অনিন্দিতা রায়
পর্ব ১ — ট্রেনের জানালা
শিয়ালদহ স্টেশন গমগম করছে মানুষের চিৎকারে, বোঝাই ট্রেনের হুইসেলে আর উদ্বাস্তুদের কান্নায়। আগস্টের আর্দ্র গরমে ছাপোষা মানুষের ভিড় যেন এক বিশাল ঢেউ হয়ে উঠেছে, যাদের কোনো ঠিকানা নেই, আছে শুধু ছিন্ন দেহের মতো ভেঙে যাওয়া স্মৃতি। অঞ্জলি দাঁড়িয়ে আছে ভাই হরিদাসকে পাশে নিয়ে, হাতের মুঠোয় একটা ভাঁজ করা চিঠি। সেই চিঠি খুলনা থেকে সঙ্গে এনেছে, অন্য কিছু আনতে পারেনি। ট্রাঙ্কে আছে সামান্য কাপড় আর কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল, কিন্তু বুকের ভেতর যেটা নিয়ে এসেছে সেটা অদৃশ্য—শিকড় ছেঁড়া এক গ্রামের ঘ্রাণ, উঠোনে ঝরা শিমুলফুল, আর রহিমার মুখ। চারপাশে রেললাইনের শব্দে ভরে উঠলেও অঞ্জলি শুনতে পাচ্ছে কেবল একটাই প্রতিধ্বনি—রহিমা কি এখনও বেঁচে আছে, ওর লেখা চিঠিটা কি কখনো পৌঁছাবে?
ভিড়ের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে, কেউ গলায় বাচ্চা ঝুলিয়ে কাঁদছে, কেউ বস্তার ভেতর চাল-ডাল বাঁচিয়ে রাখছে, কেউ আবার দিশাহীন চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যেন ওপারে ফেলে আসা দেশটাকে দেখতে পাবে। হরিদাস কেবল জিজ্ঞেস করছে, “দিদি, আমরা এখন কোথায় থাকব?” অঞ্জলি জানে না, উত্তর দিতে পারে না। চিঠিটার ভাঁজ খুলে দেখে নেয় সে, যেন অক্ষরগুলোই বাঁচিয়ে রাখবে। রহিমাকে লেখা সেই শেষ চিঠি—“যদি কখনো দেখা না হয়, মনে রেখো আমাদের উঠোনের শিমুলগাছটা দু’জনের।” ভিড় ঠেলে যখন তারা স্টেশন থেকে বেরোয়, অঞ্জলির চোখে ভেসে ওঠে তাদের পুরোনো উঠোন—দু’জনে বসে ছায়ায় কাঁথা সেলাই করছে, হাসছে, কোনো ছোঁয়া নেই ধর্মের। অথচ এক রাতে সেই উঠোনে আগুন, চিৎকার, পায়ের শব্দ, তাড়া করে নিয়ে যাওয়া। আজ সেইসব ভাঙা ছবির মতো লেগে আছে চোখের কোণে।
কলকাতার হাওয়া অন্যরকম—ধুলোয় ভরা, গরমে নোনতা, গলির ভেতর থেকে ভেসে আসছে মানুষের গালাগালির সঙ্গে বাজারের ডাক। কিন্তু এই শহরে তারা কেউ নয়, যেন নিছক ছাই। রেললাইনের ধারে কাগজে মোড়া চাল খেতে বসে অঞ্জলি বুঝল, এই শহর ওদের গ্রহণ করেনি, আবার ফিরেও যেতে পারবে না। এক অচেনা মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছে তারা, যেখানে কোনো শিকড় নেই। অঞ্জলি আবার চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরল। ভিড়ের চিৎকার, দূরের দাঙ্গার গুজব, ক্ষুধার হাহাকার—সবকিছুর মাঝেও কেবল কাগজের সেই অক্ষরগুলো যেন আশ্রয় হয়ে উঠল।
রাত নামলে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তারা এক কোণে জায়গা পেল। হরিদাস ঘুমিয়ে পড়ল মাটিতে মাথা রেখে, অঞ্জলি চোখ মেলেই রইল। দূরে একটা ট্রেনের জানালা থেকে আলোর ফালি পড়ে আছে প্ল্যাটফর্মে, সেই আলোয় চিঠির অক্ষরগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অঞ্জলি মনে মনে ফিসফিস করে বলল—“তুই থাকিস ওপারে, আমি আছি এপারে, তবু একই আকাশের নিচে।” আর এই আকাশই হলো একমাত্র সীমানা, যা ভাগ হয়ে যায় না।
পর্ব ২ — হারানো উঠোন
খুলনার সেই বাড়িটার কথা অঞ্জলি ভুলতে পারে না, আজও চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুলগাছ, যার নিচে দুপুরের ভাতঘুমে দুলে যেত ছায়া, আর রহিমা এসে ডেকে বলত, “চলো খেলতে যাই।” হাওয়ায় ভেসে আসত আমড়া আর বেলফলের গন্ধ, পুকুরের ধারে ভিজে মাটির ওপর খালি পায়ে দৌড়ে যেত তারা, কাঁদামাটির কেল্লা বানাত, কচুরিপানায় সাজানো যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈন্যের খেলা খেলত। অঞ্জলি আর রহিমার বন্ধুত্বে কখনো কোনো প্রশ্ন ছিল না কে হিন্দু, কে মুসলমান, শুধু ছিল শৈশবের অবিরাম হাহাকারহীন আনন্দ। অঞ্জলির মা ডাক দিত বারবার, “অঞ্জলি, পড়তে বসো”, কিন্তু রহিমার হাত টেনে নিয়ে যেত মাঠে, যেখানে ছেলেরা ফুটবল খেলত আর মেয়েরা লুকোচুরি। শিমুলগাছের লাল ফুল ঝরে জমে থাকত মাটিতে, তারা ভেবে নিত এ যেন তাদের নিজস্ব খেলার মণিমুক্তা।
তবু সময় বদলাল। সেই উঠোনে একদিন এল ফিসফিসানি, বড়দের মুখে অজানা শব্দ—“ভাগ হবে, দেশ আলাদা হবে।” অঞ্জলি প্রথমে বুঝতে পারেনি, শুধু দেখল রহিমার বাবা এক রাতে হঠাৎ কথা বলছেন গম্ভীর গলায়, “আমাদের এখানে থাকতে হবে, ওরা যাবে ওপারে।” আর অঞ্জলির বাবা নিঃশব্দে মুখ নামিয়ে রেখেছিলেন, যেন কোনো অনিবার্য ঝড় আসছে। খেলার মাঠে ছেলেদের লড়াই বেড়ে গেল, কাদা ছোড়াছুড়ি থেকে হঠাৎ হিংস্র চিৎকার। মেয়েরা ভয়ে আর বেরোয় না, কিন্তু রহিমা প্রতিদিনই ছুটে আসে অঞ্জলির কাছে। এক বিকেলে তারা দু’জনে উঠোনে বসে ছিল, বাতাসে ধানের গন্ধ, রহিমা বলল, “শোন, যদি কখনো তোরা চলে যাস, তুই কিন্তু ভুলবি না।” অঞ্জলি হেসে বলেছিল, “আমি কোথায় যাব বল তো?” কিন্তু বুকের ভেতর কেমন খচখচ করছিল।
তারপর এলো সেই রাত, যেদিন উঠোনের শান্তি ছিঁড়ে গেল। দূরে প্রথমে শোনা গেল আওয়াজ, তারপর চিৎকার, তারপর আগুনের আলো। অঞ্জলির মা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “চলো, তাড়াতাড়ি।” হাতে কিছু ধরবার সময় ছিল না, শুধু টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল তারা। অঞ্জলি তখনও পিছনে তাকাল, উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে শিমুলগাছ, রহিমা কোথায় সে জানে না। ভিড়ের মধ্যে, অন্ধকারের তাড়াহুড়োয় শুধু একবার মনে হলো কেউ ডাকছে—“অঞ্জলি!” কিন্তু সেটা কি সত্যিই রহিমা ছিল, না কল্পনা, সে আজও জানে না।
সেদিন থেকে উঠোনটা অঞ্জলির মনে এক দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। কলকাতার শরণার্থী দালানে বসে সে বারবার চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় সেই শিমুলগাছ, যার পাতায় আলো পড়ছে, আর রহিমা হাত ধরে টানছে। কিন্তু বাস্তবের ভেতর সে জানে—ফিরে যাওয়ার পথ নেই। শিকড় ছেঁড়া মানুষ আবার কোথায় শেকড় গাঁথবে? হরিদাস যখন খেলতে চায় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে, অঞ্জলি চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, ভাবে—ওর শৈশবটা আর কখনোই শিমুলফুলের মতো রঙিন হবে না।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অঞ্জলি চিঠিটা বের করে আবার পড়ে। সেখানে লেখা আছে—“আমাদের উঠোনটা কারও নয়, আমাদের দু’জনের। তুই যদি চলে যাস, আমি একা খেলব, তবু শিমুলগাছের ছায়া তোকে মনে করাবে।” অঞ্জলি চোখ ভিজে ওঠে, চিঠির অক্ষরগুলো যেন ভেসে ওঠে গাঢ় কালি হয়ে। সে জানে রহিমার কণ্ঠ এখন আর শুধু শব্দ নয়, তার অস্তিত্বের শেষ আশ্রয়।
পর্ব ৩ — দাঙ্গার আগুন
সেই রাতটা আজও অঞ্জলির চোখে লেগে আছে, যখন হঠাৎ করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল ভয় আর আগুন। বিকেল থেকে বাতাসে অস্বাভাবিক একটা গন্ধ ছিল, মানুষের মুখে গুজব ছড়াচ্ছিল—“আজ রাতে কিছু হবে, সাবধানে থেকো।” অঞ্জলির বাবা মশাল হাতে উঠোনে ঘুরছিলেন, মায়ের চোখে উৎকণ্ঠা, হরিদাস তখনও বুঝতে পারেনি, সে বারবার বলছিল, “দিদি, এত চুপচাপ কেন সবাই?” রাত গভীর হতেই হঠাৎ দূরে শোনা গেল চিৎকার, তারপর কুকুরের ঘেউ ঘেউ, তারপর আর্তনাদ। আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছিল গ্রামটার দক্ষিণ দিক থেকে, যেখানে বাজার বসত। একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল কাকিমা, “ওরা এসেছে, পালাও, সবাই পালাও।”
অঞ্জলির মা আর দেরি করলেন না, ঘরে যতটুকু পারলেন কাপড়চোপড় জড়ো করে নিলেন, অঞ্জলিকে টেনে বের করলেন। হরিদাস কাঁদছিল, “আমার বইগুলো, আমার খেলনা!” কিন্তু কোনো কিছু নেবার সময় ছিল না। বাইরে তখন রাস্তাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, পুরুষরা দৌড়চ্ছে, কেউ হাতে লাঠি, কেউ খালি হাতে। আগুনের গন্ধে আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, ধোঁয়ায় বাতাস ভারী। অঞ্জলি বারবার পিছনে তাকাচ্ছিল—রহিমা কোথায়? ওর বাড়ি তো পাশেই, যদি একবার দেখা পেত! কিন্তু সেই সুযোগ দিল না সময়।
অন্ধকারে যখন তারা গ্রাম ছাড়ছিল, হঠাৎ শোনা গেল নারীদের কান্না আর পুরুষদের চিৎকার মিশে এক অমানবিক শব্দে। কারা কার ঘরে ঢুকে পড়ছে, কারা কাকে টেনে বের করছে, কারা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু ভয়ের রক্তগন্ধ। হরিদাস মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরেছে, বাবা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সবাইকে। অঞ্জলি তখনো বুকের কাছে চেপে রেখেছে সেই কাগজটা, রহিমাকে লেখা শেষ চিঠি।
গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে তারা যখন বাঁশঝাড় পেরোচ্ছিল, তখন মনে হলো পিছনে কেউ ডাকছে, “অঞ্জলি!” এক মুহূর্ত থেমে গেল সে, বুক ধড়ফড় করছে, এ কি সত্যি রহিমার কণ্ঠ? কিন্তু বাবা ধাক্কা দিলেন, “চলো তাড়াতাড়ি, পিছনে তাকাবে না।” আবার দৌড় শুরু হলো, কাঁদা মাটিতে হোঁচট খেল হরিদাস, তবু থামা যায় না।
পরের দিন সকাল হলে দেখা গেল অর্ধেক গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি পোড়া, পুকুরের ধারে ভেসে আছে গৃহস্থালির ভাঙা জিনিসপত্র। কেউ কেউ নিখোঁজ, কারও লাশ মিলে গেল ধানক্ষেতে। যারা বেঁচেছে, তারা সবাই ভয়ে পাগল। অঞ্জলির বাবা তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, “এখানে আর থাকা যাবে না। আমাদের যেতে হবে কলকাতা।”
যাওয়ার আগে অঞ্জলি একবার শুধু উঠোনে গেল। শিমুলগাছ দাঁড়িয়ে আছে নির্লিপ্তভাবে, তার লাল ফুলগুলো ধোঁয়ার মধ্যে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সে কাঁপা হাতে গাছের গুঁড়িতে ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল, “রহিমা, আমি যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের গাছটা রয়ে গেল।” চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, তবু সে জানত আর ফেরা হবে না।
সেদিন রাতেই তারা ট্রেন ধরল। আশপাশে ভিড় জমেছিল উদ্বাস্তুদের, কারও হাতে বাচ্চা, কারও বগলে গোছা গোছা বস্তা, কারও চোখে শুধু আতঙ্ক। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে অঞ্জলি দেখল ফেলে আসা গ্রামটা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, সেই অন্ধকারে যেন লুকিয়ে গেল রহিমার মুখও।
পর্ব ৪ — পথে অন্ধকার
ট্রেনটা যখন খুলনা ছাড়ল, তখন রাত ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। কামরার ভেতরぎぎぎ না, এবার শুধু ভিড় আর কান্নার শব্দ। কাঠের সিটে ঠাসা মানুষ, মেঝেতে বসে আছে শিশুরা, জানালার গ্রিলে ঝুলছে সুটকেস, লণ্ঠন, চাদরের পুঁটলি। এইসব মানুষ সবাই কোথাও যাচ্ছে, কিন্তু কারও কাছে নেই নিশ্চিত গন্তব্য। অঞ্জলি জানে তারা কলকাতা যাবে, শরণার্থীদের ভিড়ে ঠাঁই পাবে কোনো অচেনা দালানে, তবু বুকের ভেতর ভয়টা থামছে না—তারা কি বাঁচতে পারবে? কামরার এক কোনে বসে হরিদাস অস্থির হয়ে বলল, “দিদি, আমরা বাড়ি ফেরব তো?” অঞ্জলি তার মাথায় হাত রেখে বলল, “আমরা এখন নতুন জায়গায় যাচ্ছি।” গলায় শক্তি রাখলেও ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছিল।
ট্রেনটা চলতে শুরু করলে বাইরে অন্ধকার গিলে নিল ফেলে আসা সব স্মৃতি। অঞ্জলি জানালার দিকে তাকাল, দূরে গ্রামগুলো পেছনে চলে যাচ্ছে, মাঠের ধূসরতা মিলিয়ে যাচ্ছে ভোরের কুয়াশায়। কোথাও কোথাও আগুনের ধোঁয়া এখনো উড়ছে, সেই আগুনই যেন সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে অঞ্জলির শৈশব। জানালার কাচে ভেসে উঠল রহিমার মুখ—ও কি এখনো বাড়িতে আছে, নাকি তারাও পালিয়েছে? অঞ্জলির বুকের ভেতর তখন একটানা ধকধক শব্দ, হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে চিঠিটা।
হঠাৎই কামরার ভেতর চিৎকার উঠল। সামনের দিক থেকে খবর এল—পথে দাঙ্গাবাজরা হামলা করতে পারে, ট্রেন থামলে বিপদ হবে। মা আঁচল টেনে মুখ ঢেকে বসে রইলেন, বাবা নিঃশব্দে বললেন, “যা হবে দেখা যাবে।” ভিড়ের মধ্যে একটা বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল, মা তাকে বুকে জড়িয়ে হাহাকার করে উঠলেন। সেই কান্নায় যেন পুরো কামরা কেঁপে উঠল। হরিদাস ভয়ে আঁকড়ে ধরল অঞ্জলির হাত, কাঁপা গলায় বলল, “আমরা কি মরে যাব?” অঞ্জলি কোনো উত্তর দিল না, শুধু চিঠিটা তার হাতে ধরিয়ে দিল, বলল, “এটা ধরে রাখ, এটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।”
ট্রেন যত এগোচ্ছে, পথ তত অনিশ্চিত। কোনো কোনো স্টেশনে ভিড় চড়াও হওয়ার চেষ্টা করছে, গালি, হুমকি, লাঠির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অঞ্জলির মনে হলো পুরো দেশটা যেন এক লম্বা মৃত্যুমিছিল হয়ে উঠেছে, যেখানে কারও চোখে ভরসা নেই। ভোরের আলোয় নদীর ঘাট পেরোবার সময় দূরে দেখা গেল স্রোতের ভেতর ভেসে থাকা কাঠের কুঠুরো আর ভাঙা পালকি। মানুষের জীবন যেন এখন বাতিল জিনিসের মতো ভেসে যাচ্ছে।
রাত কাটতে না কাটতেই অঞ্জলির মনে হলো, এই পথের অন্ধকার কোনো দিন শেষ হবে না। প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর গন্ধ, ক্ষুধার হাহাকার, আর অচেনা চিৎকার ভেসে আসছে। তবু সে জানে, পৌঁছাতেই হবে। কারণ ওপারে হয়তো কিছুই নেই, তবু বেঁচে থাকার জন্য অন্য কোনো রাস্তা নেই। হরিদাস ক্লান্ত হয়ে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। অঞ্জলি চোখ বন্ধ করল না। জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে মনে বলল—“রহিমা, তুই যদি থাকিস, একদিন হয়তো আবার দেখা হবে।”
কিন্তু জানালার বাইরে ভোরের আলোয় কেবল অন্ধকারই ভেসে উঠছিল।
পর্ব ৫ — অস্থায়ী আশ্রয়
কলকাতায় নামার মুহূর্তে অঞ্জলির মনে হয়েছিল যেন অন্য এক দুনিয়ায় এসে পড়েছে—অগণিত মানুষের ভিড়, ট্রামের ঘণ্টা, রিকশার চাকা, রেললাইনের ধারে ছড়িয়ে থাকা বোঝাই মালপত্র আর কান্নায় ভরা মুখ। শহরটা যেন এক বিশাল শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মানুষ জায়গা খুঁজছে বাঁচার, আবার প্রতিটি মানুষ অন্যের চোখে ভিড় মাত্র। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো এক পরিত্যক্ত স্কুলবাড়িতে, যেখানে শ্রেণিকক্ষগুলোতে গাদাগাদি করে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে, দেয়ালে এখনো চক দিয়ে লেখা আছে পাঠ্যসূচি, কিন্তু মেঝেতে ছড়ানো কম্বল, থালাবাটি আর মানুষের নিঃশ্বাসে সেই অক্ষরগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। অঞ্জলি, হরিদাস আর বাবা-মা এক কোণে জায়গা পেল, ভাঙা বেঞ্চ টেনে মাথার ওপর কাপড় টাঙানো হলো অস্থায়ী ছাউনি হিসেবে, যেটুকু তাদের নতুন ঘর বলা যায়। রাতে শোনা যায় অচেনা মানুষের শ্বাসকষ্ট, বাচ্চাদের কাঁদা, মায়েদের শান্ত করার চেষ্টা, বৃদ্ধদের হাহাকার। দিনের পর দিন খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে পাতলা খিচুড়ির থালা হাতে ফেরত আসতে হয়, হরিদাস প্রথমে নাক সিঁটকোলেও ক্ষুধায় পরে সব চেটে খেয়ে নেয়। অঞ্জলির কাজ হয়ে উঠল মা-কে সাহায্য করা, জল আনা, কাপড় ধোয়া, ছোট ভাইকে সামলানো, আর মাঝে মাঝে সেই চিঠিটা বের করে বুকের কাছে চেপে ধরা।
শহরটা তাদের কেবল আশ্রয় দিয়েছে, গ্রহণ করেনি। গলির ভাড়াটে লোকেরা বলত—“ওরা উদ্বাস্তু, ভিখিরি, আমাদের ভাত কাড়তে এসেছে।” শব্দগুলো অঞ্জলির কানে বাজত, তবু প্রতিবাদ করতে পারত না, কারণ তাদের সত্যিই কিছু ছিল না, ছিল না নিজের মাটি। বাবা রোজ কাজের খোঁজে বেরোতেন, কারও দোকানে মজুরি হয়তো মিলবে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় ফিরতেন খালি হাতে। মা ধুতি-শাড়ি সেলাইয়ের কাজ খুঁজছিলেন, কিছুটা হলেও চাল-ডাল জোটানো যায়। রাতে আলো নিভে গেলে অঞ্জলি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ভাবত—তাদের শিমুলগাছের ছায়ায় হয়তো আজও রহিমা বসে আছে, আর এখানে সে যেন অচেনা এক কারাগারে আটকে।
তবু এই অস্থায়ী আশ্রয়ের ভেতরও কিছু মানবিকতা টিকে ছিল। পাশের ঘরে এক বৃদ্ধা মহিলা তাদের দিকে ভাত বাড়িয়ে দিলেন, বললেন—“খেয়ে নাও মা, আমি তো আর কতটা খেতে পারি।” এক যুবক, যে নিজেও শরণার্থী, হরিদাসকে খেলার জন্য কাঠের গাড়ি বানিয়ে দিল। সেই মুহূর্তগুলোই অঞ্জলিকে মনে করিয়ে দিত যে অন্ধকারের ভেতরেও আলো বেঁচে থাকে। তবু ভোরবেলায় যখন ঘুম ভাঙত, সবার প্রথমে কানে আসত করুণ আর্তনাদ—“আমার ছেলেটাকে খুঁজে দাও”, “আমার ঘরটা একবার দেখতে চাই।”
অঞ্জলি বুঝে গেল তারা এখানে দীর্ঘদিনই থাকতে বাধ্য, এই স্কুলঘরই হবে তাদের বাড়ি, যেখানে দেয়ালের দাগ, চুন-সুরকির ফাটল, ভাঙা বেঞ্চ আর গাদাগাদি মানুষদের মধ্যে তারা গড়ে নেবে নতুন জীবন। কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে ছিল একটাই প্রশ্ন—রহিমা এখন কোথায়? সে কি বেঁচে আছে, নাকি সেই দাঙ্গার আগুনে হারিয়ে গেছে? চিঠিটার ভাঁজ খুলে অঞ্জলি পড়ল, প্রতিটি অক্ষরে বুক কেঁপে উঠল, যেন শব্দগুলো তাকে আশ্বাস দিচ্ছে—“তুই একা নস।”
পর্ব ৬ — নতুন শহরের কষ্ট
কলকাতার দিনগুলো অঞ্জলির কাছে ক্রমশ এক অদ্ভুত পরীক্ষার মতো হয়ে উঠল—যেখানে প্রতিটি সকাল মানে লড়াই, প্রতিটি রাত মানে অস্থির দুঃস্বপ্ন। স্কুলবাড়ির সেই আশ্রয়ে ভিড়ের ভেতর দিন কাটছিল, কিন্তু পেট ভরছিল না, আশা মিটছিল না। বাবা রোজ সকালে বেরোতেন, কখনো মজুরির কাজ জুটত, কখনোই কিছু মিলত না, ফিরতেন ধুলোয় মাখা মুখ নিয়ে, চোখে এক অদ্ভুত পরাজয়ের ছায়া। মা শাড়ির প্রান্তে কেটে রাখা সুতো দিয়ে অন্যদের কাপড় সেলাই করতেন, কিন্তু এত মানুষে ভাগ হলে তাতে দু’মুঠো চাল ছাড়া আর কিছু আসত না। হরিদাস মাঝে মাঝে খাবারের জন্য কান্না করত, তার ছোট মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলির বুক ভেঙে যেত, তবু সে মাকে শান্ত করার মতো শক্ত গলায় বলত, “চিন্তা কোরো না, আমি কিছু একটা করব।”
সেই প্রতিশ্রুতিই তাকে রোজ ভোরে শহরের অলিগলিতে নিয়ে যেত। কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াত অঞ্জলি, কখনো ধোপার দোকানে, কখনো চায়ের ঠেকে, আবার কখনো ধানদোয়ার আড়তে। অনেক জায়গায় মানুষ প্রথমেই মুখ ফিরিয়ে বলত, “উদ্বাস্তু মেয়ে দিয়ে কী হবে?” কারও কারও চোখে ছিল কৌতুক, কারও কণ্ঠে ঘৃণা, যেন এরা মানুষ নয়, এরা কেবল বোঝা। অঞ্জলি বারবার লজ্জায় মাথা নিচু করত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা আগুন জ্বলে উঠত—কেন তারা ঘরছাড়া হল, কেন এমন অপমান সহ্য করতে হচ্ছে? উত্তর কোথাও নেই।
একদিন দুপুরে এক ধনী বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সে, কাজ চাইতে। ভিতর থেকে মালকিন বেরিয়ে এলেন, সোনার চুড়ি, উজ্জ্বল শাড়ি, চিবুকে অবহেলা। অঞ্জলি কাঁপা গলায় বলল, “আমায় কিছু কাজ দেবেন?” মালকিন একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, “তুমি তো উদ্বাস্তু, তোমাদের বিশ্বাস করা যায় না।” সেই শব্দগুলো যেন ছুরি হয়ে বিঁধল বুকের ভেতর। চোখ ভিজে এলেও অঞ্জলি কিছু বলল না, চুপচাপ ফিরে গেল, পায়ে কাঁদা লেগে যাচ্ছিল, তবু বুকের ভেতর ছিল একরাশ দগদগে যন্ত্রণা।
সন্ধ্যায় স্কুলবাড়িতে ফিরে এসে যখন অন্যরা খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছিল, অঞ্জলি এক কোণে বসে চিঠিটা বের করল। রহিমাকে লেখা সেই কাগজই একমাত্র সান্ত্বনা। মনে হলো রহিমা যদি থাকত, তার হাত ধরেই হয়তো বলত, “ভয় পাস না, তুই পারবি।” অক্ষরগুলো পড়তে পড়তে চোখের জল ভিজিয়ে দিল কাগজটা, তবু মনে হলো এটাই তাকে শক্ত রাখছে।
শহরটা তাকে কোনো জায়গা দেয়নি, কিন্তু তবুও সে বুঝতে পারল, বেঁচে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে। মায়ের সেলাইয়ে সাহায্য করা, হরিদাসকে পড়াতে বসানো, বাবাকে সাহস জোগানো—এই সবই যেন তার নতুন দায়িত্ব। কিন্তু রাত নামলেই দেয়ালের ফাটল ধরে ভেসে আসে অন্যরকম নিঃসঙ্গতা। শহরের কোলাহলের ভেতর সে বারবার শুনতে পায় রহিমার ডাক, “অঞ্জলি, কোথায় গেলি?” সেই ডাকেই সে বুক শক্ত করে বলে ওঠে, “আমি আছি, আমি বেঁচে আছি।”
কিন্তু অন্তরে জানে—এ শহর তাদের জন্য এখনো শত্রুর মতোই।
পর্ব ৭ — খবরের কাগজে নাম
সেই সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হয়েছিল—লাইনে দাঁড়িয়ে পাতলা খিচুড়ির থালা নেওয়া, স্কুলঘরের মেঝেতে বসে খাওয়া, তারপর কাজের খোঁজে বের হওয়া। কিন্তু দুপুরবেলা হঠাৎই শরণার্থী শিবিরে হইচই শুরু হলো। কেউ একজন হাতে করে খবরের কাগজ নিয়ে এসেছে, সেখানে বড় অক্ষরে ছাপা খবর—“পূর্ববঙ্গে নতুন দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগে পুড়ল একাধিক গ্রাম।” লোকজন ভিড় করে দাঁড়াল, গলা উঁচু করে পড়া শুরু হলো—“খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলে গত রাতে ব্যাপক হিংসা, বহু মানুষ নিখোঁজ, অনেকে নিহত।” অঞ্জলির বুক ধড়ফড় করতে লাগল, সে ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে গিয়ে কাগজটা পড়তে চাইলো। চোখ আটকে গেল এক ছোট্ট কলামে, যেখানে লেখা—“মহেশপুর অঞ্চলে শিমুলগাছতলা গ্রামে দাঙ্গা, কয়েকজন যুবতী নিখোঁজ।” শব্দগুলো যেন বজ্রপাত হয়ে পড়ল তার ওপর। শিমুলগাছতলা—ওদের গ্রাম, রহিমার বাড়ি সেখানেই। অঞ্জলির হাত কাঁপতে লাগল, ঠোঁট শুকিয়ে এল, সে আর পড়তে পারছিল না, শুধু বারবার মনে হচ্ছিল, রহিমার নাম কি ওই ‘নিখোঁজ’দের মধ্যে আছে?
সন্ধ্যায় শিবিরে ফেরার পর বাবা বললেন, “কাগজে যা ছাপা হয়েছে, সব খবর সত্যি নাও হতে পারে।” মা নিঃশব্দে কাঁদছিলেন, কারণ সেও বুঝেছিলেন সেই গ্রামে যারা রয়ে গেছে, তাদের ভাগ্য ভালো হলে হয়তো বেঁচে আছে, নয়তো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। অঞ্জলি কোণে গিয়ে বসে পড়ল, চিঠিটা বের করল, কিন্তু চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, অক্ষরগুলো আর পড়তে পারছিল না। সে শুধু কাগজটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ফিসফিস করল—“রহিমা, তুই যদি বেঁচে থাকিস, আমাকে একবার জানাস।”
রাত গভীর হলে বাইরে বৃষ্টি নামল, টিনের ছাউনি টুপটাপ শব্দে ভরে উঠল। ভিড়ের মধ্যে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে, ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে। কিন্তু অঞ্জলি ঘুমোতে পারল না। বারবার মনে হচ্ছিল, খবরের কাগজে যেসব নাম নেই, সেসব নামও তো হারিয়ে যায় না, কোথাও না কোথাও থেকে যায়। হয়তো রহিমা বেঁচে আছে, হয়তো সে-ও অঞ্জলিকে মনে করে কাঁদছে। আবার হয়তো সব শেষ হয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্বেই অঞ্জলির শরীর কাঁপছিল।
ভোরের দিকে হরিদাস ঘুমের ঘোরে বলল, “দিদি, আমরা আবার গ্রামে ফিরব তো?” অঞ্জলি মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, ঠোঁট কাঁপছিল, সে শুধু বলল, “আমরা ফিরব একদিন।” কিন্তু নিজের ভেতরে সে জানত, গ্রামটা হয়তো আর নেই। শিমুলগাছতলা যদি পুড়ে যায়, তবে তাদের শেকড়ও ছাই হয়ে গেছে। তবু আশা ছাড়তে পারল না। সেই চিঠির ভাঁজে, কালি ম্লান হয়ে যাওয়া অক্ষরগুলোতেই সে খুঁজে নিল বেঁচে থাকার সাহস।
পর্ব ৮ — অদৃশ্য কণ্ঠস্বর
সেই রাতে কলকাতার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল, টিনের ছাউনিতে টুপটাপ শব্দ যেন হাজারো অশ্রুর মতো ঝরে পড়ছিল, শরণার্থী দালানের ভেতর ভিজে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল, আর অঞ্জলি এক কোণে বসে ছিল চোখে অন্ধকার নিয়ে। চারপাশে গাদাগাদি মানুষ, ভিজে কম্বল, কান্নার শব্দ মিলেমিশে এক ধরনের দমবন্ধ করা হাহাকার তৈরি করছিল, তবু সেই হাহাকারের মাঝেই হঠাৎ মনে হলো কানে বাজছে এক অচেনা ডাক—“অঞ্জলি।” সে চমকে চারদিকে তাকাল, কেউ নেই, সবাই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে, হরিদাস মায়ের কোল ঘেঁষে কুঁকড়ে শুয়ে আছে। আবার সেই শব্দ শোনা গেল, এবার যেন বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মিশে আছে, মৃদু, গভীর, কিন্তু খুবই স্পষ্ট। অঞ্জলি বুঝতে পারল এ রহিমার কণ্ঠ, দূর থেকে ভেসে আসা অদৃশ্য কোনো পথ দিয়ে তার কাছে পৌঁছেছে।
সে জানে না এটা কল্পনা, নাকি সত্যি, কিন্তু শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পেল রহিমা শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, ভিজে চুল কপালে লেগে গেছে, আর ঠোঁট নড়ে বলছে, “আমি আছি, আমি বেঁচে আছি।” অঞ্জলির বুক ভিজে গেল কান্নায়, সে হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু ছোঁয়া পেল শুধু ফাঁকা হাওয়া। চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরে সে ফিসফিস করল, “আমি তোকে শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।”
বৃষ্টি থেমে গেলে আকাশের ফাঁকে হালকা আলো ফুটল, যেন নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি, কিন্তু অঞ্জলি জানত এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গুর। আশ্রয়ের ভেতর ক্লান্ত মুখগুলো আলোয় উন্মোচিত হলো, কারও চোখ লাল, কারও ঠোঁট শুকনো, কেউ ক্ষুধায় অচেতন, কেউ শূন্য দৃষ্টিতে বসে আছে। অঞ্জলি তাকাল, ভাবল এরা সবাই ছিন্নমূল, কিন্তু প্রত্যেকের ভেতরই হয়তো কোনো অদৃশ্য কণ্ঠস্বর আছে, যেটা তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তার জন্য সেই কণ্ঠস্বর রহিমা, অন্য কারও জন্য হয়তো মাটি, কারও জন্য সন্তান, কারও জন্য প্রার্থনা।
অঞ্জলি জানত না রহিমা সত্যিই বেঁচে আছে কিনা, হয়তো আগুনের ভেতর নিভে গেছে, হয়তো কোনো নদীর ধারে লাশ হয়ে ভেসে গেছে, তবু সেই রাতে বৃষ্টির সঙ্গে মিশে আসা কণ্ঠস্বর তাকে বোঝাল—আশা এখনো মরে যায়নি। সে শপথ করল, যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন সেই কণ্ঠস্বরকে ধরে রাখবে, কারণ এটাই তার শিকড়, এটাই তাকে ঘরছাড়া পৃথিবীতে টিকে থাকতে শেখাবে।
পর্ব ৯ — শেকড়হীনতার বোঝা
কলকাতার এই স্কুলবাড়ির ঘিঞ্জি আশ্রয়ে যতদিন পার হচ্ছিল, ততই অঞ্জলি বুঝতে পারছিল তাদের নামটাই এখন বদলে গেছে—তারা আর গ্রামবাসী নয়, তারা “উদ্বাস্তু”। এই শব্দে যেন লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য অবজ্ঞা, যেন শেকড়ছেঁড়া মানুষরা আসলে পূর্ণ মানুষই নয়। আশেপাশের মহল্লায় গেলে লোকেরা চোখ কুঁচকে তাকায়, রিকশাওয়ালা ভাড়া নিতে চায় দ্বিগুণ, দোকানিরা ফিসফিস করে বলে, “ওরা এপারে এসে ভাত কাড়ছে।” হরিদাস খেলতে বেরোলে ছেলেরা তাকে ঠাট্টা করে বলে, “ওরে উদ্বাস্তু, তোর দেশ কই?” হরিদাস ছুটে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে, অঞ্জলি তাকে বুকে টেনে নেয়, কিন্তু তার নিজের চোখও ভিজে ওঠে—কীভাবে বোঝাবে, যে দেশ তারা ফেলে এসেছে, সেটা আর তাদের জন্য নেই, অথচ এপারের মাটিও তাদের আপন করে নেয়নি। এই বোঝাই সবচেয়ে ভারী, কারণ এ বোঝা নামানোর জায়গা কোথাও নেই।
বাবা চেষ্টা করতেন সবাইকে সাহস দিতে, বলতেন, “একদিন আমরা ঠিক ঘর পাব।” কিন্তু তার কণ্ঠেও ক্লান্তি জমে থাকত। মা দিনের পর দিন সেলাইয়ের কাজ করে হাত ফেটে ফেলেছেন, তবু চাল জোটে সামান্য। অঞ্জলি বুঝল, সংসারের দায়িত্ব এখন তার কাঁধেও পড়েছে। সে কাজ খুঁজতে বেরোয়, প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হয়, গালাগাল শুনেও চুপ করে থাকে, কারণ জানে রাগ দেখানোর অধিকারও যেন তাদের নেই। প্রতিটি রাতে ভিড়ের ভেতর শুয়ে সে ভাবত, তারা কারা? হিন্দু না মুসলমানের সীমানার ভেতর তো তারা পড়ছে না, কারণ তারা এখন একটাই জাতি—শেকড়হীন উদ্বাস্তু।
চিঠিটার দিকে তাকালে মনে হতো রহিমা যদি থাকত, সে নিশ্চয় বলত, “মানুষের তো দেশ হয়, কিন্তু বন্ধুত্বের কোনো দেশ নেই।” সেই অক্ষরগুলোই অঞ্জলির একমাত্র আশ্রয়। মাঝে মাঝে অন্য মেয়েরা জিজ্ঞেস করত, “তুই কী নিয়ে এত খেয়াল রাখিস?” অঞ্জলি হাসত, বলত, “আমার ঘর।” ওরা কিছুই বুঝত না। কিন্তু সে জানত, এই ছোট্ট কাগজটাই তার একমাত্র পরিচয়, তার শেকড়ের শেষ প্রমাণ।
শহরের ভিড়ে দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু অঞ্জলির মনে হচ্ছিল প্রতিদিন সে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল একদিন অন্তত এখানে শেকড় গজাবে, কিন্তু প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি দৃষ্টি তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল—সে কারও নয়, কারও ঘরও নয় তার। এই শেকড়হীনতার বোঝা তাকে শারীরিকভাবে যত না ক্লান্ত করছিল, মানসিকভাবে তার চেয়ে বেশি পুড়িয়ে দিচ্ছিল। তবু সে জানত, এই বোঝাই এখন তার বেঁচে থাকার শর্ত, কারণ এই বোঝা না বইলে হয়তো একেবারেই অস্তিত্ব থাকবে না।
পর্ব ১০ — শেষ আলো
শিবিরের দিনগুলো একসময় অঞ্জলির কাছে শুধু টিকে থাকার গল্প হয়ে দাঁড়াল—ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই, অপমান সয়ে নেওয়া, আর ভেতরে ভেতরে এক অদৃশ্য স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরা। কিন্তু সেই স্মৃতিই তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কারণ যতবার সে হাল ছেড়ে দিতে চাইত, চিঠিটা খুলে পড়লে মনে হতো অন্ধকারের মধ্যে আলো ফুটে উঠছে। একদিন ভোরবেলায় আশ্রয়ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অঞ্জলি, আকাশে ধোঁয়াটে লাল রঙ ছড়িয়ে পড়েছিল, দূরের মন্দির থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল, আবার পাশের গলিতে নামাজের সুর মিলিয়ে যাচ্ছিল—এ শহরে ধর্মের বিভাজন ছিল, কিন্তু সুরগুলো একসাথে বেজে উঠছিল। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, মানুষের মধ্যে হয়তো ভেদ আছে, কিন্তু আকাশের নিচে সব সুর মিলেমিশে এক হয়ে যায়। হরিদাস তার পাশে এসে বলল, “দিদি, আমরা কি কোনোদিন আবার বাড়ি যাব?” অঞ্জলি তার মাথায় হাত রেখে বলল, “আমরা যে যেখানে থাকি, ওটাই হবে আমাদের বাড়ি।” কথাটা বলতে বলতে বুক কেঁপে উঠল, কারণ সে জানত, ভিটেমাটি হয়তো আর কখনোই পাওয়া যাবে না।
তবু জীবন থেমে থাকেনি। ধীরে ধীরে শহরটার অচেনা মুখগুলোও পরিচিত হয়ে উঠল, আশেপাশের মানুষদের অবজ্ঞার ভেতরেও কয়েকজন সাহায্যের হাত বাড়াল। এক বৃদ্ধ শিক্ষক হরিদাসকে পড়তে শেখাতে শুরু করলেন, বললেন, “তোমরা ছেলেমেয়েরা নতুন শিকড় গজাবে, ভয় পেও না।” সেই কথায় অঞ্জলির চোখে জল চলে এল, মনে হলো এ শহর হয়তো একদিন তাদেরও জায়গা দেবে। রাতের অন্ধকারে সে আবার চিঠিটা খুলল—কালি ফিকে হয়ে গেছে, কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে, তবু অক্ষরগুলো বেঁচে আছে। সে আঙুল বুলিয়ে পড়ল—“শিমুলগাছটা আমাদের।” অঞ্জলি চোখ বন্ধ করে শিমুলগাছের লাল ফুল ভেসে উঠতে দেখল, রহিমার হাসিমুখ মনে পড়ল, আর বুঝল এই চিঠিই আসলে তার বেঁচে থাকার শেকড়।
সেদিন রাতে বৃষ্টি নামল আবার, কিন্তু অঞ্জলির কানে আর ভয় শোনা গেল না। বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে সে শুনল রহিমার কণ্ঠ, মৃদু, গভীর, কিন্তু আশ্বাসে ভরা—“তুই একা নস।” অঞ্জলি চুপচাপ জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল, আকাশ ভরা অন্ধকারের ফাঁক দিয়ে এক ফালি আলো বেরিয়ে আসছিল। সেই আলোয় মনে হলো সব বিভাজন, সব দেশভাগ, সব হিংসা পেরিয়েও মানুষের মধ্যে ভালোবাসা বেঁচে থাকে। সে নিজের বুকের ওপর হাত রাখল, মনে হলো চিঠিটা আর কাগজ নয়, সেটা যেন তার হৃদয়ের ভেতর গেঁথে আছে।
শেষ আলোয় দাঁড়িয়ে অঞ্জলি জানল—দেশভাগ তার শরীরকে ছিঁড়ে দিয়েছে, তার ঘরকে ছাই করে দিয়েছে, কিন্তু বন্ধুত্বকে মুছে দিতে পারেনি। যতদিন সে বেঁচে থাকবে, রহিমার কণ্ঠ, সেই শিমুলগাছ, আর এই ভাঁজ করা চিঠি তাকে আলো দেখাবে। শেকড় হয়তো মাটিতে নেই, তবু শেকড় আছে স্মৃতিতে, ভালোবাসায়, আশায়। আর সেই শেকড়ই তাকে টেনে নিয়ে যাবে নতুন জীবনের দিকে।
***
				
	

	


