অর্কপ্রভ পাল
ঘন দুপুরের কলকাতা—হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে গঙ্গার জল পাগলের মতো ধাক্কা খাচ্ছে পিলারের গায়ে, আর শহরের বাতাসে যেন কোনো অদৃশ্য অস্থিরতা জমাট বেঁধে আছে। সরকারি দপ্তরে কেউ মুখ ফুটে বলছে না, কিন্তু মন্ত্রকের চত্বরে চায়ের দোকানগুলোর গুঞ্জন বলে দিচ্ছে—কিছু একটা হতে চলেছে। সায়নী বসু প্রেসক্লাবে বসে ল্যাপটপে শেষ লাইনটা টাইপ করছিল: “এই শহরে আমরা শুধু নজরে নই, আমরা এখন কানের ভিতরেও।” সে জানে, আজ রাতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে জানে, তার রিপোর্ট প্রকাশ পেলে বড় ঝড় উঠবে। একই সময়, শহরের উত্তর দিকে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে অর্ক মুখার্জী দেখছিল তার ডিজাইন করা ইন্টেলিজেন্ট সিটির মানচিত্র—আলোকিত রাস্তার প্রান্তে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দ সিসিটিভি ক্যামেরা, ধোঁয়াশায় ঢাকা সিগন্যালিং ডেটা স্টেশন, এবং সেই অদ্ভুত অঞ্চলগুলো যেখানে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য বারবার ভেঙে পড়ে। হঠাৎই ফোনে একটি নাম্বার ভেসে ওঠে—“Blocked Contact.” সে ধরে না, শুধু চুপ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির আলো টিমটিম করে নিভে যায়। বিকেল পাঁচটা বাজে তখনও, অথচ ট্রাফিক সিগনাল বন্ধ, মেট্রোর দরজা মাঝপথে আটকে, মোবাইল নেটওয়ার্কও থেমে যেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। কেউ জানত না, এগুলো পরিকল্পিত… কিংবা হয়ত কেউ জানত, কিন্তু বলার সাহস ছিল না।
অনুরাধা সেন তখন ব্যারাকপুর থানার অস্থায়ী গোয়েন্দা ঘরে বসে একটা রিপোর্ট পড়ছিল—শেষ ৬ মাসে শহরে একাধিক মানুষের অদ্ভুত মানসিক অস্থিরতা, বেছে বেছে কিছু এলাকা ঘিরে। তাদের কেউ কেউ বেঁচে আছে, কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউ গায়েব হয়ে গেছে। রিপোর্টে কিছু লাল মার্কিং করা প্যারা ছিল, যার উপর লেখা—“ওভারথিংকার সাবজেক্ট: Observe Thought Response.” সে বুঝতে পারছিল, এটা কোনো সাধারণ মানসিক রোগ নয়—এই মানুষগুলো ভয় পাচ্ছিল নিজেদের ভাবনা নিয়েই। ঠিক তখনই কলকাতা কর্পোরেশনের মেইন সার্ভারে এক হ্যাকিং চেষ্টা ধরা পড়ে। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি চেষ্টা করছে শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ঢুকতে। অথচ, যত না চুরি বা সাইবার হামলার ছাপ, তার চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয় একটা নির্দিষ্ট সময়—“রাত ৮টা”—যার আশপাশে সর্বোচ্চ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা গেছে। অনুরাধা তার টিমকে নির্দেশ দেয়, শহরের বেশ কিছু অঞ্চলে পেট্রোল বাড়াতে। কিন্তু রাতে কী ঘটবে, তার আন্দাজও ছিল না কারও।
সন্ধ্যা নামে দ্রুত। লোকেরা বাজার করে ফিরছে, ফোনের আলো জ্বেলে হাঁটছে, ব্যাঙ্ক থেকে লাইন দিয়ে টাকা তুলছে, কেউ কেউ দোকানে জেনারেটর কেনার জন্য দামাদামি করছে। ঠিক ৭টা ৫৮-এ সায়নী বসুর ল্যাপটপ হঠাৎ নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায়, তার সাথে সাথেই পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করতে থাকে—একটা ভয়েস-মেল এসেছে। সে কান পাততেই শুনতে পায় ফিসফিস করে বলা কিছু শব্দ—“তুমি বুঝে ফেলেছো, পালাও।” আতঙ্কিত সায়নী দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই চোখে পড়ে, তার চারপাশের আলো নিভে যাচ্ছে। অর্ক মুখার্জী তখন রাস্তার দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে—তার চোখ দুটো স্থির, যেন সে অপেক্ষা করছে কোনো নিশ্চিত পতনের জন্য। রাত ৮টা বেজে ০১ মিনিটে গোটা শহর এক তীব্র নীরবতায় ঢেকে যায়। অন্ধকার, নিঃশব্দ এবং চাপা শ্বাসে গমগম করতে থাকে চারদিক। ঠিক সেই সময় সাতটি নাম ধীরে ধীরে শহর থেকে মুছে যেতে শুরু করে—কেউ পরিবার থেকে, কেউ অফিসের তালিকা থেকে, কেউ থেরাপিস্টের ফাইল থেকে। সাতটি মানুষ, সাতটি মাথার ভিতরে সাতটি আলাদা চিন্তা—সব এক একটি নিষিদ্ধ সত্য, যা কাউকে বলা যায় না। আর শহর? সে চুপচাপ সব জানে, সব দেখে—আলো জ্বলে ওঠার আগে যা বলার, তা বলা যায় না।
–
ভোর চারটা বেজে পঁচিশ, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে শহরের মর্নিং শিফটের ধোঁয়াটে কুয়াশা ভেদ করে কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করছে অকারণে। লোডশেডিং চলেই আছে, কিন্তু শহরের এক কোণায় একটা ঘর হঠাৎ করেই খালি হয়ে গেছে—অর্ক মুখার্জীর ফ্ল্যাট। পুলিশ যখন পৌঁছয়, তখন তার দরজা খোলা, টেবিলের ওপর রাখা ব্লু-প্রিন্টে হালকা পেন্সিলের দাগে আঁকা গোল বৃত্তগুলো ছড়ানো—প্রত্যেকটিতে লেখা “Zone D-5”, “Zone E-3”, “Crowd Sink Area”, “Low-Wave Influence Field” ইত্যাদি। তার মোবাইল বন্ধ, ল্যাপটপের হার্ডড্রাইভ খুলে নেওয়া, আর দেয়ালের এক পাশে পেন্সিলে লেখা এক লাইন—“সবাই ভেবেছিল আমি প্ল্যান করেছি শহরটাকে বাঁচানোর জন্য, কেউ জানল না এটা একটা ফাঁদ।” অনুরাধা সেন এই মুহূর্তে জেগে আছেন। সে ধীরে ধীরে অর্কের কেস ফাইল খুলে প্রতিটি পয়েন্ট চিহ্নিত করে ফেলছে। অর্ক একজন সরকারি অথরাইজড আর্কিটেক্ট হলেও, তার ডিজাইনকৃত শহরের অঞ্চলগুলোতে বিগত ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি মানসিক রোগ, আচরণগত সমস্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব দেখে সে শুধু ফিসফিস করে বলে—”এটা নিছক ডিজাইন নয়, এটা একধরনের ভৌগোলিক চিন্তাচাপ।”
ফ্ল্যাটের দরজার পাশে অর্কের পায়ের ছাপ শেষ হয়েছে জানালার গ্রীলের কাছে, যেন কেউ নিজের ইচ্ছেতে বের হয়নি, বরং “তোলা” হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, কোনরকম জোরজবরদস্তির চিহ্ন নেই। অনুরাধা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে জানালার ওপারে তাকায়—রাতের নীরবতার ভেতর শহর যেন নিঃশব্দে কিছু গোপন করছে। সে ভেতরে ঢুকে অর্কের বুকশেলফ খোঁজে। সেখানে একটা পুরনো নোটবুক পায়, যার পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাক্যগুলোর মধ্যে একটা বিশেষ বাক্য তার চোখে পড়ে—“একটি শহর তখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, যখন সেটি নিজের চিন্তা শুরু করে।” তার গা ছমছম করে ওঠে। এতদিন সে ভাবত, মানুষ কেবল শহরকে ব্যবহার করে। আজ যেন শহর নিজেই মানুষদের বেছে নিচ্ছে।
নিউ আলিপুরে অন্য প্রান্তে, সায়নী বসুর ফ্ল্যাটে আলো নেই, মানুষ নেই, দরজা তালাবদ্ধ। তার প্রতিবেশীরা জানায়, গতরাতে সে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু আর ফেরেনি। নিচের সিসিটিভি কাজ করছে না, মোবাইল নেটওয়ার্ক ডেড, তার রিপোর্ট কোথাও আপলোড হয়নি। প্রেসক্লাবে ফোন করলে জানায়—সে গতকাল সন্ধ্যায় একটি এক্সক্লুসিভ ফাইল নিয়ে আসছিল, কিন্তু পৌঁছয়নি। আর ঠিক তখনই শহরের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এক অজানা নাম্বার থেকে ভেসে আসে একটি বার্তা—“যারা ভাবতে শেখে, তারাই আগে মুছে যায়। দ্বিতীয় জনকেও সরানো হলো।” বার্তাটি কোনো ভয়েস নয়, লেখা নয়—একটি থার্মাল স্ক্রিনে ঝাপসা ভাবে জ্বলে ওঠা শব্দের মতো। অনুরাধা কাঁপতে কাঁপতে বোঝে, কেউ একজন ভেতর থেকে শহরটাকে চেনে—অথচ সে কাউকে চেনে না। স্রেফ একটা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রাত আর কিছু মানুষের ‘ভাবনার’ ভিতরে ঢুকে শহরের ঘুম না ভাঙতেই একে একে সাতজন নিখোঁজ হচ্ছে, যেন এই শহর এক ‘চিন্তা-খাদক’, যেখানে নিরাপদ শুধু সেই, যে কিছু ভাবেই না।
–
সকালের আলো ফিরলেও কলকাতা শহরের কিছু অন্ধকার যেন মুছে যায় না। বিদ্যুৎ ফেরার পর শহরের প্রায় সব সিসিটিভি ফুটেজ রহস্যজনকভাবে “করাপ্টেড” পাওয়া যায়, মোবাইল অপারেটররা বলে ব্ল্যাকআউট চলাকালীন সময়ে ‘সিগন্যাল ওভারলোড’ হয়েছিল, অথচ কোনো কল লগ সংরক্ষিত নেই। অনুরাধা সেন তখন লালবাজারে বসে একে একে নিখোঁজদের মধ্যে মিল খুঁজে বের করতে ব্যস্ত। অর্ক মুখার্জীর মতোই সায়নী বসুও এমন একজন, যার মানসিক পরিসরে প্রবলভাবে কাজ করত ‘নজরদারি’ আর ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ নিয়ে। অনুরাধা তার সহকর্মী অরিজিৎকে নির্দেশ দেয়—“খুঁজে দেখো, শেষ এক মাসে যারা ‘মনো-ভয়’ বা চিন্তা-আক্রান্ত অসুস্থতা নিয়ে থেরাপিতে এসেছে, তাদের তালিকা লাগবে। নিখোঁজের প্যাটার্ন তৈরি করতে হবে।” সেই সময় ফোন আসে—আলিপুর থেকে, আরেকটি নিখোঁজের খবর। লাবণী সাহা, মনস্তত্ত্ব গবেষক, গতরাতে তার চেম্বারেই ছিলেন। সেখান থেকে বাইরে বেরোবার কোনো সিসিটিভি রেকর্ড নেই, অথচ চেম্বার তালাবদ্ধ, চাবি তার ব্যাগে ছিল—যেটা ভেতরে পাওয়া গেছে। চেম্বারের দেয়ালে হালকা খসখসে লেখা—“যদি মন পড়ে ফেলা যায়, তাহলে কেউ তো চুপ করেই যাবে না।”
লাবণীর ডেস্কে একটি হলুদ ফাইল খোলা ছিল—‘Cognitive Leakage in Urban Populations’। ফাইলটিতে ১২ জন ভলান্টিয়ারের নাম, যাদের মস্তিষ্কে বিশেষভাবে মনোনীত শব্দ শোনার পর পাল্টে গিয়েছিল আচরণ। পরীক্ষাটি গোপন সরকারি প্রকল্পে চলেছিল, যার ব্যাকডেটেড অনুমোদন ছিল ২০১৮ সালে—কিন্তু রিপোর্ট অনুযায়ী লাস্ট আপডেট, তিন মাস আগে। ফাইলের নীচে বড় করে লেখা—“Subject S-2: সায়নী বসু, পরিবর্তন ধরা পড়েনি, কিন্তু সচেতনতা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।” অনুরাধার মুখ শুকিয়ে যায়। তার চোখের সামনে এখন দুটো লাল দাগ—একজন রিপোর্টার, একজন গবেষক। একজন ভাবছিল কেউ তার মনের ভিতর ঢুকে পড়ছে, আরেকজন জানত সেই প্রবেশ কখন ও কীভাবে ঘটে। তারা কেউ কি অপরাধী? না কি তারা কেউ এমন কিছু জেনে ফেলেছিল, যা জানা মানেই অস্তিত্বের জন্য বিপদ?
ঠিক তখনই একটি স্কেচ আর্ট পাওয়া যায় যাদবপুরে—একটি রাস্তার দেয়ালে পেন্সিলে আঁকা। শিল্পী অজ্ঞাত, কিন্তু স্কেচে দেখা যাচ্ছে, একটি শহর যেখানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের মাথার উপর ফাঁকা বৃত্ত আঁকা, যার ভেতরে লেখা “PROCESSING…”. এই চিত্র দেখে ঋতাভ সরকারের কথা মনে পড়ে অনুরাধার—একজন গ্রাফিক নভেল আঁকিয়ে, যার আঁকা গল্পে গত ৬ মাসে তিনটি চরিত্র ‘মনের কারণে’ গায়েব হয়ে যায়। সে প্রথমে ধরে এগুলো নিছক কাকতালীয়, কিন্তু তারপর যখন জানতে পারে ঋতাভ নিজেও গতরাতে নিখোঁজ, তখন সব গুলিয়ে যায়। অনুরাধা বুঝতে পারে, এই লোকেরা কেউ হারিয়ে যায়নি—তাদের খুঁজে নেওয়া হয়েছে, তাদের মুছে ফেলা হয়েছে। এবং এ মুছেই ফেলার পেছনে রয়েছে এমন এক ছায়া যাকে কেউ চেনে না, কিন্তু যার অস্তিত্ব প্রতিটি চিন্তার ভেতরেই লুকিয়ে। শহর এখন আর চোখ দিয়ে দেখে না, সে শোনেও না—সে শুধু ভাবনাকে চেনে। আর যত বেশি ভাবো, তত বেশি বিপদে পড়ো।
–
শহরের পুবদিকের এক কোণে, যেখান থেকে বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন কলকাতার ঝাপসা আকাশ অনেকটাই কাছাকাছি মনে হয়, সেখানে বসে আছে অনুরাধা সেন। গঙ্গার পারে পুরনো এক ঘাটে হেলান দিয়ে থাকা মেয়েটি অফিসার হলেও আজ তার চোখে ক্লান্তি, কানে হেডফোন—তবে তাতে গান বাজে না, ভেসে আসে মানুষের চিন্তার সারাংশ। ফিল্টার করা ভাবনার সারাংশ। নতুন প্রজন্মের এক গোপন প্রযুক্তি—‘ThoughtCatch’—যা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নয়, কিন্তু ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর অন্দরমহলে চুপিসারে ব্যবহার করা হয়। অনুরাধার কাছে এসেছে নতুন ফাইল: সাত নম্বর নিখোঁজ ব্যক্তি—জয়ন্ত করিম। বয়স ৩৯, পেশায় সাংবাদিক, ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং করতেন, সম্প্রতি হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেন। তার ভাবনার রেকর্ড বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া গেছে তা আতঙ্কের চেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর—”তারা আমার ভাবনার শব্দগুলো বিক্রি করছে, আমি যখন ঘুমাই, তখনও কেউ শুনছে।”
জয়ন্তের নিখোঁজ হওয়ার আগের ৭২ ঘণ্টা অনুসন্ধান করে অনুরাধা তার মোবাইল লোকেশন ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখতে পায় সে তিনদিন একই এলাকায় বারবার গেছে—সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক অচেনা ভবনের কাছাকাছি। ভবনটির নাম নেই, সরকারি নথিতে সেটা রেকর্ডই নেই। স্যাটেলাইট ইমেজেও তার ছায়া অস্পষ্ট। যেন কেউ ইচ্ছা করে মুছে দিয়েছে তার অস্তিত্ব। অনুরাধা সেখানে পৌঁছালে দেখা যায় পুরো ভবন ফাঁকা, তালা দেওয়া। কিন্তু সেই তালা ঠিক তালা নয়, বরং একটা বায়োমেট্রিক লক, যার উপরে লেখা—”ACCESS GRANTED THROUGH PATTERN MEMORY.” সে বুঝে যায়, এটা সাধারণ ভবন নয়—এটা সেই জায়গা, যেখানে মস্তিষ্কের গোপন কোষে থাকা ভাবনারও উপস্থিতি ধরা পড়ে। জয়ন্ত সম্ভবত এখানে এসে কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন—অথবা হয়তো তাকেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
ফেরার পথে অনুরাধা বুঝতে পারে কেউ তার পিছু নিয়েছে। তার গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে বারবার ঝাপসা একটা বাইকের আলো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কাছে এলেও প্লেট নাম্বার স্পষ্ট হয় না। এমন সময় তার ইন্টেলিজেন্স ট্যাবে আসে এক অদ্ভুত সিগনাল—সামনের বিলবোর্ডটি যা অন্ধকারে ডুবে ছিল, সেটি হঠাৎ জ্বলে ওঠে। তাতে ভেসে আসে একটি বাক্য: “ভাবার অধিকারই কি এখন অপরাধ?” বাক্যটি দেখে অনুরাধা অবাক হয় না—তবে আশ্চর্য হয় যখন দেখতে পায় বিলবোর্ডে তার নিজের ছবিও ফুটে উঠেছে। এরপর আবার অন্ধকার। শহর আবার নিস্তব্ধ। বুঝে যায়, সে এখন কেবল অনুসন্ধানকারীদের একজন নয়—সে নিজেও লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
–
রাত তখন গভীর। কলকাতার ছাদগুলিতে শহরের ক্লান্তি জমে উঠে সাদা কুয়াশার মতো। অনুরাধা সেন তাঁর ল্যাপটপের সামনে বসে, চোখে অস্বস্তির রেখা। মাথার মধ্যে এখন যেন একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন। জয়ন্ত করিমের নিখোঁজ হওয়া, অদৃশ্য ভবনের বায়োমেট্রিক লক, এবং সেই স্লোগান—”ভাবার অধিকারই কি এখন অপরাধ?”—সব মিলে যেন একটা বৃহৎ ষড়যন্ত্রের চেহারা নিচ্ছে।
ল্যাপটপে সে খুলে রাখে জয়ন্তের শেষ আপলোড করা রিপোর্টের ড্রাফট—যেটা অফিসিয়ালি কখনোই প্রকাশিত হয়নি। ফাইলটির নাম ছিল “CognoSync: The Last Barrier.” সেটি এনক্রিপ্টেড ছিল, কিন্তু এনআইএ-এর ইন্টারনাল টুল দিয়ে আনলক করে সে পড়ে—”CognoSync একটি গোপন প্রকল্প যা নিউরাল কম্পিউটিংয়ের সাহায্যে মানুষের চিন্তা স্ক্যান করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলে। এটা কেবল বিজ্ঞাপন কিংবা নির্বাচন নয়—এটা মানুষকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করছে যাতে তারা নিজেদের মনের মধ্যেও স্বাধীন না থাকে।”
ফাইলটি পাঠ করা মাত্রই স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যায়। একটা অডিও ফাইল নিজে থেকেই প্লে হয়। একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর—রয়্যাল বেঙ্গল বাংলার মত গম্ভীর এবং ভয়ের। সে বলে, “তুমি যদি ভাবো তুমি ভাবতে পারো, তবে তুমি বোকার স্বর্গে আছো।”
এই ভয়ঙ্কর বার্তার পরে হঠাৎই রুমের আলো একবার নিভে যায়। নিরাপত্তার কারণে অনুরাধা তার নিজের ফ্ল্যাটে তিন স্তরের সেন্সর বসিয়েছিল। কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে দেখে, কেউ যেন মুহূর্তের জন্য তার লাইটস এবং ইন্টারনেট এক্সেস হ্যাক করে নিয়েছিল। কে ছিল সেটা?
এমন সময় তার মোবাইল vibrate করে। একটা নতুন মেসেজ আসে। প্রেরক অজানা। শুধু একটা লাইন:
“একটু গড়িয়াহাট রেলওয়ে আন্ডারপাসে এসো। কেউ তোমাকে সত্যি বলার জন্য অপেক্ষা করছে।”
সন্দেহ হলেও অনুরাধা সিদ্ধান্ত নেয় সে যাবে। কারণ এখন তার আর পিছু হটার উপায় নেই। সে রাত সাড়ে তিনটায় পৌঁছায় সেই পুরনো আন্ডারপাসে। জায়গাটা ভীষণ অন্ধকার, কিন্তু ঠিক মাঝখানে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে। মাথায় টুপি, চোখে ঘন ফ্রেমের চশমা। অনুরাধা তার বন্দুক প্রস্তুত রাখে, কিন্তু লোকটা বলে, “আমার নাম সৌম্য ব্যানার্জি। আমি Joyonto’র সহকর্মী ছিলাম। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।”
সৌম্য বলে, “CognoSync নামে যে প্রকল্পটা জয়ন্ত অনুসন্ধান করছিল, সেটা আসলে সরকারি বা বেসরকারি নয়—ওটা মরফেট গ্রুপ নামের এক বেসরকারি গবেষণা সংস্থার কাজ। ওরা মানুষকে ‘ভবিষ্যতের নাগরিক’ বানানোর নামে মানুষের চিন্তা, পছন্দ, এবং অনুভূতি—সবই কন্ট্রোল করতে চাইছে। Joyonto ওদের হ্যাক করে ঢুকে গিয়েছিল। আর তাই ওকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
“আর যদি বলি Joyonto এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু এমন একটা ঘরে বন্দি যেখানে তার নিজের চিন্তাও এখন তার নয়?”—এই কথায় অনুরাধার হৃদস্পন্দন থেমে যায়। সৌম্য তার হাতে দেয় একটি ছোট পেনড্রাইভ, আর বলে—“এটাই Joyonto’র শেষ রেকর্ড করা ভাবনার ফ্রেম। প্লে করলেই বুঝবে কিসে জড়িয়ে পড়েছো।”
তারপর সৌম্য চলে যায় অন্ধকারে মিলিয়ে। অনুরাধা বোঝে, এই পেনড্রাইভটাই হতে পারে পুরো কাহিনির মোড় ঘোরানোর চাবিকাঠি—অথবা হয়তো এটা একটা ফাঁদ।
তবে সে জানে, সত্যি কখনও সহজে ধরা দেয় না—তবে সে যখন আসে, সঙ্গে করে আনে বিপদ, রক্ত, আর স্বপ্নহীন রাতের পেছনে লুকিয়ে থাকা ভয়।
–
অনুরাধা সেন জানত, শহরের ওপর অদৃশ্য এক প্রভাব বিস্তার করছে, কিন্তু সেটা কে করছে—এখনও অস্পষ্ট। নিখোঁজ হওয়া ছয়জনের ফোন এবং স্মার্ট ডিভাইস ঘেঁটে তিনি দেখতে পান, এক অদ্ভুত প্যাটার্নে তাঁদের সবাই একবার করে একটি নির্দিষ্ট ক্যাফের লোকেশন ট্র্যাক করে গিয়েছেন—”কনট্রোল রুম” নামে এক গোপনীয় ক্যাফে, শহরের এক কোণে পুরনো ট্রামডিপোর পেছনে লুকিয়ে থাকা, যেটা গুগল ম্যাপে পর্যন্ত ঠিকমতো চিহ্নিত নয়। সাদা পোশাক পরে, ছদ্মবেশে, অনুরাধা সেখানে পৌঁছে যান। কাফেটি বাইরে থেকে সামান্য আধা-ধ্বংসপ্রাপ্ত, কিন্তু ভিতরে একেবারে জ্যান্ত—নীরব অদ্ভুত আলো, দেয়ালে চুম্বকীয় প্যানেল, এবং একটি প্রজেকশন দেয়ালে লেখা: “ভাবনাও প্রমাণ”। এখানকার এক কর্মচারী, রহস্যময় চেহারার যুবক, অনুরাধার পরিচয় বুঝে ফেলার পর বলে বসে, “আপনার ভাবনায় সন্দেহ আছে, মিস সেন… আপনি কি সত্যিই স্বাধীন?”
সেই রাতে অনুরাধা ফিরে এসে বিছানায় ঘুমাতে পারেন না। তাঁর মনে হতে থাকে, কেউ যেন ভাবনায় ঢুকে পড়ছে, কেউ যেন ঠিক করে দিচ্ছে তিনি কী ভাববেন, কী ভাবা উচিৎ নয়। তিনি নিজের অতীত ভুলে যেতে শুরু করেন—একজন অফিসার হিসাবে তাঁর দায়িত্ব কি ছিল, কোন মামলায় তিনি কখন কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করেন, তাঁর ল্যাপটপে একটি এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার, যার নাম “OBSERVER_LOG_37″। ফোল্ডার খুলতেই দেখা যায়, গত তিন সপ্তাহ ধরে তাঁর প্রতিটি ভাবনার টাইমস্ট্যাম্পড রেকর্ড, এমনকি সেইসব মুহূর্ত যখন তিনি একা ছিলেন, কারো সামনে না। সেখান থেকে বোঝা যায়—শুধু তাকেই না, পুরো শহরকে কেউ একজন পর্যবেক্ষণ করছে—শুধু কর্ম, বাক্য নয়, বরং চিন্তাও। এটা কোনো সরকারী প্রোজেক্ট নয়, বরং একাধিক কর্পোরেট এবং এক্স-মিলিটারি ব্রেন হ্যাকারদের তৈরি একটি ছায়া-প্রকল্প, যার নাম—”Blackout Protocol”।
অনুরাধা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি যা ভাবছেন, তা ভুল প্রমাণ করতে হবে—তাঁকে ভাবনার ওপর ভাবনা রাখতে হবে, ছদ্মচিন্তা করতে হবে। তাঁর মনে পড়ে, পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রুদ্রদীপ, এখন একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট, যিনি কাজ করছেন “Meta-Thought Defense” নামে এক নতুন সিস্টেমে—যেটা মূলত মস্তিষ্ককে নিজের ভাবনার বাইরের ভাবনার কোটিং দেয়। পরদিন, অনুরাধা তাঁকে খুঁজে পান জাদুকরের মতো এক ল্যাবরেটরিতে, যেখানে রুদ্রদীপ বলেন, “চিন্তা আর চিন্তার অস্ত্র—এই লড়াইটা আর মস্তিষ্কের ভিতরে নেই, এটা এখন এক্সটারনাল সিগন্যালের খেলা। যেই মুহূর্তে তোমার চিন্তা তারা ট্র্যাক করে, সেটার সঙ্গে সিগন্যাল মিক্সিং করে তারা তোমার ব্যক্তিত্বই বদলে দেয়।” অনুরাধা বুঝে যান—যে সাতজন নিখোঁজ হয়েছে, তারা নিখোঁজ নয়, বরং অন্য কারো হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন একটাই—তাদের “কে” বানিয়েছে, এবং কেন?
–
নন্দনের ফাঁকা গেটপাশে দাঁড়িয়ে ছিল অনুরাধা। তার হাতে একখানা ছোট রেডিও, যেটা কিছুক্ষণ আগেই বিশিষ্ট সাংবাদিক অনিমেষের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার চোখ ছলছল করছিল—না ক্লান্তিতে, না হতাশায়—বরং এমন এক অনুভূতিতে, যা নির্ভুলভাবে বর্ণনা করা যায় না। অনিমেষের কণ্ঠস্বর সেই রেডিও থেকে বারবার ফিরে আসছিল—“তোমার মনে কী আছে?” এ এক ধরনের অডিও রেকর্ডার, যা মানুষের চিন্তা-ধারা ধারাবাহিকভাবে রূপান্তর করছে শব্দে, তবে নির্দিষ্ট এক তরঙ্গেই। এই ডিভাইসের অস্তিত্বই প্রশ্ন তোলে দেশের নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে। এদিকে আরএমআই-এর হ্যাকড রিপোর্ট জানাচ্ছে, শেষ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিটি, একা এক ট্যাক্সি চালক—পার্থ চক্রবর্তী—তার নিজের চিন্তার মধ্যে বিশ্বাস করত যে “শহরের বাতাসে ভেসে বেড়ায় মানুষের ভেতরের কথাগুলো”, এবং ব্ল্যাকআউটের দিন সে ট্যাক্সি রেখে হেঁটে চলে গিয়েছিল গড়িয়াহাটের গলিতে এক গোপন গবেষণাগারের দিকে। কাকতালীয়ভাবে, সেই গলিতেই সিসিটিভি বন্ধ হয়েছিল ঠিক ৩টা ১৪ মিনিটে।
কথোপকথনে, অনুরাধা এবার সিদ্ধান্ত নেয় তথ্য নিয়ে আর লুকোছাপা নয়—তার নিজের ‘মস্তিষ্ক-প্রতিসরণ’ রিপোর্ট সে নিজেই খোলে, যা সে পেতেই চায়নি। এতে লেখা, “ব্ল্যাকআউটের সময় ৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড ধরে সন্দেহ করা হচ্ছে অফিসার সেন গোপনে ভাবছিলেন, রাষ্ট্রের অনুমোদনহীন ভেতরের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া উচিত।” অনুরাধা অবাক নয়, কারণ সে জানত যে কেউ না কেউ তার চিন্তা নিয়েও খেলা করছে। এই সময়েই খোঁজ আসে আরও একটি সূত্রের—‘মিরর স্ক্রীন’ নামে এক গোপন প্রতিষ্ঠান, যারা থট-অবজারভেশন নিয়ে কাজ করে, এবং ব্ল্যাকআউটের কয়েকদিন আগেই তারা সরকারি ডেটা লাইসেন্স পায়। এবং ওই লাইসেন্সের আবেদনপত্রে সাক্ষর করেছিলেন অনুরাধারই ঊর্ধ্বতন, ডি.আই.জি. অর্জুন ঘোষাল।
অনুরাধা এবার ঠিক করে ফেলে—সে আর শুধুই তদন্তকারী নয়, সে নিজেই এখন টার্গেট। যে শহর চুপচাপ চলে যেতে চায়, সেই শহরই এখন নীরবে শোনে, বোঝে, এবং সিদ্ধান্ত নেয়—কারা নিরাপদ, আর কারা নয়। যখন চিন্তা হয়ে যায় অপরাধ, তখন যুক্তি দাঁড়ায় রাষ্ট্রের গলায়। রাত তখন ১টা ৩৭, অনুরাধা হাঁটছে সেই পুরনো গবেষণাগারের দিকে—ভাঙা গেট, লাল আলো, ভেতরে সিস্টেমের গর্জন, এবং রেকর্ডকৃত মানুষের ভাবনার গুঞ্জন—শহরের নিঃশব্দ অভ্যুত্থান এখানেই কি শুরু?
–
সেই গলিটার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, অনুরাধার মনে হলো—এই শহর তার সঙ্গে কথা বলছে। না, রাস্তাঘাট, বাতাস বা আলো নয়—এই শহর কথা বলছে তার স্মৃতির ভেতর দিয়ে। ভাঙাচোরা ইটের নিচে, ফেলে রাখা এক কনসোলের মতো পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রয়েছে সেই সব চিন্তার রেকর্ড, যেগুলো কেউ কোনওদিন বলেনি—বলতে পারেনি। গড়িয়াহাটের ওই নির্জন গবেষণাগার, ‘মিরর স্ক্রীন’-এর সেই গোপন ল্যাবরেটরি, যেখানে মানুষ নিজের মাথার মধ্যে গোপন রাখা চিন্তাভাবনা স্ক্যান করিয়ে টাকা আয় করত—তা এখন পরিত্যক্ত, কিন্তু তাদের সিস্টেম এখনো চালু।
ভেতরে ঢুকে অনুরাধা দেখতে পেল এক ভয়ানক আর্কাইভ—কাঁচের দেয়ালের পেছনে সাজানো রয়েছে ‘মেমরি ক্যাপসুল’—ছোট, আঙুলের মতো যন্ত্র, যেগুলো মানুষের একেকটি “চিন্তার দৃশ্য” ধারণ করেছে। দেয়ালে লেখা ছিল:
“থটস্ আর রেসিডুয়াল—একবার রেকর্ড হলেই, তা আর ধ্বংস হয় না।”
হঠাৎই একটিতে চোখ আটকে যায়—”Subject: Arjun Ghoshal”।
ডি.আই.জি. ঘোষালের ব্যক্তিগত স্মৃতি, যার মধ্যে সে বলে উঠছে,
“তোমার মতো লোকেরা যদি নিজের মাথায় বিশ্বাস রাখতে শেখে, তাহলে আমরা আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব না। চিন্তাই বিপ্লবের প্রথম অস্ত্র!”
অনুরাধা নিঃশব্দে একটি থট-পড পকেটে রেখে দেয়। বাইরে তখন বৃষ্টি নামছে—আর একদিকে উঠে আসছে সাইরেনের শব্দ—সাদা রঙের একটি গাড়ি এগিয়ে আসছে গবেষণাগারের দিকে।
এই মুহূর্তেই হঠাৎ তার ফোনে আসে একটি এনক্রিপ্টেড মেসেজ:
“RUN. THEY KNOW.”
– প্রেরক: ‘অ্যানোনিমাস-০১৩’
সে জানে, এটা অনিমেষ পাঠিয়েছে। যদিও সে নিখোঁজ, তার রেডিও থেকে অনুরাধা আগেই শুনেছিল শেষবারের মতো একটি লাইন—
“যদি আমি হারিয়ে যাই, স্মৃতিগুলোকে বিশ্বাস করো। কারণ স্মৃতি কখনো মিথ্যে বলে না।”
অনুরাধা সেই ক্যাপসুল নিয়ে ছুটতে থাকে, পেছনে কাঁটা তার, মাটিতে ছড়ানো ল্যাবের যন্ত্রাংশ, আর বাতাসে একটি স্পষ্ট আওয়াজ—গভীর কণ্ঠে রেকর্ডিং ভেসে আসে…
“চিন্তা একটা রাষ্ট্রদ্রোহ—তুমি কী ভাবছো, সেটাই বলে দেবে তুমি কতটা বিপজ্জনক!”
পেছন থেকে একজোড়া বুটের শব্দ এগিয়ে আসছে। এবার শহর সিদ্ধান্ত নেবে, কে থাকবে—আর কে হারিয়ে যাবে।
–
মেঘলা রাতের শিয়ালদহ স্টেশন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। অনুরাধা ছুটে চলেছে ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে পার হওয়া সেই ট্রেনটির দিকে—যেটা শহরের বাইরে কোনো এক গোপন ‘মেমরি ফার্ম’-এর দিকে নিয়ে যাবে, যেখানে বলা হয় মুছে ফেলা যায় মানুষের ভাবনা, আর লেখা যায় নতুন চিন্তা। পকেটে রাখা ক্যাপসুলে অরুণ ঘোষালের গোপন স্বীকারোক্তি—যেটা কিনা পুরো প্রশাসনিক কাঠামোকে বিপন্ন করে দিতে পারে—একটা অণু-আকারের যন্ত্র, অথচ তাতে লুকিয়ে আছে হিমালয়ের মতো বিস্ফোরণ।
ট্রেন যখন ছাড়ল, সে জানে এবার আর ফেরার পথ নেই।
সেই ‘মেমরি ফার্ম’-এর অবস্থান ছিল হুগলির এক পরিত্যক্ত চা-বাগানের নীচে—যেখানে লুকিয়ে ছিল “Project Gaman” নামের এক গোপন ডেটা ক্লাউড, যার মাধ্যমে সরকারের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হতো বেছে নেওয়া জনসাধারণের উপর। এই প্রযুক্তি মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর নাম করে রপ্ত করত তাদের চিন্তার রাশ।
অনুরাধা দেখতে পেল বিশাল এক গোলাকার কক্ষে সারি সারি থট-ম্যাপিং পড বসানো, যেখানে মানুষ শুয়ে আছে, কিন্তু চোখ খোলা—তারা জেগে আছে, অথচ নিজের মতো করে ভাবছে না। একটা বিশাল স্ক্রিনে ফুটে উঠছে:
“99.76% Thought Convergence Achieved. National Consciousness Sync In Progress.”
হঠাৎ করেই অনুরাধার সামনে এসে দাঁড়ায় এক মুখ—সাদা অ্যাপ্রোন, ঘামে ভেজা মুখ, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি—
“ডঃ অরিন্দম রায়চৌধুরি।”
এই সেই বিজ্ঞানী যিনি প্রথম ‘স্মৃতি রিসেট’ প্রোটোকল তৈরি করেছিলেন, এবং যিনি এই মুহূর্তে তার মাথার মধ্যে স্ক্যান করতে চায়।
তিনি ধীরে ধীরে বলে উঠলেন—
“তুমি জানো, তোমার নিজের স্মৃতিই তোমার শত্রু হয়ে দাঁড়াতে পারে? আমরা যদি তোমার নিজের চিন্তাগুলো তোমার বিরুদ্ধে ফিরিয়ে দিই, তখন তুমি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারবে না।”
কিন্তু অনুরাধা থেমে যায় না। সে পকেট থেকে বের করে সেই ক্যাপসুল।
ডঃ রায়চৌধুরি হেসে বলে,
“তুমি কী করবে এটা দিয়ে? কেউ বিশ্বাস করবে না! এটা তো শুধু একটি মগজের টুকরো চিন্তা। যুক্তি না থাকলে সেটা ‘গল্প’ হয়ে যায়।”
অনুরাধা ক্যাপসুলটি প্রবেশ করায় ‘কেন্দ্রীয় মেমরি ইনজেক্টর’-এর ডাকে। মুহূর্তেই অডিটোরিয়ামে ভেসে আসে অরুণ ঘোষালের সেই স্বীকারোক্তি—
“আমরা কেউ স্বাধীন নই। আমরা ঠিক করে দিচ্ছি কে কী ভাববে, কে কী স্বপ্ন দেখবে, এমনকি কে কবে প্রতিবাদ করবে।”
চারপাশে উপস্থিত পডের মানুষগুলোর চোখ ঝলকে ওঠে। তাদের মধ্যে কেউ একজন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“আমি… আমি তো এসব ভাবিনি… তাহলে… কারা ভাবিয়েছিল?”
ডেটা সিস্টেমে হঠাৎ ‘Feedback Loop’ তৈরি হয়—যেখানে মানুষের অবচেতন নিজেই প্রশ্ন তুলছে নিজেদের চিন্তার উত্স নিয়ে। সেই লুপ এতটাই প্রবল হয় যে সার্ভার একে একে থমকে যেতে থাকে। বিশাল স্ক্রিনে ঝলকে ওঠে:
“THOUGHT REBELLION INITIATED.”
“HOST SYSTEM ERROR.”
“MEMORY SOVEREIGNTY ACTIVATED.”
সাইরেন বেজে ওঠে। অরিন্দম রায়চৌধুরি ভয়ে পেছন হটে যায়। তার কণ্ঠে তখন আর আত্মবিশ্বাস নেই, বরং অনুতাপ,
“আমরা চিন্তাকে বন্দি করতে গিয়েছিলাম… কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম, মানুষ ভাবতে জানে নিজেই।”
অনুরাধা জানে, এই মুহূর্তে যুদ্ধটা একটা ক্যাপসুল আর একটা বিবেকের মাঝে নয়—এটা গোটা রাষ্ট্র বনাম একজন সাধারণ মানুষের চিন্তার মধ্যে।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার মস্তিষ্কে তখন শুধু একটি আওয়াজ বারবার ফিরে আসে— “ভাবা মানেই বাঁচা।”
–
রাত তিনটের পর শহরের বিদ্যুৎ ফিরলেও, আলো আর অন্ধকারের পার্থক্য যেন মুছে গেছে। অনুরাধা সেন একটি গোপন ঘরে বসে আছে, সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ধরা পড়া তথাকথিত “চিন্তা অপরাধীদের” ডেটা, শহরের গভীর থেকে পাওয়া এক ডিভাইস, এবং সেই অ্যালগোরিদম যার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়া সম্ভব। বাইরে অন্ধকারে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে প্রাক্তন সাইবার সায়েন্টিস্ট ঈশান ঘোষ—তাঁর চোখে অপরাধীর অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের হিমশীতল মেকানিজমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এই দুই চরিত্র এখন এক বিকল্প ভবিষ্যতের দুয়ারে দাঁড়িয়ে, যেখানে ভাবনার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাদের হাতে সময় খুব কম। অনুরাধা ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখতে পেল সাত জন নিখোঁজ মানুষের শেষ চিন্তাগুলো—কেউ স্বপ্ন দেখছিল আত্মহত্যার, কেউ খুনের পরিকল্পনার, কেউ বিশ্বাস করছিল এই সমাজটাই একটি সিম্যুলেশন। এই চিন্তাগুলো কি আদৌ অন্যায়? না কি এগুলোই মানুষ হওয়ার প্রমাণ?
অন্যদিকে, নিউ টাউনের একটি পরিত্যক্ত ভবনের বেজমেন্টে গোপনে চালু আছে ‘নিউরোডেটা সার্ভার’, যার মাধ্যমে চলছিল ‘মাইন্ড স্ক্যানিং’ প্রজেক্টের রেকর্ডিং। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি অফিসারদের মধ্যে একজন, যিনি প্রকৃতপক্ষে সেই প্রজেক্টের লিক করা সায়েন্টিস্ট—ডাঃ রিমা সেন—চেষ্টা করছে প্রমাণ জোগাড় করে প্রজেক্ট বন্ধ করার। হঠাৎ করে সিস্টেমে ঢুকে পড়ে ঈশান, একটি বিশেষ কোড দিয়ে সার্ভার শাটডাউন করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিক সেই সময়, মেইন কন্ট্রোল রুম থেকে একটি মুখ ভেসে ওঠে—”আপনারা যা ভাবছেন, সেটাও আমরা জানি।” ঈশান বুঝতে পারে, তারা কেবল ভাবনা দেখছে না, বরং চিন্তাকেও প্রেডিক্ট করছে। এই প্রযুক্তি এখন ‘প্রি-থট জাজমেন্ট’ করছে—মানে, ভবিষ্যতে কে কী করতে পারে, তার পূর্বাভাস দিয়ে সিস্টেম নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—কাকে গ্রেফতার করতে হবে, কাকে “মুছে ফেলতে” হবে। অনুরাধা সেই মুহূর্তে বুঝে ফেলে, আইন এবং ন্যায় এখন আর কোর্টে স্থির হয় না—বরং মস্তিষ্কের মধ্যেই ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে।
গল্প শেষ হয় সূর্যোদয়ের মুহূর্তে, যখন অনুরাধা এবং ঈশান শহরের ছাদ থেকে একে একে সমস্ত চিন্তা-ট্র্যাকিং ডিভাইস ধ্বংস করে। পুলিশ এসে ঈশানকে গ্রেফতার করতে চায়, কিন্তু অনুরাধা বাধা দেয়—”আপনি যদি ভাবনার জন্য মানুষকে অপরাধী করেন, তবে একদিন আপনি নিজেও ধরা পড়বেন, কারণ আপনি নিজেই প্রতিদিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন—সেটাই তো চিন্তা।” ঈশান চোখ বন্ধ করে বলে, “অবশেষে, ব্ল্যাকআউটটা শহরের নয়, বিবেকের।” শহরজুড়ে আলো জ্বলতে শুরু করে—কিন্তু কে জানে, সেই আলো কতটা নিজের, আর কতটা কোনো অদৃশ্য তৃতীয় চোখের নিয়ন্ত্রিত?
শেষ