Bangla - হাস্যকৌতুক

বাবলু দার বিয়ে.কম

Spread the love

স্বপন সরকার


অধ্যায় ১: বিয়ের বিজ্ঞাপন ও বিড়ম্বনা

বাবলু দা, পুরো নাম বাবলু মুখার্জি, পঞ্চান্ন ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এখনও ব্যাচেলর। কেউ কেউ বলে — “ব্যাচেলর” না, “চিরকুমার”! চোঙা প্যান্ট, ফুলহাতা সাদা গেঞ্জি আর একটা জরাজীর্ণ হাতঘড়ি হাতে, চুলের রং এখন আর কালো নয়, তবে টানা চিরুনিতে পাক ধরা চুলেও বাবলু দা এক রকম আভিজাত্য বজায় রেখেছেন। থাকেন পূর্ব মেদিনীপুরের এক অজ পাড়াগাঁয়ে, নাম হল ‘আটঘরা’। গাঁয়ে কেউ ‘বাবলু মুখার্জি’ বলে না, সবাই বলে “বাবলু দা”। কেউ আবার বলে “বিয়ের পাকা খাতা খুলে রেখে ধোঁয়া তুলছেন।”

বাবলু দা’র বিয়ে হয়নি কেন, সেটা নিয়ে গোটা গ্রামে অন্তত সাত রকমের গল্প প্রচলিত। কেউ বলে, কলেজের সময় এক প্রেমে পড়েছিলেন, মেয়েটা হঠাৎ বিয়ে করে দিল্লি চলে যায়, বাবলু দা সেই থেকে কুমার। আবার কেউ বলে, “ওর মতন রগচটা লোককে কোন মেয়ে সহ্য করবে?” কেউ বা বলে, “আসলে উনি মা ছাড়া আর কাউকে জীবনসঙ্গিনী ভাবতেই পারেন না!”

এই গল্পগুলো যেমনই হোক, আসল সত্যিটা হল—বাবলু দার কোনোদিন ‘মনের মতন’ পাত্রী জোটেনি। আর আজকাল তো পাত্রী খোঁজা মানেই মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট আর ভিডিও কল। আর এতদিন মাটির টেপ রেডিও শোনার মানুষ হঠাৎ মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করবে—ভাবা যায়?

কিন্তু দিন বদলায়। মা গত হয়েছেন বছর পাঁচেক, বাবলু দার দাদা বম্বেতে থাকে, বোন আছে খড়গপুরে। সবাই চাপ দিচ্ছে—”তুই একা মানুষ, বিয়ে কর! অন্তত একটা মানুষ তো থাকুক পাশে!” আগে বাবলু দা বলতেন, “বিয়ে করলেই কি পাশের মানুষ হয়? পাশের মানুষ অনেকেই হয়, বিছানার পাশেরটা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক!”

এইসব বলে এড়িয়েই গেছেন। কিন্তু গত শীতে একটা ঘটনা ঘটল, যেটা তাঁর জীবনটাই ঘুরিয়ে দিল।

বাবলু দা হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে স্থানীয় হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার দিদি বয়সে ছোট, তবে বড় বকবক করে। রসিকতার ছলে বলল, “বাবলুদা, হাঁটু তো বয়সের কারণে ব্যথা করছে। বিয়ে করলে একটু ঝাঁকুনি-টাকুনি পেলে আবার নড়চড় ঠিক হয়ে যেত!” — ডাক্তারি পরামর্শ যে এমন রসালো হতে পারে, তা কে জানত?

বাড়ি ফিরে এসে বাবলু দা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বললেন, “আর কতদিন? বয়স তো ছুঁই ছুঁই করছে…এবার তো সত্যিই কিছু একটা করা দরকার।”

সেই রাতেই, বহু কষ্টে স্মার্টফোনটা অন করলেন। ভাগ্নে দিয়ে গিয়েছিল একবার, কখনো ব্যাবহার করেননি। এখন চালু করে, ইন্টারনেট চালাতে গিয়ে দুবার ভুল করে নিজের নামে শেয়ার চ্যাট খুলে ফেললেন। সেইখানে যা সব ছবি, ভিডিও দেখা গেল — “ঘটতেছে অঘটন, বিয়ে করতে চাইলে খুঁজে দেখুন এই পাত্রী” — এসব দেখে মাথা ঘুরে গেল।

পরের দিন পাশের বাড়ির পিকুল এসে যখন বলল, “বাবলুদা, চাইলে আমি আপনার জন্যে একখানা প্রোফাইল খুলে দিতে পারি shaadi.com-এ,” তখন বাবলুদা কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিলেন।

পিকুল, বয়সে বিশের ঘরে, কিন্তু স্মার্টফোন চালনায় সে যেন পন্ডিত। আধঘণ্টার মধ্যেই সে বাবলু দার ‘প্রোফাইল’ খুলে দিল। বয়স, উচ্চতা, রাশি, শখ — সব কিছু লিখে দিল।

“কিরে, শখে কী লিখলি?”
“লিখেছি, রবীন্দ্রসংগীত, রান্না, আড্ডা আর রাত্রে হাঁটাহাঁটি।”
“রাত্রে হাঁটাহাঁটি! আমি কি কুকুর?”
“আরে দাদা, একটু রোমান্টিক ভাব আনতে হয়!”

পিকুল আর একটা স্মার্ট জিনিস করল—বাবলু দার একটা ছবি তুলে দিয়ে দিল। সাদা পাঞ্জাবি, ঠোঁটের কোণে কালি, চুলে সিঁদুরের মত পাক—ফুল ‘বাঙালি প্রেমিক’ লুক।

প্রোফাইল একটিভ হতেই শুরু হল ম্যাচ আসা। একদিনেই তিনটে প্রোফাইল ‘ইন্টারেস্টেড’। এক নম্বর – ‘সুপর্ণা দেবী’, বয়স ৪৮, বিধবা, কলকাতা বালিগঞ্জে থাকেন। দ্বিতীয় – ‘গীতা রানী পাল’, গরুছাগল পোষেন, ঝাড়গ্রামের দিকের কেউ। তৃতীয় – ‘নেহা রায়’, বয়স ৩৫, সুন্দরবনের কেউ, কিন্তু সন্দেহজনকভাবে প্রোফাইলটা ইংরেজিতে লেখা।

বাবলু দা কাঁপা গলায় বললেন, “পিকুল, তুই এই নেহা রায়ের সঙ্গে কথা বল।”

পিকুল ভিডিও কল দিল, এবং ফলাফল এমন হল—

ভিডিওতে যে মেয়েটা এল, সে আদৌ নেহা রায় নয়। সোজা বলতে গেলে, মেয়েটা ‘ফিল্টার’ দিয়ে এমন সাজিয়ে নিয়েছে যে সে চেনার উপায় নেই। কথা বলার সময় হঠাৎ তার পেছনে একটা লোক গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “বলে দে, পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স লাগবে!” — বাবলু দা ভয়ে ভিডিও বন্ধ করে দিলেন।

“ধাপ্পাবাজি! এ তো স্পষ্ট চিটিং!” — বাবলু দার মুখ তখন ফ্যাকাসে।

পিকুল হাসতে হাসতে বলল, “ওসব অনেক আছে দাদা! কিন্তু চিন্তা কোরো না, আমি ফিল্টার চেনার অ্যাপ ইনস্টল করে দিয়েছি। এবার ধরা পড়ে যাবে।”

এইভাবে বাবলু দার শুরু হল নতুন জীবন — ‘বিয়ে খোঁজার জীবন’। প্রতি রাতে তিনি এক কাপ দুধ আর একটা রজনীগন্ধা নিয়ে বসতেন মোবাইল স্ক্রিনের সামনে। পাত্রী দেখতেন, প্রোফাইল পড়তেন, পিকুলের সাহায্যে কথা বলতেন।

কিন্তু প্রতিবারই কিছু না কিছু গণ্ডগোল হয়। কখনো পাত্রী বলে, “আমি তো শুধুই NRI খুঁজি।” কখনো বলে, “আপনার তো চুল পড়ে গেছে, আমি হেয়ারফুল পছন্দ করি।” কখনো বলে, “তুমি রান্না শিখেছ?” — বাবলু দা বলেন, “আমি ডিম সেদ্ধ করি দারুণ!” — সঙ্গে সঙ্গে প্রোফাইল ব্লক।

কিন্তু একদিন, একটি বিশেষ প্রোফাইল এল—“মাধবীলতা সেন, বয়স ৪৬, কলকাতার লেডি ক্যানিং স্ট্রিটে থাকেন, অবিবাহিতা, শখ — কবিতা লেখা, ঝুমঝুমি বাজানো এবং বোকার মতো লোকদের হাসানো।” ছবিটাও মন ভাল করে দেওয়া—সতেজ মুখ, বড় ফ্রেমের চশমা, মুখে হালকা হাসি।

বাবলু দা একদম প্রেমে পড়ে গেলেন। পিকুলকে নিয়ে ভিডিও কল দিলেন। ওপার থেকে এক সুন্দরী মহিলা এলেন, বললেন, “আপনি কি সত্যিই রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসেন?”
বাবলু দা বললেন, “হ্যাঁ, তবে গাই না, কারণ গেলে প্রতিবেশীরা দরজা বন্ধ করে।”
মাধবীলতা হেসে বললেন, “তাহলে মিল আছে, আমিও কবিতা লেখি, কিন্তু কেউ পড়ে না!”

ওই মুহূর্তে বাবলু দা’র মনে হল — এই মেয়েটাই ঠিক।

কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়। পরের দিন হঠাৎ মাধবীলতা ফোন করে বললেন, “আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই, আগামী শনিবার, হাওড়ার কাছে এক কফিশপে আসবেন?”

বাবলু দা নার্ভাস। প্রথমবার কোনও নারীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, তাও ইন-রিয়েল-লাইফ! সেদিন সকালে তিনি একটা নীল পাঞ্জাবি পরলেন, চুলে তেল দিলেন, চামড়ার স্যান্ডেল পায়ে গুঁজলেন, আর জীবনে প্রথমবার ফোনে Google Map চালু করলেন।

গন্তব্য: কফি উইথ লাভ।

যেতে যেতে বাসে তিনি মনে মনে রিহার্সাল করলেন — “আপনার কবিতা খুব ভালো, আপনি চমৎকার লিখেছেন।” আরেকটা অপশন ছিল — “আপনি আমার জীবনে বসন্তের হাওয়া।”

কিন্তু যখন তিনি পৌঁছলেন, তখনই শুরু হল আসল হাস্যকর কাণ্ড। কেননা—

কফিশপে একসঙ্গে হাজির তিনজন মহিলা — এবং প্রত্যেকেই বলছেন, “আমি মাধবীলতা সেন।”

বাবলু দা থমকে দাঁড়ালেন, আর মনে মনে বললেন,
“বিয়ে.কম তো বুঝলাম…এ তো পুরো ‘ধোঁকা.কম’!”

অধ্যায় ২: তিন মাধবীলতা ও তৃতীয় বিপদ

কফিশপের কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বাবলু দা’র চোখ স্থির হয়ে গেল। ভিতরে এসি চলছে, টেবিল জুড়ে বসে আছে তিনজন মহিলা। চা-কফির কাপ পাশে, কারো হাতে বই, কেউ বা ফোনে ব্যস্ত। কিন্তু সমস্যাটা হলো — তিনজনের সবার নাম মাধবীলতা সেন।

বাবলু দা মুখে হালকা হেসে বললেন, “আঁ…আঁ…আমি বাবলু মুখার্জি। আপনারা কেউ কি…মানে, মাধবীলতা সেন?”

তিনজন একসাথে মুখ তুলে তাকালেন এবং একসঙ্গে বললেন, “আমি!”

এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবীর যে কোনো ব্যাচেলর হয়তো উল্টে পালাত। কিন্তু বাবলু দা দাঁড়িয়ে থাকলেন, একটু চুল চুলকে বললেন, “তা হলে…আপনারা কি একই প্রোফাইল থেকে এসেছেন? নাকি ত্রিকোণ প্রেমের নাটক শুরু হলো?”

তিন মহিলার একজন হেসে উঠলেন, “ওই যে, আমরা আসলে বোনেরা। আমি—মাধবীলতা, ও—মাধুরী এবং ও—মাধবী। মা আমাদের নাম রেখেছিলেন তিন ‘মা’ দিয়ে।”

“তিন বোন? তাও আবার একই সঙ্গে বিয়ে খুঁজছেন?” — বাবলু দা’র চোখে তখন রীতিমতো টিভি সিরিয়ালের প্লট।

মাধবীলতা হাসলেন, “আসলে প্রোফাইলটা আমার, কিন্তু আমরা তিন বোন একসঙ্গে থাকি। আগে থেকেই ঠিক ছিল, কাউকে বিয়ে করলে আমরা তিনজনেই যাচাই-বাছাই করব। এটা আমাদের ‘বোর্ড মিটিং’। আপনি পাস করলেই তবে বিয়ের আলোচনা এগোবে।”

“বোর্ড মিটিং!” — বাবলু দা মনে মনে বললেন, “এ তো ইন্টারভিউ নয়, সিভিল সার্ভিস!”

তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি পকেট থেকে ছোট ডায়েরিটা বের করে বললেন, “আমি তো প্রস্তুত হয়েই এসেছি। কিছু প্রশ্ন আমিও এনেছি।”

মাধুরী বললেন, “বলেন দাদা, আমরাও শুনি।”

বাবলু দা বললেন, “আপনাদের রান্নার কেমন হাত?”
মাধবী বললেন, “খুব ভালো! তবে আপনি ডিম ভাজা খেতে চাইলে নিজেই করতে হবে।”
“বাহ!” — বাবলু দা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

এরপর আরও নানা প্রশ্ন চলে—‘কবিতা কোন সময় লেখেন’, ‘রাত্রে টিভি কতক্ষণ দেখেন’, ‘সন্ধ্যায় ঘুরতে যেতে চান কিনা’। সব কিছুর শেষে, মাধবীলতা চুপ করে বললেন, “বাবলু দা, একটা কথা বলি?”

“নিশ্চয়ই, বলুন।”

“আপনি হয়তো ভাবছেন আমরা তিন বোন মিলে মজা করছি। আসলে না। আমরা ছোটবেলা থেকেই একে অপরের সাথে সব ভাগ করে বড় হয়েছি। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম—বিয়েও যেন আমাদের কারও মধ্যে দূরত্ব না আনে। তাই আমার বিয়ে মানে ওদের জীবনেও বদল। আপনাকে শুধু আমার নয়, আমাদের পরিবারের একজন হতে হবে।”

বাবলু দা একটু থমকে গেলেন। এত চিন্তাভাবনা করে বিয়ে করার কথা তিনি কখনও ভাবেননি। বরং তাঁর তো প্ল্যান ছিল — “দুধ-রুটি-রেডিও-সন্ধ্যার হাঁটা” — এর সঙ্গে একজন কথা বলার মানুষ পেলেই হলো।

এদিকে কফিশপের ওয়েটার ততক্ষণে অর্ডার নিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবলু দা এক কাপ “ক্যাপুচিনো” অর্ডার করলেন। জীবনেও খাননি, কিন্তু সিনেমায় দেখেছেন। সঙ্গে বললেন, “আর একটা দার্জিলিং চা দিন, পাতা দিয়ে, ডিপ ফ্লেভার…শুধু গন্ধের জন্য।”

মাধবীলতা হেসে ফেললেন, “আপনি তো আসলেই কফির চেয়ে চায়ের মানুষ। আমারও তাই।”

এই প্রথম তাঁদের দু’জনের মধ্যে একসঙ্গে হাসির বিনিময় হল।

কফি পানের পরে তিন বোন বললেন, “আপনার চরিত্র ভালো, হাস্যরস আছে, সোজা কথা বলেন। আমরা ভাবছি আপনাকে দ্বিতীয় সাক্ষাতে বাড়িতে ডাকব। আপনি কি রাজি?”

বাবলু দা বললেন, “রাজি তো বটেই, তবে আমি বাড়িতে গেলে লুচি-আলুরদম পাওয়া যাবে তো?”

মাধুরী হেসে বললেন, “একশো শতাংশ! তবে আপনি আগে বলুন, আপনি কী দিতে পারবেন?”

বাবলু দা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “আমি দিতে পারি—রাতে এক কাপ দুধের সঙ্গে গল্প, সকালে ঘুমভাঙা রবীন্দ্রসংগীত, আর মাঝে মাঝে পিকুলের নতুন আবিষ্কার। মানে, হাস্যরসের স্টক আমার কাছে চিরকাল থাকে।”

এই কথায় হাসিতে ফেটে পড়লেন তিন বোন।

সে দিনটা শেষ হলো অনেক স্মৃতি নিয়ে। বিদায় নেবার আগে মাধবীলতা বললেন, “এই কফিশপে দেখা হবে ঠিক এক সপ্তাহ পরে। আপনি পাস করলেই আমরা আলোচনা এগোব।”

বাবলু দা বাড়ি ফিরে এলেন। এত ভালো দিন বহুদিন পর কাটালেন। পিকুল এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো দাদা? কনফার্ম?”

বাবলু দা বললেন, “ভাই, আজ মনে হলো, বিয়ে একা মানুষের প্রজেক্ট না, একটা টিমওয়ার্ক।”

পরের দিন সকালে, বাবলু দা হঠাৎ খবরের কাগজ খুলে একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দেখলেন—

“বিয়ের নামে চক্র! তিন বোন মিলে পুরুষদের ঠকাচ্ছে! শিকার হয়েছেন বহু ব্যাচেলর!”

তাঁর গলা শুকিয়ে গেল। নিচে লেখা, “তিন বোন — মাধবীলতা, মাধুরী, মাধবী — ফেসবুক, বিয়ের অ্যাপ ও কফিশপে সাক্ষাৎ করিয়ে টাকা আদায় করে পালায়!”

বাবলু দা চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। পিকুল ছুটে এসে ধরল, “দাদা! কী হলো?”

বাবলু দা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন,
“পিকুল… আমি কি প্রেমে পড়েছি? নাকি প্রতারণার ফাঁদে পড়েছি?”

অধ্যায় ৩: প্রেম না প্রতারণা, পিকুলের প্যাঁচাল তদন্ত

বাবলু দা সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেননি। বিছানায় গড়াগড়ি, মাথার ভেতর ঘুরছে তিনটে মুখ—মাধবীলতা, মাধুরী, মাধবী। সবাই এত আপন, এত আন্তরিক, এত বাস্তব… তাহলে কি এইসবকিছু মিথ্যে? তাহলে কি… বাবা রে বাবা! এই বয়সে এসে প্রেম নয়, পুলিশ কেসে পড়তে হলো নাকি!

পরদিন সকালে পিকুল আসতেই বাবলু দা আর দেরি করলেন না। পিকুলকে বসলেন সামনে।
“শোন, আমার ফোনে তোদের সঙ্গে কথা বলার সময় যেসব স্ক্রিনরেকর্ডিং রেখেছিলিস, সব বের কর।”
পিকুল ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন, দাদা? আপনি তো বেশ প্রেমে পড়েছিলেন!”

বাবলু দা থমকে বললেন, “পড়েছিলাম, এখন প্রশ্ন হচ্ছে—প্রেমে পড়েছিলাম, না ফাঁদে?”

পিকুল বলল, “ওরে বাবা! তাহলে শুরু হল ডিটেকটিভ বাবলু!”

পিকুল তার ফোন থেকে সব ভিডিও ফুটেজ, স্ক্রিনশট আর মেসেজের কপি এনে দিল। তারা দু’জনে একরকম গোয়েন্দাগিরি শুরু করল—পিকুলকে বলা হলো সব ছবির মেটাডেটা চেক করতে, স্ক্রিনশটের আইপি লোকেশন ট্র্যাক করতে, এমনকি সেই কফিশপের সিসিটিভি ফুটেজ চেয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতেও ভাবলেন।

“কিন্তু দাদা,” পিকুল বলল, “এই বয়সে আপনি কি চাইছেন? বিয়ের আগে CID তদন্ত?”

“হ্যাঁ, চাইছি,” বাবলু দা চেঁচিয়ে বললেন, “আমি আর চাই না কেউ এসে আমার মন নিয়ে খেলে। এই মন তো আর আইটেম না, যে Add to Cart করে কেউ কিনে নিয়ে যাবে!”

ঠিক তখনই একটা ফোন এল। মাধবীলতার নাম। বাবলু দা ফোন ধরলেন। ওপার থেকে বলল,
“বাবলু দা, আপনি আজ আমাদের বাড়িতে আসবেন তো? আমরা অপেক্ষা করব।”

বাবলু দা দ্বিধায় পড়ে গেলেন। যাবেন, না যাবেন না? পিকুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে বলল,
“দাদা, যান। কিন্তু আমি যাব আপনার সঙ্গে। ছদ্মবেশে।”

“ছদ্মবেশে?”
“হ্যাঁ, আমি ক্যামেরা নিয়ে যাব, কুরিয়ার বয়ের ছদ্মবেশে। সব ভিডিও করে ফেলব!”

পরিকল্পনা ফাইনাল। বিকেলে বাবলু দা পরলেন তাঁর প্রিয় টেরিকট পাঞ্জাবি, পায়ে স্যান্ডেল, আর হাতে একটা ছোট উপহার—মাধবীলতার জন্য ছোট্ট একটা বই: “জীবনের রসায়ন”।

পিকুল meanwhile একটা হাফ প্যান্ট, টুপি আর মুখে মাস্ক পরে রেডি। তার হাতে কুরিয়ার ব্যাগ, আর ব্যাগের ভেতর ছোট ক্যামেরা।

গন্তব্য: শ্যামবাজার, কলকাতা।

চলে এল সেই বাড়ি, তিনতলা, পুরনো কিন্তু গোছানো। বাবলু দা কলিং বেল বাজালেন, খুললেন মাধবীলতা নিজে। মুখে সেই হাসি।

“এসুন বাবলু দা, আপনাকে নিয়েই গল্প করছিলাম।”
ভিতরে ডেকে নিলেন। বসার ঘর সাজানো, কোথাও গন্ধে গোলাপ আর লেবুর মিল। মাধুরী এসে বললেন, “আজ আপনার জন্যে আলু পরোটা বানিয়েছি। রুচি অনুযায়ী গরম করব।”
মাধবী বলল, “দুধ না চা?”

এত যত্ন দেখে বাবলু দা’র সন্দেহ একটু কাঁপল। তবুও তিনি ভিতরে ভিতরে সতর্ক।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ একটা খটাস শব্দ! পিকুল গেটের বাইরে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে একটা ঝোপে পড়ে গেল! ভুল করে পা পিছলে যায়। ভেতর থেকে কেউ জানল দিয়ে দেখে ফেলল। মাধুরী বলল, “কে বাইরে?”

বাবলু দা উঠে দাঁড়ালেন, “আসলে…আসলে ও আমার…কুরিয়ার বয়, ও একটা বই আনছে।”

মাধবীলতা বললেন, “দারুন তো! দেখি দেখি!”

পিকুল কুরিয়ার বয়ের ছদ্মবেশে এসে ভিতরে ঢুকল, মুখে মাস্ক, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যায়—চেনা লোক। মাধবী ঘাড় কাত করে বলল, “এই পায়ের চাল তো পিকুলের মতো!”

বাবলু দা হেসে বললেন, “আরে না না, আপনি নিশ্চয়ই ভুল দেখছেন।”

কিন্তু তখনই বিপত্তি! পিকুলের কাঁধের ক্যামেরা ঝুলে বাইরে পড়ে গেল।

তিন বোনের চোখ ছানাবড়া। মাধবীলতা জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কী?”

পিকুল এবার আর লুকাতে পারল না। মুখ খুলে বলল,
“দিদি, দোষ করিনি। আমরা একটা ভিডিও করতে চেয়েছিলাম, কারণ আপনি তিনজনকে নিয়েই খবরের কাগজে একটা প্রতারণার অভিযোগ এসেছে।”

তিন বোন প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন। তারপর মাধবীলতা বললেন, “ওটা আমরা জানি। সেই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। ওটা আমাদের প্রতিবেশী এক নোংরা মনের লোক ছড়িয়েছে, কারণ আমরা ওর ছেলেকে বিয়ে দিতে রাজি হইনি। আমাদের নামে রিপোর্টও হয়েছিল, কিন্তু প্রমাণের অভাবে পুলিশ অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে।”

বাবলু দা ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়লেন।
“তাহলে… আপনারা প্রতারক নন?”

মাধুরী বললেন, “না। কিন্তু আপনি যে আমাদের এতটা সন্দেহ করেন, সেটা জেনে খুব খারাপ লাগল।”

মাধবী চোখ নামিয়ে বলল, “আপনি কি ভালোবাসেন সন্দেহ করে, প্রমাণ চাইতে? নাকি বিশ্বাস দিয়ে?”

বাবলু দা চুপচাপ। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, মাধবীলতার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“আমি ভয় পেয়েছিলাম। কারণ জীবনে আমি কখনও ভালোবাসা পাইনি। যেটুকু পেয়েছি, সেটাও সন্দেহে শেষ হয়ে গেছে। তাই এবার যখন মন খুলে কিছু পেতে যাচ্ছিলাম, তখন ভয় ধরল—হারিয়ে ফেলি না আবার।”

তিন বোন একটু চুপ। তারপর মাধবীলতা আস্তে বললেন,
“তাহলে একটা সুযোগ দিন নিজেকে প্রমাণ করার। আর আমরা আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই—নতুন করে, নির্ভয়ে।”

বাবলু দা এবার বুকের ভিতর এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলেন।

সে দিন সন্ধ্যায় পিকুল তাঁকে বলল,
“দাদা, আপনি প্রেমিক না, গোয়েন্দা প্রেমিক! তবে একটা কথা বলি?”
“বল।”
“এই প্রেমটা আর সন্দেহে মারবেন না। এবার বিশ্বাসে এগোন। নয়তো মাধবীলতা দিদি সত্যিই হারিয়ে যাবে।”

বাবলু দা চুপ করে মাথা নাড়লেন।

তারপরই তিনি ফোন করলেন মাধবীলতাকে:
“আমি আগামী রবিবার আবার আসব। তবে এবার আর ক্যামেরা নয়, শুধু একটা ফুল নিয়ে।”

ওপাশে থেকে মাধবীলতা হেসে বললেন,
“এই তো আমার বাবলু দা!”

অধ্যায় ৪: গোগন কাকু ও গণ্ডগোলের ঘন্টা

রবিবার সকালবেলা বাবলু দা আয়নায় নিজের চুল আঁচড়াচ্ছেন, হালকা নার্ভাস। নতুন হাফশার্ট, পকেটে কৌটো ভর্তি তাজা গন্ধরাজ ফুল—মাধবীলতার প্রিয়। এদিকে পিকুল দরজার কাছে বসে গম্ভীর মুখে বলল,
“দাদা, আজ আর কোনো ক্যামেরা নেই তো?”
“না রে বাপু, আজ শুধু হৃদয় দিয়ে প্রেম দেখাতে হবে।”

পিকুল ভুরু কুঁচকে বলল, “কিন্তু প্রেম দেখানোর স্টাইলে আপনি এখনও একটু ট্যাকনিক্যাল।”

বাবলু দা উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভাই, এই বয়সে প্রেমও যেন একটা সফটওয়্যারের মতো, ইনস্টল করতে গেলে আপডেট লাগে, পাসওয়ার্ড ভুলে গেলেই গণ্ডগোল।”

সকাল সাড়ে দশটায় বাবলু দা যখন মাধবীলতার বাড়ির সামনে পৌঁছালেন, তখন রোদের ঝাঁজে স্যান্ডেল চেঁচিয়ে উঠছে। কিন্তু মনের রোদ ছিল অন্যরকম। দরজা খুলল মাধবীলতা, আজ সে পরেছে হালকা নীল সালোয়ার কামিজ, খোপায় একটা ফুল, আর চোখে চোখ রাখতেই বাবলু দা’র গলগল করে ঘাম বেরিয়ে গেল।

“বসুন, আজ আমার এক বিশেষ আত্মীয় এসেছেন। তিনি আমাদের সব বিয়ের পরামর্শদাতা। আমাদের বিয়ে-বিশারদ।”

বাবলু দা চমকে উঠে বললেন, “মানে… বিয়ে-বিশারদ? মানে… বিয়ে বিশেষজ্ঞ?”

ঠিক সেই মুহূর্তে ভিতর থেকে প্রবেশ করল এক অদ্ভুত চরিত্র—পকেটভর্তি পানমশলা, হাফপ্যান্টের উপর জামা, গলায় সোনার চেইন, আর চোখে কালো সানগ্লাস—গোগন কাকু।

“নমস্কার, আমি গোগন চৌধুরী। বিয়ে নিয়ে পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা। কুমার বিয়ে হবে, না বিবাহিতদের পুনরায় বিয়ে, সবই আমার হাতের খেল।”

বাবলু দা তো স্তম্ভিত।
“আপনি কি… বিয়ে ঠিক করেন?”
“না না, আমি সাজেশন দিই। কে কাকে মানায়, কে কাকে সহ্য করতে পারবে, এসব আমার একেবারে গবেষণার বিষয়।”

গোগন কাকু একটা ডায়েরি খুললেন।
“তো বাবলুবাবু, কিছু প্রশ্ন করব। উত্তর দিন মন দিয়ে।”
“এই তো পড়লাম ইন্টারভিউয়ে আবার!” — বাবলু দা মনে মনে বললেন।

প্রশ্ন শুরু—
“আপনি ঘুমান কোন পাশে?”
“মানে?”
“বিয়ে হলে তো ঘরের জায়গা ভাগ হবে—আপনার ডান দিক ঘুমালে স্ত্রী বাঁ দিকে ঘুমোবে। কনফ্লিক্ট হবে না তো?”
বাবলু দা বললেন, “আমি তো একা ঘুমোই… এখনও…”

“ঠিক আছে, দ্বিতীয় প্রশ্ন—চায়ের কাপ আপনি ধুয়ে রাখেন তো?”
“মানে, নিজে ধুই না, কিন্তু… জামাইষষ্ঠীর দিনে একবার…”
“চলবে না! এই বয়সে চা খেয়ে কাপ নিজে না ধুলে বিবাহ জীবন টিকবে না।”

ততক্ষণে মাধবীলতা একটু অস্বস্তিতে বলল, “কাকু, এত রিগোরাস কিউশ্চেনিং না করলেই হয়…”

কিন্তু গোগন কাকু থামেন না।
“তৃতীয় প্রশ্ন—আপনার স্নোরিং আছে কি?”
বাবলু দা ঘামতে থাকেন।
“আমার স্নোরিং নেই, তবে শীতে একটু গলা জোরে ওঠে…”

“খারাপ না, কিন্তু মাঝেমধ্যে বাঁশিও বাজে কিনা সেটা দেখে নিতে হবে।” — গোগন কাকু ঘাড় কাত করে বললেন।

এরপর গোগন কাকু একপ্রকার ফাইনাল রিপোর্ট দিলেন,
“ছয়টা লাল পতাকা, তিনটা সবুজ। মোটামুটি আপনি ‘অবজার্ভেশন ক্যাটেগরিতে’ পড়েন। মানে, প্রেমে হাঁটা যাবে, কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে পা মচকে গেলে দোষ আপনার!”

মাধবীলতা মুখ চুপ করে শুনছিলেন। তারপর বললেন,
“কাকু, এখন আমাদের একটু একা থাকতে দিন।”

গোগন কাকু দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবলু দা’র কানে ফিসফিস করে বললেন,
“সাবধানে, বাবু। প্রেম মানেই মধুর ফাঁদ!”

দরজা বন্ধ হতেই মাধবীলতা বললেন,
“দেখুন, আমি জানি গোগন কাকু অতিরিক্ত করেন। কিন্তু আমি চাই আপনি বুঝুন—আমরা জীবনে প্রতিবার ঠকেছি। তাই এবার ভেবেচিন্তে এগোতে চাই।”

বাবলু দা একটু এগিয়ে এসে বললেন,
“আমি বুঝি। আমিও জীবনে অনেক হোঁচট খেয়েছি। আর আমার প্রেম মানেই ভয় নয়, ভরসা। কিন্তু একটা কথা বলি?”

“বলেন।”

“আপনার যদি আমায় মনে হয় এমন একজন যে ঝগড়ার পরে চুপচাপ চায়ের কাপ নিয়ে আসবে, তাহলে আমি আপনাকে জীবন দিতে রাজি।”

মাধবীলতা হেসে ফেললেন।
“তা হলে আপনার জন্যে আজ দুপুরে তৈরি আছে—পটল পোস্ত আর চালতার টক।”

বাবলু দা চোখ বন্ধ করে বললেন, “এটাই তো প্রেম! মাছ নয়, পোস্ত!”

সে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া চলল, গোগন কাকু বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের পান চিবোতে চিবোতে বললেন,
“এই প্রেম বেশিদিন টিকলে আমার অবিশ্বাসের তত্ত্ব মিথ্যে হয়ে যাবে!”

সন্ধ্যেবেলা, ফেরার আগে মাধবীলতা বললেন,
“পরের সপ্তাহে আমার বাবা-মা’র পুরনো বন্ধুরা আসবেন, তাঁরা আপনাকে দেখতে চান। আপনি রাজি তো?”

বাবলু দা চোখ তুলে বললেন,
“আমি তো রাজি হয়েই আছি। শুধু একটাই অনুরোধ…”

“কি?”

“এই বিয়ের আগে একটু প্রেম করতে দিন না। আপনি রাজি?”

মাধবীলতা হেসে বললেন,
“চা খেয়ে উত্তর দেব!”

অধ্যায় ৫: আত্মীয় সমাবেশ ও ‘বিয়ে-বিপর্যয় থিয়োরি’

রবিবার সকাল দশটা।
শ্যামবাজারের সেই পুরনো তিনতলা বাড়ির বসার ঘর আজ যেন সরষে ফুলে ভরে গেছে—লাল, হলুদ, সবুজ পাড়ের শাড়ি পরা চারপাঁচজন পিসি-মাসি-কাকিমা ঘরে বসে চায়ের কাপ হাতে মুখ টিপে হাসছেন। বাঙালি আত্মীয় মানেই যেন দেশি FBI, চোখে রিমলেস চশমা আর মুখে প্রশ্নবাণ।

গোটা ব্যাপারটার নাম—“পাত্র পরিদর্শন সভা”।
অফিসের ইন্টারভিউ যেমন কর্পোরেট প্যানেল নেয়, তেমনই আজ মাধবীলতার আত্মীয় প্যানেল বসেছে। টেবিলের এক পাশে বসে বাবলু দা, কপালে সামান্য ঘাম, পাঞ্জাবির বোতাম খুলে ফেলেছেন একটা।

আর ঠিক উল্টোদিকে বসে আছেন মাধবীলতার চার মাসি, এক কাকিমা, আর বিয়ে-বিশারদ গোগন কাকু, আজকে নতুন লুকে—সাদা পাঞ্জাবি, কাঁচা পাকা চুলে নতুন পার্ট করা।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে প্রথম মাসি জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবলুবাবু, আপনার কীরকম রান্না পছন্দ?”

“আসলে আমি সব খাই… একসময় চিংড়ি অ্যালার্জি ছিল, কিন্তু প্রেমে পড়ার পর সেটা ঠিক হয়ে গেছে। একবার মাধবীলতা গার্লিক চিংড়ি রাঁধল, তখন থেকে আমি শুদ্ধ চিংড়িপ্রেমিক।”
ঘরে হালকা হাসির রোল উঠল।

দ্বিতীয় মাসি মুখ কুঁচকে বললেন,
“আচ্ছা, আপনি তো অবিবাহিত বললেন? কেন? এতদিন কেন করলেন না?”

বাবলু দা একটু থেমে বললেন,
“আসলে… নিজের মনের মতো কাউকে পাইনি। আর যখন পেয়েছি, তখন বয়স দেখে সবাই বলল, ‘এখন আর সময় নেই।’ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, প্রেমের সময় হয় না। প্রেম সময়কে তৈরি করে।”

এই কথায় মাধবীলতা চা বানাতে বানাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। হাসল না, কাঁদল না—শুধু চোখ একটু চিকচিক করে উঠল।

তৃতীয় মাসি তখন বললেন,
“আপনি কি সকালে তুলসি দিয়ে চা খান, না একেবারে ডিরেক্ট দুধ-চিনি?”

বাবলু দা মুখে হাত দিয়ে ভাবলেন, “এই প্রশ্নও কেউ করে!”
তারপর মাথা চুলকে বললেন,
“সকালটা তুলসি দিয়ে, সন্ধ্যায় দুধ চিনি, আর রাতে মাধবীলতার হাসি।”

ঘরে আবার হাসির হাওয়া। মাধবীলতা এবার একটা ট্রে নিয়ে এল—পাঁপড়ি, সিঙ্গাড়া, চানাচুর, আর ছোট ছোট সন্দেশ।

ঠিক তখনই গোগন কাকু মুখ খুললেন।

“সব প্রশ্ন তো হলই, এবার আমি একটা থিয়োরি বলব—বিয়ে-বিপর্যয় থিয়োরি।”

ঘর হঠাৎ চুপচাপ।

গোগন কাকু বললেন,
“বিয়ে হলো একধরনের ক্রিয়াশীল বিপর্যয়। দুই ভিন্ন মানুষ যখন এক ছাদের নিচে আসে, তখন তাদের চিন্তা, অভ্যাস, অভিমান—সব এক জায়গায় ধাক্কা খায়। যদি এই ধাক্কা সহ্য করার মতো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে সেই বিয়ে ভেঙে পড়ে।”

বাবলু দা গম্ভীর মুখে শুনছিলেন।

গোগন কাকু আরও বললেন,
“তাই আমার থিয়োরি বলে—যে দম্পতি ঝগড়া করতে জানে, তারা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কারণ যারা ঝগড়া করে, তারা মনের কথা বলে। যারা চুপ থাকে, তারা ভিতরে ভিতরে মরতে থাকে।”

সবার চোখ এবার বাবলু দার দিকে। তিনি একটু হাসলেন,
“আমি ঝগড়া পারি না। আমি চুপ করে থাকি। কিন্তু এইবার ভাবছি, কথা বলব—রেগে, ভালোবেসে, না হয় হেসে। কারণ এই বিয়েটা আমি ভাঙতে চাই না।”

সবার মুখে একটা চাপা প্রশংসা। এমনকি গোগন কাকুও খানিকটা নরম।

তখনই প্রবেশ করল নতুন চমক—
ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলেন একজন ৭৫ বছরের বৃদ্ধ—পাতলা ধুতি, ফতুয়া, আর চোখে ধাতব ফ্রেমের চশমা।

“বাবলু?” — তাঁর গলা কেঁপে উঠল।

বাবলু দা ঘুরে তাকালেন।
“জ্যাঠামশাই! আপনি!”

ঘরে সবাই থ। বাবলু দার জ্যাঠামশাই হরিপদ রায়—চাকরির সময়কালে ছিলেন বিখ্যাত স্কুল ইন্সপেক্টর। এখন অবসর জীবন, কিন্তু ভয় ধরানো ব্যক্তিত্ব এখনও অটুট।

“তুই এখানে কি করছিস?”
“জ্যাঠামশাই, আমি… আমি বিয়ে করতে এসেছি।”

হরিপদবাবু চোখ কুঁচকে তাকালেন মাধবীলতার দিকে।
“এটাই সেই মেয়ে?”

মাধবীলতা মাথা নিচু করল।

“তোরা কেউ জানিস, তোর ঠাকুরদার নাম ছিল ‘বিয়েঅভিষেক রায়’? তার বিয়ের দিন দশ মিনিটে তিনবার পাত্রী পালিয়েছিল। তাই আমাদের বংশে কেউ সহজে বিয়ে করে না।”

ঘরের মধ্যে হাসির ধাক্কা। কেউ হাসতে পারল না, কেউ হাসি চেপে চোখ ফাটাল।

বাবলু দা ধীরে ধীরে গিয়ে জ্যাঠার সামনে দাঁড়ালেন।

“জ্যাঠামশাই, এই প্রথমবার আমি কাউকে ভালোবেসেছি। আর এই প্রথমবার আমি বিয়ে করতে চাই, ভয় পেয়ে নয়—ভালোবাসা দিয়ে। আপনি আশীর্বাদ করুন।”

জ্যাঠা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি কি ওকে ভালোবাসো?”

মাধবীলতা ধীরে মাথা নাড়াল।

হরিপদ রায় একটুখানি হাসলেন।
“তা হলে করো বিয়ে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত?” — সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল।

“বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে নিচে লিখতে হবে—
‘বিয়ে হলো বিপর্যয় নয়, দুই জন বোকা মানুষের সাহসী সিদ্ধান্ত।’”

বাবলু দা আর মাধবীলতা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। তারপর একসাথে বললেন—
“ডিল!”

গোগন কাকু পান মুখে গুলে বললেন,
“এই বিয়েতে আমি কনফার্ম—সন্দেশ কম, গোলমাল বেশি হবে!”

বাবলু দা বললেন,
“তাহলে তো জমে যাবে! কারণ আমি এই গোলমালটাকেই ভালোবেসে ফেলেছি।”

অধ্যায় ৬: মেনু, মনোমালিন্য ও মঞ্জুলার মেলোড্রামা

যে দিনটা বাবলু দা কল্পনাও করেননি, সেই দিনটাই এসে গেছে—বিয়ে ঠিক। দিন ঠিক। ভেন্যু ঠিক। কেবল বাকি ছিল… যুদ্ধ।

না, দেশপ্রেমিকের যুদ্ধ নয়, বরং বাঙালি বিয়ের সবচেয়ে জ্বলন্ত যুদ্ধ—কোন আইটেম থাকবে বিয়েবাড়ির মেনুতে?

শুক্রবার সন্ধ্যায়, মাধবীলতার ছাদে, একটা গোল টেবিল ঘিরে বসেছে বিয়ে পরিকল্পনা কমিটি।
দুই পরিবারের সদস্যরা, পিকুল সহ বাবলু দা, আর স্বভাবতই—গোগন কাকু, যিনি আজ এসেছেন একখানা ল্যাপটপ নিয়ে।

“আজ আমরা ঠিক করব বিয়ের খাবার আর বাজেট।” — গোগন কাকু ঘোষণা করলেন।
“এই ল্যাপটপে আছে আমার তৈরি করা ‘বিয়ে বাজেট ক্যালকুলেটর 2.0’। শুধু মেনু ঢোকাও, সঙ্গে সঙ্গে টোটাল খরচ বেরিয়ে আসবে। টাইম সেভিং, মন-বাঁচানো, পকেট-বান্ধব।”

বাবলু দা গম্ভীর মুখে বললেন,
“আমার দাবিটা খুব ছোট—আমার বিয়েতে ‘চিংড়ি মালাইকারি’ চাই।”

পাশ থেকে মাধবীলতার মাসি হুহু করে উঠলেন,
“কি! চিংড়ি! আমাদের বংশে বিয়েতে মাছ মানেই কাতলা। চিংড়ি হলে ডালিতন্ত্র নষ্ট হবে!”

একজন কাকা বললেন, “চিংড়ি দিলে পেট খারাপ হয়। আমার তো বিয়ের দিনই তিনবার গেলাম…”
(বাক্যটা আর শেষ হতে দিল না মাধবীলতা।)

“বাবলু, তুমি চিংড়ি এত ভালোবাসো?”
“মাধবী, আমি চিংড়ি ভালোবাসি না। আমি তোমার রান্না করা চিংড়িটা ভালোবাসি।”

ঘরে মৃদু হাসি। তবে চিংড়ি বিতর্ক এখনও মুছে যায়নি।

তখনই গোগন কাকু ল্যাপটপে টাইপ করে বললেন,
“চিংড়ি রাখলে খরচ বাড়বে—প্রতি প্লেটে ₹৫০ বেশি। মোট গেস্ট ধরেছি ২০০ জন। তাহলে শুধু চিংড়ি বাবদ বাড়তি খরচ ₹১০,০০০।”

সবার চোখ কপালে।

“তা হলে চিংড়ির বদলে মুড়ি ঘণ্ট রাখলে কেমন হয়?” — বললেন এক দিদিমা।

পিকুল মুখ কুঁচকে বলল,
“বিয়ে, না কীর্তন?”

মাধবীলতা বললেন,
“তা হলে কর compromise—মাছ থাকবে কাতলা, কিন্তু বাবলুর জন্যে আলাদা এক বাটি চিংড়ি রান্না করব।”

গোগন কাকু হাত তুলে বললেন,
“এই হলো বিয়ের মূল—স্মার্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট। কেউ হারল না, কেউ জিতল না। কেবল হৃদয় জিতে গেল।”

সবাই হাততালি দিল।
কিন্তু তখনই ঘটল বিপর্যয়।

ছাদের গেট দিয়ে ঢুকল এক মহিলা—চোখে রোদচশমা, হাতে মোবাইল, কাঁধে ডিজাইনার ব্যাগ, আর মুখে আত্মবিশ্বাসের চোঙ্গা।

“বাবলু?” — তার গলা একটু চড়া।

ঘরে থমথমে নীরবতা। বাবলু দা চমকে উঠলেন।
“মঞ্জু!”

মঞ্জুলা শর্মা—বাবলু দার কলেজ লাইফের সেই অতৃপ্ত প্রেম।
যিনি হঠাৎ উড়ে গিয়েছিলেন দিল্লি, তারপর কানপুর, তারপর কোথায় না কোথায়… আর এখন এসেছেন বিয়ের ঠিক আগে।

“তুমি বিয়ে করছ? আমায় না জানিয়েই?”
বাবলু দা ঘামতে লাগলেন।
“মানে… আমি তো ভেবেছিলাম তুমি… আমায় ভুলে গেছো।”

“ভুলে যাই! আমি তো রোজ তোমার ফেসবুক ঘাঁটি, রিলস দেখি, তুমি এখন স্টার! হ্যাশট্যাগ বিয়েডটকম দিয়ে পোস্ট করো, অথচ আমাকে কিছুই বলো না!”

মাধবীলতা এবার ধীর গলায় বললেন,
“দয়া করে বলবেন আপনি কে?”

মঞ্জুলা উত্তর দিল,
“আমি বাবলুর অতীত। এমন অতীত, যা ভুলে গেলে ভবিষ্যত কাঁপে।”

সবাই স্তব্ধ।
গোগন কাকু চশমা মুছলেন।

তখনই বাবলু দা উঠে দাঁড়ালেন।
“মঞ্জু, হ্যাঁ, তুমি ছিলে আমার অতীত। কিন্তু আজ আমার পাশে যে মানুষটা আছে, সে শুধু বর্তমান নয়—ভবিষ্যতের ছাদও।”

“তুমি কি আমায় একটুও ভালোবাসোনি?”
“ভেবেছিলাম ভালোবাসি। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা কী, সেটা মাধবীকে দেখে বুঝেছি।”

মাধবীলতা চুপ। মঞ্জুলা একটু চমকে গেল।

গোগন কাকু ফিসফিস করে বললেন,
“ম্যাডাম, এ প্রেম লাইভ স্ট্রিমে যাচ্ছে না। তাই নাটক বাদ দিন।”

মঞ্জুলা মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় একটা কড়া কথা ছুঁড়ে গেল—
“বাবলু, তুই এখনো বোকাই আছিস… কেবল এবার বোকা প্রেমিক নয়, বোকা বর হচ্ছিস।”

ঘরের নীরবতা আর ফিরল না। কেবল হালকা হাওয়া, পেঁয়াজির গন্ধ আর এক নতুন রকমের বোঝাপড়ার সুবাস ভেসে বেড়াল।

পিকুল নিচু গলায় বাবলু দাকে বলল,
“দাদা, আপনি যদি হিরো হতেন, এই সিনটা সিনেমা হলে উঠত।”

বাবলু দা হাসলেন,
“পিকুল, জীবনই তো এখন সিনেমা। আর আমি সেই সিনেমার accidental hero।”

অধ্যায় ৭: কার্ড বিতরণ, ক্যালিগ্রাফি বিপত্তি ও গোগন কাকুর গবেষণা

কলকাতার ডিসেম্বরে যখন ঠান্ডার মধ্যে কুয়াশা, তখন বাঙালি পরিবারে বিয়ের তপ্ত হাওয়া।

আজ বাবলু দা আর মাধবীলতার বিয়ের কার্ড ছাপা হয়ে গেছে। নকশা করেছেন স্বয়ং পিকুল, যার গ্রাফিক ডিজাইনিংয়ের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল “জলপাইগুড়ি পোস্টার শিল্প উৎসব”-এ, কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল “অজগর স্যারের রিটায়ারমেন্ট পোস্টারে টাইপো” দিয়ে।

কার্ডগুলো দেখতে বেশ রাজকীয়—মহাতারকা ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বর-কনের কার্টুন, নিচে লেখা:

“বিয়েটা আমরা করছি, কিন্তু আতিথেয়তায় আপনিই মুখ্য!”
বাবলু ও মাধবীলতা।

কিন্তু বিপত্তি শুরু হল যখন এক কাকিমা কার্ড হাতে নিয়ে পড়তে গিয়ে বললেন,
“এটা কি লিখেছিস? ‘বিয়ে নয়, বিপর্যয়ের সাহসী সিদ্ধান্ত’? এটা তো জ্যাঠামশাই বলেছিলেন মজা করে! এটা কি সত্যিই ছেপে দিয়েছিস?”

বাবলু দা মাথা চুলকালো,
“মানে আমি ভাবলাম ওই লাইনটা আলাদা, অরিজিনাল—জাস্ট টাচ অফ হিউমার।”

কাকিমা চিৎকার,
“তোর বিয়েতে লোকে হাসবে, না কাঁদবে? বিয়ে তোয়াটা কমেডি ক্লাব?”

পিকুল গম্ভীর গলায় বলল,
“দিদি, এটা কিন্তু edgy কনসেপ্ট—Gen-Zদের কাছে হিট হবে।”

“জেন জি কে? বউয়ের মামার নাম?”
— বলে এক মাসি চায়ের কাপ ঠেলে দিলেন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে এলেন গোগন কাকু, যিনি সদ্য রিসার্চ শেষ করেছেন।

“আপনাদের সবাইকে জানাতে পেরে আমি গর্বিত,” তিনি বললেন, “আমি তৈরি করেছি এক রিপোর্ট:
‘শুভবিবাহ বিশ্লেষণ: ১৯৮০–২০২৪’।”

সবার মুখ হাঁ!

গোগন কাকু ল্যাপটপ খুলে বোর্ডে প্রজেকশন দিলেন। স্লাইড ১:

> বাঙালি বিয়ের ধরনবদল পরিসংখ্যান
১. কাতলা মাছ: ৯৫% (১৯৮০) → ৬৫% (২০২৪)
২. ল্যাবরা vs আলুভাজা বিতর্ক: নিরসীম
৩. গানবাজনা: অচিরেই ডিজে ও ঢাকের ফিউশন

বিয়ে সফল হওয়া না হওয়া নির্ভর করে কার্ডের কভার ডিজাইনের উপর না। নির্ভর করে দাম্পত্যের উপর।

“এই যুগে যদি বর-কনে নিজেদের মনের মতো কার্ড বানাতে না পারে, তাহলে বিয়েটা সারাজীবন কপালভাগ্যই থাকবে।”

সবার মুখ গম্ভীর। কাকিমা একটু শান্ত।

ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটল—মাধবীলতার এক সহকর্মী মীনাক্ষী এল চায়ের নিমন্ত্রণে।

কার্ড দেখে সে বলল,
“ওয়াও! এটা তো পুরোটাই ভাইরাল হবে! দিদি, আমি এটা ইনস্টাতে পোস্ট দিচ্ছি! #Biyebiporjoy #BabluWedsMadhabi”

পিকুল বলল,
“তুই পোস্ট কর! আমি এখনই QR কোড তৈরি করে দিচ্ছি কার্ডের কোণায়, যাতে লোকে RSVP করতে পারে ডিজিটালি!”

কেউ বলল, “RSVP মানে?”

পিকুল: “মানে, RSVP—‘রসগোল্লা সঙ্গে ভেটকি পাওয়া’!”

হাসির বন্যা। এমনকি কঠিন মুখ করা কাকিমাও হেসে ফেললেন।

পরদিন থেকে শুরু হল কার্ড বিতরণ অভিযান। বাবলু দা ও মাধবীলতা হাত ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন—শ্যামবাজার, হাতিবাগান, গড়িয়া। এক কার্ড দিতে গিয়ে এক আত্মীয় বললেন,
“তুই তোর দাদার মতো দেখতে, কিন্তু এত সাহস কবে হল?”

এক জায়গায় গিয়ে এক বৃদ্ধ আত্মীয় বললেন,
“তোদের বিয়ের কার্ডটা আমার মকবুল হোসেনের আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছে!”

বাবলু দা জিজ্ঞেস করলেন, “মানে সুন্দর?”

“না, মানে বোঝা যায় না।”

বাড়ি ফিরে এসে বাবলু দা বললেন,
“মাধবী, আমরা কি একটু বেশি জোকার হয়ে যাচ্ছি?”

মাধবীলতা হাসলেন,
“না, আমরা আসলেই যে কেমন, সেটাই হচ্ছি। এটাই সবচেয়ে বড় সাহস।”

সেই রাতে গোগন কাকু তাঁদের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন।

“এটা তোমাদের জন্য। আমি লিখেছি এক পংক্তি, বিয়ের দিন গেটের সামনে ঝুলিয়ে দিও।”
খাম খুলে বাবলু দা দেখলেন:

“হাসতে হাসতেই বাঁধা পড়ুক, এই পাগলপারা জোড়া
নইলে বিয়ে হবে, কিন্তু গল্প হবে না।”

অধ্যায় ৮: মেহেন্দি, মাইক্রোফোন, আর মধুরতম ম্যারেজ মেলোডি

কলকাতার শীতের সন্ধ্যে। আকাশে রংধনুর মতো আলো, বাগানঘেরা বাড়ির উঠোনে আলো-দেওয়া শামিয়ানা, আর মঞ্চের উপর ঝুলছে এক বিশাল ব্যানার:

“বাবলু দার বিয়ে.কম – Live from Lake Town”

মঞ্চে ডিজে বক্স, পাশে বাঙালি ঢাকির দল, মাঝখানে বসলেন গোগন কাকু। মুখে চওড়া হাসি, হাতে একখানা মাইক।
“এটা কোনো সাধারণ মেহেন্দি নয়, এটা হলো ‘সংগীত সন্ধ্যার সিঙ্গিং সার্কাস’। সবাই গান গাইবে, নাচবে, আর কে কতটা ‘বিয়ে-উপযুক্ত’ প্রমাণ করতে পারে—তা দেখাবে!”

প্রথমে মঞ্চে উঠলেন মাধবীলতার জেঠিমা। তিনি গাইলেন পুরনো বাংলা সিনেমার গান—
“ও পাগলা বাবু, রঙিন কাপড় পরো না গো…”

পাশ থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল,
“এই গানটা তো বিয়ের জন্য না, মানসিক হাসপাতালে ভালো মানায়।”

এরপর মঞ্চে উঠলেন বাবলু দার মেসোমশাই, যিনি জীবনে প্রথমবার কন্যাসংগীত শুনে বলেছিলেন, “মেয়েরা এত করুণ গান গায় কেন?”
তিনি গাইলেন –
“দুঃখ ভোলো, পাত্র খোঁজো, শুভবিবাহের ডাক…”
তাল-বেতাল হোক, সবাই হাততালি দিল।

কিন্তু মঞ্চে ঝড় উঠল যখন এলেন—গোগন কাকু নিজের লেখা র‍্যাপ নিয়ে। মাইক হাতে বললেন:

“বিয়ে মানে চা-জলখাবার,
নয় তো কেবল ফেসবুক অ্যাভতার!
এটা জীবনের সফটওয়্যার আপডেট,
পিকুল দিচ্ছে ডিজাইন, আমরা করছি ডেট!”

পিকুল ঝাঁপিয়ে উঠে চিৎকার করল,
“Uncle, you killed it!”

তবে সবাই অপেক্ষায় ছিল একটাই মুহূর্তের জন্য—বাবলু দা’র গানের ডেবিউ।
তিনি গিটার হাতে মঞ্চে উঠলেন।
“এই গানটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আর সবচেয়ে বড় সত্যিকে নিয়ে।”

গান শুরু হল – “তুমি এসেছিলে হঠাৎ, ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট দিয়ে,
আমি ভেবেছিলাম স্ক্যাম—হয়তো কোন জাল মেয়ে।
তারপর রিলসে দেখি তুমি ডান্স করো হ্যাপি,
আর আজ আমি বিয়ে করছি, With this WhatsApp-lovey-dovey!”
লোকজন হেসে লুটোপুটি। মাধবীলতা সামনের সারিতে বসে অঝোরে হাসছেন।
পিকুল বলল,
“এটা আমি ভাইরাল করে দেব, ‘বাঙালি বর গায় ব্রাইডকে—সংগীত থেকে সেলিব্রেটি’।”

ঠিক তখনই বেজে উঠল ফোন।

“Breaking News!” — বলল মঞ্চের কোণে বসে থাকা পাড়ার ইউটিউবার সুলেখা বৌদি।
“আমার চ্যানেল থেকে এখনই লাইভ হচ্ছি—‘বাবলু দার বিয়ে.কম’ এখন OTT রিলিজের পথে! নেটফ্লিক্স না হোক, অন্তত ‘নেট-বৌদি’ প্ল্যাটফর্মে তো হিট হবে!”

সবাই হেসে গড়াগড়ি।

কিন্তু ঠিক এমন সময় এক জোড়া অচেনা গাড়ি ঢুকল উঠোনে। সবাই চুপ।

গাড়ি থেকে নামল এক দল অফিসারসুলভ পোশাকপরা লোক।
“কে বাবলু সিংহ?”
বাবলু দা চমকে বললেন, “আমি।”

“আমরা আয়কর দপ্তর থেকে এসেছি। গত তিনমাসে আপনার ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার এক লাখ ছাড়িয়েছে। আয় হয়েছে অন্তত ₹৩ লক্ষ স্পনসরড পোস্ট থেকে। আপনি কি ইনকাম ট্যাক্স ফাইল করেছেন?”

সবাই স্তব্ধ।

তখনই গোগন কাকু সামনে এগিয়ে বললেন,
“উনি এখন বর। বিবাহীত অবস্থায় মানুষের ওপর ট্যাক্স চাপানো বিধিসম্মত প্রেমবিরোধী কাজ।”

এক অফিসার বললেন,
“এটা কোনো আইন নয়।”

গোগন কাকু গম্ভীর গলায় বললেন,
“তবে এটা আবেগের আইন। যেটা লিখে রাখিনি, কারণ আমরা ভালোবাসায় বিশ্বাস করি, ব্যালান্স শিটে না।”

অফিসাররা হেসে বললেন,
“আপনারা অসাধারণ। আচ্ছা, আমরা বিয়েতে থেকেও যেতে পারি? কাতলা আছে তো?”

“চিংড়িও আছে!” — বলল মাধবীলতা।

বিয়ের আগের রাতটা শেষ হল চা, চপ, গানে গানে।
পিকুল বলল,
“এই গল্পটা শেষ নয়। বরং শুরু।”

বাবলু দা মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, আর আমাদের গল্পটার টাইটেল একটাই—বাবলু দার বিয়ে.কম।”

সমাপ্ত

 

1000023619.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *