প্রদীপ মালাকার
এক
ঈহিত কর্ণিক নদীর দিকে তাকিয়ে বসেছিল লোকাল বাসের জানালায়, কাঁচের ওপারে ভেসে যাচ্ছিল আধা ঝাপসা একচিলতে সবুজ, দূরের সোনালি সর্ষে আর মাঝেমাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি। কলকাতার শীতের দুপুর ফিকে হয়ে আসছিল, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের শান্ত ধুলোপথ যেন পুরনো কাহিনির বইয়ের মতো পাতা উল্টাচ্ছিল। ঈহিত, পেশায় অনলাইন নিউজ পোর্টালের রিপোর্টার, কিন্তু আসলে একজন কৌতূহলী অনুসন্ধানকারী—যে ভয় আর যুক্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়ায় সত্য। গত দুই মাস ধরে সে অনুসরণ করছিল এই নদীপারের পুরনো প্রাসাদের গল্প, যেখানে নাকি রাতের গভীরে বাঁশির সুর ভেসে আসে, আর যাদের সে সুর ছুঁয়ে যায় তারা কখনো ফিরে আসে না। শহরে বসে এগুলো ‘হরর কনটেন্ট’ হলেও, ঈহিতের কাছে এগুলো চ্যালেঞ্জ—সে বিশ্বাস করে প্রতিটি অলৌকিক কাহিনির পেছনে এক বাস্তব, মানবিক ব্যাখ্যা লুকিয়ে থাকে। সে এইবার সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেই সেখানে যাবে, রাত কাটাবে, রেকর্ড করবে, আর সত্যকে সামনে আনবে। ব্যাগে শুধু একটা DSLR ক্যামেরা, একটা ভয়েস রেকর্ডার, একটা ছোটখাট ড্রোন আর টর্চ—এই নিয়েই ঈহিত পা রাখে হাটিনগর স্টেশনে, যেখানে থেকে নদীর ধার মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। স্টেশনে নেমেই সে টের পায় বাতাসটা কেমন কাঁপা-কাঁপা, যেন কেউ ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে কিন্তু শব্দে ধরতে দিচ্ছে না।
গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে ঈহিত প্রথমে চোখে পড়ে বিশাল একটা পুকুর, তারপর গাঁয়ের শেষপ্রান্তে ছোট এক চায়ের দোকান। দোকানের বেঞ্চিতে বসে সে একটু বিশ্রাম নেয় এবং দোকানদার লোকটির কাছেই প্রথম শোনে “ওই ভগ্নবাড়ির বাঁশি” নিয়ে সরাসরি কিছু। লোকটির নাম বামাচরণ, বয়স ষাটের কাছাকাছি, গাল ভর্তি সাদা দাড়ি, চোখে ভ্রু কুঁচকানো সতর্কতা। ঈহিত নাম বলতেই সে বলে, “আপনিও বুঝি সেই বাঁশির খোঁজে?”—তার কণ্ঠে ছিল হাসির ছায়া, কিন্তু চোখে ছিল ভয়। সে জানায়, বহু বছর আগে নদীর ধারে ওই প্রাসাদে জমিদার পরিবারের বাস ছিল—শেষ জমিদার আত্মহত্যা করেন, কিন্তু তার আগে তাঁর প্রেমিকা বাঁশি বাজাতে বাজাতে হারিয়ে যান বৃষ্টির এক রাতে। তারপর থেকেই প্রতি বছর দু-একজন সাহস করে ভেতরে যায়, আর ফেরে না। কেউ ভাবে তারা হারিয়ে যায়, কেউ ভাবে পাগল হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ বলে—“তাদের ডাক পড়ে গিয়েছিল।” ঈহিত হেসে ওঠে—তার চোখে এসব লোককথা, ছেলেবেলার গপ্পো, কিন্তু সে বুঝে নেয়, গ্রামের ভয় বাস্তব, অন্তত তাদের বিশ্বাসে। বামাচরণ বলে, যদি সত্যিই প্রাসাদে রাত কাটানোর ইচ্ছে থাকে, তবে আগে দেখা করে আসতে হবে এক জনের সঙ্গে—ঊরুণা ব্যানার্জী। একজন অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপিকা, যিনি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ওই বাড়ির রহস্য নিয়ে বহু বছর ধরে গবেষণা করছেন। ঈহিত হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যায় ঊরুণা দেবীর একতলা ছোট বাড়িতে। বাড়ির সামনে ঝুপ করে নুয়ে পড়া বটগাছ, আর উঠোনের কোণে রাখা এক চৌকি—সেই চৌকিতে বসে ছিলেন একজন শাড়ি পরিহিতা মহিলার ছায়াময় অবয়ব।
ঊরুণা ব্যানার্জী ছিলেন এক বর্ণময় অথচ নিঃসঙ্গ নারী। ঈহিতকে দেখে প্রথমেই বলেন, “তুমি কি ফেরার ইচ্ছা নিয়ে গেছো?” প্রশ্নটা এমনভাবে করা হয় যেন সে নিশ্চিত, কেউ গেলে ফেরে না। তার ঘরে ঈহিত বসে শোনে এক দীর্ঘ ইতিহাস—এই নদী একসময় ছিল বাণিজ্যের প্রাণ, আর তার ধারেই ছিল ‘দূরঙ্গ প্রাসাদ’—যার ভিতরে বসবাস করতেন জমিদার রাজশেখর রায়, যিনি সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন আর প্রেমে পড়েছিলেন এক সঙ্গীতশিল্পী নারীর—অথিরা। অথিরার বাঁশির সুর ছিল অভিশপ্ত সুন্দর, যার মোহে পড়ে যায় রাজা, প্রজা এমনকি সভার ব্রাহ্মণরাও। কিন্তু সেই প্রেম ছিল অসম, অসমাপ্ত, আর একদিন এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় অথিরা তার বাঁশি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। কেউ বলে সে আত্মঘাতী, কেউ বলে সে নদীতে ডুবে গেছে, আবার কেউ বলে সে আজও বাজায়—প্রাসাদের ছায়াঘেরা বারান্দায় বসে। কথার মাঝে, একসময় ঈহিত জানতে চায়, “আপনি কি বিশ্বাস করেন এমন কিছু?” ঊরুণা হালকা হাসেন, বলেন, “বিশ্বাস করো বা না করো, যারা ফেরে না তারা সবাই একদিন তোমার মতোই যুক্তির খোঁজে গিয়েছিল।” ঈহিত সেই রাতে প্রাসাদের দিকে হাঁটা শুরু করে। সন্ধ্যা নামছে, নদীর ওপার লাল হয়ে উঠেছে, আর বাতাসে হালকা একটা সুর যেন খেলে যাচ্ছে—ঠিক বাঁশির মতো, কিন্তু এত মৃদু যে বোঝা যায় না আসলেই কিছু বাজছে কি না। গাঁয়ের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দূরঙ্গ প্রাসাদ—ছায়ায় মোড়া, একপাশে ভেঙে পড়া মিনার, ছাদের ফাটলে গজিয়ে উঠেছে গাছ, আর কুয়াশায় তার অবয়ব যেন আরও বড়, আরও ভয়ংকর মনে হয়। ঈহিত জানে, সে ফিরে আসবে। বা অন্তত সে তখনও বিশ্বাস করত—সব রহস্যের ব্যাখ্যা আছে।
দুই
ঈহিত কর্ণিক প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে টের পায়, দিনের আলো ফুরিয়ে গেলে জায়গার রঙ বদলে যায়—কেবল চেহারা না, যেন ইতিহাসও ফিরে আসে ধুলো ধরা দেওয়ালে। ভগ্নপ্রাসাদের ধ্বস্ত দরজা আধখোলা, আর দরজার ওপাশ থেকে হালকা ঠান্ডা বাতাস আসছে; যেন ভেতরের অন্ধকার তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। ঈহিত তার টর্চ জ্বালিয়ে, এক হাতে ক্যামেরা চালু করে ঢুকে পড়ে সেই দীর্ঘ হ্যাজমিন্ট ঘরে, যার চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা আসবাব, ছেঁড়া পর্দা আর ধুলোঢাকা পোর্ট্রেট—সবই অতীতের। হঠাৎই তার চোখে পড়ে দেয়ালের ওপর আধমুছে যাওয়া একটি ছবি, এক তরুণী বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার চোখে আছে অব্যক্ত কোনো প্রশ্ন। ঈহিত থেমে যায়; ছবির নাম নিচে লেখা—“অথিরা, ১৯২২”। সে ধীরে ধীরে ক্যামেরা তাক করে ছবিটার দিকে, কিন্তু ক্যামেরার ফ্রেমে ছবিটা ফোকাস নিতে চায় না—অদ্ভুতভাবে ব্লার হয়ে যায় বারবার। তখন সে প্রথমবার ভাবে, এই জায়গার ইতিহাস হয়তো এখনো শুধু বইয়ের পাতায় আটকে নেই, বরং দেওয়াল, মেঝে, বাতাস—সবকিছুতেই মিশে আছে সেই অতীত।
ঈহিতের মাথায় ফিরে আসে ঊরুণা ব্যানার্জীর কথা। দুপুরবেলায় তার কাছে বসে সে শোনে এক বিস্মৃত ইতিহাসের ধূলিধরা পৃষ্ঠা, যা কোনো সংবাদ প্রতিবেদনে লেখা যায় না। ঊরুণা বলেন, “অথিরা শুধু সঙ্গীতশিল্পী ছিল না, ছিল প্রাসাদের আত্মা।” রাজশেখর রায়, জমিদার, তার সভায় একবার অথিরাকে গান গাইতে শুনে মুগ্ধ হন এবং প্রাসাদে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানান। অথিরা রাজি হন, কিন্তু কিছু শর্তে—প্রতি পূর্ণিমায় নদীর ধারে বসে সে একা বাঁশি বাজাবে, কারও উপস্থিতি ছাড়াই। সবাই জানত, ওটা তার একান্ত সময়, তার ব্যক্তিগত প্রার্থনা। কিন্তু ঠিক এক বছর পরে, সেই পূর্ণিমার রাতে, অথিরার গলায় আর বাঁশি বাজে না। পরদিন সকালে খুঁজেও তার কোনো সন্ধান মেলে না। নদী ঘেঁষে কেবল পাওয়া যায় একজোড়া ভিজে পদচিহ্ন, আর একটি বাঁশির ছেঁড়া টুকরো। তখন থেকেই শুরু হয় বাঁশির গল্প—যে বাঁশি বাজে অথিরার গলায়, যার সুরে মাঝে মাঝে ভেসে আসে একজোড়া কান্নার ছায়া। ঈহিত জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কি বিশ্বাস করেন এসব?” উত্তরে ঊরুণা বলেছিলেন, “বিশ্বাস আর অভিজ্ঞতা এক জিনিস নয়। যারা সুর শুনেছে, তারা বোঝে।” তিনি আরও বলেন, প্রাসাদে কিছু নির্দিষ্ট জায়গা আছে, যেগুলোতে দাঁড়ালে বাতাস বদলে যায়, মেঝে কেঁপে ওঠে, আর অতীতের ছায়া ঘনিয়ে আসে। তিনি একটা পুরনো ম্যাপ দেন ঈহিতকে—প্রাসাদের গোপন কুঠুরির, যা একমাত্র অথিরা ব্যবহার করত। “তুমি যদি সত্যি জানতে চাও,” ঊরুণা বলেছিলেন, “তবে ওই ঘরে রাত কাটাও—সেখানে ইতিহাস এখনো ঘুমায় না।”
এইসব কথার ভার মাথায় নিয়েই ঈহিত সেই ঘরের খোঁজে নামে নিচতলার এক ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে। ধুলো আর জালাগাছে ঢাকা পথ ধরে সে পৌঁছায় এক তালাবন্ধ দরজার সামনে, যার গায়ে আঁকা একতারা ও বাঁশির ছবি—মনে হয় জলের রঙে আঁকা, কিন্তু হাত বোলালে রঙ উঠে আসে না। দরজাটা খোলার চেষ্টা করতেই হালকা ঠুস শব্দে খুলে যায়—কোনো লক ছিল না, শুধু অপেক্ষা ছিল যেন। ঘরটা ছিল একেবারে শীতল, যেন অন্য সময়ের এক কক্ষ—মেঝেতে প্রাচীন কার্পেট, জানালায় ভারি পর্দা, আর কোণার দিকে রাখা একটি বাঁশির কেস। ঈহিত ক্যামেরা ঘুরিয়ে সব ধারণ করতে থাকে, কিন্তু তার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়তে থাকে অকারণেই। বাতাসে একটা সুর ভেসে আসে, খুব মৃদু, খুব দূর থেকে—যেন নদীর পাড়ে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে, আর সুরটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে এই ঘরের দেওয়ালজুড়ে। ঈহিত প্রথমে ভাবে, হয়তো কল্পনা, কিন্তু ক্যামেরার অডিও-গ্রাফেও সামান্য স্পাইক দেখা দেয়—একটা স্পষ্ট ‘high pitch’। সে থমকে যায়। এই প্রথমবার তার যুক্তিবাদ একটু নড়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এই প্রাসাদে ইতিহাস শুধুই স্মৃতি নয়—এটা এক জীবন্ত কাহিনি, যা এখনো প্রতীক্ষায়, হয়তো কিছু বলার জন্য। হয়তো তাকে।
তিন
ঈহিত কর্ণিক নিচতলার সেই ঘরে বসে বুঝে গিয়েছিল, এই প্রাসাদ শুধু ইতিহাসের স্মৃতি নয়—এ এক চলমান অস্তিত্ব, যেখানে সুরের ভেতরে লুকিয়ে আছে আর্তনাদ, আর প্রতিটি দেওয়ালে লেখা আছে কোনো না কোনো অপেক্ষার গল্প। কাঁধের ক্যামেরা তখনও চালু, আর বাতাসে গা শিরশির করা সুরের রেশ যেন চারদিকের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে নিচ্ছিল নিঃশব্দ ধারালো ছুরির মতো। হঠাৎ করেই তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে এক চেহারা—সে বুঝতেই পারেনি কখন, কীভাবে কেউ প্রবেশ করেছে সেই বন্ধ ঘরে। লম্বা, ছিপছিপে এক পুরুষ, ধূসর পাঞ্জাবি পরা, চোখদুটো গভীর ও অস্বাভাবিক স্থির। মুখে কোনো ভয় নেই, কিন্তু উপস্থিতি এমন যে মুহূর্তেই মনে হয় যেন বহু শতকের পুরনো ক্লান্তি জমে রয়েছে তার চোখে। ঈহিত চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কে? আপনি কীভাবে এলেন?” লোকটি কেবল বলল, “গার্গণ… আমি এই প্রাসাদের প্রহরী।” তার কণ্ঠে যেন পাথর চেঁচে ওঠার শব্দ, সময়ের ধুলো জমে থাকা গলায় একটানা স্বর। ঈহিত তার চোখে দেখে—সেখানে কোনো জীবন নেই, কেবল ধৈর্য আর প্রতীক্ষা। গার্গণ জানায়, সে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে এই প্রাসাদে পাহারা দেয়। কেউ না জানে, না ডাকে, কিন্তু সে থাকে। কেউ বাঁশির সুর শুনে আসে, কেউ কৌতূহল নিয়ে, কেউ আবার হারানো কারো সন্ধানে—কিন্তু যে আসে, সে বদলে যায়। ঈহিতের হৃদয়ে অদ্ভুত হিমে ভরা শীত নেমে আসে, কিন্তু সে নিজের কৌতূহল সামলায়। “আপনি কী জানেন অথিরার গল্প?”—প্রশ্ন করে সে। গার্গণ স্থিরভাবে বলে, “অথিরা এখনো এই বাড়িতে বাজায়… কিন্তু তার বাঁশির সুর শুধু শুনতে পায় সেই, যার ভেতরে ফাঁকা জমে গেছে।”
প্রাসাদের অন্ধকার করিডোর দিয়ে গার্গণ ঈহিতকে নিয়ে যায় এক প্রাচীন বারান্দায়, যেখান থেকে নদী স্পষ্ট দেখা যায়। চাঁদের আলোতে ঝিকমিক করছে জল, আর দূর থেকে মাঝে মাঝে বাতাস বইছে থেমে থেমে। গার্গণ বলল, “এই বারান্দা থেকে অথিরা বাঁশি বাজাত। এখানে বসেই সে প্রতীক্ষা করত—কখন সে ফিরবে, যাকে সে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সে ফেরেনি। অথিরা তার অপেক্ষার ভিতরে মিশে গেছে, আর সেই অপেক্ষাই সুর হয়ে বাজে প্রতি রাতের নির্জনতায়।” ঈহিত জিজ্ঞেস করে, “আপনি জানেন সে কে ছিল? যার জন্য অথিরা প্রতীক্ষা করত?”—গার্গণের ঠোঁট কেঁপে ওঠে। সে কোনো উত্তর দেয় না, শুধু তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। মুহূর্ত খানেক চুপ থেকে সে বলে, “যারা বাঁশির ডাক শুনতে পায়, তারা হয় আশীর্বাদপ্রাপ্ত, নয়তো অভিশপ্ত।” ঈহিত ভাবতে পারে না, এই কথাগুলোর মানে কী। সে বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু গার্গণের চোখে যে গভীর স্তব্ধতা, তা যেন শতকালের স্মৃতি জমা রেখে দিয়েছে। “তোমার ভেতরে যে ফাঁকা জায়গাটা, সেটা শুনে ফেলেছে অথিরা… তাই তো ডাক এসেছে,” বলে গার্গণ, আর ঈহিত কাঁপে। তার নিজেরও তো এক অতীত আছে—এক হারানো সম্পর্ক, এক সময়কার কণ্ঠস্বর যা এখন কেবল ভয়েস মেমো হয়ে পড়ে থাকে মোবাইলে। ঈহিত চুপ করে থাকে, আর গার্গণ চলে যায়, যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়, কোনো শব্দ না রেখে।
রাত বাড়ে। ঈহিত বারান্দায় বসে থাকে, হাতের ক্যামেরাটা পাশে রেখে। নদী জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব কাঁপে কাঁপে চলে যায়। হঠাৎ করেই বাতাস থেমে যায়—অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারপাশে। তারপর, একটানা এক সুর—বাঁশির। এবার যেন স্পষ্ট। দরজার আড়াল থেকে নয়, দেয়ালের পেছন থেকেও নয়, একেবারে কাছে… তার পাশেই কেউ যেন বসে আছে। ঈহিত ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়—কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, গার্গণ শুধু প্রহরী নয়—সে এক বার্তাবাহক, এক প্রবেশদ্বারের পাহারাদার। যারা অতীত আর বর্তমানের মাঝে সেতু খুঁজে পায়, তারা যেন ওই বাঁশির সুরে পার হয়ে যায়, এমন এক পৃথিবীতে যা ব্যাখ্যার বাইরে। ঈহিত সেই মুহূর্তে জানে না, তার কৌতূহল তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে—কিন্তু সে ফিরে যেতে পারবে তো?
চার
ঈহিত কর্ণিক জানত, রাতটা সহজ যাবে না, কিন্তু সে কল্পনাও করতে পারেনি সময় এমন অচেনা হয়ে উঠবে—যেন ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে, শুধু সুরের স্পন্দনে এগোচ্ছে সবকিছু। সে গার্গণের কথার রেশ কাটিয়ে আবার ঘুরে ফিরে সেই পুরনো কুঠুরিতে ফিরে আসে, যেখান থেকে সন্ধ্যায় সে প্রথম শুনেছিল বাঁশির মৃদু সুর। ব্যাগ থেকে সে বার করে ক্যামেরা, ভয়েস রেকর্ডার আর ছোট ড্রোন—তার আধুনিক অস্ত্র, যা দিয়ে সে অতিপ্রাকৃতের মুখোশ টেনে ফেলবে বলে এসেছে। জানালায় পর্দা লাগিয়ে দেয়, ঘরের কোণায় টর্চ বসিয়ে দেয় এমনভাবে যাতে আলো ছায়া তৈরি করে না, কারণ সে জানে—ভয়ের মাঝেও অনেক সময় খেলা করে আলো আর ছায়া, যা চোখকে প্রতারণা করে। ভেতরের মেঝেতে সে বসে, রেকর্ডার চালু করে, একটা ছোট খাতা খুলে সময় লিখে রাখে: রাত ১১:৩৮, ঘরের ভেতরে বাতাস স্থির, শব্দ নেই। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, চারদিক শোনে—শুধু তার নিঃশ্বাস আর মেঝেতে ধুলোয় টর্চের হালকা ঝিলিক। হঠাৎ একটা খসখস শব্দ হয় জানালার কাচে—সে ঘুরে দেখে, কিছু নেই। হয়তো বাতাস, হয়তো না। আবার সময় লিখে রাখে। তার মনে পড়ে, গার্গণ বলেছিল: “যদি ডাক পড়ে, শব্দ আসবে প্রথমে, তারপর ছায়া, তারপর স্মৃতি।” ঈহিত নিজেকে হাসতে চায়, কিন্তু তার ঠোঁট শুকিয়ে যায়।
রাত আরও ঘন হয়, আর ঘরের ভেতরে বাতাস ধীরে ধীরে বদলে যায়—না, গন্ধ নয়, তাপমাত্রাও নয়—একটা অনুভূতি। মনে হয় কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, অথচ সে বসেই আছে। ক্যামেরার স্ক্রিনে কিছু ধরা পড়ে না, কিন্তু তার মনে হয়, কিছু একটা আছে। সে টর্চ নিভিয়ে ঘরটা অন্ধকার করে, শুধু রেকর্ডার আর ক্যামেরা চালু রেখে দেয়। প্রায় দশ মিনিট কেটে যায় কোনো শব্দ ছাড়া। হঠাৎ রেকর্ডারে হালকা একটা হুইসেল টাইপ সাউন্ড ওঠে—একটা সরু বাঁশির মতো। ঈহিত ক্যামেরা তাক করে জানালার দিকে, কিন্তু জানালার বাইরে শুধু নদীর আলো। তখন সে ঘরের কোণায় রাখা বাঁশির কেসটার দিকে তাকায়—যেটা সে সন্ধ্যায় দেখেছিল অথিরার কক্ষের ভেতরে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কেসটা খুলে দেখে, ভিতরে কিছু নেই, কিন্তু ভিতরের কাপড়জোড়া এখনো ভাঁজ করা আছে, যেন কিছু একটা সদ্য তোলা হয়েছে। হঠাৎ জানালার বাইরে কার যেন ছায়া ভেসে ওঠে—একটি নারী অবয়ব, সাদা ধবধবে শাড়ি পরা, তার চোখে সরাসরি তাকিয়ে আছে ঈহিতের দিকে, এবং ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বাঁশি ধরেছে। ঈহিত জোরে শ্বাস নেয়, ছুটে গিয়ে জানালার বাইরে তাকায়—কেউ নেই। সে আবার বসে পড়ে, বুকের ভেতরে যেন গর্জে উঠছে অজানা কিছু। এই প্রথমবার তার মনে হয়, সে যা দেখল, সেটা তার কল্পনা নয়।
তারপর অনেকক্ষণ নীরবতা। ঈহিত চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে দেয় দেয়ালে। কিন্তু হঠাৎ করে দূরে কোথাও গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসে, যেন কেউ গাইছে—এক পুরনো বাউলসুরের মতো কিছু, খুব ধীরে ধীরে গলা তুলে এগিয়ে আসছে কাছে। গানটা যে ভাষায়, সে বুঝতে পারে না, কিন্তু সুরটা তার ভেতরে চেপে বসে। সে চোখ খুলে দেখে ঘরের ছাদে অন্ধকারে ছায়া নড়ছে—একটি নারীর ছায়া, চুল খোলা, গলায় বাঁশি ঝুলছে, আর ঠোঁটে সে সেই সুর তুলছে, যা না শোনা, অথচ স্মৃতির মতো পরিচিত। ঈহিত মনে মনে ভাবে—“আমি তো আগে কখনো এই গান শুনিনি, কিন্তু কেন মনে হচ্ছে আমি জানি?” তার পেছনের দেয়ালে হঠাৎ করেই শব্দ হয়—কেউ যেন পায়ের পাতায় হেঁটে গেল। ঈহিত ঘুরে তাকাতে গিয়ে পড়ে যায়, তার ক্যামেরা মেঝেতে পড়ে শব্দ করে, টর্চ ছিটকে যায়, অন্ধকার পুরো ঘরটাকে গ্রাস করে। আর সেই মুহূর্তে আবার বাজে বাঁশি—এবার একটানা, ব্যথায় ভরা। ঈহিত বুঝতে পারে, এখন আর সে শুধুই এক দর্শক নয়—সে হয়ে উঠেছে অংশ। এই বাড়ির গল্পে, এই বাঁশির অভিশাপে, তার নিজের একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, আর সেই জায়গা হয়তো তাকে শেষপর্যন্ত ফিরতে দেবে না।
পাঁচ
পুব আকাশে চাঁদের আলো নিভে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, কৃশানু জানলপথে বসে ছিল। তার দৃষ্টি ছিল নদীর জলে, যেখানে কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা জল মাঝে মাঝে আলো আঁধারিতে ঝলকে উঠছিল, যেন সেই নদী নিজেই কিছু বলতে চাইছে। ভগ্নপ্রাসাদের ছাদ থেকে রাতের শেষ বাঁশির সুর এসেছিল ঠিক আধঘণ্টা আগে—এবার সুরটা আগের চেয়ে আরও দীর্ঘ, আরও গভীর। কৃশানুর মনে হচ্ছিল, এই সুর তাকে কোথাও টেনে নিচ্ছে, অতীতের কোনো অদৃশ্য পলিমায়। গলার কাছটা শুকিয়ে এলো, শরীরে হিম হয়ে থাকা বাতাস ছুঁয়ে গেলেও সে আর কম্পন করছিল না, কারণ তার মন তখন আটকে ছিল সেই সুরের গভীরে—যেখানে শব্দের চেয়েও বেশি ছিল একটা অনুভব। সে জানত, আজ রাতে তাকে বসে থাকলে চলবে না, তাকে বেরোতেই হবে, এই রহস্যের ভেতরে ঢুকতে হবে, যেখানে হয়তো কোনো গল্প নয়, বরং সত্যি লুকিয়ে আছে। একা একা ঘর ছেড়ে সে নামল নিচে, হাতে কেবল একটা পকেট টর্চ আর অল্প ব্যাটারির ক্যামেরা, গলায় ছিল তার মা-দেওয়া লোহিতপাথরের মাদুলিটি। দরজা ঠেলে বেরোতেই দেখা গেল পেছনের বারান্দা দিয়ে হালকা কুয়াশা ঢুকছে—তার মধ্যে থেকে উঠে এলো একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর—“তুমি আবার এসেছো?”
এই কণ্ঠস্বর কৃশানুর সমস্ত রক্তকে যেন জমিয়ে দিল, কারণ এটা কোনো স্বপ্ন ছিল না—একেবারে সজাগ অবস্থায় সে শুনতে পেল সেই মৃদু অথচ ছলনাময় কণ্ঠ। সে সামনে এগোতেই দেখল, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এক কালো ঘোমটা পরা নারী, যার শরীর আধো আলোয় যেন তৈরি ছিল ছায়া দিয়ে। তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু চিবুকের নিচে একটা রুপোর নাকছাবি ঝলমল করছিল। “তুমি কি তাকে খুঁজছো?” নারী প্রশ্ন করল, যার ঠোঁট ছিল নিরিবিলিতে সজীব, কিন্তু চোখদুটি ছিল এমন শূন্য যে কৃশানু সেগুলোর দিকে তাকাতে সাহস পেল না। “কাকে?” সে জিজ্ঞেস করল, গলা কাঁপছে। “যে বাঁশি বাজায়… সে এখানে ছিল একদিন। তার অপেক্ষায় আছে এই ভগ্নবাড়ি, এই নদী, আর আমি… আমরা।” নারী ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, কিন্তু তার পা মাটি স্পর্শ করছিল না, যেন বাতাসেই ভাসছে সে। হঠাৎ একটা শীতল ঝাপটা এসে গেল, কুয়াশা ঘন হয়ে উঠল, আর চোখের নিমেষে নারী মিলিয়ে গেল। কৃশানু তার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে চাইলে দেখতে পেল, স্ক্রিন সাদা হয়ে আছে—কোনো ইমেজ ধরা পড়েনি। সে জানত, কিছু একটা ভুলভাল নয়, বরং সত্যিই ঘটছে। এই বাড়িতে কিছু অতিপ্রাকৃত নয়, বরং অতীতের কোনো অমীমাংসিত ঘটনা এখনও বারবার ফিরে আসছে ছায়ারূপে।
সে ফিরতে চাইল না। তার মধ্যে একধরনের জেদ এসে গেছে—এই ভৌতিক উপস্থিতির পেছনে কিছু একটা সত্য লুকিয়ে আছে, যার চাবিকাঠি এই নারী কিংবা এই “বাঁশিওয়ালা”। ভেতরে ফিরে এসে সে দেখতে পেল ঘর বদলে গেছে—যেখানে আগে কাঠের তক্তা ছিল, এখন সেখানে পাথরের মেঝেতে একটা ছোট্ট শঙ্খ পড়ে আছে, রক্তের দাগ লাগানো। দেয়ালে জলচিহ্নের মতো ফুটে উঠেছে পুরোনো আঁকিবুকি—মুখাবয়ব, হাত, আর এক জোড়া চোখ, যেগুলো ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল জোরে। বাতি নিভে গেল, কৃশানু দাঁড়িয়ে থাকল অন্ধকারে, তার মাথার ভেতরে বাজতে লাগল সেই বাঁশির সুর, এবার এত স্পষ্ট, এত গভীর, যেন কারও কান্না দিয়ে তৈরি। সেই রাত ছিল তার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত, যেখানে সে বুঝেছিল, ভয়ে নয়, বিশ্বাসেই সে এগোতে হবে—কারণ ছায়ারা যা লুকিয়ে রেখেছে, তা হয়তো সত্যিই আলো চায়।
ছয়
চাঁদের আলোয় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক ঋভু ভেবেছিল, এমন অভিজ্ঞতা তার জীবনে আর হয়নি। গতকাল রাতে যেভাবে মৃন্ময়ীর আত্মা যেন তার সামনে আত্মপ্রকাশ করল—তার চোখ, তার কণ্ঠ, সেই বাঁশির শব্দ—সব কিছু যেন বাস্তব থেকেও অস্বস্তিকরভাবে অবাস্তব। সকালে ঘুম ভাঙার পর, ভগ্নবাড়ির ভেতরের ঘরগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে এক পুরনো কাঠের সিন্দুক খুঁজে পায়, যেটার গায়ে ছিল অদ্ভুত সব খোদাই করা চিহ্ন—কোনওটা সাপের মতো, কোনওটা যেন পাখির পাখনা। সিন্দুকের ভিতরে সে পায় পুরনো কিছু চিঠি, তার মধ্যে একটি ছিল ইংরেজিতে লেখা, এবং তারিখ অনুযায়ী ১৮৭৪ সালের। চিঠিতে একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার, আর্নেস্ট ব্ল্যাকে, তার সুপিরিয়রের কাছে লিখছেন এক রহস্যময় দুর্ঘটনার কথা—এক স্থানীয় জমিদার পরিবারে প্রতিটি উত্তরসূরির রহস্যময় মৃত্যু, আর বাড়ির পাশের নদীতে বাচ্চাদের বাঁশির আওয়াজ শোনা যাওয়ার খবর। চিঠির শেষে লেখা ছিল, “This house must be sealed. Evil speaks in music.” ঋভুর কাঁধে যেন ঠান্ডা একটা হাওয়া বয়ে যায়। সে বুঝে যায়, এই বাঁশির আওয়াজ কেবল ভৌতিক কল্পনা নয়—এ যেন ইতিহাসের গভীর কোনো মায়ার ফাঁদ।
ঋভু সেই চিঠির ফটোকপি করে নিয়ে যায় স্থানীয় লাইব্রেরির এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ অদ্ভুতুড়ে মানুষ সোমকেশ সিংহর কাছে, যিনি পুরাতত্ত্ব আর প্রাচীন সংকেত নিয়ে কাজ করেন। সোমকেশ উৎসাহে চোখ বড় করে বলেন, “এই চিহ্নগুলো যে তান্ত্রিক চিত্রলিপি, এটা আমি নিশ্চিত। এগুলো ‘অগ্নিসূত্র তান্ত্র’ থেকে নেওয়া—যেখানে বলা আছে, কিছু শব্দ বা সুরের মাধ্যমে নির্দিষ্ট আত্মাকে জাগ্রত করা যায়। বাঁশি সেই মাধ্যম হতে পারে।” ঋভুর মাথা ঘুরে যায়। সে ভাবে, তাহলে মৃন্ময়ী কি সেই আত্মা, যে বাঁশির সুরে জাগে? আর কে বাজায় সেই বাঁশি? সোমকেশ আরো বলে, “এই বাড়ির অবস্থান, নদীর ধারের এই অঞ্চল এক কালে এক প্রাচীন শ্মশান ছিল। কেউ কেউ বলে, এই বাড়ি এক গুপ্তঘরের উপর দাঁড়িয়ে, যেখানে এককালীন মৃৎশিল্পীরা তাদের আত্মিক অভিশাপের সঙ্গে পুঁতে রাখত পুতুল। আর সেই পুতুলই আত্মার বাহন হয়ে থাকত।” ঋভুর মনে পড়ে, সেদিন রাতে সে যেই পুতুলটা দেখেছিল, তার চোখে জ্বলজ্বল করছিল কেমন যেন এক জীবন্ত অভিসার।
ঋভু এবার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে আবারও সেই ভগ্নবাড়িতে ফিরে যেতে হবে—এইবার আর ভয় নয়, বরং সত্য উন্মোচনের সংকল্পে। রাতে সে আবার ফিরে যায়, সঙ্গে নেয় রেকর্ডার, একটি প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থের কপি, আর সোমকেশের নির্দেশ মতো কিছু মন্ত্র লেখা কাগজ। সে সেই পুরনো পুতুলটিকে খোঁজে, যেটা আগের রাতে দেখেছিল। পায়ও, তবে এবার পুতুলটা বসে আছে ঘরের এক কোণে, ঠিক যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে পুতুলটার পায়ের নিচে খুঁজে পায় একটা ফাটল, যেটা আসলে এক গোপন সুড়ঙ্গের মুখ। এক অন্ধকার, ভেজা সুড়ঙ্গ—যেখানে বাতাসের মধ্যে ভেসে আসে বাঁশির সেই পরিচিত অথচ ভয়ার্ত সুর। সে নিঃশব্দে এগোয়, সুড়ঙ্গের ভেতরে টর্চের আলোয় ধরা পড়ে দেওয়ালে আঁকা প্রাচীন প্রতিচ্ছবি—এক রাজকুমারী, এক বাঁশি, এক ভগ্নপ্রায় নদীঘাট আর শত শত চোখ। এবং এক জায়গায় লেখা—”যারা সুরকে বোঝে, তারাই মুক্তি দিতে পারে।” ঋভুর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। সে বুঝে যায়, এই গল্পে সময়, ইতিহাস আর আত্মা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে। পরবর্তী পদক্ষেপ তার, কিন্তু সেই পথে আর ফেরা নেই।
সাত
রাত্রির নীরবতা তখন চরমে পৌঁছেছে, নদীর জল ঠান্ডা বাতাসে হালকা ঢেউ তোলে আর দূরে কোথাও একটা শিয়ালের ডাক শোনা যায়। হিরণ তার হাতে থাকা ক্যামেরা শক্ত করে ধরে রেখেছে, মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের রেখা, কিন্তু চোখে কৌতূহলের ঝলক এখনও নিভে যায়নি। সে অন্ধকার গলিপথ ধরে ধীরে ধীরে চলতে থাকে, যেখানে গৃহের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাঁশির শব্দ আরও জোরালো হয়ে উঠছে। তার পেছনে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে মহুয়া, এক হাতে শক্ত করে ধরা লণ্ঠন, অন্য হাতে তার রেকর্ডার। আচমকা, এক পুরোনো কাঠের দরজা খটাস করে খুলে যায়, এবং সামনে এসে দাঁড়ায় এক ফিকে নীল আলোর আবরণে ঢাকা, আধা-দৃশ্যমান এক ছায়ামূর্তি। ছায়াটা কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ বেরোয় না, শুধু চোখ দুটো যেন শতাব্দীর বেদনা বহন করছে। হিরণ হাঁপিয়ে ওঠে, কিন্তু পিছু হটে না। সে ক্যামেরা তোলার চেষ্টা করে, অথচ বোতাম কাজ করে না—মনে হয় চারপাশের সব যন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে সেই উপস্থিতির সামনে।
ছায়ামূর্তির চোখে চোখ রাখতেই মহুয়ার মনে পড়ে যায় সেই পুরনো গল্প, যা একবার তার দাদু বলেছিলেন—নবাবি আমলে নদীর তীরে বানানো এই প্রাসাদে ছিলেন এক সুরের সাধক, যিনি বাঁশির মাধ্যমে মৃত আত্মাদের শান্তি দিতেন। এক রাত্রে, রাজসভার একজন ঈর্ষান্বিত সঙ্গীতশিল্পী তার বাঁশি ভেঙে দেন, এবং সুরের সাধক আক্ষেপে আত্মহনন করেন, তার আত্মা আজও সুরের খোঁজে এই ধ্বংসস্তূপে ঘোরে। মহুয়ার মনে প্রশ্ন জাগে—এই ছায়াটা কি সেই সাধকের? হিরণ পা বাড়ায় সামনে, ছায়াটার সামনে গিয়ে বলে, “আপনার কণ্ঠ চাই না, শুধু সত্য চাই।” অদ্ভুতভাবে, ছায়ামূর্তি তার দিকে বাঁশির একটি অংশ এগিয়ে দেয়—ভাঙা বাঁশির অর্ধেক, যা হিরণের হাতে এলেই প্রচণ্ড ঠান্ডা অনুভব করে সে, আর মুহূর্তেই চোখের সামনে দেখতে পায় এক অতীতের দৃশ্য—প্রাসাদের উজ্জ্বল দিন, সভাঘরের সুর, আর তারপর বিশ্বাসঘাতকতা, হিংসা, রক্ত।
হিরণ ছায়ামূর্তির থেকে বাঁশির টুকরো নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে, সঙ্গে মহুয়া। তারা ভগ্নবাড়ি পেরিয়ে আসে, কিন্তু সেই বাঁশির আওয়াজ যেন এখনও কানে বাজছে—এবার আর ভয় নয়, যেন এক আশীর্বাদের সুর। প্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরে এসে থেমে হিরণ মহুয়াকে বলে, “এই গল্প শুধু ভূতের নয়, বরং এক নিঃস্ব আত্মার আর্তি—যার শান্তি আমরা দিতে পারি, যদি তার সুর ফেরাই।” মহুয়া সম্মত হয়—তারা সিদ্ধান্ত নেয়, প্রাসাদের ইতিহাস ও বাঁশির টুকরো নিয়ে ফিরে যাবে শহরে, খুঁজবে ইতিহাসবিদদের, সঙ্গীতজ্ঞদের, এবং ফিরিয়ে দেবে সেই হারানো সুর, যাতে ছায়ামূর্তি আর এই ভগ্নবাড়ি বাঁশির আওয়াজে নয়, শান্তির নিঃশ্বাসে ভরে ওঠে। কিন্তু হিরণ জানে, রাত এখনও শেষ হয়নি, আর সামনে অপেক্ষা করছে আরও গভীর অন্ধকার।
আট
চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাওয়া নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তিয়াসা যখন প্রাসাদের দিকে তাকায়, তার মন অদ্ভুত এক ভারে নুয়ে আসে। রাত প্রায় দেড়টা। বাড়ির দরজার লোহার কড়াগুলি ঠাণ্ডা বাতাসে হালকা করে বাজছে, যেন কারো অদৃশ্য আঙুলের ছোঁয়ায়। সে ধীরে ধীরে দোতলার সেই ঘরে উঠে আসে যেখানে আগের রাতে বাঁশির শব্দ শুনেছিল। ঘরটা আগের মতোই, ধুলো জমা কাঠের মেঝে, ছিন্ন পর্দা, ভাঙা জানালা, আর দেয়ালের কোণে একটা বিশাল আয়না। আয়নাটার কাঁচ ফেটে গেছে, কিন্তু তার ভেতরে কী যেন লুকিয়ে আছে—একটা পুরোনো মুখ, একজোড়া চোখ, যেটা ঠিক তার নিজের নয়, বরং যেন সময়ের ফাঁকে আটকে থাকা কোনো অচেনা ছায়ার। তিয়াসা প্রথমে ভাবে, ওর চোখের ভুল, কিন্তু পরক্ষণেই দেখে সেই মুখটা ধীরে ধীরে তার নিজের মুখের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, এক অদ্ভুত মিল তৈরি করছে। সে আর্তনাদ করে পেছনে ফিরে তাকায়, কিন্তু ঘর ফাঁকা। হঠাৎ সেই পরিচিত বাঁশির সুর। এবার অনেক কাছ থেকে। যেন দেয়ালের ওপারে কেউ দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছে।
তিয়াসা ভয় না পেয়ে এগিয়ে যায়, দেয়ালের পেছনে কান দেয়। কিন্তু সুর থেমে যায়। সে আয়নার সামনে এসে আবার দাঁড়ায়। এবার আয়নার মধ্যে একটা দৃশ্য ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে—প্রাসাদের সেই সময়ের ছবি, যখন এটি পরিপূর্ণ ছিল। রাজকীয় সাজসজ্জা, সুরেলা বাঁশির আওয়াজ, আর সবার সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবতী—চোখে রহস্যের ছায়া, হাতে বাঁশি। ঠিক তখনই এক ভদ্রলোকের মুখ দেখা যায়, গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে সেই মেয়েটির দিকে। তিয়াসা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই আয়নাটা সময়ের দরজা। এই আয়নার মধ্যে আটকে আছে সেই ইতিহাস, যেটা কেউ জানে না। হঠাৎ আয়নাটা কেঁপে ওঠে, যেন ভেতরের কেউ বেরিয়ে আসতে চাইছে। তিয়াসা ভয় পেয়ে এক ধাপ পিছিয়ে আসে। তখন তার চোখে পড়ে, আয়নার নিচে একটা ছোট লেখা খোদাই করা—”মুখ যে দেখেছে, তারই গল্প বয়ে যায় বাঁশির সুরে।” হঠাৎ জানালার পর্দা ঝলকে ওঠে, বাইরে কোনো এক অদৃশ্য ছায়া দ্রুত চলে যায়। তিয়াসা দৌড়ে জানালার কাছে যায়, কিন্তু কেউ নেই। কেবল রাতের হাওয়া আর সেই নদীর গাঢ় গন্ধ।
তিয়াসা এবার ভয় পায় না। সে বুঝে গেছে, এই বাড়ি শুধু অভিশপ্ত নয়, এই বাড়ি এক ইতিহাসের ধারক। পরদিন সকালে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু তার মুখে যেন অন্যরকম শান্তি। শহরে ফিরে গিয়ে অফিসে বসে সে লেখে—“ভগ্নবাড়ির বাঁশি: এক আত্মার প্রতীক্ষা।” কিন্তু গল্পটা শেষ হয় না। কারণ, সেই রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে আবার সেই আয়নাটা দেখে স্বপ্নে—এবার আয়নার ভেতর থেকে মেয়েটি তাকে ডাকছে। তার বাঁশি বাজিয়ে তিয়াসার দিকেই তাকিয়ে আছে। তিয়াসা জানে, সে আবার ফিরবে। কারণ আয়নার দরজা খুলে গেছে, আর সে একবার মুখ দেখেছে।
নয়
নদীর ভেজা বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তাপসী। তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা অর্ধেকটা আলোয়, অর্ধেকটা ছায়ায় ঢাকা—যেন বাস্তব আর কল্পনার সীমানায় দুলতে থাকা এক ছায়ামূর্তি। সে যে হরিশ ছিল, তাতে আর সন্দেহ নেই, কিন্তু তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত নির্মমতা, এক অতিপ্রাকৃত নীরবতা। বাঁশির আওয়াজ ক্রমশ মিশে যাচ্ছিল নদীর শব্দে, যেন নদীর জল নিজেই হয়ে উঠেছে এক প্রাচীন সঙ্গীতের বাহক। হরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তার চোখ দুটি একেবারে শূন্য, অথচ গভীর, যেন তলিয়ে যেতে চায় তাপসীর আত্মার গভীরে। “তুই তো এসেছিস… শেষ সুরটা শোনার জন্য,” তার কণ্ঠে ছিল অতীতের বিষণ্নতা, বর্তমানের বিষ্ময় এবং ভবিষ্যতের বিভীষিকা। তাপসী পেছাতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন আটকে গেছে ঘাসে, মাটিতে, ভয়ে। সে দেখতে পেল, হরিশের শরীরের চারপাশে বাতাস ঘন হয়ে আসছে, এবং সেই বাতাসের মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে ভগ্নবাড়ির পুরনো দরজার চাবি, এক পোড়া দিনের নোটবুক, এবং সেই বাঁশির অর্ধেক ভাঙা টুকরো।
হঠাৎই চারপাশের সমস্ত শব্দ থেমে গেল। কেবল একটানা একটি নীরবতা, যেন প্রকৃতিও দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। হরিশ একপা করে নদীর দিকে এগোতে লাগল, আর তার পেছনে চলতে লাগল তাপসী। সে জানে না কেন, জানে না কী শক্তিতে, কিন্তু যেন এক অদৃশ্য সুতোর টানে সে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নদীর কিনারায়। তখন হরিশ থেমে দাঁড়াল, এবং তার হাতে উঠে এল সেই বাঁশির অর্ধেক অংশ। সে সেটা তাপসীর দিকে বাড়িয়ে দিল। “তুই এখন শুন,” সে বলল, “শেষ সুর তো তোকে দিয়েই লেখা হবে।” তাপসী বাঁশিটা হাতে নিয়ে ঠোঁটে আনতেই হঠাৎ তার ভেতরের সব স্মৃতি জেগে উঠল—সে যেন দেখতে পেল হরিশ, কুন্দন, নন্দিতা আর সেই দগ্ধ প্রাসাদ; দেখল আগুন, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম, প্রতিশোধ এবং সেই ভয়ানক সত্য—সে নিজেও ছিল সেই প্রাসাদের কেউ, আগুনের রাতে যাকে পুড়িয়ে শেষ করতে চেয়েছিল হরিশ।
বাঁশির সুর যখন উঠল, নদীর জল থমকে গেল। অন্ধকারের বুক চিরে সেই সুর ভেসে উঠল আকাশে, এবং এক মুহূর্তে চারপাশে যেন আলো ছড়িয়ে পড়ল। হরিশ তখন মাথা নিচু করে বলল, “এই সুরই আমাকে মুক্তি দেবে।” কিন্তু হঠাৎই বাঁশির সুর থেমে গেল, কারণ বাঁশির শেষ ছিদ্রটি ফেটে গেছে, এবং তাপসী বুঝতে পারল—হরিশ চায় না মুক্তি, সে চায় চক্রের পুনরাবৃত্তি। আর সেই চক্রের নতুন কাহিনি শুরু হবে তাপসীকে দিয়েই। তারপর এক ঝটকায় হরিশ নদীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, এবং সঙ্গীত মিলিয়ে গেল বাতাসে। তাপসী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, হাতে সেই ভাঙা বাঁশি, হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী সুরের অভিশাপ।
দশ
আকাশ ভোরের প্রথম আলোয় ধীরে ধীরে ভরে উঠছে, নদীর জলে সূর্যের রঙ ছড়িয়ে পড়ছে যেন রক্তাক্ত স্মৃতির প্রতিচ্ছবি। পত্রলিপি হাতে নিয়ে বিরাজ অচল বসে আছে সেই ভগ্নপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের মাঝে, যেখানে একদিন বাঁশির শব্দে কেঁপে উঠত রাত। চোখে তার এক অদ্ভুত স্থিরতা, যেন এই পৃথিবীর কোনও কিছুর সঙ্গে আর তার সর্ম্পক নেই, আবার একইসঙ্গে বাস্তবকে আঁকড়ে ধরার এক গোপন চেষ্টা। ধূপের গন্ধ, পুড়ে যাওয়া কাঠের গুঁড়োর উপর ছড়িয়ে থাকা ছাই আর বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর—সব মিলিয়ে এক অলৌকিক সমাপ্তির সূচনা হয়েছে। পত্রলিপির শেষ লাইনটা ছিল—“আমি বাঁশি বাজাই, যাতে কেউ আমার না বলা কথা শুনতে পারে।” বিরাজ বুঝে গিয়েছে, বাঁশির আওয়াজ কখনও শুধু সুর নয়, তা কোনও এক আত্মার আর্তনাদ, হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরের শেষ প্রয়াস।
সে ধীরে ধীরে উঠল, তার ক্যামেরা, নোটবুক আর পত্রলিপি কাঁধে ঝুলিয়ে এগিয়ে চলল নদীর ঘাটের দিকে। ভোরের আলোয় ভেসে থাকা প্রাসাদের ছায়া যেন এক শেষ অভিনয়ের মঞ্চ। পথ চলতে চলতে সে ফিরে দেখল না একবারও, কারণ সে জানত, আর কোনও বাঁশির শব্দ তাকে ডাকবে না। যাদের আত্মা মুক্তি পেয়েছে, তাদের আর পিছু ফেরার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই মুহূর্তে, হঠাৎ নদীর ওপার থেকে ভেসে এল এক মৃদু বাঁশির সুর—একটু অন্যরকম, নতুন কোনও যন্ত্রণা, নতুন কোনও গল্পের শুরু হতে চলেছে বুঝি। বিরাজ থেমে গেল না, সে জানে, কিছু আওয়াজ শোনার জন্য নয়, বোঝার জন্য থাকে। আর কিছু সত্য শুধু অনুভবের মধ্যেই থেকে যায়।
কলকাতায় ফিরে এসে, বিরাজ তার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ধারাবাহিক রিপোর্ট তৈরি করে, ‘ভগ্নবাড়ির বাঁশি’ নামে। পাঠকরা বিস্ময়ে পড়ে যায়, কেউ বিশ্বাস করে, কেউ ভাবে তা এক সাংবাদিকের কল্পনা। কিন্তু যেদিন শেষ পর্বটি প্রকাশিত হয়, পরদিন সকালে শহরের এক কোণে একজন বৃদ্ধ মহিলা খুঁজে পাওয়া যায়, যিনি বলেন, “আমি ওঁর মা, সুরবালা, অনেক বছর আগে আমার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। আজ যেন আবার তার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।” এ খবর বিরাজ পায় কিছুদিন পরেই। সে চুপ করে থাকে। সত্য সবসময় বলে দেওয়া যায় না। কিছু বাঁশি শুধু রাতের গভীরেই শোনা যায়, ভোরের আলোয় তারা নিঃশব্দ হয়ে যায়। আর যারা সেই সুর শুনেছে, তারা জানে, কিছু শব্দ চিরকাল মানুষের বুকেই বাজে… নিঃশব্দে, অনাদরে, অথচ চিরন্তন।
সমাপ্ত




