Bangla - রহস্য গল্প

বনানীর অন্ধকারে

Spread the love

অভ্রনীল দত্ত


পর্ব ১ – যাত্রা শুরু

সকালবেলা কোলাহলমুখর শিয়ালদহ স্টেশনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে যখন তারা সবাই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল, তখনও কারও মাথায় ছায়ামাত্রও ছিল না কী অপেক্ষা করছে সামনে। কলকাতার এই পাঁচজন কলেজ–বন্ধু—অনিক, সুমিত, তন্ময়, দেবলীনা আর রুদ্র—দীর্ঘদিন পর আবার মিলে একসঙ্গে কোথাও বেরোচ্ছে। গন্তব্য সুন্দরবন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য একটাই—দু–একদিন শহরের কোলাহল ভুলে প্রকৃতির নির্জন অরণ্যে কিছুটা সময় কাটানো, বাঘ দেখার ভাগ্য হলে আরও ভালো, আর সবার ওপরে একধরনের অদেখাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা।

রুদ্র, যে দলের মধ্যে সবচেয়ে উচ্ছল, আগেই পরিকল্পনা করেছিল গোটা ট্রিপ। সে বলেছিল—“এইবার তো পুজোর ভিড় নেই, একেবারে নিস্তব্ধ জঙ্গলে গিয়ে আসব। কী রোমাঞ্চ বলো তো!” বাকিরা তার কথায় সায় দিয়েছিল, যদিও দেবলীনা ভেতরে ভেতরে একটু আশঙ্কিত ছিল। শহুরে মেয়েটি প্রকৃতির মায়াজালে টান পেলেও তার ভয় ছিল জঙ্গলের অচেনা আঁধার নিয়ে।

ট্রেনে পৌঁছে তারা ক্যানিং, সেখান থেকে ভ্যানগাড়িতে ঘাটে। নদীর ধারে ঘাটে এসে দাঁড়াতেই দেখা গেল ভাটার জলে ধূসর আকাশের নীচে নৌকাগুলো কেমন উদাসীন ভেসে আছে। নদীর ওপারে কুয়াশায় ঢাকা বনভূমি দাঁড়িয়ে যেন নিঃশব্দ প্রহরীর মতো। সেই দৃশ্যেই প্রথমবার অনিকের মনে কেমন অস্বস্তি খেলে গেল।

তাদের জন্য ট্রলার ভাড়া করা ছিল। নৌকার মালিক স্থানীয় জেলে, নাম হরিদাস। সাদা ধুতি, কুঁচকে যাওয়া মুখ, কিন্তু চোখদুটো কেমন যেন তীক্ষ্ণ আর অচেনা ভয়ে ভরা। তারা সবাই নৌকায় চড়তে উদ্যত হতেই হরিদাস ফিসফিস করে বলে উঠল—
“আপনাদের যদি ঘুরতে হয়, ঘুরুন। তবে এক জিনিস মনে রাখবেন—জঙ্গলের ভেতরে রাত কাটাতে যাবেন না। নদীর ধারে থাকবেন। পূর্ণিমা আসছে… তখন বনানীর ভেতরে যা ঘটে, তার সাক্ষী হতে চাইবেন না।”

সুমিত হেসে উঠেছিল—“এইসব কুসংস্কার আমরা মানি না, কাকু। পূর্ণিমা হলে চাঁদের আলোতে আরও সুন্দর লাগবে, তাই না?”
কিন্তু হরিদাস হাসল না। সে শুধু মাথা নাড়ল, চোখ নামিয়ে নৌকো চালাতে শুরু করল।

জলপথে এগোতে এগোতে দলের ভেতরে হাসি–আনন্দ, আড্ডা চলল ঠিকই, কিন্তু দেবলীনাকে বারবার বিরক্ত করছিল বৃদ্ধের কথাগুলো। সে একসময় ফিসফিস করে অনিককে বলল—“তুই লক্ষ্য করেছিস? লোকটার চোখে কী অদ্ভুত ভয়! এ আবার কেমন কথা, পূর্ণিমার রাতে জঙ্গলে বিপদ?”
অনিক কাঁধ ঝাঁকাল—“গ্রামের লোকেরা সবসময়ই একটু অন্ধবিশ্বাসী হয়। তুই বেশি সিরিয়াস হবি না।”

কিছুক্ষণ বাদে নৌকা থামল এক ছোট্ট গ্রামে। তাদের রাতের থাকার ব্যবস্থা এখানেই, এক ভাঙাচোরা অতিথিশালায়। নৌকা থেকে নামতেই তারা খেয়াল করল গ্রামের প্রান্তে এক বৃদ্ধা বসে আছেন মাটির ওপর, হাতে বেতের ঝুড়ি। কুঞ্চিত মুখ, ম্লান চাহনি। হঠাৎই তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন—
“এই জঙ্গলে গেলে সবাই ফেরে না। সাবধানে থেকো।”

কথাটা যেন কাঁটার মতো বিঁধল সবার মনে। রুদ্র হেসে উড়িয়ে দিল—“আরে, এ তো সিনেমার ডায়লগের মতো শোনাচ্ছে!” কিন্তু বৃদ্ধার চোখদুটি তখনও অদ্ভুত ভাবে স্থির হয়ে রইল তাদের ওপর, যেন সময়ের গভীর থেকে উঠে আসা কোনো সতর্কবার্তা।

সন্ধ্যা নামতে নামতে তারা গ্রাম ছেড়ে নদীর ধারে ফিরে এল। ট্রলারের ডেকে বসে বাতাস খেতে খেতে দেবলীনা বারবার ফিরে তাকাচ্ছিল অরণ্যের অন্ধকারের দিকে। কেমন যেন শ্বাসরোধ করা নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে সেখানে। ঝিঁঝিঁর ডাক পর্যন্ত থেমে গেছে।

রাত বাড়তে থাকল। কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালিয়ে তারা গল্প শুরু করল, মজা–আড্ডা, তাস খেলা। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নদীর ওপার থেকে ভেসে আসছিল অদ্ভুত এক আওয়াজ—কোনও বাঁশির মতো, আবার যেন মানুষের গলার সুর, টান টান শিস। প্রথমে ভেবেছিল গ্রামের কারও বাজানো, কিন্তু একটু লক্ষ্য করতেই দেখা গেল শব্দটা অদ্ভুতভাবে একটানা বাজছে আর কোথা থেকে আসছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

সুমিত বলল—“শুনছিস? কেমন বাঁশির আওয়াজ!”
রুদ্র হেসে বলল—“ওরে বাবা! রোমান্টিক মুডের সুরকারও তো থাকতে পারে গ্রামে।”
কিন্তু অনিকের চোখ গাঢ় হয়ে উঠেছিল। সে আস্তে করে বলল—“শব্দটা শুনে কি তোরও মনে হচ্ছে, যেন আমাদের দিকেই ডাকছে?”

সবাই চুপ করে গেল। দেবলীনা আঁচলটা কাঁধে আরও জড়িয়ে নিল। হরিদাস তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে নদীর জলে দাঁড় টানছিল। আলোয় তার মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছিল না স্পষ্ট, কিন্তু ঠোঁটের কাছে যেন এক চাপা কাঁপুনি।

রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। দলটা সিদ্ধান্ত নিল শুয়ে পড়বে। কিন্তু যখন একে একে সবাই বিছানায় গেল, তখনও বাঁশির আওয়াজ যেন বাতাসে ভেসে এল অদ্ভুত ঘোরের মতো। আর অরণ্যের সেই কালো অন্ধকার, কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে, যেন তাদের অপেক্ষায় রইল।

তারা তখনও জানত না—এটাই কেবল শুরু।

পর্ব ২ – অচেনা ডাক

রাতটা যেন শেষ হচ্ছিলই না। অরণ্যের কালো আচ্ছাদনে ঢেকে থাকা নদীটাও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুধু মাঝেমধ্যেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে সেই অদ্ভুত বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছিল। প্রথমে সবাই একে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু যখন শব্দটা ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মিত বেজে চলল, তখন তাদের মধ্যে অস্বস্তি ঢুকে পড়ল।

দেবলীনা ঘুমোতে পারছিল না। সে বারবার উঠে বসছিল, ঘরের জানলা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকাচ্ছিল। কেরোসিন ল্যাম্পের ম্লান আলোয় তার চোখে ভয় ফুটে উঠেছিল। অনিক ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
—“তুই ঘুমাচ্ছিস না কেন?”
—“পারছি না,” দেবলীনা উত্তর দিল। “ওই বাঁশির আওয়াজটা কেমন অদ্ভুত লাগছে। কারও ডাকের মতো… যেন আমাদের দিকে।”

অনিক মুখে হাসির ভান করল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেও অস্বস্তি অনুভব করছিল। কারণ সত্যিই শব্দটা একঘেয়ে নয়, বরং কোথাও যেন মানুষের গলার মতো ওঠানামা করছে, যেন বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে।

রুদ্র, সুমিত আর তন্ময় অবশ্য গা করেনি। তারা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শুধু হরিদাস, নৌকোর মালিক, বাইরের চৌকাঠে বসে ছিল। চোখদুটো তার অরণ্যের অন্ধকারে স্থির। হঠাৎই সে গলা নামিয়ে বলে উঠল,
—“এ সুর আপনারা শহরের লোকেরা বুঝবেন না। এটা ডাক।”
অনিক চমকে জিজ্ঞেস করল,
—“ডাক মানে? কার ডাক?”
—“যারা ফেরে না, তাদের ডাক,” হরিদাস উত্তর দিল। কণ্ঠে কেমন হিমশীতল গাম্ভীর্য।

দেবলীনা শিউরে উঠল। সে বলল—“আপনি এভাবে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”
হরিদাস কোনো উত্তর দিল না। শুধু ধীরে ধীরে নদীর জলে দৃষ্টি নামিয়ে রাখল।

পরদিন ভোরে সবাই ঘুম থেকে উঠল এলোমেলো চেহারায়। কেউ ঠিকমতো বিশ্রাম পায়নি। চা খেতে খেতে রুদ্র বলল—“আরে দ্যাখো, কাল রাতে আমরা সবাই ভয় খেয়েছি এক বাঁশির জন্য! লোকাল টাউনে এমন হতেই পারে। আজকের দিনটা মজা করে কাটাও। কিছু বাঘ-টাঘ দেখলে দারুণ হবে।”

তারা সকলে রাজি হল জঙ্গলের ভেতর একটু ঘোরাঘুরি করতে। গাইড হরিদাস প্রথমে আপত্তি করল, কিন্তু শেষে রাজি হয়ে গেল এই শর্তে যে সূর্য ডোবার আগে তারা নদীর ধারে ফিরে আসবে।

সকালটা বেশ স্বাভাবিক ছিল। ঘন ম্যানগ্রোভের ভেতর দিয়ে ট্রলার চলছিল। জলকচুর ভেতর থেকে মাঝেমধ্যেই লাফিয়ে উঠছিল ছোট মাছ। দূরে কোথাও দেখা গেল লাল কাঁকড়ার দল। রুদ্র ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে ব্যস্ত হল, সুমিত বারবার মজা করছিল—“শোন, এই ছবিগুলো ইনস্টাতে দিলে দারুণ জমবে।”

কিন্তু দেবলীনার মনে শান্তি ফিরল না। তার চোখ বারবার অরণ্যের গভীর অন্ধকারে চলে যাচ্ছিল। গাছের ডালপালা যেন কারও হাতের মতো এগিয়ে আসছিল নৌকার দিকে।

দুপুর নাগাদ তারা নৌকা থেকে নেমে এক নির্জন দ্বীপে পা রাখল। বালুকাময় জমি, চারপাশে উঁচু ঝোপঝাড়। প্রথমে সব স্বাভাবিক মনে হলেও, একসময় তারা লক্ষ্য করল আশপাশে কোনও পাখির ডাক নেই, এমনকি বাতাসও যেন থমকে আছে। কেমন এক চাপা নিস্তব্ধতা।

সুমিত মজা করে বলল—“এটা তো দারুণ ফটোশুটের জায়গা!” কিন্তু সেই সময়েই হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে এক শব্দ শোনা গেল—ফস করে কিছু সরে গেল ভেতরে। সবাই চমকে তাকাল, কিন্তু চোখে কিছু ধরা পড়ল না।

তন্ময় বলল—“হয়তো শিয়াল বা অন্য কোনও জন্তু।”
অনিক ফিসফিস করল—“না, আওয়াজটা কেমন যেন মানুষের পায়ের মতো লাগল।”

তাদের মধ্যে নীরবতা নেমে এল। ঠিক তখনই দূরে কোথাও থেকে আবার ভেসে এল সেই বাঁশির সুর। দিনের আলোয়ও তার শব্দ কেমন রহস্যময়, যেন ঝোপের আড়াল থেকে অচেনা কেউ ডাকছে।

হরিদাস কড়া গলায় বলে উঠল—“চলুন। আর এক মিনিটও এখানে নয়।”
সে সবাইকে দ্রুত নৌকায় ফিরিয়ে নিল। ফিরে আসার পথে নদীর ওপর কুয়াশা জমে উঠছিল। অথচ দুপুরবেলা এই কুয়াশা কেন তা বোঝা গেল না।

ট্রলারে ফিরে আসার পর সবারই মন খারাপ হয়ে গেল। হাসি–মজা থেমে গিয়েছিল। শুধু রুদ্রই তখনও আশাবাদী, সে বলছিল—“আরে, এত ভয় পেলে চলবে নাকি? কাল রাতে আর আজকে দিনে একটা সুর শুনেই তোমাদের মুখ শুকিয়ে গেল!”

অনিক শান্ত গলায় উত্তর দিল—“তুই খেয়াল করেছিস? ওই বাঁশির সুরটা কেমন যেন প্রতিবার আমাদের আশেপাশেই বাজছে। যেন ছায়ার মতো পিছু নিচ্ছে।”

সন্ধে নামল। আকাশে পূর্ণিমার আলো ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে। নদীর জলে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে কেমন অদ্ভুত সাদা ঝলক তৈরি করছিল। সবাই খাওয়া শেষ করে ডেকে বসেছিল। হঠাৎই আবার ভেসে এল সেই বাঁশির সুর—এবার যেন আরও কাছে, আরও জোরে।

দেবলীনা চিৎকার করে উঠল—“এবার বুঝি সত্যিই কেউ আমাদের ডাকছে!”
হরিদাস মুখ ফিরিয়ে বলল—“এ ডাকে সাড়া দিলে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।”

সবাই স্তব্ধ। সেই মুহূর্তে নদীর ওপার থেকে কেমন যেন একটা ছায়ামূর্তি নড়তে দেখা গেল। দূরে হলেও স্পষ্ট বোঝা গেল—মানুষের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। আর বাঁশির সুর ভেসে আসছে তার দিক থেকেই।

তন্ময় কেঁপে উঠে বলল—“ওই যে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! দেখছিস?”
কিন্তু যতই তাকানো যায়, কুয়াশার ভেতরে ছায়ামূর্তিটা মিলিয়ে গেল। আর সঙ্গেসঙ্গেই থেমে গেল বাঁশির সুর।

চারপাশে আবার ঘন নিস্তব্ধতা নেমে এল। সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা বুঝল, এ নিছক কাকতালীয় কিছু নয়। কোনও অচেনা শক্তি সত্যিই তাদের অনুসরণ করছে।

আর সেই রাতেই ঘটল প্রথম নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা।

পর্ব ৩ – নিখোঁজ

রাত গভীর। ট্রলারের ভেতর সবাই কোনোরকমে ঘুমোবার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই বাঁশির শব্দের ছায়া যেন তাদের কানে লেগে রইল। একটু শান্ত হতেই আবার শিসের মতো হালকা আওয়াজ ভেসে আসছিল কুয়াশার ভেতর থেকে। দেবলীনা কাতর গলায় বলল—
—“আমি ঘুমোতে পারছি না, অনিক… কেমন যেন মনে হচ্ছে, কেউ আমাদের দেখছে।”

অনিক চুপ করে পাশে শুয়ে ছিল। সে ভান করছিল যে কিছুই শোনেনি। ভেতরে ভেতরে তারও বুক ধড়ফড় করছিল।

রুদ্র অবশ্য একেবারেই গা করল না। সে বলল—“তোমরা সবাই ভূতের গল্পের মতো ভাবছ। আমি তো যাচ্ছি ওপরে, একটু ধূমপান করি।” বলে সে ডেকে উঠে গেল।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎই নিচে বসে থাকা অনিকদের কানে এল এক অদ্ভুত শব্দ—মৃদু পায়ের শব্দ, তারপর যেন এক চাপা চিৎকার! মুহূর্তে সবাই উঠে পড়ল। ট্রলারের ডেকে ছুটে গিয়ে দেখা গেল—রুদ্র কোথাও নেই।

চারপাশ ঘন কুয়াশা। নদীর ওপর সাদা আভা ছড়িয়ে আছে, তার মাঝখানে শুধু বাতাসের মতো এক শূন্যতা। ডেকের রেলিংয়ের কাছে পড়ে আছে রুদ্রর জুতো আর তার মোবাইল ফোন। ফোনের স্ক্রিন ভাঙা, আলোটা নিভে গিয়েছে।

দেবলীনা আতঙ্কে কেঁপে উঠল—“এ কী! রুদ্র কোথায় গেল?”
সুমিত চিৎকার করে ডাকতে লাগল—“রুদ্র! রে রুদ্র!”
কিন্তু নদীর ওপার থেকে ভেসে এল শুধু প্রতিধ্বনি আর… সেই বাঁশির সুর। এবার শব্দটা আরও তীক্ষ্ণ, আরও দীর্ঘ। যেন বিদ্রুপ করছে।

হরিদাস কড়া গলায় বলে উঠল—“আমি বলেছিলাম না? পূর্ণিমার রাতে জঙ্গলের ভেতর ডাক শোনা যায়। যার কান ধরে, সে আর ফেরে না।”

অনিক গর্জে উঠল—“চুপ করুন! আমাদের বন্ধুকে বাঁচাতে হবে। আপনি নৌকা থামান, নামতে হবে।”
হরিদাস মাথা নাড়ল—“এ সময় নামা মানে মৃত্যু। নদী আপনাদের গিলে খাবে।”

তন্ময় ইতিমধ্যেই রেলিংয়ে হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎই সে চিৎকার করে উঠল—“দেখ! ওখানে কাদার ভেতর পায়ের ছাপ!”
সবাই নিচে আলো ফেলে দেখল, সত্যিই নদীর ধারের কাদায় পায়ের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সেগুলো যেন মানুষের নয়—অদ্ভুত বড় আকারের, আর টেনে নিয়ে যাওয়া দাগের মতো লম্বা চিহ্ন। যেন কেউ জোর করে টেনে নিয়ে গেছে রুদ্রকে।

দেবলীনার গলা শুকিয়ে গেল। সে আঁকড়ে ধরল অনিকের হাত। অনিক ঠান্ডা গলায় বলল—“ওর মানে হচ্ছে, রুদ্র একা যায়নি। কেউ ওকে টেনেছে।”

চারপাশের কুয়াশা আরও ঘন হতে লাগল। বাঁশির সুর এবার থেমে গেল, কিন্তু তার জায়গায় যেন শোনা গেল ফিসফিস করে কারও কথা বলা—খুব কাছ থেকে, আবার কোথাও নেই। শব্দটা স্পষ্ট শোনা গেল সবার কানে, তবু বোঝা গেল না কোন ভাষা।

সুমিত ভয় চেপে রাখতে পারল না। সে বলল—“আমরা পুলিশে খবর দেব! মোবাইল নাও।”
কিন্তু একে একে তারা মোবাইল বের করে দেখল—কোনওটাতেই নেটওয়ার্ক নেই। যেন এই অরণ্য আর সভ্য জগতের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে।

অনিক স্থির গলায় বলল—“ভয় পেও না। রুদ্র এখনও কোথাও আছে। আমাদের খুঁজে পেতেই হবে।”

তখন হরিদাস ঝুঁকে মাটির কাছে কিছু তুলে আনল। সবার সামনে ধরতেই দেখা গেল—একটা ভাঙা বাঁশি, কাদায় ভিজে আছে। সে বলল—
—“যে ডাকছিল, সে এ জিনিস রেখে গেছে। এটা সতর্কবার্তা। বুঝুন, ও ফিরে আসবে না।”

সেই মুহূর্তে হাওয়া যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। চারপাশে নিস্তব্ধতা এত ঘন হয়ে উঠল যে হৃদস্পন্দনের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল। নদীর ওপারে গাছের সারি হঠাৎ দুলে উঠল বাতাস ছাড়াই। আর কুয়াশার মধ্যে মুহূর্তের জন্য দেখা গেল—একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র নয়, একেবারেই অপরিচিত। মুখ দেখা যায় না, কিন্তু চোখের জায়গায় যেন আগুনের মতো লাল দুটি বিন্দু জ্বলছে।

দেবলীনা কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল—“ওই যে… ওই যে আমাদের দেখছে।”
অনিক রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে জানত, রুদ্র হয়তো আর নেই। কিন্তু সেই ছায়ার পেছনে যে রহস্য আছে, সেটাই এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

হরিদাস দাঁড় টেনে দ্রুত ট্রলার ঘোরাতে লাগল। সে বলল—“এখন যদি ফিরতে হয়, তাহলে এখনই ফিরতে হবে। না হলে তোমরাও হারিয়ে যাবে।”

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল—রুদ্র কোথায় গেল? পায়ের ছাপগুলো কাদের? আর কেনই বা প্রতিবার বাঁশির সুরের পরেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে?

সেদিন রাতেই তারা বুঝল—এই ভ্রমণ আর নিছক আনন্দযাত্রা নয়। এ এক অদৃশ্য ফাঁদের ভেতরে ঢুকে পড়া। আর ফাঁদ থেকে বেরোনো এত সহজ নয়।

পর্ব ৪ – গোপন মন্দির

সকাল উঠতেই সবাই রুদ্রর কথা মনে করে শিউরে উঠল। অন্ধকার রাতে অদ্ভুত সেই বাঁশির সুর, ডেকে ফেলে নিয়ে যাওয়া ছায়া, আর কাদায় পড়ে থাকা টেনে নেওয়ার দাগ—সব মিলিয়ে যেন এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এখন আর পিছু হটার পথ নেই। গ্রামে খবর দিতে গেলেও গ্রামের লোকজন তাদের কথা শুনবে কি না সন্দেহ।

অনিক দৃঢ় গলায় বলল—“আমরা বসে থাকলে চলবে না। রুদ্রকে খুঁজতেই হবে। জঙ্গলে নামতে হবে।”
দেবলীনা আতঙ্কে প্রতিবাদ করল—“তুই পাগল হয়ে গেছিস? কাল রাতে ওকে চোখের সামনে হারালাম। আবার ওই অরণ্যে ঢুকব?”
তন্ময় হাত বাড়িয়ে দেবলীনাকে শান্ত করল—“দেখ, আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। ভয় পেলে ওর কোনো সমাধান হবে না।”

হরিদাস অনেক বোঝাল—“ওই জঙ্গল এড়িয়ে চলুন। নদীর ধারে থাকুন।” কিন্তু বন্ধুরা শোনেনি। শেষমেশ অনিচ্ছায় সে-ই গাইড হল।

সকাল গড়াতেই তারা পায়ে হেঁটে অরণ্যের ভেতরে ঢুকল। চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়, উঁচু উঁচু সুন্দরী গাছ, নিচে জটলানো কাদার মতো মাটি। প্রতিটি পা ফেলতে হচ্ছিল সাবধানে। বাতাসে লবণাক্ত কাঁকড়ার গন্ধ। মাঝে মাঝে কোথাও কাদার ভেতর বুদবুদ উঠছে।

হঠাৎই দেবলীনা থেমে গেল। তার চোখ পড়েছিল গাছের কাণ্ডে আঁকা অদ্ভুত সব চিহ্নে—ত্রিভুজ, অর্ধচন্দ্র, আর ফাঁসির দড়ির মতো বৃত্ত। সেগুলো কাদামাখা হলেও বোঝা যাচ্ছিল ইচ্ছে করেই কেউ এঁকেছে।
—“দেখ, এগুলো কেমন অদ্ভুত চিহ্ন!”
অনিক এগিয়ে গিয়ে হাত বুলিয়ে বলল—“এগুলো কোনো প্রাচীন মন্ত্রচিহ্নের মতো মনে হচ্ছে।”

হরিদাস গম্ভীর গলায় বলল—“এইসব চিহ্ন মানে বিপদ। ওরা এখনো আছে।”
তন্ময় প্রশ্ন করল—“ওরা মানে কে?”
হরিদাস আর কিছু বলল না।

তারা আরও ভেতরে এগোল। হঠাৎই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হল এক দৃশ্য—ঘন বনের মধ্যে লতাপাতা, ঝোপঝাড়ে ঢাকা এক ভগ্নপ্রায় স্থাপনা। পাথরের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি, মাঝখানে গম্বুজ ভেঙে পড়ে আছে, তবু বোঝা যায় এককালে এটি ছিল মন্দির।

সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল।
দেবলীনা ফিসফিস করে বলল—“এখানে মন্দির! কিন্তু কে বানিয়েছিল?”
সুমিত বলল—“বুঝতে পারছিস না? এটাই হয়তো সেই অদ্ভুত ঘটনার কেন্দ্র।”

তারা সাবধানে এগিয়ে গেল। মন্দিরের দরজা আধভাঙা, কিন্তু তার গায়ে লাল রঙের দাগ শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল রঙ, কিন্তু কাছে গিয়ে স্পষ্ট হল—এগুলো রক্তের মতোই দেখতে।

দেবলীনা আঁকড়ে ধরল অনিকের হাত—“আমি ভেতরে ঢুকব না।”
অনিক বলল—“কিছু না জেনে ফিরে গেলে রুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাহস রাখ।”

ভেতরে ঢুকতেই এক শীতল স্রোত গা বেয়ে নামল। আলো প্রায় ঢুকছিল না, কেবল ম্লান অন্ধকার। দেয়ালে জড়ানো মাকড়সার জাল, মাটিতে ছড়ানো ভাঙা প্রতিমার টুকরো। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল দেয়ালে আঁকা মূর্তি—মানুষকে বেদীতে শুইয়ে তার গলায় ছুরি বসানোর দৃশ্য।

সুমিত হঠাৎ কেঁপে উঠল—“এগুলো কী! এখানে তো স্পষ্ট মানববলির ছবি আঁকা আছে।”
তন্ময় কণ্ঠ শুকিয়ে গেল—“তাহলে গ্রামের বৃদ্ধা যা বলেছিল, সব সত্যি?”

ঠিক তখনই, মন্দিরের ভেতর থেকে আবার ভেসে এল সেই বাঁশির সুর। এবার একেবারে কানে বাজল, যেন মন্দিরের অন্ধকার গর্ভ থেকেই আসছে। সবাই কেঁপে উঠল।

হরিদাস কেঁদে ওঠার মতো গলায় বলল—“আমি বলেছিলাম না? এখানে কারও আসা উচিৎ নয়। এই মন্দির অভিশপ্ত। পূর্ণিমার রাতে ওরা আবার ফিরে আসে।”

সবাই স্থির দাঁড়িয়ে শুনছিল। বাঁশির সঙ্গে এবার যোগ হল মন্ত্রোচ্চারণের মতো গলা। স্পষ্ট বোঝা গেল, একাধিক মানুষ একসঙ্গে জপ করছে। অথচ ভেতরে তাদের ছাড়া আর কেউ নেই।

অনিক সাহস সঞ্চয় করে চিৎকার করল—“কে আছিস এখানে? সামনে আস।”
কিন্তু উত্তর এল না। শুধু সুর আর জপ চলতেই থাকল, ক্রমশ আরও জোরে, আরও ভয়ঙ্কর।

হঠাৎই বাতাসের ঝাপটা এসে লণ্ঠন নিভে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবাই শুনতে পেল—দেয়ালের ভেতর দিয়ে যেন কারও হাত ঘষার শব্দ। সুমিত আতঙ্কে লণ্ঠন জ্বালাতে গিয়ে হাত কাঁপিয়ে ফেলল। আলো জ্বলতেই দেখা গেল—দেয়ালের কোণায় কাদামাখা হাতের ছাপ। সবে রাখা হয়েছে, রক্তাক্ত আঙুলের দাগ মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে।

দেবলীনা চিৎকার করে উঠল। অনিক তাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল—“চুপ কর। ভয় দেখানোই ওদের উদ্দেশ্য।”

কিন্তু সেই সময়েই ভেতরের অন্ধকার থেকে হঠাৎ ভেসে এল এক গর্জন—মানুষের নয়, জন্তুর নয়, অথচ স্পষ্ট জীবন্ত।

সেই মুহূর্তে তারা সবাই বুঝল—রুদ্রর নিখোঁজ হওয়ার রহস্য এই মন্দিরের সঙ্গেই যুক্ত। আর এই মন্দির শুধু ইতিহাস নয়, আজও এখানে কিছু আছে, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রাণঘাতী সত্য।

পর্ব ৫ – ভূতের গল্প

মন্দিরের অন্ধকার গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে তারা সবাই স্তব্ধ। ভাঙাচোরা পাথরের মূর্তি, দেয়ালে আঁকা মানববলি আর কাদামাখা রক্তাক্ত হাতের ছাপ যেন একসঙ্গে চাপা দমবন্ধ করা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। বাতাসে কেমন এক অদ্ভুত গন্ধ—ধূপের মতো, আবার পচা কাদার গন্ধ মিশে আছে।

হঠাৎই হরিদাস গলা নামিয়ে বলল—“আপনারা যদি জানতে চান, তবে শোনান দেব। এই মন্দিরের কাহিনি শুনলে ঘুম উড়ে যাবে।”

অনিক গম্ভীর চোখে তাকাল—“বলুন। সত্যিটাই শুনতে চাই।”

হরিদাস মাটিতে বসে পড়ল, যেন পুরনো এক ইতিহাসের ভার তার শরীরকে নুইয়ে দিল। কণ্ঠস্বর কর্কশ, তবু প্রতিটি শব্দ যেন শিরদাঁড়া বেয়ে শীতলতা নামিয়ে দিচ্ছিল।

“অনেক বছর আগে, এই সুন্দরবনের গভীরে এক রাজপরিবারের শাখা থাকত। তারা প্রকৃতিকে ভয় পেত না, বরং নিজেদের শক্তি প্রমাণ করতে চেয়েছিল জঙ্গলের অদৃশ্য দেবতার কাছে। সেই জন্য তৈরি হয়েছিল এই মন্দির। এখানে পূজা হত অদ্ভুত এক দেবতার, যার নাম উচ্চারণ করতে গ্রামের লোকেরা এখনও ভয় পায়। পূজার মূল আচার ছিল—মানববলির রীতি।”

দেবলীনা চমকে উঠল—“মানববলি? সত্যি?”
হরিদাস মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। গ্রামের গরিব মানুষ, ভাসমান জেলে, পথিক—যে ধরা পড়ত, তাকে টেনে আনা হত এখানে। পূর্ণিমার রাতে বাঁশির সুর বাজত, লোকজন মনে করত দেবতার আহ্বান। আর তখনই তারা বন্দি হত। মন্ত্রোচ্চারণের পর জীবন্ত মানুষকে বেদীতে শুইয়ে দেওয়া হত।”

সুমিত ঘৃণায় কেঁপে উঠল—“এ সব ভয়াবহ প্রথা কে চালাত?”
—“একদল সাধু। কিন্তু তারা সাধু ছিল না, ছিল লোভী যাজক। তারা বিশ্বাস করত, মানুষের রক্তেই দেবতা সন্তুষ্ট হন। আর এই রক্ত ঢেলে দিতেন জঙ্গলের বেদীতে।”

তন্ময় ফিসফিস করে বলল—“তাহলে রুদ্র…?”
হরিদাস তাকাল তার দিকে। চোখদুটো কেমন গাঢ় হয়ে উঠল। “যাকে এই ডাক ধরে, সে আর ফেরে না। রুদ্র যদি বাঁশির সুরে সাড়া দিয়ে থাকে, তবে… ও হয়তো তাদের অর্ঘ্য হয়ে গেছে।”

দেবলীনা কেঁপে উঠল। “কিন্তু এ তো অতীতের কথা! এখন তো এসব হওয়ার কথা নয়।”
হরিদাস শ্বাস ফেলল। “আপনারা তাই ভাবছেন। কিন্তু এই মন্দির আজও জীবিত। পূর্ণিমার রাতে এখানে সেই সুর বাজে, সেই মন্ত্র শোনা যায়। যারা একবার শোনে, তারা আর প্রতিরোধ করতে পারে না। জঙ্গলের আত্মারা এসে তাদের টেনে নিয়ে যায়। আমি ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের গ্রামের তিনজন ছেলে এভাবেই উধাও হয়েছিল। তাদের লাশও আর পাওয়া যায়নি।”

কথা শেষ হতেই সবাই নিস্তব্ধ। বাতাস হঠাৎ জমে উঠল আরও ঠান্ডা। অরণ্যের ওপাশ থেকে শোনা গেল পাখিদের অস্বাভাবিক ডানা ঝাপটানোর শব্দ, যেন আতঙ্কে উড়ে যাচ্ছে।

অনিক স্থির কণ্ঠে বলল—“আপনি বলতে চাইছেন, রুদ্রকেও এই মন্দির টেনে নিয়েছে?”
হরিদাস গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।

ঠিক তখনই আবার ভেসে এল সেই বাঁশির সুর—এবার এত কাছে যে মনে হল মন্দিরের ভেতর থেকেই বাজছে। সবাই শিউরে উঠল। মন্ত্রোচ্চারণের গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল, যেন একদল অদৃশ্য মানুষ একসঙ্গে জপ করছে।

সুমিত আতঙ্কে ফিসফিস করে বলল—“কেউ কি সত্যিই আছে ভেতরে?”
অনিক দাঁত চেপে বলল—“না, আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আমি প্রমাণ না পেলে বিশ্বাস করব না।”

সে আলো জ্বালিয়ে মন্দিরের আরও গভীরে এগিয়ে গেল। বাকিরাও তার পেছনে। এক অন্ধকার করিডর পেরিয়ে তারা পৌঁছল এক ছোট কক্ষে। ভেতরে মাটির ওপর পড়ে আছে কিছু পুরনো সামগ্রী—ভাঙা বাঁশি, মরচে ধরা ছুরি, আর শুকনো হাড়গোড়।

দেবলীনা হঠাৎই চিৎকার করে উঠল। মাটিতে গড়িয়ে থাকা হাড়গুলোর একটাতে এখনও লালচে দাগ লেগে আছে। অনিক লণ্ঠন তুলে ধরতেই দেখা গেল, সেটা মানুষের পাঁজরের হাড়।

তন্ময়ের গলায় কাঁপুনি—“তাহলে এসব শুধু গল্প নয়। এ সত্যি।”

হরিদাস প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল—“এগুলো সেইসব মানুষের হাড়, যারা ফেরেনি।”

ঠিক তখনই কক্ষের ভেতর যেন অদৃশ্য কেউ হেঁটে গেল। পায়ের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল সবাই। তারা ঘুরে তাকাল, কিন্তু আলোয় কেউ নেই। অথচ বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ল রক্তের কাঁচা গন্ধ।

অনিক কণ্ঠ শক্ত করে বলল—“আমাদের বেরোতে হবে। এখনই।”

তারা ছুটে বাইরে এল। মন্দিরের সামনে এসে শ্বাস নেবার সময়ই আবার বাঁশির সুর ভেসে উঠল। এবার এত ভয়ঙ্কর, এত দীর্ঘ, যেন আকাশের চারপাশ কেঁপে উঠল।

দেবলীনা কান চাপা দিয়ে বসে পড়ল। অনিক তাকে টেনে তুলল। সবাই দৌড়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল, ফিরে চলল নদীর দিকে। কিন্তু পেছনে ফেলে এল এক অভিশপ্ত মন্দির, যেখানে ইতিহাস এখনও বেঁচে আছে, আর প্রতিটি পূর্ণিমায় নতুন শিকার দাবি করে।

পর্ব ৬ – দ্বিতীয় নিখোঁজ

মন্দির থেকে পালিয়ে এসে নদীর ধারে দাঁড়াতেই সবাই হাঁপিয়ে উঠল। শ্বাস যেন বুক থেকে বেরোচ্ছিল না। কুয়াশা ভেদ করে নদীর ওপারে ভাঙা গাছপালা, ভেসে যাওয়া কচুরিপানা—সব মিলিয়ে দৃশ্যটা কেমন ভূতুড়ে। বাতাসে আবার সেই গন্ধ, কাদার সঙ্গে মিশে যাওয়া পুরনো রক্তের মতো।

অনিক চারপাশে তাকিয়ে বলল—“আমরা যত দ্রুত সম্ভব নৌকায় ফিরে যাই। এখানে এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়।”
হরিদাস গম্ভীর কণ্ঠে যোগ করল—“সঠিক বলছেন। পূর্ণিমার রাত যত এগোবে, ডাক তত বাড়বে। তখন ফিরবার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।”

তারা দ্রুত নৌকার দিকে হাঁটতে লাগল। কিন্তু পেছনে যেন প্রতিটি পা ফেলতেই ভেসে আসছিল সেই বাঁশির সুর। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে কেউ তাদের দেখছে।

দেবলীনা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেল। সে ফিসফিস করে বলল—“তোমরা শুনছ? আমার নাম ধরে কেউ ডাকল।”
সবাই থমকে দাঁড়াল। চারপাশ নিস্তব্ধ। তন্ময় বলল—“তুই হয়তো ভুল শুনেছিস।”
কিন্তু দেবলীনা কেঁপে উঠল—“না, একেবারে স্পষ্ট শুনেছি। ওই কণ্ঠস্বরটা রুদ্রর মতো।”

সুমিত চেঁচিয়ে উঠল—“রুদ্র! রে রুদ্র, তুই কোথায়?”
সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যের ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো ভেসে এল রুদ্রর কণ্ঠ—“আমি এখানে… সাহায্য কর…”

সবাই স্তব্ধ। অনিক এগিয়ে গেল কিছুদূর। সত্যিই ঝোপের আড়াল থেকে যেন কারও ছায়া নড়ল। কিন্তু কাছে যেতেই দেখা গেল, কিছু নেই। শুধু মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়া পায়ের দাগ।

হরিদাস কঠোর গলায় বলল—“এগুলো আসল নয়। ওরা তোমাদের কান দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। রুদ্র ফেরেনি।”

দেবলীনা ভেঙে পড়ছিল। অনিক তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। অবশেষে তারা নৌকায় ফিরল।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। নদীর জলে তার প্রতিফলন কেমন অদ্ভুত রূপ নিচ্ছে—মাঝেমাঝে যেন রক্তিম হয়ে উঠছে। সবাই একসঙ্গে বসেছিল, কেউ কিছু বলছিল না।

ঠিক তখনই সুমিত বলল—“আমরা শুধু ভয় পাচ্ছি। কিন্তু কিছু তো করতে হবে। আমি ক্যামেরা সেট করে রাখছি। যদি আবার কিছু অস্বাভাবিক হয়, তাহলে রেকর্ড থাকবে।”

সে তার ক্যামেরা ডেকে লাগিয়ে দিল। লেন্স অরণ্যের দিকে তাক করা। ক্যামেরার লাল আলো ঝিকঝিক করতে লাগল।

রাত বাড়ল। বাতাসে বাঁশির সুর আবার ভেসে উঠল। এবার আরও কাছে, আরও জোরে। সবাই কান চাপা দিল। কিন্তু ক্যামেরা চলছে।

হঠাৎই দেবলীনা চিৎকার করে উঠল—“সুমিত কোথায়?”

সবাই ছুটে দেখল, সুমিত আর নেই। তার চেয়ার উল্টে পড়ে আছে, কিন্তু সে নিজে উধাও। ক্যামেরাটা এখনও রেকর্ড করছে। অনিক তাড়াহুড়ো করে ফুটেজ চালাল।

ভিডিও দেখে সবার রক্ত হিম হয়ে গেল। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে—সুমিত বসে আছে, হঠাৎ তার পেছনে এক অন্ধকার ছায়া দাঁড়াল। মুখ দেখা যায় না, শুধু দুটো জ্বলজ্বলে লাল চোখ। সুমিত ঘুরে তাকাতেই ছায়াটা হাত বাড়াল। এক মুহূর্তে সে শূন্যে মিলিয়ে গেল। চেয়ারটা উল্টে পড়ল। তারপর ফ্রেমে শুধু খালি ডেক, আর পেছনে বাঁশির সুর।

দেবলীনা প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেল। তন্ময় কাঁপতে কাঁপতে বলল—“ওকে… ওকে ওরা নিয়ে গেল।”
অনিক দাঁত চেপে বলল—“না। আমি মানতে পারছি না। এটা যাই হোক, কোনো না কোনো যুক্তি আছে। মানুষকে এভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায় না।”

হরিদাস করুণ গলায় বলল—“আপনারা বুঝুন, এ জঙ্গলে সবকিছুর ব্যাখ্যা নেই। ডাক একবার পেয়ে গেলে ফেরার উপায় থাকে না। আজ রুদ্র গেছে, আজ রাতেই সুমিতও গেল।”

তাদের বুকের ভেতর ভয় জমাট বাঁধতে লাগল। পূর্ণিমার চাঁদ তখন আকাশে আরও উঁচুতে, নদীর জল যেন লালাভ আলোয় ঝলমল করছে। আর বাঁশির সুর থামছেই না, যেন প্রতিটি মুহূর্তে আরও কাছে চলে আসছে।

অনিক স্থির কণ্ঠে বলল—“আমরা পালিয়ে বাঁচতে পারব না। রহস্যের মূলে যেতে হবে। না হলে কাল সকালের মধ্যে হয়তো আমাদের কাউকে বেছে নেবে।”

তন্ময় হতাশ গলায় বলল—“কিন্তু কোথায় যাব? কোথা থেকে শুরু করব?”
অনিক দৃষ্টি ফেরাল অরণ্যের দিকে। “ওই মন্দিরই সূত্র। আমাদের ওখানেই ফিরতে হবে।”

হরিদাস কেঁপে উঠল—“আপনারা যদি আবার সেখানে যান, কেউ ফিরবেন না।”
অনিক উত্তর দিল—“ফিরব কি ফিরব না, সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু আমরা যদি চুপচাপ বসে থাকি, সবাই শেষ হয়ে যাব।”

দেবলীনা চোখ ভিজে মাথা নাড়ল। ভয় তার বুক চেপে ধরেছে, তবু সে জানত, পালিয়ে লাভ নেই।

দূরে তখনও কুয়াশার ভেতর থেকে ভেসে আসছিল বাঁশির ডাক—অচেনা, অথচ পরিচিত। যেন অরণ্য নিজেই তাদের টেনে নিচ্ছে। আর এবার তাদের আর কোনো উপায় নেই, শুধু এগিয়ে যাওয়া ছাড়া।

পর্ব ৭ – গোপন সুড়ঙ্গ

রাতের শেষ প্রহর। ট্রলারের ডেক নিস্তব্ধ, শুধু নদীর জল টুপটাপ শব্দ করছে। রুদ্র ও সুমিতের অনুপস্থিতি সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। দেবলীনা কেঁপে বসে আছে, চোখে অশ্রু জমে গেছে। তন্ময় মুখ গম্ভীর করে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। অনিক বারবার মুঠি শক্ত করছে—ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে একধরনের অদম্য প্রতিজ্ঞা তার চোখে ফুটে উঠছে।

—“আমরা এভাবে বসে থাকতে পারি না,” অনিক অবশেষে বলল। “যা কিছু ঘটছে, তার কেন্দ্র ওই মন্দির। সেখানেই আমাদের উত্তর আছে।”
দেবলীনা আঁকড়ে ধরল অনিকের হাত—“ওখানে আবার ফিরতে চাইছিস? গতকালই দেখেছিস কী ভয়ঙ্কর… আমি আর পারব না।”
অনিক নরম গলায় বলল—“আমি জানি তুই ভয় পাচ্ছিস। আমরাও পাচ্ছি। কিন্তু পালিয়ে বাঁচা যাবে না। রুদ্র আর সুমিতের মতো আমরাও হারিয়ে যাব। আমাদের সত্যি জানতে হবে।”

শেষমেশ সবাই রাজি হল। ভোর হতেই তারা ট্রলার ছেড়ে আবার অরণ্যের দিকে রওনা দিল। কুয়াশা ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র, সূর্যের আলো পর্যন্ত গাঢ় হয়ে এসেছিল।

বনের ভেতর ঢুকতেই সেই পরিচিত গন্ধ নাকে এল—কাদার সঙ্গে মিশে থাকা রক্তের কাঁচা গন্ধ। গাছের গুঁড়িতে আঁকা অদ্ভুত চিহ্নগুলো যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। সবাই নিঃশব্দে এগোতে লাগল।

অবশেষে তারা পৌঁছল সেই ভগ্নপ্রায় মন্দিরে। দিন হলেও ভেতরে অন্ধকার গাঢ়। মন্দিরের দরজায় লতাপাতা, আর তার গায়ে শুকনো রক্তের দাগ।

ভেতরে ঢুকতেই আবার কানে এল সেই অচেনা ফিসফিস—মন্ত্রোচ্চারণের মতো গলা, অথচ চারপাশ খালি। হরিদাস থমকে দাঁড়াল, তার চোখ আতঙ্কে ভরা।

অনিক টর্চ জ্বালিয়ে এগোল। সবাই তার পেছনে। করিডর পেরোতে পেরোতে তারা পৌঁছল সেই ছোট কক্ষটিতে, যেখানে ভাঙা বাঁশি, মরচে ধরা ছুরি আর মানুষের হাড় পড়ে ছিল। কিন্তু আজ আরও কিছু নতুন জিনিস দেখা গেল—মাটিতে রাখা তাজা ফুল, ধূপকাঠির ছাই, আর এক পেয়ালা রক্তমাখা তরল।

দেবলীনা চিৎকার করে উঠল—“কেউ এখানে এসেছে! গতরাতেই।”
তন্ময় কণ্ঠ শুকিয়ে গেল—“মানে এখনো… ওরা আছে?”

অনিক ঠান্ডা গলায় বলল—“হ্যাঁ। আর এটাই প্রমাণ করে আমাদের সন্দেহ ঠিক।”

সে চোখ বোলাল কক্ষের দেওয়ালে। হঠাৎই খেয়াল করল মাটির একপাশে পাথরের ফাঁক। কাছে গিয়ে আলো ফেলতেই দেখা গেল সেখানে একটা গোপন দরজার মতো অংশ। মসৃণ নয়, বরং কাদামাখা, অর্ধেক ভাঙা। অনিক হাত দিয়ে চাপ দিতেই পাথর সরে গেল। ভেতর থেকে বেরোল ঠান্ডা বাতাস, আর এক আঁধার পথ।

সবাই স্তম্ভিত।
—“এটা কী?” দেবলীনা কেঁপে জিজ্ঞেস করল।
অনিক বলল—“গোপন সুড়ঙ্গ। হয়তো এখান দিয়েই তারা আসে আর যায়।”

হরিদাস আতঙ্কে পিছু হটল—“না, ওদিকে যাবেন না। এই পথ মৃত্যু ডেকে আনে।”
কিন্তু অনিক পিছপা হল না। সে টর্চ উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকল।

সুড়ঙ্গটা ছিল সরু, নোংরা মাটি দিয়ে গড়া, দেয়ালে শ্যাওলা আর কাদা জমে আছে। গন্ধ কেমন যেন পচা মৃতদেহের মতো। হাঁটতে হাঁটতে সবার পা পিছলাচ্ছিল। মাথার ওপরে কোথাও কোথাও ঝুলছিল বাদুড়, আলো পড়তেই ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

দেবলীনা কাঁপতে কাঁপতে বলল—“এ জায়গাটা যেন দমবন্ধ করা কবরে হাঁটার মতো।”
তন্ময় গম্ভীর গলায় বলল—“হয়তো সত্যিই এটা কবরই।”

সুড়ঙ্গ যত গভীরে গিয়েছে, ততই মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ স্পষ্ট হয়েছে। বাঁশির সুরও শোনা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে কাছে আসছে। সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। ভয় তাদের চোখে স্পষ্ট।

হঠাৎই সুড়ঙ্গ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বাঁদিকের পথটা অনেকটা নীচের দিকে ঢালু, ডানদিকেরটা সরল। অনিক থেমে গেল। সে বলল—“আমরা ভাগ হব না। একসঙ্গে থাকব।” সে বাঁদিকের পথ বেছে নিল।

কিছুদূর নামতেই তারা দেখল দেওয়ালে খোদাই করা আছে অদ্ভুত সব চিত্র—মানুষকে বেদীতে শুইয়ে ছুরি বসানো, রক্তে দেবতার প্রতিমা স্নান করছে। ছবিগুলো এতটাই জীবন্ত যে আলো পড়তেই মনে হচ্ছিল তারা নড়ছে।

দেবলীনা চোখ ফেরাল, কিন্তু তার ভেতরে যেন ছবি গেঁথে গেল। সে প্রায় কেঁদে উঠল—“আমি পারছি না, অনিক।”
অনিক তার কাঁধে হাত রাখল—“সাহস রাখ। এখানেই আমাদের উত্তর।”

অবশেষে সুড়ঙ্গ শেষ হল এক বিশাল চোঙা গর্ভকক্ষে। ভেতরে মশাল জ্বলছে। কারও উপস্থিতির প্রমাণ স্পষ্ট। মাটিতে রক্তের দাগ টাটকা। মাঝখানে পাথরের বেদী, তার ওপর পড়ে আছে কিছু কাপড়—চেনা কাপড়। সবাই একসঙ্গে চমকে উঠল।

ওগুলো রুদ্রর টি-শার্ট আর সুমিতের ব্যাকপ্যাক।

দেবলীনা হাহাকার করে উঠল। তন্ময় ঠোঁট কামড়ে ধরল। অনিক কেঁপে উঠল, কিন্তু নিজেকে সামলাল।
—“ওরা… ওরা এখানেই ছিল। হয়তো এখনও কাছেই আছে।”

ঠিক তখনই গর্ভকক্ষের ভেতর প্রতিধ্বনির মতো বাজল সেই মন্ত্রোচ্চারণ। কোথাও কেউ নেই, অথচ চারপাশ ভরে গেল গলার আওয়াজে। বাঁশির সুরও মিলল তার সঙ্গে।

আর গর্ভকক্ষের অন্ধকারে হঠাৎই নড়ে উঠল ছায়া।

পর্ব ৮ – অন্ধকারের সত্য

গর্ভকক্ষের অন্ধকারে ছায়াগুলো প্রথমে অস্পষ্ট ছিল। মশালের আলোয় দপদপ করে নড়ছিল তারা, যেন জীবন্ত। মন্ত্রোচ্চারণ থেমে গেল হঠাৎ, কিন্তু বাঁশির সুর বাজতে থাকল—এবার কানে লাগার মতো তীক্ষ্ণ। অনিক টর্চ উঁচু করে আলো ফেলল। মুহূর্তেই ভেসে উঠল এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

সামনের দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দু’জন মানুষ—মুখে কালো কাপড় বাঁধা, হাতে মশাল। চোখে হিংস্র আলো। তাদের পোশাকে লাল দাগ, বোঝাই যায় রক্ত লেগেছে। অনিক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণে সত্যি প্রকাশ পেল—এ ভূতের নয়, মানুষের কাজ।

তন্ময় গলা শুকিয়ে ফিসফিস করল—“তাহলে… এতদিন ধরে ওরা-ই?”
হরিদাস মাথা নিচু করল—“হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো এ শুধু প্রেতাত্মার ছায়া। কিন্তু এরা আসল শিকারি।”

কালোমুখোদের একজন কর্কশ গলায় বলল—“তোমরা চলে আসার সাহস করলে? ভালো করেছ। এখন তোমাদেরও রক্ত দেবীর বেদীতে চড়বে।”

দেবলীনা কেঁপে উঠল। অনিক তাকে আড়াল করল। সঙ্গেসঙ্গেই অন্ধকার থেকে আরও কয়েকজন বেরিয়ে এল। তারা সবাই একই রকম পোশাক পরা, হাতে বাঁশি। বোঝা গেল, এই বাঁশিই তাদের সিগন্যাল। অরণ্যের ভেতর থেকে বাঁশির শব্দ বাজিয়ে তারা শিকারকে টেনে আনে।

তন্ময় চিৎকার করে উঠল—“রুদ্র আর সুমিত কোথায়? ওদের কী করেছ?”
একজন হাসল, গলা কর্কশ—“তোমাদের বন্ধুদের আত্মা এখন দেবীর কণ্ঠে মিশেছে। আর তাদের শরীর… বেদীকে স্নান করিয়েছে।”

দেবলীনা ভেঙে পড়ল। অনিক দাঁত চেপে এগিয়ে গেল। “তোমাদের এই পাপের শেষ আজই হবে।”

কালোমুখোরা হেসে উঠল। “কে রুখবে? আমাদের রক্তের বাণিজ্য বহুদিনের। এ জঙ্গলের নিস্তব্ধতা আমাদের ঢেকে রাখে। তোমাদের মতো শহুরে লোকেরা কেবল হারিয়ে যায়। কেউ প্রশ্ন করে না।”

অনিকের মাথায় বজ্রাঘাত হল। সে বুঝল—এ শুধু অন্ধকার রীতি নয়, এর পেছনে আছে অপরাধচক্র। মানুষকে গুম করে ফেলা, পাচার, আর লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুর ব্যবসা। ভূতের ভয় দেখিয়ে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর।

হরিদাসের চোখ ভিজে উঠল। “আমি ছোটবেলা থেকেই শুনেছি, পূর্ণিমায় ডাক আসে। আজ বুঝলাম, ডাকটা মানুষের। ওরা-ই আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।”

তন্ময় ক্ষোভে কাঁপছিল। “তাহলে সবটাই সাজানো! বাঁশির সুর, মন্ত্রোচ্চারণ, সব নাটক?”
একজন কালোমুখো উত্তর দিল—“হ্যাঁ। ভয় ছাড়া মানুষকে টানা যায় না। পূর্ণিমার রাত আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ সময়। নদী তখন জেগে ওঠে, আর শহর দূরে থাকে। এই অরণ্য আমাদের দুর্গ।”

অনিক হাত মুঠো করে এগিয়ে গেল। “আমরা কারও ভয় পাই না। যত শক্তি আছে, আজই সত্য প্রকাশ করব।”

হঠাৎই কালোমুখোরা এগিয়ে এল। দেবলীনা চিৎকার করল। মুহূর্তে হাতাহাতি শুরু হল। মশালের আলোয় ঘরের ভেতর রক্তক্ষয়ী লড়াই। অনিক এক কালোমুখোর হাতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল, তার মশাল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। আগুনের আলোয় দৃশ্য আরও স্পষ্ট হল—গর্ভকক্ষের কোণে পাথরের বেদী, তার ওপর শুকিয়ে যাওয়া রক্ত, আর পাশে রুদ্রর টি-শার্ট, সুমিতের ব্যাগপ্যাক।

দেবলীনা সেই দৃশ্য দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ল। অনিক তাকে টেনে আড়ালে নিল। তন্ময় এক লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে এক কালোমুখোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু তাদের সংখ্যা অনেক।

ঠিক তখনই করিডর থেকে ভেসে এল পুলিশের বাঁশির আওয়াজ। একদল সশস্ত্র লোক আলো ফেলতে ফেলতে ঢুকে পড়ল। কালোমুখোরা ছুটে পালাতে চাইছিল, কিন্তু ঘেরাও হয়ে গেল।

অনিক হতভম্ব। সে বুঝতে পারল না—পুলিশ হঠাৎ এল কীভাবে?

হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—“আমি কাল রাতেই গ্রামে খবর পাঠিয়েছিলাম। জানতাম, একদিন সত্যি প্রকাশ পাবে।”

পুলিশেরা কালোমুখোদের হাতকড়া পরাতে লাগল। মুখোশ খুলতেই দেখা গেল—গ্রামেরই কয়েকজন মানুষ। অরণ্যের অন্ধকারকে ঢাল করে তারা বহু বছর ধরে পাচারের ব্যবসা চালাচ্ছিল। রুদ্র আর সুমিতকে তারা হত্যা করেছে।

দেবলীনা চিৎকার করে উঠল—“আমাদের বন্ধুরা কোথায়? ওদের দেহ…?”
এক পুলিশ অফিসার নীচু গলায় বলল—“আমরা খুঁজে পাবো। কিন্তু তোমাদের শক্ত থাকতে হবে।”

অনিক চোখ বন্ধ করল। সে জানত, বন্ধুদের আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু অন্তত অন্ধকারের সত্য প্রকাশ পেল।

মশালের আলো নিভে গেল ধীরে ধীরে। গর্ভকক্ষের দেয়ালে আঁকা রক্তাক্ত ছবি এখন নিছক প্রমাণ। ভূতের ভয়, পূর্ণিমার ডাক, সব আসলে মানুষের তৈরি এক ফাঁদ।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল—এই অরণ্যের নিস্তব্ধতা, বাঁশির সুর—সবই কি কেবল প্রতারণা? নাকি সত্যিই এর গভীরে আছে অন্য এক অদৃশ্য অন্ধকার, যাকে এখনো স্পর্শ করা যায়নি?

চাঁদের আলো সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়ল। নদীর জল যেন কেঁপে উঠল নিঃশব্দে। আর অনিক অনুভব করল—রুদ্রর হাসি, সুমিতের কণ্ঠ, কোথাও ভেসে আছে, অদৃশ্য হয়ে।

পর্ব ৯ – জীবনমৃত্যুর লড়াই

সুড়ঙ্গের গর্ভকক্ষ তখনো ধোঁয়া আর আগুনের আঁচে ভরা। পুলিশের মশাল, কালোমুখোদের ধস্তাধস্তি আর চারপাশে চাপা আর্তচিৎকারে পরিবেশ অস্থির। দেবলীনা ঠায় দাঁড়িয়ে কাঁপছিল, চোখদুটো ভিজে অন্ধকারে আরও ডুবে গেছে। অনিকের বুকের ভেতর তখন তীব্র শ্বাসপ্রশ্বাস আর দপদপে রক্তস্রোত—বন্ধুদের হারানোর শোক আর প্রতিশোধের তীব্র ক্ষুধা একসঙ্গে জ্বালাচ্ছিল তাকে।

কালোমুখোদের মধ্যে কয়েকজনকে পুলিশ ধরে ফেলেছে, কিন্তু বাকিরা ছড়িয়ে পালাতে শুরু করেছে সুড়ঙ্গের গলিপথে। মশালের আলোয় তাদের ছায়া কেঁপে উঠছে। গলার কাছে বাঁশি ঝুলছে সবার। কেউ কেউ এখনো বাজাচ্ছে, তীক্ষ্ণ শিসের মতো সুর ভেদ করছে কান।

একজন অফিসার চিৎকার করল—“ওদের থামাও! জীবিত ধরা দরকার।”
অনিক হঠাৎই এক কালোমুখোর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটা বাঁশি ঠোঁটে তুলেছিল, কিন্তু অনিক তার মুখে ঘুষি মারতেই সে লুটিয়ে পড়ল। অনিক মাটিতে তার হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—“রুদ্র কোথায়? সুমিতের দেহ কোথায় রেখেছ?”
লোকটা ছটফট করছিল, কিন্তু উত্তর দিল না। অনিক তার গলায় চাপ বাড়াতেই লোকটা ফিসফিস করে বলল—“ওরা এখন দেবীর খাদ্য… তোমরা বাঁচতে পারবে না।”

অনিকের রাগে চোখ জ্বলে উঠল। সে লোকটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিল।

হরিদাস তখন দেয়ালের এক পাশে ঠেস দিয়ে বসে ছিল, হাঁপাচ্ছিল। তার চোখে ভয় আর স্বস্তি মিশে। সে বলল—“আমি ভেবেছিলাম, এই অন্ধকার কোনোদিন ধরা পড়বে না। আজ তোমরাই প্রমাণ করেছ।”

কিন্তু যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্ত থেকে হঠাৎই মশাল হাতে কয়েকজন কালোমুখো একসঙ্গে এগিয়ে এল। তাদের হাতে ছুরি, বাঁশি বাজছে তীব্র সুরে। মুহূর্তে ঘর ভরে গেল আতঙ্কে। পুলিশরা বন্দুক তুলল।

“থামো!” এক অফিসার গর্জে উঠল। “আর এগিয়ো না।”
কিন্তু কালোমুখোরা শোনেনি। তারা গলা ফাটিয়ে মন্ত্র পড়তে শুরু করল, যেন আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায়।

এক মুহূর্তে গুলির আওয়াজ কেঁপে উঠল সুড়ঙ্গে। বারুদে ঘ্রাণ মিশে গেল কাদার দুর্গন্ধের সঙ্গে। দুজন কালোমুখো পড়ে গেল মাটিতে। কিন্তু বাকিরা মরিয়া। তারা ছুরি উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশের ওপর।

অনিক তন্ময়কে টেনে আড়াল করল। তাদের সামনে এক ছুরি ঝলসে উঠেছিল। অনিক লাঠি কুড়িয়ে লোকটার হাতের ওপর আঘাত করল। ছুরি পড়ে গেল মাটিতে। মুহূর্তে সে লোকটার মুখোশ টেনে খুলে দিল।

দেবলীনা স্তব্ধ হয়ে গেল। এ সেই গ্রামের মুদি দোকানদার, যাকে তারা গতকাল খাবার কিনতে দেখেছিল। সাধারণ মানুষ—কিন্তু অরণ্যের অন্ধকারে পরিণত হয়েছে হত্যাকারীতে।

তন্ময় কণ্ঠ শুকিয়ে বলল—“মানে পুরো গ্রামটাই জড়িত?”
হরিদাস ফিসফিস করল—“সবাই নয়। কিন্তু কয়েকজন বহুদিন ধরে এ চক্র চালাচ্ছে। বাইরে লোকজনকে বোঝায় ভূতপ্রেতের গল্প। আর ভেতরে চলে রক্তের ব্যবসা।”

যুদ্ধ চলছিল। গুলির শব্দ থেমে থেমে কেঁপে উঠছিল। সুড়ঙ্গ ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছিল। কেউ চেঁচাচ্ছিল, কেউ দৌড়োচ্ছিল।

অনিক বুক দপদপ করতে করতে এগোল বেদীর দিকে। রুদ্রর টি-শার্ট, সুমিতের ব্যাগ এখনো পড়ে আছে। সে কাপড়গুলো হাতে তুলে নিল। বুক কেঁপে উঠল।
—“তোমাদের আর ফিরিয়ে আনা যাবে না,” সে ফিসফিস করে বলল। “কিন্তু তোমাদের রক্তে যারা হাত রাঙিয়েছে, তারা বাঁচবে না।”

ঠিক তখনই এক কালোমুখো পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিকের ওপর। ছুরির ঝলক চোখের সামনে। অনিক কেবল শরীর বাঁকিয়ে কোনোমতে এড়াল। লড়াই শুরু হল। ঘুষি, ধাক্কা, ছুরির ঝলক—মশালের আলোয় এক ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ। অনিক শেষ মুহূর্তে লোকটার হাত চেপে ধরে ছুরি ঘুরিয়ে দিল। ছুরির ফলায় আলো ঝলসে উঠল, আর লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

দেবলীনা চিৎকার করে উঠল—“অনিক!”
অনিক ঘাম ঝরাতে ঝরাতে দাঁড়াল। তার শার্টে রক্ত লেগে গেছে, কিন্তু সে বেঁচে আছে।

এদিকে পুলিশ ধীরে ধীরে কালোমুখোদের দমন করতে শুরু করেছিল। কয়েকজন বন্দি হল, বাকিরা পালাল অরণ্যের ভেতর। বাঁশির সুর থেমে গেল ধীরে ধীরে, কেবল নিস্তব্ধতা ভর করল।

সবাই হাঁপাচ্ছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। দেবলীনা অনিকের দিকে তাকিয়ে ভিজে চোখে বলল—“আমরা কি সত্যিই বেঁচে ফিরতে পারব?”
অনিক তার হাত ধরল। “যতক্ষণ লড়াই করছি, ততক্ষণ বাঁচব। রুদ্র আর সুমিতের আত্মা অন্তত শান্তি পাবে।”

বাইরে তখন পূর্ণিমার আলো সুড়ঙ্গের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছিল। রক্তের ওপর পড়ে সে আলো যেন অদ্ভুত লাল আভা ছড়াচ্ছিল। যুদ্ধ শেষ হলেও অরণ্যের ভেতর এখনো গোপন গর্জন বেঁচে ছিল, যেন এই লড়াই কেবল শুরু।

অনিক বুক সোজা করে দাঁড়াল। সে জানত, এখান থেকে পালানো মানেই শুধু বেঁচে থাকা নয়, সত্যিটাকে বাইরে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু সত্য সবসময় আলোয় টিকে থাকতে পারে তো? অরণ্যের অন্ধকার কি এত সহজে মুছে যায়?

এই প্রশ্ন তার বুকের ভেতরে চাপা আগুনের মতো জ্বলতে থাকল।

পর্ব ১০ – শেষ ভোর

সুড়ঙ্গের ভেতর ধোঁয়া তখনো ভাসছে। গুলির শব্দ থেমে গেছে, তবে বাতাসে এখনো বারুদের ঝাঁঝ, কাদার গন্ধ আর রক্তের কাঁচা তীব্রতা। পুলিশের হাতে ধরা পড়া কালোমুখোরা শৃঙ্খলিত, চোখে আতঙ্ক। আর যারা পালিয়েছে, তারা অরণ্যের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।

অনিক বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে। তার হাতে রুদ্রর টি-শার্ট, সুমিতের ব্যাগপ্যাক। বুকের ভেতর কাঁপন থামছে না। মনে হচ্ছিল, বন্ধুরা যেন এখানেই দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, ডাকছে। চোখ বন্ধ করলেই রুদ্রর গলা কানে ভেসে আসছে—“আরে, ভয় পেলে চলবে নাকি?” সুমিতের হাসি যেন হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। অনিকের চোখ ভিজে উঠল।

দেবলীনা এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে বলল—“চল, এখান থেকে বেরোই।”
অনিক মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আমাদের বাঁচতে হবে। ওদের জন্যই।”

পুলিশেরা সবাইকে নিয়ে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হচ্ছিল। ভোর আসছে। পাখিদের ডাক ভেসে আসতে শুরু করেছে। অথচ সেই স্বাভাবিক শব্দও আজ ভিন্ন মনে হচ্ছিল—যেন বহুদিন পরে প্রকৃতি তার আসল কণ্ঠ ফিরিয়ে পাচ্ছে।

অরণ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হরিদাস বলল—“এই অভিশাপ বহু বছর ধরে চলছিল। আমি ভেবেছিলাম, কোনোদিন এ সত্যি প্রকাশ পাবে না। তোমাদের সাহস না থাকলে আজও হয়তো চলত।”
তন্ময় ক্লান্ত গলায় বলল—“আমরা শুধু সত্য খুঁজতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর মূল্য দিতে হয়েছে রুদ্র আর সুমিতকে হারিয়ে।”

সবাই চুপ। শব্দহীন অশ্রু যেন নীরবতাকে আরও ভারী করে তুলেছিল।

গ্রামের দিকে নামতেই কয়েকজন বৃদ্ধ, নারী ও শিশু দৌড়ে এল। তাদের চোখ ভরা আতঙ্ক আর প্রশ্ন। পুলিশ বন্দিদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের মানুষদের কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিল—“ওরা আমাদের লজ্জা! আমাদের অভিশাপ!”

অনিক বুঝতে পারল, অরণ্যের ভয়, ভূতের গল্প আসলে ঢাল হয়ে কাজ করেছে। গ্রামও জানত, কেউ কেউ এসবের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ভয় আর চুপ থাকা, সেই কালো সত্যিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এতদিন।

নদীর ধারে এসে ট্রলারে উঠল সবাই। আকাশ তখন সোনালি হতে শুরু করেছে। পূর্ব আকাশে সূর্যের আলো নদীর জলে ঝিকমিক করছে। কুয়াশা সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

দেবলীনা ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ লাল, কণ্ঠ ভারী। “আমরা তো ফিরছি, কিন্তু সত্যিই কি শেষ হল সব? ওই বাঁশির সুর, ওই ছায়ামূর্তি—সবই কি কেবল মানুষের কাজ?”
অনিক তাকাল নদীর ওপারে, যেখানে অরণ্য আবার নীরব দাঁড়িয়ে। সে ধীরে বলল—“মানুষই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছায়া। কিন্তু হয়তো এর ভেতরে অন্য অন্ধকারও লুকিয়ে আছে, যেটা আমরা স্পর্শ করিনি।”

হরিদাস মৃদু শ্বাস ফেলল। “অরণ্য তার রহস্য রাখে নিজের কাছে। মানুষ চুরি করে, হত্যা করে, কিন্তু প্রকৃতির ভয় সবসময়ই আমাদের ছাপিয়ে যায়। তোমরা চলে যাচ্ছ, কিন্তু এই ডাক থামবে না।”

সেই মুহূর্তে বাতাসে যেন হালকা একটা শিস ভেসে এল। খুব ক্ষীণ, প্রায় অদৃশ্য। সবাই চুপ করে গেল। দেবলীনার শরীর কেঁপে উঠল। অনিকের বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতলতা নেমে এল।

কিন্তু সুরটা মিলিয়ে গেল ভোরের আলোয়। নদীর ওপর আলো ছড়িয়ে পড়ল, সূর্য উঠল ধীরে ধীরে। মনে হল, অন্ধকার পিছু হটছে।

ট্রলার এগোতে লাগল। তারা পিছনে ফেলে এল সেই অভিশপ্ত মন্দির, সেই সুড়ঙ্গ, সেই রক্তাক্ত ইতিহাস। কিন্তু তাদের চোখে চিরকাল থেকে যাবে রুদ্রর নিখোঁজ হওয়া, সুমিতের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, আর অরণ্যের অদৃশ্য ফিসফিস।

শেষবারের মতো অনিক পেছনে তাকাল। ঘন অরণ্য তখনও নিস্তব্ধ, রহস্যে মোড়া। যেন তার ভেতরে লুকিয়ে আছে আরও অনেক অজানা গল্প।

ভোরের আলোয় তারা বেঁচে ফিরল, কিন্তু অরণ্যের অন্ধকার তাদের রক্তে মিশে গেল চিরদিনের জন্য।

***

WhatsApp-Image-2025-08-26-at-6.09.07-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *