শ্যামল রায়
পর্ব ১: শেষ প্রদর্শনের আগে
পূর্ব মেদিনীপুরের একটা ছোট্ট গ্রাম—ধনঞ্জয়চক। গাছপালা ঘেরা, ধুলো মাখা পথ, আর বিকেলের শেষে চায়ের দোকানে গমগমে আড্ডা। সেই গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা টালির ঘর, চারপাশে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে, জানলার ধারে একটা কাঠের তাক। তাকের ওপর সারি সারি মুখোশ—রাবণের, হনুমানের, গরুড়ের, রাক্ষসের, বাঘের, মহিষাসুরের। এবং একটা মুখোশ—সাদামাটা, ফ্যাকাশে, যার এক চোখ সামান্য খুঁত আছে।
এই মুখোশটা হাতে নিয়ে বসে আছেন সদানন্দ বাউরী। বয়স আশির কাছাকাছি, গায়ে পাটবস্ত্রের ফেটানো ফতুয়া, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। বহুরূপী জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে সদানন্দ, মনস্থির করেছেন—এবছর মহালয়ার আগের দিন, তিনি শেষবার মঞ্চে উঠবেন।
কিন্তু ব্যাপারটা কেবল একটা অভিনয় নয়।
এই শেষ মুখোশ পরে তিনি খুঁজবেন একটা হারানো মুখ।
তার ছেলেকে।
তিন দশক আগে, সদানন্দ যখন এই পেশায় এক নামী বহুরূপী, কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত লোকনাট্য সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হতেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর পুত্র—জীতেন্দ্র। ছেলেটি অসাধারণ বাঁশি বাজাতো, আর বাবার মুখোশ পরার সময় তার চোখে থাকতো বিস্ময়। সদানন্দ তাকে শিখিয়েছিলেন—মুখোশ কখনোই শুধু ঢাকনা নয়, ওটা একেকটা আত্মা।
কিন্তু জীবনের একটা সময় এসেছিল যখন টাকার অভাব, মায়ের দীর্ঘ অসুস্থতা, আর গ্রামে আধুনিক চাকরির প্রতি আকর্ষণে জীতেন্দ্র মুখ ফিরিয়ে নেয় এই সংস্কৃতি থেকে। “তুমি কেবল রাক্ষস সাজো, কিন্তু দানবতা বুঝো না,” বলেছিল একদিন। তারপর এক ঝড়ের রাতে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কোনো চিঠি, কোনো খবর নেই।
সেই থেকে সদানন্দ শুধু মুখোশ বানিয়েছেন—নতুন মুখোশ, পুরনো মুখোশ, কিন্তু খুঁজে পাননি সেই মুখ।
আজ ২৯শে ভাদ্র। গ্রামের মেলা শুরু হবে তিন দিনের মধ্যে। কুলাধারী মোড়ের কাছে একটা অস্থায়ী মঞ্চ হবে, যেখানে সদানন্দ তাঁর ‘শেষ রূপ’ তুলে ধরবেন। কেউ জানে না—সেটা কী রূপ হবে। এমনকি গঙ্গারাম হালদার—যিনি সদানন্দকে প্রায় পুত্রের মতো দেখেন—তিনিও না।
“বাবা, এবার থাকো। শরীরটা ভালো নেই,” বলেছিল গঙ্গারাম সকালে।
সদানন্দ শুধু বলেছিলেন, “মুখোশে যতক্ষণ প্রাণ আছে, আমি থামতে পারি না।”
সন্ধ্যায়, মুখোশ তাক থেকে নামিয়ে তিনি একে একে চোখের কাছে ধরছিলেন। ছোট্ট কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় প্রতিটা মুখ প্রাণ পায়।
একটা মুখোশে থেমে যান তিনি। সেটা ঠিক অভিনয়ের জন্য নয়। দেখতে অনেকটা জীতেন্দ্রর মতন—যেমন সে ছোটবেলায় ছিল। চঞ্চল চোখ, বাঁকা হাসি, আর কপালের একটা দাগ। সেই মুখোশটাকে আলতো করে বুকে টেনে নেন সদানন্দ।
“তুই কোথায় গেলি রে, জিতু?” কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন তিনি।
তারপর একটা পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে, বার করেন একখানা ধুতি, একটা নকশা করা বেল্ট, আর কাঠের জুতো। এগুলো ছিল তার প্রথম মঞ্চাভিনয়ের স্মারক।
রাত্রি গভীর হয়। ঘরের বাইরে শিয়াল ডাকে। ভেতরে সদানন্দ বসে থাকেন একা।
কিন্তু মন একা নয়। মনে একটা দৃঢ় সংকল্প।
শেষবার মঞ্চে উঠবেন।
শেষবার মুখোশ পরবেন।
শেষবার খুঁজবেন—নিজেকে নয়, নিজের হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে।
আসলে, হয়তো এই মুখোশটাই তাঁর শেষ আশ্রয়।
হয়তো মুখোশের আড়ালেই একদিন সামনে আসবে সেই মুখ—
যাকে তিনি ভালোবেসেছেন সবচেয়ে বেশি, এবং হারিয়েছেন সবচেয়ে গভীরভাবে।
পর্ব ২: মেলার ডাকে মুখোশের প্রস্তুতি
গ্রাম ধনঞ্জয়চকের প্রান্তে কুলাধারী মোড়ের কাছে মাঠটা তখন সাজছে আলো আর বাঁশের কাঠামো দিয়ে। প্যান্ডেল উঠছে, লাউডস্পিকারে বাজছে পুরনো বাউল গান—“মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে…” পুজোর মেলার প্রস্তুতি পুরোদমে। ছোট ছোট ছেলেরা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, দোকানিরা এসে স্টল বানাচ্ছে, আর দূরে একটি অস্থায়ী মঞ্চের কাঠামো তৈরি হচ্ছে।
এই মঞ্চেই সদানন্দ বাউরী শেষবার উঠবেন—এটা যারা জানে, তারা একরকম অস্থিরতায় আছে।
গঙ্গারাম হালদার, যার কাঁধে এখন পুরো মেলার সাংস্কৃতিক দায়িত্ব, নিজের বাইসাইকেলে চড়ে সকাল সকাল চলে আসে সদানন্দের ঘরে।
“বাবা, আস্তে আস্তে জ্বর হচ্ছেতো? গলা কেমন যেন বসে গেছে কাল রাত থেকে,” চিন্তিত গলায় বলে সে।
সদানন্দ একটু হেসে বলে, “যে লোক মহিষাসুর সাজতে গিয়ে আগুনের মশাল হাতে নাচে, তার ভয় জ্বরে নয়।”
গঙ্গারাম দম নেয়, “তবে এবার রূপটা কী হবে, একটু বলো না। পোস্টার ছাপাতে হবে।”
সদানন্দ মুখ নামিয়ে বলে, “রূপ নয়, এ এক মুখ খোঁজার গল্প… এবার দর্শকরাও মুখোশের আড়ালে মুখ খুঁজবে।”
ঘরে ফিরে সদানন্দ শুরু করেন প্রস্তুতি। পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে বার করেন কিছু ধুলোমাখা পোশাক। একেকটা জামা, মাথার পাগড়ি, নীল কুমিরের মুখোশ, আগুনের লেজের মতন টেইল।
কিন্তু এবার তিনি বেছে নেন এক নতুন সাজ।
এই মুখোশ সে আগে কোনোদিন মঞ্চে পরেননি। এটা তিনি বানিয়েছিলেন এক রাত ঘুম ভেঙে বসে—যেদিন গ্রামের কোনো এক আত্মীয় বলে গিয়েছিল, “তোমার ছেলেকে হায়দরাবাদে রেলস্টেশনে দেখেছিলাম। মুখে দাড়ি, চোখ ফাঁকা।”
সেদিনের পর সেই মুখটা মনে গেঁথে গিয়েছিল সদানন্দের। সেই মুখটাই বানিয়ে রেখেছিলেন এক কোণে। আজ সেই মুখোশটা বেছে নিলেন।
সন্ধ্যায় পাড়ার কিছু ছেলে-মেয়ে এসে দাঁড়ায় তাঁর জানলার কাছে।
“সদানন্দদা, তুমি কি সত্যিই আবার মহিষাসুর হবে?”
“না রে,” তিনি হাসেন, “এবার আমি এক পাগল বাবা—যে তার ছেলেকে খুঁজছে মেলা-মঞ্চে। জানিস, এটা আমার নিজের গল্প।”
ছোট্ট টুকাই বলে ওঠে, “তোমার ছেলে কি সত্যিই আছে কোথাও?”
সদানন্দ স্থির চোখে তাকায় ছেলেটার দিকে।
“সব মুখোশের নিচে একটা মুখ থাকে… আর কিছু মুখোশ এমন, যা মুখ খুঁজে বেড়ায়। জানিস, আমি সেই দ্বিতীয়টা।”
রাত বাড়ে। সদানন্দ বসলেন আয়নার সামনে।
একটা ভাঙা আয়না, যার ডানদিকে একটু ফাটল।
তিনি মুখে লাগান সাদা রঙের প্রলেপ, চোখের নিচে কালো রেখা, ঠোঁটে নীল ছোঁয়া। মুখোশটা হাতের কাছে রেখে তিনি তাকিয়ে থাকেন আয়নার দিকে।
হঠাৎই আয়নায় দেখেন—এক অচেনা মুখ যেন তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
তিনি চমকে ওঠেন। কিন্তু ওটা তো মুখোশ নয়। মুখোশের পেছনে থাকা কেউ?
না… কল্পনা।
কিন্তু হাওয়া যেন ঘরের ভেতর কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ল্যাম্পটা দুলছে, ঘরজুড়ে একটা অলৌকিক নিস্তব্ধতা।
সদানন্দ মুখোশটা বুকে চেপে ধরেন।
“তুই ফিরবি তো, জিতু? এই মেলার ভিড়ে? যদি একবার মুখটা দেখি, আমি সব ছেড়ে দেব… এই মুখোশ, এই মঞ্চ, এই জীবন পর্যন্ত…”
তার কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যায় রাতের বাতাসে।
তিন দিন পর মেলা।
সদানন্দের ‘শেষ রূপ’ মঞ্চস্থ হবে সন্ধে ছটায়।
কিন্তু গঙ্গারাম জানে না, দর্শক জানে না, এমনকি মুখোশও জানে না—এই অভিনয়ের শেষে কাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
হয়তো এক দর্শকের মুখেই লুকিয়ে আছে সেই হারিয়ে যাওয়া পুত্র…
হয়তো মুখোশ খুললেই সত্যি দেখা দেবে সেই মুখ।
পর্ব ৩: যাত্রার আগের দিন
ধনঞ্জয়চকের আকাশে তখন সাদা মেঘ ভাসছে। মেলার আগের দিনটা যেন গ্রামের বুকে একটা আলাদা রকম উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে। মাটির গন্ধ, তালপাতার ছাউনি বাঁধা, আর ফেস্টুনের রঙ মিশে যাচ্ছে আলো-হাওয়ার সঙ্গে।
বাজারের মোড়ে চায়ের দোকানে জমে উঠেছে আলোচনা।
“তোর মনে হয়, সদানন্দদা এবার কী সাজবে?”
“শুনেছি, এবার উনি নিজের গল্প বলবে।”
“হ্যাঁরে, শুনলি না? উনি নাকি ছেলে খুঁজছেন—মঞ্চ থেকে!”
এই কথাগুলো সদানন্দ জানেন। গঙ্গারাম সকালে এসে বলেও গিয়েছিল, “বাবা, লোকজন জটলা পাকাচ্ছে, কেউ বলছে তুমি নাকি পাগল হয়ে গেছ, কেউ বলে এটা নতুন নাটকের স্টাইল। আসলে তারা জানে না—তুমি শুধু মুখোশ পরে নও, মুখোশ খোলার মানুষ!”
সদানন্দ তবু চুপ। তিনি আজ সকাল থেকে কথা বলছেন কম। তার চোখে এক ধরণের স্থিরতা। যেন বহু বছর ধরে প্রস্তুত হয়ে থাকা এক যাত্রা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
এদিন দুপুরে, এক যুবক এসে হাজির হয় সদানন্দের বাড়িতে। চামড়ার ব্যাগ কাঁধে, চোখে সানগ্লাস, মুখে কাঁচা দাড়ি।
“সদানন্দ বাউরী এখানে থাকেন?”
দরজা খুলে দেন সদানন্দ নিজেই। ছেলেটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
যুবক অস্বস্তিতে বলে, “আমি আসলে লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছি। আপনার বিষয়ে অনেক শুনেছি। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। আপনি কি কাল মেলায় অভিনয় করবেন?”
সদানন্দ একটুও মুখ বদলায় না। শুধু বলে, “তুই কি মুখোশ চিনিস?”
যুবক থেমে যায়।
“মানে?”
“মুখোশের কাজ কী?”
“ধরুন… নিজেকে লুকানো। বা অন্য কিছু হয়ে ওঠা?”
সদানন্দ তখন ধীরে ধীরে বলেন, “মুখোশ কাউকে লুকায় না, বরং খুঁজে আনে। নিজের ভেতরের হারানো মুখকে সামনে আনে।”
সন্ধ্যায়, সদানন্দ বসেন নিজের ঘরে। সামনে সাজানো মুখোশগুলো।
একটার দিকে চোখ আটকে যায়।
ফ্যাকাশে রঙ, খাঁজ কাটা গাল, চোখে দুঃখের ছাপ।
তিনি ধীরে ধীরে মুখোশটা হাতে নেন।
তখনই দরজায় টোকা পড়ে।
গঙ্গারাম।
“বাবা, কালকের রিহার্সালটা করবো? লোকজন একদম আগ্রহে বসে আছে। আবার অনেকে হাসাহাসিও করছে।”
সদানন্দ বলে, “হাসুক। যখন তারা মুখোশ খুলে মুখ দেখবে—তখন চুপ করে যাবে।”
গঙ্গারাম ধীরে বলেন, “তুমি ঠিক আছ তো, বাবা? শরীরটা কেমন জানি দুর্বল দেখাচ্ছে।”
“আমি ক্লান্ত, গঙ্গা… শুধু ক্লান্ত।”
গঙ্গারাম কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। তারপর কাঁধে হাত রেখে বলে, “কাল আমি তোমার পাশে থাকব। যদি জীতেন্দ্র আসে, যদি সে সত্যিই আসে—তবে আমিও দেখতে চাই।”
সদানন্দ হালকা হেসে বলে, “তুই তো আমার ছেলের মতোই।”
গঙ্গারাম নিচু গলায় বলে, “তবু, বাবার মুখে নিজের ছেলের নাম শোনার একটা আলাদা দাম থাকে।”
রাত্রে, সদানন্দ জেগে থাকেন। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে। একসময় কেরোসিনের আলো নিভে যায়।
ঘরের অন্ধকারে কেবল মুখোশগুলোর ছায়া। যেন একেকটা মুখোশ নিজের মধ্যে কান্না, রাগ, শূন্যতা, প্রতীক্ষা ধরে রেখেছে।
একটা মুখোশের গায়ে আলতো করে হাত রাখেন সদানন্দ।
“কাল… হয় শেষ অভিনয়, নয় শেষ আশ্রয়…”
তার চোখে তখন জল জমে আসে। কিন্তু তিনি জানেন, মুখোশের পেছনে চোখের জল লুকিয়ে থাকে না—ওটা মঞ্চে গলে পড়ে, দর্শকের দিকে গিয়ে ঠেকে।
এই শেষ মঞ্চ, এই শেষ রূপ… কে জানে, সে কি কেবল নাটক? নাকি জীবন নিজেই মুখোশ পরে এসেছে দেখতে—এক বাবা কীভাবে ছেলেকে খুঁজে বেড়ায় নিজের ছায়ায়, রূপে, সৃষ্টিতে।
পর্ব ৪: মুখোশের পেছনে মুখ
মেলার দিন।
ধনঞ্জয়চকের সকালটা একটু বেশিই আলো ঝলমলে। ভোর থেকেই পাড়ায় পাড়ায় বাজছে ঢাক-ঢোল, মাইক বাজাচ্ছে ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’। বাচ্চারা ঘোরে ফুচকার ঠেলাগাড়ি ঘিরে, মেয়েরা দলে দলে শাঁখা-পলা পরে বেরোচ্ছে মন্দিরের দিকে।
আর গ্রামের কেন্দ্রস্থলে বাঁশের তৈরি অস্থায়ী মঞ্চ—সেখানে আজ সন্ধ্যা ছটা নাগাদ উঠবেন সদানন্দ বাউরী। তাঁর শেষ রূপ।
গঙ্গারাম সব কিছু সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত। প্যান্ডেল ঠিক আছে কিনা, সাউন্ড সিস্টেম চলছে তো? হঠাৎ এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিকে দেখে থমকে যায় সে।
“আরে, আপনি তো… আপনি কালই তো সদানন্দদার বাড়িতে গিয়েছিলেন?”
ছেলেটি মাথা নোয়ায়, “হ্যাঁ। আমি লোকনাট্য নিয়ে প্রজেক্ট করছি। আজ দেখতে এসেছি।”
গঙ্গারাম ভালো করে তাকিয়ে দেখে—ছেলেটার চোখে একটা চেনা ছায়া। কে যেন… কোথায় যেন…
“আপনার নাম?”
“জয়ন্ত,” সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় ছেলেটি।
“আপনি কি আগে কখনও এই গ্রামে এসেছেন?”
“না,” ছেলেটি এক সেকেন্ড থেমে বলে, “অন্তত মনে নেই।”
গঙ্গারাম ধন্ধে পড়ে যায়। সেই চোখের ভেতর কিছু একটা আছে—যা যেন চেনা, অজানা একসঙ্গে।
বিকেল চারটের সময় সদানন্দ আসেন মঞ্চের পাশে নির্দিষ্ট ঘরে। পা হাঁটে ধীরে, কিন্তু মনের মধ্যে আগুন।
গঙ্গারাম গিয়ে বলে, “সব প্রস্তুত। শুধু তোমারই অপেক্ষা।”
সদানন্দ বলে, “গঙ্গা, আজ মঞ্চে আমি কাঁদলে দয়া করে পর্দা টানিস না। এ কান্না চরিত্রের নয়, মানুষের।”
গঙ্গারাম চুপ করে থাকে।
সন্ধ্যা ছ’টা। মঞ্চের সামনে ভিড় জমে উঠেছে। লোকজন অপেক্ষা করছে—অনেকে ছবি তুলছে, কেউ ফেসবুক লাইভ চালু করেছে।
মঞ্চে আলো নিভে যায়।
পরে বাজে বেহালার টান। তারপর ধীরে ধীরে আলো জ্বলে ওঠে।
মঞ্চে উঠে আসেন সদানন্দ। মাথায় ধুতি বাঁধা, মুখে সেই অচেনা মুখোশ। শরীরেও নতুন পোশাক, যেটা তিনি কোনোদিন পরেননি।
তাঁর হাতে একটা বাঁশি।
তিনি বললেন না কিছুই।
শুধু হাঁটলেন মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে ধরলেন।
“আমি এক বাবা… যার মুখোশ মুখ চায়।”
মঞ্চ স্তব্ধ। দর্শকেরা একে একে থেমে যায়। মোবাইল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বন্ধ হয়।
“আমি যে মুখ খুঁজছি, সেটা রাক্ষসের নয়, দেবতার নয়, মানুষের। একটা ছেলের মুখ, যে হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল। আমি জানি না সে এখন কোথায়, আমি জানি না সে কেমন আছে। আমি শুধু জানি, আমি এই রূপ ধরে দাঁড়িয়ে আছি… যদি কখনো সে এসে বলে—‘তুমি কি আমায় খুঁজেছিলে, বাবা?’”
সদানন্দ থেমে যান। মুখোশটা নামিয়ে ফেলেন।
তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে—অভিনয় নয়, পিতৃত্বের ছায়ায় ভেজা এক জলচোখ।
মঞ্চে তখন কেমন যেন এক বিদ্যুৎ বয়ে যায়।
ভিড়ের মধ্যে এক যুবক দাঁড়িয়ে পড়ে।
তার নাম জয়ন্ত।
সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। মুখে যেন কথা নেই, শুধু চোখে বিস্ময়, ভয়, একটা টান।
গঙ্গারাম দেখে—সদানন্দের চোখও থেমে গেছে ছেলেটার মুখে।
যেন কেউ আয়নায় নিজেরই যুবক ছেলেবেলা দেখছে।
“তুই?” কাঁপা গলায় বলেন সদানন্দ।
ছেলেটা থেমে যায়।
একটা দীর্ঘ নীরবতা।
তারপর সে বলে—
“আমি জানি না আপনি কে… কিন্তু এই মঞ্চ, এই মুখোশ, এই বাঁশির আওয়াজ… আমার ভেতরে যেন কিছু জেগে উঠছে। আমার মাথার ভেতরে কেউ যেন বলে উঠছে—‘ঘরে ফেরা হয় নাকি?’”
সদানন্দ তখন চোখ বন্ধ করে বলেন—
“এই রূপটাই ছিল আমার শেষ আশ্রয়… আর তুইই যদি আমার মুখ খুঁজে ফিরিস—তবে আমি অভিনয় ছেড়ে দিতে পারি।”
পর্ব ৫: রক্তের টান, স্মৃতির ছায়া
মেলা তখন স্তব্ধ। শত মানুষের ভিড়, কিন্তু যেন কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। চোখে সবাই চেয়ে আছে দু’জনের দিকে—এক বৃদ্ধ, যার চোখে কান্না আর মুখে অভিমানের রেখা, আর এক যুবক, যার চোখে কিছু অচেনা স্মৃতির মিহি ছায়া।
গঙ্গারাম এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকের ভেতর যেন বেজে চলেছে মৃদু ঢাকের শব্দ।
জয়ন্ত—যে নিজেকে শুধু একজন গবেষক বলে পরিচয় দিয়েছে—ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগোয়। সদানন্দ তখনো মুখোশ হাতে দাঁড়িয়ে। মুখে কোনো রঙ নেই, অথচ তাতে যেন শত রঙ মিশে আছে।
“আপনি আমাকে চেনেন?” ছেলেটা প্রশ্ন করে।
সদানন্দ জবাব দেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন।
“আপনার চোখে যা আছে, আমার মনে নেই,” বলে ছেলেটি। “আমার ছেলেবেলা কেমন ছিল, আমি জানি না। কে ছিল আমার বাবা-মা, সেটাও ধোঁয়াটে। শুধু এটুকু জানি, সাত বছর বয়সে একটা আশ্রমে ঠাঁই পাই—তখন নাম ছিল ভোলা, তারপর নাম বদল হয়ে হয় জয়ন্ত। আমার কোনও জন্ম সনদ ছিল না, কেউ খুঁজতেও আসেনি। আমি স্রেফ একজন ছায়া ছিলাম।”
সদানন্দের ঠোঁট কাঁপে। “ভোলা… জীতেন্দ্র তোকে ভোলা বলেই ডাকত যখন ছোট ছিলিস।”
“জীতেন্দ্র?” ছেলেটা থেমে যায়।
“আমার ছেলে। তোকে কোলে করে খেলাতো, মুখোশ পরত না—তবে সব মুখ চিনত।”
জয়ন্ত অসহায়ভাবে মাথা নাড়ে। “আমি কিছু মনে করতে পারি না… কিছুই না। কেবল গতকাল যখন মুখোশ দেখলাম আপনার ঘরে, তখন মনে হল, আমি এই সবকিছুর মধ্যেই ছিলাম একসময়।”
সদানন্দ ফিসফিস করে বলেন, “ভেতরের রক্ত কখনও হারায় না। স্মৃতি ভুলে গেলেও শরীর মনে রাখে—মঞ্চের আলো, মুখোশের গন্ধ, বাঁশির সুর…”
মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন কানাকানি শুরু করে। “ওই ছেলেটাই কি সদানন্দদার ছেলে?” “নাকি নতুন কোনো নাটক চলছে?”
গঙ্গারাম মুখ তুলে দেখে—এই নাটক scripted নয়, বাস্তব। চোখের জল মঞ্চের রঙ মুছে দিচ্ছে।
সেদিন রাত।
মেলা ভাঙে ধীরে ধীরে। রঙিন বেলুন ফেটে যায় একে একে, প্যান্ডেলের আলো নিভে আসে। কেবল সদানন্দের ঘরে তখন আলো জ্বলছে। টেবিলের উপর রাখা মুখোশগুলো যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।
সামনে বসে জয়ন্ত।
সে একটা মুখোশ হাতে নেয়। “এইটা… এইটার ভেতর যেন একটা গন্ধ লুকিয়ে আছে। যেন অনেকদিন আগের বৃষ্টির গন্ধ, কাদায় ভেজা পায়ের ছাপ…”
সদানন্দ চুপচাপ তাকে দেখে যান।
“আমি জানি না, আমি আপনার ছেলে কিনা। হয়তো আমার ছেলেবেলা এখানেই ছিল, হয়তো না। কিন্তু যদি আপনি চান, আমি কিছুদিন এখানে থাকতে পারি। যদি কিছু মনে পড়ে… যদি সত্যিই আমি জীতেন্দ্র হই…”
সদানন্দ ধীরে বলেন, “তুই জীতেন্দ্র হ, বা নয়—তা মুখোশ জানে না। কিন্তু একজন মানুষ হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিকে যদি খুঁজে পেতে চায়—তবে সে আমার কাছেই থাকবে। তোকে আমি রেখে দেব, জয়ন্ত। কারণ তুই খুঁজে চলেছিস… আর আমিও।”
ঘরের ভিতরে তখন হাওয়ার সঙ্গে বাজে মুখোশের ঝংকার।
এই সন্ধি—একটা মুখোশ আর এক মুখের মধ্যে নয়, দুই জীবনের মধ্যে।
পর্ব ৬: মুখোশের পাঠশালা
সদানন্দের বাড়ির উঠোনে এখন রোজ সকালবেলায় একটা নতুন দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে একটা পুরনো দড়ির খাট পাতা থাকে, তার ওপরে বসে থাকেন সদানন্দ, আর ঠিক সামনের কাঠের পিঁড়িতে বসে জয়ন্ত—যে নিজের নামের অর্থ নতুন করে বোঝার চেষ্টা করছে।
মুখোশগুলোর সামনে আজকাল আর ধুলো পড়ে না। জয়ন্ত তাদের যত্ন করে পরিষ্কার করে, রঙ মেশায়, রশি বাঁধে, আবার একেকটা মুখোশ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।
“কী দেখছিস?” সদানন্দ প্রশ্ন করেন একদিন।
“মুখোশের ভেতরে একেকটা গল্প,” জয়ন্ত ধীরে বলে। “এইটা দেখলে মনে হয় একটা বাচ্চা তার বাবাকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছে… এইটা যেন একটা মায়ের মুখ—যার ছেলে যুদ্ধে গেছে… এইটায় একটা পাগল বৃদ্ধ—যে বলে, ‘আমি রাক্ষস নই, আমি ক্ষুধার মুখ।’”
সদানন্দ চুপচাপ শুনে যান। তারপর বলেন, “তুই মুখোশ পড়ছিস, জয়ন্ত। বাইরের নয়, ভেতরের। তুই এখন সত্যিকারের বহুরূপী হবার পথে।”
গ্রামে নানা কথা চলছে। কেউ বলছে, সদানন্দ এক নতুন ছেলে পেয়েছে। কেউ আবার বলছে, ওটাই তার হারানো ছেলে, কিন্তু লোকলজ্জায় মুখে আনছে না।
চায়ের দোকানে এমন কথাও উঠেছে—“ভালো তো, নাটক করে ছেলে ফিরে এলো! ও তো সিনেমা হতে পারে!”
গঙ্গারাম এসব শুনে বিরক্ত হয়, কিন্তু সদানন্দ নির্বিকার।
“মানুষ যদি নাটক ভাবেই নেয়, তবে সেটা একটা সার্থক নাটক,” হেসে বলেন তিনি। “কারণ এই নাটক অন্তত একটাকে ফিরিয়ে এনেছে।”
গঙ্গারাম একদিন জয়ন্তকে ডেকে বলে, “তুই যদি সত্যিই জীতেন্দ্র হোস, তবে কী করবি? ফিরবি, কোলেপিঠে বসবি, না সবার সামনে মুখ খুলবি?”
জয়ন্ত একটু থেমে বলে, “আমি যদি জীতেন্দ্র না হই… তাহলেও কি এই বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাবে?”
গঙ্গারাম কিছু বলেন না। হয়তো তাঁরও উত্তর নেই।
সন্ধ্যার সময় সদানন্দ এক নতুন মুখোশ বানাতে শুরু করেন। জয়ন্ত পাশে বসে থাকে।
“এই মুখোশটা কিসের?” সে জিজ্ঞেস করে।
“একজন ছায়া-পুত্রের,” সদানন্দ বলেন। “যার শরীরে হয়তো আমার রক্ত নেই, কিন্তু চোখে আছে আমার অতীতের ছায়া।”
“তুমি কি নিশ্চিত, আমি জীতেন্দ্র নই?”
“আমি নিশ্চিত হইনি কোনোদিনই। আমি শুধু এটুকু জানি, আমার মন চায়—তুই জীতু হোস। আর মন সবসময় যুক্তি বোঝে না।”
এক সন্ধ্যায় গ্রামের নাট্যসংঘ থেকে লোক আসে। তারা বলে, “সদানন্দদা, আপনার আবার পারফর্ম করা উচিত। এখনকার ছেলে জয়ন্তকে নিয়ে একটা যুগল মুখোশাভিনয় হোক না!”
সদানন্দের চোখে জল আসে।
তিনি বলেন, “আমরা দুজনেই এখন মুখোশ পরি… শুধু রঙের নয়, পরিচয়েরও। সেই মুখোশ খুলে যদি একদিন মঞ্চে একসাথে উঠতে পারি—তবে তাতে নাটক নয়, ইতিহাস লেখা হবে।”
জয়ন্ত তার কাঁধে হাত রাখে। তারা দুজন একে অপরকে দেখে—নির্বাক, কিন্তু তীব্র সংলাপে বাঁধা।
এই সম্পর্ক—রক্তের নাও হতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতা, সময়, ছায়া—সব মিলিয়ে যেন মুখোশের মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন আত্মীয়তা।
পর্ব ৭: রক্ত না ছায়া?
বর্ষা শেষে আকাশ পরিষ্কার। ধনঞ্জয়চক যেন ধুয়ে-মুছে আরও উজ্জ্বল। গাছের পাতায় টাটকা সবুজ, আর মাঠের ঘাসে শিশিরের বিন্দু। এমন দিনে সদানন্দ এক কোণে বসে থাকেন, মুখোশহীন, কিন্তু মুখ গম্ভীর।
জয়ন্ত আসে হাতে একটা চিঠি নিয়ে।
“কী এটা?” সদানন্দ চোখ তোলেন না।
“হায়দরাবাদের শিশু আশ্রমের রেকর্ড। আমি পেতে চেয়েছিলাম কিছু ক্লু—আমার অতীত নিয়ে। কাল রাতেই মেইলটা এলো।”
সদানন্দ চুপ করে শোনেন। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে, যদিও মুখে কোনো ভাব নেই।
জয়ন্ত ধীরে পড়ে শোনায়:
“পিতা: অজ্ঞাত। মাতা: অজানা। ছেলেটিকে ১৯৯৯ সালের একটি ভোরবেলা একটি রেলস্টেশনের বেঞ্চ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বয়স আনুমানিক সাত। নাম বলতে পারেনি। গলায় একটি পিতলের লকেট ছিল—যেখানে উৎকীর্ণ ছিল ‘জীতু’।”
সদানন্দের ঠোঁট শুকিয়ে যায়। তিনি বলেও ফেলেন, “পিতলের লকেট? সেটা তো… ওটা তো আমি দিয়েছিলাম জীতেন্দ্রকে জন্মদিনে। নিজের হাতেই খোদাই করেছিলাম।”
জয়ন্ত কিছু বলে না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তাঁর চোখে।
“তুই কোথায় রেখেছিস লকেটটা?”
জয়ন্ত পকেট থেকে বার করে দেয়। পুরনো, একটু কালচে লকেট, পিছনে আঁকা—‘জীতু’।
সদানন্দ লকেটটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করেন। যেন বহু বছর পরে কোনও মূর্তি ছুঁয়ে তিনি তাঁর ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন।
“তুই… আমারই ছেলে… তুই জীতেন্দ্র… তোকে আমি হারিয়েছিলাম ওই ঝড়ের রাতে, যেদিন আমি রেগে গাল দিয়েছিলাম তোর স্বপ্নকে…”
জয়ন্ত—যে হয়তো এতদিন নিজের ভেতরে ভাসছিল, আজ তার পায়ের নিচে মাটি পায়।
“তুমি আমার বাবা?”
“তুই আমার ছায়া, আমার রক্ত, আমার ভুলের জবাব… তুই আমার মুখোশের ভেতরের মুখ।”
জয়ন্ত তখন থেমে গিয়ে বলে, “তবে আমি আর জয়ন্ত নই। আমি জীতু। আর তুমি কেবল বহুরূপী নও—তুমি আমার পথের আলোর মুখোশ।”
সদানন্দ উঠে দাঁড়ান। ধীরে বলেন, “তাহলে একবার মঞ্চে উঠি… বাবা আর ছেলে… মুখোশ ছাড়াই, শুধু নিজের মুখ নিয়ে। দেখিয়ে দিই—লোকনাট্যে আজও সত্যি লেখা যায়।”
সেই রাত—ধনঞ্জয়চক আবার আলোয় ভরে যায়। গঙ্গারাম ঘোষণা করেন—
“আজ প্রথমবারের জন্য, সদানন্দ বাউরী তাঁর নিজের পুত্রকে নিয়ে মঞ্চস্থ করবেন একটি মুখোশহীন অভিনয়—‘শেষ মুখোশ’।”
মঞ্চে উঠে আসে দুই প্রজন্ম। একজন বয়সের ভারে নুয়ে, আর একজন মুখে দ্বিধা মিশ্রিত আত্মবিশ্বাস।
তারা একসাথে বলে—
“আমরা রূপ ধারণ করি না…
আমরা রূপ ফিরিয়ে আনি।
এটাই আমাদের গল্প।
এটাই আমাদের মুখোশের শেষ পাঠ।”
পর্ব ৮: একসাথে অভিনয়, একসাথে ক্ষমা
মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে। ধনঞ্জয়চকের মাঠে আবার একবার বসল প্যান্ডেল, কিন্তু এবারে লোকের ভিড়টা যেন একটু অন্যরকম। সবাই জানে, আজ শুধু এক ‘অভিনয়’ নয়—আজ এক স্বীকারোক্তি, এক সম্পর্কের আবিষ্কার।
গঙ্গারাম হাতে মাইক নিয়ে বলছে,
“গ্রামের ইতিহাসে প্রথমবার—সদানন্দ বাউরী ও তাঁর পুত্র জীতেন্দ্র বাউরী, একসঙ্গে মঞ্চে। অভিনয়ের নাম—‘শেষ মুখোশ।’ কিন্তু জানিয়ে রাখি, এই গল্পটা scripted নয়… এটা তাঁদের জীবনের সত্য।”
তালির ঝড় ওঠে না, বরং মাঠ জুড়ে গভীর নিঃশ্বাস। এমন নিঃশব্দ শ্রদ্ধা খুব কম মেলে।
মঞ্চে উঠে সদানন্দ আর জীতু—তাঁদের গায়ে মুখোশ নেই। মাথায় পাগড়ি, কিন্তু চোখে শুধুই চোখের ভাষা।
অভিনয় শুরু হয়।
সদানন্দ বলেন, “এক বাবা মুখোশ পরে নিজেকে ভুলে যায়… সে ভাবে, মঞ্চই তাঁর ঘর, দর্শকই তাঁর সন্তান। সে ভাবে, তার হাতের রঙ, তার গলার গর্জনই যথেষ্ট।”
জীতু বলে, “আর এক ছেলে ভাবে, তার জীবন শুধু পালিয়ে যাওয়া—যে বাবা রূপে থাকে, তাকে ছুঁতে নেই। সে ভাবে, মুখোশ পরা মানুষ ভালোবাসতে জানে না।”
সদানন্দ তখন নিচু গলায় বলে, “কিন্তু বাবা ছেলেকে গাল দিয়ে নয়, গলা টিপে নয়—ভালোবেসে ফেলে মুখোশের ভেতর থেকে। ছেলেটাও সেটা বোঝে, যখন সে নিজের মুখ খুঁজে ফেরে এক পুরনো মঞ্চে।”
মঞ্চে আলো গাঢ় হয়। পেছনে বাঁশির সুর বেজে ওঠে। মঞ্চের ফ্লোরে জ্বলজ্বল করে উঠে আসে দুটো ছায়া—একটা বয়সে ভারী, অন্যটা তাজা কিন্তু টলমল।
দর্শকেরা তখন নিঃশব্দ।
সদানন্দ জীতুর কাঁধে হাত রাখেন। “তুই আমাকে ক্ষমা করবি, জীতু?”
জীতু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুমি আমায় হারিয়ে ফেলোনি, বাবা। আমিও তো খুঁজিনি। এখন খুঁজে পেয়েছি—তাই মুখোশটা আর দরকার নেই।”
মঞ্চের নিচে বসে থাকা এক বৃদ্ধা দর্শক হঠাৎ চোখ মুছতে মুছতে বলে, “এইটাই তো আমাদের নিজেদের গল্প, না? বাবারা ভুল করে, ছেলেরা রাগ করে। কিন্তু শেষে যদি হাতে হাত পড়ে—তবে সব মুখোশ খুলে যায়।”
রাতের শেষে গঙ্গারাম সেই মুখোশগুলো নিয়ে মাঠে দাঁড়ায়। সবকটাই রেখে দেয় এক জায়গায়।
জীতু এসে পাশে দাঁড়ায়।
“কি করছো?”
“ভেবেছিলাম মুখোশ নিয়ে একটা প্রদর্শনী করব, যেটা বলবে—মুখোশ পরে মানুষ পালায় না, মানুষ খুঁজে ফেরে।”
জীতু হেসে বলে, “তবে একটাও রেখে দাও—যেটা তুমি বানাবে এখন, আমার জন্য। নতুন রূপে, নতুন করে।”
গঙ্গারাম বলে, “তুই এখন থেকেই বহুরূপী।”
জীতু উত্তর দেয়, “না, আমি একরূপী… কিন্তু সেই রূপটা খুঁজে পেতে বহু মুখোশ পেরোতে হয়েছে।”
(চলবে…)
পর্ব ৯: নতুন মুখোশ, নতুন মঞ্চ
সদানন্দের বাড়ির উঠোনে সকালে রোদ পড়ে বাঁশের ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে। মুখোশের তাক থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে সবক’টা মুখোশ—পরিস্কার, সাজানো, আর মাঝখানে এক ফাঁকা জায়গা।
সেখানে তৈরি হচ্ছে একটি নতুন মুখোশ।
জীতু বসে আছে হাতে তুলো আর রঙ নিয়ে।
সদানন্দ পাশে বসে শুধু দেখে, নির্দেশ দেয় না।
“এই মুখোশটা কেমন হবে?” জীতু জিজ্ঞেস করে।
“তুই যেমন চাইবি। কারণ এটা হবে তোর প্রথম সৃষ্টির মুখোশ। আর মনে রেখ—মুখোশ শুধু মুখ ঢাকে না, মনও বলে।”
জীতু রঙ মেশায়—হালকা হলুদে একটা অদ্ভুত রকম প্রশান্তির ছোঁয়া, ঠোঁটে একটা টানা দাগ, যেটা হাসি নয়, আবার কান্নাও নয়। চোখ দুটো বড়—যেন কিছু খুঁজছে, আবার কিছু ছেড়েও দিচ্ছে।
সদানন্দ দেখে আর মুগ্ধ হয়।
“তুই জানিস, এই মুখোশটা আসলে আমারই একটা মুখ,” বলেন তিনি। “যেটা আমি কখনও বানাতে পারিনি। তুই সেটা আজ বানিয়ে দিলি।”
গঙ্গারাম সেই বিকেলে আসে এক নতুন খবর নিয়ে।
“কলকাতার ‘লোকমঞ্চ উৎসব’-এ ডাক এসেছে। চিঠি পাঠিয়েছে তারা। তারা চায়, তোমাদের দু’জনের সেই ‘শেষ মুখোশ’ নাটকটা যেন ওখানে হয়।”
সদানন্দ চুপ করে। চোখের কোণ কাঁপে।
“তুই যাবি তো, জীতু?”
জীতু বলে, “আমি শুধু যাব না, আমি আবার শুরু করব। তোমার সঙ্গে। কিন্তু এবার যেন কোনো মুখ হারিয়ে না যায়।”
কলকাতা।
‘লোকমঞ্চ উৎসব’-এর মূল মঞ্চে লোক জমেছে চোখে পড়ে না—কিন্তু অনুভবে টের পাওয়া যায়। মিডিয়া, দর্শক, শিল্পী, নাট্যকার—সবাই অপেক্ষা করছে।
ঘোষণা হয়,
“আজকের নাটক—‘শেষ মুখোশ’। অভিনয়: সদানন্দ বাউরী ও জীতেন্দ্র বাউরী।”
তালির শব্দ হয়। কিন্তু এবার কেউ ছবি তোলে না। সবাই চায় অনুভব করতে।
মঞ্চে উঠে আসে দুই মানুষ। বাবা ও ছেলে। মুখে কোন মুখোশ নেই, কিন্তু হাতে দু’টি মুখোশ—যেগুলো তারা শেষ দৃশ্যে খুলে মাটিতে রাখবে।
নাটক শুরু হয়।
বাবা বলে, “আমি রূপ ছিলাম, কিন্তু মুখ ছিল না।”
ছেলে বলে, “আমি মুখ ছিলাম, কিন্তু রূপ হারিয়েছিলাম।”
তারা একে অপরের দিকে তাকায়।
বাবা বলে, “তুই ফিরেছিস, রূপ নিয়ে নয়—নিজের মুখ নিয়ে।”
ছেলে বলে, “তুমিও আর বহুরূপী নও—তুমি আমার একরকম সত্য।”
শেষ দৃশ্যে দু’জন মঞ্চের মাঝখানে এসে মুখোশ মাটিতে রাখে। আলো নিভে যায়।
তখন পুরো থিয়েটার দাঁড়িয়ে পড়ে। কাঁপতে কাঁপতে হাততালি বাজে।
কেউ শুধু নাটক দেখে না—সবার মনে যেন নিজের বাবার মুখ, বা ছেলের অভিমানের মুখ ফুটে ওঠে।
মঞ্চের পরের দিন সদানন্দ বলেন, “আমার মুখোশগুলো আমি এবার রেখে দেব না ঘরের তাকেতে। এগুলো আমরা নিয়ে যাব গ্রামে গ্রামে—দেখাবো, কেমন করে মুখোশ পরেও মানুষ হতে হয়।”
জীতু হেসে বলে, “আর সেই যাত্রার নাম হবে—‘বহুরূপীর শেষ মুখোশ’। কিন্তু সেটা শেষ নয়—নতুন শুরু।”
পর্ব ১০: মুখোশমুক্ত জীবনের মঞ্চ
ধনঞ্জয়চক আজ আলাদা রকম চুপচাপ।
সদানন্দ আর জীতু ফিরে এসেছে কলকাতা থেকে। গ্রামের মানুষ অপেক্ষা করছিল—বুঝতে চাইছিল এই যাত্রা শেষ হলো, নাকি নতুন কোনো পথের শুরু।
গঙ্গারাম সকালে এসে বলে,
“তোমাদের দু’জনের ওই নাটক দেখে কলকাতার নাট্যকর্তারা চিঠি দিয়েছে—চায়, তোমরা সারা বাংলায় ট্যুর করো। তোমার মুখোশ নিয়ে, তোমাদের গল্প নিয়ে।”
সদানন্দ হাসেন।
“জীবনের সবচেয়ে বড় মুখোশ হল ভয়ের মুখোশ—যেটা আমাদের থামিয়ে দেয়। এবার সেটা খুলে ফেলতে চাই।”
জীতু চুপ করে পাশে বসে।
“তুমি জানো বাবা, আমার এতদিনকার অভিমান কেবল একটা জিনিস নিয়েই ছিল—তুমি আমার স্বপ্ন বোঝোনি। আর আজ বুঝি, আমি-ও তোমার যন্ত্রণা বোঝোনি।”
সদানন্দের চোখে জল জমে।
“তুই বুঝিস, এটাই বড় প্রাপ্তি।”
গল্প শুরু হয়েছিল একজন বৃদ্ধের কাছ থেকে, যিনি মুখোশ পরতেন শুধু অভিনয়ের জন্য নয়—নিজেকে লুকোতে।
শেষে এসে সেই বৃদ্ধই মুখোশ খুলে দাঁড়ালেন সত্যের সামনে—ছেলের সামনে, নিজের সামনে।
সন্ধ্যেবেলা, গ্রামের পুকুরপাড়ে তারা বসে। পেছনে লাল সূর্য ডুবে যাচ্ছে। জীতু বলে,
“আমাদের নাটকের নাম বদলে দেব?”
“কী রাখবি?”
“‘শেষ মুখোশ’ নয়—‘প্রথম মুখ।’ কারণ এই প্রথম, আমরা মুখোশ ছাড়া নিজেদের মুখে একে অপরকে দেখলাম।”
সদানন্দ একটু হেসে মাথা নেড়ে বলেন, “তুই এখন শুধু আমার ছেলে নোস, তুই আমার উত্তরাধিকার।”
জীতু মাথা নিচু করে বলে, “আর তুমি শুধু আমার বাবা নও, তুমি আমার মুখোশহীন জীবনের প্রথম রূপকার।”
শেষ দৃশ্যে, মঞ্চে তারা দু’জন।
তারা দু’জন দাঁড়িয়ে বলে—
“আমরা মুখোশ পরেছি রঙের, চরিত্রের, ভুলের…
এখন আমরা মুখোশ খুলেছি সম্পর্কের, স্বীকারোক্তির, ক্ষমার।
এখন আমরা শুধু মানুষ—বহুরূপী নয়, বহুসত্যর ধারক।
আমাদের গল্পের নাম—‘বহুরূপীর শেষ মুখোশ।’”
আলো নিভে যায়।
শুধু পেছনে পড়ে থাকে একটুকরো মুখোশ—
নির্জীব নয়, জীবনের সব রং মেখে তৈরি এক জীবন্ত ইতিহাস।




