Bangla - ভূতের গল্প

বটতলার কঙ্কাল

Spread the love

সুমনা মাইতি


অধ্যায় ১ –

গ্রামের চৌহদ্দি পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই যে জঙ্গলঘেরা পথটা মাঠের দিকে চলে গেছে, তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট পুরোনো বটগাছ। চারদিকে ঝুলে থাকা অজস্র দড়ির মতো শেকড় আর অন্ধকারে ঢেকে রাখা পাতার ছাউনি যেন দূর থেকে দেখলে আকাশের সঙ্গে মিশে থাকা কোনো দানবের রূপ মনে হয়। দিনের বেলা মানুষ সেখানে গরু চরাতে যায়, শুকনো কাঠ কুড়িয়ে আনে, কিংবা ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে, পাখিরা ডাকতে ডাকতে থেমে যায়, আর বটগাছের শেকড়ের ফাঁক দিয়ে ওঠে অচেনা ফিসফিস শব্দ। গ্রামের ছেলেমেয়েরা একে অপরকে ভয় দেখাতে প্রায়ই বলে—“ওই গাছটার নিচে ভূত আছে, রাত হলে কেউ গেলেই আর ফিরে আসে না।” যদিও বেশিরভাগ সময় এগুলো নিছক গল্প বলেই মনে হত, তবুও গ্রামের মানুষদের মনে কোথাও একটা চাপা আতঙ্ক থেকে যেত।

সেই বিকেলে, যখন আকাশে রোদ ম্লান হয়ে এসেছে আর মাঠের গরুগুলো ফিরিয়ে আনা হচ্ছিল, তখন কয়েকজন রাখাল ছেলে বটগাছের তলায় বসে দড়ি দিয়ে খেলা করছিল। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন চোখ কচলে চিৎকার করে উঠল—“ওই দেখ! ওখানে কে শুয়ে আছে?” সবাই তাকিয়ে দেখে, গাছের গোড়ায় হেলে পড়ে আছে এক মানুষের কঙ্কাল। শুকনো হাড়গুলো যেন অনেকদিনের পুরোনো, তবুও অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার, যেন মাটির ধুলোয় মাখেনি কখনো। চোখের গর্ত ফাঁকা অথচ মনে হচ্ছিল সেই শূন্য চোখদুটি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুহূর্তে বাতাসে শিরশিরে একটা ঠান্ডা বয়ে গেল, চারপাশের কাকগুলো একসঙ্গে ডেকে উড়াল দিল। ভয়ে ছেলেগুলোর গলা শুকিয়ে এলো, তাদের মনে হচ্ছিল হাড়গুলো নড়ছে, আস্তে আস্তে হাতটা যেন মাটি থেকে উঠতে চাইছে। তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না—একসঙ্গে চিৎকার করে মাঠের দিক ছুটে পালাল।

কিছুদূর গিয়ে যখন সাহস সঞ্চয় করে তারা আবার পেছনে তাকাল, তখন অবিশ্বাস্য দৃশ্যের মুখোমুখি হলো। যে জায়গায় কিছুক্ষণ আগে স্পষ্টভাবে কঙ্কাল দেখা গিয়েছিল, সেখানে আর কিছুই নেই—গাছের গোড়ায় শুধু আগের মতো শুকনো পাতা আর শেকড়ের ছায়া। যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু ভয়ের ঘোর তাদের বুকের ভেতর জমাট বেঁধে রইল। ছেলেরা গ্রামে ফিরে হাঁপাতে হাঁপাতে সবার সামনে ঘটনা খুলে বলল—কেমন করে বটতলায় কঙ্কাল শুয়ে থাকতে দেখেছে, আর মুহূর্তে মিলিয়েও গেছে। মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গোটা গ্রামে। কেউ বলল এটা নিশ্চয় ভূতের কাজ, কেউ বলল কোনো অকালমৃত আত্মার অশান্তি, আবার কেউ ফিসফিস করে বলল গাছটার সঙ্গে বহুদিন আগের কোনো গোপন মৃত্যুর ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের পথগুলো শুনশান হয়ে গেল, কেউ আর বটগাছের দিকে যাওয়ার সাহস করল না। প্রথম দিনের মতোই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে, আর গ্রামের মানুষের মনে স্থায়ী হয়ে বসে গেল বটতলার কঙ্কালের ভয়।

অধ্যায় ২ –

পরদিন ভোর থেকেই গ্রামের অলিগলিতে শুধু একটাই আলোচনা—বটগাছের তলায় কঙ্কাল দেখা গেছে। রাখাল ছেলেরা কাঁপা গলায় আগের দিনের ঘটনাটা যতবারই বলছিল, ততবারই গল্পের রঙ গাঢ় হচ্ছিল। কেউ বলছে কঙ্কালের চোখ জ্বলজ্বল করছিল, কেউ বলছে সে হাত নাড়তে চাইছিল, আবার কেউ বলছে হাড়গুলো নিজেরাই গড়িয়ে গড়িয়ে উঠতে চাইছিল। ফলে গ্রামবাসীদের মনে ভয় আরও বেড়ে গেল। সকালের হাটে যারা আলু, পেঁয়াজ, চাল-ডাল কিনতে এসেছিল, তাদের আলোচনায়ও কঙ্কালের গল্প ঘুরছিল। অনেকে বলল, বটগাছটা বহুদিন থেকেই অশুভ—রাতে ওর ডাল থেকে নাকি ঝোলানো পায়ের শব্দ শোনা যায়, আবার মাঝে মাঝে শেকড়ের ফাঁক থেকে হাহাকার ভেসে আসে। এতদিন এ গল্পগুলো নিছক গুজব বলে মনে হত, কিন্তু এবার রাখাল ছেলেদের চোখে দেখা কঙ্কালের কথা শুনে সবাই একমত হল যে এতে নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক শক্তি কাজ করছে। ফলে গ্রামে অদ্ভুত আতঙ্কের ছায়া নেমে এল, যেন সাধারণ জীবনযাত্রার উপর এক কালো মেঘ ভর করেছে।

গৃহস্থ গণেশ, যিনি সবসময় ভয় পেয়ে প্রথমে চিৎকার করেন আর পরে অন্যদের ভয় দেখান, তিনি এবার ভয়ে একেবারেই ঘরবন্দি হয়ে গেলেন। সকাল থেকে রাত অবধি শুধু বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন—“আমি বলেছিলাম, ওই গাছটা ভালো না… এখন দেখলে তো! কঙ্কাল নিজে এসে হাজির।” তার স্ত্রী কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছিল না। গণেশ ঘরের দরজায় তালা এঁটে বসে রইলেন, এমনকি মাঠে গরু আনতে যাওয়ার কথাও ভুলে গেলেন। তাঁর এই অতিরিক্ত ভয়ের কারণে আরও অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। মহিলারা সন্ধ্যার পর বাইরে পা রাখল না, শিশুরা খেলতে খেলতে গল্প শুনে ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। গ্রামের মানুষরা মনে করতে লাগল, বটগাছের শেকড়ে নাকি এক অকালমৃত আত্মা বন্দি হয়ে আছে, আর সেই আত্মা প্রতিশোধ নেবার জন্য কঙ্কালের রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। দিন যত গড়াল, ততই ভয় তীব্র হয়ে উঠল।

এই অবস্থায় গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান হরিদাস মণ্ডল এগিয়ে এলেন। তাঁর কথাই গ্রামে শেষ কথা। তিনি লোকজন জড়ো করে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন—“আমি গ্রামবাসী সবাইকে সতর্ক করছি, বটগাছের তলায় কেউ যেও না। ওখানে অশুভ শক্তির বাস। কেউ গেলে গ্রামের বিপদ বাড়বে। তাই এখন থেকে সন্ধ্যা নামলেই ওই দিক দিয়ে পথ মাড়ানো যাবে না।” হরিদাস মণ্ডলের এই নির্দেশ যেন সবার ভয়কে আরও গাঢ় করে দিল। যাঁরা মনে মনে ভাবছিলেন ঘটনাটা হয়তো কাকতালীয়, তাঁরাও চুপ করে গেলেন। কারণ গ্রামের নেতা যখন অভিশাপের কথা বলছে, তখন কেউ আর সাহস করে আপত্তি তুলতে পারল না। এভাবেই অল্প কিছু দিনের মধ্যে বটগাছের নাম হয়ে গেল “অভিশপ্ত গাছ”, আর গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করতে শুরু করল—সেই গাছের নিচে সত্যিই এক ভয়ঙ্কর অলৌকিক শক্তি রয়েছে, যে কাউকে গ্রাস করতে প্রস্তুত।

অধ্যায় ৩ –

গ্রামের সবাই যখন আতঙ্কে অস্থির, তখন একমাত্র ভিন্ন সুর শোনা গেল গ্রামের স্কুলশিক্ষক গোপাল মাস্টারের মুখে। তিনি পঞ্চাশোর্ধ বয়সী, চশমা পরা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক সরল অথচ দৃঢ়চেতা মানুষ। স্কুলে তিনি ছেলেমেয়েদের শুধু অঙ্ক আর বাংলা পড়ান না, শেখান যুক্তি দিয়ে ভাবতে, প্রশ্ন করতে, কুসংস্কারকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করতে। তাই গ্রামের মানুষ তাঁকে সম্মান করলেও, তাঁর কথাকে অনেকসময় অস্বস্তিকর মনে করে। সেই রাতে গ্রামসভার ভিড়ের মধ্যে যখন সবাই ভয়ে ভয়ে বটগাছকে অভিশপ্ত ঘোষণা করছে, তখন গোপাল মাস্টার শান্ত গলায় বললেন—“এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে পৌঁছোও না। একটা কঙ্কাল দেখা গেছে, আবার মিলিয়ে গেছে—এটা মানে এই নয় যে ভূতপ্রেত কাজ করছে। এর পেছনে যুক্তি আছে, রহস্য আছে। হয়তো কারও ষড়যন্ত্র, হয়তো কোনো দেহ লুকোনো হয়েছিল, অথবা আলোর ভেলকিতে চোখে ভুল দেখা দিয়েছে।” তাঁর এই যুক্তিবাদী মন্তব্য শুনে ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। কেউ ফিসফিস করে বলল, “মাস্টারমশাই আবার বিদ্যে ফলাতে শুরু করলেন।” আবার কেউ অবাক হয়ে বলল, “তাহলে কি সত্যিই কোনো খুনখারাপি লুকিয়ে আছে?”

গোপাল মাস্টারের সন্দেহ আরও জোরালো হলো যখন তিনি রাখাল ছেলেদের সঙ্গে বসে খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেরা প্রত্যেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বর্ণনা দিল—কেমন করে হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, আবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়েও গেল। মাস্টার মন দিয়ে শুনলেন, তারপর বললেন—“মানুষের হাড় কয়েক সেকেন্ডে মিলিয়ে যেতে পারে না। হয়তো তোমরা ভয়ে ভুল দেখেছো, হয়তো ওখানে কারও দেহের চিহ্ন ছিল, যা বাতাসে উড়ে যাওয়া পাতা বা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে চোখ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চিত—ওখানে কিছু একটা আছে, যার কারণ আমাদের খুঁজতে হবে। অশুভ শক্তি বলে ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলে কিছুই জানা যাবে না।” তাঁর কথায় কিছু তরুণ সাহস পেয়ে মাথা নাড়ল, কিন্তু প্রবীণরা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল। হরিদাস মণ্ডল ভ্রু কুঁচকে বললেন, “মাস্টার, তুমি আমাদের বাপ-ঠাকুরদার বিশ্বাসকে অপমান করছো। এসব যুক্তি দিয়ে ভূতের অভিশাপ দূর করা যায় না।” মাস্টার শান্তভাবে জবাব দিলেন, “বিশ্বাস থাকুক, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু ভয়কে কাজে লাগিয়ে মানুষকে অন্ধ করা ঠিক নয়। সত্যিটা খুঁজে বের করাই আমাদের দায়িত্ব।”

গ্রামে তাঁর এই মনোভাব এক আলোড়ন তুলল। কারও কাছে তিনি সাহসী যুক্তিবাদী, আবার কারও কাছে তিনি অবুঝ বিদ্বান, যিনি অলৌকিক শক্তির গুরুত্ব বুঝতে চান না। মহিলারা কানে কানে বলল—“মাস্টারমশাই এত কথা বলছেন, কাল যদি কঙ্কাল তাঁকেই ধরে বসে!” ছেলেরা স্কুলে এসে আরও উৎসাহ নিয়ে তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করল। গোপাল মাস্টারের যুক্তিবাদী মানসিকতা ধীরে ধীরে এক দলকেও ভাবতে শিখাল—হয়তো এ ভয়ের আড়ালে কোনো বাস্তব ঘটনা লুকিয়ে আছে। কিন্তু একইসঙ্গে গ্রামে অস্বস্তির বাতাস বইল, কারণ যুক্তির আলো কুসংস্কারের আঁধারকে উন্মুক্ত করে দেয়, আর হরিদাস মণ্ডলের মতো প্রভাবশালীরা সেটা মোটেও পছন্দ করল না। গ্রামের চৌপথে যেন এখন দুটো শিবির তৈরি হলো—একদিকে যারা বিশ্বাস করছে বটগাছ অভিশপ্ত, অন্যদিকে যারা গোপাল মাস্টারের মতো মনে করছে এর পেছনে অজানা কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

অধ্যায় ৪ –

গ্রামের এক কোণে অল্পবয়সী বিধবা শীলা বসবাস করে, সাদা শাড়ি আর নিস্তব্ধ চোখে যেন সারাদিন এক অনুচ্চারিত শোক বহন করে চলে। অরুণের মৃত্যুর পর থেকেই তার জীবন যেন থেমে গেছে। একসময় সকালের নদীর ধারে খেলা, বিকেলের মাঠে লুকোচুরি, আর পূর্ণিমার রাতে বটগাছের নিচে বসে গল্প—এসব ছিল তাদের দু’জনের শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অরুণ ছিল হাসিখুশি, পরিশ্রমী এক তরুণ, যে সবসময় বলত—“একদিন শহরে গিয়ে বড়লোক হবো, তোকে একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে দেব।” শীলা সেই স্বপ্নকে বুকে আঁকড়ে বেঁচেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন খবর এলো—অরুণ আর নেই, হঠাৎ দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। কেউ বলল সে নদীতে ডুবে গেছে, কেউ বলল জমি নিয়ে বিবাদের কারণে তাকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সঠিক কারণ কেউ বলতে পারল না। শুধু জানা গেল, তার দেহ আর পাওয়া যায়নি। সেই দিন থেকেই শীলার মনে বটগাছটার সঙ্গে অরুণের এক অদৃশ্য যোগ তৈরি হলো। যতবারই সে সন্ধ্যায় ওই পথে হেঁটে যায়, মনে হয় শেকড়ের আড়ালে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে, তাকেই ডাকছে।

শীলা একা একা বটগাছের দিকে চেয়ে কত রাত কেঁদেছে। গ্রামের লোকেরা যখন ভয় পেয়ে বলত—ওখানে ভূত আছে, ওখানে অশুভ আত্মা ঘুরে বেড়ায়, তখন শীলা মনে মনে প্রতিবাদ করত। সে ভাবত—ওটা ভূত নয়, ওটা অরুণ। সে এখনও শান্তি পায়নি, এখনও ফিরে আসতে চাইছে। রাখাল ছেলেরা যখন কঙ্কাল দেখার কথা বলল, শীলার বুক কেঁপে উঠল। সে আর সন্দেহ করল না—অরুণের অস্থির আত্মাই বটতলার কঙ্কালের রূপে ধরা দেয়। তার মনে হলো, অরুণ হয়তো তাকে কোনো বার্তা দিতে চাইছে, হয়তো বলতে চাইছে তার মৃত্যুর সত্যিটা এখনও গোপন। শীলার চোখে ভেসে উঠল শেষবারের দেখা—সেই বিকেলে অরুণ বিদায় না বলে হঠাৎ কোথায় যেন চলে গিয়েছিল, আর তারপর থেকেই সে নিখোঁজ। আজও সেই হাহাকার তার বুকের ভেতর জমে আছে। তাই গ্রাম যত ভয় পায়, শীলা ততই টানে টানে বটগাছের কাছে যেতে চায়।

কখনো কখনো রাতে শীলা স্বপ্ন দেখে, সে বটগাছের শেকড়ের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আর হঠাৎ অরুণ বেরিয়ে আসছে, তার চোখে শূন্য দৃষ্টি, শরীরে কঙ্কালের ছাপ। অরুণ তাকে ডেকে বলছে—“শীলা, আমাকে মুক্ত করো।” ঘুম ভেঙে গেলে শীলা ঘাম ভিজে যায়, তবুও মনে হয় এ শুধু স্বপ্ন নয়, এ অরুণের আত্মার আর্তি। সে বিশ্বাস করে, গ্রামের লোকেরা ভুল করছে, কঙ্কাল কোনো অশুভ শক্তি নয়, বরং এক অকালমৃত আত্মার ব্যথা, যে ন্যায় চাইছে, মুক্তি চাইছে। আর সেই মুক্তির চাবি হয়তো শীলার হাতেই লুকিয়ে আছে। তার বুকের ভেতর তখন এক অদ্ভুত সংকল্প জন্ম নেয়—সে একদিন সবার সামনে প্রমাণ করবে যে বটতলার কঙ্কাল অরুণেরই, আর তার মৃত্যুর রহস্য গোপন রাখা যাবে না।

অধ্যায় ৫ –

গ্রামে যতই ভয় বাড়তে থাকল, ততই শক্তি বাড়তে থাকল ওঝা মহাদেবের। বয়সে তিনি পাকা পঞ্চাশ, লম্বা চুল গোঁজামিল দিয়ে বাঁধা, কপালে বড় লাল টিপ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে লোহার ছড়ি। সারা গ্রামে তাঁর পরিচিতি—যে কোনো ভূতপ্রেতের উপদ্রব তিনি এক নিমেষে দূর করতে পারেন। রাখাল ছেলেদের মুখে কঙ্কালের গল্প শোনার পর মহাদেব সুযোগ বুঝে গর্জে উঠলেন—“আমি বলেছিলাম না, ওই বটতলায় অশুভ শক্তি আছে? এরা এখন জেগে উঠেছে। পুজো, যজ্ঞ, হোম না করলে গ্রামে সর্বনাশ হবে।” তাঁর চোখমুখ এমনভাবে উগ্র হয়ে উঠল যে লোকেরা আর তর্ক করার সাহস পেল না। মহাদেব ঘোষণা করলেন, এক বিশাল পূজা আর হোম করতে হবে, যাতে অশুভ শক্তি শান্ত হয়। আর তার জন্য প্রচুর চাল, ডাল, ঘি, আর অবশ্যই টাকাপয়সা প্রয়োজন। গ্রামবাসীরা ভয়ে ভয়ে নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশি দিয়ে ফেলল, কারণ তাদের মনে হল, যদি পূজা না হয় তবে সর্বনাশ অবধারিত। মহিলারা কান্নাকাটি শুরু করল, পুরুষরা ঘর থেকে মাটির হাঁড়ি ভরে ধান, টাকা, এমনকি গয়না পর্যন্ত এনে ওঝার হাতে দিল। এভাবেই মহাদেব একেবারে গ্রামের উপর প্রভাব বিস্তার করলেন।

দিন যত গড়াতে লাগল, মহাদেবের দাপট ততই বাড়তে লাগল। তিনি বটগাছের চারপাশে লাল কাপড় বেঁধে দিলেন, চারদিকে কালো ধূপকাঠি গুঁজে রাখলেন, আর গম্ভীর গলায় বললেন—“এখন থেকে এই এলাকা অভিশপ্ত, এখানে কেউ যেও না। শুধু আমি যখন আসব, তখন আসা যাবে।” গ্রামবাসীরা দূর থেকে হাতজোড় করে প্রণাম করতে লাগল। অনেকে বলল, ওঝা না থাকলে হয়তো গ্রাম ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু গোপাল মাস্টারের রাগ চেপে রাখা গেল না। তিনি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—“এ সব ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়। মহাদেব ওঝা মানুষের ভয়কে পুঁজি করছে। অশুভ শক্তি থাকলে তার প্রমাণ দেখাও। নইলে কেন আমাদের কাছ থেকে এত টাকা নিচ্ছো?” তাঁর এই কথা শুনে মুহূর্তের জন্য জনতার ভিড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। অনেকের মনে হয়েছিল, সত্যিই তো, এত টাকার দরকার কেন? কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। মহাদেব রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন—“তুমি শিক্ষক হয়েছো বলে ভেবো না, সব বোঝো! ভূতপ্রেতকে হেলায় নিলে তোমারই সর্বনাশ হবে।” তিনি আঙুল তুলে গোপাল মাস্টারকে অভিশাপ দিলেন, “তোমার ঘরে শ্মশানের ছায়া নামবে।”

গোপাল মাস্টার শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“তোমার অভিশাপেও ভয় নেই, মহাদেব। আমি জানি সত্যের সামনে মিথ্যা টিকতে পারে না। মানুষকে ভয় দেখিয়ে প্রতারণা করা পাপ।” তাঁর কথা শুনে গ্রামবাসীদের মনে যেন এক ঝলক আলো জ্বলে উঠল, যদিও তারা সেই মুহূর্তে কিছুই প্রকাশ করল না। সবাই ভয়ে মুখ নিচু করে রইল, কারণ তারা জানত—ওঝার বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁর ক্রোধের শিকার হতে হবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেকেই ভাবল, হয়তো মাস্টার ঠিকই বলছেন। মহাদেব ওঝা তখন আরও জোরে চেঁচাতে লাগলেন, ধোঁয়া ছড়ানো ধূপকাঠি নেড়ে নেড়ে বললেন—“যদি পূজা না হয়, তবে একে একে সবার ঘরে মৃত্যুর ছায়া নেমে আসবে!” ভয়ঙ্কর ঘোষণা শুনে গ্রাম আবারও কেঁপে উঠল। এইভাবে মহাদেব ওঝার দাপট এক ভয়ঙ্কর শাসনে পরিণত হলো, যেখানে ভয় আর কুসংস্কার একসঙ্গে মিলে অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলল।

অধ্যায় ৬ –

চাঁদের আলোয় সেদিন গ্রাম যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। চারদিকের বাঁশবন থেকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছিল, আর দূরের কুকুরের ডাক অকারণেই বুক হিম করে দিচ্ছিল। সেই রাতেই গোপাল মাস্টার ঠিক করলেন, ভয়ের আড়ালে সত্যিটা খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু একা নয়—তার সঙ্গে গেল শীলা, যে অরুণের মৃত্যুর পর থেকে বটগাছটিকে নিজের বুকের ব্যথার সঙ্গে মেলাতে শিখেছে। দু’জন নিঃশব্দে অন্ধকার গলিপথ ধরে এগোতে লাগল। গ্রামের লোকদের জানানো হয়নি, কারণ কেউ জানলে আবার হৈচৈ বাধবে। গোপাল মাস্টারের চোখে ছিল কৌতূহলের জেদ, আর শীলার চোখে অদ্ভুত টান—যেন সে অপেক্ষা করছে অরুণের সঙ্গে দেখা হওয়ার। যতই তারা বটগাছের কাছে পৌঁছোল, শেকড়ের নিচের কালো অন্ধকার ততই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। বাতাসে একটা অচেনা গন্ধ—পুরনো ভেজা মাটি আর শুকনো পাতার গন্ধের সঙ্গে যেন মিশে ছিল শোকের আভাস।

হঠাৎ শীলা থমকে দাঁড়াল। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল—“মাস্টারমশাই, দেখুন…!” গোপাল মাস্টার চোখ কচলিয়ে তাকালেন। সত্যিই, বটগাছের শেকড়ের নিচে অদ্ভুত আলো ফুটে উঠছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে মানুষের কঙ্কালের রূপ ফুটে উঠল। কঙ্কালের হাড়গুলো চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে, যেন অন্ধকার ভেদ করে নিজের অস্তিত্ব জানাচ্ছে। গোপাল মাস্টার নিশ্বাস চেপে তা দেখছিলেন—যুক্তিবাদী মন বলছিল এ হয়তো কোনো প্রতারণা বা প্রাকৃতিক ভ্রম, কিন্তু চোখের সামনে যে দৃশ্য তিনি দেখলেন, তা যুক্তির সীমানা ছাড়িয়ে গেল। অথচ শীলা ভয়ে পিছিয়ে গেল না। বরং ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল—“অরুণ… তুমি কি আমায় ডাকছো?” সেই মুহূর্তে কঙ্কালের ফাঁপা চোখের গর্ত যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল, এক অচেনা আলোতে জ্বলে উঠল। শীলার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু তার চোখে জল ভরে গেল—সে অনুভব করল, এ অরুণেরই উপস্থিতি। অরুণ যেন নীরবে তাকে কিছু জানাতে চাইছে, যেন অসমাপ্ত সত্যটা প্রকাশ করার জন্য তার আত্মা ব্যাকুল হয়ে আছে।

গোপাল মাস্টার প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তিনি খেয়াল করলেন, কঙ্কাল কোনো ভয় দেখাচ্ছে না, বরং স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন অপেক্ষা করছে। হঠাৎ শীলার কণ্ঠ ভেসে এল কাঁপা সুরে—“আমি জানি তুমি শান্তি পাচ্ছ না, অরুণ। তুমি কি আমাকে বলতে চাইছো, কীভাবে তোমার মৃত্যু হয়েছিল?” শূন্য রাতের মধ্যে হালকা বাতাস বয়ে গেল, গাছের পাতাগুলো কাঁপতে লাগল, আর কঙ্কালের অবয়ব দুলে উঠল। সেই মুহূর্তে গোপাল মাস্টারের শরীর কাঁপলেও, তাঁর মনের ভেতর নতুন এক উপলব্ধি জন্ম নিল—এটা ভয় নয়, এটা রহস্য। অরুণের মৃত্যুর রহস্যই হয়তো কঙ্কালের আড়ালে লুকানো আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আলো মিলিয়ে গেল, কঙ্কালের অবয়ব অদৃশ্য হয়ে গেল, আবার চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। শীলা হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল, আর ফিসফিস করে বলল—“সে চাইছে আমরা সত্যিটা খুঁজে বের করি।” গোপাল মাস্টার শীলার কাঁধে হাত রেখে স্থিরভাবে বললেন—“হ্যাঁ শীলা, আমি এখন নিশ্চিত। এখানে কোনো অলৌকিক খেলা নয়—এখানে লুকিয়ে আছে হত্যার গোপন ইতিহাস।”

অধ্যায় ৭ –

পরদিন সকালেই গোপাল মাস্টার নিজের জেদি মানসিকতা নিয়ে নেমে পড়লেন খোঁজখবর করতে। এতদিন গ্রামে যে কথাটা চাপা ছিল, তিনি বুঝতে পারলেন এখন আর সেটাকে চেপে রাখা যাবে না। অরুণের মৃত্যু যেদিন হয়েছিল, সেই দিনটাতে কে কোথায় ছিল, কী ঘটেছিল—সব খুঁটিয়ে জানতে শুরু করলেন তিনি। শুরুতে অনেকে মুখ বন্ধ রাখল, ভয়ে কিংবা সুবিধার কারণে। কিন্তু গোপাল মাস্টারের অবিচল দৃষ্টির সামনে কিছু লোকের গলার স্বর কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে তিনি আবিষ্কার করলেন, অরুণকে সবাই যেমন বলেছিল ‘নদীতে ডুবে মারা গেছে’, তা আসলে ছিল সাজানো গল্প। নদীতে কোনো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি, অথচ দু’দিনের মধ্যেই বিষয়টা চাপা পড়ে গিয়েছিল। অরুণ ছিল সৎ, পরিশ্রমী, কিন্তু গ্রামের জমি সংক্রান্ত ঝামেলায় সে বারবার প্রতিবাদ করত। প্রভাবশালী হরিদাস মণ্ডল ও তার সঙ্গীরা গ্রামের জমি জোর করে দখল করছিল, আর অরুণ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। গোপাল মাস্টার খুঁজে খুঁজে বের করলেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী, যারা গোপনে বলল, সেই রাতেই হরিদাসদের সঙ্গে অরুণের ঝগড়া হয়েছিল। তারপর থেকে অরুণ আর বাড়ি ফেরেনি।

গোপাল মাস্টার যখন বিষয়টা গভীরভাবে খুঁজতে লাগলেন, তিনি জানতে পারলেন—অরুণকে হত্যা করা হয়েছিল পরিকল্পনা করে। তাকে প্রথমে আঘাত করে অচেতন করা হয়, তারপর শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয়। মৃতদেহ কোথায় লুকোনো হয়েছিল, সেই রহস্যই এতদিন কাউকে ভাবিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বটগাছের শেকড়ের সঙ্গে অরুণের আত্মা যে বাঁধা পড়ে আছে, সেটা এখন পরিষ্কার হতে শুরু করল। গ্রামসংলগ্ন বটগাছটির বিশাল শেকড়ের ফাঁকে ফাঁকেই ছিল অরুণের দেহ চাপা দেওয়া। মাটি আর শেকড় তাকে গ্রাস করে রেখেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দেহ হাড়ে পরিণত হয়, আর কঙ্কালের আবির্ভাব হয় প্রতি রাতে। গোপাল মাস্টার যুক্তি দিয়ে বুঝলেন, অরুণের আত্মা শান্তি পাচ্ছিল না কারণ তার মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অথচ আসল সত্য কেউ স্বীকার করতে চায়নি। এ ছিল এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র, যার আড়ালে লোভ, ক্ষমতা আর অন্যায়ের নির্মম হাত লুকিয়ে ছিল।

গ্রামের ভেতর খবরটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। গোপাল মাস্টার লোকজনকে একত্রিত করে বললেন—“অরুণকে দুর্ঘটনায় মারা গেছে বলা হয়েছিল, কিন্তু আসল সত্যটা হলো তাকে হত্যা করা হয়েছে। জমি দখলের লোভে হরিদাস মণ্ডল আর তার সঙ্গীরা এই অপরাধ করেছে। অরুণের দেহ বটগাছের শেকড়ে ফেলে রেখে তারা ভেবেছিল, চিরকাল এটা চাপা পড়ে থাকবে। কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। অরুণের আত্মা আজও মুক্তি চাইছে।” গ্রামবাসীরা হতবাক হয়ে গেল। এতদিন যে ভয়কে ‘অলৌকিক’ ভেবে কেঁপে উঠেছিল, তা আসলে ছিল রক্তমাংসের মানুষের লোভের ফল। সবাই বুঝতে পারল, মহাদেব ওঝার পুজো-যজ্ঞ কোনো সমাধান নয়, সত্যের মুখোমুখি হওয়াই একমাত্র পথ। শীলার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিল, সে নিঃশব্দে ফিসফিস করল—“অরুণ, অবশেষে সত্যটা সবাই জানল।” গোপাল মাস্টারের চোখেও জ্বলে উঠল এক দৃঢ়তা—এখন শুধু বাকি আছে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা, আর অরুণের আত্মাকে প্রকৃত মুক্তি দেওয়া।

অধ্যায় ৮ –

অরুণের মৃত্যুর সত্যটা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করতেই গ্রামে যেন অদ্ভুত আলোড়ন দেখা দিল। গোপাল মাস্টার আর শীলা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“এই হত্যার বিচার না হলে অরুণের আত্মা শান্তি পাবে না, গ্রামও মুক্ত হবে না।” সাধারণ মানুষ প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, ভেতরে ভেতরে অনেকেই চাইছিল এই অন্যায়ের অবসান হোক। কিন্তু হরিদাস মণ্ডলের অবস্থান ছিল একেবারেই ভিন্ন। প্রভাবশালী ও ধূর্ত মানুষটি বুঝতে পারল, সত্য প্রকাশ পেলে সবার আগে তার নামই আসবে। তাই সে গ্রামবাসীদের একত্র করে বলল—“সব বাজে কথা। কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি। অরুণ মদ খেয়ে নদীতে পড়ে মারা গেছিল। এখন যারা ভুয়া গল্প ছড়াচ্ছে, তারা আসলে গ্রামে অশান্তি ছড়াতে চাইছে।” তার গলায় ছিল ভয় মিশ্রিত হুঁশিয়ারি—“যে এই কথা বলবে, সে আমার রোষ থেকে রেহাই পাবে না।” হরিদাস জানত, গ্রামবাসীরা এখনো ভয়কেই বড় সত্যি মনে করে, তাই সেই ভয়কেই কাজে লাগাল। মানুষ একে অপরের দিকে তাকাল, কেউ সাহস পেল না মুখ খোলার। এভাবে হরিদাস সত্যের পথ আটকে দিলেন।

গোপাল মাস্টার অবশ্য সহজে হার মানলেন না। তিনি গ্রামে জোর গলায় বলতে থাকলেন—“হরিদাস মণ্ডলই আসল অপরাধী। সে আর তার সঙ্গীরাই অরুণকে মেরেছিল।” কিন্তু তখনই শুরু হল হরিদাসের পাল্টা চাল। সে কয়েকজন গুণ্ডা টাইপ লোক ভাড়া করে আনল, যারা রাতে গোপাল মাস্টারের বাড়ির সামনে গিয়ে ভয় দেখাল। শীলার দিকেও কুৎসিত ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিল তারা, যাতে ভয় পেয়ে সে চুপ থাকে। কিন্তু শীলা বরং আরও শক্ত হয়ে দাঁড়াল। সে বলল—“অরুণের আত্মার কাছে আমি দায়বদ্ধ। সত্যিটা আমি প্রকাশ করবই।” এ কথা শুনে হরিদাস আরও ক্ষিপ্ত হল। সে পঞ্চায়েতে বসে ঘোষণা করল, “যে এসব মিথ্যে কথা ছড়াবে, তার কোনো জায়গা থাকবে না এই গ্রামে।” তার কণ্ঠে দাপট থাকলেও ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা স্পষ্ট হচ্ছিল। কারণ সে জানত, যতই চাপ দিক, একদিন না একদিন সত্য ফাঁস হবেই। আর সেই সত্যই তার সর্বনাশ ডেকে আনবে।

এদিকে গ্রামবাসীদের মনেও দ্বন্দ্ব শুরু হল। একদিকে হরিদাসের ভয়, অন্যদিকে গোপাল মাস্টার ও শীলার সত্যভিত্তিক সাহসী বক্তব্য। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলতে লাগল—“হয়তো মাস্টার ঠিকই বলছে।” আবার কেউ চুপ করে রইল, কারণ তারা জানত, হরিদাসের রোষ ভীষণ। গ্রামে ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য চাপা টানাপোড়েন ছড়িয়ে পড়ল। রাতে কেউ ঠিকমতো ঘুমোতে পারল না। বটগাছের তলায় এখনো মাঝে মাঝে কঙ্কালের আবির্ভাব হচ্ছিল, যা অরুণের আত্মার নীরব প্রতিবাদ হিসেবে দেখা দিচ্ছিল। শীলা প্রতিবার সেটা দেখেই আরও দৃঢ় হচ্ছিল। গোপাল মাস্টার বললেন—“সত্য চাপা পড়ে থাকলে এই আত্মা শান্তি পাবে না। আমাদের লড়াইটা শুধু অরুণের জন্য নয়, এই গ্রামের ভবিষ্যতের জন্যও।” কিন্তু হরিদাস যেভাবে ভয় আর দমননীতির জাল বিছিয়ে দিল, তাতে সত্যের পথ আরও দুর্গম হয়ে উঠল। গ্রামের মাটিতে যেন তখন অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল—একদিকে অন্যায়ের দাপট, অন্যদিকে সত্যের আলোকবর্তিকা।

অধ্যায় ৯ –

সেই রাতে শীলা বিছানায় শুয়ে থাকলেও তার চোখে ঘুম নামছিল না। দিনের পর দিন বটগাছের তলায় অরুণের কঙ্কালের আবির্ভাব, গোপাল মাস্টারের সাহসী লড়াই, আর হরিদাস মণ্ডলের হুমকি—সব মিলিয়ে তার ভেতর এক অস্থিরতা জমা হচ্ছিল। অবশেষে ক্লান্ত শরীর তাকে ঘুমের জগতে টেনে নিল। ঘুম ভাঙতেই সে দেখল, চারপাশে এক অদ্ভুত আলোয় ভেসে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে সেই বটগাছের নিচে, কিন্তু পরিবেশটা অস্বাভাবিক নীরব। হঠাৎই পাতার ঝিরঝির শব্দের ফাঁক দিয়ে এক পরিচিত মুখ ভেসে উঠল—অরুণ। তবে সে আর রক্তমাংসের অরুণ নয়, বরং এক স্বচ্ছ, ধোঁয়াশার মতো রূপ। তবুও শীলা এক মুহূর্তে তাকে চিনে নিল। বুক কেঁপে উঠল, চোখ ভিজে গেল। অরুণ নীরব কণ্ঠে বলল—“শীলা, আমি শান্তি পাচ্ছি না। যতদিন না সত্যিটা সবাই জানে, ততদিন আমি মুক্ত হব না।” তার গলায় কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল শুধু এক গভীর ব্যাকুলতা।

শীলা হাত বাড়িয়ে অরুণকে ছুঁতে চাইল, কিন্তু তার আঙুল শুধু শূন্যতাকে স্পর্শ করল। সেই মুহূর্তে অরুণের চোখে জল ভেসে উঠল, অথচ তার ঠোঁট কাঁপল এক নিঃশব্দ মিনতির সুরে—“আমি বারবার কঙ্কালের রূপে ফিরে আসছি, শুধু সবাইকে মনে করিয়ে দিতে যে আমার মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। কিন্তু যদি সত্যিটা চাপা পড়ে থাকে, তবে আমি চিরদিন এই বটগাছের সঙ্গে বাঁধা পড়ে থাকব।” শীলার গলা আটকে এলো। সে ফিসফিস করে বলল—“অরুণ, আমি চেষ্টা করছি। মাস্টারমশাইও চেষ্টা করছেন। কিন্তু হরিদাস মণ্ডল…” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অরুণ ধীরে মাথা নেড়ে বলল—“ভয় পেয়ো না। অন্যায়ের শিকড় যত গভীরই হোক, সত্য একদিন ফুঁড়ে বেরোয়। তুমি কেবল থেমো না।” সেই স্বপ্নদৃশ্যের প্রতিটি শব্দ শীলার হৃদয়ে খোদাই হয়ে গেল।

হঠাৎ শীলা দেখল, চারপাশের আলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অরুণ ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে, কিন্তু মিলিয়ে যাওয়ার আগে তার কণ্ঠ আবার ভেসে এল—“আমায় মুক্ত করো, শীলা। শুধু সত্য প্রকাশ পেলেই আমি শান্তি পাব।” স্বপ্ন ভেঙে শীলা ঘাম ভেজা শরীরে জেগে উঠল। চারপাশে নিস্তব্ধ রাত, শুধু দূরে কুকুরের ডাক। কিন্তু তার বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, অরুণের আত্মা আর দেরি সইতে পারছে না। এখন সত্য প্রকাশ করাটাই তার একমাত্র দায়িত্ব। সেই মুহূর্তে তার ভয় উধাও হয়ে গেল। সে প্রতিজ্ঞা করল, যতই বাধা আসুক না কেন, সে হরিদাস মণ্ডলের দাপটকে আর ভয় করবে না। অরুণের আত্মার মুক্তিই হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য, আর সেই লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সে থামবে না।

অধ্যায় ১০ –

পরদিন সকালে গোপাল মাস্টার আর শীলা একসঙ্গে গ্রামের চত্বরের দিকে এগোলেন। চারপাশে তখন এক অদ্ভুত টানটান পরিবেশ। গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছিল, তাদের চোখে কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্রণ। এতদিন যে সত্য চাপা ছিল, আজ তা প্রকাশিত হবে—এই আভাস যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। গোপাল মাস্টার শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“আমি এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছি যা অরুণের মৃত্যুর আসল রহস্য উন্মোচন করবে।” তিনি হাতে তুলে ধরলেন কিছু নথি—অরুণের জমির কাগজপত্র, যা তার নামে ছিল, কিন্তু মৃত্যুর পর সেগুলো হরিদাস মণ্ডলের নামে ঘুরে গেছে। সঙ্গে আরও কয়েকজন বৃদ্ধ গ্রামবাসী সাক্ষ্য দিলেন—সেই রাতের ঝগড়া তারা নিজের চোখে দেখেছিল, কিন্তু ভয়েই এতদিন চুপ ছিল। শীলা তখন কাঁপা গলায় জানাল, “অরুণ শুধু আমার বন্ধু ছিল না, সে এই গ্রামের ন্যায়ের জন্য লড়ছিল। তাকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ সে অন্যায়ের সামনে মাথা নত করতে চায়নি।” গ্রামের মাটিতে তখন নিস্তব্ধতা নেমে এলো, যেন সবাই একসঙ্গে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে।

হরিদাস মণ্ডল প্রথমে প্রতিবাদ করে উঠল—“সব মিথ্যে! এরা আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।” তার কণ্ঠে আগের মতো দৃঢ়তা ছিল না, বরং আতঙ্কের ছায়া ভেসে উঠেছিল। গোপাল মাস্টার তখন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—“যদি সত্যিই মিথ্যে হয়, তবে কেন এই জমির কাগজে তোমার নাম? কেন প্রত্যক্ষদর্শীরা একই ঘটনা বলছে? আর কেন অরুণের দেহ বটগাছের শেকড়ে চাপা পড়ে ছিল?” এই প্রশ্নগুলির সামনে হরিদাস একেবারে নীরব হয়ে গেল। তার মুখ থেকে কোনো উত্তর বেরোল না। গ্রামবাসীরা তখন আর ভয় পেল না। যে মানুষ এতদিন ভয় দেখিয়ে তাদের শাসন করেছে, তার মুখোশ খুলে পড়তেই তার ভেতরের কাপুরুষতা প্রকাশ পেল। একে একে অনেকে এগিয়ে এসে বলল—“আমরা এতদিন ভুল করেছি। অরুণকে বাঁচাতে পারিনি, কিন্তু আজ তার ন্যায়ের লড়াই শেষ করতে হবেই।” মুহূর্তের মধ্যেই হরিদাস ও তার সঙ্গীদের ঘিরে ধরল গ্রামবাসীরা। তারা আর কোনো বাহ্যিক শাসনের অপেক্ষা করল না, নিজেদের নিয়মে অপরাধীদের শাস্তি দিল, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর লোভের কারণে নিরীহ প্রাণ কেড়ে নেওয়ার সাহস না করে।

সন্ধের দিকে বটগাছের নিচে অরুণের কঙ্কালকে সম্মানের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হল। শীলার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল প্রশান্তির ছাপ। অরুণের কঙ্কালের ওপর ফুল রেখে সে মৃদু স্বরে বলল—“তুমি এখন মুক্ত, অরুণ।” গোপাল মাস্টারও মাথা নত করলেন, তিনি অনুভব করলেন সত্যের জয় শুধু অরুণের আত্মাকে মুক্ত করল না, গ্রামকেও অশুভ ছায়া থেকে উদ্ধার করল। সমাধিস্থ হওয়ার পর থেকে আর কখনো বটগাছের নিচে কঙ্কাল দেখা যায়নি। বাতাস যেন হালকা হয়ে উঠল, গ্রামবাসীরা নতুন করে শান্তি পেল। রাতের অন্ধকারে যখন শীলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের বটগাছটির দিকে তাকাল, সে অনুভব করল অরুণের আত্মা আর বন্দি নেই। তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা জাগল, যেন অরুণ বিদায় জানিয়ে চলে গেছে অন্য কোনো মুক্ত জগতে। বটতলার রহস্যের অবসান হলো, আর সেই সঙ্গে হলো এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের অবসান। শীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তবে সেটা ছিল স্বস্তির—অরুণের আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে।

-শেষ-

1000058090.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *