ঋত্বিক বসু
১
শীতকাল তখন ঠিক জমে ওঠেনি, তবে পাহাড়ি হাওয়ায় একটা ঝাঁঝালো ঠান্ডা সকাল নিয়ে হাজির হয়েছিল অভিষেক দাশগুপ্ত। দার্জিলিঙের চৌরস্তা থেকে আরও পঁচিশ কিলোমিটার উপরের দিকে, ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম — ‘চাংথাং’। কেউ শোনেনি শহরে এই গ্রামের নাম, আর যারা শুনেছে, তারা এটাকে এড়িয়ে গেছে বছরের পর বছর। অভিষেক কিন্তু ইচ্ছা করেই এখানে এসেছে। কলকাতার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ লোকজ বিশ্বাস ও লোকশ্রুতি নিয়ে। উত্তরবঙ্গের গা ছমছমে প্রাচীন গল্প-গাথা নিয়ে একটা গবেষণাপত্রের কাজ চলছে তার। এই চাংথাং গ্রামের কথা সে প্রথম শুনেছিল একটি অজানা তিব্বতি চিঠিতে, যেটা পাওয়া গিয়েছিল সিকিম সীমান্তের এক পুরনো গুহায়, সঙ্গে একটা সাদা কালচে বই — নাম নেই, লেখক নেই, শুধু কয়েকটি শব্দ: “Bhoboghure Library — where Time bends.” তখনই সে স্থির করেছিল, যা-ই হোক, তাকে সেখানে যেতে হবে। গ্রামে পৌঁছতেই প্রথম যে বিষয়টা তাকে চমকে দিল, তা হল নিস্তব্ধতা। যেন কোনও অদৃশ্য নিয়মে হাঁটাহাঁটা, কথাবার্তা, এমনকি শিশুর কান্নাও এখানে সীমিত — মাপজোখ করে নেওয়া। বাঁশ আর পাথরের তৈরি ছোট ছোট বাড়িগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে, পিছনে বিশাল পাহাড় মাথা উঁচিয়ে আছে, আর সামনে সবুজ উপত্যকা এক অচেনা আয়নায় গলে যেতে চাইছে।
গ্রামের একমাত্র ছোট্ট গেস্টহাউসটিতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন অভিষেক। মালপত্র রেখে সে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে — হাতে নোটবুক, কাঁধে ব্যাগ, চোখে কৌতূহল। পাহাড়ি পথ ধরে চলতে চলতে সে গ্রামের এক প্রান্তে পৌঁছায়, যেখানে পুরনো এক কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে এক টিলার মাথায়। সিঁড়ির মুখেই বসে ছিল একজন মাঝবয়সি মহিলা, চোখে রোদচশমা, হাতে একগুচ্ছ শুকনো পাতা আর কাঠি। অভিষেক এগিয়ে যেতেই মহিলা বললেন, “আপনি ওই লাইব্রেরির খোঁজে এসেছেন, না?” প্রশ্নটা ছিল সরাসরি, কিন্তু কণ্ঠে কোনও সন্দেহ বা বিস্ময় নেই, যেন আগেও বহুবার কেউ এসেছে একই কারণে। অভিষেক চমকে উঠলেও মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। আপনি কী জানেন এ বিষয়ে কিছু?” মহিলার নাম ডলি লেপচা, বয়স পঁচিশ, গ্রামে জন্ম কিন্তু বেড়ে ওঠা কালিম্পঙে। বাবার মৃত্যুর পর ফিরে এসেছেন মায়ের সঙ্গে থাকতে। ডলি বললেন, “এই পাহাড়ে এক লাইব্রেরি আছে ঠিকই, কিন্তু কেউ সেখানে যায় না। যারা গিয়েছে, তারা ফিরেও আসেনি। আমার কাকু, বিনোদ লেপচা, তিনিও একজন পাঠক ছিলেন… তারপর আর কিছুই নয়।” অভিষেক থমকে গেল। কাকু হারিয়ে গেছেন মানে? ডলি জানাল, পনেরো বছর আগে বিনোদ একদিন সকালের দিকে পাহাড়ি পথ বেয়ে লাইব্রেরির দিকে রওনা দেন। তার আগে সে স্বপ্নে একটি সাদা ঘরের কথা বলতেন, যেখানে বইরা নিজে নিজে পাতা উল্টে দেয়। “ও বলত, ‘ডলি, বই পড়তে হয় না — তারা তোকে পড়ে।’” সেদিনই সে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। অভিষেকের মধ্যে কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে ভয় আর অবিশ্বাসও মিশে যায়। সত্যিই কি এমন কিছু সম্ভব? কিন্তু ইতিহাস বলে, লোকগল্পের আড়ালে কখনো কখনো থেকে যায় সত্যের কঙ্কাল।
পরদিন ভোরে অভিষেক গেল বৃদ্ধা রানু থাপার সঙ্গে দেখা করতে — গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা ও কথিত রক্ষক ‘লাইব্রেরির’। রানু থাকেন একটি বাঁশের ঘরে, পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা ঘুড়ির মতো ছোট্ট ঘর, যার একপাশে ঝর্ণার ধারা পড়ছে। তাঁর মুখে কুঁচকে যাওয়া গল্প, চোখে ঘোলা নদীর মতো শূন্যতা। রানু বলেন, “তুমি যদি সত্যিই সেই লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা ভাবো, তবে একবারও পেছনে ফিরে দেখো না। কারণ লাইব্রেরি জানে, কে তাকে দেখতে এসেছে, আর কে হারিয়ে যেতে। ওটা একটা ঘর নয়, ওটা একটা চেতনা। একটা বোধ। সময় যাকে ঘিরে থাকে, আবার খুলেও দেয়।” অভিষেক অবাক হয়ে শোনে এই সব কথাবার্তা। রানু জানালেন, লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকলে ঘড়ি কাজ করে না, নড়াচড়া থেমে যায়, আর যারা একবার ভিতরে গিয়ে বইয়ের স্পর্শ পায়, তারা আর ফিরে আসতে চায় না। “কারণ ওরা তখন বই হয়, পাঠক নয়,” রানুর মুখে অস্ফুট হাসি। ঘরে ফেরার পথে, সন্ধ্যা নামার আগেই অভিষেক একবার সিঁড়ির মাথার দিকে তাকাল। গা ছমছমে ঠান্ডা বাতাসে পাতাগুলি যেন চাপা স্বরে ফিসফিস করছিল। দূরের পাহাড় তখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা, আকাশের রঙ নীল থেকে ধূসর। অভিষেক জানে না—সত্যি কি সে ইতিহাস খুঁজছে, নাকি নিজেই হতে চলেছে কোনও ইতিহাসের পাতার চিহ্ন?
২
ডলির কণ্ঠে ছিল পাহাড়ি ঝর্ণার মতো স্বচ্ছতা, কিন্তু তাতে কোথাও যেন জমে থাকা কষ্টের একটা স্তর টের পাওয়া যেত। অভিষেক পরদিন সকালে গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে ডলির বাড়ির পথে হাঁটছিল, মেঘ তখন নেমে এসেছে মাঠের উপর, ছায়ার মতো। ডলির বাড়ি একদম গ্রামের শেষপ্রান্তে — কাঠ ও পাথরের তৈরি দোতলা ছোট্ট ঘর, চারপাশে নেপালি গন্ধরাজ ফুলের গাছ, আর একটি বাগানে ঘাসের ভেতর ছড়িয়ে রয়েছে কিছু প্রাচীন কাঠের জিনিস — বোধহয় পুরোনো মেশিন বা খেলনা। ডলি তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে ভিজে কাপড় মেলছিল। অভিষেককে দেখে সে হাসল না, কিন্তু চোখে ছিল চিন্তিত উষ্ণতা। “আপনি সত্যিই যাচ্ছেন লাইব্রেরিতে?” প্রশ্নটা যেন একটা ব্যর্থ প্রত্যাশা, উত্তর জানার পরও জানতে চাওয়ার মতো। অভিষেক বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু যাওয়ার আগে আমি আপনার কাকুর কথা আরও জানতে চাই। আপনি বলেছিলেন, তিনি লাইব্রেরির পাঠক ছিলেন। ঠিক কী ঘটেছিল?” ডলি কাপড় শুকাতে দিয়ে তাকে বসলেন রান্নাঘরের পাশে একটি কাঠের বেঞ্চে। আগুনে দপদপ করে জ্বলছিল কাঠের টুকরো, আর চায়ের হাঁড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছিল পাতার মতো। তারপর ডলি ধীরে ধীরে খুলে বলতে লাগলেন তাদের পারিবারিক ইতিহাস, যেটা অনেকটা সেই পাহাড়ের মত — বাইরে থেকে স্থির, ভিতরে আগ্নেয়।
বিনোদ লেপচা ছিলেন ডলির কাকা, ডলির বাবার ছোট ভাই। ছোটবেলায় দার্জিলিঙে পড়াশোনা করতেন, কিন্তু বইয়ের থেকে বেশি আকর্ষণ ছিল আঁকা, লেখালেখি, ও নিসর্গে হারিয়ে যাওয়ার প্রতি। কৈশোরে তিনি একবার টানা চারদিন নিখোঁজ ছিলেন, পরে ফিরে এসে বলেছিলেন, তিনি এক ‘সাদা ঘরে’ ছিলেন, যেখানে চারপাশে শুধু বই, এবং সেই বইগুলো তার কথা শুনত। সবাই ভেবেছিল মানসিক সমস্যা — গ্রামের ডাক্তারেরা একে পাগলামির লক্ষণ বলেছিল। কিন্তু ডলি বলল, “আমার কাকু পাগল ছিলেন না। আমি তখন ছোট, কিন্তু মনে আছে, উনি বলতেন, ‘ডলি, বই শুধু কাহিনি নয়, বই একটা জানলা — জানলার ওপার থেকে কেউ তোমায় দেখে।’” এক বিকেলে, বিনোদ একটি নোটবুক আর একটি হ্যান্ডল্যাম্প নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন লাইব্রেরির দিকে। তার আগে তিনি রানুকে বলেছিলেন — “আমি আজ আবার পড়তে যাচ্ছি, এবার মনে হয় ওরা আমায় জায়গা দেবে।” সেই ছিল শেষ দেখা। তখনই ডলি প্রথম শুনেছিল ‘ভবঘুরে লাইব্রেরি’ নামটা — কাকু ওই নামেই ডাকতেন ওই জায়গাটিকে। নামটা শুনলেই একটা হাওয়ার ধাক্কা লাগে মনে। যেন এই নামটা একমাত্র ওই লাইব্রেরির জন্যই বানানো। এরপর গ্রামবাসীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল, পুলিশও এসেছিল — কিন্তু লাইব্রেরির দরজা ছিল বন্ধ, আর ভেতর থেকে কারও সাড়া আসেনি। সেই ঘটনার পরে গ্রামের লোকেরা ভয় পেয়ে লাইব্রেরির দিকে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
অভিষেক চুপচাপ শুনছিল। ডলির কথায় ছিল না কোনও অলংকার, তবু তা ছিল গভীর, যেন তার স্মৃতির ভিতরে ঢুকে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। সে বলল, “তুমি কাকুর হারিয়ে যাওয়ার পরও লাইব্রেরি নিয়ে ভাবো?” ডলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “প্রথমে খুব ভয় পেতাম। তারপর বুঝলাম, কাকু গিয়েছিলেন কারণ কিছু তাকে ডাকছিল। ওখানে কিছু আছে—সাধারণ নয়, কিন্তু একেবারেই অদ্ভুতভাবে সত্যি। এই যে সময়—তুমি বলো, এখন সকাল দশটা। কিন্তু লাইব্রেরির সামনে দাঁড়ালে সেই সময়ের কোনো মানে থাকে না। আমার মনে হয়, সময় সেখানে জমে যায়।” অভিষেক নোটবুকে লিখতে শুরু করল ডলির বর্ণনা — “Where time congeals. Not flowing, not ticking, but suspended like a breath held too long.” সে হঠাৎ প্রশ্ন করল, “তুমি কি কখনও গিয়েছিলে ওই লাইব্রেরির কাছে?” ডলি মাথা নেড়ে বলল, “একবার। বাবার সঙ্গে। ছোট ছিলাম, বাবার পেছনে ছুটতে ছুটতে গেছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা সাদা গেট দেখেছিলাম — অনেকটা গির্জার মতো। ওখানে এক ধরণের গন্ধ ছিল — পুরনো কাগজ আর বরফের। তারপর বাবা চিৎকার করে উঠেছিল, আমাকে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। বলেছিল, ‘ওখানে কেউ ঘুমিয়ে আছে—ঘুম ভাঙলে ফিরে আসতে পারবি না।’” অভিষেক মনে মনে ভাবল, এই গ্রাম, এই মানুষগুলো কোনও অজানা সত্যের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে—যেটা ইতিহাস নয়, ভবিষ্যত। সে জানে, এই রহস্যকে সে এড়িয়ে যেতে পারবে না। হয়তো এই লাইব্রেরির ভেতরেই আছে এমন কিছু, যা কেবল বই নয়—একটা বিকল্প অস্তিত্ব, এক চেতনা, যেটা পাঠককেই গ্রাস করে লেখক করে তোলে।
৩
তৃতীয় দিনের সকালটা ছিল অস্বাভাবিক নীরব। পাহাড়ের ধারে চাংথাং গ্রামের আকাশ যেন রাতের ধোঁয়া নিয়ে জেগে উঠেছিল। অভিষেক দাশগুপ্ত তখন সোজা হেঁটে যাচ্ছিল গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে, যেখানে মাটির আঁকাবাঁকা পথ শেষ হয়েছে এক ঝর্নার ধার ঘেঁষে। সেই ঝর্নার পাশে বসবাস করেন রানু থাপা — প্রায় ষাটের কোঠায় এক লেপচা বৃদ্ধা, যিনি বছরের পর বছর ধরে ‘ভবঘুরে লাইব্রেরি’র একমাত্র জীবিত সাক্ষী বলে গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে। ডলি তাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল—“ওনার সঙ্গে কথা বলবেন সাবধানে, ও নিজেও লাইব্রেরির পেছনে কিছু হারিয়েছেন।” বৃদ্ধার কুঁড়েঘর ছিল বুনো লতাপাতায় ঘেরা, কাঠ ও বাঁশের তৈরি, একপাশে ধোঁয়া উঠছে উনুন থেকে। দরজায় টোকা দিতেই এক নিমগ্ন চাহনি নিয়ে রানু থাপা দরজা খুললেন—কথা বলার আগে অনেকটা সময় তিনি অভিষেকের দিকে চেয়ে রইলেন। যেন চেনার চেষ্টা করছেন তার চোখের ভিতরের ছায়া। “তুমি যদি বই খুঁজতে এসে থাকো, তবে ফিরে যাও। এখানে বই পড়ে না, এখানে মানুষই পঠিত হয়,”—এই ছিল তাঁর প্রথম বাক্য। এমন একটি বাক্য যা অভিষেকের ভিতর ঠান্ডা স্রোতের মতো বয়ে গেল। বসতে বলার পর, রানু চা তৈরি করতে লাগলেন। সেই সময় অভিষেক লক্ষ করল, ঘরের এক কোণে বহু পুরনো একটি ছেঁড়া চাদরে মোড়া বই রাখা—তারা যেন ধুলোতেই জন্মেছে।
রানু থাপা বলতে লাগলেন, যেন কোনও প্রস্তুত বিবরণ নয়, বরং অভিজ্ঞতার অঙ্গারে পোড়া স্মৃতির বর্ণনা। “আমার স্বামীও একসময় গিয়েছিল সেই লাইব্রেরিতে। মানুষ বলত, ওখানে জ্ঞান আছে—ভবিষ্যতের, অতীতের। আমরা তখন নতুন বিবাহিত। ও বলত, ‘রানু, ওটা শুধু কাঠের ঘর নয়—ওটা সময়ের কাহিনির কবরস্থান।’ প্রথমে আমি হাসতাম, বলতাম ওর মাথা খারাপ। কিন্তু ও একরকম ভাবে পড়ে গিয়েছিল ওই লাইব্রেরির প্রেমে। বইয়ের মতো ওর নিজের চিন্তাও বদলে যাচ্ছিল। রাতে ঘুমের ভেতর বলে উঠত অদ্ভুত ভাষা—যেটা কোনও সংস্কৃত, কোনও নেপালি, কোনও তিব্বতি নয়। একদিন সন্ধেবেলা ও বলল, ‘আমি যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, জানবে, আমি কোথাও আছি, যেখানে সময় আর এগোয় না।’ আমি ছুটে গিয়েছিলাম—সেই টিলার ওপরে। দেখেছিলাম, দরজা খোলা। ভিতরে একটা আলো ছিল, কিন্তু শব্দ ছিল না। সে গেল। আর ফিরল না। খোঁজ করার কেউ ছিল না, যারা ছিল, তারা ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল।” রানুর হাত তখন চায়ের কাপ ধরে থরথর করছিল, চোখে জল জমেনি, কিন্তু অভিষেক বুঝতে পারছিল—এই মহিলা প্রতিদিন কথা বলেন সময়ের সঙ্গে, এমন এক সময়, যেটা আটকে গেছে কাঠের দরজার অন্যপাশে। “অনেক বছর পর,” রানু বললেন, “আমি এক রাতে দেখেছিলাম দরজাটা আবার খুলেছে। কিন্তু সে রাতে বাতাস বইছিল উল্টো দিকে। মনে হয়েছিল, সেই বইগুলো আমাকে চিনে ফেলেছে। আমি পিছিয়ে এসেছিলাম।” অভিষেক তখন মনে মনে লিখে নিচ্ছিল এই সেদিনকার ঘটনাগুলো—সে জানত, এই সাক্ষাৎ কোনো প্রমাণ নয়, তবুও এক জ্বলন্ত সত্য।
কথা শেষে রানু থাপা অভিষেককে বললেন, “তুমি যদি যাও, তবে একটা জিনিস মনে রেখো—তুমি যা খুঁজবে, সেটাই তোমাকে খুঁজে নেবে। বইগুলো পড়ার আগে, ওরা তোমার স্মৃতি পড়ে ফেলে। তোমার ভাবনা, তোমার অভিপ্রায়—সব ওরা জানে। আর যদি কোনোদিন ফিরে আসতে চাও, তবে একটিই উপায়—তোমাকে নিজেকে ভুলে যেতে হবে।” এই কথাগুলো বলার সময় রানুর কণ্ঠস্বরে কোনও আতিশয্য ছিল না, বরং ছিল সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়ানো এক সৈনিকের মতো স্থিরতা। অভিষেক দরজা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আকাশের দিকে তাকাল—সূর্য তখনও ওঠেনি পুরোপুরি, কুয়াশা ঢেকে রেখেছে চারপাশ। কিন্তু তার ভিতরেই সে দেখল, সেই পাহাড়ি টিলার ওপরে লাইব্রেরির কাঠের সিঁড়ি—নীরব অথচ আমন্ত্রণময়। মনে হচ্ছিল, যেন কারও দৃষ্টি ভেদ করে আসছে তার কাঁধে। ফিরে এসে সে তার খাতায় এক লাইন লিখল, “আমি যাচ্ছি, কারণ আমি আর ফিরে আসার জন্য বাঁচছি না—আমি সেই অধ্যায় খুঁজছি, যা লেখা হয়নি কিন্তু পড়া যায়।” সেই রাতেই সে ঠিক করল, পরদিন সূর্য ওঠার আগেই সে পৌঁছে যাবে ভবঘুরে লাইব্রেরির দরজায়।
৪
সেই সকালে পাহাড়ি কুয়াশা এতটাই ঘন ছিল যে এক হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ছিল না। অভিষেক দাশগুপ্ত ধীরে ধীরে পা ফেলে উঠছিল সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে—যেখানে ওঠার আগে তাকে অনেকেই সাবধান করেছিল। হাতে একটি পুরোনো হ্যান্ডল্যাম্প, পিঠে খাকি ব্যাগ, আর বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত গম্ভীরতা। ক্লান্তি ছিল না, ছিল যেন প্রতীক্ষার শেষে এক প্রবল নির্ভরতা। লাইব্রেরির দরজার সামনে পৌঁছে সে প্রথম যেটা অনুভব করল, তা হলো শব্দের অনুপস্থিতি। না পাখির ডাক, না পাতার নড়াচড়া—এক ধরনের বাষ্পঘেরা স্তব্ধতা চারপাশে জমাট বেঁধে আছে। কাঠের দরজাটি প্রায় ছয় ফুট উঁচু, অদ্ভুত সব খোদাই—বইয়ের পাতা, চক্র, কিছু লেখা যা স্পষ্ট নয়, এবং মাঝখানে একটি বৃত্ত, যা খানিকটা চোখের মত দেখতে। অভিষেক হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই সেই দরজা নিজে থেকেই কড়া শব্দে খোলা শুরু করল—একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো ধ্বনি বেরোল তার ফাঁক দিয়ে, যেন অনেককাল পর সে আবার কাউকে স্বাগত জানাতে চাইছে। ভিতরে ঢুকতেই হ্যান্ডল্যাম্পের আলো টিম টিম করে জ্বলে উঠল। ভেতরের ঘর ছিল অন্ধকার নয়—বরং অদ্ভুতভাবে আলোকিত, যেন বইগুলো নিজেরাই আলোর উৎস। চারদিকে কাঠের তাকজোড়া দেয়ালে ঠাসা—কিন্তু প্রতিটি বইয়ের মলাট একেবারেই নামহীন, লেখকহীন, শিরোনামহীন। শুধু এক একটা বই স্পর্শ করলেই তার পাতা খুলে যাচ্ছে, আর পাতায় পাতায় ভেসে উঠছে শব্দ—নামহীন ভাষায়, যার কিছু বোঝা যায়, কিছু যায় না। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি শব্দ যেন অভিষেকের মন পড়ে ফেলছে—সে যা ভাবছে, যা মনে রাখছে, তা-ই বই হয়ে ফিরে আসছে তার সামনে।
তাকে তখন আর হাঁটতে হচ্ছিল না, যেন তাকগুলো নিজেই পথ করে দিচ্ছে তার চলার জন্য। পায়ের নিচে কাঠের মেঝে নয়, বরং কাগজে মোড়া কুয়াশা—কখনও মনে হচ্ছিল, সে হেঁটে যাচ্ছে বাতাসের উপর দিয়ে। হঠাৎ একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, দরজায় কোনও তালা নেই, শুধু একটা কালো কাপড় ঝুলছে। ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পেল, সেখানে একটা টেবিল, আর টেবিলের উপর রাখা একটি নোটবুক, পাশে একটি স্টিলের ফাউন্টেন পেন। টেবিলের ঠিক সামনে বসানো আছে একটি আয়না—অথচ আয়নায় তার নিজের প্রতিবিম্ব নেই। কেবল দেখা যাচ্ছে, একজন অন্য মানুষ লিখছে সেই নোটবুকে, আর প্রতিটি বাক্য যেন তার মনের কথার সঙ্গে মিলছে। অভিষেক ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে নোটবুক খুলল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল, “পাঠক হিসেবে এসেছ, লেখক হয়ে ফিরে যেয়ো না।” পরের পাতায় যে লেখা দেখা গেল, তা অবিশ্বাস্য—একটি কাহিনি, ঠিক তার নিজের জীবনকথার মতোই লেখা, যেখানে শেষের বাক্য বলে, “এই ঘরেই তুমি নিজেকে হারাবে।” অভিষেক তখন বুঝে গেল, এটি কোনও সাধারণ লাইব্রেরি নয়—এ এমন এক স্থান যেখানে বইয়ের মধ্যে কেবল কাহিনি নয়, মানুষের অস্তিত্ব লুকিয়ে থাকে। সে একটা বই হাতে তুলতেই দেখল—বইটির পাতাগুলো খোলা হচ্ছিল না; বরং পাতাগুলোর ভাঁজে তার নিজের শৈশব, মা-বাবার সঙ্গে কাটানো স্মৃতি, কলেজ জীবনের দিনলিপি, এমনকি ডলির সঙ্গে কথোপকথনের মুহূর্ত ভেসে উঠছিল। বইটি ছিল তার নিজের, অথচ সে কোনওদিন লেখেনি।
এই ঘরটির ঠিক এক কোণে হঠাৎ করে আলোর ঝলকানি দেখা দিল, আর শব্দ করে খুলে গেল একটি গোপন দরজা—তার পেছনে এক সরু সিঁড়ি নামছে নিচের দিকে, অন্ধকারের গভীরে। অভিষেক একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। ফিরে যাবেন? কিন্তু কোথায়? সে জানে, এই লাইব্রেরি এখন শুধু একটি জায়গা নয়—এটা একটা সময়চক্র, যেখানে ঢুকলে কোনোভাবেই আগের অবস্থানে ফেরা যায় না। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই চারপাশে শব্দ উঠতে লাগল—নতুন ধরনের কণ্ঠস্বর, যেন শত শত পাঠকের কণ্ঠ মিশে এক সমবেত ধ্বনি তৈরি করছে, “লিখে যাও, কারণ তুমিই পরবর্তী অধ্যায়ের স্রষ্টা।” নিচে নেমে অভিষেক একটি বিশাল কক্ষ দেখতে পেল, যেখানে চারপাশে দেয়ালে বসানো অনেকগুলো ঘড়ি—কিন্তু প্রতিটি ঘড়ি চলছে আলাদা সময়ে। কোনওটা পিছিয়ে, কোনওটা এগিয়ে, কোনওটা থেমে গেছে। এবং ঘরের ঠিক মাঝে বসে রয়েছে একজন মানুষ—নামহীন, অন্ধকারে ঢাকা মুখ। সে বলল না কিছুই, শুধু অভিষেকের দিকে তাকিয়ে রইল। অভিষেক তখন বুঝতে পারল—এ যেন এক ভবিষ্যতের পাঠক, অথবা অতীতের লেখক, অথবা হয়তো সে নিজেই অন্য এক রূপে। ঠিক তখনই ঘরের মাঝখান থেকে উঠে এল বাতাসের ধাক্কা, আর অভিষেক দেখতে পেল একটি বই—নতুন, খালি পাতা, প্রথম পাতায় লেখা, “ভবিষ্যত শুরু এখানেই।” সে জানত, আর কোনও ফেরার পথ নেই। এই লাইব্রেরির অন্তর্গত হয়ে গেছে তার সময়, তার স্মৃতি, তার অস্তিত্ব। এবং সেই মুহূর্তে, ভবঘুরে লাইব্রেরি অভিষেক দাশগুপ্ত নামের এক পাঠককে গ্রাস করল—যে বই পড়তে এসেছিল, কিন্তু নিজেই হয়ে উঠল একটি না-লিখে ফেলা বইয়ের প্রথম অধ্যায়।
৫
সেই নিচের কক্ষটি যেন দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অভিষেক ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল—আলোর উৎস বলেই কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, তবু একটা সোনালি কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছিল বাতাসে। ঘরের মাঝখানে রাখা একটা টেবিলের ওপর একটি পুরনো চামড়ার বাঁধানো খাতা পড়ে ছিল, তার উপরে ধুলো জমে রয়েছে বহু বছর ধরে। অভিষেক তা খুলে দেখল—প্রথম পাতায় নীল কালিতে লেখা একটা নাম: অরণ্য সেন। এই নাম তার অচেনা ছিল না—ডলি একবার বলেছিল যে এই অরণ্য ছিলেন বছর পনেরো আগে নিখোঁজ হওয়া একজন লেখক, যিনি লাইব্রেরির রহস্য খুঁজতে এসেছিলেন। অভিষেক নিঃশব্দে বসে পড়ল টেবিলের পাশে, পাতাগুলি উল্টাতে লাগল—প্রতিটি পৃষ্ঠায় অরণ্যর হাতের লেখা, কিন্তু তা কেবল তথ্য নয়, একেবারে অনুভবের অনুরণন। “আজ তিনদিন আমি এই ঘরে। বাইরে সময় চলছে কি না জানি না। আমার মনে হয়, এখানে সময় নিজেই আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে,”—এই ধরনের লাইন পড়তেই অভিষেকের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা শিহরণ নামল। ডায়েরির ভেতরে অরণ্য বর্ণনা করছেন কেমনভাবে লাইব্রেরি প্রথমে তাকে কথা শোনায়, পরে তার স্মৃতি নিয়ে খেলা শুরু করে। “একটা বই ছিল যেখানে লেখা ছিল আমি কী খাচ্ছি, কী ভাবছি, এমনকি পরদিন কী স্বপ্ন দেখব। আমি সেটা পড়ার পর সত্যিই ওই স্বপ্ন দেখেছি। এটা কি ভবিষ্যত নাকি শুধুই ভবিষ্যতের সম্ভাবনা?”
একটা পাতায় এসে অভিষেক থমকে গেল। সেখানে আঁকা ছিল একটা হাতঘড়ির ছবি, আর ঘড়িটার কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরছিল। নিচে লেখা ছিল: “যদি কেউ এই লাইব্রেরিতে ঢোকে এবং ফিরে যেতে চায়, তাকে সময় ভুলে যেতে হবে। কারণ এখানে সময় নিজে এক পাঠ্যবস্তু।” তার নিচে ছিল একটা ভয়ানক কথা—“এই ঘরে আমি নিজেকে হারিয়েছি। আমি এখন একজন পাঠক নই, আমি এক পাঠ্য হয়ে গেছি।” অভিষেক বইটা বন্ধ করতে পারছিল না। অরণ্য যেন তারই মনের কথা আগে থেকে লিখে রেখেছেন। সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস ঘন হয়ে উঠল—কিছু একটা পরিবর্তিত হচ্ছে যেন। ডায়েরির পরের পাতায় লেখা: “যদি কেউ পড়ে এই খাতা, জেনে রাখো, তুমি আমি নও, কিন্তু তুমি হতে পারো।” অভিষেক বুঝে যায়, অরণ্য নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন এই লাইব্রেরির ভেতরে, এবং ডায়েরি যেন একটা রেখা—যেখানে কাহিনির শেষ মানেই অন্য কারও শুরু। অরণ্যর ডায়েরিতে একটা অংশে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল একটি “সাদা দরজার” কথা, যেটি লাইব্রেরির মূল স্তরের নিচে, এবং যেটি সময়কে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে—যেখানে ঢুকলে বাস্তব আর স্মৃতি আলাদা হয়ে যায়।
সেই দরজা খুঁজতে গিয়ে অভিষেক সিঁড়ি দিয়ে আরও নিচে নামতে শুরু করল, ডায়েরিটা শক্ত করে ধরে। সিঁড়ির শেষে যেটা সে দেখতে পেল, তা ছিল ঠিক যেমন অরণ্য বর্ণনা করেছিলেন—একটি সাদা, কাঠের দরজা, তাতে কোনো হাতল নেই, কিন্তু মাঝখানে একটি চক্রাকৃতি প্রতীক। সে দরজার সামনে দাঁড়াতেই মনে হতে লাগল, এই জায়গা তার মনেরই কোনো কোণ। দরজা এমনভাবে কেঁপে উঠছিল, যেন তারই হৃদস্পন্দনের প্রতিচ্ছবি। ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা: “এই দরজার ওপারে শুধু ভবিষ্যত নয়, এখানের প্রতিটি পদক্ষেপে তুমি নিজের কাহিনির লেখক হয়ে উঠবে। এখানে তোমার চিন্তা পৃষ্ঠায় ছাপা পড়বে, আর তোমার স্মৃতি হয়ে যাবে অধ্যায়। একবার ঢুকলে ফিরে আসা মানে নিজেকে ভুলে ফেরা।” অভিষেক জানত, সে আর আগের মানুষ নেই। সে যে ইতিহাসের অধ্যাপক, যে বাস্তবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেই মানুষটি লাইব্রেরির ভেতরেই রয়ে গেছে। তার হাতে এখন এক ডায়েরি, যেখানে ভবিষ্যতের ছায়া লেখা রয়েছে, এবং সামনে সেই দরজা—যেখানে লিখিত নয় এমন সময় অপেক্ষা করছে। এবং সে জানে, তাকে ঢুকতেই হবে। কারণ কেবল সে নয়—লাইব্রেরিও চায়, সে তার কাহিনির লেখক হয়ে উঠুক।
৬
দরজাটি এমনভাবে খুলল, যেন বহুদিন ধরে জমে থাকা বাতাস হঠাৎ করে মুক্তি পেয়েছে। অভিষেক ধীরে ধীরে সেই সাদা দরজার ভিতরে পা রাখল। ভিতরটা ছিল সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ—কোনো তাক নেই, কোনো বই নেই, কেবল চারপাশে ধবধবে সাদা দেয়াল। তবে সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই একটা শব্দ ভেসে এল, যা শব্দের চেয়ে বেশি ছিল অনুভূতি। যেন কারও মনের ভিতর কথা বলছে কেউ, স্পষ্ট নয়, তবু বুঝতে পারা যায়। “তুমি এসেছো। অনেকটা সময় ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম,”—এই কণ্ঠস্বর তার মাথার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। অভিষেক প্রথমে ঘাবড়ে গেল, কিন্তু ঠিক সেই সময় সে দেখতে পেল দেয়ালের ওপর তার নিজের ছায়া নেই, কিন্তু বাম দিকের দেওয়ালে ভেসে উঠছে কিছু শব্দ—এমনকি সেগুলো চলন্ত, যেন কেউ টাইপ করে যাচ্ছে এক অদৃশ্য যন্ত্রে। লেখা উঠছে তার প্রতিটি চিন্তার ভিত্তিতে, তারই মুহূর্তের ভাবনা, শ্বাস, সন্দেহ, বিশ্বাস। “তুমি এখন পাঠক নও। তুমি একজন সম্ভাব্য রূপ। এক ভবিষ্যৎ, যাকে আমরা অনেক আগে থেকেই জানি। এখানে সময় লেখা হয়, অনুভব পড়া হয়, আর স্মৃতি সম্পাদনা হয়,”—এমনই ছিল সেই কণ্ঠস্বরের ভাষা। এই ঘর ছিল সময়ের এক সিমেন্টেড স্তর, যেখানে যেটা ঘটেছে, হচ্ছে, এবং ঘটবে—সব কিছু একসঙ্গে উপস্থিত, কিন্তু কেবল অনুভূতির ক্যানভাসে। অভিষেক হঠাৎ দেখতে পেল, সামনের দেয়ালে তার জীবনের কয়েকটা মুহূর্ত—মায়ের মৃত্যু, কলেজে প্রথম ক্লাস, ডলির সঙ্গে প্রথম কথোপকথন—সব ভেসে উঠছে কালো অক্ষরে। সে এক ধরণের ভারমুক্ত অনুভব করল, যেন নিজেকেই বাইরে থেকে দেখছে, এক পাঠক হয়ে।
হঠাৎ সেই সাদা ঘরজুড়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে এল, আর মাঝখানে আলোকিত হয়ে উঠল একটা গোল টেবিল, তার উপর রাখা কিছু বই—কিন্তু এরা কোনো সাধারণ বই নয়। তাদের পৃষ্ঠাগুলো কাচের মতো স্বচ্ছ, আর অভিষেক তাকাতেই প্রতিটি বইয়ে ভেসে উঠছে তার ভবিষ্যৎ। একটিতে লেখা, “তুমি লাইব্রেরির মধ্যেই রয়ে যাবে, কখনও ফিরে যাবে না।” অন্যটিতে—“তুমি ফিরে যাবে, কিন্তু তুমি আর তুমি থাকবে না।” আরও একটিতে লেখা—“তুমি নিজের অতীতকেই মুছে ফেলবে, ভবিষ্যতের একজন কাহিনিকার হয়ে উঠবে।” কণ্ঠস্বর বলল, “তুমি যা ভাবছো, সেটাই সত্য নয়। কারণ ভবিষ্যৎ এখানে ধরা যায়, কিন্তু তাকে বেছে নিতে হলে ভুলে যেতে হয় নিজের ভিতরের দৃঢ়তা। তুমি কী হতে চাও?” অভিষেক জানত না উত্তর। সে কোনও বই স্পর্শ করেনি, কেবল চেয়ে ছিল—আর ঠিক তখনই চারপাশে একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। বইগুলো বাতাসে ভেসে উঠতে লাগল, ঘরের দেয়ালে দেখা যেতে লাগল অন্যান্য মুখ—অন্যান্য ‘অভিষেক’, যাদের কেউ লাইব্রেরির মধ্যেই থেকে গেছে, কেউ ফিরে গিয়েছে, কেউ লিখে গিয়েছে এমন কিছু, যা অন্যরা আজও পড়ছে। সে বুঝতে পারল, এই ঘর কোনও একক বাস্তবতা নয়—এটি এক ‘সম্ভাব্যতা ঘর’, যেখানে প্রত্যেক পাঠক একটা বিকল্প ভবিষ্যতের প্রতিনিধি।
এইবার সেই কণ্ঠস্বর আরও নরম, আরও ব্যক্তিগত হয়ে উঠল। “তুমি যদি ফিরে যাও, তুমি সব কিছু মনে রাখবে না। শুধু অনুভবটুকু থাকবে—যে তুমি কোনোদিন কোথাও এক লাইব্রেরির মধ্যে ঢুকেছিলে। যদি থাকতে চাও, তবে লিখে যেতে হবে। কারণ এখানকার ভাষা তুমি—তোমার ভাবনা, তোমার যন্ত্রণা, তোমার ভালোবাসা। এখানে কেউ আর একা নয়, সবাই একে অপরের লেখক।” অভিষেক তখন বুঝে গেল, তার সামনে কেবল সিদ্ধান্ত নয়—তার সামনে একটি অস্তিত্বের রূপান্তরের দরজা খুলে গিয়েছে। সে যদি বইয়ে হাত রাখে, সে হয়ে উঠবে কাহিনির স্রষ্টা—যার নাম থাকবে না, কিন্তু যার লেখা অন্যরা পড়বে ভবিষ্যতের দিনগুলিতে। আর যদি সে ফিরে যায়, তবে হয়তো সব ভুলে গিয়ে, শুধু একটা স্বপ্নের রেখা নিয়ে বাঁচবে। সেই মুহূর্তে, অভিষেক ধীরে ধীরে একটা বইয়ের দিকে হাত বাড়াল—বইটির নাম ছিল না, মলাটে কেবল তারই চোখ আঁকা, আর নিচে লেখা ছিল, “তুমি যতবার আমাকে পড়বে, আমি ততবার তোমাকেই লিখে যাবো।” ভবিষ্যতের কণ্ঠ তখন নিঃশব্দে মিশে গেল বাতাসে, আর ঘরের আলো নিভে গেল। এবং অভিষেক বুঝে গেল—সে আর কোনও দুনিয়ার পাঠক নয়। সে এখন নিজেই এক লাইব্রেরি। সে এখন ভবিষ্যতের একজন স্বর।
৭
পাহাড়ি গ্রাম চাংথাং-এ সেই সপ্তাহের সকালগুলো অদ্ভুত রকম শান্ত। কুয়াশা জমে থাকা আকাশের নিচে পাহাড়ের গায়ে গায়ে যেন সময় জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ডলি লেপচার মনে তখন ঝড় উঠেছে। অভিষেক দাশগুপ্ত নিখোঁজ হয়েছেন তিন দিন আগে—সকালবেলা বেরিয়ে গিয়েছিলেন ভবঘুরে লাইব্রেরির দিকে, আর আর ফিরেননি। গ্রামের লোকেরা চুপচাপ, কেউ কেউ চোখ ঘুরিয়ে নেয়, কেউ বলে, “আরেকজন গেল…” ডলি কিন্তু চুপ করে বসে থাকার মানুষ নয়। তার জীবনে দ্বিতীয়বার এমন কেউ হারিয়ে যাচ্ছে, যে ছিল ভিন্ন, যে শুধু বিশ্বাস করত না গল্পে—গল্পের ভিতরে গিয়ে সত্য খুঁজতে চাইত। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো ফিরে আসবেন, কিন্তু গতরাতের স্বপ্ন তাকে জাগিয়ে তোলে। সে দেখেছিল অভিষেক দাঁড়িয়ে আছেন একটা সাদা দরজার সামনে, তার হাতে একটা খাতা, মুখটা অস্পষ্ট—আর সে বলছে, “আমি আছি, কিন্তু আর আমি নই।” ঘুম ভাঙতেই ডলি বুঝেছিল, এ স্বপ্ন নয়, এটা এক আহ্বান। আর সেই আহ্বানে সাড়া না দিলে হয়তো আর কাউকেই ফিরে পাওয়া যাবে না। সেইদিন ভোরেই সে বেরিয়ে পড়ল—পিঠে একটা ব্যাগ, হাতে একটা তান্ত্রিক লেপচা তাবিজ, আর বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত জেদ নিয়ে।
ডলি পৌঁছাল সেই সিঁড়ির সামনে, যা ওঠে লাইব্রেরির দিকে। বাতাস কাঁপছিল, এবং আশ্চর্যভাবে দরজাটা ছিল একটু ফাঁকা—যেন কাউকে ডাকার জন্য অপেক্ষা করছে। গ্রামে শোনা কথায় বলে, কেবল একজন “পাঠাভ্যন্তরীণ”ই লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতে পারে—অর্থাৎ যে কাহিনির সঙ্গে জড়িত, কিন্তু পাঠক নয়, বরং চরিত্র। ডলি সেই চরিত্র। অভিষেকের জীবনে, অরণ্যের অনুস্মৃতিতে, এমনকি বিনোদের অতৃপ্ত অনুসন্ধানে—সেইসব মানুষের পাশে ডলি ছিল, আছে, এবং থাকবে। দরজায় পা রাখতেই সে টের পেল বাতাসের ভিতর তার নাম ধ্বনিত হচ্ছে—একটা কণ্ঠস্বরে নয়, বরং দেয়ালের গায়ে গায়ে, মেঝের প্রতিটি ধাপে ধাপে। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই সে দেখল, তাকগুলো নড়ছে না, পথ খুলছে না, বরং সব কিছু স্থির। ঠিক তখনই ডলি বলল, “আমি অভিষেককে খুঁজছি। ও কোথায় আছে?” তার প্রশ্ন বাতাসে হারাল না, বরং সামনের এক তাক হঠাৎ খুলে গেল, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি বই—যার উপর লেখা ছিল অভিষেকের নাম। বইয়ের পাতাগুলো খুলতেই ডলি দেখতে পেল সেই তিন দিনের সমস্ত ঘটনা—অভিষেক কী দেখেছে, কী পড়েছে, কীভাবে পৌঁছেছে সেই সাদা দরজার ঘরে। সে পড়ে ফেলল অরণ্য সেনের ডায়েরির অংশও, এবং বুঝতে পারল যে, এখানে কেউ কেবল হারিয়ে যায় না—তারা এক একটা ‘চাপা কাহিনি’ হয়ে রয়ে যায়, যারা তখন আবার অন্য কারও মাধ্যমে নিজেকে লিখে নেয়।
ডলি বুঝল, তাকে সাদা দরজার খোঁজ করতে হবে, যেখানে ভবিষ্যতের কণ্ঠ কথা বলে। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঝেতে হালকা কম্পন শুরু হল, আর সামনে এক অদ্ভুত আলো তৈরি হল—কুয়াশার ভিতর একটা চক্র ভেসে উঠল, তার মাঝখানে দরজা। ডলি এগিয়ে গিয়ে যখন দরজার সামনে দাঁড়াল, তখন একটা স্বর তার ভিতরে বলে উঠল—“তুমি পাঠক নও, কিন্তু তুমি কাহিনির ভিতর থেকে এসেছো। তুমি জানো ভালোবাসা কীভাবে লেখাকে রক্ষা করে।” দরজাটা খোলার আগে ডলি নিজের তাবিজটা বের করল—সেটা ছিল তার কাকার, বিনোদের দেওয়া শেষ উপহার। দরজার ভিতরে ঢুকতেই সে দেখতে পেল না একটাও তাক, একটাও বই। কেবল একটিই ঘর, যেখানে মাঝখানে একটি খালি চেয়ার, আর সামনে বসে আছেন অভিষেক—চোখে অপার শূন্যতা, হাতে সেই একই ডায়েরি, কিন্তু মুখে কোনও শব্দ নেই। ডলি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি লিখছো তো, কিন্তু নিজের কথা তো লিখছো না। তুমি তো হারিয়ে যাচ্ছো কাহিনির ভিতরে।” তখনই অভিষেক ধীরে ধীরে মাথা তুলল, চোখে ভেসে উঠল সেই পুরনো অভিষেক—যে প্রশ্ন করত, ভাবত, ভালোবাসত। সে বলল, “তুমি এসেছো… তুমি সত্যিই এসেছো?” ডলি উত্তর দিল না, কেবল তার হাত ধরল, আর তখনই চারদিক আলোয় ভরে উঠল। লাইব্রেরি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল—এমন একটা শব্দ, যেন সময় নিজেই কিছুটা ভারমুক্ত হল।
৮
লাইব্রেরির সেই গোপন কক্ষের আলো নিভে যাওয়ার পরে, চারদিক ধীরে ধীরে এক অন্যরকম আভায় জেগে উঠল। এটা আর আগের মতো কাঠের তাক বা সাদা দরজার ঘর নয়—এটা ছিল এক আক্ষরিক, কল্পনাতীত পাঠবিশ্ব। চারদিকে বই ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে, কিছু কাচের মতো স্বচ্ছ, কিছু আবার কুয়াশায় মোড়া, কিছু এত পুরনো যে তাদের মলাট নেই, শুধু গন্ধ আছে। অভিষেক ও ডলি যখন একসঙ্গে এই জায়গায় প্রবেশ করল, তখন তারা অনুভব করল যে কোনও শব্দ এখানে মুখে বলা যায় না—শব্দ নিজেরাই বাতাসে গড়ে ওঠে, আর পাঠকের মনে প্রবেশ করে। হঠাৎ করে একটা বই ডলির দিকে এগিয়ে এল—মাথার ওপরে ঘুরছিল, যেন এক কৌতূহলী পাখি। অভিষেক বলল, “এরা অপেক্ষা করছে।” ডলি চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কার জন্য?” অভিষেক একটু হেসে বলল, “লেখকের জন্য নয়, পাঠকের জন্যও নয়—এই বইগুলো অপেক্ষা করে স্মৃতির জন্য। আমরা যারা এসেছি, আমাদের হৃদয়ে যা থেকে যায়, সেটাই এখানে কাহিনি হয়ে জমা পড়ে।” সত্যিই, এক মুহূর্তে একটা বই খুলে গেল, আর তার ভিতর দিয়ে ভেসে উঠল ছোট্ট ডলির সেই দুপুর—যেদিন তার কাকা হারিয়ে গিয়েছিলেন। ডলি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল—এটা কোনও রূপক নয়, এটা বাস্তবের এক বিকল্প সংরক্ষণ।
তারা এগিয়ে যেতে লাগল সেই বিশাল ‘বই-ভুবনের’ গভীরে, আর একের পর এক ঘরে পৌঁছাতে লাগল, যেখানে কিছু বই নিজে নিজেই পড়া হচ্ছে, কেউ নেই সামনে—তবু পাতাগুলো উল্টাচ্ছে, শব্দ তৈরি হচ্ছে। অভিষেক বলল, “তুমি জানো, এখানে কেউ কেউ ফিরে আসতে চায় না, কারণ ফিরে গেলে তারা এই অভিজ্ঞতা ভুলে যায়। লাইব্রেরি সেই দাগটুকুও রেখে দেয় না।” ডলি তখন জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমরা কেন ফিরব না এখানে? এখানেই থেকে যাই না?” অভিষেক একবার থেমে গিয়ে বলল, “কারণ এই লাইব্রেরি আমাদের তৈরি করছে, কিন্তু কাহিনি তখনই পূর্ণ হয়, যখন কেউ তা পড়ে।” সেই সময়, সামনে এক দরজা খুলে গেল, ভিতরে বসে ছিলেন একজন বৃদ্ধ মানুষ, যার গলায় একই তাবিজ, যা ছিল ডলির পিঠের ব্যাগে। ডলি কিছু না বলেই বুঝে ফেলল—এ তার কাকা বিনোদ। কিন্তু বৃদ্ধ কিছু বলেন না, শুধু একবার চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়েন, যেন বলছেন—“তুমি পৌঁছেছো।” অভিষেক তার ডায়েরির প্রথম পাতা খুলে দেখল—সেখানে কোনও শব্দ নেই, কেবল একটা আয়না-সদৃশ কাগজ, যেখানে সে দেখল নিজের প্রতিচ্ছবি। ডলি বলল, “এখানে সময় থেমে যায়, কিন্তু তুমি বদলে যাও। আর এটাই ভবঘুরে লাইব্রেরির সত্য।” তখনই চারপাশের বইগুলো ধীরে ধীরে একে একে আবার ঘরে ফিরে যেতে লাগল, যেন নিজের জায়গায় বসে যাচ্ছে একটি নতুন পাঠকের জন্য।
সেই মুহূর্তে, তারা বুঝতে পারল লাইব্রেরি আসলে কোনও ভয়ঙ্কর রহস্য নয়, কোনও অশুভ ছায়া নয়—এটা এক জটিল, নীরব স্মৃতি-যন্ত্র। এটা এমন এক স্থান যেখানে প্রত্যেক মানুষের জীবনের এমন অধ্যায় জমা হয়, যেগুলো লিখে ওঠা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। অভিষেক বলল, “আমরা যদি এখানে থেকে যাই, তবে আমাদের কাহিনিও কেউ পড়বে না। আমরা ফিরে যাব, কিন্তু এই জায়গাটা আমাদের ভিতরে থেকে যাবে—একটা বিকল্প স্মৃতির মতো।” ডলি সম্মতি দিল। ঠিক তখনই লাইব্রেরি তাদের সামনে সেই পুরনো কাঠের দরজাটা ফেরত এনে দিল—এবার দরজার গায়ে লেখা, “যারা ফিরে যেতে চায়, তাদের সব ভুলে যেতে হবে না—কেবল হৃদয়ে রাখো, যে তোমার ভিতরেও এক লাইব্রেরি রয়েছে।” অভিষেক আর ডলি একসঙ্গে দরজার দিকে পা বাড়াল। পেছনে ভেসে এল এক কণ্ঠস্বর—ভবিষ্যতের সেই কণ্ঠ, এবার আরও শান্ত, আরও মানবিক—“তোমরা যারা ফিরে যাচ্ছো, জেনে রেখো—পাঠ শেষ নয়, এটা শুধুই বিরতি।” দরজা খুলল, আলো ঢুকল, আর দুই মানুষ ফিরে এল পাহাড়ের সেই ভোরে, যেখানে পাখিরা ডাকছে, আর কুয়াশা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে সূর্যের স্পর্শে। কিন্তু তাদের চোখে তখনও সেই অদ্ভুত বইয়ের আলোর ছায়া।
৯
ভোরের প্রথম আলো যখন চাংথাং গ্রামের উঁচু–নিচু ছাদের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে, তখন ডলি আর অভিষেক ধীরে ধীরে সেই পুরোনো মাটির রাস্তা ধরে ফিরছিল। চারপাশে যেন সব কিছু একই আছে—ঝিরঝিরে বাতাস, পাহাড়ের নিচু পাখির ডাক, রানু থাপার উঠোন থেকে বেরোনো ধোঁয়ার গন্ধ। তবু তাদের মনে হচ্ছিল, কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে, যা চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। এই পরিবর্তন সময়ের নয়—চেতনার। অভিষেক ভাবছিল, “আমি ফিরে এসেছি”—কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, যেন সে নিজের ছায়া হয়ে ফিরেছে। ডলি একবারও কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে শুধু অভিষেকের হাত শক্ত করে ধরে ছিল, যেন বলতে চাইছে, “তুমি যেখানেই থেকো, আমি এখানে আছি।” তারা দু’জনেই জানত—যে জায়গা তারা দেখেছে, যে স্মৃতি তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তা আর কখনও মুছে যাবে না। কিন্তু বাইরের দুনিয়াকে তা বোঝানো যাবে না। কারও পক্ষে বিশ্বাস করাও সম্ভব নয় যে, বইয়ের একটি ঘরে দাঁড়িয়ে কেউ ভবিষ্যতের মুখ দেখতে পেয়েছে। তারা পৌঁছল রানু থাপার কুঁড়ে ঘরের সামনে, দরজা খুলে বৃদ্ধা বললেন না কিছু, শুধু হাসলেন, যেন বুঝে গেলেন সব।
রানু থাপা শুধু একটা কথা বললেন—“তোমরা ফিরে এসেছো। সবাই পারে না।” অভিষেক চুপ করে তার হাতে ধরিয়ে দিল সেই খাতাটি, যেটা অরণ্য সেন রেখে গিয়েছিলেন। রানু কাঁপা হাতে বইটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন, “এটা এখন সম্পূর্ণ। যেটা অসম্পূর্ণ ছিল, সেটাই এখন এক অধ্যায় হয়ে গেছে।” অভিষেক বুঝতে পারল, ভবঘুরে লাইব্রেরির প্রকৃত রহস্য সময়কে আটকে রাখা নয়—বরং স্মৃতি ও আত্মার গভীরে এক আত্মদর্শনের আয়না তুলে ধরা। তারা দু’জনেই বুঝেছিল—তারা ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কেউই আর সেই আগের মানুষ নয়। তারা এখন এমন কিছু জানে, যা বলা যায় না। শুধু লেখা যায়। ডলি বলল, “আমরা কাউকে বলব না। তবু আমরা লিখে যাব।” অভিষেক একবার আকাশের দিকে তাকাল—মেঘ সরে গেছে, সূর্যের আলো পড়ছে পাহাড়ের ওপর। তার মনে হল, ভবিষ্যতের কণ্ঠ এখনও কানে বাজছে—কিন্তু তা এখন আর নির্দেশ নয়, বরং এক স্মৃতির অনুরণন, যা তার হাতকে লেখার জন্য উৎসাহিত করে যাচ্ছে। তার ভিতরে যেন সেই লাইব্রেরি এখনও বেঁচে আছে—পৃষ্ঠাগুলো উল্টোচ্ছে ধীরে ধীরে।
সন্ধ্যার দিকে তারা ফেরার প্রস্তুতি নিতে লাগল। অভিষেক নিজের খাতায় লিখতে শুরু করল। প্রথম লাইনে সে লিখল, “এই পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলো মানচিত্রে নেই। কিন্তু তারা আমাদের ভিতরেই থাকে—সেইসব স্মৃতির মতো, যেগুলো আমরা কখনও বলি না, কেবল অনুভব করি।” ডলি দূর থেকে তাকিয়ে হাসল—সে জানত, অভিষেক এবার লিখবে, কারণ সে দেখেছে, সে ছুঁয়েছে সেই সীমারেখা যেখানে পাঠক আর লেখকের ভেদ থাকে না। তারা দু’জনেই ঠিক করল, তারা ফিরে যাবে শহরে। ডলি আবার পাহাড়ি স্কুলে পড়াবে, আর অভিষেক তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবে—কিন্তু এবার সে শুধু পাঠ দেবে না, সে নিজের লেখা থেকে এক অনুচ্ছেদ পড়বে—একটা এমন অধ্যায়, যা কোনও বইয়ের মলাটে নেই, কিন্তু কিছু পাঠকের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। এবং একদিন, কেউ যদি কোনও পাহাড়ি লাইব্রেরির গল্প বলে, কেউ যদি বলে, “একটা জায়গা আছে, যেখানে সময় পড়ে থাকে বইয়ের পাতায়”—তবে তারা জানবে, সে গল্প সত্যি। কারণ তারা সেখানে ছিল। তারা জানত, ভবিষ্যতের পথ বইয়ের পাতায়ও লেখা যায়—যদি কেউ সত্যি শুনতে চায়।
১০
মাসখানেক কেটে গেছে। শহরে ফিরে আসার পরে অভিষেক তার পুরোনো জীবনকে ধীরে ধীরে ছুঁতে শুরু করেছিল—বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, ছাত্রদের প্রশ্ন, ধুলোমাখা লাইব্রেরি, পুরনো সহকর্মীদের ক্লান্ত আলাপ। কিন্তু সে আর আগের মানুষ ছিল না। তার চোখে একটা অতল গভীরতা এসেছে, যেটা ছাত্ররাও মাঝে মাঝে লক্ষ করে। তার লেখা এখন বদলে গেছে—তথ্যের গাঁথুনি নয়, বরং স্মৃতির নদীর মতো বয়ে চলা বাক্য। ডলি ফিরে গেছে পাহাড়ি স্কুলে—সে এখন শুধু শিক্ষক নয়, এক গল্প বলা মানুষ হয়ে উঠেছে, যার মুখে মাঝে মাঝে ছায়া নামে, আর শিশুরা বিস্ময় নিয়ে বলে, “ম্যাম, আপনি কী সত্যিই একটা লাইব্রেরির ভেতরে হারিয়ে গেছিলেন?” ডলি হাসে, কিছু বলে না, শুধু একটুখানি দূরে তাকিয়ে থাকে। কেউ জানে না তারা কী দেখেছে। কিন্তু রাতের নির্জনতায়, এক এক বইয়ের পাতায়, এক একটা ডায়রির প্রান্তে—তাদের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন রয়ে গেছে। অভিষেক মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখে, তার ডেস্কে পড়ে থাকা খাতায় নতুন শব্দ লেখা—যা সে লেখেনি। অথবা সে যেন নিজেরই লেখা পড়ছে প্রথমবার। এমনকি, তার ক্লাসে যখন এক ছাত্র বলল, “স্যার, আপনি আমাদের সময়ের বাইরে থাকা গল্প বলুন”—তখন সে থেমে গিয়ে ভাবল, সময়ের বাইরে কি কিছু সত্যিই থাকে?
একদিন বিকেলে অভিষেক এক পুরোনো কফিশপে ডলির পাঠানো চিঠি পড়ছিল। চিঠিতে ডলি লিখেছে, “তুমি কি জানো, প্রতিদিন স্কুলের লাইব্রেরিতে একটা খালি তাক দেখি। যেন সেখানে একটা বই রাখা আছে, কিন্তু দেখা যায় না। হয়তো তুমি লিখবে একদিন, আর সেটা সেই শূন্য জায়গা পূরণ করবে।” সেই চিঠির শেষ লাইন ছিল—“তুমি কি জানো, কবে আমরা আবার ফিরব সেই পাহাড়ে?” অভিষেক উত্তর লেখেনি। কারণ সে জানত, ভবঘুরে লাইব্রেরি কাউকে ডাকলে, কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না। সে একদিন হয়তো ফিরবে, হয়তো নয়। কিন্তু তার লেখা ফিরবে—প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি ছন্দে। তার ছাত্রেরা আজও বলে, “স্যার, আপনি যে সময় নিয়ে কথা বলেন, তা তো ইতিহাস নয়, যেন একটা জীবন্ত চরিত্র।” অভিষেক তখন শুধু বলে, “সময় আসলে এক পাঠযোগ্য শরীর। তুমি যত গভীরে পড়ো, তত বেশি হারিয়ে যাও নিজেই।” সেই বিকেলে, সে একটা নতুন খাতা খুলল। প্রথম পাতায় লিখল, “আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু আমিই কি সেই আমি?” তারপর সে লিখল লাইব্রেরির প্রথম দৃশ্য—কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা দরজা, যার ওপারে কাহিনি নিজে নিজে লেখা হয়। শব্দগুলো যেন ঝরে পড়ছিল আত্মার গভীরতা থেকে।
তিন বছর পরে, চাংথাংয়ের সেই পাহাড়ি লাইব্রেরির কাছে আবার কুয়াশা জমেছে। কেউ একজন সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে—নতুন কেউ। হয়তো আরেক অভিষেক, আরেক ডলি। অথবা সম্পূর্ণ নতুন একটি চরিত্র, যার কাহিনি এখনও লেখা হয়নি। ভবিষ্যতের কণ্ঠ আবার জেগে উঠবে—ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে। আর লাইব্রেরির সেই শূন্য তাকটি অপেক্ষা করবে, নতুন কোনও স্মৃতির জন্য, যা পাঠে ধরা পড়বে না, কিন্তু হৃদয়ে থেকে যাবে চিরকাল। ভবঘুরে লাইব্রেরি কাউকে আটকায় না। সে কেবল ডাকে। যারা শুনতে পায়, তারাই চলে আসে। যারা চলে আসে, তারা আর কোনওদিন পুরোপুরি ফিরে যেতে পারে না। কেবল তারা হয়ে ওঠে কাহিনির এক অবিচ্ছেদ্য পৃষ্ঠা। এবং একদিন, হয়তো তুমিও, হ্যাঁ, ঠিক তুমিও যদি সেই পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে দাঁড়াও—যেখানে কুয়াশার ভেতরে একটা দরজা দাঁড়িয়ে থাকে—তবে মনে রেখো, সে কাহিনি কিন্তু অনেক আগেই লেখা হয়ে গেছে।
—
সমাপ্ত