বোধিসত্ত্ব চক্রবর্তী
(১)
কলকাতার নারকেলডাঙার থানায় সদ্য বদলি হয়ে আসা অফিসার অরিত্র বসু জানতেন না, এই বদলি তার জীবনের সব যুক্তি-পরম্পরাকে ভেঙে দেবে। সেই সময় বর্ষা শেষের দিন, আকাশে ছাইরঙা মেঘের স্তর ঝুলছে। সকালবেলা থানায় বসেই অরিত্রর হাতে এসে পড়ে এক বিশেষ চিঠি—দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ‘ছায়ামাটি’তে পরপর তিন বছর একদিনে আগুন লেগে গেছে, গ্রামের একাংশ ছাই হয়ে গেছে, এবং আজও কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। চিঠির নিচে স্বাক্ষর করেছেন ডি.এস.পি. গগন সরকার—অরিত্রকে বলা হয়েছে, ঘটনাটি তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। অরিত্র প্রথমে ভাবলেন, এ তো ফায়ার ব্রিগেডের ব্যাপার, পুলিশের কী? কিন্তু পড়তে পড়তে চোখ আটকে গেল চিঠির এক লাইনে—“গ্রামবাসীরা দাবি করছেন, এ এক তান্ত্রিক অভিশাপ; প্রতি বছর একজন মানুষ বলি না দিলে এই আগুন আসে।” এই বাক্যটি যেন মাথায় বজ্রপাতের মতো পড়ল। আধুনিক কলকাতায় দাঁড়িয়ে এমন কুসংস্কার কীভাবে এখনও সম্ভব? অরিত্রর যুক্তিবাদী মন এমন দাবিকে মনে করল আদিম ভয় আর অজ্ঞানতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি তখনও জানতেন না, এই ‘অভিশাপ’-এর গা ছমছমে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন এক সত্য, যা শুধুই তান্ত্রিক নয়—বরং ভয়ানক বাস্তব।
দুদিন পর, সরকারী জিপে করে অরিত্র রওনা হলেন ছায়ামাটি গ্রামের দিকে। রাস্তা ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল—চওড়া পিচ রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা মাটির পথ, ছোট ছোট পুকুরের ধার, বাঁশবনের ছায়া, আর মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গাড়ির পাশে বসে থাকা রঘু মাঝি—যাকে অস্থায়ী গাইড হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে—চুপচাপ বসে আছে, চোখে একরকম আতঙ্ক। অরিত্র প্রশ্ন করলেন, “এই আগুন কি আপনি নিজে কখনও দেখেছেন?” রঘু থমকে গেল, তারপর আস্তে বলল, “দেখেছি বাবু, নিজের চোখে। গত বছর সন্ধ্যেবেলায় মাঠে গরু চরাতে গেছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা ঘরের ছাদে আগুন—বাতাস ছিল না, বিদ্যুৎও না, কেউ জ্বালিয়েওনি। আগুনটা যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল!” অরিত্র এসব কল্পকাহিনি ভেবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু লক্ষ্য করলেন—রঘুর হাত কাঁপছে। ছায়ামাটি পৌঁছে যখন তাঁরা গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন, পল্লবী চক্রবর্তী তখন মাটির চৌকাঠে বসে একদল বাচ্চাকে পড়াচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে বোঝা গেল তিনি এখানে নতুন, কিন্তু দৃঢ়চেতা। অরিত্রর সঙ্গে পরিচয় হতেই তিনি বললেন, “এই গ্রামে যুক্তি খুঁজতে এসেছেন? তাহলে বুঝে নিন, এখানে যুক্তি নয়—ভয় কাজ করে।” সেই প্রথমবার অরিত্র অনুভব করলেন, এই তদন্তটা হয়তো শুধু দুষ্কৃতিদের খোঁজ নয়—এ এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের বাতাস পাল্টে গেল। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন প্রকৃতি নিজেই নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। অরিত্র গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, কিন্তু কেউ ঠিক করে চোখে চোখ রাখল না। সবাই একই কথা বলছে—“আগুন দেবতা রাগ করলে কেউ বাঁচে না। বামাচরণের অভিশাপ আজও জীবিত।” কে এই বামাচরণ? জানা গেল, প্রাচীন কালের এক তান্ত্রিক, যিনি আগুনের পূজা করতেন, আর মানুষের বলি দিয়ে শক্তি আহরণ করতেন। গ্রামের মাটির নিচে নাকি এখনও তাঁর কুণ্ড পড়ে আছে, যেখানে বলির রক্ত গেলে আগুন নিভে যায়। এক বৃদ্ধা মহিলা বললেন, “শুধু আগুন না বাবু, ওই রাতে কুকুর ডাকে না, পাখি ওড়ে না, বাতাস থেমে থাকে।” সেই রাতে অরিত্র ঘুমোতে পারলেন না। তিনি জানতেন, সবকিছুর ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু খাতায় কলমে ব্যাখ্যা থাকলেও, এই রাতের নিস্তব্ধতা যেন তাঁর বুকের ওপর চেপে বসেছে। একসময় দূরে শোনা গেল বীণার মতো এক অদ্ভুত ধ্বনি—আসছে গিরিজা ঠাকুরের বাড়ি থেকে। সেই প্রাচীন, কাঠে খোদাই করা দরজার ওপারে এক কন্ঠস্বর বলে উঠল, “আপনি যদি অভিশাপ ভাঙতে চান, তাহলে বলির রক্তে হাত ভিজিয়ে তবে আসুন।” অরিত্র বুঝে গেলেন—এই লড়াই কেবল যুক্তির নয়, এটা সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন ভয় আর সত্যের সংঘর্ষ।
(২)
পরদিন সকাল। গ্রামের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, কিন্তু ছায়ামাটির বাতাসে কিছু একটা যেন বদলে গেছে। অরিত্রর ঘুম ভেঙেছিল খুব ভোরে, কারণ তার কানে এসেছিল ঘোড়ার খুরের শব্দ, অথচ বাইরে বেরিয়ে দেখেন—কোনো ঘোড়া নেই, কেবল শুঁয়োপোকার মতো গড়িয়ে চলেছে কুয়াশা। তিনি চা খেতে খেতেই খেয়াল করলেন, পল্লবী রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে তর্ক করছেন। একজন পরনে গামছা, হাতে একটা লাল কাপড় বাঁধা থলে, চোখেমুখে উত্তেজনার ছাপ। অরিত্র এগিয়ে গিয়ে শুনলেন—লোকটা বলছে, “এবার ওকেই বলি দিতে হবে! অভিশাপ রুখতে হলে বলির রক্ত দরকার, এই নিয়ম।” পল্লবী ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “তোদের নিয়ম মানে খুনকে বৈধতা দেওয়া? বিজলী একটা বাচ্চা মেয়ে, আর তাকে মারার কথা ভাবছো?” অরিত্র তখনই বিষয়টি বুঝলেন—বিজলী, যার বয়স কেবল ১৪, তাকে এবার বলির পাত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
অরিত্র থামালেন লোকটিকে, নাম জানা গেল—ধনঞ্জয় মণ্ডল, গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য এবং গিরিজা ঠাকুরের অনুগামী। অরিত্র তাকে বললেন, “এই দেশে আইনের বাইরে কেউ রায় দিতে পারে না। কোনো শিশু হত্যা বরদাস্ত করা হবে না।” ধনঞ্জয় কটমট করে তাকিয়ে বলল, “বাবু, আইন তো আগুন থামাতে পারে না। এই গ্রামের বুক জ্বলবে আবার, যদি নিয়ম না মানেন।” সে চলে যেতেই পল্লবী ফিসফিস করে বললেন, “এই গ্রামে ক্ষমতা চলে গিরিজার হাতে। সে যা বলে, তাই আইন। আর এই ‘বলি’ প্রথা আজও টিকে আছে শুধুমাত্র ভয়ের জোরে।” কথাটা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে রঘু মাঝি আস্তে বলল, “এই ভয় কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি বাবু। ১২ বছর আগে আমার ছেলেটা হারিয়ে গেছিল। পরদিন সকালে পাওয়া গেছিল পুড়ে যাওয়া একটা কঙ্কাল। কেউ কিছু বলেনি, সবাই চুপ করে নিয়েছিল, যেন কিছু হয়নি।” অরিত্র স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বিষয়টা শুধুই কুসংস্কার নয়, এখানে বাস্তব মানুষ মারা গেছে, হয়তো এখনও মরবে—যদি সময়মতো কিছু না করা হয়।
সন্ধেবেলা, অরিত্র গিয়ে হাজির হলেন গিরিজা ঠাকুরের পুরনো, মাটির বাড়িতে। গায়ে মেখে থাকা ধূপের গন্ধ, রক্তলাল আলোয় আলোড়িত এক অন্ধকার ঘর। বৃদ্ধ গিরিজা তখন বসে, চোখ বন্ধ, তার সামনে রাখা একটি আগুন জ্বালানো তামার পাত্র। অরিত্র বললেন, “আমি জানতে এসেছি, আপনি কেন বলির কথা বলছেন? আজকের যুগে একজন শিশুকে বলি দেওয়া—এটা কী ধরনের ধর্ম?” গিরিজা চোখ খুললেন, এবং হঠাৎ সেই চোখদুটো যেন আগুনে জ্বলে উঠল। তিনি বললেন, “আপনি পুলিশ, আইন জানেন। কিন্তু এই মাটি আইন মানে না বাবু। এই মাটিতে এক পা রাখার আগেই আপনার পায়ের তলায় চলে এসেছে বামাচরণের অভিশাপ। সে অভিশাপের ভাষা রক্ত। সে রক্ত না পেলে মাটি জ্বলে, আগুন খায় মানুষ, ঘর, ফসল।” অরিত্র বললেন, “এই গল্প বানিয়ে গ্রামের মানুষকে ভয় দেখানো হচ্ছে।” গিরিজা ধীরে বললেন, “গল্প না হলে প্রতি বছর একই দিনে আগুন লাগে কেন? কোথা থেকে আগুন আসে, বলেন?” অরিত্র কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ঘরের বাইরের দিক থেকে ছুটে এলো এক শিশু—চিৎকার করে বলল, “মাঠের দিকের ঘরটায় আগুন লেগেছে!”
অরিত্র দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখলেন, সত্যিই মাঠের কিনারার একটি কুঁড়েঘর আগুনে জ্বলছে। কিন্তু আশ্চর্য, কেউ কোনো আগুনের উৎস দেখতে পাচ্ছে না—না বৈদ্যুতিক তার, না জ্বালানো মশাল, না রান্নার আগুন। আগুন যেন মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে। অরিত্র নিজে জল এনে নিভাতে গেলেন, আর ঠিক তখনই গ্রামের এক বৃদ্ধা পেছন থেকে বলে উঠলেন, “এবার না বলি হয়, আগুন থামবে না বাবু। এই আগুন মরবে না।” আগুনটা শেষমেশ নেভে, কিন্তু রেখে যায় এক ভয়ঙ্কর ছাপ—গ্রামের মানুষ আরও এক ধাপ কাছে চলে আসে বলির রক্তের দিকে। অরিত্র বুঝলেন, এবার তাঁকে কেবল একজন পুলিশ নয়, একজন মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে সেই ভয়ঙ্কর ‘রক্তের ছায়া’র সামনে। সে রাতে, বিজলী লুকিয়ে আসে পল্লবীর ঘরে—তার চোখে কান্না, গলায় ফিসফিস শব্দ, “আপারা, আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচান।” অরিত্র সিদ্ধান্ত নেন—এই অভিশাপ ভাঙার সময় এসেছে, এবং তার শুরু হবে ইতিহাস খুঁড়ে—বামাচরণের আসল পরিচয় আর এক শতাব্দী পুরোনো অগ্নিতন্ত্রের অভিশপ্ত সূত্র থেকে।
(৩)
পরদিন সকালেই অরিত্র বসু ঠিক করলেন, আর অপেক্ষা নয়। যতক্ষণ না প্রমাণ মেলে, ততক্ষণ “অভিশাপ” কথাটা কেবল একটা অজুহাত। কিন্তু তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন—গতরাতের আগুন স্বাভাবিক ছিল না। আশপাশে কোনো আগুনের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত কুঁড়েঘরের মালিক বলেছিল, সে তখন বাইরে ছিল, ভেতরে রান্নাও হয়নি। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়—ঘরটা জ্বলে গেলেও পাশের ঝুপড়িগুলো একটাও ছোঁয়া হয়নি আগুনে, যেন আগুন বেছে বেছে ওই জায়গাটাকেই পুড়িয়েছে। কিছু একটা যে লুকিয়ে আছে, সেটা নিশ্চিত। এই রহস্যের সূত্র খুঁজতে তিনি রঘু মাঝির সঙ্গে গ্রামের পুরনো শ্মশানঘাটে গেলেন। এই শ্মশানঘাটটাকে গ্রামবাসীরা বলে “বামাচরণের মহাশ্মশান”—কারণ এখানেই নাকি তাঁর অগ্নি-তন্ত্রের সমস্ত চর্চা হতো, এবং এখানেই পঞ্চমুখী আগুন জ্বালিয়ে তিনি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
শ্মশানঘাটে পৌঁছে অরিত্রর নজরে পড়ল এক পুরনো, শ্যাওলা ধরা শিলালিপি, কাঁকর পাথরে খোদাই করা। উপরের দিকে কিছু অক্ষর প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু নিচের দিকে এক সারি লেখা এখনো স্পষ্ট:
“যে আগুনে বলি নেই, সে আগুন ফিরে এসে গ্রাস করে উৎসর্গকারীকে।”
অরিত্র আঁচ করলেন—এই বার্তাটা শুধু তন্ত্রের ভাষা নয়, একধরনের হুমকি। শিলালিপির পাশে একটি মাটির স্তম্ভ ছিল, যার তলায় জড়ো হয়ে ছিল মাটি খুঁড়ে ওঠা ইট। রঘু বলল, “এইখানে নাকি একটা সুড়ঙ্গ ছিল বাবু, বহু বছর আগে। তখনো আমরা ছেলেমানুষ। কিন্তু একদিন এক রাত্তিরে গিরিজা ঠাকুর আর কয়েকজন মানুষ এই জায়গা ঘিরে কিছু করছিল। তারপর থেকে আর কেউ কাছে যায় না।” অরিত্রর সন্দেহ বেড়ে গেল। হয়তো গ্রামের ভয় আর অভিশাপের গল্পের আড়ালে এখানে চলে আসছে কোনো গোপন কর্মকাণ্ড, যার মাধ্যমেই এই আগুন ঘটানো হচ্ছে। তিনি ইটগুলো সরাতে শুরু করলেন, রঘু তাকে সাহায্য করল। কিছুক্ষণ পরেই তাঁরা খুঁজে পেলেন একটি লোহার দরজা, প্রায় মাটির সমান। সেই দরজার ওপর একটা চিহ্ন খোদাই করা—পাঁচটি আগুনের জিহ্বার মতো প্রতীক, ঠিক তন্ত্রসাধকদের “পঞ্চতত্ত্ব আগ্নিচক্র”র প্রতীক।
অরিত্র তখন পল্লবীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসতেই চমকে গিয়ে বললেন, “এই প্রতীকটা আমি একটা পুরনো তাম্রলিপিতে দেখেছি। আমার NGO অফিসে একটা লোক স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে কিছু কাগজ দিয়েছিল। ওখানে বলা আছে, এই অঞ্চলে একসময় একটি ‘অগ্নি-পীঠ’ ছিল—যেখানে মানুষ বলির মাধ্যমে আগুনের দেবতাকে তুষ্ট করত। ওই চক্রই ছিল তাদের প্রতীক।” অরিত্র বুঝতে পারলেন, এ কেবল একটি নিছক ভয় বা গুজব নয়—এর পেছনে আছে একটি পুরনো, সুপরিকল্পিত রীতি, যার ভিত্তি তন্ত্র এবং নিয়ন্ত্রণ। দরজাটা খোলার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু তালা জংধরা, প্রায় ভেঙে গেছে। রঘু বলল, “আমি লোহার মিস্ত্রি ডেকে আনতে পারি বাবু।” অরিত্র বললেন, “না, সেটা নয়। এতে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের এখন জানতে হবে—এই দরজার ওপারে কী?”
সন্ধ্যে নেমে এলে, পল্লবী তাঁর অফিস থেকে তাম্রলিপির ছায়াপ্রতিলিপি নিয়ে এলেন। অরিত্র সেই পুরনো সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলা ভাষায় লেখা পংক্তি গুলো পড়লেন—
“বামায় চরণং যঃ দত্তে অগ্নিঃ তেন পূজিতা।
রক্তবিন্দু বিনা স্থিরো ন স্যাৎ, পীঠং জ্বালয়তি।”
(যে বামাচরণের চরণে অর্ঘ্য দেয়, তাকে আগুন দেবতা তুষ্ট করেন।
রক্ত বিনা সে স্থির নয়—পীঠ নিজেই জ্বলে ওঠে।)
এই শিলালিপি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এখানে এক সময় এক ভয়াবহ বলির প্রথা ছিল। আর সেই প্রথার কথা বলা হচ্ছে এখনো, কারণ কেউ সেটা জিইয়ে রেখেছে—হয় গিরিজা ঠাকুর, নয় তো তার অনুগামীরা। দরজাটা একবার খুললেই হয়তো দেখা যাবে কীভাবে এই আগুন ছড়ানো হয়—গোপনে। হয়তো দরজার নিচে আছে তেলের লাইন, গ্যাস চেম্বার, এমন কিছু যা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করা হয়েছে “অভিশাপ”-কে বাস্তব বলে প্রমাণ করার জন্য।
রাতে অরিত্র ঠিক করলেন, আগুনের দরজা খুলতে হবে, কিন্তু দিনের আলোয় নয়—রাতে। কারণ, যারা এই ভয় সৃষ্টি করছে, তারাও রাতেই কাজ করে। দরজা খোলার আগে অরিত্র যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন আবার সেই অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলেন—ঘোড়ার খুরের টুপটাপ আওয়াজ, অথচ চারপাশে কোথাও কোনো ঘোড়া নেই। পল্লবী হঠাৎ থমকে গিয়ে বললেন, “আপনি শুনছেন?” অরিত্র মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। এটা দ্বিতীয়বার।” পল্লবী ধীরে বললেন, “এই আওয়াজটা নাকি শোনা যায় ঠিক বলির আগের রাতে। সে রাত নাকি নিজেই হাঁটতে থাকে…”
(৪)
রাত ঘনিয়ে এসেছে। ছায়ামাটির আকাশে চাঁদ লুকিয়ে পড়েছে মেঘের পেছনে, আর চারপাশে এমন নিস্তব্ধতা যে নিজের নিশ্বাসের শব্দও যেন কানে বাজে। অরিত্র বসু, পল্লবী, এবং রঘু মাঝি এক পুরনো টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মাটির লোহার দরজার সামনে, যেটি তারা সকালে খুঁজে পেয়েছিলেন। পল্লবী নিজের হাতে একটি তামার তাবিজ পরে এসেছে—পুরো ব্যাপারটা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলেও সে জানে, এই রাতে সাহসের পাশাপাশি দরকার কিছু বিশ্বাস, কিংবা আত্মরক্ষা। রঘু একটা পুরনো লোহার রড দিয়ে তালা ভাঙার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একসময় ভাঙা তালাটা একটা ধাতব শব্দে খুলে পড়ল। লোহার দরজাটা দারুণ ভারী, কিন্তু অরিত্র এবং রঘু মিলে ধাক্কা দিতে দিতে সেটা কিছুটা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে উঠে এল একধরনের গন্ধ—পুরনো ধূপ, মরা পশুর গন্ধ আর যেন কিছু পোড়া রক্তের ধোঁয়া। যেন শতাব্দীর জমে থাকা অভিশাপ এখন ধীরে ধীরে বাইরে বেরোচ্ছে।
তারা নিচে নামলেন সরু সিঁড়ি বেয়ে, যার গায়ে খোদাই করা কিছু অদ্ভুত প্রতীক—তন্ত্রমতে পঞ্চতত্ত্বের চিহ্ন, রক্তমাখা আগ্নিযন্ত্রের রেখাচিত্র, আর বামাচরণের কুণ্ডলাকৃতি নামচিহ্ন। এই সিঁড়ি শেষ হয় এক গোলাকার গুহায়, যেটির মাঝখানে রয়েছে একটা মাটির চৌবাচ্চা। তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে কয়লার মতো পোড়া কাঁচ, হাড়গোড়ের মতো জিনিস, আর পুরনো তামার থালা। ঘরের দেয়ালে একদিকে আঁকা রয়েছে এক বিরাট চিত্র—এক নগ্ন সাধু, যার চারপাশে আগুন জ্বলছে, মাথার চারপাশে পাঁচটি রক্তরেখা। পল্লবী আঁতকে উঠল, “এইটা বামাচরণেরই প্রতীক। আমি পুরনো তাম্রলিপিতে এই রূপটাই পড়েছিলাম।” অরিত্র চারপাশ খুঁজতে লাগলেন—কোনো প্রমাণ আছে কি না যে কেউ এখনো এই ঘর ব্যবহার করে? ঠিক তখনই তাঁর চোখে পড়ল এক কোণায় আধুনিক প্লাস্টিকের তেলের বোতল, পাশে একটা ছোট ড্রাম। তিনি এগিয়ে গিয়ে খোলার চেষ্টা করলেন। বোতলের গায়ে লেখা: “Highly Inflammable. Petroleum Ether.”
এই মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এ কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি পরিকল্পিত, ভয়-নির্ভর অপরাধ, যেখানে তন্ত্রমন্ত্রের নামে গ্রামের মানুষদের বশে রাখা হচ্ছে। তেলের সাহায্যে প্রতিবার আগুন লাগানো হচ্ছে নির্দিষ্ট ঘরগুলোতে। কে করছে? উত্তর একটাই—গিরিজা ঠাকুর এবং তাঁর গোষ্ঠী। পল্লবী ধীরে বলল, “তাহলে অভিশাপের গল্প আসলে একটা ছায়া, যার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে লোভ, ক্ষমতা আর ভয়।” হ্যাঁ, ভয়ই তো এই গ্রামের শাসনব্যবস্থা—যে ভয়কে পুঁজি করে গ্রাম শাসন করা হয়, এবং প্রয়োজন হলে কারও জীবন নিয়ে সেই ভয়কে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়।
তারা গুহা থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল। অরিত্র মোবাইলে সব কিছু রেকর্ড করলেন, প্রমাণ জোগাড় করলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থেকে গেল—এবারের ‘বলি’ কীভাবে আটকানো যাবে? বিজলী, সেই ছোট মেয়েটি, যার নাম আগে থেকেই দেওয়া হয়ে গেছে আগুনের খিদে মেটানোর জন্য। গিরিজা ঠাকুর কি চুপ করে বসে থাকবে? নাকি সে আরও বড় ভয় ছড়াবে? সেই রাতে অরিত্র ঠিক করলেন—এবার তিনি খোলাখুলি যুদ্ধ করবেন। কুসংস্কার আর অপরাধের এই অন্ধ গুহা থেকে ছায়ামাটিকে মুক্ত করতে হবে। পরদিন সকালেই তিনি ফোন করলেন ডি.এস.পি গগন সরকারকে, কিন্তু ফোন কেটে গেল। আবার করলেন, বারবার। কিন্তু সিগনাল আসে না। পল্লবী তখন বলল, “আপনি ফোন করতে পারছেন না? আজকে দিনটা ‘আগুনের দিন’—এবছর এই দিনেই বলি হয়। এর আগে প্রতি বছর এই দিনে কেউ না কেউ নিখোঁজ হয়ে গেছে। আজ রাতই ফয়সালার রাত, অরিত্র।” অরিত্র জানতেন, এই রাতের আগুন এখন আর শুধু মাটির নিচেই নেই—এটা ছড়িয়ে পড়তে চলেছে সমস্ত ছায়ামাটি জুড়ে।
(৫)
সন্ধ্যে নামতে নামতেই পুরো ছায়ামাটি যেন কোনো এক অদৃশ্য নির্দেশে পালটে গেল। বাতাস ভারী, গন্ধে মিশে আছে পুরনো ধূপ, জ্বলন্ত রেজিন আর ভয়ের ধোঁয়া। গ্রামের মানুষের চোখে মুখে কেমন এক অচেনা স্তব্ধতা—কেউ কথা বলছে না, কেউ কারো চোখে চোখ রাখছে না, সবাই যেন কিছু একটা জানে কিন্তু বলতে পারছে না। পল্লবী বলল, “আজ রাত দশটার পরেই শুরু হয় সেই ‘অনুষ্ঠান’। বলির আগে তারা মেয়েটিকে অজ্ঞান করে একটা নির্দিষ্ট গুহায় নিয়ে যায়। গ্রামের অনেকেই জানে, কিন্তু মুখ খোলে না।” অরিত্র বললেন, “আমি ওকে বাঁচাবো। কিন্তু সেটা করতে হলে প্রমাণ দিয়ে প্রথমে গিরিজাকে চাপে ফেলতে হবে। তাহলে তার অনুগামীরা কিছুটা হলেও পিছিয়ে যাবে।”
রাত আটটা। অরিত্র বিজলীর বাড়িতে গিয়ে দেখলেন, মেয়েটি নেই। তার মা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বলল, “তিনজন লোক এসে বলল পুজোর জন্য তাকে নেয়া হবে। আমি বাধা দিলাম, কিন্তু তারা বলল—এটাই নিয়ম। আমি কি করতাম?” পল্লবী বলল, “তারা মেয়েটিকে নিয়ে গেছে পাহাড়ের পাদদেশের সেই গুহায়। আগুনের কুণ্ডের সামনে ওকে উৎসর্গ করবে।” অরিত্র সঙ্গে সঙ্গে নিজের রিভলভার নিয়ে নিলেন, মোবাইলের ব্যাটারি ৫%—কোনো কাজের নয়। গ্রামের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন, সবাই চুপ। কিন্তু একজন কিশোর আস্তে এগিয়ে এসে বলল, “আপনি চলুন আমার সঙ্গে। আমি জানি ওকে কোথায় নিয়ে গেছে।” অন্ধকার গ্রামের গলি, বাঁশঝাড়, কাঁটাঝোপ পেরিয়ে তারা পৌঁছাল সেই প্রাচীন গুহার সামনে—যেখান থেকে ধোঁয়া আর পেতলের ঘণ্টার আওয়াজ আসছে।
ভেতরে ঢুকে যা দেখলেন, তা শিউরে ওঠার মতো। আগুনের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মানুষ, লাল কাপড় বাঁধা শরীরে, চোখে বিভ্রান্তি আর উন্মাদনা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিরিজা ঠাকুর, হাতে রক্তরঞ্জিত খড়্গ। তার সামনে বসে আছে বিজলী—অজ্ঞান অবস্থায়, মাথায় এক ফোঁটা রক্ত। গিরিজা উচ্চারণ করছে তান্ত্রিক মন্ত্র, আর বলছে, “এই রক্তে জ্বলবে না ছায়ামাটি, এই রক্তেই সন্তুষ্ট হবে অগ্নিদেবতা!” সেই মুহূর্তেই অরিত্র রিভলভার বের করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “সবাই থামুন! কেউ নড়বেন না! এই পুরো জায়গাটা এখন থেকে অপরাধস্থল। এই মেয়েটিকে বলি দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ হিসেবে। আমি এসআই অরিত্র বসু, কলকাতা পুলিশের প্রতিনিধি।”
হঠাৎ চারদিক স্তব্ধ। গিরিজা ধীরে হেসে বলল, “আপনি যা দেখছেন, তা আপনি বুঝতে পারবেন না। এখানে আইন চলে না বাবু, এখানে চলে আগুনের ধর্ম।” সে চোখে আগুনের ঝলক নিয়ে খড়্গটা তুলে ধরল। কিন্তু অরিত্র পিছিয়ে না গিয়ে বন্দুক তাক করলেন, বললেন, “আপনার পুরনো তন্ত্র এখন আর কাউকে ভয় দেখাতে পারবে না। আমরা গুহা থেকে আগুনের উৎস পেয়েছি, আপনার তেলের বোতল, প্লাস্টিক ড্রাম—সব রেকর্ড করেছি। আপনি এখন খুনের চেষ্টায় অভিযুক্ত। সবাই হাত উপরে তুলুন।” গিরিজা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে একজন লোক, গ্রামেরই মানুষ, চিৎকার করে বলল, “এ আর কতদিন চলবে ঠাকুর? আমার ভাইকে আগুন খেয়েছে, আমার মা বলি গিয়েছিলেন। আমি আর ভয় পাই না!” মুহূর্তে বাকি গ্রামবাসীরাও যেন সাহস ফিরে পেল। একজন বলল, “এই লোকটা আমাদের ঠকিয়েছে এত বছর। এখন সব ফাঁস হয়ে গেছে!”
গিরিজার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পল্লবী আর রঘু মিলিয়ে বিজলীকে তুলে ধরল। মেয়েটি তখনও অচেতন, কিন্তু জীবিত। গিরিজাকে গ্রামবাসীরাই ধরে ফেলল, তার খড়্গ ফেলে দিল কেউ একজন। পুলিশকে খবর দেওয়া হলো পরদিন ভোরে, আর সকালে গোটা বিষয়টি সংবাদপত্রে ছড়িয়ে পড়ল। গিরিজা ও তার গোষ্ঠী গ্রেপ্তার হলো, পুরনো গুহা সিল করা হলো, এবং একসময় সেখানে গড়ে উঠল একটি “স্মৃতি শিখা”—যা স্মরণ করিয়ে দেবে সেই দিনের আগুন আর সাহসের গল্প।
বিজলী সুস্থ হলো কয়েকদিন পর। তার চোখে ছিল ভয় নয়, মুক্তির আভা। ছায়ামাটি ধীরে ধীরে ফিরতে লাগল স্বাভাবিক জীবনে। অরিত্র ফিরে গেলেন কলকাতায়, কিন্তু মাথায় রয়ে গেল আগুনের সেই রাতে ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলো। পল্লবী তাকে বলল, “ভয় কখনও অভিশাপ নয়, তা যদি প্রশ্ন করতে শেখে। তুমি প্রশ্ন করেছিলে—সেজন্যই ছায়ামাটি বাঁচল।”
ছায়ামাটির রাত এখন নিস্তব্ধ, অথচ এই স্তব্ধতার গভীরে রয়েছে কিছু এমন শব্দ যা কেবল অনুভব করা যায়। আগুন নিভেছে, অন্তত চোখে দেখা সেই আগুন। গিরিজা ঠাকুরের নতুন গোষ্ঠীও ধরা পড়েছে পুলিশের জালে, তাদের গুহা সিল করে দেওয়া হয়েছে চিরতরে। প্রশাসনের কড়া নজর এখন ছায়ামাটির উপরে—এখন আর কোনো রাতেই কেউ কাউকে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যায় না। পল্লবী এখন গ্রামপঞ্চায়েতের সদস্যা, রঘু মাঝি তাঁর সহকর্মী। বিজলী বড় হয়েছে, সে বলে, “আমি একদিন পুলিশ হব, যেন আর কেউ আমার মতো ভয় না পায়।”
কলকাতায় ফিরে গেছেন এসআই অরিত্র বসু, কিন্তু তার ডেস্কে এখনো সেই পোড়া শিলালিপির ছবি রাখা। রাতের বেলা যখন শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসে, তখন মাঝে মাঝে সে নিজের জানালা দিয়ে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে—যেন কিছু অনুসন্ধান করছে। পল্লবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ এখনো টিকে আছে—শুধু অফিসিয়ালি নয়, এক নীরব বন্ধুত্বের আবেগে বাঁধা এক সম্পর্ক। কেউ কিছু বলে না, কিন্তু জানে—সেই আগুন একবার একসঙ্গে তারা পেরিয়ে এসেছিল।
কিন্তু এই গল্পের সত্যিকারের সমাপ্তি?
গ্রামের বাইরে, সেই পাহাড়ের গুহার পেছনে থাকা শুকনো নদীখাতের কাছে, এক রাতে দেখা যায় এক বালক—সে বসে আছে আগুনের সামনে, মাটি দিয়ে আঁকছে তান্ত্রিক প্রতীক। তার পাশে পড়ে আছে সেই পুরনো মুখোশ।
সে বলে, “আমরা তো আগুনকে থামাইনি, কেবল ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।”
আগুন কখনো নিভে যায় না। কেবল সময়ের জন্য আড়ালে থাকে।
—-




