রুদ্রাণী বসু
পর্ব ১: মেঘলা সোমবার
কলকাতার আকাশটা সেদিন মুঠোফোনের নোটিফিকেশন সেন্টারের মতো ছিল—একটার পর একটা ধূসর মেঘ, আর ভিজে যাওয়া নীলের উপর এলোমেলো সাদা বার্তা। অফিসের পরে গ্যালারিতে ছোট্ট এক প্রদর্শনী ছিল। বিজ্ঞাপনের কাজে যেসব তরুণ ছবি তোলে, তাদের মধ্যে সেরা দশটা ফ্রেম ঝুলেছিল দেওয়ালে। মাধুরী সেখানে দাঁড়িয়ে এক ফ্রেমে চোখ আটকে রাখল—পুরনো ট্রামের জানালার ধারে বসে থাকা এক তরুণী, হাতে কুয়াশিতে ভেজা বই। ছবির নাম ছিল, ‘মাঝরাস্তায়’।
কেন জানি না, শিরোনামটা পড়তেই গলার কাছে টান লেগে গেল। মাঝরাস্তায় থাকা কি কেবল শহরের ট্রাফিকের কথা বলে, নাকি একজন মানুষ যখন দুই সিদ্ধান্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে—সেই গোপন অনিশ্চয়তাও এর মধ্যেই ধরা পড়ে? সে ভাবতে ভাবতেই পিছন থেকে এক গলা ভেসে এল—“তুই এখনও শিরোনাম পড়ে ছবি দেখিস, মাধুরী?”
সে ঘুরেই প্রথমে গলাটা চিনল, তারপর চোখ। ঈশান। দশ বছর আগের কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে যেন হাঁটতে হাঁটতে এই গ্যালারিতে এসে দাঁড়িয়েছে। চশমার ফ্রেম পাল্টেছে, হাসিটা না—সে এখনও এক দাগচিরে আলোর মতো, টের পাইয়ে দেয় কিন্তু বিঁধে না। “তুই?”, মাধুরীর বিস্ময়টুকু নিজের অজান্তে বেরিয়ে পড়ল। “তুই কলকাতাতেই আছিস?”
ঈশান বলল, “না, বেঙ্গালুরুতে। এখানে ক’দিনের কাজ। গ্যালারির পেছনের বন্ধুটি আমার।” কথার ফাঁকে সে জানাল, কত দ্রুত শহর বদলায়, আর মানুষও—তবু কিছু মুখ, কিছু বাক্য—একই থাকে, একইরকম ভরসার মতো। মাধুরীর মনে পড়ে গেল, কলেজের শেষ বর্ষে কীভাবে হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, কীভাবে তার সমস্ত দৌড়ঝাঁপে ঈশান আড়াল হয়ে থাকত। তখনই বুঝেছিল, পাশে থাকার আর নাম দেওয়ার মধ্যে বিশাল দূরত্ব আছে। তারা আর নাম দেয়নি।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গ্যালারির কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা, ভেতরে আলো-ছায়া। লোকজন কমে গেলে ঈশান বলল, “এক কাপ কফি হবে? অনেক কথা বাকি আছে।” উলটোদিকের ছোট্ট ক্যাফেতে বসতে বসতে মাধুরীর মনে হল, বছরগুলো আসলে কেবল পাতলা স্তর, আঙুলের ডগা দিয়ে চাপ দিলে নীচে আবার পুরনো রঙ দেখা যায়। টেবিলে এসপ্রেসোর কাপ, দেওয়ালে সুরেলা জ্যাজ—কিন্তু তারা যে সুরে কথা বলছে, সেটা পুরনো বাংলার এক তান: “কেমন আছিস?”, “তোর মা?”, “সৌরভ কেমন?”—স্বামী সৌরভের নামটা বেরোতেই মাধুরীর গলা সামান্য কেঁপে উঠল; ঈশানের চোখে অচেনা এক নরমতা এল।
“সৌরভ ভালো। কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমিও। জীবনটা… তোমার ‘মাঝরাস্তায়’ ছবিটার মতো।” সে হেসে উঠল, কথাটা যেন হালকাভাবে বলে ফেলতে চাইল। ঈশান হালকা মাথা নাড়ল। “সবাই কোথাও না কোথাও মাঝরাস্তায়। তুই ছবি দেখিস, আমি ছবি তুলি—এইটুকু পরিবর্তন ছাড়া কি বদলেছে?” প্রশ্নটা যেন গোল করে চারদিকে ঘুরল, তারপর টেবিলের কিনারায় এসে বসে পড়ল। উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ মাধুরী পেল না।
ফেরার সময় বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। শান্ত, ক্লান্ত শহর। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে মাধুরী ফোনটা বের করতেই দেখল, হোয়াটসঅ্যাপে অচেনা একটি নম্বর থেকে বার্তা: “ঘর পৌঁছালে জানাস। ভালো লাগছিল তোর সঙ্গে বসতে।” সে জানে কোন নম্বর, তবু প্রোফাইল ছবি নেই দেখে একটু স্বস্তি পেল। নিজের নামটা টাইপ করে ‘সেন্ড’ করার আগেই থেমে গেল—এই ছোট্ট জানানোটা কি অনুচিত? কিন্তু ঠিক কোন ‘বিধি’র বিরুদ্ধে যাবে? সৌরভ কি এমন কোনও লিখিত নিয়ম রেখেছে যে, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না?
ট্যাক্সির জানালায় ভিজে রোদের আদল লেগে ছিল, আর তাতে মাধুরীর মুখের কৌণিকতা স্থির। সে বাড়ি পৌঁছল। ফ্ল্যাটের বারান্দায় টবে জমে থাকা জল, জানলার কাছে নীল রঙের চেয়ার—সবই একই জায়গায়। শুধু বালিশের কোণায় একটা দীর্ঘশ্বাস জমে আছে, যেটা সে রাখেনি; জীবনের কোথাও থেকে এসে নিজে নিজেই বসে পড়েছে। সৌরভের ঘরে আলো জ্বলছে, সে ল্যাপটপে কোনো প্রজেক্ট দেখছে। “খাইবে?”, জিজ্ঞেস করল মাথা না তুলেই। মাধুরী বলল, “খাবো। আজ গ্যালারিতে….” কথাটা শেষ করতে পারল না। সে কি বলবে এখনই?—“আজ ঈশানের সঙ্গে দেখা”? বললে কী হবে? একটা ওভেনের আওয়াজ, একটা ফাইলের নাম, একটা নার্ভাস হাসি, দু-একটা প্রশ্ন—তার পরেই হয়তো আর কিছুই না। অথবা, অচেনা কৌতূহল, যেটা এই নিস্তরঙ্গ সন্ধ্যাটাকে দ্রুত, অকারণে, ভারী করে তুলবে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন সে সিঙ্কে থালা ঢুকিয়ে রাখছে, ফোনটা কিচেন কাউন্টারে কাঁপল। একই নম্বর: “পৌঁছালি?” এই সাধারণ, নিরাপদ শব্দবন্ধটা হঠাৎ এত ব্যক্তিগত মনে হল কেন? সে লিখল, “হ্যাঁ। ধন্যবাদ, আজ ভালো লাগল। ভালো থেকো।” ‘সেন্ড’ করার আগে আবার থামল। ‘ভালো লাগল’—শব্দটা কি খুব বেশি? কিন্তু সত্যি তো—ভালো লেগেছিল। সে পাঠিয়ে দিল।
রাতের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাধুরী নিচের পার্কিং লটে নামতে থাকা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে রইল। এই বাড়ির প্রতিটি জিনিসই সে চিনে নিয়েছে—চেয়ার, আলনা, ওয়ারড্রোবের বাম দিকটা যেখানে শার্ট রাখে সৌরভ, ডানদিকে তার সালোয়ার-কামিজ—সবই নিখুঁত বিন্যাসে। তবু কোথাও একটা ফাঁক আছে। সেই ফাঁকের নাম—নিজেকে ভুলে যাওয়া। অফিসের প্রেজেন্টেশন, কাস্টমারের ব্রিফ, রবিবারের বাজার—এসবের ভিড়ে সে কবে শেষবার নিজের জন্য বসে কিছু লিখেছিল, মনে করতে পারল না। একসময় সে কবিতা লিখত। এখন কবিতার বদলে সে ক্যাপশন লেখে—যার ভাষা সুন্দর, কিন্তু অনাহূত।
সৌরভ এসে বারান্দায় দাঁড়াল। “ঠান্ডা লাগবে। ভেতরে যা।” তার গলায় কোনো অভিযোগ নেই, সহানুভূতিও নয়—শুধু ব্যস্ত মানুষের মৃদু যত্ন। মাধুরী ভেতরে এল। বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, “আজ একটা ছবির প্রদর্শনী ছিল। কলেজের এক বন্ধু—পুরনো—ও ছিল সেখানে। কথা হল।” নিজের গলাটা সে অবহেলায় সমান রাখল। সৌরভ চোখ তুলল না—“ভালো। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে মন ভাল থাকে। আমাদের এই রুটিনে মাঝে মাঝে বাতাস ঢোকাতে হয়।” এমনই নিঃশব্দ, পরিণত, যুক্তিসংগত—সৌরভের বাক্যগুলো সবসময় এমনই। কিন্তু তার ভেতরে ঢুকে থাকা নীরবতার থলিটা কে খুলে দেয়?
রাত গভীর হলে মাধুরী ড্রয়ারে রাখা একগুচ্ছ পুরনো পোস্টকার্ড বের করল। কলেজ ফেস্টিভ্যালের পোস্টার, কবিতার হাতের লেখা, গিটার পিক—সবকিছুর মাঝে চাপা পড়ে ছিল একটা চিঠি—যেটা সে কখনো পাঠায়নি। ঈশানকে লিখেছিল, এক শীতে। “আমরা কি নাম দিতে পারি?”—এই ছিল শেষ লাইনটা। পাঠায়নি। কেন পাঠায়নি, তারও উত্তর নেই। সময়ের কাছে প্রশ্ন করলে সময় কেবল কাঁধ ঝাঁকায়।
ফোন আবার কাঁপল। ঈশান লিখেছে—“তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল। যদি কখনো কফির জায়গাটা বদলাতে ইচ্ছা করে, আমি আছি। কোনো উত্তর না দিলেও ক্ষতি নেই। শুধু জানিস, মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে আমি আয়নার মতো দাঁড়িয়ে থাকি—যতটা লাগে, ততটাই।”
এই কথাগুলোতে কোনও প্রতিশ্রুতি নেই, কোনও দাবি নেই—শুধু এক অদ্ভুত স্বস্তি। মাধুরী উত্তর দিল না। পর্দার ভেতরে আলো বন্ধ হল; বাইরে শহর নিঃশব্দ। সে বিছানায় শুয়ে আকাশের অদৃশ্য ছাদে ঝুলে থাকা তার রাতগুলো গুনতে লাগল। প্রতিটি রাত যেন একেকটা কাঁচের জানালা—ভেতরে সে, বাইরে শহরের আলো। কাঁচের ওপারে তাকালে নিজের প্রতিবিম্বই দেখা যায় বেশি, শহর কম। নিজের ভিতরে যে ফাঁকটা, সেটাই আজের বৃষ্টির শব্দে স্পষ্ট হয়ে উঠল। আর সেই ফাঁকে, শব্দহীন পায়ে, এক পুরনো গলা এসে দাঁড়িয়ে আছে।
ভোরে যখন ঘুম ভাঙল, জানালায় বৃষ্টির হালকা আওয়াজ। আলমারির উপর ছেড়ে রাখা পোস্টকার্ডের পাশে ফোনটা পড়ে। স্ক্রিনে কোনো নতুন বার্তা নেই। মাধুরী যেন স্বস্তি পেল, আবার খানিকটা অস্বস্তিও—অপেক্ষা করলে যেমন হয়। সে জানে, আজ অফিসে প্রেজেন্টেশন; সৌরভেরও কল আছে। দিন চলবে তার নিজের গতিতে। তবু কোথাও কোনো সুর বদলে গেছে—খুব ক্ষীণ, তবু স্পষ্ট।
এই বদলের নাম কি পরকীয়া? নাকি কেবল নিজের ভিতরের, বহুদিনের অদেখা দরজায় কড়া নাড়া? মাধুরী উত্তর জানে না। সে শুধু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ দুটি দেখল—সেখানে ক্লান্তি আছে, কিন্তু একফোঁটা আলোও আছে—যেটা বৃষ্টির পরে ছাদের মতো পরিষ্কার। এবং সেই আলোর দিকে তাকিয়েই সে ভেতরে ভেতরে জানল—কোনো নাম না দেওয়া সম্পর্কেরও ওজন আছে; কেউ তা তুললে দূরে কোথাও বজ্রের মৃদু ধ্বনি শোনা যায়।
আজকের মতো সে সেই ধ্বনিটুকুই শুনে রাখল—আর বাকিটা বলবে আগামীকাল।
পর্ব ২: পুরনো নম্বর
কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউসের গন্ধটা যেন কোথাও বুকের ভেতর জমে থাকে—বছরের পর বছর কেটে গেলেও, প্রথম কাপে ফোঁটানো কফির মতোই উষ্ণ, ভারী, আর অদ্ভুতরকম ঘন। মাধুরী কখনও ভাবে নি, আবার সেই কাঠের টেবিলে বসতে হবে, যেখানে আঙুলের নখ দিয়ে নাম খোদাই করেছিল একসময়কার একদল নিরুদ্বেগ তরুণ-তরুণী। এবার শুধু দু’জন—সে আর ঈশান। তবু টেবিলের চারপাশে যেন ভিড় জমে উঠেছে পুরনো দিনের, স্মৃতির মতো করে।
“তোর মনে আছে, একদিন আমি চারবার এক্সট্রা কাপ অর্ডার করেছিলাম, কেবল তোর সঙ্গে বসে থাকার জন্য?”— ঈশান মুচকি হেসে বলল।
মাধুরী কাগজের ন্যাপকিনে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, “আমার মনে আছে, তারপর আমার বাবার ফোন এসেছিল। আমি অজুহাত দেখিয়ে চলে গিয়েছিলাম।”
“অজুহাত?” ঈশান তাকাল সরাসরি চোখে।
সে একটু থমকাল। “হ্যাঁ… বাবা চাইতেন না আমি অত সময় নষ্ট করি। বলতেন, যেটুকু দরকার পড়াশোনা করো, তারপর ঘরে ফিরো। আর বাকিটুকু… তুমি জানো।”
ঈশান মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, জানি। তোর বাবার সেই কঠোর দৃষ্টি, আমি ভুলিনি।”
দু’জনের কথার মাঝখানে হঠাৎ চুপচাপ একটা শূন্যতা এসে বসল। সেই শূন্যতা যেন টেবিলের কাঠের গায়ে আঁচড় কেটে গেল। তারা দু’জনেই কফি নাড়তে লাগল, অথচ চোখের ভেতরে অন্য দৃশ্য ভাসছিল—একটা অসমাপ্ত তরুণ সময়, যে সময়ে তারা হয়তো একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারত, কিন্তু দেয়নি।
কফিহাউসের বাইরে বৃষ্টি ধীরে ধীরে থামছিল। লোকজন আসছে-যাচ্ছে, কথার ঢেউ উঠছে-নামছে। অথচ এই টেবিলে যেন সব শব্দ আটকে আছে।
“তোকে একটা কথা বলব?”— ঈশান নরম গলায় বলল।
“কি?”
“তোকে দেখার পর মনে হল, আমি যেন আবার সেই পুরনো সময়ে ফিরেছি। তুই বদলাসনি মাধুরী। তোর চোখ এখনও একইরকম।”
এই কথাটুকু শুনে মাধুরীর বুকের ভেতর হঠাৎ একটা অদ্ভুত ধাক্কা লাগল। কতদিন যে কেউ তার চোখ নিয়ে কিছু বলেনি! সংসারে সৌরভ তাকে প্রশংসা করে না—অভিযোগও করে না। সে যেন একরকম নিরপেক্ষ সমীকরণের মধ্যে থেকে যায়। ঈশানের কথায় হঠাৎ মনে হল, সে এখনও দৃশ্যমান, এখনও কারও নজরে ধরা পড়ে।
“আমরা বদলাইনি নাকি?”— মাধুরী প্রশ্ন করল।
ঈশান কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “শুধু আমাদের চারপাশ বদলেছে। আমরা তো সেই আগের মতোই আছি।”
শব্দগুলো যেন ধীরে ধীরে তার ভিতরের শূন্য জায়গাগুলোতে ঢুকে পড়ছিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর, মাধুরী বলল, “তোর নম্বরটা আছে?”
ঈশান ফোনটা বের করে দিল। মাধুরী তার নাম সেভ করল—কিন্তু নামটা লিখল ‘ঈশান ২’। যেন একটা অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় নম্বর। অথচ ঠিক সেই নামের ভেতরেই কত অদ্ভুত প্রয়োজন গোপনে ঢুকে পড়ল।
ফেরার সময় কফিহাউসের বাইরে বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। রাস্তায় কাগজ উড়ছে। মাধুরী ট্যাক্সিতে উঠল। ঈশান সামনের সিটে বসেছিল। গাড়ি চলতে শুরু করল। দু’জনেই জানলার বাইরে তাকাল। শহরের আলো ভিজে আছে, ট্যাক্সির কাঁচে নেমে আসছে অস্পষ্ট রেখা। মাঝে মাঝে তাদের চোখ ধাক্কা খাচ্ছে জানলার প্রতিফলনে।
হঠাৎ ঈশান বলল, “মনে আছে, একদিন আমরা রোদ্দুরের নিচে বই মেলায় হাঁটছিলাম, আর তুই বলেছিলি—এই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে?”
মাধুরী হাসল। “হ্যাঁ। তখন তো মনে হত, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে মুক্তি মিলবে।”
“এখনও কি তাই মনে হয়?”
সে একটু থেমে উত্তর দিল, “এখন মনে হয়, মুক্তির নামই ভিড়। যত মানুষ, তত মুখোশ। আর সেই ভিড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সহজ।”
ঈশান তাকিয়ে রইল তার দিকে। কিন্তু আর কিছু বলল না।
ট্যাক্সি যখন মাধুরীর বাড়ির কাছে পৌঁছল, তখন রাত ন’টা বাজে। সে নেমে দরজা খুলতে গিয়েই থমকাল। পেছনে তাকিয়ে দেখল, ঈশান তাকিয়ে আছে। চোখে যেন নীরব প্রতিশ্রুতি। মাধুরী কিছু বলল না। শুধু হালকা মাথা নাড়ল।
বাড়িতে ঢুকতেই সৌরভ বলল, “আজ এত দেরি?”
“অফিসের কাজ, তারপর কফিহাউসে একটু ঢুঁ মেরেছিলাম। কলেজের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা।”
সৌরভ মাথা নাড়ল। খুব বেশি কৌতূহল তার নেই। আবার ল্যাপটপের দিকে ঝুঁকে গেল।
কিন্তু মাধুরীর ফোনে মেসেজ এল—ঈশান: “বাড়ি পৌঁছলি?”
সে লিখল, “হ্যাঁ।”
তারপর কিছুক্ষণ ভেবে যোগ করল, “আজকের দিনটা অন্যরকম লাগল।”
কয়েক সেকেন্ড পরই উত্তর এল— “আমারও।”
ফোনটা ড্রয়ারে রেখে দিল মাধুরী। কিন্তু ভিতরে কোথাও একটা সুর বেজে উঠেছিল।
সেই রাতে সে স্বপ্ন দেখল—একটা বিশাল লেক, চারপাশে অন্ধকার। লেকের ধারে বসে আছে সে আর ঈশান। দু’জনেই চুপ। শুধু জল টুপটাপ শব্দ করছে। হঠাৎ ঈশান তার হাত ধরল। মাধুরী চমকে উঠে গেল। স্বপ্ন ভেঙে গেল।
ভোরে জানলা খুলে দেখল, আকাশ ফর্সা। বাইরে পাখির ডাক। তবু বুকের ভেতর এখনও সেই স্বপ্নের ছোঁয়া রয়ে গেছে।
অফিসে যাওয়ার সময় ব্যাগে ফোনটা বারবার বাজছিল। ঈশানের মেসেজ— “আজ দুপুরে সময় আছে?”
মাধুরী উত্তর দিল না। অথচ তার আঙুল কাঁপছিল। ভেতরে কোথাও একটা টান টান সুতোর মতো টানছিল।
অফিসের কাজ শেষ করে সে যখন বাইরে বেরোল, তখন আকাশে আবার মেঘ। ফোন খুলতেই দেখল, ঈশানের মেসেজ— “লেকের ধারে যদি আসিস, আমি থাকব।”
সে জানত, যাওয়া উচিত নয়। তবু পা যেন নিজে থেকেই পথ চিনে নিল।
পর্ব ৩: কাঁচের জানালা
অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মাধুরীর চোখে ধরা পড়ল ভিজে ছাদের জল। বর্ষার দিনগুলো এমনিতেই তার ভেতরটা ভারী করে তোলে। সেদিনও কাজের চাপ ছিল পাহাড়সম—মিটিং, প্রেজেন্টেশন, ক্লায়েন্ট কল। তবু ভেতরে কোথাও যেন একটানা শব্দ বাজছিল, এক অদ্ভুত প্রতীক্ষার ঘণ্টাধ্বনি। ঈশানের বার্তাটা এখনও স্ক্রিনে রয়ে গেছে— “লেকের ধারে যদি আসিস, আমি থাকব।”
সে চেয়েছিল না উত্তর দিতে, চেয়েছিল সবকিছু অস্বীকার করে যেভাবে এতদিন বেঁচে এসেছে সেভাবেই চলতে। কিন্তু শরীর আর মন একসঙ্গে কখনও একই রাস্তায় হাঁটে না। দুপুরের পর হঠাৎ করে আকাশ মেঘে ঢেকে গেল, অফিসের ভিতর অন্ধকার ছায়া পড়ল। অজানা এক তাগিদে সে কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ল।
ট্যাক্সির জানালায় টুপটাপ বৃষ্টি নামছে। মাধুরী হঠাৎ অনুভব করল, সে যেন ভেসে চলেছে এমন এক জায়গার দিকে, যার ঠিকানা তার জানা, কিন্তু তার নিজের কাছে ব্যাখ্যা নেই। গাড়ি থেমে গেল লেকের ধারে।
ঈশান সত্যিই দাঁড়িয়ে ছিল। ভিজে গাছের নিচে ছাতা ধরেছিল একহাতে, অন্য হাতে একটা বই। তাকে দেখেই মাধুরীর বুকের ভিতর কেমন যেন ধাক্কা লাগল। এত বছর পরও এই মানুষটার মুখ যেন তার ভেতরের নিস্তব্ধতার আয়না।
“তুই এলি।” ঈশানের গলায় অবাক আর আনন্দ মিশে।
“হ্যাঁ… ভাবিনি আসব।” মাধুরী হেসে ফেলল নিজের অজান্তেই।
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল লেকের পাড়ে। চারপাশে কাদা, ভেজা মাটি, গাছের গায়ে জমে থাকা জলকণা। শহরের শব্দ যেন এখানে এসে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর ঈশান বলল, “মনে আছে, আমরা একবার কলেজ থেকে পালিয়ে এখানে এসেছিলাম? তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল।”
“মনে আছে।” মাধুরী হালকা হেসে বলল। “তুই বলেছিলি—বৃষ্টির জল সব মুছে দেয়।”
“কিন্তু সব মুছে যায় না, তাই তো?” ঈশান তাকাল তার চোখে।
মাধুরী উত্তর দিল না। শুধু জলের দিকে তাকিয়ে থাকল। সত্যিই তো, কতকিছুই থেকে যায়—অর্ধেক লেখা কবিতা, না পাঠানো চিঠি, অস্বীকার করা অনুভূতি।
লেকের ধারের বেঞ্চে বসে তারা ভিজে হাওয়া গায়ে মাখল। ঈশান ব্যাগ থেকে একটা পুরনো নোটবুক বের করল। পাতায় কালি ছড়িয়ে থাকা কিছু কবিতা, কিছু অদ্ভুত আঁকিবুঁকি।
“তোর লেখা?” মাধুরী অবাক হল।
“হ্যাঁ। অনেকদিন ধরে লিখি। কিন্তু প্রকাশ করি না। কেবল নিজের জন্য।”
পাতা উল্টিয়ে মাধুরী একটা লাইন পড়ল: “জলরঙে আঁকা মুখ কাঁচের জানালায় ভিজে যায়, কিন্তু ভিতরের মানুষ ভিজে না।”
এই লাইনটা পড়তেই বুকের মধ্যে কেমন চাপা টান অনুভব করল সে। যেন নিজের জীবনটা এভাবে লেখা হয়ে গেছে।
“তুই এখনও লিখিস?” ঈশান প্রশ্ন করল।
মাধুরী মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। “না। আমি এখন কেবল বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন লিখি। যেগুলোতে কবিতার মতো শব্দ থাকে, কিন্তু কবিতা হয় না।”
ঈশান তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তুই নিজেকে ভুলে গেছিস, মাধুরী।”
এই বাক্যটা হঠাৎ করে তাকে অস্থির করে তুলল। যেন তার সমস্ত গোপন শূন্যতা উন্মোচিত হয়ে পড়ল কারও সামনে। সে অন্যদিকে তাকাল, জলের ঢেউয়ে মন ডুবিয়ে দিল।
বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, কিন্তু বাতাসে কাঁচা গন্ধ। ঈশান উঠে দাঁড়াল। “চল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই।”
মাধুরী মাথা নাড়ল। “না, আমি নিজে যাব।”
তাদের মধ্যে নীরবতা নেমে এলো। কিন্তু সেই নীরবতার ভিতরে যেন অনেক কিছু ভাসছিল। ঈশান আর কিছু বলল না, শুধু চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি রেখে গেল।
বাড়ি ফেরার পথে ট্যাক্সির জানালায় নিজের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে রইল মাধুরী। কাঁচের ওপারে শহরের আলো ঝাপসা, ভেতরে তার মুখ। এই কাঁচের জানালাটা যেন তার জীবন—ভেতরের মুখ, আর বাইরের শহর, আলাদা, তবু পাশাপাশি।
ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখল সৌরভ টেবিলে বসে কাজ করছে। “আজ আবার দেরি?”— সৌরভ জিজ্ঞেস করল, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।
“হ্যাঁ… একটু লেট মিটিং ছিল।” মাধুরী মিথ্যে বলল।
সৌরভ আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। ল্যাপটপের আলোয় তার মুখ নিস্তরঙ্গ।
রাতের খাবারের পর মাধুরী একা দাঁড়াল বারান্দায়। ফোনে আবার মেসেজ এল—ঈশান: “আজকের বিকেলটার জন্য ধন্যবাদ। কাঁচের জানালার ভেতরটা একদিন খুলে দিস।”
মাধুরী স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর উত্তর দিল না। শুধু ফোনটা চুপ করে টেবিলে রেখে দিল।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা সুর বাজতে লাগল—অচেনা, অস্বস্তিকর, অথচ গভীরভাবে আকর্ষণীয়।
বিছানায় শুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে ভাবল—এই কাঁচের জানালাটা কি ভাঙবে কোনোদিন? নাকি সবকিছু এইভাবেই, আধভিজে, আধআঁধারে থেকে যাবে?
পর্ব ৪: রোদে দাগ
সকালটা একেবারে উজ্জ্বল ছিল। জানলার কাচ দিয়ে রোদের আলো বিছানার চাদরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তবু মাধুরীর শরীরটা অদ্ভুত ভারী লাগছিল। মাথার ভেতরে যেন গতকালের বিকেলের লেকের ছবি আটকে আছে—ঈশানের চোখ, সেই নীরবতার ভার, আর তার নিজের অস্বস্তি।
সৌরভ টেবিলে বসে অফিসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে casually বলে উঠল,
“তুমি আজ অফিসে একটু আগে বেরোবে তো? নন্দিনী আসবে ঘর পরিষ্কার করতে।”
“হ্যাঁ, বেরোব।” মাধুরীর গলায় কেমন শুষ্কতা।
তারপরই সৌরভের এক প্রশ্ন—“গতকাল লেট মিটিং বলেছিলে, কেমন হল?”
মাধুরী এক মুহূর্ত থেমে গেল। মিথ্যে বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল না, বরং সহজ লাগছিল। এটাই তাকে ভয় পাইয়ে দিল। “ভালোই হয়েছে। ক্লায়েন্ট সন্তুষ্ট।”
সৌরভ হেসে ল্যাপটপ ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। দরজার কাছে এসে বলল,
“আজ রাতে আমার কনফারেন্স কল আছে। তুমি ডিনার আগে খেয়ে নিও।”
এইরকমই। যত্নের মতো শোনালেও শব্দগুলো নিরপেক্ষ, নিরাসক্ত। যেন কেউ চেকলিস্ট পড়ছে।
দরজা বন্ধ হতেই মাধুরী বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত চাপা নিঃসঙ্গতা অনুভব করল। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রোদের আলো তার গায়ে পড়ছিল, আর সেই আলোর ভেতরে কোথাও একটা দাগ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল—যেটা সে এতদিন চাপা দিয়ে রেখেছিল।
আলমারির ড্রয়ারে হাত ঢুকিয়ে বের করল সেই পুরনো পোস্টকার্ডের গুচ্ছ। আজ আবার সেগুলো একে একে উল্টে দেখতে লাগল। একটা চিঠি বেরিয়ে এল—বছরের পর বছর চাপা পড়ে থাকা। সেই চিঠির শেষ লাইনটা: “আমরা কি নাম দিতে পারি?”
চোখ জলে ভিজে উঠল। কত সহজেই একটা প্রশ্ন তার পুরো জীবনকে বদলে দিতে পারত! অথচ সেই সাহসটা সে পায়নি।
মোবাইলটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে বার্তা: “আজ রোদে বেরিয়েছিস? তোর চোখে রোদ কেমন লাগে, জানিস?”—ঈশান।
মাধুরী টেবিলে বসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বার্তার দিকে। তারপর হালকা একটা উত্তর লিখল: “রোদে চোখে দাগ পড়ে। তবু ভালো লাগে।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এল: “আমারও তাই। একদিন দেখাবি?”
হঠাৎ তার মনে হল, এই কথোপকথনগুলো এক অদৃশ্য জালে জড়িয়ে ফেলছে তাকে। চাইলে সহজেই এড়িয়ে যেতে পারত, কিন্তু যাচ্ছে না।
অফিসে পৌঁছে কাজের মধ্যে ডুবে গেল। কিন্তু প্রতিটি ফাঁকেই ঈশানের নাম যেন ভেসে উঠছিল। লাঞ্চ টাইমে সহকর্মীরা গল্প করছে, হাসছে—মাধুরীর মনে হচ্ছিল সে বাইরে থেকে দেখছে সবকিছু, নিজের ভেতরের স্রোতটাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
দুপুরে হঠাৎ সৌরভ ফোন করল। “আজ সন্ধ্যায় হয়তো একটু আগে ফিরব। কনফারেন্স কলটা ক্যানসেল হয়েছে।”
“আচ্ছা,” মাধুরী বলল, কিন্তু তার গলায় একফোঁটা উচ্ছ্বাসও শোনা গেল না। বরং অদ্ভুত অস্বস্তি হল। যদি ঈশান আবার বার্তা পাঠায়? যদি দেখা করতে চায়?
বিকেলে বৃষ্টি নামল না, বরং রোদের ঝলকানি বাড়ল। অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ ঈশানের ফোন এল।
“একটু সময় হবে?”
মাধুরী দ্বিধায় পড়ে গেল। গলাটা শুকিয়ে গেল।
“আজ… সৌরভ আগে ফিরছে।”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নরম গলায় বলল,
“ঠিক আছে। তবু তুই যখন খুশি, বলিস।”
কলটা কেটে যাওয়ার পর মাধুরীর বুকের ভেতর যেন এক অদ্ভুত ফাঁকা তৈরি হল।
বাড়ি ফিরে সত্যিই সৌরভকে পেল বসার ঘরে। হাতে খবরের কাগজ, টেবিলে চায়ের কাপ। হেসে বলল,
“আজ তোদের প্রেজেন্টেশনের কথা শুনেছি বসদের থেকে। ভালো কাজ করেছ।”
মাধুরী অবাক হল। এতদিন পর স্বামীর মুখে প্রশংসা। তবু আনন্দ হল না। বরং আরও একটা শূন্যতা চেপে ধরল। প্রশংসার শব্দগুলো যেন তার গায়ে গা ছোঁয়াচ্ছে না।
ডিনারের সময় দু’জনের মধ্যে সাধারণ কথাবার্তা চলল—বাজার, বিদ্যুতের বিল, নন্দিনীর কাজ। অথচ ভেতরে ভেতরে মাধুরী অন্য কোথাও ছিল।
রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। সৌরভ ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে গেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে রোদের শেষ দাগটা যেন এখনও ভেসে আছে তার চোখে।
হঠাৎ ফোন কেঁপে উঠল। ঈশানের বার্তা: “আজও মাঝরাস্তায় রইলি?”
মাধুরী চোখ বুজল। উত্তর দিল না। তবু বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আলোড়ন উঠল—যেন রোদের দাগ চামড়া ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গেছে।
সে জানে, এই দাগ সহজে যাবে না। বরং আরও স্পষ্ট হবে।
পর্ব ৫: সাদা মিথ্যে
সকালবেলা রান্নাঘরের ভেতর ভাতের গন্ধ ভেসে আসছিল। নন্দিনী কড়াইতে নাড়ছিল, আর মাধুরী ডাইনিং টেবিলে বসে অফিসের কাগজপত্র গোছাচ্ছিল। সৌরভ হঠাৎ এসে বলল,
“আজকে তোদের আবার লেট মিটিং আছে?”
মাধুরী এক মুহূর্ত থেমে গেল। মনে পড়ে গেল গতকালের রাতের বার্তা—ঈশানের: “আজও মাঝরাস্তায় রইলি?” সে উত্তর দেয়নি। তবু বার্তাটা বুকের ভেতরে গেঁথে ছিল।
“হ্যাঁ,” সে শান্ত গলায় বলল, “আজও লেট হবে।”
এই মিথ্যেটা বলা সহজ ছিল। এত সহজ যে নিজেরই ভয় হচ্ছিল। সৌরভ কিছুই সন্দেহ করল না, বরং হালকা মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে। আমি অফিস থেকে ফেরার সময় খাবার নিয়ে আসব।”
মাধুরীর মনে হল, সংসারের গাঁথুনি আসলে সাদা মিথ্যের উপরই দাঁড়িয়ে থাকে। কে কার কাছে কী গোপন করে, কতটা চেপে যায়—এসব হিসেবেই সংসার টিকে থাকে।
অফিসে পৌঁছে কাজের ভিড় সামলাতে সামলাতে বারবার ফোনটা কাঁপছিল। ঈশানের বার্তা: “আজ কি দেখা হবে?”
মাধুরী প্রথমে উত্তর দিল না। কিন্তু দুপুরের পর জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়তেই মনে হল, যদি সে না যায়, তবে নিজের ভিতরের স্রোতটাকে বাঁধতে পারবে না। সে লিখল: “হ্যাঁ, বিকেলে।”
লেকসাইড নয়, এবার তারা দেখা করল শহরের এক নতুন কফিশপে। কাচের দেয়ালঘেরা, নরম আলো, নিস্তরঙ্গ সুর বাজছে ভেতরে। ঈশান আগে থেকেই বসে ছিল। মাধুরী ঢুকতেই তার চোখে যে আলো ঝিলিক দিল, তা যেন কফিশপের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল।
“তুই এলি।” ঈশানের কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বস্তি।
“হ্যাঁ… জানতাম না আসব কি না। কিন্তু চলে এলাম।”
দু’জনেই কফি অর্ডার দিল। কাপ টেবিলে এল, কিন্তু তাদের কথা যেন কফির বাষ্পে মিলেমিশে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঈশান হঠাৎ বলল,
“তোর চোখে আজ খুব ক্লান্তি। সব ঠিক আছে?”
মাধুরী হেসে ফেলল। “সব ঠিক। সংসার, অফিস, কাজ—সব মিলিয়ে একটু ব্যস্ত।”
“ব্যস্ততা আর শূন্যতা এক জিনিস নয়।” ঈশান চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
কথাটা শুনে মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। মনে হল, এই মানুষটা যেন তার অদৃশ্য ফাঁকগুলো এক ঝলকে পড়ে ফেলছে।
হঠাৎ ঈশান নরম গলায় বলল,
“মনে আছে, একবার তুই বলেছিলি—ভালোবাসা মানেই না হয় নাম দেওয়া? শুধু অনুভূতি থাকলেই হয়?”
মাধুরী স্তব্ধ হয়ে গেল। এই কথাটা সে বহু বছর আগে বলেছিল, যখন তারা কলেজে ছিল। ঈশান এখনও মনে রেখেছে!
কফিশপের ভেতর থেকে বাইরে তাকালে শহরের ব্যস্ততা চোখে পড়ে—গাড়ি, আলো, মানুষ। অথচ তাদের টেবিলে এক অদ্ভুত শান্তি। যেন তারা একটা আলাদা জগতে আছে।
“তুই সুখী?”— ঈশানের প্রশ্নটা হঠাৎ ছুঁড়ে দেওয়া পাথরের মতো লাগল।
মাধুরী উত্তর খুঁজল। সৌরভের যত্ন, সংসারের স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা—এসবই তো আছে। তবু কি এটাই সুখ? নাকি সুখ অন্যকিছু?
“জানি না।” সে ফিসফিস করে বলল।
ঈশান কফির কাপ নামিয়ে রাখল। “আমারও তাই মনে হয়।”
তাদের মধ্যে কথার চেয়ে নীরবতাই বেশি বলছিল। মাধুরীর মনে হচ্ছিল, এই নীরবতাই তার প্রয়োজন—যেখানে সে নিজের সত্যিটুকু আড়াল না করেও শ্বাস নিতে পারে।
বিকেল গড়িয়ে এলে তারা বিদায় নিল। বাইরে তখন রোদ নরম হয়ে এসেছে। ঈশান বলল,
“আমি তোকে মিথ্যে বলার জন্য ডাকি না, মাধুরী। তুই যখন আসিস, মনে হয় সত্যিই তোর দরকার ছিল।”
মাধুরীর চোখে জল এসে গেল। কিছু না বলে স্রেফ মাথা নাড়ল।
বাড়ি ফিরতেই সৌরভের কণ্ঠ—
“খুব লেট হল আবার। প্রেজেন্টেশনটা ভালো হয়েছে?”
“হ্যাঁ।” মাধুরী মুচকি হেসে বলল।
আবার সেই সাদা মিথ্যে। ছোট্ট, নিরীহ, অথচ তীব্র।
ডিনারের সময় সৌরভ বলছিল অফিসের কাজের কথা। মাধুরী শুনছিল, কিন্তু মন অন্য কোথাও। প্রতিটি বাক্যের আড়ালে যেন ঈশানের চোখ, তার নীরবতা ভেসে উঠছিল।
রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ ফোনে বার্তা এল—ঈশান: “আজকের সন্ধেটা মনে রাখব। তুই?”
মাধুরী অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল স্ক্রিনে। তারপর লিখল: “আমি তোকে মিথ্যে বলি। তবু মনে হয়, এটাই আমার সত্যি।”
বার্তাটা পাঠিয়েই সে বুকের ভেতরে অদ্ভুত স্বস্তি পেল, আবার ভয়ও।
ফোনটা নিভিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করল। তার মনে হল, এই সাদা মিথ্যে যেন রোদের দাগের মতো—চামড়ায় ছোট্ট এক আঁচড়, কিন্তু গভীরে ঢুকে গিয়েছে।
পর্ব ৬: লেকের ধারে
শনিবার দুপুর। কলকাতার আকাশে হালকা রোদ, কোথাও কোথাও সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মাধুরীর শরীরজুড়ে ক্লান্তি, তবু আজকের দিনটাকে সে আলাদা করে রেখেছিল নিজের জন্য। সকালে সৌরভ অফিসে বেরিয়ে গেছে—উইকএন্ড হলেও মাঝে মাঝে তার প্রজেক্টের কারণে বাইরে যেতে হয়। এই একাকিত্বটাই মাধুরীর কাছে সুযোগ।
ফোনে ঈশানের বার্তা: “আজ লেকের ধারে একটু হাঁটবি?”
মাধুরী জানত, যাওয়া উচিত নয়। প্রতিবারই সে নিজেকে বোঝায়—এই হবে শেষ। অথচ শেষ বলে কিছু থাকে না। সুতোর মতো টান বারবার টেনে নিয়ে যায় তাকে। সে লিখল: “ঠিক আছে, তিনটের পর।”
লেকের ধারে যখন পৌঁছল, তখন সূর্যের আলো নরম হতে শুরু করেছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছিল জলে। বাতাসে কাঁচা ঘাসের গন্ধ। বেঞ্চে বসে ছিল ঈশান, তার চোখে সেই চিরচেনা নীরবতা।
“তুই এলি।” ঈশানের গলায় অদ্ভুত কোমলতা।
“হ্যাঁ। আসব না ভাবছিলাম। কিন্তু…”
“কিন্তু?”
মাধুরী হাসল। “কিন্তু আমি জানি, না এলে সারাদিন একটা শূন্যতা থেকে যাবে।”
ঈশান চুপ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। চোখে এমন দৃষ্টি, যেটা মাধুরী অনেক বছর দেখেনি কারও কাছে।
দু’জনে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল লেকের পাড় ধরে। জলের গায়ে আলো নেচে যাচ্ছে, চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় মানুষ—কেউ হাত ধরে হাঁটছে, কেউ চুপ করে বসে আছে। অথচ তাদের দু’জনের হাঁটা যেন আলাদা, অন্যরকম।
একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে ঈশান বলল,
“মাধুরী, আমি জানি তুই অপরাধবোধে ভুগিস। কিন্তু জানিস, এই দেখা করার মধ্যে আমি কোনো অন্যায় দেখি না।”
“কেন?”
“কারণ তুই এখানে আসিস নিজের সত্যিটাকে মনে করিয়ে দিতে। তোর ভেতরে যে মানুষটা হারিয়ে গেছে, আমি কেবল তাকে ডাক দিই।”
কথাগুলো শুনে মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। সত্যিই তো, কতদিন সে নিজের ভেতরের মানুষটার সঙ্গে কথা বলেনি। সংসারের দৌড়ঝাঁপ, অফিসের চাপ—সবকিছু মিলে যেন সে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের কণ্ঠ।
অনেকক্ষণ তারা চুপ করে বসে রইল। তারপর হঠাৎ মাধুরী বলল,
“তুই কখনও বিয়ে করলি না কেন?”
ঈশান মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। “চেষ্টা করেছি। দু-একটা সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু কোথাও যেন আমি সত্যি ছিলাম না। মনে হত, আমি অভিনয় করছি। তারপর ছেড়ে দিলাম।”
“আর একা থাকা কষ্টকর হয় না?”
“হয়। কিন্তু ভুয়ো সঙ্গের চেয়ে একা থাকা ভালো। অন্তত আয়নায় তাকালে নিজেকে মিথ্যে বলতে হয় না।”
এই কথাগুলো মাধুরীর কানে যেন বজ্রপাতের মতো লাগল। সে জানত, নিজের সংসারে প্রতিদিন সে ছোট ছোট সাদা মিথ্যে বলে চলেছে। সেই মিথ্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতিদিনের জীবন।
বিকেলের হাওয়া ক্রমশ ঠান্ডা হচ্ছিল। লেকের ওপরে আলোর রেখা ভেঙে যাচ্ছিল। ঈশান পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে দিল। তাতে হাতে লেখা কয়েকটা লাইন—
“তুই যখন হাসিস, শহরটা যেন ভিজে ওঠে।
তোর চোখে আমি যে জল দেখি, তা শুধু বৃষ্টি নয়,
তা আমার না বলা কথা।”
মাধুরীর হাত কেঁপে উঠল। সে জানত, এটা কবিতা নয় শুধু—এটা একরকম স্বীকারোক্তি।
“এগুলো কেন লিখিস?”
“কারণ অন্যভাবে বলা যায় না। তুই যদি না পড়িস, তবু আমি লিখি। কারণ এটা না লিখলে আমি বাঁচতে পারব না।”
মাধুরীর মনে হল, এই মানুষটার জন্য সে যেন অদৃশ্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। অথচ সংসারে সে প্রয়োজনীয়, কিন্তু দৃশ্যমান নয়।
হঠাৎ ঈশান বলল,
“তোর কি কখনও মনে হয়, তুই যে জীবন বেছে নিয়েছিস, সেটা তোর নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্য?”
মাধুরী চুপ করে গেল। উত্তর তার কাছে নেই।
সন্ধে নামার আগে তারা বিদায় নিল। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঈশান বলল,
“মাধুরী, তুই যখন ফিরে যাবি, আবার মিথ্যে বলবি। আমি জানি। কিন্তু অন্তত নিজের কাছে সত্যিটা চাপিস না।”
মাধুরীর গলায় কথা আটকে গেল। সে কেবল মাথা নাড়ল।
বাড়ি ফিরে দেখল সৌরভ এখনও ফেরেনি। টেবিলে একটা নোট পড়ে আছে—“দেরি হবে, তুমি খেয়ে নিও।”
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এই নোটের অক্ষরগুলো যেন তার সংসারের প্রতিচ্ছবি—সংক্ষিপ্ত, প্রয়োজনীয়, কিন্তু অনুভূতিহীন।
রাত গভীর হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনটা খুলল। ঈশানের বার্তা: “আজকের বিকেলটা আমার কাছে সত্যি ছিল।”
মাধুরী উত্তর দিল না। তবু তার বুকের ভেতরে আজ এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। যেন লেকের জলে ভেসে থাকা আলোর রেখা এখনও তার চোখে লেগে আছে।
সে জানে, এই শান্তি স্থায়ী নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটুকুই তার কাছে যথেষ্ট।
পর্ব ৭: লুকোনো দরজা
অক্টোবরের শুরুতে হঠাৎ শহরের হাওয়ায় উৎসবের গন্ধ ভেসে এল। রাস্তায় আলোর তার ঝুলছে, পুজোর কেনাকাটায় ভিড় জমছে। অথচ মাধুরীর ভিতরে কোনও উৎসব নেই। বরং ভেতরে একটা ভার, যেটা দিন দিন বাড়ছে।
সকালে অফিসে যাওয়ার আগে সৌরভ হঠাৎ বলল,
“আমাকে হয়তো বদলি হতে হবে। কোম্পানির নতুন প্রজেক্ট হায়দরাবাদে। কনফার্ম হয়নি এখনও, কিন্তু খুব সম্ভব।”
মাধুরীর হাতের কাপে থাকা চা হঠাৎ কেঁপে উঠল। “মানে? তুমি ওখানে থাকবেই?”
“হয়তো। কয়েক মাস অন্তত। পরে স্থায়ী হলে তোমাকেও নিয়ে যাব।”
সে কিছু বলল না। মাথা নেড়ে শুধু বলল, “আচ্ছা।”
কিন্তু ভিতরে ভিতরে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। হায়দরাবাদ—মানে পরিচিত শহর, পরিচিত রাস্তাঘাট, এই ফ্ল্যাট, এমনকি ঈশান থেকেও দূরত্ব।
অফিসের কাজ সে এদিন গুছিয়ে করতে পারল না। মাথায় বারবার ঘুরছিল সৌরভের কথা। তার মনে হচ্ছিল, জীবন যেন তাকে একটা লুকোনো দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই দরজা খুললেই সব পাল্টে যাবে।
বিকেলে ঈশানের বার্তা এল— “আজ একটু দেখা করব?”
মাধুরী অনেকক্ষণ দ্বিধায় ছিল। তারপর লিখল, “হ্যাঁ। লেকের পাশেই।”
লেকের ধারে আজ ভিড় কম। আলোও ফিকে হয়ে এসেছে। বেঞ্চে বসে ছিল ঈশান। মাধুরী পাশে বসতেই সে বুঝে ফেলল কিছু একটা হয়েছে।
“তুই অস্থির লাগছিস। কী হয়েছে?”
মাধুরী নীচের জলে তাকাল। “সৌরভের বদলির সম্ভাবনা আছে। হায়দরাবাদ।”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদু গলায় বলল,
“তাহলে তোকে দূরে নিয়ে যাবে।”
“হয়তো।”
“তুই চাইছিস?”
এই প্রশ্নটা যেন কাঁটার মতো বিঁধল। সে কিছুক্ষণ উত্তর খুঁজল। তারপর আস্তে বলল,
“আমি জানি না। জানি শুধু, আমি এই শহর ছাড়তে চাই না।”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “মাধুরী, জীবনে এক সময় প্রশ্নটা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়—‘তুই আসলে কী চাইছিস?’ এই প্রশ্ন এড়ানো যায় না।”
মাধুরীর চোখ ভিজে উঠল। সে সত্যিই জানে না। সংসারের নিরাপত্তা? নাকি নিজের ভিতরের সত্যি?
ঈশান বলল,
“জীবন তো একটাই। যদি নিজের জন্য না বাঁচিস, তবে কার জন্য?”
কথাগুলো শুনে বুকের ভেতরে ঝড় উঠল। সে চুপ করে ঈশানের দিকে তাকাল। চোখে এক অদ্ভুত টান।
হঠাৎ বাতাসে শাঁ শাঁ শব্দ হল। দূরে কোথাও পাখির ঝাঁক উড়ে গেল। মনে হল, এটাই হয়তো সেই সংকেত—কোনও একটা অচেনা দরজা খোলার।
“ঈশান…” সে ফিসফিস করে বলল।
ঈশান তার দিকে ঝুঁকে এল। তাদের মধ্যে দূরত্বটা মুহূর্তের জন্য মুছে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই মাধুরী সরে গেল। চোখে জল নিয়ে বলল,
“না। আমি পারব না।”
ঈশান শান্ত গলায় বলল,
“আমি তোকে কিছু জোর করছি না। আমি শুধু চাই তুই নিজেকে মিথ্যে না বলিস।”
মাধুরী মাথা নাড়ল।
বাড়ি ফেরার পথে তার মনে হচ্ছিল, নিজের ভিতরের দরজাটা যেন আজ সামান্য খোলা হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি নয়।
রাতে সৌরভ খবরের কাগজ পড়ছিল। মাধুরী হঠাৎ বলে ফেলল,
“যদি তোমার বদলি হয়, আমি কি এখানে থেকে যেতে পারব?”
সৌরভ অবাক হয়ে তাকাল। “মানে? আমি যদি চলে যাই, তুমি একা থাকবে?”
“হয়তো। অফিস তো এখানেই।”
সৌরভ একটু ভেবে বলল,
“দেখা যাক। এখনই কিছু বলার নেই।”
কথাটা বলে সে আবার কাগজে ডুবে গেল।
মাধুরী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দূরের আলো ঝাপসা লাগছিল। মনে হচ্ছিল, জীবনের লুকোনো দরজা এখন তার সামনে। ভেতরে যাওয়ার সাহস আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
ফোন কেঁপে উঠল। ঈশানের বার্তা: “যতক্ষণ না তুই নিজেকে বেছে নিচিস, ততক্ষণ তুই আটকে থাকবি।”
মাধুরী চোখ বন্ধ করল। বার্তাটা যেন তার ভেতরের সত্যিটাই লিখে দিল।
পর্ব ৮: ব্রেকিং পয়েন্ট
শহরের বাতাসে তখন উৎসবের উত্তেজনা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আলোর তোরণ, ঢাকের শব্দে মিশে গেছে মানুষের ভিড়। কিন্তু মাধুরীর ভেতরটা নিস্তব্ধ, যেন কোথাও গভীর অন্ধকার জমে আছে। বাইরে যত আলো, ভেতরে তত অন্ধকার।
সকালে অফিসে বেরোনোর আগে সৌরভ বলল,
“আমার বদলির নোটিশ এসে গেছে। আগামী মাসের মধ্যেই হায়দরাবাদ যেতে হবে।”
মাধুরী চুপ করে দাঁড়াল। তার মনে হচ্ছিল, যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।
“তুমি কী করবে?”— সৌরভ জিজ্ঞেস করল।
“মানে?”
“তুমি কি এখানেই থাকবে, না আমায় সঙ্গ দেবে?”
প্রশ্নটা এত সহজ, অথচ উত্তরটা এত কঠিন। মাধুরী জানে, এই মুহূর্তে বলা যে-কোনো শব্দ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সে বলল না। শুধু ফিসফিস করে বলল, “দেখা যাক।”
অফিসে পৌঁছেও মাথা ঘুরছিল। কাজের ফাঁকে ফোনটা কেঁপে উঠল—ঈশানের বার্তা: “আজ একবার দেখা করবি? জরুরি।”
মাধুরী প্রথমে দ্বিধা করল। তারপর ভাবল, এই অস্থিরতার মধ্যে একমাত্র ঈশানই তার কথা বোঝে। সে লিখল, “হ্যাঁ। সন্ধ্যায়।”
সন্ধ্যায় তারা দেখা করল একটা নির্জন ক্যাফেতে। আলো অল্প, সুর নরম। ঈশান বসেছিল কোণে। মাধুরী ঢুকতেই সে সরাসরি বলল,
“তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচিস। বলবি না?”
মাধুরীর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। “কি লুকোচ্ছি?”
“সৌরভের বদলির কথা।”
মাধুরী অবাক হল। “তুই জানলি কীভাবে?”
“তোর মুখেই পড়ে ফেলেছিলাম আগের দিন। আর আজ এক বন্ধুর থেকে শুনলাম।”
চুপচাপ কফির কাপ নাড়ছিল মাধুরী। তার গলায় কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না।
ঈশান মৃদু গলায় বলল,
“মাধুরী, আমি তোকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে চাই না। কিন্তু আমি চাই, তুই নিজের কাছে মিথ্যে না বলিস। তুই যদি এখানেই থাকতে চাই, তবে সেটা বল। আর যদি ওর সঙ্গে যেতে চাই, সেটাও বল। এই মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা তোর জন্য যন্ত্রণাদায়ক।”
মাধুরীর চোখে জল চলে এল। “আমি জানি না কী চাই।”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তুই জানিস। শুধু সাহস পাচ্ছিস না।”
ঠিক তখনই মাধুরীর ফোনে সৌরভের বার্তা এল— “আজ এত লেট কেন? ফিরছ তো?”
স্ক্রিনের আলোতে ঈশান সব দেখল। তার চোখে অদ্ভুত যন্ত্রণা ফুটে উঠল।
“তুই আবার মিথ্যে বলবি, তাই তো?”
মাধুরী কিছু বলল না। শুধু মাথা নীচু করে বসে রইল।
ঈশান উঠে দাঁড়াল। “আমি জানি, তুই কষ্ট পাচ্ছিস। কিন্তু আমি আর তোর মিথ্যের অংশ হতে চাই না।”
মাধুরীর বুক ভেঙে পড়ল। “ঈশান…”
“না, মাধুরী। আজ থেকে আমি আর তোর ছায়ার মতো থাকব না। তুই যদি সত্যিই আমাকে চাই, তবে খুঁজে নিস। নাহলে আমি হারিয়ে যাব।”
কথাগুলো বলে ঈশান চলে গেল।
মাধুরী বসে রইল একা। ক্যাফের আলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চোখের জলে। মনে হচ্ছিল, এটাই তার জীবনের ব্রেকিং পয়েন্ট—যেখান থেকে সবকিছু ভেঙে যাবে, বা নতুনভাবে তৈরি হবে।
বাড়ি ফিরতেই সৌরভ দরজার কাছে দাঁড়ানো। “এত দেরি হল কেন?”
মাধুরী ঠোঁট কামড়ে বলল, “অফিসে প্রেজেন্টেশন ছিল।”
সৌরভ চোখে তাকাল না, শুধু মাথা নাড়ল। তার নিস্পৃহতা যেন আরও তীব্র লাগছিল আজ।
রাতে আলো নিভে গেলে মাধুরী বিছানায় শুয়ে কাঁদছিল চুপচাপ। ফোনটা টেবিলে পড়ে ছিল, স্ক্রিন নিভে। ঈশানের কোনো বার্তা নেই।
কিন্তু বুকের ভেতরে যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আজকের রাতটা তাকে ভেঙে দিচ্ছিল ভেতর থেকে।
সে জানত, এই দ্বন্দ্ব আর টেকানো যাবে না। তাকে কোনো একপাশ বেছে নিতেই হবে।
পর্ব ৯: ফেরা
পুজোর ঢাকের শব্দ শহর জুড়ে বাজছে, আলোয় ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। অথচ মাধুরীর ভেতরটা নিস্তব্ধ। মানুষ যত উল্লাস করছে, তার বুকের ভেতর তত অদ্ভুত এক শূন্যতা।
ঈশানের সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার পর কেটে গেছে কয়েকদিন। সে আর ফোন করেনি, বার্তাও পাঠায়নি। মাধুরীর প্রতিদিন যেন শূন্যে ঝুলে থাকে। অফিসে যায়, হাসে, মিটিং করে—সব স্বাভাবিকতার অভিনয়। অথচ ভিতরে ভিতরে সে ভেঙে যাচ্ছে।
একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে সে হঠাৎ হাঁটতে লাগল। পায়ের তলা যেন নিজে থেকেই পথ চিনে নিল—সরাসরি লেকের ধারে। সেখানে পৌঁছে দেখল বেঞ্চটা খালি। ঈশান নেই। তবু সে বসে রইল অনেকক্ষণ। বাতাসে শুকনো পাতার শব্দ, জলের গায়ে চাঁদের আলো। মনে হচ্ছিল, ঈশান না থেকেও যেন আছে।
সে ভাবছিল, এই ফেরা কিসের? পুরনো জীবনে, নাকি নতুন জীবনে?
বাড়ি ফিরতেই সৌরভ অপেক্ষা করছিল। “তুমি কোথায় ছিলে?”
“অফিস থেকে একটু হাঁটছিলাম।” আবার সেই সাদা মিথ্যে।
সৌরভ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আমার বদলির ব্যাপারটা কনফার্ম হয়েছে। আগামী মাসে চলে যাব।”
মাধুরীর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। “আমি যদি এখানেই থাকতে চাই?”
সৌরভ অবাক হল। “মানে? তুমি একা থাকবে?”
“হয়তো।”
সৌরভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার ইচ্ছে হলে থেকো। আমি আপত্তি করব না।”
এই বাক্যটা শুনে মাধুরীর অদ্ভুত লাগল। আপত্তি নেই—মানে কি কোনো টানও নেই? সে কি সত্যিই এই সংসারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে?
সেদিন রাতে ঘুম এল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। হঠাৎ মনে হল, জীবনটা এক অদৃশ্য দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে—কোনও দিকে পড়ে গেলেই সব শেষ।
পরদিন দুপুরে সাহস সঞ্চয় করে মাধুরী লিখল: “ঈশান, আমরা কি দেখা করতে পারি?”
একটু পরেই উত্তর এল: “হ্যাঁ। আমি আছি।”
সন্ধ্যায় তারা দেখা করল। ঈশান চুপচাপ তাকিয়ে ছিল তার দিকে। অনেকক্ষণ পর বলল,
“তুই ফিরলি।”
মাধুরীর চোখে জল এসে গেল। “আমি তোকে হারাতে চাইনি। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম।”
ঈশান হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল। “ভয় থাকবেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুই সত্যিটা এড়িয়ে যাবি।”
দু’জনেই হাঁটতে লাগল লেকের ধারে। মাধুরী হঠাৎ বলে ফেলল,
“আমি জানি না সামনে কী হবে। সৌরভ চলে যাবে, আমি হয়তো এখানেই থাকব। কিন্তু আমি আর মিথ্যে বলতে চাই না।”
ঈশানের চোখে নরম আলো ফুটে উঠল। “এটাই তো চাই। তুই সত্যিটাকে মানলে বাকি সব নিজে থেকেই ঠিক হবে।”
আকাশে তখন পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছিল। মাধুরীর মনে হল, এই উড়ানটাই তার জীবনের প্রতীক।
বাড়ি ফেরার সময় সৌরভ টেবিলে বসে ছিল। “তুমি খুব দেরি করলে।”
মাধুরী এবার মিথ্যে বলল না। ধীরে ধীরে বলল, “এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলাম।”
সৌরভ কিছু জিজ্ঞেস করল না। শুধু মাথা নাড়ল। তার চোখে অদ্ভুত এক ক্লান্তি।
রাতে আলো নিভে গেলে মাধুরী বিছানায় শুয়ে অনেক ভেবেছিল। এই সংসার, এই মিথ্যে, এই দ্বন্দ্ব—সবকিছু তার কাছে অস্পষ্ট। তবু একটাই পরিষ্কার—সে আর নিজেকে অস্বীকার করতে পারবে না।
ভোরে ঘুম ভাঙার পর জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছিল। সেই আলোয় মাধুরীর মনে হল, সে যেন নতুন করে ফিরেছে—নিজের কাছে।
পর্ব ১০: বৃষ্টির পরে
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ। শহরে তখন হালকা শীতের ছোঁয়া, সকালবেলার হাওয়ায় একধরনের শুষ্কতা। মাধুরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। নিচে রাস্তায় মানুষজন তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছে, দোকানের শাটার উঠছে। তার ভেতরে একটা অদ্ভুত শান্তি—যেন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে হাওয়ায় নিঃশব্দ ভরাট হয়ে গেছে।
সৌরভের বদলির তারিখ নিশ্চিত হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই সে হায়দরাবাদ যাবে। মাধুরীকে কিছু বলেনি আর—কেবল একদিন রাতের খাবার খেতে খেতে casually বলে ফেলেছিল,
“তুমি যদি থাকতে চাও, থেকো। আমার আপত্তি নেই।”
কোনও টান নেই, কোনো আবেগ নেই। মাধুরী সেদিন আর কিছু বলেনি। কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন এক শূন্যতা পাক খেতে খেতে ভেঙে পড়েছিল।
সেদিনই সে ঠিক করেছিল—এইবার নিজের জীবনের দায়িত্ব সে নিজেই নেবে।
ঈশানের সঙ্গে দেখা হল পরদিন বিকেলে। লেকের ধারে নয়, এবার তারা গেল এক নির্জন ছাদের উপর। শহরের আলো দূরে, আকাশ ফাঁকা, আর কেবল বাতাস বইছে।
ঈশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। মাধুরী এসে বলল,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
ঈশান তাকাল তার চোখে। “কি সিদ্ধান্ত?”
“আমি আর মিথ্যে বলব না। সৌরভ চলে যাবে, আমি থাকব। আমার নিজের জীবনটা আমি নতুন করে শুরু করব।”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তাহলে তুই সত্যিই ফিরেছিস।”
মাধুরীর গলায় কম্পন ছিল, তবু দৃঢ়তা ফুটে উঠল। “আমি জানি না সামনে কী আছে। হয়তো আমরা একসঙ্গে থাকব, হয়তো আলাদা। কিন্তু আমি অন্তত নিজের সত্যিটাকে বেছে নিলাম।”
ঈশান তার হাত ধরে বলল, “এটাই যথেষ্ট। বাকিটা আমরা খুঁজে নেব।”
হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে উঠল। অল্প পরেই বৃষ্টি শুরু হল। ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দু’জনেই ভিজতে লাগল। মাধুরীর মনে হচ্ছিল, এই বৃষ্টি যেন তার সব পুরনো দাগ মুছে দিচ্ছে—সাদা মিথ্যে, অপরাধবোধ, দ্বিধা।
সে হেসে উঠল, অদ্ভুত মুক্তির হাসি। ঈশান অবাক হয়ে তাকাল।
“কী হল?”
“মনে হচ্ছে, আমি আবার বেঁচে উঠেছি।”
বৃষ্টির ফোঁটা তার চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল, চোখের পাপড়ি ভিজে যাচ্ছিল। ঈশানের চোখে তখন শুধু একটাই দৃশ্য—মাধুরী, নতুন করে জন্ম নেওয়া এক নারী।
বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। রাস্তায় ভিজে মাটি, আলো ঝলমল করছে। মাধুরীর মনে হচ্ছিল, এটাই তার নতুন জীবনের শুরু।
ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল, সৌরভ টেবিলে বসে আছে। ব্যাগ গুছোচ্ছে। মুখে কোনও আবেগ নেই। মাধুরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর সৌরভ বলল,
“তুমি ঠিক করেছ?”
মাধুরী মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আমি এখানেই থাকব।”
সৌরভ শুধু মাথা নাড়ল। কোনও প্রশ্ন নেই, অভিযোগ নেই। যেন দু’জনের মধ্যে একটা চুক্তি হল—নীরব, কিন্তু চূড়ান্ত।
রাতে শুয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল মাধুরী। আকাশ পরিষ্কার, বৃষ্টির পরে নক্ষত্রগুলো আরও স্পষ্ট। তার মনে হচ্ছিল, জীবনের আকাশও পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সে জানে, এই পথ সহজ নয়। সামনে অনেক প্রশ্ন আসবে, অনেক দ্বন্দ্ব। কিন্তু সে অন্তত আজ নিজের সত্যিটাকে বেছে নিয়েছে।
মোবাইল কেঁপে উঠল। ঈশানের বার্তা: “আজ বৃষ্টির পরে আকাশ পরিষ্কার। তুইও।”
মাধুরী স্ক্রিনে তাকিয়ে হাসল। উত্তর দিল না। কারণ এইবার আর কোনও শব্দের প্রয়োজন নেই।
তার বুকের ভেতরে আজ একটাই সুর বাজছিল—
বৃষ্টির পরে ছাদে দাঁড়ালে যেমন সবকিছু নতুন লাগে, তেমনি নতুন তার জীবন।
সমাপ্ত