Bangla - রহস্য গল্প

বাতাসিয়াপুর হত্যাকাণ্ড

Spread the love

জয় ভট্টাচার্য


চুপচাপ বাতাস

কালিম্পঙের এক কোণে, কুয়াশা মোড়া ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম বাতাসিয়াপুর। চারদিকে পাহাড়, গাছগাছালি আর নিঃস্তব্ধতা—শহরের ব্যস্ততা থেকে যেন একেবারে পালিয়ে আসার জায়গা। ঠিক সেখানেই শীতের ছুটিতে ঘুরতে এসেছিল চার বন্ধু—সৌরভ, অরিত্র, তিয়াসা আর মেহুল।

দার্জিলিং থেকে ছোট গাড়িতে এক ঘণ্টার পথ পেরিয়ে, শেষ বিকেলে তারা পৌঁছালো বাতাসিয়াপুর। গ্রামের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কাঠের বাংলো—“হিমালয় ভিউ লজ”। নামের সঙ্গে মিলে বাংলোর বারান্দা থেকেই দেখা যায় কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়ের চূড়া।

বাংলোর কেয়ারটেকার বুড়ো গনেশবাবু, মুখে চিরকালীন ধূসরতা। “রাতের দিকে বেশি বাইরে যাইয়েন না বাবুরা,” বললেন চা এগিয়ে দিতে দিতে। “এই পাহাড়ে কুকুরও কখনও কখনও হাওয়ায় ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, বুঝলেন তো?”

তিয়াসা হেসে ফেলল। “ভয়ের গল্প দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা চলছে বুঝি?”

গনেশবাবুর গলা নিস্তেজ। “ভয় যদি সত্যি হয়?”

বন্ধুরা ব্যাগ রেখে বসলো বড় ঘরে। কাঠের মেঝে একটু কড়কড়ে হলেও বেশ আরামদায়ক। পেছনের জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে ধীরে ধীরে, যেন কারও নিঃশ্বাস।

সৌরভ ক্যামেরা বের করে তুলতে লাগলো ছবি—“এই আলোটা দেখ, কী অসাধারণ! ঠিক যেন ভুতুড়ে সিনেমার সেট।”

অরিত্র মজা করে বলল, “খুন যদি হয় তো প্রথম সন্দেহ তোকেই করা হবে, বেশি সিনেমাবাজ।”

মেহুল একটা কম্বল জড়িয়ে বলল, “পাহাড় ভালো লাগে, কিন্তু এত চুপচাপ জায়গায় রাত কাটানো… একটু অস্বস্তিকর লাগছে না?”

তিয়াসা ব্যস্ত ছিল তার ট্যাবলেট আর নোটপ্যাডে। “তোমরা জানো, বাতাসিয়াপুর একসময় ব্রিটিশদের সাময়িক ছুটি কাটানোর জায়গা ছিল। এখানে নাকি একটা পুরনো কেল্লা ছিল, যা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।”

সৌরভ প্রশ্ন করল, “কেউ এখনো থাকে এখানে?”

“কিছু স্থানীয় পরিবার আছে। তবে গত এক দশকে এখানে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে—লোকজন নিখোঁজ, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা—সবই গুজব, যদিও পত্রিকায় কিছুই ওঠে না।” —বলল তিয়াসা, চোখ না তুলে।

রাত নেমে এলো। তারা চারজন আগুন জ্বালিয়ে বসলো বারান্দায়। গরম কফি, স্মৃতি, হাসি আর অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা ছিল শান্ত, কিন্তু অদ্ভুত রকম অস্থিরও।

অন্ধকার একটু ঘন হতেই হঠাৎই পেছনের ঝোপ থেকে এক ঝাঁক কুকুরের চিৎকার। সবাই চমকে উঠল।

“কিছু নয়, বোধহয় কোনো প্রাণী চলে গেছে,” গনেশবাবু আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন। কিন্তু তাঁর চোখে কেমন একটা চাপা উদ্বেগ।

সেদিন রাতে সবাই খুব একটা ঘুমাতে পারেনি। জানালার কাচে হাওয়ার ধাক্কা, কাঠের ঘরের কিঞ্চিৎ শব্দ, আর যেন দূরে কেউ হাঁটছে—সব মিলিয়ে একটি অজানা ভয় হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিল।

পরদিন সকালে শুরু হোল সত্যিকারের আতঙ্ক।

বাংলোর পাশের মাঠে, গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলছিল। হঠাৎ এক শিশু চিৎকার করে উঠল।

সৌরভ, অরিত্র দৌড়ে গেল। ঘাসে পড়ে আছে এক মৃতদেহ। তিয়াসা বলল, “এ তো দীপু! কাল দুপুরেও বাজারে দেখা হয়েছিল!”

ছেলেটির মুখ বিবর্ণ, চোখ খোলা, শরীর শক্ত হয়ে গেছে। আশেপাশে কেউ নেই।

মেহুল হাওয়ার অভাবে হাঁপাচ্ছিল, “এটা কি… খুন?”

তিয়াসা নিচু হয়ে দীপুর আঙুলে নীল দাগ দেখল। বিষক্রিয়া?

পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেল, কিন্তু তারা শুধু লিখল—“প্রাকৃতিক মৃত্যু—হয়তো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ।”

কিন্তু তিয়াসার চোখ বলছিল, এটা কিছুতেই স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।

একটি মৃত শরীর

সকাল তখন ঠিক আটটা। পাহাড়ি রোদ কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘাসে ভেজা মাঠে। কিন্তু এই নিরীহ সকালটাও হঠাৎ ভেঙে পড়ল চিৎকারে—

“লাশ! লাশ পড়ে আছে মাঠে!”

সৌরভ, অরিত্র, তিয়াসা আর মেহুল তখন সকালের চা খাচ্ছিল বারান্দায়। চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এল সামনের মাঠে। পাঁচ-ছয়জন স্থানীয় মানুষ জড়ো হয়েছে ইতিমধ্যে। মাঠের একপাশে ঘাসের মাঝে পড়ে আছে একটা নিথর দেহ—চোখ খোলা, মুখ থমথমে।

দীপু—সেই তরুণ ছেলেটা, যাকে কাল বাজারে হাসিমুখে দেখা গিয়েছিল।

তিয়াসা এক হাঁটু গেঁড়ে নিচু হয়ে ওর শরীরের দিকে তাকাল। হাতদুটো ঠান্ডা, আঙুলে হালকা নীল ছোপ। ওর সাংবাদিক-স্বভাব কাজ করছিল এখন।

“এই রকম আঙুলের রঙ বিষক্রিয়ার লক্ষণ হতে পারে,” সে ফিসফিস করে বলল।

“হৃদরোগও তো হতে পারে,” বলল অরিত্র, যদিও গলায় ছিল দ্বিধা।

“দীপু তেমন রোগী ছিল না। কালই বাজারে কথা বলেছি, একদম ঠিকঠাক ছিল,” বলল এক স্থানীয় বৃদ্ধ।

“এই জায়গাটা ভালো না বাবু,” আরেকজন ফিসফিস করে যোগ করল। “গত বছরও নাকি এক ছেলে গাছের ডালে ঝুলে ছিল…”

পুলিশ আসে আধঘণ্টা পরে। পাহাড়ি অঞ্চলের রাস্তায় সময় লাগে। এসআই শংকর রাই, মাঝবয়সী, থমথমে গলার স্বরে বললেন, “বডি প্যাক করুন। পাঠাতে হবে ময়নাতদন্তে।”

তিয়াসা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, “স্যার, বিষক্রিয়া হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। আঙুল দেখেছেন?”

“আপনি ডাক্তার?”

“না। আমি সাংবাদিক—কলকাতা থেকে এসেছি। এও জানি, স্থানীয়ভাবে আপনি যত কম লিখবেন, তত কম ঝামেলা হবে। কিন্তু এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না।”

এসআই রাই একঝলক তাকাল ওর দিকে, তারপর শান্ত গলায় বলল, “আপনার পর্যবেক্ষণ আমরা খতিয়ে দেখব। আপাতত পেছনে থাকুন।”

তিয়াসা মুখে কিছু বলল না, কিন্তু চোখে আগুন। এখানে কিছু একটা লুকোচ্ছে, সেটা সে নিশ্চিত।

মেহুল তখনো ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। বারবার বলছিল, “আমরা একটা পিকনিকে এসেছি… আর এখানে খুন? এটা কি সিনেমা হচ্ছে?”

সৌরভ ক্যামেরা নিয়ে এল। লাশ তোলার আগে যতটা সম্ভব ছবি তুলল। বিশেষ করে দীপুর হাত, মুখ, জামার কোনার ছিঁড়ে যাওয়া অংশ—সবকিছু।

“তুই এসব ছবি কী করবি?” অরিত্র চাপা গলায় বলল।

“নথি। প্রমাণ। এরপর যদি কেউ বলে কিছু হয়নি, তখন কাজে আসবে।” —জবাব দিল সৌরভ।

বিকেলের দিকে তারা চারজন আবার মাঠে এসে বসে। চারপাশ নিঃস্তব্ধ। বাতাস হালকা ঠান্ডা আর গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে।

“তিয়াসা, তুই কাগজে কিছু লেখার কথা ভাবছিস?”

“না। এখনও না। পুরো ঘটনা না জেনে কিছু লেখা মানে হল গুজব ছড়ানো। তবে আমি নোট নিচ্ছি।”

সে ব্যাগ থেকে একটা পুরনো লাল নোটবুক বার করে পাতায় লিখে ফেলল—

“০২ জানুয়ারি – দীপুর মৃত্যু: বিষক্রিয়া সন্দেহ। আঙুলে নীল দাগ। পুলিশের অনাগ্রহ। বাংলোর আশেপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।”

হঠাৎ অরিত্র বলল, “তোমরা কি লক্ষ্য করেছো? দীপুকে শেষবার বাজারে দেখা গিয়েছিল এক অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে। লাল টুপি, কালো জ্যাকেট…”

সৌরভ ক্যামেরা খুলে ছবিগুলো স্ক্রল করে। কয়েকটা ঝাপসা হলেও এক ছবিতে সত্যিই দেখা গেল দীপুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা একজন পুরুষ, মুখটা পুরো পরিষ্কার নয়।

“লোকটা কে?”

“তাকে তো বাজারে কেউ চেনে না,” বলল মেহুল।

তিয়াসা আবার লিখল, “অচেনা ব্যক্তি – লাল টুপি। ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। খুঁজে বের করতে হবে।”

সন্ধ্যার দিকে বাংলোর সামনে গনেশবাবু এলেন চা দিতে।

সৌরভ জিজ্ঞেস করল, “গনেশদা, দীপু কি আপনাদের চিনত?”

বুড়ো লোকটা মাথা নাড়ল, “চিনত। খুব চুপচাপ ছিল। কিন্তু ইদানীং কিছু নিয়ে চিন্তায় ছিল। কয়েকদিন আগেও রাত করে বাজার থেকে ফিরেছিল।”

“সে কি কারো সঙ্গে মেশে?”

গনেশবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর আস্তে বললেন—

“রাজীব নামের একজন ছেলের সঙ্গে কিছুদিন ধরে মিশত। বাইরের ছেলে না, কিন্তু এখানকারও না।”

“রাজীব?”

“হ্যাঁ। খুব চুপচাপ। বাইক নিয়ে আসে যায়। অনেকেই ভাবে ও ড্রাগ ডেলিভারি করে। তবে প্রমাণ নেই।”

তিয়াসা এবার ঠিক করল—এই ‘রাজীব’ নামটা সে মাথায় রাখবে।

সেই রাতে আবার বাংলোর পেছন দিকে কারা যেন পায়ের শব্দ করে। সৌরভ জানালার পাশে গিয়ে দেখল ছায়ার মতো কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছে। সে ক্যামেরা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল… কিন্তু সেখানে তখন আর কেউ নেই।

কিন্তু দরজার পাশে মাটিতে পড়ে ছিল একটা পুরনো, ছেঁড়া কাগজ। তাতে অর্ধেক লেখা:

“…ডেলিভারি ৫ তারিখের আগেই শেষ করতে হবে। পাহাড়ে বেশি ঝুঁকি নয়…”

সৌরভ সেটা তুলে ব্যাগে রাখল। চোখে আগুন। এবার সে জানে, এই মৃত্যুর সঙ্গে বড় কিছু জড়িয়ে আছে।

ছবির আড়ালে রহস্য

সকালে চোখ খুলেই সৌরভ ল্যাপটপ খুলে বসল। আগের দিন রাতে ক্যামেরায় তোলা সব ছবি একে একে বড় স্ক্রিনে এনে দেখছিল। প্রতিটি ছবির প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁজছিল কোনও অদৃশ্য সূত্র, কোনও ক্লু।

হঠাৎ একটি ছবি তার চোখ আটকে দিল।

বাজারের ছবি—দীপু দাঁড়িয়ে আছে, সামনে সেই লাল টুপি ও কালো জ্যাকেট পরা লোকটি। কিন্তু এবার দেখা গেল, তার ডান হাতে একটি প্যাকেট, যার গায়ে ইংরেজিতে লেখা—“Himalaya Organics – For Strength & Focus”। একটা ভেজাল স্টেরয়েড কোম্পানির নামের মতো।

“তিয়াসা! একবার তোকে কিছু দেখাতে হবে,”—সে চিৎকার করে ডেকে তোলে।

তিয়াসা চশমা পরে পাশে এসে বসল। “ওই প্যাকেটটা তো অনেকটা সাপ্লিমেন্টের মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি নামটা আগে শুনিনি। সার্চ কর।”

সৌরভ সঙ্গে সঙ্গে সার্চ করল—Himalaya Organics For Strength & Focus।

কোনো অফিসিয়াল ওয়েবসাইট নেই। কয়েকটা ব্লগ ও Reddit পোস্টে লেখা—

“This is not a verified supplement. Suspected to be used for spiking drinks.”

“Found in rural areas of North Bengal. Often sold without license.”

“Linked with neurological damages in minor cases.”

তিয়াসা হঠাৎ বলে উঠল, “বুঝতে পারছিস, দীপু হয়তো এই প্যাকেটটা কারও জন্য আনছিল বা নিজে নিচ্ছিল—আর সেটার সাথেই তার মৃত্যু জড়িত হতে পারে!”

“আর এই লাল টুপি লোকটা সেই ডেলিভারির লোক হতে পারে,” সৌরভ যোগ করল।

অরিত্র এসে বলে, “তবে তো এ গন্ধ ড্রাগ চক্রেরই, বলেছিলাম না কিছু আছে?”

তিয়াসা বলল, “গনেশদা ‘রাজীব’ নাম বলেছিল, ঠিক? তাহলে আমাদের খুঁজতে হবে—এই রাজীব আর ওই লাল টুপি লোকটা এক ব্যক্তি কিনা।”

সেই সময়েই দরজায় টোকা।

গনেশবাবু দাঁড়িয়ে, মুখ থমথমে। হাতে একটা প্যাকেট।

“বাবুরা, এইটা কেউ ফেলে গেছে পেছনের দরজার ধারে। কে রেখে গেছে বলতে পারি না।”

সৌরভ প্যাকেটটা খুলে দেখে, ভিতরে কিছু কাগজ আর একগুচ্ছ ছবি।

ছবিগুলো দেখে চার বন্ধু স্তব্ধ।

দীপুর ছবি তো আছেই, সঙ্গে আরও তিন-চারজন স্থানীয় ছেলের ছবি—কেউ পাহাড়ি পথে দাঁড়িয়ে, কেউ অন্ধকার ঘরে বসে কিছু হাতে নিচ্ছে। বেশিরভাগ ছবিই যেন কোনও গোপন জায়গা থেকে তোলা, কিছুটা ঝাপসা।

তিয়াসা চোখ সরু করে বলল, “এই তো প্রমাণ। কেউ নজরে রাখছিল ওদের… হয়তো ওদের ব্যবহার করছিল।”

কাগজগুলোতে হাতে লেখা কিছু তথ্য—

“ডেলিভারি সময়ে দীপু সন্দেহ জাগায়”

“রাজীব আর দীপুর মধ্যে মতবিরোধ”

“পাহাড়ি বাংলোর পেছনে লুকানো স্লট – নিরাপদ ড্রপ পয়েন্ট”

অরিত্র অবাক হয়ে বলল, “মানে আমাদের বাংলোর পিছনেই ড্রাগ ডেলিভারি হয়?”

তিয়াসা সেই পুরনো লাল খাতায় আবার লিখল—

“ছবিতে গোপন তদারকি। কারা জানে? দীপুর সাথে আরও কে যুক্ত? পাহাড়ি লজ–চক্রের নিরাপদ ঘাঁটি?”

“একটা কাজ করতে হবে,” সৌরভ বলল, “আজ সন্ধ্যায় বাংলোর পেছনে যাই। দেখতে হবে ওরা কী লুকোয়।”

মেহুল অস্থির, “এগুলো খুব বিপজ্জনক লাগছে… পুলিশে কিছু বলব?”

তিয়াসা ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল, “পুলিশ কিছু করবে না। এসআই রাই নিজে হয়তো এর সঙ্গে জড়িত।”

তিনজন চুপ করে গেল। বাতাস গম্ভীর হয়ে এল। সেই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারল—এই ছেলেখেলা নয়।

তারা ঢুকেছে একটি মাদকচক্রের অন্ধকার গহ্বরে, যার পরত খুলতেই আরও বিপদ বেরিয়ে আসবে।

পাহাড়ি রাতের গোপন চুক্তি

রাত তখন প্রায় ১১টা। বাতাসিয়াপুরে সেই সময়ে পা ফেলা যায় না। পাহাড়ি রাস্তা শুনশান, কুয়াশায় ঢাকা। তবে চারজন বন্ধু—সৌরভ, তিয়াসা, অরিত্র আর মেহুল—হেডল্যাম্প আর ক্যামেরা নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়েছে বাংলোর পিছনের পাথরের গলিপথ ধরে। গন্তব্য—বাংলোর পেছনের সেই “নিরাপদ ড্রপ পয়েন্ট”, যেটার উল্লেখ ছিল কাগজে।

কুয়াশার ভেতর দিয়ে অন্ধকারে রাস্তা কেটে যাওয়া যেন কোনও ভূতের সিনেমার দৃশ্য।

“এত রাতে কেউ দেখলে কী বলবে?” মেহুল ফিসফিস করল।

“তুই কম বল, বেশি শুন,”—চুপিসারে বলল সৌরভ।

“তোর সাহস কই, ক্যামেরা তো তুই চালাস,” মেহুল পাল্টা জবাব দিল।

হঠাৎ, দূরে, একটা নিঃশব্দ শব্দ। কেউ যেন জুতো টেনে চলেছে পাথরের উপর দিয়ে।

তিয়াসা ইশারা করল—”ওইদিকে চল।”

তারা চারজন জঙ্গলের গাছপালা পেরিয়ে পৌঁছাল এক পুরনো কাঠের ঝুপড়ির সামনে। একেবারে পরিত্যক্ত দেখালেও ভিতর থেকে মৃদু আলো ফুটে বেরোচ্ছে। সৌরভ ক্যামেরার নৈশ মোড অন করে ফ্রেমে ধরে রাখল সব।

ভেতর থেকে দুটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল—

“আগামী সপ্তাহে শহর থেকে বড় মাল আসবে। পুলিশের ওই লোক সব সামলে দেবে।”

“দীপু নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছিল রে ভাই। বেশি কথা বলছিল। ঝুঁকি নিতে হল।”

তিয়াসা মুখ চেয়ে এক মুহূর্ত থেমে গেল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “আমরা ঠিক শুনেছি। দীপুকে ওরাই সরিয়েছে।”

অরিত্র একটা খড়ের গাদা পেরিয়ে একটু কাছাকাছি গিয়ে উঁকি মারল। দুই ব্যক্তি—একজন মাঝবয়সী, চোখে কালো সানগ্লাস, অন্যজন যুবক—হুডি গায়ে। যুবকটার মুখ কিছুটা পরিচিত ঠেকল। তিয়াসা ফিসফিস করে বলল, “ওই লোকটাই তো ক্যামেরার ছবিতে ছিল!”

সৌরভ একে একে কয়েকটা ছবি তুলে নিল। শাটারের ক্লিক শব্দ এক মুহূর্তের জন্য জোরে হয়ে গেল।

ভেতরের লোকদুটো চমকে উঠল।

“কে ওখানে?”—চেঁচিয়ে উঠল একজন।

চারজন দৌড়ে পালাল! পেছন থেকে শব্দ এল—পায়ের ছাপ, গুলি নয় তবে ভারী পদক্ষেপে তাড়া। সৌরভ পথ চিনে সবাইকে নিচের বাঁকের দিকে নামিয়ে আনল। মিনিট পাঁচেক দৌড়ের পর তারা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেহুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এইবার চল বন্ধু, ট্রেনে উঠে কলকাতা ফিরে যাই… আমি আর এগুলো পারব না।”

তিয়াসা ওর কাঁধে হাত রাখল। “এখনই ফেরার সময় না, মেহুল। দীপু খুন হয়েছে। আর আমাদের কাছে আছে তার প্রমাণ। আমরা যদি চুপ করে থাকি, তাহলে আরও দীপু মরবে।”

সৌরভ মাটিতে বসে ক্যামেরা খুলে ছবি চেক করল।

“দারুণ স্পষ্ট ছবি। মুখ, কথাবার্তা, ডেটা—সব আছে। এগুলো প্রিন্ট করে সাংবাদিক বন্ধুদের পাঠাতে হবে। তিয়াসা, তুই কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিস?”

“আমি আনন্দমেলা আর টাইমসের কিছু পরিচিতদের জানি। তবে এক্ষুনি জানানো ঠিক হবে না। আগে জানতে হবে পুলিশের মধ্যেও কে সত্যি আর কে বিক্রি হয়ে গেছে।”

সেই সময় ফোনটা বেজে উঠল—অচেনা নম্বর।

তিয়াসা একটু দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করল।

“তুমি যদি সত্যিই দীপুর জন্য ন্যায় চাও, কাল সকালে বাতাসিয়াপুরের পুরনো ল্যাম্পপোস্টের কাছে এসো। একা। পুলিশের কাউকে জানিও না। নয়তো… তুমিও ওর মত হারিয়ে যাবে।”

কল কেটে গেল।

তিয়াসা হঠাৎ চুপ মেরে গেল।

“কি বলল?”—সৌরভ জিজ্ঞেস করল।

সে ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের কেউ সাহায্য করতে চায়। তবে সে-ও বিপদে। আর কাল সকালেই হয়তো পুরো রহস্যের মুখোমুখি হতে হবে।”

অন্ধকারের মুখোমুখি

সকাল ৬টা। পাহাড়ি বাতাসে ঘাস ভেজা, হালকা রোদের ছোঁয়া গায়ে লাগলেই ঠান্ডা কেটে যায়। বাতাসিয়াপুরের পুরনো ল্যাম্পপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে তিয়াসা। গায়ে গা-ঢাকা হুডি, চোখে রোদচশমা। সৌরভ, অরিত্র আর মেহুল কিছুটা দূরে পাহাড়ি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আছে।

সবার হৃদস্পন্দন যেন একসঙ্গে চলছে—ধীরে, কিন্তু থেমে থেমে।

দু’মিনিট পেরোল।

তিন।

চার…

তিয়াসা কেবল ঘড়ি দেখছিল আর চারপাশে চোখ রাখছিল।

তখনই হালকা শব্দ—জুতোর মচমচ আওয়াজ। ঘাসে পা ফেললে যেমন হয়। পেছন থেকে একজন ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। মাথায় টুপি, মুখে গামছা বাঁধা।

“তুমি একাই এসেছো, ভালো। বাকিরা দূরে?”

তিয়াসা ঠান্ডা গলায় বলল, “তাদের খবর দেওয়ার দরকার হয়নি।”

লোকটা একটু হেসে বলল, “আমি দীপুর বন্ধু ছিলাম। নাম বলব না। কিন্তু জানো, দীপু যা জানত, তা বেশি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বড় খেলোয়াড়দের নাম ফাঁস করতে চায়নি।”

“তুমি কী করতে চাও?”

লোকটা ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল। কিছু নথি আর একটা পুরনো মোবাইল।

“এই ফোনে সব রেকর্ড আছে। রাজীব, এসআই রাই, আর আরও দুজন—সব কথোপকথন। ওরা কিভাবে এই পাহাড়ি গ্রামে ফার্মাসিউটিক্যাল ড্রাগ আনত, কে কে টাকা নিত… সব।”

তিয়াসা এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। লোকটা বলল, “আমি আর পারছি না। ওরা আমার পেছনেও লাগতে পারে। তুমি শহরে গিয়ে যদি এগুলো পৌঁছাতে পারো সাংবাদিকদের কাছে, তবেই কাজ হবে।”

“তুমি পুলিশের কাছে যেতে পারতে না?”

“যাদের কাছে যাওয়া উচিত, তারাই তো ওদের লোক!”

হঠাৎ, পাহাড়ি রাস্তার ওপাশ থেকে আওয়াজ এল—“ওই! দাঁড়াও!”

দুজন ছায়ামূর্তি দৌড়ে আসছে, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে ওয়াকি-টকি।

লোকটা বলল, “তাড়াতাড়ি যাও! আমাকে ধরা পড়তে দিলেও, তুমি ফোনটা নিয়ে পালাও।”

তিয়াসা দৌড়াতে শুরু করল। পেছন থেকে সেই লোক ছুটে গিয়ে আড়ালে গেল, আর পাহাড়ি পথটা ধরে গোলমাল, ধস্তাধস্তির শব্দ শোনা গেল।

অন্যদিকে, সৌরভ, অরিত্র আর মেহুল ছুটে এল তিয়াসার দিকে।

“কি হল?”

“ফোনটা পেয়েছি। সব রেকর্ড আছে। তবে লোকটা ধরা পড়ে গেল…”

তারা তাড়াতাড়ি বাংলোয় ফিরে এল। সৌরভ সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা ল্যাপটপে কানেক্ট করে সব অডিও একে একে শোনাতে লাগল।

প্রথম রেকর্ডিং:

রাজীব: “এইবার বড় চালান আসছে দিল্লি থেকে। পাহাড়ে সহজে কেউ কিছু বোঝে না।”

রাই: “তোরা ডেলিভারি করে যা। পুলিশ যা বলবে, আমি সামলাব। দীপু বেশি কথা বলছে।”

রাজীব: “ওকে সরিয়ে দিতে হবে।”

দ্বিতীয় রেকর্ডিং:

রাজীব: “বাংলোর পেছনের কুয়োর গা ঘেঁষে মাল নামাও। এক সপ্তাহ পর নেপাল সীমানা পেরিয়ে যাবে।”

অন্য কণ্ঠ: “বাচ্চাদের দিয়েই পাঠাতে হবে। সন্দেহ কম।”

তিয়াসা এক দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল।

“ওরা স্কুলের ছেলেমেয়েকেও মাদকচক্রে ব্যবহার করছে…”

সৌরভ বলল, “এই প্রমাণ যথেষ্ট। মিডিয়া, প্রশাসন, সবার কাছে এই গুলো পৌঁছালে ওরা বাঁচবে না।”

অরিত্র যুক্ত করল, “কিন্তু আমাদের আগে যেতে হবে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে সাংবাদিকদের অফিসে, সঙ্গে শহরের নিরপেক্ষ পুলিশের কাছে।”

মেহুল বলল, “তাহলে এখনই ব্যাগ গোছাও। আজ রাতেই আমরা ট্রেনে উঠব।”

তিয়াসা বলল, “না। আরও একবার যাচাই করতে হবে—বাংলোর কুয়োর পাশে ড্রপপয়েন্টে কোনও প্রমাণ পড়ে আছে কিনা। ওটা পেলে, কেসটা আরও শক্ত হবে।”

তাদের চোরা অভিযান শেষ হয়নি।

এখনও বাকি সত্যকে উন্মোচন করা, এবং দোষীদের মুখোশ খুলে দেওয়া।

কুয়োর ধারে লুকোনো মৃত্যু

রাত তখন ১১টা। পাহাড়ের গায়ে কুয়াশা চেপে বসেছে। বাতাসের শব্দে পাতার ফিসফিসানি যেন ফিসফিস নয়—কারও কান্না।

চার বন্ধু হাঁটছে নিঃশব্দে, হাতের টর্চ নিঃশব্দে রাস্তা দেখাচ্ছে।

গন্তব্য: বাংলোর পিছনের পুরনো কুয়ো।

এটাই সেই জায়গা, যেখানে রাজীব আর তার চক্র মাদক লুকাতো, যেখান থেকে দীপু হয়তো প্রমাণ পেয়েছিল।

সৌরভ বলল, “সাবধানে থেকো। ক্যামেরা চালু আছে।”

তিয়াসা বলল, “আমাদের কাছে এখন যা আছে, তা যেকোনও বড় চক্রকে ধরাশায়ী করতে পারে। কিন্তু তার আগে প্রমাণ আরও জোরালো করতে হবে।”

তারা কুয়োর ধারে পৌঁছাল। জায়গাটা একদম নির্জন। কুয়োর গা ঘেঁষে নেমে যাওয়া পাথরের সিঁড়ি, পাশে পুরনো বাঁধানো গাছগাছালি। একটা জায়গায় মাটি কাটা, অনেকটা যেন সদ্য কেউ কিছু পুঁতে রেখেছে।

“ওই জায়গাটায় টর্চ ফেল,” অরিত্র বলল।

মাটি আলগা। তিয়াসা হাতে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল।

খুঁড়তেই একটা প্যাকেট বেরিয়ে এল। প্লাস্টিকে মোড়া, ভিতরে কয়েকটা ছোট কৌটো, কিছু পাউডার, ইনজেকশন, আর… একজোড়া গ্লাভস—তাতে রক্তের দাগ।

“হoly crap!”—মেহুল কাঁপা গলায় বলে উঠল।

সৌরভ ক্যামেরা জুম করে ছবি তুলল।

তিয়াসা বলল, “এই গ্লাভসটা হয়তো হত্যাকারীর। আর এই ইনজেকশনেই দীপুকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।”

সেই মুহূর্তে পেছন থেকে পদধ্বনি।

“এতো বেশি জেনে ফেলেছো রে বাচ্চারা…”

চারজন ঘুরে তাকাল।

রাজীব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বন্দুক। পেছনে সেই এসআই রাই।

“সব ছবি, সব রেকর্ড মুছে ফেলো। ফোনটা দাও,”—রাজীব গর্জে উঠল।

তিয়াসা ধীরে ধীরে পেছনে মোবাইলটা পকেটে রাখল। কিন্তু তার চোখ সৌরভের দিকে—ইঙ্গিত স্পষ্ট।

অরিত্র ধীরে করে একটা পাথর তুলল।

রাজীব বলল, “চেষ্টা কোরো না, খুব সহজে গুলি করে দেব। যেমন দীপুকে মেরেছিলাম। ওর গায়ে ইনজেকশন দিয়েই জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপর কুয়োর পেছনের পথ দিয়ে এনে ঠেলে ফেলা—কে জানবে?”

তিয়াসা বলল, “তুমি নিজে স্বীকার করলে। রেকর্ডিং চলছে।”

রাজীব থমকাল। সৌরভ হঠাৎ দৌড়ে পাশের পাথরের আড়ালে গিয়ে ক্যামেরা ছেড়ে দিল একটা পাহাড়ি ঢালু পথে—ডেটা ট্রান্সফার অন।

তারপর বলে উঠল, “তুই তো গুলি করবি না। কারণ গুলি চললেই পাহাড়ি পুলিশ এসে পড়বে।”

এসআই রাই চেঁচিয়ে উঠল, “তাহলে তোদের এখানেই শেষ করতে হবে!”

তখনই পেছন থেকে গর্জে উঠল মাইক—

“থেমে যাও! পুলিশ! কেউ নড়বেন না!”

কয়েকজন স্পেশাল টাস্ক ফোর্স অফিসার ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজীব আর রাই-এর উপর।

হাতকড়া পরিয়ে রাজীবকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হল।

তিয়াসা বিস্মিত।

সামনে এল সেই লোক—যে আগের দিন তিয়াসাকে ফোন করেছিল। এখন তার পুলিশ ব্যাজ দেখা গেল।

“আমি সুব্রত ঘোষ, এনসিবি থেকে। তোমরা যা করেছো, সেটা সাহসের কাজ। তোমাদের সাহায্য ছাড়া আমরা বাতাসিয়াপুরের এই মাদক চক্র ফাঁস করতে পারতাম না।

অরিত্র চুপ করে বলল, “তবে দীপুর হত্যার বিচার হবে তো?”

সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, “হবে। এখন যা প্রমাণ আছে, তাতে ওদের শাস্তি নিশ্চিত। আর দীপু… দীপু ছিল বীর। ওর সাহসেই আমরা আজ এখানেই পৌঁছাতে পেরেছি।”

তিয়াসা পেছন ফিরে তাকাল। কুয়োর পাশের গাছের পাতার ফাঁকে ভোরের আলো।

বাতাসিয়াপুর, যা ছিল একটা ছোট পাহাড়ি গ্রাম, আজ যেন ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠল।

কলকাতা ফিরে বিচারযুদ্ধ

তিনদিন কেটে গেছে বাতাসিয়াপুর অভিযান থেকে।

কলকাতার গরম রোদ, ট্রাফিকের ধোঁয়া আর কোলাহল চার বন্ধুদের এক মুহূর্তের জন্যও সেই পাহাড়ি স্মৃতি ভুলতে দেয় না।

তিয়াসা আজ কলকাতার এক সংবাদ চ্যানেলের মুখোমুখি বসে। ক্যামেরার সামনে চোখে চোখ রেখে সে জানাচ্ছে দীপুর হত্যার নেপথ্যের রহস্য, কিভাবে পুলিশ-প্রশাসনের কিছু দোষী ব্যক্তিরা মাদকচক্রের সাথে যুক্ত ছিল, আর কিভাবে বাতাসিয়াপুরের কুয়োর ধারে মৃত্যুর গন্ধে মোড়া সেই প্রমাণ উদ্ধার হয়েছিল।

সৌরভ আর মেহুল ব্যস্ত বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় রিপোর্ট পাঠাতে। অরিত্র সেই এনসিবি অফিসার সুব্রত ঘোষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে, যেন কেস আদালতে ঠিকভাবে দাঁড়ায়।

সেইদিন সন্ধ্যায় তারা চারজন মিলে বসেছিল তিয়াসার বাড়ির ছাদে। হাতে চা, সামনে কলকাতার ছায়াময় আকাশ।

মেহুল বলল, “দেখো, মিডিয়া তো পুরো পাগল হয়ে গেছে। প্রতিটা চ্যানেল আমাদের গল্প দেখাচ্ছে।”

সৌরভ হাসল, “আর বলিস না, আমাদের ছবি নিয়েও মিম বানাচ্ছে! ‘চক্রভেদী চার বন্ধু!’”

সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল, তবে তার ভেতরেও থেকে গেল এক ধরনের ভার।

তিয়াসা চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আচ্ছা, দীপুর বাবা-মাকে বলেছো?”

অরিত্র বলল, “হ্যাঁ। আমি আজ ওনাদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি শুধু বললেন—‘আমার ছেলে বাঁচাতে পারেনি কাউকে, কিন্তু তার বন্ধুরা দেশের বাচ্চাদের রক্ষা করলো।’”

তিয়াসার চোখে অশ্রু। “দীপু থাকলে আজ কী বলত কে জানে…”

তারপর সে উঠে দাঁড়াল।

“আরেকটা কাজ বাকি। কাল এনসিবি কোর্টে পেশ করবে অভিযুক্তদের। আমাদের যেতে হবে। দীপুর হয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে।”

পরদিন সকাল – কলকাতা সেশন কোর্ট

নিরাপত্তা ঘেরা কোর্টরুম, সংবাদপত্রের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, এনসিবির ঘনঘটা—সবকিছুর মাঝে হাজির করা হল রাজীব ও এসআই রাই-কে। বিচারক তাঁর কড়া দৃষ্টিতে দেখলেন, আর এনসিবি অফিসার সুব্রত ঘোষ সমস্ত তথ্য ও রেকর্ড আদালতের সামনে পেশ করলেন।

তারপর ডাকা হল তিয়াসাকে।

কোর্টরুমে নিঃশব্দ।

তিয়াসা বলল, “আমি তিয়াসা সেন। একজন কলেজ শিক্ষার্থী। আমি দীপু মৈত্রর বন্ধু। ওর মৃত্যুর পেছনের সত্যি আমি নিজে দেখেছি, শুনেছি, আর হাতে করে এনেছি। আমি এই আদালতের কাছে অনুরোধ করছি—ওদের যেন সর্বোচ্চ সাজা হয়। শুধু দীপুর জন্য নয়, বাতাসিয়াপুরের মতো গ্রামের প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যতের জন্য।”

জজ কিছুক্ষণ কাগজপত্র দেখে বললেন—

“এই আদালত এনসিবির উপস্থাপিত প্রমাণ, অডিও রেকর্ড, এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর ভিত্তিতে অভিযুক্ত রাজীব ঘোষ ও এসআই রাই-কে দোষী সাব্যস্ত করছে। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি 302, 120B, এবং NDPS Act এর আওতায় মামলা প্রমাণিত হয়েছে। এই আদালত তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করছে।”

কোর্টরুমে হালকা উচ্ছ্বাস।

সৌরভ, অরিত্র, মেহুল—তিয়াসার দিকে এগিয়ে এল।

তিয়াসার মুখে একফোঁটা হাসি—তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও একধরনের শান্তি।

একটি চক্র ভেঙে পড়েছে।

একটি বন্ধুর মৃত্যু বৃথা যায়নি।

চারজন সাধারণ তরুণ-তরুণী তাদের সাহস, বুদ্ধি আর মানবিকতা দিয়ে প্রমাণ করে দিল—সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু হারিয়ে যেতে পারে না।

সমাপ্ত

IMG-20250609-WA0006.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *