উৎসব দেব
কলেজ থেকে বেরিয়ে সায়ন দত্ত হাঁটছিল ধীর পায়ে, কানে হালকা হেডফোন গুঁজে। বিকেলের ধূসর আলো রাস্তার দু’ধারে গাছের পাতায় ছায়া ফেলে রেখেছে, আর শহরের ট্রাফিকের শব্দ একঘেয়ে শোঁ শোঁ করে ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। একেবারেই সাধারণ, নিস্তরঙ্গ দিন—যেমনটা তার প্রায় প্রতিদিনই যায়। সায়নের জীবনের রুটিনে যেন কোনও স্পন্দন নেই, তার ভেতরের যন্ত্রণা এবং নিঃসঙ্গতা ঢেকে রাখার একমাত্র উপায় সে খুঁজে পেয়েছে সংগীতের মাঝে। গানের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য সে তার সস্তা হেডফোনটি ব্যবহার করত, কিন্তু আজ হঠাৎ সেটা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। একটু বিরক্ত মুখে সে রাস্তার পাশের পুরনো এক ইলেকট্রনিক্স দোকানে ঢুকে পড়ে—”বিশ্বনাথ অ্যান্ড সন্স: রেডিও-টিভি রিপেয়ারিং”। দোকানটা ছোট, প্রায় অন্ধকার, ঝুলে থাকা তারে ঘেরা। কাঁচের ভিতরে পুরনো যন্ত্রপাতির স্তূপে তার চোখ আটকে যায়—একটা নীল রঙের হেডফোন, ধুলোমাখা, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণীয়। দোকানদার, এক বৃদ্ধ মানুষ, ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে হেসে বলল, “চাইলে নিয়ে যান, মাত্র ২০০ টাকা। কেউ নেয় না এসব পুরনো জিনিস। কিন্তু আপনি যদি গান ভালোবাসেন, তাহলে এটা পছন্দ হবে। এটা… অন্যরকম।” কেন যেন সেই ‘অন্যরকম’ শব্দটা কানে লেগে যায় সায়নের। অত বেশি না ভেবেই হেডফোনটা কিনে নেয় সে।
বাসায় ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে, জানালার পাশে বসে সায়ন হেডফোনটি কানে লাগায়। ছেলেটি একদম একা থাকে—মা-বাবা বিদেশে, সে থাকে শহরের উপকণ্ঠে এক ভাড়া ফ্ল্যাটে, যার দেয়ালগুলো নিজের মত নিঃশব্দ। নতুন হেডফোনটা কানেই একটা ঠান্ডা স্পর্শ দেয়, যেন মেটালের চেয়ে বেশি কিছু। মোবাইলে প্রিয় গান চালিয়ে দেয় সে—Radiohead-এর “No Surprises”। কিন্তু গানের মাঝে হঠাৎ শব্দ কাটতে শুরু করে। কিছু ফিসফিসানি, যেন ভীষণ নিচু স্বরে কেউ বলছে, “তুই শুনছিস? আমি… আমি এখনো আছি…”। সায়ন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে—শুধু গান চলছে, আর কনফার্ম করার জন্য হেডফোন খুলে আবার পরে। এবারো স্পষ্ট শোনা যায়—নারীকণ্ঠ, ভয় আর কষ্টে ভরা, যেটা কোনোভাবেই গানের অংশ না। সে মোবাইল থেকে গান বন্ধ করেও হেডফোন পরেই থাকে। কিছু না চললেও সেই কণ্ঠ আবার আসে—“ভালোবাসার নামে… আমায় আটকে রেখেছিল… বিশ্বাস করিস না… ওদের।” ভয় না পেলেও, তার ভিতরটা থমকে যায়। এই প্রথমবার, হেডফোনের বাইরে থেকেও কেউ যেন তাকে ডাকছে।
পরদিন ক্লাসে বসেও মন দিতে পারে না সায়ন। মাথায় ঘুরে ফিরে বেড়ায় সেই কণ্ঠ, সেই অজানা বার্তা। ল্যাপটপে হেডফোনটি প্লাগ ইন করে সে চেষ্টা করে রেকর্ড করার। অডিও সফটওয়্যারে গান ছাড়াই সে রেকর্ড অন করে, এবং কয়েক মিনিট পরে প্লেব্যাক করে। রেকর্ডিং-এ শোনা যায় হালকা মিউজিকাল হুম, এবং তার মাঝে সেই নারীকণ্ঠের ছায়া—”আমার নাম তিস্তা… যদি কেউ শোনে, প্লিজ, আমাকে খুঁজে বের করো…”। এতো পরিষ্কার বার্তা! কে এই তিস্তা? কে এই কণ্ঠ? সে কি কোনোভাবে এই হেডফোনে বন্দি হয়ে আছে? নাকি এটা কোনও অডিও ইলিউশন? বাড়ি ফিরে সায়ন পুরোনো কলেজ ফেস্ট ফাইল ঘাঁটতে শুরু করে, আর ইন্টারনেটে ‘তিস্তা’ নাম খুঁজে দেখে। যা খুঁজে পায়, তা তার পিঠে ঠাণ্ডা স্রোত নামিয়ে দেয়—গত বছর তাদের কলেজের এক ছাত্রীর নিখোঁজ সংক্রান্ত একটি খবর, “তিস্তা মৈত্র, সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী, কলেজ ফেস্টের রাত থেকে নিখোঁজ, পুলিশ তদন্ত ব্যর্থ।” ছবিতে দেখা যায় এক ম্লান হাসি—কালো চোখ, সাদামাটা পোশাক, একরকম অদ্ভুত নির্জনতা সেই মুখে।
সায়নের মন যেন একটা গভীর খাদে পড়ে যেতে থাকে। তার মাথার ভিতর ঘুরে বেড়ায় একটাই প্রশ্ন—এই হেডফোনে যদি তিস্তার কণ্ঠ থেকে থাকে, তবে সে কীভাবে সেখানে এল? কণ্ঠ কি রেকর্ডেড? কেউ কি ইচ্ছে করে কিছু প্ল্যান করে হেডফোনে এসব ঢুকিয়েছে? না কি, এটা তিস্তার শেষ চিৎকার, যা হাওয়ার সাথে থেকে গেছে এই যন্ত্রে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সে স্থির করে, আগামীকাল সে যাবে কলেজের অডিও ক্লাবের রুমে, যেখানে রাখা আছে পুরনো রেকর্ডিং গুলো, সিসিটিভি ফুটেজ, এবং হয়তো… কিছু লুকানো সত্য। আর অজান্তেই, সায়ন ধীরে ধীরে পা রাখে এমন এক রহস্যের জগতে, যেখানে সংগীত আর সাইবার সিগন্যাল মিলেমিশে তৈরি করছে এক বিভ্রম—যার থেকে আর ফেরার পথ নেই।
***
সায়ন দত্তর ঘুম আসেনি সেদিন রাতে। হেডফোন খুলে রাখলেও মনে হচ্ছিল সেই কণ্ঠ এখনো তার ঘরে রয়ে গেছে, দেয়ালের ছায়ার মধ্যে থেকে কাঁপা গলায় ডেকে চলেছে। বারবার সেই লাইন ফিরে আসছিল—“তিস্তা… যদি কেউ শোনে…”। সে ঠিক করল, এর একটা উত্তর খুঁজতে হবে। পরদিন সকালে কলেজে গিয়েই সে লাইব্রেরি এবং মিডিয়া ক্লাবের দিকে পা বাড়ায়। লাইব্রেরির পুরোনো খবরের কাটিং ফাইলে সে পায় “কলেজ ফেস্ট নিখোঁজ” সংক্রান্ত কিছু রিপোর্ট। সেখানে তিস্তার নাম ছিল—তিস্তা মৈত্র, সেকেন্ড ইয়ার মিউজিক অনার্স, কলেজের রক ব্যান্ড ‘প্রিজমা’-র ভোকালিস্ট। ওই রাতেই সে গেয়েছিল একটি সলো পারফরম্যান্স, আর তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি। রিপোর্ট অনুযায়ী, সে একাই হোস্টেল ফিরছিল, কিন্তু পৌঁছয়নি। তার মোবাইল, ব্যাগ—সব হোস্টেল রুমেই পড়ে ছিল। সায়নের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে—এত গুরুত্বপূর্ণ কেস, অথচ আজ একবছর পর কেউ তিস্তার কথা স্মরণও করে না?
মিডিয়া ক্লাবের রুমটা সায়নের জন্য অপরিচিত নয়। সেখানকার একজন সিনিয়র, প্রিয়াংশু ঘোষ ওরফে পি-জি, বিখ্যাত ‘হ্যাকিং গিক’, সায়নের পূর্বপরিচিত। পি-জি বরাবরই রহস্যে মজে, প্রযুক্তি ঘাঁটতে ভালোবাসে, এবং পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে তার অদ্ভুত এক আনন্দ। সায়ন তার কাছে অডিও রেকর্ডিং নিয়ে আসে এবং জিজ্ঞেস করে, এটা কি কোনো Deepfake বা সিগন্যাল হ্যাকিংয়ের ফল? পি-জি আগ্রহ নিয়ে অডিও পরীক্ষা করে, কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। তার মুখে কৌতূহলের ছাপ—”সত্যি বলতে, এই ভয়েসটা খুব প্রাচীন মেথডে এনকোড করা, যেটা কিছুটা ‘ওয়েভ ইনডাকশন’-এর মতো। তুই কোথা থেকে পেলি এটা?” সায়ন হেডফোন দেখায়। পি-জি সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, আবার শুনে, আর একটা দম নিয়ে বলে, “এটা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ভয়েস ইম্প্রিন্টিং-এর মতো কিছু হতে পারে। কেউ যেন তার মনের ভাবনা বা অভিজ্ঞতা এখানে রেখে গেছে। এটা রেকর্ডিং না, এটা একটা অনুভব, একরকম ডিজিটাল স্মৃতি।” কথাটা শুনে সায়নের মাথা যেন চক্কর খায়—ডিজিটাল স্মৃতি? স্মৃতি কি যন্ত্রে আটকে রাখা যায়?
তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তিস্তার ফেস্টের রাতের ফুটেজ খুঁজবে। মিডিয়া ক্লাবের হার্ডড্রাইভে সেই রাতের ভিডিও ছিল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো “ড্যামেজড ফাইল” হিসেবে চিহ্নিত। ভিডিও স্ক্র্যাবিংয়ের মাধ্যমে তারা পুনরুদ্ধার করে কিছু অংশ। দেখা যায় তিস্তা একটি সলো পারফর্ম করছে—ব্লু কালারের জামা, চোখে তীব্র এক অনুভূতি, আর তার কণ্ঠে একটা অসম্ভব গভীরতা। হঠাৎ মাইক ফিডব্যাক দেয়, ক্যামেরা কাঁপে, তারপর ক্লিপ শেষ। ভিডিওর শেষ ফ্রেমে দেখা যায়—দর্শকদের মাঝে বসে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তিস্তার দিকে, যার মুখ ছায়ায় ঢাকা। পি-জি সেটি ফ্রিজ করে জুম ইন করে কিন্তু মুখ অস্পষ্ট। “এটাই শেষ পারফরম্যান্স,” বলে পি-জি। সায়ন জিজ্ঞেস করে, “তুই কি তিস্তার সঙ্গে আগে কখনও কথা বলেছিস?” পি-জি একটু থেমে বলে, “হ্যাঁ, একবার… ও বলেছিল, ‘সাউন্ডটা আমাকে খেয়ে নিচ্ছে’।” কথাটির মধ্যে ছিল অদ্ভুত বিষণ্ণতা, যেন সে একটা অদৃশ্য দেওয়ালের ভেতরে আটকা পড়েছিল।
সায়নের মধ্যে একটা পরিবর্তন শুরু হয় তখন থেকেই। সে আর হেডফোনটা শুধুমাত্র সংগীতের জন্য ব্যবহার করে না—ওটা যেন এখন তিস্তার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। প্রতিদিন সে কিছুটা সময় হেডফোন পরে বসে থাকে, আর কিছু না হলেও তিস্তার কণ্ঠ একবার আসবেই—আস্তে, স্পষ্ট, আর যেন আরও ব্যক্তিগত। একদিন সে শুনতে পায়, “আমি বিশ্বাস করেছিলাম, সাউন্ড আমাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু ওরা চেয়েছিল আমার কণ্ঠ, আমার ভয়েস… বন্দি করে রাখতে চেয়েছিল।” কে এই “ওরা”? কেউ কি তিস্তার কণ্ঠ ব্যবহার করতে চেয়েছিল কোনও ডিজিটাল এক্সপেরিমেন্টে? নাকি তাকে চিরতরে চুপ করিয়ে দিতে? সায়নের কাছে এখন আর এটা কেবল এক নিখোঁজ কেস নয়, এটা হয়ে উঠেছে এক জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের গল্প, যেখানে একমাত্র সূত্র—এক জোড়া ব্লু হেডফোন।
***
রাতটা ছিল ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ, জানালার বাইরে ঝরছিল নিঃশব্দ বৃষ্টি। সায়ন হেডফোন পরে বসে ছিল আবার, রেকর্ডার চালু করে। এবার আর গান না, শুধু নিঃশব্দে শুনছিল, সেই কণ্ঠ আবার ফিরে আসে কিনা। কিছু সময় পরে, হঠাৎ ভেসে এলো—”০৩:১২… তারপর দক্ষিণ… ওরা সব জানে…”। ভয়েস টুকরো টুকরো, অদ্ভুতভাবে কাটা কাটা, যেন শব্দের মধ্যে কিছু চেপে রাখা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। সায়ন শব্দগুলো বারবার চালিয়ে শোনে, অডিও এনালাইসিস সফটওয়্যার দিয়ে বিশ্লেষণ করে। সে খুঁজে পায় একটা প্যাটার্ন—তিস্তার ভয়েস মাঝে মাঝেই সময় ও দিক নির্দেশ করছে। “০৩:১২”, “দক্ষিণ”, “বেসমেন্ট”—এই শব্দগুলো মিলিয়ে সায়ন অনুমান করে, তিস্তা হয়তো কোথাও কিছু লুকিয়ে রেখেছিল, কিংবা কেউ তাকে সেখানে আটকে রেখেছিল। মাথায় একটা প্রশ্ন দানা বাঁধে—ওই সময়টাতে, কলেজ ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকের বেসমেন্টে কী ঘটে ছিল?
পরদিন, সায়ন ক্লাস শেষ করে চলে যায় কলেজের পুরনো অডিটোরিয়াম বিল্ডিংয়ে। ভবনটির দক্ষিণ পাশে এক ছোট বেসমেন্ট ঘর ছিল, বহুদিন অব্যবহৃত। তালা ছিল না, শুধু একটা কড়া দরজা, যেটা অল্প চাপেই খুলে যায়। ভিতরে অন্ধকার, ধুলোমাখা কাঠের স্টোরেজ, পুরোনো স্পিকার, ক্যাবল, ব্যানার—আর দেয়ালের এক পাশে একটা ছোট স্পঞ্জের কক্ষে ঢোকার পথ। টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল, সেখানে একটা ভাঙা চেয়ার, কিছু সিডি, আর দেয়ালে হাতে লেখা কিছু শব্দ—”এখানেই শেষ হয়নি…”। বুকের ভিতর সায়নের ছন্দপতন ঘটে। একটা সিডি তুলে নেয় সে, নাম লেখা—“T.M. – Layered Mix”। ফিরে এসে ল্যাপটপে চালিয়ে দেখে, তিস্তার একটি মিক্সড ট্র্যাক—কিন্তু গানের মধ্যে বারবার শব্দ থেমে যায়, আর ভয়েস দিয়ে কাঁপা গলায় বলা হয়, “এই গানটা কেউ বাজাবে না… যদি বাজাও, ওরা শুনবে…”। বার্তাটা শুনে গায়ে কাঁটা দেয়। কে এই “ওরা”? তিস্তা কি শুধু ভয় পাচ্ছিল, না কি কেউ তাকে পর্যবেক্ষণ করছিল?
সায়নের মাথায় প্রশ্নের পাহাড় জমতে থাকে। পি-জি-র সাহায্যে সিডি’র অডিও ফাইল খুলে শব্দ স্তরে বিশ্লেষণ করে। তারা খুঁজে পায়, মূল গানের ট্র্যাকে আরও দুটি লেয়ার ছিল, যেগুলো সাধারণ সফটওয়্যারে দেখা যায় না। এগুলো ছিল সাউন্ড ওয়েভ কোডিং, একরকম সিগন্যাল প্যাটার্ন। পি-জি বলে, “এটা কোনো মিউজিক প্রজেক্ট না, এটা ইনক্রিপটেড ভয়েস ট্রান্সমিশন। সাউন্ডের মাধ্যমে কেউ মেমোরি স্টোর বা শেয়ার করছিল।” সায়ন তখনই বোঝে—তিস্তার ভয়েস হয়তো তার নিজের কণ্ঠ ছিল না, বরং সে অন্য কারও ভয়েস স্টোর করছিল, কিংবা এমন কিছুর সাক্ষী ছিল যা সে বুঝতে পেরেছিল খুব দেরিতে। হেডফোনটা শুধুই একটি মিডিয়াম নয়, এটা এমন এক যন্ত্র যার মাধ্যমে স্মৃতি, কণ্ঠ আর ভয় মিশে গেছে।
রাত বাড়ে। সায়ন হেডফোন পরে আবার শোনে সেই লেয়ারড ট্র্যাক। এবার কণ্ঠ বলে, “ভেবেছিলাম গান আমাকে বাঁচাবে, কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমার চারপাশের শব্দগুলো সত্য ছিল না, ছিল ফাঁদ।” সেই কণ্ঠের মধ্যে ভয় ছিল, কিন্তু কিছু দৃঢ়তাও ছিল। যেন সে কারো জন্য রেখে যাচ্ছে একটা দিকনির্দেশ—একটি গোপন মানচিত্র, যেটা শুধুমাত্র শব্দে লেখা। হঠাৎ করেই, হেডফোনের ভিতরে অন্য এক কণ্ঠ ভেসে ওঠে—পুরুষ কণ্ঠ, গভীর, শীতল—“তুইও এখন শুনছিস, তাই তুইও আমাদের খেলার অংশ।” সায়ন চমকে উঠে হেডফোন খুলে ফেলে। এবার আর শুধু তিস্তার কণ্ঠ নয়—আরও কিছু শোনা যাচ্ছে। কে যেন পিছন থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত সায়ন বুঝে যায়, সে আর শুধুই একজন শ্রোতা নেই… সে এখন গল্পের মধ্যে প্রবেশ করে ফেলেছে।
***
সায়নের মাথায় যেন অবিরত শব্দ বেজে চলেছে—তিস্তার কণ্ঠ, সেই পুরুষ কণ্ঠ, লুকানো বার্তা আর হেডফোনের ভিতরের অতল গহ্বর। পরদিন সকালে সে সোজা যায় পি-জির হোস্টেল রুমে। পি-জি, যার প্রকৃত নাম প্রিয়াংশু ঘোষ, হলের এক কোণে তার ল্যাপটপ, চারটে মনিটর, ছড়ানো ক্যাবল আর সার্ভার সংযোগে গেমার-ল্যাবের মতো একটা সেটআপ বানিয়ে রেখেছে। পি-জি চা খেতে খেতে বলল, “তুই এত সকালে এখানে? নিশ্চয়ই তোর কেস সিরিয়াস!” সায়ন সব খুলে বলে—সিডির অডিও, লেয়ারিং, ভয়েস ট্রান্সমিশন, এমনকি সেই পুরুষ কণ্ঠও। পি-জি প্রথমে হেসে ফেলে, তারপর গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে বলে, “তুই বুঝেছিস তো, এটা একটা হাইব্রিড সিগন্যাল, যেটা হেডফোনকে রিসিভার বানিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন প্রযুক্তি আমরা ‘Sonic Signature Manipulation’ বলে চিনি—যেটা একধরনের স্মৃতি বা কণ্ঠ ইমপ্লান্ট করতে পারে। এটা এখনও পরীক্ষামূলক। তিস্তা হয়তো ছিল সেই পরীক্ষারই অংশ।”
এই কথা শুনে সায়নের বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে, “কে বা কারা করত এমন এক্সপেরিমেন্ট?” পি-জি জবাব দেয়, “অডিওনেটিক্স নামে একটা ক্লোজড রিসার্চ গ্রুপ ছিল, যারা অডিও ট্রিগার ব্যবহার করে মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। এটা সরকার অনুমোদিত ছিল না। তিস্তা সম্ভবত একজন টেস্ট সাবজেক্ট ছিল—অথবা… হঠাৎ ওর ভেতর কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। হয়তো সে ‘শুনতে’ শুরু করেছিল এমন কিছু যা ওদের পরিকল্পনার বাইরের।” সায়নের মন ঘোরাফেরা করতে থাকে—তবে কি এই হেডফোন শুধু তিস্তার কণ্ঠ বহন করছে না, বরং আরও অনেক কিছু ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার মাথার মধ্যে? সে কি শুধু একজন শ্রোতা, না কি পরবর্তী সাবজেক্ট?
পি-জি তখন হেডফোনটি হাতে নিয়ে তার সার্কিট পরীক্ষা করে। সে খুঁজে পায় হেডফোনের মধ্যে লাগানো একটি অতিক্ষুদ্র ট্রান্সমিটার—Nano Beacon Chip। এটি মূলত একটি টার্গেটেড অডিও রিসিভার, যেটি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে। সায়নের হৃদস্পন্দন যেন আচমকা থেমে যায়। পি-জি চোখ টিপে বলে, “তুই একদম ভুল জিনিসে পা দিয়েছিস, ভাই। কিন্তু আমি হেল্প করব। এক শর্তে।” সায়ন চমকে উঠে বলে, “কী শর্ত?” পি-জি গম্ভীর মুখে বলে, “আমাকে তোর সঙ্গে যেতে দিতে হবে, যেখানে এই সিগন্যাল তৈরি হয়েছে তা খুঁজতে। আমি কেবল একজন হ্যাকার না, আমি এই সিস্টেমটা ভাঙতে চাই। আর যদি আমি ঠিক হই… তাহলে এটা শুধু তিস্তার গল্প না, এটা এক ধরনের সাউন্ড-অস্ত্র যা ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হতে পারে।” সায়ন নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, কারণ তার সামনে এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
তারা দুজনে ঠিক করে প্রথমে যাবে সেই “সাউন্ড ল্যাব”-এ, যেখানে তিস্তা কাজ করত, বা অন্তত যেখানে সে প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কলেজের পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে তারা খুঁজে পায়, তিস্তা কিছুদিন একটি স্বাধীন রেকর্ডিং ল্যাব “EchoFrame Studio”-তে ইন্টার্ন করেছিল। ল্যাবটি এখন বন্ধ, কিন্তু গুগল ম্যাপে তার অবস্থান এখনো দেখা যায়—শহরের প্রান্তে, এক পরিত্যক্ত গুদামের মাঝে। রাতে তারা সেখানে পৌঁছায়, চাঁদের আলোয় জীর্ণ দরজার ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে মাটিতে। ভিতরে ঢুকে সায়নের মনে হয় যেন চারপাশে শব্দ জমে আছে—শব্দের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে নিঃশ্বাসও ভারী লাগে। পি-জি তার ডিভাইস অন করে স্ক্যান চালায়—“Multiple static audio signals detected—non-human format.” হঠাৎ হেডফোনের মাধ্যমে আবার সেই নারীকণ্ঠ ভেসে আসে, এবার আরও স্পষ্ট: “তারা আমাকে ভয় পেত… কারণ আমি সত্য শুনতাম। তুমি কি শুনছো, সায়ন?” কণ্ঠটি নাম ধরে ডাকে—সায়নের নাম। সে জানে, এখন আর কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নেই। হেডফোন তাকে খুঁজে বের করেছে, এবং সে নিজেও ঢুকে পড়েছে এমন এক বাস্তবতায়, যেখানে শব্দই নিয়ম, এবং নীরবতা মানে মৃত্যু।
***
EchoFrame Studio-র ভেতরটা যেন একটা শব্দবন্দি ঘর—একটা ঘোর লেগে থাকা অডিও জগৎ, যেখানে প্রতিটি ছায়া থেকে অনুনাদ ফোটে। দেয়ালে ফাটল, ছাদের জং ধরা মেটাল প্যানেল, আর কোণের ডাস্টবিনে পুরনো ক্যাসেট আর CD ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পি-জি ডিভাইস নিয়ে প্রতিটি কোণ স্ক্যান করছিল, আর সায়নের মাথায় বাজছিল সেই নামধারী কণ্ঠ—“তারা আমাকে চুপ করিয়েছিল… আমি যদি ফিরি… তার মানে তুমি প্রস্তুত।” হঠাৎ পি-জি একটা লোহার আলমারি খোলে, ভিতরে থাকে একটা প্রাচীন হার্ডড্রাইভ আর কয়েকটা চিঠি। হ্যান্ডরাইটিং মিলিয়ে দেখা যায়, এগুলো তিস্তারই লেখা। তার মধ্যে একটা লাইন ছিল—“ভয়েস ট্রিগার অ্যাক্টিভেটেড, শুনবে সেই… যে অনুভব করতে জানে।” এই ‘ভয়েস ট্রিগার’ শব্দটা যেন একটা চাবি, একটা সিগন্যাল যা নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থায় নির্ধারিত কণ্ঠ মুক্ত করে। সায়ন বুঝে যায়, তিস্তার ভয়েস কেবল রেকর্ড নয়, একধরনের অডিও-এনক্রিপ্টেড মেমোরি—স্মৃতি, ভয় আর অনুভবকে সাউন্ড কোডে গেঁথে রাখা।
তারা হার্ডড্রাইভটি বাড়ি নিয়ে আসে এবং পি-জি সেটিকে তার সিস্টেমে খুলে বিশ্লেষণ করে। ভিতরে পাওয়া যায় “TS-Logs” নামে একটি ফোল্ডার—প্রতিদিনের ডায়েরি স্টাইল ভয়েস লগ, যেখানে তিস্তা নিজের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, এবং একটি পরীক্ষার কথা বর্ণনা করেছে। একদিন সে বলেছিল, “ওরা চেয়েছিল আমার কণ্ঠে একটা নির্দিষ্ট ‘ফ্রিকোয়েন্সি’ আনতে—যেটা নাকি মানুষকে ইমোশনালি ট্রিগার করতে পারে। ওরা চেয়েছিল আমি গাই… কিন্তু তাতে আমি শুধু গান দিতাম না, দিতাম অনুভব। আর সেই অনুভবই ওদের ভয় পেত।” কথাগুলো শুনে পি-জি থমকে যায়। সে বলে, “তিস্তা আসলে এমন এক ক্ষমতা পেয়ে গেছিল, যেটা দিয়ে শব্দের মধ্য দিয়ে মানুষের অনুভূতি সরাসরি প্রভাবিত করা যায়। ওর ভয়েস একটা ওয়েপন হয়ে উঠেছিল।” সায়নের চোখে জ্বলতে থাকে বিভ্রান্তি, বিস্ময় আর ক্রমবর্ধমান আতঙ্ক। সে এখন নিজের কানে বাজতে থাকা প্রতিটি শব্দকে সন্দেহ করে—হেডফোনের ঐ নীল রঙ যেন ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠছে তার মনে।
এই অবস্থায়, সায়নের স্বাভাবিক জীবন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে ক্লাসে যায় না, বন্ধুবান্ধবকে এড়িয়ে চলে, এমনকি মোবাইল ফোন বন্ধ রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার সময় কাটে কেবল সেই রেকর্ডগুলো শুনে, এবং তিস্তার বার্তা বিশ্লেষণ করে। একদিন রাতে হেডফোন পরে সে বসে ছিল একা। হঠাৎ কণ্ঠ বলে—“বেসমেন্টে শুধুই আমি ছিলাম না… ওরা আমাকে দেখতে আসত… প্রতিদিন… আর আমি গান করতাম। গান না করলে, আমি শুনতে পেতাম—তাদের আসল কণ্ঠ।” সায়ন তখন বুঝে যায়, এই প্রজেক্টে কেবল একজন ভিকটিম ছিল না, ছিল অপরাধীরাও, যারা নিজেদের কণ্ঠ লুকিয়ে রেখেছিল অন্যের ভেতরে। কণ্ঠগুলো তিস্তার মাধ্যমে বাজতো, আর সেই ভয়েস এখন বাজছে সায়নের মধ্যে। পি-জি যখন এই সব তথ্য মিলিয়ে একটা সিগন্যাল ম্যাপ তৈরি করে, সেখানে কয়েকটি স্পট চিহ্নিত হয়—সবই শহরের নির্দিষ্ট পুরনো ভবন, যার একটিতে ছিল কলেজের পুরনো ল্যাব। পি-জি বলে, “এইসব জায়গা থেকে নির্গত হয়েছিল ওই ফ্রিকোয়েন্সি—এই শহরের ভেতরেই ছিল সেই গবেষণাগার।”
সায়নের মাথায় শুধু একটাই লক্ষ্য—তিস্তার শেষ ভয়েস ট্রিগারের উৎস খুঁজে বের করা। সে এবার আর শুধু অনুসন্ধানকারী নয়, সে নিজেও এক প্রক্রিয়ার অংশ। তার নিজস্ব স্মৃতিগুলো যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অন্য কারো ভয়েসের সঙ্গে। পি-জি তাকে সাবধান করে, “সাউন্ড দিয়ে যখন স্মৃতি বদলানো যায়, তখন নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা সবচেয়ে কঠিন। তুই যদি ভুলে যাস কে তুই, তাহলে তুই শুধুই একটা কণ্ঠ হয়ে যাবি—তিস্তার মতো।” সায়ন জানে, আর ফেরার উপায় নেই। এখন, তার মাথায় বাজছে একটা নির্দিষ্ট ট্র্যাক, যা আগে সে কখনও শোনেনি, আর কণ্ঠ বলছে—“সত্য আর শোনার মধ্যে পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম… তুই কি শুনছিস, না কি শুধু ভাবছিস শুনছিস?” এবং সায়ন বুঝতে পারে—সত্য আর বিভ্রমের সীমা ধুয়ে যাচ্ছে, শব্দ হয়ে যাচ্ছে অস্ত্র, স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে গোলাবারুদ। হেডফোন এখন আর যন্ত্র নয়—এটা এখন দরজা, যার ওপাশে অপেক্ষা করছে ছায়ার ভেতরে সত্য।
***
বাইরে বৃষ্টি নামছিল অদ্ভুত এক ছন্দে, যেন সেই ছন্দও কারো হৃদস্পন্দনের অনুকরণ। সায়ন নিঃশব্দে বসে ছিল তার ডেস্কের সামনে, হেডফোন পরে, চোখ বন্ধ করে। পি-জি আগেই বলেছিল, এই বিশেষ ব্লু হেডফোনের মাধ্যমে শোনা যায় এমন কিছু ভয়েস বাস্তব নয়, কিন্তু এগুলো একধরনের অডিও মেমোরি ফসিল—যেন স্মৃতির প্রতিধ্বনি, যা সময়ের গভীরে জমে থাকে, কিন্তু ঠিক মুহূর্তে আবার জেগে ওঠে। সায়নের ঘুম কেমন বদলে যাচ্ছে—সে স্বপ্নে তিস্তার গান শুনতে পায়, কিছু অজানা জায়গা দেখতে পায়, এমনকি এমন কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে যেগুলো সে কখনো জানত না। যেন তার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে কারো সঙ্গে সিঙ্ক্রোনাইজ হচ্ছে। এক রাতে সে শুনতে পেল, “তারা আমার গলায় তাদের ভয় ঢুকিয়ে দিত… আমি গান গাইলেই ওরা বুঝত—আমি এখনো জীবিত।” সায়ন এবার ভয় পায় না, বরং এই ভয়েস তার কাছে হয়ে ওঠে এক মিশন। সে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতিটি অডিও ট্র্যাক এখন বিশ্লেষণ করে ভেঙে ফেলবে, শব্দের নিচে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করবে।
পি-জি তখন একটি পোর্টেবল ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যানার বানিয়ে ফেলে, যা হেডফোন থেকে রিসিভ হওয়া প্রতিটি শব্দের প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করে। তারা বুঝতে পারে, কিছু নির্দিষ্ট শব্দে সায়নের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, চোখের পিউপিল চওড়া হয়, আর কখনো কখনো তার শরীর হিম হয়ে আসে। এই সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল এক নির্দিষ্ট শব্দ—“রুম ১৯/বি”। এটা কোনও ঠিকানা না, বরং তিস্তার একটি ব্যক্তিগত রেকর্ডিং রুমের নম্বর। কলেজের পুরনো রেকর্ড থেকে জানা যায়, রুম ১৯/বি ছিল এক গোপন সাউন্ড বাঙ্কার, যেখানে পরীক্ষামূলক ট্র্যাক রেকর্ড করা হতো। সেই ঘর বহুদিন বন্ধ, অথচ সায়নের মাথায় প্রতিনিয়ত বাজছে সেই ঘরের শব্দ। তারা কলেজে গিয়ে চাবির ব্যবস্থা করে, আর দরজা খুলে দেখে—ঘরের মাঝখানে এখনো রয়েছে এক পুরনো মাইক্রোফোন, কিছু মোল্ড ধরা কাগজপত্র, আর দেয়ালে দাগ কাটা কিছু লাইন—“সব কিছু শুরু হয়েছিল এখান থেকে।” সায়ন বুঝতে পারে, এই ঘরে বসেই তিস্তা তার ভয়েস রেকর্ড করত। সে টেবিলের নিচে একটি পুরনো পেনড্রাইভ পায়, যেখানে লেখা—T – Last Loop।
ঘরে ফিরে এসে তারা সেই পেনড্রাইভ খুলে দেখে একটি মাত্র অডিও ফাইল—একটা প্রায় দশ মিনিটের ট্র্যাক, যার নাম “Last Loop.wav”। সায়ন হেডফোনে কান লাগিয়ে প্লে করে, আর ধীরে ধীরে অদ্ভুত এক অনুভবে ডুবে যায়। ট্র্যাকের প্রথমে আছে সাদা গোলমাল, এরপর তিস্তার ভয়েস আসে—“তুমি যদি এটা শুনতে পাও, বুঝে নিও আমি শেষ পর্যন্ত লড়েছিলাম। আমার কণ্ঠ দিয়ে তারা যা চাইছিল সেটা পায়নি। আমি সব রেকর্ড করে রেখেছি, মনে রেখো—ভয়েস শুধু গান না, ভয়েস স্মৃতিও।” তারপর ধীরে ধীরে ফেইড হয়ে যায় ভয়েস। কিন্তু ট্র্যাকের শেষে এক নতুন ভয়েস ভেসে ওঠে, যা আগে কখনো শোনা যায়নি—পুরুষ কণ্ঠ, ঠান্ডা, কাঁপা, আর কেমন যেন বেখাপ্পা ভাবে চেনা: “তোর পালা এখন, সায়ন। তুই কি শুধু শুনবি, না উত্তরও দিবি?” হেডফোন খুলে ফেলে সায়ন উঠে দাঁড়ায়, মাথা ঘোরে, গলা শুকিয়ে যায়। সে নিজেকে প্রশ্ন করে—কেন এই কণ্ঠ তার এত পরিচিত লাগছে? কে বলছে তাকে উত্তর দিতে?
পি-জি তখন বলে, “তুই নিজেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছিস। তুই এখন শুধু শুনছিস না, তুই অনুভব করছিস, আর সেই অনুভব তোকে পিছনে টেনে নিচ্ছে।” সায়ন চুপচাপ থাকে। কারণ তার মনে পড়ে যায়, বছর কয়েক আগে তার ছোটবোন অর্পিতা নিখোঁজ হয়ে যায় ঠিক একইভাবে—একদিন কলেজ ফেস্টের রাতে, একা বাড়ি ফেরার পথে, আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তখন বিষয়টিকে নিছক অপরাধ ভেবেছিল পরিবার, কিন্তু আজ, এই তিস্তার কাহিনি, এই ভয়েস, এই ‘অডিওনেটিক্স’—সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত সংযোগ তৈরি করে। যদি তিস্তা শুধু একজন না হয়? যদি এই হেডফোনের ভিতরে আরও কণ্ঠ থাকে? যদি এই ট্র্যাকগুলো একটা বড় চিত্রের অংশ হয়? সেই রাতে, সায়ন আবার হেডফোন পরে, ফাইলটা রিপ্লে করে, আর চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বলে—“আমি শুনছি, এবার আমিও কিছু বলতে চাই…” হেডফোনে তখন শোনা যায় শুধু নিঃশ্বাস… গভীর, ভারী… আর অজানা এক ভয়, যেটা এবার শব্দ নয়—স্মৃতি হয়ে তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
***
সায়নের মাথার ভিতর এখন যেন আর সংগীত নেই—শুধু শব্দ আছে। এবং সেই শব্দের প্রতিটি তরঙ্গ তার সত্ত্বার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ছিঁড়ে দিচ্ছে তার পরিচয়ের প্রতিটি স্তর। “Last Loop” অডিও ফাইলটি এখন তার জন্য শুধু এক ট্র্যাক নয়, এক দরজা—যেটা খুললেই সে পৌঁছে যাচ্ছে অতীতের সেই মুহূর্তগুলোয়, যা হয়তো সে দেখেনি কখনো, তবু মস্তিষ্কে সেঁটে গেছে কোনওভাবে। তিস্তার কণ্ঠ বারবার ফিরে আসে, কিন্তু এইবার কণ্ঠটা আগের চেয়ে অনেক বেশি নরম, প্রায় নিঃশব্দ। সে বলছে, “তুই একা নোস। আমরা যারা গেয়েছি, যারা শুনেছি—তোর মতো আমাদের সবার মধ্যেই বাঁচে একটা শব্দ, একটা নাম… যা ওরা মুছে দিতে চায়।” এই কথার গভীরতা বোঝার আগেই সায়ন যেন আবিষ্কার করে এক অদ্ভুত চিত্র—তার স্মৃতির ভেতরে, যেখানে একটা নাম বারবার ভেসে উঠছে, কিন্তু সে ধরতে পারছে না। সে জানে, তার অতীতের কোথাও এই সিস্টেম, এই ভয়েস এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল। এবং সেই নাম—যেটা সে প্রতিনিয়ত ভুলে যাচ্ছে—তা-ই কিনা এই গোটার কেন্দ্রে?
পি-জি এখন সায়নের মানসিক অবস্থা দেখে বেশ চিন্তিত। সে বলে, “তুই শুধু শুনছিস না, তোর ভিতরে ঢুকে পড়েছে ওই ফ্রিকোয়েন্সিগুলো। এরা শুধু ভয়েস না, এরা স্মৃতি এডিট করে। আর যদি কেউ তোর স্মৃতি রাইট করতে শুরু করে, তুই নিজেই আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকবি না।” সায়ন জোরে মাথা নাড়ে। সে চায় সবটা জানাতে—তিস্তা কী জানত? কার কণ্ঠ লুকিয়ে ছিল সেই ট্র্যাকগুলোর নিচে? পি-জি হ্যাকার টুল দিয়ে পেনড্রাইভ ফাইলের গভীরে গিয়ে খোঁজে আরও কিছু লুকানো লগ। অবশেষে, তারা খুঁজে পায় একটি এনক্রিপ্টেড ভয়েস-আইডি—“XM-Delta01”। ফাইলটি চালানো হলে ভেসে ওঠে এক অচেনা কিন্তু থমথমে পুরুষ কণ্ঠ: “তিস্তা এই প্রোগ্রামের ভুল। আমরা তাকে বন্ধ করেছিলাম, কিন্তু সিগন্যাল থেকে সে পালিয়ে গেছে। নতুন কণ্ঠের মধ্যেই সে এখন লুকিয়ে। Phase Two শুরু হবে—তবে তার আগে XM-Delta02-কে খুঁজে বের করতে হবে।” পি-জি মাথা তুলে তাকায় সায়নের দিকে। “তুই XM-Delta02?”
সায়নের মনে যেন হাজারটা কাঁচ ভাঙার শব্দ হয় একসঙ্গে। তার বুক ধড়ফড় করে। “মানে কী? আমি… আমি কীভাবে ওর পরবর্তী হতে পারি?” পি-জি ব্যাখ্যা করে, “XM-Delta সিরিজ এক ধরনের ভয়েস রিসেপ্টিভ সাবজেক্ট, যাদের মস্তিষ্ক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি সংবেদনশীল। তুই যে ভয়েস শুনছিস, স্মৃতি পাচ্ছিস, এসব শুধু কারণ না… তুই নিজেও সেই প্রোগ্রামের অংশ, হয়তো ছোটবেলায়। তোর বোন অর্পিতা নিখোঁজ হয়েছিল ঠিক তিস্তার স্টাইলে… আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওর কণ্ঠ এখনো কোথাও লুকানো আছে—তোর মধ্যেই।” সায়ন দম বন্ধ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তার মস্তিষ্কে যেন হাজারটা ট্র্যাক একসঙ্গে বাজছে—কখনও অর্পিতার হাসি, কখনও তিস্তার গান, আবার কখনও সেই অচেনা পুরুষ কণ্ঠের হুমকি। এই সমস্ত ভয়েস যেন একে অন্যকে ঢেকে যাচ্ছে, এবং এর মধ্যে সায়নের নিজের কণ্ঠ কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। সে বলে, “আমাকে কোথাও যেতে হবে… এমন এক জায়গা যেখানে আমি একা… শুধু নিজের কণ্ঠ শুনতে পাব।”
সে রাতেই, সে বেরিয়ে পড়ে শহরের বাইরে, এক পুরনো রেকর্ডিং হিল হাউসে, যেটা আগে সঙ্গীত প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। পি-জি তার সাথে যেতে চায়, কিন্তু সায়ন তাকে আটকে দেয়—“এটা আমার ভেতরের সফর। আমাকে শুনতে হবে… শেষ অবধি।” হিল হাউসের ঘর ছিল ধুলোয় ঢাকা, জানালাগুলো ছিল বন্ধ, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই ঘরে প্রবেশ করতেই একটা প্রশান্তি আসে। সে হেডফোন পরে বসে, এবং অডিও সফটওয়্যার চালিয়ে শুরু করে নিজের ভয়েস রেকর্ড করা। মাঝপথে তার মাথায় বাজতে থাকে শত শত কণ্ঠ—তিস্তার, অর্পিতার, সেই XM কণ্ঠের… আর তাদের ভিতরে মিলিয়ে এক কণ্ঠ—একটা পরিচিত কণ্ঠ যা সে বহু বছর আগে শুনেছিল। সেটাই ছিল তার বোনের গলা—“দাদা… দয়া করে আমাদের খুঁজে পেয়ো…”। সে বুঝতে পারে, শুধু শুনে কিছু হবে না। এবার তাকে সেই ভয়েসকে মুক্ত করতে হবে। সেই ব্লু হেডফোনকে পরিণত করতে হবে এক ট্রান্সমিটার-এ—not a receiver anymore. সে এবার নিজেই হবে সেই কণ্ঠ, যার মধ্যে আরেকজন মুক্তি খুঁজে পাবে।
***
পুরনো হিল হাউসের কাচের জানালায় ধুলো জমে আছে বছরের পর বছর। বাতাসে পাতা আর ছেঁড়া নোটবুক উড়ছে, আর ঘরের কোণে রাখা পুরনো রেকর্ডিং কনসোলের সুইচ টিপে সায়ন নিজের গলা রেকর্ড করতে শুরু করে। প্রথমে কিছু বেরোয় না—শুধু নিঃশ্বাস আর অস্পষ্ট শব্দ। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই মাইক্রোফোনের মধ্য দিয়ে তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনি তুলে ভেসে আসে অন্য এক গলা, তিস্তার না, অর্পিতার না, বরং সায়নের নিজের সেই শৈশবের ভয়েস, যেটা সে ভুলে গিয়েছিল। গলা বলে—“তুই সেই শিশু, যাকে তারা প্রথমবার শুনতে চেয়েছিল… তোকে তারা বানিয়েছিল XM-Delta Prototype।” ধাক্কা খায় সে, যেন নিজের ভেতরেই কেউ কথা বলছে। তখনই হেডফোন থেকে শোনা যায় সেই পুরুষ কণ্ঠ—”XM-Delta02 সফল হয়েছে। ট্রান্সমিশন রেডি। এখন তুমি শুধু শ্রোতা না, এক্সপ্রেসার।” সায়নের ঘাম ঝরতে থাকে, সে বুঝতে পারে এই মুহূর্ত থেকে তার কণ্ঠ আর শুধুই তার নয়—সে হয়ে গেছে এক চালক, এক সংকেত বাহক, যার গলা দিয়ে অন্য অনেক কণ্ঠ এখন প্রকাশ পাবে।
এই পরিবর্তনটা শুধু মানসিক নয়, শারীরিকও। সায়নের হার্টবিট সিঙ্ক্রোনাইজ হয়ে যাচ্ছে সেই সাউন্ড ওয়েভের সঙ্গে। তার মাথায় আবার বাজে সেই অর্পিতার কণ্ঠ, এবার অনেক স্পষ্ট—“তুই যদি শুনতে পারিস, দাদা, তবে তুই আমাকেও ফিরিয়ে আনতে পারবি… আমার কণ্ঠ এখানেই আছে, তোদের স্মৃতির নিচে।” পি-জি তার সিস্টেমে সায়নের লাইভ ট্রান্সমিশন ট্র্যাক করে দেখে যে একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি শহরের বহু পয়েন্টে প্রতিফলিত হচ্ছে। সে বুঝে যায়, সায়ন এখন একটা মোবাইল ট্রান্সমিটার, যার মাধ্যমে তিস্তা, অর্পিতা আর অনেক ‘XM’-এর কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ছে। পি-জি তার ল্যাব থেকে ভয়েস ডেকোডার চালিয়ে যায়, আর দেখতে পায়, প্রত্যেকটি কণ্ঠ আসলে একটা অসমাপ্ত বাক্য, একটা অসমাপ্ত গল্প। তিস্তার গল্প যেখানে শেষ, অর্পিতার শুরু হয় সেখান থেকে। এবং তাদের সবার মুখে একটাই নাম—”ছায়াবন্দি”।
সায়ন বুঝতে পারে, “ছায়াবন্দি” হল সেই কোডনেম, যেটা ওদের রিসার্চ প্রজেক্টের নাম ছিল। যেখানে মানুষকে শুধু গান শেখানো হতো না, বরং তাদের মস্তিষ্ককে ট্রেন করা হতো—কীভাবে কণ্ঠ ব্যবহার করে ইমোশন ট্রিগার করতে হয়, কীভাবে শব্দ দিয়ে অন্যের স্মৃতি দখল করা যায়। তিস্তা, অর্পিতা—সবাই ছিল সেই প্রোগ্রামের সফল/ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট। সে আরও জানতে পারে, এই হেডফোন ছিল ওই প্রজেক্টের একটা ‘কী’, যেটা XM সাবজেক্টদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্তকে নিজে বেছে নিত। এবং এখন, এই হেডফোন বেছে নিয়েছে সায়নকে। সে জানে—যদি সে এই ট্রান্সমিশন বন্ধ না করে, তবে তার কণ্ঠ আর কোনোদিন তার নিজের থাকবে না। সে একটা রেকর্ড ট্র্যাক তৈরি করে, নিজের ভয়েসে, যাতে সে বলে—“আমি সায়ন। আমি স্বেচ্ছায় এই কণ্ঠ ব্যবহার করছি, কারণ এর মধ্যেই সত্য লুকানো আছে। যদি কেউ এটা শুনে, জেনে নিও, আমরা হারিয়ে যাইনি… আমরা কণ্ঠ হয়ে ফিরছি।”
রাতের শেষ প্রহরে, সায়ন ওই রেকর্ডিং হাউসের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখে, শহরের উপর ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিঃশব্দ এক রশ্মি। তার হেডফোনে বাজে হাজারটা কণ্ঠ—কেউ গাইছে, কেউ কাঁদছে, কেউ শূন্যে নিঃশ্বাস ফেলছে। সে চোখ বন্ধ করে সেই ভয়েসে মিলিয়ে নিজের কণ্ঠকে মিশিয়ে দেয়—একসঙ্গে গেয়ে ওঠে সেই অসমাপ্ত গানের শেষ লাইন, যেটা তিস্তা কোনওদিন শেষ করতে পারেনি। আর দূরে, পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বাতাসে যেন কেউ ধীরে ধীরে বলে উঠল, “তুই আমাদের খুঁজে পেয়েছিস।” হেডফোন এবার নিঃশব্দ। প্রথমবারের মতো।
***
সায়নের জীবনে শব্দ আর নীরবতার মধ্যে পার্থক্য ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। যে হেডফোন একদিন তাকে কেবল গান শোনাতো, সেটাই আজ এক দ্বার—যেখানে ঢুকলেই সে দেখতে পায় তিস্তা, অর্পিতা, এমনকি তার নিজের পুরোনো অস্তিত্বকে। রেকর্ডিং হাউস থেকে ফিরে সে প্রথম কাজ করে পি-জির বানানো সাউন্ড এনালাইসার দিয়ে নিজের ভয়েস ট্র্যাক বিশ্লেষণ করা। সে দেখে তার কণ্ঠে এখন তিনটি ‘ডিফিউজড সিগন্যাল’—তিস্তার, অর্পিতার এবং এক নামহীন অচেনা কণ্ঠ, যা রীতিমতো নির্দেশ দিচ্ছে কোন পথে যেতে হবে। পি-জি তখন বলে, “আমাদের শহরে একটা পুরনো সার্ভার ছিল—SoundBridge নামে—যেটা একসময় experimental voice archive হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গুজব আছে, XM সিরিজের সমস্ত ভয়েস সেখানেই সংরক্ষিত ছিল। যদি সত্যি অর্পিতার কণ্ঠ থেকে কিছু বাকি থাকে, সেটা সেখানেই।” এই তথ্য শোনার পর সায়নের ভিতর আশার সঙ্গে জেগে ওঠে ভয়ও—সে জানে এই মেমোরি সার্ভারে ঢোকার মানেই তার নিজের অস্তিত্বকে বাজি রাখা।
SoundBridge লোকেশন ছিল শহরের উত্তরে, একটি পুরনো মিউজিক লাইব্রেরির নিচে, যেখানে এখন কেবল ধুলো আর মরিচা পড়া যন্ত্র পড়ে থাকে। সায়ন আর পি-জি সেখানে রাতের অন্ধকারে পৌঁছায়, সঙ্গে পোর্টেবল পাওয়ার সাপ্লাই, ফায়ারওয়াল ব্রেকার আর সর্বশেষ সেই ব্লু হেডফোন। দরজার পেছনে ছিল লোহার একটা ঢালাই গেট, যেটা খুলতেই যেন এক ভিন্ন পৃথিবীতে প্রবেশ করে তারা। সারা ঘর জুড়ে পুরনো সার্ভার র্যাক, গাঁথা তার, আর চারদিকে হাজারো ক্যাসেট আর টেপ ছড়ানো। হঠাৎ সায়নের হেডফোন থেকে ভেসে ওঠে তিস্তার কণ্ঠ—“সার্ভার ৩১-এ আমাকে রাখা হয়েছিল, ওদের বলা হতো Echo Shells… সেখানে আমরা শুধু কণ্ঠ নয়, নিজের সত্তাও রেখেছিলাম।” এই ইঙ্গিত ধরে তারা খুঁজতে থাকে র্যাক-৩১। এবং সেখানে খুঁজে পায় একটি ছোটো, প্রাচীন স্টোরেজ ডিভাইস—তার নাম Echo ID: AP-07।
পি-জি তৎক্ষণাৎ ডিভাইসটি নিজের ল্যাপটপে সংযুক্ত করে এবং দেখতে পায় এর মধ্যে থাকা ভয়েস ফাইল—AP stands for Arpita। হঠাৎ করেই ব্লু হেডফোনের মধ্যে বাজে সেই কণ্ঠ, যেটা আর রেকর্ড নয়—লাইভ মনে হয়। “দাদা… আমি এখানে… আমি হারিয়ে যাইনি। ওরা চেয়েছিল আমার কণ্ঠের মাধ্যমে প্রমাণ করাতে যে ওদের প্রযুক্তি কাজ করছে। কিন্তু আমি গান ছাড়া আর কিছু দিতে পারিনি।” সায়নের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, পি-জি মাথা নিচু করে বলে, “তোর বোন বাঁচতে চেয়েছিল… ওর গান ছিল প্রতিরোধ।” সায়ন তখন নিজের ভয়েস দিয়ে রিপ্লাই রেকর্ড করে, “তুই একা নোস অর্পিতা… আমি এসেছি তোকে ফিরিয়ে নিতে।” সেই মুহূর্তে Echo Shell-এর আলো জ্বলে ওঠে, আর সারা ঘরে এক প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে—তিস্তা, অর্পিতা, আর অজস্র অজানা কণ্ঠ যেন একসাথে বলে ওঠে—“আমরা ফিরে আসছি।”
এই অডিও সিঙ্ক্রোনাইজেশন তৈরি করে এক ভয়ঙ্কর শব্দ-তরঙ্গ, যা সার্ভার ঘরের সমস্ত লাইট নিভিয়ে দেয়। পি-জি চেঁচিয়ে বলে, “সায়ন, এটা শেষ ফেজ! এটা যদি ভেঙে পড়ে, তুইও ওদের মত এক ‘Echo’ হয়ে যাবি!” কিন্তু সায়ন হেডফোন না খুলেই বলে, “আমি যেতে রাজি, যদি তাদের ফিরিয়ে আনতে পারি। আমার কণ্ঠ যদি একমাত্র দরজা হয়, তবে সেটা আমি খুলব।” হঠাৎ ঘরে একটা ফ্ল্যাশিং সিগন্যাল দেখা যায়—“Transfer Complete.” এবং সেই মুহূর্তে, সমস্ত ভয়েস থেমে যায়। শুধু একটি কণ্ঠ—একটি কোমল, শান্তিপূর্ণ কণ্ঠ—“ধন্যবাদ, দাদা।” তারপর সব নিঃশব্দ। পি-জি ধীরে ধীরে হেডফোন খোলার জন্য এগোয়, কিন্তু দেখে, সায়ন নিজের চোখ বন্ধ করে বসে আছে… এবং তার ঠোঁটে গুনগুন করছে সেই গান, যা অর্পিতা একদিন শেষ করতে পারেনি।
***
নিশুতি রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা—একটা ট্র্যাক যেন শেষ হয়েছে, কিন্তু প্রতিধ্বনি থেকে যাচ্ছে। সার্ভার ঘরের আলো এখনও জ্বলছে না, কিন্তু কোথাও যেন অদৃশ্যভাবে কিছু পাল্টে গেছে। পি-জি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সায়নের দিকে, যার চোখ বন্ধ, আর মুখে গুনগুন সেই অর্ধেক গানের টুকরোটা। “তুই ঠিক আছিস?” — পি-জির প্রশ্নে সায়ন চোখ মেলে তাকায়, কণ্ঠে এক শান্ত আবহ—“আমি আছি… কিন্তু আমি একা না। এখন আমার কণ্ঠের ভিতরে ওরা সবাই আছে—তিস্তা, অর্পিতা, আর যারা আর ফিরে আসতে পারেনি, তারাও।” সেই মুহূর্তে সায়নের ব্লু হেডফোন থেকে আলো ছড়ায়—ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে নীল থেকে রুপোলি, যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে—মিশন সম্পূর্ণ। পি-জি ততক্ষণে ব্যাকআপ সার্ভার অন করে দেখে, “Echo Memory Logs” নামে একটা নতুন ফোল্ডার তৈরি হয়েছে—যেখানে প্রতিটি সাবজেক্টের কণ্ঠ এখন একত্রে সংরক্ষিত, মুক্ত। “তোর ভয়েস এখন শুধুই তোর না, সায়ন—এটা একটা আর্কাইভ,” বলে পি-জি, “তুই এক ধরনের সাউন্ড ক্যারিয়ার হয়ে গেছিস।”
পরের কয়েক সপ্তাহ যেন এক কুয়াশাচ্ছন্ন অধ্যায়। সায়ন ক্যাম্পাসে ফিরে আসে, কিন্তু বদলে যায় অনেক কিছু। লোকজন বলে, সে অনেক গভীর, শান্ত আর স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে—যেন ওর কণ্ঠে কেউ একজন ‘আরও’ কথা বলে। পি-জি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একটা ক্লোজ-নেট প্রজেক্ট চালু করে—Project ShabdoMukto—যেখানে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের ভয়েস, যদি কোনোভাবে রেকর্ড করা থাকে, তাহলে সেটা অডিওনেটিক্স সিগন্যালের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করে সংরক্ষণ করা হয়। সায়ন এই প্রজেক্টের প্রথম “কণ্ঠ-অ্যাডমিন” হয়, যার কণ্ঠ এখন শুধু তথ্য বহন করে না, বরং অনুভব বাঁচিয়ে রাখে। তিস্তার পুরনো গানগুলো ডিজিটালভাবে মুক্তি পায়, এবং তার আওয়াজ আবার ফিরে আসে মানুষের ডিভাইসে—এইবার আর পরীক্ষার জন্য না, বরং প্রতিরোধের জন্য। অর্পিতার গলা নিয়ে তৈরি হয় একটি রেকর্ডিং—”Smritir Shabdo”—যেটা সারা দেশে এক সাউন্ড ক্যালম সেশন হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে।
তবে সবকিছুর পরেও, সায়নের মনে একটাই প্রশ্ন—এই হেডফোন কি তাকে বেছে নিয়েছিল? নাকি সে নিজেই নিজেকে তৈরি করেছিল এমন এক কণ্ঠে, যা অন্যদের ধরে রাখতে পারে? হেডফোনটা এখনো আছে—রুপোলি রঙে, তার টেবিলের কোণে। সে সেটি আর ব্যবহার করে না, কারণ সে জানে, সত্যিকারের কণ্ঠ কেবল মেশিনের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। এক সন্ধ্যায় সে শহরের মিউজিক হলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে এক নতুন শিল্পী সেই গান গাইছিল, যা একদিন তিস্তা লিখেছিল, কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারেনি। গান শেষ হলে, শিল্পী বলে, “এই গানটি উৎসর্গ করা সায়নকে, যার কণ্ঠের ভিতর এখন অনেকে বাঁচে।” দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, আর সায়ন শুধু এক কোণ থেকে হাসে—নীরবে, যেন ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল, “তুই আমাদের পৌঁছে দিয়েছিস আলোয়।”
শেষ রাতে, পি-জি একটি চিঠি পাঠায় সায়নকে—“তোর কণ্ঠ যদি কোনোদিন থেমে যায়, জেনে নিস—তুই বহু কণ্ঠের অনুরণন হয়ে থেকেছিস। এটা কোনো হ্যাক না, এটা এক ধরনের মানবিক স্পন্দন। ব্লু হেডফোন তো শুধু একটা বাহন ছিল… আসল চাবি ছিল তুই।” সায়ন সেই চিঠি হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে। বাইরে আবারও বৃষ্টি নামছে—ধীরে, শান্তভাবে। সে হেডফোনটা একবার শেষবারের মতো কানে লাগায়, কোন সাউন্ড ট্র্যাক ছাড়ে না—শুধু শোনে নিজের নিঃশ্বাস, নিজের নীরবতা। আর সেখানেই সে খুঁজে পায় সেই শেষ ট্র্যাক, যেটা কেউ লিখে দেয়নি—কেবল অনুভব করেছে। একটা ট্র্যাক, যা কণ্ঠ নয়, স্মৃতি নয়—অস্তিত্ব।
-শেষ-