নীলাক্ষি বসু
বর্ষার রাত। আকাশ যেন কারও অন্তহীন শোক মেখে ভিজে উঠেছে। জানালার কাচের ওপরে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, ছোট ছোট দাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে দূরের বজ্রপাতের সাদা ঝলকানি। হোস্টেলের পুরনো দালানটা বৃষ্টির ঝাপটায় কাঁপছে, বাতাসের ঠান্ডা স্রোত বারবার জানালা ভেদ করে ঢুকে পড়ছে ছোট ঘরটায়। কক্ষের ভেতরে ম্লান আলোয় এক কোণে বসে আছে অর্পণ, সামনের টেবিলে খোলা সরকারি চাকরির প্রস্তুতির মোটা বই। পৃষ্ঠাগুলো ভিজে যাচ্ছে আর্দ্রতায়, মাঝে মাঝে পাতার কিনারা উল্টে উঠছে বাতাসে। অর্পণ খেয়াল করে, প্রতিবার জানালার কাচে বৃষ্টির আঘাত হলে তার বুকের ভেতরটাও অদ্ভুতভাবে ধকধক করে ওঠে। এ যেন কেবল বাইরের ঝড় নয়, তার ভেতরেরও এক অস্থিরতা। মেঘলা, তার সহপাঠিনী ও রুমমেট, পাশের চেয়ারে বসে। তার চুল এখনো আধভেজা, বৃষ্টিতে ভিজে আসা গাঢ় কালো আঁচল থেকে জল টুপটুপ করে বইয়ের ওপর পড়ছে। প্রথমে মেঘলা কেবল পড়াশোনায় মন দিয়েছে—প্রশ্নপত্র ঘাঁটছে, মার্জিনে লিখে রাখছে নোটস। কিন্তু ধীরে ধীরে সেও যেন বুঝতে পারছে, এই ভেজা কক্ষের মধ্যে কেবল পড়াশোনার শব্দ নেই, আছে এক অদ্ভুত টান—যা না চাইতেই তাদের নিঃশ্বাসের ভেতর মিশে যাচ্ছে।
চোখাচোখি হওয়ার বিষয়টা খুব সহজভাবে শুরু হয়। একটা জটিল গণিতের প্রশ্নে মেঘলা অর্পণকে ডাকে, সে ঝুঁকে পড়ে সমাধান দেখায়। সেই মুহূর্তে, বুক থেকে উঠে আসা তার গরম নিশ্বাস মেঘলার গালে লাগে, আর একঝলক বাতাসে মেঘলার ভিজে চুল অর্পণের হাতে ছুঁয়ে যায়। দু’জনেই চুপ করে যায়, যেন কেউ কিছু না বললেই ভালো হয়। কিন্তু চুপ থাকার মধ্যে যে কত কিছু লুকিয়ে থাকে, তারা দু’জনই তা টের পায়। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, বিদ্যুৎ কেটে গিয়ে ঘরটা আরও অন্ধকার হয়ে এসেছে, কেবল ছোট টেবিল ল্যাম্পের আলোয় তারা মুখোমুখি। বইয়ের পৃষ্ঠায় আলো পড়ছে, তার ছায়া গিয়ে পড়ছে দু’জনের মুখে। মেঘলা আঙুল দিয়ে একটা শব্দ আন্ডারলাইন করতে গিয়ে হালকা করে অর্পণের আঙুল ছুঁয়ে দেয়—এ যেন ইচ্ছে করে নয়, কিন্তু অজান্তেই ঘটে যাওয়া এক অদ্ভুত স্পর্শ। অর্পণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে, মনে হয় যেন মেঘলার চোখদুটোতে বৃষ্টির মতোই গভীর আর টলমল জল জমে আছে। মেঘলা দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়, কিন্তু সে নামানোয় আর দূরত্ব তৈরি হয় না, বরং নিঃশব্দে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হয় দু’জনের মাঝে।
এভাবে সময় এগোয়। বাইরের বৃষ্টি যেন এক অবিরাম ছন্দ বাজিয়ে চলেছে, আর সেই ছন্দের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে তাদের পড়াশোনার শব্দ। মাঝে মাঝে বজ্রপাতের আলোয় জানালার কাচ ঝলসে ওঠে, আর তাদের চেহারায় ভেসে ওঠে ক্ষণিকের দীপ্তি—যেন সেই আলো তাদের মনের গোপন অনুভূতিগুলোকে এক নিমেষে প্রকাশ করে দিচ্ছে। ঘরে কফির হালকা গন্ধ ছড়িয়ে আছে, কিন্তু সেই গন্ধকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া আর ভেজা চুলের গন্ধ। অর্পণ চেষ্টা করে বইয়ে মন দিতে, কিন্তু সে বুঝতে পারে, তার মন আটকে আছে মেঘলার নিঃশ্বাসে, তার চোখের আড়ালে জমে থাকা কথায়। মেঘলাও টের পায়, বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে, তার দৃষ্টি বারবার সরে যাচ্ছে অর্পণের আঙুলের দিকে, যেভাবে সে কলম ধরে আছে, যেভাবে মাঝে মাঝে কপাল কুঁচকে ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে। দুই দেহের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি, অথচ সেই ফাঁকা জায়গার ভেতর যেন হাজারো ঝড় বইছে। ভেতরে ভেতরে তাদের দু’জনের মনে জন্ম নিচ্ছে নতুন এক নীরবতা—যা আর কেবল নীরব নয়, বরং এক অঘোষিত প্রতিশ্রুতি, যে প্রতিশ্রুতির শুরু এই ভেজা কক্ষের ভেজা জানালা থেকে।
~
রাত গভীর হচ্ছে, কিন্তু পড়াশোনা যেন ক্রমশ কমে আসছে তাদের কাছে। প্রথমে দু’জনেই একাগ্র হয়ে বইয়ের পাতায় ঝুঁকে ছিল, প্রশ্নোত্তর চলছিল স্বাভাবিকভাবে—কে কোন অধ্যায় পড়েছে, কোন অংশ নিয়ে সমস্যায় আছে, কীভাবে শর্টকাটে মনে রাখা যায়। মেঘলা একটা ইতিহাসের প্রশ্ন করে, অর্পণ তা ব্যাখ্যা করে উদাহরণসহ লিখে দেয় খাতায়, কিন্তু খাতার পাতার ওপর তাদের মুখগুলো যতটা কাছে আসে, তার চেয়েও কাছে আসে তাদের শ্বাসের উষ্ণতা। বাইরে বজ্রঝলকানির আলোয় মুহূর্তের জন্য পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে, আর সেই আলোয় দেখা যায় দু’জনের চোখে জমে থাকা এক অদ্ভুত দ্বিধা—যা কথায় বলা যায় না। অর্পণ খেয়াল করে, মেঘলার চোখে একদিকে যেমন পড়াশোনার চাপ, তেমনই লুকানো আছে এক রহস্যময় আকর্ষণ। মেঘলা আবার খেয়াল করে, অর্পণ বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে, যেন বইয়ের ভেতরের অক্ষর নয়, বরং তার চোখের দৃষ্টিই পড়ার মতো কিছু। মাঝে মাঝে প্রশ্নের ফাঁকে নীরবতা নেমে আসে, সেই নীরবতা তাদের দু’জনকে আরও বেশি অস্বস্তি ও অচেনা আনন্দে ভরিয়ে তোলে। মনে হয়, এই নীরবতা আর কেবল পড়াশোনার ক্লান্তি নয়, বরং কিছু অচেনা শব্দের জন্মক্ষেত্র, যেগুলো মুখে উচ্চারণ না হলেও ভেতরে ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে।
এইসব অদৃশ্য অনুভূতির মধ্যে আসে ছোট ছোট স্পর্শের মুহূর্ত। খাতার ওপর কলম রাখতে গিয়ে দু’জনের আঙুল একসাথে ছুঁয়ে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে যেন শরীরে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে যায়। মেঘলা দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়, কিন্তু তার মুখের লাল আভা লুকিয়ে রাখা যায় না। অর্পণও চুপ করে যায়, কেবল চোখ নামিয়ে কলম ঘোরাতে থাকে। আবার একবার খাতা টানতে গিয়ে অর্পণের কাঁধে ধাক্কা লাগে মেঘলার, অর্পণ থমকে যায়, তারপর হালকা হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। মেঘলা ভ্রূ কুঁচকে রাগ দেখাতে চাইলেও চোখে মৃদু হাসির রেখা খেলে যায়। এইসব ছোট ছোট ধাক্কা, ছোঁয়া, চোখাচোখি—সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে বইয়ের অক্ষর ঝাপসা হয়ে যায়, আর স্পষ্ট হয়ে ওঠে দেহ ও মনের অনুচ্চারিত ভাষা। বাইরে বজ্রপাতের গর্জন যেন এই আবেগের প্রতিচ্ছবি, হঠাৎ আলোকিত হয়ে ওঠা আকাশের মতোই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাদের ভেতরের টানাপোড়েন। বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ আর বজ্রপাতের ধ্বনি যেন তাল মিলিয়ে ছন্দ বাজায়, আর সেই ছন্দের ভেতরেই মিশে যায় তাদের দমবন্ধ নীরবতা।
মিনিটগুলো গড়িয়ে যায়, কিন্তু তাদের পড়াশোনা যেন আর এগোয় না। বই খোলা থাকলেও অক্ষরগুলো তাদের চোখে সরে সরে যায়, মন চলে যায় অন্যদিকে। মেঘলা চেষ্টা করে আবার মনোযোগ ফেরাতে, একটা প্রশ্ন তোলে, কিন্তু উত্তর শুনতে গিয়ে অর্পণের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে তার বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে। অর্পণও টের পায়, সে যতই বোঝানোর ভান করুক, আসলে তার মনোযোগ চলে যাচ্ছে মেঘলার গলার কাছে ঝরে পড়া চুলে, কিংবা বুকের হালকা ওঠানামায়। তারা দু’জনেই জানে, এই অনুভূতি নতুন, অচেনা, অথচ অস্বীকার করার মতো নয়। তাই যখন আবারও তাদের হাত একসাথে ছুঁয়ে যায়, এবার কেউ হাত সরায় না। বরং দু’জনের আঙুল ধীরে ধীরে একে অপরকে মুঠো করে ধরে ফেলে, যেন অদৃশ্য চাপে বাধ্য হয়ে। ঘরের ভেতর সেই মুহূর্তে বৃষ্টির শব্দ, বজ্রপাতের আলো, আর তাদের দমবন্ধ উত্তেজনা—সব এক হয়ে যায়। যেন প্রকৃতি নিজেই সাক্ষী হচ্ছে, পাঠের আড়ালে জন্ম নিচ্ছে এক গভীর প্রলোভনের, যা ধীরে ধীরে তাদের জীবনকে অন্য পথে নিয়ে যাবে।
~
ঘড়ির কাঁটা তখন অনেক রাত পার করেছে। বৃষ্টির শব্দ যেন আর থামতেই চাইছে না, জানালার কাচ বেয়ে টুপটাপ ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে একটানা, তার সাথে মাঝে মাঝে বজ্রপাতের গর্জন কাঁপিয়ে দিচ্ছে হোস্টেলের চারপাশ। অর্পণ খেয়াল করে, পড়াশোনার বই খোলা থাকলেও দু’জনের মন যেন আর অক্ষরের মধ্যে ডুব দিতে পারছে না। মেঘলার মুখে হালকা ক্লান্তির ছাপ, ভিজে চুল কপালের পাশে লেপ্টে আছে, চোখের কোণে হালকা জল জমেছে বৃষ্টির আর্দ্রতায়। অর্পণ হঠাৎ বলে ওঠে, “চল না, এক কাপ কফি বানাই। একটু গরম কিছু হলে ভালো লাগবে।” মেঘলা প্রথমে চুপ থাকে, তারপর হাসি টেনে মাথা নাড়ে, যেন সেই প্রস্তাবও একধরনের স্বস্তি এনে দিল। দু’জনে মিলে ছোট ইলেকট্রিক কেটলি আর গ্যাস স্টোভের ঝকঝকে শিখায় কফি বানাতে শুরু করে। কফির গুঁড়ো যখন ফুটন্ত জলে মিশে যায়, তখন ঘরটা ভরে ওঠে এক অদ্ভুত গন্ধে—কেবল কফির নয়, সেই গন্ধে যেন মিশে থাকে ক্লান্তি কাটানোর প্রতিশ্রুতি, আর একটু অন্যরকম মুহূর্তে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার ইঙ্গিত। বাইরে বৃষ্টি চলতে থাকে একই তালে, কিন্তু ভেতরে যেন আরেকটা সুর বাজতে শুরু করেছে।
কফি বানাতে বানাতে দু’জনের হাত আবারও একে অপরের সাথে লেগে যায়। গরম কাপ ধরতে গিয়ে মেঘলা হালকা চমকে ওঠে, তার আঙুল ছুঁয়ে যায় অর্পণের। অর্পণ তখনই কাপটা এগিয়ে দেয়, কিন্তু তার চোখ মেঘলার দিকে আটকে থাকে। ধোঁয়া ওঠা কাপে ঠোঁট রাখার সময় মেঘলার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, ঠোঁটে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তির ছায়া খেলে যায়, আর সেই দৃশ্য অর্পণকে আরও গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যেন এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেছে—বাইরের ঝড় থেমে গেছে, কেবল এই ছোট ঘর, কফির গন্ধ, আর তাদের দু’জনের নিঃশ্বাস একসাথে মিশে আছে। মেঘলার ঠোঁটের ভঙ্গি, ভিজে চুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলবিন্দু, আর গায়ের ওপর হালকা কম্বলের ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে ঘরটা হয়ে ওঠে আরও অন্তরঙ্গ, আরও ঘন। অর্পণ চেষ্টা করে চোখ সরাতে, কিন্তু সে বুঝতে পারে, তার চোখের ভেতর মেঘলার প্রতিচ্ছবিই এখন সবচেয়ে স্পষ্ট। মেঘলাও সেটা টের পায়, কাপে ঠোঁট রেখে হালকা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে, “তুমি এত তাকিয়ে থাকো কেন?” প্রশ্নটা সোজা হলেও উত্তরটা যেন সহজে আসে না। অর্পণ কেবল হাসে, আর সেই হাসির মধ্যে লুকিয়ে থাকে অজস্র অপ্রকাশিত স্বীকারোক্তি।
কফির ধোঁয়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় বাতাসে, কিন্তু সেই ধোঁয়ার মতোই ঘন হয়ে ওঠে ঘরের আবহাওয়া। বইগুলো টেবিলে খোলা পড়ে আছে, কিন্তু কারও চোখ সেদিকে নেই। মেঘলা কাপ নামিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, বৃষ্টির ফোঁটা আঙুলে ধরে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর জানালার কাচে হালকা বৃত্ত আঁকে। অর্পণ তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়, তবে কোনো কথা বলে না—শুধু নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে, আর সেই উষ্ণ নিশ্বাস মেঘলার গলার কাছে গিয়ে মিলিয়ে যায়। দু’জনের মধ্যে তখন দূরত্ব খুব বেশি নয়, অথচ সেই ফাঁকাটুকুই যেন বারবার দমবন্ধ করে তোলে। মেঘলার চুলে হাত রাখতে চায় অর্পণ, কিন্তু সাহস করে না; অর্পণের চোখে চোখ রাখতে চায় মেঘলা, কিন্তু লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বাইরের বজ্রপাত তখন আবারও আকাশ কাঁপিয়ে দেয়, আর সেই আলোয় এক মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে—দু’জনের বুকের ভেতরই আসলে একই ঝড় বইছে। কফির উষ্ণতা, বৃষ্টির ছন্দ আর একে অপরকে কাছে পাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে সেই রাত হয়ে ওঠে অদ্ভুতভাবে ঘন, যেন প্রতিটি ফোঁটা কফি আসলে তাদের সম্পর্কের ভেতরে নতুন এক স্বাদ যোগ করে দিচ্ছে।
~
বাইরে তখনও টানা বৃষ্টি, কিন্তু রাত যেন ক্রমশ আরও নিস্তব্ধ হয়ে উঠছে। হোস্টেলের ছোট ঘরটায় কফির কাপ ফাঁকা হয়ে গেছে, বইগুলো টেবিলে ছড়ানো পড়েই আছে, আর টেবিল ল্যাম্পের হলুদ আলোয় ঘরটা ভিজে ভিজে মনে হচ্ছে। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটুপ করে পড়ছে, মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটায় হালকা ফোঁটা ভেতরে এসে লাগছে। মেঘলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে কাচে জল মুছছে, আর অর্পণ পেছন থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে—তাকিয়ে আছে অনেকটা সময় ধরে, এমনভাবে যে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার আর কোনো ইচ্ছে নেই। হঠাৎ এক মুহূর্তে আকাশ বিদীর্ণ করে এক বিশাল বজ্রঝলকানি কাঁপিয়ে দেয় চারপাশ, আলো আর অন্ধকার একসাথে মিশে যায়। সেই আকস্মিক দীপ্তিতে যেন অর্পণের বুকের ভেতর জমে থাকা সমস্ত দ্বিধা ভেঙে যায়। অচেতন স্বরে সে বলে ফেলে—“তোমায় আমি শুধু সহপাঠী বলে ভাবতে পারিনি।” কথাটা মুখ দিয়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর কেঁপে ওঠে, মনে হয় যেন এ কথা বলার জন্যই এতদিনের সমস্ত নীরবতা, সমস্ত ঝড় জমা হয়ে ছিল। তার চোখে তখন ভয়, দুশ্চিন্তা আর অদ্ভুত এক মুক্তির আভা একসাথে খেলা করছে—মনে হচ্ছে, হয়তো এ স্বীকারোক্তি সম্পর্ককে অন্য রূপ দেবে, হয়তো আবার সবকিছু ভেঙেও যেতে পারে।
কথাটা শুনে মেঘলা প্রথমে চুপ করে যায়। তার আঙুল তখনও জানালার কাচে বৃত্ত আঁকছে, কিন্তু তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। ঘরের ভেতর যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে—বাইরে বৃষ্টি চললেও ভেতরে সেই শব্দ মিলিয়ে যায় অদৃশ্য নীরবতায়। মেঘলার চোখে তখন দোটানার ছাপ, সে যেন ভেবে পাচ্ছে না, উত্তর কী হবে। কিন্তু দীর্ঘ নীরবতার পর সে ধীরে ধীরে হাত তোলে, জানালার ভেজা কাচে রেখে দেয় নিজের মুঠো, যেন সেই ভিজে কাচই হয়ে উঠেছে তাদের মধ্যে একমাত্র সেতু। কাচের ওপরে জল টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে, আর সেই ফোঁটার ভেতরেই ভেসে ওঠে তার উত্তর—মৃদু কণ্ঠে, কিন্তু স্পষ্ট স্বরে সে বলে, “আমিও।” দুটো শব্দ যেন একসাথে ঝরে পড়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে জানালার ওপাশে বৃষ্টির শব্দ আরও জোরে বাজতে শুরু করে—যেন প্রকৃতি নিজেই করতালি দিয়ে উঠল তাদের স্বীকারোক্তির জন্য। অর্পণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না যে এত সহজে তার মনের কথার প্রতিধ্বনি মিলল। মেঘলার ঠোঁটে তখন হালকা হাসি, চোখে জমে থাকা জল আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আর সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে আর কোনো দূরত্ব থাকে না, কেবল এক অদৃশ্য স্রোত বয়ে যায়, যা তাদের দু’জনকে একই স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
সেই মুহূর্ত থেকে ঘরটার আবহাওয়াও যেন পাল্টে যায়। টেবিলের ওপর ছড়ানো বই আর কাগজের গুরুত্ব হারিয়ে যায়, কারণ তারা দু’জনেই জানে, এখন আর কোনো প্রশ্নোত্তর, কোনো প্রস্তুতির চাপে এই নীরবতার গভীরতা মুছে দেওয়া যাবে না। অর্পণ ধীরে ধীরে মেঘলার দিকে এগিয়ে আসে, কিন্তু তার চোখে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, বরং এক শান্ত ভরসা। মেঘলা তার মুখ ঘুরিয়ে তাকায় অর্পণের চোখের দিকে, আর এক পলকের জন্য তাদের দৃষ্টি এক হয়ে যায়। বাইরে বজ্রপাত আবারও আকাশ আলোকিত করে তোলে, আর সেই আলোয় যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাদের আবেগ—এ শুধু আকর্ষণ নয়, বরং এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি। তারা দু’জনেই টের পায়, আজকের রাতই তাদের সম্পর্কের নতুন জন্মদাতা। বৃষ্টির ঝাপটা, বজ্রপাতের গর্জন, ভেজা কাচের ঠান্ডা স্পর্শ—সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। অর্পণ মনে মনে ভাবে, এই এক স্বীকারোক্তির জন্যই হয়তো এতদিন অপেক্ষা ছিল, আর মেঘলা বোঝে, সে আর একা নয়—এই ভেজা রাত, এই বৃষ্টির জানালা থেকে শুরু হল তাদের মিলনের নতুন যাত্রা।
~
বাইরে তখনও টানা বৃষ্টি, হোস্টেলের করিডোর ভিজে একেবারে কাদামাটির মতো হয়ে গেছে। জানালার কাচে জলবিন্দুরা পরস্পরের গায়ে গড়িয়ে পড়ে, যেন আড়াল করা কাহিনি ফিসফিস করছে। ঘরের ভেতরে অর্পণ ও মেঘলা প্রথমে বই-খাতা ছড়িয়ে বসেছিল, কিন্তু কতক্ষণ আর অক্ষর গিলতে পারে মন! শব্দগুলো ঝাপসা হতে থাকে, পাতার ওপরে পড়তে থাকে ফোঁটার ছায়া। হঠাৎ একসময় অর্পণ মৃদু ভঙ্গিতে খাতাটা একপাশে সরিয়ে দেয়। মেঘলা অবাক হয়ে তাকায়, তারপর হাসে—একটা লাজুক, দ্বিধাগ্রস্ত হাসি। অর্পণ তখন আর কোনো যুক্তি খোঁজে না, শুধু মেঘলার হাতটা নিজের দিকে টেনে নেয়। দু’জনের আঙুল জড়িয়ে গেলে যেন বুকের ভেতর হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। বাইরে বজ্রপাতও যেন সেই মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে ওঠে।
প্রথমে হাত ধরা শুধু একটুকরো সান্ত্বনার মতো লাগে—যেন অবিরাম পড়াশোনা আর বাইরের অস্থির ঝড়ের মাঝখানে সামান্য আশ্রয়। কিন্তু সময় যত এগোয়, হাতের ভেতরের উষ্ণতা গাঢ় হতে থাকে। মেঘলার চোখে তখন কোনো প্রশ্ন নেই, নেই কোনো অস্বীকারও। তার চোখেমুখে খেলার মতো একরাশ ঝড়—ভয়, টান, আর এক অজানা আকর্ষণ। অর্পণ নিজের বুকের ভেতর তীব্র শব্দে হৃদস্পন্দন শুনতে পায়, যেন সেটা শুধু তার নয়, দু’জনের। আঙুলের আলতো চাপ ধীরে ধীরে তালু বেয়ে, কাঁপুনি ছড়িয়ে সারা শরীরে পৌঁছে যায়। দু’জনেই চুপচাপ বসে, কিন্তু সেই নীরবতাই সবকিছুর ভাষা হয়ে ওঠে। শব্দের প্রয়োজন পড়ে না—স্পর্শই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র সংলাপ।
বাইরে ঝড় আরও জোরে বয়ে যায়, বাতাসের ধাক্কায় জানালার কাচ কেঁপে ওঠে, তবুও ঘরের ভেতরে যেন অন্য এক আবহ। অর্পণ ও মেঘলা সেই মুহূর্তে ভুলে যায় চাকরির প্রস্তুতির বোঝা, ভুলে যায় হোস্টেলের চারপাশের ব্যস্ততা। তাদের মধ্যে যে উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়, সেটাই হয়ে ওঠে আসল সত্যি। মেঘলা হাত থেকে চোখ সরাতে পারে না—কোনো এক অলিখিত প্রতিজ্ঞার মতো জড়িয়ে থাকে। আর অর্পণ মনে মনে ভাবে, পৃথিবী যদি এখনই থেমে যায়, তবুও এই মুহূর্তটাই যথেষ্ট। বাইরে ঝড় চলতেই থাকে, কিন্তু তাদের ভেতরে জন্ম নেয় এক নতুন নিশ্চয়তা—প্রেম শুধু কথায় নয়, হাতের উষ্ণতায়ও ধরা দেয়।
~
রাতের নিস্তব্ধতায় ভেসে আসা বৃষ্টির শেষ শব্দ যেন এক এক করে নিঃশেষ হয়। গহন অন্ধকারের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে সাদা আলোর রেখা চিড়ে আসে জানালার ফাঁক দিয়ে, এবং আকাশের অন্ধকারের নিচে জমে থাকা আর্দ্রতা বাতাসের সঙ্গে মিশে মাটির গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেও চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে—নীরবতা এমন এক রূপে আছে, যা কেবল শরীরের ক্লান্তি নয়, মনকে ও শিথিল করে। তারা শুয়ে আছে একে অপরের পাশে, নিঃশ্বাস মিলিয়ে, শরীরের গরম আর হৃদস্পন্দনের ছন্দ একে অপরকে স্পর্শ করছে। গত রাতের সংস্পর্শ কেবল শারীরিক ছিল না, বরং অনুভূতির গভীরতায় ঢুকে গেছে। হঠাৎ করেই মনে হয়, যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছে, তা এক মৃদু ঢেউয়ের মতো—ধীরে ধীরে ভাঙছে, আবার গেঁথে যাচ্ছে দু’জনের মন ও আত্মার ভেতরে। চোখ বন্ধ রেখে, তারা একে অপরের হাত ধরে, এক ধরনের অদৃশ্য বন্ধনের অনুভূতি অনুভব করছে, যা শব্দের বাইরে, সময়ের বাইরেও। এই নীরবতা তাদেরকে এক নতুন ভোরের দিকে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে কোনো ব্যাখ্যা নয়, কেবল অনুভব আছে।
বিকেলের মতো আলোর নরম ঢেউ জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে, এবং তাদের কক্ষের প্রতিটি কোণকে স্বাভাবিক করে তোলে। সকাল কিংবা মধ্যরাত—সময়ের পার্থক্য যেন অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের চোখে চোখ রেখে সেই গভীর বোঝাপড়ার স্বাদ গ্রহণ করছে, যা কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হাতের উষ্ণতা কেবল শীতকালের ঠান্ডা হাওয়াকে প্রতিহত করছে না, বরং দুই মনকে সংযুক্ত করার একটি নিঃশব্দ ভাষা তৈরি করছে। শরীরের প্রতিটি স্পর্শ যেন তাদের অতীতের স্মৃতিগুলিকে মুছে দিয়ে, নতুন অনুভূতির একটি সূচনা করছে। তারা জানে, এই সম্পর্ক শুধু আজকের রাতের নয়, বরং এক দীর্ঘ পথের শুরু, যেখানে একে অপরের অনুভূতি, ভীতি, সুখ এবং আশা ধীরে ধীরে বিনিময় হবে। চারপাশে নীরবতা বিরাজ করছে, তবে সেই নীরবতা কোনও শূন্যতার মতো নয়—বরং এটি একধরনের শক্তিশালী সংযোগের প্রতীক, যা বলে দিচ্ছে যে, কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই।
বৃষ্টির বন্ধ হওয়ার পর যে শান্তি ভেতরে আসে, তা কেবল আকাশের জন্য নয়, তাদের মন ও আত্মার জন্যও। ধীরে ধীরে তারা নিজেরাই এই নীরবতার ভোরকে অনুভব করছে—যা আগের কোনো ভোরের সঙ্গে মিল নেই। নতুন সম্পর্কের সূচনা এক ধরনের আত্মিক মিলন, যা হৃদয়ের ভিতরে, মানসিক স্তরে গভীরভাবে উপস্থিত। তারা অনুভব করছে, যে রাতের অন্ধকার এবং বৃষ্টির ঝরঝরে শব্দ তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু নির্মাণ করেছে। এই সেতু কেবল তাদের শরীর নয়, মনকেও সংযুক্ত করেছে। তারা জানে, এখন থেকে একে অপরের পাশে থাকা মানে শুধু শারীরিক সংযোগ নয়, বরং মানসিক ও আত্মিক বোঝাপড়ার একটি স্থায়ী সূত্র। এই নীরবতার ভোরে, তাদের হৃদয়ের শব্দ একে অপরের প্রতি এক অদ্ভুত নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি করছে, যা বলে দিচ্ছে—এই সম্পর্ক কেবল শুরু, তবে এটি যথেষ্ট শক্তিশালী, স্থায়ী এবং গভীর, যাতে সময় ও পরিস্থিতি কোনোটাই এটি ভাঙতে পারবে না।
এই অধ্যায়ে বৃষ্টির শেষ শব্দের পরও একটি দীর্ঘস্থায়ী নীরবতার ভোর সৃষ্টি হয়, যা কেবল শারীরিক নয়, অনুভূতির স্তরে গভীরভাবে প্রোথিত। এটি তাদের সম্পর্কের একটি মূর্তিকরণ, যেখানে অনুভূতি, বোঝাপড়া এবং অদৃশ্য বন্ধনের মিলন ঘটে, যা আগামী দিনের সমস্ত উত্তেজনা ও অস্থিরতাকে একধরনের সুরক্ষা দেয়। এই নীরবতার ভোরে, তারা একে অপরের সাথে কেবল শুয়ে নেই; তারা একে অপরের মনের ভেতরে, হৃদয়ের গভীরে ঢুকে গেছে। এই অধ্যায় পাঠককে এমন এক নিঃশব্দ অনুভূতি এনে দেয়, যেখানে সম্পর্কের সূচনা, সংযোগ এবং গভীর বোঝাপড়ার সব দিক প্রতিফলিত হয়, যা কেবল ভ্রান্তি নয়, বরং সম্পূর্ণ আত্মিক মিলনের প্রতীক।
~
ভোরের নরম আলো ধীরে ধীরে জানালার কাঁচে পড়তে শুরু করে, এবং বৃষ্টির আর্দ্রতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় কাঁচের ওপর জমে থাকা জলকণাগুলো এক এক করে শুকতে থাকে। যে জানালার বাইরে রাত্রি জুড়ে বৃষ্টি ঝরেছিল, আজ সে জানালা যেন এক নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে—তাদের নতুন সম্পর্কের প্রথম ভোরের। অর্পণ ও মেঘলা আবার বই খুলে বসে, তবে এ বারে তাদের চোখে শুধু পাঠ্যপুস্তকের প্রতি মনোযোগ নেই। তাদের চোখে জেদ, উদ্দীপনা, আর একে অপরের পাশে থাকার অদৃশ্য শক্তি প্রতিফলিত হচ্ছে। বইয়ের শব্দ, পাতার খসখস শব্দ, আর জানালার ওপর বৃষ্টি শুকোয়ার অতি সূক্ষ্ম শব্দ—সবই যেন এক ধরনের পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, যা তাদের মনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। তারা জানে, জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেমন একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া দরকার, ঠিক তেমনি এই ভোরের নিঃশব্দ মুহূর্তও তাদের মনে একটি গভীর প্রতিশ্রুতি বদ্ধ করে। প্রতিটি চোখের মিলন, প্রতিটি হাতের স্পর্শ যেন বলে দিচ্ছে—এই সম্পর্ক কেবল রোমান্টিক নয়, বরং জীবনের সব ওঠাপড়ার মধ্যে এক অপরিহার্য সঙ্গী হিসেবে তৈরি হচ্ছে।
বইয়ের পৃষ্ঠার শব্দগুলো কখনও কখনও তাদের হৃদয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখে। অর্পণ যখন একটি বাক্য পড়ে, মেঘলা তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি ছুঁড়ে দেয়, আর সেই হাসি যেন তার সমস্ত ভাবনা ও জেদের প্রতিফলন। তাদের মধ্যে কোনো কথার প্রয়োজন নেই; চোখের ভাষা, হাতের নরম স্পর্শ এবং নিঃশব্দ বোঝাপড়াই যথেষ্ট। জানালার ভেজা কাঁচের ওপর ভোরের আলো খেলা করছে, আর সেই আলো তাদের মুখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে দিচ্ছে—যা প্রতিদিনের জীবনকে এক নতুন আশার সঙ্গে মিলিত করে। তারা জানে, শুধু চাকরির বা পড়াশোনার লক্ষ্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ছোট বড় মুহূর্তে একে অপরের সঙ্গী হতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তে এই প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে। ভোরের নীরবতা, শুকতে থাকা কাঁচের শব্দ, বইয়ের পাতার হালকা খসখস—সবই যেন একত্রে তাদের ভবিষ্যতের সুরের মতো, যা শুধু আজকের জন্য নয়, বরং আগামী দিনের সব স্বপ্ন এবং চ্যালেঞ্জের জন্যও প্রেরণা যোগাচ্ছে।
বৃষ্টি থেমে গেলেও জানালার ভেজা কাঁচ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থেকে যাচ্ছে। তারা জানে, এই সম্পর্ক কেবল মধুর মুহূর্ত নয়; এটি এক দীর্ঘ যাত্রার শুরু, যেখানে একে অপরের পাশে থাকা মানে একে অপরের স্বপ্ন, হতাশা, সুখ এবং অস্থিরতাকে ভাগ করে নেওয়া। অর্পণ ও মেঘলা একে অপরের দিকে তাকিয়ে নতুন পরিকল্পনা করছে, কিন্তু এবার চোখে শুধুই অধ্যায় শেষ করার উদ্দীপনা নয়; বরং জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একসাথে কাটানোর দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। ভোরের আলো তাদের কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করছে, আর সেই আলো যেন তাদের হৃদয়কে আরও উজ্জ্বল করে তুলছে, নতুন দিনের জন্য নতুন আশা ও প্রেরণা জাগিয়ে তুলছে। এই অধ্যায়ে পাঠক দেখতে পায় কেবল এক সম্পর্কের সূচনা নয়, বরং সেই সম্পর্কের ভিতরে জন্ম নেওয়া গভীর বোঝাপড়া, প্রতিশ্রুতি এবং একে অপরকে জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করার দৃঢ় সংকল্প। জানালার ভেজা কাঁচ, ভোরের আলোর কোমলতা এবং নিঃশব্দ মিলনের অনুভূতি—সব মিলিয়ে এটি একটি চিত্রমান প্রতিশ্রুতি, যা বলছে, সত্যিকারের ভালোবাসা কেবল অনুভবের মধ্যে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষণে স্থায়ী হয়ে ওঠে।
—-