১
তপন মিত্রের জীবনের প্রতিটি ছন্দ যেন গত কয়েক মাসে বদলে গেছে। ইতিহাসের শিক্ষক সে, কলকাতার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ায়। কিন্তু স্কুল, টিউশন, আর অতীতের ছায়ায় ঢাকা জীবন — তপনের দিনগুলো যেন কেমন একটা কুয়াশায় ঘেরা। একসময়ে সে ছিল প্রাণবন্ত, ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক, বন্ধুদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। এখনকার তপন নিঃসঙ্গ। কিছুদিন আগে প্রেমিকা ঋতাভার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে গেছে। কষ্ট আর অভিমান মিলেমিশে এক অদ্ভুত শূন্যতা তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।
এই শূন্যতা থেকে মুক্তির জন্যেই সে এখন ঘন ঘন বাইকে চড়ে বেড়ায়, একা। কলকাতার ভিড়, শব্দ আর স্মৃতি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও নিঃশ্বাস নিতে চায়। এই শনিবার সকালেও সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় — সুন্দরবনের দিকে একটু ঘুরে আসবে। হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে বাইকে করে যাবে, বিকেলের মধ্যে ফিরেও আসবে। সে জানে না, আজকের এই সফর তার জীবনের ছন্দ শুধু নয়, বিশ্বাসকেও চিরদিনের জন্য বদলে দেবে।
সকাল আটটার মধ্যে রওনা দেয় সে। বাইকের ট্যাংক ফুল, গায়ে একটা হালকা জ্যাকেট, ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার, পানির বোতল, আর একটি ছোটখাটো DSLR ক্যামেরা। পথে যেতে যেতে সে ক্যানিং, গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ হয়ে পৌঁছায় বকখালি সীমান্তে। বনমহলে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ, নদীর ধারে। পাখিদের ডাক, গাছেদের দুলুনি, আর ধীর বাতাসে তার ক্লান্ত চোখ কিছুটা জিরিয়ে নেয়।
বিকেল পাঁচটার পর সে বাইকে ফেরে, কলকাতার দিকে। কিন্তু আসার পথে যে ভুলটা সে করল, তা ছিল মারাত্মক। সে বেছে নেয় বাসন্তী হাইওয়ের রাস্তা।
বাসন্তী হাইওয়ে — দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি প্রাচীন ও নির্জন পথ। দিনের আলোয় যেমন নিরীহ, রাতের আঁধারে এই রাস্তা হয়ে ওঠে আতঙ্কের নাম। স্থানীয়দের মতে, এই রাস্তায় মাঝরাতে নাকি এক মহিলা লিফট চায়, আর তাকে যেই না গাড়িতে তোলে, সে গাড়ির মধ্যেই উধাও হয়ে যায়। পেছনে রেখে যায় শুধু একটি হলুদ খাম, যার মধ্যে থাকে একটি চিঠি — যার তারিখ ১৯৭৪।
তপন এসব গল্পে বিশ্বাস করে না। সে পড়েছে, জানে, এইসব গ্রামীণ ভূতুড়ে গল্প মানসিক বিভ্রম মাত্র। আধুনিক যুগে ভূতপ্রেতের স্থান নেই — এ বিশ্বাসেই সে বাইক চালিয়ে ঢুকে পড়ে বাসন্তী হাইওয়ের অন্ধকারে।
তখন রাত প্রায় ১২টা। চারদিক নির্জন, গাছেদের ছায়া রাস্তার ওপর পড়ে আছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে চারপাশ। রাস্তায় মাঝে মাঝে কিছু লাইটপোস্ট থাকলেও, অনেকগুলোর আলো নেভা। কেবল বাইকের হেডলাইটই পথ দেখায় তাকে।
একটা সময় সে দেখে — রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। সাদা রঙের শাড়ি পরা, খোঁপা করা চুল, আর এক হাতে একটা ছোট ব্যাগ। অন্য হাতে সে লিফট চায়। সোজাসুজি তপনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
তপনের মনের ভেতর খচখচ করে ওঠে কিছু একটা। মনে পড়ে যায় পড়া সেই কাহিনি। কিন্তু সে নিজেকে বোঝায় — “ভূত নেই, ভূত নেই… এটা নিছক কাকতালীয়।”
সে বাইক থামায়। মহিলা এগিয়ে এসে বলে — “বাসন্তী মোড় অব্দি পৌঁছে দেবেন? একটু কাজ ছিল, এই রাতেই ফিরতে হবে। একা যেতে পারছি না।”
তপন মাথা নাড়ে। পেছনের সিটে বসে পড়ে মহিলা। বাইক চলতে শুরু করে। তখন তপনের ঘাড়ে যেন হিমেল বাতাস লাগতে থাকে — অস্বাভাবিক ঠান্ডা। আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা যেতে লাগে দশ মিনিট। মহিলা চুপচাপ, কোনো শব্দ নেই, কোনো প্রশ্ন নেই।
তপন অবশেষে এক জায়গায় বাইক থামায়, পিছনে তাকিয়ে বলে — “আপনার গন্তব্য এসে গেছে।”
কিন্তু পেছনে কেউ নেই। সিট ফাঁকা।
তপনের মুখ শুকিয়ে যায়। সে বাইকের দিকে তাকায় — সিটের ওপরে একটা হলুদ খাম রাখা। ধুলো জমে আছে খামে। হাত কাঁপতে কাঁপতে সে খাম তোলে। খামের গায়ে লেখা —
“২১ মার্চ, ১৯৭৪”
চোখ মেলে সে পড়ে —
“প্রিয় অরিজিৎ, কাল রাতেও তুমি কথা দিয়েছিলে — বাসন্তী মোড় থেকে আমায় তুলে নেবে। তুমি এলে না। আমি হেঁটে চলি রাস্তায়… একা… অন্ধকারে। সেই রাস্তায়, গর্তের কাছে, একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে। আমি আর কিছু মনে নেই… কিন্তু আমি জানি, আমি এখনো এখানেই… প্রতীক্ষায়…
– মীনাক্ষী”
তপনের কাঁধের পেছনে হিমেল বাতাস এক ঝটকায় বয়ে যায়। দূরে রাস্তার কোনো গর্তের ধারে কে যেন তাকিয়ে আছে। কুয়াশার ভেতর একটা অবয়ব — সাদা শাড়ি, একজোড়া কালো চোখ, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে… ঠিক তার দিকেই।
২
তপন মিত্র বাইক স্টার্ট করে দ্রুতগতিতে রাস্তা ছাড়তে চাইলেও কেমন যেন গতি পায় না। হেডলাইট কাঁপতে থাকে, বাইকের সাইলেন্সার থেকে বিকট শব্দ বেরোতে থাকে, হ্যান্ডেল যেন হঠাৎ ভারি হয়ে উঠেছে। পেছনে আর তাকাবার সাহস নেই। চোখের সামনে শুধু ধোঁয়াশা আর কুয়াশা। যেন একটা অদৃশ্য শক্তি পিছন থেকে চেপে ধরেছে তাকে।
রাস্তায় কোন মোড় নেই, কোন দিকনির্দেশক নেই, শুধু একটানা রাস্তা, কুয়াশার দেয়ালে বন্দি। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই, GPS বন্ধ। সময় দেখে — রাত ১:২৮। মাত্র বিশ মিনিট হয়েছে এই অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছে, অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে।
কিছুটা দূরে একটা কুঁড়ে ঘর দেখা যায় রাস্তার পাশে — ভাঙাচোরা চায়ের দোকান। বাইক থামিয়ে ভেতরে ঢোকে। চা বিক্রি হয় না বহুদিন, বোঝাই যায়। কিন্তু আশ্চর্য, ঘরের কোণায় এক বৃদ্ধ বসে আছেন। পেট্রোম্যাক্স আলোয় তাঁর চোখ চকচক করছে। চোখে ছানি, হাতে একটা চিঠির মতো কাগজ ঘষছেন।
“কী চাই?” বৃদ্ধ বললেন।
তপন বলল, “আমি এক মহিলাকে লিফট দিয়েছিলাম… তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। আমি খাম পেয়েছি… তারিখ ১৯৭৪। কিছু বলবেন?”
বৃদ্ধ তাকিয়ে রইলেন তার চোখে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন — “তোমায় পেছনে ফিরতে বারণ করেছিল কেউ?”
তপন স্তম্ভিত। “কী বলছেন?”
বৃদ্ধ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ও এখানে বছর চল্লিশের বেশি সময় ধরে আসে। কেউ কেউ ওকে দেখে, কেউ কেউ দেখে না। যাকে দেখে, তার জন্য থাকে ডাক। ও এক সময়ে আমার ছাত্রী ছিল। নাম ছিল মীনাক্ষী দে। ভীষণ ভালো নাচত। প্রেমে পড়েছিল এক শহুরে ছেলের, নাম ছিল অরিজিৎ দত্ত। ছেলেটা কথা রেখেছিল না, আর সেই অভিমানে… ও চলে যায় এই রাস্তার মাঝখানে, সেই গর্তটার সামনে।”
তপন বলল, “আপনি কিভাবে জানেন?”
বৃদ্ধ মাথা নিচু করে বললেন — “আমি ছিলাম তখন ওর স্কুলের হেডমাস্টার। সেই ঘটনাটা আমাকেও ভেঙে দিয়েছিল। পুলিশের রিপোর্ট ম্যানিপুলেট করা হয়েছিল। বলেছিলো, অ্যাক্সিডেন্ট। কেউ বলে আত্মহত্যা। কিন্তু আমি জানি, ওর আত্মা এখানেই আটকে গেছে।”
তপনের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। “কিন্তু সে ফিরে কেন আসে?”
“ওর অভিমান এখনো আছে। যে তার প্রতীক্ষায় ফেলে চলে গিয়েছিল, সে ফিরে আসবে এই বিশ্বাসে ও অপেক্ষা করে। যেকোনো পুরুষ যার মুখে অনুরূপ অভিব্যক্তি… যাকে ওর অরিজিৎ মনে হয়… তার বাইকে চড়ে। তারপর…”
বৃদ্ধ থেমে যায়।
তপন বলল, “আমাকে কী করতে হবে?”
বৃদ্ধ বললেন, “তোমাকে ওর সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলতে হবে। ওকে জানাতে হবে — অরিজিৎ আর নেই। তুমি তাকে খুঁজে পাওনি। তাকে শান্তি দিতে হবে। তাহলেই মুক্তি পাবে।”
তপনের গলা শুকিয়ে যায়। “আমি যদি না পারি?”
বৃদ্ধ বললেন, “তবে তুমি আটকে যাবে। ওর মতো। এ রাস্তা সহজে ছাড়ে না কাউকে।”
ঘড়ির কাঁটা তখন ১:৫৯। তপন বাইকে ওঠে আবার। বৃদ্ধ বলেন, “২:১৩ নাগাদ ও আবার আসবে। তুমি থামো না, তপন। ও আসবে, তোমাকে ডাকবে। পেছনে তাকিও না। কথাও বলো না। যদি পারো — রাস্তা ছাড়বে তোমাকে। যদি না পারো… আমি আর কিছু করতে পারব না।”
তপনের বুক ধড়ফড় করতে থাকে। বাইকের হেডলাইট জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। সে স্টার্ট দেয়, হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে। রাস্তার সেই মোড় — সে জানে, আবার আসবে সেই মুহূর্ত।
আর ঠিক ২:১৩-তে… সেই ছায়ামূর্তি আবার দেখা যায়। সাদা শাড়ি, ভেজা চুল, থমথমে মুখ। হাত তুলে লিফট চায়।
তপন চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালায়। পেছনে তাকায় না। মনে মনে জপ করে, “আমি অরিজিৎ নই… আমি তপন…”
তিন কিলোমিটার দূরে, রাস্তায় একটা বড় গর্ত পড়েছে। সেই জায়গা — যেখান থেকে ওর আত্মা মুক্ত হতে পারে। তপন সেই গর্তের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয় বাইক। তখনই… পিছন থেকে ভেসে আসে কাঁপা কাঁপা গলা…
“তুমি ফিরেছ, অরিজিৎ?”
তপন পিছনে না তাকিয়ে বলে, “আমি তপন। আমি এসেছি তোমার কথা শুনতে, তোমাকে মুক্তি দিতে।”
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা। তারপর বাতাসে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ… “আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম, কেন তুমি আসোনি…”
তপন বলে — “সে আর আসবে না। কিন্তু আমি এসেছি। এবার তুমি শান্ত হও। এবার তুমি ফিরে যাও… আলোয়।”
এক ঝলক বাতাস আসে। বাইকের চারপাশে কুয়াশা ঘনীভূত হয়। তারপর… হঠাৎ সব থেমে যায়। বাতাস নিঃশব্দ, রাত নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটা দেখায় — ২:২২।
তপন বাইক স্টার্ট করে। এবার সহজেই চলে যায়। বাসন্তী হাইওয়ে তাকে আর আটকায় না।
তবে… যাওয়ার সময় শেষবারের মতো পেছনে তাকায় সে — দেখে, রাস্তার পাশে পড়ে আছে সেই চিঠির খাম। তাতে লেখা:
“ধন্যবাদ। এবার আমি যেতে পারি…”
৩
পরদিন সকাল। তপন মিত্রের চোখ খুলতেই তার বুকটা অদ্ভুত রকম ভার হয়ে আসে। মনে হয় যেন কিছু একটা রেখে গেছে সেই রাস্তা, তার ভেতরে। সে এখন নিজের বাড়িতে, বালিগঞ্জের এক পুরনো দোতলা বাড়ির নিচতলায়। বাইক গ্যারেজে রাখা, জামাকাপড় খুলে রাখা, জুতো জায়গামতো — সবই ঠিকঠাক। কিন্তু একটা জিনিস ঠিক নেই। তার টেবিলের ওপর রাখা খামটা।
হ্যাঁ, সেই হলুদ খাম। যার মধ্যে ছিল ১৯৭৪ সালের চিঠি। সে তো সেটি ফেলে এসেছিল বাসন্তী হাইওয়ের ধারে! তাহলে কীভাবে এটি ফিরে এল?
তপন থমকে যায়। ধীরে ধীরে খামটা তোলে। দেখে — ঠিক আগের মতোই ধুলো জমা খাম, কিন্তু এবার একটি নতুন লাইন লেখা আছে পেছনে —
“এখনো অনেক কিছু বলা বাকি…”
তপনের গা শিরশির করে ওঠে। এইবার সে ভাবে, এই ঘটনা তো কেবল রাতের দুঃস্বপ্ন নয়, কিছু একটা সত্যিই ঘটেছে। সে ঠিক করে — এবার তাকে সত্যিটা জানতে হবে। একা নয়, সাহায্য নিতে হবে।
সে ফোন করে তার পুরোনো বন্ধু নীলয় সেনকে — একজন সাংবাদিক, যিনি প্যারানর্মাল বিষয়ে লেখালেখি করেন, আর “অতীন্দ্রিয় কলকাতা” নামে একটি ব্লগ চালান। তপন তার সব কথা খুলে বলে। চিঠি, মহিলা, গর্ত, বৃদ্ধ — সব।
নীলয় প্রথমে হাসে, “তুই ভূতে বিশ্বাস করিস, তপন?”
তপন গম্ভীর স্বরে বলে — “বিশ্বাস না করলেও ঘটনাগুলোকে এড়াতে পারছিস?”
নীলয় তখন সিরিয়াস হয়। “দেখ, চিঠিটা আমাকে দেখাতে পারবি?”
তপন রাজি হয়। দুপুরে নীলয় আসে, চিঠি দেখে। সে চিঠির কাগজ স্পর্শ করে, ঘ্রাণ নেয়, বলে — “এটা ৭০ দশকের কাগজ। এধরনের খাম এখন মেলে না। এটা আসল।”
নীলয় বলে, “তুই কি সেই গর্তটা দেখাতে পারবি আমাকে?”
তপন চিন্তা করে। তারপর মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের সন্ধ্যা নামার আগে ফিরতে হবে। আমি আবার রাস্তায় আটকে যেতে চাই না।”
দু’জনে বাইকে বেরিয়ে পড়ে, ক্যামেরা, নোটবুক আর রেকর্ডার সাথে নিয়ে। তারা পৌঁছে যায় সেই গর্তটার কাছে। আশ্চর্য — সেই জায়গায় একটা ছোটো মেমোরিয়াল দেখা যায়। ভাঙা পাথরে লেখা —
“মীনাক্ষী দে (১৯৫৬–১৯৭৪)। অকালপ্রয়াণ। স্মৃতির শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
নীলয়ের চোখ কপালে উঠে যায়। “এটা কেউ তোদের বলল না?”
তপন বলে — “বৃদ্ধ বলেছিলেন — মীনাক্ষী এখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু এত বছর ধরে কেউ এটা মুছে ফেলেনি, সংস্কারও হয়নি।”
নীলয় মাটিতে বসে পাথরের চারপাশ ঘেঁটে দেখতে শুরু করে। হঠাৎ পাথরের নিচে একটা ধাতব বাক্স পায়। খুলে দেখে — ভেতরে পুরোনো ছবি, একটি পাউডারড কৌটো, আর একটি লাল রঙের দিনলিপি। তপনের হাত কাঁপে।
দিনলিপি খুলে পড়তে শুরু করে তারা। প্রথম পাতায় লেখা —
“আমি মীনাক্ষী। আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সব লিখে রাখব। হয়তো কেউ পড়বে একদিন… যদি আমি না ফিরি।”
তারা পড়ে — প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং যন্ত্রণার কাহিনি। অরিজিৎ তার প্রেমিক, কিন্তু একদিন সে ভান করে — শহরে চলে যাবে চাকরির জন্য। কিন্তু পরে জানা যায় সে বিয়ে করেছে আরেকজনকে। মীনাক্ষী সেই রাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে — আর ফিরে আসে না।
নীলয়ের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। “তপন, এটা শুধু ভূতের গল্প নয়। এটা এক অসমাপ্ত প্রেমের প্রতিশোধের দলিল। ওর আত্মা মুক্ত হতে চায়, কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি এতদিন।”
তপন বলে, “তাহলে আমাদের কী করতে হবে?”
নীলয় বলে — “তুই আবার সেই রাস্তায় যাবি, তপন। এবার ওর সঙ্গে কথা বলবি — কিন্তু এইবার আমরা তার কণ্ঠ রেকর্ড করব। আমরা ইতিহাস লিখব — ওর ইতিহাস। তারপর ওকে ছেড়ে দেব, শান্তিতে।”
তপনের বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরে। কিন্তু এবার সে পিছিয়ে যায় না। কারণ, সে বুঝে গেছে — চিঠির আগমন ছিল কেবল শুরু। শেষ এখনো হয়নি।
৪
সন্ধে ছ’টা। তপন আর নীলয় আবার তৈরি। হাতে রেকর্ডার, ক্যামেরা, গলার কাছে ঝুলছে ল্যাভালিয়ার মাইক্রোফোন। মাথার মধ্যে কাঁপছে ভয়, কিন্তু বুকের মধ্যে জমে আছে একটা দৃঢ় সংকল্প — আজ রাতে তারা মুখোমুখি হবে এক আত্মার, যে চায় শুধু মুক্তি।
তারা পৌঁছে যায় সেই গর্তের কাছে, যেখানে স্মৃতিফলক, যেখানে সন্ধ্যা নামলেই কুয়াশা গাঢ় হয়ে ওঠে। নীলয় তার ক্যামেরা সেট করে, ত্রিপড লাগিয়ে বলে — “যা কিছু হোক, আমরা এটা রেকর্ড করব। ইতিহাস ভুলে গেলে ইতিহাস ফিরে এসে দাবি তোলে।”
তপন বাইকে বসে। ঘড়ির কাঁটা ১:৫৮। মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। এই সময় তারা চারপাশে অদ্ভুত ঠাণ্ডা অনুভব করে। যেন বাতাস হঠাৎ ভারি হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ঠিক ২:১৩-তে, রাস্তার শেষপ্রান্তে আবার সেই ছায়ামূর্তি দেখা যায় — ধীরপায়ে এগিয়ে আসে, সাদা শাড়ি, চুল ভেজা, চোখে অপার বিষাদ।
নীলয় ক্যামেরা অন করে। মাইকে ফিসফিস করে — “সে এসে গেছে।”
তপন এইবার বাইক স্টার্ট করে না। দাঁড়িয়ে থাকে। মহিলা এগিয়ে আসে, বলে — “তুমি ফিরে এসেছ, অরিজিৎ?”
তপন গলার স্বর স্থির রেখে বলে — “আমি তপন। কিন্তু আমি এসেছি তোমার জন্যই। তুমি কী চাও, মীনাক্ষী?”
মহিলার মুখ এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে বলে — “তুমি জানো আমার নাম?”
নীলয় রেকর্ড চালু রেখেছে। মীনাক্ষীর আত্মা যেন প্রথমবার নিজের পরিচয়ে কথা বলছে। সে বলে —
“আমি তার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। অরিজিৎ। সে বলেছিল ফিরে আসবে। আমি সেই কথার অপেক্ষায় মরেও শান্তি পাইনি। এই রাস্তা আমার আশ্রয় হয়েছে। যারা আমাকে দেখে, তাদের মধ্যে আমি খুঁজি তাকে। কিন্তু কেউ তাকে নয়। কেউ আমাকে বোঝে না…”
তপন বলে — “আমি জানি, সে আর আসবে না। সে ভুল করেছে। কিন্তু তুমি তো তাকে ছেড়ে দিলে না। তুমি তো নিজেকেও আটকে রাখলে।”
মীনাক্ষী কেঁদে ওঠে। বাতাস কাঁপে। গাছের পাতা সাঁই সাঁই করে নড়ে ওঠে। ক্যামেরার লেন্সে ঝাপসা হয়ে যায় দৃশ্য।
তপন ধীরে ধীরে বলে — “তুমি যদি মুক্তি চাও, তাহলে এবার ক্ষমা করো তাকে। তোমার কষ্ট অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিও না। আমি কথা দিচ্ছি — আমি তোমার কাহিনি পৌঁছে দেব দুনিয়ার কাছে। তোমার গল্প কেউ জানবে, কেউ মনে রাখবে।”
মীনাক্ষীর চোখে জল। মুখটা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে ওঠে। হাওয়ায় তার চুল উড়ে যায়। তারপর সে বলে — “তুমি কথা দাও… তুমি আমার নাম ভুলবে না?”
তপন মাথা নাড়ে। “না। আমি লিখব। বলব। পৃথিবী জানবে — মীনাক্ষী দে ছিল, ভালোবাসত, ধোঁকা পেয়েছিল… আর ক্ষমা করেছিল।”
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসে হাওয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। মীনাক্ষীর মুখটা হাল্কা হাসিতে নরম হয়ে ওঠে। সে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় আলোয়। কুয়াশা ভাঙে, রাস্তাটা আবার দেখা যায় — শান্ত, ধুলোবালি-মাখা, কিন্তু আর অভিশপ্ত নয়।
নীলয় ক্যামেরা বন্ধ করে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে — “তুই এটা করলি… তুই তাকে মুক্ত করলি।”
তপন চুপ করে। হালকা চোখ ভেজা। সে জানে — আজকের রাত শুধু এক আত্মার মুক্তি নয়, তার নিজেরও। এতদিন নিজের ভুল, নিজের ব্যর্থতা, নিজের নির্জনতার মধ্যেই সে আটকে ছিল। আজ সে নিজেকে মাফ করতে পেরেছে।
তারা শহরের দিকে ফেরে। এবার আর কোনো ছায়া, কোনো হাততোলা মহিলা নয়। রাস্তা শুধু রাস্তা — অন্ধকার নয়, আত্মার ভারমুক্ত।
৫
তপন আর নীলয় ফিরে এসেছিল কলকাতায় এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে। যদিও মীনাক্ষীর আত্মা শান্তি পেয়েছে, তাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। তপন ঠিক করেছিল — সে এই কাহিনি লিখে প্রকাশ করবে, যেন মানুষ জানে সত্যিকারের ভালোবাসার বেদনা, আত্মত্যাগ আর ক্ষমার কথা।
তিন সপ্তাহ পর, কলকাতার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক “রাত্রিকাল” পত্রিকায় বেরোয় তপনের লেখা প্রবন্ধ — “বাসন্তী হাইওয়ের প্রেতাত্মা: এক অস্পষ্ট কাহিনির পরিসমাপ্তি।” লেখাটি রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। পাঠকেরা চমকে যায়, কেউ কেউ মীনাক্ষীর স্মৃতিচিহ্নে ফুল দিতে যায়, কেউ বা মন্তব্য করে — “এতদিনে একটা আত্মা মুক্তি পেল।”
তপন প্রতিদিন অসংখ্য মেল পেতে শুরু করে — কেউ ভূতের গল্প শোনাতে চায়, কেউ বা কৃতজ্ঞতা জানায়।
কিন্তু এক চিঠি তাকে থমকে দেয়। খামটা অদ্ভুত পরিচিত। ঠিক যেন সেই পুরনো খামের মতো, যার মাধ্যমে প্রথম চিঠিটা এসেছিল। এবারও চিঠির উপর নেই কোনো প্রেরকের নাম। ভিতরে ভাঁজ করা একটি ছোটো চিঠি:
“তুমি যাকে মুক্তি দিয়েছ, সে হয়তো এক রূপে স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু তুমি কি জানো, বাসন্তী হাইওয়েতে সে একা ছিল না?”
“আরো একজন অপেক্ষায় আছে — যে মীনাক্ষীর মত ভাগ্যবতী হতে পারেনি। সে এখনও আঁধারে বন্দী।”
তপনের কাঁপুনি ধরে। এইবার চিঠির নিচে একটি নাম লেখা — “অরিজিৎ”।
তপন বিশ্বাস করতে পারে না। অরিজিৎ? সেই বিশ্বাসঘাতক প্রেমিক? তাহলে কি সে মরেছে? নাকি এখনো বেঁচে, আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাস করছে?
সে চিঠিটা নিয়ে যায় নীলয়ের কাছে। নীলয় পত্র পড়ে, বলল — “তুই বলেছিলি, মীনাক্ষী চিঠি লিখেছিল। কিন্তু আমরা কি কখনো অরিজিৎ সম্পর্কে খোঁজ করেছিলাম? সে কই গেল?”
তপন মাথা নাড়ল, “আমরা শুধু ওর মৃত্যুর দিকেই নজর দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর জীবনের অন্য চরিত্রগুলো?”
নীলয় বলল — “তুই কি খুঁজে দেখবি অরিজিৎ কেমন করে হারিয়ে গেল?”
তপন সম্মত হল। দুজনে আবার অনুসন্ধানে নামে। তারা পুরনো ভোটার লিস্ট ঘাঁটে, মীনাক্ষীর ঠিকানায় যায় — পুরনো প্রতিবেশীদের খোঁজ করে।
তারা জানতে পারে — ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে অরিজিৎ বিশ্বাস হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পুলিশ তদন্ত করেও কিছু পায়নি। এমনকি কোনো দেহও মেলেনি। পরিবারের লোকেরা বলেছিল, “সেও নিশ্চয় পালিয়ে গেছে কোথাও…”
তপনের মনে সন্দেহ জাগে — “না, সে পালায়নি। সে কোথাও আটকে পড়েছিল… হয়তো মীনাক্ষীর মতোই।”
এবার তাদের খোঁজ নতুন মোড় নেয় — এবার শুধু এক প্রেতাত্মার নয়, বরং দুটি হারিয়ে যাওয়া প্রাণের কাহিনি ঘিরে।
তারা সিদ্ধান্ত নেয় — আবার বাসন্তী হাইওয়েতে যাবে, এবার সেই স্মৃতিফলকের আশেপাশে খুঁজবে নতুন কোনো চিহ্ন, নতুন কোনো ‘ভয়াবহ নীরবতা’।
চিঠিটা আবার পেছনে ঘুরিয়ে দেখে তপন। সেখানে হাল্কা করে আঁকা একটি পেন্সিল স্কেচ — এক গাছ, যার ডালে দড়ির মতো কিছু ঝুলছে। নিচে লেখা — “১৪তম মাইলস্টোন।”
তপন মুখ তুলে চায়। সে জানে, তাদের এই গল্প শেষ হয়নি। শুধু একটি আত্মা নয় — বাসন্তী হাইওয়ের রহস্য আরও গভীর, আরও ছায়াপাতানো।
৬
তপন ও নীলয় আবার বেরিয়ে পড়ে — এবার গন্তব্য সেই ১৪তম মাইলস্টোন। চিঠির পেছনের চিত্র অনুসারে, সেখানে থাকা এক গাছ হতে পারে তাদের পরবর্তী রহস্যের সূত্র।
বাসন্তী হাইওয়ের সেই নির্জন পথে তারা পৌঁছয় রাত প্রায় ১২টা নাগাদ। তারা খুঁজে খুঁজে পৌঁছে যায় ১৪ নম্বর মাইলস্টোনে। এক ধরণের হালকা হাওয়া বইছে, আশেপাশে ঘন ঝোপঝাড়, আর ঠিক রাস্তার ধারেই এক পুরনো, খুঁতখুঁতে গাছ — গায়ে অসংখ্য দাগ, খোঁচা খোঁচা ছাল, আর ডালে জড়ানো পুরনো, ছেঁড়া দড়ি।
তপনের বুকের মধ্যে অজানা কাঁপুনি। নীলয় ক্যামেরা অন করে বলে — “এটাই সেই গাছ। চিঠির ছবিতে যেমন ছিল।”
তারা গাছটা ঘুরে ঘুরে দেখে। হঠাৎ তপনের চোখে পড়ে — গাছের গায়ে খোদাই করে লেখা এক নাম: “অরিজিৎ বি.”
তপন কেঁপে ওঠে। “এই গাছেই কি আত্মহত্যা করেছিল অরিজিৎ?”
নীলয় নিচে আলো ফেললে দেখে গাছের গোড়ায় একটা কাঠের বাক্স, মাটির নিচ থেকে আধা বেরিয়ে আছে। তারা সেটাকে তুলে আনে। খুললে দেখা যায়, ভিতরে এক পুরনো ডায়েরি।
ডায়েরির পাতাগুলো হলদেটে, কিন্তু কিছু কিছু লেখা এখনো পড়া যায়।
“২৪ মার্চ, ১৯৭৪
আজ মীনাক্ষীর চিঠি পেলাম। সে জানতে পেরেছে সব কিছু। আমি জানি, তার চোখে আমি শুধু এক মিথ্যেবাদী। কিন্তু আমি পালাতে চেয়েছিলাম না। আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমার পরিবার, সমাজ… তারা কখনো মেনে নিত না।
আমি ঠিক করেছি, আমি তার কাছে ফিরব না। তার সামনে আর দাঁড়াবো না, কারণ আমি জানি, আমি তার চোখে পড়লেই সে ভেঙে পড়বে।
আমি নিজেকে শেষ করে দেব, যেন আমার অস্তিত্বই আর না থাকে। যেন আমার ভুলের দাগটা কেউ না দেখে। আমি জানি, মীনাক্ষী আমায় খুঁজবে… কিন্তু আমি চাই না সে আমাকে খুঁজে পাক। আমি চাই না, সে জানুক আমি কীভাবে শেষ হলাম।
তবে যদি কখনো কেউ এই লেখা পড়ে, জানবে — আমি ভালোবাসতাম। ভয় পেয়েছিলাম, তাই পালিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিকারের পাপ ছিল তাকে ফেলে যাওয়া। আমি আমার পাপের জন্য শাস্তি নিচ্ছি।”
তপন ডায়েরি বন্ধ করে। চোখের কোণে জল। নীলয় বলে — “ও মরেছিল অপরাধবোধে। আর মীনাক্ষী মরেছিল বিশ্বাসভঙ্গে। এ যেন ভালোবাসার দুই প্রান্তে দুই মৃত্যু।”
তারা গাছটার চারপাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তপন ডায়েরিটা এক পাশে রেখে বলে — “আমরা দুজনের গল্প জানলাম। এবার ওদের সম্মান জানানো উচিত।”
তারা গাছের গায়ে দুটো নতুন নামফলক পোঁতে — একটাতে লেখা “মীনাক্ষী দে (১৯৫১-১৯৭৪)” এবং অন্যটিতে “অরিজিৎ বিশ্বাস (১৯৫০-১৯৭৪)”, নীচে ছোটো করে লেখা — “তোমরা আলাদা মরেছিলে, একসাথে শান্তি পেও।”
ঠিক সেই মুহূর্তে, যেন বাতাস থেমে যায়। চারপাশে হালকা আলো — কুয়াশার মাঝে যেন দুটি ছায়ামূর্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, মুখে শান্ত হাসি। এক মুহূর্ত পরেই তারা মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
তপন আর নীলয় বুঝতে পারে — এবার সত্যিই শান্তি এসেছে। এ গল্পের এক অধ্যায় শেষ হল। কিন্তু…
ঠিক যাওয়ার আগে, তারা দেখে, গাছের নীচে পড়ে আছে আরেকটি চিঠি — সাদা খামে, মলিন অক্ষরে লেখা: “তপনের কাছে”।
তপন খাম খুলে চিঠি পড়ে:
“তুমি আমাদের কথা শুনেছো, বোঝার চেষ্টা করেছো। আমার আত্মার ভার তুমি বইছো, এখন সেই ভার আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। তোমার মধ্যে এক আলাদা শক্তি আছে — যারা শুনতে পায় না, দেখতে পায় না, তাদের জন্য তুমি পথ খুলে দাও।
এবার তুমি শোনো অন্যদেরও, খুঁজে বার করো হারানো আত্মাদের কথা।
— মীনাক্ষী”
তপন আর নীলয় গাড়িতে ওঠে। বাসন্তী হাইওয়ে আবার পিছনে পড়ে থাকে, কিন্তু এবার আর সেই ভূতের রাস্তা নয় — বরং স্মৃতির, প্রেমের, আর শান্তির সাক্ষ্য হয়ে রইল সেই পথ।
৭
তপন আবার নিজের টেবিলে বসে। এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কলকাতায় ফিরেছে, কিন্তু ভেতরের অনুভূতিগুলো এখনো রয়ে গেছে সেই বাসন্তী হাইওয়ের ধুলোতায় মোড়া। সে ডায়েরির পাতা উল্টায় — পুরনো কালি, নতুন ভাবনা। মীনাক্ষী আর অরিজিৎ যেন অদৃশ্যভাবে পাশে দাঁড়িয়ে।
নীলয় বলে, “তুই জানিস, এই গল্পটা শুধু ভূতের নয়। এটা আসলে মানুষের গল্প — ভুলের, ভালোবাসার, ভয়ের, মুক্তির। এটা সবার শোনার দরকার।”
তপন মাথা হেঁট করে হাসে। “তাই তো ভাবছি, এবার আমি এই সব আত্মার কথা লিখব — যাদের কণ্ঠ নেই, যাদের আর কেউ মনে রাখে না। আমি লিখব তাদের কথা।”
সেই দিন থেকেই শুরু হয় তপনের এক নতুন যাত্রা। সে পুরনো গ্রাম, ফেলে আসা রেলস্টেশন, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি — সব জায়গায় যায়, খোঁজে সেই প্রেতাত্মাদের গল্প, যারা এখনো অপেক্ষা করছে মুক্তির।
সে লেখে — “ছায়ার নিচে দাঁড়ানো মানুষটা”, “জলরঙে আঁকা চোখ”, “বেহালার শেষ সুর”… প্রতিটি গল্পে জীবনের কথা, মৃত্যুর কথা, আর মধ্যবর্তী সেই অনন্ত শূন্যতার কথা।
পাঠকেরা তাকে নাম দেয় — “ভূতের লেখক তপন সান্যাল।”
কিন্তু তপন জানে, সে শুধু লেখক নয়। সে এক “শ্রোতা” — মৃতদের কথার শ্রোতা।
এক সন্ধ্যায়, তার ঘরের দরজায় কড়া নড়ে।
একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে, হাতে একটা খাম।
তপন জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার?”
মহিলা বলেন, “আমার মেয়েটা চল্লিশ বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। সবাই বলে সে আত্মহত্যা করেছিল, কিন্তু আমি জানি, কিছু একটা লুকিয়ে আছে। আপনি কি শুনবেন আমার কথাটা?”
তপন চুপ করে থাকে। তারপর বলল — “বসুন। বলুন। আমি শুনছি।”
তারপর… কালি চলে নতুন পাতায়, শব্দ জেগে ওঠে, আর এক আত্মার ইতিহাস জন্ম নেয়।
এইভাবেই শেষ হয় “বাসন্তী হাইওয়ের ভূত” — একটি ভালোবাসা, একটি বিশ্বাসঘাতকতা, আর দু’টি আত্মার শান্তির যাত্রা।
কিন্তু শুরু হয় “ভবিষ্যতের লেখক তপনের” এক নিরবধি যাত্রা — যার পথে গল্পই আলো।
— সমাপ্ত —