কুশল রায়
১
শীতল বাতাসে ভেসে আসা ধোঁয়ার মতো কুয়াশার মধ্যে দার্জিলিং স্টেশনে ট্রেন থামতেই কাঁপতে কাঁপতে নামল অনির্বাণ ও মেহুলী। চারদিকে হালকা গুঞ্জন, মালবাহকদের হাঁকডাক, আর দূরে পাহাড়ে উঁকি দিয়ে থাকা বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে যেন একটা রঙহীন চিত্রকল্পে ঢুকে পড়েছে তারা। অনির্বাণের হাতে এক চামড়ার ট্রলি, অন্য হাতে মেহুলীর হাত। মেহুলী হালকা কমলা রঙের উলেন শালে নিজেকে জড়ানো, চোখে সানগ্লাস। তাদের মুখে বিবাহিত জীবনের সেই স্বাভাবিক জড়তা—যেখানে শরীরের স্পর্শ আছে, কিন্তু মনের ছায়াগুলো এখনো ধরা দেয়নি একে অপরকে। হোটেল থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছিল, চালক হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। গাড়ির জানালা দিয়ে তারা দেখতে থাকল কুয়াশার চাদরে মোড়ানো দার্জিলিংয়ের চায়ের বাগান, পাহাড়ি পথ, আর লতানো কুয়াশা যেভাবে গাছের ডাল জড়িয়ে থাকে, এক মুহূর্তের জন্য মেহুলী যেন অনুভব করল, একে অপরকে জানার সেই যাত্রার সূচনা এভাবেই নিঃশব্দে হয়।
হোটেলটা ছিল ম্যালের কাছে পুরনো ব্রিটিশ কনভার্টেড বাংলো, কাঠের মেঝে, আগুন জ্বালানোর পুরনো ফায়ারপ্লেস আর উঁচু খোলা জানালা থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া তাদের জানিয়ে দিচ্ছিল—এটা পর্যটকদের শহর নয়, বরং সময়কে পিছনে ফেলে আসা এক মঞ্চ, যেখানে দুজন অপরিচিত মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের চরিত্রে ঢুকবে। অনির্বাণ একটু ক্লান্ত, চুপচাপ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়; আর মেহুলী সেই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখে, কুয়াশার ফাঁক দিয়ে কখনোই সূর্য দেখা যায় না, শুধু আলোটুকু বোঝা যায়। তার ভিতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি—এই মানুষটার সঙ্গে সে সারাজীবন কাটাবে, কিন্তু তবুও সে কি সত্যিই অনির্বাণকে জানে? অনির্বাণের ফোন বেজে ওঠে, অফিস থেকে কিছু মেসেজ, সে একবার তাকিয়ে দেখে রেখে দেয়। মেহুলী সেই মুহূর্তে পিছন ফিরে ভাবে, এই সময়টুকু শুধু তাদের দুজনের—বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়াই এগোতে হবে।
সন্ধ্যায় হোটেলের ডাইনিং রুমে তারা একসাথে বসে ডার্জিলিং টি আর হালকা কেক খায়। কথার ফাঁকে অনির্বাণ casually বলে ফেলে, “তুই একা বেড়াতে আসলে বোধহয় বেশি এনজয় করতে পারতি।” মেহুলী হালকা হেসে জবাব দেয়, “হয়তো, কিন্তু তোর সঙ্গে এই ঠাণ্ডা ভাগ করে নেওয়াটাও মন্দ লাগছে না।” কথাগুলো যেন স্বাভাবিক, কিন্তু ভিতরে একটা অলিখিত সংকেত কাজ করে—তাদের মধ্যে এখনো দূরত্ব আছে, আর সেই দূরত্বটাই হয়তো আকর্ষণের জায়গা তৈরি করছে। রাতে তারা পাশাপাশি শোয়, কিন্তু বিছানার দুই দিক থেকে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ে। আলো নিভে যায়, বাইরে কুয়াশার মধ্যে একটাই ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে থাকে, যেন পাহাড়ি শহরের প্রত্যেক প্রান্তে অন্ধকারের ভিতর আলো খোঁজার প্রতীক হয়ে। মেহুলী চোখ বন্ধ করে ভাবে, এই যাত্রার শুরুতেই এত অনিশ্চয়তা—তবু কোথাও সে অনুভব করে, গল্পটা এখানেই শেষ নয়, বরং এই ‘অচেনা’ থেকে ‘আপন’ হয়ে ওঠার পথটাই হবে তাদের আসল হানিমুন।
২
রাত গভীর হতে হতে জানালার কাচের গায়ে জমে ওঠা শিশির এক অদ্ভুত চিত্র এঁকে চলেছিল, আর ঘরের ভেতরে সেই ঠাণ্ডা বাতাসেও যেন এক ধরনের অপেক্ষা ছড়িয়ে ছিল। অনির্বাণ বিছানায় শুয়ে, পাশে থাকা মেহুলীর চুলের গন্ধ অনুভব করছিল—তপ্ত জবা ফুলের মতো নরম, কিন্তু সেই গন্ধের ভেতরেও ছিল একরাশ সংশয়। তারা একে অপরের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলেও, চোখে চোখ পড়ছিল না, কথার ফাঁকে শব্দগুলো কেবল মুখস্থ সংলাপের মতো উচ্চারিত হচ্ছিল। মেহুলী বলল, “তোকে পাশে পেয়ে ভালো লাগছে, অথচ তোকে ছুঁতে সাহস পাই না।” অনির্বাণ একটু নড়ে উঠে বলল, “আমি জানি না আমরা এখন ঠিক কী করছি… প্রেমের জায়গায় এসেও এত হিসেব কেন করছি।” সেই মুহূর্তটা তাদের প্রথম কাছাকাছি আসার সময় নয়, বরং প্রথম সত্যি কাছে আসার দ্বিধার সময়। তারা জানত, বিয়ে হয়ে গেছে, শারীরিক মিলন অবধারিত, কিন্তু হৃদয়ের দরজাটা খোলেনি এখনও—কেবল শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোনো মূহূর্তকে মেহুলী অশ্রদ্ধা করতে পারছিল না। তবুও তারা একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে—ধীরে ধীরে, যেন কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেওয়ার আগে অনুমতি চাইছে চোখের ভাষায়, নিঃশব্দে।
মোমবাতির আলোয় মুখের ছায়া গাঢ় হয়ে উঠেছিল, আর তার মাঝখানেই স্পর্শগুলো কথা বলতে শুরু করেছিল। অনির্বাণের ঠোঁট ছুঁয়ে গেল মেহুলীর কপালে, তারপর তার গালের পাশ দিয়ে নামতে নামতে একটানা ঢেউয়ের মতো ছুঁয়ে চলল তার গলা ও কাঁধ। মেহুলীর শ্বাস ভারী হয়ে উঠলেও সে নিজেকে নির্ভার রাখার চেষ্টা করছিল, কারণ তার ভেতরে এখনও প্রেম আর প্রবৃত্তির সীমারেখা ঝাপসা ছিল। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু সেই আলিঙ্গনটা কোনো প্রাপ্তির ছিল না—বরং ছিল এক নিঃশব্দ অনুসন্ধান। বিছানায় সময় কাটানো মানে শুধু শরীর নয়, মেহুলীর কাছে এটা ছিল একসাথে পথ হাঁটার প্রতীক, অথচ অনির্বাণ তখনো ধরতে পারেনি সেই গভীরতা। যখন তারা সম্পূর্ণ এক হয়ে গেল, সেই মূহূর্তেও যেন কিছুটা শূন্যতা থেকে গেল—যেন প্রেমের চেয়ে বড় কোনো না বলা কথা থেকে গেছে। মিলনের শেষে তারা দুজনেই নিঃশব্দে শুয়ে রইল, কারোর মুখে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো জবাব নেই, শুধু একে অপরের নিঃশ্বাস গোনার শব্দ—যা একঘণ্টা আগেও অচেনা ছিল।
ভোরের দিকে মেহুলী উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল, পাহাড়ের মাথায় জমা হালকা রোদ কুয়াশাকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তার চোখে তখন কোনো অনুতাপ নেই, বরং এক গভীর উপলব্ধির আভা, যে সে এক সঙ্গীর শরীরকে শুধু গ্রহণ করেনি, তার নিঃসঙ্গতাকেও ছুঁয়ে এসেছে। পেছনে বিছানায় শুয়ে থাকা অনির্বাণ ঘুমিয়ে থাকলেও, তার মুখে যেন ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মেহুলী বুঝে যায়, এই সম্পর্ক শুধু দেহের নয়—এই সম্পর্ক ‘বোঝার’ জায়গা থেকে শুরু না হলে, কোনো ‘ভালোবাসা’ টিকে থাকবে না। সে ধীরে ধীরে এসে অনির্বাণের কপালে এক হালকা চুমু খায়, যেন বলে—“আমরা শুরু করেছি, কিন্তু এখনও অনেকটা পথ বাকি।” বিছানার চাদরে শরীরের উষ্ণতা রয়ে গেলেও, মনে একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়ে গেছে। পাহাড়ি শহরের এই প্রথম রাত হয়তো তাদের শারীরিকভাবে এক করে দিল, কিন্তু মানসিকভাবে তারা দুজনেই বুঝতে শুরু করল, শরীর মিলিয়ে গেলেই ভালোবাসা আসে না—ভালোবাসা আসে, যখন দুটি মন নিঃশব্দে একে অপরের ভাষা শিখে নেয়।
৩
সকালটা দার্জিলিং-এর মতোই ঠাণ্ডা, ধীরে ধীরে রোদের রেখা ঘরের জানালায় উঁকি দিচ্ছে। মেহুলী কাঁধে চাদর জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার হাতে এক কাপ গরম চা। চায়ের ধোঁয়া আর পাহাড়ি বাতাস মিলেমিশে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে, অথচ তার চোখে যেন স্পষ্ট এক দ্বিধা। গত রাতের শারীরিক মিলন যেন তাকে ভেতর থেকে বদলে দিয়েছে, অথচ সে নিশ্চিত নয়—এই ঘনিষ্ঠতা কীভাবে পরিণত হবে। তার মনে হয়, সে যেন কোনো গল্পের মাঝে ঢুকে গেছে যার শুরুটা হয়ে গেছে, কিন্তু পরের পাতাগুলো অজানা। অনির্বাণ তখনও বিছানায় ঘুমোচ্ছে—মুখে গভীর ঘুমের ছাপ, কিন্তু কপালে কিছু চিন্তার রেখা জমে আছে। মেহুলী জানে, তাদের সম্পর্কটা কেবল বিবাহসূত্রে গাঁথা নয়; বরং প্রতিদিন একটু একটু করে একে অপরকে বোঝা, প্রশ্ন করা, না-বলা কথাগুলোকে খুঁজে নেওয়ার গল্প। সে ঘরে ফিরে এসে ধীরে ধীরে কাপটা টেবিলে রাখে, তারপর বিছানার পাশে বসে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে থাকে—যেন কিছু না বলেই বোঝাতে চাইছে, ‘তুই ঠিক কী ভাবিস আমাকে নিয়ে?’
অনির্বাণ ধীরে ধীরে জেগে ওঠে, চোখ কচলাতে কচলাতে বলে, “ঘড়ি কটা বাজে?” মেহুলী হালকা হেসে বলে, “সাড়ে আটটা। চা বানিয়ে রেখেছি।” অনির্বাণ একটু বিছানা থেকে উঠে বসে, তার চোখে তখনও অর্ধঘুম আর কিছুটা আনমনা ভাব। সে চা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, আর মেহুলী চুপচাপ তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুই জনের মাঝখানে হালকা বাতাস বইছে, এক অজানা শূন্যতা যেন তাদেরকে কিছু বলতে বাধা দিচ্ছে। হঠাৎ অনির্বাণ বলে ওঠে, “তুই সবসময় এমন? এত ভেতরের কথা ভাবিস?” মেহুলী একটু থেমে, মৃদু হাসে—“আমি মানুষটার ভেতর ঢুকে বুঝতে চাই। মুখের কথা দিয়ে সব বোঝা যায় না তো।” অনির্বাণ একটু চুপ থেকে বলে, “আমার জীবনে কখনও কেউ এতটা বোঝার চেষ্টা করেনি।” এই কথাটা শুনে মেহুলীর চোখে একটা আলোর ঝলক দেখা যায়—সে বুঝে নেয়, এই মানুষটার হৃদয়ের দরজা খুলতে হয়তো একটু সময় লাগবে, কিন্তু সেই দরজার ওপারে একটা কোমল মানুষ লুকিয়ে আছে, যে শুধু নিজের মনের কথা বলতে শেখেনি।
ব্রেকফাস্ট শেষে তারা ম্যাল রোডে হাঁটতে যায়। চারপাশে পাহাড়, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলমলে চূড়া, দোকানগুলোতে উলের মাফলার আর কাঠের খেলনা। মেহুলী মাঝে মাঝে দোকানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর অনির্বাণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে—কিন্তু তার চোখে তাড়া আছে, যেন সে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চায়। হঠাৎ মেহুলী বলে, “অনির্বাণ, তুই এত কম কথা বলিস কেন? আমি তোকে অনুভব করতে পারি, কিন্তু তোর কথা শুনতে চাই।” অনির্বাণ একটু থেমে হেসে বলে, “আমি এত সহজে নিজেকে খুলে দেখাতে পারি না। ছোটবেলা থেকেই অভ্যেস হয়েছে নিজের মতো করে সব হজম করে নিতে।” এই কথাটা শোনার পর মেহুলীর মনে এক ধরনের সহানুভূতি জেগে ওঠে—সে জানে, এই মানুষটা যতটা কঠিন মনে হয়, ভিতরে ততটাই কোমল আর ভীতু। মেহুলী চুপচাপ অনির্বাণের হাত ধরে, আর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে আমরা শুরু করি একে অপরকে পড়তে শেখা দিয়ে।” তাদের মাঝে শীতল বাতাস বইছিল, কিন্তু হাতের উষ্ণতায় যেন সম্পর্কের প্রথম সত্যিকারের সংলাপ শুরু হলো। সেই দিন থেকে, সেই চায়ের কাপের ধোঁয়া থেকেই যেন গড়ে উঠতে শুরু করল এমন এক সম্পর্ক, যা শুধু শরীরের নয়—বরং মনে মনে ধরা দেওয়া এক প্রেম, যার রঙ হয়তো হালকা ধূসর, কিন্তু গভীর অসীম।
৪
সেদিন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল তারা একটি ছোট ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যে, যেখানে এক পাহাড়ি ঝরনার কথা আগের দিন লোকাল গাইড বলেছিল। রাস্তা ছিল সরু, পাইন গাছে ঘেরা, আর মাঝে মাঝে সূর্যের রোদের ঝলক ঠিক যেন কোনো পুরনো প্রেমপত্রের ভাঁজে রাখা হলুদ আলো। অনির্বাণ আর মেহুলী পাশাপাশি হাঁটছিল, কিন্তু মুখে তেমন কোনো কথা হচ্ছিল না, কারণ দুজনেই যেন নিজের ভিতরে ডুবে ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় এসে মেহুলী থেমে যায়, নিচে নামার পথটা দেখিয়ে বলে, “ওখানেই ঝরনা, শুনছিস না শব্দটা?” অনির্বাণ একটু তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর বলে, “তুই এত আগ্রহ নিয়ে এসব খুঁজে বেড়াস, ভালো লাগে।” মেহুলী হেসে জবাব দেয়, “আমি তো জায়গা খুঁজি না, মুহূর্ত খুঁজি।” তারা নামতে শুরু করে পাথরের ঢাল বেয়ে, আর নিচে নেমে এসে দেখে, সত্যিই এক ঝরনার ধারে কাঠের ছোট বেঞ্চ, পাশে মসৃণ পাথরে গড়িয়ে পড়া জল, আর দূরে শুধুই সবুজের স্তব্ধতা। ঝরনার শব্দ যেন ভেতরের সমস্ত শব্দ চাপা দিয়ে দেয়, আর সেই নিঃশব্দ আওয়াজেই যেন নিজেদের কথাগুলো ধরা দেয় সহজে।
মেহুলী বসে পড়ে বেঞ্চে, জুতো খুলে পা ডুবিয়ে দেয় ঠান্ডা জলে। অনির্বাণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, তারপর এসে পাশেই বসে পড়ে। হঠাৎ মেহুলী বলে, “তোর মধ্যে অনেক কিছু আছে যেগুলো তুই লুকিয়ে রাখিস, তুই কি কাউকে বলতে পারিস?” অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে, “শৈশবটা খুব বেশি স্থির ছিল না। বাবার বদলি চাকরি, মা সবসময় ব্যস্ত—বন্ধু বলতে বই আর নিজের মাথার ভেতর গল্প।” সে থেমে যায়। মেহুলী নরম গলায় বলে, “তুই কি কখনও প্রেমে পড়েছিলি?” অনির্বাণ হালকা হাসে, তারপর বলে, “হ্যাঁ, একটা সময় ছিল, কলেজে। কিন্তু শেষমেশ সেটা আমার না বলা চিঠিগুলোর ভেতরেই রয়ে গেল। আমি কখনও কোনো সম্পর্ককে গভীরভাবে ছুঁতে পারিনি, ভেবেছিলাম সময়ই একসময় ভালোবাসা এনে দেবে।” তার কণ্ঠে তখন ক্লান্তির মতো কিছু ছিল না, বরং এক ধরনের মেনে নেওয়ার গলা। মেহুলী জিজ্ঞেস করে, “আর এখন? আমাদের এই নতুন সম্পর্কটা?” অনির্বাণ একটু চুপ থেকে বলে, “তুই আমার ভেতরের কিছুকে নেড়ে দিচ্ছিস, যা আমি অনেকদিন ধরে চেপে রেখেছিলাম। তোর সঙ্গে কথা বললেই মনে হয় আমি নিজের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি।”
সেই মুহূর্তটা তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি করে, ঝরনার শব্দের মাঝে যে শূন্যতা ছিল তা যেন তাদের ভিতরের কথাগুলো জায়গা করে দেয়। মেহুলী ধীরে ধীরে অনির্বাণের দিকে তাকায়, বলে, “আমি তোকে ভালোবাসি এই জন্যেই, কারণ তুই মুখে না বললেও চোখে সব কিছু লেখা থাকে।” অনির্বাণ একবার গভীরভাবে তার দিকে তাকায়, তারপর হালকা করে মেহুলীর হাত ধরে। ঠান্ডা জলে ডুবে থাকা দুই জোড়া পায়ের নিচ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ি স্রোত, কিন্তু তাদের মাঝে যে নিঃশব্দ অনুভব তৈরি হয়েছিল, তা সময়ের কোনো প্রবাহে গলে যাওয়ার নয়। সেই দুপুরবেলায় তারা প্রথমবার কোনো ভান ছাড়া কথা বলে, কোনো শারীরিক স্পর্শের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সেই মানসিক নগ্নতা—যেখানে তারা দুজনেই একটু একটু করে খোলস ছাড়তে শুরু করে। ফিরে আসার পথে আর তেমন কথা হয়নি, কিন্তু তাদের দুজনের হাঁটার ছন্দ যেন এক হয়ে গেছে, আর মেহুলী বুঝে যায়, এই মানুষটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে—ঝরনার জলের মতোই স্বচ্ছ, আর গভীর, যদি তাকে বোঝার সাহস থাকে।
৫
ঝরনার দিনটির পর, যেন খানিকটা সহজ হয়ে উঠেছিল তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের সুর। অনির্বাণ কিছুটা বেশি কথা বলছিল, মাঝে মাঝে মেহুলীর ছবি তুলছিল, এমনকি সে একবার মজা করে বলেছিল, “তোর ব্লগে আমার ছবি যাবে, তার আগে তো একটু স্টাইল করে নিতে হবে।” মেহুলী হেসে গড়াগড়ি খেয়ে বলেছিল, “তুই তো আস্তে আস্তে ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে যাচ্ছিস।” অথচ সেই হালকা হাওয়ার মতো দিন হঠাৎ সন্ধ্যাবেলায় ঘন মেঘে ঢেকে গেল, ঠিক যেন দার্জিলিং-এর আবহাওয়ার মতো, কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে। তাদের হোটেলের ঘরে ফেরার পর মেহুলী তার ল্যাপটপ খুলে বসেছিল, কিছু ছবি সিলেক্ট করছিল, আর অনির্বাণ তখন সোফায় বসে মোবাইলে স্ক্রল করছিল। হঠাৎ মেহুলী অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করল, “তুই সারাক্ষণ ফোনে কী করিস বল তো?” কথাটা একেবারে অভিযোগের সুরে না বললেও, অনির্বাণের গলায় বিরক্তি ফুটে উঠল—“মানে? আমি কি তোকে অবহেলা করছি?” মেহুলী একটু থেমে বলল, “তুই মাঝে মাঝে এমনভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখিস… মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি একা এই সম্পর্কে কথা বলে যাচ্ছি।”
এই কথাটা বলা মাত্রই যেন চাপা জমে থাকা কিছু টানাপোড়েন ফেটে বেরিয়ে এল। অনির্বাণ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই যদি সবসময় একটা অভিযোগের প্যাকেট হাতে রাখিস, তাহলে কিছুই ঠিক হবে না। আমি যেমন, তেমন ভাবেই আমাকে গ্রহণ করতে হবে তোকে।” মেহুলী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে—এই মানুষটা যার চোখে এত কোমলতা সে দেখেছিল ঝরনার ধারে, তার গলায় এমন আত্মরক্ষার কাঁটা কেন? সে ধীরে বলল, “আমি তোকে পাল্টাতে বলিনি, শুধু চাই তুই মাঝে মাঝে খুলে বলিস নিজের কথা। আমি একা টেনে নিতে পারব না আমাদের এই গল্পটা।” অনির্বাণ তখন বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে জেদ, “তুই জানিস না, আমার জন্য কী কী রেখে এসেছি আমি… আমি তোকে ভালোবাসি কি না, সেটা বুঝতে পারার আগেই তুই আমার অনুভূতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছিস।” কথাগুলো যেন ঠান্ডা ছুরির মতো, শব্দে রক্ত নেই, কিন্তু ব্যথা চিরে যায় মেহুলীর ভিতর। সে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে যায়, কেবল বাইরের রাস্তায় কুয়াশার মাঝে কিছু কুকুরের ডাকে অদ্ভুত এক হাহাকার বেজে ওঠে।
রাতটা তারা আলাদা আলাদা পাশে ঘুমোয়। কেউ কোনো কথা বলে না, শুধু মাঝে মাঝে ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যায়, যেন সময়ও অপেক্ষা করছে—এই দুই মানুষ আবার কবে একে অপরকে ছুঁয়ে বলবে, “আমি এখানে আছি।” মেহুলীর মনে হয়, সম্পর্কের গভীরতা শুধু ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে মাপা যায় না, বরং এমন খারাপ মুহূর্তেই বোঝা যায়—কে কতটা ধৈর্য ধরে রাখতে পারে একে অপরকে। সে জানে, এই রাতটা তাদের সম্পর্কের খুব জরুরি একটা রাত—কারণ মিলনের রাত যেমন কাছাকাছি আনে, তেমন ঝগড়ার রাত বলে দেয়, তারা কতটা টিকে থাকতে পারবে। অনির্বাণ হয়তো নিজের মতো লড়াই করে যাচ্ছিল, নিজেকে বোঝাতে চাইছিল, এই ভালোবাসার ভার কি সে সত্যিই নিতে প্রস্তুত? আর মেহুলী সেই রাতে জানে, ভালোবাসা মানে কেবল ভালো ভালো কথা নয়, বরং খারাপ কথা শোনার পরেও পাশে থেকে যাওয়ার সাহস। রাতের গভীরে, বাতি নিভে গেলে, তারা ঘুমিয়ে পড়ে ঠিকই—কিন্তু তাদের মন যেন ঘুমোয় না, ভিতরে ভিতরে জেগে থাকে একটা অপূর্ব অস্থিরতা, যা হয়তো তাদের পরবর্তী সংলাপের ভিত পেতে দেয়, অচেনা নিরবতা থেকে নতুনভাবে একে অপরকে দেখার প্রস্তুতি হিসেবে।
৬
পরদিন সকালে মেঘলা আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকতেই মেহুলীর ঘুম ভাঙে, কিন্তু সে উঠে বসে না, বরং শুয়ে শুয়েই অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে থাকে—যার পিঠ তার দিকে, নিঃশ্বাস ধীর, চোখ বুজে যেন পৃথিবীর সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ঝগড়ার রেশ এখনও বাতাসে ভাসছে, কিন্তু তার মধ্যেও এক আশ্চর্য শান্তি রয়েছে, ঠিক যেন ঝড়ের পর হঠাৎ থেমে যাওয়া বৃষ্টি। মেহুলী ধীরে বিছানা থেকে নেমে চুপচাপ গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। বাইরে দার্জিলিং-এর রাস্তাগুলো কুয়াশায় মোড়া, রিকশার ঘণ্টা, চায়ের দোকানের ধোঁয়া আর পাহাড়ি পথের গুমোট নিস্তব্ধতা এক ধরনের আবেশ তৈরি করছে। মেহুলী তার গায়ে চাদর জড়িয়ে কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বারান্দায় চলে যায়, এবং কোনো এক অভিমানের চুপচাপ অভিব্যক্তিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায় লেন্সের ভিতর। ছবি তুলতে তুলতে সে হঠাৎ অনুভব করে—অভিমান যতই থাক, ভোরের আলো যেভাবে সব কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন করেই ভালোবাসাও রাগের পাথর গলে বেরিয়ে আসে। ফিরে এসে দেখে অনির্বাণ উঠে বসেছে, তাকে দেখে কিছু বলল না, শুধু চোখে একটা ক্লান্তি আর অপরাধবোধ—দুটি ভিন্ন নদী একসাথে বইছে তার চোখের গভীরে।
তারা চুপচাপ হোটেলের ব্রেকফাস্ট সেরে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। আজ তাদের যাওয়ার কথা লয়েড বটানিক্যাল গার্ডেনে, কিন্তু পথটা যেন শুধু গন্তব্যের দিকে নয়, বরং নিজেদের ভেতরের দিকেও এক যাত্রা। হাঁটতে হাঁটতে মেহুলী হঠাৎ বলে বসে, “অনির্বাণ, তুই জানিস, কখনও কখনও মানুষের ভেতরের কুয়াশা বাইরের চেয়েও বেশি ঘনীভূত হয়।” অনির্বাণ থেমে যায়, তারপর নিঃশব্দে বলে, “আমি জানি, আর সেই কুয়াশার ভেতরেও তুই যে আলো খুঁজিস, সেটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।” মেহুলী তাকিয়ে থাকে তার দিকে, কোনো রাগ নেই, শুধু একটা দীর্ঘ অপেক্ষার মতো চোখ, যেন অনেক কথার পর একটা চুপচাপ হাত ধরা—তারা দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করে, পাশে পাশে, এবার একটু কাছাকাছি। গার্ডেনে পৌঁছে তারা অনেকটা সময় কাটায় গাছের ছায়ায় বসে, দুজনে মিলে ক্যামেরা নিয়ে পাখি দেখতে দেখতে হাসতে থাকে, ছোট ছোট পাতা হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখে, আর কথা হয়—ভাঙা, গড়া, আবার জোড়া লাগা—সব মিলিয়ে সম্পর্কটা যেন এক ধরণের বুনন, যার সুতো কখনও আলগা হয়ে যায়, কখনও শক্ত করে বাঁধা পড়ে। অনির্বাণ একটা ছোট বোনসাই গাছের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই গাছটা জানিস তো, বছরের পর বছর ধরে নিজের আকৃতি ধরে রাখে, একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করে।” মেহুলী বলল, “যেমন আমাদের সম্পর্ক—ধৈর্য দিয়ে গড়া।”
দুপুরের দিকে তারা ম্যাল রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় সেই পুরনো কাঠের চায়ের দোকানে, যেখানে তাদের প্রথম গল্প শুরু হয়েছিল এই শহরে। এবার তারা একই কাপ থেকে চা খায়, মেহুলী মাঝেমধ্যে ক্যামেরা ছেড়ে অনির্বাণের মুখের দিকে তাকায়—সে যেন একটু শান্ত, একটু মসৃণ, আগের মতো খোলামেলা না হলেও ধীরে ধীরে ভেঙে পড়া দেয়ালগুলোর ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে। বিকেলের দিকে কুয়াশা নামার শুরুতেই মেহুলী বলে, “অনির্বাণ, আমি চাই তুই তোর কষ্টগুলোও আমায় বলিস, শুধু হাসি নয়, কান্নাগুলোও ভাগ করে নিতে চাই।” অনির্বাণ ধীরে মাথা নাড়ে, তার চোখে কিছু গলছে, সে বলে, “তুই পাশে থাকলে, হয়তো পারব, খুব ধীরে হলেও।” আর সেই মুহূর্তে দার্জিলিং-এর বাতাসে যেন এক ধরণের নতুন শব্দ বাজে, এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয় দুই মন, দুই অতীত আর দুই ভবিষ্যতের মাঝখানে। দিনটা শেষ হয় চুপচাপ সানসেট পয়েন্টে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের ঢালে লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ছে, আর সেই আলোয় মেহুলী দেখছে—ভালোবাসা মানে কেবল রোমান্টিকতা নয়, বরং সেই অব্যক্ত মুহূর্তগুলোকে ধারণ করা, যা মুখে না বললেও হৃদয় বুঝে নিতে পারে।
৭
পরদিন সকালে হোটেল রিসেপশনের পাশে রাখা কাঠের ছোট্ট পোস্টবক্সে হঠাৎ করে একটি হলুদ খাম চোখে পড়ে মেহুলীর, তার নিজের নাম সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা—“মেহুলী সাহা, হোটেল সানরাইজ, দার্জিলিং।” বিস্ময়ে থমকে যায় সে, কারণ কেউ জানে না তারা এখানে এসেছে, আর চিঠির লেখাও তার অচেনা। কাঁপা হাতে খাম খুলে ভেতরের পৃষ্ঠাগুলি পড়তে শুরু করতেই তার ভেতরের নিঃশব্দ কুড়ানো স্মৃতিগুলি ঝড়ের মতো ফিরে আসে। এটা কোনও বর্তমানের চিঠি নয়, এটা যেন অতীতের এক যাত্রাপত্র—চিঠির ভাষা, অক্ষর ও সেই গন্ধ সবই যেন কোনও পুরনো দিনের। “তুমি যেখানেই যাও, আমি জানি তোমার চোখে একদিন আমার ছায়া পড়বেই… তুমি ভালো থেকো, আমার স্মৃতি নিয়ে নয়, নিজের আলো নিয়ে।” মেহুলী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কে লিখেছে, কিন্তু লেখার ধরন, আবেগ, শব্দচয়ন—সব কিছুতেই একটা প্রাক্তনের চিহ্ন স্পষ্ট। সে চুপচাপ বসে থাকে রিসেপশনের সামনে, চিঠি তার কোলের উপর, চোখে কুয়াশার মতো বিস্ময় আর মনের ভেতরে প্রশ্নের এক অন্তহীন লাইন। সেই সময় অনির্বাণ এসে পড়ে তার পাশে, দেখে মেহুলী কেমন থমকে গিয়ে বসে আছে, সে চুপচাপ জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক তো?” মেহুলী একটু ধীরে মাথা নাড়ে, চিঠি দেখিয়ে বলে, “এইটা এসেছে আমার নামে, কিন্তু প্রেরকের নাম নেই… আর আমি নিশ্চিত এটা আমার কলেজের সময়ের অরুণাভ লিখেছিল। তুই কি ভাবিস, এমনটা কীভাবে সম্ভব?”
সেদিন তাদের সব পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়, কারণ মেহুলীর ভেতরে হঠাৎ শুরু হয় এক ব্যক্তিগত অনুসন্ধান। তারা হোটেলের পুরনো রেজিস্টার দেখতে চায়, জানতে চায় গত কয়েকদিনে কেউ পুরনো কোনও চিঠি রেখে গেছে কিনা, কিন্তু রিসেপশনিস্ট কেবল একটিই তথ্য দিতে পারে—পূর্বে একজন প্রবীণ লোক এসেছিলেন, গায়ে ধুলো-মাখা কোট, হাতে কাঁপা আর চোখে মোটা চশমা, তিনি চুপচাপ খামটি রেখে চলে যান, কোনও কথাও বলেননি। এই বর্ণনা শুনে মেহুলীর মাথায় যেন একটা ঝড় বয়ে যায়—এই চেহারা অনেকটাই মেলে অরুণাভর বাবার সঙ্গে, যিনি শেষবার দেখা দিয়েছিলেন তাদের কলেজ ফেস্টে। হঠাৎ মেহুলী বুঝতে পারে—এই চিঠি কোনো সরাসরি প্রেমপত্র নয়, বরং একটা অধ্যায়ের ইঙ্গিত, যা এখনো ঠিকভাবে বন্ধ হয়নি। সে অনির্বাণকে জানায়, “আমি জানি, এটা আজকের আমাদের সম্পর্কের বাইরে, কিন্তু আমি যদি এর একটা উত্তর না পাই, তাহলে আমার মন থেকে সেটা কখনও মুছে যাবে না।” অনির্বাণ কিছু বলে না, শুধু তার মুখে একটা অব্যক্ত স্বীকৃতি—সে জানে, ভালোবাসা মানে কখনও কখনও পুরনো ছায়াদের সাথেও সহমত হয়ে চলা। তারা সিদ্ধান্ত নেয়—যতক্ষণ দার্জিলিংয়ে আছে, চেষ্টা করবে চিঠির সূত্র ধরে কিছু খোঁজ বার করতে।
সন্ধ্যায় তারা গিয়ে পৌঁছায় একটি পুরনো কাঠের বাড়িতে, যেখানে আগে ‘রাতুল সাহা’, অরুণাভর এক আত্মীয় থাকতেন, যিনি এখন একমাত্র জীবিত আত্মীয় বলে জানা যায়। রাতুলবাবু, এখন বছর সত্তরের, দরজা খুলে তাদের দেখে একটু অবাক হলেও অতিথি হিসেবে বসতে বলেন। মেহুলী সাহস করে চিঠি দেখায়, জানতে চায় অরুণাভ সম্পর্কে কিছু। দীর্ঘ নীরবতার পর তিনি বলেন, “অরুণাভ দার্জিলিং চলে এসেছিল অনেক বছর আগে, যখন শহরের কোলাহল আর মানুষের কাছ থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অনেকটা তোমার চিঠির মতোই সে নিজেকে লিখে লিখে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তারপর, হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ জানে না কোথায় গিয়েছিল, শুধু আমি জানতাম, সে তোমার নাম করে মাঝেমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলত—‘একদিন ও ফিরে আসবে, আমি জানি।’” এই কথা শুনে মেহুলীর গলা শুকিয়ে আসে, চোখের কোণ ভিজে ওঠে। অনির্বাণ তার হাত ধরে চুপ করে থাকে, যেন সে বুঝতে পারে এই মুহূর্তে কোনও শব্দ নয়, কেবল উপস্থিতি প্রয়োজন। রাতুলবাবু বলেন, “আমার ধারণা, এই চিঠি অনেকদিন আগে লেখা হয়েছিল, কিন্তু সে হয়তো কাউকে অনুরোধ করে রেখেছিল সঠিক সময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কারণ অরুণাভ সব সময় বলত—‘যদি আমি না থাকি, তাও যেন আমার লেখাগুলো পৌঁছয়।’” রাতে তারা ফিরে আসে হোটেলে, চিঠিটি মেহুলী আবার হাতে নেয়, অনির্বাণ পাশে বসে বলে, “চিঠি পৌঁছেছে, কারণ সে জানত—তুই একদিন এই শহরে ফিরে আসবি।” মেহুলী চোখ বন্ধ করে, চিঠির শব্দগুলোর ভেতর এক অতীতের আলো দেখতে পায়, আর অনির্বাণের উপস্থিতিতে সেই আলোতে একটা নতুন গল্পের সম্ভাবনা খুঁজে পায়।
৮
দার্জিলিংয়ের সেই সকালের কুয়াশা যেন মেহুলীর ভেতর জমে থাকা অজস্র প্রশ্ন আর অনির্বাণের নীরব জবাবকে ঘিরে ঘূর্ণি তোলে। আগের রাতের পর তারা দুজনেই বুঝেছিল, কিছু সম্পর্ক মসৃণ নয়, কিন্তু তারা ভেঙেও পড়ে না। তারা বেঁচে থাকে প্রশ্ন আর উত্তরের মাঝখানে, নরম আলো আর গাঢ় অন্ধকারের সীমানায়। হোটেলের বারান্দায় বসে, তারা চুপ করে চা খাচ্ছিল। কিন্তু সেই চায়ের কাপে শুধু দুধ বা চিনি ছিল না, ছিল অতৃপ্ততা, ছিল বুঝতে না পারা এক টান। অনির্বাণ বুঝছিল, তার নির্লিপ্ততা যতটা তার নিজের নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা থেকে, ততটাই তার ভয় থেকেও—ভয়, মেহুলী যদি সত্যিই তার মনটা পড়ে ফেলে? আর মেহুলী বুঝছিল, ভালোবাসা তাকে বলতে শিখিয়েছে সাহসের ভাষা, কিন্তু অনির্বাণকে বুঝতে গেলে তাকে নীরবতার ব্যাকরণ শিখতে হবে। তারা যেন দুজনেই ভুল কিতাবের পাঠ নিচ্ছিল, কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছিল একই অধ্যায়ে পৌঁছতে।
বিকেলের দিকে তারা হাঁটতে বের হলো। হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ আর রাস্তার পাশে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর হেঁটে যেতে যেতে তারা আবার নতুন করে কথা বলতে শুরু করল। এই প্রথম অনির্বাণ নিজে থেকে মেহুলীর পুরনো ব্লগ পড়ার অভিজ্ঞতার কথা বলল—কীভাবে সেই লেখাগুলো পড়ে সে একজন “অন্য রকম” মেয়েকে কল্পনা করেছিল, আর এখন সেই কল্পনার মানুষটা তার সাথেই হাঁটছে। মেহুলী হাসল, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে যেন ছিল এক নরম কান্না—কারণ সে বুঝেছিল, অনির্বাণ তাকে ভালোবাসে, কিন্তু প্রকাশের ভাষাটা আজও শিখতে পারেনি। তারা পাশাপাশি হাঁটছিল, মাঝখানে নীরবতার ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই নীরবতা আর অস্বস্তিকর নয়, বরং শান্ত—যেন দুজনেই তার মধ্যে নিজেদের মুখ দেখে নিতে পারছিল। শহরের এক কোণে বসে তারা দুজনে শেয়ার করল এক প্লেট মোমো আর এক কাপ গরম চা। চায়ের ধোঁয়ার মধ্যে মেহুলী দেখল, অনির্বাণের চোখে ভেসে আছে একটা অদ্ভুত কোমলতা, একটা নিমজ্জিত ঘর খোঁজার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
রাতে তারা একসাথে সিনেমা দেখল ল্যাপটপে, শুয়ে রইল পাশাপাশি, একে অপরকে স্পর্শ না করেও ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল দৃষ্টির ভাষায়। অনির্বাণ ধীরে ধীরে তার হাতে হাত রাখল, কিন্তু এইবার তাতে কোনো আকুতি ছিল না, ছিল স্নেহের আশ্রয়। মেহুলী প্রথমবার বুঝল, শরীর নয়, এই ছোঁয়ার মধ্যে আত্মার সাড়া রয়েছে। তারা কথা বলল না অনেকক্ষণ, কিন্তু তাদের মাঝখানের শূন্যতা যেন ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে লাগল অভিমানের পরিবর্তে এক ধরনের বোঝাপড়া দিয়ে। অনির্বাণ হয়তো এখনো ঠিক জানে না কীভাবে মেহুলীকে বলতে হয়, “আমি তোমায় ভালোবাসি,” কিন্তু তার চোখে সেই বাক্য ছিল, স্পষ্ট, নির্লিপ্ত নয়। মেহুলী অনির্বাণের কাঁধে মাথা রাখল। সেই মুহূর্তে দার্জিলিংয়ের কুয়াশা যেন তাদের দুজনের চারপাশে এক নরম পর্দা তুলে দিল—যেখানে তারা দুজনেই নিরাপদ, আর বেডরুমের বাইরে গড়ে উঠছে তাদের সত্যিকারের সম্পর্ক।
৯
পরদিন সকালে দার্জিলিংয়ের বাতাসে ছিল বিদায়ের একটা অদৃশ্য গন্ধ, যেন পাহাড় জানত তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে। মেহুলী ধীরে ধীরে জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল, আর অনির্বাণ জানালার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল—তার মুখে সেই পরিচিত নীরবতা, যার অর্থ বোঝা সহজ নয়। মেহুলী অনেকবার তাকাল তার দিকে, কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শব্দ যেন ঠোঁটে আসার আগেই থেমে যাচ্ছিল। পাহাড়ে কাটানো এই কয়েকটা দিন তাদের মধ্যে এক অলক্ষ্য সেতু গড়ে তুলেছিল, যা দৃশ্যমান না হলেও স্পষ্ট অনুভব করা যায়। কিন্তু সেই সেতুতে এখন যেন একটা হালকা ফাটল, কারণ বিদায় মানে সবসময় “ফিরে আসা” নয়। ট্রেন ধরার সময়টা যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল, আর তার সাথে বাড়ছিল একটা অব্যক্ত চাপা কষ্ট। মেহুলী বুঝছিল, এই পাহাড়ে তারা একে অপরের ভেতর একটু একটু করে প্রবেশ করেছিল, আর এখন আলাদা হতে হবে সেই প্রবেশাধিকার হারিয়ে। অনির্বাণের চোখে ছিল একটা অনিচ্ছা, কিন্তু সে তা প্রকাশ করছিল না, যেন কোনও দায় এড়াতে চায়—না অনুভূতির, না সম্পর্কের।
ট্যাক্সির মধ্যে বসে শহরকে পেছনে ফেলে রাখার সময় মেহুলী একটা শেষবারের মতো চেয়ে দেখল পাহাড়ের দিকে—যেখানে তারা হাঁটেছিল, কথা বলেছিল, চা খেয়েছিল, নীরবে বসেছিল। প্রত্যেকটা জায়গা যেন তার মনের ভিতরে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে। অনির্বাণ পাশেই ছিল, কিন্তু তাদের মাঝখানে সেই পুরনো দূরত্ব ফিরে এসেছিল—এবার আর অচেনা নয়, বরং খুব চেনা, খুব সত্যি। হাওড়ার ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো, আর গার্ড বাঁশি বাজিয়ে দেওয়ার আগের মুহূর্তটা যেন অনেক বড় হয়ে উঠল। মেহুলী জানত, কিছুই বললে অনির্বাণ থেমে যাবে না, কারণ সে কিছু শুনতেও প্রস্তুত নয়। কিন্তু সে চুপ থাকলেও, তার চোখে চোখ রাখার ভেতরে মেহুলী তার ভেতরের দোলাচল দেখতে পাচ্ছিল। অনির্বাণ তাকে ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল শুধু, “ভালো থেকো।” মেহুলী কিছু বলল না, শুধু হালকা মাথা নেড়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু তার মনে চলছিল এক দীর্ঘ সংলাপ—যা কখনও বলা হয়নি, শুধু অনুভবের মধ্যে বেঁচে থাকে।
ট্রেন যখন গতি পেল, মেহুলী জানালার ধারে বসে দূরত্বকে গুনছিল—শুধু মাইল দিয়ে নয়, অনুভব দিয়ে। অনির্বাণ জানত, সে একজনকে হারাচ্ছে, যে তার অনেক আগে থেকেই ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। সে দাঁড়িয়ে দেখছিল ট্রেনটা দূরে চলে যাচ্ছে, আর তার ভিতরে যেন কেউ চিৎকার করে বলছে, “থেমে যাও,” কিন্তু ঠোঁট কিছু বলছে না। এই দুরত্বটা কখন তৈরি হলো, কে জানে—হয়তো প্রথমদিনেই, যখন তারা বুঝেছিল, তারা দুজন দুই রকমের মানুষ। কিন্তু তারা দুজনেই জানত, সেই ভেদরেখার মাঝে কিছু অভিন্নতা গড়ে উঠেছিল, যা খুব সহজে মুছে ফেলা যায় না। পাহাড় আর মেঘের শহরটাকে তারা পেছনে ফেলে চলে গেল, কিন্তু দার্জিলিং যেন তাদের হৃদয়ের ভেতরে রয়ে গেল—একটা অসমাপ্ত কবিতা হয়ে, যার শেষ লাইনটা কেউ লেখেনি, শুধু অনুভব করেছে।
১০
কলকাতায় ফিরে আসার পর মেহুলীর দিনগুলো কেমন যেন নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল। দার্জিলিংয়ের স্মৃতি, পাহাড়ের সেই কুয়াশামাখা পথ, সেই নির্জন বেঞ্চ আর অনির্বাণের চোখের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না সে। অফিসের টেবিলের সামনে বসে থেকেও তার মন ছুটে যেত সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে, যেখানে একান্ত কিছু মুহূর্তে তারা মুখ না খুলেও অনেক কথা বলেছিল। মেহুলী ভাবত, এই সম্পর্কটার কোনও নাম দেওয়া সম্ভব ছিল না—এটা প্রেম ছিল, না অল্প সময়ের এক গভীর সংযোগ, কেউ জানত না। কিন্তু যা ছিল, সেটা নি:সন্দেহে বাস্তব এবং বেদনাদায়ক। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে বারবার ফিরে যেত সেই শেষ ট্রেনযাত্রায়, যেখানে অনির্বাণের “ভালো থেকো” শব্দটা কানে বাজত অনেক গভীর অর্থে। শহরের কোলাহলে ফিরে এসেও তার ভেতরকার নিঃশব্দ কথোপকথন থামেনি—যেন মনে হচ্ছিল, কোনও কিছু বলা হয়নি, কিছু রয়ে গেছে জমে। সে জানত, সম্পর্কগুলো সবসময় কোন পরিণতির জন্য হয় না, অনেক সময় শুধু অনুভব করাই যথেষ্ট।
দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে হঠাৎ একদিন সে নিজের ফ্ল্যাটে চিঠির খাম পায়—সাদা খামে, হাতে লেখা, প্রেরকের নামহীন। ভেতরে একটিই কাগজ—অনির্বাণের হাতে লেখা একটি চিঠি। তার হাত কেঁপে উঠল, বুকের ভেতর যেন অনির্বাণের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। চিঠিতে লেখা ছিল, “মেহুলী, আমি জানি, তুমি এখনো মনে করো আমি কেন কিছুই বলিনি সেই দিন, কিন্তু আমি শুধু নিজেকে সাহস করে দাঁড়াতে পারিনি তোমার সামনে। পাহাড়ের সেই দিনগুলোতে আমি প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করেছিলাম যে, তুমি আমার ভিতরের এক শূন্য জায়গা পূরণ করছ, কিন্তু ঠিক সেই জায়গাতেই আবার ভীষণ ভয়ও ছিল—হারানোর, ভুল বোঝার, কিংবা আবার একা হয়ে যাওয়ার। আমি চাইনি তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে, যার ভিতরে আমি নিজেই এখনও অন্ধকারে। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর বুঝলাম, সেই ভয়টাই তো আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আমি জানি না তুমি আবার যোগাযোগ করবে কিনা, আমি জানি না তুমি এখনও এই অনুভূতিকে মনে রেখেছ কিনা, কিন্তু আমি তোমায় জানাতে চেয়েছিলাম—তোমার উপস্থিতি আমার জীবনটাকে নরম করে দিয়েছে। যদি কোনোদিন আবার দেখা হয়, আমি হয়তো তখনও চুপ থাকব, কিন্তু আমার চোখে তুমি হয়তো সেই অনন্ত কবিতাটা পড়ে নিতে পারবে, যা আজও অসমাপ্ত।” এই চিঠির শব্দে মেহুলীর চোখ জলে ভিজে গেল, আর মনে হচ্ছিল, তার জীবনে আবার কোনও ধ্বনি ফিরে এসেছে—যা হারিয়ে গিয়েছিল বিদায়ের ট্রেনের শব্দে।
চিঠিটা পড়ার পরের দিনগুলোতে মেহুলী যেন একটু একটু করে আবার নিজের ভেতরের আলোকে ফিরে পেল। সে বুঝতে পারল, কিছু সম্পর্ক প্রশ্ন রাখে, কিছু উত্তর দেয় না, তবু সেগুলো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকে। সে সিদ্ধান্ত নিল অনির্বাণকে কোনও উত্তর দেবে না, কারণ উত্তর সবসময় শব্দে হয় না, অনেক সময় তা শুধু অনুভবে হয়। সে সেই চিঠিটা একটা সাদা খামে ভরে নিজের ডায়েরির মাঝে রেখে দিল—যেন এক দিন সে নিজেই আবার সেই চিঠিটার মধ্যে ফিরে যেতে পারে, অনুভব করতে পারে সেই পাহাড়ের বাতাস, সেই নীরবতা, সেই চোখের ভাষা। কয়েকদিন পর সে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে দেখল—শীত আসছে। তার মন বলল, হয়তো আরেকবার দার্জিলিং যাওয়া যায়, কিন্তু এবার শুধু পাহাড় নয়, সেই বেঞ্চ, সেই পাইন গাছ, সেই নৈঃশব্দ্যের কাছে। গল্পটা আবার শুরু হবে কিনা, জানা নেই, কিন্তু তার হৃদয়ের শেষ পাতায় ‘শেষ চিঠি’ নামের এই অধ্যায়টা ঠিকই থেকে যাবে—চিরকাল।
সমাপ্ত