পল্লবী ঘোষ
১
কলকাতার সেই রাতটা অদ্ভুতভাবে চুপচাপ, যেন হাওয়ার মধ্যে গল্প লুকিয়ে আছে—আর সেই গল্প শুনতে পাওয়ার জন্যই তন্ময় সেদিন রাতে বন্ধুবান্ধবের আড্ডা শেষে একা হাঁটতে বেরিয়েছিল। কলেজ স্ট্রিটের চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে বন্ধুরা যে যার দিকে চলে গেল, কিন্তু তন্ময়ের মনে এক অদ্ভুত আকর্ষণ টানতে লাগল তাকে অচেনা এক গলির দিকে। রাত তখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই, রাস্তায় হালকা কুয়াশা, রাস্তার বাতির আলোয় ছায়া লম্বা হয়ে কুয়াশার মধ্যে মিশে যাচ্ছে। তন্ময় এই শহরটাকে ভালোবাসে—তার ইটের দেয়াল, পুরনো বাড়ির ছাদ থেকে ঝোলানো লতাপাতা, আর বিশেষ করে এই রাতের কলকাতাকে, যখন শহরটা নিজের মতো নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে, নিজের অদেখা গল্পগুলো খুলে ধরে কেবল সেইসব চোখের জন্য, যারা সত্যিই দেখতে জানে। তন্ময় সাহিত্যের ছাত্র, রাতের আড্ডায় কবিতা লেখে, বন্ধুদের হাসায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, ওর মধ্যে আরেকজন তন্ময় আছে—যে এই শহরের অন্ধকার গলির ছায়া দেখতে চায়, যে গল্পের পেছনের গল্প খুঁজে বের করতে চায়, যে চায় শোনাতে সেইসব কাহিনি, যেগুলো কেউ শোনে না। সেই তন্ময়ই সেদিন বেছে নিল অজানা এক পথ। বন্ধুরা হাঁক দিলেও সে শুধু হাত নাড়ল, কানে হেডফোন লাগিয়ে ঢুকে পড়ল গলিটায়। গলি যতই এগোতে লাগল, তন্ময়ের মনে হল, সে যেন শহরের এক পুরনো অধ্যায়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। ইটের দেয়ালে ধুলো, পোস্টারের ছেঁড়া টুকরো, আর গলির শেষপ্রান্তে এক বিশাল বটগাছ—যার শিকড় রাস্তায় নেমে এসে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। গাছের গায়ে লাল কাপড় বাঁধা, বাতাসে সেই কাপড় নড়ে, আর অদ্ভুতভাবে মনে হয়, যেন কেউ ডাকছে। তন্ময় প্রথমে থমকে যায়, ভাবল ফিরে যাবে; কিন্তু কৌতূহল তাকে আর থামতে দিল না। সে গাছের তলায় এসে দাঁড়াল, আর তখনই নজরে পড়ল—সেই বৃদ্ধাকে।
বৃদ্ধা বসে আছেন গাছের গোড়ায় রাখা ভাঙা পাথরের বেঞ্চে। শীর্ণ চেহারা, চোখদুটি যেন আগুনের মতো উজ্জ্বল, অথচ গভীর। পরনে ম্লান রঙের বেনারসি শাড়ি, গলায় ঝুলছে পুরনো রুদ্রাক্ষের মালা, আর মুখে এমন এক অভিব্যক্তি, যেন বহু বছর ধরে কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। তন্ময় এক মুহূর্তের জন্য চমকে যায়—রাতের আঁধারে এমন একটা জায়গায় কারো বসে থাকা কি স্বাভাবিক? বৃদ্ধা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকান, আর অদ্ভুত কোমল কণ্ঠে বলেন, “বসে শোন, ছেলে। গল্প শুনবি?” তন্ময় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতা এমনই যে, ‘গল্প’ শব্দটা শুনেই সে কিছুটা নরম হয়ে যায়। বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, “গল্প? কী গল্প?” বৃদ্ধা তখন চোখ বুজে নিঃশ্বাস নেন, যেন সেই গল্পের ভার বুকে নিয়ে আছেন বহু বছর ধরে। চারপাশের বাতাস থমকে যায়, আর তন্ময় অনুভব করে, এই বৃদ্ধা আর পাঁচজনের মতো নন। তবু কে জানে কেন, তার সামনে বসে পড়ে। বৃদ্ধা আস্তে আস্তে বলতে শুরু করেন—“অনেক বছর আগে আমি লিখতাম, লিখতাম এমন কিছু, যা শুনে লোকে কাঁপত, আবার ভাবতও। আমার নাম লীলাবতী। জানিস, আমার গল্প আজও শেষ হয়নি…” তন্ময় অবাক হয়ে শোনে। কলকাতার সাহিত্য ইতিহাসে লীলাবতী নামটা কোথাও যেন শুনেছে সে, কিন্তু স্মৃতি স্পষ্ট নয়। বৃদ্ধার গলায় ব্যথা আর অহঙ্কার, গল্পকারের সেই চিরকালীন ব্যথা, যে জানে তার গল্পের শেষ এখনও লেখা হয়নি। তন্ময় ভেতরে ভেতরে অনুভব করে, এই মহিলা অদ্ভুত, রহস্যময়, কিন্তু ভয় নয়, বরং এক অজানা টান তাকে আঁকড়ে ধরছে। শহরের বাতাস ভারী হয়ে আসে, দূরের কোনও মন্দির থেকে ঘণ্টা বাজে, আর তন্ময় বুঝতে পারে, এই গল্প শুধু গল্প নয়—এ এক রহস্য, এক জীবনের হিসাব, যা শেষ হয়নি।
তন্ময় একপলকে চারপাশটা দেখে নেয়। গাছের শিকড়ের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত ছায়া নড়াচড়া করে, জোনাকি উড়ে এসে বসে বৃদ্ধার রুদ্রাক্ষের মালায়, আর বাতাসে একবারের জন্যও মনে হয়, দূরে কেউ দাঁড়িয়ে দেখছে। তবু তন্ময় সরে যায় না। সে বসে থাকে, আর বৃদ্ধা বলতে থাকেন নিজের কথা—যেমন করে একদিন লিখতেন সমাজের অন্ধকার নিয়েও, ভয় না পেয়ে। তন্ময় বুঝতে পারে, লীলাবতী শুধু এক বৃদ্ধা নন, এই শহরেরই এক টুকরো ইতিহাস, যাকে শহর ভুলে গেছে, কিন্তু যিনি নিজেকে ভোলেননি। রাত গভীর হয়, তন্ময়ের মনে হয়, যেন সময় থমকে গেছে। সে ভাবে, বন্ধুরা কোথায়? বা এই মুহূর্তে সেই কথাগুলো সে শোনার জন্যই কি এখানে এসেছে? বৃদ্ধা হঠাৎ থেমে বলেন, “আমার গল্পের শেষটা শুনবি? নাহলে আমি শান্তি পাবো না।” তন্ময় মাথা নাড়ে। বাতাসে শিরশিরে ঠান্ডা, দূরের কুকুরের ডাক আর পাতা ঝরার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। তবু তন্ময়ের কানে শুধু ভেসে আসে বৃদ্ধার গলা—“আমার গল্প আজও কেউ শোনেনি…তুই শুনবি, তন্ময়?” সেই মুহূর্তে নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে তন্ময়—বৃদ্ধা ওর নাম জানলেন কীভাবে? বুকের ভেতর ঠকঠক করে ওঠে তন্ময়ের হৃদয়, কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভয় নয়, বরং আরও গভীর কৌতূহল জেগে ওঠে ওর মনে। ওর ঠোঁট ফাঁক হয়, ধীরে ধীরে বলে, “হ্যাঁ… শুনব, দিদিমা…” আর তখনই শহরের নিঃশব্দ বাতাসে লীলাবতীর কণ্ঠে ভেসে আসে সেই গল্প, যা তন্ময় শুধু শোনে না, অনুভব করে—যার প্রতিটি শব্দ যেন ওর নিজের জীবনের সাথেও কোথাও গিয়ে মিলে যায়। সেই গল্পের শুরুতেই রাতের বটতলা, বৃদ্ধা লীলাবতী আর তন্ময়—তাদের তিনজনের গল্প, যা এই শহরের অন্ধকারের মতোই অদ্ভুত, রহস্যময় এবং শেষ না হওয়া।
২
তন্ময়ের চোখে তখন এক অনাবিষ্কৃত ইতিহাসের আলো জ্বলতে থাকে, আর লীলাবতীর কণ্ঠে সেই রাতের বটতলা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। বৃদ্ধা আস্তে আস্তে বলতে শুরু করেন, “অনেক বছর আগে, এই শহরেই, আমি লিখতাম—আমার কলমই ছিল আমার পরিচয়। তখনও মেয়েদের জন্য লেখা সহজ ছিল না, সমাজের চোখ রাঙানি ছিল, কিন্তু আমি থামিনি। আমার গল্পে ছিল এমন কিছু সত্য, যা লোকে দেখতে চাইত না। আমি লিখতাম কাশিমবাজারের বউমার কথা, যে শ্বশুরবাড়ির অন্ধকার ঘরে বসে নিজের জীবনকে জিজ্ঞেস করত—কেন? লিখতাম রঙিন শাড়ির আড়ালে লুকোনো কান্নার গল্প, আর লিখতাম সেই সব মানুষের কথা, যাদের নাম ইতিহাসে নেই, তবু তারাই এই শহরটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রথমে লোকে হাসত, বলত, ‘বউ হয়েই থাকতে পারিস না? কলম ধরলি কেন?’ কিন্তু আমি জানতাম, এই গল্পগুলো না লিখলে আমি নিজেকেই ভুলে যাব।” লীলাবতীর কণ্ঠে সেই রাতের হাওয়ার মতোই শীতলতা, আর তন্ময় টের পায়, গল্প বলতে বলতে বৃদ্ধার চোখের কোণে জলের রেখা ফুটে উঠেছে। আশেপাশের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে আসে, বটগাছের শিকড়ের ফাঁকে কিছু ছায়া নড়ে ওঠে, আর তন্ময়ের বুকের ভেতর কেমন অজানা কাঁপন লাগে। তবু সে শুনে যায়, কারণ এই গল্প শুধু অতীত নয়—এ যেন শহরের কোনো হারানো আত্মার ডাক, যা তন্ময়কে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়।
তন্ময় ধীরে ধীরে নিজের গলা স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কেন লিখতেন, দিদিমা? কী ছিল সেই গল্পে, যা আপনার জীবনকে এভাবে বদলে দিল?” লীলাবতী তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে বললেন, “আমি লিখতাম, কারণ আমি বাঁচতে চাইতাম। আমার স্বামী ছিলেন এক প্রভাবশালী মানুষ, সমাজের চোখে আদর্শ; কিন্তু ঘরের ভেতর তিনি ছিলেন এক অদৃশ্য শিকল, যিনি চেয়েছিলেন আমাকে বন্দি রাখতে। প্রথম প্রথম আমি লিখতাম লুকিয়ে, রাতের আঁধারে, মোমবাতির আলোয়। জানিস তন্ময়, একরাত আমার লেখা দেখে ফেলেছিলেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘তুই কি আমার মান ইজ্জত নষ্ট করবি?’ সেদিন রাতে ভয়ে আমার হাত কাঁপছিল, তবু কলম ছাড়িনি।” বৃদ্ধা থামলেন, নিঃশ্বাস নিলেন, আর তন্ময় দেখল সেই নিঃশ্বাস যেন বছরের পর বছর জমে থাকা দুঃখের ভার। তারপর লীলাবতী আবার বলতে শুরু করলেন, “আমার গল্পগুলো ছাপা হতে লাগল, আর মানুষ পড়তে লাগল। কেউ প্রশংসা করত, কেউ তাচ্ছিল্য, কেউ আবার ভয় দেখাত। তবু আমি লিখতাম, কারণ আমি জানতাম, আমার লেখা কাউকে না কাউকে বাঁচাবে। সেই সময়, একদিন আমার হাতে এল এমন এক গল্প, যা শুধু গল্প ছিল না—তা ছিল সমাজের অন্ধকারের এক বীভৎস সত্য, যা প্রকাশ পেলে অনেক মুখোশ খুলে যেত।” তন্ময়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে; সে জানে, এই গল্পই হয়তো লীলাবতীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
লীলাবতীর কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে যায়, “সেই পাণ্ডুলিপি আমি নিজেই লিখিনি, কিন্তু সেটা আমার কাছে এসে পৌঁছেছিল। কে দিয়েছিল, আজও জানি না, তবু আমি পড়েছিলাম। পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এই সত্য গোপন রাখা যাবে না। সেই পাণ্ডুলিপি নিয়েই একরাতে আমি বেরিয়েছিলাম প্রকাশকের কাছে দিতে, কিন্তু আমি আর ফেরত আসিনি।” তন্ময় হঠাৎ শিউরে ওঠে, তার মনে হয়, চারপাশের অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। গাছের শিকড়ে লেগে থাকা মাটি সরে গিয়ে যেন কোনো অদেখা দৃষ্টি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। বৃদ্ধা বলে চলেন, “আমি কোথায় গিয়েছিলাম, কী হয়েছিল, মনে নেই। শুধু জানি, সেই রাতের পর থেকে কেউ আর আমাকে দেখেনি, আর আমার গল্পটাও হারিয়ে গেছে। এই বটতলার কাছে আমি বারবার ফিরে আসি, কারণ আমি জানি, আমার গল্প এখানেই শেষ হয়েছিল, আর এখান থেকেই শুরু হতে হবে।” তন্ময় চুপ করে থাকে, বুকের মধ্যে শব্দ করে ধুকধুক করে ওঠে হৃদয়। তার নিজের হাতের তালুতে ঘাম জমে, তবু সে চোখ সরায় না বৃদ্ধার দিক থেকে। এই গল্প শুধু এক লেখিকার নয়—এ যেন এক শহরের, এক সময়ের, আর তন্ময় নিজেই টের পায়, এই গল্প তার জীবনকেও ছুঁয়ে গেছে। সে জানে না কেন, কিন্তু তার মাথায় স্পষ্ট হয়—লীলাবতীর গল্প শেষ না করা পর্যন্ত ওর নিজেরও মুক্তি নেই।
৩
তন্ময় বুঝতে পারে, এই রাত, এই গাছ আর এই গল্প—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত জাদুতে বাঁধা পড়ে গেছে সে। লীলাবতীর চোখের সেই গভীরতা, কণ্ঠের নিঃসঙ্গ ব্যথা, আর গল্পের অসম্পূর্ণতা ওকে এমনভাবে টানছে যে সে আর নিজেকে আটকাতে পারছে না। কিন্তু ঠিক তখনই, যখন লীলাবতী থেমে গিয়ে নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে, তন্ময়ের চোখে ধরা পড়ে গাছের শিকড়ের ফাঁকে নড়তে থাকা অদ্ভুত ছায়াগুলি। প্রথমে ও ভাবে বাতাসের কারণে হবে, কিন্তু একটু পরেই টের পায়, বাতাস নেই—সব কিছু থমকে আছে, কেবল সেই ছায়াগুলো যেন ওদের কথোপকথন শুনতে শুনতে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। লীলাবতী চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন, মুখের ওপর ভয় আর শান্তির মিশ্র ছায়া। তন্ময় চুপচাপ চারপাশে তাকায়, আর মনে হয়, এই বটগাছ কেবল গাছ নয়—এ যেন এক জীবন্ত স্মৃতির পাহারা, যা লীলাবতীর সাথে সেই রাতের গোপন সত্যও লুকিয়ে রেখেছে। বাতাসে ধুলো উড়ে এসে বসে তন্ময়ের হাতে, আর দূরের কোনো মন্দির থেকে ভেসে আসে ক্ষীণ ঘণ্টার আওয়াজ, যা এই নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তন্ময় জানে, তার নিজের গল্পও আজ এই রাতের মধ্যে জড়িয়ে গেছে—এখন সে আর কেবল শ্রোতা নয়, সে হয়ে গেছে গল্পেরই অংশ।
তন্ময় আস্তে করে প্রশ্ন করে, “দিদিমা, এই ছায়াগুলো কী? কারা ওরা?” লীলাবতী চোখ মেলে তাকান, আর ওর চোখে যে দৃষ্টি দেখা যায়, তা তন্ময়ের বুকের ভেতর কাঁপন তোলে। বৃদ্ধা ধীরে ধীরে বলেন, “ওরা আমার গল্পের সাক্ষী… আমার অতীতের ছায়া… আর হয়তো সেই সব মানুষ, যাদের মুখোশ খুলে যেতে পারত আমার কলমের কারণে। জানিস তন্ময়, যখন সত্য লেখা হয়, তখন শুধু মানুষ নয়—ছায়ারাও শত্রু হয়ে ওঠে। সেই রাতেও আমি বুঝেছিলাম, কেউ বা কিছু আমাকে থামাতে চাইছে।” লীলাবতীর কণ্ঠে এমন এক সুর, যা তন্ময় কখনও শোনেনি—তাতে ভয়, দুঃখ আর এক ধরনের অপরাজেয় দৃঢ়তা মিশে আছে। তন্ময়ের মনে হয়, এই গাছের শিকড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি ছায়া সেই রাতের, যেদিন লীলাবতীর গল্প থেমে গিয়েছিল। সেই থেমে যাওয়া কণ্ঠস্বর আজও বাতাসে ভাসে, আর তন্ময় সেই শব্দগুলো অনুভব করতে পারে নিজের বুকের গভীরে। গাছের পাতা নড়ে ওঠে, কুয়াশার মধ্যে ছায়াগুলো আরেকটু স্পষ্ট হয়, তন্ময় বুঝতে পারে, এই গল্প শুধু শোনার জন্য নয়—একে বাঁচাতে হবে, না হলে লীলাবতীর আত্মা চিরকাল এই বটতলায় বন্দি থাকবে।
তন্ময়ের হাতের তালু ঘেমে যায়, কিন্তু চোখ সরায় না লীলাবতীর দিক থেকে। সে টের পায়, বৃদ্ধা চায় তন্ময় কিছু জানুক—হয়তো সেই গল্পের শেষ খণ্ড, যা আজও অজানা। লীলাবতী নিঃশ্বাস টেনে বলেন, “আমার গল্প শেষ করতে হবে তোর হাতে… আমি পারিনি, কিন্তু তুই পারবি। কিন্তু সাবধান, তন্ময়… ওরা চায় না এই গল্প শেষ হোক। ওরা তোর কাছেও আসবে।” তন্ময়ের শরীরে শিরশিরে ঠান্ডা বয়ে যায়, আর হাওয়ার মধ্যে যেন ফিসফিসে আওয়াজ শোনে, ঠিক বোঝা যায় না কোন দিক থেকে আসছে। তবু ওর ভেতরের সেই গল্পপিপাসু আত্মা জেগে ওঠে, ভয়কে চাপা দিয়ে বলে, “আমি লিখব, দিদিমা… যা সত্য, তা লুকিয়ে রাখা যায় না।” লীলাবতীর চোখে তখন ঝলকানি, যেন সেই কথায় অদৃশ্য আশা জেগে ওঠে। চারপাশের ছায়াগুলো হঠাৎ থেমে যায়, গাছের পাতা একবার জোরে দুলে ওঠে, আর সেই রাতের বটতলা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তন্ময় বোঝে, এখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই—সে এই গল্পের সাথেই জড়িয়ে গেছে, আর এই গল্পই ওকে টেনে নিয়ে যাবে শহরের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়ের গভীরে। আর সেই অধ্যায়ের প্রতিটি শব্দে লেখা আছে লীলাবতীর অসমাপ্ত গল্প, তন্ময়ের নিজের গল্প, আর সেই ছায়াদের গল্প—যারা আজও অন্ধকারের ভেতর থেকে সব শুনছে, দেখছে, আর অপেক্ষা করছে গল্পের শেষ দেখতে।
৪
তন্ময় যখন পরের দিন সকালে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করল, তখনও রাতের সেই গল্প আর বটতলার ছায়াগুলোর কথা ওর মাথা থেকে মুছতে পারল না। কলেজের করিডরের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে তন্ময় সব খুলে বলল তীর্থকে—লীলাবতীর নাম, তার অসমাপ্ত গল্প আর সেই রাতের অদ্ভুত ছায়াগুলোর কথা। তীর্থ প্রথমে মন দিয়ে শুনল, তারপর হেসে বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি রে? রাতের বটতলা? প্রেতাত্মা? এসব তুই বিশ্বাস করছিস?” তন্ময় কিছু বলতে গিয়েও থামল, কারণ জানত, তীর্থের মতো বাস্তববাদী বন্ধুকে বোঝানো কঠিন। তবু তন্ময় নিজের মধ্যে ঠিক বুঝতে পারছিল, এটা কোনো কল্পনা নয়, কোনো দুঃস্বপ্ন নয়—লীলাবতীর গল্পের ভার ওর মনে বসে গেছে, আর সেই ভার ওকে পিছু ছাড়ছে না। তীর্থ আবার বলল, “তুই রাতে একা একা গেছিস, তাই মনে হয়েছে হয়তো। আসলে তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই নিজেই ভয় পেয়ে গেছিস। তোর দোষ নেই, তোর মতো কবিতা লেখে এমন ছেলেরা একটু বেশি ভাবুক হয়।” তন্ময় তীর্থকে থামিয়ে বলল, “তুই বুঝছিস না তীর্থ, এই গল্পটা শুধু গল্প নয়। এই গল্পের মধ্যে এমন কিছু লুকানো আছে, যা ওর জীবন শেষ করে দিয়েছে আর আমাকেও টেনে নিচ্ছে।” তীর্থ ভ্রু কুঁচকে তন্ময়ের মুখের দিকে তাকাল, যেন বোঝার চেষ্টা করছে বন্ধুর কথা আসলেই অনুভব থেকে আসছে নাকি কল্পনা থেকে।
তীর্থ ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে একটা কাজ করা যাক। আজ রাতে তুই আবার যাস সেই বটতলায়, কিন্তু একা না—আমি যাব তোর সঙ্গে। যদি তুই যা বলছিস তা সত্যি হয়, আমিও দেখব। আর যদি না হয়, তুই নিজেই বুঝতে পারবি, তুই শুধু কল্পনা করছিলি।” তন্ময় এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তীর্থকে দেখে মনে হল, ওকে কথা দিয়ে ফাঁসিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তন্ময়ের নিজের মধ্যেই একটা অদ্ভুত শক্তি জন্মেছে, লীলাবতীর চোখের সেই দৃঢ়তাই যেন ওকে সাহস জোগাচ্ছে। তন্ময় আস্তে করে বলল, “ঠিক আছে, আজ রাতেই চল।” তীর্থ তখন মুচকি হেসে বলল, “তাহলে ঠিক রাত বারোটায়, কলেজ স্ট্রিটের চায়ের দোকানের সামনে দেখা হবে।” তন্ময় মাথা নাড়ল, আর বুকের মধ্যে অনুভব করল ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক রকমের উত্তেজনাও—কারণ ও জানত, আজ রাতটা হতে চলেছে গল্পের নতুন মোড়।
সেদিন সারাদিন তন্ময় পড়াশোনায় মন বসাতে পারল না। লীলাবতীর মুখ, তার কথাগুলো আর সেই ছায়াগুলো বারবার ভেসে উঠল চোখের সামনে। সন্ধ্যে নামতেই ও বুঝতে পারল, রাতের বটতলার অন্ধকার আর লীলাবতীর গল্পের টান ওকে অদৃশ্য এক যাত্রায় টেনে নিচ্ছে। রাত ঠিক বারোটায় তীর্থ এল, দুজনেই ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গেল সেই গলিটার দিকে, যেখানে সেই বিশাল বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে শহরের সমস্ত গোপন স্মৃতি বুকের মধ্যে চেপে। গলির ভেতর ঢুকতেই তীর্থ ফিসফিস করে বলল, “বাতাসটা কেমন অদ্ভুত ঠান্ডা, না রে?” তন্ময় কিছু বলল না, কেবল শুনল নিজের হৃদয়ের ধুকধুক শব্দ আর চারপাশের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বটগাছের কাছে এসে দাঁড়াতেই তন্ময় দেখতে পেল লীলাবতীকে—ঠিক আগের রাতের মতোই বসে আছেন, শাড়ির আঁচল ঠিক করছেন, আর চোখে সেই একই ক্লান্তি আর প্রতীক্ষার ছায়া। তীর্থ চমকে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ওই মহিলাটা কে?” তন্ময় আস্তে করে বলল, “দেখিস, তুইই সব বুঝতে পারবি।” বাতাস থমকে গেল, চারপাশে ছায়াগুলো আবারও নড়াচড়া শুরু করল, আর তন্ময় টের পেল—গল্পের নতুন অধ্যায় আজ রাতেই শুরু হতে চলেছে, তীর্থকে সঙ্গে নিয়েই।
৫
বৃদ্ধা লীলাবতীর চোখের ভেতর সেই রাতের অন্ধকার যেন লুকিয়ে আছে, যেদিন তার গল্প থেমে গিয়েছিল, আর তন্ময় আর তীর্থ সেই রাতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির স্রোত। লীলাবতী নিঃশ্বাস টেনে বললেন, “সেদিন রাতে আমি সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে বেরিয়েছিলাম, কারণ জানতাম, কাল সকালেই তাকে প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে হবে। তাতে এমন সত্য লেখা ছিল, যা শুধু আমার নয়—এই শহরের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলতে পারত। জানিস তন্ময়, গল্প লিখতে গিয়ে অনেকেই ভাবে কেবল কাগজে শব্দ বসাচ্ছে, কিন্তু আমি জানতাম, এই গল্প আমার জীবনের থেকেও বড় হয়ে যাবে। সেই রাতে হাওয়া অদ্ভুতভাবে ঠান্ডা ছিল, রাস্তায় কুয়াশা জমে উঠছিল, আর আমার মনে হচ্ছিল, কেউ আমার পেছন পেছন আসছে। আমি একবার ঘুরে তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। তবু সেই অনুভূতি গেল না—এমন এক ছায়া, যাকে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন এই বটগাছের কাছে এলাম, তখনই সব থেমে গেল—হাওয়া থামল, রাতের আওয়াজ থামল, শুধু আমার বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দটুকু টের পেলাম।” তন্ময় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনল, তীর্থও এবার আর হাসল না, ওর চোখেও ভয়ের ছায়া নেমে এল। বটতলার বাতাস হঠাৎ আরও ঠান্ডা হয়ে গেল, গাছের শিকড়ের ফাঁকে ছায়াগুলো যেন নড়েচড়ে উঠল, আর লীলাবতীর গলায় সেই রাতের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে ফুটে উঠল।
লীলাবতী চোখ বন্ধ করে বললেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম, পেছনে কেউ আছে, হয়তো মানুষ নয়, হয়তো সেই সত্যের ছায়া, যা বাইরে আসতে চায় না। আমার হাতের মধ্যে পাণ্ডুলিপিটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম, মনে হচ্ছিল, যদি এটা হারাই, তাহলে শুধু গল্প নয়, আমার অস্তিত্বও মুছে যাবে। সেই সময় হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল এক ছায়া—না পুরুষ, না নারী, কেবল এক অবয়ব। আমি বলতে চেয়েছিলাম কিছু, গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না। ছায়াটা আমার দিকে হাত বাড়াল, আর আমি শুধু মনে করতে পারি, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল, মাথা ঘুরছিল, আর চারপাশের সবকিছু কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছিল। তারপর… তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন আবার নিজের মধ্যে এলাম, তখন আমি আর আমি ছিলাম না—আমি হয়ে গিয়েছিলাম এই বটতলার এক অংশ, এক ছায়া, যার গল্প কেউ শোনে না, যার নাম ভুলে গেছে শহর।” লীলাবতীর কণ্ঠে তখন একটা হাহাকার, যা শুনে তীর্থ পর্যন্ত চুপ করে গেল, আর তন্ময় অনুভব করল, তার চোখ ভিজে উঠছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোনাকি উড়ে এল, আর তন্ময়ের মনে হল, এই রাতের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে সেই অদেখা রাতের চিহ্ন, যা লীলাবতীর জীবনের শেষ হয়ে যাওয়া আর এক নতুন গল্পের শুরু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তীর্থ আস্তে করে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে তুই বলতে চাচ্ছিস, তুই আসলে—” লীলাবতী চোখ মেললেন, সেই চোখে অদ্ভুত তীব্র আলো, আর বললেন, “হ্যাঁ, আমি এই শহরের জন্য শুধু এক হারানো নাম নই, আমি সেই গল্প, যাকে শেষ করতে দেওয়া হয়নি।” তন্ময়ের গলা শুকিয়ে গেল, তবু ও নিজের ভেতরের সাহস জড়ো করে বলল, “আপনি কি চান আমি সেই গল্প শেষ করি?” লীলাবতীর চোখে তখন এক বিন্দু জল ঝলমল করল, তিনি আস্তে করে বললেন, “তোর মধ্যেই দেখেছি আমি সেই আগুন, যা ভয় পায় না। কিন্তু সাবধান, তন্ময়, এই গল্পের শত্রু শুধু মানুষ নয়, ছায়ারাও চায় না এটা লেখা হোক।” তন্ময় নিজের বুকের মধ্যে সেই কথাগুলোকে টের পেল, মনে হল সত্যিই যেন কিছু অদৃশ্য শক্তি চারপাশে জড়িয়ে আছে। তবু ও আস্তে করে বলল, “যা হোক, আমি লিখব। কারণ সত্যকে কেউ চিরকাল লুকিয়ে রাখতে পারে না।” বাতাস থমকে গেল, গাছের পাতা একবার দুলে উঠল, আর সেই রাতে তন্ময় অনুভব করল—গল্পের ভার এখন ওর হাতে, আর এই ভার শুধু এক প্রেতাত্মার নয়, বরং এক শহরের অদেখা, অজানা ইতিহাসেরও। আর সেই রাতেই গল্পের নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেল, যা তন্ময় জানত, তাকে বদলে দেবে চিরতরে।
৬
রাতের সেই দেখা আর লীলাবতীর বলা কথাগুলো তন্ময়ের ভেতর এমনভাবে গেঁথে গেল যে সে আর স্বাভাবিক থাকতে পারল না। পরের দিন সকালে কলেজের লাইব্রেরির পুরনো ধুলো জমা টেবিলে বসেই সে খুঁজতে শুরু করল লীলাবতীর নাম, তার বই, তার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। পাণ্ডুলিপি নিয়ে বেরোনোর পর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া এক লেখিকার নাম অদ্ভুতভাবে সংবাদের পাতায় একদিনের জন্য উঁকি দিয়েছিল, তারপর চিরতরে মিলিয়ে গিয়েছিল। লীলাবতীর শেষ উপন্যাসের নাম পেয়েছিল তন্ময়—‘অদেখা আলোক’, যা নাকি কখনো প্রকাশিতই হয়নি। সেই নাম শুনেই তন্ময়ের বুকের মধ্যে কেমন এক শিহরণ বয়ে গেল, মনে হল এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা সমাজ দেখতে চায়নি। কিন্তু যতই খুঁজল, সেই উপন্যাসের কোনো কপি, কোনো খসড়া বা পাণ্ডুলিপির খবর মিলল না। তন্ময়ের মনে হল, যেন ইচ্ছে করে সব মুছে ফেলা হয়েছে, যেন কেউ বা কিছু চেয়েছে এই গল্প চিরতরে হারিয়ে যাক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল, তবু তন্ময় একটার পর একটা ধুলো ধরা রেকর্ড, পুরনো পত্রিকা উল্টে যেতে লাগল—কোনো একটা ইঙ্গিতের আশায়, যা তাকে লীলাবতীর সেই রাতের কাছে টেনে নিয়ে যাবে।
ঠিক সেই সময়েই তন্ময়ের চোখে পড়ল একটি হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের টুকরো, যেখানে ছোট করে লেখা ছিল—“বিখ্যাত লেখিকা লীলাবতীর নিখোঁজের রাতে সঙ্গে ছিল তার নতুন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি—যা রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়।” তন্ময়ের মনে হল, পাণ্ডুলিপিটা কোনো সাধারণ লেখা ছিল না, তাই-ই হয়তো কেউ সেটা হারিয়ে যেতে দিয়েছিল। কিন্তু কে? আর কেন? তন্ময় কাগজটা বুকের কাছে ধরে মনে মনে বলল, “আমি এই গল্প খুঁজে বের করব… কারণ এটা শুধু লীলাবতীর নয়, আমারও গল্প।” সেই রাতে তন্ময় আবার গেল বটতলায়, আবার সেই বটগাছের নিচে দাঁড়াল—যেখানে লীলাবতীর গল্প থেমে গিয়েছিল। বাতাসে যেন লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল, আর বটগাছের শিকড়ের ফাঁক দিয়ে নড়া ছায়াগুলো আগের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। লীলাবতী ধীরে ধীরে তাকালেন তন্ময়ের দিকে, তার চোখে ছিল ক্লান্তি আর অপার প্রত্যাশার মিশ্রণ। তন্ময় নিচু গলায় বলল, “দিদিমা, আমি পাণ্ডুলিপির নাম পেয়েছি, কিন্তু ওটা কোথায়, সেটা জানি না… আপনি জানেন?” লীলাবতীর চোখের ভেতর এক মুহূর্তের জন্য যন্ত্রণা ফুটে উঠল, তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “জানি… কিন্তু সেই জায়গায় যেতে সাহস লাগে। সেই পাণ্ডুলিপির সত্যই আজও অনেককে ভয় দেখায়, তন্ময়।”
তন্ময়ের মুখ শক্ত হয়ে গেল, ভয়ের থেকেও বড় হয়ে দাঁড়াল জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তীর্থের কথা মনে পড়ল, যে বলেছিল, “সাবধানে যা, তন্ময়… সব সত্য বের করলে লোকে কি মানবে?” কিন্তু তন্ময় জানত, এটা কেবল সাহসের ব্যাপার নয়—এটা নিজের গল্পের সাথেও বাঁচা। লীলাবতী তখন নিচু গলায় বললেন, “সেই পাণ্ডুলিপি এখনো আছে, শহরেরই এক পুরনো কুঠির ভেতরে, যেখানে আলো পৌঁছায় না… যেখানে শুধু ছায়ারাই পাহারা দেয়।” তন্ময় বুক ভরে শ্বাস নিল, বলল, “আমি যাব দিদিমা… কারণ গল্প লিখতে না পারলে আমি নিজেও বাঁচতে পারব না।” বাতাস থমকে গেল, গাছের পাতা একবার দুলে উঠল, আর দূরের কোনো ঘণ্টার শব্দ যেন অদৃশ্যভাবে আশীর্বাদ করল তাকে। লীলাবতী চোখ বন্ধ করে বললেন, “যাবি… কিন্তু মনে রাখিস, তোর কলমই তোর তাবিজ, তোর সত্যই তোর ঢাল… ছায়ারা তোর ভয় চায়, তুই যদি ভয় না পাস, ওরা কিছুই করতে পারবে না।” সেই রাতে তন্ময় প্রথমবার টের পেল, সত্যের ভার কেমন হতে পারে—যা একদিকে ভয় দেখায়, আর একদিকে বাঁচিয়ে রাখে। আর তন্ময় বুঝল, তার সামনের পথ আর সহজ নয়—কারণ সেই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপির ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন এক ইতিহাস, যা শুধু লীলাবতীর গল্প নয়, শহরের অদেখা অন্ধকারের কাহিনি, যা প্রকাশ পেলে শহরেরই চেহারা বদলে যাবে চিরতরে।
৭
রাতের বেলায় কলকাতার পুরনো অলিগলির মধ্যে ঢুকে পড়লে শহরটাকে আর আগের মতো মনে হয় না—ইটের দেওয়াল, ভাঙা বারান্দা আর ছাদের ফাটলগুলো যেন নিজেই কথা বলতে শুরু করে। সেই রাতেই তন্ময় একা বেরোল, হাতে কেবল একটি নোটবুক আর কলম—যা লীলাবতী বলেছিলেন ওর তাবিজ আর ঢাল। শহরের আলো-আঁধারিতে তন্ময়ের চোখে সেই কুঠিরের ছবি ফুটে উঠছিল—এক পুরনো, পরিত্যক্ত বাড়ি, যার গল্প ও শুনেছিল কলেজের লাইব্রেরির এক বৃদ্ধ কর্মচারীর মুখে। লোকটা বলেছিল, “বাবু, ওই কুঠিরের ভেতরে নাকি এখনও রাত্রি থমকে থাকে, আর কেউ ভেতরে ঢুকলে ফিরে আসে না আগের মতো।” তবু তন্ময় জানত, ওকে যেতেই হবে, কারণ লীলাবতীর অসমাপ্ত গল্পের শেষ লাইনটুকু শুধু সেখানেই লুকানো আছে। গলির মধ্যে ঢুকতেই হাওয়া যেন ভারী হয়ে এল, আর অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে এলো—পুরনো কাগজ, ভিজে কাঠ আর কেমন এক বেসামাল ভয়ের গন্ধ। তন্ময়ের গলা শুকিয়ে এল, তবু পা থামাল না। সামনের দেওয়ালে চাঁদের আলো ফেলে গেল ছায়া, আর সেই ছায়া যেন তন্ময়ের পিছু নিল, একবার নয়, বারবার।
তন্ময় যখন কুঠিরের ভাঙা দরজার সামনে পৌঁছোল, তখনই টের পেল, ভেতর থেকে যেন কেউ তাকে দেখছে। শ্বাস বন্ধ করে ভেতরে পা রাখল। দরজার কড়ার শব্দ যেন সারা রাত জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল। অন্ধকারের মধ্যে কাঠের সিঁড়ির ধুলোয় ঢেকে যাওয়া ধাপগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তন্ময়ের চোখ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হল। ভেতরের দেওয়ালজোড়া প্রায় পড়ে আসছে, ছাদের কোণায় জাল বোনা মাকড়সা আর ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে ঢুকছে কুয়াশা। এই বাড়ির এক ঘরেই নাকি লীলাবতীর সেই পাণ্ডুলিপি লুকানো, কিন্তু তন্ময় জানত না কোন ঘর। হঠাৎ ও শুনতে পেল নিচু ফিসফিস শব্দ, যেন একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর কিছু বলতে চাইছে, আর সেই শব্দ শোনা মাত্রই ওর সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল, হঠাৎই সামনের দেয়ালে দেখল অদ্ভুত ছায়ার আকার, যারা একসঙ্গে এক দিকে তাকিয়ে আছে—আর সেই দিকেই ওর যেতেই হবে। তন্ময় বুঝতে পারল, এই ছায়ারা এই কুঠিরের পাহারাদার, ওদের চোখ এড়িয়ে যেতে হবে, নাহলে ওর গল্পও হয়তো এখানেই থেমে যাবে।
তন্ময় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পা বাড়াল, নিজের হাতে ধরা নোটবুকের দিকে তাকাল আর মনে মনে বলল, “ভয় পাব না… সত্যের গল্প লিখতে হবে।” সেই ঘরটার দরজায় হাত রাখতেই ঠান্ডা লোহার স্পর্শে ওর হাত কেঁপে উঠল। ভেতরে ঢুকে দেখল, অদ্ভুতভাবে জোনাকি উড়ছে—যার আলোয় ধুলো জমা মেঝের এক কোণে চোখে পড়ল একটা কাঠের বাক্স। তন্ময় দৌড়ে গিয়ে বাক্সটা টেনে আনল, খুলতে গিয়ে টের পেল, যেন কারো অদৃশ্য হাত ওকে আটকাতে চাইছে, বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তন্ময় দাঁত চাপা দিয়ে বাক্স খুলল—আর ভেতর থেকে বেরোল হলদে কাগজের বান্ডিল, যার গায়ে লেখা—‘অদেখা আলোক’। তন্ময়ের মনে হল, এ শুধু কাগজ নয়, যেন লীলাবতীর দম, তার অসমাপ্ত কান্না, আর এক শহরের চেপে রাখা ইতিহাসের ফিসফিসানি। ঠিক সেই মুহূর্তে, পেছন থেকে ও শুনতে পেল সেই ফিসফিসে ছায়াগুলোর আওয়াজ, যেগুলো আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তন্ময় কাগজের বান্ডিল বুকের কাছে চেপে ধরল, জানত এই গল্প শেষ না করলে শুধু লীলাবতীর মুক্তি নয়, ওর নিজেরও মুক্তি হবে না। আর সেই রাতে, ছায়ার পাহারার মধ্যেই, তন্ময় প্রতিজ্ঞা করল—যা কিছু দেখবে, যা কিছু জানবে, সব লিখে শেষ করবে—কারণ এটাই ওর জীবনের গল্প, যা ভয় পেয়েও থামবে না।
৮
কুঠিরের অন্ধকারে বুক ধড়ফড় করতে থাকা তন্ময় হাতে আঁকড়ে রেখেছে সেই হলদে কাগজের বান্ডিল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ও টের পেল ছায়াগুলো আরও কাছে চলে এসেছে, যেন পাণ্ডুলিপিটা ফেরত নিতে চায়। বাতাস ভারী, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, আর ওর কানের কাছে এক অজানা ফিসফিসানি, যা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছিল না, শুধু অনুভব করা যাচ্ছিল—“ফিরিয়ে দে… লিখিস না…” কিন্তু তন্ময় জানত, যদি ও থামে, সব শেষ হয়ে যাবে। ওর চোখে তখন ভেসে উঠল লীলাবতীর মুখ, সেই চোখের আকুতি আর অদম্য ইচ্ছা—যা বলে, গল্পকে শেষ না করলে সত্য কখনও আলোয় আসবে না। নিজের বুকের ধুকধুক আওয়াজ চাপা দিয়ে তন্ময় বসে পড়ল কুঠিরের মেঝেতে, আর পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতা উল্টোল। ঠিক তখনই ওর গায়ে কাঁটার মতো শিহরণ বয়ে গেল—কারণ প্রথম লাইনে লেখা ছিল এমন কিছু, যা শুধু এক শহরের গোপন অন্ধকার নয়, ওর নিজের ভেতরের ভয়কেও চুরি করে নিল। সেই লাইনগুলোতে লীলাবতী লিখেছিলেন এমন এক ষড়যন্ত্রের কথা, যা শহরের কিছু শক্তিশালী মুখোশধারী মানুষকে নিয়ে—যাদের নাম আজও কেউ প্রকাশ করতে সাহস পায়নি। তন্ময়ের চোখ বড় হয়ে গেল, পাতা উল্টোতে উল্টোতে ওর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল, কিন্তু হাত থামল না, কারণ জানত এই সত্যের ভার, যতই ভয়ঙ্কর হোক, ওর হাতেই লেখা।
পাতা উল্টোতে উল্টোতে তন্ময় পড়তে লাগল সেই নারীদের কথা, যাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছিল, সেই বালিকার কথা, যার মৃত্যু সংবাদ চাপা পড়েছিল টাকার জোরে, আর সেই অদৃশ্য দালালের কথা, যে রাতের অন্ধকারে ভাগ করে নিত নোংরা লেনদেনের হিসাব। তন্ময়ের মনে হল, এই কাগজগুলো শুধু গল্প নয়, এ এক জীবন্ত রক্তাক্ত দলিল—যা প্রকাশ পেলে কেঁপে উঠবে পুরো শহর। ঠিক সেই সময়ে বাতাসের মধ্য দিয়ে ছায়াগুলোর ফিসফিসানি জোরালো হয়ে উঠল, যেন ওদের ধমক আর আকুতি মিলেমিশে তন্ময়কে আটকাতে চাইছে। ও টের পেল, ওরা ওর দিকে এগিয়ে আসছে, চারপাশে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে আসছে, আর বুকের ভেতরটা কেমন জমে আসছে। তবু তন্ময় থামল না, পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় চোখ রাখল, আর তাতে লেখা শেষ লাইনটুকু পড়ে ওর চোখ ভিজে এল—“আমার গল্প থামানো যাবে না, কারণ গল্পই আমার প্রেতাত্মা… যদি কেউ সাহস করে পড়ে, সত্য একদিন ঠিকই নিজের পথ খুঁজে নেবে।” সেই মুহূর্তে তন্ময় বুঝল, লীলাবতীর আত্মা শুধু গল্প লিখতে চায়নি, ও চেয়েছিল কেউ যেন ভয়কে অতিক্রম করে সত্যের দরজা খুলে দেয়।
তন্ময় বুকের কাছে পাণ্ডুলিপিটা চেপে ধরল, আর মনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা করল, “তোমার গল্প শেষ করব, দিদিমা… যা কিছু দেখব, সব লিখব।” সেই প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গেই ছায়াগুলো থমকে গেল, যেন ওর মধ্যে লীলাবতীর ইচ্ছার আলো দেখল। কুঠিরের ভাঙা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে তন্ময়ের মুখে পড়ল, আর সেই আলোয় ওর চোখে শুধু ভয় নয়, অদম্য স্পর্ধা দেখা গেল। ছায়াগুলো সরে গেল পেছনে, আর তন্ময় টের পেল, এখন আর একা নয়—ওর কলমে আছে লীলাবতীর আকাশছোঁয়া সাহস, আর সেই অসমাপ্ত গল্পের শক্তি। তন্ময় দাঁড়াল, একবার পাণ্ডুলিপির দিকে তাকাল, তারপর ধুলোয় ভরা অন্ধকার ঘর থেকে বেরোল, মনে মনে বলল, “গল্প শেষ না করলে আমি বাঁচব না… আর সত্যের জন্য লড়াই করব, যত বড়ই হোক ছায়ার ভয়।” সেই রাতে তন্ময় জানত, ও শুধু পাণ্ডুলিপি খুঁজে পায়নি—ও খুঁজে পেয়েছে নিজের গল্প, যা লিখতে লিখতে ওকেও ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, কারণ গল্পই একমাত্র সত্য, যা কখনও শেষ হয় না।
৯
তন্ময় যখন কুঠির থেকে বেরিয়ে এলো, তখন রাতের কলকাতা কেমন অচেনা লাগছিল—গলির বাতি, ভাঙা দেয়ালের ছায়া আর রাস্তার নীরবতা যেন সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মঞ্চ তৈরি করেছিল, যেখানে ওর হাতের পাণ্ডুলিপিটাই একমাত্র সত্য। বুকের কাছে শক্ত করে ধরা সেই কাগজের বান্ডিলটাকে নিয়ে তন্ময় হাঁটছিল, আর মনে হচ্ছিল, ওর পেছনে এখনো ছায়াগুলো হেঁটে আসছে, কিন্তু এবার আর ভয় দেখানোর জন্য নয়, যেন ওর সিদ্ধান্তকে পরীক্ষা করার জন্য। মাথায় ঘুরছিল লীলাবতীর সেই শেষ লাইন—“গল্পই আমার প্রেতাত্মা… যদি কেউ সাহস করে পড়ে, সত্য একদিন ঠিকই নিজের পথ খুঁজে নেবে।” তন্ময়ের মনে হল, এই শহরের গোপন অন্ধকার, এই হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠগুলোকে যদি ও কাগজে না আনে, তাহলে সত্যিই ও বেঁচে থাকবে না—কারণ নিজের ভেতরের গল্প না লিখলে মানুষের বেঁচে থাকাটাই কেবল নকল হয়। রাতের নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে তন্ময়ের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, আর দূরের কোনো ঘুঘুর ডাক যেন এক অদ্ভুত সঙ্গত দিচ্ছিল ওর পথ চলায়। ও বুঝতে পারছিল, শুধু নিজের জন্য নয়, লীলাবতীর জন্যও, শহরের সেই অদেখা মুখগুলোর জন্যও এই গল্প শেষ করতে হবে।
তন্ময় ঠিক করল, যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল, সেই বটতলায় গিয়েই এই পাণ্ডুলিপিটাকে শেষ করবে। শহরের গলিপথ পেরিয়ে যখন আবার সেই বটগাছের নিচে পৌঁছোল, তখন রাতের হাওয়ায় পাতা কাঁপছিল, আর ছায়াগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন অপেক্ষা করছে। বটগাছের শিকড়ের ফাঁকে লীলাবতী বসেছিলেন আগের মতোই, চোখে একই ক্লান্তি, কিন্তু ওকে দেখে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল মুখে। তন্ময় ধীরে ধীরে বসে বলল, “দিদিমা, আমি পেয়েছি পাণ্ডুলিপিটা… কিন্তু লিখব কিভাবে?” লীলাবতী নিচু গলায় বললেন, “তোর ভয়কে আগুন বানাস… কলম দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে যা কিছু দেখিস, সব লিখে ফেলিস… তুই যখন লিখবি, তখন ছায়ারাও পুড়ে যাবে। মনে রাখিস, গল্প কখনো মরে না, গল্পই মরে না বলে প্রেতাত্মা হয়ে থাকে।” তন্ময়ের চোখের সামনে ভেসে উঠল সেইসব অজানা মুখ, যাদের কথা লেখা আছে পাণ্ডুলিপিতে, সেই নারীর কান্না, সেই অন্ধকার লেনদেনের শব্দ আর লীলাবতীর হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠ। ওর হাতের তালুতে ঘাম জমে গেল, কিন্তু বুকের ভেতর থেকে ভয়ের থেকেও বড় হয়ে উঠল সেই আগুন—যা সত্যকে বাইরে আনতে চায়।
তন্ময় নোটবুক খুলে কলম চালাতে শুরু করল, আর প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে অনুভব করল লীলাবতীর উপস্থিতি, যেন তার হাত ধরে কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে। ছায়াগুলো তখন গাছের শিকড়ের ফাঁকে নড়ছিল, বাতাসের ফিসফিসানি আরও স্পষ্ট হচ্ছিল, “থাম… লিখিস না…” কিন্তু তন্ময় থামল না, পাতার পর পাতা লিখে গেল সেই সত্য, যা এতোদিন ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তন্ময়ের হাত কাঁপছিল, কিন্তু কলম থামছিল না, আর গাছের শিকড়ের ভেতর থেকে যেন অদ্ভুতভাবে বাতাস বইল, পাতা কেঁপে উঠল, আর ছায়াগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। শেষ লাইনটুকু লিখে তন্ময় যখন মাথা তুলল, তখন লীলাবতীর মুখে এক শান্তি আর তৃপ্তির ছায়া, যা তন্ময় আগে কখনো দেখেনি। বৃদ্ধা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তুই লিখেছিস… এখন গল্প শেষ হয়েছে… আর তোরও শুরু।” হাওয়ার মধ্যে জোনাকি উড়ে এলো, আর তন্ময় বুঝল, সেই রাতে শুধু এক গল্প নয়, এক প্রেতাত্মারও মুক্তি ঘটল, আর তন্ময় নিজেও জন্ম নিল এক নতুন লেখক হিসেবে—যার কলমের আগুন শুধু গল্প বলে না, গল্পের মধ্যেই আলো জ্বেলে দেয়, যা অন্ধকার ছিঁড়ে সত্যকে সামনে আনে।
১০
রাত ভোর হতে না হতেই বটতলার হাওয়া হালকা হয়ে এল, আর গাছের পাতায় জমা শিশিরের ফোঁটায় ভোরের আলো খেলে গেল। তন্ময় চোখ তুলে দেখল—লীলাবতী আর আগের মতো বসে নেই, যেন কোথাও মিলিয়ে গিয়েছেন সেই অদৃশ্য বাতাসের মধ্যে, কেবল গাছের শিকড় আর ছায়াগুলোতে রয়ে গেছে তাঁর উপস্থিতির স্পর্শ। তন্ময় হাতের নোটবুকের পাতায় চোখ রাখল, যেখানে লেখা আছে সেই অসমাপ্ত গল্পের শেষ লাইন, যা ও নিজের হাতে শেষ করেছে। অদ্ভুতভাবে মনে হল, যেন লীলাবতীর আত্মা এই শেষ লাইনটার মধ্যেই স্থির হয়ে গেছে, আর শহরের বাতাসের মধ্যে ওর নাম এখনো ফিসফিস করে বাঁচবে। তন্ময় চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “দিদিমা, গল্প শেষ হল, কিন্তু আমার পথ তো এখনই শুরু”—আর ঠিক তখনই ভোরের প্রথম আলোয় ওর মনে হল, লীলাবতীর কণ্ঠস্বর যেন বাতাসে ভেসে বলছে, “গল্প শেষ হয় না, তন্ময়… শুধু গল্পের পথ বদলায়, আর লিখতে গিয়ে তুইও বদলে যাবি।” হাওয়ার মধ্যে সেই কথাগুলো শোনার পর তন্ময় বুঝল, সত্যকে মুখোমুখি হতে গিয়ে ও নিজেই এক নতুন তন্ময়ে রূপ নিয়েছে—যে আর ভয় পায় না, যে জানে ছায়া যতই ভয় দেখাক, কলমের আলোই শেষ পর্যন্ত জ্বলে থাকে।
তন্ময় ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল শহরের রাস্তায়, আর মনে হল, এই শহরটা আর আগের মতো নেই। রাস্তার ধুলো, দেওয়ালের ফাটল, কুয়াশার পর্দা—সবকিছুতেই যেন লুকিয়ে আছে অজানা গল্প, যেগুলো শুধু একজন সাহসী শ্রোতার অপেক্ষায় থাকে। তীর্থের কথা মনে পড়ল—যে একদিন বলেছিল, “সব সত্য বলা যায় না রে”—কিন্তু তন্ময় এখন জানে, বলা না গেলেও লেখা যায়, আর লেখা থেকেই জন্ম নেয় নতুন আলো। সেই রাতে যে কুঠির থেকে তন্ময় বেরিয়েছিল, সেই ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলো আর সেই ছায়াদের ফিসফিসানি ওর জীবনের অংশ হয়ে গেছে, যেগুলো হয়তো কখনো যাবে না, তবু সেই ভয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাহসের শক্তি। তন্ময় জানত, এই গল্প শুধু শহরের অন্ধকার ইতিহাস নয়, ওর নিজের গল্পও বটে—যেখানে এক ভয়ের রাত পেরিয়ে ও হয়ে উঠেছে নিজের কলমের স্রষ্টা। আর এই গল্পই ওকে শিখিয়েছে, সত্য যতই চাপা পড়ুক, একদিন ঠিকই জেগে ওঠে কোনো না কোনো কলমের ছোঁয়ায়।
শেষবারের মতো তন্ময় বটতলার দিকে তাকাল, আর মনে মনে বলল, “ধন্যবাদ, দিদিমা—তোমার গল্প আমাকেও জাগিয়েছে।” শহরের ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে ও নতুনভাবে হাঁটতে লাগল, হাতে সেই নোটবুকটা নিয়ে—যেখানে লেখা আছে লীলাবতীর ‘অদেখা আলোক’-এর শেষ অংশ আর তন্ময়ের নিজের লেখা শেষ লাইনগুলো। ভোরের রোদে যখন পাতা উল্টোল, তখন কাগজের উপরে ছায়া পড়ে রইল না—রইল কেবল অক্ষরের আলো, যা কখনো নিভে যায় না। আর সেই সকালে, তন্ময় জানল, গল্পের শেষ মানে আসলে জীবনের নতুন শুরু, আর সত্যই একমাত্র প্রেতাত্মা—যা কোনো ছায়া, কোনো ভয়, কোনো রাত চিরকাল বন্দি করে রাখতে পারে না।
সমাপ্ত