অতিন্দ্র মুখার্জী
অধ্যায় ১ – ঝড়ের রাত
সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের ভেতর যখন ভাটা নামে, তখন গোটা অঞ্চলের নদী, খাঁড়ি আর নোনা জল যেন অন্য এক সুরে বেজে ওঠে। দিনের শেষে জোয়ারের স্রোত সরে গিয়ে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে কেবল মাটির গন্ধ আর ভেজা বাতাস ভেসে বেড়ায়। এ সময় মাছ ধরতে বের হওয়া জেলেদের জন্য কাজটা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি ভয়ংকরও বটে, কারণ ভাটার পরে আসা ঝড় বা ঘূর্ণি হঠাৎ করেই সবকিছু গ্রাস করতে পারে। হরিদাস মণ্ডল, চেহারায় বলিষ্ঠ কিন্তু জীবনে দুঃখে জর্জরিত, এই রাতেও নিজের ভাঙাচোরা নৌকায় জাল নিয়ে নদীতে নামে। আকাশে তখন কালো মেঘ জমে উঠেছে, বাতাসের গায়ে লবণাক্ত কটু স্বাদ, গাছের শেকড় আর ম্যানগ্রোভের পাতাগুলো কাঁপছে অনিয়মিত ছন্দে। দূরে কোথাও কোথাও বাজ পড়ছে, সারা আকাশ আলোকিত হয়ে উঠছে ক্ষণিকের জন্য, আর সেই আলোয় নদীর ওপরের অন্ধকার ঢেউ যেন দাঁত বের করা দানবের মতো ভেসে উঠছে। হরিদাস জানে, এ সময় নদীতে নামা মানে মৃত্যুকে আহ্বান করা, কিন্তু সংসারের টান তাকে থামতে দেয় না। কমলার মুখ মনে পড়ে—ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের সামনে যদি খালি হাঁড়ি থাকে, তবে বেঁচে থাকার অর্থই হারিয়ে যাবে।
নৌকা ভেসে যায় স্রোতের টানে, আর হরিদাস জাল ফেলতে ফেলতে ভাবে ঝড়ের আগমনী বার্তা। আকাশে তখন এমন এক শব্দ উঠেছে যা মানুষকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়—ঝড়ের হুংকার। চারপাশের গাছগুলো হেলে পড়ছে, ডালপালা ভেঙে পড়ছে পানির ওপর, নৌকা দুলছে ভয়ানকভাবে। সেই সঙ্গে নদীর বুক থেকে উঠে আসছে অদ্ভুত ফেনা, যেন কোনো অচেনা জীব পানির তল থেকে উঠে এসে নিশ্বাস ফেলছে। হরিদাস ঠান্ডা ঘাম ঝরতে থাকা শরীর নিয়ে দাঁড় টানতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঝড়ের গতি তার সমস্ত শক্তি কেড়ে নেয়। হঠাৎ একসময় মনে হয়, নৌকা আর তাকে মানছে না, স্রোত নিজের মতো করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা দিকে। আশেপাশের অন্ধকার এত ঘন হয়ে ওঠে যে নিজের হাতও স্পষ্ট দেখা যায় না। বজ্রপাতের আলোয় হরিদাস হঠাৎ দেখতে পায় নদীর মাঝখানে এক ফ্যাকাশে নীলাভ আলো ভাসছে, যেন জলের গভীর থেকে ডেকে আনছে। প্রথমে ভাবে এটি হয়তো জেলেদের পরিচিত কোনো মাছের ঝাঁক, কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে হয়—এ আলো মানুষের চোখ নয় কি? ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে তাকে অচল করে দেয়। নৌকা দুলতে দুলতে আলোটার দিকে এগোতে থাকে, আর হরিদাস জালের দড়ি আঁকড়ে ধরে কেবল চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ তীব্র ঝড় তার মাথার ওপরে নেমে আসে। বজ্রধ্বনির তীব্রতায় কানে তালা লেগে যায়, নদীর জল উথালপাথাল হয়ে ওঠে। নৌকা ছিটকে যায় স্রোতের ঘূর্ণির ভেতরে, হরিদাস ছিটকে পড়ে যায় জলের গহ্বরে। চারদিকে শুধু অন্ধকার আর ঝড়ের গর্জন, আর সেই ফাঁকে আবারও দেখা যায় নীলাভ আলোর ঝলক। হরিদাস সাঁতরাতে চায়, কিন্তু হাত-পা যেন শিকল বাঁধা, আরেক অদৃশ্য শক্তি তাকে নিচে টেনে নিচ্ছে। সে চিৎকার করতে পারে না, বুক ফেটে আসা আতঙ্ক কেবল ভেতরে গুমরে ওঠে। এক ঝলক মনে হয় দূরে কমলা দাঁড়িয়ে আছে, বাচ্চারা কাঁদছে—কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জলের স্রোত সবকিছু গ্রাস করে নেয়। গ্রামে পরদিন সকালে খবর পৌঁছায়—হরিদাস মণ্ডল আর নেই, ঝড়ে নদী তাকে গ্রাস করেছে। কমলা ভেঙে পড়ে, গ্রামবাসী শোকাহত হয়, কিন্তু সুন্দরবনের মানুষ জানে—এটাই নিয়ম, প্রকৃতির নিয়ম, এখানে মানুষ নদীর সঙ্গে লড়ে টিকে থাকে, আর এক মুহূর্তেই নদী মানুষকে নিজের অন্ধকার গহ্বরে টেনে নেয়। তবে কেউ কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে—ঝড়ের রাতে যারা হারিয়ে যায়, তারা আসলে পুরোপুরি হারায় না, কখনো কখনো তারা ফিরে আসে… কিন্তু আর আগের মতো মানুষ হয়ে নয়।
অধ্যায় ২ – শূন্য ঘর, শূন্য মন
ঝড়ের পরদিন ভোরে সুন্দরবনের আকাশে যখন লালচে রোদ ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল, তখনও গ্রামে যেন অন্ধকারে মোড়া ছিল কমলার ঘর। ঘরের চারপাশে ভাঙা চালার ফাঁক দিয়ে ভিজে বাতাস ঢুকছিল, ভাটার কাদার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল সর্বত্র। বিছানার একপাশ ফাঁকা পড়ে ছিল—সেই জায়গায় কোনোদিন হরিদাস ঘুমাত, তার শরীরের উষ্ণতা আর ঘামের গন্ধে ভরে থাকত জায়গাটা। এখন কেবল ঠাণ্ডা খালি কাপড়, ভিজে মাটির শীতলতা আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কমলা সারারাত একটুও ঘুমোতে পারেনি; চোখ দুটো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু অশ্রু শুকোয়নি। মনে হচ্ছিল স্বামীকে না পেয়ে তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে, ঠিক যেমন ভাটার সময় নদী ফাঁকা হয়ে যায়। বাইরে থেকে প্রতিবেশীরা আসছিল, কেউ দুধ, কেউ ভাত, কেউ শুকনো কাঠ এনে দিচ্ছিল সহানুভূতির নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু কমলা অনুভব করছিল, কোনো খাবার বা কোনো সমবেদনা তার ভেতরের শূন্যতা পূর্ণ করতে পারছে না। চারপাশের মানুষজন সান্ত্বনা দিলেও তার কান তাদের কথা শোনেনি; বারবার সে দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল হরিদাস এখনই দরজা ঠেলে ঢুকে আসবে, হাসতে হাসতে বলবে—“ভয় পেয়ো না কমলা, আমি তো আছি।”
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভয়াবহ। গ্রামে সবাই জানত, ঝড়ে নদীতে হারানো মানুষ আর ফেরে না। যারা নদীর গহ্বরে ডুবে যায়, তারা হয় স্রোতের সঙ্গে বহুদূরে চলে যায়, নয়তো জঙ্গলের গভীরে কুমির বা বাঘের শিকার হয়। তাই গ্রামবাসীরা যখন কমলার কপালে স্নেহের হাত রাখছিল, তখন তাদের চোখে ছিল নিশ্চিত শোকের ছাপ। তবুও কমলার মন মেনে নিতে পারছিল না। একে একে প্রতিবেশীরা চলে গেলে, সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করল, তখন সে একা হয়ে বসে থাকল খালি ঘরের মধ্যে। ঝড়ের সময় ভেঙে পড়া চালের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে মাটিতে পড়ছিল, সেই আলোয় কমলা দেখতে পাচ্ছিল হরিদাসের রাখা জাল, ভাঙা দাঁড়, তার গামছা—সবকিছু যেন বলছে, সে এখনও বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে তার কানে ভেসে আসছিল নদীর গর্জন, আর সেই শব্দে মনে হচ্ছিল যেন স্বামীর ডাক শুনতে পাচ্ছে। “কমলা…”—এমন মৃদু আওয়াজে বুক কেঁপে উঠছিল, কিন্তু ঘর খালি, দরজা খালি। ভেতরে ভয় জন্মাচ্ছিল, কিন্তু ভয়কে দূরে ঠেলে সে এক অদ্ভুত বিশ্বাস আঁকড়ে ধরল—হরিদাস হারিয়ে যায়নি, সে কোথাও আছে, হয়তো আহত, হয়তো নদীর ধারে বসে ফিরতে চাইছে।
এই বিশ্বাসই তাকে টিকিয়ে রাখল, যদিও বাইরের সবাই তাকে বোঝাতে চাইছিল সত্যিটা মেনে নিতে। বুধু মাঝি এসে বলেছিল, “মা, নদী যাকেই নেয়, তাকে ফেরায় না। হরিদাসের আত্মা এখন বনবিবির কাছে।” কিন্তু কমলা মাথা নাড়ল, তার চোখ লাল হয়ে উঠল, কণ্ঠে কাঁপুনি নিয়ে বলল, “না দাদু, ও আসবেই, আমি জানি।” গ্রামবাসীরা ফিসফিস করে বলতে লাগল, কমলার শোকে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু রাতে যখন বাতাস নদীর দিক থেকে বইতে লাগল, কমলা দাঁড়িয়ে রইল উঠোনে। তার মনে হচ্ছিল বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে হরিদাসের নিঃশ্বাস, জলের ফিসফিসানি যেন তার নাম ধরে ডাকছে। শূন্য ঘরের ভেতর বসে থেকেও সে বারবার কেঁপে উঠছিল, যেন অদৃশ্য কারও উপস্থিতি টের পাচ্ছে। বুকের ভেতরে ব্যথা বাড়ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে এক তীব্র বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল—ঝড়ের সেই রাত হরিদাসকে হয়তো নদী নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নদী তাকে ফিরিয়েও দেবে। গ্রামবাসীরা যখন তাকে একা, শোকাহত, বিভ্রান্তা বলে ভাবছিল, তখন কমলার ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক অদ্ভুত প্রত্যাশা—যা আসন্ন রহস্যের পূর্বাভাস হয়ে থেকে গেল।
অধ্যায় ৩ – অদ্ভুত প্রত্যাবর্তন
ঝড়ের কয়েকদিন পরের এক ভোরবেলা, যখন সুন্দরবনের আকাশে কুয়াশা জমে আছে, ম্যানগ্রোভের ভেতর থেকে ভিজে হাওয়া বইছে আর খাঁড়ির জলে ভাটা নেমে মাটি দেখা দিয়েছে, তখন গ্রামবাসীরা হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। নদীর ঘোলাটে স্রোতের ওপর দিয়ে এক মানুষ ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে। প্রথমে অনেকে ভাবল—কোনো অচেনা জেলে বোধহয় পথ ভুলে এখানে এসে পড়েছে। কিন্তু যত কাছে আসতে লাগল, ততই অবাক হয়ে চোখ বড় করতে লাগল সবাই। চেনা শরীর, চেনা ভঙ্গি, কাঁধে সেই ভাঙা জাল—এ যে হরিদাস মণ্ডল! কেউ চিৎকার করে উঠল, “ওই তো হরিদাস! বাঁচি রে!” দৌড়ে গিয়ে সবাই তাকে ঘিরে ধরল। কিন্তু কাছ থেকে দেখে প্রত্যেকের বুকের ভেতর কেমন শীতল হাওয়া বয়ে গেল। হরিদাস দাঁড়িয়ে আছে শুকনো দেহে, যেন ঝড় তাকে স্পর্শই করেনি, কিন্তু তার চোখের ভেতর জ্বলছে এক অদ্ভুত নীল আলো। ভোরের কুয়াশার মতো নরম নয়, আবার আগুনের মতোও নয়—বরং গভীর জলের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা কোনো অচেনা আলোর মতো। গ্রামবাসীরা প্রথমে অবাক, তারপর ধীরে ধীরে ভয় পেতে শুরু করল।
কমলা ছুটে এসে স্বামীকে আঁকড়ে ধরল। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্না উথলে উঠল, কিন্তু গায়ে হাত দিতেই কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভব করল। মনে হল, স্বামীর দেহে প্রাণ আছে, অথচ তাপ নেই। হরিদাস ধীরে ধীরে তাকাল কমলার দিকে, কিন্তু তার চোখের নীল আলো এমনভাবে কাঁপছিল যে কমলার বুক কেঁপে উঠল। সে ভেবে নিতে পারল না—এ তার স্বামী, নাকি অন্য কেউ? তবুও ভালোবাসা তাকে বাঁধল, সে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল, “তুমি ফিরেছ হরি, আমি জানতাম তুমি ফিরবেই।” হরিদাস খুব আস্তে, অচেনা স্বরে বলল, “আমি ফিরে এসেছি।” সেই কণ্ঠস্বর গ্রামে অনেকের গায়ে কাঁটা দিল। এটা হরিদাসের স্বর হলেও, ভেতরে যেন আরও কারও প্রতিধ্বনি আছে, এক অচেনা সত্তা যেন তার গলার ভেতর দিয়ে কথা বলছে। বুধু মাঝি চুপচাপ দূর থেকে তাকিয়ে থাকল, তার চোখে ভয়, ঠোঁটে নিঃশব্দ প্রার্থনা। গ্রামবাসীরা ফিসফিস করে বলতে লাগল—“ও যে মানুষ নাকি… না কি নদীর ফেরত পাঠানো কিছু?” কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল, আবার কেউ মনে মনে দূরে সরে যাচ্ছিল।
দিন যত এগোতে লাগল, ততই অদ্ভুত ঘটতে লাগল। হরিদাস শরীরে কোনো ক্ষতচিহ্ন না থাকলেও খাবারের প্রতি তার আগ্রহ হারিয়ে গেল। দিনে সে খুব কম কথা বলত, কিন্তু রাতে উঠোনে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো তার ঠোঁট নড়ত, যেন কারও সঙ্গে ফিসফিস করছে, অথচ পাশে কেউ নেই। মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসত অচেনা সুর, যেন গভীর জলের গান। গ্রামের লোকেরা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল—এই মানুষ আর আগের মতো নেই। একদিকে সবাই খুশি, কারণ ঝড়ের রাতে যাকে হারিয়েছিল, সে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে এক অদৃশ্য ভয় তাদের ভেতরে গ্রাস করছিল—এ হরিদাস কি আসলেই তাদের আপনজন, নাকি নদীর অতল থেকে আসা কোনো অচেনা ছায়া, যে মানুষের শরীর ধার করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে? কমলা একা বসে থাকতে থাকতে ভাবত, আলোর ঝলক ধরা সেই চোখ দুটো কি সত্যিই তার চেনা স্বামীর চোখ, নাকি সেই চোখে লুকিয়ে আছে সুন্দরবনের অজানা রহস্য? গ্রামের বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল অশান্তির গন্ধ, আর সবাই টের পাচ্ছিল—অদ্ভুত প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটার সূচনা হয়েছে, যা তাদের স্বাভাবিক জীবন ভেঙে দেবে।
অধ্যায় ৪ – বদলে যাওয়া মানুষ
হরিদাস ফিরে আসার পর প্রথম কয়েকদিন গ্রামে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল—এ এক অলৌকিক ঘটনা, ঝড়ে ডুবে যাওয়া মানুষটি কিভাবে ফিরে এল! কমলা প্রথমে আনন্দে কেঁদে উঠেছিল, তার শূন্য ঘর যেন আবার ভরে উঠল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এই মানুষটি আগের সেই হরিদাস নয়। তার হাসি ম্লান, তার চোখে আছে অদ্ভুত নীলাভ আলো, যা সন্ধ্যা নামলেই যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সে খুব কম কথা বলে, কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না। গ্রামে যেসব মানুষ তাকে দেখে খুশি হয়েছিল, তাদের মাঝেও ধীরে ধীরে শঙ্কার স্রোত বইতে লাগল। কারণ একসময় যে হরিদাস ছিল প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, গান গাইতে ভালোবাসত, সে এখন অচেনা, নীরব এবং অদ্ভুত। কেউ কেউ মনে মনে বলাবলি করল—এ কি সত্যিই আমাদের হরিদাস, নাকি ঝড় তার দেহ নিয়ে গেছে আর ফিরিয়ে দিয়েছে অন্য কিছু?
রাত হলেই হরিদাস ঘরের বাইরে এসে নদীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নদীর জলে চাঁদের আলো পড়লে তার চোখে সেই অদ্ভুত নীল আলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কমলা প্রথমে ভাবত হয়তো স্বামীর চোখে ক্লান্তি জমেছে, কিংবা ঝড়ের রাতে পানিতে ডুবে থাকার কারণে চোখে অদ্ভুত রঙ এসেছে। কিন্তু পরে সে লক্ষ্য করল, হরিদাস মাঝে মাঝে অজানা ভাষায় ফিসফিস করে কিছু শব্দ উচ্চারণ করছে। সেই শব্দগুলি মানুষের কোনো ভাষার মতো শোনায় না—না বাংলার, না অন্য কিছুর। যেন গভীর সমুদ্রের অন্ধকার থেকে আসা কোনো আওয়াজ, যা শুধু হরিদাসের ঠোঁটে ফুটে উঠছে। এক রাতে কমলা সাহস করে তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ তুমি?” হরিদাস তার দিকে তাকাল না, শুধু ধীরে ধীরে ফিসফিস করতে থাকল। সেই মুহূর্তে কমলার মনে হল, এই মানুষটির শরীর হয়তো তার স্বামীর, কিন্তু আত্মা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
গ্রামবাসীরাও পরিবর্তন টের পেল। কেউ কেউ বলল, ঝড়ের রাতে হরিদাসকে নদী টেনে নিয়েছিল, আর এখন সে মানুষ হয়ে নয়, নদীর দূত হয়ে ফিরে এসেছে। অন্যরা ফিসফিস করে বলল, “ঝড়ের দেবতা তার শরীরে ঢুকেছে।” এক রাতে, গ্রামের কয়েকজন মৎস্যজীবী দেখল—হরিদাস একা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে অজানা ভাষায় কিছু উচ্চারণ করছে। আর আশ্চর্যের বিষয়, ঠিক তখনই নদীর ঢেউ যেন অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠল, গাছের ডালপালা কাঁপতে লাগল, আর দূরে শকুনের মতো কিছু কালো ছায়া উড়ে গেল। মানুষ ভয়ে দৌড়ে পালাল। পরদিন তারা এই ঘটনার কথা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে দিল। কমলা শোনার পর ভেতরে ভেঙে পড়ল, তবুও মনে মনে ভাবল—এ কি সত্যিই আমার হরিদাস, নাকি নদীর অন্ধকার থেকে উঠে আসা অন্য কেউ তার রূপ নিয়েছে? তার বুকের ভেতর ভয় আর ভালোবাসা একসঙ্গে লড়াই করতে লাগল। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না—স্বামীকে আঁকড়ে ধরবে, নাকি তাকে ভয় করবে। সেই রাত থেকে সুন্দরবনের নীরবতা আর আগের মতো থাকল না, যেন প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি বাতাস হরিদাসের ফিসফিসানি বহন করে নিয়ে যায় নদীর গভীরে।
অধ্যায় ৫ – গ্রামবাসীর সন্দেহ
রাঘু সরকার, গ্রামের প্রবীণতম জেলেদের একজন, দীর্ঘদিন ধরে নদী ও জোয়ার-ভাটার খেয়াল রাখছে। তার চোখে কিছুই সহজে এড়িয়ে যায় না। একদিন ভোরবেলায়, যখন সবাই নদীতে নামতে প্রস্তুত, রাঘু লক্ষ্য করল—হরিদাস নৌকার ধারে দাঁড়িয়ে আছে আর আশ্চর্যজনকভাবে আশেপাশে অসংখ্য মাছ একত্র হয়ে ভিড় করছে। সাধারণত মাছ এভাবে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে না, আর তাও দিনের আলো ওঠার আগেই এত কাছে ভিড় জমানো অস্বাভাবিক। সে চুপচাপ ঘটনাটা দেখে রাখল, কিন্তু সেদিনই প্রথম সন্দেহের বীজ বপন হয়ে গেল তার মনে। পরে কয়েকজন জেলে একসঙ্গে বলাবলি করল, “হরিদাস ফিরে আসার পর থেকেই নদীর আচরণ পাল্টেছে। আগে যেখানে জালে সামান্য মাছ মিলত, এখন সেখানে অঢেল মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এ কি আশীর্বাদ, নাকি অন্য কিছু?” কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল, আর মানুষজনের কৌতূহল থেকে ধীরে ধীরে ভয় জন্ম নিতে লাগল।
কিছু লোক খুশি হয়ে বলল, “হরিদাসের শরীরে নিশ্চয়ই কোনো দেবশক্তি ঢুকেছে। সে এখন গ্রামকে রক্ষা করছে। নদী তাকে মান্য করছে।” এমনকি কয়েকজন মাছ বিক্রেতা বলল, এর ফলে বাজারে এখন মাছের জোগান বেড়েছে, দামও ভালো মিলছে। তারা মনে করল—এটা একেবারেই সৌভাগ্যের লক্ষণ। কিন্তু অন্যদিকে গ্রামের একাংশ বিষয়টিকে ভয়ঙ্কর দিক থেকে দেখতে লাগল। তাদের ধারণা, সাধারণ মানুষকে এভাবে নদীর মাছ কাছে টেনে আনা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এটি অশুভ শক্তির লক্ষণ, নদীর গভীর থেকে উঠে আসা কোনো অদ্ভুত ক্ষমতা। রাঘু সরকার আরও চিন্তিত হয়ে পড়ল, কারণ সে দেখল হরিদাস যখন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন মাছগুলোর চোখ অস্বাভাবিকভাবে ঝলমল করে, আর যেন অদৃশ্য কোনো টানে তারা তার চারপাশে ভিড় জমায়। যেন নদীর তলদেশ থেকে কোনো অচেনা শক্তি তাদের ডাকছে। এই দৃশ্য সে যতই দেখল, ততই বুকের ভেতর অস্বস্তি বাড়তে লাগল।
এভাবেই গ্রামে দুটো মত তৈরি হয়ে গেল—একদল হরিদাসকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখল, আরেকদল তাকে অশুভ শক্তির বাহক ভাবতে শুরু করল। সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের উঠোনে আলো-আঁধারিতে গল্প গড়ে উঠতে লাগল। কেউ বলল, “হরিদাস আর সেই মানুষটা নেই, তার শরীরে নদীর আত্মা বাস করছে।” কেউ আবার জবাব দিল, “না না, ও তো আমাদের জন্য মাছ আনছে, এ নিশ্চয়ই দেবীর আশীর্বাদ।” এই মতবিরোধে গ্রামে একটা চাপা উত্তেজনা তৈরি হল। আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল কমলা—সে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তার স্বামী সত্যিই অলৌকিকভাবে আশীর্বাদ হয়ে ফিরেছে, নাকি নদীর ভয়ংকর অন্ধকার থেকে কিছু এসে তাকে গ্রাস করেছে। রাঘু সরকার অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল, একদিন গভীর রাতে হরিদাসকে অনুসরণ করবে। কারণ তার মনে হচ্ছিল, এই রহস্যের উত্তর লুকিয়ে আছে নদীর ঢেউ আর হরিদাসের নীল চোখের গভীরে।
অধ্যায় ৬ – বুধুর সতর্কতা
সন্ধ্যা নামার আগেই গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল অদ্ভুত আলোচনা। কেউ বলছিল হরিদাস আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এসেছে, কেউ আবার বলছিল অশুভ শক্তির আগমন ঘটেছে। এই সময়েই প্রবীণ জেলে বুধু মাঝি গ্রামের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তার সাদা দাড়ি, কুঁচকানো মুখ আর নদী-খাওয়া চোখে এক ধরনের গাম্ভীর্য ছিল। বুধু এমন এক মানুষ, যাকে গ্রামের সবাই শ্রদ্ধা করে, কারণ তার জীবন কেটেছে নদীর স্রোত, জোয়ার-ভাটা আর ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, কী বলবে সে। বুধু আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা যাকে হরিদাস বলছ, সে হরিদাস নয়। এ তো ভাটার শেষে আলো।” গ্রামবাসীরা হতভম্ব হয়ে গেল। কেউ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, “ভাটার শেষে আলো মানে কী?” বুধু গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “নদী মাঝে মাঝে মানুষকে নিয়ে যায়। ঝড়ের রাতে, ভাটার টানে যারা হারিয়ে যায়, তারা আর মানুষ হয়ে ফেরে না। নদী তাদের বদলে দেয়। ফিরিয়ে আনে কেবল শরীর, কিন্তু প্রাণে ভরে দেয় অন্য কিছু। তাদের চোখে তখন জ্বলে ওঠে নদীর আলো, সেই আলো যা মানুষকে টেনে নেয় আবার নদীর গভীরে।”
এই কথা শুনে গ্রামের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কেউ বিশ্বাস করছিল, কেউ হেসে উড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু যারা হরিদাসের নীল চোখ দেখেছে, তারা অস্বস্তি চেপে রাখতে পারছিল না। বুধু মাঝি তখন আরও বলল, “আমি এ দৃশ্য আগেও দেখেছি। আজ নয়, বহু বছর আগে। একবার কালীপুজোর রাতের ঝড়ে মধু নামের এক জেলে হারিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন পর সে ফিরেছিল অক্ষত শরীরে, কিন্তু তার চোখও এমনই নীল আলোয় জ্বলজ্বল করত। প্রথমে সবাই খুশি হয়েছিল, ভাবল মধু কোনো দেবশক্তি নিয়ে ফিরেছে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগল—গ্রামের গৃহপালিত পশু উধাও হয়ে গেল, নদীর জলে ভেসে উঠল অচেনা মৃতদেহ, আর এক রাতে মধু হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল নদীর ভাটার টানে। তারপর থেকে আর তাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি। আমি তখন থেকেই জানি, নদী কাউকে ফেরায় না—ফেরায় কেবল তার ছায়া, তার আলো।” বুধুর কণ্ঠে ভয় আর অভিজ্ঞতার ভার মিশে ছিল। গ্রামবাসীরা শিউরে উঠল। কেউ কেউ মুখ ঢেকে বলল, “তাহলে হরিদাসও একদিন…?” কিন্তু কেউ সাহস পেল না বাক্যটা শেষ করতে।
কমলা এ সব শুনে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। সে নিজের স্বামীকে অচেনা ভাবতে পারছিল না, আবার হরিদাসের নীল চোখের গভীর অদ্ভুত টান তাকে অস্বস্তিতে ভরিয়ে তুলছিল। বুধুর সতর্কবাণী গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়ালেও অনেকে বলল, “না, এটা বুড়োর কুসংস্কার। নদী মানুষকে ফেরায় না—এইসব বাজে গল্প বলে ভয় দেখায়।” কিন্তু যাদের রাতের বেলা নদীর পাড়ে হরিদাসকে ফিসফিস করতে শুনেছে, অচেনা ভাষায় ডাকতে শুনেছে, তারা আর কিছু বলতে পারল না। বুধু মাঝি আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “যদি তোমরা আমার কথা না শোনো, তাহলে সাবধান থেকো। নদী যাকে একবার নিয়ে গেছে, তাকে আর নিজের মতো করে আমাদের মাঝে রাখে না। চোখের ভেতরের নীল আলোটা সেই প্রমাণ। একদিন সে আবার টেনে নিয়ে যাবে, আর সঙ্গে হয়তো আরও কাউকে।” তার এই কথাগুলো গ্রামের বুক কাঁপিয়ে দিল। মানুষজন বুঝে গেল—ঝড়ের রাতে হারিয়ে যাওয়া হরিদাস আসলে কেবল হরিদাস নয়, তার ভেতর নদীর অচেনা অন্ধকারও বসবাস করছে।
অধ্যায় ৭ – কমলার দ্বন্দ্ব
কমলার জীবন হরিদাসের অনুপস্থিতিতে যেন হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, অথচ তার ফিরে আসার পরও সেই শূন্যতা কাটেনি, বরং আরও জটিল রূপ নিয়েছিল। দিনের বেলায় হরিদাস তাকে স্বামীর মতোই পাশে বসে খাওয়ায়, মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে নীরব হাসি দেয়, কিন্তু সেই চোখের নীল আলো কমলার বুক কাঁপিয়ে তোলে। সেই চোখে সে যেন এক অচেনা টান অনুভব করে, যেন গভীর নদীর তলদেশ থেকে কেউ ডাকছে। প্রতিদিন রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে এক ভয় জন্মায়—এ কি সত্যিই তার স্বামী নাকি নদীর ফেরত পাঠানো এক ছায়ামাত্র? সে চুপচাপ স্বামীকে দেখে, তার গায়ের পরিচিত ঘ্রাণ খোঁজে, তার হাতের স্পর্শে আগের উষ্ণতা খোঁজে, কিন্তু কোথাও যেন মিল পায় না। কখনও মনে হয়, সে মানুষটার ভেতরে সত্যিই হরিদাস আছে, আবার হঠাৎ করেই মনে হয়—এই শরীরটা শুধু খোলস, ভেতরে অন্য কেউ বসবাস করছে। এই দ্বন্দ্ব তাকে দিন দিন ভেঙে ফেলতে লাগল।
কমলা মনে মনে বারবার বুধু মাঝির সতর্কবার্তা স্মরণ করছিল—“এ হরিদাস নয়, এ ভাটার শেষে আলো।” কথাগুলো তার কানে বাজতে থাকত যখন সে দেখত, গভীর রাতে হরিদাস ঘুম থেকে উঠে নদীর ধারে চলে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে জলের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁট নড়তে থাকে, অথচ কোনো মানুষে বোঝে না সে কী বলছে। কমলা দূর থেকে তাকে দেখত, বুক কাঁপত, কিন্তু কাছে যেতে পারত না। ভেতরে ভেতরে সে ভয় পেত, যদি সত্যিই তার স্বামী আর মানুষ না থাকে, তবে সে কাকে ভালোবাসছে? তবুও তার মন মানতে চাইত না। সে বারবার নিজেকে বোঝাতে চাইত—না, হরিদাস এখনও বেঁচে আছে, নদী তাকে পুরোপুরি নিতে পারেনি। এই টানাপোড়েনে তার দিন-রাত কেটে যাচ্ছিল। কখনও স্বামীকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করত, আবার কখনও মনে হত তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত। ভালোবাসা আর ভয়ের এই দ্বন্দ্বে কমলা ঘুম হারিয়ে ফেলেছিল, চোখের নিচে কালো দাগ পড়তে শুরু করেছিল।
গ্রামবাসীরাও কমলার এই টানাপোড়েন টের পেত। কেউ কেউ তার পাশে এসে সান্ত্বনা দিত, কেউ বলত স্বামীর যত্ন করো, কেউ আবার কানে কানে বলে যেত—“ও মানুষটা তোমার স্বামী নয়।” এইসব কথায় তার মন আরও ভেঙে যেত। সে চেষ্টা করত স্বামীকে আগের মতো বিশ্বাস করতে, কিন্তু বারবার চোখের সেই নীল আলো তাকে মনে করিয়ে দিত বুধুর সতর্কতা। হরিদাস যখন তার দিকে চেয়ে থাকে, কমলার বুকের ভেতর উষ্ণতা আর শীতল স্রোত বয়ে যেত—যেন সে একসঙ্গে ভালোবাসা আর আতঙ্কের শিকার। তার মনে হত, যদি সে সত্যিই অন্য কেউ হয়ে থাকে, তবে কি তার ভালোবাসা তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? নাকি নদী ইতিমধ্যেই তাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কমলার মন ভেঙে যাচ্ছিল, তবুও একটুখানি আশা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল—হয়তো এখনও কোথাও গভীরে তার হরিদাস বেঁচে আছে, অপেক্ষা করছে মুক্তির।
অধ্যায় ৮ – গ্রামের সিদ্ধান্ত
গ্রামের বাতাসে তখন এক অদ্ভুত অস্থিরতা জমে উঠেছে। হরিদাসের প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই নদী যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে—মাছেরা দলে দলে ভিড় জমাচ্ছে, জালের ফাঁকেও অঢেল ধরা পড়ছে, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীদের মনে ভয়ও বেড়ে চলেছে। রাঘু সরকার, যার চোখ সবসময় সন্দেহ খুঁজে বেড়ায়, সোজাসুজি ঘোষণা করল, “ওকে এ গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। নদী যা একবার কেড়ে নেয়, তাকে আর ফিরিয়ে আনে না। ও ফিরে এসেছে মানে এর ভেতরে কিছু অশুভ আছে।” তার কথায় অনেকেই মাথা নাড়ল। তারা ভয় পাচ্ছিল, যদি হরিদাস সত্যিই অশুভ শক্তির বাহক হয়, তবে একদিন পুরো গ্রাম নদীর অভিশাপে ভেসে যাবে। কিন্তু একইসঙ্গে অনেকে বলল, হরিদাসের চারপাশে যে মাছ ভিড় করে, তা তো আশীর্বাদ ছাড়া কিছু নয়। যেসব পরিবার আগে অভুক্ত থাকত, তারা এখন নদী থেকে প্রচুর মাছ পেয়ে বাজারে বিক্রি করছে, সংসারে স্বস্তি এসেছে। এই সুবিধা তারা সহজে ছাড়তে চাইছিল না। ফলে গ্রামের মধ্যে দুটো দলে বিভক্তি তৈরি হলো—একদল ভয় পেয়ে হরিদাসকে তাড়াতে চাইছিল, আরেকদল লোভে পড়ে তাকে রক্ষা করতে চাইছিল।
এই বিভক্তির মধ্যে আরও এক ধরনের গোপন ফিসফিসানি শুরু হলো। গ্রামের কিছু লোক বিশ্বাস করতে লাগল, হরিদাস কেবল মাছ টানার ক্ষমতাই রাখে না, সে হয়তো নদীর তলদেশে লুকিয়ে থাকা ধনরত্নও বের করতে পারবে। সুন্দরবনের জঙ্গলের ভেতর বহু যুগ ধরে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের গুপ্তধনের কাহিনী তারা বহুবার শুনেছে। কেউ বলল, “যদি ওকে ব্যবহার করা যায়, তবে আমরা নদীর নিচে লুকিয়ে থাকা সোনা-রূপা সব পেয়ে যাব।” এই প্রলোভনে কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ রাঘুর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেল। তারা বলল, “ওকে তাড়ানো যাবে না, বরং আমাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে।” কিন্তু যারা হরিদাসের চোখের নীল আলো দেখেছে, তারা ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল। রাত্রির আঁধারে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হরিদাসের শরীর থেকে যে আলো যেন ছড়িয়ে পড়ত, সেটা কোনো মানুষের নয়, সেটা নদীর অচেনা গভীরতা থেকে উঠে আসা। কমলা নীরবে এই সব শোনে, কিছু বলতে পারে না। তার ভেতর দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে—সে বুঝতে পারে না, মানুষগুলো কেন ভয় না পেয়ে বরং অন্ধ লোভে অশুভ শক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে চাইছে।
শেষমেশ গ্রামের প্রবীণরা একত্র হয়ে বৈঠক ডাকল। বড় বটগাছের তলায় সবাই জড়ো হলো—পুরুষেরা, মহিলারা, এমনকি কিশোররাও। আলোচনার ঝড় উঠল। রাঘু গলা চড়িয়ে বলল, “যতদিন এ গ্রামে থাকবে, ততদিন আমাদের সর্বনাশ হবে। তাড়িয়ে দাও।” আরেকদল পাল্টা বলল, “না, এর মাধ্যমে আমাদের জীবন বদলে গেছে। নদী আমাদের কৃপা দিচ্ছে।” এভাবে দীর্ঘক্ষণ তর্ক চলল। বুধু মাঝি এক কোণে বসে সব শুনছিল, মাঝে মাঝে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল, কিন্তু প্রথমে কিছু বলল না। গ্রাম আস্তে আস্তে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল—বিশ্বাস বনাম ভয়, আশীর্বাদ বনাম অভিশাপ। সেই রাতে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট না হলেও, গ্রামের মাটিতে ফাটল নেমে এলো। সবাই বুঝতে পারল, হরিদাস কেবল একজন মানুষ নয়, সে যেন এক আয়না, যার ভেতরে প্রতিফলিত হচ্ছে মানুষের লোভ, ভয়, আর অন্ধ বিশ্বাস। গ্রামভাগ হয়ে গেল, অথচ নদীর গাঢ় অন্ধকার নীরবে সব শুনে চলল, যেন সময়ের অপেক্ষায় আছে—কবে তার আলো আবার কাউকে টেনে নিয়ে যাবে ভাটার গভীরে।
অধ্যায় ৯ – ভাটার ডাক
সেই রাতটা ছিল অমাবস্যার রাত, চারপাশে ঘন অন্ধকার, শুধু বাতাসের গর্জন আর নদীর স্রোতের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন সুন্দরবনের বুকটা হাহাকার করছে। সবাই ঘরে ঢুকে দরজা-জানালা শক্ত করে আটকে রেখেছিল, কিন্তু নদীর পাড়ে তখনও একটা অদ্ভুত আলো খেলা করছিল। জোয়ার-ভাটার খাঁড়ির গভীর থেকে সেই আলো ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল, কখনও তীব্র হয়ে উঠছিল, আবার কখনও মিলিয়ে যাচ্ছিল। যেন নদীর বুক থেকে কেউ শ্বাস নিচ্ছে আর ছেড়ে দিচ্ছে। হরিদাসের চোখে তখন সেই আলো জ্বলে উঠল আরও উজ্জ্বল হয়ে। সে যেন অচেতনভাবে উঠে দাঁড়াল, কারও ডাকে সাড়া দিচ্ছে এমনভাবে নদীর দিকে হাঁটা শুরু করল। কমলা ভয়ে কেঁপে উঠল, সে তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু তার শরীর থেকে এমন এক শীতল শক্তি বেরোচ্ছিল যে সে কাছে যেতেই পারল না। গ্রামের কয়েকজন যারা দূর থেকে সব দেখছিল, তারা চিৎকার করে উঠল, “আলো ডাক দিচ্ছে! ওকে নিয়ে যাবে!”
হরিদাস খাঁড়ির ধারে পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেল, তার চোখে সেই অদ্ভুত নীল আলো এখন আরও স্পষ্ট। তার শরীর কেঁপে উঠছিল, যেন ভেতর থেকে অন্য কারও শক্তি বেরিয়ে আসছে। সে হাত দুটো আকাশের দিকে তুলল, ঠোঁট নড়তে লাগল, কিন্তু শব্দগুলো কোনো মানুষের ভাষা ছিল না—একটা গভীর জলতলের স্রোতের মতো, যা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নদীর বুক থেকে আলো আরও তীব্র হয়ে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে খাঁড়ির স্রোত যেন তাকে টেনে নিতে লাগল। গ্রামের লোকজন দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে রাখতে চাইলো, কিন্তু কাছে যেতেই তাদের মনে হল যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। হরিদাসের শরীর তখন কাঁপছিল, তার মুখ থেকে অচেনা শব্দ বের হচ্ছিল, আর তার চোখের আলো নদীর আলোর সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছিল। দৃশ্যটা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে অনেকে চিৎকার করে দৌড়ে পালাল।
শেষ মুহূর্তে, হরিদাস যেন পুরোপুরি আলোয় ডুবে গেল। তার শরীর টেনে নিয়ে গেল খাঁড়ির গভীরে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণ পরেই সে আবার পাড়ের উপর পড়ে রইল। সবাই অবাক হয়ে দেখল—সে এখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু তার চোখ বন্ধ, শরীর নিস্তেজ। মনে হচ্ছিল, সে অন্য কোনো জগৎ থেকে ফিরে এসেছে। কেউ কেউ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “নদী ওকে ডাকছিল… কিন্তু এখনও পুরোপুরি নেয়নি।” বুধু মাঝি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “এ নদীর খেলা, আজ ডাক দিয়েছে, কাল হয়তো পুরোপুরি নিয়ে নেবে। ও এখন আর পুরোপুরি আমাদের মাঝে নেই।” গ্রামবাসীর বুক কেঁপে উঠল, কেউ ভয় পেল, কেউ আবার বিশ্বাস করল এ কোনো অলৌকিক শক্তির ইশারা। কিন্তু কমলা, যিনি পুরো ঘটনাটা সামনে থেকে দেখেছিল, বুঝতে পারল—তার স্বামী এখন দুই জগতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, আর যেদিন নদী তাকে সত্যিই ডেকে নেবে, সেদিন আর ফেরত দেবে না।
অধ্যায় ১০ – আলো ও অন্ধকার
সুন্দরবনের আকাশে সেদিন যেন অন্য এক আবহ নেমে এসেছিল। হাওয়ায় কাঁচা নোনাজলের গন্ধ ছড়িয়ে ছিল, খাঁড়ির জলে অচেনা রঙের ঝিলিক কাঁপছিল। হরিদাসকে ঘিরে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছিল, কারও চোখে ভয়, কারও চোখে কৌতূহল। এতদিন যার হাসি, শ্রম, আর মাটির গন্ধে ভরা জীবন তারা দেখেছে, আজ সেই মানুষ যেন আর কেবল মানুষ নেই। কমলা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল, চোখে জল ঝরছিল অথচ ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করছিল—এটা কোনো শেষ নয়, বরং এক অন্য যাত্রার শুরু। হরিদাসের দেহে তখন নীল আলোর ঢেউ উঠছিল, তার মুখে এক অচেনা শান্তি ফুটে উঠেছিল। গ্রামের বৃদ্ধেরা শিউরে উঠছিলেন, ফিসফিস করে বলছিলেন, “এ তো মানুষের শরীর নয়, জলের কোনো দূত।” ঢেউয়ের মত আলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল, যেন অন্ধকার ভেদ করে কিছু জানাতে চাইছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ সাহস করে এগোতে পারছিল না, শুধু বাতাসের ফিসফিস আর হরিদাসের নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছিল সেই রাতের ঘন অন্ধকারে।
ঠিক সেই মুহূর্তে খাঁড়ির ভেতর থেকে জোয়ার-ভাটার গম্ভীর সুর ভেসে এল, যেন অজানা কোনো শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে। হরিদাস একবার চারপাশে তাকাল, তার চোখে স্নেহ আর অনন্তের মায়া ভাসছিল। কমলার সঙ্গে চোখ মেলল সে, আর সে দৃষ্টিতে যেন হাজার কথা লুকিয়ে ছিল। কোনো কথা মুখে না বলেও কমলা বুঝে গেল, এ বিদায় চিরকালের, তবু এর ভেতরে কোনো শূন্যতা নেই—বরং প্রকৃতির গভীরতায় এক মিলন লুকিয়ে আছে। হঠাৎ হরিদাসের শরীর কেঁপে উঠল, আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তারপর মুহূর্তের মধ্যে সে খাঁড়ির জলে মিলিয়ে গেল। গ্রামবাসীরা হতবাক হয়ে দেখল, সেই নীল আলো পানির ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে, ধীরে ধীরে অন্ধকার ভেদ করে জোয়ারের ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কেউ কেঁদে উঠল, কেউ চুপ করে রইল, কিন্তু প্রত্যেকের মনে অদ্ভুত এক শ্রদ্ধা জন্ম নিল। তারা অনুভব করল, মানুষ কেবল মাটি বা মাংসের শরীর নয়, প্রকৃতির রহস্যেরও এক অংশ, যা কখনো আলো হয়ে আবার কখনো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
গ্রামের জীবন আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করল, কিন্তু কোথাও যেন এক অদৃশ্য চিহ্ন রয়ে গেল। কমলা প্রতিদিন ভোরে খাঁড়ির ধারে গিয়ে দাঁড়াত, চোখ মেলে জলের ভেতর তাকাত—কোথাও কি সেই নীল আলো ফুটে ওঠে? মাঝে মাঝে গভীর রাতে গ্রামবাসীরা বলে, তারা জলে আলোর ঝলক দেখে, আর তার সঙ্গে মিশে থাকে হরিদাসের মতো এক সুরেলা কণ্ঠ, যেন জলরাশি তাদের ডাকছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হরিদাস গ্রামে এক কিংবদন্তি হয়ে উঠল—মানুষ নয়, প্রকৃতির দূত। কিন্তু কমলার মনে কখনো দুঃখ নয়, বরং এক তৃপ্তি জন্ম নিল। সে বুঝল, ভালোবাসা মাটির বাঁধনে আটকে থাকে না, জল, আকাশ, আলো আর অন্ধকারের ভেতর দিয়েও তার যাত্রা চলে। হরিদাসের অস্তিত্ব তাই গ্রামবাসীর কাছে হারিয়ে যায়নি, বরং নদীর ঢেউ, বাতাসের গন্ধ আর সুন্দরবনের নীরব জলে সে আজও রয়ে গেছে—এক নীল আলোর মতো, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির রহস্য সবসময় মানুষের হাতের বাইরে, তবু তার ভেতরেই মানুষের শিকড় গভীরভাবে গাঁথা। এভাবেই আলো আর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হরিদাস থেকে যায় চিরন্তন সঙ্গী হয়ে, সুন্দরবনের অন্তরে।
শেষ




