সুদীপ্ত দাস
আরিয়ান আর নন্দিতা দু’জনের বাড়ি একই মহল্লায়। জন্ম থেকে একই পরিবেশে বড় হওয়া, দু’জনের পরিবারও অনেকটা কাছাকাছি। মহল্লার সরু গলিতে প্রতিদিন বিকেলে খেলাধুলার আসর বসত—লাঠি খেলা, লুকোচুরি, বা ক্রিকেটের ম্যাচ। সেই মাঠে সবসময় একসঙ্গে দেখা যেত আরিয়ান আর নন্দিতাকে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরও তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যায়। প্রথম দিন যখন স্কুলে ক্লাস টিচার তাদের একই বেঞ্চে বসিয়ে দেন, তখন থেকেই যেন অদ্ভুত এক সখ্য তৈরি হয়। ছুটির টিফিনে নন্দিতার মা যে আলুভাজা দিয়ে পাঠাতেন, আরিয়ানের হাতে সেটা না দিলে নন্দিতার খাওয়া শেষ হতো না। আরিয়ানও টিফিনের ডিমটা ভেঙে নন্দিতাকে দিত—তাদের ছোট ছোট ভাগাভাগির ভেতরেই জন্ম নেয় গভীর বন্ধুত্ব। ক্লাসের বাইরে অন্যরা যখন প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, তারা দু’জন মিলে প্রতিদিন নতুন খেলা বানিয়ে মজা করত। কখনো প্রতিযোগিতায় কে বেশি বানান জানে, কখনো কে দ্রুত আঁকতে পারে, আবার কখনো কে বেশি কাগজের নৌকা ভাসাতে পারে। প্রতিদিনের এই ছোট ছোট মুহূর্তই তাদের দু’জনকে একে অপরের কাছে অপরিহার্য করে তোলে।
কিন্তু শৈশবের গল্প শুধু খেলার নয়, আবিষ্কারেরও। ক্লাসের পড়াশোনায় একসঙ্গে বসে নতুন কিছু শেখা ছিল তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। গণিতের কঠিন অঙ্কে হিমশিম খাওয়ার সময় নন্দিতা যখন রাগে খাতা বন্ধ করে দিত, তখন আরিয়ান ধৈর্য ধরে বোঝাতো। আরিয়ান বাংলা রচনায় ভালো না হলে নন্দিতা তার খাতায় সুন্দর সুন্দর বাক্য লিখে দিত, যেন শিক্ষক মুগ্ধ হয়ে যান। ধীরে ধীরে বুঝতে না পেরেই তারা একে অপরের শক্তিতে পরিণত হয়। বন্ধুরা মজা করে বলত, “তোরা একে অপরের ছায়া।” স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে তারা প্রায়ই থেমে যেত রাস্তার ধারে থাকা পুরনো বটগাছটার নিচে। সেখানে বসে দু’জনে কাগজে আঁকিবুকি করত, একে অপরকে গল্প শোনাত, কিংবা কল্পনা করত ভবিষ্যৎ—কোন পেশায় যাবে, কে বড় হয়ে কী হবে। তাদের কথা বলার শেষ ছিল না। কখনো ঝগড়া হতো ছোট কারণে—নন্দিতা বলত সে গল্প লিখতে ভালো, আরিয়ান বলত সে অঙ্কে সেরা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার সব ভুলে তারা হাসিখুশি হয়ে যেত। এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো এক সময় তাদের জীবনের অপরিহার্য স্মৃতিতে রূপ নেয়।
শৈশবের এই সম্পর্ক এতটাই আন্তরিক ছিল যে, একে অপর ছাড়া তারা নিজেদের দিন কল্পনাই করতে পারত না। মহল্লার বার্ষিক অনুষ্ঠান হোক কিংবা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা—সবখানেই তারা একসঙ্গে অংশ নিত। নাচে নন্দিতা এগিয়ে থাকলেও, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করত আরিয়ান, আর নন্দিতা সামনের সারিতে হাততালি দিত। দু’জনের পরিবারও এই সম্পর্ককে উৎসাহ দিত; প্রতিবেশীরা প্রায়ই বলত, “এরা একে অপরের জন্যই জন্মেছে।” যদিও তখন কেউ প্রেম বা সম্পর্কের গভীরতা বোঝে না, কিন্তু তাদের শৈশবের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে এমন এক বন্ধনে রূপ নেয়, যা অটুট, অটল। সময়ের স্রোতে অন্য ছেলেমেয়েরা তাদের খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকলেও, আরিয়ান আর নন্দিতা নিজেদের ভেতরে আলাদা এক জগৎ গড়ে নেয়—যেখানে বন্ধুত্বের নির্ভরতা, ভাগাভাগির আনন্দ আর একে অপরের প্রতি নিঃশর্ত আস্থা ছিল সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই শৈশবই ছিল তাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি, এক অদৃশ্য মাটি, যেখানে অঙ্কুরিত হতে যাচ্ছিল একদিন নতুন এক সম্পর্ক—বন্ধুত্বের গভীর শেকড় থেকে জন্ম নিতে চলা অচেনা প্রেম।
–
স্কুলজীবনের মাঝামাঝি সময়ে আরিয়ান আর নন্দিতার বন্ধুত্ব আরও শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। তাদের সহপাঠীরা প্রায়ই অবাক হয়ে দেখত, যেকোনো কাজেই দু’জন একসঙ্গে। ক্লাসে বসা থেকে শুরু করে গ্রুপ প্রোজেক্ট, সবখানেই তারা একে অপরকে ছাড়া কিছু ভাবত না। এমনকি শিক্ষকেরাও মাঝে মাঝে মজা করে বলতেন, “তোমরা একে অপর ছাড়া বাঁচতে পারো না নাকি?” কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরে তারা দু’জনই হাসত, যেন উত্তরটা আসলে নিজেদের কাছেই স্পষ্ট—তারা একে অপরকে ছাড়া সত্যিই অসম্পূর্ণ। পড়াশোনার ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করার পাশাপাশি জীবনের ছোটখাটো সমস্যায়ও তারা সঙ্গী হয়ে যেত। নন্দিতা যখন ক্লাসে কোনো ছাত্রীদের সঙ্গে মনোমালিন্যে জড়িয়ে পড়ত, আরিয়ান তার হয়ে পাশে দাঁড়াত। আবার আরিয়ান যদি মাঠে খেলতে গিয়ে আঘাত পেত, নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেত পানির বোতল আর ফার্স্ট এইড নিয়ে। ধীরে ধীরে তাদের চারপাশের সবাই এটাই মেনে নিল যে, এ বন্ধুত্ব অন্যরকম—এ বন্ধুত্ব যেন শিকড় গেঁড়ে বসেছে তাদের প্রতিটি দিনের ভেতরে।
তাদের বন্ধুত্বের মজার দিকও ছিল অসংখ্য। টিফিনের সময় টেবিলের নিচে একে অপরের খাতা আদানপ্রদান করে কার্টুন আঁকত, আবার কখনো বানিয়ে ফেলত নতুন খেলা—যেমন, কে এক মিনিটে সবচেয়ে বেশি শব্দ লিখতে পারে কিংবা কে অঙ্কের উত্তর আগে বের করতে পারে। অনেক সময় প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত। নন্দিতা বলত, “তুমি সবসময় নিজের কথাই ঠিক মনে করো!” আরিয়ান হেসে বলত, “তুমি ভুল করলে সেটা তো আমাকে ধরতে হবে।” কিন্তু দিনের শেষে ঝগড়ার রেশ মিলিয়ে যেত, আর তারা আবার আগের মতো একসঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠত। শীতের সকালে ক্লাস শুরুর আগে তারা মাঠে বসে রোদ পোহাতো, আর গ্রীষ্মকালে পরীক্ষার পর একসঙ্গে আইসক্রিম খেতে যেত। এভাবেই প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব যেন নতুন নতুন স্মৃতি তৈরি করে রাখত।
তাদের সম্পর্ক এতটাই গভীর হয়ে ওঠে যে, বাইরের লোকেরা প্রায়ই কৌতূহল নিয়ে তাকাত। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলত, “এরা কি শুধু বন্ধু, নাকি এর চেয়ে বেশি কিছু?” কিন্তু আরিয়ান আর নন্দিতার কাছে তখন সম্পর্কের সংজ্ঞা ছিল কেবল একটাই—অটুট বন্ধুত্ব। তারা হয়তো তখনও বুঝতে পারেনি ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, কিন্তু সেই অজান্তেই তারা গড়ে তুলছিল এমন এক ভরসার জায়গা, যেটা জীবনভর কাউকে সহজে দেওয়া যায় না। ছোট ছোট দুঃখ, ব্যর্থতা কিংবা আনন্দ—সবকিছু তারা ভাগাভাগি করত। অন্যরা যেখানে বন্ধুত্বকে হালকা করে দেখত, সেখানে তারা এটাকে এক বিশেষ আশ্রয় মনে করত। ঠিক যেন দু’জন আলাদা মানুষ নয়, বরং একই ছায়ার দুটি রূপ। এই সময়েই বন্ধুত্বের বাঁধন এতটাই শক্ত হয়ে যায় যে, তা ভবিষ্যতের প্রেমের মজবুত ভিত্তি তৈরি করে ফেলে—তারা দু’জন তখনও জানত না, কিন্তু জীবন ধীরে ধীরে তাদের সেই দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
–
স্কুলের শেষ বছরটা ছিল আরিয়ান আর নন্দিতার জীবনের সবচেয়ে দ্বিধাময় সময়। এসএসসি পরীক্ষার চাপ, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, আর এক অদৃশ্য আতঙ্ক—যদি একসঙ্গে থাকার সময়টা শেষ হয়ে যায়। প্রতিদিন পড়ার টেবিলে বসলে বইয়ের অক্ষরের ভিড়ে তারা ভবিষ্যতের নানা প্রশ্নে ডুবে যেত। পরীক্ষার হলে একসঙ্গে বসতে না পারলেও বাইরে বেরিয়ে দু’জনের চোখে চোখ পড়লেই হাসি ফুটত। তবে সেই হাসির আড়ালে একটা অজানা ভয়ের ছায়া ঘুরপাক খেত। কারণ দু’জনের পরিবারই আলাদা আলাদা কলেজের পরিকল্পনা করছিল। কেউ চাইছিল নন্দিতা বিজ্ঞান নিয়ে ভালো কলেজে যাক, আবার কেউ বলছিল আরিয়ান যেন বাণিজ্য নিয়ে অন্য শহরে ভর্তি হয়। প্রতিদিন এই সব আলোচনা দু’জনের কানে আসত, আর তারা বুঝত—স্কুলজীবনের একসাথে থাকার নিশ্চয়তা হয়তো এখানেই শেষ। কিন্তু তাদের মন কিছুতেই এই বিচ্ছেদ মানতে চাইত না। বিকেলের পড়ার ফাঁকে বটগাছের নিচে বসে তারা দীর্ঘ সময় নীরবে কাটাত, যেন একে অপরের চোখে চোখ রাখলেই সব ভয় মুছে যাবে। তবুও ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি গড়ে উঠছিল, যা দু’জনের কারোরই প্রকাশ করার সাহস ছিল না।
এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলো কেটে গেলে সামনে এলো কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি। চারদিকে ব্যস্ততা—কে কোন কলেজে আবেদন করবে, কে কোথায় ভর্তি হবে। বন্ধুরা সবাই স্বপ্ন আঁকতে শুরু করেছে, কেউ চিকিৎসক হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা ব্যাংকার। কিন্তু আরিয়ান আর নন্দিতার কাছে স্বপ্নের রং ম্লান হয়ে যাচ্ছিল, কারণ তাদের একসঙ্গে থাকার নিশ্চয়তা ছিল না। নন্দিতার মা প্রায়ই বলতেন, “মেয়েকে ঢাকায় বড় কলেজে ভর্তি করতে হবে।” আরিয়ানের বাবা চাইতেন ছেলে যেন শহরের সেরা বাণিজ্য কলেজে যায়। এদিকে দু’জনেই বুঝতে পারছিল, হয়তো জীবন তাদের আলাদা পথে টেনে নিয়ে যাবে। পরীক্ষার পরের ছুটির এক বিকেলে তারা আবার দেখা করল। মেঘলা আকাশের নিচে নীরবে বসে নন্দিতা হঠাৎ বলে উঠল, “যদি আমরা আলাদা হয়ে যাই?” আরিয়ান একটু থেমে উত্তর দিল, “বন্ধুত্ব কি কখনো আলাদা হয়?” নন্দিতা চুপ করে রইল, কিন্তু চোখের ভেতর ভাসমান অশ্রু লুকোতে পারল না। সেই মুহূর্তে তারা দু’জনই বুঝল—এটা শুধু বন্ধুত্ব নয়, এর ভেতরে একটা টান আছে যা বিচ্ছেদ মানতে চায় না।
সৌভাগ্যক্রমে কয়েক সপ্তাহ পর খবর এলো—দু’জনেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফর্ম একই জায়গায় গৃহীত হয়েছে। যেন অলৌকিকভাবে তারা আবারও একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেল। আনন্দে তারা ছুটে গিয়ে একে অপরকে জানাল খবরটা। তাদের চোখে তখন ঝলমলে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ছিল এক অদ্ভুত স্বস্তি। তারা দু’জনই মনে মনে শপথ করল—জীবন যেদিকে নিয়ে যাক না কেন, তারা একে অপরকে ছাড়বে না। বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে এই পুনর্মিলনের খবর যেন তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে দিল। সেই মুহূর্তে হয়তো তারা এখনো প্রেমের নাম উচ্চারণ করেনি, কিন্তু বন্ধুত্বের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি—কোনো দূরত্ব, কোনো বিচ্ছেদই তাদের আলাদা করতে পারবে না। আর এই প্রতিশ্রুতিই হয়ে উঠল তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নতুন অধ্যায়ের ভিত্তি।
–
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দিনটা ছিল আরিয়ান আর নন্দিতার জীবনের একেবারে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। স্কুল আর কলেজের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে এখন তারা বিশাল এক জগতে প্রবেশ করল—যেখানে নতুন নতুন মুখ, ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন আর নানান ধরণের প্রতিযোগিতা। ক্যাম্পাসের প্রথম দিনেই তাদের চোখে ধরা দিল অপরিসীম ভিড়, সবুজে ঘেরা মাঠ, বিশাল লাইব্রেরি আর প্রাণবন্ত আড্ডার জায়গাগুলো। নন্দিতা উচ্ছ্বাসে চারপাশ দেখছিল, আরিয়ান একটু নিরবচাপ হয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। তবে নতুন পরিবেশের ভিড়ে তারা দু’জনেই দ্রুত বুঝে গেল, পুরনো পরিচিতির ছায়া ছাড়া এগোনো কঠিন। তাই ক্লাস শুরু হতেই তারা আবার একসঙ্গে বসতে শুরু করল, আগের মতোই নোট ভাগাভাগি করে পড়তে লাগল। কিন্তু ধীরে ধীরে আরিয়ান লক্ষ্য করল, নন্দিতা নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, হাসছে, কখনো কখনো গ্রুপ প্রোজেক্টে অন্যদের সঙ্গে কাজ করছে। এসব দেখে আরিয়ান এক অচেনা অনুভূতির মধ্যে পড়ল—যেটাকে সে প্রথমে ব্যাখ্যা করতে পারল না। মনে হচ্ছিল, যেন কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
দিন যত এগোতে লাগল, নন্দিতার নতুন বন্ধুদের সংখ্যা তত বাড়ল। ক্লাস শেষে একসঙ্গে ক্যান্টিনে যাওয়া, লাইব্রেরিতে পড়তে বসা কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া—নন্দিতার চারপাশে সবসময় অনেক মানুষ থাকত। আরিয়ানও পাশে থাকত, কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা জন্ম নিতে লাগল। আগে যেটা ছিল শুধু বন্ধুত্ব, এখন সেটা যেন অন্য রকম কিছু হয়ে উঠছে। নন্দিতাকে যখন অন্য ছেলেরা মজা করে কথা বলত বা তাকে কোনো প্রশ্নে সাহায্য করত, তখন আরিয়ান অস্বস্তি বোধ করত। প্রথমে সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল—এটা স্রেফ অভ্যাসের পরিবর্তন, বন্ধুত্বের জায়গায় অন্য কাউকে দেখার অক্ষমতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝল, এটা আসলে অন্য কিছু। নন্দিতার হাসি এখন তাকে ভিন্নভাবে আলোড়িত করে, তার একটুখানি মনোযোগ পেলে আরিয়ান সারাদিন আনন্দে ভরে যায়। অথচ নন্দিতা তখনও নির্ভারভাবে সবকিছু সামলাচ্ছিল, কারণ তার কাছে আরিয়ান এখনো সেই একই শৈশবের সেরা বন্ধু।
এদিকে নন্দিতা ধীরে ধীরে লক্ষ্য করতে শুরু করল, আরিয়ান মাঝে মাঝে অকারণে চুপচাপ হয়ে যায়। আগে যেখানে ওর সঙ্গে অবিরাম গল্প করত, এখন কখনো কখনো অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। একদিন ক্লাস শেষে নন্দিতা হেসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এত চুপচাপ কেন? আগের মতো হাসছ না।” আরিয়ান হেসে এড়িয়ে গেল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার বুকের ভেতর তখন এক নতুন অনুভূতির ঝড় বইছে। সে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে—এটা আর কেবল বন্ধুত্ব নয়। নন্দিতাকে হারানোর ভয়ে, কিংবা তাকে অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করার অক্ষমতায় তার মন এক অদৃশ্য প্রেমের জন্ম দিচ্ছে। সে চায়, নন্দিতা যেন শুধু তার কাছেই থাকে, তার হাসি যেন কেবল তার জন্যই ঝরে পড়ে। অথচ মুখে সে এখনো কিছু বলতে পারছে না, কারণ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ভাঙতে সে ভয় পাচ্ছে। অন্যদিকে নন্দিতারও মনে হতে শুরু করেছিল, আরিয়ানের প্রতি তার টান অন্য রকম। কিন্তু দু’জনেই নিজেদের ভেতরের এই নতুন অনুভূতিকে প্রকাশ করতে না পেরে নীরবে আঁকড়ে ধরে রাখল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নতুন পরিবেশ তাই শুধু পড়াশোনার নয়, বরং সম্পর্কের নতুন উপলব্ধির সূচনা হয়ে উঠল—যেখানে বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে প্রেমের পথে।
–
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো যত এগোতে লাগল, আরিয়ান আর নন্দিতার মধ্যে অদৃশ্য এক টান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। প্রথমদিকে আরিয়ান ভেবেছিল, এটা হয়তো অভ্যাসের কারণে—নন্দিতাকে ছাড়া দিন কাটাতে না পারার স্বাভাবিক অনুভূতি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক ভিন্ন রকম আকাঙ্ক্ষা। নন্দিতার হাসি এখন আর শুধু বন্ধুর হাসি মনে হয় না, সেটা যেন বুকের গভীরে অদ্ভুত কাঁপন তোলে। নন্দিতার চোখে চোখ পড়লে বুকের ভেতর অজানা উত্তেজনা জমে ওঠে। এমনকি ক্লাসে অন্যদের সঙ্গে নন্দিতার হাসাহাসি দেখতে পেলেও তার ভেতর ঈর্ষার ঝড় বয়ে যায়। আগে যেখানে নন্দিতাকে বোঝানো সহজ ছিল, এখন তাকে নিয়ে নিজের মনের কথা বোঝানোই আরিয়ানের কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সে ভয় পাচ্ছিল, যদি এ কথা প্রকাশ পায় তবে বন্ধুত্বের ভিত্তি ভেঙে যেতে পারে। অথচ যতই চাপা দিতে চাইছিল, ততই অনুভূতিগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছিল।
অন্যদিকে নন্দিতার অবস্থাও ভিন্ন ছিল না। সে হয়তো সরাসরি বোঝেনি, কিন্তু প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনাই তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। একদিন পরীক্ষার আগের রাতে নন্দিতা পড়তে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। কিছু সূত্র বুঝতে না পেরে ফোন করে বসে আরিয়ানকে। আরিয়ান তখনো নিজে পড়ছিল, তবু সব ছেড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নন্দিতাকে বোঝাল। পড়া শেষ হওয়ার পর নন্দিতা নীরবে বলেছিল, “তুমি না থাকলে আমি পারতাম না।” কথাটা বলেই সে অবাক হয়ে গিয়েছিল, কারণ নিজের অজান্তেই যেন বুকের ভেতরের গভীর সত্যিটা ফসকে বেরিয়ে গেছে। সেই রাতে নন্দিতা প্রথমবার উপলব্ধি করল, আরিয়ান তার কাছে শুধু বন্ধু নয়। সে আরিয়ানের ওপর নির্ভর করে, তার পাশে থাকলে অন্য রকম শান্তি পায়, তার কথা শুনলে মন হালকা হয়ে যায়। এগুলো কি কেবল বন্ধুত্বের চিহ্ন, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে অন্য কিছু? প্রশ্নটা তাকে ঘুমাতে দেয়নি সেদিন।
তবে তারা কেউই তখনও সরাসরি কিছু বলেনি। প্রতিদিনের মতো দেখা করা, ক্লাসে পাশাপাশি বসা, একসঙ্গে লাইব্রেরিতে পড়া—সবকিছু চলতে থাকল আগের মতো। কিন্তু তাদের ভেতরের অনুভূতি বদলে যাচ্ছিল। নন্দিতা লক্ষ্য করত, হঠাৎ করে আরিয়ান চুপচাপ হয়ে যায়, আবার কিছুক্ষণ পর ছোট কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন দেখায়। আরিয়ানও টের পেত, নন্দিতার চোখে চোখ পড়লে সে দ্রুত অন্য দিকে তাকিয়ে নেয়, যেন ভেতরের লুকোনো কথা চোখে ধরা পড়ে যাবে। এই অস্থিরতা, এই দ্বিধা তাদের দু’জনকে ভেতরে ভেতরে আরও কাছাকাছি টেনে আনছিল। তারা দু’জনেই বুঝছিল, এটা আর শুধু বন্ধুত্ব নয়—এমন এক হৃদয়ের টান, যা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তবুও মুখে কিছু বলতে না পারার যন্ত্রণা তাদের দিনগুলোকে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর অস্থিরতায় ভরে তুলছিল, যেন প্রতিটি মুহূর্তে প্রেমের অচেনা বাতাস ধীরে ধীরে তাদের চারপাশ ঘিরে ফেলছে।
–
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যাচ্ছিল, আরিয়ান আর নন্দিতার সম্পর্কের ভেতরে সেই অদৃশ্য পরিবর্তন ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। তারা দু’জনেই বোঝার চেষ্টা করছিল, ঠিক কী ঘটছে তাদের ভেতরে, কিন্তু কাউকেই কিছু বলার সাহস হচ্ছিল না। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে পাশাপাশি হাঁটার সময়, ক্যান্টিনে বসে এক কাপ চা ভাগাভাগি করার সময় কিংবা লাইব্রেরির নীরবতায় একসঙ্গে পড়ার মুহূর্তগুলো যেন নতুন এক অর্থ তৈরি করছিল। তাদের চোখে চোখ পড়লেই বোঝা যেত, ভেতরে কিছু আছে যা অপ্রকাশিত থেকেও প্রবলভাবে উপস্থিত। আগে যেখানে তারা নির্দ্বিধায় সব কথা বলত, এখন সেখানে নীরবতার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিল। ছোট ছোট বিরতি, চোরাচোখে তাকানো, অকারণ হাসি—এসবই হয়ে উঠছিল একধরনের নীরব স্বীকারোক্তি। বন্ধুদের কাছে হয়তো তারা আগের মতোই দু’জন সেরা বন্ধু, কিন্তু তারা নিজেরাই জানত, সম্পর্কটা বদলে যাচ্ছে।
একদিন বিকেলে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে তারা পড়াশোনা করছিল। চারপাশে হইচই, হাসির শব্দ, কিন্তু তাদের মধ্যে নেমে এসেছিল অদ্ভুত এক নীরবতা। হঠাৎ নন্দিতা মাথা তুলে তাকাল আরিয়ানের দিকে। আরিয়ানও তাকিয়ে ছিল ওর চোখের দিকে, আর সেই মুহূর্তে সময় যেন থমকে গেল। কেউ কিছু বলল না, কিন্তু চোখের ভাষায় বোঝা গেল, দু’জনের মনেই একই কথা ঘুরছে। নন্দিতা দ্রুত চোখ নামিয়ে বইয়ের পাতায় মন দিল, আর আরিয়ান বুকের ভেতরের অস্থিরতা লুকিয়ে আবার পড়া শুরু করল। সেদিন দু’জনের কেউ মুখ খোলেনি, তবুও মনে হয়েছিল যেন কোনো স্বীকারোক্তি হয়ে গেছে—কথায় নয়, দৃষ্টির ভেতর দিয়ে। এভাবেই দিনের পর দিন, তাদের দৃষ্টির ভেতর জমতে লাগল এমন সব গোপন বার্তা, যা ভাষায় প্রকাশ করার সাহস তাদের ছিল না।
তাদের এই নীরবতার ভেতরে একধরনের উত্তেজনা জমে উঠছিল। তারা কেউই সাহস পাচ্ছিল না সরাসরি বলার, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একে অপরের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে উঠছিল। নন্দিতা হয়তো কোনো কারণে দেরি করে এলে আরিয়ান অস্থির হয়ে পড়ত, আবার আরিয়ান কোনো সমস্যায় পড়লে নন্দিতা সব কাজ ফেলে পাশে দাঁড়াত। বাইরের মানুষ এসবকেই স্রেফ বন্ধুত্বের প্রকাশ ভাবত, কিন্তু তারা জানত, এর ভেতরে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। তাদের সম্পর্কটা যেন এক অসমাপ্ত কবিতা, যেখানে প্রতিটি পঙক্তি লেখা হয়ে যাচ্ছে নীরবতায়। এই নীরব স্বীকারোক্তিই ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্বের সীমানা ভেঙে প্রেমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল—যদিও তারা তখনও বুঝতে চাইছিল না, কিংবা বুঝেও বলতে পারছিল না। তারা কেবল নীরবতার ভেতরে, চোখের ভাষায়, অস্থির নিশ্বাসে একে অপরকে জানিয়ে দিচ্ছিল—“আমরা বদলে যাচ্ছি।”
–
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। চারপাশে আলোকসজ্জা, মঞ্চে গান, নাটক আর কবিতা আবৃত্তি চলছে। নন্দিতা দায়িত্ব পেয়েছিল অনুষ্ঠান পরিচালনার কাজে, তাই সকাল থেকেই ব্যস্ত। আরিয়ান তাকে সাহায্য করছিল, যেমন সবসময় করে। তবে ব্যস্ততার মাঝেই হঠাৎ নন্দিতার শরীর খারাপ হয়ে গেল। গরমে আর দৌড়ঝাঁপে মাথা ঘুরে সে প্রায় মঞ্চের পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। চারপাশের ভিড়ের মধ্যেও আরিয়ান দৌড়ে এসে তাকে সামলে নিল। তার মুখে আতঙ্ক, হাত কাঁপছে, যেন পৃথিবীর সবকিছু থেমে গেছে। নন্দিতাকে পাশের চেয়ারটিতে বসিয়ে দিল, ঠান্ডা পানি এনে দিল, আর কপালে হাত রাখল। সেই মুহূর্তে আরিয়ানের চোখে ভয় আর ভালোবাসার মিশ্রণ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, নন্দিতা তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলো। হয়তো অসুস্থতার দুর্বলতায়, হয়তো বুকের ভেতরের অচেনা টানের কারণে, নন্দিতা অর্ধেক হাসি দিয়ে বলল, “তুমি ছাড়া আমি সত্যিই কিছু না।”
এই কথাটাই যেন আরিয়ানের বুকের ভেতরের বাঁধ ভেঙে দিল। এতদিন ধরে যা চাপা দিয়ে রেখেছিল, সেই সত্যি আর ধরে রাখতে পারল না। চারপাশে গান বাজছিল, মানুষ ব্যস্ত ছিল নিজেদের আনন্দে, কিন্তু তাদের দু’জনের ভেতরে তখন তৈরি হচ্ছিল এক নিঃশব্দ মহল। আরিয়ান ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাকে শুধু বন্ধু ভাবতে পারি না, নন্দিতা। জানি না কখন, কিভাবে হলো… কিন্তু তুমি আমার কাছে কেবল বন্ধু নও। তুমি আমার সবকিছু।” কথাগুলো বলে সে থেমে গেল, যেন ভয়ে আছে—এই স্বীকারোক্তি হয়তো সবকিছু ভেঙে দেবে। নন্দিতা এক মুহূর্ত নীরব থাকল, তার বুকের ভেতর ঢেউ খেলল। এতদিন যে অনুভূতি সে এড়িয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে তা মুখোমুখি হয়ে গেল।
নন্দিতা ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল, ঠোঁটে ফুটল এক লাজুক হাসি। তার চোখে জল চিকচিক করছিল, অথচ সেই জল দুঃখের নয়—এটা ছিল স্বস্তি আর আনন্দের। সে ফিসফিস করে বলল, “আমিও।” এই দুটি শব্দের মধ্যেই যেন তাদের সমস্ত নীরবতার পরিসমাপ্তি ঘটল। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অনুভূতি, চোখের ভাষায় লুকিয়ে থাকা বার্তা, অস্থির নিশ্বাস—সবকিছুর শেষ হলো সেই মুহূর্তে। তারা দু’জনই বুঝল, তাদের সম্পর্কটা অনেক আগে থেকেই প্রেমে রূপ নিয়েছিল, শুধু মুখে উচ্চারণ হয়নি। সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, আলো আর সংগীতের ভিড়ে, তারা দু’জন প্রথমবারের মতো খোলাখুলি স্বীকার করল নিজেদের অনুভূতি। বন্ধুত্বের গভীর শেকড় থেকে জন্ম নেওয়া সেই প্রেম এখন বাস্তব, স্পষ্ট, আর চিরস্থায়ী হয়ে উঠল।
–
সেই রাতের পর আরিয়ান আর নন্দিতার জীবনে নতুন সূচনা হলো। একে অপরকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর তাদের চোখে চোখ রাখার ভঙ্গি বদলে গেল, কথা বলার সুরে এল অদ্ভুত কোমলতা। আগে যেখানে বন্ধুত্বের সহজ স্বাভাবিকতা ছিল, এখন সেখানে যুক্ত হলো হৃদয়ের গভীর অনুভূতি। ক্লাসে একসঙ্গে বসা, লাইব্রেরিতে পাশাপাশি পড়া, কিংবা ক্যান্টিনে চা খাওয়ার সময়—সবকিছু যেন নতুন আলোয় ভরে উঠল। বন্ধুরা তাদের আগের মতোই একসঙ্গে দেখে মজা করত, কিন্তু তারা দু’জন জানত, এই সম্পর্ক এখন অন্য স্তরে পৌঁছেছে। নন্দিতা হঠাৎই মাঝে মাঝে চুপচাপ হয়ে যেত, তারপর হেসে বলত, “আমাদের কি এতদিনেই বোঝা উচিত ছিল না?” আরিয়ান হেসে উত্তর দিত, “হয়তো সময়টাই চেয়েছিল আমরা বুঝতে দেরি করি, যাতে আজকের মুহূর্তটা এত সুন্দর হয়।” এই ছোট ছোট সংলাপেই স্পষ্ট হয়ে উঠল, তারা কতটা আন্তরিকভাবে একে অপরকে আপন করে নিয়েছে।
তাদের প্রেমে বন্ধুত্বের মজবুত ভিত ছিল বলে ঝগড়া বা অভিমানও হয়ে উঠত মিষ্টি। কোনো কারণে যদি আরিয়ান রাগ করত, নন্দিতা কাগজে ছোট ছোট কার্টুন এঁকে তার হাতে দিত। আর নন্দিতা যদি অভিমান করত, আরিয়ান খাতা ভরে লিখত, “আমি দুঃখিত।” দু’জনের এই ছোট ছোট ভালোবাসার প্রকাশ তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ঋতুই যেন তাদের প্রেমের নতুন অধ্যায় হয়ে উঠল—বসন্তে একসঙ্গে গাছতলায় বসা, বর্ষায় ভিজে ক্যাম্পাসে হাঁটা, শীতে এক কাপ চায়ের উষ্ণতা ভাগাভাগি করা। বন্ধুত্ব থেকে জন্ম নেওয়া এই প্রেম এতটাই স্বচ্ছ আর আন্তরিক ছিল যে, এর ভেতরে কোনো ভান ছিল না। তারা দু’জনই জানত, একে অপর ছাড়া তাদের জীবন কল্পনা করাই অসম্ভব।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলতে শুরু করল। পড়াশোনার চাপ, ক্যারিয়ারের স্বপ্ন—সবকিছুর মাঝেই তারা শপথ নিল, যত ঝড়-ঝাপটা আসুক না কেন, তারা একে অপরের হাত ছাড়বে না। নন্দিতা বলত, “আমরা যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলাম, সেদিন যদি কেউ বলত একদিন আমরা এভাবে থাকব, আমি বিশ্বাসই করতাম না।” আরিয়ান উত্তর দিত, “তাহলে হয়তো ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের এই সুন্দর মিশেলটা আমরা অনুভব করতে পারতাম না।” তাদের চোখে তখন শুধু একটাই প্রতিশ্রুতি—যেভাবে শৈশব থেকে একসঙ্গে ছিল, সেভাবেই সারাজীবন কাটাবে। এভাবেই বন্ধুত্ব থেকে শুরু হওয়া তাদের যাত্রা প্রেমে পরিণত হলো, আর সেই প্রেম হয়ে উঠল জীবনের সবচেয়ে স্থায়ী, সবচেয়ে নিখুঁত বন্ধন।
***




