Bangla - ভূতের গল্প

বৃষ্টির রাতে বউমা

Spread the love

বৃষ্টির রাত। এমন এক বৃষ্টি, যা যেন শুধু রাতের নীরবতা চুরমার করে দিতে আসে। সরলা দেবী জানালার পাশে বসে পুরনো কাঠের দোলনায় আস্তে আস্তে দুলছেন। তাঁর সামনে ছোট টেবিলে রাখা একটি মাটির প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে, এবং তার পাশে রাখা একটি ফ্রেম করা ছবি—অমিতের, তাঁর একমাত্র ছেলে, যিনি গত তিন বছর আগের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখনো সেই দিনটার কথা ভাবলে সরলার বুকের মধ্যে একধরনের ঠান্ডা ঢেউ খেলে যায়। ছেলের শেষ জন্মদিনের সময় তোলা ছবি—চোখে হাসি, মুখে আত্মবিশ্বাস, যেন বলছে, “মা, আমি আছি তো!” অথচ সেই হাসির পেছনে কি লুকিয়ে ছিল কোনো গোপন কথা? কিছুদিন ধরে সরলার মনে একটা খচখচে সন্দেহ কাজ করছিল—অমিত কি কিছু লুকোচ্ছিল? তবে সে তো এমন ছেলে নয়… সরলা বিশ্বাস করেন, ছেলে তাঁকে কখনো ঠকাতে পারে না। সেই বিশ্বাসেই তো তিনি এই তিন বছর কাটিয়েছেন একা, সেই পুরনো লাল ইটের খুপরি বাড়িতে, যেখানে প্রতিটা ঘরের দেয়াল এখনো ছেলের গন্ধে মেশা।

বৃষ্টি একটু একটু করে আরও ঘন হয়ে উঠছে। বাইরে ঝমঝম শব্দে চারপাশ যেন এক ছন্দে নেচে উঠেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎ দরজায় টুক টুক টুক শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো গাছ থেকে কোন শাখা পড়ে গেল, কিংবা বাতাসে জানালার পাল্লা ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু না, এবার স্পষ্ট শব্দ—দরজায় কেউ নক করছে। এত রাতে, এমন বৃষ্টির মধ্যে? কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার দিকে এগোলেন সরলা দেবী। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কুকুর ‘ভোলা’ বিকটভাবে ঘেউ ঘেউ করে উঠল, তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কান খাড়া করে বসে রইল। দরজায় কপাট লাগানো, কিন্তু তলার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল একজোড়া পা—ভিজে শাড়িতে ঢাকা, খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। সরলা ধীরে ধীরে দরজা খুললেন, আর ঠিক তখনই একটা বজ্রপাত আকাশ ফুঁড়ে নামল, আলোয় মুহূর্তের জন্য চেহারাটা দেখা গেল—একটা মেয়ের, বয়স ২৫-২৬, চোখে জল, ঠোঁটে ফিসফিসে কণ্ঠ, “আমি অমিতের স্ত্রী, অনামিকা। আমাকে চিনতে পারলেন না?” সরলা দেবী প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সেই মূহূর্তে যেন তাঁর বুক ধড়ফড় করে উঠল, মুখ শুকিয়ে গেল। এই নাম, এই দাবি—সব কিছু যেন এক বিশ্রী স্বপ্নের মত। অমিত তো কখনো বলেনি, সে বিয়ে করেছে! আর সে তো মারা গেছে তিন বছর আগে! তাহলে এই মেয়ে কে? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির শরীরটা ভিজে, মুখে করুণ এক অভিব্যক্তি—তবে সবচেয়ে বেশি কাঁপিয়ে দিল যে জিনিসটা, তা হল তার গলায় ঝোলানো অমিতের ছবিওয়ালা লকেট। সেই একই ছবি, যা এখনো সরলার পুজোর ঘরে রয়েছে।

মেয়েটিকে ভিজতে দেখে আর কিছু ভাবতে পারলেন না সরলা। হয়ত পাগল, কিংবা ভুল করছে—কিন্তু এত রাতে মেয়েটিকে বাইরে রাখাও অন্যায়। তিনি তাকে ঘরে ডেকে আনলেন। অনামিকা ভিজে শাড়ি বদলাল, পুরনো একটা কম্বলের নিচে বসে কাঁপতে কাঁপতে চা খাচ্ছিল। সে বলল, “আমি অনেক খুঁজে আপনাদের বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। অমিত আমাকে বিয়ের সময় বলেছিল, মাকে চমক দেব, কিন্তু তারপরই…” সে হঠাৎ থেমে গেল। চোখদুটো নিচের দিকে নামিয়ে বলল, “আপনার ছেলে আমাকে খুব ভালোবাসত। আমাদের বিয়ে হয়েছিল মুম্বইতে। কিন্তু দুর্ঘটনার দিন ও ফোন করেছিল—বলে, এবার মা-র সঙ্গে দেখা করতে যাব, সব জানিয়ে দেব। আমি অপেক্ষা করছিলাম… এরপর খবর এল… ও আর ফিরল না।” সরলা নির্বাক। তাঁর বুকের মধ্যে একটা কিছু চুপচাপ ভেঙে পড়ল। এতদিন তিনি জানতেন, অমিত শুধু তাঁর ছিল, তাঁর ছায়ায় বড় হওয়া ছেলেটি এমন কিছু করতেই পারে না—কিন্তু এখন? এই মেয়ের চোখে যে যন্ত্রণাটা, সেটা তো সাজানো নয়। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—সে এতদিন কোথায় ছিল? কেন অমিত কিছু বলেনি? সবচেয়ে ভয়ের কথা—সে যে রাতে এল, ঠিক সেই রাতে আবার ভোলাও আচরণ করল অদ্ভুতভাবে—মেয়েটিকে দেখে প্রথম吠ালেও পরে থেমে গিয়ে কাঁপতে থাকে। ঘরের বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল, দেয়ালের পুরনো ফ্রেমগুলো থেকে ধুলোর গন্ধের বদলে একধরনের অজানা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মেয়েটির চোখে গভীর বিষাদ, কিন্তু মাঝেমাঝে তার চোখের কোণে এমন এক আলো ফুটে ওঠে—যা এক মায়ের মনে সন্দেহের বীজ বুনে দেয়।

সকালবেলা বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের মুখ ভার। সরলা দেবী ঘুম থেকে উঠে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের কাদামাটির রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে জল ঝরছে। অথচ তাঁর মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। গত রাতের ঘটনাটা যেন এখনো কোনো দুঃস্বপ্নের মতো। ‘বউমা’—এই শব্দটা তাঁর জীবনে এতটা হঠাৎ করে, এতটা অলক্ষ্যে ঢুকে পড়বে, সেটা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি। মেয়েটি এখনো ঘুমাচ্ছে, দালানের কোণের ঘরটায়। ঘরের ভেতর ঢোকার পর সে আর কোনো প্রশ্ন করেননি। কিন্তু আজ সকাল থেকে একটার পর একটা প্রশ্ন তাঁকে পেয়ে বসেছে—অমিত কি সত্যিই এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিল? কেন বলেনি কিছু? আর যদি বলেই থাকে, তাহলে এই তিন বছর মেয়েটি কোথায় ছিল? নিজের মতো করে হয়তো একবার এই মেয়ের মুখোমুখি বসে সব কথা জেনে নেওয়া দরকার, ভাবলেন সরলা। কিন্তু তার আগে তিনি চান প্রফুল্ল কাকার সঙ্গে একটু কথা বলতে—এই পাড়ার সবচেয়ে পুরনো মানুষ, যাঁর স্মৃতি শক্তি এখনো টনটনে, এবং যিনি অনেক আগেই বলেছিলেন, “অমিত তো শহরে গিয়ে নতুন জীবন গড়েছে, হয়তো কিছু লুকোচ্ছে রে।”

চায়ের কাপ হাতে প্রফুল্ল কাকার কাছে গেলেন সরলা দেবী। কাকা খড়ি দিয়ে একটা হুক্কা সাজাচ্ছিলেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে কাশি দিয়ে বললেন, “কি বলো তো, বউমা বলছো! আমি তো রাতেই দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু তার মুখ আমার কোথায় যেন আগে দেখা মনে হচ্ছে।” এই কথাটাই বেশি নাড়া দিল সরলাকে। “মানে? আপনি কি ওকে আগে কোথাও দেখেছেন?” কাকা মাথা নাড়লেন, “পুরোপুরি নিশ্চিত নই। কিন্তু সেই বছরখানেক আগে, থানা মোড়ের পাশে এক মেয়েকে কাঁদতে দেখেছিলাম—একদম ছিন্নভিন্ন চেহারা, চোখে অদ্ভুত ফাঁকা ভাব, মুখে বলছিল, ‘আমার স্বামী হারিয়ে গেছে।’ পরে পুলিশ এসে তাকে কোথায় যেন নিয়ে গেল।” কাকার কথা শুনে সরলার গায়ে কাঁটা দিল। তিনি কোনো কথা না বলে বাড়ি ফিরে এলেন। বউমা তখন উঠেছে। তাঁর গায়ে সেই সরলার দেওয়া শাড়ি, চুল বেঁধে ছাদে শুকাতে দিয়েছে কাপড়। খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলল, যেন এই বাড়িতেই জন্মেছে। বলল, “চা করে দিচ্ছি মা, আপনি একটু বিশ্রাম নিন।” মা—এই শব্দটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য সরলার চোখ ছলছল করে উঠল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভিতরকার অস্বস্তিকে ঠেলে সরিয়ে বললেন, “তোমার বাড়ি কোথায়, অনামিকা? আগে কি কখনো এখানে এসেছিলে?” অনামিকা হাসল, “অমিতের মুখে এতবার এই বাড়ির কথা শুনেছি, যেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতাম। কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম।” সে থেমে গিয়ে বলল, “আমার বাড়ি বর্ধমানে ছিল, বাবা-মা কেউ নেই, তাই অমিত-ই ছিল আমার সব।” সরলা কিছু বললেন না, কিন্তু ভেতরে একটা অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল—মেয়েটির কথা যেমন যুক্তিসংগত, তেমনই আবার কোথাও যেন একটু বেশি গুছানো।

সন্ধ্যা নামার কিছু আগেই ঘটনা ঘটল। সরলা দেবী তখন ঠাকুরঘরে বসে সন্ধ্যার পুজো করছেন, অনামিকা রান্নাঘরে। হঠাৎ একটা শব্দ—ঠাকুরঘরের পাশে রাখা কাঠের আলমারির দরজা আপনা থেকেই খুলে গেল। কোনো বাতাস ছিল না, কোনো নড়াচড়া ছিল না, কিন্তু দরজাটা ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে খুলে গেল। সরলা ভয় পেয়ে উঠলেন, তবু উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলেন। ঠিক তখনই আবার সেই কুকুর ‘ভোলা’—যে সারাদিন চুপ করে ছিল, হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল, এবং তারপর ছুটে গেল অনামিকার ঘরের দিকে। ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দাঁত বের করে গরগর করতে লাগল। অনামিকা তখন একা বসে ছিল, কিন্তু তার চোখ ছিল জানালার বাইরে, মুখে হালকা হাসি। সে ধীরে ধীরে ঘুরে সরলার দিকে তাকাল, আর বলল, “ভোলা তো আমাকে চিনতেই পারছে না, তাই ভয় পাচ্ছে। একসময় ও আমায় খুব ভালোবাসত।” এই কথাটা কানে যেতেই শরীর হিম হয়ে গেল সরলার। ভোলা তো অমিত মারা যাওয়ার এক মাস পর আনা কুকুর—তাহলে সে কীভাবে ওকে চিনত? মেয়েটা কী বলল এখন? সরলা কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু তার ভেতর ভয় জমাট বাঁধতে লাগল। ভোলাও তখনো থেমে থেমে গরগর করছে, আর অনামিকা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে কুকুরটার দিকে। রাতে খাওয়ার সময় মেয়েটা জানাল, সে অমিতের সমস্ত চিঠি আজও রেখে দিয়েছে, তার ব্যাগে আছে, সকালে দেখাবে। কিন্তু সারারাত, ঘরের দেয়াল ধরে ধরে, সরলা শুধু একটা শব্দ শুনলেন—ছায়ার পায়ের শব্দ, ভেজা পায়ের আওয়াজ, যেন কেউ চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে… আর মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে—একটা ফিসফিসে স্বর, ঠিক যেভাবে অনামিকা বলেছিল—”আমি ফিরে এসেছি… এইবার চিরতরে…”

পরদিন সকালটা কুয়াশায় ঢাকা ছিল, যেন চারপাশের প্রকৃতি কিছু গোপন সত্য আড়াল করতে চাইছে। সরলা দেবী খুব ভোরে উঠে পুকুরের ধারে বসে ছিলেন। মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছিল। গত রাতের ছায়ার পায়ের শব্দ, অনামিকার মুখে অদ্ভুত সব কথা—সব মিলিয়ে যেন বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝখানে দুলতে থাকা এক অদৃশ্য দড়ির উপর হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। সকালে অনামিকা রান্নাঘরে ঢুকে আবার হাসিমুখে বলল, “আজ আপনার প্রিয় লাউঘন্টা বানাবো মা। মনে আছে, একবার অমিত বলেছিল আপনার প্রিয় রান্না কোনটা?” সরলা চমকে উঠলেন। কথাটা ঠিক, একদিন অমিত তাঁকে বলেছিল, “মা, আমি যেখানে থাকি না কেন, তোমার লাউঘন্টার স্বাদ আর কোথাও পাই না।” কিন্তু সেটা তো অনেক আগে… অনামিকা কি করে জানে এইসব? সরলা প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু আবার ভাবলেন, হয়ত অমিত বলেছিল তাকে… হয়ত।

কিছুক্ষণ পর অনামিকা ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগ থেকে বের করল কয়েকটা কাগজ—চিঠি। “এই নিন মা, অমিতের হাতের লেখা। আমাদের বিয়ের পর, যখন ও বাইরে যেত, আমাকে এসব চিঠি লিখত। আমি সব রেখে দিয়েছি।” সরলা জড়ানো হাতে চিঠিগুলো নিলেন। অমিতের হাতের লেখা—সেই আঁকাবাঁকা, বাঁ দিকে হেলে যাওয়া অক্ষরগুলো তিনি এক ঝলকেই চিনে ফেললেন। প্রতিটি চিঠিতে রয়েছে প্রেম, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, এমনকি সরলার কথা—”অনামিকা, একদিন তোমাকে আমার মায়ের সঙ্গে বসিয়ে লাউঘন্টা খাওয়াবো, তখন তুমি বুঝবে ও কতটা সহজ মানুষ।” এই লাইনটা পড়ে সরলার বুকের ভেতর মোচড় দিল। এই মেয়েটা তাহলে সত্যিই ছিল অমিতের জীবনে? তাহলে কেন অমিত একবারও বলেনি মায়ের কাছে? আর এই চিঠিগুলো যদি সত্যিই ওর, তাহলে একটাই প্রশ্ন—এই মেয়েটি এতদিন কোথায় ছিল? এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, এক চিঠির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা, “আমার ভয় করে, মা জানলে কি তুমি থাকবে আমার পাশে? নাকি আমায় ছেড়ে দেবে? আমি জানি মা ভীষণ একা…” এর পর আর কিছু লেখা নেই—শুধু একটা দাগ, যেন কলমটা হঠাৎ থেমে গেছে, কিংবা ছিঁড়ে গেছে কিছু।

চিঠি পড়া শেষ করেই সরলা বুকের ভেতর ধড়ফড় শব্দ অনুভব করলেন। তিনি জানেন, এসব চিঠি যদি অমিতের, তবে অনামিকা মিথ্যা বলছে না। কিন্তু কেন, কেন এই মেয়ে এতদিন কিছু বলল না? আর এমন সময়েই আবার সেই পা টিপে টিপে হেঁটে চলার শব্দ, ভেজা পায়ের ছাপ, যা গত রাতে এসেছিল—আজ আবার দিনের আলোতেই সেই আওয়াজ। সরলা আচমকা জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ছাদ থেকে ভেজা কাপড় নিচে নামিয়ে আনছে অনামিকা। অথচ তার পায়ের নিচে ভিজে মেঝেতে পড়ছে গাঢ় জলরঙের ছোপ ছোপ দাগ, যেন কোনো মৃত শরীর সরে সরে হেঁটে যাচ্ছে। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না—ভেতরে গিয়ে বললেন, “অনামিকা, তুমি কোথায় ছিলে তিন বছর? কেন আসলে এখন?” মেয়েটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “অমিত বলেছিল, সময় আসলে আমি যেন মায়ের কাছে ফিরে আসি। মা-ই আমাকে চিনে নেবে। মা-ই জানবে, কে সত্যি… কে নয়।” সে হঠাৎ আবার পেছন ফিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল, যেন কারো সঙ্গে কথা বলছে না, বরং আকাশে ঝুলে থাকা কোনও ছায়ার সঙ্গে কথা বলছে। আর তখনই সরলার মনে পড়ে গেল সেই কফিনের মুখ—অমিতের নিথর মুখ, চোখ বন্ধ, কিন্তু ঠোঁটে চাপা একটা হাসি… এমন হাসি যা যেন কিছু লুকিয়ে রাখে চিরতরে। সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠল, আর জানালার পর্দা যেন নিজে থেকেই নড়ে উঠল। কোথাও একটা ধ্বনি—দীর্ঘশ্বাসের মত, না কি ফিসফিস করা কথা—যেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না, কিন্তু মনে হল যেন কানে ভেসে এল, “ও চলে আসবে মা… ওর প্রতীক্ষা করো…”

দিন যত গড়াতে লাগল, অনামিকার উপস্থিতি যেন সরলা দেবীর চারপাশের বাস্তবতাকে একটা নতুন ছাঁচে ফেলতে লাগল। মেয়েটি ঠিকমতো রান্না করে, সরলা দেবীর জন্য মাথা টিপে দেয়, এমনকি পুজোর থালাও সাঁজিয়ে দেয় সকালে—যেন বছরের পর বছর ধরে এই বাড়ির বউমা সে-ই। কিন্তু এই ঘর, এই উঠোন, এই চৌকাঠ—সব কিছুর সঙ্গে তার এমন সহজ সংযোগে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা জমে ওঠে, যেন সে সব কিছু আগেই জানত। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে সরলার, যখন মেয়েটি একদিন নিঃশব্দে অমিতের ঘরে গিয়ে একটা পুরনো কাগজের বাক্স বের করে বলল, “এটা তো ওর কলেজের সময়কার স্ক্র্যাপবুক, তুমি রেখেছিলে না মা?” সরলা অবাক হয়ে তাকান। সেই বাক্সটা তো তিনি নিজেই লুকিয়ে রেখেছিলেন আলমারির পিছনে, কাউকে না জানিয়ে! এবার সরলা আর থাকতে পারেন না। মনস্থির করেন, তিনি একবার অমিতের পুরনো বন্ধুকে ফোন করবেন—বিশ্বজিৎকে, যে এখন কলকাতায় চাকরি করে। বিশ্বজিৎ তো অমিতের জীবনের সবকিছু জানত। তিনি হালকা কাঁপা হাতে ফোনটা নিলেন।

বিশ্বজিতের কণ্ঠস্বর ভেসে এল ফোনে, একটু ধরা, একটু বিব্রত। “আন্টি… আপনি… এতদিন পর?” সরলা সরাসরি বললেন, “বিশ্বজিৎ, তুমি কি জানো, অমিত বিয়ে করেছিল?” ফোনের ওপাশে দীর্ঘ নীরবতা। তারপর বিশ্বজিত বলল, “আন্টি, আপনি যদি জানতে চান সত্যি কথা, তাহলে হ্যাঁ—অমিত বিয়ে করেছিল। খুব গোপনে, কারণ উনি ভয় পেতেন আপনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে। মেয়েটির নাম ছিল অনামিকা, বেশ ভালো মেয়ে। কিন্তু…” “কিন্তু কী?” — সরলার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। বিশ্বজিত ধীরে ধীরে বলল, “দুর্ঘটনার দিন আসলে… ওরা দুজনেই ছিল গাড়িতে। শুধু অমিতের মৃত্যু হয়নি আন্টি, অনামিকাও… মারা গিয়েছিল।” সেই মুহূর্তে যেন সময় থেমে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। ফোনটা হাত থেকে পড়ে যেতে যেতে কোনোক্রমে ধরে ফেললেন সরলা। “তুমি কী বলছ? মেয়ে তো আমার ঘরে আছে এখন!” বিশ্বজিত স্তব্ধ, কণ্ঠে ভয়—“না না আন্টি, আপনি হয়ত কাউকে ভুল করছেন। বা…” আর কিছু বলেনি সে। ফোনটা কেটে গেল। সরলা চুপ করে বসে থাকলেন। চোখের সামনে ভেসে উঠল মেয়েটির হাসিমুখ, তার হাতের স্পর্শ, রান্নাঘরের ধোঁয়া… কিন্তু এ কী করে সম্ভব? তবে কি…?

সন্ধ্যায় অনামিকা ঘরে ঢুকে আবার সেই স্বাভাবিক গলায় বলল, “মা, আজ আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাবো। ছোটবেলায় আমি মা-র গায়ে মাথা রেখে ঘুমোতাম, মনে হয় আজ তোমার কোলটাই দরকার।” সরলা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। চুপচাপ মাথা নেড়ে বলেন, “এসো।” সেই রাতে দুজন পাশাপাশি ঘুমাতে গেলেও সরলার চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই। মাঝরাতে ঘুমের ভান করে তিনি অনুভব করলেন, মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে, জানালার দিকে হাঁটছে। জানালার পর্দা তুলে দাঁড়িয়ে থেকে সে যেন কারো সঙ্গে কথা বলছে। তারপর সে বলল, খুব আস্তে—“আর কিছুক্ষণ, তারপর আমি নিয়ে যাব ওকে… মা তো সব জেনে গিয়েছে এখন…” সরলার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি হঠাৎ চোখ মেলে চিৎকার করে উঠলেন, “তুমি কে? কে তুমি? অনামিকা তো তিন বছর আগেই মরেছে!” মেয়েটি ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল। মুখে সেই চেনা মিষ্টি হাসি, কিন্তু চোখে অন্ধকার। বলল, “জীবনের থেকেও গভীর যে সম্পর্ক, তার বাঁধন তো মৃত্যুও কাটতে পারে না মা… আমি এসেছি… শুধু অমিতের কথা রাখতে।” তারপর সে একপা একপা করে এগিয়ে আসে… সরলা ধীরে ধীরে পিছোতে থাকেন… হৃদয়ের গতি থেমে যাচ্ছে যেন… আর ঘরের চারপাশে বাজতে থাকে একটা অদ্ভুত সুর… যেন মৃত কারো পায়ের ঘুঙুর, আর সেই ছায়ার ছন্দময় কান্না…

পরদিন সকালেই সরলা দেবী উঠেই স্থির করেন—আর নয়। এতদিন ধরে যেটা তিনি নিজের মনকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, আজ সেটা ভেঙে পড়েছে। মেয়েটি যতই ‘বউমা’ হয়ে উঠুক, যতই ঘরের প্রতিটি কোণ তার ছায়ায় জড়িয়ে পড়ুক, তবু একটা অদৃশ্য ভয় সরলার বুকের গভীরে জমে উঠেছে। বিশ্বজিৎ তো স্পষ্ট বলেছে—অনামিকাও মৃত। তাহলে এই যে অনামিকা, যে সারাদিন পাশে থেকে কথা বলে, রান্না করে, ছেলেকে স্মরণ করে, রাতের নিস্তব্ধতায় জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে অজানা কারো সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে—সে কে? সে কীভাবে জানে সরলার লুকোনো জিনিস, পুরনো বাক্স, ঘরের অলিখিত রীতিনীতিগুলো? না, আর নয়—আজই তিনি যাবেন থানায়, যাবেন অমিতের মৃত্যুর রেকর্ড খুঁজতে, যাবেন সেই হাসপাতালে, যেখানে ওদের দুজনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এক কাপ চা নিয়ে তিনি ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর পিছন থেকে অনামিকার গলা এল, “মা, আজ তো আপনি আমাকে কিছু বলেননি। কিছু হয়েছে?” মেয়েটির কণ্ঠে উদ্বেগের ছোঁয়া, কিন্তু সেই উদ্বেগ যেন কাচের মতো—টলটলে, স্পষ্ট, তবু ঠান্ডা। সরলা হেসে বললেন, “না, একটু বেরোবো। তুমি বাড়ি সামলাও। ফিরে এসে কথা বলবো।” অনামিকা মাথা নাড়ল, তবু চোখে সেই একই শীতল ছায়া।

থানায় গিয়ে পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে সরলা নিশ্চিত হলেন—হ্যাঁ, দুর্ঘটনার দিন দু’টি মৃতদেহই এসেছিল—অমিত চক্রবর্তী এবং অনামিকা সেন। মৃত্যুর সময় দুজনের নাম একসঙ্গেই নথিভুক্ত হয়েছে, পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী অনামিকার মাথায় গুরুতর চোট ছিল, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছিল। তারপর মরদেহ হস্তান্তর করা হয় তার মামার হাতে—যিনি থাকেন হাওড়ায়। সরলা মাথা ঘুরতে ঘুরতে বেঞ্চে বসে পড়লেন। তিন বছর আগে, এই সময়টাতেই তিনি শোকে ঘরবন্দি ছিলেন, আর সেই সময়, সেই ক্ষত তার হৃদয়কে এতটাই অসাড় করে দিয়েছিল যে, কেউ মারা গেলেও তিনি আর খোঁজ নেননি, বিশ্বাস করেছিলেন শুধু অমিত নেই, এটাই যথেষ্ট। এখন মনে হচ্ছে, সেই শোকই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অন্ধকার—সেই শোকের আড়ালেই কেউ ফিরে এসেছে। হাওড়া গিয়ে অনামিকার মামার বাড়ি খুঁজে পেলেন তিনি অনেক খোঁজাখুঁজির পর। সেখানে গিয়ে তিনি যেটা জানলেন, তা যেন তাঁর হৃদয়ে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল। অনামিকার মামা বললেন, “হ্যাঁ, আমরা ওর শরীরটা সৎকার করেছিলাম। কিন্তু… জানেন তো, শেষকৃত্যের সময় হঠাৎ আগুন নিবে যাচ্ছিল বারবার। এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, যেন সে যেতে চাইছে না… যেন কিছু অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।” সরলা স্তব্ধ। “আপনারা কখনো ওই মেয়েকে আবার দেখেছেন?” প্রশ্ন করলেন তিনি। বৃদ্ধ চুপ করে থেকে বললেন, “দুইবার। একবার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, একবার সিঁড়ির নিচে বসে। ওর মা-বাবার ছবির সামনে বসে ছিল, গায়ে সাদা শাড়ি, পায়ে খালি, মুখে জলভেজা হাসি… তার পর আর না। আমরা চলে যাই বাড়ি থেকে।”

সন্ধ্যায় ফিরে এসে বাড়ির গেট খুলেই সরলা দেখলেন, অনামিকা উঠোনে বসে রয়েছেন, হাতে একটুকরো পুরনো কাপড়—যেটা ছিল অমিতের। তাঁর গালে হালকা কান্নার রেখা, চোখদুটো লাল। সরলা কিছু না বলেই এগিয়ে গেলেন, অনামিকার পাশে বসলেন। চুপ করে বললেন, “তুমি জানো না তো, কদিন ধরে আমি কতটা দোটানায় আছি… একটা মা, তার ছেলে আর একটা অজানা ছায়ার মাঝখানে কিভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখবে?” অনামিকা মুখ তুলল। “আমি ফিরে এসেছি, কারণ অমিত আমায় অপেক্ষা করতে বলেছিল। ও বলেছিল, মা একদিন আমাকে চিনে নেবে। আমি এসেছি সেই প্রতীক্ষা নিয়ে।” সরলা এবার আর লুকোতে পারলেন না। বললেন, “কিন্তু তুমি তো মারা গিয়েছিলে, অনামিকা। তুমিও জানো সেটা। তুমি… কি সত্যিই শুধু অপেক্ষা করতে এসেছো?” মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারে মুখটা অদ্ভুত ঠান্ডা দেখাল। “যদি কেউ ভালোবাসায় বাঁধা থাকে, তবে কি মৃত্যু তাকে থামাতে পারে মা?” তারপর সে ধীরে ধীরে অমিতের ঘরের দিকে চলে গেল, দরজাটা খুলে ঢুকে গেল। আর সেই মুহূর্তে দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে শুধু একটা আওয়াজ ভেসে এল—একসাথে দুটি কণ্ঠ, এক পুরুষ, এক নারী, একসাথে বলছে—“এইবার আমরা সম্পূর্ণ…” ঘর নিস্তব্ধ, বাতাস ঠান্ডা, ঘরের কোণে রাখা অমিতের ছবিতে হালকা ফাটল। সরলা কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, জানেন… বৃষ্টির রাতে যেই বউমা এসেছিল, সে শুধু ফিরে আসেনি—সে কাউকে সঙ্গে করে নিয়েও গেছে।

বৃষ্টির রাত থেমে গেলেও হাওয়ার দাপট একটুও কমেনি। কাঁপতে কাঁপতে শ্রীমতী মীরা সেন উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। উঠোনের ওপারে পেছনের দরজাটা অদ্ভুতভাবে একটু ফাঁকা, যেন কেউ একটু আগেই ঢুকেছে কিংবা বেরিয়েছে। এমনটা আগে কখনো হয়নি। অমিতের মৃত্যুর পর থেকেই পেছনের দরজা বরাবর বন্ধ থাকে, বন্ধই রাখেন মীরা — একা থাকেন বলেই আরও সাবধান।

মনের ভিতরে এক আশঙ্কা নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোলেন। হাতে একটা লোহার টর্চ, কিন্তু বাতি ঝিমঝিম করছে। দরজার গায়ে হাত দিতেই একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন তাঁর সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলো। সেই হাওয়ার সঙ্গে এল এক পরিচিত গন্ধ — ভিজে চুলের, বাসি সিঁদুরের, আর আগরবাতির। এই গন্ধটা কোথায় যেন আগে পেয়েছেন তিনি…

দরজার বাইরে কাউকে দেখতে পেলেন না। শুধু কুয়াশায় ভেজা অন্ধকার, আর সাঁঝবাতির ম্লান আলো। হঠাৎ মনে পড়ল — সেই বউমা, সুতপা, যেদিন প্রথম এসেছিল, ঠিক এই রকম গন্ধ ছিল তার গায়ে।

পেছনের দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরে এলেন মীরা। ঠিক তখনই রান্নাঘরের দিক থেকে একটা শব্দ — যেন হাঁড়ির ঢাকনা পড়ে গেলো। তিনি দৌড়ে সেখানে গেলেন। ঢাকনাটা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে আছে, কিন্তু আশ্চর্য, যে হাঁড়িতে চাপা ছিল সেটা ঠান্ডা। সে তো দুপুরেই ধোয়া হয়েছিল। তাহলে এই শব্দ এল কোথা থেকে? কে ফেলল?

হঠাৎই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়া নড়ল। মীরা অবাক হয়ে পিছন ফিরে দেখলেন — কেউ নেই। কিন্তু দরজার সামনে ভেজা মেঝেতে জুতোর ছাপ!

তিনি আতঙ্কে পিছিয়ে এসে চেয়ারে বসে পড়লেন। হৃদপিণ্ডটা যেন বুকে লাফাচ্ছে। এই বাড়িতে আজকাল এমন সব জিনিস হচ্ছে, যা ব্যাখ্যা করা যায় না।

দুপুরবেলার ঘটনা মনে পড়ে গেলো…

আজ সকালে সুতপা এসে রান্নাঘরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলেছিল,
“মা, আপনি কি পায়েস রান্না করবেন আজ?”
মীরা একটু অবাক হয়েছিলেন —
“তুমি জানলে কী করে?”
সুতপা হেসে বলেছিল,
“অমিত বলেছিল, আপনি প্রতি শ্রাবণের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার পায়েস করেন। তাই না?”
মীরার শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল তখনই। এটা তো একান্তই পারিবারিক একটা রীতি, যা অমিত ছাড়া আর কেউ জানত না। তাহলে এই মেয়েটা জানল কীভাবে?

তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি অমিতকে কতদিন চিনতে?”
সুতপা মাথা নিচু করে বলল,
“প্রায় চার বছর। আমরা বিয়ের আগেই একসাথে থাকতাম, কিন্তু আপনার কাছে আসার সাহস পাইনি। সে বলেছিল একদিন ঠিক নিয়ে আসবে আমাকে… কিন্তু…”
সে আর কিছু বলতে পারেনি। চোখে জল জমেছিল।

মীরার মনটা কেমন যেন দুলে উঠেছিল। যদি সত্যি হয়… যদি এই মেয়ে তার ছেলের বউ হয়…? কিন্তু অমিত তো কোনোদিন তাকে এ কথা বলেনি!

ফিরে আসি বর্তমান রাতের ঘটনায়।

সেই পেছনের দরজা বন্ধ করার পর থেকে মীরার মনে একরাশ সন্দেহ জন্ম নিয়েছে।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সুতপার ঘরটা একটু খুঁটিয়ে দেখবেন।

চুপচাপ পা টিপে টিপে তিনি ঘরের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ভেতর থেকে মৃদু আলো ঝলসাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ, কিন্তু ভিতর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রোচ্চারণের মত একটা শব্দ…
“ওঁ নমঃ শিবায়… ওঁ কালী কালিকা… ওঁ নমঃ…”

মীরা চমকে উঠলেন। এই সময়, রাতে, একা একা মেয়ে মন্ত্র পড়ছে কেন? তিনি জানেন, এই বাড়িতে কালীপুজোর সময় বাদে কেউ মন্ত্র পাঠ করে না।

অবশেষে সাহস করে দরজার পাল্লা একটু ফাঁক করলেন। ভেতরে সুতপা বসে আছে, সামনে একটা কালী ঠাকুরের ছবি, ধূপ-ধুনো জ্বলছে, আর হাতে একটা পুরনো দিনের খাতা।

তাঁর চোখে পড়ে খাতার ওপরে লেখা অমিতের হাতের লেখা — “ডায়েরি – ২০১৯”।

মীরার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। তিনি বুঝতেই পারলেন না, অমিতের পুরনো ডায়েরি এই মেয়ের হাতে কীভাবে এল?

ঠিক তখনই সুতপার চোখ দরজার ফাঁক দিয়ে মীরার চোখের দিকে পড়ে গেলো। সে হেসে বলল,
“ভেতরে আসুন মা। আপনি তো সব জানতেই চাচ্ছেন, তাই না?”

মীরা সাড়া দিতে পারলেন না। পা যেন শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নিজের অজান্তেই তিনি ভিতরে ঢুকে পড়লেন।

সুতপা ধীরে ধীরে বলল,
“এই খাতাটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম অমিতের ফ্ল্যাটে। ও মারা যাওয়ার আগের রাতেও এই খাতায় কিছু লিখেছিল… একদম শেষ পাতায়…”

মীরা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কী লেখা ছিল?”

সুতপা সেই পাতা খুলে দেখাল।
অমিতের হাতের লেখা, স্পষ্ট —
“আমি চাই না ও আমার মৃত্যুর পর একা থাকে। কেউ না কেউ তাকে পৌঁছে দিক আমার মায়ের কাছে। মা যেন তাকে গ্রহণ করেন…”

সুতপার চোখে জল, আর মীরার চোখে বিস্ময়।

তবে সেই রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আবার একবার রান্নাঘরের হাড়ির ঢাকনা নড়ে ওঠে।

এবং মীরার ঘুম ভেঙে যায়, তিনি শুনতে পান পেছনের দরজার তালাটা খুলছে…

রাত তখন দেড়টা। বাইরের ঝড় কমেছে, কিন্তু জানালার কাঁচে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে টুপটাপ করে। সুচেতা দেবী বিছানায় বসে আছেন, কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না। তাঁর চোখ দুটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে, মনে হচ্ছিল যেন এক অদৃশ্য চোখ তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎই দোতলার সিঁড়ির দিক থেকে একটি চাপা পায়ের শব্দ ভেসে এল—আস্তে আস্তে কারা যেন নিচে নামছে। ভয়ে শরীরটা জমে গেল সুচেতার। তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন না, কেবল কান খাড়া করে রইলেন। পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নামল ঘরে, সেই নীরবতার ভিতরেই আচমকা পেছনের খোলা দরজায় দেখা গেল এক ছায়ামূর্তি—অচেনা, অথচ পরিচিত! সেটি এগিয়ে এসে দরজার গায়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, গলার স্বরে বলল, “মা, আমি… অমিত।” সুচেতার গলা শুকিয়ে গেল, চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল, কিন্তু মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোল না। অমিত? যে ছেলে তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সেই অমিত! সে কীভাবে এখন দাঁড়িয়ে? ছেলেটির মুখে চিরচেনা হাসি, অথচ চোখে গভীর গ্লানি। “তুমি ওকে চিনতে পারোনি মা… আমার স্ত্রীকে? ও মরেনি, ও তো এসেছে তোমার কাছে আশ্রয়ের আশায়,” ছায়ামূর্তিটা বলল, আর এক লহমায় মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

সুচেতা দেবী ঘেমে উঠে বসলেন। চারদিকে তাকিয়ে বুঝলেন, তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু ঘরের পরিবেশ এতটা ভারী, যেন স্বপ্ন এখনও পুরোপুরি কাটেনি। জানালার পর্দা উড়ছে, কোথা থেকে যেন জবা ফুলের গন্ধ আসছে, সেই গন্ধ যা সুচেতা পেতেন অমিত ছোটবেলায় সন্ধ্যাবেলা খেলতে বেরনোর আগে মাথায় তেল মাখাত—তখনকার সেই তেলেই মেশানো থাকত জবার নির্যাস। তিনি ধীরে ধীরে বিছানা ছাড়লেন, পা রাখলেন ঠান্ডা মেঝেতে। নিচে রান্নাঘর থেকে যেন হালকা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে—পাত্রে কিছু নাড়াচাড়া করার মতো শব্দ। তিনি নিচে নেমে এলেন, ফসফসে গলায় ডাক দিলেন, “কে? ঝর্ণা? তুই নাকি?” কোনও জবাব এল না। রান্নাঘরে গিয়ে তিনি দেখলেন, চুলায় কড়াই, পাশে রাখা গ্যাস লাইটার, কিন্তু কেউ নেই। টেবিলের ওপর একটি ভিজে কাপড় রাখা—তা যেন কারো ভিজে চুল থেকে চুঁইয়ে পড়া জল মুছতে ব্যবহার করা হয়েছে। হঠাৎ পিছন থেকে কারো নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনলেন, তিনি পিছনে ঘুরতেই দেখলেন মেয়েটি দাঁড়িয়ে—সাদা শাড়ি, গলায় লোহা, চোখে অপার ক্লান্তি। “আমি… অমিতের বউ। আপনার বউমা,” মেয়েটি ধীরে ধীরে বলল। সুচেতা দেবীর বুকের ভিতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেল। তিনি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি… কে? তুমি এখানে কী করছো?” মেয়েটির ঠোঁটে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, “আমি এলাম কারণ আমার আর কোনও জায়গা ছিল না… অমিত বলেছে এখানে এলেই মা আমার আশ্রয় দেবে। আমি কি থাকতে পারি কিছুদিন?”

সুচেতা দেবী হতচকিত হয়ে পড়লেন। তিনি জানতেন, এটা কোনও সাধারণ মেয়ে নয়। কিন্তু এটাও সত্যি যে, গত সাত দিন ধরে এই মেয়েটি যা যা বলেছে, যা যা করেছে—তাতে কোথাও কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। সে ঘরের কাজ করেছে, পুজোর থালায় ফুল সাজিয়েছে, এমনকি সুচেতার জন্য বালিশে নতুন কভারও দিয়েছে। তাহলে সে ভূত হলে এসব করছে কীভাবে? তাঁর মনের ভিতর দ্বন্দ্ব, ভয়, কৌতূহল সব একসঙ্গে ছটফট করছে। তখনই মেয়েটি বলল, “আপনি তো অমিতের মৃত্যুর পর কিছুই জানলেন না। আপনার ছেলে… সে মারা যায়নি পুরোপুরি। তার একটা অংশ আমার সঙ্গেই থেকে গেছে। সে আমাকে বলেছিল, তোমার মায়ের কাছে যেও, উনি তোমার জন্য একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবেন। আমি সেই আলো দেখতে দেখতে এসেছি… আপনি তো জানেন, আলো না থাকলে আমরা পথ পাই না মা…” মেয়েটির গলার স্বর নিস্তরঙ্গ, অথচ গভীর। তখন হঠাৎ বাইরে বাজ পড়ল, একটা বিকট শব্দে, যেন আকাশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি জানালার দিকে তাকাল, বলল, “আজ রাতেই সব জানবেন… আমি কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি… অমিতের মৃত্যুর পেছনের সত্যিটা… আর আপনি জানবেন, আপনার ঘরেই কতগুলো দরজা ছিল যা আপনি কোনওদিন খোলেননি। এখন সেই দরজাগুলো নিজেরাই খুলছে।” তার চোখে তখন যেন এক অজানা রহস্যের দ্যুতি, যা পৃথিবীর আলোয় নয়, অন্য কোথাও তৈরি হয়। সুচেতা দেবী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন তিনি তৈরি হচ্ছেন এমন এক সত্য জানার জন্য, যা তার সমস্ত বিশ্বাস, যুক্তিকে ভেঙে দেবে। সেই রাতে, বৃষ্টির শব্দ থেমে গেল, বাড়ির ভিতর শুধু ছায়ারা চলাচল করতে লাগল… আর এক বউমা, যে কিনা হয়ত বেঁচে নেই, কিন্তু যার কান্না এখনও দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায়—সে বসে রইল বারান্দার এক কোনায়। এখনো অপেক্ষা করছে শেষ কথাটার জন্য।

বৃষ্টির শব্দে আবার এক রাত শুরু হল। ঘর জুড়ে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, তার মাঝেও জলের শব্দ, পাতার ফিসফাস, ঘড়ির টিকটিক — সব মিলিয়ে রাতটা যেন হঠাৎ গা ছমছমে হয়ে উঠল। মা-ঠাকুরুনির আজ আর ঘুম আসছে না। ঘরের কোণে বসে তিনি জলকণার দিকে তাকিয়ে আছেন নিঃশব্দে। জলকণার মুখে আজ হাসি নেই, চোখজোড়া লালচে, ক্লান্ত। ঠান্ডা দৃষ্টিতে জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। হঠাৎই ঠাকুরুনির কাঁপা গলায় প্রশ্ন ভেসে এল, “তুই কে, মা? সত্যি করে বল। অমিত তো মরেছে তিন বছর আগে। তুই কোথা থেকে এলি?” জলকণা যেন প্রস্তুত ছিল এমন প্রশ্নের জন্য। সে মুখ ঘুরিয়ে শান্তভাবে বলল, “মা, আমি অমিতের স্ত্রী। হয়ত আপনারা জানতেন না, কারণ ও চায়নি আপনাদের জানাতে।” ঠাকুরুনি চমকে উঠে বললেন, “কিন্তু কেন?” এবার জলকণা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল এক রহস্যময় কাহিনি — তার অমিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায়, বৃষ্টির এক রাতে। অমিত তখন এক বইয়ের দোকানে কাজ করত। সেখানেই জলকণার সঙ্গে আলাপ। বন্ধুত্ব, প্রেম, তারপর এক গোপন বিয়ে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই অমিতের মৃত্যু হয় — আচমকা এক রোড অ্যাক্সিডেন্টে। অথচ এরপরও জলকণা তার ‘শ্বশুরবাড়ি’ খুঁজে বেড়ায়। কেন?

জলকণা বলতে লাগল, “অমিত বলত, তার বাড়ি মেদিনীপুরে। একটা বড় পুরনো বাড়ি, অনেক গাছপালা, উঠোনে শিউলি পড়ে থাকে। আমি শুনে কল্পনায় আঁকি সেই ছবি। তারপর অমিত নেই, কিন্তু আমি জানি, আমাকে যেতে হবে সেখানে। কারণ আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম অমিতকে — ওর মৃত্যুর পরও আমি তার স্মৃতি আগলে রাখব। তাই আমি খুঁজে বের করলাম এই ঠিকানা।” ঠাকুরুনি চুপ করে শোনেন, কিন্তু তাঁর চোখে জল। তিনি কি বিশ্বাস করবেন জলকণার এই কথা? না কি এ আরেক ছলনা? হঠাৎ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জলকণার ছায়া যেন একটু লম্বা হয়ে ওঠে। বিদ্যুতের ঝলকে ঠাকুরুনি দেখে, ছায়াটা যেন দুটো নয়, তিনটে! কল্পনা, না কি সত্যি? তিনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই জলকণা বলে, “মা, আমি জানি, আপনি ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু আমি খারাপ কিছু চাই না। আমি শুধু এখানে থাকতে চাই, যতদিন পারি।” ঠাকুরুনি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকেন মেয়েটার দিকে — তার চোখে কি সত্যিই শুধু দুঃখ, না কি লুকিয়ে আছে অন্য কিছু?

রাত বাড়ে। বৃষ্টি আরও জোরে পড়ে। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে একটা শব্দ আসে — যেন দরজার চেপে ধরা কাঁপুনি, অথবা কারও নিঃশব্দ হাঁটা। ঠাকুরুনি কাঁপতে কাঁপতে বলেন, “তুই কিছু শুনলি, মা?” জলকণা জানলার দিকে তাকিয়েই বলে, “হ্যাঁ, মা। সে এসেছে।” ঠাকুরুনির গলা শুকিয়ে যায়, “কে এসেছে?” জলকণা ঘুরে ঠাকুরুনির চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, বলে, “অমিত।” উত্তরে তখন শুধুই শিউরে ওঠা একটা নীরবতা, আর জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি, যার চোখ জ্বলছে অন্ধকারে…

বৃষ্টির সেই কুয়াশাঘেরা সন্ধ্যায় মালতী আবার স্বপ্ন দেখে। সেই একই স্বপ্ন, যেখানে অমিতের মুখ দেখা যায় না, কিন্তু একটা করুণ কণ্ঠ বারবার বলছে, “মা, তুমি তাকে সরাও না, ওর কিছু করার ছিল না…” হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় মালতীর। বিছানায় উঠে বসে সে দেখল, জানালার পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে, আর ঘরের মধ্যে সেই মেয়েটার গন্ধ—একধরনের সোঁদা মাটির গন্ধ, যেটা প্রথম রাতে দরজায় এসে দাঁড়ানো মেয়েটার গা থেকে এসেছিল। মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যায় পেছনের উঠোনে। সেখানে গাছের নিচে একজোড়া চপ্পল পড়ে আছে, যেটা সে আগে কখনো দেখেনি। ভয় আর কৌতূহল মিলে মালতীর গলা শুকিয়ে যায়। হঠাৎ, পেছন থেকে কেউ বলল, “আমি বলেছিলাম না, আমায় ঠেলে দিও না? আমি এসেছিলাম সত্যি নিয়ে, কিন্তু এই বাড়ি তো শুধু অতীত আঁকড়ে ধরে।” মালতী ঘুরে দেখে, সেই বউমা, কিন্তু এবার তার চোখ লাল, মুখে ফ্যাকাশে হাসি, আর তার গায়ে সেই নীল পাড়ের শাড়ি, যেটা অমিতের মৃত্যুর দিন তার প্রিয় শাড়ি বলে হারিয়ে গিয়েছিল।

মালতী অসুস্থের মতো পিছিয়ে পড়ে, গলায় কোনো আওয়াজ বেরোয় না। বউমা বলে, “তিন বছর আগে অমিতের মৃত্যুর রাতে, আমি তার সঙ্গেই ছিলাম। আমরা বিয়েটা গোপনে করেছিলাম, কারণ আপনি আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না বলেই অমিত ভয় পেত। সেদিন আমরা ফিরছিলাম ট্রেনে, আপনি ফোন করে বারবার বলছিলেন, ফিরে আসিস না। সেই অস্থিরতা, সেই তাড়াহুড়ো, ট্রেনের একটা ধাক্কায় অমিত পড়ে যায়। আর আমি বাঁচি না মরি জানি না। কিন্তু আমার চেতনাটা আটকে গেছে এখানে, কারণ কেউ বিশ্বাস করেনি আমি ছিলাম ওর স্ত্রী।” মালতী এবার কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, “তুই কেন এভাবে এলি? এতদিন কোথায় ছিলি? আমি তো জানতেই পারিনি, ও বিয়ে করেছিল। আমি তো তোকে খুঁজতেও পারিনি…” মেয়েটা চোখ তুলে বলে, “কারণ আপনি খুঁজতে চাননি, মা। আপনিই বলেছিলেন ও যেন সব ফেলে ফিরে আসে। আমি তো তখন অমিতের সন্তান ধারণ করেছিলাম। কিন্তু সেই সন্তানও…” কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠল, আর মেয়েটার মুখ যেন মুহূর্তে মিলিয়ে গেল।

পরদিন সকালে মালতী প্রতিবেশী অশোক কাকুকে ডেকে পাঠায়। বলে, সে বাড়ি ছাড়তে চায়। অশোক কাকু অবাক হয়ে জানতে চান কেন। মালতী আর কিছু না বলে শুধু নীল পাড়ের শাড়িটা বের করে দেখায়, যেটা তিন বছর আগে খুঁজে পাওয়া যায়নি, আর যা আজ সকালে তার বিছানার পায়ের কাছে neatly ভাঁজ করা অবস্থায় পাওয়া গেছে। অশোক কাকু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “মালতী, হয়তো তুই কোনো ভুল করেছিস, আর সেই ভুলই ফিরে ফিরে এসে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখ, কারও ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, সে ভুলে যায় না। হয়তো ও এসেছিল শুধু এটুকু বোঝাতে—সে ছিল, আর ওর একটা সত্যি ছিল।” মালতী জানে, এই বাড়ির প্রতিটা কোণ এখন তার কাছে একেকটা স্মৃতি হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই বউমার কান্নাভেজা চোখ, সেই অনুনয়—সেগুলোর ব্যথা যে তার চেতনায় গেঁথে গেছে। হয়তো বৃষ্টির রাতে দরজায় দাঁড়ানো সেই মেয়ে কেবল একটা প্রেত নয়, সে ছিল নিজের স্বীকৃতির খোঁজে ঘুরে বেড়ানো এক অপূর্ণ আত্মা—যার গল্পটাও এই বাড়ির মতো, ঝাপসা, ভিজে, আর গভীর যন্ত্রণায় মোড়া।

১০

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের সব শব্দ যেন নিঃশেষে মিশে গেল এক অনন্ত নীরবতায়। শিউলি জানলার পাশে বসে ছিল। বাইরে আবার বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ করে, সেই পরিচিত সুর, যা গত কয়েকদিন ধরে বারবার ফিরে আসছে তার জীবনে। কিন্তু আজকের বৃষ্টির সুরটা আলাদা। মনে হচ্ছে, এক অনুরণন—অমিতের নিঃশেষ আত্মার আর্তি যেন ভেসে বেড়াচ্ছে সেই জলের শব্দে। ঘরের ভেতরে তার সামনে পড়ে আছে সেই পুরনো ডায়েরি, যেটা কাল রাতে বউমা রেখে গেছিল। খুলে দেখা যায়, তার প্রথম পাতায় লেখা অমিতের হাতে—”যদি কোনোদিন হারিয়ে যাই, শিউলিকে সত্যিটা জানিয়ে দিও।” নিচে তারিখ—তিন বছর আগে। বাকি ডায়েরি ভর্তি শিউলির চেনা ছেলের জীবন থেকে লুকোনো কথাগুলো—এক নিঃশব্দ যন্ত্রণা, যেটা অমিত কখনো শেয়ার করতে পারেনি কারও সঙ্গে। ভেসে ওঠে সেই ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ বউমার মুখ, যে রাতে এসে দাঁড়িয়েছিল, যে বলেছিল, “আমি অমিতের স্ত্রী”—কিন্তু আজ ডায়েরির শেষ পাতায় অমিত নিজেই লিখেছে, “তাকে আমি ভালোবেসেছিলাম, বিয়েও করেছিলাম, কিন্তু সংসার করতে পারিনি। আমি মরিনি, আমি শুধু লুকিয়ে পড়েছিলাম নিজের ভুলের ভেতর।” হঠাৎ একটা ঝড়ো হাওয়া জানলায় ধাক্কা মারে, শিউলি চমকে ওঠে। চোখের সামনে সেই ‘বউমা’র ছায়ামূর্তি যেন ভেসে ওঠে। সে কি তবে সত্যি অমিতের স্ত্রী? তবে অমিত… মরেনি?

শিউলি ডায়েরি নিয়ে দৌড় দেয় সেই ঘরের দিকে, যেখানে কয়েকদিন আগে বউমা ছিল। দরজা বন্ধ। বারবার ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও কোনো সাড়া নেই। কিন্তু ভিতর থেকে যেন ভেসে আসছে হাসির শব্দ—স্নিগ্ধ এক নারীকণ্ঠ, যেন ভীষণ চেনা। হঠাৎ করে দরজাটা খুলে যায়। ভিতরে কেউ নেই। একটা টেবিলের ওপর রাখা আছে সাদা শাড়ি, একজোড়া শাখা-পলা আর সেই পুরনো ছবি—অমিত আর এক অচেনা মেয়ের, বিয়ের দিনের ছবি। শিউলি ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে এগিয়ে যায়, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে, “আমি এখন মুক্ত, মা।” শিউলি ঘুরে দাঁড়ায়—ঘরে কেউ নেই, শুধু বৃষ্টির শব্দ। তবু সে যেন বুঝতে পারে, কারও উপস্থিতি ঠিক পাশেই আছে। কান্না আর হাঁপানির ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি হঠাৎ আবিষ্কার করে, তার বুকের ভারটা যেন হালকা হয়ে গেছে। বহুদিন পর এক অদ্ভুত প্রশান্তি জেগে ওঠে তার মনে। হয়তো সত্যিই আজ সে তার ছেলেকে আবার ফিরে পেয়েছে—নতুন এক রূপে, নতুন এক সত্যের মধ্যে।

সেই রাতেই শিউলি গ্রামের পুরনো মন্দিরে যায়, যেখানে অমিত ছোটবেলায় খেলা করত। পুরোহিত তাকে বলে, “তিন বছর আগে এক মেয়েকে দেখেছিলাম এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসে থাকতে। সে বলত, সে তার স্বামীকে খুঁজছে। তারপর হঠাৎ একদিন সে আর এল না।” শিউলি চুপ করে থাকে। তার মনে হয়, সে আজ বুঝতে পেরেছে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। সেই মেয়েটি, সেই অচেনা বউমা, তার ছেলের প্রিয়তমা—তিন বছর ধরে ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছিল, আর আজ, অমিতের ডায়েরির মাধ্যমে সব খুলে জানিয়ে দিয়ে, সে বিদায় নিয়েছে। শিউলি বাড়ি ফিরে এসে দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি তখনও ঝরছে, তবে আর ভয় নেই, শুধু শান্তি। সে দরজা খোলে, জানে—ভবিষ্যতে আবার কোনোদিন সেই বউমা ফিরে এলে, সে আর ভয় পাবে না। কারণ এবার সে জানে, তাকে আর অচেনা বলা চলে না। এবার সে তার পরিচিত, আপনজন, অমিতের অদৃশ্য ছায়ার মতো প্রিয় ভালোবাসা।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *