Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

বাতাসের ফিসফিসানি

Spread the love

দেবাশিস রায়


পুরোনো নদীর ঘাটটি এখন যেন সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া একটি জায়গা। দিনের বেলায়ও মানুষের পদচারণা খুবই কম, রাতে তা যেন আরও একাকী হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের তীব্র রোদ কিংবা বর্ষার ঝড়—সবকিছু মিলিয়ে ঘাটের কাঠের ডেক, ছেঁড়া দোলনা, এবং ভাঙা নৌকা-সবকিছুই অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। নদীর ধারে ধুলো মিশ্রিত কাদামাটি, নরম বাতাসে পানি ধীরে ধীরে ধোঁয়া হয়ে ওঠে, আর নীরবতা এতটাই ঘন যে মাঝে মাঝে দূরের জঙ্গলের পাতা হেলানো শব্দও স্পষ্ট মনে হয়। রাতের অন্ধকারে ঘাট যেন এক রহস্যময় স্থান, যেখানে সময় থেমে গেছে—প্রতিটি সোপান, প্রতিটি নৌকা যেন অতীতের কোনো গল্পের সাক্ষী। অরুণ, একমাত্র নৌকাওয়ালা, এখানে দিনরাত কাটায়। সে নিজেকে এই খেয়াঘাটের অংশ মনে করে; প্রতিটি বাঁকা পথ, প্রতিটি নৌকার ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠের শব্দ তার কাছে পরিচিত। মানুষজন তাকে প্রশ্ন করলে, সে শুধু হেসে বলে, “আমি এখানেই থাকি। এই নদীই আমার ঘর।”

অরুণের জীবন নিঃসঙ্গ কিন্তু শান্ত। সে নদীর গতিবেগ, বাতাসের হাওয়া, জলের তরঙ্গ—সবকিছুই গভীরভাবে বুঝতে পারে। মানুষের উপস্থিতি খুব কম, তাই সে দিনভর নদী এবং ঘাটের সাথে একাকী সময় কাটায়। রাতে নদীর ওপর চাঁদের প্রতিফলন দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মনে মনে ভাবেন—এই নিস্তব্ধতায় কত গল্প লুকিয়ে আছে। হঠাৎ, এক গভীর রাতে, সে বাতাসে কিছু ভেসে আসে—হলুদ আলোতে নদীর প্রতিফলন যেন নড়াচড়া করছে। আর তখনই সে প্রথমবার অনুভব করে, কোনো কণ্ঠস্বর যেন নদীর ঢেউয়ের সাথে মিলিয়ে তাকে ডাকছে। “আমাকে ওপারে নিয়ে চল…” শব্দটি এত মৃদু, কিন্তু এতটাই আকর্ষণীয় যে অরুণের হৃদয় দ্রুত ধড়কতে থাকে। সে বুঝতে পারে এটি কোনো স্বাভাবিক কল্পনা নয়; এটি যেন এক অচেনা মহিলার আহ্বান, যা তার জীবনে এক অদ্ভুত ভয় এবং আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়।

কণ্ঠস্বরের প্রতি আগ্রহ এবং ভয় মিশ্রিত অনুভূতিতে অরুণ নৌকায় উঠে বসে। নদী যেন তার প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। বাতাসের হালকা ছোঁয়া, জলের স্রোত, এবং নীরবতা—সব মিলিয়ে এক ভিন্ন ধরনের বাস্তবতা তৈরি করছে। অরুণ শোনে প্রতিটি শব্দের প্রতিধ্বনি, এবং মনে মনে প্রার্থনা করে যেন সে কোনো ভুল বোঝাবুঝিতে আছন্ন না হয়। নদীর অন্যপাড়ে কি আছে, কে ডাকছে—এই প্রশ্ন তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভয়কে জন্ম দেয়। ঘাটের নিস্তব্ধতা, ভাঙা নৌকা, অন্ধকার, সবকিছু মিলিয়ে যেন একটি রহস্যময় পৃথিবী তৈরি করছে, যেখানে অরুণ এক অচেনা, অদৃশ্য জগতের প্রবেশদ্বারকে স্পর্শ করতে চলেছে। রাতের অন্ধকারে, নদী এবং কণ্ঠস্বরের মধ্যে, অরুণের জীবন যেন নতুন গল্পের দিকে ধাবিত হচ্ছে—একটি যাত্রা যা তাকে একাকীত্ব থেকে অজানা রহস্যের দিকে নিয়ে যাবে।

অরুণের রাতের অভিজ্ঞতা তাকে এক অদ্ভুত আতঙ্ক এবং কৌতূহলের মধ্যে ফেলে দেয়। কণ্ঠস্বরটি যেন তার মনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে—মৃদু, আকর্ষণীয়, কিন্তু এক ধরনের অদ্ভুত ভয়ও সৃষ্টি করছে। সে দিনরাত নদীর ধারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে, চোখে জলবিন্দু, হৃদয়ে অস্থিরতা। এক সময় নদীর জলের নীরব ঢেউয়ের মধ্যে কণ্ঠের প্রতিধ্বনি স্পষ্টভাবে শুনতে পায়, কিন্তু কারো দেখা মেলে না। ঘাটের প্রতিটি নৌকা, প্রতিটি ছেঁড়া কাঠ, প্রতিটি ঘাটের পাথর যেন অতীতের কোনো গল্প ফিসফিস করছে। অরুণের মনে ভয় এবং উত্তেজনা একসাথে জেগে ওঠে—ভয় যেন তাকে পিছু হটতে বাধ্য করছে, আর কৌতূহল তাকে আরও কাছে টেনে আনছে। রাতের নিস্তব্ধতা, হাওয়ার ঝাপটা, নদীর ধীর স্রোত—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটি অদ্ভুত জাদুর পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা অরুণকে তার সীমারেখার বাইরে নিয়ে যেতে চায়।

এদিকে, গ্রামের মানুষজনও এই রহস্য নিয়ে কানাঘুষো করছে। খেয়াঘাটে রাতের বেলায় অশান্ত আত্মা দেখা যায়—এমন গল্প তারা রাতভর একে অপরকে বলছে। কেউ কেউ বলছে, নদীর ওপারে কোনো দুঃখী আত্মা বন্দি আছে, আর কেউ বলছে, ঘাটের নৌকায় অজানা শক্তি কাজ করছে। ছোটাছুটি করা শিশুরা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা—সবাই এক ধরনের অদ্ভুত আতঙ্কে ঘাট থেকে দূরে থাকে। অরুণ শুনতে পায় গ্রামের একাংশ মানুষ মৃদু মৃদু এই কণ্ঠের কথার উল্লেখ করছে। কেউ বলছে, “রাতের বেলায় ঘাটে যেও না, ওখানে আত্মা আসে।” আবার কেউ ইঙ্গিত দেয়, “এক সময় এখানে কোনো মেয়ের করুণ মৃত্যু হয়েছে, তাই হয়তো এখনও সে ফিরে আসে।” এই গুঞ্জনের মধ্য দিয়ে অরুণের মনে উত্তেজনা আরও বাড়ে—কৌতূহল কি ভয়কে পরাস্ত করতে পারবে, নাকি এটিকে আরও গভীর করবে?

এবই অচেনা কণ্ঠের রহস্যের প্রথম ইঙ্গিত দেয় বৃদ্ধা সরলা। গ্রামের সবচেয়ে অভিজ্ঞ, স্মৃতিশক্তি প্রবল এই নারী একদিন হঠাৎ অরুণকে ডাকেন। চোখে অদ্ভুত গভীর দৃষ্টি, এবং কণ্ঠে কম্পন নিয়ে তিনি বলেন, “মেঘলা… নামটি মনে রেখো। অনেক দিন আগে এখানে এক করুণ কাহিনী ঘটেছিল, যা আজও নদীর ধারে ভেসে বেড়ায়।” সরলার কথায় এক রহস্যময় অতীতের ছায়া অরুণের মনে ঘন হয়ে ওঠে। মেঘলা—এই অজানা নামটি, এক অদ্ভুত কণ্ঠের সাথে মিলিয়ে অরুণের মনের ভেতর অজানা প্রশ্ন এবং উত্তেজনার জন্ম দেয়। কে এই মেঘলা? তার অতীত কি এই কণ্ঠের সঙ্গে জড়িত? অরুণের মনে ধীরে ধীরে একটি সংকল্প গড়ে ওঠে—সে এই রহস্যের মূলে পৌঁছাবে, যেভাবে বা যাই হোক, ঘাটের নিস্তব্ধতার আড়ালে লুকানো সত্য উন্মোচিত হবে।

গ্রামের শান্ত নদীর ধারে এক নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে কিরণ নামের তরুণ অনুসন্ধানকারীর আগমনের সঙ্গে। শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে, কিরণ গ্রামের পুরোনো লোককথা, রহস্য এবং অজানা গল্পের সন্ধানে এসেছে। তার হাতে ক্যামেরা, নোটবুক, এবং কৌতূহলের অদম্য আগ্রহ—সব মিলিয়ে সে যেন একটি প্রস্তুত যাত্রী, যে অতীত এবং বর্তমানের সীমারেখা ছুঁতে চায়। গ্রামের মানুষজন প্রথমে তাকে অবাক চোখে দেখে, কারও কারও মধ্যে সন্দেহ, আবার কারও মধ্যে কৌতূহল। কিন্তু কিরণের দৃষ্টি এবং ভদ্র আচরণ ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষকে তার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। সে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে আসে, যেখানে অরুণ দিনের পর দিন একাকী নৌকায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

খেয়াঘাটে পৌঁছানোর পর, কিরণ তার ক্যামেরা খুলে প্রতিটি নৌকা, ঘাটের ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠ এবং নদীর ধীর স্রোত শট করে। তিনি নোটবুকে প্রতিটি শব্দ, গুঞ্জন এবং বাতাসের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা গল্প লিখতে থাকেন। সেই সময় অরুণ নীরবভাবে তাকিয়ে থাকে—একদিকে তার ভয়, অন্যদিকে কৌতূহল তাকে কিরণের কাছাকাছি নিয়ে আসে। কিরণ বিনয়ের সঙ্গে অরুণের সঙ্গে আলাপ শুরু করে, গ্রামের ইতিহাস এবং ঘাটের রহস্য সম্পর্কে জানতে চায়। অরুণ প্রথমে দ্বিধায় থাকে, মুখে এক অচেনা ভয়, চোখে অল্প অপরিষ্কৃত উদ্বেগ। কিন্তু কিরণের আন্তরিকতা এবং আগ্রহ তাকে একটি ছোট টুকরো সত্য জানানোর সাহস জোগায়।

অরুণ কণ্ঠস্বরের রহস্য, গ্রামবাসীর গুঞ্জন, এবং মেঘলার নামের ইঙ্গিতটি কিরণের সামনে অল্প অল্প করে খুলে দেয়। সে জানায়, “রাতের বেলায় কিছু ভেসে আসে—শুধু আমি শুনি, কেউ দেখেনি।” কিরণ মনোযোগ দিয়ে শোনে, নোটবুকে লেখে এবং ক্যামেরার লেন্সে সেই নিস্তব্ধ ঘাটকে ধারণ করার চেষ্টা করে। তারা দু’জন ধীরে ধীরে নদীর ধারে বসে গল্পের আড্ডা দেয়, যেখানে কল্পনা, আতঙ্ক, এবং বাস্তবতার সীমারেখা মিশে যায়। অরুণের দ্বিধা এবং কিরণের আগ্রহ এক ধরনের রহস্যময় বন্ধন গড়ে তোলে, যা এই খেয়াঘাটের গভীরতা এবং অচেনা কণ্ঠের রহস্যের দিকে ধীরে ধীরে নেয়। রাতের নীরবতা, বাতাসের ফিসফিসানি, এবং নদীর স্রোতের শব্দ—সবকিছু যেন তাদের আলোচনার সাক্ষী, এবং নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘোষণা করে।

বৃদ্ধা সরলা কিরণের সামনে বসে ধীরে ধীরে মেঘলার কাহিনী খুলতে শুরু করে। তার চোখে এক ধরনের বিষাদের আভা, আর কণ্ঠে অতীতের গভীর দুঃখের প্রতিধ্বনি। সরলা জানায়, মেঘলা এক সময় পুরো গ্রামের প্রাণ ছিল—তার হাসি, খেলা, ও উদার স্বভাব গ্রামের প্রতিটি মানুষের মনে আনন্দ বয়ে আতো। সবাই তাকে ভালোবাসত, তার উপস্থিতি যেন গ্রামের নিস্তব্ধ দিনগুলোকেও জীবন্ত করে তুলত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ও মানবিক দুর্বলতা মেঘলার ভাগ্যকে একটি অন্ধকার পথে নিয়ে যায়। যে মানুষকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করত, তার কারণে মেঘলা গভীর বিশ্বাসঘাতকের শিকার হয়, এবং গ্রামে একটি করুণ ঘটনা ঘটে যা তার জীবনকে চিরতরে পরিবর্তিত করে। সরলার কথায় যেন অতীত জীবনের ছায়া ঘাটের বাতাসে ভেসে আসে, প্রতিটি শব্দ নদীর ধীরে ধীরে চলা জলের সঙ্গে মিশে কিরণের মনে গভীরভাবে প্রবেশ করে।

কিরণ শোনে এবং তার কানে প্রতিটি শব্দ যেন আলাদা রকমের গুঞ্জন সৃষ্টি করে। সরলা বর্ণনা করেন, কিভাবে মেঘলার প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা এবং পরিণতির কাহিনী গ্রামের মানুষদের মনে এক অদ্ভুত আতঙ্কের বীজ রোপণ করেছিল। গ্রামবাসীর মধ্যে যারা তাকে চিনত, তারা মেঘলার কথা বললে এক ধরনের নীরবতা বিরাজ করত। কিরণ ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে কেবল গল্পই নয়—এই ঘাট, নদীর জল, এবং বাতাসের মধ্যেই মেঘলার স্মৃতির ছায়া এখনও বেঁচে আছে। সরলা এমনভাবে বর্ণনা করেন যে কিরণ মনে মনে শিউরে ওঠে; মনে হয়, কাহিনী যেন তার নিজের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি কথা, প্রতিটি ব্যথার আভাস কিরণের হৃদয়ে এক অদ্ভুত আবেগ জাগায়—যেন সে নিজেও সেই করুণ ঘটনায় অংশগ্রহণ করছে।

রাতের নীরবতা আরও ঘন হয়ে আসে। হঠাৎ, বাতাসের মধ্য দিয়ে ভেসে আসে এক হালকা, মৃদু কান্নার শব্দ। কিরণ চমকে ওঠে; সে প্রথমে মনে করে নিজের কল্পনা বা বাতাসের ফিসফিসানি, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে শব্দটি এতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সে নিশ্চিত হয়—এটি কোনো কল্পনা নয়। নদীর ওপারে, ঘাটের পাশে, যেন কেউ সত্যিই তাকে ডাকছে। কিরণ দ্রুত নোটবুক খুলে শব্দটি লিখতে থাকে, ক্যামেরার লেন্স দিয়ে চারপাশের অন্ধকার ধরা শুরু করে। সরলার চোখে তখন এক অদ্ভুত দৃষ্টি—সে জানে, কিরণ সত্যিই মেঘলার গল্পের গভীরে প্রবেশ করেছে। বাতাসে ভেসে আসা কান্নার শব্দ, সরলার বর্ণনা, এবং ঘাটের নিস্তব্ধতা—সবকিছু মিলিয়ে কিরণকে এমন এক রহস্যময় বাস্তবতার মধ্যে টেনে নিয়ে যায়, যা তাকে মেঘলার করুণ অতীত এবং তার স্মৃতির ছায়ার একান্ত সাক্ষী বানায়।

গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেদ করে অচেনা অদ্ভুত উপস্থিতি—রঘু। সে গ্রামে নতুন নয়, কিন্তু গ্রামের মানুষজনের কাছে সে সবসময় একাকী এবং রহস্যময়। কেউ তার সঙ্গে বেশি কথা বলে না, কেউও তার মুখোমুখি হতে চাই না। সে যেন এক অদ্ভুত ছায়া, যা সব সময় গ্রামের মানুষের চোখের কোণায় থাকে, কিন্তু সরাসরি দেখা যায় না। তার চোখে একটি অদ্ভুত উৎকণ্ঠা, এবং পদক্ষেপে যেন কোনো অজ্ঞাত আশঙ্কা লুকানো। কিরণ প্রথমবার যখন রঘুকে লক্ষ্য করে, সে ধীরে ধীরে তার অদ্ভুত আচরণ ও চলাফেরার পেছনে রহস্য খুঁজতে থাকে। রঘু প্রায় সব সময় খেয়াঘাটের দিকে আসে, নৌকাগুলোর পাশে দাঁড়ায়, অথচ কাউকে কিছু বলে না। তার এই অদ্ভুত উপস্থিতি কিরণের জন্য কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।

কিরণ লক্ষ্য করে, রঘুর চোখে এক ধরনের অস্থিরতা সব সময় ভেসে ওঠে—যেন সে নিজের অতীতকে খুঁজছে বা চেপে রাখা কোনো সত্যকে লুকানোর চেষ্টা করছে। তার আসা-যাওয়া, ঘাটে দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো এবং নৌকার দিকে তাকানো—সবকিছুই একটি অদ্ভুত ধাঁধার মতো। কিরণ তার নোটবুকে প্রতিটি ঘটনা লিখে রাখে, প্রতিটি ছোট ছোট অভ্যাস লক্ষ্য করে। রঘুর মধ্যে কিছু অজ্ঞাত করুণতা আছে—যা গ্রামবাসী কখনও বুঝতে পারে না, কিন্তু কিরণ তার সূক্ষ্ম নজরে তা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ঘাটের নিস্তব্ধ রাতগুলোতে রঘুর ছায়া যেন মেঘলার স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে আসে, যা কিরণকে একটি অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে।

ধীরে ধীরে কিরণ ইঙ্গিত পায় যে রঘুর পরিবারের সঙ্গে মেঘলার মৃত্যুর একটি রহস্যময় যোগসূত্র আছে। সরলা, গ্রামের মানুষজনের গুঞ্জন, এবং রঘুর আচরণ—সব মিলিয়ে একটি অন্ধকার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রঘু নিজেকে গোপন রাখে, কিন্তু তার চোখে, ভঙ্গিতে এবং অস্থির পদক্ষেপে এক ধরণের অপরিস্কার সত্যের প্রতিফলন কিরণ স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারে। নদীর ধারে, খেয়াঘাটের নিস্তব্ধতায়, রঘু যেন এক জীবন্ত রহস্য হয়ে দাঁড়ায়, যা মেঘলার করুণ অতীতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কিরণ বুঝতে পারে যে এই রহস্যের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া সে মেঘলার সত্য ও গ্রামের ইতিহাসের গভীরতা অন্বেষণ করতে পারবে না। রাতের হিমবাহী হাওয়া, নদীর ফিসফিসানি, এবং রঘুর অদ্ভুত অস্থিরতা—সবকিছু মিলিয়ে কিরণকে একটি নতুন অধ্যায়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে সে গ্রাম এবং মেঘলার করুণ অতীতের সাথে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হতে চলেছে।

রাতের নিস্তব্ধতায় খেয়াঘাটের অন্ধকার যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে। কিরণ একা, ক্যামেরা ও নোটবুক রেখে নদীর ধারে বসে সত্য খুঁজতে থাকে। বাতাসের হালকা ফিসফিসানি, জলের ধীর স্রোত, এবং ঘাটের ভাঙা কাঠের আওয়াজ—সবকিছু এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করছে। কিরণ জানে, রাতের এই নিস্তব্ধতায় মেঘলার রহস্যের কোনো আভাস মিলতে পারে, কিন্তু তার ভয়ও কম নয়। হৃদয় ধুকধুক করছে, হাত কাঁপছে, তবু সে থেমে নেই। সে স্থির হয়ে চোখ রেখে নদীর অপর পাড়ের অন্ধকার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, প্রত্যেকটি ছায়া, প্রতিটি প্রতিফলন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

হঠাৎ, কিরণ প্রথমবার স্পষ্টভাবে অনুভব করে ছায়ার মতো মেঘলাকে। ভেজা শাড়ি, চোখে জল, এবং ঠোঁটে একটাই অনুরোধ—“আমাকে ওপারে নিয়ে চল…”। কিরণ চমকে ওঠে; তার হৃদয় কেঁপে ওঠে ভয় এবং বিস্ময়ের মিলিত আবেশে। বাতাসের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা শব্দ, নদীর ধীর স্রোত, এবং মেঘলার অদ্ভুত উপস্থিতি—সবকিছু একত্রিত হয়ে তাকে এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। সে বুঝতে পারে, মেঘলা শুধু অতীতের স্মৃতি নয়; সে যেন নদীর ধারে জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছে, তার করুণতা ও আকাঙ্ক্ষা কিরণের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।

কিরণের ভয় যত বাড়ে, সত্য জানার আকাঙ্ক্ষাও তত প্রবল হয়। সে ধীরে ধীরে মেঘলার দিকে এগিয়ে আসে, শরীর কেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, এক অদ্ভুত শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মেঘলার চোখের দুঃখ, শাড়ির ভেজা ছাপ, এবং ঠোঁটের অনুরোধ—সবকিছু কিরণের মনে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। সে বুঝতে পারে, এই মুহূর্তে সে একমাত্র মানুষ যিনি মেঘলার করুণ ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারছেন। রাতের অন্ধকার, বাতাসের ফিসফিসানি, নদীর জলের প্রতিফলন, এবং মেঘলার ছায়া—সব মিলিয়ে কিরণকে এমন এক রহস্যময় বাস্তবতার মধ্যে টেনে নিয়ে যায়, যা তাকে জীবনের এক গভীর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং রহস্য উন্মোচনের পথে প্রবল আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।

বৃদ্ধা সরলার কণ্ঠে ধীরে ধীরে মেঘলার করুণ ইতিহাস উন্মোচিত হতে শুরু করে। কিরণ অবাক চোখে শোনে, চোখে জলের আভা এবং হৃদয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। সরলা জানায়, মেঘলা এক তরুণ নৌকাওয়াল—যার নাম বহু বছর ধরে কেউ ভুলে গেছে—তার প্রেমে পড়েছিল। তারা নদীর ধারে, খেয়াঘাটের তীরে, অজস্র দিন কাটাত, হেসে খেলত, স্বপ্ন বুনত। কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী জমিদার, যার সম্পদ ও ক্ষমতা গ্রামের প্রতিটি জীবনে প্রভাব ফেলত, মেঘলাকে নিজের বউ করতে চাইলে বিরোধ জন্মায়। প্রেম এবং শক্তি, স্বাধীনতা এবং শাসন—সবকিছু এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে মিলিত হয়। জমিদার মেঘলার চাহিদাকে অস্বীকার করে, এবং তার প্রভাবশালী পদক্ষেপ গ্রামের নিস্তব্ধতার আড়ালে এক অন্ধকার ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়।

এক রাত, সেই অন্ধকারে, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মেঘলার জীবন শেষ হয়ে যায়। নদীর ধারে তার মৃত্যু ঘটে, যেটি গ্রামের সকলের জন্য ছিল এক অদ্ভুত ধাক্কা। কেউ স্পষ্টভাবে জানে না, কে সত্যিই এতে ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু গুঞ্জন ও ছায়া এক অদ্ভুত ভয় তৈরি করে। সরলা কিরণকে জানায়, মেঘলার মৃত্যুর পেছনে যে ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল, তার ছায়া আজও খেয়াঘাটের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। নদীর জলের প্রতিফলন, বাতাসের হালকা ফিসফিসানি, এবং রাতের নিস্তব্ধতা—সবকিছু মিলিয়ে একটি করুণ, ভয়ঙ্কর ইতিহাসকে বয়ে আনে। কিরণ এই সমস্ত তথ্য নোটবুকে লিখে রাখে, ক্যামেরার লেন্স দিয়ে নদী এবং ঘাটের অন্ধকারে তার উপস্থিতি ধারণ করতে চেষ্টা করে।

ধীরে ধীরে কিরণ বুঝতে পারে, এই অন্ধকারের মূল উত্তরাধিকার বহন করছে রঘু। সরলা ইঙ্গিত দেয়, যে রঘু জমিদারের বংশধরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এবং তার অস্থিরতা, ঘাটের কাছে আসা-যাওয়া, এবং একাকীত্ব—সবই মেঘলার করুণ অতীতের সঙ্গে যুক্ত। রঘু শুধু এক ব্যক্তি নয়; সে সেই ইতিহাসের জীবন্ত প্রতিফলন, যা আজও গ্রামবাসীর মধ্যে এক অদ্ভুত রহস্য ও ভয় ছড়াচ্ছে। কিরণ উপলব্ধি করে যে, মেঘলার সত্য এবং রঘুর সম্পর্কের রহস্য জানার মধ্য দিয়ে সে শুধু অতীতের করুণতা বুঝবে না, বরং বর্তমানের অন্ধকারের উৎসকেও উদঘাটন করতে পারবে। রাতের অন্ধকার, বাতাসের ফিসফিসানি, নদীর ধীর স্রোত, এবং রঘুর অস্থির ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে কিরণকে এক গভীর, রহস্যময় এবং করুণ ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

রাতের গভীর নিস্তব্ধতায় কিরণ নৌকায় চড়ে নদীর ধারে দাঁড়ায়। তার হাতে ক্যামেরা নেই, শুধু নোটবুক এবং মনের গভীর সংকল্প—মেঘলার আত্মাকে ওপারে নিয়ে যাওয়া। বাতাস এক অদ্ভুত স্থিরতা নিয়ে আসে, নদীর জলের স্রোত নিঃশব্দ হয়ে যায়, এবং চারপাশের ঘাট যেন নিজেকে ধরে রাখছে। কিরণ ধীরে ধীরে নৌকা চালিয়ে মেঘলার ছায়ার মতো উপস্থিতির দিকে এগিয়ে আসে। মেঘলার চোখে কান্নার আভা, ঠোঁটে এক অদ্ভুত অনুরোধ—“আমাকে ওপারে নিয়ে চল…”—শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিরণের হৃদয় ভয়ে ও উত্তেজনায় কেঁপে ওঠে। সে জানে, এই যাত্রা শুধু নদীর ওপারে পৌঁছানোর নয়, বরং অতীতের করুণ ইতিহাসের সঙ্গে একান্ত মুখোমুখি হওয়ার।

নৌকা ধীরে ধীরে নদীর মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে। বাতাস থেমে যায়, নদীর ঢেউ শান্ত হয়, এবং কিরণ অনুভব করে মেঘলার উপস্থিতি যেন নদীর সাথে মিশে যাচ্ছে। শব্দটি ক্রমশ কমতে থাকে, যেন কণ্ঠটি নদীর গভীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিরণ মনে মনে প্রার্থনা করে যেন মেঘলা অবশেষে শান্তি পায়। তার হাত কাঁপছে, চোখে অশ্রু, কিন্তু মনে একটি অদ্ভুত তৃপ্তি কাজ করছে—মেঘলার আত্মাকে সত্যিই মুক্তি দিতে পারার সম্ভাবনা। নদীর হালকা প্রতিফলন, চাঁদের আলো, এবং নীরবতার মধ্য দিয়ে কিরণ অনুভব করে, এই রাত এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

কিন্তু যখন নৌকা আবার ঘাটের কাছে ফিরে আসে, বাতাস হঠাৎ আবারো হালকা ফিসফিস করে। কিরণ কানের কাছে শব্দটি শোনে—“এখনো কি আমি মুক্তি পেলাম…?”। এই মৃদু, রহস্যময় ফিসফিসানি কিরণের হৃদয়ে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। পাঠকও এই মুহূর্তে শ্বাসরুদ্ধ হয়; মনে হয় মেঘলার আত্মা হয়তো সত্যিই মুক্তি পেয়েছে না, কিংবা তার অভিশাপ আরও গভীর হয়েছে। নদীর ধীর স্রোত, খেয়াঘাটের অন্ধকার, বাতাসের ফিসফিসানি—সবকিছু মিলিয়ে একটি রহস্যময়, করুণ এবং অপ্রত্যাশিত শেষ দৃষ্টান্ত তৈরি করে। কিরণের চোখে, নৌকার প্রতিটি ঢেউয়ে এবং বাতাসে—সবকিছু মিলিয়ে পাঠককে ভাবায়, আত্মা সত্যিই শান্তি পেয়েছে নাকি এই রহস্য আরও গভীর হয়েছে।

1000062162.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *