প্রেমের মতো অদ্ভুত উত্তাপ। দেব আর অনন্যার সম্পর্কও যেন তেমনই—অতীতের শীত থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন ঋতুর দিকে এগিয়ে চলেছে।

তবে বসন্ত সবসময় সহজ নয়। বিশেষ করে তখন, যখন তার সঙ্গে আসে বাস্তবের কিছু নতুন প্রশ্ন।

সেদিন অফিসে দুপুরের দিকে দেব নিজের কেবিনে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা ফোন এল।

“হ্যালো, দেব।”

ওপাশে কণ্ঠটা ছিল চেনা—মধুমিতা মুখার্জী, দেবের বড় দিদি। লন্ডনে থাকে, ব্যাঙ্কে চাকরি করে, বড়দের মতো গলা, স্পষ্ট মতামত, আর দেবের জীবনে একমাত্র মানুষ যে ছোটবেলার দিনগুলো দেখে এসেছে।

“দি? এতদিন পর?”
“হ্যাঁ। একটু সিরিয়াস কথা আছে রে। মা চায় তুই আবার আমাদের পুরনো বাড়িতে আসিস কিছুদিনের জন্য।”
“এখন?”
“হ্যাঁ। বাবা-মার ওয়েডিং অ্যানিভার্সারি সামনে। ভাবলাম সবাই একসাথে একটু দেখা-সাক্ষাৎ হলে ভালো হয়।”

দেব কিছু বলল না। অনেকদিন হয়নি সে তার বেহালার পুরনো বাড়িতে গেছে। ওখানে যাবার মানেই অনেক কিছু—অনেক মুখোমুখি হওয়া।

“আর,” দিদি থেমে বলল, “তুই যদি চাস, অনন্যাকে নিয়েও আসতে পারিস। মা কিছু বলেনি, কিন্তু আমি জানি ও জানে।”

দেব একটু চুপ করে বলল, “আমি ভেবে জানাচ্ছি।”

সন্ধ্যায় অনন্যা ওর ফ্ল্যাটে এসেছিল। হাতে দুটো কফির কাপ, পরনে হালকা নীল কুর্তি।

দেব কফি নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল।

“আজ একটু চুপচাপ লাগছে,” অনন্যা বলল। “সব ঠিক আছে?”

“দিদির ফোন এসেছিল,” দেব বলল। “বেহালায় আমাদের বাড়িতে যেতে বলেছে। বাবা-মার অ্যানিভার্সারি।”

“তুমি যাবে?”
“ভেবেছি যাব।”

একটু নীরবতা।

“তুমি চাইলে…” দেব আস্তে বলল, “তুমিও যেতে পারো আমার সঙ্গে।”

অনন্যা থেমে গেল।

“তোমার পরিবার জানে আমার কথা?”

“জানে। অন্তত মা বোঝে। বাবার ব্যাপারে নিশ্চিত নই।”

“তুমি কি চাইছ আমি যাই?” অনন্যা প্রশ্ন করল।

দেব তাকাল তার চোখে। “আমি চাই আমার অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে তুমি থাকো। শুধু বর্তমান নয়।”

অনন্যা ধীরে মাথা নাড়ল।

“তাহলে চলো,” সে বলল। “আমারও কিছু মুখোমুখি হওয়ার বাকি আছে।”

সেদিন বিকেলে তারা গেল বেহালায়—একটা পুরনো, ছিমছাম দোতলা বাড়ি। ছোট বারান্দা, সিঁড়ির কোণে শিউলি গাছ। ভেতরে গিয়ে অনন্যা যেন একটু থমকে দাঁড়াল—এই বাড়িতে অতীতের ছায়া, পুরনো ছবি, আর চেনা গন্ধ।

দেবের মা এলেন এগিয়ে—চুলে হালকা পাকা রঙ, মুখে ধীরে পড়ে যাওয়া ক্লান্তি, কিন্তু চোখে অসীম উষ্ণতা।

“তুই ঠিক আছিস তো, বাবা?” মা বললেন।
“এই মা, দেখে নে কে এসেছে,” দেব বলল।

অনন্যাকে দেখে একটু থেমে গেলেন। তারপর আস্তে এসে বললেন, “তুমি অনন্যা, তাই তো?”

অনন্যা একটু কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ আন্টি। আমি…”

মা হাত ধরে ফেললেন।

“জানি মা। তোমাদের কাহিনি আমি জেনেছি অনেক আগেই। কিন্তু এখন আমি শুধু চাই, আমার ছেলে আবার হাসুক। ও আবার কাউকে বিশ্বাস করুক।”

অনন্যা কেঁপে উঠল এই কথায়। এক মুহূর্তের জন্য চোখ ভিজে উঠল।

তাদের পাশে এসে দাঁড়াল দেবের বাবা—শক্ত মুখ, গম্ভীর গলা, কিন্তু চাহনিতে আগ্রহ।

“তুমি কী করছ এখন?”
“স্টার্টআপ চালাই,” অনন্যা বলল। “আর… দেবের সঙ্গে কাজ করি।”

“ভালো,” তিনি বললেন, “তোমরা কাজের মধ্যে থেকো। আর অতীতের ভুলগুলো গিনতে যেও না। জীবন অনেক ছোট।”

দেব চোখ বন্ধ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলল।

এই যে পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতা—এইটুকুই যেন তার কাঁধ থেকে এক বিশাল বোঝা সরিয়ে দিল।

রাতে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া, গল্প, পুরনো অ্যালবাম দেখা চলল। হাসি, ঠাট্টা, স্মৃতি—সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত শান্তি।

ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে অনন্যা ছবি দেখছিল। একটা ছবি—দেব ছোট, পেছনে শুঁড় খোলা, হেসে দাঁড়িয়ে আছে।

“তুমি বদলাওনি,” অনন্যা বলল। “তোমার চোখ এখনও সেইরকমই। কেবল একটু বেশি অভিজ্ঞতা নিয়ে নেমে গেছে ভেতরের দিকে।”

দেব এসে পাশে দাঁড়াল।

“আর তুমি?”
“আমি বদলেছি,” অনন্যা বলল। “আগে আমি কেবল নিজেকে রক্ষা করতাম। এখন আমি ভালোবাসতে শিখেছি।”

দেব তার দিকে তাকাল।

“ভালোবাসলে দায় নিতেও হয়,” সে বলল।

অনন্যা বলল, “এইবার আমি নেব। সবটা।”

পর্ব ৮

রবিবার সকালের রোদটা ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে ফ্রেমে বাঁধানো ছবির গায়ে। দেবের মা টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজাচ্ছেন—লুচি, আলুর দম, চিনি ছাড়া চা। দেব সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল, আর অনন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল পেছনের গলির ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে।

“তুমি এখানে মানিয়ে নিতে পেরেছ তো?” দেব পাশ থেকে এসে জিজ্ঞেস করল।

অনন্যা হেসে বলল, “তোমার বাড়িটা তো খুব শান্ত। যেন সময়ও একটু ধীর গতিতে চলে এখানে। আমি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।”

“তুমি চাইলেই অভ্যস্ত করে তুলতে পারো,” দেব বলল, “এটা তোমার হয়ে উঠতে পারে।”

অনন্যার চোখে পড়ল, দেব সেটা সহজ কথার মতো বললেও তার গলায় লুকানো ছিল একধরনের অদৃশ্য আবেগ। অনেকদিনের স্বপ্ন, যা হয়তো উচ্চারণের সাহস পায়নি।

তবে তার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

অনন্যা দেখে নিল—স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ‘Mr. Subir Sarkar’—তার বাবা।

গলার নিচে কেমন একটা টান লাগল। এত বছর পর বাবার ফোন, হঠাৎ? তাও এই সকালে?

“হ্যালো?”

“তুমি কোথায়, অনন্যা?” গম্ভীর কণ্ঠ।

“দেবের বাড়িতে, বেহালায়।”

“সত্যি করে বলো, তুমি ওর সঙ্গে আবার জড়িয়ে পড়েছ?”

“আমি ওকে ভালোবাসি, বাবা। সেটা তো তোমাকেও একদিন বলা উচিত ছিল।”

ওপাশে কিছুক্ষণ চুপ।

“আজ দুপুরে বাড়ি এসো। কিছু কথা আছে।”

ফোন কেটে গেল।

অনন্যা দুপুরে সাউথ সিটিতে বাবার ফ্ল্যাটে পৌঁছাল। সুভীর সরকার তাকে বসাল ড্রয়িংরুমে, সামনে এক কাপ কফি।

“তুমি জানো, আমি তোমার ওপর রেগে আছি না। আমি শুধু উদ্বিগ্ন,” তিনি বললেন। “তুমি একজন এমন মানুষের সঙ্গে আবার সম্পর্ক গড়ছ, যে একসময় তোমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে পারত।”

“যে একসময় আমাকে ভালোবেসেছিল। আর যাকে আমি ফেলে দিয়েছিলাম,” অনন্যা ঠান্ডা গলায় বলল।

“তুমি এটা প্রেম বলে বোঝাতে পারো। কিন্তু তুমি জানো না, সে কী ধরনের লোক হয়ে উঠেছে এখন। তোমার স্টার্টআপের ৪২% শেয়ার ওর হাতে, এই কথা তুমি ভাবো না?”

“আমি ভাবি,” অনন্যা বলল। “আর আমি এটাও জানি, ও আমার পাশে দাঁড়িয়েছে যখন আমি সাহস করে নিজের দোষ স্বীকার করেছি সবার সামনে। সেইটা কি কেউ করে, শুধু প্রতিশোধের খাতিরে?”

সুভীর চোখ নামিয়ে বললেন, “আমি শুধু চাই, তুমি নিরাপদে থাকো।”

“বাবা, আমার নিরাপত্তা যদি ভালোবাসার মাপে না আসে, তাহলে সেটা আসলে শূন্য। আমি যদি ভুল করিও, সেটা হবে আমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি আর কারো ভয়ে চুপ থাকব না।”

সুভীর সরকার চুপ করে রইলেন। তার চোখে একটা হালকা কম্পন, যেন একটা পুরনো দেয়াল ধীরে ধীরে ফাটছে।

“তুমি জানো তো, আমি কখনো চাইনি তোমার কোনো ক্ষতি হোক,” তিনি আস্তে বললেন।

“আমি জানি, বাবা,” অনন্যা বলল। “কিন্তু এবার আমাকে নিজের পথটা নিজে বেছে নিতে দাও। দেব আমার পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু ভালোবাসা দিয়ে নয়—সত্যি দিয়ে।”

অনন্যা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। দেব বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল, তাকিয়ে রইল ওকে দেখে।

“বাবা বলেছে আর যোগাযোগ না করতে,” অনন্যা বলল। “তারপর আবার বলেছে, সে আমার সিদ্ধান্তকে মানে।”

দেব ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “তোমার কী ইচ্ছা?”

অনন্যা বলল, “আমার ইচ্ছা তোমার পাশে হাঁটতে। চুপ করে নয়—খোলাখুলি, সাহস নিয়ে।”

“তাহলে চল,” দেব বলল।

“কোথায়?”
“একটা নতুন ঠিকানার দিকে। যেখানে আমরা আর ছায়া হই না, আমরা আলোয় হাঁটি।”

অনন্যা মুচকি হেসে বলল, “আমি প্রস্তুত।”

পরদিন অফিসে একটি ছোট প্রেজেন্টেশন ছিল। ক্লায়েন্ট ছিল বিদেশি, প্রজেক্ট বড়, দায়িত্বে ছিল দেব ও অনন্যা—একসাথে।

তারা প্রবেশ করল কনফারেন্স রুমে, শার্ট-প্যান্টে, স্মার্টনেসে ভরা, চোখে আত্মবিশ্বাস। ক্লায়েন্ট তাদের টিমওয়ার্ক দেখে মুগ্ধ। আর মিটিং শেষে, অনন্যা বলল—

“This project is special. Because when two people trust each other again, the rest becomes execution.”

সবাই হাততালি দিল।

দেব তার পাশে তাকিয়ে বলল, “তোমার উচ্চারণ শুধু প্রেজেন্টেশনের নয়, জীবনেরও অংশ হয়ে গেছে।”

অনন্যা বলল, “আর তুমি আমার গল্পের সেই চরিত্র, যাকে একদিন হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু সে ফিরে এসে প্রমাণ করেছে—যে মেয়েটিকে সে ভোলেনি, সেই মেয়েটাও তাকে হারায়নি আসলে।”

দেব হাত ধরল অনন্যার টেবলের নিচে।

চোখে চোখ।

নীরব সম্মতি।

পর্ব ৯

দেব আর অনন্যার জীবনে যেন এক আশ্চর্য ছন্দ এসে গিয়েছে। অফিস, মিটিং, রাতের ছোট ছোট হাঁটা, একসাথে বই পড়া, সিনেমার টুকরো দৃশ্য নিয়ে বিতর্ক—সবকিছুতেই একটা সহজতা। দুজনেই জানে, এই সম্পর্কটা ভাঙনের উপরে নয়, নির্মাণের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে।

তবে প্রতিটি নির্মাণের মাঝেই কিছু পুরনো ফাটল লুকিয়ে থাকে। আর যদি সেই ফাটলে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে হাত ঢোকায়?

সেদিন দুপুরে অনন্যা তার কেবিনে ব্যস্ত ছিল এক ক্লায়েন্ট ডেলিভারি নিয়ে। হঠাৎ মেইলে একটা নোটিফিকেশন এলো—“Confidential: Term Sheet Amendment”। পাঠিয়েছে দেব। অথচ এর আগে কোনও আলোচনা হয়নি এমন কোনও অ্যামেন্ডমেন্ট নিয়ে।

দ্রুত মেইল খুলে পড়ে অনন্যা চমকে উঠল।

একটা লাইন—

“Proposed equity restructuring: Investor stake to be increased from 42% to 51%.”

অর্থাৎ এখন থেকে দেব এককভাবে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়?

তাড়াতাড়ি সে দেবকে ফোন করল।

“তুমি এই মেইলটা পাঠিয়েছো?”

দেব একটু থেমে বলল, “হ্যাঁ। সেটা নিয়ে বিকেলে বোর্ড মিটিং আছে।”

“তুমি আমার সঙ্গে আলোচনা না করে এমন একটা পদক্ষেপ নিতে গেলে?”

“এই ডিসিশন purely professional, অনন্যা,” দেব ঠান্ডা গলায় বলল। “এখন বাজারের যে অবস্থা, তাতে আমাদের নতুন ফান্ড আনতে গেলে মেজর শেয়ার হোল্ডিং দরকার। আমি সেই দায়িত্ব নিচ্ছি।”

“তুমি ঠিক করছো, আমি যেন শুধু মুখ দেখানোর জন্য এখানে আছি?” অনন্যার গলা কাঁপছিল।

“তুমি জানো, আমি কখনও তা চাইনি। কিন্তু এই ডিলটা না হলে কোম্পানি শেষ হয়ে যাবে,” দেব বলল।

“তাহলে আগে আমাকে জানালে না কেন?”

“কারণ আমি জানি, তুমি আবেগ দিয়ে ভাবতে, ব্যবসা দিয়ে নয়।”

অনন্যা ফোনটা কেটে দিল।

তার বুকের মধ্যে গর্জে উঠল একটা পুরনো যন্ত্রণা—যেখানে সে অপমানিত হয়েছিল, বিশ্বাস হারিয়েছিল, আর আজ… সে কি আবার সেই জায়গায় ফিরে যাচ্ছে?

বিকেলের বোর্ড মিটিং যেন একটা কাচের গলি—যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃষ্টির নড়াচড়া শোনা যায়।

দেব চুপচাপ প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে, ইনভেস্টরদের সামনে পরিসংখ্যান তুলে ধরছে। তাদের চোখ চকচক করছে সংখ্যার সম্ভাবনায়। অনন্যা স্লাইডের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু তার মন অন্য কোথাও।

যখন ভোটের সময় এল, অনন্যা বলল, “আমি প্রশ্ন তুলছি এই শেয়ার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে। এটা যদি হয়, তাহলে কোম্পানির কো-ফাউন্ডার হিসেবে আমার স্ট্যাটাস ক্ষুণ্ণ হবে। আমি চাই এটা অন্তত এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত থাকুক।”

বোর্ড চেয়ারম্যান বলল, “Miss Sarkar, your concern is valid, but the majority is leaning toward accepting this offer.”

অভ্যন্তরীণ ভোটে অনন্যা একা দাঁড়াল বিরোধিতায়। বাকি সবাই পক্ষে।

বোর্ড মিটিং শেষ হতেই সে নিজের ডেস্কে ফিরে এল। সবকিছু যেন কেমন অচেনা লাগছিল। সেই অফিস, সেই কাঁচের জানালা, সেই চেনা মুখ—সবই যেন দূরের।

একটু পরেই দেব তার কেবিনে এল।

“অনন্যা, কথা বলবে?”

“এখন নয়,” অনন্যা বলল। “আমি শুধু কাজ শেষ করতে চাই।”

“আমি জানি, তোমার খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমি চাইনি এটা তোমাকে আঘাত করুক।”

“তুমি কী চাইলে সেটা আর বড় কথা নয়, দেব। তুমি কী করলে সেটা বড় কথা। তুমি জানো আমি তোমার ওপর কতটা ভরসা করেছিলাম?”

“আমি চাইনি আমাদের সম্পর্ক এতে জড়াক। আমি কাজ আর ব্যক্তিগত জিনিস আলাদা রাখতে চেয়েছি।”

“তাহলে খুব ভালো করেছো। এখন আমরা শুধু বিজনেস পার্টনার,” অনন্যা বলল।

তার ঠোঁটে কাঁপুনি, চোখে লুকোনো জ্বলজ্বলে অভিমান।

দেব এবার আর কিছু বলল না। কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

সেই রাতটা ভীষণ চুপচাপ। বারান্দার বাতাসে হাওয়া নেই, শুধু স্মৃতির শব্দ। অনন্যা বিছানায় শুয়ে, ছাদে তাকিয়ে ভাবছিল—এই ছেলেটাকেই সে বিশ্বাস করতে শিখেছিল আবার। সেই কি আজ আবার তাকে পেছনে ঠেলে দিল?

তার ফোন বেজে উঠল—দেব।

সে ধরল না।

তারপর আবার।

এইবার সে ফোন ধরল।

“আমি জানি তুমি রেগে আছো,” দেব বলল। “তুমি চাইলে আমি সব ব্যাখ্যা দিতে পারি।”

“ব্যাখ্যা নয়, দেব। আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকো, আমার ওপর আস্থা রাখো।”

“তুমি কি ভাবছো আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি?”

“আমি ভাবছি, তুমি আমার কথা না ভেবেই একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আর সেটা সম্পর্ককে না ভেবে করেছো।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা।

তারপর দেব বলল, “তাহলে যদি আমি কাল কোম্পানির নাম থেকে আমার নাম সরিয়ে নিই? ফান্ডিং টানব না? তাহলে কি আমাদের ঠিক থাকবে?”

“আমি চাই না তুমি হেরে যাও। আমি চাই, তুমি আমায় সঙ্গে নিয়ে জিতো।”

“তবে একবার দেখা করো। আসো। কোথাও যাওয়া যাক, সবকিছু থেকে দূরে।”

অনন্যা বলল, “ঠিক আছে। কাল সকালে। আমি প্রস্তুত।”

পর্ব ১০

সকালে কলকাতা ছিল কিছুটা মেঘলা। আকাশ যেন ধূসর কাগজ, যার গায়ে কোনও ভবিষ্যৎ লেখা নেই। অনন্যা ঠিক সকাল সাতটায় গাড়িতে উঠল। ডেস্টিনেশন—প্রিন্সেপ ঘাট। দেব আগেই বলেছিল, “ভিড়ের মধ্যে নয়। একটা চুপচাপ নদীর ধারে, যেখানে আমি কেবল দেব, আর তুমি কেবল অনন্যা।”

ও পৌঁছাল প্রায় সাড়ে সাতটায়। ঘাট প্রায় ফাঁকা। মাত্র কয়েকজন ঘুমভাঙা শহরের সঙ্গী হিসেবে বসে আছে—কেউ মাছ ধরছে, কেউ বই পড়ছে, কেউ চুপ করে বসে আছে গঙ্গার দিকে মুখ করে।

দেব ওকে দেখে এগিয়ে এল। পরনে হালকা সাদা শার্ট, চোখে ক্লান্তি আর মুখে অপেক্ষার ছাপ।

“ধন্যবাদ, এসেছো,” সে বলল।

“তুমি ডেকেছিলে,” অনন্যা চোখ সরাল না।

তারা গিয়ে বসল পানির একদম ধার ঘেঁষে। গঙ্গার ঢেউ নরমভাবে তীরে ধাক্কা দিচ্ছে, যেন কথারও ভাষা আছে।

দেব আস্তে বলল, “আমি আজ তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”

“ক্ষমা?” অনন্যার গলায় ছিল কৌতুক। “তুমি কি বুঝেছো আসলে কী ভুল করেছো?”

“হ্যাঁ। আমি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটা আমাদের দুজনের নয়—আমার একার ছিল। আর সম্পর্ক তো একা চলে না, তাই তো?”

অনন্যা চুপচাপ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল।

দেব আবার বলল, “অনেকবার মনে হয়েছে, তুমি যদি আমায় ভালোবাসো, তাহলে সব মেনে নেবে। কিন্তু আমি বুঝিনি, ভালোবাসা মানেই সব কিছু মেনে নেওয়া নয়। বরং ভালোবাসা মানে পাশে দাঁড়ানো, প্রশ্ন করলেও হাত না ছাড়া।”

“তুমি কী করতে চাও এখন?” অনন্যা জিজ্ঞেস করল।

“আমি বোর্ডকে জানাবো—আমি সেই শেয়ার ট্রান্সফার পিছিয়ে দিচ্ছি। তুমি চাইলে আমরা একসাথে নতুন শর্ত নিয়ে এগোতে পারি।”

“আর যদি না চাই?”

“তাহলে আমি এই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যাব। কারণ এই কোম্পানির চেয়ে তুমি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।”

অনন্যা এবার তার চোখে চোখ রাখল।

“তুমি জানো তো, এই কথা আমায় এতদিনে কেউ বলেনি?”

“তাহলে বললাম,” দেব হেসে ফেলল।

তাদের মধ্যে কিছুটা নীরবতা নামল। পাশ দিয়ে একটা নৌকা চলে গেল, বোটম্যান গান গাইছে—পুরোনো বাংলা লোকগান, জল আর শব্দে মিশে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুজনের পুরোনো ভুল।

অনন্যা বলল, “তুমি কি জানো, আমি কখনো ভাবিনি আমি কাউকে আবার ভালোবাসতে পারব। কিন্তু তুমি এসেছিলে, ধীরে ধীরে, ঠোঁটের নয়, চোখের ভাষায়… এবং তুমি বুঝিয়ে দিয়েছো—ভালোবাসা আবার জন্মায়।”

দেব এবার বলল, “তবে একটা কথা বলি? আমি এখনো মাঝে মাঝে ভয় পাই, যদি তুমি আবার…”

“ফেলে দিই?”

“হ্যাঁ।”

অনন্যা আস্তে ওর হাত ধরল।

“এইবার, আমি ছাড়ব না। যদি না তুমি ছাড়ো।”

দেব হাতটা শক্ত করে ধরল।

“তাহলে এইবার আমরা একসাথে?”

“হ্যাঁ,” অনন্যা বলল। “কোনও বিভাজন ছাড়াই।”

এক সপ্তাহ পরে…

অফিসে ইনভেস্টর মিটিং ছিল। দেব আর অনন্যা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নতুন প্রেজেন্টেশন দিল। এইবার সেই অ্যামেন্ডমেন্টে ছিল স্পষ্ট লেখা—Both co-founders to retain equal control. All major decisions to require mutual consent.

সভাঘরে হাততালি পড়ল। অনন্যা এক পলক দেবের দিকে তাকাল। সে মুচকি হাসল।

চেয়ারম্যান বলল, “Looks like your partnership is more stable than most marriages.”

সবাই হেসে উঠল।

কিন্তু তারা জানত—এটা হাসির জায়গা নয়, এই মুহূর্তটা তারা অর্জন করেছে—ভেঙে পড়ে, উঠে দাঁড়িয়ে, এবং একে অপরকে সত্যি জানার মাধ্যমে।

সেদিন সন্ধ্যায় তারা ফিরছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছিল। দেব বলল, “চলো, এই উইকএন্ডে কোথাও যাই। তোমার সেই পুরনো স্কুলে, সেন্ট মারি’স হোস্টেল। যেখানে এই গল্পটা শুরু হয়েছিল।”

অনন্যা তাকিয়ে বলল, “চলো। হয়তো ওই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারব—সেই অনন্যা আর দেব কোথায় হারিয়েছিল, আর এই অনন্যা-দেব কোথা থেকে জন্ম নিল।”

দেব গাড়ি থামাল। রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান। দুজনে একসাথে বসে চা খেলো—মাঝে মাঝে এমন ছোট ছোট মুহূর্তই তো প্রমাণ, সব ঠিকঠাক চলেছে।

আর ঠিক সেখানেই অনন্যা বলল, “তুমি জানো, আমি এই গল্পটার নাম রেখেছি—‘যে মেয়েটিকে আমি ভোলেনি’। কিন্তু গল্পটা আসলে তোমার নয়, আমারও।”

দেব হাসল, “তবে এইবার গল্পটা আমরা একসাথে লিখি।”

অনন্যা মাথা নাড়ল।

“হ্যাঁ, আর এইবার যেন শেষে কোনও ভুল না থাকে। শুধু ভালোবাসা।”

শেষ

1000024672.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *