Bangla - রহস্য গল্প

বাঘের থাবা

Spread the love

দীপায়ন গুহ


সুন্দরবনের ঘন সবুজের বুক চিরে চলে যাওয়া সরু জলপথে সকালবেলায় ধোঁয়াশা ছেয়ে ছিল। কেওড়া, গরান আর সুন্দরী গাছের পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আলো ফোটার চেষ্টা করলেও ঘন কুয়াশার কুন্ডলীতে হারিয়ে যাচ্ছিল সমস্ত দৃশ্য। বন বিভাগের টহল নৌকোটি ঘোলা জলে এগিয়ে চলছিলো—চালকের মুখে গভীর উদ্বেগ। সামনে বসে থাকা বিট অফিসার রবিউল শেখ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল জলের পাশে সদ্য দেখা দেওয়া কয়েকটি বাঘের পায়ের ছাপের দিকে। এই চতুর্থ বার, গত এক মাসে, এই অঞ্চলেই মৃতদেহ মিলেছে বন দফতরের আধিকারিকের, আর এই বার… সেই মৃতদেহটি ছিল তাঁরই বহু বছরের পরিচিত, ডিএফও প্রফুল্ল ঘোষ। গাছে গাছে কাকের চিৎকার, হঠাৎ হঠাৎ দমকা বাতাস, আর সেই জলের ওপর ভেসে ওঠা নিথর দেহ—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটি অভিশপ্ত নিস্তব্ধতা নামিয়ে দিয়েছিল। মৃতদেহটি দেখে মনে হচ্ছিল বাঘের থাবায় ছিন্নভিন্ন হয়েছে, কিন্তু রবিউল প্রথম চোখে পড়া সেই ক্ষতচিহ্নটি লক্ষ্য করেছিল—গলায় সূক্ষ্ম সুঁচের চিহ্ন, যেন ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। সুন্দরবনে বাঘ আক্রমণ নতুন কিছু নয়, কিন্তু একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ঘিরে ধরছিলো তাঁকে। কিছু একটা ঠিক নেই। প্রফুল্লবাবু কখনো অযথা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করতেন না, আর এই নির্জন গাছপালার মাঝে কীসের সন্ধানে এসেছিলেন তিনি, সে প্রশ্নের উত্তর তখনো অজানা ছিল।

পরদিন সুন্দরবন পূর্বাঞ্চল ফরেস্ট অফিসে কলকাতা থেকে আগত নতুন ডিএফও অরণ্য সাহা অফিস ঘরে ঢুকে রিপোর্টগুলো ঘাঁটতে শুরু করলেন। বয়সে চল্লিশের কোঠায়, দায়িত্ববান, দৃঢ়চেতা, আর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ এই অফিসার এর আগেও পশ্চিম মেদিনীপুরে একাধিক চোরাকারবারি ধরার জন্য পরিচিত ছিলেন। কাগজের পাতাগুলোর মাঝে তিনি দেখতে পেলেন বিগত তিনটি মৃত্যুর সঙ্গে অদ্ভুত মিল—তিনজনেই বন দফতরের কর্মী, তিনজনেই একা ছিলেন মৃত্যু সময়ে, আর তিনজনের শরীরেই ট্রাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশনের সামান্য চিহ্ন। উপর থেকে চাপ আসছে ঘটনাগুলোকে “বন্য প্রাণীর দায়” বলে চাপা দিতে, কিন্তু অরণ্য বুঝতে পারলেন, এর পেছনে আরও গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। এদিকে সহকর্মী বর্ণালী মণ্ডল, সদ্য রেঞ্জ অফিসার পদে উন্নীত হওয়া, অরণ্যের সিদ্ধান্তে পূর্ণ সমর্থন জানালেন। তিনি নিজেও মনে করছিলেন—এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়। এদের দেহে বাঘের থাবা থাকলেও, আগে থেকেই তারা অচেতন ছিলেন—তা না হলে কেউই এত সহজে শিকার হত না। ট্রাঙ্কুইলাইজার কে দিল? আর কীসের জন্য? কোথাও না কোথাও বন দফতরের অভ্যন্তরেই একজন “অসত্‍ ব্যক্তি” এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, এমন সন্দেহ জোরালো হতে শুরু করল।

তদন্ত শুরু হল জঙ্গল ঘেরা একটি দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে সাধারণত মানুষ যায় না। অরণ্য, বর্ণালী আর বিট অফিসার রবিউল শেখ মিলে একটি গোপন নজরদারির সিদ্ধান্ত নেন। রাতের অন্ধকারে, এক পুরোনো রেঞ্জ বিট অফিসের কাছে ক্যাম্প বসানো হয়। চারপাশে বাঘের ডাক, শিয়ালের চিৎকার, আর ছায়া ছায়া গাছের আড়াল—সব মিলিয়ে একটি রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ। হঠাৎ হরু মাঝি, একজন প্রবীণ নৌচালক, রাতে এসে জানায়—সে একটি গোপন গন্ধ পেয়েছে, গভীর জঙ্গলে কয়েকজন লোক রাতের আঁধারে যাচ্ছে, কারোর হাতে ট্রাঙ্ক, কারোর কাছে তীরধনুকের মতো কিছু দেখা গেছে। অরণ্য কৌতূহলী হন। ট্রাঙ্কুইলাইজার ছোড়ার জন্য এখনো কেউ তীরধনুক ব্যবহার করে? এই রহস্য যেন কেবল জঙ্গলের মাঝে নয়, গোটা সুন্দরবনের হৃদয়ে জমে উঠছে। কিন্তু কে এই অদৃশ্য শিকারি, যে একে একে বনকর্মীদের নিশানা করছে, আর কেন? সে কি মানুষ, না বাঘরূপী কোনো রাক্ষস? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই অরণ্য চোখ রাখলেন দূরের কুয়াশা ঢাকা জঙ্গলে—যেখানে গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে ভেসে এল এক মুহূর্তের বাঘের পায়ের ছাপ… অথচ পাশে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় ছিল কারোর বুটের স্পষ্ট ছাপও।

রাতের অন্ধকারে সুন্দরবনের সেই নির্জন বনাঞ্চলের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়েছিল এক পাখির আতঙ্কিত ডানা ঝাপটানোর শব্দ। বিট অফিসার সুধাংশু রায় হ্যাঁন্ডহেল্ড টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন গোসাবা রেঞ্জের মধ্যবর্তী সেই দুর্গম অংশে, যেখানে কয়েকদিন আগে প্রফুল্ল ঘোষের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। তিনিও তদন্তে নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁর মুখে চাপা উত্তেজনা আর ভয় মিশে একটা স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ ছিল। রাতে একা বেরনোর অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও, তিনি একটি ফোন কল পেয়েছিলেন—অজানা নম্বর থেকে, যেখানে কেউ বলেছিল, “আপনার অফিসারের মৃত্যুর আসল সত্য গোরমারা চরে আছে… যদি সাহস থাকে, চলুন দেখিয়ে দিই।” ফোনের কণ্ঠস্বর ছিল চাপা, কিন্তু মানবিক—না খুবই কৃত্রিম—ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, অন্তত খুঁজে বের করবেন কি ঘটছে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তাঁর হাঁটু বেঁকে এল। চোখের পাতা ভারি হয়ে এল। চারপাশ ঘোলা, আর শরীর যেন জমে গেল। পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে তিনি দেখেছিলেন একটা ছায়া—মানুষের আকৃতি, কিন্তু চোখে ছিল লাল আলো… কিংবা সেটা টর্চের রিফ্লেকশন ছিল? তারপর আর কিছু মনে নেই।

পরদিন সকালে রবিউল শেখ খবর পান—আরও একজন বন আধিকারিক নিখোঁজ। তিনি ও বর্ণালী দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং পায় সুধাংশুর মৃতদেহ। সেই একই পদ্ধতি—মাটি ছোঁয়া মুখ, গলায় ছোট সুঁচের দাগ, আর দেহ ছিঁড়ে গেছে বাঘের থাবার মতোভাবে। কিন্তু আশেপাশে পায়ের ছাপ গুলো ছিল একেবারেই অস্বাভাবিক। বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেলেও সেই সঙ্গেই ছিল ছাপা জুতো পরে চলা মানুষের স্পষ্ট পদচিহ্ন। বর্ণালী মণ্ডল সঙ্গেসঙ্গেই বললেন, “এখানে কেউ বাঘের চলার ছাঁচ তৈরি করছে, কেউ এটা সাজাচ্ছে।” অরণ্য সাহা এসে পৌঁছে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেন, এবং সিদ্ধান্ত নিলেন এবার থেকে সরকারি তদন্ত নয়—নিজেদের গোপন অনুসন্ধান চালাতে হবে। এভাবে একের পর এক মৃত্যু হওয়া মানে কেবল দুর্ঘটনা নয়—কেউ খুব নিখুঁতভাবে নিজের দাগ মুছে কাজ করছে, এবং শুধু বনকর্মীদেরই নিশানা করছে কেন, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কোথাও কি কেউ বন দফতরের একটি নির্দিষ্ট গোপন এলাকা থেকে লোকজন সরাতে চাইছে? নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এদের হটিয়ে একটা অঞ্চল দখল করতে চাইছে কোনো চোরাচালানের স্বার্থে?

সন্ধ্যায় ফরেস্ট অফিসে বৈঠক বসে, যেখানে রবিউল শেখ বলেন—“এই এলাকায় একটা পুরনো গুজব আছে, ‘বাঘ মামা’ নামে এক লোক নাকি আছে, যাকে কেউ চোখে দেখেনি, কিন্তু রাতবিরেতে বাঘের মতই সে ঘোরে… তার পায়ের ছাপ বাঘের মত, গলা দিয়ে আসে ফিসফিসে শব্দ।” অরণ্য সেই গুজব উড়িয়ে না দিয়ে বলেন, “গুজব অনেক সময় সত্যের খোলস হয়।” তিনি বর্ণালীকে দায়িত্ব দেন, সুন্দরবনের পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে এমন কোনও চোরাচালানের ঘটনা বা রহস্যময় প্রাণী সংক্রান্ত রিপোর্ট ছিল কি না, সেটা বের করতে। বর্ণালী বলেন, “প্রফুল্লবাবুর ব্যক্তিগত খাতায় আমি একটা লাল কলমে আঁকা সাংকেতিক চিহ্ন দেখেছিলাম… তিনটে তীরচিহ্ন আর একটা দাঁড়ানো বাঘের ছবি… ওটা কি চোরাকারবারীদের প্রতীক?” হঠাৎই সবকিছু যেন মিলতে শুরু করে—ট্রাঙ্কুইলাইজার, ছদ্মবেশী বাঘের থাবা, বনে ঘুরে বেড়ানো চোরাকারবারী, আর বন দফতরের ভেতর থেকেই লুকোনো সহযোগিতা। এই মৃত্যুরা দুর্ঘটনা নয়—একটা ‘হাত’ গোটা সুন্দরবনের প্রাণীজগতকে ব্যবসার বস্তু বানিয়ে ফেলছে, আর তার জন্য বাঘের ছায়া ব্যবহার করছে। তবে সেই ছায়ার পেছনে যে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, সেটা অরণ্য এখন নিশ্চিত। এবং তিনি এবার সিদ্ধান্ত নেন—এই মৃত্যুগুলোর হিসাব চাইতে হবে। সুন্দরবনের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে একটি নরখাদকের পরিচয়, যে মানুষের রূপে বাঘ হয়ে উঠেছে।

কলকাতা বিমানবন্দর থেকে নেমে নেমেই অরণ্য সাহা সুন্দরবনের হাওড়া ফেরি ঘাটের ভিড় অতিক্রম করে সরাসরি বন দফতরের অস্থায়ী কার্যালয়ে এসে পৌঁছালেন। পাঞ্জাবি শার্টের পকেটে মোবাইল ফোন ঠাসা, হাতে রস্ট্রুমে ঢুকেও সারি ভেঙে ফাইল পড়ছেন—কয়েকক্ষণের মধ্যেই তিনি জানতে পারলেন, দুইজন কর্মীর মৃত্যুর জায়গা এবং পদ্ধতির মধ্যে মিলটা অতীব মাত্রী: প্রত্যেকটিতেই ট্রাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশনের চিহ্ন, আর সেই চিহ্ন জঙ্গলের মোহনায় যেন একটা রক্তমাখা নাটকের আস্তরণ। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বলল, এটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব “মানবসৃষ্ট ঘটনা” হিসেবে তোলা দরকার, নয়তো বন বিভাগ এই গোটা পরিস্থিতিকে আবার বাঘ আক্রমণ বলে চাপা দেবে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বর্ণালী মণ্ডলের সাথে বৈঠকে বসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, মৃতদেহের ফরেনসিক রিপোর্ট, স্থানীয় বিট অফিসার রবিউল শেখের স্বাক্ষ্য—all একত্রে পুনর্বিবেচনা করতে বললেন। বর্ণালী, যে পূর্বে প্রফুল্ল ঘোষের ব্যক্তিগত খাতার সাংকেতিক চিহ্নগুলোর কথা উল্লেখ করেছিলেন, সে কাগজগুলো খুঁজে নিয়ে এলেন—লাল কলমে আঁকা “তিনটি তীর” আর পাশে দাঁড়ানো বাঘের প্রতীক। এই প্রতীক একদিকে যেমন চোরাচালানের কোনো গ্যাং—‘বাঘের ছায়া’—এর ব্র্যান্ডিং মনে হচ্ছিল, অন্য দিকে এর গভীরে লুকিয়ে ছিল বন বিভাগের কাউকে ভয় দেখানোর ডাক। অরণ্য বুঝতে পারলেন, শুধু বাঘ নয়, জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও প্রাণী—মানুষের বাসনা, লোভ আর নির্মমতা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে নেমে তিন জনেই পৌঁছালেন জাহানারা খাতুনের মৃতদেহের ঠিক পাশেই। জাহানারা, অভিজ্ঞতা ছিল কম, তবে সাহস ছিল অগাধ; একাই গভীর জঙ্গলে গিয়ে ট্র্যাকিংয়ের কাজ করছিলেন—একটু একা হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন যেন। বর্ণালীর ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এলো লাল কলমের সেই খাতা—জাহানারা ব্যক্তিগত দিনের পাতা, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, “গত বিকেলে হরু মাঝি আইসা কয়—বাঘ মামা জঙ্গলে ফাঁদ পাতা শুরু করছে। আমি যাচ্ছি তার ছায়া ধরতে।” এরপরের লাইনগুলো পড়ে বোঝা যেত, তিনি কোনও দৃশ্যমান প্রতি-প্রমাণে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু সরাসরি জঙ্গলে যাওয়ার আগে তার দেহে যে ট্রাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশনের দাগ, তাকে কেউ সচেতনভাবে মেরে ফেলে করেছে। গলায় জ্বলজ্বল তীব্র ব্যথা কাটানোর জন্য যে ইনজেকশন সেই রাতে গান্ধীনগর ঘাটে নৌকা থেকে পূঁছে বসিয়েছিলেন, তা কি তিনি আত্মরক্ষা করতে পারতেন? নাকি কারো ইন্ধনে দৃশ্যমান ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন? অরণ্য পকেটে রাখা লেন্স হ’তে বের করে সেই ক্ষুদ্র দাগগুলো আরো ঘনজোরে পর্যবেক্ষণ করলেন—রক্তের শুকনো দাগ, যে মুহূর্তে গলার নিচে প্লাস্টিকের সূক্ষ্ম আবরণ ফাটিয়ে শরীরে ঢুকে গিয়েছিল। খেয়াল করলেন, ছেঁড়া কাপড়ে চোখ বুলিয়ে দেখা যায়, বাঘের থাবা খোদাই করা ছাঁচের ছাপ, অদ্ভুত নিখুঁত—একেবারে বাঘ বা মানুষের নয়, বরং কেউ দুইয়ের মিশ্রণই তৈরি করছে। এই স্বপ্নের মতো মিলন আর রহস্যের মিশ্রণে অরণ্য নিশ্চিত হলেন—এবার আর শুধুই ফরেনসিক রিপোর্ট বা নামমাত্র তদন্ত থেকে কাজ চলবে না, জঙ্গলেই গোপন অভিযান চালাতে হবে।

রাত্রি নামতেই তিনজনই ক্যাম্পে ফিরে এলেন। অরণ্য স্বচ্ছ হাতে চা বানিয়ে সবাইকে বললেন, “এখন কেউ একা বেরোবে না, আমরা তিনজনেই থাকব একসঙ্গে, হাতে থাকবে শুধু ব্রাউনি হ্যান্ডগান আর অতিরিক্ত বল্ট-পাউচ।” রবিউল শেখ মাথা হিলিয়ে সম্মতি জানালেন, আর বর্ণালী বললেন, “আমি এখন জঙ্গল থেকে কিছু নতুন ছাপ সংগ্রহ করার চেষ্টা করব, ট্রাঙ্কুইলাইজারের প্রোবসেও আগের মতো কোনো নমুনা পাওয়া গেছে কি না, সেটা দেখতে চাই।” হঠাৎ বাতাসের একটা ঝাপটা দিয়ে ক্যাম্পের চতুর্দিকে ঝাঁজাল ভাবের ছায়া নেমে এল। অরণ্য বললেন, “শ্রোতরা বলে যে, সুন্দরবনের বাঘ রাতের বেলায় মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য অনেক সময়ই ‘গাজী পাড়ির রাজা’। কিন্তু আমরা সে গল্পগুলো ফেলা থাকবে। আজ রাতে যদি কেউ আমাদের ওপর হামলা করে, বুঝবেন সেটা বাঘ নয়, মানুষ।” তখনই দূরের কুয়াশা ঢেকে ফেলা শ্যামলাল জঙ্গলে হঠাৎ ভেসে এলো একটা পোড়া গাছের টুপের আওয়াজের মতো শব্দ… এবং মাটিতে পড়ে থাকা একটা শুকনো পাতা কুয়াশার ভেতর ছুটিয়া গেল। অরণ্যর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল—জঙ্গলের এ বার্তাটি শুধু সতর্ক করেছে, কিন্তু কে দিল সেটি? বাঘ মামা, নাকি তার ছায়া? আর সবচেয়ে বড় কথা, পরের শিকার কার হবে…?

সকালবেলা সুন্দরবনের নোনাজল পেরিয়ে অরণ্য সাহা, বর্ণালী মণ্ডল আর রবিউল শেখ পৌঁছালেন একটি পুরনো, পরিত্যক্ত রেঞ্জ অফিসের কাছে। জায়গাটিতে বহুদিন ধরে কেউ যেত না, কেবল গাছপালা আর লতা-গুল্ম ছেয়ে গেছে চারদিক। কিন্তু গতকাল রাতের ক্যাম্প থেকে কুয়াশার মধ্যে তারা যে শব্দ শুনেছিলেন, সেই দিকেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতার গাদার মধ্যে হঠাৎ বর্ণালীর চোখে পড়ল কিছু — বাঘের পায়ের ছাপ, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ছাপগুলো সরলরেখায়, সমান দূরত্বে পড়ে আছে। প্রকৃত বাঘের চলার ছন্দে ছাপ কখনওই এত নিখুঁত হয় না। বর্ণালী মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে ডাস্ট ব্রাশ দিয়ে পায়ের ছাপের গঠন খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তিনি বললেন, “এই ছাপগুলো ছাঁচ দিয়ে তৈরি করা। কোনও ভারী বুট জুতোর নিচে লাগানো প্লাস্টিকের থাবার ছাঁচ দিয়ে কেউ এগুলো বানিয়েছে।” অরণ্য নিরবিচারে বললেন, “তাহলে কেউ ইচ্ছে করে বাঘের উপস্থিতির ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করছে, যাতে প্রকৃত অপরাধ ঢেকে ফেলা যায়।” ঠিক তখনই রবিউল অদূরে একটি সাদা ক্যানিস্টার খুঁজে পেলেন, যার গায়ে লেখা: Medetomidine 20mg/mL – Veterinary Use Only। বর্ণালী বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললেন, “এটা তো খুব শক্তিশালী ট্রাঙ্কুইলাইজার। সাধারণ পশু চিকিৎসকরাও খুব কম ব্যবহার করেন। এর মানে এই চক্রের পেছনে কেউ রয়েছে, যে পশু ওষুধে অত্যন্ত দক্ষ।” অরণ্যর মনে পড়ে গেল এক পুরোনো নাম — ডঃ কুশল বাগচী, যিনি বছর পাঁচেক আগে সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য প্রকল্পের অংশ ছিলেন এবং হঠাৎ চাকরি ছেড়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার খবর অনুযায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে পশু পাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহও উঠেছিল, কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে ধরা যায়নি।

তাদের ফিরে আসার পথে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়—একটা বিষণ্ণ, ঘন জঙ্গলজোড়া নিস্তব্ধতা যেন একে একে আছড়ে পড়ছিলো জলধারায়। ফিরে এসেই অরণ্য প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করলেন এবং গোপন নোটবুকে লিখে রাখলেন: “পদচিহ্ন সৃষ্ট বাঘ নয়, বাঘ সৃষ্ট মানুষ।” তিনি আবার ডেকে পাঠালেন ডঃ শোভনালিকা মিত্রকে—এক পশু চিকিৎসক যিনি বনদফতরের পরামর্শদাতা এবং আগে কুশলের সহকর্মী ছিলেন। শোভনালিকা এসে মৃত সুধাংশু রায়ের ফরেনসিক নমুনা পুনর্বার পরীক্ষা করলেন এবং স্পষ্ট বললেন, “এই ইনজেকশন দিয়েছে খুব নিখুঁত হাতে। একজন প্রফেশনাল। এবং শরীরের এমন জায়গায়, যেখানে নাড়ি ছুঁয়ে দেওয়া যায়। সাধারণ কোনও চোরাকারবারী এত নিখুঁতভাবে ইনজেকশন দিতে পারবে না।” এরপর তিনি আরেকটা চমকপ্রদ তথ্য দিলেন—সেই ক্যানিস্টারটিতে তাদের পুরোনো গবেষণা প্রকল্পের সিল ছিল, যেটি বছরখানেক আগে রহস্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কেবল প্রাণীর শিকার নয়, বরং সুপরিকল্পিত গবেষণা লুকিয়ে আছে। অরণ্য বর্ণালীকে নির্দেশ দিলেন, বন দফতরের পুরনো ফাইল খুঁজে ডঃ কুশল বাগচী সম্পর্কে যতদূর সম্ভব তথ্য বের করতে। শোভনালিকা মাথা নিচু করে বললেন, “কুশল খুব প্রতিভাবান ছিল, কিন্তু তার ভেতরে একরকম অন্ধ ভালোবাসা ছিল শিকারের প্রতি। একসময় ও বলত—‘একটা বাঘের গায়ে হাত রাখলে আমি ঈশ্বরের ছোঁয়া পাই।’”

সে রাতে ক্যাম্পে বসে তিনজন কর্মকর্তার সামনে আবার আলোচনায় উঠল সেই নাম—“বাঘ মামা”। হরু মাঝি, যিনি দিনের বেলায় চুপচাপ ছিলেন, সন্ধ্যার সময় হঠাৎ এসে বললেন, “আপনারা মানুষ খুঁজছেন, আমি ছায়া দেখেছি। গত সাতদিনে পাঁচবার আমার নৌকার নিচে কিছু নড়েছে। সেটা বাঘের থেকেও ভয়ংকর। ওর চোখ দুটো লাল, আর সে কথা বলে না—শুধু তাকিয়ে থাকে।” অরণ্য ধৈর্য ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চোখে দেখেছো?” হরু কাঁপা গলায় বলল, “হ্যাঁ বাবু, কিন্তু মানুষ নয়, বাঘের মতো চলাফেরা করে… পায়ের ছাপও বাঘের, কিন্তু সে সোজা আমার দিকে হাঁটে। মানুষরূপী বাঘ।” কথাগুলো শোনার পরেও অরণ্য ভেঙে পড়লেন না। তিনি জানতেন, ভয় আর বাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। তিনি শেষবারের মতো ফাইলটা খুললেন, যেখানে প্রফুল্ল ঘোষের হাতে লেখা ছিল, “যদি আমি মরে যাই, খুঁজো—চিহ্নের নিচে ছায়া।” সেই চিহ্নটা ছিল তিনটি তীর আর একটি দাঁড়ানো বাঘ। অরণ্য এবার বুঝলেন, ছায়ার আড়ালে সত্যটা খুঁজে বের করতেই হবে, আর এর জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ হবে—ডঃ কুশল বাগচীর নাম ধরে তাকে খুঁজে বার করা। কারণ এখন পরিষ্কার, বাঘের থাবা নয়—মানুষের হাতেই রয়েছে এই মৃত্যুর মূল রহস্য।

জলগঙ্গার বুক পেরিয়ে সন্ধেবেলায় ছোট্ট নৌকাটি থামল মৌসুনি চরের কাছে, যেখানে বহু বছর আগে একটি পুরনো বন অফিসের ধ্বংসাবশেষ এখনও টিকে আছে, কিন্তু এখন তা জঙ্গলে ঢেকে গিয়ে একেবারে অদৃশ্যপ্রায়। অরণ্য সাহা, বর্ণালী মণ্ডল, রবিউল শেখ ও নৌকাচালক হরু মাঝি—এই চারজন পাড়ে পা রাখলেন। চারপাশে নিস্তব্ধতা এতটাই ঘন যে নিজেদের নিঃশ্বাসের আওয়াজও কানে বাজছিল। হরু মাঝি এবার হঠাৎ থেমে, ধীরে ধীরে বললেন, “এইখানেই একসময় ‘বাঘ মামা’ রাত্রে আশ্রয় নিতেন বাবু। এখন আর কেউ আসে না।” অরণ্য কিছু বলার আগেই হরু নিজের অভিজ্ঞতা শোনাতে শুরু করলেন—“একবার শীতকালে আমি, সোমেন আর নিতাই এখানে মাছ ধরতে এসে রাত কাটাই। রাতে শুনি কেউ একটা ঘরে ঢুকছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি—এক লোক, শরীরে চামড়ার জ্যাকেট, মুখে বাঘের মতো মুখোশ, গায়ে গামছা পেঁচানো, সামনে দাঁড়িয়ে একটা জ্বলন্ত লণ্ঠন আর বাঘের থাবার ছাঁচ বানাচ্ছে।” কথাগুলো শুনে বর্ণালী আঁতকে উঠলেন, “আপনি কিছু করেননি?” হরু একরকম গলায় বললেন, “আমরা তিনজন তো গলা ফাটিয়ে দৌড়েছি। পরদিন ফিরে এসে দেখেছি সেই ঘরে পড়ে আছে একটা কাঁচের শিশি—আর ভেতরে গাঢ় নীল তরল।” অরণ্য অবিলম্বে বললেন, “এই রকম কোনো শিশি কি এখনো আছে তোমার কাছে?” হরু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “রাখা ছিল, কিন্তু এরপর আমার নৌকা ডুবে গেছিল। তবে আমি মনে করি, সেই লোকটা মানুষ নয়, ওর শরীরের চলাফেরা, কথা না বলা, আর বাঘের মত মুখোশ… সব কিছুই যেন বিভীষিকাময়।” অরণ্য এবার নিশ্চিত হয়ে উঠলেন—বাঘ মামা শুধু ছায়া নয়, কোনো এক পিশাচী বাস্তব রূপ, যার ভয়কে স্থানীয় মানুষ গল্পে পরিণত করেছে।

তাঁরা সন্ধ্যার মধ্যেই সেই ভাঙা অফিসে প্রবেশ করলেন। টর্চের আলোয় ভেতরে দেখা গেল—আধাভাঙা টেবিল, চিত্রাহীন দেয়াল, আর এক কোণে একটি ছেঁড়া বস্তার ভেতরে কী যেন রেখেছে। বর্ণালী ধীরে ধীরে বস্তাটি খুললেন—ভেতরে পাওয়া গেল কয়েকটি প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে তৈরি থাবার ছাঁচ, কিছু পুরনো ট্রাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশনের খালি প্যাকেট, আর অদ্ভুতভাবে প্রাচীন কিছু পশু কঙ্কাল, যেগুলোকে জোড়া লাগানো হয়েছে রাবারের তার দিয়ে। রবিউল বললেন, “এগুলো শুধুই বাঘের ছায়া নয়, এ এক প্রকার হিংস্র ভয়ঙ্কর নাটক, যা কাউকে আতঙ্ক ছড়াতে সাহায্য করছে।” অরণ্য এসবের ছবি তুলতে তুলতে বললেন, “এটা একটা মোহজাল। কেউ আমাদের চোখের সামনে পশু হত্যা, পাচার আর খুন করছে, অথচ দেখাচ্ছে সবটাই বন্য প্রাণীর কাজ।” হরু মাঝি তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “এই চর আর একটা রহস্য লুকিয়ে রাখে বাবু। এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, জলার ভেতর একটা পুরনো কুয়া আছে—‘ঘুমন্ত বাঘের মুখ’ নামে পরিচিত। কারো সাহস হয় না যাওয়ার, কারণ কুয়োটা নাকি নিশুতি রাতে গর্জন করে।” অরণ্য প্রশ্ন করেন, “তুমি গেছো কখনো?” হরু মুখ নিচু করে বলেন, “একবারই গিয়েছিলাম। কুয়োর পাশে পেয়েছিলাম মানুষের হাড়… আর একটা ছোট তালা মারা কাঠের বাক্স।” বাক্সের ভেতরে কী ছিল, তা হরু বলতে পারেননি—কারণ খোলার আগেই একজন রহস্যময় লোক তাকে দেখে ফেলেছিল, আর সে পালিয়ে এসেছিল প্রাণ বাঁচাতে।

ক্যাম্পে ফিরে এসে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন পরদিন সকালে ‘ঘুমন্ত বাঘের মুখ’ কুয়োর দিকেই অভিযান চালাবেন। অরণ্য অফিসে বসে নিজের নোটে লিখলেন: “সত্যের ছায়া যতই ঘন হোক, তার পায়ের ছাপ ছাড়ে। এবার সেই ছায়ার স্রষ্টাকে বের করতেই হবে।” বর্ণালী সে রাতেই পুরোনো বন বিভাগের আর্কাইভ ঘেঁটে কুশল বাগচীর নাম আর একটি কোড ফাইল খুঁজে পেলেন—“PROJECT BHAIRAVA”—এক গোপন গবেষণা প্রকল্প, যার মাধ্যমে বাঘের মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা চলছিলো, এবং ট্রাঙ্কুইলাইজারের মাধ্যমে বাঘকে ব্যবহারযোগ্য বানানোর পরিকল্পনা ছিল। কুশল সেই প্রকল্পে লিড করেছিলেন, এবং হঠাৎ একদিন সেই সমস্ত রিপোর্ট সহ উধাও হয়ে যান। এখন এটা স্পষ্ট—এই কুশলই হয়ত “বাঘ মামা” ছদ্মনামে ফিরে এসেছে। অরণ্য বুঝলেন, এটি আর কোনও অজানা অস্তিত্ব নয়, বরং একজন পাগল বিজ্ঞানীর নির্মিত আতঙ্ক, যার থাবায় পড়ে যাচ্ছে একের পর এক বনকর্মী। প্রশ্ন একটাই: সে কেন এই হত্যার খেলায় মেতেছে? প্রতিশোধ, গবেষণার বিকৃতি, না কি আরও কোনও ভয়াবহ উদ্দেশ্য? সেই উত্তর লুকিয়ে আছে ‘ঘুমন্ত বাঘের মুখ’-এর কুয়োর ভেতর, যেখানে পৌঁছোতে হলে পাড়ি দিতে হবে জলার বুক, আর মুখোমুখি হতে হবে সুন্দরবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মানবছায়ার।

সকালবেলা যখন ঘন কুয়াশা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, অরণ্য সাহা ও তাঁর দল রওনা দিল ‘ঘুমন্ত বাঘের মুখ’ কুয়োর উদ্দেশ্যে। চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন রুদ্ধ, জলাভূমির ধারে ধারে হাঁস, বক, আর কাঁকড়ার গর্ত; কিন্তু তার ভেতরেও এক অদ্ভুত ঠান্ডা শূন্যতা বিরাজ করছিল। বর্ণালী মণ্ডল আগের রাতেই ‘Project Bhairava’ ফাইল থেকে সংগ্রহ করা তথ্যগুলো নিয়ে এসেছিলেন। নৌকার ছাউনি তোলা হতেই অরণ্য সেই ফাইল খুললেন—অল্প বাতাসে পাতা উল্টে যাচ্ছিল, যেন কাগজগুলো নিজেরাই অস্বস্তিতে কেঁপে উঠছে। রিপোর্ট বলছে: “PROJECT BHAIRAVA — experimental neural sedation protocol for Panthera Tigris, lead: Dr. Kushal Bagchi.” অর্থাৎ, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল বাঘের ওপর গভীর স্নায়ু-নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে তাকে “অবচেতন রেসপন্স” শেখানো, যাতে তাকে অস্ত্র বা নজরদারি কাজে লাগানো যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সুন্দরবনেরই একটি নির্দিষ্ট চরে কয়েকটি বাঘকে ধরে এদের ওপর সেই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ১৮ মাসের মাথায় তিনটি বাঘ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, এবং এক বনকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। তখন তদন্ত বন্ধ করে প্রকল্প গোপনে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। অরণ্য বিস্ময়ে বললেন, “এর মানে কুশল সেই সময় থেকেই নিজের মতো কিছু চালাচ্ছিল। সম্ভবত, প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পর সে গোপনে কাজ চালিয়ে গেছে।” ঠিক তখনই রবিউল শেখ ফাইলের একটি পৃষ্ঠা তুলে বললেন, “এই দেখুন, এখানে লেখা আছে—‘Subject 3 showed significant responsiveness to ocular light trigger’—মানে কুশল হয়তো বাঘের মস্তিষ্কে এমন কিছু কাজ করছিল যেটা চোখের আলো দেখলেই রেসপন্স করে। এখন মনে হচ্ছে, সে হয়তো শুধু বাঘ নয়, মানুষকেও এই পরীক্ষার অংশ বানিয়েছে।”

‘ঘুমন্ত বাঘের মুখ’ কুয়োর কাছে পৌঁছাতেই এক অস্বাভাবিক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে—জলে ভেজা রাবার আর পুরনো ট্রাঙ্কুইলাইজারের তীব্র রাসায়নিক গন্ধ। কুয়োর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছগুলোর গায়ে আঁকা ছিল লাল কালি দিয়ে তৈরি অদ্ভুত প্রতীক—তিনটি তীর আর তার নিচে একটি ছায়ার মত বাঘরূপী মুখ। কুয়োর মুখ ছিল পাথরে বাঁধানো, আর পাশে ছাউনি ঘেরা একটি অস্থায়ী ঘর। তারা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই বিস্ময়ে হFrozen হলো—ভেতরে রাখা ছিল চ্যাপ্টা প্যাথোলজি বোর্ড, যার ওপর মানুষের মস্তিষ্কের নকশা, পশুর নিউরাল পাথওয়ে, এবং ট্রাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশনের রুটিন চিহ্নিত করে তৈরি বিশাল নীল ছক। পাশেই রাখা ছিল একটি বন্ধ ট্রাংক, যেটির তালা ভেঙে দেখা গেল—ভেতরে ছেঁড়া ইউনিফর্ম, তিনজন নিহত বনকর্মীর আইডি কার্ড, ও একটি ছোট খাতা। খাতাটি খুলতেই দেখা গেল কুশলের হাতে লেখা পংক্তি—“প্রকৃতির শান্তি আসে শিকারের ভারসাম্য রক্ষায়। যারা বাধা দেয়, তারা ব্যাঘ্র-ক্রোধে দগ্ধ হবে।” অরণ্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন—এ যেন একজন বিকৃত অথচ নির্ভুল বিজ্ঞানীর মনোগ্রাফ, যে নিজেকে প্রাকৃতিক বিধান প্রতিষ্ঠার ‘মাধ্যম’ বলে মনে করে। রবিউল ফিসফিস করে বললেন, “মানে কুশল নিজেকে কোনো মিশনের সৈনিক মনে করছে। যাদের সে হত্যা করছে, তারা তার বিশ্বাসে প্রতিবন্ধক।” বর্ণালী এও খেয়াল করলেন যে খাতার একাধিক পাতায় ডিএফও প্রফুল্ল ঘোষের নাম লেখা, তার পাশে লাল কালি দিয়ে ঘেরা কুণ্ডলী আর নিচে লেখা ‘বিপদ’। এই মৃত ব্যক্তিদের সবাই কোনো না কোনোভাবে পুরনো প্রকল্প বন্ধ বা তদন্ত করতে চেয়েছিলেন। কুশল তাই হয়তো একে একে তাদের হত্যা করছিল।

ফেরার পথে অরণ্য আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি স্পষ্ট বুঝে গেলেন—এই হত্যার নেপথ্যে কেবল পাগলামি নয়, বরং এক বিজ্ঞানমনস্ক মনস্তত্ত্ব কাজ করছে, যে প্রকৃতিকে বিকৃত করে এক নিজস্ব ‘নিয়ম’ তৈরি করতে চাইছে। ক্যাম্পে ফিরে তিনি জরুরি বৈঠক ডাকলেন বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিয়ে। কিন্তু যেই মুহূর্তে তিনি ফোন করতে গেলেন, বর্ণালী বাধা দিলেন—“স্যার, ফোনে কিছু বলবেন না। এই গোটা বিষয়টা উপরে জানালে কুশলের মদদপুষ্ট কেউ ওখান থেকেই প্রমাণ নষ্ট করে ফেলবে।” অরণ্য থেমে গেলেন। সে মুহূর্তে একটা প্রশ্ন তীব্র হয়ে উঠল—কুশল একা কি এসব করেছে? না কি বন দফতরের কেউ, উচ্চপদস্থ কেউ, তার এই কাজে সহযোগিতা করেছে? আর যদি করে থাকে, তবে কি PROJECT BHAIRAVA আদতে সরকারের অনুমোদনহীন কোনও ‘ছায়া প্রকল্প’? হয়তো এর মাধ্যমে শুধু বাঘ নয়, মানুষকেও নিয়ন্ত্রণের খেলায় ব্যবহার করা হচ্ছিল। ঠিক তখনই ক্যাম্পের বাইরে পাহারায় থাকা রবিউল হঠাৎ ছুটে এসে বলল—“স্যার, আমাদের নৌকোর পাশ থেকে একটা রেকর্ডার পেলাম… কেউ আমাদের কথাবার্তা গোপনে রেকর্ড করেছে।” ক্যাম্পে অন্ধকার নেমে এল, শুধু টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফাইলের ছায়ায় সেই খোলা পাতাটিতে লেখা একটি লাইন উজ্জ্বল হয়ে রইল—“বাঘ তো শুধু মুখোশ, থাবা তো মানুষেরই।”

ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই অরণ্য সাহা তার ছদ্মবেশে সাজানো পরিকল্পনা কার্যকর করলেন। ক্যাম্পের স্যাটেলাইট ফোনে নির্ভর না করে তিনি ও বর্ণালী মণ্ডল ঠিক করলেন—প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত ওপর মহলে কিছু জানানো যাবে না। রাতের অন্ধকারে রবিউল শেখ ও হরু মাঝির সহযোগিতায় তাঁরা পৌঁছে গেলেন মৌসুনি চরের উত্তর-পূর্ব কোণে, যেখানে ‘চিড়িয়াখানা ঘেরা’ বলে পরিচিত একটি জায়গা আছে—স্থানীয় ভাষায় “কাঁচা জঙ্গলে তৈরি অস্থায়ী শিবির” হিসেবে পরিচিত। হরু মাঝি বলেছিল, এখানেই মাঝেমধ্যে মাঝরাতে স্পিডবোট এসে থামে, অজানা মাল লোড করে যায়। আগেও কেউ সেখানে প্রবেশের সাহস করেনি, কারণ বাঘ মামার গর্জন নাকি এখান থেকেই শোনা যেত। অরণ্যর মনে পড়ে গেল গত কয়েকদিনের রহস্য: প্রকৃত বাঘ ছিল না কোথাও, কিন্তু গর্জনের শব্দ, ট্রাঙ্কুইলাইজারের গন্ধ আর ছাঁচের থাবা—সব মিলিয়ে এক কৃত্রিম আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। তাঁরা তিনজন পেছনের দিকের জলচর ধরে চুপিসারে কাছে গেলেন। ঘন লতায় ছাওয়া ছোট একটি ঘর, বাইরের প্রাচীরে বাঁশ ও ত্রিপলের ছাউনির ভেতর এক ধরণের গুদামঘর। ভিতরে দেখা গেল চারটি ড্রাম, তার মধ্যে রাখা প্রোটিন ইনজেকশন, চেতনানাশক ওষুধ, বন্যপ্রাণীর চামড়া, দাঁত, এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর—বাঘের দুই ছানা কাঁচা খাঁচায় জীবিত আটকে রাখা।

বর্ণালী বিস্ময়ে ফিসফিস করে বললেন, “এরা তো সরকারি গবেষণার নমুনা! এগুলো তো কেবল Project Bhairava-র অংশ ছিল!” অরণ্য কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে ড্রামের পাশে থাকা একটা বক্স খুললেন, যার মধ্যে গোপনে রাখা ছিল বেশ কয়েকটি রেকর্ডিং যন্ত্র, দুটি কম্পিউটার হার্ডডিস্ক, এবং প্রমাণস্বরূপ একাধিক সরকারি সীলমোহর। অরণ্যর গলা খসখসে হয়ে গেল—এইসব প্রমাণ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, এই গ্যাং শুধু পাচার নয়, বরং সরকারি প্রকল্পের ছদ্মবেশে অবৈধ গবেষণা চালাতো। তখনই রবিউল হঠাৎ ঘরের কোণের অন্ধকারে এক সিন্দুক দেখে এগিয়ে গেলেন। তালা ভেঙে দেখা গেল একগুচ্ছ চিঠি—তাতে কুশল বাগচীর হাতে লেখা বিভিন্ন নোট এবং তার নির্দেশনা, যেগুলো পাঠানো হয়েছে “আর কে” নামের এক ব্যক্তিকে। সেই চিঠির একটিতে লেখা ছিল—“যতদিন না পর্যন্ত তারা ‘বাঘ মামা’কে বিশ্বাস করবে, ততদিন আমাদের কাজ নিরাপদ। তোমার দায়িত্ব শুধু মিডিয়াতে বাঘের খবরে আতঙ্ক ছড়ানো।” অরণ্য বুঝলেন, এই “আর কে” বন দফতরের কোনও উচ্চপদস্থ আধিকারিক, যে কুশলের এই কর্মকাণ্ডে নীরবভাবে সাহায্য করছিল। তখনই আচমকা বাইরে টর্চের আলো পড়ল। কেউ বা কারা তাদের উপস্থিতি বুঝে ফেলেছে। অরণ্য তৎক্ষণাৎ বর্ণালী ও রবিউলকে বললেন, “ফাঁকা হাতে ফিরব না। এই হার্ডডিস্ক আর কাগজগুলো নাও, আমি ওদের বাধা দিই।” তিনি বন্দুক হাতে ঘরের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, আর দুজন অন্ধকারে হারিয়ে গেল খালের পাশ ঘেঁষা সরু পথ ধরে।

অরণ্য বনের ফাঁকা অংশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঘন কুয়াশায় চারদিক অস্পষ্ট। তখনই সামনে এসে দাঁড়াল তিনটি মুখোশধারী মানুষ—তাদের হাতে তীরধনুক, মুখে পশুর চামড়ার ছায়াময় মুখোশ, আর কাঁধে বন বিভাগের পুরনো ব্যাজ। একজন বলল, “তুমি যেটা জানো, সেটা জানাই ঠিক ছিল না, সাহা বাবু। এত কৌতূহল ভালো নয়।” তারা অরণ্যকে ঘিরে ধরতে শুরু করে, কিন্তু ঠিক তখনই গুলির শব্দে সব কেঁপে ওঠে—বর্ণালী মণ্ডল পাহাড়ি কৌশলে উঁচু গাছের ডাল থেকে স্নাইপ শটে একজন মুখোশধারীর কাঁধে গুলি ছুড়ে দেয়। অরণ্য সুযোগ বুঝে নীচু হয়ে পড়ে থাকা একটা কাঠের ঢাকনা দিয়ে আরেকজনকে আঘাত করেন। রবিউল পেছন থেকে এসে তৃতীয় ব্যক্তিকে ধরে ফেলেন। মুখোশ খুলতেই দেখা গেল, সে বন দফতরের এক নিম্নপদস্থ কর্মী, যার কাজ ছিল পরিবহন ও নজরদারি। সে কেঁদে পড়ে স্বীকার করে—“সব কুশল বাবুর নির্দেশে করেছি, বাবু! আমরাও ভয় পেতাম ওকে। বলত, বাঘের আত্মা ওর ভেতর ঢুকে গেছে!” অরণ্য তখন জোর গলায় বললেন, “না, আত্মা নয়—ভয় ঢুকেছে, আর সেটা তৈরি করেছে কুশল। আর তোমরা সেই ভয়ের দালাল।” সবাই মিলে ফেরত আসে ক্যাম্পে। হাতে প্রমাণ, ভিডিও রেকর্ডার আর সেই খাঁচার ছবি।

সেদিন রাতে ক্যাম্পের আলো যখন কুয়াশা ছুঁয়ে হেলে পড়ছিল, অরণ্য তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন: “ছায়ার রূপ উন্মোচিত হলো, কিন্তু তার ছায়া যাদের মাথায় পড়েছে, তারা এখনো অন্ধকারে। এবার সময় এসেছে মুখোশের আড়ালের মুখ প্রকাশের।” পরদিন কলকাতা বন ভবনে একটি গোপন ইমেল পাঠানো হলো—প্রমাণ, চিঠি, রেকর্ডার, সব সহ। এবার আর ফিরে তাকাবার নয়। কিন্তু অরণ্য জানতেন, বড় ফাঁদ এখনো সামনে। কারণ কুশল বাগচী এখনো ধরা পড়েনি। এবং যতক্ষণ না তার মুখোশ খুলছে, ততক্ষণ থাবার হুমকি থেকেই যাবে।

সন্ধে নামে ধীরে ধীরে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের নির্জনতা যেন আরো গা-ছমছমে হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ অরণ্য সাহা জানতেন, সমস্ত ছায়ার উৎস একটাই—ডঃ কুশল বাগচী। হরু মাঝির দেয়া তথ্য এবং কুয়োর নীচের গোপন চিঠির সূত্র ধরে অরণ্য ও বর্ণালী বেরিয়ে পড়েছিলেন সুন্দরবনের এক প্রাচীন নির্জন দ্বীপের দিকে, যেখানে এক সময়ে বন বিভাগের গোপন গবেষণাগার ছিল, পরে পরিত্যক্ত। হাওয়ার গর্জন, কাঁকড়ার চলাফেরা, আর দূরে কোথাও হরিণের ডাক—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত স্বপ্নের মতো পরিবেশ। কিন্তু সেই স্বপ্নে জেগে ছিল এক দুঃস্বপ্নের মানুষ, যে বাঘের মুখোশ পরে মানুষের বিচার করে চলেছে। চন্দনের গন্ধে ভেজা কুয়াশার মধ্যে কাঠের পুরনো ঘরটি দেখা দিল—মাটির ওপর বাঁধানো ছাউনি, ভেতরে মাটি কাটা টেবিল, আর দেয়ালে ঝুলছে প্রাণীর হাড়, চোখের স্নায়ুর মানচিত্র, এবং কেন্দ্রীয়ভাবে রাখা একটা কাঁচের খাঁচা—ভেতরে এক ব্যথাতুর বাঘছানা। ঠিক তার সামনেই বসে থাকা একজন, কাঁধে বর্ণহীন শাল, মুখে ধূসর দাঁড়ি-গোঁফ, চোখে কাঁচের চশমা, কিন্তু সবার চেয়ে বেশি কুয়াশাভরা চাহনি। তিনিই কুশল বাগচী।

অরণ্য পা টিপে ঘরে ঢুকতেই কুশল ধীরে বলে উঠলেন, “তুমি এসেছো, সাহা। আমি জানতাম।” বর্ণালী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থমকে গেলেন, আর কুশলের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক বিকৃত হাসি। “তুমি তো জানো, প্রকৃতি ব্যালেন্স খোঁজে। আর মানুষ সেটা ভাঙে। আমি শুধু সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনছি। বাঘ আর মানুষ—দু’জনের মাঝের প্রাচীর সরিয়ে দিয়েছি,” বলে কুশল একটি বটল দেখালেন, যার গায়ে লেখা—‘Oculine Neural Tincture’—এক বিশেষ ট্রাঙ্কুইলাইজার মিশ্রণ, যা পশুর চোখের আলোয় সাড়া দিয়ে আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। অরণ্য সামনে এগিয়ে বললেন, “তুমি বাঘ নয়, তুমি পশুত্বের গবেষণার নামে খুন করেছো। প্রফুল্ল ঘোষ, সুধাংশু, জাহানারা—তারা শুধু প্রতিবন্ধক ছিল, তাই?” কুশল এবার দাঁড়ালেন। “তারা আমার পথ আটকাল। PROJECT BHAIRAVA থামিয়ে দিলো। সরকার ভয় পেল। আমি ভয় পাইনি। আমি বাঘের মত দেখতে মুখোশ পরি, কারণ এতে মানুষ ভয় পায়, আর ভয় দেখালে মানুষ থামে। তুমি থামবে না বুঝি?” তার চোখে তখন উন্মাদনা। বর্ণালী এবার গর্জে উঠলেন, “তুমি শুধু পাগল না, তুমি খুনী। তুমি বাঘ না, শকুন। বিজ্ঞানী হলে মানুষ বাঁচাও, খুন করো না।” কুশল তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি জানো না—আমি এই খাঁচায় রাখা বাঘছানাটির নাম রেখেছি—‘মানব’। কারণ এর ওপর আমি মানুষের নিউরাল প্রতিক্রিয়া প্রয়োগ করেছি। ও আমার সৃষ্টি।”

ঠিক তখনই অরণ্য কুশলের দিকে এগিয়ে গেলেন ধীরে ধীরে, পকেট থেকে বের করলেন সেই রেকর্ডার, যেটি গোপনে কুশলের কথোপকথন রেকর্ড করছিল। কুশল ছিটকে গেলেন। “তুমি আমার কথা রেকর্ড করছো?” হঠাৎ ঘরের পেছনের দিকে তীব্র গর্জন। অরণ্য পেছনে তাকিয়ে দেখলেন—দুইজন মুখোশধারী দালাল প্রবেশ করেছে, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে। “তোমার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম, সাহা,” বলে একজন গুলি চালাল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে খাঁচার দরজা খুলে যায়। বাঘছানাটি, যদিও ছোট, তবু ভয়ংকর তীক্ষ্ণতায় একজন দালালের পায়ে কামড় বসিয়ে দেয়। বর্ণালী পেছন থেকে একটি কাঠ তুলে আরেকজনের মাথায় আঘাত করেন। কুশল পালাতে যায়, কিন্তু অরণ্য ঠিক তার পথ আগলে দাঁড়ায়। “তোমার বিজ্ঞান আর মুখোশ এখানেই শেষ,” বলে অরণ্য তাঁর হ্যান্ডগান বের করে বললেন, “চল, এবার বনবিভাগের প্রকৃত গুহায় চল, যেখানে সত্যর মুখোশ খোলে।” কুশল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চেহারায় তখনও সেই একই পাগলামি। “আমার কাজ তো শেষ সাহা, আমি ছায়া তৈরি করেছি… এবার তারাই চলবে,” বলে সে নিঃশ্বাস ফেললেন।

সেদিন রাতে অরণ্য, বর্ণালী, আর রবিউল ফিরে এলেন ক্যাম্পে। কুশল গ্রেপ্তার, সমস্ত প্রমাণ হেফাজতে, PROJECT BHAIRAVA চিরতরে বন্ধ। কিন্তু ক্যাম্পে বসে অরণ্য তাঁর নোটবুকে শেষ বাক্যটি লেখেন—“ছায়া তো ধরা পড়ে, কিন্তু ভয়? সে রয়ে যায়… বাঘের থাবা আর মানুষের মন, দুটোই গভীর জঙ্গল।”

ডঃ কুশল বাগচীর গ্রেপ্তারের খবর কোলকাতা বনবিভাগে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি অদৃশ্য ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল উপরের মহলে। অরণ্য সাহা ও বর্ণালী মণ্ডল তখন ব্যস্ত কুশলের নোটবুক, ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক বিশ্লেষণে। প্রতিটি ফাইলে এক অদ্ভুত নাম ঘুরেফিরে এসেছে—“RK”, কখনও ছদ্মনামে, কখনও ‘পরিচালক’, কখনও কুশলের একমাত্র ‘শক্তি’। বর্ণালী গভীর অনুসন্ধানে আবিষ্কার করলেন এক গোপন কোডেড ফোল্ডার—RiktaKanta.doc—যার মধ্যে কুশলের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে একটি বার বার উঠে এসেছে: “যদি আমি ধরা পড়ি, তোমাকে বোঝাতে হবে—তুই আমাকে শুরু করেছিলি। এই থাবা তোর দেওয়া।” এক মুহূর্তের মধ্যে সেই নাম খুলে গেল—রিক্তকান্ত রায়, পশ্চিমবঙ্গ বনবিভাগের এক জ্যেষ্ঠ আধিকারিক, বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিনির্ধারণী বোর্ডের উপদেষ্টা, বহুদিন আগে সুন্দরবনের বাঘ পুনর্বাসন প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অরণ্য হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, “এই লোকটাই RK। ও-ই কুশলকে নিয়োগ করেছিল, ও-ই PROJECT BHAIRAVA-র পেছনের আসল মাথা। আমরা যদি কুশলকে শুধু পাগল বিজ্ঞানী ভাবি, তাহলে RK শকুন, যে নিজের ছায়ায় লুকিয়ে থেকেছে।” ঠিক তখনই অফিসে ফোন আসে—কলকাতা হেডকোয়ার্টার থেকে, অদ্ভুত ঠাণ্ডা গলায় এক অফিসার জানান, “সাহা বাবু, আপনি আগামীকাল দুপুরে পরিবেশ বোর্ডে রিপোর্ট জমা দেবেন, নির্দেশ উপরের মহল থেকে।” ফোন কেটে যেতেই বর্ণালী বললেন, “তারা চায় আপনি শহরে যান, যাতে ফাঁকা পড়ে আপনার তদন্ত ক্যাম্প, আর এর মধ্যেই তারা প্রমাণ নষ্ট করতে পারবে।” অরণ্য গভীরভাবে চিন্তা করলেন, তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন—তিনি যাবেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাবেন একটি চিঠি, একটি খাঁচা ও একটি রেকর্ডার, যাতে সত্য চেপে রাখা না যায়।

পরদিন দুপুরে অরণ্য সাহা উপস্থিত হন পরিবেশ ভবনে। ঠাণ্ডা এয়ারকন্ডিশনের ভেতরে গা ছমছমে নিঃশব্দতা। কুশলের হাতে লেখা চিঠি, প্রমাণের ফোল্ডার আর বাঘছানাটির ভিডিও-সহ তিনি পৌঁছে যান রিক্তকান্ত রায়ের কেবিনে। বিশাল টেবিলের ওপারে বসে থাকা মানুষটি মুখে হাসি নিয়ে বললেন, “অরণ্য বাবু, আপনি আজকাল বেশি সক্রিয় হচ্ছেন। প্রকৃতিকে অত বিশ্লেষণ করলে সে রেগে যায়।” অরণ্য দৃঢ় গলায় বলেন, “আমি বিশ্লেষণ করি না, সত্যি উন্মোচন করি। আর এই চিঠিগুলো বলছে, আপনি কুশলের ‘গাইড’, আপনি তাঁকে শুরু করেছিলেন।” রিক্তকান্ত হেসে বলেন, “বিজ্ঞান তো শুধু কাগজে নয় সাহা, তার আত্মাও আছে। আমি কুশলকে বাঁচিয়েছিলাম। তুমিই তাকে শেষ করলে।” অরণ্য এবার রেকর্ডারটি চালান—কুশলের শেষ কথাগুলো: “RK আমাকে বলেছিল, ‘বাঘ মানুষ নয়, মানুষ বাঘ হলে তারে চিনে নেব।’ আমি শুধু বাঘ বানাতে গিয়েছিলাম।” এই প্রমাণ শুনে রিক্তকান্ত মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যান, তারপর ধীরে বলেন, “আমার সময় ফুরিয়েছে, সাহা। তুমি যা খুঁজেছিলে, তা পেয়ে গেছ। এবার ফিরে যাও। আমার আর কোনও মুখোশ নেই।” অরণ্য এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আপনার মুখোশ এখন কেবল আইনের হাতে যাবে, রিক্তকান্তবাবু।” ঠিক তখনই কলকাতা পুলিশ ও ফারেস্ট ভিজিল্যান্স অফিসার প্রবেশ করেন, অরণ্যর আগেই পাঠানো ইমেলের ভিত্তিতে। রিক্তকান্ত দাঁত চেপে বলেন, “তোমরা বাঘের গর্জন থামাতে পারবে না, সাহা। কেউ পারবে না।”

রাত তখন গভীর। সুন্দরবনের ক্যাম্পে ফিরে অরণ্য দেখলেন, বর্ণালী একটি নতুন নোট খুলেছেন—‘Operation Mangal—Bhairava-এর পরবর্তী পর্যায় প্রতিরোধের পরিকল্পনা।’ অরণ্য জানেন, এ এক যুদ্ধের শেষ নয়, কেবল প্রথম ছায়ার পতন। PROJECT BHAIRAVA-র পেছনে আরও অর্থ, আরও মুখোশধারী রয়ে গেছে—দেশি-বিদেশি অনুদান, বায়োটেক কোম্পানি, আর গোপন ল্যাবরেটরির সাথে। কিন্তু অন্তত আজ একটি নাম মুখোশহীন হলো। সেই রাতে অরণ্য একটি চিঠি লেখেন, যার ঠিকানায় লেখা—”ভারতের বন্যপ্রাণী ভবিষ্যতের জন্য।” চিঠিতে তিনি লেখেন:
“বাঘের থাবা প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, মানুষের লোভের ছায়া। সেই ছায়া যতদিন বাঁচে, বাঘ ততদিন শিকার নয়, অস্ত্র হয়। আমাদের দায়িত্ব—সেই অস্ত্র ভেঙে সত্যকে সামনে আনা।”

১০

বর্ষার এক ভেজা সকালে অরণ্য সাহা বসে আছেন ক্যাম্প অফিসে। ছাউনির ওপর বৃষ্টির ফোঁটার পর্দা টেনে দিয়েছে সময়কে; চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল জলে ভিজে ওঠা বনের গন্ধ এবং জলের ঝরনার মতো গর্জন। PROJECT BHAIRAVA নিষ্ক্রিয়, ডঃ কুশল বাগচী ও রিক্তকান্ত রায় গ্রেপ্তার, সমস্ত প্রমাণ ভারত সরকারের হাতে। সুন্দরবনের অন্ধকার যেন কিছুটা পাতলা হয়েছে—কিন্তু অরণ্য জানেন, এই জঙ্গল সম্পূর্ণরূপে কখনও শান্ত হয় না। হঠাৎ করেই হাতে এল একটি প্যাকেট—কোনও প্রেরকের নাম নেই, কেবল লেখা ‘সাহা বাবু, আপনি যা দেখেন, সবটাই আলো না’। ভেতরে ছিল একটি পুরনো ক্যামেরা রিল, একটি মানচিত্র এবং একটি চিঠি, কুশল বাগচীর হাতের লেখা নয়—বরং এক অচেনা স্টাইল, সম্ভবত গবেষণার সহকারীর, অথবা আরও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কোনও বিজ্ঞানীর। চিঠিতে লেখা ছিল:
“তোমরা বাঘের ছায়া ধরেছো। এখনো রয়ে গেছে সেই থাবা, যেটা আরেকটি দ্বীপে বিশ্রামে আছে। কুশল শুধু মুখ, দেহটা ছিল অন্য কোথাও। PROJECT BHAIRAVA এখনো শেষ হয়নি।” অরণ্য চুপচাপ সেই মানচিত্র খুলে দেখলেন—এটি সুন্দরবনেরই এক অচিহ্নিত দ্বীপ, যেখানে নাকি ‘মৃত বাঘেদের পুনরুজ্জীবন গবেষণা’ চালানো হচ্ছিল। চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিল—”তার আগে আমার ছায়ার খোঁজ নিও—নাম ছিল, এখন আর নেই। আমি থাবা ছিলাম, বাঘ নয়।” সেই লাইন অরণ্যের শিরায় হিম শীতলতা ছড়িয়ে দিল।

তিনি বর্ণালী মণ্ডলকে ডাকলেন, চিঠি দেখালেন। দু’জন সিদ্ধান্ত নিলেন—তারা যদি এই কাজ শেষ করতে চান, তবে শেষ ছায়াটাকেও উন্মোচিত করতে হবে। ক্যাম্প ছেড়ে অরণ্য, বর্ণালী ও রবিউল ফের যাত্রা করলেন সেই ‘চিহ্নহীন’ দ্বীপের দিকে, যেটি স্থানীয় জেলেরা “মরণচর” বলে ডাকে। সেখানে পা রাখতেই চোখে পড়ল—পুরনো গাছের কাণ্ডে খোদাই করা মুখোশের ছবি, পাথরের নিচে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্লাস্টিক ইনজেকশন, আর একটি ঝুপড়ি, যার ভিতরে ছোট এক কম্পিউটার স্টেশন এখনো চালু, সোলার প্যানেল চালিত। ভিতরে রাখা ফাইলে দেখা গেল—PROJECT BHAIRAVA-2.0 শুরু হওয়ার আগেই কেউ গোপনে এখান থেকে তথ্য সরিয়েছিল এবং রপ্তানি করেছিল বাইরের এক বায়োটেক ফার্মে। এই তথ্য কুশল জানত না। অর্থাৎ, সে নিজেই ছিল একটা বড় ছায়ার পুতুল। ঠিক তখনই রবিউল এক ফাইলে পেলেন নাম—“Dr. A. Bhave, Bioethics, Zurich.” একজন বিদেশি বিজ্ঞানী, যিনি হয়তো পুরো প্রজেক্টের মূল পরিকল্পনাকারী। বর্ণালী বললেন, “মানে এটা শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক স্তরের প্রকল্প ছিল। আর আমরা এখন শুধুই প্রথম স্তর খুলেছি।” অরণ্য ধীরে বলে উঠলেন, “আমরা ভেবেছিলাম বাঘ আমাদের ভয়, এখন বুঝছি বাঘ আমাদের দর্পণ। আমরা যা করেছি, বাঘ তা ফিরিয়ে দিয়েছে।”

তারা ফিরে এলেন কলকাতায়। সরকার সব জানে, কিন্তু চুপ। কারণ এখন বিষয় আন্তর্জাতিক। অরণ্য বুঝলেন—এই খেলা এখন বৈজ্ঞানিক নয়, কূটনৈতিক। PROJECT BHAIRAVA হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু তার ছায়া আজও ঘুরে বেড়ায়। সেই রাতে অরণ্য তাঁর শেষ নোট লিখলেন—
“আমরা জঙ্গলের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলাম এক থাবা। এখন বুঝি, সেই থাবা শুধু পশুর নয়, মানুষেরও—যার নখে বিজ্ঞান, যার রক্তে ক্ষমতা, আর যার চোখে মুখোশ। আমরা মুখোশ খুলেছি। থাবা বাকি।”
বাইরে তখন আবার গর্জে উঠেছে মেঘ, আর এক কোণে রাখা বাঘছানাটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে তার পরবর্তী ভবিষ্যতের দিকে।

1000036003.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *