Bangla - রহস্য গল্প

ভগ্ন কুঠিরের প্রতিধ্বনি

Spread the love

তন্ময় লাহিড়ী


নবান্নের আগে বর্ষা থেমে গিয়েছিল, কিন্তু গ্রামের কাঁচা রাস্তা এখনও স্যাঁতসেঁতে। হালকা কুয়াশায় মোড়া মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে সাব্যসাচী রায় তাকিয়ে ছিল ভগ্ন জমিদারবাড়িটার দিকে। ক’টা জানালার কাঁচ নেই, ছাদে আগাছার রাজত্ব, আর দেয়ালগুলোয় গাঢ় সবুজ শ্যাওলা লেপে আছে—তবু, সেই কুঠির যেন সময়ের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে এক অমোচনীয় অভিযোগ নিয়ে। শহর কলকাতার জীবন থেকে দূরে, বহু বছর পর সে আবার ফিরে এসেছে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেয়—কিন্তু এভাবে? কুড়িয়ে পাওয়া এক পুরনো চিঠির টানে, যেখানে লেখা ছিল—“কুঠির জেগে উঠেছে, সাব্যসাচী, ফিরে আয়।” পাঠিয়েছিলেন ভবানী দাসী, যিনি তার ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে কাজ করতেন, এখন একা থাকেন গ্রামের উপান্তে। সাব্যসাচীর মধ্যে একটা অদ্ভুত টান কাজ করছিল সেই দিন থেকেই—একটা অসম্পূর্ণ ইতিহাস যেন তাকে টেনে আনছিল।

গ্রামে পা দিয়েই সে টের পায়, এখানে বাতাসে একরকম চাপা ভয়। লোকেরা জমিদারবাড়ির পাশে যেতে চায় না, এমনকি দিনের আলোতেও। ভবানী দাসী তার ছোট কুঁড়ে ঘরে তাকে বসিয়ে বলেন, “তোকে যা বলার আছে, এখনই বলা উচিৎ।” তারপর ধীরে ধীরে খোলেন একটা বাঁধা ডায়েরি, পাতাগুলো কুড়মুড়ে আর সাদা কাগজে লালচে-কালো কালি দিয়ে লেখা—“সন্ন্যাসীর শেষ কথা।” সাব্যসাচী কাগজের গায়ে আঙুল রাখতেই কেমন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল তার শরীরজুড়ে। ভবানী জানালেন, এই ডায়েরি নাকি একবার আগুনে পড়েছিল, কিন্তু পুড়েনি। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, এই লেখাগুলোর ভিতর রয়েছে অভিশাপ, এবং সন্ন্যাসী কৃপালানন্দের আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায় ওই ভগ্ন কুঠিরে, কারণ শত বছর আগে জমিদার হরিনাথ রায় তাকে কৌশলে মেরে ফেলেছিলেন। ভবানী বললেন, “তুই জানিস না, তোর রক্তেই আছে সেই জমিদারের উত্তরাধিকার। এইবার সময় হয়েছে সেই ঋণ শোধের।” সাব্যসাচী অবিশ্বাস করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার ভিতরের ইতিহাস গবেষকও টের পাচ্ছিল—এখানে কোথাও একটা সত্য আছে, যেটা এখনো ধরা দেয়নি।

সেই রাতেই ঘটল প্রথম অদ্ভুত ঘটনা। সাব্যসাচী আর তার কলেজের বন্ধু তুষার, যে এখন স্থানীয় এক সংবাদপত্রে কাজ করে, তারা মশাল হাতে জমিদারবাড়ির সামনে গেল। বাতাস নিস্তব্ধ, ঝিঁঝিঁর ডাকে একটানা শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল। হঠাৎ একটা জানালায় আলো দেখা গেল—মশালের মতো নয়, আগুনের মতো ঝলসে ওঠা কোনো আলোর রেখা। সাব্যসাচীর বুক কেঁপে উঠল, তুষার ফিসফিস করে বলল, “ওই… তুই দেখলি তো?” তারা বাড়ির দিকে এগোতেই হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল গরম ধোঁয়ার মতো এক ঝাঁঝালো গন্ধ। মুহূর্তে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, মাটিতে সাড়া শব্দ, যেন কেউ পায়ে বেড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে উপরের ঘরে। তারা পেছন ফিরে দৌড়ে পালাল—কিন্তু সাব্যসাচী অনুভব করল, তার পিঠে যেন কেউ হাত ছুঁয়ে বলছে, “ফিরে আয়… সত্য এখনও গলা টিপে মরা পড়ে আছে।” সেই মুহূর্তে, সে বুঝে গেল—এই ভগ্ন কুঠির শুধু একটি ধ্বংসস্তূপ নয়, এটি একটি অপরাধের সাক্ষী, একটি অভিশপ্ত অতীতের প্রতিধ্বনি।

***

পরদিন সকালে সাব্যসাচী উঠে দেখল, গ্রামের মানুষদের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না, কিন্তু তার চোখে-মুখে, চায়ের দোকানে, উঠোনের বেঞ্চে চাপা গুঞ্জন—গত রাতে কেউ নাকি জমিদারবাড়ির সামনে আলো দেখতে পেয়েছে। কেউ আবার বলছে, শোনেনি, কিন্তু “ঘুমের ভেতর কার যেন নাম ধরে ডাক শুনেছে।” এমনকিছু কথা ছড়িয়েছে, যা সহজে বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু গ্রামের মাটিতে বিশ্বাসই সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা। ভবানী দাসী তাকে ডেকে পাঠালেন আবার। এবার তার চোখে ভয়ের পাশাপাশি একটা দাহ আছে—যেন বহু বছর ধরে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখা কিছু বলার জন্য প্রস্তুত তিনি। সাব্যসাচীকে বসিয়ে তিনি বললেন, “তুই কি জানিস, হরিনাথ রায় কৃপালানন্দকে মেরেছিল ঠিক কোথায়?” সাব্যসাচী মাথা নাড়ল। ভবানী ফিসফিস করে বললেন, “সেই নিচতলার গোডাউনঘরটায়, যেখান থেকে আজও আগুনের গন্ধ ওঠে। আমি তখন বাচ্চা, মায়ের কোলে। মা তখন ও বাড়ির রাঁধুনির মেয়ে। আমার চোখের সামনে লোকটা কাঁধে ধুপচন্দন নিয়ে প্রণাম করতে এসেছিল, আর হরিনাথ সাহেব তাকে বলেছিল—‘আমার সম্পদে নজর দিস না।’ তারপর কি হল জানিস?”

ভবানী থামলেন, যেন মনে করতে চাইছেন—অথবা হয়তো মনে না করলেও সেই স্মৃতি নিজেই ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। “ওই রাতেই কৃপালানন্দ হারিয়ে গেল। কেউ দেখেনি, কেউ খোঁজ করেনি। তারপর কিছুদিন পর তার গায়ের মালা, লাঠি, আর এক ফালি রক্তমাখা কাপড় পাওয়া গেল বাগানের পেছনের পুকুরঘাটে। কেউ মামলা করেনি। জমিদারের বিরুদ্ধে কে মুখ খুলবে বল?” সাব্যসাচী স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। ভবানী বললেন, “আমার মা বলেছিল—কৃপালানন্দ মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘আগুন থেকে আগুনই জন্মায়। যারা অন্যায় করে, তারা নিজের ঘরেই পুড়ে মরে।’” সাব্যসাচী এবার জানতে চাইল, “কিন্তু এর সঙ্গে এখনকার ঘটনার সম্পর্ক কী?” ভবানী ধীরে বলে উঠলেন, “সেই ঘর, সেই পুকুরঘাট, সেই বাতাস আবার সক্রিয় হয়েছে। ও ঘরটা আবার খুলেছে, মশালের আলো আবার জ্বলছে। তোরা যা দেখছিস, তা শুধু অলৌকিক নয়, এটা ন্যায়ের জেগে ওঠা।”
এইসব কথা শুনেও সাব্যসাচী যুক্তিবাদী মন দিয়ে ভাবছিল, হয়তো কেউ এই ভূতের কাহিনির সুযোগ নিচ্ছে। হয়তো গ্রামের মানুষদের ভয় দেখিয়ে জমিদারবাড়ি দখল করার চক্রান্ত—কিন্তু তার বুকের ভিতরে একটা অস্বস্তি জমে উঠছিল। সে শুধু অনুভব করতে পারছিল, এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কিছু সত্য, যেটা আবেগ নয়, বরং রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।

সেদিন সন্ধ্যায় রাধিকার সঙ্গে দেখা হয় সাব্যসাচীর। গ্রামের নতুন স্কুলশিক্ষিকা, চোখে ভারী চশমা, কথা কম বলে, কিন্তু অনেক কিছু বোঝে—এমনই তার ভাব। তারা একসঙ্গে মাঠ পেরিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ রাধিকা থেমে গিয়ে বলল, “তুমি কি জানো, আমি ওই বাড়ির পাশে ঘুমোতে পারি না?” সাব্যসাচী জিজ্ঞেস করল, “কেন?” সে বলল, “আমি স্বপ্ন দেখি—কেউ যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে আমার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু সেই নামটা আমার না। কোনো এক ‘রানু’র নাম সে বারবার বলে।” সাব্যসাচী চমকে উঠল। “রানু”? ভবানীও বলেছিল, “রানু” নামে এক মেয়ে নাকি হরিনাথের দাসীদের মধ্যে একজন ছিল, যাকে সন্ন্যাসী খুব স্নেহ করতেন। এইসব টুকরো টুকরো তথ্য যেন এক কুয়াশাচ্ছন্ন কাহিনির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল।
সেই রাতে সাব্যসাচী ডায়েরিটা আবার খুলে পড়ে। এক জায়গায় লেখা—“আগুন নিভে না, যতক্ষণ না শেষ উত্তরসূরি নিজে দেখে নেয় রক্তের দাগ।” কে এই শেষ উত্তরসূরি? আর কে জেগে উঠেছে ভগ্ন কুঠিরের গহীনে? বাতাস নিঃশব্দ, কিন্তু মনে হল যেন কানে কেউ ফিসফিস করে বলছে—“তুই ফিরেছিস, এখন আর পিছু হটা নেই।”

***

সব্যসাচী পরদিন সকালে উঠে ডায়েরির সেই অংশ আবার পড়ল—“আগুন নিভে না, যতক্ষণ না শেষ উত্তরসূরি নিজে দেখে নেয় রক্তের দাগ।” সে অনুভব করছিল, কৃপালানন্দ কেবল একটি সন্ন্যাসী ছিলেন না, তার মৃত্যু কোনো সামান্য ঘটনা ছিল না—এ যেন এক ঐতিহাসিক প্রতিশোধের সূচনা। তার মৃত্যু যেন পুরো জমিদার পরিবার, তাদের উত্তরসূরি, এমনকি এই গ্রামের ভবিষ্যতের উপরে একটা অদৃশ্য দায় রেখে গিয়েছিল। তুষারকে সঙ্গে নিয়ে সাব্যসাচী সেই দিনের ঘটনাগুলো একত্র করার চেষ্টা করছিল। তুষার বলল, “আমার দাদু বলত, কৃপালানন্দ ছিল সাধনার পথে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া মানুষ। সে ভবিষ্যৎ দেখতে পেত। জমিদার হরিনাথ ভেবেছিল ও তার সবকিছু জেনে গেছে, তাই ভয় পেয়েই তাকে সরিয়ে দেয়।” সাব্যসাচী জবাবে বলল, “তাহলে হয়তো এই আত্মাও সবকিছু জানে, এবং অপেক্ষা করছে।”

সেদিন বিকেলে তারা দুজনে জমিদার বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখে। পুরনো আমগাছের নিচে পাথরের গায়ে কিছু খোদাই পাওয়া যায়—অদ্ভুত প্রতীক, যেগুলো সাব্যসাচীর মতে, প্রাচীন তান্ত্রিক চিহ্ন। তার মধ্যে একটি প্রতীকে স্পষ্ট করে লেখা ছিল: “অগ্নিতপস্যা।” হঠাৎ একটা ঝটকা দিয়ে বাতাস প্রবল হয়ে উঠল, যেন কোন অদৃশ্য হাত সমস্ত পাতা কাঁপিয়ে বলে উঠছে, “আমার প্রতীক্ষা ফুরোয়নি।” তারা বাড়ির পেছনে একটা ছোট ঘর দেখতে পেল, যেটার দরজা খোলা—ভিতরে ঢুকতেই এক চিলতে গন্ধ ছড়ায়—ধুপ, চন্দন আর ছাইয়ের গন্ধ একত্র মিশে গেছে। ঘরের মেঝেতে একটা ছোট আসন, তার পাশে একটা তিনটি দগ্ধ মালার ভগ্নাংশ পড়ে ছিল। তুষার ভয়ে পিছিয়ে আসে, কিন্তু সাব্যসাচী সেই মালায় হাত দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার ভিতর ছায়ার মতো একটা ছবি ভেসে ওঠে—এক গেরুয়া বসনের পুরুষ, চোখে স্থির দৃষ্টি, মুখে নিঃশব্দে উচ্চারিত কোনো মন্ত্র। সে মুহূর্তে মনে হল, যেন কেউ তার মনের ভিতর ঢুকে পড়েছে।

সব্যসাচী দিশেহারা হয়ে বাড়ি ফিরে যায় এবং ভবানীর কাছে সব খুলে বলে। ভবানী চুপ করে শোনেন, তারপর বলেন, “তুই ওই ঘরটা খুলে ফেলেছিস? ওটা ছিল নিষিদ্ধ। সেখানে কৃপালানন্দ সাধনায় বসতেন। ওর মৃত্যুর পর কেউই ঘরটা ছোঁয়নি।” সাব্যসাচী তবু নিজের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে চায়, বলে, “আমি কিছু একটা দেখেছি… মনে হচ্ছে, সে আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে।” ভবানী এবার একটা সাদা কাপড়ের পুঁটুলি এনে দেয়, খুলে তার ভিতর থেকে বের হয় একটা তামার তাবিজ, যেটায় খোদাই করা আছে, “অগ্নিদর্শী কৃপালানন্দ।” ভবানী বলে, “এটা সে নিজে একবার দিয়েছিল আমার মাকে, বলেছিল—‘যদি কোনোদিন আবার অন্ধকার নামে, এটা ফিরিয়ে দিস ওর কাছে।’” তাবিজটা হাতে নিয়েই সাব্যসাচীর হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে, যেন তামার ভিতরে এখনো জমে আছে শতবর্ষ পুরোনো অগ্নি, অদৃশ্য কিন্তু জীবন্ত। সেই মুহূর্তে তার মনে হল, এবার যা-ই ঘটুক, সে আর পিছু হটতে পারবে না। ভগ্ন কুঠির তার অপেক্ষায় আছে, আর সন্ন্যাসীর পদচিহ্ন তাকে নিজের ইতিহাসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে—ধীরে ধীরে, অপ্রতিরোধ্যভাবে।

***

সব্যসাচী সেই রাতেই ভবানী দাসীর কাছ থেকে পাওয়া তামার তাবিজ হাতে নিয়ে ডায়েরির পাতাগুলোর দিকে ফিরে তাকাল। আগুনের আলোয় পাতাগুলোর অক্ষর যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। এক জায়গায় সে খুঁজে পেল সেই দিনের বর্ণনা—যেদিন সন্ন্যাসী কৃপালানন্দ জমিদার হরিনাথ রায়ের প্রাসাদে শেষবার প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, “আজ সে ডেকেছে, আমি যাচ্ছি। সে ভয় পায়, কারণ সে জানে আমি দেখতে পাই। কিন্তু আমি প্রতিশোধ নিতে যাই না, আমি মুক্তি দিতে চাই।” সাব্যসাচীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই মানুষটি যে মারা গিয়েছিলেন অন্যায়ভাবে, তিনি শুধু ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বা যোগসিদ্ধ ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক শান্ত, সহিষ্ণু সাধক, যাঁর বিশ্বাস ছিল ক্ষমার শক্তিতে। কিন্তু তাঁর এই বিশ্বাসকেই দুর্বলতা ভেবে হরিনাথ রায় তাঁর উপর চালিয়েছিলেন নির্মমতা।

সব্যসাচী ডায়েরিতে লেখা অনুচ্ছেদগুলোর সাথে মিলিয়ে হরিনাথ রায়ের পরিবারের ইতিহাস খুঁজতে থাকে। সে বুঝতে পারে, তার দাদুর পূর্বপুরুষরা এই জমিদার পরিবারের অবৈধ শাখা। হরিনাথ রায়ের একটি গোপন সম্পর্ক ছিল গ্রামের এক চাকরের মেয়ের সঙ্গে, এবং সেই সম্পর্ক থেকেই জন্ম নেয় এক সন্তান—সব্যসাচীর প্রপিতামহ। অর্থাৎ, তার শিরায় বইছে সেই রক্ত, যা একদিকে অপরাধীর, আবার অন্যদিকে সেই পরিবারেরও, যার উপর অভিশাপ লেগে আছে। এই সত্য তার ভিতরে এক দ্বন্দ্ব তৈরি করে—সে কি নিজেকে শুধু গবেষক হিসেবে দেখবে, নাকি একজন উত্তরসূরি হিসেবে সত্যের বোঝা কাঁধে তুলে নেবে? তার মনে হতে থাকে, প্রতিটি ডায়েরির পৃষ্ঠা, প্রতিটি ভগ্ন দেয়াল, আর প্রতিটি কুঠিরঘরের ছায়া যেন তাকে বলছে—”তুই দায় এড়াতে পারিস না।”

রাত গড়িয়ে ভোর হতেই সাব্যসাচী একাই হাজির হয় জমিদার কুঠিরের পূর্বদিকের বন্ধ ঘরের সামনে—ডায়েরিতে লেখা ছিল, এখানেই হয়েছিল সেই হত্যা। দরজাটা এক চাপা ঠেলাতেই খুলে যায়, যেন কোনো অলৌকিক অনুমতি সে পেয়ে গেছে। ঘরের ভিতর বাতাস ভারী, মেঝেতে ছাইয়ের স্তর, আর কেন্দ্রে একটা কালো দাগ—দেখলেই বোঝা যায়, একসময় এখানে প্রচণ্ড আগুন জ্বলেছিল। সে দৃষ্টি ফেলে দেয়ালের উপর, যেখানে কারও পায়ের ছাপের মতো দাগ, কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে সোজা উঠে গেছে খাড়া দেওয়ালে। হঠাৎ ঘরের বাতাস কেঁপে উঠে ধুপের গন্ধ ছড়ায়, আর তার কানে ভেসে আসে মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনি—একই সঙ্গে অদ্ভুত ও শান্তিকর। তৎক্ষণাৎ সাব্যসাচীর মনে হয়, কেউ যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, “তুই তো দেখতে পেলি, এবার শুন—কারণ স্মৃতির দহন আর রক্তের ক্ষত একসঙ্গে লুকোনো যায় না।” এই অদৃশ্য উচ্চারণে সে নিশ্চিত হয়, কৃপালানন্দের আত্মা এখনো বাঁচে, এবং সে কিছু বলতে চায়—তাকে নয় শুধু, বরং সকলকে—যারা ভুলে গেছে ইতিহাস, আর যারা রক্তে বহন করছে সেই অপরাধের উত্তরাধিকার।

***

গ্রামের সকালের বাতাসে এখন আর আগের মতো নিরীহতা নেই। জমিদারবাড়ির আশপাশে লোকজন যেতে ভয় পায়, এমনকি দুপুরেও কেউ ওদিক দিয়ে হাঁটে না। অথচ সব্যসাচী যেন আরও বেশি আকর্ষণ অনুভব করছে সেই কুঠিরের প্রতি—তার গবেষণার খাতায় এই বাড়ি এখন কেবল ইতিহাস নয়, এক জীবন্ত প্রশ্নপত্র। ডায়েরির পুরনো পাতাগুলো এক এক করে ছিঁড়ে যাচ্ছে—অদ্ভুতভাবে, যেন কেউ বা কিছু চায় না সত্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পাক। তুষার যখন আবার আসে তার সঙ্গে দেখা করতে, তখন সে আনে পুরনো রেকর্ড রুম থেকে বের করা একটা কাগজ—এক গোপন নথি, যাতে হরিনাথ রায়ের এক অবৈধ পুত্রের নাম উল্লেখ ছিল। আর সেই নামের পাশে সাব্যসাচীর প্রপিতামহের নাম হুবহু মিলে যায়। সে মুহূর্তে বাস্তব যেন তার বুকের উপর ভারী হয়ে নামে। সে আর কেবল ইতিহাসপাঠক নয়, সে নিজেই ইতিহাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে।

ভবানী দাসী এই তথ্য শুনে প্রথমে থমকে যান। তারপর ধীরে বলে ওঠেন, “তুইই শেষ উত্তরসূরি। তাই তোকেই সব দেখতে হবে, সব বুঝতে হবে, আর হয়তো… সব ভোগ করতে হবে।” ভবানী এবার একটি কাঁসার থালা এনে তার হাতে দেন, যার মধ্যে একটি ক্ষয়প্রাপ্ত চিঠি ও একটি ছোট রক্তাক্ত চন্দনরেখা রাখা ছিল। চিঠিটা হরিনাথ রায়ের লেখা—এক গোপন স্বীকারোক্তি, যেখানে সে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। “আমি ভয় পেয়েছিলাম… আমি জানতাম, কৃপালানন্দ আমার অন্তরের গোপন পাপ দেখে ফেলেছে। আমি তাকে সরালাম, কিন্তু আজও আমি জ্বলছি সেই আগুনে যা সে রেখে গিয়েছিল।” চিঠিটা পড়ে শেষ করার আগেই সব্যসাচীর গলা শুকিয়ে গেল। তার মনে হতে লাগল, সেই আগুন আজও তাকে ঘিরে ফেলছে, নিঃশ্বাসে ছাইয়ের গন্ধ জমে যাচ্ছে। রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই—সে সেই পুরুষেরই উত্তরসূরি, যার এক ভুলের জন্য আজও গ্রামের বাতাস ভারী।

সেই রাতে আবার ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। জমিদারবাড়ির ভেতরে আচমকা দেখা যায় আগুনের মতো আলোর রেখা। এইবার সব্যসাচী একা নয়, গ্রামের কয়েকজন যুবকও দূর থেকে তা দেখে। তারা ভাবে কেউ হয়তো বাড়িতে ঢুকেছে, চুরি করতে। কিন্তু ভিতরে গিয়ে তারা দেখে, উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক সন্ন্যাসীর অবয়ব—গেরুয়া বসন, উজ্জ্বল চোখ, হাতে একটি মশাল। কিন্তু কেউ সাহস পায় না এগোতে। পরদিন ভোরে, সেই ঘর থেকে পাওয়া যায় একটি নতুন লেখা—কৃষ্ণমাটি দিয়ে দেয়ালের গায়ে লেখা—“রক্ত আমার নয়, দায় তার যিনি বয়ে বেড়ান।” সাব্যসাচী নিশ্চিত হয়, এ বার্তাটি তার জন্য। আত্মা চায় না শুধু প্রতিশোধ, চায় পরিত্রাণ। কিন্তু পরিত্রাণ কি সম্ভব? একশো বছর আগের পাপ কি নতুন শতাব্দীর একজন উত্তরসূরি মুছে ফেলতে পারে? সে জানে না—কিন্তু তার ভিতর থেকে এক শক্তি বলে ওঠে, “তোরই হাতে সত্যর আলোকবর্তিকা। তুই না এগোলে কেউ এগোবে না।” সেই মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নেয়, যা-ই ঘটুক, কুঠিরের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। কারণ ইতিহাস থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না, আর রক্তের সম্পর্ক কখনো নিছক কাকতালীয় নয়—তা অনেক সময় পূর্বজন্মের ঋণস্মারক।

***

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে যেন ধুলো জমা স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। মন্দিরার হাতের লণ্ঠনটা থরথর করে কাঁপছিল, কিন্তু সেটা আতঙ্কে না বাতাসে, বোঝা যাচ্ছিল না। প্রাচীন কুঠিরটির দোতালায় ওঠার সিঁড়ি ছিল চিরকালীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন, সেখানে পা রাখা মানে যেন ইতিহাসের নিষিদ্ধ কক্ষের চাবি ঘোরানো। রুদ্র তার ক্যামেরা চালু করে পিছন থেকে অনুসরণ করছিল, আর প্রতিটি কাঠের সিঁড়ির চিড়বিড় শব্দ যেন তার শ্বাসকে থামিয়ে দিচ্ছিল। উপরে উঠে তারা যে ঘরটিতে প্রবেশ করল, সেটি ছিল এক কালের বৈঠকখানা—মেঝেতে ছড়ানো চূর্ণ ধুলো, দেওয়ালে পোকায় কাটা রঙ, আর বাতাসে ছড়ানো অপার এক বিষাদ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ছিল কোণার বিশাল আয়নাটি, যেখানে কেউ দাঁড়ালেই অন্য এক মুখ যেন প্রতিফলিত হতো—অপরিচিত কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে চেনা।

মন্দিরা আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। ঠিক তখনই খোলা জানালার পর্দা হঠাৎ করে উঠতে লাগল বাতাস ছাড়াই, আর ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল এক দীর্ঘশ্বাসের মতো আওয়াজ। রুদ্র হতভম্ব হয়ে ক্যামেরা গুটিয়ে পকেটে ভরল, কারণ এই অভিজ্ঞতা তার কোন প্রযুক্তিতেই ধরা সম্ভব নয়। মন্দিরার দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ছিল আয়নার ওপারে—সেখানে ধীরে ধীরে গঠিত হচ্ছিল এক সন্ন্যাসীর অবয়ব। সাদা ধুতি, গেরুয়া উত্তরীয়, চোখে দৃষ্টি নেই, কিন্তু অভিশাপ যেন জমে আছে ঠোঁটের কোণে। ঘরের তাপমাত্রা নেমে আসছিল, শ্বাসের ভাপ দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। তখনই হঠাৎ আয়নার উপর দাগ কেটে এক শব্দ লেখা হল—“অতীত।” মন্দিরা কাঁপতে কাঁপতে পিছু হটতে লাগল, আর ঠিক সেই সময় জানালার কাঁচ ভেঙে একটা পাথর ছুটে এল ঘরে। তাতে বাঁধা ছিল পুরনো ছেঁড়া কাগজ, যেন চিঠি—যার অক্ষরগুলো রক্তের মতন লাল।

চিঠিটা খুলে পড়তেই রুদ্র আর মন্দিরার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তাতে লেখা ছিল—“যে রক্তে শুদ্ধি চেয়েছিলে, সেই রক্তেই হবে বিনাশ। শুদ্ধি হয়নি, রক্ত পুড়েছে। আমি ফিরেছি। -অজ্ঞাত।” এই বার্তা যেন শুধু সতর্কবার্তা নয়, এক পুঞ্জীভূত প্রতিশোধের আগমনী সঙ্কেত। রুদ্র এক ঝটকায় জানালার দিকে তাকাল, কিন্তু বাইরেটা তখন গভীর কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল—কোন মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কেবল টিপটিপ শব্দে বৃষ্টি পড়ছিল ছাদে। ঘরের ভিতর তখনো আয়নাটায় সেই সন্ন্যাসীর অবয়ব অটুট ছিল—তার চোখ দুটি যেন ধীরে ধীরে খুলে আসছিল, ধ্বংস আর ন্যায় বিচারের এক অজানা আগুন নিয়ে।

***

শ্রাবণ-শেষের রাতে ধীরে ধীরে বৃষ্টি শুরু হলো, যেন আকাশও কেঁদে উঠেছে কুঠিরের অতৃপ্ত আত্মার আর্তনাদে। আরণ্যকের কাঁপা হাতে ধরা ছিল সেই পুরোনো সন্ন্যাসীর কাষ্ঠপটের মূর্তি, যেটা সে খুঁজে পেয়েছিল দেউলঘরির বেদীমূলে। মূর্তিটার চোখ দুটো গভীর, একরাশ অপার নির্লিপ্তি আর অভিমান মেশানো। চারদিকে এতদিন ধরে ঘটে চলা অদ্ভুত ঘটনাগুলোর মধ্যে এই মূর্তিই যেন ছিল মূল সূত্রধর—এটা আরণ্যক এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। সে যতই গভীরে ঢুকছে, ততই খুলছে একের পর এক স্তর, আর প্রতিটা স্তরের নিচে যেন জমে আছে অপরাধ আর বিশ্বাসঘাতকতার চোরাস্রোত। হঠাৎ একটা ঝড়ো হাওয়া উঠে এল—কুঠিরের ভেতরে বৃষ্টি ঢুকে পড়ল ভাঙা জানালা দিয়ে, আর সেই বাতাসে কাঁপতে লাগল গায়ে লেগে থাকা পুরোনো পুথির পাতা, যেগুলোর ভাষা আধা সংস্কৃত, আধা ব্রজবুলি, কিন্তু প্রতিটা বাক্যে যেন ফুঁটে উঠেছে সন্ন্যাসীর আত্মার প্রতিশোধস্পৃহা।

মাঝরাত পার হয়ে গেলেও দেবলীনা ঘরে ফিরে এল না। তার ফোনও বন্ধ। আরণ্যকের বুকের ভেতর শূন্যতা আর আশঙ্কা জমতে লাগল এক অজানা বিষের মতো। শেষে সে একাই রওনা দিল দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সেই পুরোনো গোপন টানেলের দিকে, যেটা আগে একবার আবিষ্কার করেছিল সে। মাটির গন্ধ, স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ, আর দূরের ফোঁসফোঁসে শব্দ—সব মিলে সৃষ্টি করল এক অব্যক্ত আতঙ্ক। হঠাৎই তার সামনে দেখা দিল সেই ছায়ামূর্তি—কালো ধুতি, গেরুয়া চাদর, লাল জ্বলন্ত চোখ। কিন্তু এবার আরণ্যক পিছিয়ে আসেনি। সে এগিয়ে গেল, পকেট থেকে বার করল সেই কাষ্ঠপটের মূর্তি। ঠিক সেই মুহূর্তেই ছায়ামূর্তির চোখ যেন শান্ত হল, এবং তার ঠোঁটের কোণে ফুটল এক রহস্যময় হাসি। চারপাশে বাতাস স্তব্ধ, যেন সময় দাঁড়িয়ে পড়েছে এক পলকের জন্য। আর সেই নিঃশব্দতার মাঝেই ছায়ামূর্তি আস্তে করে বলল, “শুদ্ধিকরণ শুরু হয়েছে, সত্য উদ্ভাসিত হবে।”

কিন্তু এই শুদ্ধিকরণ মানেই যে মুক্তি, তা নয়। বরং এই শুদ্ধিকরণের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও গা ছমছমে ইতিহাস। কুঠিরের গুপ্তভান্ডার যে আসলে এক জাগ্রত পীঠস্থান, তা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। সেই পুরোনো পাণ্ডুলিপিতে লেখা রয়েছে, “যে সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী। তাঁকে হত্যা করে ভিন্ন ধর্মের উপাসনা শুরু করেছিল জমিদার, আর সেখানেই ছিন্ন হয়েছিল শুভ শক্তির জ্যোতিষ্ক্রম।” এই তথ্য জানার পর আরণ্যকের মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। সে বুঝতে পারে, শুধু প্রতিশোধ নয়, এই আত্মার উদ্দেশ্য হল পুনঃপ্রতিষ্ঠা—শক্তির, সত্যের, সংহতির। আর সেই দায়িত্ব এসেছে তার কাঁধে। চারপাশে বজ্রপাত শুরু হলো, কুঠিরের চূড়ো যেন কেঁপে উঠল। আরণ্যক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সন্ন্যাসীর মূর্তির সামনে, আর কানে বাজতে লাগল—“আত্মা যেখানে বন্দি, মুক্তির আলো সেখানেই জ্বলে।”

***

ভোরের আলোতে গোরস্থানের কুয়াশা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, কিন্তু জমিদার বাড়ির ভেতরে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। চতুর্থার মৃত্যুর পর গ্রামের লোকজন আরও ভয় পেয়ে গেছে। বনমালী সন্ন্যাসীর নাম উচ্চারণ করাও যেন অমঙ্গল ডেকে আনে—এই বিশ্বাস এখন সবখানে। গিরিধারী, রামেশ্বর আর অর্ণব তিনজনেই সিদ্ধান্ত নেয় যে আজ রাতেই তারা শেষবারের মতো কুঠিরে যাবে। অর্ণবের হাতে থাকা পুরনো চিঠিগুলোতে সন্ন্যাসীর সত্যিকারের ইতিহাস উঠে এসেছে—সে একজন নিরীহ দার্শনিক ছিল, যাকে জমিদার হেমচন্দ্র সেন বিশ্বাসঘাতকতা করে পুড়িয়ে মারে, কারণ তিনি প্রজাদের মধ্যে ন্যায়ের কথা বলতেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সন্ন্যাসীর আত্মা কি সত্যিই এই শতাব্দী পেরিয়েও প্রতিশোধ নিচ্ছে, নাকি মানুষের অপরাধবোধ আর কুসংস্কারের মিশ্রণেই এমন বিভীষিকা তৈরি হয়েছে?

রাত দশটা বাজতেই তারা পৌঁছে যায় জমিদারবাড়ির সামনে। সারা আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, যেন প্রকৃতি নিজেও চুপ করে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। ভিতরে প্রবেশ করতেই রামেশ্বর দেখে, আবার সেই মশালের আলো—এবার একটানা ঘূর্ণায়মান, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। অর্ণব চিৎকার করে বলে, “এটা হয়তো আত্মার চলাচল নয়, আমাদেরই কোনো অজানা সত্যের ছায়া।” তারা তিনজন ছুটে যায় ওপরে—সেখানে, পুরনো কুয়োর ধারে, আগুনের রশ্মিতে দেখা যায় একটা ছায়ামূর্তি—কোনো মানুষ নয়, যেন বেদনায় গড়া ছায়া, যার চোখে ছিল ক্ষোভ আর ক্ষমা, একসাথে। গিরিধারী কাঁপা গলায় বলে, “মহারাজ, ক্ষমা করুন—আপনার গল্প আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি তো রক্ত চেয়েছিলেন না, শুধুই ন্যায়।”

আত্মার ছায়া আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে, এবং তার সাথে নিভে যায় মশালের আলো। এক মুহূর্তে যেন পুরো কুঠির নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে—কোনো শব্দ নেই, শুধু বাইরে বৃষ্টির ধারা পড়তে শুরু করে। তারা তিনজন জানালার দিকে এগিয়ে যায়—নবান্নর আগের রাত, গ্রামের আলোয় ভরে উঠছে দিগন্ত। নিচে নামার সময় তারা দেখে, দেওয়ালে আঁকা সেই পুরনো ছবি—সন্ন্যাসীর—যেটা এতদিন গায়েব ছিল, সেটা আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবার তাঁর মুখে শান্তি। অর্ণব ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “কিছু প্রতিশোধ অস্তিত্ব পায়, কারণ আমরা তাকে ভয় পাই। কিন্তু কিছু আত্মা মুক্তি পায়, কারণ আমরা অবশেষে তাদের স্বীকার করি।” এই রাতে জমিদারবাড়ি আর কাঁপে না, মশাল আর জ্বলে না, আত্মা আর প্রতিশোধ চায় না—কারণ অবশেষে, ইতিহাস একটুখানি ন্যায় পেয়েছে।

____

1000044068.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *