নীলাঞ্জনা সেন
সকালটা যেন এক অচেনা হাওয়ার মতো এসে ঢুকে পড়েছিল ঘরে, জানালার ফাঁক দিয়ে রোদ ঢুকছিল ধীরে ধীরে, সেই আলো এতটা নরম যে মনে হচ্ছিল একে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেই মিলিয়ে যাবে, বোনটা তখনো আধো ঘুমের ভেতর চায়ের কাপ হাতে বসে ছিল, তার চোখের তলায় হালকা লাল রেখা, হয়তো রাত জেগে ছিল অনেকক্ষণ, অথবা হয়তো নিঃশব্দে কারও সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথন করেছে ফোনে, আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি, কারণ ভোরের নীরবতা ভাঙতে ইচ্ছে করছিল না, শুধু দেখছিলাম সে নিঃশব্দে স্ট্যাটাস আপডেট করছে—“বিষ্ণুপুর যাচ্ছি, সকালটা তোর কপালে”—আমার অদ্ভুত লাগছিল এই লাইনগুলো, কাকে পাঠালো, কেন পাঠালো, তার ভেতরে কী চলছে আমি জানি না, কিন্তু এতটুকু বোঝা যাচ্ছিল আজকের দিনটা অন্যরকম হতে চলেছে, আমরা দুজনেই যেন শহরের গণ্ডি থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলাম, সেই ক্লান্ত ক্লকওয়ার্ক রুটিন থেকে মুক্তি নিয়ে যেতে চাইছিলাম অন্য এক জগতে, যেখানে শুধু লাল মাটির গন্ধ আর টেরাকোটা মন্দিরের নিঃশব্দ ইতিহাস কথা বলবে। ট্রেন ধরার তাড়াহুড়োতে সকালের হালকা হাওয়া আরও ঘনীভূত লাগছিল, প্ল্যাটফর্মের কোলাহল, চায়ের দোকানের ধোঁয়া আর রেললাইন ধরে লম্বা হয়ে যাওয়া ভোরের আলো মিলে মিশে গিয়েছিল, হাতে ধরা কাগজের কাপের কফি যেন হঠাৎ করেই অনেক পুরোনো স্মৃতির দরজা খুলে দিচ্ছিল, দাদুর সঙ্গে ছোটবেলায় ট্রেনে ওঠার সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছিল, বোনটা তখন আমার হাত ধরে টানছিল আর বারবার জিজ্ঞেস করছিল কবে ট্রেন ছাড়বে, সেই স্মৃতির সঙ্গে আজকের এই যাত্রার অদ্ভুত এক যোগসূত্র যেন তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। জানালার পাশে বসে যখন ট্রেন ছাড়ল, বাইরে তাকিয়ে দেখি ধানের ক্ষেত, কচুরিপানায় ভরা পুকুর, কুয়াশায় ঢাকা দূরের টিলা সব যেন ভেসে আসছে চোখের সামনে, বোনটা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—“দেখ, ঠিক আগের মতোই আছে, যেন কিছুই বদলায়নি”—তার কণ্ঠে এক ধরনের বিস্ময়, এক ধরনের শিশুসুলভ আনন্দ, আমি চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম, কারণ আসলে বদলেছে অনেক কিছু, বদলেছি আমরাই, কিন্তু এই ল্যান্ডস্কেপ, এই প্রকৃতির মুখ যেন অচল ঘড়ির মতো একইরকম থেকে গেছে, আর সেই একইরকমের ভেতরেই খুঁজে পাওয়া যায় পরিচিতির আরামের ঘ্রাণ, আমি মনে মনে ভাবছিলাম আজকের দিনটা কেমন যাবে, কী দেখতে পাব, কী অনুভব করব, কিন্তু তার থেকেও বেশি ভাবছিলাম—আমার বোনটা আসলে কী খুঁজতে চাইছে আজকের এই সফরে।
ট্রেনের জানালার কাঁচে ঠেস দিয়ে বসেছিলাম, বাইরে দৃশ্যগুলো ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছিল, শহরের উঁচু দালানগুলো হারিয়ে গিয়ে জায়গা নিচ্ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ আর গ্রামবাংলার অচেনা মুখ, লাল মাটির পথের পাশে শালগাছ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, কাঁচা ঘরের উঠোনে বাচ্চারা খেলা করছে, কেউ লাটাই ঘুরাচ্ছে, কেউ কাদা দিয়ে ছোট্ট মাটির ঘর বানাচ্ছে, বোনটা চোখ বড় বড় করে দেখছিল সবকিছু, যেন তার বহুদিনের অচেনা গল্পগুলো হঠাৎ করে ভেসে উঠেছে সামনে, আমি তাকে দেখছিলাম আর মনে হচ্ছিল এই মেয়েটা যাকে আমি প্রতিদিন দেখি, তার ভেতরে আরেকটা পৃথিবী লুকিয়ে আছে যেটা খুব কম লোকই চেনে, তার চোখের ভেতরে আজ অন্যরকম উজ্জ্বলতা, যেন এই সফর তাকে নতুন করে বাঁচার একটা অজুহাত দিয়েছে, ট্রেনের হালকা দুলুনির ভেতর সে পুরোনো নোটবুক বের করে কিছু লিখতে শুরু করল, কলমের আঁচড়ে বুঝলাম ও শুধু দৃশ্য লিখছে না, নিজের মনের কথাও লিখছে, সেই মনের কথাগুলো হয়তো আমি কখনও পড়ব না, কিন্তু জানি এই পাতাগুলোতেই সে শান্তি খুঁজে পায়, ট্রেন ধীরে ধীরে স্টেশনের কাছে আসছিল, ঘোষণা শোনা গেল বিষ্ণুপুর স্টেশন, আর আমাদের দুজনের বুকের ভেতরেই যেন হঠাৎ একটা দোলা দিল, যেন সত্যিই আমরা একটা যাত্রার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি, নামার পর প্ল্যাটফর্মে যে গরম গন্ধটা ভেসে এলো সেটা ছিল ইট, ধুলো আর পুরোনো শহরের বাতাস মিলে তৈরি এক অদ্ভুত সুবাস, স্টেশনের দেয়ালে ঝোলানো পোস্টারগুলোয় লেখা উৎসবের নাম, টেরাকোটা প্রদর্শনী, বালুচরি শাড়ির মেলা, এসবই যেন জানিয়ে দিচ্ছিল আমরা ইতিহাসের ভেতরে পা রাখতে যাচ্ছি, বাইরে বেরিয়ে যখন রিকশায় উঠলাম তখনো বোনটা চোখে এক অদ্ভুত আলো নিয়ে চারপাশ দেখছিল, আমি হাসলাম, বললাম, “মনে হচ্ছে তো, একেবারে অন্য গ্রহে এসেছিস,” ও হেসে উত্তর দিল, “না, মনে হচ্ছে আমি আমার হারানো জায়গায় ফিরে এসেছি।”
রিকশাটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল শহরের সরু গলির ভেতর দিয়ে, রাস্তার দু’পাশে ছোট দোকান সাজানো, কোথাও মাটির খেলনা, কোথাও টেরাকোটা ঘোড়া, আর মাঝে মাঝে বালুচরি শাড়ির ঝলমলে রঙে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল, বাতাসে যেন লাল মাটির গন্ধ মিশে ছিল, সঙ্গে ছিল কাঁসার থালায় ভেজা ধূপকাঠির গন্ধ, যা ভেসে আসছিল কোনো এক প্রাচীন মন্দিরের উঠোন থেকে, চারপাশে এমন এক আবহ তৈরি হয়েছিল যেন সময় এখানে থমকে গেছে, গাড়ির শব্দ নেই, হর্ন নেই, শুধু পায়ের শব্দ আর কখনও কখনও গরুর গাড়ির চাকা ঘোরার খসখস আওয়াজ, বোনটা চারপাশে তাকিয়ে বারবার বলছিল—“দেখো, এ যেন ইতিহাসের ভেতরে হাঁটছি আমরা,” তার গলার সুরে উত্তেজনা আর বিস্ময় একসাথে মিশে ছিল, আমি চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম ইটের গায়ে খোদাই করা সূক্ষ্ম নকশাগুলোর দিকে, যেগুলো এখনও বেঁচে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে, সেই খোদাইয়ের ভেতরেই তো আছে প্রেম, যুদ্ধ, কৃষিকাজ, আর মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অমলিন ছাপ, মনে হচ্ছিল ইটগুলো যেন গল্প বলছে—আমাদের পূর্বপুরুষদের, তাদের স্বপ্ন আর সংগ্রামের, রিকশা থামল শ্যামরায় মন্দিরের সামনে, দূর থেকে মন্দিরটা দেখে মনে হলো যেন লাল মাটির বুকের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল স্মৃতিসৌধ, আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে, বোনটা নেমে এসে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠল, তার হাত ছুঁয়ে দিল ঠান্ডা ইটের গা, আর সে নিঃশব্দে বলল—“মানুষ হয়তো বদলায়, কিন্তু এই ইটগুলো বদলায় না, এরা সব মনে রাখে,” আমি হেসে উত্তর দিলাম—“তাই তো, হয়তো আমাদের গল্পগুলোও এখানে লুকিয়ে থাকবে কোনো না কোনোভাবে,” আর সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমরা কেবল ভ্রমণে আসিনি, এসেছি নিজেদের হারানো অংশকে খুঁজে বের করতে।
মন্দিরের প্রাঙ্গণে ঢুকতেই মনে হলো যেন অন্য এক সময়ে চলে এলাম, ইটের দেওয়ালে খোদাই করা গল্পগুলো এত স্পষ্ট যে চোখ আটকে যাচ্ছিল বারবার, কোনো খোদাইয়ে রথযাত্রা, কোনো খোদাইয়ে যুদ্ধক্ষেত্র, আবার কোথাও কৃষকের মুখে হাসি, বোনটা হাঁটছিল আস্তে আস্তে, হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি ছবির গায়ে, যেন সময়ের বুক থেকে ধুলো মুছে দিচ্ছে, হঠাৎ সে থেমে বলল—“তুমি কি বুঝতে পারছো, এখানে কত মানুষের শ্বাস লেগে আছে, কত প্রার্থনা, কত আনন্দ, কত দুঃখ,” আমি মাথা নেড়ে হেসে উত্তর দিলাম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমিও যেন এক অদ্ভুত আবেগে ভেসে যাচ্ছিলাম, মন্দিরের উঠোনে হাওয়ায় বাজছিল ঘুঙুরের মৃদু আওয়াজ, হয়তো কোনো মহড়া হচ্ছিল ভেতরে, সেই আওয়াজ যেন ইটের খাঁজে খাঁজে ঢুকে গিয়ে ফিরে আসছিল প্রতিধ্বনি হয়ে, আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, শুধু শুনছিলাম সেই সুর, সেই ছন্দ, যা শত বছর আগেও হয়তো বাজত এই একই উঠোনে, তারপর মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম পাশের বাজারের দিকে, সেখানকার দৃশ্য যেন একেবারেই অন্যরকম—দোকান সাজানো টেরাকোটা ঘোড়া, হাতপাখা, বাঁশের খেলনা, আর রঙিন কাচের গয়না, বোনটা তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল এক দোকানে, কতগুলো পুতুল বেছে নিল, তাদের রঙ, মুখভঙ্গি, সবকিছুতেই একরকম প্রাণ আছে, দোকানদার হাসি মুখে বলল—“এইগুলোই তো বিষ্ণুপুরের চিহ্ন, এগুলো ছাড়া এখানে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ,” বোনটা পুতুলগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে বলল—“এদের নিয়েই আমি একটা গল্প লিখব,” তার চোখে তখন সেই ছোটবেলার আলো, যেটা আমি অনেক দিন দেখি না, আমি তাকিয়ে রইলাম আর মনে হচ্ছিল সত্যিই এই ভ্রমণটা আমাদের কেবল দর্শন নয়, একটা ভেতরের পথ খোঁজা।
বাজারের কোলাহল পেরিয়ে আমরা একটা ছোট্ট খাবারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম, বাইরে কাঠের বেঞ্চে বসে খাওয়া যায়, ভেতর থেকে ভেসে আসছিল ভাজা মশলার গন্ধ, মালিক হাসিমুখে বললেন—“বসুন দাদা, গরম ভাত, আলুর চচ্চড়ি, মাছের ঝোল দেবো,” আমরা জায়গা করে নিলাম এক কোণে, সামনে এসে হাজির হলো মাটির থালায় ধোঁয়া ওঠা ভাত, পাশে পাতলা আলুর চচ্চড়ি, ডাল আর ঝাল মাছের ঝোল, খেতে খেতে হঠাৎ বোনটা থেমে গেল, চোখের কোণে এক অদ্ভুত শান্তি, বলল—“তুমি জানো, শহরে যতই দামি রেস্টুরেন্টে খাই না কেন, এই স্বাদটা পাওয়া যায় না, এখানে খেলে মনে হয় আমি আবার ছোটবেলায় ফিরে গেছি,” আমি চুপ করে তার দিকে তাকালাম, হয়তো সত্যিই আমাদের ভেতরের মানুষটা কখনও বদলায় না, সে সবসময় ফিরে যেতে চায় তার শিকড়ে, তার চেনা স্বাদে, তার চেনা গন্ধে, জানালার বাইরে তখন পথের ধুলো উড়ছিল, আর দোকানের ভেতরে বসে থাকা কিছু বয়স্ক লোক আড্ডা দিচ্ছিল রাজনীতি আর গ্রামের গল্প নিয়ে, তাদের হাসি, তাদের উচ্চস্বরে তর্ক, সব মিলিয়ে জায়গাটা যেন একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, খাওয়া শেষ হলে মালিক মিষ্টি হিসেবে ছোট্ট বাটি ভরে দই দিলেন, দইটা এত ঘন আর মিষ্টি যে প্রথম চামচেই মনে হলো সারা দিনের ক্লান্তি মুছে গেল, বোনটা চামচ নামিয়ে রেখে হেসে বলল—“আমার মনে হচ্ছে আজকের দিনটা আমার জন্য একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে, হয়তো এটাই সেই দিন যেটার কথা আমি বহুদিন ধরে লিখতে চেয়েছিলাম,” আমি তার চোখের ভেতরে অচেনা ঝিলিক দেখতে পেলাম, সেখানে শুধু খাবারের আনন্দ ছিল না, ছিল নিজের ভেতরের কোনো হারানো অংশ ফিরে পাওয়ার তৃপ্তি।
দুপুরের রোদ একটু একটু করে নরম হয়ে আসছিল, আমরা আবার হাঁটা ধরলাম মন্দিরের দিকেই, রাস্তার দু’পাশে দোকানগুলো তখন ভিড় জমাচ্ছে, বাইরে রাখা টেরাকোটা ঘোড়াগুলো সূর্যের আলোয় লালচে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন তারা জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদার হয়ে, বোনটা এক হাতে পুতুলের থলে নিয়ে অন্য হাতে ফোনে ছবি তুলছিল, তার চোখে তখন নিখাদ উচ্ছ্বাস, যেন ছোট্ট একটা স্মৃতি বন্দি করছে সে, যেটা পরে কোনো এক নিঃশব্দ বিকেলে আবার খুলে দেখবে, মন্দির চত্বরে ঢুকতেই হাওয়ায় বাজতে লাগল মৃদঙ্গ আর ঘণ্টার শব্দ, হয়তো কোথাও আরাধনা চলছে, সেই সুর যেন ইটের খাঁজে প্রতিধ্বনি হয়ে গাঢ় হয়ে উঠছিল, আমরা ছায়াঘেরা এক কোণে বসে পড়লাম, বোনটা নোটবুক খুলে কিছু লিখতে শুরু করল, কলমের টুকটুক শব্দ যেন হাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল, আমি তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে, সেখানে কোনো ক্লান্তি নেই, শুধু এক ধরনের নরম আলো, যেন ভেতর থেকে জ্বলছে, হঠাৎ সে থেমে বলল—“শোনো, আমি ভাবছি একটা গল্প লিখব, নাম দেবো—ইটের স্মৃতি,” আমি হাসলাম আর বললাম—“চমৎকার নাম, তবে সাবধান, ইটেরা কিন্তু অনেক কিছু মনে রাখে,” সে হেসে মাথা নেড়ে আবার লিখতে শুরু করল, তার আঙুলের ভেতর থেকে ঝরে পড়া শব্দগুলো যেন মাটির সঙ্গে, গাছের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল, আর আমি অনুভব করছিলাম এই ভ্রমণ কেবল দেখা নয়, এটা একটা অভ্যন্তরীণ যাত্রা, যেখানে আমরা নিজের ভেতরের শূন্যতাকে পূর্ণ করার পথ খুঁজছি।
বিকেলের আলো তখন সোনালি হয়ে উঠছে, মন্দিরচত্বরে বসে থাকতে থাকতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ছায়া ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে মাটির ওপর আঁকিবুঁকি কাটছে, চারপাশে কিছু ছেলেমেয়ে খেলছিল, তাদের হাসি আর চিৎকার মিলেমিশে এক ধরনের উল্লাস তৈরি করছিল, বোনটা চুপচাপ তাদের দেখছিল, হয়তো মনে মনে ভাবছিল একসময় তারও এরকম ছুটে বেড়ানো দিন ছিল, এখন কেবল স্মৃতির পাতায় বেঁচে আছে, আমরা কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলাম কাছের এক শালবনের দিকে, গাছগুলো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে, মাটিতে শুকনো পাতার স্তর, হাঁটলে খসখস শব্দ হয়, সেই শব্দে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, মনে হয় প্রকৃতিই যেন কোনো আলগা সুর তুলছে, বোনটা গাছের নিচে বসে পড়ল, তার চোখ আকাশের দিকে, বলল—“দেখো, এই আকাশটা শহরে কখনও দেখা যায় না, এত বিশাল, এত নীল, এত শান্ত,” আমি মাথা তুলে তাকালাম, সত্যিই, যেন আকাশটা এখানে আরও কাছে, আরও স্পষ্ট, শালবনের ভেতর দিয়ে আসা হাওয়াটা ঠান্ডা ছিল, গায়ে শিহরণ জাগাচ্ছিল, বোনটা তার নোটবুকে কয়েকটা লাইন লিখল, তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল—“আমি লিখেছি, মানুষ আকাশকে নিজের মতো করে ভাগ করে নেয়, কিন্তু আকাশ আসলে কারও নয়, ঠিক যেমন বিষ্ণুপুরও কারও নয়, তবু সবাই এর ভেতরে নিজেদের একটা অংশ খুঁজে পায়,” আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, কারণ এই কয়েকটা লাইনের ভেতরেই সে পুরো ভ্রমণের আসল মানে ধরে ফেলেছে, সূর্য তখন ধীরে ধীরে নামছে, চারপাশে আলো কমে আসছে, শালগাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা সেই শেষ আলো আমাদের মনে এমন এক আবেশ তৈরি করছিল, যা ভাষায় বোঝানো যায় না।
সন্ধ্যা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে, শহরের আকাশে তখন প্রথম তারা জ্বলতে শুরু করেছে, মন্দিরের তোরণগুলোতে লণ্ঠনের মতো ছোট ছোট আলো জ্বালানো হয়েছে, সেই আলোয় ইটের গায়ে লম্বা ছায়া পড়ছে, হাওয়ায় ভেসে আসছে শঙ্খ আর ঘণ্টার শব্দ, মনে হচ্ছিল যেন ইতিহাসের ভেতর দিয়ে হাঁটছি, একদিকে আধুনিকতার ছাপ, আর অন্যদিকে সেই অচল সময়ের অদ্ভুত টান, আমরা দুজনেই হাঁটছিলাম সরু গলি ধরে, দোকানগুলো তখনও খোলা, কোথাও বাঁশের বাঁশি বেজে উঠছে, কোথাও কিশোরেরা ঢোল বাজাচ্ছে, বোনটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল—“শোনো, এই শহরটা যেন একেবারেই অন্যরকম, এখানে রাতও কথা বলে, এখানে নীরবতাও জীবন্ত,” আমি হেসে উত্তর দিলাম—“হয়তো এ কারণেই মানুষ বারবার ফিরে আসে বিষ্ণুপুরে, এখানেই তারা নিজেদের হারানো শব্দ খুঁজে পায়,” রিকশা আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল আমাদের নিয়ে, চারপাশে তখন উৎসবের আমেজ, মাটির প্রদীপ সাজানো হচ্ছে, রঙিন কাপড় ঝোলানো, আর শিশুদের হাসির শব্দ মিশে যাচ্ছিল রাতের গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে, আমরা থেমে গেলাম এক প্রাচীন তোরণের সামনে, বোনটা কাঁধে ঝুলানো পুতুলের ব্যাগটা শক্ত করে ধরল, তারপর বলল—“আমি এগুলোকে কাছে রাখব, প্রতিদিন মনে হবে কিছুই বদলায়নি,” আমি তাকিয়ে বললাম—“হয়তো বদলায়নি এ শহর, কিন্তু বদলেছি আমরা, আর সেই বদলটাই আমাদের নতুন করে এই শহরের সঙ্গে জুড়ে দেয়,” উপরে তাকিয়ে দেখলাম আকাশটা আরও ভরে গেছে তারা দিয়ে, মনে হচ্ছিল তারা যেন খুব কাছে নেমে এসেছে, যেন আমাদের চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে।
ট্রেনে ফেরার সময় রাত ঘন হয়ে এসেছিল, জানালার বাইরে অন্ধকার মাঠ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট আলো ঝিকমিক করছে দূর গ্রামে, রেললাইনের ধাতব শব্দ একঘেয়ে ছন্দ তুলছিল, তার ভেতরেই যেন একটা ঘুমপাড়ানি গান লুকিয়ে ছিল, বোনটা জানালার কাঁচে মাথা ঠেসে বসে ছিল, তার মুখে ক্লান্তি থাকলেও চোখে ছিল অদ্ভুত তৃপ্তি, হঠাৎ সে আস্তে করে বলল—“তুমি জানো, আজকের দিনটা আমার জীবনের এক ছোট্ট পালা হয়ে থাকবে, একটা জায়গা যেটা আমাকে মনে করিয়ে দিল আমি আসলে কে ছিলাম, কী খুঁজছিলাম,” আমি চুপচাপ শুনছিলাম, কারণ উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম কীভাবে অন্ধকার আর আলো মিলে এক অদ্ভুত খেলা তৈরি করছে, বোনটা ধীরে ধীরে তার নোটবুকটা খুলল, ভেতরে লেখা কয়েকটা লাইন আমাকে পড়তে দিল, সেখানে লেখা ছিল—“একদিনের বিষ্ণুপুর, মাটির গন্ধ, মন্দিরের ছায়া, আর নিজের হারানো রঙ ফিরে পাওয়া,” আমি পড়তে পড়তে থেমে গেলাম, মনে হচ্ছিল এই কয়েকটা শব্দই যথেষ্ট আজকের পুরো দিনের ব্যাখ্যা দিতে, ট্রেন যখন একের পর এক স্টেশন পেরোচ্ছিল তখন আমাদের ভেতরকার নিঃশব্দ কথোপকথন যেন আরও গভীর হয়ে উঠছিল, কোনো শব্দ ছিল না, শুধু একে অপরের উপস্থিতি আর রাতের সেই দীর্ঘ যাত্রা, যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল—ভ্রমণ আসলে শুধু জায়গা দেখা নয়, ভ্রমণ মানে নিজেকে নতুন করে দেখা।
শহরের আলো ক্রমশ কাছে আসছিল, ট্রেনের জানালার বাইরে উঁচু দালান আর সেতুর ঝলমলে বাতি দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমরা আবার সেই চেনা ভিড় আর ব্যস্ততার ভেতর ঢুকে যাচ্ছি, অথচ বুকের ভেতরে এখনো রয়ে গেছে বিষ্ণুপুরের মাটির গন্ধ, শালবনের হাওয়া আর মন্দিরের প্রতিধ্বনির সুর, বোনটা আমার হাত আলতো করে ধরে বলল—“চলো, আগামী সপ্তাহে আবার কোথাও যাই, এবার আরও বেশি সময় নিয়ে,” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম, কারণ আমিও জানতাম এই এক দিনের ভ্রমণ আমাদের ভেতরে যে শূন্যতা ছিল তাকে ভরিয়ে দিয়েছে, ফেরার পথে ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল আমরা কেবল একটা শহর ঘুরে এলাম না, আমরা আমাদের ভেতরের সেই হারানো মানুষটাকে খুঁজে পেলাম, যে বহুদিন কোথাও লুকিয়ে ছিল, বোনটার চোখে তখন এক ধরনের শান্ত আলো, যেন সে অবশেষে নিজের ভিতরের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে, আমার মনে হচ্ছিল এই সফরের আসল প্রাপ্তি কোনো পুতুল, কোনো ছবি বা কোনো গল্প নয়, আসল প্রাপ্তি হলো নিজেদের ভেতরের সেই হারানো অংশকে আবার খুঁজে পাওয়া, ট্রেন যখন শেষ স্টেশনে এসে দাঁড়াল তখন মনে হচ্ছিল দিনটা শেষ হয়নি, বরং একটা নতুন শুরু হলো, যেখানে প্রতিটি ভ্রমণই আমাদের শেখাবে—ফিরে দেখা মানে শুধু জায়গা দেখা নয়, ফিরে দেখা মানে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া।
শেষ