Bangla - তন্ত্র

বেড়াজালের যজ্ঞ

Spread the love

রাহুল রায়


অধ্যায় ১:

শহরের ব্যস্ততম ব্যবসায়িক মহল যে মানুষটির ছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত ছিল, তিনি হলেন শশাঙ্ক বসু। সত্তরের কোঠায় পৌঁছেও তাঁর প্রভাবশালী উপস্থিতি এবং ব্যবসায়িক দক্ষতা সবাইকে মুগ্ধ করত। তিনি ছিলেন রিয়েল এস্টেট, জুয়েলারি থেকে শুরু করে বিদেশি আমদানি-রপ্তানির মতো নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এক ধনকুবের। তাঁর অফিসগুলো শহরের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কোণে ছড়িয়ে ছিল, আর তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাজারের গতিপথ বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। কিন্তু ব্যবসায়িক সাফল্যের বাইরেও মানুষটি সম্পর্কে শহরের সাধারণ মানুষ ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা খুব বেশি কিছু জানত না। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল এক রহস্য, এমনকি তাঁর পরিবারও তাঁকে কখনও সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেনি। শশাঙ্ক বসু কখনও মদ, নারীর প্রতি আকর্ষণ বা বিলাসিতার প্রদর্শন নিয়ে আলোচনায় আসেননি। বরং তিনি সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন, যেন বাইরের জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধুই প্রয়োজনীয় লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবুও তাঁর মৃত্যুসংবাদ যেন শহরের প্রতিটি স্তরে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ল, কারণ এ ছিল এক দিক থেকে ক্ষমতার শূন্যতার শুরু, আবার অন্যদিকে এক অদৃশ্য ভয়ের আবির্ভাব।

শশাঙ্ক বসুর মৃত্যুর ঘটনা ছিল আকস্মিক, যদিও তিনি কয়েক মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসকরা বলেছিলেন তাঁর হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে গেছে, বিশ্রাম নিতে হবে, কিন্তু তিনি কখনোই ব্যবসার গতি থামাতে চাননি। মৃত্যুর আগের রাতে প্রাসাদের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে তিনি শুয়ে ছিলেন, চারপাশে সন্তানরা, স্ত্রী, আর কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাঁকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল, চিকিৎসক বারবার তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখ যেন দূরে কোথাও তাকিয়ে ছিল, যেন তিনি অন্য জগতের সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছেন। ঠিক শেষ মুহূর্তে তিনি কেঁপে ওঠা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠলেন—“যজ্ঞ এখনো অসম্পূর্ণ…”। বাক্যটি উচ্চারণ করে তিনি চিরদিনের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। পরিবার প্রথমে এই কথা কোনো গুরুত্ব দিতে চায়নি; তারা ভেবেছিল মৃত্যুর আগে তিনি অজ্ঞানতার ঘোরে কিছু অসংলগ্ন কথা বলছেন। কিন্তু সেই তিনটি শব্দ—“যজ্ঞ”, “অসম্পূর্ণ”—অদ্ভুত এক ঠান্ডা শিহরণ তৈরি করে দিল প্রত্যেকের মনে।

শবদাহের পর পরিবারের সদস্যরা যখন প্রাসাদে ফিরে আসে, তখনই প্রথম সেই অস্বাভাবিকতার মুখোমুখি হতে হয়। প্রাসাদটি ছিল অতি প্রাচীন, শশাঙ্ক বসুর পূর্বপুরুষদের তৈরি বিশাল অট্টালিকা। এর ভেতরে একাধিক ঘর, করিডর, সিঁড়ি, গোপন কুঠুরি আর ভূগর্ভস্থ পথ লুকিয়ে ছিল। ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য তিনি এই প্রাসাদে বিলাসিতার কোনো অভাব রাখেননি, কিন্তু সব কক্ষই সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। পরিবারের কারও কোনোদিন অনুমতি ছিল না পশ্চিম দিকের পুরোনো একটি ডানায় প্রবেশ করার। মৃত্যুর পর শশাঙ্কের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়ক কয়েকজন সেই দরজা খুলতেই দেখা গেল ধুলোয় ভরা অন্ধকার কক্ষ, আর মাঝখানে এক বিশাল যজ্ঞকুণ্ড। কুণ্ডটি পাথরের বৃত্তাকার নির্মাণ, চারপাশে অদ্ভুত চিহ্ন, তন্ত্রমন্ত্রের প্রতীক আঁকা। সেখানে অর্ধেক পোড়া কাঠ, ছাই আর কিছু কালো রঙের শুকনো রক্তের মতো দাগ চোখে পড়ল। পরিবারের সদস্যরা হতভম্ব হয়ে গেল। যে মানুষটিকে তারা এতদিন কেবল ব্যবসায়ী ভেবেছিল, তাঁর জীবন যে গোপনে তন্ত্রসাধনার সঙ্গে এত গভীরভাবে যুক্ত ছিল, তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। যজ্ঞকুণ্ডটির চারপাশে কয়েকটি পুরোনো খাতা ও কিছু পিতলের সামগ্রীও পড়ে ছিল, যেগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এগুলো কোনো গুপ্ত আচার সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

পরিবারে ভয়ের আবহ নেমে এল। কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না যে ধনকুবের শশাঙ্ক বসু আসলে ছিলেন এক গূঢ় তান্ত্রিক সাধক, কিন্তু যজ্ঞকুণ্ডের উপস্থিতি সেই সন্দেহকে সত্য করে তুলল। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো, প্রাসাদের পরিচারক মঞ্জরী জানালেন মৃত্যুর আগের কিছু সপ্তাহ ধরে শশাঙ্ক বসু প্রায় প্রতিরাতে ওই কক্ষে একা বসে থাকতেন, কখনও মন্ত্রোচ্চারণ করতেন, কখনও আগুন জ্বালাতেন। অথচ বাইরে পরিবারের কাছে বা ব্যবসায়িক দুনিয়ায় তিনি ছিলেন স্বাভাবিক, সুস্থ মানুষ। মৃত্যুর পর তাঁর শেষ উচ্চারণ—“যজ্ঞ এখনো অসম্পূর্ণ”—এবার ভিন্ন মাত্রা পেল। সবাই ভাবতে শুরু করল, যদি যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থাকে, তবে তার পরিণতি কী হতে পারে? উত্তর মেলেনি, কিন্তু প্রাসাদের সেই যজ্ঞকুণ্ড হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। ঠিক শবদাহের রাতেই দেখা গেল কুণ্ডের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধোঁয়া আর অল্প অগ্নিশিখা বেরিয়ে আসছে, যদিও সেখানে আগুন দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, আর শশাঙ্ক বসুর সেই শেষ কথা যেন দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল—“যজ্ঞ এখনো অসম্পূর্ণ…”।

অধ্যায় ২:

শবদাহের রাত—প্রাসাদজুড়ে এক অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এসেছিল। সেদিন সারা শহরের অর্ধেক প্রভাবশালী মানুষ শশাঙ্ক বসুর শেষকৃত্যে হাজির হয়েছিল, আর শোকযাত্রার পর পরিবার ভাঙা মন নিয়ে ফিরে এসেছিল নিজের অট্টালিকায়। কিন্তু বাড়ির প্রতিটি দেয়াল যেন গুমোট হয়ে উঠেছিল, যেন শতাব্দীর পুরোনো প্রাসাদ নিজেই বুঝতে পারছে তার মালিক চলে গেছে। রাত নেমে এলে বিদ্যুৎবাতিগুলোও যেন অকারণে মিটমিট করতে শুরু করল। চারপাশে শোকার্ত পরিবেশে কেউ কথা বলছিল না, কেবল শোক আর ক্লান্তি সবাইকে স্তব্ধ করে রেখেছিল। ঠিক তখনই, গভীর অন্ধকারে আচমকা পশ্চিম ডানার সেই রহস্যময় কক্ষ থেকে এক অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল। যজ্ঞকুণ্ড, যা দিনের বেলা ঠাণ্ডা ছাইয়ে ঢাকা ছিল, তা হঠাৎ করে আগুনে ভরে উঠল। প্রথমে মৃদু শিখা, পরে তীব্র লেলিহান জ্বলন্ত আগুন—যেন অদৃশ্য কেউ কাঠ জ্বালিয়ে দিয়েছে। পরিবারের সবাই ছুটে এলো কক্ষটির সামনে। দরজার ভেতর দিয়ে দেখা গেল অগ্নিকুণ্ড যেন নিজের অদৃশ্য শক্তিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আগুনের শিখা ছাদ ছুঁতে চাইছে, চারপাশে গরম বাতাসের ঝাপটা আসছে, অথচ কক্ষে কোনো কাঠ, কোনো তেল বা দাহ্য বস্তু রাখা ছিল না।

আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল প্রত্যেকের মনে। নীলিমা বুক চাপড়াতে লাগল—“এটা কি অভিশাপ?”। ইন্দ্রাণী কাঁপা গলায় বলল—“বাবা যজ্ঞ অসম্পূর্ণ রেখে গেছেন… এ কি তারই প্রতিফলন?”। পরিচারিকারা চিৎকার করে বাইরে দৌড়ে গেল, তারা প্রাসাদের পুরোনো বিশ্বাস অনুযায়ী বলছিল, “পুরোনো শক্তি জেগে উঠেছে।” অমৃত, যিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, শিক্ষিত ও যুক্তিবাদী, তিনি সবাইকে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন। তাঁর মতে এটা কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নয়, বরং হয়তো প্রাসাদের পুরোনো কাঠামোতে জমে থাকা কোনো রাসায়নিক পদার্থে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, কিংবা গ্যাস লিক হয়ে আগুন জ্বলছে। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“এইসব বাজে কুসংস্কারে কান দিও না। এ নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আছে।” কিন্তু পরিবারের অন্যরা, বিশেষত ইন্দ্রাণী ও নীলিমা, কোনো যুক্তিতেই আশ্বস্ত হতে পারল না। শশাঙ্ক বসুর শেষ কথাগুলো বারবার তাদের কানে বাজছিল—“যজ্ঞ এখনো অসম্পূর্ণ।” তাদের মনে হচ্ছিল আগুনের এই আচমকা উত্থান আসলে সেই অসম্পূর্ণ যজ্ঞের ডাক, কোনো অদৃশ্য শক্তির দাবি।

এই সময় সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল অর্পণের সঙ্গে। অর্পণ, অমৃতের ছেলে, তখন বয়সে কেবল বাইশ। সে স্বভাবতই সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ এবং দাদুর প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত ছিল। যখন সবাই আতঙ্কে চেঁচামেচি করছে, তখন অর্পণ নীরবে যজ্ঞকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে পড়ল আগুনের শিখার ভেতর এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি। প্রথমে সে ভেবেছিল আলোর খেলা, কিন্তু ক্রমে সেই ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল—শশাঙ্ক বসুর মুখ। আগুনের ভেতরে যেন তার দাদু তাকে ডাকছেন, তাঁর ঠোঁট নড়ছে, অথচ কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অর্পণের বুক কেঁপে উঠল, সে এক অদ্ভুত টান অনুভব করল, যেন আগুন তাকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। সে চিৎকার করে উঠল—“দাদু! আমি তোমাকে দেখছি!”। বাকিরা হতভম্ব হয়ে তাকাল, কিন্তু তাদের চোখে কেবল আগুন ছাড়া আর কিছু ধরা পড়ল না। অমৃত ছেলের কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল—“এটা তোমার ভ্রম! আগুনের ভেতর কোনো মুখ নেই।” কিন্তু অর্পণের চোখে জল এসে গেল, সে কাঁপা গলায় বলল—“না বাবা, আমি স্পষ্ট দেখেছি… দাদু আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।”

পরিবারের বাকি সদস্যরা আরও ভীত হয়ে পড়ল। নীলিমা কান্নাকাটি করে বলল—“দেখো না, শশাঙ্কদা মৃত্যুর পরও শান্তি পায়নি। তাঁর যজ্ঞ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তাই তিনি ছেলেকে ডেকে আনছেন।” ইন্দ্রাণী চুপচাপ মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে দিল, হয়তো নিজের অজান্তেই বাবার তন্ত্রপথের ছোঁয়া তার মধ্যে কাজ করছিল। প্রাসাদজুড়ে ভয়ের আবহ জমাট বাঁধল। অমৃত চেষ্টা করল যুক্তি দিয়ে বোঝাতে—“এটা কোনো প্রতিফলন, হয়তো আলো আর ছায়ার খেলা। মন যেমন চায় তেমনই রূপ দেখতে পাচ্ছ।” কিন্তু তাঁর নিজের ভেতরেও কোথাও একটা অস্বস্তি জেগে উঠেছিল। কীভাবে হঠাৎ করে ছাইভরা যজ্ঞকুণ্ড আগুনে ভরে উঠল? কীভাবে আগুন টানা কয়েক মিনিট ধরে জ্বলতে থাকল অথচ কোনো দাহ্য পদার্থ ছাড়াই? বিজ্ঞানীসুলভ ব্যাখ্যা দিলেও তাঁর চোখে চোখে যেন ভয় খেলে গেল। আর অন্যদিকে, অর্পণের মধ্যে দাদুর ছায়া দেখা পাওয়ার পর থেকে এক অদ্ভুত পরিবর্তনের সূচনা হলো। পরিবারের সবাই ভয়ে সেদিন রাতে কেউ ঘুমোতে পারল না, কেবল যজ্ঞকুণ্ডের আগুন দপদপ করে জ্বলতে থাকল, আর প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল যেন প্রতিধ্বনিত করে তুলল শশাঙ্ক বসুর শেষ বাক্য—“যজ্ঞ এখনো অসম্পূর্ণ…”।

অধ্যায় ৩:

শশাঙ্ক বসুর মৃত্যুর কয়েকদিন পর, প্রাসাদের ভেতরের পরিবেশ যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। দিনরাত যজ্ঞকুণ্ডে অকারণে অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠা আর নিভে যাওয়া এখন আর নতুন কিছু নয়। পরিবারের লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ এটিকে নিছক ভ্রম বলে উড়িয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু গভীর রাতে যখন আগুনের আলো পুরো প্রাসাদজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আর দূর থেকে কণ্ঠস্বরের মতো অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, তখন আর কাউকেই স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক সেই সময়েই শহরের প্রাচীন তান্ত্রিক কাশীনাথ শর্মা প্রাসাদে এসে হাজির হলেন। তিনি ছিলেন বয়সে প্রৌঢ়, শরীরে দুর্বলতা থাকলেও চোখদুটি অস্বাভাবিকভাবে দীপ্ত। তাঁর পরনে ছিল গেরুয়া কাপড়, হাতে একটি ত্রিশূল আকৃতির দণ্ড, আর কপালে ভস্মের রেখা। তিনি প্রবেশ করতেই যেন প্রাসাদের প্রতিটি কোণ কেঁপে উঠল। পরিবারের সবাই অবাক হয়ে তাকাল, কারণ শশাঙ্ক বসুর সঙ্গে কাশীনাথের সম্পর্ক সম্পর্কে তারা কোনোদিন কিছু জানত না। কিন্তু বৃদ্ধের দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারিত প্রথম কথাগুলো সবাইকে স্তব্ধ করে দিল—“শশাঙ্ক বসুর যজ্ঞ অসম্পূর্ণ। আর সেই অসম্পূর্ণতা এখন এই প্রাসাদের প্রতিটি দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে।”

কাশীনাথ শর্মা ধীরে ধীরে যজ্ঞকুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। আগুন তখনও নিভে নেই, শিখা মৃদু হলেও টিকে আছে। কুণ্ডের চারপাশে পাথরে খোদাই করা প্রতীকগুলো দেখে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন—“এই প্রতীক, এই কুণ্ড—সবই প্রাচীন তান্ত্রিক আচার। শশাঙ্ক বসু বহু বছর ধরে এক বিরল যজ্ঞ সম্পাদন করছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর কারণে সেটি অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। আর অসম্পূর্ণ যজ্ঞ মানেই অশান্ত শক্তির বিস্তার।” পরিবারের কেউ কিছু বলার আগেই তিনি চুপচাপ মন্ত্রোচ্চারণ করে ছাই স্পর্শ করলেন, আর মুহূর্তেই যেন বাতাস আরও শীতল হয়ে উঠল। ইন্দ্রাণী কেঁপে উঠে বলল—“আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?” কাশীনাথ উত্তর দিলেন—“অসম্পূর্ণ যজ্ঞের শক্তি এখন এই প্রাসাদের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি এটিকে নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তবে ধীরে ধীরে এর প্রভাব চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। কেবল আপনাদের পরিবার নয়, সমগ্র শহর অশান্তিতে ভরে উঠবে। মৃত্যু, রোগ, দুর্ঘটনা—সবই এই শক্তির প্রতিফলন হবে।” তাঁর চোখের চাহনিতে এমন এক ভয়ানক সতর্কতা লুকিয়ে ছিল যে, উপস্থিত সবাই নিঃশব্দে গিলে নিলেন তাঁর কথা।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর কাশীনাথ বললেন—“যজ্ঞকে সম্পূর্ণ করতে হবে। শশাঙ্ক বসু যে আচার শুরু করেছিলেন, সেটি শেষ না হলে এই শক্তি থামানো যাবে না। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, প্রস্তুতি নিন। আমি সাহায্য করব।” কিন্তু এই প্রস্তাব শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের মধ্যে বিভাজন শুরু হয়ে গেল। অমৃত, যিনি সবসময় যুক্তিবাদে বিশ্বাস করতেন, রাগে ফেটে পড়লেন—“আপনি কী বলছেন? আমাদের পরিবারকে আবার এই অদ্ভুত তন্ত্রের ফাঁদে টানবেন? বাবা হয়তো নিজের কুসংস্কারে এইসব কাজ করেছেন, কিন্তু আমরা কেন তার দায় নেব?” তিনি সোজাসুজি কাশীনাথকে অস্বীকার করে বললেন, “আমার কাছে বিজ্ঞানই সত্যি। আগুন কেন জ্বলে উঠছে তারও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। এসব যজ্ঞ-মন্ত্র কেবল অন্ধবিশ্বাস।” অমৃতের কণ্ঠে দৃঢ়তা থাকলেও তাঁর চোখে অস্বস্তির ছায়া ফুটে উঠছিল, কারণ অন্তরের গভীরে সেও জানত, বিজ্ঞানের সব যুক্তি দিয়ে হয়তো এই আগুনকে বোঝানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে, ইন্দ্রাণী মায়ের মতো কাঁপা গলায় বলল—“কিন্তু অমৃত, বাবার শেষ কথা কি ভুলতে পারো? তিনি নিজেই বলেছিলেন যজ্ঞ অসম্পূর্ণ… আমি মনে করি কাশীনাথ পণ্ডিত সত্য বলছেন।”

সবচেয়ে অদ্ভুতভাবে আকৃষ্ট হলো অর্পণ। দাদুর মৃত্যুর পর থেকেই সে যেন এক অজানা টানে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর আগুনের শিখায় দাদুর মুখ দেখার অভিজ্ঞতা তার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে। সে ফিসফিস করে বলল—“আমি জানি দাদু আমাকে ডাকছেন। এই যজ্ঞ শেষ করতে হবে। না হলে তিনি শান্তি পাবেন না।” তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের উন্মাদনা ঝরে পড়ল। নীলিমা ভয়ে কেঁপে উঠল, সে আবার বলল—“কিন্তু যদি যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে বলি দিতে হয়?” প্রশ্নটি বাতাসে ঝুলে রইল। কাশীনাথের চোখ হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, কিন্তু তিনি সরাসরি উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন—“প্রত্যেক আচারেই ত্যাগ থাকে। তবে সেই ত্যাগই শক্তিকে শান্ত করে।” এই অস্পষ্ট উত্তর পরিবারকে আরও আতঙ্কিত করল। অমৃত গর্জে উঠল—“কোনোভাবেই আমি আমার পরিবারকে এইসব বিপজ্জনক আচার-অনুষ্ঠানে টানতে দেব না।” কিন্তু ইন্দ্রাণী ও অর্পণ দৃঢ়ভাবে কাশীনাথের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তারা ইতিমধ্যেই তাঁর কথায় আস্থা স্থাপন করেছে। প্রাসাদের ভেতরে তখন বাতাস ভারী হয়ে উঠল—একদিকে যুক্তি আর বিজ্ঞানের কণ্ঠ, অন্যদিকে রহস্যময় তন্ত্রশক্তির আহ্বান। আর সেই বিভাজনের রেখা অদৃশ্যভাবে পরিবারের ভেতরেই জন্ম নিতে শুরু করল।

অধ্যায় ৪:

গভীর রাত, চারপাশ নিস্তব্ধ। প্রাসাদের পুরোনো দালানকোঠা কেবল হাওয়ার শব্দে কেঁপে উঠছিল। সবার অজান্তে অর্পণ চুপচাপ উঠে যেত যজ্ঞকুণ্ডের ঘরে। আগুন যেন তাকে ডাকত, অদৃশ্য এক টানে টেনে নিত শূন্যতার ভেতরে। প্রথমে সে কেবল আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত—ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে সে শুনতে শুরু করল অদ্ভুত ফিসফিসানি। কারও অচেনা গলার মতো শোনালেও, কখনো কখনো সেই শব্দ স্পষ্ট হয়ে দাদুর কণ্ঠস্বরের রূপ নিত। “অর্পণ… আমি আছি… আমাকে শেষ করো… অসম্পূর্ণ রেখো না।” সেই ডাক শুনলেই অর্পণের সারা শরীর কেঁপে উঠত। তার মনে হতো, আগুনের শিখার ভেতর দিয়ে দাদু হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, আর সে এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞায় বাঁধা পড়ছে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে শুরু করত আগুনের প্রতিফলনে, আর ঠোঁটে অজান্তেই ফিসফিস করে মন্ত্র উচ্চারণ করত, যেগুলো সে জীবনে আগে কখনো জানত না। যেন শশাঙ্ক বসুর অপূর্ণ সাধনা উত্তরাধিকার সূত্রে তার রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে।

দিনের বেলা অর্পণকে স্বাভাবিক মনে হলেও, নীলিমা বুঝতে পারছিল যে তার ছেলের ভেতরে কিছু একটা বদলাচ্ছে। মা হিসেবে সে প্রথম লক্ষ্য করল অর্পণের চাহনির অদ্ভুত শূন্যতা। আগে যেখানে ছেলেটি হাসিখুশি আর কল্পনাপ্রবণ ছিল, এখন সেখানে নীরবতা আর অস্থিরতা জায়গা করে নিয়েছে। মাঝেমধ্যেই অর্পণ গভীর মনোযোগে তাকিয়ে থাকত কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুর দিকে, যেন কারও সঙ্গে নীরবে কথা বলছে। খাবার টেবিলে বসলে হঠাৎ চমকে উঠত, আবার রাতের অন্ধকারে ঘুমের ভেতর মন্ত্রোচ্চারণ করত। নীলিমা একদিন ভয়ে তাকে জাগিয়ে তুললে অর্পণ লালচে চোখে তাকিয়ে বলেছিল—“মা, তুমি বুঝতে পারছ না, দাদু আমাকে ডাকছে। আমি ছাড়া আর কেউ এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে পারবে না।” নীলিমা আঁতকে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল, যজ্ঞের আগুন কেবল কুণ্ডেই সীমাবদ্ধ নেই, সেটি ধীরে ধীরে ছেলের মস্তিষ্ক ও আত্মায় প্রবেশ করছে।

অন্যদিকে, অমৃত এখনও সবকিছু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় মেলাতে চাইছিল। সে নীলিমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে এগুলো কেবল মানসিক ভ্রম, শোক আর কল্পনার খেলা। কিন্তু মা হিসেবে নীলিমার চোখ এড়িয়ে কিছু যাচ্ছিল না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, অর্পণ কেবল মানসিক বিভ্রান্তির শিকার নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির আসক্তিতে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন রাতে ঘুম ভাঙলে সে ছেলের বিছানা খালি দেখতে পেত, আর যজ্ঞকুণ্ডের ঘর থেকে মৃদু আওয়াজ ভেসে আসত। সে একদিন সাহস করে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেছিল। অর্পণ তখন মাটিতে বসে আছে, চোখ বন্ধ, দুই হাত জোড় করে মন্ত্র পড়ছে, আর আগুনের শিখা যেন তার শ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে। সেই দৃশ্য নীলিমার শরীর শীতল করে দিয়েছিল। সে চাইছিল চিৎকার করে ছেলেকে টেনে বের করতে, কিন্তু বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ভয়ের পাথর বসে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, দরজা পেরোলেই আগুন তাকে গ্রাস করবে।

এভাবেই অর্পণের পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে লাগল, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দিল, আর দিনরাত এক অদ্ভুত নেশার মতো যজ্ঞকুণ্ডে মগ্ন থাকল। ইন্দ্রাণী একদিন বলেছিল—“এটাই তো সত্যি, যজ্ঞের উত্তরাধিকার নাতির ঘাড়ে পড়েছে।” তার গলায় যেন গর্বও ছিল, আবার ভয়ও। অমৃত রেগে গিয়ে বলেছিল—“তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছ? ছেলে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে, আর তুমি তাতে উৎসাহ দিচ্ছ?” কিন্তু যতই তিনি রাগ করুন না কেন, নীলিমা জানত ভেতরে ভেতরে তাঁরও ভয় জমে উঠছে। কারণ রাতের পর রাত, শশাঙ্ক বসুর শেষ কথা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—“যজ্ঞ এখনো অসম্পূর্ণ।” আর এখন মনে হচ্ছিল, সেই অসম্পূর্ণতা পূরণ করার দায়িত্ব অনিবার্যভাবে অর্পণের ঘাড়েই এসে পড়েছে। প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল যেন এই ভবিষ্যদ্বাণী ফিসফিস করে শোনাচ্ছিল, আর অর্পণ ধীরে ধীরে নিজের ভিতরকার মানুষটিকে হারিয়ে এক অদ্ভুত, বিপজ্জনক টানে এগিয়ে যাচ্ছিল অজানার দিকে।

অধ্যায় ৫:

প্রাসাদের ভেতরে শশাঙ্ক বসুর মৃত্যুর পর যেন প্রতিটি ঘরেই এক অদৃশ্য ভার জমে উঠেছিল। কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় ছিল তাঁর বিশাল ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। পুরোনো কাঠের তাকভর্তি শত শত বই, ধুলো জমা পাণ্ডুলিপি, আর চামড়ার মোড়ানো খাতাপত্রে ভরা এই কক্ষ সবসময় পরিবারের বাকিদের কাছে নিষিদ্ধ ছিল। শশাঙ্ক বসু জীবিত অবস্থায় প্রায় প্রতিরাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে কাটাতেন, কিন্তু কেউ কোনোদিন জানত না তিনি কী পড়েন বা কী লেখেন। এক ঝড়ো সন্ধ্যায়, যখন বাইরের আকাশে মেঘ গর্জন করছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তখন ইন্দ্রাণী হঠাৎ প্রস্তাব দিল—“আমাদের এখানে খুঁজতে হবে। হয়তো বাবার যজ্ঞ নিয়ে কোনো সূত্র লুকানো আছে।” অনেক দ্বিধার পর সবাই সম্মত হলো, আর সেদিন প্রথমবারের মতো লাইব্রেরির ভারী তালা খোলা হলো। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত গন্ধ বেরিয়ে এল—পুরোনো কাগজের গন্ধ, সঙ্গে যেন কিছু পচা ধূপের গন্ধও মিশে আছে। তাকগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে যখন বইপত্র নামানো হচ্ছিল, তখনই একটি ধুলোমাখা ডায়েরি পাওয়া গেল। কভারটি ছিল কালচে বাদামি, যেন বছরের পর বছর আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে থেকেছে। প্রথম পাতায় লেখা ছিল কেবল একটি লাইন—“আমার যজ্ঞ, আমার উত্তরাধিকার।”

ডায়েরি খুলে পড়া শুরু হতেই সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রতিটি পাতায় অদ্ভুত চিহ্ন, মন্ত্র, আর জটিল বর্ণনা। শুরুতে শশাঙ্ক বসু লিখেছেন কিভাবে তিনি ছোটবেলা থেকেই তন্ত্রমন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, আর ব্যবসায়িক সফলতার পেছনে কেবল পরিশ্রম নয়, এই গুপ্ত আচারগুলোর শক্তিই তাকে সাহায্য করেছে। পাতার পর পাতা জুড়ে তিনি নিজের সাধনার বিবরণ লিখেছেন—কোন কোন আচার সম্পন্ন হয়েছে, কোন দেবতার আরাধনা করেছেন, কোন রাতে কোন নক্ষত্রের প্রভাবে শক্তি আহরণ করেছেন। পড়তে পড়তে সবাই বুঝতে পারল, শশাঙ্ক বসুর ধনসম্পদের সঙ্গে এই অদ্ভুত শক্তির যোগসূত্র অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যতই শেষের দিকে এগোনো হলো, লেখাগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগল। শেষ অধ্যায়ে বড় অক্ষরে লেখা ছিল—“যজ্ঞের প্রকৃত উদ্দেশ্য অমরত্ব। দেহের সীমা ভেঙে আত্মাকে চিরকাল টিকিয়ে রাখা।” আর তারপরেই স্পষ্টভাবে লেখা ছিল সেই শর্ত—“শেষ ধাপ সম্পন্ন হবে এক মানব প্রাণ বলির মাধ্যমে। না হলে সমস্ত সাধনা ধুলিসাৎ হয়ে যাবে।”

এই সত্য জানার পর নীলিমার বুক যেন ভেঙে গেল। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল—“এটা অসম্ভব… আমাদের পরিবারে কেউ এমন ভয়ঙ্কর কিছু চাইতে পারে না।” তার চোখে জল এসে গেল, কারণ সে হঠাৎ ভাবতে শুরু করল, শশাঙ্ক বসুর মৃত্যু আদৌ স্বাভাবিক ছিল কিনা। হয়তো এই যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থাকার কারণেই তাঁকে টেনে নিয়েছে অশুভ শক্তি। ইন্দ্রাণী যদিও বিস্মিত হয়েছিল, তার চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা দেখা গেল। যেন ভয়ঙ্কর সত্য জানার পরও সে গোপনে মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। অমৃত ডায়েরি ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো, কিন্তু নীলিমা তাকে থামিয়ে দিল—“না, এটা আমাদের বুঝতে হবে। এটাই হয়তো জানাবে, কীভাবে আমরা এই যজ্ঞ বন্ধ করতে পারি।” কিন্তু তখনই সবার নজরে এল অর্পণ। সে ডায়েরির দিকে এক অদ্ভুত আসক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। পাতার অক্ষরগুলো যেন সরাসরি তার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। সে নিঃশব্দে ফিসফিস করে পড়ছিল মন্ত্রগুলো, আর তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যাচ্ছিল।

রাত গভীর হওয়ার পর, সবাই ঘরে চলে গেলেও অর্পণ চুপিচুপি আবার লাইব্রেরিতে ফিরে এল। ডায়েরি খুলে আগুনের আলোয় পড়তে পড়তে তার চোখে অস্বাভাবিক দীপ্তি জ্বলে উঠল। সে হাত বুলিয়ে লিখাগুলো স্পর্শ করছিল, যেন এগুলো কেবল কাগজের অক্ষর নয়, বরং দাদুর হাত থেকে সরাসরি তার কাছে আসা এক উত্তরাধিকার। “মানুষের প্রাণ বলি…”—শব্দগুলো তার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছিল, আর সে অনুভব করছিল যে এই কাজ তারই করার কথা। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক দৃঢ়তা জমে উঠল। অন্যদিকে, নীলিমা নির্ঘুম শুয়ে শুয়ে ভাবছিল—ডায়েরির এই সত্য যদি বাস্তব হয়ে ওঠে, তবে তার ছেলেকে বাঁচানো যাবে তো? দাদুর অপূর্ণ সাধনা এখন কি সত্যিই অর্পণের ঘাড়ে এসে পড়েছে? প্রশ্নগুলো তাকে শিউরে তুলছিল, কিন্তু একই সময়ে বুঝতে পারছিল যে অর্পণ এখন আর আগের মতো নেই। সে ক্রমে নিজের ছায়া হারিয়ে দাদুর পথ ধরে হাঁটছে। আর ডায়েরি তার হাতে আসার পর, সেই পথ থেকে ফেরার কোনো সুযোগ হয়তো আর অবশিষ্ট নেই।

অধ্যায় ৬:

শশাঙ্ক বসুর মৃত্যুর পর যজ্ঞকুণ্ডের অদ্ভুত আগুন যেন পরিবারের জীবনকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দিল। রাতের অন্ধকারে আচমকা জ্বলে ওঠা সেই শিখা, কখনো তার ভেতরে ছায়ামূর্তি ভেসে ওঠা—সব মিলিয়ে এক রহস্যময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। পরিবার বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। ইন্দ্রাণী ও অর্পণ বিশ্বাস করছিল যে এটা নিছক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সম্ভব নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে দাদুর অসমাপ্ত সাধনার শক্তি। অন্যদিকে, অমৃত ক্রমশ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। তার কাছে এসব অদ্ভুত কাহিনি মানসিক ভ্রম ছাড়া কিছু নয়। নীলিমা মাঝখানে পড়ে আতঙ্কিত হচ্ছিল, কারণ সে দেখছিল ছেলে প্রতিদিন আগুনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। তখনই অমৃত শহরের এক প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসক ডা. সমীরণ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্য চাইল। সমীরণ কেবল চিকিৎসক নন, তিনি ভূতত্ত্ব ও রাসায়নিক বিক্রিয়াতেও যথেষ্ট পড়াশোনা করেছিলেন। অমৃত চাইলেন, এই রহস্যের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হোক, যাতে সবাইকে প্রমাণ করা যায় যে শশাঙ্ক বসুর যজ্ঞ আসলে নিছক প্রতারণা।

ডা. সমীরণ প্রথম রাতে এসে কুণ্ড পরীক্ষা করলেন। তিনি গ্যাস মাস্ক পরে যজ্ঞকুণ্ডের চারপাশে যন্ত্রপাতি বসালেন, বাতাসে কোনো রাসায়নিক উপাদান আছে কিনা, মাটির ভেতর থেকে কোনো দাহ্য গ্যাস বের হচ্ছে কিনা—সব পরীক্ষা শুরু করলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রাসাদের এই অংশের নিচে কিছু প্রাকৃতিক গ্যাস আটকে থাকতে পারে, যা অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে হঠাৎ জ্বলে উঠছে। কখনো সালফারের গন্ধ, কখনো অদ্ভুত শব্দ—সবকিছুরই ব্যাখ্যা তিনি বিজ্ঞানের আলোয় খুঁজে আনলেন। তবে যতই তিনি বিশ্লেষণ করলেন, একটি জিনিসের ব্যাখ্যা তিনি পেলেন না—আগুনের শিখার রঙের পরিবর্তন। কখনো লাল, কখনো নীল, কখনো আবার সবুজাভ ঝলকানি—যা স্বাভাবিক রাসায়নিক দহনের সঙ্গে মেলানো যায় না। সমীরণ বললেন, “আমি বলতে পারি না এর ভেতর অতিপ্রাকৃত কিছু আছে কিনা, তবে রাসায়নিক যুক্তি দিয়ে সবটা বোঝানো যাচ্ছে না।” এই স্বীকারোক্তি অমৃতকে বিরক্ত করল, কিন্তু ইন্দ্রাণী আর অর্পণের চোখে অদ্ভুত এক তৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠল।

ঠিক তখনই কাশীনাথ শর্মা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বললেন, “ডাক্তারবাবু, এটাই তো পার্থক্য। যা বিজ্ঞানে ধরা যায় না, তা-ই তন্ত্র। আপনি যত যন্ত্র বসান, যত বিশ্লেষণ করুন, এই শক্তি তার নিয়মে চলে। এর যুক্তি মানুষের যুক্তি নয়।” তাঁর কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, আর চোখে ছিল অদ্ভুত দীপ্তি। তিনি আরও যোগ করলেন, “শশাঙ্ক বসু যে সাধনায় প্রবেশ করেছিলেন, তা বিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ কুণ্ড কেবল অগ্নি নয়, এ এক দ্বার—যা খুললে দেহ আর আত্মার সীমানা মুছে যায়।” সমীরণ প্রতিবাদ করতে চাইলেন, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল। যেন তিনিও নিজের ভেতরে অনুভব করছিলেন, এই আগুন কেবল গ্যাসের খেলা নয়। পরিবার বিভক্ত হয়ে পড়ল আরও তীব্রভাবে। অমৃত জোর দিয়ে বলছিলেন যে সবকিছু প্রমাণিত হবে, অন্যদিকে অর্পণ ফিসফিস করে ডায়েরির লাইন পড়ছিল, যেন বিজ্ঞানীর উপস্থিতিই তার কাছে হাস্যকর। নীলিমা আতঙ্কে কাঁপছিল, কারণ সে বুঝতে পারছিল দুই শক্তি—বিজ্ঞান আর তন্ত্র—এখন এই বাড়ির ভেতরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সমীরণ বললেন, তিনি আরও কিছু পরীক্ষা করবেন, কিন্তু তার জন্য সময় দরকার। অমৃত তাকে সমর্থন করল, কারণ এটাই একমাত্র উপায় এই বিভ্রান্তি কাটানোর। কিন্তু কাশীনাথ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন—“সময় নেই। যজ্ঞ অসম্পূর্ণ থেকে গেলে তার ক্রোধ এই প্রাসাদকেই নয়, গোটা পরিবারকে ধ্বংস করবে।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই অর্পণ হঠাৎ বলে উঠল, “না, আমি সময় নষ্ট করব না। দাদুর কাজ শেষ করব।” তার গলায় এমন এক দৃঢ়তা ছিল যা শুনে নীলিমার বুক কেঁপে উঠল। কাশীনাথ সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে মাথা নাড়লেন, ইন্দ্রাণীও ছেলের পাশে দাঁড়াল। অন্যদিকে অমৃত সমীরণকে নিয়ে চিৎকার করে উঠল, “আমি কাউকে হত্যা হতে দেব না, আমি এই পাগলামি মানি না।” প্রাসাদের ভেতর যেন আগুনের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল। বিজ্ঞান বনাম তন্ত্রশক্তির দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে গেল। কিন্তু যে আগুন কুণ্ড থেকে প্রতিরাতে অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছিল, তার প্রতিটি শিখা যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিল—শশাঙ্ক বসুর যজ্ঞ শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণ থাকবে না। আর সেই যজ্ঞকে পূর্ণ করার জন্য হয়তো অর্পণ ইতিমধ্যেই নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছে।

অধ্যায় ৭:

প্রাসাদের রাতগুলো ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। যজ্ঞকুণ্ডের রহস্যময় আগুন একদিকে বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করছে, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের মনের ভেতর আতঙ্ক বুনে দিচ্ছে। কিন্তু সেই ভয় হয়তো সবার থেকে তীব্রভাবে অনুভব করছিল প্রাসাদের গৃহপরিচারিকা মঞ্জরী। বহু বছর ধরে সে এই বাড়িতে কাজ করছে। শশাঙ্ক বসুর জীবদ্দশায়ও তার চোখে পড়েছিল অনেক অদ্ভুত আচার অনুষ্ঠান, যদিও সে কখনো প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস করেনি। তবে বসুর মৃত্যুর পর থেকে কুণ্ডের সামনে অদ্ভুত ছায়া, কানে ফিসফিস আওয়াজ, রাতের অন্ধকারে অজানা পায়ের শব্দ—এসব সে স্পষ্টই অনুভব করছিল। এক গভীর রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে আছে, মঞ্জরী রান্নাঘরের কাজ সেরে উঠোন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎই সে অনুভব করল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। প্রাসাদের দীর্ঘ করিডরজুড়ে টিমটিমে আলো, দেওয়ালে ছায়া পড়ছে, আর তার পায়ের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আরেকটি শব্দ। আতঙ্কিত হয়ে সে পেছন ফিরে তাকাল—কেউ নেই। কিন্তু চোখের কোণে সে দেখল, যজ্ঞকুণ্ডের শিখার ভেতর থেকে যেন এক অবয়ব বেরিয়ে আসছে, কালো ধোঁয়ার মতো আবছা ছায়া, ধীরে ধীরে তার দিকে এগোচ্ছে।

মঞ্জরী প্রথমে ভাবল হয়তো চোখের ভ্রম, কিন্তু ছায়াটা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। তবে চিৎকার থেমে গেল তার গলায়, যেন কেউ তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে গেল কুণ্ডের দিকের অন্ধকারে। রাত ভোর হলো, সবাই তাদের নিজ নিজ ঘরে ঘুমিয়ে রইল, কিন্তু ভোরবেলা কাজের জন্য মঞ্জরী আর কোথাও পাওয়া গেল না। নীলিমা প্রথমে ভেবেছিল সে হয়তো গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, কিন্তু কোনো খবর নেই। তার কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি, এমনকি এক কাপড়ও নিখোঁজ হয়নি—সে যেন হঠাৎ মিলিয়ে গেছে। বাড়ির ভেতরে অস্বস্তির বাতাস ছড়িয়ে পড়ল। ইন্দ্রাণী মুখ গোমড়া করে বলল, “আমি বলেছিলাম না? এই কুণ্ড বলি চায়। এখন শুরু হয়ে গেল।” অমৃত রাগে ফেটে পড়ল, “এটা পাগলামি! মঞ্জরী হয়তো কোথাও পালিয়েছে, হয়তো ভয় পেয়ে গ্রামে চলে গেছে।” কিন্তু তার নিজের মনেও শিহরণ জেগে উঠছিল। কারণ আগের রাতেই সে শুনেছিল করিডর দিয়ে কারো দৌড়ানোর শব্দ।

পরদিন সকালে অমৃত আর ডা. সমীরণ মিলে প্রাসাদজুড়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। চারপাশে কিছুই মেলেনি, কিন্তু যখন তারা যজ্ঞকুণ্ডের কাছে গেল, তখনই এক শীতল স্রোত বয়ে গেল তাদের শরীরে। মাটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল কিছু লাল দাগ—রক্ত। যদিও সেটা অল্প কয়েক ফোঁটা, তবুও দাগ শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছিল। নীলিমা ভয়ে চিৎকার করে উঠল, আর ইন্দ্রাণী ফিসফিস করে বলল, “এটাই প্রথম বলি।” অর্পণ তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখ স্থির হয়ে আছে কুণ্ডের দিকে। তার ঠোঁটে এক চাপা হাসি খেলে যাচ্ছিল, যেন সে আগেই জানত এই ঘটনাটা ঘটবে। কাশীনাথ ধীর কণ্ঠে বললেন, “যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। বলি ছাড়া এই কুণ্ডের আগুন নেভানো যাবে না।” এই কথা শুনে অমৃত ক্রোধে ফেটে পড়ল, “তুমি চুপ করো! এসব মিথ্যে ভয় দেখানো ছাড়া কিছু না। আমি পুলিশের কাছে যাব।” কিন্তু নীলিমা তার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “না, পুলিশ কিছু করতে পারবে না। তুমি কি দেখছো না, এটা মানুষের কাজ নয়?”

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদে এক ভয়ার্ত নীরবতা নেমে এল। সবাই আলাদা আলাদা ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। বাইরে ঝড় বইছিল, জানলার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল টুপটাপ করে। কিন্তু সেই শব্দের ভেতরেও যেন ভেসে আসছিল মঞ্জরীর কণ্ঠ—আবছা, দীর্ঘশ্বাস ভরা ফিসফিসানি, “বাঁচান… বাঁচান…”। নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে নিজের ছেলেকে আঁকড়ে ধরল, কিন্তু অর্পণ তার মায়ের কোল থেকে সরে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি যজ্ঞকুণ্ডের দিকে স্থির, যেন সেখানে কেউ তাকে ডাকছে। তার মনের ভেতর ডায়েরির শব্দগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছিল—“প্রথম বলি অগ্নিকে জাগ্রত করে। তারপরেই যজ্ঞ এগোয়।” অর্পণ সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল, দাদুর উত্তরাধিকার এখন তার ভেতরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মঞ্জরীর হারিয়ে যাওয়া, কুণ্ডের রক্ত, আর ছায়ার খেলা—সবই ছিল সেই বৃহৎ আচার অনুষ্ঠানের প্রথম ধাপ। পরিবার আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল, কিন্তু অর্পণ নিঃশব্দে নিজের ভেতরে প্রতিজ্ঞা করছিল—যজ্ঞ থামবে না, বলি একবার শুরু হয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না।

অধ্যায় ৮:

শশাঙ্ক বসুর মৃত্যুর পর থেকে যে ছায়া বসু প্রাসাদকে গ্রাস করেছিল, তা এবার পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিকে ব্যবসার জগতে অমৃতের দায়িত্ব বেড়ে চলছিল। বাইরের লোকজনের কাছে সে পরিবারের মুখ, আর্থিক সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। দিনভর সে অফিস, মিটিং আর রিপোর্টের মধ্যে ডুবে থাকত, যেন এ বাড়ির অদ্ভুত রহস্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। তার কাছে যজ্ঞকুণ্ডের আগুন আর মন্ত্রোচ্চারণ নিছক বিভ্রান্তি, যা তাকে ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। অথচ রাতের অন্ধকারে প্রাসাদজুড়ে অন্যরকম দৃশ্য গড়ে উঠছিল। অর্পণ সেই আগুনের চারপাশে বসে মন্ত্র জপ করছে, চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এক অদৃশ্য শক্তির প্রবাহ। তার ঠোঁট কাঁপছে, দাদুর শেখানো ভাষাহীন ধ্বনি যেন নিজের থেকেই বেরিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে সে ব্যবসার কাগজপত্র, পড়াশোনা, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গও ছেড়ে দিল। তার কাছে এখন কেবল যজ্ঞকুণ্ডই বাস্তব, বাকিটা সব অস্থায়ী মরীচিকা।

অর্পণের এই পরিবর্তনে ইন্দ্রাণী যেন নতুন প্রাণ খুঁজে পেল। এতদিন ধরে সে নিজেকে বাবার ছায়ায় খুঁজত, কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর মনে হয়েছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এখন অর্পণের মধ্যে সে বাবারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। ধীরে ধীরে সে নিজেই মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল। বাড়ির পুরোনো কপাটবন্ধ ঘরে রাখা শশাঙ্ক বসুর আচার-অনুষ্ঠানের জিনিসপত্র বের করে আনল। গায়ে লাল শাড়ি জড়িয়ে, মাথায় সিঁদুরের টিপ কেটে বসে থাকত কুণ্ডের পাশে। তার চোখে যেন এক অদ্ভুত উন্মাদনা, কণ্ঠে বাবার পুরোনো মন্ত্রের প্রতিধ্বনি। অমৃত একদিন তাকে থামাতে গিয়ে বলেছিল, “ইন্দ্রাণী, এসব বন্ধ করো। তুমি বুঝতে পারছ না, বাবার ছায়া আমাদের গ্রাস করছে।” কিন্তু ইন্দ্রাণী উল্টে বলেছিল, “না দাদা, তুমি বুঝতে পারছ না। বাবা আমাদের জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেটাই একমাত্র মুক্তির পথ। ব্যবসা-ট্যবসা সব মায়া। সত্যি আছে এই যজ্ঞের ভেতরেই।” তার কণ্ঠে ছিল উন্মাদ এক দৃঢ়তা, যা অমৃতকে ভিতরে ভিতরে শঙ্কিত করে তুলেছিল।

নীলিমা এই অবস্থায় সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়ল। একদিকে তার ছেলে অর্পণ ধীরে ধীরে দাদুর পথে পা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ির মেয়েরাও যেন সেই শক্তির আকর্ষণে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। মা হিসেবে সে মরিয়া হয়ে ছেলেকে টেনে বের করতে চাইছিল। বারবার ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করত—“অর্পণ, এ পথ মৃত্যুর, এ পথ রক্তের। তুমি ফিরে এসো। তোমার দাদু যা করেছিলেন, সেটা অন্যায় ছিল।” কিন্তু অর্পণ তার মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলত, “মা, তুমি বুঝবে না। দাদু ভুল কিছু করেননি। তিনি অমরত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন, আর আমি তা পূর্ণ করব।” এই কথা শুনে নীলিমার বুক কেঁপে উঠত। একদিন ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে ফেলল, কিন্তু অর্পণ তাকে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে যজ্ঞকুণ্ডের দিকে চলে গেল। সেই মুহূর্তে নীলিমা বুঝে গেল, সে আর কেবল ছেলের সঙ্গে লড়ছে না—সে লড়ছে এক প্রজন্মের অদৃশ্য অভিশাপের বিরুদ্ধে।

এইভাবে পরিবার দুই ভাগে ভেঙে পড়ল। একপক্ষ, যেখানে ইন্দ্রাণী আর অর্পণ, যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার পক্ষে দাঁড়াল। তাদের কাছে শশাঙ্ক বসুর উত্তরাধিকারই সত্য। অন্যপক্ষ, যেখানে অমৃত আর নীলিমা, মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে যজ্ঞ ভাঙতে। কাশীনাথ এই বিভাজনকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল। তার কণ্ঠে একদিন শোনা গেল রহস্যময় সতর্কতা—“যজ্ঞ অসম্পূর্ণ রাখা যাবে না। হয় তোমরা একে ভাঙবে, নয় পূর্ণ করবে। মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকলে ধ্বংস ডেকে আনবে।” কথাগুলো শোনার পর অমৃত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু মনের ভেতর আতঙ্ক গোপন করতে পারেনি। প্রাসাদের প্রতিটি কোণায় এখন যেন টানাপোড়েনের প্রতিধ্বনি বাজতে লাগল। খাবার টেবিলে, করিডরের আলাপে, এমনকি রাতের নিস্তব্ধতায়—প্রত্যেক মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল, বসু পরিবার আর এক পরিবার নেই। তারা ভাগ হয়ে গেছে দুই মন্ত্রে, দুই শক্তিতে, দুই ভবিষ্যতের দিকে। আর যজ্ঞকুণ্ডের শিখা প্রতিদিন আরও উঁচু হয়ে উঠছে, যেন চুপচাপ অপেক্ষা করছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য।

অধ্যায় ৯:

কাশীনাথের কণ্ঠে সেদিন অদ্ভুত গাম্ভীর্য ভেসে এলো। বসু প্রাসাদের বিশাল হলঘরে সবাই জড়ো হয়েছিল, আর বৃদ্ধ তান্ত্রিক সবার সামনে অগ্নিদৃষ্টি মেলে উচ্চারণ করল—“যজ্ঞ অপূর্ণ আছে। এর শেষ ধাপ পূর্ণ না হলে অগ্নিশক্তি আর এই প্রাসাদকেই নয়, গোটা বংশকে ধ্বংস করবে। কিন্তু মনে রেখো, শেষ ধাপে চাই রক্তের উত্তরাধিকারীর প্রাণ।” মুহূর্তে ঘরে নেমে এলো মৃত্যু-নিঃশ্বাসের মতো নীরবতা। অমৃত হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “তুমি কী বলছ, পণ্ডিতজি? আমাদের বংশধরের রক্ত লাগবে মানে?” তার চোখে ছিল ক্রোধ, কিন্তু বুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল গভীর ভয়। ইন্দ্রাণী অদ্ভুতভাবে চুপ করে রইল, যেন কথাগুলো তার কাছে নতুন কিছু নয়। আর অর্পণ, যে কদিন ধরেই যজ্ঞকুণ্ডের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছিল, সে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার চোখের কোণে যেন হালকা এক ঝিলিক—মেনে নেওয়ার, গ্রহণ করার প্রস্তুতি। নীলিমা এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল। তার গলা কাঁপতে কাঁপতে বেরোল—“না! আমি কাউকে মরতে দেব না। এই যজ্ঞ যদি রক্ত চায়, তবে আমি নিজেই ধ্বংস করব একে।” কিন্তু কাশীনাথ থামাল, “মা, তুমি পারবে না। এ আগুন তোমার হাতে নিভবে না। যজ্ঞ এখন রক্ত ডাকছে।”

সেই রাতটা ছিল প্রাসাদের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম। অমৃত আর নীলিমা প্রাণপণ চেষ্টা করছিল অর্পণকে যজ্ঞকুণ্ড থেকে দূরে রাখতে। তারা ছেলেকে বারবার বলছিল—“তুই আমাদের রক্ত-মাংস, তুই দাদুর অভিশাপ বহন করতে বাধ্য নোস।” কিন্তু অর্পণ যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি, ঠোঁটে অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণ। রাত গভীর হতে হতে হঠাৎ কুণ্ড থেকে এক বিকট শব্দ উঠল, যেন হাজারো ঢাক একসঙ্গে বেজে উঠল। আগুনের শিখা আচমকা আকাশচুম্বী হয়ে উঠল, আর তার ভেতর থেকে বেরোল শক্তিশালী ঘূর্ণি। সবাই আতঙ্কে পিছু হটল, কিন্তু অর্পণ দাঁড়িয়ে রইল আগুনের ঠিক সামনে। মনে হলো শিখাগুলো তাকে ডাকছে, টেনে নিচ্ছে নিজের ভেতরে। তার পা ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল কুণ্ডের দিকে। অমৃত চিৎকার করে তার হাত ধরতে গেল, কিন্তু আগুনের তাপে পুড়ে উঠল তার চামড়া। ইন্দ্রাণী নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল—তার চোখে ছিল ভয় নয়, বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তি। যেন সে চায় এই আহ্বান পূর্ণ হোক।

নীলিমা সেই মুহূর্তে নিজেকে সামলাতে পারল না। মাতৃত্বের শক্তি যেন তার ভেতর বিস্ফোরিত হলো। সে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল, তাকে আগুন থেকে সরিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু কুণ্ডের শিখা যেন অদৃশ্য হাত হয়ে অর্পণকে টেনে নিচ্ছিল। নীলিমা প্রাণপণ লড়াই করছিল, ছেলের শরীর আঁকড়ে ধরে চিৎকার করছিল—“না! আমি আমার সন্তানকে দেব না! আমি দেব না!” তার গলা ফেটে যাচ্ছিল, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল অগ্নিশিখার লাল আলোয় ঝিলিক দিয়ে। অর্পণ তখনও মন্ত্র জপ করছিল, যেন দাদুর আত্মা তার দেহে প্রবেশ করেছে। আগুনের ভেতর থেকে ভেসে এলো ফিসফিসানি—“রক্ত চাই… উত্তরাধিকারীর রক্ত…” এই শব্দ শুনে নীলিমার বুক কেঁপে উঠল, তবুও সে শক্ত করে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কুণ্ড থেকে বেরোনো আগুন তার চুল ছুঁয়ে দিচ্ছিল, তার শাড়ি আগুনে পুড়ে যাওয়া শুরু করল, কিন্তু সে ছাড়ল না। তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল পুরো প্রাসাদজুড়ে, যেন রাতের অন্ধকার ভেদ করে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

শেষ মুহূর্তে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। শিখার ঘূর্ণি অর্পণকে পুরোপুরি টেনে নিতে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু নীলিমার বুকের আঁকড়ে ধরা আর তার মাতৃত্বের আহাজারি যেন এক অচেনা শক্তি তৈরি করল। আগুন হঠাৎ কেঁপে উঠল, প্রচণ্ড গর্জন করে আবার মিইয়ে গেল। কুণ্ডের ভেতর থেকে ধোঁয়ার স্তম্ভ আকাশে উঠল, কিন্তু অর্পণ মাটিতে পড়ে রইল—অর্ধচেতন, ঘামে ভেজা, ঠোঁটে এখনও মন্ত্রের ফিসফিসানি। নীলিমা তাকে বুকে চেপে ধরে কাঁদছিল, আর অমৃত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, বুঝতে পারছিল না—যজ্ঞ কি সত্যিই ব্যর্থ হলো, নাকি আরও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে? কাশীনাথের চোখে সেই মুহূর্তে অদ্ভুত আতঙ্ক ফুটে উঠল। সে ধীরে ধীরে বলল—“শেষ আহ্বান থেমেছে, কিন্তু যজ্ঞ থামেনি। রক্তের পিপাসা মিটবে না এত সহজে।” প্রাসাদজুড়ে তখন কেবল মায়ের কান্না, ভয়ের নিঃশ্বাস, আর নিভে যাওয়া আগুনের ছাই ভেসে বেড়াচ্ছিল।

অধ্যায় ১০:

সেই রাতটা যেন স্বয়ং মৃত্যুর আগমনের রাত। প্রাসাদের আকাশে অঝোর বর্ষণ, চারদিক জুড়ে বজ্রবিদ্যুতের দাপট। প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল শিউরে উঠছিল সেই গর্জনে। কিন্তু হলঘরের মধ্যে চলছিল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। যজ্ঞকুণ্ড থেকে আগুনের ঢেউ আকাশ ছুঁয়ে উঠছিল, তার আলোয় ঘরজুড়ে ছায়ারা নাচছিল, যেন শয়তানের বাহিনী প্রাসাদ ঘিরে ধরেছে। কাশীনাথ শর্মা কুণ্ডের সামনে বসে প্রাণপণ মন্ত্র জপ করছিল, তার কণ্ঠে ছিল এক অমানবিক শক্তি, চোখদুটো লাল হয়ে জ্বলছিল আগুনের প্রতিফলনে। অর্পণ তখন অর্ধচেতন অবস্থায় কুণ্ডের কিনারে বসে, হাত কেটে রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছিল আগুনে। কুণ্ড যেন আরও ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিল, তার শিখা আরও উন্মত্ত হয়ে অর্পণকে গ্রাস করতে চাইছিল। ইন্দ্রাণী নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ বন্ধ করে মন্ত্রোচ্চারণে লিপ্ত—যেন বাবার অসমাপ্ত যজ্ঞ তার ভেতর দিয়ে পূর্ণ হয়ে উঠছে। আর নীলিমা সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠছিল, তার বুকের ভেতর কেবল একটাই আওয়াজ—“না, আমার ছেলেকে আমি মরতে দেব না।” অমৃত ততক্ষণে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়েছে, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না—সে কি শক্তির এই উন্মত্ত স্রোতে ভেসে যাবে, নাকি শেষবারের মতো প্রতিরোধ করবে।

হঠাৎ কাশীনাথের গলা বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠল—“অগ্নিদেব! রক্তের উত্তরাধিকারী সমর্পিত হলো। এখন যজ্ঞ সম্পূর্ণ হোক!” তার কণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে শিখা তীব্র হয়ে উঠল, ঝড়ের মতো কুণ্ড থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অর্পণের দেহ কাঁপছিল, ঠোঁট ফিসফিস করছিল অচেনা মন্ত্রে, চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমে। নীলিমা ছুটে গিয়ে ছেলেকে টেনে ধরতে চাইলো, কিন্তু তীব্র তাপে বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। তখন অমৃত, যে এতদিন সবকিছু উপেক্ষা করতে চাইছিল, হঠাৎ বুঝতে পারল—এখন আর দ্বিধার সময় নেই। সে নীলিমার দিকে তাকাল, তাদের চোখে একই সিদ্ধান্ত জ্বলে উঠল। দু’জনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল কুণ্ডের দিকে। বজ্রবিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল, তারা দুই পাশে দাঁড়িয়ে যজ্ঞকুণ্ডের প্রাচীর ভাঙতে শুরু করেছে। ইটগুলো একে একে খুলে পড়ছিল, আগুনের ঝড় তাদের হাত-পা জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তারা থামল না। কাশীনাথ গর্জন করে উঠল, “পাগল! তোমরা কী করলে জানো না। যজ্ঞ ভাঙলে মৃত্যু ছাড়া কিছুই আসবে না।” তবুও অমৃত আর নীলিমা এক মুহূর্ত থামল না। তারা প্রাণপণ লড়ে, শেষমেশ কুণ্ডের দেয়াল ভেঙে ফেলল।

সঙ্গে সঙ্গে ঘটল অদ্ভুত বিস্ফোরণ। কুণ্ড থেকে আগুন উল্কাপিণ্ডের মতো ছিটকে বেরোল, হলঘরের প্রতিটি কোণ লাল হয়ে উঠল, আর সেই আগুনে গ্রাস হয়ে গেল কাশীনাথ। বৃদ্ধ তান্ত্রিকের চিৎকার কানে বাজল, তার শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগল, অথচ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে মন্ত্র উচ্চারণ করতে ছাড়ল না। আগুন তার কণ্ঠরোধ করে দিল, আর মুহূর্তের মধ্যে সে ভস্মে মিশে গেল। যজ্ঞকুণ্ড থেকে শিখা নিভে গেল ধীরে ধীরে, রক্তের প্রবাহ থেমে গেল। ঝড়ের মতো গর্জন থেমে গিয়ে ঘরে নেমে এলো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ইন্দ্রাণী মূর্ছা গিয়ে পড়ে গেল মেঝেতে, যেন তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। অর্পণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, তার মুখে এখনও মন্ত্রের অস্পষ্ট ফিসফিসানি। নীলিমা তাকে বুকে টেনে নিল, বুকের ভেতর হাহাকার নিয়ে কাঁদতে লাগল। অমৃত হাঁপাচ্ছিল, চোখে ভয় আর অবিশ্বাস জমে উঠেছিল—সে কি সত্যিই যজ্ঞ ভাঙতে পেরেছে, নাকি আরও বড় অভিশাপ ডেকে আনল?

কিছুক্ষণ পর অর্পণ ধীরে ধীরে চোখ খুলল। তার চাহনিতে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন সে আর আগের মানুষ নেই। ঠোঁট নড়ছিল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। নীলিমা তাকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু তার বুকের ভেতর কেবল একটাই আতঙ্ক—এই সন্তান কি সত্যিই ফিরে এসেছে? নাকি দাদুর আত্মা এখন তার ভেতর চিরকাল বাস করবে? অমৃত ছেলের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল। তার মনে হলো—যজ্ঞ হয়তো ভেঙে দেওয়া গেছে, কিন্তু আগুনের ছাই এখনও জ্বলছে ভেতরে ভেতরে। কাশীনাথ নেই, যজ্ঞকুণ্ড ভস্মে মিশে গেছে, কিন্তু অর্পণের চোখের অচেনা ঝিলিক যেন বলছিল, গল্প এখানেই শেষ নয়। বাইরে বজ্রপাত আবার গর্জে উঠল, জানালার ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো বাতাস এসে নিভে যাওয়া কুণ্ডের ছাই উড়িয়ে নিয়ে গেল অন্ধকারে। শেষ প্রশ্নটা অমৃত, নীলিমা আর পাঠকের মনেই রয়ে গেল—যজ্ঞ কি সত্যিই শেষ হলো? নাকি তা কেবল নতুন রূপে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে?

____

 

1000057774.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *