মালবিকা সেনগুপ্ত
ঢাকার ধুলো-ধোঁয়া আর ট্র্যাফিকের চক্রব্যূহ পেরিয়ে যখন জয়িতা নামল মেঘনাঘাটের ছোট্ট ফেরিঘাটে, তখন সূর্য মাথার উপর একচিলতে আগুন হয়ে দাঁড়িয়ে। চারপাশে জনমানবশূন্য প্রান্তর, দুটো হেমন্তের কাক আর কয়েকটা শুকনো পাতার ঝটপট আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। ঠিক এইখানেই সে শুট করবে তার নতুন ট্র্যাভেল ভ্লগ: “Unfiltered Bengal”-এর এক বিশেষ পর্ব।
“মোবাইল ডেটা কাজ করছে না? নো টাওয়ার?” – ক্যামেরাম্যান শান্তু মাথা চুলকে বলল।
জয়িতা মাথা নাড়ল। ও জানত এই চর অঞ্চলে ঢুকলেই নেটওয়ার্ক ঘুমিয়ে যায়, মানুষের শব্দের চেয়ে নদীর শব্দ বেশি জোরালো হয়।
“চর বলরামপুর”, গুগল ম্যাপে মাত্র একটা বিন্দু। কিন্তু সেই বিন্দুর মধ্যে যেন সারা বিশ্ব আটকে আছে—বাঁশের ঘর, লালচে মাটি, ধু-ধু নদীর ধার আর অসংখ্য মুখ। এখানে মানুষজন সহজ, একটু ধীর, আর কথায় কথায় হাসে।
পাকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছাল একটি পুরনো স্কুলের সামনে। স্কুলের পেছনেই গেস্ট হাউস। স্কুলের বারান্দায় একটা কিশোরী বসে বাঁশের বাঁশিতে সুর তুলছে। তার গলাটা যেন নদীর জল—স্বচ্ছ, অথচ গভীর।
জয়িতা থেমে গেল।
“তুমি গান করছো?”
কিশোরী মুচকি হেসে বলল, “বাঁশি। কিন্তু গানও জানি।”
তার নাম রূপা। ক্লাস নাইনে পড়ে। সারাদিন গরু চরায়, সন্ধ্যাবেলা নদীর পাশে বসে গান গায়। তার স্বপ্ন—একদিন শহরে গিয়ে গান রেকর্ড করবে।
“তোমার বাবা-মা কি বলেন?”
“বলে—মেয়েমানুষ গান করে কী হবে? কিন্তু আমি তো গানের মধ্যেই নিজের সব খুঁজি।”
জয়িতা হেসে ফেলল। নিজের পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে গেল—যখন তারাও বলত, “ভিডিও করে কেরিয়ার হয় না।” এখন তার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা তিন লাখ। কিন্তু এই খ্যাতি তাকে ক্লান্ত করে, অচেনা করে তোলে।
সন্ধ্যায়, নদীর ধারে ক্যাম্পফায়ারের মতো করে সবাই বসেছিল। রূপা একটানা গাইছিল—
“নদীর বুকে জোছনার কাঁপন
তোমায় খুঁজি ভোরের ফাগুনে…”
তার গলায় শহুরে প্রশিক্ষণ নেই, কিন্তু আছে এক দুরন্ত সত্যতা, যা ক্যামেরা ধরতে পারে না। জয়িতা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল।
“রেকর্ড করব তোমার গানটা, পারমিশন দিলে। ইউটিউবে দেব।”
“আপনারা শহরের লোক, আমাদের গান শুনবে?”
“শুনবে, শুধু শুনবে না—ভালওবাসবে।”
পরদিন সকালবেলা শান্তু উঠেই বলল, “জয়িতা দি, আজ সকালটা অন্যরকম লাগছে না?”
সত্যিই। চর বলরামপুর যেন রাতে একটা জাদু ছড়িয়েছে। বাতাসটা আরও নরম, রোদের ছায়ায় পাখিদের ডাক গাঢ় হয়েছে।
তারা নদীর ধারে গেল আবার, আজকের ফুটেজ তুলবে বলে। হঠাৎই জয়িতা থমকে গেল—একজন বৃদ্ধা মাটির হাঁড়িতে জল ঢালছেন, তার ছায়া পড়েছে বালুচরে, এবং সেই ছায়ার মধ্যে যেন একরাশ ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
“তুমি কি জানো, এই চরটা নদীর পেটে ছিল এককালে?” বৃদ্ধা বললেন। “নদী যখন সরে যায়, তখন চর জন্মায়। আবার নদী ফিরে এলে চর হারিয়ে যায়।”
এ কথাটা জয়িতার মনের গভীরে বসে গেল। যেন তার নিজের জীবনটাই এমন এক চর—নিরাপদ, কিন্তু অস্থায়ী।
সন্ধ্যায় সে আবার রূপার কাছে গেল।
“তোমার গান শুধু গান না, একটা রিহাই।”
“তুমি তো এখানে কয়েক দিনের জন্য, তারপর তো চলে যাবে।”
“হয়তো আমি চলে যাব, কিন্তু তোমার গান আমার ভেতর থেকে যাবে।”
জয়িতা ওই রাতে নিজের চ্যানেলের সব ড্রাফট মুছে দিল। লিখল—
“আজ আমি শহরের কনটেন্ট ক্রিয়েটর নই। আমি একজন শ্রোতা, যে বালুচরের গান শুনেছে, আর নিজেকে খুঁজে পেয়েছে নদীর ঢেউয়ে।“
চর বলরামপুর তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে নিজের শিকড়ে—যেখানে মোবাইল নেই, কেবল গান, মাটি, আর নদী।
সকালের আলো নদীর জলে চকচক করছে। রাত্রির শিশির এখনো পাতার গায়ে ঝুলে আছে। চর বলরামপুরের সেই নির্লিপ্ত সৌন্দর্য যেন জয়িতার ভেতরটা আলতো করে টেনে নিচ্ছে—এক অজানা আবেশে।
গেস্ট হাউসের ছাতায় দাঁড়িয়ে সে দেখছিল ছোট ছোট গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা দৌড়ে স্কুলে যাচ্ছে। পায়ে জুতো নেই, ব্যাগ জোড়া পুরনো, কিন্তু মুখে খুশির ছটা। ওর একসময়ের দৌড়ঝাঁপের শহুরে দিনগুলোর সঙ্গে এই চিত্রের কোনও মিল নেই, কিন্তু কিছু একটা যেন গভীর আত্মীয়তা তৈরি করে নিচ্ছে।
“চা খাবেন?” গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার হারাধন মশাই এক কাপ ধোঁয়া ওঠা লাল চা বাড়িয়ে দিলেন।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“বলুন না ম্যাডাম,”
“রূপার গানের কথা বলছিলাম। ওকে আপনি কখনো গান শেখাতে বলেছিলেন?”
“সেই তো ছোট থেকে গাইছে। নদীর ধারে বসে বসে নিজেই শিখেছে। গলা যেমন তার, এমন গলা এই পাড়ায় কেউ পায়নি কোনোদিন।”
জয়িতার মনটা কেমন যেন হল। এত প্রতিভা, অথচ সুযোগের অভাব।
“শুনেছি, ওর পরিবার চায় না ও গান নিয়ে কিছু করুক?”
“এই গ্রামে গান মানেই মেলায় গিয়ে নাচা, গাইয়া। সেই দাগের বাইরে কেউ ভাবেই না। মেয়েমানুষ হয়ে গান গাওয়া মানেই চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে।”
জয়িতা জানে এমন বাস্তবতা। একদা তিনিও তো “মেয়েদের ভিডিও বানানো মানায় না” এই কথার গণ্ডি পেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু তবু শহরে থেকেও তার পথ মসৃণ ছিল না।
বিকেলে রূপাকে নিয়ে নদীর ধারে চলে গেল জয়িতা। আজ সে ক্যামেরা আনেনি।
“আজ ভিডিও করব না। শুধু শুনব। ঠিক আছে?”
রূপা লজ্জা পেয়ে বলল, “আপনি শুনবেন! আমি তো ঠিকমতো গান শিখিইনি…”
“তোমার গলায় আছে হৃদয়। সেটা শেখানো যায় না। গান করো রূপা, শুধু নিজের জন্য করো।”
রূপা আস্তে আস্তে গাইতে লাগল—
“পথের ধুলায় চিঠি লিখেছি,
তুমি যদি পড়ো, আমি থাকি বেঁচে…”
জয়িতার চোখ ভিজে এল। সেই গানে যেন কেবল চর বলরামপুর না, তার নিজের পুরোনো প্রেম, হারিয়ে যাওয়া দিন, মায়ের রান্নার ঘ্রাণ—সব মিশে গেছে।
“তুমি গান লিখো কখনো?”
“না, আমি তো শুধু শুনি আর মনে রাখি। জলের মতো। গানও আমার ভেতরে এমনিই আসে।”
“তবে একদিন লিখবে। আমি বিশ্বাস করি।”
সন্ধ্যায় ফেরার সময় রূপা বলল, “আপনি এলে খুব ভালো লাগে। আপনি শহরের মানুষ, কিন্তু চোখে আমাদের মতো সরলতা আছে।”
জয়িতা একটু থমকাল। এই সরল চোখ, সে শেষ কবে নিজের মুখে দেখেছে?
রাতে ক্যামেরাম্যান শান্তু বলল, “দি, কাল রওনা হব তো? তিনদিনের ফুটেজ তো কমপ্লিট।”
জয়িতা নিরুত্তর রইল। একটু পরে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি আরেকদিন থাকব।”
“কেন? ফুটেজ তো হয়ে গেছে।”
“ফুটেজ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমার ভিতরের অংশগুলো এখনো ধরতে পারিনি।”
শান্তু কিছু না বলে মাথা নেড়ে চলে গেল। জয়িতা আবার খাতার পাতা খুলল। লিখতে লাগল—
“এই চর আমাকে বলেছে থামতে। যেখানে সব ছোট, কিন্তু অনুভব বড়। যেখানে গান ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নয়, আত্মার স্পন্দন।“
রাতের আকাশে তখন অগণিত তারা। একটা ঘুমহীন মেঘ উড়ে যাচ্ছিল উত্তর দিকে। চর বলরামপুরে নিস্তব্ধতা, কিন্তু জয়িতার ভিতরে শব্দের ঢেউ।
সে জানে—এই চর হয়তো তার পরের ভিডিও সিরিজের নাম হবে, অথবা হয়তো জীবনের নতুন শুরু।
রাত গভীর হলে চর বলরামপুর এক আশ্চর্য নীরবতায় ঢেকে যায়। জয়িতা বিছানায় শুয়ে জানালার ফাঁক গলে দেখছিল দূরের নদীটা কেমন নিঃশব্দে স্রোত বইয়ে চলেছে। আর দূরে কোথাও যেন কারও গলার আওয়াজ ভেসে আসছে—অনিয়মিত, ধ্বনি-ছায়ায় ভরা, যেন দেহ-ভোলা কোনও বাউল পথ হারিয়ে গান গাইছে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই একরাশ পাখির ডাক, ধানের গন্ধে মিশে থাকা কুয়াশা, আর উঠোনে কাকের সঙ্গে খেলা করা ছোট একটা ছেলে।
গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে থাকা হারাধন মশাই বললেন, “আজ শনিবার, গ্রামে বাজার বসবে। ওখানে গেলে আরও ভালো ফুটেজ পেতে পারেন।”
জয়িতা বলল, “আজ ভিডিও করব না। শুধু দেখব।”
শান্তু অবাক, “আপনি ভিডিও না করে শুধু দেখবেন?”
“হুম। চোখ দিয়ে দেখার সময় যদি ক্যামেরার লেন্সের বাইরে যাই, তাহলে অনেক কিছু অনুভব করা যায়।”
বাজারে পৌঁছেই সে হারিয়ে গেল মানুষের মধ্যে। সবজি, মাছ, পাটের ব্যাগ, কাঁচা হলুদের গন্ধ, বাচ্চাদের কান্না, মহিলাদের ঝগড়া—সব মিলিয়ে একটা জীবন্ত কোলাজ।
হঠাৎ করেই সে চোখে পড়ল এক বয়স্ক লোক, খুপরি ঘরের সামনে বসে বাঁশের বাঁশি বানাচ্ছেন। তাঁর নাম রামু পাল। রূপার বান্ধবী বলেছিল এই রামু কাকাই প্রথম ওকে বাঁশি বাজাতে শিখিয়েছিল।
“আপনি বাঁশি বাজান?”
“আগে বাজাতাম, এখন শুধু বানাই। বাজানোর মতো ফুসফুস আর নেই।”
জয়িতা একটা বাঁশি হাতে নিল। হালকা, কিন্তু তার মধ্যে যেন ধরা আছে অজস্র বাতাস, নদীর গান, আর হারিয়ে যাওয়া কোনও ঋতুর আওয়াজ।
“এই বাঁশি তো রূপা’র মতো মানুষদের জন্য।”
“হ্যাঁ, ও যেন একদিন এই চর ছাড়িয়ে দূরে যায়।”
জয়িতা ভাবছিল—যদি সত্যিই রূপাকে সুযোগ দেওয়া যায়? একটা অডিও রেকর্ড করে ইউটিউবে দেয়া যায়? হয়তো কিছু হবে না, হয়তো একটা নতুন দরজা খুলে যাবে।
সন্ধ্যার দিকে সে রূপাকে বলল, “তুমি কি একটা গান গেয়ে রেকর্ড করবে?”
রূপা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আপনি আমার গান শহরে শোনাতে চান?”
“তোমার গানের মধ্যে যে নদীর গন্ধ, তা মানুষ ভুলে গেছে। আমি সেটাই ফিরিয়ে আনতে চাই।”
“আমার তো ভালো মাইক নেই, স্টুডিও নেই…”
“আমার আছে। কিন্তু তোমার সাহসটাই সবচেয়ে দরকার।”
রূপার চোখে জ্বলজ্বল করা আশ্চর্য আলো ফুটে উঠল।
পরের দিন তারা গেস্ট হাউসের ঘরে একটা অস্থায়ী সেট আপ করল। শান্তু সাউন্ড রেকর্ডার রাখল, ছোট একটা স্ট্যান্ড মাইক। রূপা একটা সাদা সালোয়ার পরে এল, চুল বেঁধেছে, চোখে আলতো কাজল।
সে গাইতে শুরু করল—
“আমার চোখে নদী বইছে,
তুমি যদি স্রোত হও…”
প্রথম দুই লাইনেই ঘরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ক্যামেরা ধরা পড়ল না, কিন্তু বাতাসে একটা ধ্রুপদি শিহরণ।
জয়িতা শুনছিল, শুধু প্রযোজক নয়, একজন শ্রোতা হয়ে। একটা সময়ে ওর নিজের প্রথম রেকর্ডিংয়ের দিন মনে পড়ছিল। কাঁপছিল, ভুল করছিল, আবার শুরু করছিল। আজ রূপার মধ্যে সেই পুরনো নিজেকে খুঁজে পেয়ে, যেন সেদিনের জয়িতার চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাসী একটা মেয়েকে দেখল সে।
রেকর্ডিং শেষ হতেই সে রূপার কাঁধে হাত রাখল, “তুমি তৈরি। আমি তোমার গান আপলোড করব।”
“তাহলে আমি শহরের মানুষের কানে পৌঁছাব?”
“না শুধু কানে না, হৃদয়ে।”
সেই রাতে ভিডিও এডিট করে ইউটিউবে দিল জয়িতা—
“Voice of the River: Rupa from Char Bolrampur”
ছবিতে রূপা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ডে শুধু বাঁশির সুর আর একটা সরল কণ্ঠের গান।
রাত তিনটায় জয়িতা ঘুমোতে গেল। তার মনে হচ্ছিল, প্রথমবারের জন্য কোনও কনটেন্ট বানিয়ে সে পরিপূর্ণতা অনুভব করছে, কারণ এটাতে শুধুই লাভ নেই, আছে ভালোবাসা।
আর সে বুঝল—এই বালুচরের দিনগুলোই আসলে তার জীবনের সবথেকে নির্জন অথচ গভীর অধ্যায় হয়ে উঠছে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দরজায় টোকা।
“দি… রূপার ভিডিওটা ভাইরাল হইছে।” — শান্তু প্রায় ছুটে এসেই বলল।
জয়িতা চোখ কচলাতে কচলাতে ফোনটা হাতে নিল।
৪৮,০০০+ ভিউ। ৬.২ কে লাইক। কমেন্টে কেউ লিখেছে —
“This voice touched my soul. Where can I find more songs from her?”
“Rupa is a gem. Please make more videos on such hidden talents.”
“Never knew Bengal’s chars held such magic.”
জয়িতার বুকটা কেমন করে উঠল। অবিশ্বাস, আনন্দ, আর একটা চাপা গর্ব—সব একসঙ্গে।
সে বেরিয়ে পড়ল, পা টেনে নয়, যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে গেল রূপাদের উঠোনে।
রূপা তখন কলসি নিয়ে জল তুলছে, তার চুলে গুঁজে রাখা একটা হলুদ ফুল, যা কোনও কিশোরী স্বপ্নের মতো নিষ্পাপ।
“রূপা, তোমার ভিডিওটা ভাইরাল!”
“ভাইরাল মানে?”
“মানে হাজার হাজার মানুষ তোমার গান শুনেছে। সবাই বলছে তারা আবেগে ভেসে গেছে। তোর গলা… এখন একটা সম্পদ।”
রূপা প্রথমে বোঝে না। তারপর জয়িতা ফোনটা এগিয়ে দেয়, কমেন্ট পড়ে শোনায়। মেয়েটার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
“ওরা আমাকে সত্যি শুনেছে?”
“শুধু শুনেনি, ভালোবেসেছে।”
একটা ছোট্ট ছেলের মতন সে লাফিয়ে উঠল, দুটো হাত একসঙ্গে ঠুকে বলল, “বলো, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?”
জয়িতা হাসে। এমন আনন্দ দেখলে ওর নিজেরও মনে হয়—দুনিয়া এখনও সুন্দর হতে পারে।
“আচ্ছা রূপা,” একটু থেমে জয়িতা বলে, “তুই কি চাইবি গান শিখতে, প্রপার ট্রেনিং পেতে?”
রূপা এক মুহূর্ত থেমে জিজ্ঞেস করল, “মানে শহরে যাব?”
“না, আমি একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারি, বা শহর থেকে কেউ যদি এসে শেখাতে চায়… তোর জন্য একটা নতুন পথ খুলে যেতে পারে।”
রূপার মুখ থেকে হাসিটা একটু থমকে গেল। সে বলল, “আমার বাবা কি রাজি হবেন?”
জয়িতা বুঝে, লড়াইটা এখন শুরু হচ্ছে।
সেদিন বিকেলে তারা রূপার বাবার সঙ্গে দেখা করল।
রূপার বাবা—উজ্বলচাঁদ, একজন মাঝি। পাঁজি দেখেই নৌকো নামান, কথায় কম, চোখে কঠিন শাসন।
“আপনি কি জানেন, আপনার মেয়ে এখন ইন্টারনেটে ভাইরাল? হাজার হাজার মানুষ তার গান শুনছে।”
উজ্বলচাঁদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর কড়া গলায় বলেন, “মেয়ে মানুষের এই সব গান-টান ভালো নয়। দোষ দেবে পাড়া।”
“কিন্তু যদি গানই ওর পথ হয়?”
“মেয়ে মানে ঘর সামলানো, বিয়ে, বাচ্চা। এত দূর ভাবার দরকার নেই।”
রূপা চুপচাপ বসে। মুখে কোনও অভিমান নেই, আছে একরকম শ্রদ্ধাভরা গ্লানি।
জয়িতা আস্তে বলল, “আপনার মেয়ের গলায় এমন কিছু আছে, যা শহরের নামজাদা গায়িকাদের মধ্যেও পাওয়া যায় না। আপনি চাইলে আমি নিজে গ্যারান্টি দেব—ও কোনওদিন অপমান করবে না পরিবারকে।”
উজ্বলচাঁদ ধোঁয়া ছাড়েন একটা বিড়ির। তারপর হঠাৎ বলেন, “এক শর্তে রাজি। গান সে শিখতে পারবে, কিন্তু চরের বাইরে যাবে না। এখানে থেকেই শিখতে হবে।”
জয়িতা মুখে হাসি ধরে রাখতে পারল না। “শর্ত মানা হলো। আমি ব্যবস্থা করব।”
রূপার চোখে জল। ও উঠে এসে জয়িতার হাত ধরে বলল, “আপনি না এলে, এই চর তো কখনো জানতেই পারত না আমার গলা আছে।”
সেই সন্ধ্যায় গেস্ট হাউসে ফিরে জয়িতা একটা ছোট স্টোরি আপলোড করল ইনস্টাগ্রামে—
“A riverbank. A girl. A voice like morning breeze. She didn’t ask for fame, but it found her anyway. #RupaOfTheRiver”
রাতের আকাশে আজ যেন আরও বেশি তারা। শান্তু বলল, “দি, তুমি অনেক কিছুর চেয়ে বড় একটা জিনিস করেছ—একটা জীবন বদলে দিয়েছ।”
জয়িতা ছাদে শুয়ে থাকল। চর বলরামপুরের বাতাস তার চুলে খেলে যাচ্ছিল। মোবাইল অফ করে, চোখ বন্ধ করে সে ভাবল, কী আশ্চর্য এই জায়গাটা—
যেখানে এসে শহরের মানুষ খুঁজে পায় নিজের হারিয়ে যাওয়া হৃদয়।
জয়িতা চর বলরামপুরে থাকার দিনটা বাড়িয়ে দিয়েছে আরও তিনদিন। অজান্তেই এই ‘অফলাইনে থাকা দিনগুলো’ তার জীবনের সবচেয়ে অনলাইন মুহূর্ত হয়ে উঠেছে—যেখানে সে নিজেকে সবচেয়ে সংযুক্ত, সবচেয়ে জীবন্ত অনুভব করছে।
সকালে উঠে সে নদীর ধারে হাঁটতে বেরোয়। হাওয়ার গায়ে থাকে ঘাসের ঘ্রাণ, কুয়াশার স্তরে স্তরে জমে থাকা গত রাতের স্মৃতি। আজ রূপা তাকে নিয়ে গেল পাশের গ্রামের এক মহিলার কাছে, যিনি লোকগানের এক অদ্ভুত ধারা চর্চা করেন—যেখানে গান গাওয়ার পাশাপাশি শরীরী অভিব্যক্তির একটা গভীর দার্শনিক মানে থাকে।
“এগুলো আমাদের ঠাকুমার শিখিয়ে যাওয়া গান,” বললেন বৃদ্ধা রজনী মেয়ে, “শরীর মানেই শুধু কাম না, শরীর দিয়েই ভগবানকে ধরা যায়, এটাই আমাদের বিশ্বাস।”
জয়িতা অবাক। কলকাতার আর্কাইভ ঘেঁটে, অসংখ্য বই পড়ে এতদিন যা সে কেবল তত্ত্ব হিসেবে জেনেছে, আজ চর বলরামপুরের মাটিতে সে তার স্পন্দন শুনছে।
সন্ধ্যেবেলায় সে বসে রূপার সঙ্গে আবার একটা নতুন গান রেকর্ড করল—এবারের গানটা ছিল এক পুরোনো ব্রতচারীর পদ, যেখানে নদী, প্রেম আর ত্যাগ একসঙ্গে জড়ানো।
“আমার দেহে গঙ্গা বহে
তুমি আসো না, আমি ডুবে যাই
সুরের স্রোতে ভেসে ভেসে
ভালোবাসা পাই না পাই…”
জয়িতার ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ল না কেবল গানের ছবি, বরং রূপার মুখের এক অলিখিত আত্মবিশ্বাস, আর নদীর পাড়ে বসে থাকা সেই দাদিমার চোখে ধরা পড়ল অভিজ্ঞান।
পরদিন সকালে, একটি ছোট ইনস্টাগ্রাম রিল বানিয়ে সে পোস্ট করল:
“When she sings, even the river listens. #CharChronicles #RupaOfTheRiver”
বেলা বাড়তেই মেইলে ঢুকল এক বিশেষ বার্তা—কলকাতার একটি নামী লোকগান রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে রূপার গানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা চায় রূপার গান নিয়ে একটি সংরক্ষণ প্রোজেক্ট করতে।
জয়িতা খুশির আতিশয্যে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেল রূপাদের বাড়িতে।
“রূপা! কলকাতা থেকে লোকেরা চায় তোমার গান সংরক্ষণ করতে। মানে, তোমার কণ্ঠের গান থাকবে লাইব্রেরিতে, ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীরা শুনবে। এটা কত বড় সুযোগ জানিস?”
রূপা যেন অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। “আমি… আমি তো শুধু নদীর ধারে বসে গাই…”
“তাই তো, কিন্তু ওই গানের মধ্যেই রয়েছে ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন—সব। তুই জানিস না, তুই কী বানাচ্ছিস প্রতিদিন।”
রূপা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “আপনি জানেন, জয়িতা দি, প্রথমদিকে আমার ভয় করত… আপনি ভিডিও করে নিয়ে যাবেন, আমায় ভুলে যাবেন।”
জয়িতা থেমে গেল। তারপর রূপার হাতটা ধরে বলল, “আমি তো নিজেকে ভুলতে বসেছিলাম, রূপা। তুই আমায় মনে করিয়ে দিয়েছিস আমি কেন এই কাজ শুরু করেছিলাম—কারণ, আমি চাইছিলাম এমন কিছু মানুষকে সামনে আনতে, যাদের সত্যিই শোনার দরকার ছিল। আমি তোর পাশে আছি, সবসময়।”
সেদিন রাতে গেস্ট হাউসের ছাদে বসে হারাধন মশাই এসে বললেন, “ম্যাডাম, আপনার মতো লোক কম আসে এখানে। অনেকে আসে, ছবি তোলে, চলে যায়। আপনি থাকেন। মন নিয়ে থাকেন।”
জয়িতা মৃদু হাসে। “আমি এখানে শুধু ভিডিও তুলতে আসিনি, নিজেকে খুঁজতেও এসেছিলাম।”
হারাধন মশাই বললেন, “আপনি হয়তো জানেন না, এই চরও তো এমনই—নদীর গর্ভে জন্ম নেয়, আবার কখনও নদী এসে সব ধুয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু যতদিন থাকে, ততদিন সে প্রাণ দেয় শত মানুষের জীবনকে।”
জয়িতার গলা খাঁ খাঁ করে উঠল। একটা দার্শনিক সত্য যেন তাকে স্পর্শ করে গেল—বালুচর শুধু মাটি নয়, সেটা একটা অবস্থান, একটা সময়, একটা স্মৃতি।
সেদিন রাতে, নিজের ইউটিউব কমিউনিটিতে সে একটা দীর্ঘ পোস্ট দিল—
*”Dear followers,
Today, I want to tell you about a place called Char Bolrampur. About a girl named Rupa. And about a voice that made me remember why I started this channel.
This isn’t just a vlog. It’s a journey.
A return.
To silence.
To sincerity.
To the soul.”*
তার পর দিন ছিল তার এই চরে থাকার শেষ দিন। শান্তু সকাল সকাল সব ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে। গাড়ি ঠিক সময়ে এসে দাঁড়াবে।
জয়িতা জানে, তার কাজ শেষ হয়নি। বরং এই শুরু। সে এখান থেকে শহরে ফিরে যাবে, কিন্তু চর বলরামপুর থেকে বেরোবে না।
সে রূপার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তুই আমার প্রথম কনটেন্ট না, তুই আমার প্রথম আত্মা-দেখা শিল্পী।”
রূপা ফিসফিস করে বলল, “আপনি আবার আসবেন তো?”
জয়িতা একটু থেমে বলল, “আমি তো আছিই। শুধু চরে নয়, প্রতিটি গানে, প্রতিটি সুরে, যেখানে তুই থাকবি—সেখানে আমিও থাকব।”
গাড়ির জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চর বলরামপুরের বাতাসে একটা পরিচিত সুর ভেসে এল।
রূপা আবার গাইছে—
“তুমি চলে যাও, নদী থেকে দূরে
আমি স্রোতের গল্পে তোমায় রই গেঁথে…”
আর জয়িতা জানে, সে একদিন ঠিক ফিরে আসবে—কারণ কিছু জায়গা থাকে, যেখান থেকে কেউ চাইলেও চিরতরে ফিরে আসতে পারে না।
দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। শহরে ফিরে এসে আবার সেই পুরনো রুটিনে ঢুকে পড়েছে জয়িতা—মেইল চেক, ব্র্যান্ড মিটিং, এডিটিং রুম, আর স্টুডিওর টাইট শিডিউল।
কিন্তু কিছু একটা বদলে গেছে।
সে আগের মতো ভিডিও বানাতে পারছে না। চমকপ্রদ ভ্রমণ, বিলাসবহুল হোটেল, চায়ের বাগান—সবই যেন ফাঁপা লাগছে। রূপার মুখ, চর বলরামপুরের নদীর ঢেউ, সেই গানের আওয়াজ যেন প্রতিনিয়ত ওর ভেতর থেকে ডাকছে।
একদিন রাতে সে ল্যাপটপ খুলে সেই প্রথম রেকর্ড করা রূপার গান চালাল।
“আমার চোখে নদী বইছে
তুমি যদি স্রোত হও…”
সেই সরল সুরে যেন তার ভিতরের ক্লান্তি, দৌড়, স্বার্থ সব গলে যেতে লাগল।
সে ঠিক করল, আজই আবার রূপার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
সকাল সকাল সে রূপাকে ফোন করল। রূপা একটু হেসে বলল, “আপনি আবার ফোন করলেন! আমি ভাবছিলাম, আপনি এত ব্যস্ত, ভুলে গেছেন হয়তো।”
“ভুলে যাবো?” জয়িতা হেসে বলল, “আমি প্রতিদিন তোকে মনে করি রূপা। তোদের গান, তোদের জীবনটাই আমার কাছে অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠেছে।”
রূপা ফিসফিস করে জানাল, “আমি দুটো নতুন গান বানিয়েছি। নিজের লেখা। আপনি এলে গাইব।”
জয়িতা থেমে গেল। সে জানত না, এত দ্রুত এমন বদল আসবে রূপার মধ্যে—নিজেই গান লেখা, নিজের কথায় সুর বসানো!
“তাহলে আমি আবার আসছি, রূপা।”
“এই সপ্তাহেই আসবেন?”
“হ্যাঁ, শুটিং করব না, কেবল তোর সঙ্গে থাকব। আবার চর-এর বাতাস নিতে চাই।”
ফোন রাখার পরই জয়িতা একটি ই-মেইল পাঠাল লোকগান রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে—
“Rupa has written her first original compositions. I want to bring her to the archive, but only if you allow her to remain rooted. No exploitation, only respect.”
তারা সম্মত হল। এমনকি বলল, তারা নিজে থেকে গবেষক পাঠাতে চায় চর বলরামপুরে। জয়িতা খুশি হল—তার কাজ শুধু একটি কনটেন্ট বানানো নয়, বরং একটিকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক যাত্রাপথ তৈরি করে দেওয়া।
সেদিন বিকেলে সে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি নতুন ভিডিও পোস্ট করল—
“Char Diaries: Beyond the Lens”
ভূমিকা হিসেবে সে বলল,
“এই ভিডিওতে কোনো স্পেশাল ইফেক্ট নেই, নেই ঝকঝকে ক্যামেরার কারসাজি। আছে শুধু স্মৃতি, গান আর মাটির গন্ধ।“
ভিডিওতে কোলাজ ছিল—রূপার প্রথম রেকর্ডিং, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু, বৃদ্ধার কথোপকথন, আর জয়িতার সেই হাসিমুখ যেদিন সে বলেছিল—
“আমি আর শহরের লোক নই, আমি চরের মানুষ হয়ে গেছি।“
কমেন্টে এক জন লিখেছে—
“For the first time, a travel video felt like coming home.”
আরেকজন লিখেছে—
“We don’t just need influencers. We need witnesses. Thank you for being one.”
সন্ধ্যায় ফোন এল একজন মিউজিক প্রোডিউসারের—কলকাতার এক নামজাদা লোকগান লেবেল থেকে।
“জয়িতা, রূপার গান নিয়ে একটা সম্পূর্ণ EP বানাতে চাই। আপনি যদি প্রজেক্টটা কিউরেট করেন, আমাদের প্রোডাকশন দেবে।”
জয়িতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “শুধু একটি শর্তে—রূপা নিজে থাকবে ফ্রন্টে, তার গান ওর কথাতেই থাকবে, আর রেকর্ডিং হবে চরে বসে, শহরে নয়।”
প্রোডিউসার একটু থমকে গিয়ে বললেন, “এতটা স্বতন্ত্র ভাবনা… কিন্তু হ্যাঁ, আপনি যেভাবে চান, করব।”
রাতটা ঘুম এল না জয়িতার। সে জানত, তার হাত দিয়ে কেবল একটা মেয়ে না, একটা চর্চা, একটা লোকসংস্কৃতি, একটা চর—এখন নতুন আলোয় আসছে।
সকালে ফের গাড়ির টিকিট কাটল। ফের যাওয়ার সময় সে নিজের রোদচশমাটা ব্যাগে রাখল, চুল খুলে রাখল—
এবার সে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে নয়, রূপার ‘আপনজন’ হয়ে ফিরবে চর বলরামপুরে।
চর বলরামপুরে পা দিয়েই জয়িতা বুঝে গেল, চারপাশ কিছুটা বদলেছে। একই নদী, একই বাতাস, কিন্তু কোথাও একটা হালকা উত্তেজনা, যেন চর জুড়ে কেউ ধীরে ধীরে চেনা মাটিকে ছাপিয়ে উঠছে। গেস্ট হাউসে পৌঁছে সে যখন সুটকেস খুলছিল, তখনই বাইরে থেকে রূপার ডাক ভেসে এল।
“জয়িতা দি! আপনি সত্যিই এলেন?”
জয়িতা দরজায় দাঁড়িয়েই জড়িয়ে ধরল রূপাকে। রূপা আগের চেয়ে অনেক বেশি খোলা, আত্মবিশ্বাসী—যেন চর আর কণ্ঠের মাঝখানে তৈরি হয়েছে এক নতুন সেতু।
“তুই নিজে গান লিখেছিস শুনেছি?”
রূপা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “হ্যাঁ… নদীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দুটো লাইন এসেছিল মনে। পরে ছন্দ বসিয়ে গাইবার মতো করে ফেললাম।”
সন্ধ্যাবেলা গেস্ট হাউসের উঠোনে ছোট্ট গোল হয়ে বসার আয়োজন হল। হারাধন মশাই, রূপার মা, দু-একজন পাড়া-প্রতিবেশী, আর জয়িতা। বাতাসে ধূপের গন্ধ। নদীর ওপারে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। রূপা উঠে দাঁড়াল।
তার গলায় কোনও মাইক নেই, কিন্তু চোখে একরাশ নিশ্চয়তা। সে শুরু করল নিজের লেখা গান—
“জল বলে আমায়, থামিস না মা
সুর যদি হারাস, দিশা ভুলিস না
চরের বুকে আমি দাঁড়িয়ে থাকি
তোর গানের ঢেউয়ে, জীবনের হাকি…”
জয়িতা স্তব্ধ। গানটা শুধুই গান নয়—একটা বিবৃতি, একটা চিৎকার, একটা আহ্বান। এমন গান শহরের চকমকে রেকর্ডিং স্টুডিওতে তৈরি হয় না। এটা নদীর বুকে জন্ম নেওয়া গান।
সবার মুখে বিস্ময়, কেউ কেউ নিচু গলায় বলছে, “এই মেয়েটার গলা যেন আগুন…”
গান শেষে রূপা একটু হেসে বলল, “আমি চাই, এই গানটাই ওদের রিসার্চ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হোক।”
জয়িতা মাথা নাড়ল। “পাঠাবো, অবশ্যই পাঠাবো। শুধু এটা নয়, আরও দশটা লিখবি, গাইবি, আমি থাকছি তোর পাশে।”
রাত্তিরে গেস্ট হাউসে বসে জয়িতা পেন খুলে একটা চিঠি লিখতে শুরু করল—নিজের শহুরে বন্ধুর নামে, যে সবসময় বলে তার ‘কনটেন্টে ইমোশন বেশি, প্রফেশনালিজম কম’।
“তুই যদি দেখতে, একটা গ্রামের মেয়ে কেমন করে নিজের কণ্ঠ খুঁজে পেয়েছে, তবে বুঝতি—এটাই আসল প্রফেশন। এই চর, এই গান, এরা কনটেন্ট না, এরা জীবন।“
সকালে রূপার বাবার সঙ্গে ফের দেখা করল সে।
উজ্বলচাঁদ মুখ গম্ভীর করে বললেন, “এই গান যদি ওর ভালো করে, তাহলে আমি আর আটকাব না। তবে চরের মানুষদের সম্মান যেন থাকে।”
জয়িতা মাথা নত করল, “আমি কথা দিচ্ছি, চর-এর নাম কখনও মুছে যাবে না।”
পরদিন কলকাতা থেকে এক গবেষক দম্পতি এলেন—দুর্গাদাস ও নীলিমা বসু। তাঁদের আগ্রহ—চর অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের মৌখিক লোকসংস্কৃতি কীভাবে তাদের জীবনে আত্মবিশ্বাসের বাতাবরণ গড়ে তোলে।
“রূপার গান শুনে আমরা অভিভূত,” নীলিমা বললেন, “আমরা চাচ্ছি সে একটি ওয়ার্কশপ-এ অংশ নিক—নতুন লেখকদের সঙ্গে কথা বলুক, নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করুক।”
রূপা প্রথমে সংকোচে পড়ে গেল।
“আমি তো কিছুই জানি না—শুধু নদীর ধারে বসে গাই…”
জয়িতা কাঁধে হাত রাখল, “তুই যা জানিস, তা বইয়ে লেখা নেই রূপা। তুই জানিস—একটা মেয়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যখন চারপাশে কেউ চায় না সে গান করুক। তুই জানিস—শব্দ কেমন করে আত্মা ছুঁয়ে যায়। সেটাই তোর শক্তি।”
ওয়ার্কশপের দিন ধার্য হল। ঠিক হল, রেকর্ডিং থাকবে, প্রশ্নোত্তর থাকবে, এমনকি রূপার নিজের লেখা একটি গান দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান।
সেদিন সন্ধ্যায় রূপা বলল, “আপনি তো আবার চলে যাবেন না?”
জয়িতা বলল, “তুই কোথাও গেলে আমি যাব। তুই এই চরের সুর, আমি তোর শ্রোতা। তুই হারালে আমি নিজেকেই হারাব।”
রূপা একটুখানি চুপ থেকে বলল, “তাহলে এই গানটা লিখলাম আপনার জন্য।”
সে গাইতে শুরু করল—
“তুমি ছিলে শুনতে
আমি হয়েছিলাম সুর
তুমি না এলে
আমি থাকতাম বন্ধ ঘর…”
চর বলরামপুরের বালির উপর দিয়ে হালকা হাওয়া বইছিল। আর জয়িতা বুঝতে পারল—এই চরের দিনগুলো কেবল কনটেন্ট নয়, কেবল প্রোজেক্ট নয়—এ তার জীবনের গান হয়ে উঠেছে।
ওয়ার্কশপের দিন সকাল থেকেই চর বলরামপুর যেন অন্যরকম এক উৎসবে মেতে উঠেছে। নদীর হাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত ছন্দ, পাড়ার বাচ্চারা নতুন জামা পরে ঘোরাঘুরি করছে, রূপার মা তুলসীতলায় ধূপ জ্বালাচ্ছেন আর হারাধন মশাই আঙিনা ঝাঁট দিচ্ছেন মন দিয়ে—যেন এ দিনটা শুধু একটা অনুষ্ঠান নয়, তাদের নিজের পরিবারের কোনও বিশেষ কেউ আজ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে।
গবেষক দম্পতি—দুর্গাদাস ও নীলিমা বসু মাটির উঠোনে চেয়ার পেতে বসেছেন। ক্যামেরাম্যান শান্তু প্রস্তুত। ছোট্ট একটা মাইক সেটআপ হয়েছে। সামনে রূপা, তার পরনে হালকা সাদা-গোলাপি সালোয়ার, চোখে কোল, গলায় নিজের বানানো এক মালা। কিন্তু তার চেয়েও উজ্জ্বল আজ তার চোখের দৃষ্টিটা—একটা চেনা চর এখন তার মঞ্চ হয়ে উঠেছে।
জয়িতা একটু দূরে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছে অপলক। তার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই প্রথম দিনের কথা—রূপা যখন বাঁশি বাজাচ্ছিল স্কুলের বারান্দায়। তখন সে জানত না, এই মেয়েটি একদিন কেবল এই চরের না, হাজার হাজার মানুষের মন জয় করবে।
ওয়ার্কশপ শুরু হলো।
দুর্গাদাস বললেন, “রূপা, তুমি কি আমাদের সেই প্রথম দিনের গল্পটা বলো? তোমার নিজের ভাষায়?”
রূপা একটু থেমে বলল, “আমি ছোট থেকেই গান ভালোবাসি। কিন্তু কেউ কখনও গুরুত্ব দেয়নি। সবাই বলত, ‘মেয়ে হয়ে গান গাইছিস কেন?’ আমি চুপ করে থাকতাম। কিন্তু আমার মনে হত, নদী শুনছে তো! তারপর একদিন জয়িতা দি এলেন। সে আমার গান শোনেন, বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাসেই আজ আমি এখানে।”
নীলিমা বসু বললেন, “তোমার লেখা গানগুলো তো একেবারে অভিজ্ঞতার গভীর থেকে আসে। তুমি কীভাবে লিখো?”
“আমি লিখি, যখন নদীর ধারে বসি। আমি ভাবি, নদী যদি কথা বলতে পারত, সে কী বলত? আমি সেই কথাগুলোই গানে লিখি।”
জয়িতার গলা বুজে আসে। এত সরলতায় এত প্রজ্ঞা, এত গভীরতায় এত উন্মুক্ততা—এসব কোনও স্কুল, কোনও কোর্স শেখাতে পারে না।
তখনই দুর্গাদাস বললেন, “তুমি এখন তোমার সেই গানটা গাও, যেটা তুমি জয়িতার জন্য লিখেছিলে।”
রূপা একটু হেসে বলল, “এই গানটা শুধুই গানের জন্য নয়। আমি যখন ভয় পেতাম, তখন জয়িতা দি আমায় সাহস দিতেন। সেই সাহসটাই এই গানে আছে।”
সে গাইতে শুরু করল—
“তুমি যখন পাশে থাকো
চর হয়ে ওঠে চেনা গান
নদীর ঢেউ হঠাৎ থামে
ভেসে আসে তোমার নাম…”
পেছনে শিশুদের মুখ হাসিতে ভরে উঠল। কেউ কেউ মোবাইল তুলে ভিডিও করছে। আর জয়িতার চোখ বেয়ে নেমে এল নীরব অশ্রু।
ওয়ার্কশপ শেষ হতেই দুর্গাদাস বললেন, “আমরা চাই রূপার গান সংরক্ষণ করতে। তার লেখা ও সুর নিয়ে একটা রিসার্চ প্রজেক্ট তৈরি হবে।”
রূপা লাজুকভাবে বলল, “আমি কি পারব?”
জয়িতা এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই তো সেই প্রথমদিনেই পারতিস। শুধু তখন তোকে বিশ্বাস করা লোক ছিল না। এখন আছে।”
সন্ধ্যাবেলায় জয়িতা আর রূপা নদীর পাড়ে হাঁটছে। সূর্য ডুবে গেছে, আকাশে একরাশ নরম কমলা আলো।
“রূপা, যদি তুই চাস, আমি তোকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চাই।”
“আপনি চাইলে আমি বলব, গাইব, সব করব। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কি রে?”
“এই গানের শুরুতে আপনার নাম থাকবে। কারণ আপনি না থাকলে, আমি কণ্ঠই খুঁজে পেতাম না।”
জয়িতা হেসে বলল, “ঠিক আছে, তবে তোর একটা শর্ত আমিও রাখব—তুই কখনও থামবি না। কোনও ভয় তোর কণ্ঠ না নেভাতে পারে।”
রূপা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি প্রতিদিন নদীর কাছে প্রতিজ্ঞা করি—গান হবে আমার পথ। আর আপনি থাকবেন আমার সঙ্গী।”
চরের বাতাস হালকা শিউরে উঠল। জয়িতা জানে, এই গান, এই চর, এই মানুষগুলো তার জীবনের সবচেয়ে সেরা গল্প।
এটা কনটেন্ট নয়। এটা আত্মার ঠিকানা।
চর বলরামপুরের শীতকালটা অন্যরকম। সকালে কুয়াশায় ঢেকে থাকে গোটা চর, যেন কোনো অদৃশ্য চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে এই ক্ষুদ্র গ্রাম্য জগতটাকে। কাঁথার নিচে লুকিয়ে থাকা শরীর যেমন উষ্ণ, তেমনই নদীর জলে ছুঁয়ে থাকা বাতাসও একটা ঘন আবেগ জড়িয়ে আনে।
আজ রূপার জীবনের একটা বড় দিন। গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধি দল আসছে তার গান ও চর্চা সংরক্ষণের জন্য। শুধু ভিডিও নয়, তারা চায় রূপার লেখা, গান শেখার পদ্ধতি, এমনকি তার নদীকে নিয়ে ভাবনাও ডকুমেন্টেড হোক। এটা একটা সম্পূর্ণ আর্কাইভ হবে—‘Voice of the Char’ নামে।
রূপা খুব ভয় পেয়েছিল শুরুতে। সে বলেছিল, “আমি তো কোনো লেখাপড়া জানি না, আমি শুধু গান গাই।”
জয়িতা বলেছিল, “তুই যা জানিস, সেটা বইয়ের পাতায় নেই। তুই যা বলিস, সেটা গবেষকরা খুঁজে বেড়ায়।”
সকালে জয়িতা নিজে রূপার চুল বেঁধে দিল, ওর গলায় একটা পাতার মালা পরিয়ে দিল। মাটি ছুঁয়ে বানানো সেই মালা যেন রূপার সমস্ত কাঁপুনি শুষে নিচ্ছিল।
দুপুরবেলা ছোট একটা খোলা প্যান্ডেল বানানো হয়েছে স্কুলের পাশে। চরের মানুষজন, আশেপাশের গ্রামের কয়েকজন শিক্ষক, এমনকি দুই-তিনজন সাংবাদিকও এসেছে। আজ রূপা শুধু চর বলরামপুরের না—সে এখন লোকগানের প্রতিনিধিত্বকারী একটি কণ্ঠ।
অনুষ্ঠান শুরু হলে গবেষক নীলিমা বসু বললেন, “রূপার কণ্ঠে কেবল সুর নেই, আছে সময়, সমাজ আর স্মৃতির গন্ধ। আমরা চাই তার প্রতিটি গান ভবিষ্যতের গানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছাক।”
তখন রূপা উঠে দাঁড়াল। কণ্ঠে না আছে রিহার্সালের ছাপ, না আছে সাজানো বুলি—তবু প্রতিটি বাক্য যেন গাঁথা কবিতায়।
“আমি গান গাই, কারণ আমার চারপাশে কথা বলার লোক খুব কম ছিল। আমি কথা বলতাম নদীর সঙ্গে, গরুর সঙ্গে, বাঁশির সঙ্গে। যখন জয়িতা দি এসেছিলেন, তখন প্রথম মনে হয়েছিল—আমার কণ্ঠে কেউ কান দিচ্ছে। সেই কানটাই আমার সাহস।”
তারপর সে গাইতে শুরু করল একেবারে নতুন লেখা একটা গান—
“চরের মাটি বুকে রেখেছি,
তুমি বলো, আমি কি গাই না?
হাওয়ার দিক বদলালেই কি
আমার সুর থেমে যায় না?”
সারা মাঠ নিস্তব্ধ। শুধু সেই কণ্ঠ, নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা হালকা ঢেউয়ের শব্দ, আর অদৃশ্য কোনো আর্শীবাদ।
অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা জয়িতার চারপাশে ঘিরে ধরল। কেউ বলল, “আপনি তো কনটেন্ট ক্রিয়েটর, হঠাৎ গবেষণার দিকে এলেন কেন?”
জয়িতা উত্তর দিল ধীরে—“আমি কনটেন্ট বানাই না এখন, আমি এখন গল্প বলি। রূপা আমার জীবনের গল্প। সে প্রমাণ করেছে প্রযুক্তির বাইরে থেকেও শিল্প তৈরি হয়, সংস্কৃতি টিকে থাকে।”
সাংবাদিক আরেকজন বলল, “আপনি কি ভবিষ্যতে এমন আরও প্রতিভা খুঁজবেন?”
“আমি খুঁজব না, বরং তাদের বলব—তোমরা নিজেরাই উঠে এসো। আর আমরা, যারা শহরে থাকি, তারা শিখব কিভাবে শুনতে হয়।”
সন্ধ্যার আগে রূপা এসে জয়িতার কোল ঘেঁষে বসে। সে বলে, “আপনি কি জানেন, আজ প্রথম মনে হচ্ছে আমি সত্যি কিছু হয়েছি?”
জয়িতা বলে, “তুই তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিলি, শুধু সেটা আজ সবাইকে বোঝাতে পারলি।”
রূপা চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আপনি না এলে এই চর এখনও শুধু জলের ধারে একটা চুপচাপ গ্রামই থাকত।”
“তুই ভুল বলছিস। তুই না থাকলে আমি কোনওদিন জানতেই পারতাম না, জীবন কতটা সুরে ভরা। তোকে পেয়ে আমি নিজেকে পেয়েছি।”
সেদিন রাতে গেস্ট হাউসের ছাদে বসে জয়িতা লিখল তার পরবর্তী ভিডিওর স্ক্রিপ্ট—
“We go to find stories. But sometimes, stories find us.
This is not a vlog.
This is not a feature.
This is a pilgrimage.
To a place where voice met silence and made music.”
চর বলরামপুর তখন নিঃশব্দ। কেবল দূরে রূপার গলা ভেসে আসছে—কোনো নতুন সুরের খসড়া হয়তো, অথবা কোনো চিরন্তন গান, যা নদী শোনে, আর জয়িতা অনুভব করে।
বিকেলের শেষ আলোটা চর বলরামপুরে এসে পৌঁছলে আর আলো নয়, যেন স্মৃতি হয়ে যায়। কুয়াশা মিশে যাওয়া রোদের ওই নরম ছায়াগুলোতে আজ জয়িতা নিজেকে একটু অন্যভাবে দেখছিল। এখানে আসার ঠিক এক মাস আগে, সে ছিল এক সফল ইউটিউবার, নানা ব্র্যান্ডের প্রোমোতে জড়ানো এক মুখ, একের পর এক ‘Engagement Strategy’-এর ভিতর নিজেকে হারিয়ে ফেলা এক পরিপাটি পরিচয়।
আজ সে কেবল এক শ্রোতা। এক সাক্ষী। এক পথরেখা—যার উপর দিয়ে রূপা হেঁটে যাচ্ছে নিজের পরিচয়ের দিকে।
সকালবেলা রূপার বাবা উজ্বলচাঁদ এসে বললেন, “ম্যাডাম, আমি ঠিক করেছি রূপার গান আমিও শিখব। ছোটবেলায় আমি গান গাইতাম, পরে ছেড়ে দিই।”
জয়িতা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আপনি যদি গান ধরেন, তাহলে চর বলরামপুরের এই নৈঃশব্দ্য গান হয়ে উঠবে।”
রূপা তখন উঠোনে ধান ঝাড়ছে। সে এখন শুধু কণ্ঠ নয়, সে এক আন্দোলন, এক নীরব প্রতিবাদ, এক সংস্কৃতির মুখ। সে গানের মধ্য দিয়ে বাঁচে, আর বাঁচিয়ে তোলে চারপাশের মানুষদের।
দুপুরে জয়িতা ওর সঙ্গে শেষবারের মতো নদীর পাড়ে গেল।
“আমি কাল ফিরব, রূপা।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আপনি ফিরবেন ঠিকই। কিন্তু আমি চাই, আপনি বারবার ফিরে আসুন। আমার গান যতদূরই যাক, এই চরে আপনি না থাকলে আমি পথ হারিয়ে ফেলব।”
“তুই নিজে তো এখন পথের দিশারি, রূপা। তুই আর কারও ছায়া নয়, তুই নিজের আলো।”
রূপা তখন পকেট থেকে একটা ছোট বাঁশি বের করল—পুরনো, কাঠের, হাতে বানানো।
“এই বাঁশিটা রামু কাকা দিয়েছিলেন ছোটবেলায়। আমি যেদিন প্রথম নদীর ধারে গান গেয়েছিলাম, ওই বাঁশির সুরে প্রথম আমার গলার ভেতরের ঢেউ জেগেছিল। এটা আমি আপনাকে দিতে চাই।”
জয়িতা বাঁশিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।
“এটা আমি রেখে দেব। কিন্তু আমি জানি, এর আসল সুর তুই, রূপা। আমি শুধু তোর এক চিরকালীন শ্রোতা।”
সন্ধ্যেবেলা গেস্ট হাউসে একটা ছোট বিদায় সভার আয়োজন হয়। স্কুলের শিক্ষকেরা, রূপার মা, বাবা, গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি—সবাই উপস্থিত।
জয়িতার জন্য তারা একটি হাতে বানানো পাটের ব্যাগ দিয়েছে, যার গায়ে লেখা—
“চর বলরামপুরে ফিরে এসো।”
জয়িতা সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল—
“এই চর আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে আমার হারানো প্রশ্নগুলো, আর তাদের উত্তর। শহরে আমরা অনেক কিছু পাই—নাম, টাকা, স্ট্যাটাস। কিন্তু আমরা হারিয়ে ফেলি সেই সত্যিকারের ‘শোনা’র ক্ষমতা। এখানে এসে আমি প্রথমবার শুনেছি—কোনও মানুষ কীভাবে গেয়ে ওঠে নিজের ইতিহাস। রূপার কণ্ঠ শুধু এই চরের নয়, এটা গোটা বাংলার, গোটা দেশের। আমি কৃতজ্ঞ।”
রূপার মা চোখ মুছছিলেন। কেউ একটা পেছন থেকে ফিসফিস করছিল, “এই মেয়েটা যদি না আসত, রূপা কোনোদিন উঠেই আসতে পারত না…”
জয়িতা সেটা শুনে মুখ নিচু করে বলল, “আমি আসিনি, বরং রূপাই আমায় ডেকে এনেছিল। আমি তো শুধু তার গল্পটা একটু রেকর্ড করে দিয়েছি।”
রাত্রে, ঘরে ফেরার ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়ার সময়, সে সেই বাঁশিটা বার করল। নিঃশব্দে ঠোঁটে ছুঁইয়ে একটা টান দিল। কোনও নিখুঁত সুর এল না, কোনও বিশেষ গানও না—তবু তার মনে হল, এই অক্ষরবিহীন সুরেই সে তার জীবনের সবচেয়ে সত্যি জিনিসটা ধরে ফেলেছে।
ভোরবেলা গাড়িতে ওঠার সময় রূপা এসে শেষবারের মতো বলল—
“আমি গাইব, জয়িতা দি। আমি লিখব, শিখব, আর সবাইকে শোনাব। কিন্তু আপনি ছাড়া এই গানগুলো একরকম ফাঁকা। আপনি সঙ্গে না থাকলে ভয় করব।”
জয়িতা ওর চোখে চোখ রাখল।
“তুই জানিস, তোকে দেখেই আমার ভিতরের সাহসটা জেগেছিল। তুই আমার গল্প, রূপা। আর সেই গল্প আমি বাঁচিয়ে রাখব যতদিন পারি।”
গাড়ি চলতে শুরু করল। চর বলরামপুর পেছনে পড়ে যেতে লাগল। বাঁশের ঘর, মাটির গন্ধ, রূপার গলা, হারাধনের চা, নদীর ঢেউ—সব কিছু যেন ধীরে ধীরে মিশে গেল রিয়ারভিউ মিররে।
তবু একটুও হারাল না। কারণ জয়িতার ভেতরে এখন একটা নদী বইছে—যার স্রোতে সে নিজেকে আবার চিনেছে।
কলকাতায় ফিরে সে চ্যানেলের নাম বদলে ফেলল।
“Unfiltered Bengal” নয়, এখন চ্যানেলের নাম: “Voice of the Earth”
প্রথম ভিডিওর শুরুতেই লেখা—
“This story began in a forgotten char and became a memory that will never fade.”
ভিডিওর শেষে দেখা যায়—
রূপা গাইছে তার নতুন গান—
“আমি গাই, কারণ আমি আছি
তুমি শুনলে, আমি বাঁচি
এই চর, এই জল, এই সুর
আমার পৃথিবীর ঠিকানা…”
শেষ




