১
শহরের সকাল সবসময়ই ব্যস্ততার সঙ্গে শুরু হয়—বসন্তপুর নামের এই আধুনিক নগরীটা যেন ঘুমায় না। উঁচু উঁচু বহুতল ভবনের জানালা থেকে সূর্যের আলো গড়িয়ে এসে পড়ছে নিচের ব্যস্ত রাস্তায়, যেখানে গাড়ির হর্ন আর মানুষের ভিড় মিলেমিশে এক অদ্ভুত কোলাহল তৈরি করেছে। এই ভিড়ের মাঝেই প্রতিদিনের মতো পথ হাঁটছে বনলতা—পঁচিশ বছরের এক তরুণী, যার চেহারায় ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট হলেও চোখে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে নোটবুক, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গিমায় যেন কেবল দায়িত্ব পালন করার যান্ত্রিকতা। শহরের এই কোলাহল তাকে কখনোই আপন মনে হয়নি; বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভিড় তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সে এই ব্যস্ত মানুষের অংশ হলেও কোথাও যেন বিচ্ছিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ঢোকার আগে সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তাকায় রাস্তার অন্য প্রান্তে—লোকজন দৌড়াচ্ছে, ছোট ছোট কফিশপ থেকে ভেসে আসছে কফির গন্ধ, আকাশে উড়ছে ধুলো আর পাখির ডানা—সবকিছুই যেন এত পরিচিত অথচ তার কাছে একেবারেই অচেনা। বনলতা ভাবে, হয়তো জীবন এমনই হওয়ার কথা, তবুও তার বুকের ভেতর অজানা এক আকাঙ্ক্ষা কুরে কুরে খায়—কিছু যেন অসম্পূর্ণ, কিছু যেন অনুপস্থিত।
ক্লাসরুমে বসে থেকেও সে বারবার খেয়াল করে, তার মন পড়াশোনায় নেই। শিক্ষক লেকচার দিচ্ছেন, চারপাশে সহপাঠীরা নোট নিচ্ছে, কেউবা হাই তুলছে, কিন্তু বনলতার দৃষ্টি চলে যায় জানলার বাইরে। দূরে দেখা যায় শহরের এক কোণায় আকাশচুম্বী বিল্ডিং আর মানুষের অবিরাম ব্যস্ততা, কিন্তু তার কানে ভেসে আসে অন্য এক শব্দ—যেন কোথাও গভীর অরণ্যের ভেতর থেকে ভেসে আসছে পাতার খসখসানি, শালিক বা কাকের ডাক নয়, বরং বুনো পাখির অচেনা সুর। মাঝে মাঝেই সে অনুভব করে, যেন কারো দৃষ্টি তার ওপর স্থির হয়ে আছে, কিন্তু ঘুরে তাকালেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। এই অস্বস্তিকর অনুভূতি তাকে আরও একা করে তোলে। সহপাঠীদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে সে আলাদা হয়ে থাকে, যেন একটা দেয়াল তাকে আড়াল করে রেখেছে। তার বন্ধু মধুরা মাঝে মাঝে হাসাহাসি করে বলে—“তুই তো সবসময় ভাবনার জগতে থাকিস, যেন অন্য দুনিয়ার মানুষ।” বনলতা হাসে, কিন্তু অন্তরে কোথাও যেন মনে হয় কথাটা সত্যিই। অন্য দুনিয়া… হয়তো সত্যিই সে কোথাও অন্য দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু কেমন করে সেটা ব্যাখ্যা করবে? কেউই তো বুঝবে না। রাতে ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বনলতা নিজেকে দেখে, অচেনা লাগে নিজের চোখকেও। সেই চোখে কেবল ক্লান্তি বা শূন্যতা নয়, লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা তার নিজের কাছেও ধাঁধার মতো।
শহরের কোলাহল আর একাকীত্বের এই টানাপোড়েনে দিনগুলো একঘেয়ে হয়ে যায়, তবুও বনলতার অন্তরের গভীরে প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নেয় অদ্ভুত প্রশ্ন। কেন সে বারবার মনে করে, এই জীবন কেবল আংশিক, এর বাইরে আরেকটি জীবন তাকে টানছে? কেন রাতে ঘুমোতে গেলেই অদ্ভুত এক অরণ্যের গন্ধ তার নাকে এসে লাগে? কেন সে অনুভব করে, তার শরীরে বইছে এক অচেনা শক্তির ধারা, যা তাকে আলাদা করে তোলে অন্য সবার থেকে? শহরের ব্যস্ত সড়কে যখন সবাই দ্রুত পা চালায়, তখন বনলতা মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে, চারপাশের কোলাহল থেকে চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তের জন্য শুনতে চায় নিজের অন্তরের সুর। কিন্তু সেই সুর এত জটিল, এত গভীর যে, বোঝা যায় না তা কি বর্তমানের, নাকি কোনো অতীত জীবনের। দিন শেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরে, রাস্তায় ভিড় কমতে শুরু করে, আলো ঝলমলে বিলবোর্ডগুলো ঝলসে ওঠে, আর গাড়ির লাইটের রেখা শহরকে রঙিন করে তোলে। তবুও এই আলো, এই ভিড়, এই শহরের সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তার মনে হয়, এই সবকিছুই যেন এক কৃত্রিম মায়া—যা আসল জীবনের আড়াল মাত্র। বনলতার জীবনের প্রথম অধ্যায় এই শহরেই শুরু, কিন্তু সে টের পায়, তার ভেতরে যে শূন্যতা জেগে আছে, সেটাই একদিন তাকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যাবে। আর সেই পথের শুরু শহরের কোলাহল নয়, বরং অদ্ভুত এক অরণ্যের অচেনা ছায়ার মধ্যে।
২
সেই রাতে বনলতা ঘুমোতে গেল স্বাভাবিকভাবেই, শহরের কোলাহলে ক্লান্ত শরীর আর মন বিছানায় শুয়ে পড়তেই ধীরে ধীরে ডুবে গেল অচেতনতার গভীরে। কিন্তু এই ঘুমের ভেতরেই যেন শুরু হলো এক অন্য যাত্রা। চোখ মুদে থাকার মাঝেও হঠাৎ সে অনুভব করল চারপাশের বাতাস পাল্টে গেছে, কংক্রিটের দেয়াল আর বৈদ্যুতিক আলো মিলিয়ে গিয়ে জায়গা নিয়েছে ঘন অরণ্যের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। গায়ের ভেতর এক অদ্ভুত শীতলতা বয়ে গেল—যেন বনের ভেজা মাটি আর শ্যাওলা তার ত্বক ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে হঠাৎ বুঝতে পারল, তার হাতে কিছু ভারী বস্তু রয়েছে। চোখ খুলতেই দেখল, তার ডান হাতে ধরা তীর, আর বাঁ হাতে ধনুকের কাঠামো, যেটা সে আগে কখনো স্পর্শই করেনি, অথচ তার গ্রিপে যেন অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্য। চারপাশের গাছগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার দানবের মতো, আর পাতার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলো মাটিতে অদ্ভুত নকশা এঁকে দিয়েছে। বাতাসে শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত সব শব্দ—কোথাও শেয়ালের হাহাকার, কোথাও বুনো পাখির চিৎকার, আবার কোথাও শাখা ভাঙার শব্দ। এই অপরিচিত অথচ ভেতরে ভেতরে পরিচিত পরিবেশে দাঁড়িয়ে বনলতার বুকের ভেতর হঠাৎ করে জন্ম নিল এক অদ্ভুত সাহস। যেন সে জানে, এখানে সে দুর্বল নয়, এখানে সে শুধু একজন পথহারা মেয়ে নয়—এখানে সে শিকারিনী, রক্ষক।
তার পায়ের নিচে মচমচ শব্দ করে ভাঙা শুকনো পাতা চূর্ণ হচ্ছে, কিন্তু তার পদক্ষেপ আশ্চর্যরকম দৃঢ়। একসময় সে এগিয়ে গেল অরণ্যের গভীর দিকে, যেখানে আলো আরও ক্ষীণ, আর শব্দ আরও ভৌতিক। হঠাৎই শুনতে পেল ডান দিকের ঝোপে কোনো ভারী দেহ নড়াচড়া করছে। শিকারীর প্রবৃত্তি যেন আপনাতেই জেগে উঠল তার ভেতরে। সে হাঁটু ভেঙে নীচু হয়ে বসলো, হাতে ধনুক টানটান করে ধরল, আর চোখ স্থির করল ঝোপের দিকে। তার নিঃশ্বাস ধীর হয়ে এলো, হৃদস্পন্দন স্থির হয়ে গেল—যেন সে বহু বছরের অভ্যাসে প্রশিক্ষিত। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে ভুলেই গেল যে বাস্তবে সে শহরের সাধারণ এক মেয়ে; এখন সে সম্পূর্ণভাবে অন্য রূপে মিশে গেছে। হঠাৎ করে ঝোপ থেকে এক বুনো হরিণ লাফিয়ে বেরিয়ে এলো, তার চোখে ভয়ের ছাপ। হরিণটা দৌড়ে পালিয়ে গেল বনের গভীর দিকে। বনলতা ধনুক নামিয়ে ফেলল, তীর ছোড়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার ভেতর থেকে এক অচেনা করুণা জেগে উঠল। কিন্তু হরিণ চলে যাওয়ার পরও তার বুকের ভেতর সেই শিকারিনীর অনুভূতিটা থেকে গেল, যেন তার দেহের ভেতরে নতুন এক শক্তির প্রবাহ শুরু হয়েছে।
ঠিক সেই সময় দূরে কোথাও হঠাৎ ভেসে এলো ভিন্ন ধরনের শব্দ—গভীর, ভৌতিক, আর অমানবিক। বনলতার শরীর শিউরে উঠল। সেই শব্দটা ছিল না কোনো পশুর ডাক, না কোনো বাতাসের শব্দ। সেটা যেন কারো গম্ভীর গর্জন, কারো অন্ধকার উপস্থিতি। সে তাকাল বনপথের দিকে, আর সেখানে দেখল দুটো আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখ তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে। চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল, পাখির ডাক থেমে গেল, এমনকি বাতাসও যেন নিঃশব্দ হয়ে পড়ল। তার মাথার ভেতর হঠাৎই অদ্ভুত সব দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল—মানুষের চিৎকার, আগুনে জ্বলে ওঠা কুটির, আর অরণ্যের ধ্বংস। সেই চোখদুটো তাকে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কেবল শত্রু নয়—সে অন্ধকারের প্রতীক। বনলতার গা-জুড়ে ঠাণ্ডা ঘাম বেরোল, কিন্তু একই সঙ্গে বুকের ভেতর থেকে প্রবল সাহস ফেটে বেরোল। সে ধনুক হাতে তুলে নিল, তীর লাগাল, আর নিশানা করল সেই জ্বলন্ত চোখের দিকে। সেই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর যেন কারো কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো—“শিকারিনী, তুমি একা নও।” সে চমকে উঠল, কিন্তু ভয় পেল না। বরং তার ভেতরে অচেনা আত্মবিশ্বাস কাজ করল, যেন এই ভূমি, এই বন, এই দায়িত্ব তার নিজের। ধনুক টেনে ধরতেই সে অনুভব করল, চারপাশের অন্ধকার একটু নড়েচড়ে উঠেছে, যেন ছায়াটা বুঝতে পারছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কেবল সাধারণ মেয়ে নয়—সে শেষ শিকারিনী।
৩
বনের ঘন অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা বনলতার চোখে প্রথমবার ধরা দিল সেই অদ্ভুত সত্তা—জ্বলন্ত দুটি চোখ। দূর থেকে দেখতে পেলেও চোখদুটি এত তীক্ষ্ণ আর ভয়ার্ত যে বনলতার বুক কেঁপে উঠল। সারা বন তখন নিস্তব্ধ, পাখির কিচিরমিচির বা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক সব যেন হঠাৎ থেমে গেছে। চারপাশের বাতাস ঘন হয়ে আসছে, যেন প্রতিটি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখদুটি স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে বনলতার দিকে, একটুও নড়ছে না, তবু সেই দৃষ্টির ভেতর এমন এক শক্তি আছে, যা তার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, চোখদুটি যেন সরাসরি তার আত্মার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। বনলতার হাত কাঁপতে শুরু করল, কিন্তু ধনুক থেকে তীর নামায়নি। ভয় তাকে গ্রাস করলেও, তার ভেতরে হঠাৎ এক অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠল—এ লড়াই যেন আজকের নয়, বহু পুরনো। যেন এই চোখদুটোর সঙ্গে তার আগে কোথাও দেখা হয়েছে, অনেক আগে, হয়তো অন্য কোনো জীবনে। ভয়ের মধ্যেও তাই জন্ম নিল অদ্ভুত এক পরিচিতি, যা তাকে বিভ্রান্ত করে তুলল।
ছায়াটা ধীরে ধীরে নড়ল। কোনো স্পষ্ট দেহ নেই, কেবল কালো ধোঁয়ার মতো আকার, যার মাঝখান দিয়ে মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে মানুষের মতো হাত-পা, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। জ্বলন্ত চোখ দুটি আরও কাছে এলো, আর বনলতা শুনতে পেল ভেতরে ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো এক গর্জন—যা শব্দ নয়, বরং তার মনের ভেতরে প্রবেশ করা এক অন্ধকার কণ্ঠস্বর। “তুমি… আবার এসেছো।” শব্দটি মাথার ভেতরে বাজল, যেন তার নিজের চিন্তার সঙ্গে মিশে গেছে। বনলতা হঠাৎ পিছু হটল, কিন্তু তীর ছাড়ল না। তার বুকের ভেতর প্রবল ভয় কাজ করলেও সে বুঝতে পারছিল, পালালে কোনো লাভ নেই। এই ছায়া তার শত্রু, আর এ শত্রু কেবল আজকের নয়, বহু পুরনো। সে যেন নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলল—“আমি কোথায় তোমাকে দেখেছি?” এই প্রশ্ন তার মনের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, অথচ ছায়াটা যেন তার উত্তর জানে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাতাস ছুটে এলো, পাতাগুলো ঝড়ের মতো কাঁপতে লাগল, কিন্তু সেই ছায়াটা স্থির দাঁড়িয়ে রইল, চোখদুটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বনলতার মনে হলো, এ শুধু বন দখল করতে আসেনি, এ এসেছে তার আত্মাকে গ্রাস করতে।
হঠাৎ করেই বনলতার ভেতরে শক্তির ঢেউ বয়ে গেল। ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা সেই পুরোনো পরিচিতির অনুভূতি যেন সাহসে রূপান্তরিত হলো। সে ধনুক টানল, তীর তাক করল সেই চোখের দিকে, আর অদ্ভুতভাবে অনুভব করল—তার হাত কাঁপছে না আর। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে শক্ত করে ধরে আছে। ছায়ার গর্জন আরও তীব্র হলো, যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। বনলতার কানে ভেসে এলো মানুষের কান্নার শব্দ, মহিলাদের চিৎকার, শিশুদের আর্তনাদ—যেন অতীতের কোনো ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে এসেছে। হঠাৎ বুঝতে পারল, এ শত্রু কেবল এক অরণ্যের নয়, বহু মানুষের সর্বনাশের কারণ। আর তখনই তার বুকের ভেতর থেকে উচ্চারণ বেরিয়ে এলো—“এ লড়াই আমার।” সেই মুহূর্তে ছায়ার চোখদুটি আরও কাছে চলে এলো, অন্ধকার যেন তাকে গ্রাস করতে চাইছে, কিন্তু বনলতা দাঁড়িয়ে রইল। সে জানত না এ স্বপ্ন নাকি বাস্তব, সে জানত না এ যুদ্ধ তার বর্তমান জীবনের অংশ নাকি অতীতের কোনো অসমাপ্ত অধ্যায়—তবে সে নিশ্চিত ছিল, এ লড়াই তাকে করতেই হবে। ধনুকের তার টানটান হলো, আর বনলতা প্রস্তুত হলো সেই প্রথম আঘাতের জন্য, যে আঘাত হয়তো তাকে ভয়ংকর বিপদের দিকে নিয়ে যাবে, আবার হয়তো জাগিয়ে তুলবে তার আসল পরিচয়—শেষ শিকারিনী।
৪
পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বনলতা সিদ্ধান্ত নিল, আর নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। কয়েকদিন ধরে যে স্বপ্নগুলো তাকে গ্রাস করছে, যে জ্বলন্ত চোখ তাকে তাড়া করে ফিরছে, সে আর একা তা সহ্য করতে পারছে না। তাই ক্লাস শেষে সে সোজা চলে গেল ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অরিন্দমের ঘরে। অরিন্দম অধ্যাপক ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ—চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, মাথায় পাক ধরা চুল, সবসময় পুরোনো কাগজপত্র আর বইয়ের স্তূপে ডুবে থাকা। তার বিষয়ে শোনা যেত, তিনি লোককথা, প্রাচীন মিথ আর হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন। ছাত্রছাত্রীরা তাকে কখনো অতিমাত্রায় কল্পনাপ্রবণ বলে হাসাহাসি করত, কিন্তু বনলতা জানত, তার কাছে গেলে হয়তো কিছু উত্তর পাওয়া যাবে। অরিন্দম যখন বনলতার মুখের ক্লান্তি আর চোখের ভয়ের ছাপ লক্ষ্য করলেন, তিনি নীরবে চেয়ার টেনে দিলেন। বনলতা দ্বিধা ভাঙতে একটু সময় নিল, তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—কীভাবে প্রতি রাতে সে অরণ্যে চলে যায়, কীভাবে হাতে ধনুক-তীর থাকে, কীভাবে এক অদৃশ্য ছায়া তার সামনে আসে, আর কীভাবে মনে হয় এই লড়াই অনেক পুরোনো। প্রথমে তার গলা কাঁপছিল, কিন্তু বলতে বলতে মনে হলো যেন বুক হালকা হয়ে যাচ্ছে। অরিন্দম মন দিয়ে শুনছিলেন, মাঝে মাঝে চশমার কাচ মুছে আবার চোখে দিচ্ছিলেন, কিন্তু একবারও তাকে থামালেন না। সবটা শোনার পর তিনি গম্ভীরভাবে বললেন—“তুমি জানো, বাংলার লোককথায় এক শিকারিনী নারীর কথা আছে, যাকে শেষ শিকারিনী বলা হতো। তোমার স্বপ্নের সঙ্গে সেই কাহিনির আশ্চর্য মিল আছে।”
বনলতা চমকে উঠল। সে অবাক হয়ে তাকাল অধ্যাপকের দিকে—“শেষ শিকারিনী?” অরিন্দম ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে জানালেন, “হ্যাঁ, বহু বছর আগে আমাদের গ্রামীণ ইতিহাসে এক নারী ছিলেন, যিনি কেবল শিকার করতেন না, গ্রাম রক্ষা করতেন অশুভ শক্তির হাত থেকে। তিনি ছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত, পশুপাখি, গাছপালা সব যেন তাকে চিনত। লোকেরা বিশ্বাস করত, তিনি জন্মেছিলেন অশুভ শক্তিকে ঠেকাতে। কিন্তু একসময় হঠাৎ করে তিনি হারিয়ে যান, কেউ জানে না কোথায় বা কীভাবে। তারপর থেকে তাকে আর কেউ দেখেনি, কেবল গল্পে বেঁচে আছে তার নাম। গ্রামগুলোতে আজও রাতের আগুনের পাশে বসে বয়স্করা সেই শিকারিনীর কাহিনি শোনায়। লোকেরা বলে, তিনি ছিলেন শেষ রক্ষক, কারণ তার পর আর কেউ সেই দায়িত্ব নেয়নি।” বনলতার বুক কেঁপে উঠল। স্বপ্নে দেখা ধনুক-তীর, বন, আর অন্ধকার ছায়ার সঙ্গে এই কাহিনি অদ্ভুতভাবে মিলে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল—“তাহলে… আমি কি?” অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, “আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি—তোমার স্বপ্ন কেবল সাধারণ স্বপ্ন নয়। হয়তো অতীতের কোনো ছাপ তোমার ভেতরে লুকিয়ে আছে। কখনো কখনো মানুষের জীবনে এমন ঘটে, যখন বর্তমান আর অতীত একসূত্রে বাঁধা থাকে। হয়তো তুমি সেই শিকারিনীর উত্তরাধিকার বহন করছো।”
এই কথা শোনার পর বনলতার ভেতরে ভয় আর কৌতূহল মিশ্রিত এক প্রবল ঢেউ বয়ে গেল। এতদিন সে ভেবেছিল এসব কেবল দুঃস্বপ্ন, হয়তো অবচেতনের খেলা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এর পেছনে কোনো গভীর সত্য লুকিয়ে আছে। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, আকাশে মেঘ জমছে, আলো কমে আসছে, বাতাসে অদ্ভুত ভারী ভাব। মনে হলো শহরের মাঝেও সেই অরণ্যের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। অরিন্দম শান্ত গলায় বললেন—“তুমি যদি সত্যিই এই উত্তরাধিকার বহন করো, তবে সতর্ক থাকতে হবে। যে ছায়াটাকে তুমি দেখছো, হয়তো সেটাই সেই অশুভ শক্তি, যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লুকিয়ে ছিল। সময় এসেছে আবার তা জেগে উঠার। তোমাকে বুঝতে হবে, তোমার ভূমিকা কী।” বনলতা মাথা নত করে বসে রইল। তার মনে হলো, তার চারপাশের পৃথিবী এক মুহূর্তে পাল্টে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা ঘর, বইয়ের স্তূপ, জানলার বাইরের ভিড়—সব যেন আবছা হয়ে গেছে, আর স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই অরণ্যের ছায়া। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে ভয়, কিন্তু একই সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে এক অচেনা দায়িত্ববোধ। মনে হচ্ছে, এই পথ থেকে আর ফিরে আসা যাবে না। এ পথই হয়তো তার নিয়তি—শেষ শিকারিনীর ডাক।
৫
সেই রাতেই বনলতার স্বপ্ন যেন আরও গভীর স্তরে প্রবেশ করল। এবার আর কেবল অস্পষ্ট অরণ্য বা ছায়ার চোখ নয়—সে স্পষ্টভাবে দেখতে পেল নিজেকে অন্য এক জীবনে। ঘুমের মধ্যে তার চারপাশ পাল্টে গেল, শহরের কোলাহল মুছে গিয়ে জায়গা নিল এক প্রাচীন গ্রাম। ছোট ছোট কুঁড়েঘর, ধোঁয়ায় ভরা রান্নার চুলা, শিশুদের খেলা, আর চারপাশে বিস্তৃত অরণ্য। গ্রামের মানুষজনের মুখে ভয়ের ছাপ—তারা চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, যেন কোনো ভয়ংকর শক্তি তাদের গ্রাস করতে চলেছে। ঠিক এই মুহূর্তেই সে নিজেকে দেখল এক ভিন্ন রূপে। তার গায়ে পশুর চামড়ার তৈরি পোশাক, কাঁধে ঝুলছে তীরভরা ঝুলি, হাতে ধনুক, আর চোখে সেই অদম্য দৃষ্টি। গ্রামের প্রবীণরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কাঁদছে, কেউ প্রার্থনা করছে। তারা সবাই তাকে “শেষ শিকারিনী” বলে ডাকছে। বনলতা—অথবা তার স্বপ্নের মধ্যে যিনি সেই শিকারিনী—হৃদয়ে অনুভব করল এক বিশাল দায়িত্বের ভার। গ্রাম বাঁচানো, মানুষ রক্ষা করা, আর অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো—এই কাজ কেবল তারই। সে বুঝতে পারল, এ গ্রামে আর কেউ নেই যে এই দায়িত্ব নিতে পারে। প্রকৃতি যেন তাকে বেছে নিয়েছে শেষ রক্ষক হিসেবে।
অরণ্যের ভেতর তখন দাপট চালাচ্ছিল সেই অশুভ শক্তি। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে, পশুপাখি ভয়ে পালাচ্ছে, রাতের অন্ধকারে শোনা যাচ্ছে অমানবিক গর্জন। গ্রামের মানুষদের চোখে আতঙ্ক, তারা জানত, শিকারিনী ছাড়া কেউ এই শক্তিকে থামাতে পারবে না। শিকারিনী বনলতা এগিয়ে গেল বনের গভীরে, যেখানে অন্ধকার আরও ঘন, বাতাস আরও ভারী। তার কানে ভেসে এলো প্রবীণের কণ্ঠস্বর—“স্মরণ রেখো, তুমি কেবল শিকার করো না, তুমি রক্ষক। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হলে অশুভ শক্তি তোমাকে ছুঁতে পারবে না।” সে গভীর নিশ্বাস নিল, মাটির গন্ধে ভরে উঠল তার বুক। বনের প্রতিটি শব্দ যেন তাকে ইশারা দিচ্ছিল, প্রতিটি গাছ যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ঠিক তখনই ছায়াটি আবির্ভূত হলো—আগের মতোই কালো ধোঁয়ার মতো দেহ, জ্বলন্ত চোখ, আর তার চারপাশে অন্ধকারের ঝড়। বনলতা অনুভব করল ভয়ের শীতল স্পর্শ, কিন্তু তার হাত কাঁপেনি। ধনুক তুলে ধরল, তীর বসাল, আর নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিশানা করল। তার শরীর আর মন এক হয়ে গেল, যেন পুরো বন তার সঙ্গে শ্বাস নিচ্ছে।
যুদ্ধ শুরু হলো। ছায়াটি গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, অন্ধকার ঢেউয়ের মতো ছুটে এলো তার দিকে। শিকারিনী বনলতা তীর ছুঁড়ল একের পর এক, প্রতিটি তীর অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়াল। ছায়াটি আঘাতে পিছিয়ে গেলেও বারবার ফিরে আসছিল, যেন তাকে গ্রাস না করা পর্যন্ত থামবে না। গ্রাম থেকে মানুষদের আর্তনাদ ভেসে আসছিল, তারা জানত তাদের রক্ষক লড়াই করছে জীবনের বাজি রেখে। বনলতার মনে হলো, প্রতিটি তীরের সঙ্গে শুধু তার শক্তিই নয়, পুরো গ্রামের আশা মিশে যাচ্ছে। সে লড়ছে কেবল নিজের জন্য নয়, অগণিত প্রাণের জন্য। লড়াই দীর্ঘ হলো, প্রতিটি আঘাতে তার শরীর ক্লান্ত হচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরের সাহস নিভছিল না। অবশেষে এক তীর ছুটে গিয়ে সরাসরি বিদ্ধ করল ছায়ার চোখদুটো। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ আলোয় ভরে উঠল, বন কেঁপে উঠল, আর অশুভ শক্তির গর্জন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ছায়াটি ছিন্নভিন্ন হয়ে বাতাসে মিশে গেল, শুধু তার প্রতিধ্বনির ভয়ংকর শব্দ কিছুক্ষণ প্রতিধ্বনিত হলো। গ্রামের মানুষরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আগুনের চারপাশে নাচতে লাগল, শিকারিনীকে দেখে হাত জোড় করে কৃতজ্ঞতা জানাল। কিন্তু সেই উল্লাসের মাঝেও শিকারিনী বনলতা জানত, এই লড়াই শেষ নয়। অশুভ শক্তি হয়তো আবার ফিরবে, আর হয়তো তাকে আবার লড়াইয়ে নামতে হবে। তবে আপাতত সে “শেষ শিকারিনী” হিসেবে নিজের দায়িত্ব পূর্ণ করেছে—মানুষকে বাঁচিয়েছে, বনকে রক্ষা করেছে, আর প্রমাণ করেছে, প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে তার জন্ম বৃথা নয়।
৬
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিড়ভাট্টা ও স্বাভাবিক ক্লাসের আড়ালে বনলতার ভেতরের পরিবর্তনটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। মধুরা, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রথমেই সেটা টের পেল। আগের মতো আর হাসিখুশি নেই বনলতা, ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়, যেন চোখের দৃষ্টি কোথাও দূরে অরণ্যের গভীরে আটকে আছে। একদিন মধুরা খেয়াল করল, বনলতার হাতের তালুতে ছোট ছোট দাগ—মনে হলো যেন কোনো ধারালো তীর বা ধনুকের সুতোর ঘষা লেগে তৈরি হয়েছে। অথচ সে তো শহরের মেয়ে, এসব জিনিস কখনো স্পর্শই করেনি! মধুরা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো ক্লান্তি বা মানসিক চাপের কারণে বনলতা এমন করছে, কিন্তু ধীরে ধীরে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। বনলতার মুখে মাঝেমধ্যে এমন কথা বেরিয়ে আসতে লাগল, যা শুনে মধুরার শরীর শিউরে উঠত—“অরণ্য ডাকছে আমাকে,” অথবা “ছায়াটা এখনও বেঁচে আছে।” রাতে হোস্টেলের ঘরে শুয়ে থাকাকালীন মধুরা কয়েকবার শুনেছে, বনলতা ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছে, কখনো ভয়ে কেঁপে উঠছে, কখনো ধনুক ধরার ভঙ্গি করছে। এসব দেখে মধুরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল তার বন্ধু হয়তো ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।
এক সন্ধ্যায় মধুরা সাহস করে বনলতার মুখোমুখি হলো। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তোকে কী হচ্ছে, বনলতা? তুই কদিন ধরে এমন আচরণ করছিস কেন? তুই কি আমাকে কিছুই বলবি না?” বনলতা প্রথমে চুপ করে রইল, তারপর ধীরে ধীরে তার স্বপ্নের কথা খুলে বলতে লাগল। অরণ্যের দৃশ্য, ধনুক-তীর, ছায়ার চোখ, আর গ্রামের শেষ শিকারিনী হওয়ার কাহিনি—সব কিছু সে মধুরাকে বলল। মধুরা অবিশ্বাসে হেসে ফেলেছিল প্রথমে। “তুই কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস? এগুলো কেবল দুঃস্বপ্ন, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।” কিন্তু বনলতার চোখের দৃষ্টি তাকে থামিয়ে দিল। সেই চোখে ভয় আর দায়িত্বের মিশেল দেখে মধুরা কেঁপে উঠল। সে বুঝল, এটা কেবল দুঃস্বপ্ন নয়—বনলতার ভেতরে সত্যিই কিছু একটা ঘটছে, যা সাধারণ মানুষের বাইরে। তবুও মধুরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। কয়েকদিন সে বনলতার থেকে দূরে দূরে থাকল, মনে হচ্ছিল তার বন্ধু আর সেই আগের মানুষটা নেই, যেন অন্য কোনো অচেনা সত্তা তার ভেতরে বাস করছে। হোস্টেলের করিডরে বনলতার পায়ের শব্দ শুনলেও মধুরার বুক ধড়ফড় করে উঠত, রাতের আঁধারে জানলার ফাঁক দিয়ে যদি তার ছায়া দেখা যেত, মধুরা আঁতকে উঠত।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে মধুরার ভয়ের জায়গা নিতে শুরু করল সহমর্মিতা। এক রাতে, যখন বনলতা দুঃস্বপ্নে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল আর ঘামে ভিজে কাঁপছিল, মধুরা এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তখনই প্রথমবার সে অনুভব করল, বনলতা সত্যিই একা নয়, তার ভেতরে একটা ভারী যুদ্ধ চলছে। মধুরা তখন আর ভয়ের কারণে দূরে থাকল না, বরং পাশে দাঁড়াল। সে বলল, “যা-ই হোক, আমি তোর সঙ্গে আছি। তুই যদি সত্যিই সেই শিকারিনী হোস, তবে আমিও তোর সঙ্গী হব। তুই একা লড়বি না।” বনলতার চোখে জল চলে এলো, কারণ প্রথমবার কেউ তার কথায় বিশ্বাস করল, তাকে উন্মাদ ভাবল না। সেই মুহূর্ত থেকে মধুরা হয়ে উঠল তার শক্তি। ক্লাসের ফাঁকে, হোস্টেলের নির্জন বারান্দায়, কিংবা লাইব্রেরির কোণে—বনলতা যখনই স্বপ্নের কথা বলতে চাইত, মধুরা মন দিয়ে শুনত। মধুরা ভয় পেলেও চেষ্টা করত বোঝার, এমনকি সে নিজেই পুরোনো বই খুঁজে দেখতে লাগল, যদি কোনো কাহিনি বা সূত্র পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে বনলতা বুঝতে পারল, মধুরা শুধু বন্ধু নয়, তার এই যাত্রায় প্রথম সহযাত্রী। যদিও মধুরার হৃদয়ে এখনও আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল, তবুও সে জানত, তার বন্ধুকে ছেড়ে যাওয়ার মতো মুহূর্ত এটা নয়। বনলতার যুদ্ধ শুরু হয়েছে, আর মধুরা নিজের ভেতরের ভয়কে পেছনে ফেলে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।
৭
শহরের ব্যস্ততার ভেতরেও বনলতার অস্বস্তি ক্রমশ বাড়ছিল। দিনের বেলায় ক্লাস, আড্ডা, লাইব্রেরি—সব কিছুর মাঝেও সে টের পাচ্ছিল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। অথচ চারপাশ তাকালে কাউকে দেখা যায় না। তার মনের ভেতরে কেমন এক চাপা ভয় দানা বাঁধছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো এই সবই কেবল কল্পনা, তার স্বপ্নের অবশিষ্ট ছাপ। কিন্তু যত দিন গড়াল, ততই বোঝা গেল এটা নিছক ভ্রম নয়। রাতে হোস্টেল থেকে ফেরার পথে, যখন রাস্তা প্রায় ফাঁকা, তখন তার মনে হতো কেউ খুব কাছে পায়ের শব্দ ফেলে আসছে। কিন্তু পিছনে তাকালেই ফাঁকা ফুটপাত, একটাও মানুষ নেই। শহরের নীয়ন আলোয় ভিজে থাকা দেওয়ালের গায়ে সে মাঝে মাঝে নিজের ছায়ার সঙ্গে আরেকটি লম্বা ছায়া মিশে যেতে দেখত। এক রাতে হঠাৎ সে জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠল—তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এক অন্ধকার ছায়া, চোখদুটি আগুনের মতো জ্বলছে। সে ঘুরে তাকাতেই কিছু নেই, কেবল ফাঁকা ঘর। এই অদ্ভুত উপস্থিতি তাকে যেন প্রতিটি মুহূর্তে তাড়া করছিল, এক মুহূর্তও নিস্তার দিচ্ছিল না। এমনকি ক্লাসরুমের ভিড়েও, চারপাশের মানুষের মাঝে, সে অনুভব করত সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে ভেদ করছে।
শহরের কোলাহল যেখানে প্রতিটি শব্দ মানুষকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে, সেখানে বনলতার কাছে এই ছায়ার অনুপ্রবেশ আরও অস্বাভাবিক লাগছিল। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও সে যেন নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করত। একবার মেট্রোর ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, সামনের আয়নার প্রতিফলনে সে নিজের মুখের পাশে ঝাপসা এক কালো অবয়ব দেখছে। গর্জন না থাকলেও, চোখের তীব্রতা এতটাই ছিল যে বনলতা শ্বাস নিতে পারছিল না। সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, মধুরা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল তাকে। মধুরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে?” বনলতা তখন কিছু বলতে পারেনি, শুধু কাঁপা গলায় বলেছিল, “ও আবার এসেছে।” দিন যত গড়াল, তার ভেতরে এই ভয়ের দাপট বাড়তে লাগল। রাতে আয়নায় মুখ ধোওয়ার সময় হঠাৎই চোখের কোণায় অন্ধকার নড়তে দেখত, ঘুম ভাঙলে মনে হতো কেউ বিছানার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে শহরের প্রতিটি কোণা যেন তার কাছে ভয়ের গোলকধাঁধা হয়ে উঠল। মানুষজনের হাসি, গাড়ির হর্ন, দোকানের কোলাহল—সব কিছুর আড়ালে যেন দাঁড়িয়ে আছে সেই ছায়া, যে তাকে ছাড়তে চাইছে না।
বনলতা জানত, এটা কেবল স্বপ্নের অবশিষ্ট নয়, বরং সেই অশুভ শক্তি আধুনিক শহরের দেয়াল ভেদ করে তার জীবনে ঢুকে পড়েছে। এটা আর গ্রাম কিংবা প্রাচীন অরণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই—এবার বাস্তবতার ভেতরেও তার শিকার শুরু হয়েছে। এ সত্যটা উপলব্ধি করেই বনলতার শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তার অতীত জীবনের সঙ্গে যুক্ত লড়াই এখনকার জীবনের প্রতিটি শ্বাসে মিশে গেছে। হয়তো শহরের মানুষ এখনো কিছু টের পায়নি, কিন্তু ছায়া তাকে বেছে নিয়েছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে। মধুরাকে সে যখন এসব বলল, মধুরার চোখে আতঙ্ক আবার জেগে উঠল, কিন্তু এবার সে পিছু হটেনি। বরং বলল, “তুই একা না, বনলতা। যদি ছায়া শহরে ঢুকে পড়ে থাকে, তবে আমরা একসাথে লড়ব।” বন্ধুর কথায় বনলতা সামান্য সাহস পেল, কিন্তু মনের ভেতর সে জানত—অশুভ শক্তি এবার আর কেবল অতীত নয়, বাস্তবের প্রতিটি আয়নায়, প্রতিটি ছায়ায়, প্রতিটি অন্ধকার গলিতে তার পিছু নিচ্ছে। যুদ্ধের আসল শুরু এখনো বাকি, আর শহরই এবার তার নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।
৮
সেই রাতে বনলতার ঘুম খুব অশান্ত ছিল। দিনের ভিড়ভাট্টার মাঝেও যে অশুভ ছায়া তাকে ঘিরে রেখেছিল, তা তার নিঃশ্বাসে ভার হয়ে জমে ছিল। চোখ বন্ধ করার পরপরই সে আবার সেই অরণ্যে চলে গেল। চারদিকে অন্ধকার, কিন্তু ওপরে চাঁদের আলোয় রূপালি আভা ছড়িয়ে পড়েছিল। বনলতা বুঝতে পারল, এ রাত অন্যরকম। অরণ্যের বাতাসে ছিল না শুধু ভয় বা হাহাকার, বরং এক গভীর প্রত্যাশা। হঠাৎই গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা দিলেন এক প্রবীণ ব্যক্তি—শুকনো মুখ, লম্বা দাড়ি, হাতে লাঠি, চোখে যেন শতাব্দীর জ্ঞান জমে আছে। তার চাহনিতে কোনো আতঙ্ক ছিল না, বরং এক শান্ত অথচ গভীর দৃঢ়তা। বনলতা জানল, এ মানুষটি গ্রামসংলগ্ন অরণ্যের প্রবীণ, যিনি স্বপ্নে এসেছেন তাকে ডাকতে। প্রবীণ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন, “বনলতা, তুই শুধু শিকারিনী নয়, তুই সেই রক্ষক, যে প্রকৃতির ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য জন্ম নিয়েছে। শিকারিনী কেবল গ্রাম রক্ষা করে না, সে পৃথিবীর জীবনধারার ভারসাম্য টিকিয়ে রাখে।” প্রবীণের কণ্ঠস্বরে বনলতার বুক কেঁপে উঠল—সেটা কোনো সাধারণ উপদেশ নয়, বরং দায়িত্বের ঘোষণা।
বনলতা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো এ যুগের মেয়ে। শহরের অট্টালিকা, আলো, কোলাহল—এসবের মধ্যে কোথায় সেই অরণ্যের টান? কীভাবে আমি আবার সেই শিকারিনী হব?” প্রবীণের চোখে জ্বলল গভীর দৃষ্টি। তিনি বললেন, “অশুভ শক্তি যুগে যুগে রূপ পাল্টে আসে। কখনো অরণ্যের আঁধারে, কখনো শহরের ভিড়ে। তুই যাকে ছায়া দেখছিস, সেটা আসলে সেই একই অশুভ শক্তি, যা তোর অতীতে ছিল। তোর দায়িত্ব থেকে তুই পালাতে পারবি না। কারণ পৃথিবী যখন ভারসাম্য হারায়, তখন শিকারিনী আবির্ভূত হয়।” বনলতা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ভেতরে ভয়ের ঢেউ উঠল বটে, কিন্তু সেই ভয়কে চাপা দিয়ে এক অদ্ভুত সাহসও জন্ম নিচ্ছিল। প্রবীণ যেন তার হৃদয়ের ভিতরটা দেখে নিচ্ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। সেই স্পর্শ যেন উষ্ণ অথচ অগ্নির মতো তীব্র। বনলতা অনুভব করল, তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা শক্তি আবার জেগে উঠছে। হঠাৎই সে দেখতে পেল নিজের হাতে ধনুক, পিঠে তীরভরা ঝুলি। বাতাসে অরণ্যের ডাক আরও তীব্র হয়ে উঠল।
প্রবীণ আবার বললেন, “বনলতা, তুই ভাবিস না এটা শুধু তোর লড়াই। তোর সাহস অন্যদেরও জাগাবে। তুই যে শহরে বাস করিস, সেখানেও এই অশুভ শক্তির বিস্তার ঘটবে। গাছপালা, নদী, প্রাণী, এমনকি মানুষের মন—সবই ভারসাম্য হারাচ্ছে। তুই যদি দাঁড়াস না, তবে ছায়া কেবল তোকে নয়, পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করবে।” বনলতার চোখে জল চলে এলো। সে বুঝল, তার ভেতরের দ্বন্দ্ব আর চলবে না। সে কেবল স্বপ্নের বন্দি হতে পারবে না, তাকে লড়তে হবে বাস্তবতাতেও। ধীরে ধীরে প্রবীণের অবয়ব ঝাপসা হয়ে গেল, কিন্তু কণ্ঠস্বর রয়ে গেল বাতাসে—“তুই সেই শেষ শিকারিনী, বনলতা। তুই না দাঁড়ালে কেউ দাঁড়াবে না।” স্বপ্ন ভেঙে যখন বনলতা জেগে উঠল, জানলার বাইরে তখন ভোরের আলো। চারদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু তার বুকের ভেতরে স্পষ্ট প্রতিধ্বনি হচ্ছিল প্রবীণের সেই কথা। ভয় আর দ্বিধার জায়গা নিয়ে নিয়েছিল সংকল্প। সে জানত, যুদ্ধ এখন কেবল শুরু হলো।
৯
শহরের সেই রাতটা যেন অস্বাভাবিক অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। বিদ্যুতের আলো হঠাৎই ম্লান হয়ে আসছিল, রাস্তার বাতিগুলো একে একে নিভে যাচ্ছিল, আর কোলাহলমুখর শহর অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ হয়ে উঠছিল। বনলতা অনুভব করল, ছায়ার উপস্থিতি এবার আর লুকিয়ে নেই—সে প্রকাশ্যে এসেছে, তার চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। অট্টালিকার কাঁচে, দোকানের শাটারে, এমনকি ভেজা রাস্তায় জমে থাকা জলে সে দেখতে পেল জ্বলন্ত চোখের প্রতিফলন। অন্ধকার যেন শহরকে গ্রাস করছে, আর সেই অন্ধকারের ভেতরে ঘনিয়ে উঠছে অশুভ শক্তির দমবন্ধ করা ছাপ। মধুরা তখনও তার পাশে, কিন্তু আতঙ্কে কাঁপছে। বনলতা মধুরার হাত ধরে বলল, “ভয় পাস না, এ লড়াই আমার। তবে তুই কাছে থাকিস।” ঠিক তখনই সামনে ফুটপাথ ফেটে উঠে যেন অন্ধকার তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেখান থেকে বেরিয়ে এলো সেই ভয়ঙ্কর ছায়া—লম্বা দেহ, জ্বলন্ত চোখ, মুখহীন অথচ প্রাণঘাতী উপস্থিতি। বনলতার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু এবার তার পলায়ন করার সুযোগ ছিল না। শহরের হৃদয়ে, নীয়ন আলোয় মোড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে বুঝল, এটাই সেই চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের রাত।
ছায়ার শক্তি ছিল অপ্রতিরোধ্য। সে যেন বাতাসকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। গাড়িগুলো হঠাৎই একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল, মানুষ চিৎকার করে পালাতে লাগল, অথচ তারা আসল বিপদটাকে দেখতে পাচ্ছিল না। বনলতা টের পেল, এই যুদ্ধ শুধুই তার দৃষ্টির ভেতর সীমাবদ্ধ নয়, বরং শহরের শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। ছায়া এগিয়ে আসতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই প্রবীণের কণ্ঠস্বর—“তুই শেষ শিকারিনী।” হঠাৎই তার বুকের ভেতরে আলো জ্বলে উঠল, হাতে ভারী কিছু অনুভব করল। যখন নিচের দিকে তাকাল, দেখল তার হাতে আবার ফিরে এসেছে সেই ধনুক, আর কাঁধে ঝুলছে তীরভরা ঝুলি। এটা কেবল অস্ত্র নয়, বরং তার আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উত্তরাধিকার। ছায়া প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে আঘাত করতেই চারপাশের বাতাসে বিস্ফোরণ ঘটল, কিন্তু বনলতা ধনুক তুলে ধরে তীর ছুড়ে মারল। আলোতে ভরা সেই তীর অন্ধকারকে ভেদ করে ছায়ার দেহে বিদ্ধ হলো। ছায়া কেঁপে উঠল, কিন্তু সাথে সাথে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বনলতা বুঝল, এই লড়াই সহজ নয়, প্রতিটি মুহূর্তে তার জীবন ঝুঁকির মুখে।
কিন্তু ভয় আর তাকে গ্রাস করতে পারল না। তার ভেতরে যে শিকারিনী সত্তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুমিয়ে ছিল, আজ তা জেগে উঠেছে। প্রতিটি তীর ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছিল। শহরের অন্ধকার রাস্তাগুলো যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো—ভাঙা কাঁচের শব্দ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আর তীব্র অন্ধকারের মাঝে বনলতা দাঁড়িয়ে লড়ছিল। ছায়া বারবার তাকে ধ্বংস করতে চাইছিল, তার চারপাশে বিভ্রম তৈরি করছিল, কখনো একাধিক অবয়ব নিয়ে হাজির হচ্ছিল, কখনো সরাসরি তার মন আক্রমণ করছিল। বনলতার চোখের সামনে হঠাৎই ভেসে উঠেছিল ভয়ঙ্কর দৃশ্য—মধুরা রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। সে চিৎকার করে উঠেছিল, কিন্তু মুহূর্তেই বুঝেছিল, এটা ছায়ার ফাঁদ। দাঁত চেপে সে আবার ধনুক টানল, এবার তীরের আগুন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তীর আঘাত হানল ছায়ার হৃদয়ের মাঝখানে, আর সেই মুহূর্তে শহরের বাতাসে অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে গেল। ছায়ার দেহ ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ল, জ্বলন্ত চোখ নিভে গেল। অন্ধকার পিছিয়ে গেল, বাতি আবার জ্বলে উঠল, আর শহর যেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বনলতা হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল, হাতে ধরা ধনুক এখনও আলোকিত। মধুরা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বনলতা তখন জানত, এই লড়াই শেষ হলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি। আজ সে নিজের সত্তাকে চিনেছে, শিকারিনী হিসেবে আবার জন্ম নিয়েছে, আর সামনে আসবে আরও ভয়ঙ্কর পরীক্ষার সময়।
১০
যুদ্ধের ধুলো স্তব্ধ হয়ে গেলে, বনলতার চারপাশের পৃথিবী যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় ডুবে যায়। প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে অতীতের ছায়াগুলো অনুভব করতে পারে—সেই দিনগুলো যখন সে প্রথমবার অশুভ শক্তির মুখোমুখি হয়েছিল, যখন তার ভেতরের শক্তি এবং দুর্বলতা একে অপরের সাথে লড়ছিল। মনের ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, তবে এইবার সে বুঝতে পারে যে, লড়াই কেবল ফাইনাল ফ্রন্ট নয়; এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ, যা শেষ হওয়ার নয়। শহরের ধ্বংসস্তূপের মাঝেই সে খুঁজে পায় নিজের অন্তর্গত শক্তির নতুন মাত্রা—একটি শক্তি যা শুধু তার আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং অন্যদের রক্ষা করার দায়িত্বও বহন করে। বনলতা উপলব্ধি করে, যে যে অন্ধকারের সঙ্গে সে লড়াই করেছে, তা শুধু এককালীন নয়; এই অশুভ শক্তির ছায়া সারা জীবনের জন্যই তার সঙ্গে থাকবে। এই উপলব্ধি তাকে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা দেয়। অতীতের কষ্ট, বন্ধুরা যে হারিয়েছে, এবং যে বিপদগুলো সে পার করেছে—সবই একত্রে তাকে একটি দায়িত্ববান রক্ষক হিসেবে তৈরি করেছে। প্রতিটি ক্ষত এবং ক্ষুদ্র জয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে শক্তি, যা তাকে শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, সমগ্র শহর এবং ভবিষ্যতের জন্যও প্রস্তুত করে।
যুদ্ধের অবশেষে বনলতার মনে একটি গভীর দায়িত্ববোধ জন্মায়। সে জানে যে, অশুভ শক্তি যদিও এই মুহূর্তে পরাজিত হয়েছে, তবে এটি চিরতরে নিস্তেজ নয়। তার চোখের সামনে শহরের ধ্বংসস্তূপ, এবং নিঃশব্দ রাস্তাগুলো যেন আগের মতোই কোনো হুমকির অপেক্ষায়। এই অনুভূতি তাকে ভীত করে না, বরং শক্তিশালী করে। বনলতা বুঝতে পারে, রক্ষা করার ক্ষমতা শুধু অস্ত্র বা যাদুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আসে ধৈর্য, পর্যবেক্ষণ এবং অন্তর্দৃষ্টি থেকে। ভবিষ্যতের বিপদ মোকাবিলার জন্য তাকে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ এখন গুরুত্বপূর্ণ। সে অনুভব করে যে, তার জীবন শুধুমাত্র নিজের জীবনের জন্য নয়; এটি একটি উত্তরাধিকার, যা সে আগের প্রজন্ম থেকে পেয়েছে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। এই দায়িত্বের মহিমা তাকে বিস্মিত করে, এবং সাথে সাথে নির্ভীকও করে। বনলতার ভেতরের শক্তি, যা আগে কখনও এত স্পষ্ট ছিল না, এখন পুরোপুরি উন্মুক্ত। এটি তাকে শেখায়, যে সত্যিকারের রক্ষক হওয়া মানে শুধু লড়াই করা নয়; মানে হলো জীবন, আশা এবং ভবিষ্যৎকে ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে রক্ষা করা।
শেষ প্যারাগ্রাফে বনলতা উপলব্ধি করে যে, তার যাত্রা এখানে শেষ হয়নি; এটি আসলে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। অশুভ শক্তি পরাজিত হয়েছে, কিন্তু এটি যে চিরকালীনভাবে হারিয়েছে তা নয়; তাই তার দায়িত্ব কখনো শেষ হবে না। বনলতার চোখে এক নতুন দৃঢ়তা এবং মনোসংযোগ জন্ম নেয়, যা তাকে ভবিষ্যতের সব বিপদ মোকাবিলায় সক্ষম করবে। সে বুঝতে পারে, একজন রক্ষকের কাজ শুধু শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা নয়, বরং অন্ধকারের উপস্থিতি প্রতিনিয়ত অনুভব করা এবং তার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা। বনলতার মধ্যে জন্ম নেওয়া এই নতুন দায়িত্ববোধ তাকে প্রেরণা দেয়, যা তাকে তার অন্তর্দৃষ্টি, সাহস এবং কল্পনার মাধ্যমে শত্রুর মোকাবিলায় শক্তিশালী করে তোলে। এই উপলব্ধি তাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়: যে দায়িত্ব চিরকালীন, যে লড়াই কখনো সম্পূর্ণ হয় না, এবং যে রক্ষক হওয়া মানে শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে প্রস্তুত রাখা। বনলতার পদক্ষেপ এখন ধ্রুব এবং সংকল্পবদ্ধ; সে শুধু অতীতের নয়, ভবিষ্যতেরও রক্ষক, এবং এই উত্তরাধিকার তার অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকে।
শেষ
				
	
	


