Bangla - ভ্রমণ

বর্ষায় বাংলাদেশের ভ্রমণ

Spread the love

অনিরুদ্ধ বসাক


পর্ব : পদ্মার পাড়ে, মেঘে ভেজা সকাল

পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই একটা নিঃশব্দ যাদুর মধ্যে ঢুকে পড়া। আমি তখন রাজশাহীতে, বর্ষার শুরুতেই এসে পড়েছি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামছিল, যেন মাটিকে এক নতুন জেগে ওঠার ডাক দিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্ষার সৌন্দর্য আলাদা। এখানে মেঘ শুধু আকাশে থাকে না, জমে থাকে মানুষের চোখে, গন্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাদামাখা পথঘাটে, ধানখেতের ফাঁকে, কাঁঠালের গন্ধে।

সকালটা শুরু হয়েছিল এক কাপ ধোঁয়া ওঠা লেবু-চা দিয়ে, ছোট্ট এক চায়ের দোকানে। দোকানদার বললেন, “ভাই, বর্ষা কিন্তু আমাদের দেশের একেকটা প্রেমের গল্পের মত। শুরুতে আনন্দ, মাঝখানে অভিমান, শেষে শান্তি।” আমি চায়ের কাপ হাতে বসে ভাবছিলাম, ঠিকই তো—এই বৃষ্টি যেন প্রতিটা শহর-গ্রামের মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করে দেয়।

পদ্মার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছে গেলাম একটা নৌকাঘাটে। পেছনে মাটির ঘর, সামনে জলরাশি, আর মাঝখানে আমার দাঁড়িয়ে থাকা। এক মাঝি কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে শান্তির ছায়া। বললেন, “ভাই নৌকা ভাড়ায় যাবেন? বর্ষার সময় নদীটা কিন্তু একটু অভিমানী হয়।” আমি হেসে বললাম, “চলুন, আজ আমি সেই অভিমানী নদীর গান শুনব।”

নৌকায় ওঠার পর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি এল। জল নরম ঢেউ তুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল কাঠের গায়ে। মাঝি বললেন, “এই জল কিন্তু কেবল জল না। এই পদ্মা বয়ে আনে স্মৃতি। কারো প্রিয় মুখ, কারো হারানো গল্প, আবার কারো নতুন শুরু।” কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর কেমন যেন কেঁপে উঠল।

নৌকা যখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, তখন আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করল। দূরের কোনো গাঁয়ে মেঘের শব্দে কুকুর ডেকে উঠল। একেকটা শব্দ যেন প্রকৃতির অ্যালার্ম—‘শোনো, আমি আসছি।’ হঠাৎ বৃষ্টি ঝেঁপে এল। আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলেও সেই জল ঠেকানোর উপায় ছিল না। ভিজে যাওয়া শরীরের ভেতরেও এক ধরনের উষ্ণতা ছিল। আমি জানি, এটা সেই অনুভব যা শহরের এসিতে বসে পাওয়া যায় না।

নৌকা ভিড়ল এক খেয়াঘাটে। ছোট্ট সেই জায়গাটার নাম ‘চারঘাট’। সেখানকার লোকজনেরা এতটাই অতিথিপরায়ণ, মনে হল যেন আমি বহুদিন পর নিজের বাড়ি ফিরে এসেছি। একটা বাড়ির বারান্দায় বসে কচি আম আর লবণ-মরিচ দিয়ে খাচ্ছিলাম। এক বয়স্ক মানুষ এসে বললেন, “পদ্মা এখন ঝিম মেরে আছে, কিন্তু জানেন, মাস খানেক পর এমন জোয়ার হবে, যে এই ঘরেও জল উঠে আসবে।” আমি চমকে গেলাম। অথচ তাঁদের মুখে কোনো ভয় নেই। অভ্যস্ত এই অনিশ্চয়তার সাথেই তাঁরা বেঁচে থাকেন, হাসেন, গান করেন।

আমি সন্ধ্যায় আবার ফিরে এলাম শহরে। রাস্তার পাশে ভিজে চায়ের দোকানে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। পাশে বসে থাকা ছেলেটি বলল, “আপনি বিদেশি?” আমি হেসে বললাম, “না, কিন্তু এই দেশটা আমার খুব চেনা মনে হয়।” ছেলেটি বলল, “বর্ষায় বাংলাদেশকে চিনে ফেলা যায়, কারণ এই সময়েই সব কিছু খোলা থাকে—মাটি, মানুষ আর মন।”

ফেরার পথে আমি ভাবছিলাম, পদ্মার জল, বর্ষার আকাশ, চারঘাটের অতিথিস্বভাব—সব মিলে যেন একটা কবিতা হয়ে উঠেছে। আর আমি সেই কবিতার ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি, পাতা-ফেলা ডায়েরির পাতার মতো। এই ভ্রমণের শুরুতেই আমি বুঝে গেছি, বর্ষায় বাংলাদেশ শুধু দেখা নয়, অনুভব করার জিনিস।

পর্ব : নাটোরের জলভেজা রাজবাড়ি নীলিমা সন্ধ্যা

নাটোর, নামটাতেই এক অদ্ভুত নরম রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে। আমি যখন বাস থেকে নামলাম, তখন আকাশ আর মাটি মিলেমিশে একাকার। বৃষ্টি পড়ছে না ঠিক, কিন্তু বাতাসে যে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, সেটা বলে দিচ্ছে — খুব বেশি দূরে নেই সে। রাস্তার দুপাশে কাদামাখা ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে জল জমে থাকা পুকুর, আর ছাতায় মাথা ঢেকে হাঁটতে থাকা মানুষজন। এরকম বর্ষার দিনে নাটোর যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম গন্তব্য নাটোর রাজবাড়ি। ইতিহাস আর জল এখানে একসাথে বাস করে। পুরনো রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই এক কালের দরজায় কড়া নাড়া। প্রবেশপথের দুই পাশে বিশাল ফটক, যার গায়ে লতাগুল্ম বেড়ে উঠেছে আপনমনে। আমি ভিতরে ঢুকে যেই পা রাখলাম, হালকা বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ শুনতে পেলাম। ছাদের কর্নিস থেকে পানি টপটপ করে পড়ছে। রাজবাড়ির প্রাচীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, কোনো এক সময় এখানে বেহালা বাজত সন্ধ্যায়, আর রুপোর থালায় চা পরিবেশন করা হতো রানীদের জন্য।

এক পুরোহিতের বংশধর এখন এই স্থাপত্যের দেখাশোনা করেন। উনি বললেন, “এই রাজবাড়ি বর্ষায় কাঁদে, আবার হাসেও। আপনি যদি মন দিয়ে শুনতে পারেন, শুনবেন বৃষ্টির ভেতরে লুকিয়ে থাকা চুড়ির আওয়াজ।” কথাটা শোনার পর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম ভিজে উঠোনে। কোথা থেকে যেন ভেসে এল সেই অদৃশ্য চুড়ির ঝনঝন, হয়তো মনের ভ্রম, হয়তো ইতিহাসের ছায়া।

রাজবাড়ির পাশেই আছে একটা বড় দীঘি — বৃষ্টিতে সেটা এখন প্রায় উপচে পড়ছে। জল এতটাই স্বচ্ছ যে আকাশ তার নিজের রূপ দেখতে পায় সেখানে। পাড়ে বসে কিছুটা সময় কাটালাম। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে গোসলে নেমেছে, বৃষ্টি তাদের ভয় পায় না। ওদের হাসিতে মিলিয়ে গেল সব ক্লান্তি। মনে হল, এরকমই হোক জীবন—নির্বিকার, জলছোঁয়া, নির্মল।

বিকেল গড়াতে গড়াতে চলে এলাম নাটোর শহরের এক পুরনো মিষ্টির দোকানে। বৃষ্টির দিনে সন্দেশ খাওয়ার একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। দোকানের মালিক বললেন, “আমাদের নাটোরে এসে যদি আমাদের ‘রাজভোগ’ না খান, তবে তো এলেনই না।” আমি রাজভোগ মুখে দিয়েই বুঝলাম, সত্যিই, এই স্বাদের মধ্যে আছে ইতিহাস, রাজকীয়তা আর বৃষ্টির ছোঁয়া।

সন্ধে নামছে ধীরে ধীরে। শহরের ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে, আর রাস্তায় রিকশার চাকায় জমা হচ্ছে জল। এক চায়ের দোকানে বসে দেখছিলাম—এক দম্পতি রিকশায় বাচ্চাকে নিয়ে ফিরছেন, এক বৃদ্ধা পানের দোকান থেকে ভিজে চাদর গায়ে চাপিয়ে ফিরছেন, আর আমি, এক পর্যটক, নাটোরের এই বর্ষা-বর্ণনায় একে একে সংযুক্ত হচ্ছি।

হোটেলে ফেরার পথে হঠাৎ থেমে গেলাম। সামনের এক পুরনো ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন তরুণী দাঁড়িয়ে, গায়ে শাড়ির ভাঁজে বৃষ্টি জমে আছে। ওর হাতে একটা নীল ছাতা, কিন্তু মেলে রাখেনি। শুধু তাকিয়ে আছে দূরের দিকে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। কে জানে, হয়তো নাটোর রাজবাড়ির সেই পুরনো কোন রানির আত্মা, এই বর্ষায় ফিরে আসে তার পুরনো উঠোন দেখতে!

নাটোরের বর্ষা আমার ভিতরে এক গভীর প্রশান্তি এনে দিল। রাজবাড়ির ভাঙা দেয়ালে, দীঘির জলে, অচেনা মানুষের চোখে আমি যেন খুঁজে পেলাম আমার নিজেরই কোনো হারিয়ে যাওয়া রূপ। বর্ষা এখানে শুধু প্রকৃতির ঋতু নয়, এটা স্মৃতির মতো — মনখারাপেরও, ভালোবাসারও।

পর্ব : মেহেরপুরবৃষ্টিতে ভেজা ইতিহাস সীমান্তের গান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের এক শান্ত জেলা—মেহেরপুর। বর্ষাকালে এই জায়গাটাকে একেবারে অন্যরকম লাগে, যেন কোনো পুরনো পাণ্ডুলিপির মধ্যে সজীব হয়ে উঠেছে পাতা-ওল্টানো কিছু ইতিহাস। আমি যখন পৌঁছালাম, তখন শহরের চারপাশে ধানখেত আর জলমগ্ন কাঁচা রাস্তার জঙ্গল পেরিয়ে এক ধরনের নরম নিস্তব্ধতা ভেসে আসছিল। আকাশটা ভিজে, মেঘে ঝুলে থাকা পটচিত্রের মতো, আর বাতাসে ঘাসের গন্ধ।

প্রথমেই গেলাম ঐতিহাসিক আম্রকাননে। এই সেই জায়গা যেখানে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিল। গেট দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টির ছাঁটে পুরো আম্রবাগানটা যেন এক বীরত্বগাথার স্তবক হয়ে উঠল। ভেজা মাটির গন্ধ, চারপাশে আমের পাতা নুয়ে পড়া, আর একা একা দাঁড়িয়ে থাকা সেই স্মৃতিস্তম্ভ—সবকিছুতেই যেন সময় একটুখানি থেমে গেছে।

আমার সাথে পরিচয় হল এক স্থানীয় বয়স্ক লোকের সঙ্গে, নাম শওকত আলী। তিনি তখন একটি আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁধে লাল গামছা চাপিয়ে। বললেন, “এই জায়গার প্রতিটা আমগাছ যুদ্ধ দেখেছে, ভাই। বর্ষার সময় তো মনে হয় যেন এই গাছগুলো কাঁদে, আবার নতুন করে জন্মায়।” আমি চুপ করে শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল ইতিহাস ছুঁয়ে ফেলেছে আমার কাঁধ।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাগানের এক কোণায় চলে এলাম, যেখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর টাইপের কাঠামো—নাকি আসলেই ছিল সেই সময়ের অস্থায়ী অফিস, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ভিতরে জল জমে গেছে, ঘাসে ভরে উঠেছে মেঝে। তবু, বাতাসের মধ্যেই যেন একটা কথা ঘুরছে, “স্বাধীনতার দাম শুধু রক্ত নয়, সময়কেও দিতে হয়।”

আম্রকাননের বৃষ্টিভেজা সৌন্দর্য দেখে আমি সোজা রওনা দিলাম গাংনীর দিকে, সীমান্তের কাছাকাছি এক গ্রাম। পথে যেতে যেতে দেখি, গরুর গাড়ি চলে যাচ্ছে জলকাদা চিরে, ছেলেরা মাছ ধরছে খালের ধারে, আর ছাতার নিচে এক তরুণী বাইসাইকেল চালিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। এগুলো বর্ষাকালের বাস্তব গল্প, শহরের বাইরে ছোট ছোট জীবনযাপন যেখানে জল আর সময় পাশাপাশি চলে।

গাংনীর সীমান্তে পৌঁছানোর পর সোজা চলে গেলাম এক জমি-ঘেরা উঁচু জায়গায়, যার ওপারে ভারতের চব্বিশ পরগনার ঝাপসা ছায়া। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে দূরে একটা মন্দিরের গম্বুজ দেখতে পেলাম, যদিও কুয়াশায় স্পষ্ট নয়। সীমান্তে সবসময়ই একটা নিঃশব্দ টান থাকে—অদৃশ্য রেশমি দড়ি, যেটা না ছিঁড়েও ছিন্ন।

একজন বর্ডার গার্ড সদস্য আমাকে দেখিয়ে বললেন, “ভাই, ওদিকটাও একসময় আমাদেরই ছিল। এই জমি, এই জল, এই গাছেরা জানে কোনটা কাঁটাতার, কোনটা হৃদয়ের সীমা।” কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরে বেজে উঠল একটা অদৃশ্য বাঁশির সুর—হয়তো কোনো পাড়াপারের গান, অথবা বর্ষার কোনো শোকগাথা।

সন্ধে হয়ে আসছিল। সীমান্তে তখন বাতি জ্বলে উঠছে, লাল আলো টিমটিম করছে। দূরে কে যেন একটা বাউল গান গাইছে, “আকাশ ভরা মেঘে মেঘে, মন ভরে না রে…” আমি দাঁড়িয়ে আছি এক পায়ে হাওয়ার সীমানায়, বর্ষা এখানে শুধু প্রকৃতির চিত্রনাট্য নয়, এটা একটা আদিগন্ত অনুভব—যেখানে প্রেম আর দেশপ্রেম একসাথে হাঁটে।

ফিরে আসার পথে আবার বৃষ্টি নেমে এল। ছাতা মেলে লাভ নেই, এই বৃষ্টি শরীরে না ছোঁয়ালে বর্ষা পূর্ণ হয় না। আমি ভিজতে ভিজতে হেঁটে চলেছি মেহেরপুর শহরের দিকে, পিছনে ফেলে যাচ্ছি ইতিহাসের সুরভি, আর সীমান্তের দোলানো গান।

পর্ব : বরগুনাবৃষ্টির পাড়ে সমুদ্র, কাঁকড়ার গল্প ঘূর্ণিঝড়ের ছায়া

বরগুনা নামটাই শুনলেই আমার কানে ভেসে আসে ঢেউয়ের শব্দ, গাছ ভাঙা হাওয়া, আর দূরে কোনো হারিয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের খবর। আমি যখন বরগুনা পৌঁছালাম, তখন ভোর। আকাশ ধূসর, মাটি কাদায় ভর্তি, আর রাস্তায় একটাও রিকশা নেই। শুধু দূর থেকে একটা মোটরসাইকেলের আওয়াজ ভেসে আসছিল, যেন ভাঙা মেঘের গায়ে লেপ্টে থাকা একমাত্র শব্দ।

আমার প্রথম গন্তব্য ছিল পাথরঘাটা। এটি বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে থাকা এক নিঃসঙ্গ জেলেপাড়া, যেখানে বর্ষার সময়ে মানুষ ও সমুদ্রের সম্পর্কটা আরও ঘন হয়ে যায়। পথে যেতে যেতে দেখি মাটির বাড়িগুলোর চালার ওপর কালো পলিথিন বাঁধা, যেন বৃষ্টিকে আটকানোর এক চিরন্তন প্রয়াস। চারপাশে ছড়ানো ঝাউগাছ, জল জমে থাকা মাঠ, আর মাঝেমাঝে এক-দুটো নৌকা শুকনো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা করছে।

পাথরঘাটার ঘাটে গিয়ে আমি কিছু জেলেদের সঙ্গে আলাপ করলাম। একজন নাম বলল ছালামউদ্দিন, বয়স প্রায় ষাট। তার চোখের কোণে নোনা জলের রেখা, আর গলায় সেই পুরনো ভরাট কণ্ঠস্বর। বলল, “এই বর্ষা আসলে আমাদের কাছে খেলার মত। কখন যে ঝড় ওঠে, কে জানে। তবুও মাছ ধরতে যেতে হয়। না গেলে পেট চলবে না।” আমি চুপ করে শুনছিলাম। সেই চুপে ছিল সমুদ্রের গর্জন, সংসারের হিসাব, আর জীবনের মানে।

একটা ছোট্ট ট্রলারে আমি উঠলাম, যদিও জানতাম খোলা সাগরে যাওয়া হবে না। কেবল পাড় ঘেঁষে একটু ঘুরে দেখা। চারপাশে জল, দূরে কিছু ফিশিং নেট ভেসে আছে, আর মাথার ওপর ভারী মেঘ ঘুরছে গোল হয়ে। মাঝি বলল, “ঘূর্ণিঝড়ের আগে আকাশ এমনই হয়। বোঝা যায় না কবে নামে।” আমার বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা জমে উঠছিল—অসীমের ভয়, প্রকৃতির সামনে ক্ষুদ্রতার বোধ।

ফিরে এসে আমি এক উপকূলীয় গ্রামের ভিতরে ঢুকলাম, যেখানে কাঁকড়া চাষ হয়। কাদা ভরা পুকুরে কাঁকড়া খোঁজার দৃশ্য একেবারে সিনেমার মতো—একজন হাঁটু জল কাদা পেরিয়ে জাল ছুড়ছে, আর কাঁকড়া চুপি চুপি পিছলে পালিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছেলেরা হাঁসের মতো ছুটছে, হাসছে, বৃষ্টির মধ্যে ভিজে খেলে বেড়াচ্ছে। বরগুনার বর্ষা কাঁদায় ভেজে, কিন্তু তবু যেন একটা দুরন্ত প্রাণবন্ততা রয়েছে সবকিছুর মধ্যে।

দুপুরের দিকে আমি এক স্কুলঘরের বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সেখানকার শিক্ষিকা শিমু আপা বললেন, “ঘূর্ণিঝড় এলেই এই স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্র হয়। তখন ছেলেমেয়ের পাঠ থেমে গিয়ে শুরু হয় বেঁচে থাকার ক্লাস।” তার চোখে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু ভেতরে ছিল এক অদম্য শক্তি। আমি জানি, এইরকম মানুষগুলোর কারণেই টিকে আছে উপকূলের গ্রামগুলো।

বিকেলের দিকে আবার আকাশটা খুলে এল। সামান্য রোদ উঠেছে, কিন্তু বাতাসে এখনও সেই ভয় পাওয়া নোনাজলের ঘ্রাণ। আমি একটা খুপরি দোকান থেকে মুড়ি-চানাচুর কিনে খাচ্ছিলাম। দোকানদার হেসে বলল, “ভাই, বর্ষায় ভিজে মুড়ির মজা আলাদা। তবে খেয়াল কইরেন, বৃষ্টি থেমে থাকলেও মন ভিজে যায়।”

ফেরার পথে হঠাৎ দেখলাম একটা জলছবির মতো দৃশ্য—এক বুড়ো, মাথায় ভাঙা ছাতা নিয়ে, একা হাঁটছে জলমগ্ন রাস্তা পেরিয়ে। পেছনে তার ছেলেবেলার ঘর, সামনে অনিশ্চিত কাল। আর আমি দাঁড়িয়ে, ভিজে হইচই জুড়ে, শুধু দেখছি। এই বরগুনা আমাকে কাঁকড়ার মতো একজায়গায় ধরে রাখছে—অচেনা এক কোমল ভয় আর নিঃশব্দ ভালোবাসার বাঁধনে।

পর্ব : সিলেটচায়ের পাহাড়, ঝরনার গান মেঘের বাসা

সিলেট নামটা শুনলেই মনে আসে সবুজে মোড়া টিলা, অদ্ভুত শান্ত পাহাড়ি পথ, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা একটা ঝরনার ডাক। বর্ষায় সেই ডাক আরও গাঢ়, আরও নরম। আমি যখন সিলেট পৌঁছালাম, তখন ভোর পেরিয়ে সকাল। শহরটা ধুয়েমুছে একদম ফ্রেশ, যেন বৃষ্টি এসে তার মুখ ধুয়ে দিয়েছে। রিকশাওয়ালারা ছাতা মাথায় বসে আছেন, দোকানের সামনে চায়ের কেটলি থেকে ধোঁয়া উঠছে। এই শহরে সকাল মানেই একটা ধীরস্থির আশ্রয়।

আমার গন্তব্য ছিল জাফলং, চা-বাগানের পাহাড়ঘেরা অঞ্চল। পথে যেতে যেতে চারপাশে যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ। বর্ষার কুয়াশায় চা গাছের সারিগুলো যেন ঘন মেহেন্দির রেখা। মাঝে মাঝে কিছু কর্মী বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পাতা তুলছেন—চোখে-মুখে ক্লান্তি থাকলেও শরীর যেন অভ্যস্ত। একজন বৃদ্ধা চা-তুলুনি আমাকে দেখে হেসে বললেন, “বাবা, বৃষ্টিতে চা গাছ কথা বলে। শোনার মন আছে তো?” আমি অবাক হয়ে তার কথার গভীরতা বুঝে উঠতে পারলাম না তখনই, কিন্তু পরে মনে হলো—হয়তো সত্যিই, প্রকৃতি তার ভাষায় আমাদের ডাকে।

জাফলং পৌঁছে মনে হলো যেন আমি মেঘের ভেতর ঢুকে গেছি। দূরে খাসিয়া পাহাড়, মাঝখানে ডাউকি নদী, আর চারপাশে এক ঘন জলবায়ুর আবেশ। বৃষ্টির পানি নদীকে এমন স্বচ্ছ করেছে যে পাথরের রঙ, মাছের চলাফেরা—সব দেখা যায়। নৌকা ভাড়া নিয়ে একটু দূরে যেতেই বৃষ্টির ছাঁট শুরু হল। মাঝি বলল, “ভাই, এই নদী ভারত থেকে আসে, কিন্তু বর্ষার সময় সে আমাদের দেশেরই মতো হয়ে যায়—ভিজে, নরম, উদার।”

নদীর ওপারে একটা ছোট্ট কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছালাম এক ঝরনার ধারে। স্থানীয়রা একে বলে ‘হামহাম’। যদিও বড় ঝরনা নয়, তবুও তার বুকে বর্ষার জল এমন ছন্দে পড়ে যে মনে হয় কেউ যেন গানের সুরে কাঁদছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আমি মনে মনে বললাম, “এই ঝরনার শব্দ যদি একদিন হারিয়ে যায়, তাহলে সিলেটের মনটাও নিশ্চয় শুকিয়ে যাবে।”

একটা চায়ের কুঁড়েঘরে ঢুকে আমি গরম চা খেলাম। সাথে ছিল নরম পিঠা। দোকানের ছেলেটা হেসে বলল, “ভাই, আপনি কি কবি?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “না তো!” ও বলল, “তবু আপনার চোখে দেখি, বৃষ্টির গল্প আছে। যারা গল্প বোঝে, তারা কবিই।” আমি আর কিছু বললাম না—সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমি আসলে এই বর্ষার সফরে নিজের ভিতরেই ঢুকে পড়েছি।

বিকেলটা কাটালাম লালাখালের ধারে। নদীটা বর্ষায় ফুলে উঠেছে, কিন্তু তার বুকে যেন এখনও একটা নিস্তরঙ্গ ভাব। পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম—একটি মেয়ে বালতি হাতে জল তুলছে, আর তার লাল ওড়না বাতাসে উড়ছে। সে হঠাৎ চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তারপর আবার মুখ নামিয়ে দিল। হয়তো কোনো প্রশ্ন ছিল চোখে, অথবা একটুকরো চুপ থাকা।

সন্ধের সময় সিলেট শহরে ফিরলাম। শহরের বাতিগুলো বর্ষার জলে প্রতিফলিত হয়ে উঠছে ঝলমলে। রিকশার চাকা থেকে জল ছিটিয়ে যায়, দোকানপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। মালিক বললেন, “বর্ষায় বই কিনতে মানুষ কম আসে, কিন্তু যারা আসে, তারা হৃদয় নিয়ে পড়ে।”

সিলেটের এই বর্ষা আমাকে শুধু ভিজিয়ে দিল না, সে আমার মনটাকে এমন এক শান্ত পাহাড়ে বসিয়ে দিল, যেখানে শব্দগুলোও জলধারার মতো বয়ে যায়, আর চোখের জলে-মেশা কুয়াশায় খুঁজে পাওয়া যায় আত্মার আয়না।

পর্ব : কুমিল্লাবারোয়ারি দীঘি, বৃষ্টির মঠ আর শালবনের ছায়া

কুমিল্লা শহরে বর্ষাকালের ঢেউ অন্যরকম। এখানে বৃষ্টি পড়ে যেন ধীরে, খুব সন্তর্পণে, যেন ইতিহাসকে না জাগিয়ে দেয়। আমি যখন কুমিল্লা স্টেশনে নামলাম, তখন মাটির গন্ধে একটা চেনা অচেনা ভাব জেগে উঠেছিল। রাস্তায় চলতে থাকা রিকশার ঘন্টি আর টিনের চালের ওপর বৃষ্টির শব্দ মিলে এক আশ্চর্য ছন্দ তুলছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো অদৃশ্য কবি এই শহরের ওপর ছাতা ধরে রেখেছে।

আমার প্রথম গন্তব্য ছিল ধর্মসাগর দীঘি। শহরের মাঝখানে এমন প্রশান্ত জলাধার একমাত্র বর্ষায়ই বুঝি তার পুরো সৌন্দর্যে ফেটে পড়ে। চারপাশে সিঁড়িঘাট, তার ওপর ভিজে অ্যালগি আর কচুরিপানা, আর মাঝেমধ্যে এক-দুটো পাখি বসে আছে সজনে গাছে। আমি সিঁড়িতে বসে আছি, বৃষ্টি মাথায় পড়ছে, অথচ উঠতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ এক বয়স্কা মহিলা, তার চাদরের কোণ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পাশ দিয়ে চলে গেলেন। পায়ের শব্দটাও যেন অতীত থেকে আসা এক স্মৃতি।

সেই দীঘির পাশেই আছে শালবন বিহার—প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক আশ্রমের ধ্বংসাবশেষ। আমি সেই পথ দিয়ে হাঁটছিলাম, যেখানে অদ্ভুত এক কুয়াশা ভর করেছে চারপাশে। ইটের গায়ে জমে থাকা সবুজ শেওলা যেন বলছে—”আমরা আজও জেগে আছি, শুধু অন্যরকম ভাষায় কথা বলি।” একজন পুরাতত্ত্ব কর্মী পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “বর্ষায় এখানে এলেই বোঝা যায়—এই ভাঙাচোরা ইটগুলো শুধু ইতিহাস নয়, বরং জলভেজা প্রার্থনার মতো।”

আমি আর কিছু না বলে হাঁটছিলাম। মাঝে মাঝে কোনও পাথরের কোণে জমে থাকা জল দেখে মনে হচ্ছিল, এই জল হয়তো একদিন এক ভিক্ষুর চোখের জল ছিল। তার প্রার্থনা, তার আর্তি, সবকিছু এই বর্ষায় মিশে গিয়ে আজকের নীরবতায় রূপ নিয়েছে।

শালবনের আশেপাশে কিছু স্থানীয় ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলছিল। তাদের হাসি, তাদের ছুটে যাওয়া, কাদা মেখে যাওয়াটা—সবই এত প্রাণবন্ত যে শালবনের ইতিহাসের ভার হঠাৎ হালকা হয়ে উঠল। একজন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা বর্ষায় খেলতে ভয় পাও না?” সে বলল, “ভয় পাব কেন? বৃষ্টি তো আমাদের পুরনো বন্ধু। স্কুল বন্ধ, মায়েরা রান্না করে খিচুড়ি দেয়, আর আমরা খেলি। কুমিল্লার বর্ষা মানেই খুশি।”

আমি দুপুরে গেলাম কান্দিরপাড়ের দিকে, শহরের কেন্দ্রবিন্দু বলা চলে। ছোট দোকান, মিষ্টির গন্ধ, চায়ের দোকানে জড়ো হওয়া ভিড়—সব মিলিয়ে যেন এক আরামদায়ক গৃহস্থ পরিবেশ। এক মিষ্টির দোকানে বসে আমি খেলাম বিখ্যাত রসমালাই। দোকানদার বললেন, “ভাই, বর্ষায় রস কমে যায় না, বরং বেড়ে যায়। মাটির ঘ্রাণ আর রসের স্বাদ—দুইই তখন এক।”

বিকেলে আমি গেলাম ময়নামতি যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্রে। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাদের কবর এখানে, সারি সারি সাদা শিলাপট। বৃষ্টিতে কবরের গায়ে জল জমেছে, কিছু ফুলের পাপড়ি বৃষ্টির জলে ভেসে গেছে। একটা পাথরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হল, এখানেও বর্ষা এক শ্রদ্ধার পরত হয়ে বসে থাকে। এক ভিজে পাতা উড়ে এসে আমার পায়ের পাশে পড়ল। যেন কারও অবিনাশী স্মৃতি।

সন্ধ্যায় শহরে ফেরার সময় আকাশ হালকা গাঢ়। বৃষ্টির গতি একটু কমেছে, কিন্তু বাতাসে এখনও ভেজা সময়ের ঘ্রাণ। আমি হাঁটতে হাঁটতে বুঝে যাচ্ছিলাম, কুমিল্লা বর্ষায় শুধু ভিজে না—সে কথা বলে। ইতিহাস, জীবন আর জলের ছায়ায় এখানে প্রতিটি ধ্বংসস্তূপও নতুনভাবে জন্ম নেয়।

পর্ব : সাতছড়িবৃষ্টিভেজা বন, নিশব্দ হাঁটা পাখির ডাক

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের নাম আমি আগেও শুনেছি। তবে কখনো বর্ষাকালে এখানে আসব, ভাবিনি। আমার ধারণা ছিল—জঙ্গল বর্ষায় বিপজ্জনক, পিচ্ছিল আর নীরব। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে আলাদা। আমি যখন সাতছড়ি পৌঁছালাম, তখন একটানা বৃষ্টি থেমে একটা ভেজা নীরবতা নেমেছে। গাছের পাতায় টুপটাপ জল পড়ছে, মাটির গন্ধ এত তীব্র যে মনে হচ্ছিল, একেবারে পায়ের আঙুল দিয়ে শরীরে ঢুকে যাচ্ছে।

সাতছড়িতে প্রবেশের সময় গেটের পাশে একটা চা-স্টলে বসে গরম চা খেলাম। চায়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে বৃষ্টির ঘ্রাণ, আর পাশের রেঞ্জ অফিসার বললেন, “ভাই, বর্ষায় কিন্তু বন জেগে ওঠে। যেগুলো অন্য ঋতুতে বোবা থাকে, এখন তারা কথা বলে।” আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তা কাদা, কিন্তু পাশে পাশে বৃষ্টিজল জমা গর্তে ব্যাঙের ডাক—এই তো শুরু।

জঙ্গলের মধ্যে একটু এগোতেই মনে হল, আমি শহর নামক বস্তুটিকে বহু দূরে ফেলে এসেছি। চারপাশে কেবল সবুজ, বৃষ্টিজলে ভেজা পাতা, নীচে মাকড়সার জাল, আর মাথার ওপর গাছে গাছে পাখির পাখির গলা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, একজোড়া রঙিন বুলবুলি পাখি ডানায় জল ঝেড়ে নিচ্ছে, আর বনের ভিতর দিয়ে যেন কারা হেঁটে যাচ্ছে—হয়তো হরিণ, কিংবা কল্পনার কোনো প্রাণী।

আমার গাইড ছিলেন একজন স্থানীয় যুবক, নাম ইলিয়াস। সে বলল, “এই জঙ্গলে অনেক গাছ আছে, যাদের নিচে দাঁড়ালে বৃষ্টির আওয়াজ পাল্টে যায়। কেউ কাঁদে, কেউ গান গায়।” আমি চমকে তাকালাম। সে হেসে বলল, “আপনি শুনবেন না?” আমি কিছু বলিনি। একটু সামনে গিয়ে এক বিশাল শালগাছের নিচে দাঁড়ালাম। সত্যিই, বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পত্রপটে অন্যরকমভাবে পড়ছে। একটা ভারি ভারি ছন্দ, যেন বনের মন খারাপ।

এগিয়ে যেতে যেতে আমরা পৌঁছালাম এক ছোট্ট ঝিরিপথে। বর্ষায় সেখানে জল বেড়ে গেছে, নুড়ি-পাথর ঢাকা পড়ে গিয়েছে, আর পানি এত স্বচ্ছ যে নিজের ছায়াও দেখা যায়। ইলিয়াস বলল, “এই পথে একবার একজন কবি হেঁটে গিয়েছিলেন, তারপর একটা বই লিখেছিলেন—‘বৃষ্টির বনের দিনলিপি’।” আমি বুঝলাম, এই বন শুধু গাছের ঠাসাঠাসি নয়—এ এক জীবন্ত ডায়েরি।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে হল, বনটার ভেতর থেকে কেউ আমাকে দেখছে। হয়তো কোনো বুনো শিয়াল, কিংবা কোনো অলক্ষ্য প্রাচীন আত্মা। এই সাতছড়ির বর্ষা যেন শুধু প্রকৃতির খেলা নয়—এটা কোনো পুরনো সময়ের চিঠি, যা আজ খুলে পড়ছি।

দুপুরের দিকে হালকা রোদ উঠল। গাছের পাতায় জল ঝিকিমিকি করছে। একটা চৌকি-ঘেরা স্পট পাওয়া গেল, বসে বিশ্রাম নিলাম। পাশে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বৃষ্টিতে ভিজে বসে আছে, তারা কথা বলছে না, কেবল চেয়ে আছে জঙ্গলের দিকে। হয়তো প্রকৃতি এখানে তাদের কথা নিজের মতন করে বলে দিচ্ছে।

ফিরতি পথে এক পুরনো গাছের গুঁড়িতে দেখি, খোদাই করা লেখা—“১৯৮৪, জুন। আমি এলাম, আমি হারালাম।” কে লিখেছিল? কেন? কে জানে। তবে এই বর্ষা সেই লেখাটাকেও নতুন করে ভেজায়, যেন সেই মানুষটা আবার ফিরে আসে। হয়তো আমি নিজেই সেই মানুষ—এক নতুন জন্মে।

সাতছড়ি ছাড়ার সময় বনের কিনারে দাঁড়িয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। একটা ঝিরি পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে, দূরে পাখির ডাক, আর মাথার ওপর দিয়ে মেঘ সরে গিয়ে বৃষ্টির পর সূর্য একবার হেসে উঠছে। আমি জানি, এই অনুভূতির জন্যই তো বেরিয়ে পড়া, এই বর্ষার ভ্রমণই তো আসল।

পর্ব : রাঙামাটিজলের পাহাড়, রঙিন নৌকা আর মেঘে ঢাকা পাহাড়পথ

রাঙামাটি বর্ষায় যেন নিজের শ্বাস আটকে রাখে। এখানকার পাহাড়, হ্রদ আর আকাশ মিলেমিশে এমন এক ছায়াপথ গড়ে তোলে, যেখানে সময় হেঁটে চলে ধীরে ধীরে। আমি যখন রাঙামাটি পৌঁছালাম, তখন সকালে কুয়াশা আর হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি, চারদিকে কেবল জলরঙের ছোঁয়া। শহরের রাস্তাগুলো ভিজে চকচক করছে, আর পাশে কর্ণফুলী নদীর কোলঘেঁষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রঙিন নৌকা, যেন জলেই বোনা কোনো স্বপ্নের ফ্রেম।

প্রথমেই গেলাম রাঙামাটি লেকের পাড়ে। সেই বিশাল কাপ্তাই হ্রদ, বর্ষায় আরও প্রসারিত, আরও গভীর। জলতলে পাহাড়ের ছায়া এমনভাবে পড়ে যে বোঝাই যায় না, কোনটা জল, আর কোনটা পাথর। নৌকায় ওঠার সময় মাঝি হালিম ভাই বললেন, “ভাই, বর্ষায় লেক কাঁদে আর হাসেও। আপনি শুধু চুপ করে শুনেন।” আমি মাথা নাড়িয়ে সাদা-পলিথিন ঢাকা নৌকায় উঠে পড়লাম। চারপাশে শুধু সবুজ আর ধূসর জলের তলদেশে হারিয়ে যাওয়া গাছপালা।

নৌকা চলতে চলতে পাহাড়ের গায়ে জলের ছিটে পড়ে একটা অদ্ভুত ছায়া তৈরি করছিল। দূরে ছোট ছোট দ্বীপ, পাড়ে বাঁশের ঘর, আর মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি শিশুদের, যারা ভেজা মাঠে খেলা করছে। একদল শিশু দাঁড়িয়ে ছিল কাঠের ব্রিজের নিচে, বৃষ্টির মাঝে স্লিপ করে হেসে উঠল, তাদের সেই হাসির শব্দ জল-বাতাসে মিশে গিয়ে পৌঁছে গেল আমার বুকের ভিতর।

একটা জায়গায় নৌকা থামিয়ে আমি উঠলাম চাঁদার পাশে একটা পাহাড়ি বাজারে। ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে গন্ধ পেলাম—জলেভেজা বাঁশপাতা, নানান ফল, পাহাড়ি রান্নার ধোঁয়া আর ঘর থেকে ভেসে আসা গান। এক দোকানে ঢুকে খেলাম ভাপা পিঠা আর কফি। দোকানদার বলল, “আপনি কি লেখক? আপনার চোখে বৃষ্টির ভাষা আছে।” আমি হেসে বললাম, “আমি শুধু শুনতে এসেছি।”

তারপর গেলাম শুভলং ঝরনায়। বর্ষায় সেই ঝরনার ধারা যেন খোলামেলা কান্না—একধরনের স্রোত যেখানে পাহাড় নিজেকে ঢেলে দেয়। বর্ষায় ঝরনার নিচে দাঁড়ানো মানে একধরনের শুদ্ধি। জল শরীরে পড়ছিল, অথচ মনে হচ্ছিল মনের ভেতরটাই ধুয়ে যাচ্ছে। পাশে এক পাহাড়ি কিশোরী বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে গাইছিল কোনো আদিবাসী গান, যার কথা আমি না বুঝলেও সুরটা যেন বুকে রয়ে গেল।

ফেরার পথে নৌকা আবার চলছিল হ্রদের বুক চিরে। আকাশে তখন গাঢ় মেঘ, মাঝে মাঝে বিজলির ঝলকানি। কর্ণফুলীর বুকে সেই আলো পড়ে জলের ঢেউয়ে লেগে উঠছিল রূপালী। মাঝি বলল, “ভাই, এখানে অনেক বেদনার গল্প আছে, কিন্তু বর্ষায় সব গল্প রূপক হয়ে যায়।” আমি ভাবছিলাম, সত্যিই তো—এই জল, এই পাহাড়, এই বৃষ্টি—সব মিলে যে ভাষা তৈরি হয়, তা বুঝতে গেলে নিজের ভেতরের নীরবতাকে শুনতে হয়।

সন্ধ্যায় শহরে ফিরে দেখি রাঙামাটি কেমন ধীর, আরামে জ্বলছে। হ্রদের ধারে বসে এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে ভাবছিলাম—এই শহরে বর্ষা শুধু জল নয়, একধরনের গানের মত। নির্জনতার, অভিমানীর, আর ভেসে যাওয়া কিছু অসমাপ্ত কথার।

পর্ব : ময়মনসিংহবৃষ্টির ছায়া, ব্রহ্মপুত্রের তীর আর শিল্পকলার শহর

ময়মনসিংহ বর্ষায় যেন নিজের শহুরে রূপ ছেড়ে এক কবিতায় রূপ নেয়। আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন চারপাশে ছড়িয়ে ছিল মেঘলা বাতাস, রাস্তার পাশে পলিথিনে ঢাকা ফুটপাতের বইয়ের দোকান, আর ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা এক ধরনের নীরব গান। শহরের মুখে তখন বৃষ্টির জল জমে ছোট ছোট আয়না তৈরি করছে, যেখানে আকাশ নিজের মুখ দেখছে বলে মনে হয়।

প্রথমেই গেলাম ব্রহ্মপুত্র পাড়ে। নদী বর্ষায় যেন আরও প্রশস্ত, আরও উদার। তীর ঘেঁষে বসে থাকা মানুষদের মুখে একধরনের তৃপ্তি, যেন বর্ষা তাদের সাথে পরিচিত। আমি পাথরের ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছি, মাথার ওপর ছাতা নেই। বৃষ্টি পড়ছে একটানা, হালকা, ধীর। আমার পাশে এক বয়স্ক লোক বসে মাছ ধরছিল। সে বলল, “এই নদী কাঁদতেও জানে, হাসতেও জানে। কিন্তু বর্ষায় সে শুধুই বলে—চুপ করে থাকো।”

তার কথার মাঝেই হঠাৎ একটা বড় ঢেউ এসে আমার পায়ের নিচে জল ছিটিয়ে দিল। সেই ঠাণ্ডা ছোঁয়া শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল, মনে হল আমি যেন নদীরই কেউ হয়ে গেছি। পাড়ের গাছগুলো মাথা নুইয়ে তাকিয়ে আছে জলে, আর আমি সেই গাছদের চোখ দিয়ে দেখছি—নদীর মনখারাপ।

তারপর আমি গেলাম ময়মনসিংহ শিল্পকলা একাডেমিতে। বর্ষায় সংস্কৃতির যে একটা আলাদা রূপ হয়, সেটা এখানে এসে টের পাওয়া যায়। ভেতরে তখন একদল তরুণ নাটকের মহড়া দিচ্ছিল। ছাদে বৃষ্টির টপটপ আওয়াজ, আর মঞ্চে তারা বলছে, “তুমি ফিরে এসো বর্ষায়, আমার নাম ভেজাতে।” আমি চুপ করে বসে দেখছিলাম। শিল্প আর বৃষ্টি—এ যেন প্রেমিক ও প্রেমিকার মতো, কখনও কাছাকাছি, কখনও দূরে।

একটা ছোট্ট ছেলেকে দেখি জল জমা রাস্তায় কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নৌকাটা কোথায় যাবে?” সে বলল, “ঢাকা যাবে। বড় হয়ে আমি সেখানে পড়তে যাব।” আমি হেসে বললাম, “সে তো অনেক দূর।” ছেলেটি বলল, “বর্ষার নদী জানে রাস্তা।” এমন সরল উত্তর যে এত গভীর হতে পারে, তা আমি ভাবিনি।

বিকেলে গেলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরতে। সবুজ ঘাসে জমে থাকা বৃষ্টির জল, হাঁটু ভেজা পথ, আর সাইকেলে ছাতা মাথায় ছুটে চলা ছাত্র-ছাত্রীদের দৃশ্য—সবকিছু যেন ফ্রেমবন্দি কোনো চলচিত্রের মতো। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দূরে একটা তালগাছ ঝুঁকে আছে, তার গায়ে কয়েকটি পাখি বসে আছে, একটাও শব্দ করছে না। শুধু বৃষ্টি পড়ছে, এবং প্রকৃতি চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।

রাতে শহরের এক রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম খিচুড়ি খেতে। বর্ষাকালের খিচুড়ি, গরম বেগুনভাজা আর ধোঁয়া ওঠা মুড়ির সাথে যে সুখ, তা শহরের কোলাহলে পাওয়া যায় না। রেস্টুরেন্টের এক বয়স্ক লোক হাসতে হাসতে বললেন, “এই শহরে বর্ষা আসে প্রেমের মতো—আকাশ কালো করে, মন ভিজিয়ে রেখে যায়।”

রাতে হোটেলে ফেরার সময় মনে হচ্ছিল, এই শহর আমাকে কিছু দিয়ে দিল। নদীর ঢেউ, নাটকের সংলাপ, কাগজের নৌকা আর এক বৃষ্টিভেজা ব্রহ্মপুত্র—সব মিলিয়ে ময়মনসিংহের বর্ষা যেন একটা স্নিগ্ধ প্রার্থনা, যেখানে আমি শুধু শ্রোতা।

পর্ব ১০: টাঙ্গাইলমুগ্ধ মেঘনা, জামদানি গ্রাম আর বিদায়ের কুয়াশা

টাঙ্গাইলের নাম শুনলেই অনেকের মনে আসে শাড়ির কথা। জামদানি, খাদি, টাঙ্গাইল কাতান। কিন্তু বর্ষায় এই জেলা যেন নিজের শিল্পের বাইরে এসে এক অন্য রঙের জলরঙে রাঙিয়ে দেয় চারপাশ। আমি যখন টাঙ্গাইলে পৌঁছালাম, তখন আকাশ মেঘে ঢাকা, চারপাশে ধানক্ষেতের পাশে জমে থাকা পানি, আর মাঝে মাঝে কিছু হাঁসের ঝাঁক জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট কাঁচা রাস্তায় জল থৈ থৈ, আর মানুষজন ভিজে গায়ে গামছা জড়িয়ে ব্যস্ত কাজে।

আমার গন্তব্য ছিল পতিপাড়া গ্রাম—যেখানে এখনও জামদানি বোনা হয় হাতে। বর্ষায় সেই গ্রামে ঢোকার রাস্তা যেন গল্পের মতো—একটা বাঁশের সাঁকো, পাড়ে কলাগাছ, আর ছেলেরা খালি পায়ে কাদায় হেঁটে যাচ্ছে। গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই মনে হল, সময় থেমে গেছে। দাওয়ায় বসে একজন বৃদ্ধ তাঁতি খুট খুট করে তাঁত চালাচ্ছেন, আর তার গায়ে ভিজে থাকা সাদা পাঞ্জাবি।

আমি তার পাশে গিয়ে বসতেই তিনি বললেন, “বাবা, বর্ষায় কাপড়ের আঁচলও অন্যরকম হয়। এই ঋতুতে রঙ গাঢ় হয়, প্যাটার্ন ধীরে চলে, যেন মেঘের মত।” আমি তাঁর হাতে বোনা একটা কাঁচা কাপড় ছুঁয়ে দেখলাম—ভেজা, নরম, আর মনের মত। সেই মুহূর্তে মনে হল, শিল্প শুধু হাত নয়, মন দিয়েই হয়, আর বর্ষা সেই মনটাকেই নরম করে দেয়।

গ্রামের পাশেই ছিল এক মেঘলা বিল। বর্ষায় সেটি একেবারে নদীর মতো রূপ নেয়। আমি নৌকা ভাড়া করে একটু ভেতরে গেলাম। পাশ দিয়ে চাষিরা বোরো ধান লাগাচ্ছে, দূরে কুঁড়েঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে, আর আকাশে একপাল সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। মাঝি বলল, “এই বিল আমাদের মা। বর্ষায় সে আমাদের বুকের মত হয়ে যায়।” তার কথায় একটা গভীর স্নেহ ছিল, যা আমি শহরের কোনো বাণীতে পাইনি।

নৌকা থেকে নেমে একটু হাঁটতেই গেলাম এক স্থানীয় হাটে। সেখানে বর্ষার দিনে হাট বসে না ঠিক, কিন্তু কয়েকটা দোকান খোলা থাকে। এক দোকানে পেলাম হাটের খই, গুড়, আর গরম ভাপা পিঠা। দোকানি বললেন, “ভাই, বৃষ্টির দিনে খাই বেশি, কারণ মন খালি হয়ে যায়।” আমি চুপ করে শুধু পিঠার মধ্যে মেশানো গুড়ের গন্ধ টেনে নিলাম—সেই গন্ধে ছিল ঠাকুরমার ঘর, কিশোর বেলার স্কুল ছুটি আর ভেজা বইয়ের পাতা।

বিকেলে আমি গেলাম টাঙ্গাইল শহরের বাইরের একটা ছোট মন্দিরের দিকে। সেই মন্দির বর্ষায় প্রায় পরিত্যক্ত থাকে, কারণ রাস্তা ডুবে যায়। তবু আমি গেলাম, হাঁটু জলে ভিজে পৌঁছালাম মন্দিরের বারান্দায়। সেখানে বসে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করলাম। বৃষ্টির শব্দে একটানা ছন্দ, দূরের শঙ্খ বাজছে, আর আমি যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি—নিজের ভেতরের কোনো পুরনো অন্ধকার ঘর খুলে দিচ্ছি।

সন্ধ্যায় শহরে ফিরে দেখি টাঙ্গাইল একটু অন্যরকম। রাস্তার ধারে ভেজা জামা শুকোচ্ছে, টিনের চালের নিচে গরম চায়ের গন্ধ, আর দোকানে বাজছে পুরনো রবীন্দ্রসংগীত। শেষ বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পিচঢালা রাস্তায় পড়ে বৃত্ত তৈরি করছে, যেন সময়ের ভেতর ছোট ছোট চিঠি লেখা হচ্ছে।

রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে থাকলাম একা। বর্ষা তখন বিদায়ের মুখে। হালকা বাতাস বইছে, আর মনে হচ্ছে—এই দশ পর্বের যাত্রা আমার ভিতরের অনেক জানালা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের বর্ষা শুধুই প্রকৃতি নয়, এটা একেকটা জেলার গল্প, মানুষের মুখ, ভেজা কাঁধ আর দৃষ্টি।

আমার ব্যাগে জমেছে কাদা মাখা চটি, গায়ে লেগে আছে নদীর জল, আর চোখে জমে আছে বৃষ্টির ঘ্রাণ। আমি ফিরছি ঠিকই, কিন্তু কিছু একটাকে সঙ্গে নিয়ে—যা কেবল অনুভবেই বেঁচে থাকে।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-06-29-at-9.25.38-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *