তিথি বসু
পর্ব ১ – আগমন
ভাগীরথীর জলরাশি তখন সোনালি রোদে ঝিকমিক করছে। দূরে গঙ্গার বুকে ভেসে ওঠা এক বিশাল জাহাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে চন্দননগরের ঘাটের দিকে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি, ফরাসিদের বাণিজ্য উপনিবেশ তখন নবীন কিন্তু প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে—তাদের কাছে বিদেশী জাহাজ মানেই নতুন গল্প, নতুন পণ্যের আগমন, আবার ভয়ও—যদি নতুন করে দখলদারি শুরু হয়!
আঁতোয়ান, জাহাজের এক তরুণ ফরাসি সৈনিক, জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো বাংলার মাটিকে দেখছিল। তার চোখে তখন অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি—অপরিচিত ভূমির বিস্ময়, অচেনা মানুষের ভিড়, আর ভেতরে ভেতরে জন্ম নিতে থাকা এক আশঙ্কা। প্যারিসের মৃদু শীতল হাওয়া থেকে এত দূরের এই দেশ—আর্দ্র, গরম, অচেনা গন্ধে ভরা। তবুও অদ্ভুত টান অনুভব করছিল আঁতোয়ান, যেন এই অচেনা নদী, এই অচেনা আকাশ তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ঘাটে পৌঁছতেই কান ফাটানো কোলাহল—হিন্দি, বাংলা, ফরাসি, ইংরেজি—সব মিলিয়ে এক বিচিত্র ভাষার সমাবেশ। ঘাটের পাশে কাঠের দোকানগুলোয় রঙিন কাপড় ঝুলছে, শুঁটকি মাছের তীব্র গন্ধ, মসলার ঝাঁঝালো সুবাস আর মানুষের হাঁকডাক যেন একসঙ্গে মিশে এক অচেনা সুর তৈরি করেছে। আঁতোয়ান সেই সুরে প্রথমবার ভেসে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এ যেন অন্য কোনো পৃথিবী, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি গন্ধ তাকে নতুন করে শেখাবে বেঁচে থাকার অর্থ।
জাহাজ থেকে নামার পর ফরাসি অফিসাররা ব্যস্ত হয়ে গেলেন বন্দরকর্মীদের সঙ্গে হিসাব মেলাতে। বস্তার পর বস্তা মসল্লা, সুতির কাপড়, চিনি, লবঙ্গ, জাফরান—সব নামানো হচ্ছে। আঁতোয়ানকে ডাকা হলো প্রহরীর দায়িত্ব নিতে। কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল ঘাটের ধারে। নদীর ধারে অল্পবয়সী কিছু মেয়ে বসে আছে, তারা রঙিন শাড়ি পরে ঝুড়িভরা পাটিসাপটা, আমসত্ত্ব আর কাপড়ের গাঁটরি বিক্রি করছে। আঁতোয়ানের চোখ হঠাৎ আটকে গেল তাদের মধ্যে এক মেয়ের ওপর।
সে মেয়ে অন্যদের মতো হৈচৈ করছে না। শান্তভাবে বসে আছে, কিন্তু তার চোখ যেন ঝলমল করছে। গায়ের রঙ শ্যামলা, সুতির সাদা শাড়ি পরে আছে, চুল বাঁধা খোঁপা থেকে কিছু গোছা আলগা হয়ে গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার নাম মোহনা—এই মুহূর্তে আঁতোয়ান জানত না, কিন্তু সেই অচেনা মুখই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
আঁতোয়ানের চোখে বিস্ময়ের ছায়া পড়েছিল। এতদিন যাদের শুধু ছবিতে বা কল্পনায় দেখেছে—সেই দূর দেশের নারীর রূপ যেন তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে বুঝতেই পারল না কখন থেকে তার মন মোহনাকে খুঁজতে শুরু করল। মোহনা একবার চোখ তুলে তাকাল, আর আঁতোয়ান থমকে গেল। ভাষার বাধা, সংস্কৃতির দূরত্ব—সবকিছু যেন মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই দৃষ্টির সামনে।
মোহনার বাবা ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। চন্দননগরের বাজারে ইংরেজ আর ফরাসি উভয়ের কাছেই তিনি কাপড় সরবরাহ করতেন। বিদেশীদের সঙ্গে লেনদেন করতে করতে তিনি একটু একটু করে তাদের ভাষা বুঝতে শিখেছিলেন, কিন্তু মেয়েকে কখনও সেই দুনিয়ার সঙ্গে মেলাননি। মোহনার চোখে কৌতূহল ছিল—ফরাসি জাহাজের ঝলমলে পোশাক, উজ্জ্বল তলোয়ার, আর সাদা চামড়ার মানুষদের চলাফেরা তাকে আকর্ষণ করত। তবুও দূরত্ব ছিল স্পষ্ট—তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দেয়াল অটল।
আঁতোয়ান প্রথম দিন থেকেই অনুভব করল, চন্দননগর শুধু বাণিজ্যের জায়গা নয়, এটি এক বিশাল সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র। পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ, ফরাসি—সব জাতির মানুষ এখানে এসেছে নিজেদের ভাগ্য গড়তে। কিন্তু এই ভিড়ের ভেতরেও ভাগীরথীর তীরে বসে থাকা মোহনাকে সে ভুলতে পারছিল না।
রাতে ব্যারাকে ফিরে আঁতোয়ান জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকাল। ভাগীরথীর স্রোত ঝিলমিল করছে চাঁদের আলোয়। তার মনে পড়ছিল মোহনাকে। হয়তো এ কেবল এক কিশোরোচিত আকর্ষণ, হয়তো ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি কৌতূহল। তবুও আঁতোয়ান বুঝতে পারল, সে আর আগের মতো থাকবে না। এই নদী, এই ঘাট, এই মেয়েটি তার ভেতরে নতুন এক সুর জাগিয়ে তুলেছে।
এদিকে মোহনাও ঘরে ফিরে অস্থির হচ্ছিল। ফরাসি সৈনিকটির চোখের দৃষ্টি তাকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছে। সে জানত, এমন সম্পর্ক অসম্ভব, অসম্ভবেরও বেশি বিপজ্জনক। বিদেশীদের সঙ্গে সাধারণ মেয়েদের মেলামেশা সমাজে কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়। তবুও তার মনে হচ্ছিল, সেই দৃষ্টির ভেতরে অচেনা কোনো ডাক আছে, যা তাকে আকর্ষণ করছে।
চন্দননগরের রাত নেমে এল। বন্দরে তখনো আলো জ্বলছে, সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। আঁতোয়ান ঘুমোতে পারল না। সে জানত না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, জানত না তার ভাগ্য কোথায় নিয়ে যাবে তাকে। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—এই ভূমি, এই মানুষ আর বিশেষ করে সেই মেয়ে, মোহনা—তার জীবনের গল্পকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চলেছে।
পর্ব ২ – প্রথম দেখা
ভাগীরথীর ভোরের হাওয়া আলাদা। নৌকোর দাঁড় টানার শব্দ, ভেসে আসা ভেজা মাটির গন্ধ আর বাজারের হাঁকডাকে ঘাটের সকাল যেন একেবারেই নতুন সুরে ভরে ওঠে। সেই সকালে মোহনা বাবার সঙ্গে বেরিয়েছে কাপড় বিক্রি করতে। পাটে বোনা ধুতি, সুতির শাড়ি, কিছু গামছা—বাঁশের ডোলায় গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। এভাবে সে বাবার সঙ্গে বহুবার এসেছে, কিন্তু আজকের সকালটা অন্যরকম লাগছিল। অকারণ এক ধন্দে তার বুক ধুকপুক করছিল, হয়তো আগের দিনের সেই অচেনা চোখের দৃষ্টি তার মনে অশান্তির ঢেউ তুলেছিল।
ঘাটে এসে তারা জায়গা করে বসলো। চারপাশে তখন কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। মাঝিরা জাহাজ থেকে নামানো মালামাল নিয়ে যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা দামাদামিতে ব্যস্ত। ফরাসি জাহাজ থেকে নেমে আসা সৈন্যরা টহল দিচ্ছে—তাদের চকচকে বুট, সোনালি বোতাম লাগানো কোট আর শীতল মুখ দেখে সাধারণ মানুষ দূরেই সরে দাঁড়াচ্ছিল। মোহনার বাবা এদের চেনে। তিনি জানতেন, ব্যবসার স্বার্থে এদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা দরকার। তবুও মনে ভেতর লুকিয়ে রাখা ভয়টা কখনোই কাটত না।
আঁতোয়ান সকালেই দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়েছিল। বন্দরের ভিড় দেখাশোনার অজুহাতে সে প্রায়ই চলে আসত কাপড় ও মসলার দোকানপাটের দিকে। তার চোখ সেদিনও খুঁজে নিল মোহনাকে। দূরে বসে আছে, বাবার পাশে, কিন্তু দৃষ্টি যেন অন্যত্র। আঁতোয়ান নিজের অজান্তেই পা বাড়িয়ে দিল তার দিকে।
মোহনা প্রথমে তাকায়নি। কিন্তু হঠাৎ যখন তার ছায়া এসে পড়ল কাপড়ের গাঁটরির উপর, তখনই চমকে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসি সৈনিককে চিনতে তার সময় লাগল না। সেই চোখ, সেই দৃঢ় দৃষ্টি—এবার একেবারে কাছে। দুজনের চোখ এক মুহূর্তের জন্য এক হয়ে গেল। কোনো ভাষা নেই, কোনো শব্দ নেই—শুধুই নীরব স্রোত।
আঁতোয়ান হঠাৎ করে পকেট থেকে এক ছোট্ট রুমাল বের করল। ফরাসি নকশার সাদা কাপড়, কিনারায় নীল সুতোর কারুকাজ। সে মৃদু হাসি দিয়ে ইশারায় বলল—কাপড় চাই। মোহনা হতবাক হয়ে গেল। সে জানত না কীভাবে উত্তর দেবে। ফরাসি ভাষা সে বোঝে না, ইংরেজিও না। তবে আঁতোয়ানের চোখের ভাষা অচেনা লাগছিল না।
মোহনা রঙিন একটা গামছা এগিয়ে দিল। আঁতোয়ান নিল না। আবার ইশারায় বোঝাল—সে এটা কিনতে চায় না, বরং বদলাতে চায়। নিজের রুমালটা তার হাতে দিল, আর মোহনাকে ইঙ্গিত করল গামছাটা নিতে। বাবার দৃষ্টি তখন অন্যদিকে, কোনো এক গ্রাহকের সঙ্গে দামাদামিতে ব্যস্ত। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মোহনা গামছাটা এগিয়ে দিল আর আঁতোয়ানের রুমালটা নিল। হাত ছোঁয়া লাগল ক্ষণিকের জন্য। অচেনা এক স্রোত বয়ে গেল দুজনের শরীরে।
এমন বিনিময় হয়তো কোনো অর্থ বহন করে না বাইরের দুনিয়ার কাছে। কিন্তু তাদের কাছে এটা এক গোপন সেতুর প্রথম ইট। আঁতোয়ান চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে মৃদু হেসে মাথা নত করল। মোহনার গাল হালকা লাল হয়ে উঠল। তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল—সে বুঝতে পারছিল না কী করে এই অচেনা সৈনিকের হাসি তার ভেতর এত আলোড়ন তুলছে।
দিন গড়াতে থাকল। ব্যবসার ভিড় বেড়ে গেল। কিন্তু মোহনাকে মনে হচ্ছিল, সময় যেন থেমে আছে। সে বারবার রুমালটা আঁকড়ে ধরছিল। নীল কারুকাজ করা কাপড়ের টুকরোটা তার কাছে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠেছে। বাবার চোখ এড়িয়ে সে রুমালটা আঁচলের ভাঁজে লুকিয়ে রাখল।
আঁতোয়ানও সেই দিন ব্যারাকে ফিরে অস্থির হয়ে উঠল। সে জানত, সৈনিকের দায়িত্ব কঠোর—স্থানীয়দের সঙ্গে মেলামেশা সীমিত। তবুও সেই মেয়েটির চোখের ভেতরে সে এক অচেনা শান্তি খুঁজে পেয়েছে। যুদ্ধ, রাজনীতি, উপনিবেশ—সবকিছুর বাইরে এক অন্য জগৎ যেন তার সামনে খুলে যাচ্ছে।
সন্ধ্যায় নদীর ধারে হেঁটে যাচ্ছিল মোহনা। রঙিন শাড়ি পরে সে হাঁটছিল ধীরে ধীরে। আঁচলের ভেতরে লুকোনো রুমালটা তার আঙুলে ছুঁয়ে যাচ্ছিল বারবার। ভাগীরথীর জলে তখন চাঁদের আলো নেচে বেড়াচ্ছে। দূরে ফরাসি জাহাজটা আলোয় ভাসছে। আর সেই আলোতে দাঁড়িয়ে আঁতোয়ানের ছায়া স্পষ্ট হল।
দুজনের চোখ আবার মিলল। এ বার তারা দূর থেকে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো কথা নয়, শুধু দৃষ্টির বিনিময়। আঁতোয়ান মৃদু হাত তুলল অভিবাদনের মতো, মোহনাও নীরবে মাথা নোয়াল। কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো ঘোষণা নেই। তবুও দুজনেই বুঝল—আজকের রাত থেকেই তাদের জীবন অন্য পথে হাঁটতে শুরু করেছে।
কিন্তু ভাগীরথীর স্রোত যেমন কখনো স্থির হয় না, তেমনি এ গল্পও শান্তিতে চলবে না। ঘাটে যে সব দৃষ্টি থাকে, তার মধ্যে অনেকটাই কৌতূহলী, আবার অনেকটাই শত্রুতার। ফরাসি সৈনিকের দিকে তাকানো এক সাধারণ মেয়ের চোখ কি কেউ সহজে মেনে নেবে? ইতিহাস তাদের দুজনের পথে কঠিন বাঁক তৈরি করে রেখেছে, যা তারা তখনো জানত না।
তবে সেই রাতের আকাশ, ভাগীরথীর জলে প্রতিফলিত চাঁদ আর এক টুকরো রুমাল—সবই সাক্ষী রইল তাদের প্রথম দেখা, প্রথম নীরব কথোপকথনের।
পর্ব ৩ – নীরব সেতু
চন্দননগরের দিনগুলো তখন অস্থিরতায় ভরা। ফরাসি অফিসারদের আনাগোনা, ইংরেজদের দৌরাত্ম্য, আর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে প্রতিটি দিন নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে আসে। কিন্তু আঁতোয়ান আর মোহনার কাছে সময় যেন অন্যভাবে বয়ে যাচ্ছিল। তাদের চারপাশে রাজনীতি ও ব্যবসার হিসাব থাকলেও, ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিল এক অদ্ভুত, নীরব সেতু—যা ভাষার বাঁধন মানছিল না।
মোহনা এখন প্রায়ই বাবার সঙ্গে ঘাটে আসে। কাপড় বিক্রি, মসলার দামের আলোচনা—সবকিছুর আড়ালে তার চোখ বারবার খুঁজে বেড়ায় সেই পরিচিত মুখ। আঁতোয়ানও সুযোগ পেলেই টহলের নাম করে ঘাটের ভিড়ে চলে আসে। তার চোখে স্পষ্ট এক তৃষ্ণা—শুধু একবার তাকানো, একবার দেখা।
প্রথম বিনিময়ের পর থেকে তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। কিন্তু সেই রুমালের মতো অমূল্য প্রতীক দুজনের কাছেই লুকানো রত্ন হয়ে আছে। মোহনা প্রতিদিন রাতে আঁচলের ভাঁজ খুলে রুমালটা বের করে। নীল কারুকাজের সুতোর ফাঁক দিয়ে যেন এক অচেনা দেশ, এক অচেনা মানুষ তার সামনে ধরা দেয়।
একদিন সকালে মোহনা বাবার সঙ্গে বাজারে বসেছে। ভিড় তখন একটু কম। আঁতোয়ান সেদিনও এল ঘাটে। তার চোখ খুঁজে নিল মোহনাকে। ভিড়ের মধ্যেই দুজনের চোখ মিলল। এবার আঁতোয়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ইশারায় জিজ্ঞেস করল—ভালো আছো? কোনো শব্দ নেই, শুধু ঠোঁটের নড়াচড়া আর চোখের ভাষা। মোহনা বুঝল না সবটা, তবে মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
আঁতোয়ান এরপর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাঠের টুকরো বের করল। সেটা এক ধরনের খেলনা—ছোট নৌকার আকারে খোদাই করা। সে মোহনাকে ইশারায় দিল। মোহনা বিস্ময়ে তাকাল। চারপাশে কেউ খেয়াল করছে না। সে আলতো করে নৌকাটা নিল। তার মনে হলো, যেন ভাগীরথীর ঢেউ ভেঙে দুজনের মাঝে এক অচেনা সেতু তৈরি হলো।
সেদিন সন্ধ্যায় মোহনা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে খেলনাটা হাতে নিয়ে ভাবছিল। তার মনে হচ্ছিল, অচেনা এক সৈনিকের সঙ্গে তার এত টান কেন? ভাষা তো বোঝে না, ধর্ম আলাদা, সমাজের দেয়াল বিশাল। তবুও সেই চোখের ভেতরে এমন কিছু আছে যা তাকে টানে। হয়তো এটা শুধু কৌতূহল, হয়তো এর ভেতরে প্রেমের শুরু লুকিয়ে আছে।
অন্যদিকে আঁতোয়ানও ভেবেছিল—প্যারিসে তার পরিবার আছে, দূরের দেশে প্রেম নিয়ে ভাবা কি তার কাজ? সে তো এক সৈনিক, দায়িত্ব তার কঠোর। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, যুদ্ধের চেয়ে বড় লড়াই হয়তো মানুষের ভেতরে—নিজেকে সামলানোর লড়াই। মোহনাকে একবার দেখার জন্য তার মন ছটফট করছিল।
দিন কেটে যাচ্ছিল। তাদের এই ইশারার ভাষা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। একদিন মোহনা কাপড় গুছাতে গিয়ে আঁতোয়ানকে ইশারায় বলল—কেন আসো বারবার? আঁতোয়ান ঠোঁট নেড়ে বোঝাল—তোমার জন্য। সে কথা মোহনা পুরোপুরি বুঝল না, কিন্তু চোখের ভেতরে তার অর্থ ধরা দিল। দুজনেই তখন বুঝল, তারা একই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় নদীর ধারে গোপনে দেখা হলো তাদের। মোহনার বাবা তখন অন্য গ্রামে গেছেন কাপড় কিনতে। সুযোগ পেয়ে মোহনা নৌকায় করে ঘাটের পাশে নামল। আঁতোয়ান সেখানে অপেক্ষা করছিল। নদীর হাওয়া বইছিল, আকাশে অর্ধচন্দ্র।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ভাষা না জানার যন্ত্রণা তখন তীব্র। আঁতোয়ান চেষ্টা করল কিছু ফরাসি শব্দ শেখাতে—“আমুর” (amour), “লে কুর” (le cœur)। মোহনা মৃদু হেসে তার বাংলা শব্দ বলল—“প্রেম”, “হৃদয়।” তারা একে অপরের ঠোঁটের নড়াচড়া অনুকরণ করল। বোঝার চেষ্টা করল। হয়তো সঠিক উচ্চারণ হয়নি, তবুও শব্দগুলো যেন সেতু হয়ে উঠল।
মোহনা কচি হাতে মাটিতে আঙুল দিয়ে লিখল বাংলা অক্ষরে—“মো-হ-না।” আঁতোয়ান বিস্ময়ে তাকাল। সে নিজের হাতে মাটিতে লিখল—“Antoine।” অচেনা অক্ষর, অচেনা লিপি, তবুও তাদের চোখে তখন এক অপূর্ব আনন্দ। যেন তারা পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সীমা ভেঙে ফেলেছে।
কিন্তু সেই আনন্দের আড়ালে ভয়ও লুকিয়ে ছিল। মোহনা জানত, যদি কেউ দেখে ফেলে তবে তার সর্বনাশ হবে। আঁতোয়ানও জানত, শাসকরা সৈনিকের এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। তবুও তারা দেখা থামাতে পারল না। ভাগীরথীর তীর হয়ে উঠল তাদের গোপন আশ্রয়।
একদিন ঝড় উঠল নদীতে। আকাশ কালো, বজ্রের গর্জন, ঢেউ উঁচু হয়ে উঠেছে। আঁতোয়ান টহল থেকে ফিরছিল, আর মোহনা কাপড়ের গাঁটরি বাঁচাতে ছুটছিল ঘাট থেকে। হঠাৎ একটা দড়ি ছিঁড়ে গিয়ে ভিড় জমল। মোহনা প্রায় নদীতে পড়ে যাচ্ছিল। আঁতোয়ান ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। মুহূর্তের জন্য তাদের শরীর একে অপরকে আঁকড়ে ধরল। চারপাশের কোলাহল মিলিয়ে গেল। শুধু নদীর গর্জন আর তাদের হৃদয়ের ধুকপুকানি শোনা যাচ্ছিল।
সেদিন রাতে দুজনেই ঘুমোতে পারল না। মোহনা জানল, আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। আঁতোয়ান জানল, এই ভূমি তার কাছে কেবল দায়িত্ব নয়, তার হৃদয়ের ডাকও বটে।
তাদের নীরব সেতু ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছিল—ইশারা, শব্দ, দৃষ্টি, আর স্পর্শের ক্ষণিক অনুভবের ভেতর দিয়ে। তবে ইতিহাসের প্রবল স্রোত কি এত সহজে তাদের টিকে থাকতে দেবে? চারপাশে উপনিবেশের রাজনীতি, ইংরেজদের ষড়যন্ত্র আর সমাজের রোষ জমতে শুরু করেছিল।
কিন্তু সেই মুহূর্তে, ভাগীরথীর জলে চাঁদের আলো ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর তার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছিল দুই অচেনা মানুষের নীরব প্রেম—যা হয়তো কখনো ভাষায় বলা যাবে না, তবুও হৃদয়ে থেকে যাবে অমলিন।
পর্ব ৪ – উপনিবেশের টানাপোড়েন
চন্দননগরের আকাশে তখন অস্থিরতার ছায়া। বছর কয়েক আগেও এ শহর কেবল বাজারের জন্য খ্যাত ছিল—সুতির কাপড়, নীলচাষ, মসল্লা আর গঙ্গার বুকে ভেসে আসা বিদেশি জাহাজের সমাহার। কিন্তু এখন চন্দননগর হয়ে উঠছে এক রাজনৈতিক দাবার বোর্ড। একদিকে ফরাসিরা বাণিজ্যের শক্তি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইংরেজরা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। আর মাঝখানে সাধারণ মানুষ—যাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন প্রতিদিন এই দুই শক্তির টানাপোড়েনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
আঁতোয়ান টহলের সময় টের পাচ্ছিল পরিস্থিতির পরিবর্তন। ফরাসি শিবিরে বারবার বৈঠক হচ্ছে। অফিসাররা নির্দেশ দিচ্ছেন সতর্ক থাকতে। রসদ বাড়ানো হচ্ছে, কামান বসানো হচ্ছে ঘাটে। নদীর ওপারে ইংরেজদের জাহাজও নোঙর ফেলছে। বাতাসে যেন বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, যদিও যুদ্ধের ঢাক তখনো বাজেনি।
এই অস্থিরতার মধ্যে আঁতোয়ান আর মোহনাদের নীরব সেতু আরও ভঙ্গুর হয়ে উঠছিল। তারা যখন নদীর ধারে দেখা করত, চারপাশের টানটান উত্তেজনা যেন তাদের নিঃশ্বাসকে ভারী করে তুলত। কিন্তু আকর্ষণের টান এমন ছিল যে তারা দেখা বন্ধ করতে পারল না।
একদিন সকালে মোহনা বাবার সঙ্গে কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে বসেছিল বাজারে। বাবার মুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি জানতেন, ব্যবসার দিনগুলো কঠিন হয়ে উঠছে। একদিকে ইংরেজরা চাপ দিচ্ছে তাদের কাছ থেকে সরবরাহ নেবার জন্য, অন্যদিকে ফরাসিরা দিচ্ছে আলাদা শর্ত। মাঝখানে পড়ে তিনি বিপদে।
মোহনা বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
— “বাবা, এত চিন্তা করছ কেন?”
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
— “এই শহর তো এখন আর আমাদের মতো সাধারণ ব্যবসায়ীদের জন্য নয়। এখানে এখন কেবল বন্দুক আর কামানের খেলা। আজ যদি ইংরেজরা জেতে, কাল ফরাসিরা। কিন্তু হেরে যায় আমরা—যারা শুধু জীবনটাকে টিকিয়ে রাখতে চাই।”
এই কথাগুলো মোহনাকে ভাবিয়ে তুলল। আঁতোয়ানের কথা মনে পড়ল। সে কি জানে এই সব হিসাবের বাইরে মানুষের দুঃখকষ্ট? তার চোখে যে কোমলতা মোহনা দেখেছে, সেটা কি যুদ্ধের আগুনে টিকতে পারবে?
এদিকে আঁতোয়ানকেও শোনানো হচ্ছিল অন্য গল্প। অফিসাররা বলছিলেন—ইংরেজরা শত্রু, তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনেকেই ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে, তাই কারো উপর বিশ্বাস করা যাবে না। কিন্তু আঁতোয়ানের মনে হচ্ছিল, সব মানুষ কি এক? মোহনার পরিবারের মতো সাধারণ মানুষ কি আসলেই শত্রু?
সন্ধ্যায় তারা নদীর ধারে দেখা করল। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দুজনেই চুপচাপ তাকাল একে অপরের দিকে। আঁতোয়ানের চোখে স্পষ্ট উৎকণ্ঠা। ইশারায় বোঝাল—যুদ্ধ আসছে। মোহনা ভয় পেল। সে ঠোঁটে মৃদু কাঁপা স্বরে বলল, “যুদ্ধ মানে মৃত্যু।” আঁতোয়ান বাংলা বোঝেনি, কিন্তু তার চোখ বুঝে নিয়েছিল সেই ভয়ের ভাষা।
সেদিন তারা খুব বেশি কথা বলতে পারেনি। শুধু হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। মোহনাকে মনে হচ্ছিল, নদীর স্রোতের মতো তার জীবনও ভেসে যাচ্ছে অচেনা দিকে। আঁতোয়ানের হাতের দৃঢ় চাপ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, কিন্তু সেই সান্ত্বনার আড়ালে লুকিয়ে ছিল আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত।
পরদিন ঘাটে একটা অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটল। মোহনার ভাই রঘু কাপড় নিয়ে আসছিল বাজারে। সে হঠাৎ আঁতোয়ানকে মোহনাকে দেখছে টের পেল। দূর থেকে সে লক্ষ করল, তাদের চোখের বিনিময় অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ। রঘুর মনে সন্দেহ জাগল। সে সরাসরি কিছু বলল না, কিন্তু চোখে রাগ জমে উঠল।
বাড়ি ফিরে রঘু বোনকে প্রশ্ন করল,
— “ও ফরাসি সৈনিককে তুমি কেন বারবার দেখছ?”
মোহনা চমকে উঠল। উত্তর খুঁজে পেল না। শুধু বলল, “তুমি ভুল দেখেছ।”
কিন্তু রঘু বিশ্বাস করল না। সে সতর্ক করল,
— “বিদেশীরা আমাদের কেউ নয়। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে। তুমি যদি এদের সঙ্গে মেশো, আমাদের পরিবারের মান ইজ্জত সব মাটিতে মিশে যাবে।”
মোহনার বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, ভাই যা বলছে তা সমাজের সত্যি। কিন্তু তার হৃদয়ের সত্যি অন্যকিছু। আঁতোয়ানের চোখে যে নির্ভেজাল আকর্ষণ, সেটা কি মিথ্যে হতে পারে?
এদিকে আঁতোয়ানকেও সতর্ক করা হলো। এক অফিসার তাকে বলল,
— “আমরা জানি স্থানীয় মেয়েরা অনেক সময় গুপ্তচরের কাজ করে। তাদের থেকে দূরে থাকো।”
আঁতোয়ান মাথা নোয়াল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতিজ্ঞা করল—যা-ই হোক, সে মোহনাকে ছেড়ে যাবে না।
চন্দননগরের রাস্তায় তখন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে—ইংরেজরা শিগগিরই আক্রমণ করবে। দোকানপাটে অস্থিরতা, মানুষের চোখে ভয়। নদীর জলে নোঙর ফেলা জাহাজগুলো যেন অপেক্ষা করছে যুদ্ধের সংকেতের জন্য।
এই সব অস্থিরতার মাঝেই আঁতোয়ান আর মোহনার প্রেম আরও গভীর হচ্ছিল, যদিও প্রতিটি সাক্ষাৎ হয়ে উঠছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তারা জানত, সমাজ বা রাজনীতি তাদের মেনে নেবে না। তবুও তাদের হৃদয় বারবার টেনে নিচ্ছিল একে অপরের দিকে।
এক রাতে, যখন পুরো শহর নিস্তব্ধ, আঁতোয়ান শিবির থেকে বেরিয়ে এল। নদীর ধারে গিয়ে দেখল, মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তার মুখ উজ্জ্বল, চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ। আঁতোয়ান ধীরে এগিয়ে এসে বলল কয়েকটা ফরাসি শব্দ—“নে পা প্যুর” (ভয় পেও না)। মোহনা বুঝল না, কিন্তু তার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমি ভয় পাই না, যদি তুমি থাকো।”
তাদের কথা হয়তো আলাদা ভাষায়, কিন্তু হৃদয়ের সেতু তখন দৃঢ় হয়ে উঠছিল। ভাগীরথীর স্রোতের মতো অদম্য এক শক্তি তাদের একে অপরের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু দূরে, নদীর ওপারে, ইংরেজ জাহাজের আলো জ্বলছিল। কামানের মুখ ঘুরিয়ে রাখা হয়েছে শহরের দিকে। শিগগিরই যুদ্ধ নামবে, আর সেই যুদ্ধের আগুনে কি টিকতে পারবে এই প্রেম?
পর্ব ৫ – প্রকাশ
ভাগীরথীর ঢেউ যেন সেদিন অস্বাভাবিকভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিল। আকাশে মেঘ জমে আছে, বাতাসে ভিজে ধুলো, মানুষের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। চন্দননগরের রাস্তায় তখন কানাঘুষো—ইংরেজরা যে কোনো দিন আক্রমণ চালাবে। ফরাসি শিবিরে টহল কড়া হচ্ছে, কামান ঘাটের দিকে তাক করা। এই অস্থিরতার মাঝেই আঁতোয়ান আর মোহনাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভেতরে ভেতরে বেড়ে উঠছিল, কিন্তু সময় যেন তাদের দিকে ক্রমশ বিরূপ হয়ে উঠছিল।
সেই সন্ধ্যায় মোহনা কাপড় বিক্রি সেরে ঘরে ফিরছিল। আঁচলের ভাঁজে লুকানো খেলনা নৌকাটা বারবার তার হাতে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, আঁতোয়ান যেন তার সঙ্গেই হাঁটছে। হঠাৎই পিছন থেকে ডেকে উঠল তার ভাই রঘু।
— “দিদি, দাঁড়াও!”
মোহনা থমকে দাঁড়াল। রঘুর চোখে সন্দেহ ঝলকাচ্ছে। সে লক্ষ্য করেছে বারবার ফরাসি সৈনিকের সঙ্গে বোনের দৃষ্টি বিনিময়, গোপন ইশারা। রঘুর রাগ তখন আড়াল করা যাচ্ছে না।
— “তুমি কি ভেবেছ আমরা কিছু বুঝি না? ও ফরাসি সৈনিকের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?”
মোহনা প্রথমে কিছু বলতে পারল না। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে জানত, পরিবারের সামনে সত্যি প্রকাশ পেলে সব শেষ হয়ে যাবে। তবুও তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল ভাঙা গলায়—
— “আমার কোনো দোষ নেই, ভাই। আমি কিছু চাইনি… কেবল…”
রঘু কঠিন কণ্ঠে বলল,
— “কেবল কী? ওরা বিদেশি। তারা আমাদের মাটি, আমাদের রক্ত কিছু বোঝে না। তারা আমাদের ব্যবহার করে, আর তুই… তুই তাদের কাছে মাথা নোয়াতে চাইছিস?”
মোহনার চোখে জল চলে এল। সে বলল না যে আঁতোয়ানের চোখে সে কখনো দখল বা ব্যবহার দেখেনি। সেখানে ছিল কেবল এক অচেনা কোমলতা। কিন্তু সেই সত্যি বললেও কি রঘু বিশ্বাস করত?
পরদিন সকালে বাবার কাছে খবর পৌঁছে গেল। রঘু সব খুলে বলল না, তবে ইঙ্গিত দিল—বোনের আচরণ সন্দেহজনক। বাবা মুখ গম্ভীর করে মোহনাকে ডাকলেন।
— “তুই কি সত্যিই ওদের সঙ্গে মেশছিস? জানিস না, বিদেশীদের সঙ্গে নাম জড়ালে মেয়ের ইজ্জত মাটিতে মিশে যায়?”
মোহনা চোখ নামিয়ে রাখল। বাবার কণ্ঠে হতাশা আর ভয়। তিনি জানতেন, চারদিকে নজরদারি আছে। যদি ফরাসি সৈন্যের সঙ্গে মেয়ের নাম জড়িয়ে যায়, তবে ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সমাজও কলঙ্ক ছুঁড়ে দেবে।
মোহনা চুপ করে থাকল। তার নীরবতাই হয়ে উঠল অস্বীকারহীন স্বীকারোক্তি। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
— “এই সম্পর্ক তুই আজই শেষ করবি। আর যদি না করিস, তবে তোর মুখ আমার আর দেখা হবে না।”
সেই রাতে মোহনা বিছানায় শুয়ে কাঁদছিল। আঁচলের ভাঁজ থেকে বের করল নীল কারুকাজ করা রুমাল আর ছোট কাঠের নৌকা। তার বুকের ভেতর যেন ভেঙে যাচ্ছিল সব। কিন্তু মন জানত, আঁতোয়ানের কাছে সে যতটা সত্যি খুঁজে পেয়েছে, তা কোনোদিন কারও কাছে পায়নি।
অন্যদিকে আঁতোয়ানও বিপদে পড়েছিল। শিবিরে এক সহসৈনিক তাকে প্রশ্ন করেছিল,
— “তুমি কি স্থানীয় মেয়েটিকে প্রায়ই দেখছ না? সাবধান হও। ইংরেজদের গুপ্তচর হতে পারে।”
আঁতোয়ান কিছু বলেনি। শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, মোহনাকে একবার দেখেই সে সব খুলে বলবে।
কিন্তু দেখা করা এখন বিপজ্জনক। রঘুর চোখে সন্দেহ, বাবার রোষ, শিবিরে নজরদারি—সব মিলিয়ে পথ বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও তারা থামতে পারল না।
এক সন্ধ্যায় মোহনা সাহস করে নদীর ধারে এল। আকাশে তখন অর্ধচন্দ্র, বাতাসে উত্তেজনা। আঁতোয়ান অপেক্ষা করছিল। মোহনাকে দেখে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মোহনার চোখে জল।
— “আমরা ধরা পড়ে গেছি,” মোহনা বাংলায় বলল, যদিও আঁতোয়ান শব্দ বুঝল না। কিন্তু তার চোখ, কাঁপা ঠোঁট সবই ভাষা হয়ে দাঁড়াল। আঁতোয়ান হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল।
ইশারায় বোঝাল—“আমি আছি, ভয় কোরো না।”
তাদের এই গোপন দেখা অজান্তে কারও চোখ এড়াল না। দূর থেকে রঘু সব দেখছিল। রাগে তার হাত কাঁপছিল। সে জানল, আজ আর চুপ থাকা যাবে না। পরিবার, সমাজ, এমনকি নিজের মান রাখতে হলে এই সম্পর্ক ভাঙতেই হবে।
পরদিন ঘরে প্রচণ্ড ঝড় উঠল। রঘু সবার সামনে মোহনাকে আঙুল তুলে বলল,
— “ও ফরাসি সৈনিকের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আমি নিজের চোখে দেখেছি। তুমি কি অস্বীকার করবে?”
বাবার মুখ অগ্নিদীপ্ত হয়ে উঠল। মা হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। মোহনা চোখ নামাল। তার ঠোঁট নড়ল না। নীরবতাই যেন সব বলে দিল।
বাবা গর্জে উঠলেন,
— “আজ থেকে তুই ঘাটে যাবি না। ব্যবসার কাজ থেকে তোর নাম কেটে দিলাম। আর যদি ও ফরাসি সৈন্যকে একবারও দেখি তোর আশেপাশে, তবে শপথ করছি, তোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।”
মোহনার বুক বিদীর্ণ হলো। নিজের পরিবারের এই রোষ সে আগে কখনো দেখেনি। সে জানত, এখন আঁতোয়ানের কাছে যাওয়া মানে সবকিছু হারানো। কিন্তু তার হৃদয় কি এভাবে দূরে সরে যেতে পারবে?
সেই রাতেই মোহনা ভাগীরথীর ধারে গেল। আঁতোয়ান সেখানে অপেক্ষা করছিল। দুজনের চোখে তখন অসহায়তা। মোহনা ভাঙা গলায় বলল,
— “সব শেষ হয়ে গেছে।”
আঁতোয়ান বুঝল না শব্দ, কিন্তু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলকণাই তাকে বলে দিল সত্যি। সে মৃদু হাতে মোহনাকে বুকে টেনে নিল।
নদীর জলে প্রতিফলিত হলো দুজনের ছায়া। একদিকে যুদ্ধের হুমকি, অন্যদিকে পরিবারের রোষ। তাদের প্রেম এখন প্রকাশিত, আর সেই প্রকাশই হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় বিপদ।
ভাগীরথীর ঢেউ যেন জানত—এ প্রেমের পথ কেবল কাঁটায় ভরা। তবুও সেই রাতের আকাশ সাক্ষী রইল, দুটি হৃদয় একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে, যতই পৃথিবী তাদের আলাদা করতে চায় না কেন।
পর্ব ৬ – বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া
চন্দননগরের আকাশে তখন অদ্ভুত অস্বস্তি। দিনভর বাজারের কোলাহল থাকলেও বাতাসে চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল। শহরের মানুষজন জানত, ইংরেজ আর ফরাসিদের দ্বন্দ্ব যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে। ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে ভাগীরথীর জলরাশির দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল, নদীও যেন অস্থির—ঢেউগুলো বাড়তি জোরে আছড়ে পড়ছে, বাতাস কাঁপছে অদৃশ্য কোনো অশুভ শক্তিতে।
আঁতোয়ানের শিবিরে গত ক’দিন ধরে বৈঠক লেগেই আছে। অফিসাররা কড়া কণ্ঠে নির্দেশ দিচ্ছেন—সতর্ক থাকতে হবে, অস্ত্র সবসময় প্রস্তুত রাখতে হবে। খবর এসেছে, ইংরেজরা গোপনে নদীপথে তাদের জাহাজ নিয়ে আসছে, আক্রমণের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। আঁতোয়ান সৈনিকের শপথে বাঁধা, তাই সব কথা বাইরে বলা তার নিষেধ। কিন্তু মোহনাকে মনে পড়লেই বুক কেঁপে উঠছিল। যুদ্ধ নামলে প্রথম আঘাত পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর—তাদেরই ঘরবাড়ি জ্বলবে, তাদেরই প্রাণ যাবে।
এক রাতে আঁতোয়ান দায়িত্বে থেকে শুনে ফেলল এক গোপন আলোচনা। দু’জন অফিসার চাপা গলায় বলছিলেন,
— “ইংরেজরা নাকি আমাদেরই ভেতরের কিছু লোক কিনে নিয়েছে। ভোররাতে আক্রমণ হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।”
অন্যজন উত্তর দিল,
— “শত্রু আমাদের মধ্যে আছে। বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া সর্বত্র।”
এই কথাগুলো আঁতোয়ানের কানে বাজতে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, ভেতর থেকে ভেঙে গেলে কোনো দুর্গই টিকবে না। অথচ কারা বিশ্বাসঘাতক—সেটা জানা নেই।
পরদিন টহলের অজুহাতে সে ঘাটে গেল। মোহনা তখন সেখানে নেই, কিন্তু দূরে কাপড়ের দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল রঘু। আঁতোয়ান তাকে দেখে মাথা নোয়াল, কিন্তু রঘুর চোখে কেবল ঘৃণা। সেই দৃষ্টি আঁতোয়ানের বুক ঠান্ডা করে দিল। সে বুঝল, মোহনাকে ঘিরে বিপদ আরও ঘন হচ্ছে।
সন্ধ্যায় মোহনা গোপনে নদীর ধারে এলো। আঁতোয়ান তাকে দেখে এগিয়ে গেল। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। আঁতোয়ান ইশারায় বোঝাল—“যুদ্ধ আসছে।” তার চোখে স্পষ্ট ভয়। মোহনা মৃদু কণ্ঠে বলল,
— “আমি জানি। শহরের সব মানুষই জানে।”
আঁতোয়ান বোঝাতে চাইল, শুধু যুদ্ধ নয়, ভেতরে ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতাও আছে। কিন্তু ভাষার সীমা তাকে থামিয়ে দিল। সে কেবল হাত দিয়ে বুকের ওপর ক্রস চিহ্ন আঁকল আর মাথা নাড়ল। মোহনা এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর ফিসফিস করে বলল,
— “তুমি আমাকে মিথ্যে বলছ না, আমি জানি।”
তাদের নীরব বিশ্বাস যেন আরও শক্ত হয়ে উঠল। তবুও আশঙ্কার ছায়া চারপাশে ঘন হয়ে আসছিল।
কয়েকদিন পরে এক ঘটনা ঘটল। রাতের বেলা শিবিরে পাহারা দিচ্ছিল আঁতোয়ান। হঠাৎ দেখল, এক অপরিচিত ছায়া ঘাপটি মেরে ঘাটের দিকে যাচ্ছে। সে চুপিসারে পিছু নিল। দেখল, সেই লোক ফরাসি শিবিরের ভেতর থেকে গোপন নকশা আর চিঠি বের করে নদীর ধারে কারও হাতে দিচ্ছে। দূর থেকে আঁতোয়ান বুঝতে পারল না কারা তারা, তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না—ইংরেজদেরই লোক।
সে চিৎকার করে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু তখনই কেউ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেল ঝোপের আড়ালে। মুষ্টির আঘাতে আঁতোয়ানের মাথা ঘুরে গেল। অচেতন হওয়ার আগে কেবল শুনল একটা কণ্ঠস্বর—“চুপ থাকো, নয়তো মরবে।”
অচেতন অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। জ্ঞান ফিরে পেল ভোরে। সহযোদ্ধারা তাকে খুঁজে পেয়ে শিবিরে নিয়ে এলো। অফিসাররা তাকে কঠোর জেরা করলেন—
— “তুমি সেখানে কী করছিলে? কেন একা গিয়েছিলে?”
আঁতোয়ান সব বলল—সে গুপ্তচর ধরতে গিয়েছিল। কিন্তু অফিসাররা বিশ্বাস করল না। কেউ কেউ সন্দেহ করল, আঁতোয়ানই হয়তো বিশ্বাসঘাতক।
সেই রাতে আঁতোয়ান একেবারে ভেঙে পড়ল। নিজের সহযোদ্ধারাই যখন বিশ্বাস করছে না, তখন সে কী করবে? তার মনে পড়ল কেবল মোহনাকে। যদি তার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারে, তবে হয়তো কিছুটা শক্তি পাবে।
কিন্তু মোহনাও তখন ভীষণ সংকটে। পরিবারের চাপ চরমে উঠেছে। রঘু তাকে বারবার বলছে—“ও সৈনিকের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ কর। না হলে আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।” বাবাও কঠিন কণ্ঠে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু মোহনার বুকের ভেতর অন্য যুদ্ধ চলছে। আঁতোয়ানকে ছাড়া সে এক মুহূর্ত ভাবতে পারছে না।
অবশেষে সেই রাতে, সব নিষেধ অমান্য করে, মোহনা নদীর ধারে এলো। আঁতোয়ান তখনো মাথায় আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে মোহনা ছুটে এসে হাত ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “তোমাকে কী করেছে?”
আঁতোয়ান কিছু বলতে পারল না। শুধু তার হাত ধরে চোখ ভরে তাকাল। ইশারায় বোঝাল—“আমার ওপরও বিশ্বাস নেই আর। শিবির আমাকে বিশ্বাস করছে না।”
মোহনার চোখে জল এসে গেল। সে মৃদু গলায় বলল,
— “তারা তোমাকে না মানলেও আমি মানি। তোমার চোখে মিথ্যে দেখি না।”
সেই মুহূর্তে আঁতোয়ানের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। হয়তো যুদ্ধের আগুন, বিশ্বাসঘাতকের ছায়া, পরিবার-সমাজের রোষ—সব মিলিয়ে তাদের ঘিরে অন্ধকার নামছে। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেও মোহনাই তার একমাত্র আলো।
তাদের দেখা শেষ হলো চুপিসারে। দূরে তখন কামানের চাকা টেনে আনা হচ্ছে, সৈন্যরা প্রস্তুত হচ্ছে। আকাশে ঝড়ের গর্জন, নদীতে অশান্ত ঢেউ। সবকিছুই যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে—বড় কোনো বিপর্যয় আসছে।
আঁতোয়ান ফিরে গেল শিবিরে, মোহনা ফিরে গেল ঘরে। কিন্তু দুজনের মনেই তখন এক কথাই ঘুরছিল—বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া শুধু শিবিরে নয়, তাদের প্রেমের ওপরও নেমে এসেছে।
পর্ব ৭ – যুদ্ধের আগুন
চন্দননগরের ভোরটা সেদিন ছিল অস্বাভাবিক নীরব। ভাগীরথীর জল যেন চাপা উত্তেজনায় থমকে আছে, আকাশে মেঘ জমে গিয়েছে। বাজারে স্বাভাবিক কোলাহল নেই, দোকানিরা তড়িঘড়ি করে মালপত্র গুটিয়ে রাখছে, ঘাটে নৌকা টেনে আনা হচ্ছে। সবাই জানে, বড় কিছু ঘটতে চলেছে। মানুষের চোখেমুখে ভয়, শিশুদের কান্না, মহিলাদের ব্যস্ত পা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত গুমোট বাতাস শহরটাকে ঘিরে রেখেছিল।
আঁতোয়ান আগের রাতেই বুঝেছিল, ইংরেজরা দেরি করবে না। তাদের জাহাজ নদীতে নোঙর ফেলে প্রস্তুত, সৈন্যরা গোপনে মাটির ভেতরে পা বাড়িয়েছে। আর ফরাসিদের ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহ পুরো শিবিরকে টলমল করে দিয়েছে। আঁতোয়ানকে সন্দেহ করা হয়েছে, কিন্তু তবুও তাকে পাহারায় রাখা হলো—কারণ যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিটি হাত দরকার হবে।
সূর্য ওঠার পর হঠাৎ করেই আকাশ কেঁপে উঠল। প্রবল শব্দে কাঁপল ভূমি। ইংরেজদের কামান থেকে ছোড়া প্রথম গোলা এসে পড়ল চন্দননগরের ধারে। মুহূর্তের মধ্যেই ধুলো-ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে গেল। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ল, মানুষ দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগল। শিশুদের চিৎকার, মায়েদের আর্তনাদ মিশে গেল কামানের বজ্রধ্বনির সঙ্গে।
আঁতোয়ান তখন বন্দুক হাতে ছুটছিল প্রাচীরের দিকে। তার চোখে ভেসে উঠছিল শুধু এক মুখ—মোহনা। যুদ্ধ মানে কর্তব্য, কিন্তু তার হৃদয় চিৎকার করছিল—মোহনাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু সৈনিক হিসেবে সে প্রথমেই বাধ্য হলো আদেশ মানতে। ফরাসি অফিসাররা চেঁচিয়ে বলছিলেন,
— “প্রতিরোধ করো! গঙ্গার ওপরের সেতু রক্ষা করো!”
ইংরেজ জাহাজ থেকে একের পর এক গোলা ছোড়া হচ্ছিল। ঘাটের ধারে বাজার ভস্মীভূত হয়ে গেল। মসলার দোকান, কাপড়ের দোকান, কাঠের ঘর—সব ছাই হয়ে গেল মুহূর্তে। ধোঁয়ার ভেতর মানুষ দৌড়াচ্ছে, কেউ নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে, কেউ দগ্ধ শরীর নিয়ে ছুটছে।
মোহনা আর তার পরিবার তখন আতঙ্কে ঘরে বসে ছিল। রঘু জানালা দিয়ে দেখল দূরে ধোঁয়া উড়ছে। সে চিৎকার করে বলল,
— “চলো, আমাদের বেরোতে হবে। ঘরে থাকলে মরব।”
বাবা কাপড়ের গাঁটরি ধরতে চাইলে রঘু তাকে থামাল,
— “এখন মালপত্রের কথা ভেবে লাভ নেই। প্রাণটাই বড়।”
মোহনার বুক কাঁপছিল। তার কানে কেবল বাজছিল কামানের শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ। কিন্তু চোখ বারবার খুঁজছিল আঁতোয়ানকে। সে জানত, এই আগুনের মাঝেই কোথাও সে লড়ছে।
আঁতোয়ান প্রাচীর থেকে নেমে যখন শহরের দিকে এগোল, তখন তার চোখে ভেসে উঠল ভস্মস্তূপ। চারপাশে দগ্ধ দেহ পড়ে আছে, ঘরবাড়ি জ্বলছে। সেই ধোঁয়ার ভেতর হঠাৎই সে দেখল মোহনাকে। তার পরিবার নিয়ে ভিড় ঠেলে বেরোচ্ছে। আঁতোয়ানের বুক হঠাৎ করে হালকা হয়ে উঠল—সে বেঁচে আছে।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই আবার গোলা পড়ল। এক প্রবল বিস্ফোরণে মাটিতে ছিটকে পড়ল মোহনা। আঁতোয়ান দৌড়ে গেল। ধুলো আর ধোঁয়ার ভেতর সে তাকে টেনে তুলল। মোহনা অচেতন নয়, কিন্তু ভয় আর ধাক্কায় কাঁপছে। আঁতোয়ান ইশারায় বলল—“চলো, আমার সঙ্গে।”
মোহনার চোখে তখন জল। সে ঠোঁট নেড়ে বলল, “আমার পরিবার?” আঁতোয়ান তাকিয়ে দেখল, রঘু আর তাদের বাবা-মা ভিড়ের মধ্যে লড়াই করছে বেরোবার জন্য। আঁতোয়ান ইশারায় বোঝাল—“ওরা বেরিয়ে যাবে, তুমি এখন আমার সঙ্গে এসো।”
কিন্তু তখনই রঘুর চোখে পড়ল আঁতোয়ান তার বোনকে ধরে আছে। রাগে উন্মত্ত হয়ে রঘু চিৎকার করল,
— “তুই বোনকে ছাড়! আমাদের সর্বনাশ করে এবার মরতে আসছিস?”
মোহনা চিৎকার করে বলল, “না ভাই, ও আমাকে বাঁচাচ্ছে!”
কিন্তু রঘু শুনল না। সে ছুটে গিয়ে আঁতোয়ানকে ধাক্কা দিল। আঁতোয়ান পড়ে গেল মাটিতে। মুহূর্তের মধ্যে গোলার শব্দ আবার আকাশ কাঁপাল। বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ল কাছের একটা ঘর। ধুলো আর আগুনের ভেতর দিশেহারা হয়ে গেল সবাই।
আঁতোয়ান আবার উঠে দাঁড়াল। মোহনা তার হাত ধরল। রঘু তখনও দাঁড়িয়ে, চোখে ঘৃণা আর আতঙ্ক। আঁতোয়ান বুঝল, এ মুহূর্তে রঘুকে বোঝানো সম্ভব নয়। সে কেবল মোহনাকে বাঁচাতেই মরিয়া।
শহর তখন আগুনে ভস্মীভূত। চারপাশে দৌড়াচ্ছে মানুষ, কাঁদছে বাচ্চারা, ঘর জ্বলছে। কামানের বজ্রধ্বনি আকাশ কাঁপাচ্ছে। ভাগীরথীর জলে ভেসে উঠছে জাহাজের আগুন।
আঁতোয়ান মোহনাকে টেনে নিয়ে গেল এক ভাঙা দেয়ালের আড়ালে। দুজনেই হাঁপাচ্ছিল। আঁতোয়ান ইশারায় বলল—“ভয় পেও না, আমি আছি।” মোহনা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি থাকলেও যুদ্ধ আমাদের বাঁচাবে না।”
তাদের চোখে তখন কেবল আতঙ্ক আর প্রেমের মিশ্র রং। চারপাশে মৃত্যু নেমে আসছে, কিন্তু তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে।
রাত নেমে এলে শহরটা হয়ে গেল ধ্বংসস্তূপ। ফরাসিরা প্রতিরোধ করলেও ইংরেজদের গোলাবর্ষণ থামল না। জাহাজের কামান থেকে আগুনের গোলা আসতেই থাকল। মানুষ পালিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের দিকে।
আঁতোয়ান জানত, এ যুদ্ধের ফল ভীষণ ভয়াবহ হবে। হয়তো ফরাসিরা হারবে, হয়তো বন্দি হতে হবে তাকে। কিন্তু তার চোখে তখন একটাই প্রতিজ্ঞা—যতক্ষণ বাঁচে, মোহনাকে রক্ষা করবে।
মোহনা জানত, আঁতোয়ানকে আঁকড়ে ধরা মানেই পরিবার থেকে দূরে সরে যাওয়া। রঘু হয়তো আর তাকে বোন মেনে নেবে না। কিন্তু কামানের আগুনের ভেতর সে স্পষ্ট দেখেছিল—ওই সৈনিকই তার আশ্রয়, তার জীবনের আলো।
ভাগীরথীর ঢেউ তখন আগুনের প্রতিফলনে লাল হয়ে উঠেছিল। সেই আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে দুজনের হাত এক হয়ে গেল। শহর ভস্মীভূত হলেও, তাদের হৃদয়ের আগুন আরও জ্বলে উঠল—যুদ্ধের আগুনের মাঝেই জন্ম নিল এক অনিশ্চিত, কিন্তু অটল প্রেম।
পর্ব ৮ – খোঁজ
চন্দননগর আর আগের মতো নেই। যুদ্ধের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে শহরের প্রাণ। বাজারের কাঠের ঘরগুলো ছাই হয়ে মাটিতে লুটিয়ে আছে, কাপড়ের দোকানগুলো পুড়ে ছাই, নদীর ধারে যে গুদামঘরগুলো একসময় মসলার গন্ধে ভরে থাকত সেখানে এখন শুধু ধোঁয়ার গন্ধ আর পুড়ে যাওয়া কাঠের কঙ্কাল। ভাগীরথীর জলে ভাসছে ভাঙা নৌকা, কখনো কখনো ভেসে আসছে নিথর দেহ।
মোহনা সেই ভস্মস্তূপের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে তখন কেবল একটিই লক্ষ্য—আঁতোয়ানকে খুঁজে পাওয়া। যুদ্ধের রাতের পর থেকে আঁতোয়ানকে সে আর দেখেনি। শেষ মুহূর্তে তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিল, কিন্তু বিস্ফোরণের ঝাঁকুনিতে ছিটকে গিয়েছিল দুজন। চারদিকে কোলাহল, মানুষ দৌড়াচ্ছিল প্রাণ বাঁচাতে, আর সেই বিশৃঙ্খলার ভেতরে হারিয়ে গিয়েছিল আঁতোয়ান।
মোহনা তার ভাই রঘু বা পরিবারের কাছে কিছু বলেনি। তারা ভেবেছে সে কেবল ঘরের নিরাপত্তার খোঁজ করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, তার খোঁজ অন্য কারও জন্য। সে ধুলো, ধোঁয়া আর রক্তমাখা রাস্তায় ছুটে বেড়াচ্ছিল, যেন অন্ধকারের ভেতর আলো খুঁজছে।
এক ভাঙা প্রাচীরের ধারে গিয়ে সে দেখল কিছু ফরাসি সৈন্য আহত হয়ে পড়ে আছে। কেউ কাতরাচ্ছে, কেউ নিথর। তাদের মধ্যে আঁতোয়ান নেই। মোহনার বুক কেঁপে উঠল। সে ভাবল, হয়তো দেরি হয়ে গেছে।
ঠিক তখনই দূরে শোনা গেল এক তীব্র চিৎকার। সে দৌড়ে গিয়ে দেখল, কয়েকজন ইংরেজ সৈন্য বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে কিছু ফরাসি সৈন্যকে। বাঁধা হাত, মাথা নিচু, কাদামাখা মুখ—তাদের মধ্যে হঠাৎই চোখে পড়ল আঁতোয়ানকে।
মোহনার বুক থেকে যেন হাওয়াটা বেরিয়ে গেল। সে প্রায় ছুটে গেল তাদের দিকে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াল। ইংরেজ সৈন্যরা বন্দুক তাক করে নিয়ে যাচ্ছে বন্দিদের। এ অবস্থায় এগোনো মানেই মৃত্যু। তবুও সে দাঁড়িয়ে রইল, চোখ ভরা অশ্রুতে তাকিয়ে থাকল আঁতোয়ানের দিকে।
আঁতোয়ানও তাকে দেখে ফেলেছিল। দূর থেকে চোখ মিলল। সেই চোখে তখন যন্ত্রণার ছায়া, কিন্তু তার থেকেও বড় ছিল আশ্বাস। সে চোখে বোঝাল—“আমি বেঁচে আছি। তুমি ভেঙে পড়ো না।”
মোহনা বুঝল, কিছু করার নেই। সৈন্যরা আঁতোয়ানকে ঠেলে নিয়ে গেল নদীর ধারে। তাকে অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে বাঁধা হলো। তারপর নৌকায় তুলে দেওয়া হলো, গন্তব্য সম্ভবত কলকাতার দুর্গ, যেখানে বন্দিদের রাখা হবে।
মোহনার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সে দৌড়াল নদীর ধারে, কিন্তু সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে আর এগোনো গেল না। ভাগীরথীর ঢেউ গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নৌকাটা। দূরে আঁতোয়ানের মুখ দেখা যাচ্ছিল, কেবল একবার ঘুরে তাকানো, আর তার চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা।
সেই রাত মোহনা কাটাল অসহায়ভাবে। পরিবার তাকে টেনে রাখল ঘরে, বলল—“এখন কেবল বাঁচতে হবে। বিদেশিদের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে আমাদের সর্বনাশ হবে।” রঘু কঠিন কণ্ঠে বলল,
— “তুই কি এখনো ও ফরাসি সৈনিকের কথা ভাবছিস? ওদের ভাগ্য আমাদের নয়। আমরা আমাদের জীবনটাকে রক্ষা করলেই বাঁচব।”
মোহনা কোনো উত্তর দিল না। তার চোখ তখন নদীর ওপারের অন্ধকারে স্থির। মনে হচ্ছিল, আঁতোয়ানের মুখ যেন এখনো সেখানে ভাসছে।
পরদিন ভোরে সে গোপনে বেরোল। বাজারের ভাঙা পথ পেরিয়ে গেল নদীর ধারে। ইংরেজ সৈন্যদের টহল তখনো চলছে, কিন্তু সে ভয় পেল না। সে কেবল একবার জানতে চাইল, আঁতোয়ান কোথায়। এক মাঝি তাকে ফিসফিস করে বলল—“ওদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কলকাতার দিকে। দুর্গে আটকে রাখবে।”
মোহনার বুকটা হালকা হলেও ভেতরে নতুন ঝড় উঠল। আঁতোয়ান বেঁচে আছে, কিন্তু বন্দি। সে কি কোনোদিন ফিরে আসবে? ইংরেজরা কি তাকে ছেড়ে দেবে?
সেই দিনগুলো মোহনা কাটাল অস্থিরতায়। নদীর ধারে বসে সে কেবল অপেক্ষা করত। মাঝেমধ্যে ভেসে আসত গুজব—কখনো বলা হতো বন্দিদের শাস্তি দেওয়া হবে, কখনো বলা হতো তাদের বিনিময়ে চুক্তি হবে। প্রতিটি গুজব তার হৃদয়ে নতুন ক্ষত তৈরি করত।
তবে মোহনা জানত, সে হাল ছাড়বে না। আঁতোয়ান যদি বন্দি হয়, তবে সে খুঁজবে। যদি দূরেও নিয়ে যাওয়া হয়, তবে স্রোতের মতো সে তার পথ খুঁজে নেবে।
এক সন্ধ্যায় ভাগীরথীর ঢেউয়ে আকাশের লাল প্রতিফলন দেখে মোহনা মনে মনে শপথ নিল—“আমি তোমাকে খুঁজে পাবই। তুমি বন্দি হলেও, তুমি আমার। যতক্ষণ নদী বইবে, ততক্ষণ তোমাকে খুঁজে ফিরব।”
শহরের চারপাশে তখন ধ্বংসস্তূপ আর ধোঁয়া, কিন্তু সেই ধ্বংসের ভেতরেই জন্ম নিল এক দৃঢ় সংকল্প। প্রেম হয়তো নীরব, হয়তো নিষিদ্ধ, হয়তো বিপদের মধ্যে বাঁধা। তবুও তার শক্তি নদীর মতো—কোনো বাধাই তাকে চিরদিন আটকে রাখতে পারে না।
আঁতোয়ান দূরে বন্দি, মোহনা এখানে অপেক্ষায়। তাদের মাঝে নদীর স্রোত, কামানের ধোঁয়া, সমাজের দেয়াল। কিন্তু চোখের এক দৃষ্টিই যথেষ্ট—যা বলছে, তারা এখনো একে অপরের।
পর্ব ৯ – বিদায় না প্রতিজ্ঞা?
চন্দননগরের আকাশে তখনও যুদ্ধের ধোঁয়া ঘোরাফেরা করছে। আগুনে পোড়া কাঠের গন্ধ বাতাসে মিশে গেছে, নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসছে ভাঙাচোরা নৌকার টুকরো, আর কোথাও কোথাও এখনো আগুনের ছোট ছোট শিখা জ্বলছে। শহরের মানুষ ভগ্নদশা থেকে বেরোতে চেষ্টা করছে—কেউ ঘর পুনর্নির্মাণ করছে, কেউ হারানো পরিবারকে খুঁজছে। কিন্তু মোহনাকে কোনো পুনর্নির্মাণ বা খোঁজ শান্ত করতে পারল না। তার চোখে একটাই ছবি ভাসছিল—আঁতোয়ান, বাঁধা হাতে ইংরেজ সৈন্যদের দ্বারা টেনে নিয়ে যাওয়া।
সেই থেকে দিন রাত এক করে মোহনা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝিদের কাছ থেকে খবর শোনার চেষ্টা করে, ঘাটে দাঁড়ানো প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে শোনে বন্দিদের কথা। অবশেষে একদিন সে শুনল—ফরাসি বন্দিদের কলকাতার দুর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। হয়তো অনেক দূরে, হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না।
এই খবর মোহনাকে ভেঙে দিলেও তার ভেতরে এক অদ্ভুত সাহস জাগল। সে ঠিক করল, শেষবার হলেও আঁতোয়ানকে দেখতে হবে। যত বিপদই থাকুক, বিদায় না বললে সে শান্তি পাবে না।
সেই রাতে চুপিসারে ঘর থেকে বেরোল মোহনা। রঘু তাকে থামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে কিছু না বলে আঁচল মাথায় টেনে দিল। তার চোখের দৃঢ়তায় রঘু বুঝল, তাকে আটকানো সম্ভব নয়। শুধু ফিসফিস করে বলল—
— “তুই নিজের সর্বনাশ করছিস, দিদি। ওরা আমাদের কেউ না।”
মোহনা উত্তর দিল না। তার পায়ের শব্দ মিশে গেল রাতের নীরবতায়।
ভাগীরথীর ধারে সৈন্যরা তখন বন্দিদের নৌকায় তুলছিল। আকাশে আধখানা চাঁদ, নদীর জলে প্রতিফলিত আলোয় সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল। বন্দিরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, তাদের মধ্যে আঁতোয়ানও আছে। তার হাত বাঁধা, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে অদ্ভুত শান্তি।
মোহনা ভিড়ের আড়াল থেকে তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর থেকে কান্না উঠে আসছিল, কিন্তু সে জানত চিৎকার করলে সব শেষ হয়ে যাবে। তাই সাহস করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঘাটের কিনারায়। সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আঁতোয়ান হঠাৎই তাকে দেখে ফেলল। তাদের চোখ মিলল। সেই চোখে তখন সময় থেমে গেল। ভাষা, দূরত্ব, সৈন্যদের হুমকি—সবকিছু মিলিয়ে গেল। দুজনের চোখে তখন কেবল একটিই শব্দ—বিদায়।
কিন্তু মোহনা মাথা নেড়ে দিল। তার চোখের জল ঝরে পড়ল, আর সেই জলেই ফুটে উঠল অন্য এক শব্দ—না, এটা বিদায় নয়।
আঁতোয়ানের ঠোঁট কেঁপে উঠল। দূর থেকে ফরাসি ভাষায় ফিসফিস করে বলল—“Je reviendrai” (আমি ফিরে আসব)। মোহনা বুঝল না শব্দের অর্থ, কিন্তু চোখের ভাষা বুঝল। সে ঠোঁট নেড়ে বলল বাংলায়—“আমি অপেক্ষা করব।”
সৈন্যরা তখন বন্দিদের ঠেলে নৌকায় তুলছে। আঁতোয়ান উঠে দাঁড়াল, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার চোখ মোহনাকে খুঁজে যাচ্ছিল। মোহনাও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। চারপাশের ভিড়, সৈন্যদের হুঙ্কার, নদীর গর্জন—সবকিছু মিলিয়ে যেন পৃথিবী নিঃশব্দ হয়ে গেল।
নৌকা ধীরে ধীরে স্রোতের দিকে এগোতে লাগল। ভাগীরথীর ঢেউ আলো-ছায়ায় দুলছে। আঁতোয়ান পিছনে ঘুরে তাকাল শেষবার। দূর থেকে দেখা গেল তার বাঁধা হাত, কিন্তু চোখে স্পষ্ট প্রতিজ্ঞা। মোহনার বুক ভেঙে যাচ্ছিল, তবুও সে হাসার চেষ্টা করল। সেই হাসি আঁতোয়ানের কাছে পৌঁছল কি না কে জানে, কিন্তু দুজনেই জানল—এ বিদায় নয়, এ এক প্রতিজ্ঞা।
সৈন্যরা যখন দৃষ্টি আড়াল হয়ে গেল, মোহনা তখনো নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে তখন শুধু আগুনে পোড়া শহরের গন্ধ আর ঢেউয়ের শব্দ। তার চোখে জল, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা। সে জানত, পথ যতই দীর্ঘ হোক, যতই অন্ধকার হোক, আঁতোয়ান তার কাছে ফিরে আসবে—অথবা অন্তত তার স্মৃতিই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
সেই রাতে আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলছিল। মোহনা ঘাটে বসে ফিসফিস করে বলল—“বিদায় নয়, প্রতিজ্ঞা।”
তার বুকের ভেতর প্রতিজ্ঞা গেঁথে গেল নদীর ঢেউয়ের মতো—অবিরাম, অদম্য, অটল।
পর্ব ১০ – ভাগীরথীর স্রোত
সময় বয়ে যায় ভাগীরথীর স্রোতের মতোই—অবিরাম, অচঞ্চল, কিন্তু সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। যুদ্ধের আগুন নিভে গেছে অনেক আগেই। চন্দননগর আবার গড়ে উঠেছে, বাজারে নতুন দোকান বসেছে, ঘাটে ভিড় করছে নৌকা আর মানুষ। কিন্তু শহরের মানুষ জানে, সেই ভস্মীভূত রাত চিরকাল তাদের স্মৃতিতে আঁচড় কেটে থাকবে।
মোহনার জীবনও বদলে গেছে, তবুও ভেতরে কিছু একই রয়ে গেছে। আঁতোয়ানকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার পর কত বছর কেটে গেছে—কেউ বলে পাঁচ, কেউ বলে সাত। অনেকেই ভুলে গেছে ফরাসি সৈন্যদের নাম। কেউ কেউ এখনো গুজব করে—কেউ নাকি জেলখানায় মারা গেছে, কেউ নাকি ফরাসি দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু মোহনা জানে, গুজব তার হৃদয়ের শূন্যতা ভরতে পারে না।
তার বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাকে বিয়ে দেওয়ার। রঘুও বারবার বলেছিল—“এক বিদেশির জন্য তুই কেন জীবন নষ্ট করছিস? বিয়ে কর, নতুন জীবন শুরু কর।” কিন্তু মোহনা সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। তার মুখে সবসময় একই কথা—“আমি প্রতিজ্ঞা করেছি।”
বছর ঘুরতে ঘুরতে সমাজও ক্লান্ত হয়ে গেল তাকে বোঝাতে। এখন মোহনা যেন এক ছায়ার মতো বেঁচে আছে। দিনে সে কাপড়ের দোকানে বাবাকে সাহায্য করে, রাতে ঘরে ফিরে নিরবতায় ডুবে থাকে। কিন্তু প্রতিদিন ভোরে আর সন্ধ্যায় সে ঘাটে যায়। ভাগীরথীর জলের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন স্রোতের ভেতর থেকে আঁতোয়ানের মুখ ভেসে উঠবে।
ঘাটের পাথরে বসে সে এখনো আঁচলের ভাঁজে লুকানো দুটি জিনিস বের করে—ছোট কাঠের নৌকা আর নীল কারুকাজ করা রুমাল। সময়ের দাগ পড়েছে তাতে, রং ফিকে হয়ে গেছে, তবুও মোহনাকে মনে করিয়ে দেয় এক অচেনা দেশের সৈনিককে, যে একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল—“Je reviendrai”—আমি ফিরে আসব।
কিন্তু সে কি ফিরে এসেছে? না। মোহনা জানে না, আঁতোয়ান কোথায় আছে। হয়তো ইংরেজদের বন্দিত্বে মারা গেছে, হয়তো ফরাসি দেশে ফিরে নতুন জীবন শুরু করেছে। তবুও মোহনার হৃদয়ে সে এখনো বেঁচে আছে, যেন নদীর জলের মতো—চোখে ধরা যায় না, কিন্তু সর্বদা অনুভব করা যায়।
এক সন্ধ্যায়, যখন আকাশ লাল হয়ে এসেছে, ভাগীরথীর জলে প্রতিফলিত সূর্যাস্ত দেখে মোহনার মনে হলো আঁতোয়ানের চোখ যেন এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে ভেসে আসা নৌকার বাঁশির সুর শুনে সে মৃদু ফিসফিস করে বলল—
— “তুমি যদি সত্যিই ফিরে আসতে, তবে আমি তোমাকে এই ঘাটেই খুঁজে পেতাম। তবুও আমি জানি, তুমি আমার কাছেই আছো। তোমার প্রতিজ্ঞা আমি ভুলিনি।”
চারপাশের মানুষ তাকে দেখে কেবল দুঃখ করে মাথা নাড়ত। অনেকে বলত—“এ মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। এক বিদেশির জন্য এভাবে অপেক্ষা করে জীবন কাটানো যায়?” কিন্তু মোহনা কারও কথায় কর্ণপাত করত না। তার কাছে প্রেম ছিল নদীর মতো—যা বাঁধ মানে না, যুক্তি মানে না, কেবল নিজের স্রোতে বয়ে চলে।
রাত হলে মোহনা প্রায়ই ঘাটে বসে থাকে। চাঁদের আলো ভাগীরথীর জলে নেচে বেড়ায়, আর সেই আলোতে আঁতোয়ানের মুখ ভেসে ওঠে তার মনে। সে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে—আঁতোয়ান হয়তো এখনো বেঁচে আছে, হয়তো অন্য তীরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে এই দিকেই। হয়তো নদীর স্রোতই তাদের দূরত্ব কমিয়ে দিচ্ছে।
বছর কেটে যায়। শহর পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়, নতুন প্রজন্ম জন্ম নেয়। কিন্তু মোহনা রয়ে যায় ভাগীরথীর ধারে, এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞার টানে। তার চুলে সাদা রং এসে গেছে, মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে। তবুও তার চোখে এখনো একই আলো—যে আলো এক ফরাসি সৈনিক জাগিয়ে দিয়েছিল বহু বছর আগে।
একদিন সন্ধ্যায়, ঘাটে বসে হঠাৎ সে মনে করল সেই প্রথম দিনের কথা। আঁতোয়ান রুমাল এগিয়ে দিয়েছিল, আর সে গামছা দিয়েছিল বদলে। সেই নীরব বিনিময় থেকে শুরু হয়েছিল তাদের সম্পর্ক। মোহনা হেসে উঠল—কেমন অদ্ভুত, এত বড় যুদ্ধ, সমাজের রোষ, পরিবার ভাঙন—সব কিছুর মূল ছিল এক টুকরো রুমাল আর এক টুকরো দৃষ্টি।
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ধীরে ধীরে বলল—
— “আঁতোয়ান, তুমি যদি সত্যিই ফিরে না আসো, তবুও আমি জানি, তুমি আমাকে প্রতারণা করোনি। তুমি যেদিন বলেছিলে ‘আমি ফিরে আসব’, সেই দিন থেকেই তুমি আমার ভেতরে থেকে গেছো। ভাগীরথীর স্রোতের মতো, তুমি আমার জীবনে বয়ে চলছ।”
নদীর ঢেউ তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল, যেন সায় দিল। বাতাসে ভেসে এলো দূরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। সেই সুরে মিশে গেল এক নারীর চিরন্তন প্রতীক্ষা।
চন্দননগরের ইতিহাস হয়তো আঁতোয়ান ও মোহনাকে মনে রাখবে না। ইতিহাস লিখবে যুদ্ধ, জাহাজ, কামান আর রক্তপাতের কথা। কিন্তু ভাগীরথীর ঢেউ জানে, তার তীরে এক মেয়ে আজীবন অপেক্ষা করেছে এক বিদেশি সৈনিকের জন্য।
প্রেম অসম্পূর্ণ থেকেও ইতিহাস হয়ে ওঠে। আর সেই ইতিহাসের সাক্ষী ভাগীরথীর স্রোত—যা বহন করে নিয়ে যায় না শুধু যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ, বহন করে যায় এক অনন্ত প্রতিজ্ঞার গল্পও।
মোহনা চোখ বন্ধ করে শেষবার ফিসফিস করে বলল—
— “বিদায় নয়, প্রতিজ্ঞা।”
আর নদীর স্রোত সেই প্রতিজ্ঞাকে বয়ে নিয়ে গেল দূরের অচেনা তীরে।
***