রুদ্র মুখার্জী
কলেজের প্রথম দিন থেকেই অয়ন আর স্রবন্তীর পথ যেন কেমন করে একে অপরের বিপরীতে গিয়েই দাঁড়িয়েছে। অয়ন ক্লাসের সবথেকে দুষ্টু, প্রাণোচ্ছল আর একরকম উড়নচণ্ডী ছেলে; তার হাসি, তার মজা করা আর বন্ধুদের নিয়ে হইচই করা যেন পুরো ব্যাচের অংশ হয়ে গেছে। স্রবন্তী ঠিক তার উল্টো—গম্ভীর, শান্ত, নিজের পড়াশোনায় মন দেওয়া মেয়ে। একদিকে অয়নের স্বভাবসিদ্ধ ঠাট্টা, অন্যদিকে স্রবন্তীর শীতল জবাব—এই দুটোই কলেজের আড্ডাঘরে একধরনের নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দিনেই ঘটনা ঘটে—অয়ন স্রবন্তীর খাতা উল্টে বলেছিল, “এত সুন্দর হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে ফন্ট বানিয়ে দেওয়া উচিত।” ক্লাস হেসে গড়াগড়ি, আর স্রবন্তীর গম্ভীর মুখ আরও কঠিন হয়ে যায়। সে জবাব দিয়েছিল ঠাণ্ডা স্বরে—“সবাই তোমার মতো ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে ঘোরে না।” সেই মুহূর্ত থেকে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে যায়, যা প্রতিদিনের তর্কে, খোঁচায়, এবং বিরক্তিকর হাসিতে আরও শক্ত হয়। বন্ধুরা মজা পেত, তারা বাজি ধরত যে এদের কেউ একদিন নিশ্চয় কিছুর না কিছুর জন্য একসাথে ধরা পড়বে; কিন্তু অয়ন আর স্রবন্তী, দু’জনের কাছেই এই সম্পর্কটা ছিল কেবলমাত্র চিরশত্রুতার প্রতীক।
দিন যত গড়াত, ততই তাদের সম্পর্কের এই টানাপোড়েন যেন আরও বেশি স্পষ্ট হতে থাকে। ক্লাসে অয়ন যদি কোনো কারণে দেরি করে ঢোকে, স্রবন্তী টিপ্পনী কাটত—“সময় মেপে ঢোকা কি খুব কঠিন?” অয়নও পিছিয়ে থাকত না, উত্তর আসত সাথে সাথে—“সবাই তোমার মতো কড়ি কড়ি ঘড়ি ধরে জীবন চালায় না।” প্রোজেক্টের কাজে একই গ্রুপে পড়লে রীতিমতো যুদ্ধ বেধে যেত। একে অপরের মতামতকে মানা তো দূরের কথা, দু’জনই চেষ্টা করত বিপরীত কিছু বলার। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, অন্য সবাই যখন তাদের ঝগড়া দেখে বিরক্ত হত, তখনই আবার অদ্ভুতভাবে ক্লাসটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। শিক্ষকরা অনেক সময় শাসন করলেও ভেতরে ভেতরে বুঝতেন, এই দুই ছাত্র-ছাত্রী যেন একে অপরের প্রতিচ্ছবি—তবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। দু’জনেরই মস্তিষ্ক তীক্ষ্ণ, দু’জনেই নিজের অবস্থান থেকে একচুল সরতে রাজি নয়। হয়তো সেই একগুঁয়েমিই তাদের দূরত্বকে আরও গভীর করে তুলেছিল।
তাদের বন্ধুরা কখনো মজা করে বলত, “তোমরা না আসলে একে অপরের জন্যই তৈরি, শুধু সেটা বুঝতে দেরি হচ্ছে।” কিন্তু অয়ন আর স্রবন্তী দু’জনের প্রতিক্রিয়াই ছিল সমান—একটু তাচ্ছিল্যের হাসি আর নির্লিপ্ততা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো এরা কখনো একে অপরের সঙ্গ মেনে নিতে পারবে না, যেন একসাথে একই ঘরে থাকাই অসম্ভব। তবু ভেতরে ভেতরে কিছু একটা অন্যরকম চলছিল, যা হয়তো দু’জনেই অস্বীকার করতে চাইত। অয়ন অনেক সময় অজান্তেই খেয়াল করত স্রবন্তীর মনোযোগী চোখ, তার দৃঢ়ভাবে উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি। আর স্রবন্তীও বুঝত, অয়নের হাসি যতই বিরক্তিকর হোক, তার মধ্যে একরকম চুম্বকীয় প্রাণশক্তি আছে। কিন্তু বাইরে এসে তারা সব ঢেকে রাখত ঝগড়ায়, খোঁচায়, আর ঠাণ্ডা জবাবে। এইভাবে তাদের কলেজ জীবন কাটছিল—দু’জন দু’প্রান্তে দাঁড়িয়ে থেকেও একই ভিড়ে, একই ক্লাসরুমে, একই জানালার ছায়ায় বাঁধা পড়ে। তারা কেউ জানত না, সামনে এক বৃষ্টির দিনে এই অদ্ভুত শত্রুতাই বদলে যাবে, জন্ম নেবে এক নতুন অধ্যায়ের।
***
সেদিন দুপুরের পর থেকেই আকাশে অস্বাভাবিক এক অন্ধকার নেমে এসেছিল। সূর্যের আলো ঢেকে গিয়ে কালো মেঘ যেন গিলে নিয়েছিল পুরো শহরটাকে। প্রথমে অয়ন আর স্রবন্তী ভেবেছিল এ কেবল হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হবে, যেমনটা বর্ষাকালে প্রায়ই হয়। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে হঠাৎই শুরু হলো প্রবল বর্ষণ—মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের ঝলকানি আর জানালার কাঁচে একের পর এক আছড়ে পড়া ফোঁটা। কলেজের করিডরে হৈচৈ শুরু হয়ে গেল, ক্লাস বাতিল করে দিয়ে শিক্ষকরা সবাইকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। ছাত্রছাত্রীরা ছাতা-রেইনকোট নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ল, যাদের কিছুই সঙ্গে নেই তারা ছুটে গেল গেটের বাইরে অটো বা বাস ধরতে। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই অয়ন আর স্রবন্তী নিজেদের মতো ব্যস্ত ছিল। স্রবন্তীর মাথায় তখন একটাই চিন্তা—আগামী সপ্তাহে জমা দিতে হবে এমন একটি প্রোজেক্টের নোট সে এখনো সঠিকভাবে গুছিয়ে নেয়নি। সে সিদ্ধান্ত নিল, বৃষ্টি যতই হোক না কেন, লাইব্রেরিতে গিয়ে শেষবারের মতো নোট দেখে নিয়ে তবে বেরোবে। অয়নও আসলে একই কারণে পিছিয়ে পড়েছিল—যদিও বাইরে থেকে সে দুষ্টুমি করত, ভিতরে ভিতরে প্রোজেক্টটা ঠিকমতো শেষ করতে না পারলে সে কেমন বিপদে পড়বে, সেটা সে ভালোভাবেই জানত। অদ্ভুতভাবে, দু’জন আলাদা আলাদা ভেবে একই সময়ে চলে গেল সেই ফাঁকা ক্লাসরুমে, যেখানে প্রোজেক্টের ফাইল রাখা ছিল।
ক্লাসরুমে ঢুকেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। বাইরে তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, আর ভিতরে দু’জন শত্রু যেন আটকে গেছে একই খাঁচায়। প্রথমে দু’জনেই একে অপরকে দেখে মুখ বিকৃত করল, যেন অন্য কাউকে পেলেই ভালো হতো। স্রবন্তী বিরক্ত মুখে বলল, “তুমি এখানে কেন? অন্য কোথাও যেতে পারতে না?” অয়ন কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, “দুঃখিত, আমি ভাবিনি এটা তোমার ব্যক্তিগত অফিসরুম।” বাইরে ঝড় তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল, বাতাসে জানালার কাঁচ কাঁপছিল, ভেতরে আলো মিটমিট করতে করতে অবশেষে নিভে গেল—বিদ্যুৎ চলে গেল পুরো এলাকায়। অন্ধকারে এক মুহূর্তের জন্য স্রবন্তী থমকে দাঁড়াল, আর অয়ন খেয়াল করল তার মুখে একফোঁটা উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তাদের চারপাশে কেবল বৃষ্টির আওয়াজ, জানালায় ধাক্কা দেওয়া বাতাসের শব্দ, আর দূরের বজ্রপাতের গর্জন। তারা দু’জনই বুঝতে পারল, আর যাই হোক এখন বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। ভেতরে ভেতরে দু’জনেই এই পরিস্থিতিতে খানিকটা অস্বস্তি অনুভব করছিল, কারণ একসাথে এতটা সময় কাটানো তাদের কারও পক্ষেই সহজ ছিল না। তবু উপায় না দেখে চুপচাপ বসে পড়ল দুই প্রান্তে, মাঝখানে কেবল টেবিল আর জানালার কাঁচ দিয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ধারা।
সময় যত এগোতে লাগল, পরিস্থিতিটা তত অদ্ভুত লাগতে শুরু করল। বাইরে ঝড়ের শব্দ একসময় যেন ভেতরে ঢুকে তাদের মাঝের নীরবতাকে আরও ভারী করে তুলল। সাধারণ দিনে হলে তারা এখন পর্যন্ত অন্তত দশটা তর্ক শুরু করে ফেলত, কিন্তু আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। অয়ন চেষ্টা করছিল বিরক্তির মুখোশ পরতে, কিন্তু চোখে চোখ পড়লেই তার মনে হচ্ছিল এই মেয়েটা কেবলই তার শত্রু নয়, এর ভেতরে আরেকটা গল্প লুকিয়ে আছে। স্রবন্তীও বুঝতে পারছিল, এই ভয়ংকর ঝড়ের মধ্যে সে একা হলে হয়তো আরও বেশি আতঙ্কিত হতো, অথচ অয়নের উপস্থিতি তাকে খানিকটা হলেও শক্ত করে রাখছে। জানালার ওপাশে পৃথিবী ডুবে যাচ্ছিল বৃষ্টির স্রোতে, আর ভেতরে তারা দু’জন ধীরে ধীরে যেন নিজেদের চারপাশের দেয়াল খেয়াল করা বন্ধ করে দিয়ে শুধুই শুনছিল বৃষ্টির শব্দ। সেই মুহূর্তে তারা কেউই জানত না, এই অপ্রত্যাশিত ঝড়ই আসলে তাদের জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের সূচনা। শত্রুতার মোড়ক ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছিল এক অনিশ্চিত কিন্তু টানটান সম্ভাবনার দরজা।
***
ঝড়ের শব্দ যেন যত তীব্র হচ্ছিল, ভেতরের নীরবতা ততই অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর স্রবন্তী প্রথমে মুখ খুলল, তার স্বর ছিল যথারীতি তীক্ষ্ণ। “তোমার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কারণে পুরো গ্রুপটাই সবসময় বিপদে পড়ে। আজ নোট নিতে আসছো, কিন্তু কাল জমা দেওয়ার সময়ই যদি হেসে উড়িয়ে দাও, তখন কী হবে?” অয়নের মুখে ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে উঠল। “ওহ, মহারানী আবার শুরু করলেন বক্তৃতা! জানো, তোমার এই অহংকারী স্বভাবটাই আসলে সব সমস্যার মূল। সবসময় মনে হয় তুমি-ই সঠিক, বাকি সবাই ভুল। তুমি না থাকলে নাকি দুনিয়া এগোতই না।” স্রবন্তীর চোখ চকচক করে উঠল, সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিল, “অন্তত আমি তোমার মতো সময় নষ্ট করি না। ক্লাসে ঢুকে মজা করা ছাড়া তোমার আর কোনো কাজ নেই।” দু’জনের কথার ধাক্কায় ক্লাসরুমের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। বাইরে বিদ্যুতের ঝলকানিতে তাদের মুখ দুটো কেমন যেন আলাদা নাটকের দৃশ্যের মতো ভেসে উঠছিল—একজন তীক্ষ্ণ যুক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে, আরেকজন ব্যঙ্গ আর রাগের তীর ছুঁড়ে চলেছে।
তর্কটা ধীরে ধীরে আরও গভীরে ঢুকে গেল, যেন এই বৃষ্টির সুযোগে দু’জনেই সব জমে থাকা ক্ষোভ বের করে ফেলছে। অয়ন হাত নেড়ে বলতে লাগল, “তুমি ভেবেছো খুব বুদ্ধিমতী? সত্যি বলতে কী, তুমি কেবল একটা বইপোকা। মানুষের সঙ্গে মেশার কোনো ক্ষমতা নেই তোমার। গ্রুপ প্রোজেক্ট মানেই টিমওয়ার্ক, আর তোমার ক্ষেত্রে সেটা মানে—সবাই তোমার আদেশ মেনে চলবে।” স্রবন্তী থেমে গেল না, আরও উগ্র হয়ে বলল, “আর তুমি? কোনো কাজের শুরু করলে শেষ করতে জানো না। মজার পেছনে এত দৌড়াও যে মূল জিনিসটাই হারিয়ে ফেলো। একদিন তোমার এই স্বভাব তোমাকেই ধ্বংস করবে।” তাদের কণ্ঠ এত উঁচু হয়ে উঠল যে মনে হচ্ছিল বাইরে ঝড়ের শব্দও হার মানছে। অয়ন চোখ রাঙিয়ে বলল, “শোনো স্রবন্তী, আমি যদি সত্যিই দায়িত্বহীন হতাম, তবে আজ এখানে এসে নোট নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। আমি অন্তত চেষ্টা করি—তুমি শুধু সবসময় দোষ খুঁজে বেড়াও।” স্রবন্তী তিরস্কারের হাসি দিয়ে বলল, “তুমি যা-ই বলো না কেন, আমি জানি তুমি বদলাবে না।”
কথাগুলো যেন তাদের ভেতরের চাপা অস্বস্তি আর অজানা অনুভূতিগুলোকে আরও গুলিয়ে দিল। বাইরে প্রবল বর্ষণ যেন তাদের রাগের প্রতিধ্বনি হয়ে ক্লাসরুমের কাঁচ কাঁপিয়ে তুলছিল। তবু অদ্ভুতভাবে, এই উত্তপ্ত ঝগড়ার মাঝেই দু’জনের মধ্যে একটা টান তৈরি হচ্ছিল, যা তারা কেউই স্বীকার করতে চাইছিল না। স্রবন্তীর চোখে ক্রোধ থাকলেও কোথাও যেন এক ঝলক অনিশ্চয়তার ছায়া দেখা যাচ্ছিল, আর অয়নের ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গির আড়ালে ছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। দু’জনেই জানত, এই লড়াইটা শুধু দায়িত্ব আর অহংকার নিয়ে নয়, এর আড়ালে আছে আরও গভীর কিছু—যা তারা এখনো ভাষায় আনতে পারছে না। ঝড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরের ভেতরও চলতে লাগল সেই তিক্ততার নাচ, যেন প্রকৃতি আর তাদের মনের অস্থিরতা এক হয়ে গেছে। তারা কেউ বুঝতে পারল না, এই ঝগড়াই আসলে ধীরে ধীরে তাদেরকে একে অপরের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে, যদিও আপাতত সেটা অস্বীকার করাই সহজ মনে হচ্ছিল।
***
তর্কের ঝাঁঝ শেষ হয়ে আসতেই হঠাৎ ঘরজুড়ে নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা। যেন দু’জনের কণ্ঠস্বর নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজটাও থেমে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এই বাকযুদ্ধে—স্রবন্তী এক কোণে চুপচাপ বসে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল, আর অয়ন ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এতক্ষণ যে কোলাহল চলছিল, তার বিপরীতে এই নিস্তব্ধতা ছিল অস্বস্তিকর অথচ গভীরভাবে স্বস্তিদায়কও। জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে নামছিল ধীরে ধীরে, প্রতিটি ফোঁটার শব্দ যেন ঝগড়ার সব কোলাহল মুছে দিয়ে বলছিল—কিছু কথার উত্তর হয়তো না বললেই ভালো। স্রবন্তীর বুক ধড়ফড় করছিল, এতক্ষণ রাগে কাঁপলেও এখন সে বুঝতে পারছিল তার ভেতরে অন্যরকম একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অয়ন ভেবেছিল স্রবন্তী আবার কিছু বলবে, কিন্তু তার নীরবতায় অয়নের ভেতরে হঠাৎ অচেনা এক টান তৈরি হলো। সে অবাক হয়ে দেখল, স্রবন্তী চুপচাপ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে একধরনের অগোচর স্বপ্নের ছাপ।
এই নিস্তব্ধ মুহূর্তে বাইরে হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা দিল। সেই আলোয় স্রবন্তীর মুখ আলোকিত হয়ে উঠল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ভেজা জানালার কাচে প্রতিফলিত আলো তার চোখে মুখে এমন এক কোমল ছায়া ফেলল, যা অয়নের চোখ সরাতে দিল না। সে প্রথমবার স্রবন্তীকে আর কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে পারল না, বরং একরকম অচেনা বিস্ময়ে আটকে গেল তার চোখের গভীরে। এতদিন ধরে যে তীক্ষ্ণ ভাষা, যে অহংকারের আড়ালে সে তাকে চিনেছে, সেই মুখের ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল অন্য এক স্রবন্তী—কোমল, ভীত, আবার একেবারে সত্যি। অয়ন হঠাৎ নিজের ভেতরেই প্রশ্ন করল—সে এতদিন কি সত্যিই স্রবন্তীকে চেনার চেষ্টা করেছে? নাকি কেবল শত্রু ভেবে একদিকটাই দেখেছে? স্রবন্তীর চোখে-মুখে সেই মুহূর্তে এমন কিছু ছিল, যা ঝগড়ার ভাষা দিয়ে বোঝা যায় না। অয়ন নিজেকে সামলাতে না পেরে এক মুহূর্তের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আর সেই শব্দে স্রবন্তী হকচকিয়ে ঘুরে তাকাল। চোখাচোখি হতেই দু’জনেই যেন হঠাৎ অন্য জগতে চলে গেল—যেখানে ঝগড়া নেই, অভিযোগ নেই, কেবল বৃষ্টির শব্দ আর নীরব জানালার সাক্ষ্য।
সেই চোখাচোখি থেকে দু’জনেই দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিলেও ভেতরে ভেতরে তারা দু’জনেই বদলে যাচ্ছিল। স্রবন্তীর বুকের ভেতর অচেনা কাঁপুনি তৈরি হলো, সে ভেবেছিল অয়নকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল অয়নকে ছাড়া এই ঝড়ের সময়টা আরও ভয়ঙ্কর হতো। অয়নও বুঝতে পারছিল, স্রবন্তীর উপস্থিতি তাকে অদ্ভুতভাবে শান্ত করছে, অথচ সেই স্বস্তির কথা মুখে আনা অসম্ভব। বাইরে আবার বজ্রপাত হলো, কিন্তু এখন আর ভয় লাগছিল না; বরং মনে হচ্ছিল বৃষ্টির প্রতিটি শব্দ তাদের দু’জনের নীরবতার সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন এক সম্পর্কের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঝগড়ার শেষে এই নীরবতাই তাদের দু’জনকে এক অচেনা শান্তির দিকে টেনে নিচ্ছিল, যেখানে প্রতিপক্ষ নয়, বরং একে অপরের সঙ্গী হিসেবেই তারা ধীরে ধীরে নিজেদের খুঁজে পাচ্ছিল। জানালার কাচে বৃষ্টির রেখার ভেতর দিয়ে যে অস্পষ্ট দৃশ্য ভেসে উঠছিল, সেটাই যেন ছিল তাদের ভবিষ্যতের এক ঝাপসা আভাস—যেখানে শত্রুতার আড়াল ভেদ করে জন্ম নিতে চলেছে এক অন্যরকম গল্প।
***
ঘরের ভেতরে নীরবতা আর বৃষ্টির শব্দ যেন একসঙ্গে মিশে গিয়েছিল। বাইরে বজ্রপাত মাঝে মাঝে আকাশকে সাদা আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তাদের দু’জনের মাঝে ধীরে ধীরে অন্য রকম আলো জ্বলে উঠছিল। ঝগড়ার পর যে শীতলতা নেমে এসেছিল, তার ভেতরেই কোথা থেকে যেন অয়ন কথা শুরু করল—“তুই জানিস, ছোটবেলায় আমি ভয়ানক দুষ্টু ছিলাম। পাড়ার সবাই বিরক্ত হয়ে যেত আমার জন্য।” স্রবন্তী একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। এমন ব্যক্তিগত কথা অয়ন খুব একটা বলে না। জানালার ভেজা কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দের ফাঁকে সে হালকা হাসল আর জিজ্ঞেস করল, “কী করতিস?” অয়ন হেসে বলল, “একবার পাড়ার দাদুর ছাতাটা চুরি করে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর লুকিয়ে দেখতাম উনি কীভাবে রাগে গজগজ করছেন।” কথাটা শেষ করে অয়ন নিজেই হাসিতে ফেটে পড়ল। স্রবন্তীও হাসি চেপে রাখতে পারল না। তার চোখের কোণে এক অচেনা কোমলতা ফুটে উঠল। মুহূর্তটায় তাদের মাঝে যে অদৃশ্য দেয়াল ছিল, তাতে ছোট একটা ফাটল ধরতে শুরু করল।
কথা এগোতে থাকল সহজ ভঙ্গিতে। অয়ন শোনাতে লাগল স্কুলের দিনগুলোর মজার ঘটনা—কীভাবে সে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ফুটবল খেলত, কীভাবে পরীক্ষার আগের রাতে টেবিলে বই খোলা রেখে ঘুমিয়ে যেত। স্রবন্তী হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে তোর এত অগোছালো হওয়া নতুন কিছু নয়।” অয়ন মাথা চুলকে হেসে বলল, “হয়তো। কিন্তু মায়ের কাছে আমি সবসময়ই বকা খেতাম। তবু মা-ই আমার সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল।” কথাটা বলার সময় অয়ন একটু চুপ করে গেল। তার চোখে যেন কোথাও একটা অতৃপ্তির ছায়া ভেসে উঠল। স্রবন্তী ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তোর মা এখন কেমন আছেন?” অয়ন জানাল, “ভালো আছেন, তবে শরীরটা তেমন ভালো থাকে না। আমি সবসময় চেষ্টা করি ওনার পাশে থাকতে।” স্রবন্তীর চোখ নরম হয়ে এলো। সে নিজেও পরিবারের প্রতি নিজের টানটান আবেগের কথা শোনাতে শুরু করল। বলল, “আমাদের বাড়িতে সবাই আমাকে অনেক আদর করে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি কিছুতেই বাঁধা পড়ি না। আমি চেয়েছি নিজের দায়িত্ব নিজের মতো নিতে।” কথাগুলো তার ঠোঁট থেকে বেরোতেই মনে হল যেন তার ভেতরের আরেকটা দরজা খুলে গেল।
এভাবে ধীরে ধীরে গল্প এগোতে লাগল। দু’জনের ভেতরের পুরনো ক্ষোভ যেন বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছিল। স্রবন্তী জানাল, কীভাবে ছোটবেলায় তার বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় আঙুর নিয়ে আসতেন আর সে লুকিয়ে সবার আগে খেয়ে ফেলত। আবার বলল, তার মা কড়া হলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ স্নেহশীলা। অয়ন মন দিয়ে শুনছিল, মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে হাসছিল, যেন এই প্রথমবার সে স্রবন্তীকে অন্যভাবে দেখতে পাচ্ছে। তাদের হাসি, স্মৃতি আর ছোট ছোট কাহিনি মিশে যাচ্ছিল বাইরের ঝড়-বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে। হঠাৎ এক মুহূর্তে তারা বুঝল—সময় কেটে যাচ্ছে অদ্ভুত দ্রুততায়, অথচ তাদের মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে তারা একে অপরকে অনেকদিনের চেনা মানুষ। দু’জনের মাঝের দূরত্ব আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছিল, যেন দেয়াল ভেঙে মিলে যাচ্ছে একটিমাত্র গল্পে।
***
হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুৎ চমকালো, তারপর সব অন্ধকার। পুরো ক্লাসরুম মুহূর্তের মধ্যে গাঢ় ছায়ায় ঢেকে গেল। বাইরে বৃষ্টির গর্জন যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল, বাতাসে জানালার কাঁচ কেঁপে উঠতে লাগল। স্রবন্তী প্রথমেই চমকে উঠল, তার বুকের ভেতর হঠাৎ কেঁপে ওঠা ভয়ের ঢেউ যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অন্ধকারে চারপাশ অস্পষ্ট, শুধু বৃষ্টির শব্দই পথ দেখাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে অয়নের দিকে তাকাল, কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছিল না—শুধু অন্ধকারের ভেতরে এক অনিশ্চিত উপস্থিতি। “অয়ন, আলো নিভে গেল!” স্রবন্তীর কণ্ঠে দুশ্চিন্তার কাঁপন স্পষ্ট শোনা গেল। অয়ন সামান্য দম নিয়ে এগিয়ে এলো, তার কণ্ঠ ভারী অথচ আশ্বস্ত করার মতো, “ভয় পাবার কিছু নেই, হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে আসবে।” কিন্তু তার নিজেরও বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অস্বস্তি জমে উঠছিল। হঠাৎ সে খেয়াল করল—স্রবন্তীর শ্বাস প্রায় তীব্র হয়ে উঠেছে, অন্ধকারে তার কাঁপুনি যেন কাছে বসেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
অয়ন কোনো কিছু না ভেবেই হাত বাড়িয়ে দিল। তার আঙুল ছুঁয়ে গেল স্রবন্তীর হাতের পিঠে। সেই স্পর্শ ছিল অনিচ্ছাকৃত, অথচ এক নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতির মতো। স্রবন্তী প্রথমে আঁতকে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে থেমে গেল। তার হাত কেঁপে উঠছিল, কিন্তু অয়নের স্পর্শে যেন একটু আশ্রয় পেল। অন্ধকারের ভেতরে অয়ন তার হাত আলতো করে চেপে ধরল, যেন বলল—“আমি আছি।” স্রবন্তীর বুকের ধুকপুকানি এতটাই জোরে চলছিল যে সে নিজেও টের পাচ্ছিল। সে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইল, কিন্তু কোথাও যাবার জায়গা নেই, শুধু সেই অন্ধকার, বৃষ্টি আর দু’জন মানুষের একসঙ্গে আবদ্ধ হয়ে থাকা নিঃশ্বাস। অয়নও নিজের ভেতরের ঢেউ সামলাতে পারছিল না। তার মনের মধ্যে হঠাৎ করে জন্ম নিল অচেনা টানাপোড়েন। এতদিন যার সঙ্গে প্রতিটি কথা ছিল তর্ক আর বিরক্তি, আজ সেই মানুষটিকে এভাবে কাছে টেনে নেওয়া তার নিজের কাছেই অদ্ভুত লাগছিল।
সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলল তারা। মিনিটগুলো থেমে গেল যেন। বাইরে বজ্রপাতের আলোয় একবার স্রবন্তীর মুখ ভেসে উঠল, আর অয়ন তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হল। তার চোখে অজানা ভয়ের ছায়া, আবার অদ্ভুত এক কোমলতাও। স্রবন্তীর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “অয়ন… তুই হাত ছাড়িসনি কেন?” অয়ন কিছু বলল না, শুধু নিঃশব্দে হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রাখল, যেন তার নিজের ভয়ও ওই একই স্পর্শে হারিয়ে যাচ্ছে। দু’জনেই জানত, এ মুহূর্তটা কেবল অন্ধকার আর ঝড়ের কারণে নয়—এখানে জন্ম নিচ্ছে অন্য কিছু, এমন এক অনুভূতি যেটা স্বীকার করতে এখনো তারা দু’জনেই প্রস্তুত নয়। বাইরে ঝড় তাণ্ডব চালাচ্ছিল, কিন্তু ভেতরে নীরবতার ভেতর গড়ে উঠছিল নতুন এক ঝড়—যা ভয়, লজ্জা আর আকর্ষণের মিশ্রণে তাদের অস্বস্তি আর মিষ্টি টানাপোড়েনের মধ্যে ডুবিয়ে দিল।
***
বাইরে বৃষ্টি ধীরে ধীরে থেমে এসেছে, আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ম্লান আলো, কিন্তু ঘরের ভেতরে যেন এক অদৃশ্য চৌম্বক বল আটকে রেখেছে অয়ন আর স্রবন্তীকে। তারা চাইলে উঠে চলে যেতে পারত, করিডোর দিয়ে নামতে পারত, কিন্তু কেউ নড়ল না। স্রবন্তী জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ভেজা কাচে হাত বুলাতে বুলাতে অন্যমনস্কভাবে বাইরে তাকাল। কাচের ওপরে গড়িয়ে পড়া শেষ দিকের জলবিন্দুগুলোয় প্রতিফলিত হচ্ছিল বিদায় নিতে না চাওয়া আকাশ। অয়ন তাকে চুপচাপ লক্ষ্য করছিল—সেই মুখ, যেটার প্রতি এতদিন কেবল বিরক্তি আর বিদ্রূপ ছিল, আজ যেন অন্য আলোয় দেখা দিচ্ছে। তার বুকের ভেতর একটা চাপা দম টানছিল, কিন্তু সে জানত—আজ কিছু একটা বলা জরুরি। স্রবন্তীর কাঁধে ঝরে পড়া চুলের ভিজে রেখা, তার চোখে জমে থাকা দ্বিধার ছায়া দেখে অয়ন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়াল পাশে, কণ্ঠস্বর নিচু হলেও স্পষ্ট, “তোর প্রতি যতটা রাগ দেখাই, হয়তো ঠিক ততটাই তোকে চাই।” কথাটা বেরিয়ে যেতেই বুকের ভেতর যেন একসঙ্গে ভয় আর স্বস্তির ঢেউ বয়ে গেল।
স্রবন্তী প্রথমে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। যেন শব্দগুলো তার কানে পৌঁছাতে একটু সময় নিল। তার চোখ এক মুহূর্তে বড় হয়ে উঠল, ঠোঁট কাঁপল, আর তারপর সে জানালার কাচ থেকে হাত সরিয়ে অয়নের দিকে তাকাল। চোখে অদ্ভুত ঝিলিক—অর্ধেক বিস্ময়, অর্ধেক স্বস্তি। এতদিন যে ছেলেটির সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ঠাট্টা, খোঁচা আর ক্ষোভে ভরা, তার মুখ থেকে এই স্বীকারোক্তি শুনে স্রবন্তী নিজেকেও আবেগ সামলাতে পারল না। বুকের ভেতরে যতদিনের গোপন অনুভূতি জমে ছিল, আজ হঠাৎ যেন সব উথলে উঠল। সে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “জানিস, আমি ভাবতাম শুধু আমি লুকিয়ে রাখি… হয়তো তোর প্রতি আমারও একইরকম কিছু আছে।” চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল জল, আর সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই স্রবন্তী মুখ ঘুরিয়ে নিল। অয়ন হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে আলতো স্পর্শ করল, তাতে আর কোনো দ্বিধা রইল না—দু’জনেই বুঝল, ঝগড়ার আড়ালে তারা দু’জনেই যে সম্পর্কটাকে এতদিন অবহেলা করেছে, সেটাই আসলে ছিল নীরব ভালোবাসার রূপ।
মুহূর্তটা নিস্তব্ধ হলেও ভেতরে ভেতরে ছিল অস্থিরতার ঢেউ। বাইরে ভেজা মাটির গন্ধে ভরে উঠেছে বাতাস, দূরে পাখির ডাক ধীরে ধীরে জানান দিচ্ছে নতুন শুরুর ইঙ্গিত। স্রবন্তীর গাল ভেজা, অয়ন কাছে এসে সেই জল মুছিয়ে দিল হাতের আঙুল দিয়ে। চোখে চোখ পড়তেই দু’জনেই থেমে গেল—কথার আর কোনো প্রয়োজন নেই, নীরবতাই হয়ে উঠল স্বীকারোক্তির ভাষা। এতদিনের তিক্ততা, রাগ আর অহংকারের দেয়াল হঠাৎ ভেঙে পড়েছে, আর তার জায়গায় জন্ম নিয়েছে এক অদ্ভুত কোমল টান। তারা দু’জনেই জানে, এর পর থেকে সবকিছু আর আগের মতো থাকবে না। বৃষ্টি থেমেছে ঠিকই, কিন্তু ভিজে থাকা জানালার ওপাশে আর ভেতরের এই ছোট্ট ঘরে, জন্ম নিয়েছে এক নতুন অধ্যায়—যেখানে প্রতিটি ঝগড়া হয়তো পরিণত হবে আরও গভীর সম্পর্কের অজানা রূপে।
***
বৃষ্টির শেষ ফোঁটা তখনও কদাচিৎ টুপটাপ করে জানালার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু ঝড় থেমে গেছে। বাইরে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন পৃথিবী নতুন করে নিশ্বাস নিচ্ছে। অয়ন আর স্রবন্তী ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে উঠল, দীর্ঘ সময় একই জায়গায় আবদ্ধ থাকার ক্লান্তি আর অস্বস্তি মিলেমিশে গিয়েছিল এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে। কেউ কিছু বলছিল না, তবু দু’জনের চোখেই ছিল অনুচ্চারিত স্বীকারোক্তির রেশ। দরজার দিকে পা বাড়ানোর সময় স্রবন্তী একবার পেছন ফিরে তাকাল সেই ভেজা জানালার দিকে—যা আজকের দিনটিকে তাদের কাছে স্মৃতির মতো ধরে রাখবে। কাঁচের ওপাশে আকাশে তখনও ঝুলে থাকা কালো মেঘ গোপন করছিল ভোরের আলোকে, কিন্তু মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল সোঁদা গন্ধ—যেন নতুন শুরু হওয়ার ইঙ্গিত। অয়ন দরজা ঠেলে বাইরে বেরোল, স্রবন্তী তার পিছু নিল, আর ক্লাসরুমের ভেতর রয়ে গেল ঝাপসা কাচে লেখা তাদের অদৃশ্য গল্প।
করিডোরে পা দিতেই দু’জনের সামনে খুলে গেল বৃষ্টিধোয়া কলেজ ক্যাম্পাস। ভেজা গাছের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল, মাটিতে ছোট ছোট কাদাপানির দাগে প্রতিফলিত হচ্ছিল আকাশের টুকরো। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়া ভিজে গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারদিকে, আর সেই হাওয়ায় যেন মিশে যাচ্ছিল তাদের মনের দ্বিধা। এতদিন যারা একে অপরকে সহ্য করতে পারত না, আজ সেই একই পথ ধরে পাশাপাশি হাঁটছিল বিন্দুমাত্র অনীহা ছাড়া। স্রবন্তী হালকা ভিজে চুল কাঁধ থেকে সরাতে সরাতে হাসল, অয়ন এক মুহূর্ত তাকিয়েই দৃষ্টি ফেরাল, কিন্তু তার চোখে সেই হাসি থেকে গেল অনন্তকাল। দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, অথচ নিস্তব্ধতায় জমে উঠছিল হাজার অপ্রকাশিত সংলাপ। প্রতিটি পদক্ষেপে তারা যেন বুঝে নিচ্ছিল—আজ থেকে আর কিছুই আগের মতো থাকবে না।
ক্যাম্পাসের ফটক পেরিয়ে তারা যখন রাস্তায় এল, সূর্যের আলো মেঘ ভেদ করে বেরিয়ে পড়ল। ভেজা মাটিতে সেই আলো পড়তেই চারপাশ ঝলমল করে উঠল, যেন প্রকৃতি নিজেই তাদের নতুন ভোরকে আশীর্বাদ জানাচ্ছে। অয়ন হঠাৎ থেমে দাঁড়াল, স্রবন্তীও থামল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, আর চোখের গভীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল আজকের স্বীকারোক্তির পরিণতি। আর কোনো তর্ক নয়, কোনো ঠাট্টা নয়—বরং অজানা ভালোবাসার এক অঙ্গীকার। স্রবন্তী মৃদু হেসে বলল, “মনে হয় আজকের দিনটা মনে রাখার মতো হয়ে গেল।” অয়ন হালকা মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ… এখান থেকেই হয়তো শুরু।” তারা দু’জনেই জানত, এই পথচলা আর কেবল সহপাঠীর ঝগড়াঝাঁটি নয়; বরং নতুন গল্পের প্রথম অধ্যায়। আর ভেজা জানালার মতোই সেই দিন রেখে গেল ঝাপসা অথচ অবিস্মরণীয় স্মৃতি, যেখান থেকে শুরু হল তাদের সম্পর্কের নতুন ভোর।
—




