Bangla - সামাজিক গল্প

বাঁশবাগানের গন্ধ

Spread the love

সুকুমার ঘোষ


এক

কলকাতার সল্টলেকের অষ্টম তলার কর্পোরেট অফিস কাচের দেওয়ালের ভিতর বন্দি এক ফ্ল্যাটস্ক্রিন-চালিত জীবন। কেবিনের মাথার উপরে দুলছে স্পটলাইট, ডেস্কের কোণায় রাখা অ্যালো ভেরা পাত্রে মাটি শুকিয়ে গেছে, অথচ অভিরূপ বসুর চোখে ক্লান্তির ছায়া নেই—সে অভ্যস্ত। প্রত্যেকদিন সকাল ন’টায় ঠিক নীল শার্ট, ধূসর ব্লেজার আর চকচকে লেদারের জুতো পরে অফিসে প্রবেশ করে; তার মুখে এক প্রকার যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাস—যেটা হয়তো মাল্টিন্যাশনাল পরিবেশের জরুরি পোশাক। অভিরূপ একজন সফল ব্র্যান্ড ম্যানেজার, মেট্রিক্স আর কনভার্সনের পরিসংখ্যানের সঙ্গে যার ঘুম–জাগরণের সম্পর্ক। সে জানে কোন ক্লায়েন্ট কবে “impression” চায়, কাকে “engagement” দিয়ে মাতাতে হয়, আর কোন প্রেজেন্টেশনের সময় একটা থ্রি-পয়েন্টার স্লাইড শেষ মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দিতে পারে তিন মাসের পরিশ্রম। কিন্তু ঠিক সেই বাস্তবতার মাঝেই, একটি বৃষ্টিভেজা শুক্রবার দুপুরে, সে আচমকা জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে একটি অচেনা মেঘ। মেঘটা তার জন্য চেনা নয়, কিন্তু গন্ধটা খুব চেনা লাগে। গন্ধটা তাকে নি‌য়ে যায় অনেক দূরে—তাঁর ছেলেবেলার গ্রাম কুঞ্জডিহি। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে যেখানে সে ঘুড়ি ওড়াত, নদীর ধারে হাঁটত, আর বাঁশবাগানের পাতায় কান পেতে গল্প শোনার অভিনয় করত। হঠাৎই একটা শূন্যতা তাকে ঘিরে ফেলে—যেন আধুনিকতা তাকে চিবিয়ে গিলে ফেলেছে, কিন্তু কিছু ফাঁকা রেখেছে ভিতরে। ঐ দিনই কোম্পানির HR ডিপার্টমেন্ট তাকে জানায়, তার ছয় দিনের ছুটি জমে আছে—যদি না সে নেয়, পুড়ে যাবে বছরের শেষে। অভিরূপ প্রথমে হাসে, বলে, “ছুটি মানেই ইনবক্সে মেইল জমে থাকা।” কিন্তু সেই রাতে, অফিস থেকে ফিরে তার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হালকা বৃষ্টির মধ্যে কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে সে ভাবে—শেষ কবে সে পা দিয়ে মাটি ছুঁয়েছে সত্যিকারের? শেষ কবে ঘুম থেকে উঠে পাখির ডাক শুনেছে, না কোনো ফোর্সড অ্যালার্ম? তার ব্যালকনির গ্রিলে নামছে পানির রেখা, আর তার মাথায় ভেসে আসে বাঁশবনের গন্ধ—শুকনো পাতার, আর্দ্র দুপুরের, আর ছোটবেলার মাটির ঘ্রাণ। পরদিন সকালে, গাড়িতে বসে ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের রিপোর্ট পাঠাতে পাঠাতে হঠাৎ সে বুক পকেট থেকে একটা পুরোনো ছবি বার করে। তাতে সে নিজে—দশ বছরের এক ছেলেমানুষ, পিছনে এক দীর্ঘ বাঁশবন, সামনে নদী। ছুটির সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তেই পাকা হয়ে যায়। সে ঠিক করে—যা কিছুর থেকে সে বহু বছর পালিয়ে বেড়িয়েছে, তার মুখোমুখি হবে এবার। আর সেই মুখোমুখি হওয়ার জায়গাটা অন্য কোথাও নয়—ঠিক সেই পুরোনো গ্রাম, কুঞ্জডিহি।

ট্রেনের জানালা দিয়ে বয়ে যাওয়া মাঠ, ধানক্ষেত, টালির ছাদের ঘর আর মাঝেমাঝে দূরের শাল গাছ দেখে অভিরূপ নিজের ভেতরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করে। শিয়ালদহ থেকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে বোলপুর, তারপর একটা ছোট গাড়ি ধরে সে যখন গ্রামের দিকে এগোতে থাকে, তার মনে হয়, শহরের কোলাহল যেন আস্তে আস্তে পিছনে পড়ে যাচ্ছে। GPS ট্র্যাক করা রাস্তা আর মোবাইল নেটওয়ার্ক যত দুর্বল হচ্ছে, তত যেন স্মৃতির কণাগুলো ঘন হয়ে আসছে। অভিরূপ মনে করতে পারে, এই তো সেই পথ—যেখানে সে ছোটবেলায় বাবার সাইকেলে বসে আসত, যেখানে চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকত, আর মেলা থেকে ফেরার সময় এই রাস্তাতেই মায়ের আঁচল ধরে হাঁটত। কিন্তু এখন দৃশ্যটা অনেকটাই বদলে গেছে। আগে যেখানে কাঁচা রাস্তা ছিল, সেখানে পিচঢালা পথ, ধানের মাঠে এখন সোলার প্যানেল, আর বাঁশবনের পাশ দিয়ে চলে গেছে রঙিন ব্যানারে মোড়া হোমস্টের বিজ্ঞাপন। গ্রাম যেন আর গ্রাম নেই—একটা আধা-নগরায়িত এলাকা, যেখানে চা-এর দোকানেও ওয়াই-ফাইয়ের অফার, আর যেখানে দোকানের নাম “কুঞ্জ রিফ্রেশ”। অভিরূপ বুঝতে পারে, সময় যেমন শরীর পাল্টায়, তেমনই পাল্টায় জায়গার মুখও। মোড় ঘুরে সে যখন পুরোনো বাঁশবনের দিকে পা বাড়ায়, চোখ আটকে যায়—বেশিরভাগ বাঁশ কেটে ফেলা হয়েছে, সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আধা-পাকা বাড়ি, এক হোমস্টের সাইনবোর্ডে লেখা “Green Nest Retreat—Stay with Nature, Stay with Comfort”। অভিরূপ কিছুক্ষণ বোবা দাঁড়িয়ে থাকে—এই তো সেই জায়গা, যেখানে একদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল কেটে যেত লুকোচুরি খেলায়, এখন এখানে বালিশে লিনেন কাভার আর এসির কুলার চলে। তবে সে জানে, এই বদল সে আটকাতে পারেনি, তবু তার ভেতরের ছেলেটা যেন হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছে—“আমার বাঁশবাগানটা কোথায় গেল?” অভিরূপ ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ভিতর ঢোকে, মাটির গন্ধ পায়, কয়েকটা চেনা চেহারাকে ভিন্ন রূপে দেখে। কারও কারও চোখে তাকে চেনার ছাপ—কারও হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছে সেই অভিরূপ, যে স্কুলের দোরগোড়ায় হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকত। কেউ কেউ বলে, “তুই তো সেই বসু মাস্টারের ছেলে না?”—এই ডাক তাকে অদ্ভুত এক আশ্রয় দেয়। আধুনিকতার গ্লস কোটিং ভেঙে যেন পুরোনো খোলস ছুঁয়ে যায় মনটাকে। এই কদিনের ছুটির ভিতর সে কী খুঁজতে পারবে, জানে না, তবে সে ঠিক করেছে—বাকি সময়টা শুধু নিজের শিকড়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করবে।

সন্ধ্যে নামে কুঞ্জডিহির উপর, তার চারপাশে ঝিঁঝিঁর ডাক, দূরের মন্দিরে শঙ্খধ্বনি, আর অভিরূপের বুকের ভিতরে হালকা কাঁপুনি। নিত্যানন্দ কাকার বাড়ির উঠোনে পৌঁছে সে দেখে—পুরোনো কুঁড়েঘর এখনও দাঁড়িয়ে আছে, শুধু দেওয়ালে শ্যাওলা লেগেছে, আর কাকাকে অনেক বেশি বৃদ্ধ দেখায়। কিন্তু কাকার চোখ দুটো এখনও ঝকমকে, যেন পুরোনো দিনের আলো আজও সেখানে আটকে আছে। অভিরূপ কাকার পা ছুঁয়েই বলে, “চেনেন কাকা?” —নিত্যানন্দ কাকা হাসেন, বলেন, “চিনি রে, বাঁশবনে যে সবচেয়ে উঁচু গাছে উঠতে পারত, তাকে কি ভোলা যায়?” —এই একটিমাত্র বাক্যেই যেন তার বুকের ভেতরে কিছুটা গলতে শুরু করে। সেই রাতে অভিরূপ কাকার সঙ্গে বসে, মুড়ি-আলু ভাজা আর হালকা চায়ের মাঝে গল্প করে—পুরোনো স্কুল, নদীর পাড়, কালি পূজার মেলা, আর সেই বাঁশবনের গন্ধ নিয়ে। আধুনিক শহরের অভিরূপ যেন কেঁচে পড়ছে আস্তে আস্তে, তার ভিতরে একটা ছোট্ট ছেলে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। অভিরূপ বুঝে যায়—এই ছুটি শুধু বিশ্রামের জন্য নয়, এই ছুটি—চোখ মেলবার জন্য, এই ছুটি—হারিয়ে যাওয়া কিছুকে আবার ছুঁয়ে দেখার জন্য। কলকাতার হিমঘরের মতো কেবিন আর ব্যস্ততাভরা চার্টারের বাইরে, এখানে সে পাচ্ছে এমন কিছু, যা একটুও মাপা যায় না: সময়ের বাইরে থাকা এক অনুভব, যেটা শুধু শিকড়েই পাওয়া যায়।

দুই

গ্রামের মোড়ে সিএনজি থেমে যায় এক শালগাছের ছায়া ঘেরা ঢালু রাস্তায়। অভিরূপ গাড়ি থেকে নেমে দেখে, চারপাশে কেমন যেন অপরিচিত লাগে—যেন নিজের চেনা গ্রামে নয়, বরং কোনো সাজানো গ্রাম-রিসোর্টে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আগে যেখানে বাঁশের খুঁটি পুঁতে মোড়ে দোকানের ছাউনি হত, সেখানে এখন টিনের ছাত, রঙিন প্ল্যাস্টিক চেয়ার, আর “চা-ফ্লেক্স–ফ্রি Wi-Fi” লেখা ব্যানার। দোকানের একপাশে মোবাইল চার্জিং পয়েন্ট, অন্যপাশে ই-ভ্যালেট সার্ভিসের QR কোড ঝুলছে। দোকানের আড্ডা এখন আর রসগোল্লা কিংবা মোয়া-নাড়ুর স্বাদের গন্ধে নয়, বরং ইনস্টাগ্রাম রিলের আওয়াজে মুখরিত। অভিরূপ হেঁটে যায় সেই সরু রাস্তার দিকে—যেটা এক সময় ছিল ধুলোর সঙ্গে মিশে থাকা কাঁকরপথ। সেই কাঁচা রাস্তা আজ আর নেই। তার জায়গায় পিচ ঢালা, ছ’ফুট চওড়া রাস্তা, দুই পাশে সিমেন্টের ড্রেন আর দু–একটা সোলার স্ট্রিটল্যাম্প। গ্রামের ছেলেরা বাইকে ঘোরে কানে হেডফোন গুঁজে; আগে যারা হাফপ্যান্ট পরে ছাগল চরাতে যেত, এখন তারা হুডি গায়ে ইনফ্লুয়েন্সার হবার স্বপ্ন দেখে। অভিরূপের মনে হয়, সে যেন কোন ভুল জায়গায় এসেছে—এটা সেই কুঞ্জডিহি নয়, যেটা তার স্মৃতির খামে সযত্নে লুকানো ছিল। কিন্তু পথের প্রতিটা বাঁকে তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার দৃশ্য—যেখানে বাঁশবনের মাথা ছুঁয়ে সূর্য উঠত, পুকুরের জলে জ্যোৎস্না নেমে আসত, আর সন্ধ্যায় কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে সে শোনত দাদুর মুখে পুরাণের গল্প। এখন সেখানে এক আধা-আধুনিক কফি কর্নার, কাঠের বেঞ্চি আর এসির শব্দে ঢেকে দেয় আশপাশের পাখির ডাক। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখে, আগে যেটা ছিল তার প্রিয় খেলার মাঠ—সেখানে এখন তৈরি হয়েছে পঞ্চায়েতের নতুন কমিউনিটি হল। মাঠের এক প্রান্তে ছোট্ট ঘর, যেখানে LED বোর্ড ঝলমল করছে: “Digital Kunjdihi – Proud to be Smart Village।” অভিরূপ দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ, বোঝে এই পরিবর্তনকে সে অস্বীকার করতে পারবে না। তবু কোথাও ভিতরে একটা দংশন বাজে—যেটা কেবল মনে করিয়ে দেয়, যে জায়গাটায় সে ফিরে এসেছে, সেটা আর সেই আগের মতো নেই। তবু সে জানে, এই ‘নতুন’ কুঞ্জডিহি-র ভিতরেই লুকিয়ে আছে তার সেই পুরোনো শিকড়, তার ছেলেবেলার গন্ধ, যেটাকে স্পর্শ না করলে এ সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

পথে হাঁটতে হাঁটতে সে এসে পড়ে এক ছোট্ট পুকুরের ধারে, যার পাশেই একসময় ছিল গ্রামের পাঠশালা। এখন সেটা একটি আধা-পাকা স্কুল ভবন, গেটে লেখা—“Kunjdihi Model Primary School – Estd. 1981 (Rebuilt 2020)”। স্কুল ছুটি হয়েছে, তবু ভেতরে একজন মহিলা ছাত্রীদের প্রজেক্ট বুঝিয়ে দিচ্ছেন। অভিরূপ জানে না কেন, কিন্তু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তার মনে পড়ে যায় মৌসুমীর কথা—তার শৈশবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, যার সঙ্গে সে মাটির পুতুল খেলত, বাঁশবাগানে দৌড়াত, আর মাঝে মাঝে গল্পের বই আদান-প্রদান করত। সে জানে না, মৌসুমী এখনও এখানে আছে কিনা, বা থাকলেও তাকে চিনবে কিনা, কিন্তু তার মন যেন চায়, হঠাৎ করে সেই পুরোনো বন্ধুকে দেখে ফেলুক আর একটা চেনা মুখ ফিরে পাক এই অচেনা পরিবর্তনের মধ্যে। স্কুলের সামনের রাস্তা ধরে সে আরও একটু এগোয়, দেখে গ্রামের পুরোনো নামফলক যা এখন ডিজিটাল বোর্ডে রূপান্তরিত—সেখানে লেখা “Welcome to Green Heritage Zone—Smart, Sustainable, Serene।” অভিরূপ পড়ে হেসে ফেলে—তিনটে ‘S’ দিয়ে কি গ্রামকে বোঝানো যায়? সে জানে, গ্রাম মানে শুধু প্রকৃতি নয়, মানে সম্পর্ক, অভ্যেস, ইতিহাস—যা কোন হোর্ডিং বোর্ডে ধরা যায় না। সে আবার হাঁটে, এবার গ্রামের সেই দিকটায়, যেখানে একসময় তার বাড়ি ছিল। সে দেখে বাড়ির জায়গাটা এখন অন্য কারও দখলে—দোতলা বাড়ি উঠেছে সেখানে। সামনের উঠোন পাকা, বাগানে সূর্যমুখী ফুল, আর গেটের সামনে SUV গাড়ি। অভিরূপ কিছু বলে না, শুধু পায়ের কাছে একটা শুকনো পাতাকে তুলতে গিয়ে দেখে—ওটা বাঁশপাতা। বিস্ময়ে সে হাত ভরে ফেলে পাতাটা, গন্ধ শুঁকে চোখ বন্ধ করে। সেই গন্ধটা এখনো রয়ে গেছে, যদিও চারপাশ বদলে গেছে পুরোপুরি। এটাই কি জীবনের বাস্তবতা? বদল আসে, কিন্তু কোথাও না কোথাও কিছু থেকে যায়—যেটা শুধু হৃদয় দিয়ে ধরা যায়।

পথের শেষ প্রান্তে এসে সে দাঁড়ায় বাঁশবনের শেষ প্রান্তে। একসময় যে জায়গাটা ছিল নিঃশব্দ গল্পের স্বর্গ, আজ সেখানে ঢুকতেই বাধা দেওয়া হয়: “Private Property—Entry Restricted without Booking”। অভিরূপ অবাক হয় না, শুধু এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাঁশবনের ভেতরে এখন ছোট ছোট কটেজ, প্রতিটিতে নাম দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ শব্দে—‘পুকুর’, ‘ধানখেত’, ‘আকাশ’, ‘জোনাকি’। সেগুলোর কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যায় সাদা পর্দা, আধুনিক শীতল আলোক, আর অতিথিদের ক্যামেরা তুলে ছবি তোলার ব্যস্ততা। তার মনে হয়, এই জায়গা এখন আর গন্ধে নয়, ক্যাপশনে বাঁচে—#OrganicRetreat, #RuralLuxury, #DigitalDetox। তবু বাঁশবনের এক কোণে সে দেখে কিছু বাঁশগাছ রয়ে গেছে, যেগুলো হয়তো সেসব বদলের আড়াল থেকে এখনও দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। সেদিকে তাকিয়ে অভিরূপ হঠাৎ অনুভব করে, তার ভিতরে যেন কিছু ফেটে যাচ্ছে—সময়, স্মৃতি, আধুনিকতা আর অভিমান একসঙ্গে মিশে একরকম অসহায়তা তৈরি করছে। সে জানে না, এই বাঁশবনকে ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয়—যতদিন সে এখানে আছে, প্রতিদিন এই গন্ধ খুঁজে বেড়াবে। কারণ আধুনিকতার ভেতরেও কোথাও শিকড় থাকে, আর সেই শিকড়ই তাকে আবার ফিরিয়ে আনে… মাটির কাছে, গন্ধের কাছে, নিজের কাছে।

তিন

সকালটা কুঞ্জডিহির গায়ে এক ধুলিমাখা সোনালি রোদ মেখে আসে, যেটা শহরের কাচঘেরা জানালা দিয়ে দেখলে বোঝা যায় না। অভিরূপ ভোরে উঠে দেখে, নিত্যানন্দ কাকার উঠোনে দুটো মোরগ হেঁটে বেড়াচ্ছে আর একটা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। নিত্যানন্দ কাকা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে, পত্রিকা না পড়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে—যেন সূর্যের প্রথম আলো পড়ছে তার মুখে, ঠিক যেখানে বয়স থেমে থাকে। অভিরূপ হঠাৎ করে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, যেন সময়ের কোনো গোলকধাঁধায় ফিরে গেছে দশ বছর বয়সে। কিন্তু তার মনে পড়ে যায় কেন সে ফিরেছে এখানে—বাঁশবাগানের গন্ধ পেতে। সেই গন্ধ, যেটা তার শৈশবের সবচেয়ে কাছের অনুভূতি, যেটা মাটি ছুঁয়ে থাকা দৌড়, লুকোচুরি খেলা, চুপি চুপি গিয়ে গল্প শোনার মুখবন্ধর মতো। সে নিত্যানন্দ কাকাকে জিজ্ঞেস করে, “কাকা, বাঁশবাগানটা কোথায়?” কাকা একটু চুপ করে থেকে বলেন, “বাঁশবন তো আজ আর বন নয় রে, এখন সেটা জমি। কাগজে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে, ট্যুরিস্ট হোম বানানোর জন্য। আধা অংশ এখনও খালি আছে, কিন্তু আর যে ক’টা বাঁশগাছ বেঁচে আছে, তারা শুধু সাক্ষ্য দিচ্ছে—এখানে কোনও দিন বুনো হাওয়ার শব্দ ছিল।” অভিরূপ চুপ করে থাকে, তার বুকের ভিতরে যেন কারা কাঠি ঘুরিয়ে দিচ্ছে। সে জানে, সে ফিরে এসেছে কিছু খুঁজতে—এবং তার প্রিয় জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার আগেই হারিয়ে গেছে। নিত্যানন্দ কাকা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন, “তুই থাকিস ক’দিন, তোর পায়ের ধুলোয় যদি ও জায়গাটার একটু স্মৃতি জেগে ওঠে।” অভিরূপ চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়ায়, আর ঠিক করে—আজ সে একা একবার যাবে সেই জায়গাটায়, হাঁটবে সেই পথ, যেখানে তার ছোটবেলা ছড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যে নামার একটু আগেই অভিরূপ হাঁটা শুরু করে গ্রামের শেষ প্রান্তে। কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে সে আসে সেই ঢালু জমিতে, যেখানে একসময় বাঁশবন ছিল। এখন সেখানে নির্মাণাধীন কটেজ, সিমেন্টের বস্তা, মাটি খোঁড়ার শব্দ আর দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা আধাপাকা বাঁশগাছ। সেই গন্ধটা—যেটা সে মনে রেখেছিল—এখন আর বাতাসে ভাসে না, কিন্তু মাটির খুব গভীরে যেন কোথাও চাপা পড়ে আছে। সে হাঁটে সেই ছোট্ট সরু পথ দিয়ে, যেটা এখন ঘাসে ঢেকে গেছে, যেখানে আগে হাঁটলে বাঁশের পাতার কচকচে শব্দ শুনতে পেত। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, বাঁশবনের এক কোণায় পুরোনো একটা ঢিপি—সেই জায়গাটা যেখানে তারা ছোটবেলায় “রাজা-রানী” খেলত, একটা সাদা রঙের অর্ধেক ভাঙা পাথর ছিল, যেটাকে সবাই বলত “রাজাসিংহাসন”। পাথরটা এখনও আছে, কিন্তু অনেকটাই ঢেকে গেছে গাছপালায়। সে কাছে গিয়ে পাথরটা ছুঁয়ে দেখে, তার আঙুলে লেগে যায় মাটির ছেঁড়া ছোঁয়া, আর সেই স্পর্শে যেন চোখের সামনে ফিরে আসে একটা লম্বা দুপুর—বাঁশের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা গল্প, মৌসুমীর হাসি, রোদে শুকনো পাতার গন্ধ। অভিরূপ কিছুক্ষণ সেই পাথরের সামনে বসে থাকে, তার চোখ বন্ধ থাকে, কিন্তু মন খোলা—স্মৃতি যেন ঢুকে পড়ছে তার শরীরে নি:শব্দে। সে ভাবতে থাকে, আধুনিকতা কেবল দালান বানায়, কিন্তু গন্ধ তৈরি করতে পারে না। যে গন্ধটা তার শৈশবের, সেটা কোনও হোর্ডিং বা অ্যাড ক্যাম্পেইনের ব্যাকগ্রাউন্ড হতে পারে না—ওটা কেবল অনুভব। ধীরে ধীরে আকাশের রং বদলাতে থাকে, পাখিরা ডাকতে শুরু করে, আর অভিরূপ বুঝতে পারে, সে একটা অদৃশ্য বাঁধনের ভেতর ঢুকে পড়েছে—যেটা শহর তাকে দিতে পারেনি। আর তার ভেতরে সেই পুরোনো অভিরূপ, যে হাঁটুতে কাটা নিয়ে বাঁশবনের মেঝেতে কাদায় বসত, আজ আবার একটু জেগে ওঠে। সে জানে না, এখানে আবার ফিরে আসবে কিনা, কিন্তু আজকের সন্ধ্যা—এই পাথরের পাশ, এই বাতাস, এই নিঃশব্দতা—তার স্মৃতির চিরস্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে।

রাতে নিত্যানন্দ কাকার সঙ্গে বসে সে গল্প করে। আজ আর কাকা শুধু অতীত নিয়ে বলেন না, বলেন গ্রামের ভবিষ্যৎ নিয়ে। “তুই যদি শহরে বসে ভাবিস গ্রামটা আগের মতো থাকবে, তাহলে ভুল করিস। বদল আসবেই। কিন্তু বদলের ভেতরেও কিছু কিছু জিনিস ধরে রাখতে হয়।” অভিরূপ বলে, “আমি চেষ্টা করছি কাকা। আজও গিয়ে দেখি—সেই রাজাসিংহাসনটা আছে।” কাকার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, “দ্যাখিস? এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি।” রাতটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে—চাঁদের আলোয় খড়ের চাল, পাতার মৃদু শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকির আওয়াজ যেন বলে—সব বদল খারাপ নয়, শুধু চোখের দৃষ্টিটা ঠিক রাখতে হয়। অভিরূপ জানে, সে ফিরে যেতে পারবে না শৈশবে, কিন্তু শৈশব তাকে আজ ছুঁয়েছে এক অন্য উপায়ে। বাঁশবাগানের গন্ধ, তার স্মৃতি, তার হারিয়ে যাওয়া না-হওয়া সবকিছু—সব যেন মিশে গেছে তার রক্তে, নিঃশ্বাসে। আর সেখান থেকেই শুরু হবে তার নতুন খোঁজ, যেখানে সে শুধু একজন কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ নয়, বরং শিকড় ছোঁয়া এক মানুষ—যার ভিতরে আজও জেগে আছে ছোটবেলার গন্ধে ভেজা এক বিশুদ্ধ আত্মা।

চার

যেদিন অভিরূপ পৌঁছেছিল কুঞ্জডিহিতে, সেদিন সন্ধ্যায় নিত্যানন্দ কাকার উঠোন ছিল নিঃশব্দ, গাছের পাতায় ভেসে আসা হাওয়ায় মিশে ছিল ধূপের গন্ধ, আর এখন—তিন দিন পর—সেই উঠোন যেন তার মনে এক আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কাকা ভোরবেলা উঠেই দড়ির খাটিয়ায় বসে চা খান, পেছনের পুকুরঘাটে ছেলেটা জল তুলে এনে গামলা ভরে দেয়, আর উঠোনে ছড়িয়ে পড়া আলোয় দেখা যায় পুরনো একটা লাল রঙের চেয়ার, যেটাতে অভিরূপ বসতে খুব ভালোবাসে—মনে হয় যেন সেই শৈশবের মেঝের উপর বসে থাকা অবস্থানে ফিরে গেছে সে। সকালগুলো এখানে সময় মেপে চলে না। উঠোনের এক কোণে রাখা বাঁশের ঝুড়িতে তাজা শাকপাতা, মাঝেমাঝে পেছনের আম গাছ থেকে টুপ করে কিছু পড়ে, আর মাঝেমাঝে গ্রামের এক বৃদ্ধা এসে বলেন, “বসুর ছেলে তো?” অভিরূপ মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, ফিরেছি কিছুদিনের জন্য।” সকালের চা খেতে খেতে সে কাকার মুখে শুনেছে অনেক গল্প—কিভাবে বাঁশবনের ছায়ায় একসময় গরম দুপুরে বাচ্চারা শুয়ে থাকত, কেউ কেউ পাখির বাসা গুনত, আর কিছু ছেলে বাঁশ কেটে বাঁশি বানাত। কাকার গলা একসময় গান গাইত, এখন শুধু স্মৃতি টানে। কাকা বলেন, “তুই শহরে গিয়ে বড় হয়েছিস, ভালো করেছিস, কিন্তু শিকড়টা কখনো ছিঁড়ে ফেলা যায় না, বুঝলি? বাঁশগাছ যেমন মাটির অনেক গভীরে ঢুকে থাকে, তুইও তাই।” অভিরূপ কাকার কথায় চুপ করে যায়। তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় কাকা তাকে একবার বলেছিলেন—“যদি মন খারাপ হয়, বাঁশবনের ভেতর গিয়ে দাঁড়া। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নে। যত দুঃখ থাকবে, পাতার ফাঁকে বেরিয়ে যাবে।” সেই কথাটাই আজ যেন ফিরে এসেছে। সে চুপ করে শ্বাস টানে, কাকার উঠোনে বসেই। বাতাসে এক ভেজা পানের গন্ধ, কোথাও রান্না করা খিচুড়ির মতো ঘ্রাণ, আর দূরে শোনা যায় এক বাচ্চা ছেলে খেলার সময় ‘ধপ’ করে পড়ে গিয়ে হাসছে—এই সবকিছু একসাথে মিশে গিয়ে এক অপার্থিব অনুভূতি তৈরি করে।

বিকেলের দিকে অভিরূপ আবার সেই বাঁশবাগানের দিকেই হাঁটে, কিন্তু এবার কাকা সঙ্গী হন। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে নানান কথার ফাঁকে ফিরে যায় অতীতে। কাকা বলেন, “তোর বাবা খুব শান্ত মানুষ ছিলেন। স্কুল থেকে ফিরে এসে তোরা দুই ভাই কী দুষ্টুমি করতি… কিন্তু একটা জিনিস ছিল—তোরা কখনো মিথ্যে বলতি না। বাঁশবনে গিয়ে আড়ালে পড়া, মাছ ধরা, নদীতে ঝাঁপ দেওয়া—সব জানতাম আমি, কিন্তু কিছু বলতাম না। জানতাম, এই ছোট ছোট বন্যতা থেকেই মানুষ বড় হয়ে ওঠে।” অভিরূপ শোনে আর মনে মনে ভাবে—এই কথাগুলো কেউ কোনওদিন বলে না শহরে, কেউ শোনেও না। কাকার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছায় বাঁশবনের কোণে। হঠাৎ কাকা একটা জায়গায় থামেন—একটা গাছ দেখিয়ে বলেন, “দ্যাখ, এটাই তোদের লাগানো বাঁশগাছ। তখন তোরা বলেছিলি—এ গাছে নাম লেখবি একদিন।” অভিরূপ হঠাৎ কাছে গিয়ে দেখে, গাছের গায়ে নখ দিয়ে খোদাই করা আছে “A + M”—ছেলেবেলায় মৌসুমীর সঙ্গে তার মিলে বানানো নামচিহ্ন! বুকটা ধক করে ওঠে। সে গাছে হাত ছোঁয়ায়, যেমন একটা হারিয়ে যাওয়া অক্ষর ছোঁয়া যায় পুরনো কাগজে। কাকা পেছন ফিরে তাকিয়ে বলেন না কিছু, শুধু হাঁটেন আর বলেন, “সব কিছু মুছে যায় না রে… সময়ের অনেক শক্তি, কিন্তু মানুষের মনের চাইতে বেশি নয়।” অভিরূপ মনে মনে ভাবে, এই যে একটা গাছ থেকে সে নিজের অতীতকে ছুঁতে পারছে—এই তো তার ফিরে আসার আসল সার্থকতা। এই মুহূর্তে সে বুঝে যায়—এই গ্রাম শুধু একটা জায়গা নয়, এটা একটা অনুভব, একটা জীবনধারা, যা ভোলা যায় না, ভুলে যাওয়া উচিতও নয়।

রাত্রে খাওয়ার পর কাকা তাকে ডেকে বলেন, “আজ একটু চুপচাপ বস।” চাঁদের আলোয় ছায়াপথে ভেসে থাকা পাতার ঝাপটা, আর দূরে শোনা যায় ঢোলের টুকটাক শব্দ—গ্রামের এক শীতলা পুজোর আয়োজন চলছে, যেটা আগেও হত। কাকা একটা ধামা বার করে অভিরূপের হাতে দেন—তাতে আছে কিছু চিঠি আর ছবি। “তোদের বাড়ি বিক্রি হওয়ার সময় এগুলো আমি রেখে দিই। ভেবেছিলাম, তুই যদি কোনদিন ফিরে আসিস…” অভিরূপ ধীরে ধীরে ধামা খুলে ছবি গুলো দেখে—ছোটবেলার স্কুল ইউনিফর্মে সে আর মৌসুমী দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে বাঁশবন, আর একটাতে তার বাবা, মায়ের সঙ্গে সে দাঁড়ানো—হাসছে। চোখ ভিজে যায় তার। কিছু চিঠি পড়ে, যেখানে তার মা তাকে লিখেছিল, “যদি কোনোদিন ক্লান্ত লাগে, একবার গ্রামের বাতাসে গিয়ে দাঁড়াবি, দেখবি ঠিক শান্তি পাবি।” অভিরূপ জানে, সে ক্লান্তই ছিল, তাই হয়তো ছুটি পেয়ে এসেছিল এখানে। আজ রাতে, এই উঠোন, এই চিঠি, এই পুরনো ছবি—সব মিলিয়ে তার মধ্যে একরকম পবিত্র অভিজ্ঞতা জেগে ওঠে। শহরের হোটেলের বিছানা নয়, ফাইভ স্টার রিসোর্টের ফ্রেগ্রেন্স নয়—এই উঠোনের ধুলো, এই মাটির ঘ্রাণই তার সত্যিকারের বাড়ি। সে জানে, শিকড় শুধু জন্মের নয়, চেতনারও। কাকার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে, এই মানুষটিই আসলে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন অতীতের সঙ্গে যুক্ত করে। সে হাত বাড়িয়ে কাকার কাঁধে হাত রাখে, বলে—“কাকা, আপনাকে ছেড়ে খুব দূরে চলে গেছিলাম। আপনি এখনও এখানে আছেন বলেই মনে হচ্ছে আমি এখনও পুরো হারাইনি।” কাকা কিছু বলেন না, শুধু এক দীর্ঘ নীরবতায় তার হাতটা চাপ দিয়ে রাখেন অভিরূপের উপর।

পাঁচ

গভীর দুপুরের স্নিগ্ধতা মাখা কুঞ্জডিহির আকাশে মেঘের ফাঁকে সূর্য যেন লুকোচুরি খেলছিল, আর ঠিক এই সময়েই অভিরূপ হাঁটা দিলো গ্রামের বাজারপাড়ার দিকে—যেখানে কাকা বলেছিলেন এখন মৌসুমী থাকে। বহু বছর পর সেই নামটা আবার যখন প্রথম শুনেছিল, একটা কেঁপে ওঠা হয়েছিল তার বুকের ভিতর—যেন এক পুরোনো নদী হঠাৎ আবার জল পায়, স্রোত পায়। শৈশবের বন্ধু, বাঁশবনের গন্ধ ভাগাভাগি করা সাথি, যার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল সপ্তম শ্রেণির গরমের ছুটির পর, যখন তারা দুজনেই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল সেই পাথরের ঢিবির সামনে—সেদিন মৌসুমী বলেছিল, “তুই যদি কোনোদিন ফিরে আসিস, আমি ঠিক চিনে ফেলব।” অভিরূপ তখন হাসি চেপে বলেছিল, “তুই কি বুড়ো হয়ে আমাকে চিনবি?” মৌসুমী বলেছিল, “চোখের ভিতর চেনা যায়, মুখ নয়।” সেই চোখের ভিতর ডুবে যাওয়া চেনা থাকার অনুভবটা তার ভিতর আজও থেকে গিয়েছে। সে আজ তাই চলেছে শুধু চোখের ভাষা খুঁজতে—যেখানে মৌসুমী হয়তো অন্য কেউ হয়ে গেছে, কিন্তু সেই চোখ কি এখনও তাকে চিনতে পারবে? বাজারপাড়া পৌঁছানোর আগেই এক বৃদ্ধা বলে ওঠেন, “বড় হয়ে গেছিস দেখছি রে অভিরূপ, মৌসুমী ম্যাডাম ও তোকে খুঁজছিল। ওনার স্কুলটা জানিস তো? ওই রিকশাওয়ালাকে বল, পৌঁছে দেবে।” অভিরূপ অবাক হয়, “ও আমাকে খুঁজছিল?” —বৃদ্ধা হাসেন, “ও বলেছিল, যদি কোনদিন অভিরূপ ফেরে, যেন আগে আমায় জানাও।” অভিরূপের হৃদপিণ্ড যেন কিছুটা জোরে বেজে ওঠে। গ্রামের স্কুলে পৌঁছে দেখে, একটা ঘর, বাচ্চারা বসে পড়ছে, আর মাঝখানে দাঁড়ানো এক মহিলা—হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা, ঘাড়ের কাছে বাঁধা চুল, আর হাতে ধরা সাদা চক। অভিরূপ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ সোজা পড়ে সেই মুখের উপর, যেটা তার স্মৃতিতে একটা আবছা রেখা হয়ে ছিল—আজ সেটাই জীবন্ত। মৌসুমী তাকায়, দু’জনের চোখ মেলে, আর সেই মুহূর্তে শব্দ থেমে যায়, কেবল চোখ কথা বলে ওঠে—“তুই ফিরেছিস।”

স্কুল ছুটি হলে দুজন পাশাপাশি হাঁটে—কোনো রিকশা বা বাইক নয়, হাঁটা পথেই হেঁটে যেতে চায় তারা। মৌসুমী বলে, “তুই আবার এখানে, ভাবতেও পারিনি।” অভিরূপ মাথা ঝাঁকায়, “আমি নিজেরও ভাবিনি। একটা গন্ধ আমায় টেনে আনল।” মৌসুমী হাসে, “বাঁশবাগানের গন্ধ?” অভিরূপ থেমে তাকায়, “তুই তো এখনও একই আছিস। সব জানিস।” মৌসুমী কাঁধ উঁচু করে বলে, “তোর বদল দেখা যায়, কিন্তু ভেতরের তুই একই রয়ে গেছিস।” তারা হাঁটে সেই পথ দিয়ে যেখান দিয়ে ছোটবেলায় স্কুলে যেত। মৌসুমী গল্প করে—তার কলেজ, বাবার মৃত্যু, মায়ের অসুস্থতা, নিজে স্কুলের চাকরি পাওয়া, আর এই গ্রামে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। “আমি কখনো শহরে যাওয়ার সাহস করিনি,” সে বলে। অভিরূপ জিজ্ঞেস করে, “সাহস ছিল না, না ইচ্ছা ছিল না?” মৌসুমী একটু থেমে বলে, “জানি না। হয়তো ভেবেছিলাম, কেউ তো থাকুক এখানে যাদের সব পালিয়ে যায়, তাদের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার জন্য।” অভিরূপ নিঃশব্দে হাঁটে, বোঝে, মৌসুমী শুধু একজন শিক্ষক নন—সে নিজেই এই গ্রামের স্মৃতি, তার ইতিহাসের বুকে লেখা এক অবিনাশী পংক্তি। বাঁশবনের দিকে তাকিয়ে অভিরূপ বলে, “আমি তো হারিয়ে গেছিলাম। শহর আমায় শিখিয়েছে অনেক কিছু, কিন্তু দিয়েছে কিছুটা শূন্যতা।” মৌসুমী বলে, “আমি সেই শূন্যতার জায়গাগুলো ভরতে পারব না। কিন্তু কিছু কিছু গন্ধ আছে, যেগুলো হারালেও ঠিক ফিরে আসে।” অভিরূপ তাকায়, “তুই এখনও কবিতা লেখিস?” মৌসুমী চমকে তাকায়, “তুই মনে রাখিস?” —অভিরূপ মাথা নিচু করে বলে, “যে মানুষ তার ভিতরে আমার শৈশব বাঁচিয়ে রেখেছে, তার লেখা ভোলা যায়?”

সন্ধ্যায় তারা বসে কাকার উঠোনে—মৌসুমী প্রথমে একটু দ্বিধায় ছিল, কিন্তু কাকা নিজে ডেকে এনে বলেন, “এই তোদের ঠিক জায়গা, এখানে বসলে সব ফিরে আসে।” চায়ের কাপ হাতে তারা তিনজন বসে গল্প করে—ছোটবেলার শীতকাল, মেলা, ধানকাটা, স্কুলের বার্ষিক নাটক। মৌসুমী গল্প করে, “একবার তোকে ছাড়া ‘সিন্ধুবারণ’ নাটক করতে গিয়ে কি বিপদই না হয়েছিল!” অভিরূপ হেসে ওঠে, “আমার তো মনে হয়, তখনই ঠিক করেছিলাম আমি নাটক না করে বিজ্ঞাপন বানাব।” কাকা বলে, “তোমরা যা-ই হও, শিকড় ভুললে মাটি ছিঁড়ে যাবে।” তারা চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। রাতের তারারা উঠোনের মাথার উপর দাঁড়িয়ে গেছে, হাওয়ায় ধানের গন্ধ। অভিরূপ সেই মুহূর্তে অনুভব করে, এই সন্ধ্যা—এই মৌসুমী—এই নিঃশব্দ আলাপ—সবকিছু মিলে যেন সে কিছুটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। যে শূন্যতা নিয়ে সে ফিরেছিল, তা আজ কিছুটা পূর্ণ হয়েছে। সে জানে না, মৌসুমী তার জীবনে আবার কেমন করে জায়গা নেবে, জানে না আগামীকাল সে আবার কবে ফিরবে শহরে—কিন্তু এই সন্ধ্যার কথা, এই উঠোনের কথা, এই মৌসুমীর কথা—সেইসব সে সযত্নে বয়ে নিয়ে যাবে তার ভিতরে। সে মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, “তুই ঠিক বলেছিলি… চোখের ভিতর চেনা যায়।” মৌসুমী হেসে বলে, “তুই তো চোখ ফিরিয়ে পালিয়ে গেছিলি… এবার?” অভিরূপ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “এবার আমি চোখ বন্ধ করলেও এখানে থাকতে চাই।”

ছয়

ভোররাতের কুয়াশা নামা কুঞ্জডিহির আকাশে সেই পরিচিত নিস্তব্ধতা—যা একসময় অভিরূপের কিশোর বয়সে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতো—আজ আবার ফিরে আসে। সে আজ বেশ ভোরেই উঠে পড়ে। নিত্যানন্দ কাকার উঠোনে কুয়োর ধারে বসে সে দেখছে সাদা ধোঁয়া জড়ানো গাছগাছালি, মাটির আলপথের উপর জমে থাকা শিশির আর পাখির ডাক। শহরের কাঁচের ভেতর থেকে এতটা জীবন্ত হয়ে দিন ওঠে না—সেখানে ভোর কেবল ঘড়ির কাঁটার গতি, এখানে ভোর এক আত্মিক প্রকাশ। অভিরূপ জানে, তার ফিরে আসা কোনো ছুটি কাটানোর ভ্রমণ নয়—এ এক সন্ধান, এক স্মৃতি খোঁজা, কিংবা হয়তো নিজেকেই আবার পাওয়া। কাকার বাড়ির জানলার পাশে রাখা কাঠের আলনাতে হেলান দিয়ে সে ভাবে, হারিয়ে যাওয়া কি চিরতরে চলে যাওয়া? নাকি হারিয়ে যাওয়া মানে কেবল ছুঁয়ে না থাকা? তার মনে হয়, কিছু জিনিস হয়তো হারায় না, শুধু তারা রূপ বদলায়—যেমন বাঁশবনের সেই গন্ধ এখন নেই চারপাশে, কিন্তু এখনও সে চোখ বন্ধ করলে একটা কাঁচা পাতার হালকা শ্বাস টের পায়। মৌসুমীর মুখেও সে সেই পুরোনো আলোর রেখা পেয়েছে, যা সে ভেবেছিল হারিয়ে গেছে। নিত্যানন্দ কাকার ডাকে তার ভাবনা ছিন্ন হয়। কাকা বলেন, “আজ চল, তোকে একটা জায়গা দেখাই। এখনও সবাই জানে না, কিন্তু বাঁশবাগানের এক প্রান্তে একটু জায়গা আছে, যেখানে কেউ কিছু বানায়নি—তুই ওখানে দ্যাখ, এখনও হয়তো তোর ছেলেবেলা পাথরের মতো পড়ে আছে।” অভিরূপ প্রস্তুত হয়—এই গ্রামে সে যতদিন আছে, ততদিন প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া জায়গাকে খুঁজে খুঁজে সে ফিরে আনবে তার নিজস্ব অর্থে।

কাকা আর সে হাঁটতে হাঁটতে সেই জায়গায় পৌঁছায় যেখানে কাদা-মাটি গন্ধে মিশে আছে ভিজে ইতিহাস। আধপাকা কটেজের প্রান্তে ছোট একটা গলিপথ—পাথরের গাঁথুনি ধরে ওপার যায়—আর তার ঠিক মাঝে পড়ে একটুকরো জমি যেখানে কিছু বুনো বাঁশগাছ এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। আশপাশে সুরক্ষা দেয়াল ওঠেনি, কেউ বাগান বানায়নি, আর এই নির্জনতা যেন তার শৈশবের অক্ষত এক কোণা। অভিরূপ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে, গাছের গায়ে হাত বোলায়। গাছের কাণ্ডে সে দেখে ছোট ছোট আঁচড়, মনে পড়ে যায়—তারা একবার সেখানেই মৌসুমী, রতন, পিয়ালী মিলে নাম লিখেছিল। এখনো সেই খোঁচা খোঁচা দাগ রয়ে গেছে—সময় ধুয়ে দেয়নি সব। সে চোখ বন্ধ করে দেয়। বাতাসে ভেসে আসে মৌসুমীর হাসির ধ্বনি, দাদুর গল্প, মায়ের ডাকা নাম। সে জানে, এই অনুভব কোনো জিপিএস লোকেশন থেকে পাওয়া যায় না—এ এক আত্মিক মানচিত্র, যা শুধু হৃদয় চেনে। সে মাটিতে বসেই বলে, “আমি তো ভেবেছিলাম, সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু হয়নি। তুমি এখনো আছো।” হয়তো গাছ শুনতে পায় না, কিন্তু তার শ্বাসে আজ সেই ভক্তির আবহ। তার পাশে কাকা বসে বলেন, “তুই ফিরে এসেছিস মানেই অনেক কিছু ফেরত আসবে। পৃথিবীটা বদলায়, কিন্তু মন যদি চায়, তাহলে মাটি পর্যন্ত আবার নতুন করে কথা বলে।” তারা দু’জনে বসে থাকে কিছুক্ষণ, নীরবতায়। দূরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে গ্রামের, আর এখানে, এই গাছতলায়, এক মানুষ নিজের ভেতরের হারিয়ে যাওয়া অংশকে আবার জড়িয়ে ধরছে।

সন্ধ্যায়, অভিরূপ একা হাঁটতে হাঁটতে মৌসুমীর বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। দরজায় কড়া না নেড়ে সে কেবল সেই উঠোনটায় পায়চারি করে, যেটা তার চেনা। মৌসুমী দরজা খোলে—চোখে কিছুটা ক্লান্তি, তবুও স্বাভাবিক হাসি। “তুই কিছু বলবি না?” অভিরূপ ধীরে ধীরে বলে, “আজ এমন একটা জায়গায় গেলাম, যেটা একা থেকে গেছে… যেমন আমিও ছিলাম এতোদিন। আজ মনে হল, শুধু জায়গা নয়, সম্পর্কগুলোও আবার ফিরে পাওয়া যায়।” মৌসুমী তার দিকে চায়, বলে, “তুই যদি সত্যি ফিরে আসতে চাস, তাহলে কেবল স্মৃতির জন্য নয়, জীবনের জন্য ফিরে আয়।” অভিরূপ একদৃষ্টে চায় তার চোখে, তারপর বলে, “আমি আসতে চাই… কিন্তু তুই থাকবে তো?” মৌসুমী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমরা কেউ কোথাও যাইনি আসলে। কেবল অপেক্ষা করেছি, একে অন্যকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। এখন যদি তুই বলিস, আমরা দু’জনেই একসঙ্গে খুঁজতে পারি—পুরনো বাঁশবন, পুরনো মানুষ, আর নিজেদের।” সেই রাতে, চাঁদের আলোয় কুঞ্জডিহি নিঃশব্দে বলে ওঠে—“সব কিছু হারায় না, শুধু রূপ বদলায়।” অভিরূপ বুঝে যায়, সে যা হারিয়েছিল, আসলে তা কখনো হারায়নি। মৌসুমী, বাঁশবনের গন্ধ, কাকার উঠোন—সবই এখন তার জীবনের পরম সত্য, একান্ত নিজস্ব, হারিয়ে যাওয়া না-হওয়া সেই চিরন্তন স্পর্শ।

সাত

পৃথিবীর প্রতিটি গ্রামেরই একটি নিজস্ব বাক্স থাকে—যেখানে মাটির নিচে মিশে থাকা ইতিহাস, পুরনো গন্ধ, বাঁশের পাতার শব্দ আর কিছু কিছু অদৃশ্য জিনিস লুকিয়ে থাকে। অভিরূপের কাছে কুঞ্জডিহি-ও ঠিক তেমনই এক বাক্স হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিদিন সে এক-একটি পরিচিত জিনিস নতুনভাবে খুঁজে পাচ্ছে—যেটা হারিয়ে গিয়েছিল, অথবা সময় তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আজ সকালে সে উঠেই ঠিক করে, সে কাকার ঘরের পুরোনো ট্রাঙ্কটা খুঁজে দেখবে, যেটা আগে দাদুর লেখা চিঠি, পুজোর ছবি, আর তার বাবার পুরনো বইয়ের ভাণ্ডার ছিল। কাকা হেসে বলেন, “তুই ট্রাঙ্ক খুঁজবি বলেই মনে হয়েছিল। চাবিটা তোকে দেব, কিন্তু যে চোখ দিয়ে দেখবি, সেটা যেন পুরোনো না হয়।” ট্রাঙ্কটা কাঠের—একপাশে মরচে পড়া তালা, অন্যদিকে হাতে লেখা একটা নাম—“বসু পরিবারের স্মৃতি-সম্পত্তি।” অভিরূপ ধীরে ধীরে সেটা খুলে, যেন ভেতরে কোনো শব্দ আছে যা হঠাৎ বেরিয়ে পড়লে মাটি কেঁপে উঠবে। ভেতরে দেখা যায় হলদে হয়ে যাওয়া ছবির অ্যালবাম, কিছু হ্যান্ডরাইটেন চিঠি, একটা স্কুলের রেজাল্ট শিট—যেখানে তার বাবার নাম লাল কালিতে লেখা, আর একটা খাতা—যেটা আসলে তার মা-র ডায়েরি। পাতাগুলো খুব যত্নে উল্টে পড়ে সে। তার মা লিখেছেন—“আজ অভিরূপ প্রথম বাঁশবনে একা গেল। ফিরেই বলল, ‘গাছেরা আমার সঙ্গে কথা বলে।’ আমি জানি, ও একদিন সব ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু মাটি ওকে ডাকবেই।” এই লাইনটা পড়ে তার শরীরে হিম ছুঁয়ে যায়। সে জানে না কেন, কিন্তু তার মনে হয়, এই বাক্স, এই ডায়েরি, এই পাতাগুলো যেন তার জীবনের মেরুদণ্ড। শহরে কাজের সাফল্য, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, অফিসের কাচের ঘর—সবই যেন এই এক বাক্সের সামনে ক্ষুদ্র হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, স্মৃতির আসল শক্তি এই যে, তা কখনো পুরোনো হয় না—তারা নিজেই নতুন হয় প্রতিদিন, যদি আমরা তাদের ছুঁয়ে দেখতে জানি।

বিকেলের দিকে মৌসুমী আসে কাকার উঠোনে—তার হাতে একটা ছোট্ট বাক্স, ভিতরে কিছু পুরোনো পত্রিকা, কিছু ছবি আর একটা বাঁশের পেনস্ট্যান্ড। সে বলে, “আমি ভেবেছিলাম তুই যদি সত্যিই ফিরিস, তাহলে এগুলো তোকে দেব। এটা আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনের পুরোনো সংখ্যা, যেখানে তোর গল্প ছাপা হয়েছিল—‘বাঁশবনের ছায়ায়’।” অভিরূপ বাক্সটা হাতে নিয়ে দেখে, সেই প্রথম লেখা গল্পটা, যেখানে সে এক বাঁশগাছকে নিয়ে লিখেছিল, যে নাকি এক শিশু বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে একদিন, আর তারপর প্রতিদিন অপেক্ষা করে ফিরে আসার। গল্পের শেষ লাইনে সে লিখেছিল, “বন্ধুরা কখনো হারায় না, তারা শুধু অন্য গন্ধে মিশে যায়।” মৌসুমী বলে, “তুই কখনো জানিসনি, কিন্তু আমি সেই গল্প পড়েই বুঝেছিলাম—তুই আবার আসবি।” অভিরূপ কিছু বলতে পারে না। বাক্সটা তার হাতে, যেন সেই বাক্সে মৌসুমী তার অক্ষর-ভরা হৃদয় তুলে দিয়েছে। তারা চুপ করে বসে থাকে উঠোনের এক কোণে, দূরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধানের মাঠের শেষ সীমানায়। মৌসুমী বলে, “এখন যদি তুই চাস, আমরা আবার একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে পারি… গ্রামের নতুন ছেলেমেয়েদের লেখা নিয়ে, তোর ডিজাইনে, আমার সম্পাদনায়।” অভিরূপ তাকিয়ে থাকে মৌসুমীর চোখে। “আমি আর শুধু দর্শক হয়ে থাকতে চাই না, মৌসুমী। এই বার আমি সত্যিই কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই।” তারা সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন এক প্রকল্প শুরু করবে—‘স্মৃতির বাক্স’ নামে। কুঞ্জডিহির প্রতিটি পুরনো মানুষ, বাচ্চা, স্কুলের ছাত্র, চাষি, বৃদ্ধ—যার যার গল্প, যার যার ছবি, স্মৃতি, চিন্তা—সব একসাথে তুলে ধরা হবে এক স্থায়ী সংগ্রহে। আধুনিক গ্রাম আর প্রাচীন স্মৃতির মাঝে একটা সংযোগ তৈরি করবে তারা—যা হয়তো বাঁশবনের গন্ধ ফেরাতে পারবে না, কিন্তু তার কথা মানুষের মনে রয়ে যাবে চিরদিন।

রাতে চাঁদের আলোয় কাকার উঠোনটা যেন এক নতুন রূপ ধারণ করে। পুরোনো বাক্স আর নতুন বাক্স পাশাপাশি রাখা। অভিরূপ মনে মনে ভাবে, সে আসলে কিছুই হারায়নি। বরং সব কিছু এতদিন একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল, যতক্ষণ না সে চোখ মেলে দেখেছে। কাকার কাঁধে মাথা রেখে সে বলে, “আজ অনেকটা শান্তি পাচ্ছি কাকা। মনে হচ্ছে, যেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সেটা আবার আমায় চিনে ফেলেছে।” কাকা মাথা নেড়ে বলেন, “তোর মা বলত, স্মৃতি কখনো চলে যায় না, শুধু অপেক্ষা করে, কে ফিরে আসবে ছুঁয়ে দেখবে বলে।” মৌসুমী পাশে বসে, চুপচাপ তাকিয়ে থাকে গাছের পাতায়। বাতাসে আবার সেই হালকা বাঁশপাতার গন্ধ ভেসে আসে—অভিরূপ নিশ্চিত, সেটা সত্যি। তার ভেতরে এখন আর শহরের কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ নেই—এখন সে এক স্মৃতিবাহী মানুষ, যার হাতে দুই বাক্স—একটা অতীতের, আর একটা আগামী দিনের। সে জানে, এই নতুন বাক্স শুধু তার নয়, কুঞ্জডিহির, মৌসুমীর, কাকার, আর সেই হারিয়ে যাওয়া অথচ থেকে যাওয়া বাঁশবনের, যার ছায়া আজও কোথাও এক কোণে বেঁচে আছে।

আট

দিনগুলো যেন এখন আর আগের মতো ছুটে যায় না। কুঞ্জডিহির আকাশে সকালের আলো এসে পড়ে এমনভাবে, যেন সময় নিজেই একটু ধীরে হাঁটে এখানে। অভিরূপ জানে, তার ফিরে আসার দিনগুলো ফুরিয়ে আসছে। শহরের ব্যস্ততা, মিটিং-এর লাইনআপ, প্রেজেন্টেশন, ক্লায়েন্ট মিট—সব একে একে ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এদিকে গ্রামের প্রতিটি সকাল, প্রতিটি বাতাস, প্রতিটি মানুষের হাসি যেন তাকে টেনে রাখতে চায়। আজ সকালে কাকার উঠোনে সে একটানা বসে থাকে; পাশের নারকেল গাছে কাক ডাকছে, পেছনের কুয়োর জলটা ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে উড়ছে, আর মৌসুমী এসে বসে তার পাশে। হাতে এক চিঠির খাম। সে বলে, “তোর জন্য কিছু রেখে যাচ্ছি, যেটা তুই শহরে গিয়ে পড়বি।” অভিরূপ একটু চমকে ওঠে। “এখনই পড়তে পারি না?” —মৌসুমী মাথা নাড়ে, “না। এই চিঠি তখন পড়বি, যখন আবার কুঞ্জডিহির গন্ধ মিস করবি।” চিঠি হাতে নিয়ে অভিরূপ বোঝে, মৌসুমী শুধু বন্ধু নয়, সে এই গ্রামের আত্মা। তার কথা, তার লেখা, তার স্পর্শ—সব যেন কুঞ্জডিহিরই একটি প্রতিফলন। চিঠির খাম খোলার ইচ্ছে হলেও সে সেটা করে না। সে জানে, কিছু কিছু জিনিস সময়মতো পড়াই শ্রেয়, ঠিক যেমন কিছু গন্ধ হঠাৎ করেই ফিরে আসে, যেমন বাঁশপাতায় জমে থাকা শিশিরভেজা সকালের সুবাস। তারা দুজনে পাথরের পিঁড়িতে বসে থাকে অনেকক্ষণ, কথা না বলে, শুধুই একে অপরের পাশে থেকে বুঝে নেয় অনেক অজানা কথা।

সন্ধ্যায় কাকার ঘরে আলো জ্বলে উঠলে, অভিরূপ ভাবে তার শেষ রাতে সে কিছু রেখে যাবে। সে কাকার ট্রাঙ্কে রাখা তার মায়ের ডায়েরি থেকে একটা কবিতা তুলে নেয়, লেখে তার নিচে, “এই বাড়িতে ফিরে এসে আমি আবার শিখলাম, হারিয়ে যাওয়া মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়।” কাকা বলে, “তুই তো ফিরেছিলিস স্মৃতি খুঁজতে, এখন নিজেই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছিস।” অভিরূপ হাসে, “স্মৃতি হলে অন্তত থেকে যাবো।” সেই রাতে সে হাঁটে একা, বাঁশবাগানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হাতে সেই খাম—মৌসুমীর লেখা চিঠি। সে ভাবে, খুলে পড়ে নেবে এখনই, কিন্তু হঠাৎ করে তার মনে হয়, না—সে চিঠিটা সেই দিন খুলবে যেদিন শহরের ব্যালকনি থেকে আকাশ দেখে মাটির গন্ধ খুঁজবে। বাঁশবনের পাতায় হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় সে অনুভব করে, সব গন্ধ চলে যায় না, তারা থেকে যায় এক কোণায়, ঠিক স্মৃতির মতো। সে হাঁটে সেই রাজাসিংহাসনের ঢিপির কাছে, যেখানে একদিন তার নাম খোদাই ছিল, আর এখন সেটার উপর জমেছে পাতা, শেওলা, সময়ের স্তর। সে নিজের পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করে আবার নিজের নাম লেখে—“অভি”—আর পাশে লেখে “২০২৫”। সময় জানে না, কে ফিরে আসবে আবার, কিন্তু অভিরূপ এই চিহ্ন রেখে যেতে চায়, ভবিষ্যতের কারও জন্য, কিংবা নিজেরই জন্য। এই রাত্রে তার ভেতরে সেই ছোট্ট ছেলেটা আবার জেগে ওঠে, যে ভয়ে বাঁশের তলায় লুকিয়ে পড়ত, কিন্তু স্বপ্ন দেখত একদিন ফিরে আসার।

পরদিন ভোরে অভিরূপ বেরিয়ে পড়ে। মৌসুমী এসে পৌঁছে দেয় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। দুজনেই খুব বেশি কথা বলে না, কেবল একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, অনেক অনুচ্চারিত ভাষায়। অভিরূপ বলে, “তুই কি জানিস, আমি তোর সেই গল্পটার শেষ লাইন ভুলতে পারিনি? ‘যে বন্ধুরা হারিয়ে যায়, তারা শুধু অন্য গন্ধে মিশে যায়।’” মৌসুমী মুচকি হেসে বলে, “তুই নিজেই তো সেই গন্ধ।” বাস ছাড়ে, কুঞ্জডিহির রাস্তা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। অভিরূপ জানে, এবার ফিরছে সে এক নতুন মানুষ হয়ে—যার ভেতরে বাঁশবনের গন্ধ লুকিয়ে আছে, যার স্মৃতির বাক্সে এখন কেবল পুরনো ছবিই নয়, নতুন ইচ্ছের আলোর রেখাও আছে। শহরের কাঁচের ঘরে বসে একদিন যখন হঠাৎ একটা অপরিচিত হাওয়া তার গাল ছুঁয়ে যাবে, সে তখন টেবিলের ড্রয়ার খুলে বের করবে মৌসুমীর চিঠি। খুলবে ধীরে ধীরে, আর পড়বে—“যদি কোনোদিন আবার পথ হারিয়ে ফেলিস, চোখ বন্ধ করে বাঁশবনের সেই গন্ধ মনে কর। তুই ফিরলে, আমিও থাকব।” সেই লাইনগুলো পড়ে সে হয়তো জানালার দিকে তাকিয়ে হাসবে। কারণ সে জানে, কিছু গন্ধের কোনো ঠিকানা হয় না, কিন্তু তারা ঠিক পথ চিনিয়ে দেয়। আর বাঁশবাগানের সেই গন্ধ—সেটা কোনোদিন ফুরোয় না।

শহরের ছাদে দাঁড়িয়ে অভিরূপ অনেক দিন পর এক ধরনের নিঃশব্দ ভোর দেখে। কাঁচের দেওয়ালের ওপারে সূর্য উঠছে, কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠছে কুঞ্জডিহির বাঁশবনের আলোছায়া। অফিসের মেইলে ক্লায়েন্টের নাম, প্রজেক্টের ডেডলাইন, ম্যানেজারদের রিপ্লাই—সব আছে সামনে, তবু কোথাও যেন কিছু অনুপস্থিত। তার ডেস্কের ড্রয়ারে রাখা সেই খাম, যেটা মৌসুমী দিয়েছিল, এখনো সে খুলে দেখেনি। আজ, এক শান্ত সকালে সে চিঠিটা হাতে নেয়—ধীরে ধীরে খাম খোলে। চিঠির প্রথম লাইন—“যেদিন তুমি গন্ধ খুঁজবে আর পাবে না, সেদিন এই চিঠি পড়ো।” অভিরূপ হাঁসফাঁস করে উঠছে, কারণ আজ ঠিক সেই দিন। সে পড়ে—মৌসুমী লিখেছে, “তুই হয়তো ফিরে যাবি আবার কর্পোরেট ছন্দে, আর আমি থাকব এখানে, কুঞ্জডিহির উঠোনে। কিন্তু গন্ধ জিনিসটা শুধু নাকে নয়, মনের মধ্যেও থাকে। তুই একদিন যদি মাটির গন্ধ পেতে চাস, চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিবি—বাঁশপাতা ঝরে পড়বে মনে, আমি পাশে থাকব।” অভিরূপ জানে, এই চিঠি শুধু কথার নয়—এ এক উত্তরাধিকার। বাঁশবনের সেই জীবিত সময় এখন তার ভেতরেই বেঁচে আছে। সে জানে, শিকড়কে নিয়ে যাওয়া যায় না, কিন্তু শিকড়ের থেকে পাওয়া শক্তি সঙ্গে রাখা যায়। সে জানে, শহরের ভিড়ে থাকলেও, তার ভেতরের মানুষটা কুঞ্জডিহির উঠোনে পা ডুবিয়ে বসে আছে এখনো।

স্মৃতি যদি নদী হয়, তবে তার দু’ধারে থাকে বাস্তব আর কল্পনা—আর মাঝখানে ভেসে চলে মানুষ। অভিরূপ সেই মানুষ, যে ফিরে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে। তবে এখন সে বদলে গেছে—সে জানে গন্ধের উৎস, জানে হারিয়ে গিয়েও কীভাবে ফিরে আসতে হয়, জানে ভালোবাসা মানে শুধুই একসাথে থাকা নয়—ভালোবাসা মানে সযত্নে গন্ধ ধরে রাখা, একটা চিঠি না খোলা রেখে দেওয়া, আর চোখ বন্ধ করে বাঁশপাতার শব্দ কল্পনা করা। শহরে তার পাশে বসে কেউ হয়তো বলবে, “তোমার ভেতরে কি এক আশ্চর্য শান্তি!” সে শুধু মৃদু হাসবে, কারণ সে জানে—তার ভেতরে এখনও বাঁশবাগানের গন্ধ লুকিয়ে আছে।

___

1000032077.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *