Bangla - হাস্যকৌতুক

ভজহরি মামার বউ খোঁজা

Spread the love

বাপ্পা মণ্ডল


পাড়ার সবচেয়ে আজব চরিত্র যদি কেউ হয়, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে ভজহরি মণ্ডল। বয়স ৪৫ হলেও মনটা আটকে আছে ১৮-তে। বগলে রেডিও, গলায় প্রেমের গান, মুখে রসিকতা—এই হলো তার দৈনন্দিন জীবন। পুরো গ্রাম তাকে চেনে “ভজহরি মামা” নামে—কেউ হাসে, কেউ বিরক্ত হয়, কিন্তু সবাই জানে, তার মত ব্যাচেলর আর হয় না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই ভজহরির মাথায় চেপে বসে বিয়ের ভূত!
“আমি কি বিয়ে করব না?”—এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয় এক অসম্ভব মজার, অদ্ভুতুড়ে এবং কখনো কখনো আবেগঘন অভিযান।

পর্ব ১: ব্যাচেলর বোম্বা ভজহরি

ভজহরি মণ্ডল—এই নামটা শুনলেই গাঁয়ের মানুষদের মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কেউ বলে তিনি পাগল, কেউ বলে বাউণ্ডুলে। কিন্তু একথা সবাই মেনে নেয়—তিনি বেজায় ‘অরিজিনাল’ লোক। বয়স পঁইতাল্লিশ হলেও ভজহরির মুখে এখনও কিশোরের মতো একধরনের ছেলেমানুষি ছাপ। তার চলাফেরা, কথা বলার ধরণ, আর ভাবগম্ভীর গোঁফ পাকানো দেখে লোকজন ভাবে তিনি যেন সিনেমার কোনো কমেডি চরিত্র।

ভজহরির জীবনটা ঠিক কেমন?

সকালে উঠেই সে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকায়। এক কাপ চায়ের বদলে রেডিওর গানেই তার ঘুম কাটে। বগলে একখানা রেডিও, চেয়ারে বসে সে গলা মিলিয়ে গায়—

“তুমি যে আমার, ও গো তুমি যে আমার!”

এই দৃশ্যটা পাড়ার মানুষদের কাছে একেবারে নিত্যদিনের। পাশের পাড়ার বউরা রান্না করতে করতেই বলে ওঠে,
“আহারে, ভজহরি মামা আবার প্রেমে পড়েছে বুঝি!”

একটা সময় ছিল যখন ভজহরি সত্যিই প্রেমে পড়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করে সে শহরে পড়তে গিয়েছিল, সেখানেই কলেজ ক্যান্টিনের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে। কিন্তু সেই মেয়েটা একদিন তাকে বলেছিল, “তুমি একটু বেশিই হাসো।” তারপর থেকেই ভজহরি বুঝে যায়—সবাই তার মজাকে সিরিয়াসলি নেয় না। তখন থেকেই সে ঠিক করে, প্রেম যদি না-ও হয়, হাসির অভাব থাকবে না।

তবে একটা কথা ঠিক—ভজহরি তার গোঁফ নিয়ে বেজায় গর্বিত। প্রতিদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে গোঁফ পাকায়, যেন কোনও রাজকীয় যুদ্ধের আগে সাজসজ্জা চলছে। পাড়ার এক বাচ্চা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “মামা, আপনার গোঁফে কি Wi-Fi ধরে?”
ভজহরি হেসে বলেছিল, “না রে পুচকে, এই গোঁফেই প্রেমের সিগন্যাল ধরে।”

গাঁয়ের মানুষজন যতটা না তার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত তার ভবিষ্যত নিয়ে। গ্রামের মোড়ের দাদুদের আড্ডায় রোজ আলোচনা চলে—
“ভজু মণ্ডলের আবার বিয়ে হবে রে?”
“ওরে বাবা! ও বিয়ের যোগ্য? মাথায় খালি ফানির পোকা।”
“আরে বিয়ে হলে ভালোই হবে। একটা কেউ তো থাকবে দেখাশোনার জন্য।”

ভজহরি কিন্তু এসব আলোচনা মোটেই কানে তোলে না। তার চোখে বিয়ে মানেই নাটক, নাটক মানেই গল্প, আর গল্প মানেই হাসি। সে নিজেই নিজেকে নিয়ে রসিকতা করে, “আমি এমনই ব্যাচেলর, যে বিয়ে করলে জাতির লোকসান!”

তবে এ বছর জানুয়ারি মাসের এক ঠান্ডা বিকেলে কিছু একটা বদলে যায়। ভজহরি চায়ের দোকানে বসে সিঙ্গারা খাচ্ছিল, আর পাশের রেডিও থেকে শোনা যাচ্ছিল এক পুরোনো প্রেমের গান—
“চিরদিনই তুমি যে আমার…”

হঠাৎ করে সে থেমে যায়। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে চিনু, তার ভাস্তেকে বলে,
“চিনু, একটা কথা বলি?”
“হে বলো মামা, নতুন প্রেম নাকি?”
ভজহরি সিরিয়াস গলায় বলে,
“আমি বিয়ে করতে চাই।”

চিনু হো হো করে হেসে পড়ে, চায়ের কাপটা পর্যন্ত পড়ে যেতে বসে।
“মামা, আপনি পেঁয়াজু খাওয়ার মতো বউও কিনতে চান বুঝি? এখনই বাজারে গিয়ে দেখে আসি নাকি?”

ভজহরি বলে,
“চিনু, এটা মজা না। আমি ভাবছি, এখন সময় এসেছে। বয়স তো কেবল একটা সংখ্যা। আর আমার মতো লোকের প্রেমে পড়া মানেই ইতিহাস তৈরি হওয়া।”

চিনু তখনও হেসেই চলেছে, কিন্তু ভজহরি মনের ভেতর সত্যিই একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

সেই রাতেই সে নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখে—

“আজ থেকে শুরু বউ খোঁজার অভিযান।
ব্যাচেলর ভজহরি এবার প্রেমের যুদ্ধ শুরু করলো।
জয় হবেই—হোক সে হোমিওপ্যাথি খাওয়া পাত্রী, কিংবা দুবাই স্বপ্ন দেখা কবি!”

পরদিন সকাল থেকেই সে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করতে শুরু করে। বাজার থেকে নতুন ফতুয়া কেনে, চুলে একটু নারকেল তেল দেয়, এমনকি পুরনো রেডিওটার বদলে একটা Bluetooth স্পিকার কিনে ফেলে, যেন গান শোনা আরও ‘মডার্ন’ হয়।

চায়ের দোকানে, মাছের বাজারে, এমনকি পঞ্চায়েত অফিসেও সে সবাইকে বলে বেড়ায়, “ভজহরি এবার পাত্রী চাই।”

কেউ বিশ্বাস করে, কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু ভজহরির চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি।
সে বলে,
“আমি শুধু বউ খুঁজছি না, আমি খুঁজছি এমন একজনকে, যার সঙ্গে জীবনটা গল্প হয়ে যাবে।”

এইভাবেই শুরু হয় ভজহরি মামার ‘বউ খোঁজা অভিযান’।
একটা অভিযান, যেখানে প্রেম আছে, পাগলামো আছে, হাসি আছে, কিন্তু সবকিছুর ওপরে আছে একটা বড় হৃদয়—যে হৃদয় প্রেম না পেলেও কখনো নিঃস্ব হয় না।

পর্ব ২: বউ খোঁজার প্রস্তাবনা

পৌষের শেষ দিক। হালকা শীত পড়েছে। সকালবেলা রোদের তাপে গাঁয়ের বাজার একটু একটু করে জমে উঠেছে। পান্তাভাত, শীতের ফুলকপি, নতুন আলু আর গুড়ের পিঠের গন্ধে ভরে আছে চারদিক। ঠিক সেই বাজারেই তেলেভাজার দোকানে বসে আছে ভজহরি মণ্ডল—চেয়ারে পা তুলে, বগলে রেডিও চেপে একহাতে বেগুনি মুখে দিচ্ছে, আর আরেক হাতে গোঁফে পাক দিচ্ছে।

চিনু, ভজহরির একমাত্র ভাস্তে, তখন একটা গরম জিলিপি মুখে পুরে আনন্দে চিবুচ্ছে। এই দুই মামা-ভাস্তের জুটি পাড়ায় বিখ্যাত—একজন পাগলাটে, আরেকজন তার গুণমুগ্ধ অনুগামী।

হঠাৎ ভজহরি মুখ ঘুরিয়ে চিনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“চিনু, একটা কাজ করবি?”

চিনু মুখে জিলিপি নিয়ে বলল,
“কি মামা? আবার কোনো কবিতা লিখবি নাকি?”

ভজহরি গম্ভীর গলায় বলল,
“না রে বোকা, এবার আমি সিরিয়াস। আমার বউ লাগবে। খাসা একটা।”

চিনুর মুখ থেকে প্রায় জিলিপিটা পড়ে যাচ্ছিল। সে চমকে বলল,
“মামা! বউ? আপনি?? এতোদিন তো বলতেন, ‘বউ হলে স্বাধীনতা যায়, প্রেমে পড়লে বুদ্ধি কমে।’ এখন এই কথা?”

ভজহরি বলল,
“বয়স তো আমার কিছু না। চেহারাটা দেখ, সিনেমার হিরো! গাঁয়ের সব বউরা আমাকে দেখে হেসে ফেলে—মানে তারা খুশি হয়। বুঝলি?”

চিনু এক গাল হেসে বলল,
“তাই বুঝি? ওদের হাসির কারণ আপনি বুঝতে পারছেন না, মামা!”

ভজহরি কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল,
“হাসি তাও ভালো রে! অন্তত মনোযোগ তো পায়। এখন চাই একটা জীবনসঙ্গিনী, যে আমার এই হাসি, গোঁফ আর রেডিওর প্রেম সব বুঝবে।”

চিনু বলল,
“তাহলে তো আপনাকে একটা খুব সাহসী মেয়ে খুঁজতে হবে, মামা! এক্কেবারে এডভেঞ্চারাস।”

ভজহরি মাথা নাড়ল। “ঠিক বলেছিস। এইজন্যেই তোর সাহায্য চাই। একটা ‘মিশন’ শুরু করব আমরা—নাম হবে ‘বউ হান্ট’!”

চিনু মুখ গম্ভীর করে বলল, “মানে রিয়েলিটি শো?”

“না রে বোকা! এই পাড়ার মেয়েগুলা, পাশের গ্রামের কন্যারা, এমনকি হাটের চায়ের দোকানের দিদিকেও রাডারে রাখতে হবে। আমি এবার আসলেই সিরিয়াস।”

চিনু একটুখানি হেসে বলল, “আপনি কি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেবেন নাকি? যেমনটা নিউজপেপারে দেয়?”

ভজহরি বলল, “তা ভাবছি! তবে তার আগে আমাদের কিছু শর্ত ঠিক করতে হবে। যেমন, পাত্রী চায়ের প্রেমিক হতেই হবে।”

“মানে?”

“মানে, চা না খেলে সে চলবে না। আমি দিনে পাঁচবার চা খাই। পাত্রীকে সাথে থাকতে হবে!”

চিনু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “বুঝলাম। আর?”

“সে গোঁফ-প্রেমিক হওয়া চাই। গোঁফ নিয়ে ঠাট্টা করলে চলবে না। বরং সে যেন বলে, ‘তোমার গোঁফই তোমার রত্ন।’”

চিনু বলল, “এইসব নিয়ে যদি কেউ হ্যাঁ বলে, তবে সে পাত্রী না, দেবী।”

ভজহরি চোখ উঁচু করে বলল, “দেবী হলে আপত্তি কী?”

চিনু তখন নিজের পকেট থেকে ছোট্ট একটা নোটবই বার করে লিখতে শুরু করল:
ভজহরি মামার পাত্রী খোঁজার শর্তাবলী—
১. চা প্রেমিক হতে হবে
২. গোঁফ-প্রেমিক হতে হবে
৩. রেডিওর গানে বিরক্ত হওয়া চলবে না
৪. প্রতিদিন অন্তত একবার হাসতে হবে
৫. প্রেমে পড়লে ভজহরি মামার কাব্যিক আবেগকে সম্মান করতে হবে

চিনু বলল, “এই নিলেই চলবে তো?”

ভজহরি একটু ভেবে বলল,
“আর একটা দে… বউ রান্না করুক কি না সেটা বড় কথা না, কিন্তু আমার মতো খেতে জানলে হবে।”

চিনু বলল, “মানে পেঁয়াজু খেতে পারলে ওটাই প্রেমের প্রমাণ?”

“সেই তো!”

এই বলে দু’জন আবার হো হো করে হেসে ওঠে।

এরপর দু’জনেই হাঁটতে হাঁটতে বাজারে বেরিয়ে পড়ে, যেন কোনো গুপ্তচর অভিযানে যাচ্ছে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা দেখলেই চিনু কানে কানে মামাকে বলে,
“মামা, ওই দিকের মহিলা ঠিক মনে হচ্ছে না! তার চোখে প্রেমের চিহ্ন নাই।”

ভজহরি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলত,
“চলো, পরেরটা দেখি।”

একপর্যায়ে ভজহরি মাছের বাজারে গিয়ে এক মাছওয়ালিকে জিজ্ঞেস করে বসে,
“আপনার বাড়িতে কোনো বিয়ে যোগ্য মেয়ে আছে? গোঁফ সহ্য করতে পারে এমন?”

মাছওয়ালির উত্তর—“গোঁফ থাকলেই তো আর মানুষ ভালো হয় না, বাবু!”

চিনু আবার হেসে গড়াগড়ি। ভজহরি তখন বলল,
“মাছ আর মেয়ে—দুটোই রূপে বড় বিপজ্জনক!”

বিকেলের দিকে তারা ফিরে এল চায়ের দোকানে। এবার সেই দোকানে নতুন একটা মেয়ে কাজ করছে। তার নাম ববিতা। মাথায় ছোট্ট বেণী, চোখে গম্ভীর চাহনি।

ভজহরি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বলল,
“একটা স্পেশাল চা দাও তো… মিষ্টি একটু বেশি।”

চা পেয়ে প্রথম চুমুকেই বলে উঠল,
“এই চায়ে প্রেম আছে। কে বানিয়েছে?”

ববিতা একটু অবাক হয়ে বলল, “আমি। কেমন হয়েছে?”

ভজহরি গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি চা না, তুমি আমার জীবনের নতুন রঙ।”

ববিতা কিছু না বলে হাসল।
পেছনে চিনু কানে কানে বলল,
“মামা, এইটা তো প্রেমের পাত্রী নাকি?”

ভজহরি বলল, “এই শুরু… প্রেমে পড়ার ভূতটা নড়েচড়ে উঠছে বোধহয়।”

চিনু মাথা নেড়ে বলল,
“তবে সাবধান থাকবেন মামা, ভূতের প্রেমে পড়লে মাঝরাতে কাঁথা চুরি যায়!”

পর্ব ৩: পাত্রী দেখার প্রতিযোগিতা

ভজহরি মণ্ডলের জীবনটা যেন হঠাৎ করে একটা মেগা সিরিয়ালের পর্বে পরিণত হয়েছে। একদিকে রেডিওতে পুরনো প্রেমের গান, অন্যদিকে বাস্তবে নতুন বউ খোঁজার অভিযান।
চিনুর সঙ্গে পরিকল্পনা মাফিক শুরু হলো পাত্রী দর্শনের অভিযান। লক্ষ্য—একটা “খাসা” বউ জোগাড় করা। না, শুধু সুন্দরী হলেই চলবে না। ভজহরির মতো গোঁফধারী রোমান্টিক কবি ও রেডিওপ্রেমিকের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবে, এমন পাত্রী দরকার।

চিনু একটা খাতা নিয়েছিল, তাতে প্রতিটি পাত্রী সম্পর্কে নোট রাখবে—”সাবজেক্ট ফাইল” নাম দিয়ে।

প্রথম পাত্রী: গিন্নি আর গোপন প্রেম

সকাল সকাল দু’জনে হাজির হলো প্রথম পাত্রীর বাড়িতে। দাওয়াতে বসেই পাত্রী এসে গেল—নাম কল্যাণী। শান্ত, লাজুক মুখ, ঘোমটার আড়ালে চোখের চাউনিতে যেন কবিতার ছায়া।

ভজহরি একটু গলায় রস এনে বলল,
“আপনার নামের মতো আপনার মুখেও কল্যাণ দেখা যায়।”

কল্যাণী কিছু বলার আগেই তার মা এসে চা ও নিমকি দিয়ে গেলেন। ভজহরি নিমকি মুখে দিয়ে তাকিয়ে রইল পাত্রীর মায়ের দিকে। মা বললেন,
“আপনি কি রেডিওতে কিছু করেন? আপনাকে তো কোথাও শুনেছি!”

ভজহরি একগাল হেসে বলল,
“না, আমি প্রেমে বাজি। মাইক ছাড়া কথা বললেই প্রেম জমে যায়।”

এইবার চায়ের কাপ ঠোঁটে নিয়ে পাত্রীর মা বললেন,
“আপনার গোঁফটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।”

ভজহরি হেসে ফেলে বলল,
“গোঁফে প্রেম বাঁধে, চোখে গল্প। আপনি যদি ছাত্রী হতেন, আমিই শিক্ষক হতাম!”

এ কথা শুনেই পাত্রীর মা চমকে উঠলেন। পাশে বসে থাকা কল্যাণীর চোখ ছানাবড়া। চিনু নিজের খাতায় লিখল:
অভিযান ব্যর্থ। মামা পাত্রী রেখে পাত্রীর মায়ে প্রেমে পড়েছে!”

দ্বিতীয় পাত্রী: দুবাই প্রেমিকী

দ্বিতীয় পাত্রী, পিয়ালী, একদম ফ্যাশনে ফিট। চুলে হাইলাইট, চোখে রঙিন ফ্রেমের চশমা, আর মুখে লিপগ্লসের ঝিলিক। পরিচয় হতেই বলল,
“আপনি কী করেন?”

ভজহরি বুক ফুলিয়ে বলল,
“আমি জীবনটাকে নিয়ে নাটক করি। রেডিও শোনি, গান গাই, আর প্রেম খুঁজি।”

পিয়ালী এক গাল হেসে বলল,
“আমার স্বপ্ন আমি দুবাই যাব। আপনি তো গরুর গাড়ি চড়েন!”

ভজহরি থমকে বলল,
“গরুর গাড়ির মধ্যেই তো আছে দেশি প্রেম। দুবাইয়ের হোটেলে সে প্রেম থাকবে না।”

পিয়ালী স্পষ্ট বলে দিল,
“আমি আধুনিক মানুষ, প্রেম চাই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের!”

ভজহরি মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে তোমার লাগবে ভিসা, আর আমার চাই বাংলা গানের সঙ্গী।”

চিনু নিচে লিখল:
বিয়েতে নয়, এই মেয়ে বিদেশেই যাবে। মামার ভাগ্যে নাই!”

তৃতীয় পাত্রী: কবিতার রানী

তৃতীয় পাত্রী—মীনাক্ষী। কলেজে বাংলার ছাত্রী, তার নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থও ছাপা হয়েছে। মুখে চুপচাপ, চোখে গম্ভীর ভাব।

ভজহরি হাসিমুখে বলল,
“তুমি কবিতা লেখো?”

মীনাক্ষী বলল,
“হ্যাঁ। আমার কবিতায় নারী স্বাধীনতার কথা থাকে।”

ভজহরি গম্ভীর হয়ে বলল,
“আমি বাঁশি বাজাই। ফুঁ দিয়ে প্রেম জাগাই।”

মীনাক্ষী অবাক হয়ে বলল,
“তাহলে আপনার প্রেম হাওয়ার মতো—আছে কি নেই বোঝা যায় না!”

ভজহরি গলায় ব্যথিত সুর এনে বলল,
“তবে কবিতা আর বাঁশির মধ্যে মিল আছে—দুটোই হৃদয়ের কথা বলে।”

মীনাক্ষী বলল,
“আপনার কবিতা শুনিনি, শুধু গোঁফ দেখেই কবি বলে মানতে পারব না।”

চিনু বলল,
“মীনাক্ষীদি একটু ভয়ানক, মামা। প্রেমের বদলে এই মেয়ে আপনাকে পাঠশালায় পাঠাবে!”

খাতায় লেখা হলো:
কবিতা আর গোঁফের মিল হলো না। ভজহরি মামা কবিরা এই প্রেমে ফেল করল।”

চতুর্থ পাত্রী: হোমিওপ্যাথির দাওয়াই

চতুর্থ পাত্রী, কল্পনা, একটু অন্যরকম। প্রথম দেখাতেই বলল,
“আমার কিছু শর্ত আছে বিয়ের জন্য।”

ভজহরি একটু চমকে বলল,
“বলুন, শুনি।”

“আমাকে বিয়ে করলে সপ্তাহে তিনদিন হোমিওপ্যাথি খাবার দিতে হবে।
চা-তে চিনি কম দিতে হবে।
আর রাতে রেডিও বন্ধ রাখতে হবে।”

ভজহরি চমকে উঠল।
“হোমিওপ্যাথি খাবার আগে তুমি হ্যাঁ বলো!”

কল্পনা বলল,
“হ্যাঁ বলবো, যদি সব মানেন।”

ভজহরি চিনু’র দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওরে রে! এটা বিয়ে নয়, যেন ওষুধের প্রেসক্রিপশন!”

চিনু খাতায় লিখল:
এই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে নয়, চেম্বারে দেখা করা উচিত।”

চারটি পাত্রী দেখে ফিরে এল ভজহরি মামা। মুখে চুপচাপ, চোখে চিন্তার ছায়া। চায়ের দোকানে বসে বলল,
“চিনু, প্রেমের বাজারে দাম খুব চড়া। কিন্তু মন দেওয়ার লোক নাই।”

চিনু বলল,
“মামা, বউ তো খুঁজছেন, কিন্তু আপনি যেন পাত্রী দেখে প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন!”

ভজহরি হেসে বলল,
“এটাই তো জীবন! প্রতিটা পাত্রী একটা গল্প, আর আমি সেই গল্পের ভজহরি হিরো!”

পর্ব ৪: প্রেমে পড়ার বিপত্তি

ভজহরি মণ্ডল প্রেমে পড়েছে।

হ্যাঁ, সত্যিই পড়েছে—এবার আর পাত্রীর মা, কবিতা লিখে যাওয়া পাত্রী, কিংবা হোমিওপ্যাথির চাহিদাসম্পন্ন কল্পনা নয়। এবার তার মন গিয়ে আটকাল পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে।

নতুন সহকারিণী ববিতা। বয়স কুড়ি পঁচিশ, কিন্তু চায়ের কাপ গরম রাখার মতো গরম মেজাজ আর ঠান্ডা হাসির অদ্ভুত মিশ্রণ। হালকা শাড়ি পরে দোকানে আসে, হাতে চায়ের কেটলি আর চোখে রোদচশমা—এ যেন ভজহরির কাছে একেবারে “চায়ের রানী”।

প্রেমের প্রথম চুমুক

ভজহরি প্রতিদিন বিকেলবেলা সেই চায়ের দোকানে গিয়ে বসতে লাগল। আগে যেখানে সে তিন টাকা দিয়ে এক কাপ চা খেত, এখন পাঁচ টাকাও দিলেও আপত্তি নেই—শুধু যদি ববিতার হাতে চা মেলে।

একদিন ববিতা তার সামনে কাপটা রাখতেই ভজহরি বলল,
“তুমি চা নয়, আমার জীবনের রঙ।”

ববিতা চোখ তুলেই বলল,
“আপনি চিনি খেতে পারেন, আমি খালি টিপস নিই।”

চায়ের দোকানে থাকা কিশোর-তরুণেরা তখন মুখ চেপে হাসছে। কেউ আবার বলল,
“ভজু মামা তো আজকেই প্রেমে পড়লেন!”

প্রেমের ঘোষণাপত্র

চায়ের দোকান থেকে ফিরেই ভজহরি পাড়ার মোড়ে গিয়ে ঘোষণা দিল,
“আমি বউ পেয়ে গেছি! এবার আর পাত্রী দেখতে যাব না। পাকা প্রেম!”

চিনু আশ্চর্য হয়ে বলল,
“মামা, এত তাড়াতাড়ি? পাত্রী তো আপনাকে এক কাপ চা ছাড়া কিছুই দেয়নি!”

ভজহরি গম্ভীরভাবে বলল,
“চা-ই তো জীবনের রস! সেই রস যদি প্রেমের হাতে পাই, তাহলে বিয়ে দূরের কথা—ভালোবাসাই যথেষ্ট।”

চিনু মনে মনে ভাবল, ‘মামার মাথা এবার একেবারেই নরম হয়েছে চায়ের মতো।’

বাইকারের আগমন

তিন দিন পরে হঠাৎ দেখা গেল এক লাল রঙের বাইকে একজন গোঁফছাঁটা যুবক এসে ববিতার সঙ্গে কথা বলছে। ববিতার মুখে হাসি, আর ছেলেটার হাতে হেলমেট।

চিনু, গোপন গোয়েন্দার মতো, ভজহরিকে খবর দিল:
“মামা, আমি যা শুনেছি তা শুনলে আপনার রেডিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে!”

“কি হলো রে?”

“ববিতা নাকি বলেছে—‘ও আমার বয়ফ্রেন্ড, ও বাইকার।’”

ভজহরির মুখ কেমন যেন থমকে গেল। কিন্তু গোঁফে হাত বুলিয়ে সে বলল,
“আমি সাইকেল চালাই, প্রেমে হার নেই! বাইক প্রেম দেয় না, শুধু হর্ন বাজায়।”

চিনু বলল,
“কিন্তু মামা, হর্নের আওয়াজেই অনেকে প্রেমে পড়ে যায়!”

ভজহরি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“চা-ও তো গরম হয়, ঠান্ডা হলে স্বাদ থাকে না। এখন দেখবি, কে কাকে ঠান্ডা করে ফেলে!”

প্রেমের পরিকল্পনা

ভজহরি এবার ঠিক করল—ববিতাকে জয় করতেই হবে।
পরদিন সকালে সে তার পুরোনো হারমোনিয়ামটা বার করে দোকানের সামনে বসে গেয়ে উঠল—
“তুমি চায়ের কাপে প্রেম,
আমি দুধ-চিনি মিশিয়ে গলিয়ে নিই তোমার নাম।”

পথচারীরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ববিতা দোকানের ভিতর থেকে মুখ বার করে হেসে বলল,
“চা খাওয়ার আগে গান? আজ তো প্রেম পাকা হয়ে যাবে!”

ভজহরি বলল,
“প্রেমে না হার্মোনিয়ামে বাজে, মনের তার ছিঁড়ে গেলেও গান থামে না।”

চিনু পাশে দাঁড়িয়ে সবার মোবাইল ভিডিও তোলার দৃশ্য দেখে বলল,
“মামা, এখন আপনি ভাইরাল হতে চলেছেন! প্রেম যদি না হয়, অন্তত ভিউ তো পাবেন।”

প্রেমের চূড়ান্ত বিপত্তি

দিন সাতেক চলল এই রোমান্টিক চেষ্টার ধারা। ভজহরি কখনো চায়ের সঙ্গে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে দিত, কখনো আবার কাগজে ছোট কবিতা লিখে দিত—“চায়ের কাপে তোমার হাসি, দিন শুরু হোক ভালোবাসা দিয়ে।”

শেষমেশ একদিন সাহস করে বলল,
“ববিতা, তুমি যদি বলো, আমি তোমার জন্য আমার সাইকেল বিক্রি করে রিকশা চালাতে রাজি।”

ববিতা একটু থেমে বলল,
“ভজহরি দা, আপনি খুব মিষ্টি, কিন্তু আমি আসলে ছেলেদের তেমন পছন্দ করি না।”

ভজহরি থমকে গেল।

“মানে?”

“মানে মানে… আমি মেয়েদের বেশি পছন্দ করি। আমি তো আপনাকে বন্ধু ভেবেই চা দিতাম।”

ভজহরি সেইদিন কোনো কথা না বলে দোকান ছেড়ে চলে গেল। গোঁফে হাত দিল না, রেডিও-টেডিও ভুলেই গেল। চিনু পরে গিয়ে দেখল, সে রেডিওর পাশে বসে আছে, আর গুনগুন করছে—
“তুমি যে ছিলে ভুল বোঝা প্রেম, এখন চা খাই চুপিচুপি একা একা।”

চায়ের দোকানের প্রেমে ভাটা পড়লেও ভজহরির সাহস কিন্তু কমে না। পরের দিন থেকেই আবার হাফ শার্ট, রেডিও আর পুরনো প্রেমের গান বাজিয়ে সে নতুন পাত্রী খোঁজার প্ল্যানে ব্যস্ত।

চিনু বলল,
“মামা, আপনি একটা প্রেমে পড়েন, আর আমরা সবাই চায়ের সঙ্গে ঝালমুড়ি খাই!”

ভজহরি হেসে বলল,
“জীবনটা তো চায়ের কাপ! নাড়লে ঝাঁঝ বাড়ে, আর হেসে খেলে প্রেমের মতো মিষ্টি হয়।”

পর্ব ৫: বিবাহবার্তা ও ব্রেকআপ

চায়ের দোকানে ববিতা-প্রেমে হৃদয়ভঙ্গের পরে ভজহরি মণ্ডল একপ্রকার জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল—
বিয়ে করতেই হবে!

না আর প্রেম, না আর চায়ের কাপে কবিতা—এইবার পাকা কাজের পালা।
সকালবেলা চুল আঁচড়ে, গোঁফে পাক দিয়ে সে ঘরে বসে বিজ্ঞাপন লেখার মহাপরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে উঠল।

বিজ্ঞাপনের ভাষা

ভজহরি একখানা কাগজে কালো কালিতে লিখল—

পাত্র চাহিয়াছে—গোঁফে পাক ধরা প্রেমিক, ভালোবাসায় পাকা, রান্না জানে না, তবু বউকে ভালোবাসতে জানে। পেশা: প্রেমিক, নেশা: কবিতা বাঁশি বাজানো।

বয়স: বললে মন খারাপ হবে না, অভিজ্ঞতা: অনেক ব্যর্থ প্রেম।

যোগাযোগ: ‘ভজহরি ভবন’, মোড়ের পেছনে, কাকের বাসার পাশের পাকা বাড়ি।

চিনু বলল,
“মামা, এটা কি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন, না নাটকের চিত্রনাট্য?”

ভজহরি গম্ভীর হয়ে বলল,
“চিনু, প্রেম যেমন খাঁটি লাগে, বিয়েও হোক খাঁটি কথায়!”

পাত্রীর আগমন

বিজ্ঞাপন ছাপার দুই দিনের মধ্যেই ভজহরির বাড়িতে হাজির চারজন পাত্রী—
চার ধরণের মেজাজ, চার রকমের পছন্দ, আর চারখানা চাহিদা!

প্রথম মেয়ে: সরাসরি বাস্তববাদী

সে দরজায় ঢুকেই বলল,
“আপনার তো টাকাও নেই, চুলও কম। জীবন চালাবেন কিভাবে?”

ভজহরি হাসতে হাসতে বলল,
“চুল নেই তো কী হয়েছে! মাথার ভেতরে এখনো প্রেমের বাতি জ্বলে।”

মেয়েটি বলল,
“আমি প্রেম না, ভাত-ডাল খেতে চাই!”
বলেই বেরিয়ে গেল।

দ্বিতীয় মেয়ে: হাসিবিরোধী

সে এসেই বলল,
“আপনার হাসি ভয়ংকর! মনে হয় ভূতের সিনেমা শুরু হলো!”

ভজহরি বলল,
“আমি তো হাসলেই সবাই হাসে—আপনি ব্যতিক্রম।”

মেয়েটি বলল,
“না, আমি ভয়ের সিনেমা দেখতে পছন্দ করি না।”
তিনিও চলে গেলেন।

তৃতীয় মেয়ে: সন্দেহপ্রবণ

“আপনি কি সত্যিই বিয়ে করতে চান, না কেবল হাসানোর জন্য এসব করছেন?”

ভজহরি বলল,
“আমি রসিক, তবে ভালোবাসায় সিরিয়াস!”

মেয়েটি বলল,
“আপনি পাগল নাকি?”
ভজহরি মাথা চুলকে বলল,
“পাগলামিতেই তো প্রেম আসে!”
সে ফিরেও তাকাল না।

চতুর্থ মেয়ে: ‘দেখা যাক’ গোত্রের

সে এসে বলল,
“চলো, দেখি কী হয়।”

চিনু কানে কানে বলল,
“মামা, এইটাতেই আশা আছে!”

প্রেমের ডেট এবং ডোব

ভজহরি সেই মেয়েটিকে নিয়ে প্রথম ডেটে গেল পাড়ার সবচেয়ে নামী আইসক্রিম পার্লারে।
মেনু কার্ড হাতে নিয়ে বলল,
“তুমি যা চাও, আমি তাই খাব।”

মেয়েটি বলল,
“আমি ডার্ক চকলেট খাই। আপনি?”
ভজহরি বলল,
“তুমি যেটা খাও, সেটাই আমারও প্রিয়। প্রেমে স্বাদ মিলতেই হয়!”

দু’জনে মিলে আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করছিল। হঠাৎ মেয়েটি মাথা নুইয়ে বলল,
“ভজহরি দা, একটা কথা বলি?”

ভজহরি ভাবল, “এই তো হলো। এখন প্রেমের প্রস্তাব আসবে।”
সে গম্ভীর হয়ে বলল,
“বলুন, আমি মনের দরজা খুলে রেখেছি।”

মেয়েটি বলল,
“আমি আসলে ছেলেদের তেমন পছন্দ করি না। আমি মেয়েদেরই বেশি পছন্দ করি।”

ভজহরির মুখ ফ্যাকাশে, গলার আওয়াজ গিলে গেল আইসক্রিমের সঙ্গে।

সে বলল,
“মানে? তাহলে আমি যে বিয়ে করতে চাচ্ছি?”

মেয়েটি হেসে বলল,
“ভালো বন্ধু হই না? আমি কাউকে বিয়ে করবো না।”

ভজহরি ফিরে এল একা, হাতে গলে যাওয়া আইসক্রিম আর মনের গলে যাওয়া স্বপ্ন।

মন ভাঙা রেডিও

বাড়ি ফিরে এসে রেডিও চালু করল।
রেডিওতে বাজছে—
জীবনে যদি প্রেম না মেলে, হাসির গল্প লিখে ফেলো!”

চিনু এসে বলল,
“মামা, এবার কী করবেন?”

ভজহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“চিনু, প্রেম আমার কপালে নেই, তবে গল্পে আছে! আর আমার গল্প হাসির, চোখের জলের নয়।”

ভজহরির উপলব্ধি

পরদিন সকালে সে নিজের আয়নায় তাকিয়ে বলল,
“ভজু, প্রেম তো এল, আবার গেল, কিন্তু তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস—একখানা মুঠোফোন, একটা রেডিও, আর অনেক হুমড়ি খাওয়া স্মৃতি নিয়ে।”

গাঁয়ের লোকজন আবার বলতে শুরু করল,
“ভজহরি মামা আবার ব্যাচেলর রইল?”

ভজহরি হাসল, বলল,
“ব্যাচেলরই থাকি, তবে হ্যাপি ব্যাচেলর! প্রেম না থাকলেও আমি তো হাসতে জানি, আর হাসাতে জানি!”

চিনু বলল,
“মামা, এইবার তো মনে হচ্ছে আপনার বিয়ের যাত্রা শেষ!”

ভজহরি বলল,
“শেষ না, চিনু। এটা তো একটা অভিযান। অভিযান মানে হলো—গন্তব্যের চেয়ে পথটা বেশি মজার।”

ভজহরি মামার বিজ্ঞাপন শেষে বিয়ে তো হলো না, তবে অভিজ্ঞতা হলো অনেক!
একটা কথা ঠিক—ভজহরির গল্প যত না প্রেমের, তার চেয়ে অনেক বেশি রসের।
আর সে ঠিক করল, পরের অধ্যায়ে তার জীবনে আবার নতুন কিছু শুরু হবে… না প্রেম, না বিয়ে—এইবার বন্ধুত্বের হাওয়া!

পর্ব ৬: ভজহরির বিয়ে — শেষ না শুরু?

ভজহরির বিয়ের বিজ্ঞাপন ব্যর্থ, প্রেমের চেষ্টা ব্যর্থ, পাত্রীর সাক্ষাৎকারগুলো প্রহসন।
সেই দিন বিকেলে সে রেডিওটা বন্ধ করে একরাশ চুপচাপ হয়ে বসেছিল।
চিনু এসে বলল,
“মামা, এবার সত্যিই মনে হচ্ছে অভিযানটা শেষ!”

ভজহরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অভিযান তো চলছিল মনের, কিন্তু বউ খুঁজতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলছিলাম বুঝি!”

এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল একজন—
সাবিত্রী দেবী, পাড়ার বিধবা গিন্নি। বয়স পঞ্চাশের ঘরে, কিন্তু মুখে একরাশ শান্তি।

সাবিত্রী দেবীর প্রস্তাব

ভজহরি ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“দিদি, আপনি? আজ এত সকালে?”

সাবিত্রী শান্ত গলায় বললেন,
“ভজু, চাইলে আমার সঙ্গে হাওয়া বদল করতে পারো।”

ভজহরি চোখ কপালে তুলে বলল,
“মানে! আপনি কি আমায় প্রেম প্রস্তাব দিলেন নাকি?”

সাবিত্রী হেসে ফেললেন,
“না রে বাপু! বিয়ে না হোক, বন্ধুত্ব তো হতে পারে। এই বয়সে একাকিত্ব কমানো যায় না বুঝি?”

ভজহরির চোখ চিকচিক করে উঠল।
সেই চোখে কোনও রোমান্স ছিল না, ছিল বোঝাপড়ার স্বস্তি।

বন্ধুত্বের শুরু

সেই থেকে শুরু হলো নতুন অধ্যায়।
সকালে সাবিত্রী দেবী আর ভজহরি হাঁটতে যায়—
ভজহরি লুঙ্গি পরে, সাবিত্রী দেবী আঁচল সামলে।

সন্ধ্যাবেলা, পাড়ার মোড়ে বসে চা খায়, একসঙ্গে খোশগল্প করে।
ভজহরি বলে,
“তুমি কি জানো, আমি একসময় প্রেমে পড়েছিলাম রেডিওর ঘোষিকার?”

সাবিত্রী বলেন,
“আর আমি একসময় চাইতাম সিনেমার নায়িকা হই!”

চিনু বলল,
“মামা, এইটা তো বউ খোঁজা অভিযান না, বন্ধুত্ব দিবস পালনের গল্প!”

ভজহরি হেসে বলল,
“বিয়ে না হোক, হাওয়া বদলই তো ভালোবাসার প্রথম ধাপ!”

পাড়ার গুঞ্জন

পাড়ায় গুজব ছড়াতে সময় লাগে না।
কেউ বলল,
“ভজহরি মামা তো সাবিত্রীর সঙ্গে প্রেম শুরু করেছে।”
আরেকজন বলল,
“বিয়ে করবে নাকি? এ বয়সে আবার নতুন সংসার?”

কিন্তু ভজহরি বলল,
“না রে ভাই, আমরা প্রেম করি না, তবে একে অপরকে সময় দিই।”

সাবিত্রী বললেন,
“জীবনে অনেক কিছু মিস করি আমরা। বন্ধুত্ব যেন তার একটা পূরণ।”

এক বিকেলের প্রশ্ন

একদিন বিকেলে ভজহরি আর সাবিত্রী বসেছিল পুকুরপাড়ে।
হলুদ আলোয় হাঁসেরা ডানা মেলছিল, বাতাসে ছিল শান্তির শব্দ।

ভজহরি জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কখনো মনে করো, জীবনে যদি আবার বিয়ে করতে পারতে?”

সাবিত্রী বললেন,
“না ভজু, আমি এখন আর কাউকে ভালোবাসার জন্য খুঁজি না। খুঁজি এমন কাউকে, যার সঙ্গে চুপচাপ বসে থাকা যায়।”

ভজহরি চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“তাহলে আমরা তো ঠিক আছি!”

চিনুর জিজ্ঞাসা

চিনু একদিন বলল,
“মামা, তাহলে অভিযানটা শেষ?”

ভজহরি বলল,
“শেষ? না না, এই তো শুরু। আমি খুঁজছিলাম বউ, পেয়েছি বন্ধু। বউ তো সংসার দেয়, কিন্তু বন্ধু দেয় সাহচর্য।”

চিনু বলল,
“তবে গল্পের নাম ‘বউ খোঁজা অভিযান’ কেন?”

ভজহরি হেসে বলল,
“কারণ আমরা যা খুঁজি, তা পাই না; কিন্তু যা পাই, তা আমাদের গল্প তৈরি করে।”

পাড়ার ছেলেমেয়েদের বাণী

ভজহরি আর সাবিত্রী একদিন স্কুলের মাঠে বসে ছিল। ছেলেমেয়েরা দৌড়াচ্ছে, হাসছে, খেলছে।

ভজহরি হঠাৎ বলল,
“তাদের জীবনে এখনো সবকিছু নতুন। প্রেমও, স্বপ্নও।”

সাবিত্রী বললেন,
“আর আমাদের জীবনে? স্মৃতি আর সাহচর্য।”

তারা ছেলেমেয়েদের বলল,
“জীবনটা শুধু বউ নয়, বউ না থাকলেও ভাল থাকা যায়!”

একজন কিশোর বলল,
“ভজহরি মামা, আপনি একদম কুল!”
আর এক কিশোরী বলল,
“আপনার গল্পটা সিনেমা হলে হিট হবে!”

নতুন চিঠি, নতুন আশা

একদিন চিঠি এল ভজহরির নামে—
এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা চিঠিতে লিখেছেন—

“ভজহরি মণ্ডল, আপনার গল্প শুনে আমি হাসি। আমারও বিয়ে হয়নি। চলুন, আমরা একসঙ্গে গল্প লিখি। পত্রমিতালী করব নাকি?”

ভজহরি চিনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“চিনু, মনে হয় অভিযান আবার শুরু হচ্ছে!”

চিনু বলল,
“মামা, এইটা তো সিজন টু হবে!”

ভজহরি মামার বউ খোঁজা অভিযান এক অর্থে ব্যর্থ, আবার এক অর্থে সার্থক।
সে বউ পায়নি, কিন্তু পেয়েছে এমন একজনকে, যার সঙ্গে চুপচাপ হাসা যায়, চা খাওয়া যায়, আর জীবনের হাওয়ায় হালকা হওয়া যায়।

জীবনে সব প্রেমে পরিণয় হয় না, তবে কিছু কিছু সম্পর্ক বিয়ে ছাড়াও পূর্ণতা পায়।
ভজহরি এবার জানে, সঙ্গ” মানেই সংসার নয়, কখনো কখনো শুধু একজন পাশে থাকা মানুষই যথেষ্ট।”

****

 

WhatsApp-Image-2025-06-08-at-5.04.45-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *