Bangla - হাস্যকৌতুক

বউ ও পাসওয়ার্ডের রহস্য

Spread the love

বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন সকাল থেকেই। জানালার কাঁচে টুপটাপ বৃষ্টির ছোঁয়া, আর রান্নাঘরে উনুনে ফুটছে ডালের হাঁড়ি। সঞ্চিতা চা বানাতে বানাতে বারান্দার দিকে একবার তাকালো। ঘরের মধ্যে স্বামী অনিরুদ্ধ তখন গুটিশুটি হয়ে সোফায় মোবাইলে কিছু দেখছিল।

মাঝে মাঝে তার মুখে হাসির রেখা—কখনও এক ফুঁয়ে হেসে ওঠা, আবার কখনও ঠোঁটের কোণে এক ধরণের রহস্যময় চওড়া হাসি। সঞ্চিতার চোখ সেদিকে স্থির। বেশ কিছুদিন ধরে এই দৃশ্যটা সে বারবার দেখছে। বিশেষ করে রাত আটটার পর থেকে মোবাইল যেন অনিরুদ্ধর জীবনের দ্বিতীয় স্ত্রীর মতো আচরণ করে—সারাক্ষণ চ্যাটিং, অদ্ভুত অডিও মেসেজ, আর মাঝেমধ্যে কিছু ‘টিং টিং’ শব্দে স্বামীর মুখে এক অদ্ভুত হাসি।

সঞ্চিতার ভেতরে একটু একটু করে জন্ম নিচ্ছে সন্দেহের একটা ছোট্ট বীজ।
এই বীজটা একদিনেই জন্মায়নি। গত সপ্তাহে যখন তারা একসাথে সিনেমা দেখতে গেছিল, তখনও অনিরুদ্ধ বারবার ফোন দেখে কিছু একটা লিখছিল।
সে বলেছিল, “ওফিসের কাজ। মেসেজ আসছে।”

কিন্তু সঞ্চিতা জানে—ওর অফিসের মেসেজ এত রোমান্টিক হয় না, যেখানে মানুষ হঠাৎ হেসে ওঠে, আবার মাঝেমধ্যে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।

সেইদিনই সঞ্চিতা সিদ্ধান্ত নেয় — পাসওয়ার্ড ভাঙতেই হবে।

সেদিন দুপুরবেলা, রান্না সেরে ফাঁকা ঘরে বসে ছিল সঞ্চিতা। অনিরুদ্ধ তখন স্নান করতে গিয়েছে। এই সুযোগ! তার মোবাইলটা বিছানার ওপরে পড়ে। চুপিচুপি পা ফেলে সঞ্চিতা গেল সেই ফোনটার কাছে।

হাত কাঁপছে… মনে হচ্ছে চুরি করছে।
কিন্তু এটা কি চুরি?
একজন স্ত্রী যদি নিজের স্বামীর পাসওয়ার্ড জানার চেষ্টা করে, সেটা কি অন্যায়?

সে নিজেই নিজের চিন্তাধারাকে জবাব দেয়—
“না, আমি তো ওর স্ত্রী। আমার অধিকার আছে। আর সত্যি কিছু না থাকলে ও আমাকে নিজেই পাসওয়ার্ড বলত!”

ফোন হাতে নিয়ে সে স্ক্রিন অন করলো।
চোখের সামনে ভেসে উঠল ছয়টি খালি বক্স।
ছয় সংখ্যার পাসওয়ার্ড।

প্রথমেই চেষ্টা করলো অনিরুদ্ধর জন্মদিন —
“130385” — ভুল।
নিজের জন্মদিন —
“210488” — ভুল।
বিয়ের তারিখ —
“240617” — ভুল।

মনে পড়ল, অনিরুদ্ধ একদিন বলেছিল,
“পাসওয়ার্ড একদম সহজ, তুই একবার ভাবলে পেরে যাবি!”

এই সহজ বলে যে আসলে সবচেয়ে কঠিন হবে— সেটা সঞ্চিতা বুঝতে পারেনি।

পরদিন থেকে শুরু হল তার মিশন — “পাসওয়ার্ড ভাঙো অভিযান”।

সে একটা নোটবুক নিয়ে বসল। প্রতিদিন যেসব ঘটনা ঘটে, যেসব কথা হয়, সব নোট করে রাখে।
অনিরুদ্ধ যখন রান্নাঘরে আসছে, তার চোখ কোথায়? কোন কথায় হাসছে? রাতে ঘুমোবার আগে কোন অ্যাপে ঢোকে—সব!

একদিন লক্ষ্য করল, অনিরুদ্ধ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা মেসেজ পড়ে মুখ টিপে হেসে বলে, “আবার ওইটা!”

সঞ্চিতা ভেবে পেল না — “ওইটা” মানে কী?

রাত তিনটার সময় সে ঘুম থেকে উঠে অনিরুদ্ধর মাথার নিচ থেকে ফোনটা বার করে আনে। এবার সে গুগল করে —
“How to unlock husband’s phone without password?”

গুগল বলল — “Ask your husband directly.”

সে হাসে।
“ধুর! তাহলে তো গল্পটাই শেষ হয়ে যাবে!”

এদিকে অনিরুদ্ধ বুঝতে পেরেছে কিছু একটা গরম গরম রান্না হচ্ছে — কিন্তু সেটা সুজি না সন্দেহ, বোঝা যাচ্ছে না।
সে একদিন হাসতে হাসতে বলে,
“তুই কি আমার ফোনের ডিটেকটিভ নাকি? দেখি দেখি, কোথা থেকে এই চোখের ‘এনালাইসিস’ এলো?”

সঞ্চিতা তখন খুব স্বাভাবিকভাবে বলল,
“তোমার ফোনটাই তো তোমার সবচেয়ে প্রিয়, এখন তো কেবল তাকেই ভালোবাসো!”
তার গলায় যেন হালকা অভিমানের ছোঁয়া।

অনিরুদ্ধ তখন হাসে।
“তুই তো জানিস, আমার পাসওয়ার্ড তোকে ভেবেই বানানো — একটু ভাবলে বুঝে যাবি!”

এই কথাটাই ছিল সঞ্চিতার সবচেয়ে বড় ধাঁধা।

পাসওয়ার্ড তোকে ভেবে বানানো? তাহলে সেটা কি তার নাম? তার ডাকনাম? তার ফোন নাম্বার?

সে আবার পরীক্ষা করে —
“sanchu” — ভুল।
“snchita” — ভুল।
“123456” — সেই পুরনো ট্রায়াল — ভুল।

আবার ফোন লকড হয়ে যায় ৩০ মিনিটের জন্য।

তারপর এক সন্ধ্যায়, চা খেতে খেতে সঞ্চিতা একটা ফোন কলে কান পাতল।
অনিরুদ্ধ কাউকে বলছে —
“আচ্ছা ঠিক আছে, কালকেই পাঠাবো রেসিপিটা। ওটা সঞ্চিতার রান্না— আমি শুধু forward করছি!”

সঞ্চিতা চোখ বড় করে তাকাল।
“মানে, আমি রান্না করি আর তুমি কারো সাথে শেয়ার করো? কাকে পাঠাও বলো তো?”

কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
চুপচাপ ফোনটা নাম্বার দেখে রাখল।
নাম্বারটা ‘Misti Mon’ নামে সেভ করা।

এই নাম শুনেই সঞ্চিতা রীতিমতো অবাক!
‘মিষ্টি মন’? কে এই ‘মিষ্টি মন’?

সে ভাবতে থাকে — কোনো প্রেমিকা? নাকি অফিস কলিগ? নাকি কোনো পুরোনো সম্পর্ক?

এইসব ভাবতে ভাবতে সেদিন রাতেই সঞ্চিতা সিদ্ধান্ত নিল — এই ‘মিষ্টি মন’ রহস্য ফাঁস করতেই হবে!

***

যে মুহূর্তে সঞ্চিতা “মিষ্টি মন” নামটা মোবাইল স্ক্রিনে দেখল, তার মাথার ভেতর যেন ঝড় শুরু হয়ে গেল। একটা অদ্ভুত গুমগুমে রাগ, একটা চোরাগোপ্তা কৌতূহল, আর একটা মারাত্মক গরম সন্দেহ সব একসাথে কিলবিল করে উঠল।

“মিষ্টি মন? কাকে বলে এমন নাম রে বাবা! পুরো কবিতার মতো শোনাচ্ছে। অনিরুদ্ধ আর কবিতা! অসম্ভব কিছু নয়, কারণ ও তো কলেজ লাইফে বাংলা ডিপার্টমেন্টের সেকেন্ড গার্জিয়ান ছিল। প্রত্যেক ফার্স্ট ইয়ারের কবিতা নিয়ে বক্তৃতা দিত, আর এখন হঠাৎ করে ফোনে এমন রোমান্টিক একটা নাম রাখা?”

কিন্তু মজার কথা হচ্ছে, সঞ্চিতা ঠিক খোলাখুলি কিছু বলতে পারছে না। কোনো প্রমাণ নেই, কোনো খোলসা করা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট সে এখনও দেখেনি, শুধু নামটা দেখে যে পরিমাণ জ্বালা শুরু হয়েছে, সেটা জল দিয়ে নেভানো যাবে না।

সেই রাতটা সঞ্চিতা ভালো করে ঘুমোতে পারল না। বিছানার অন্য পাশে ঘুমিয়ে থাকা অনিরুদ্ধ যেন এক বিশাল ধাঁধার মতো, যার উত্তর লুকিয়ে আছে কোনো ছয় সংখ্যার কোডে আর ‘মিষ্টি মন’ নামক অদৃশ্য কোনো চরিত্রে।

পরদিন সকালে সঞ্চিতা স্বাভাবিকভাবে চা নিয়ে অনিরুদ্ধর পাশে বসল। মুখে হাসি, কিন্তু চোখে কৌতূহল।

— “শোনো তো, একটা কথা বলো। তোমার ফোনে এমন কেউ আছে যার নাম ‘মিষ্টি মন’?”

অনিরুদ্ধ তখন অফিসের প্রেজেন্টেশন বানাচ্ছিল। মাথা না তুলে বলল,
— “হ্যাঁ আছে তো। তুই চিনিস না, ও আমার স্কুলের বন্ধু দীপ্ত। ওর বউয়ের নামও সঞ্চিতা, তাই কনফিউশন এড়াতে ওর নাম সেভ করেছি ‘মিষ্টি মন’।”

সঞ্চিতা ঠোঁট চেপে হাসল।
— “তাই নাকি? তাই তো ভাবছিলাম, এই ‘মন’ আবার এত ‘মিষ্টি’ হল কবে!”

অনিরুদ্ধ হেসে বলল,
— “আরে, বন্ধুত্বের খাতিরে নাম দিয়েছি মিষ্টি মন। একটা সময় আমাদের গ্রুপে সবাই একে-অপরকে এমন ছদ্মনামে ডাকত। কারো নাম ছিল ‘কালো চাঁদ’, কারো ‘চশমা সিং’। আসল নাম তো কেউ ব্যবহারই করত না। সেভাবে সেভ করে আছে এখনও।”

সঞ্চিতা মুখে হাসল, কিন্তু মনে মনে বলল,
“তুই যা-ই বলো, আমি কিন্তু ‘মিষ্টি মন’ রহস্যটা পাঁকে পড়ে খুঁজে বের করবই।”

পরদিন সন্ধ্যায়, অনিরুদ্ধ বাইরে বেরোবে। সঞ্চিতা পরিকল্পনা করে ফেলেছে।
সে অনিরুদ্ধর ফোন একবারের জন্য হলেও পেতে চায়। এবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নয়, এবার সে আরেক ধাপ এগোবে।

অনিরুদ্ধ স্নানঘরে ঢোকার আগেই সে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি বাইরে যাচ্ছ তো, আগে তোমার মোবাইলটা চার্জে দিয়ে দিই। এমনিতেই তো সবসময় ব্যাটারি কমে যায়।”

অনিরুদ্ধ খুশি মনে ফোনটা দিল।
সঞ্চিতা সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে চার্জে দিল, কিন্তু কেবলটা এমনভাবে লাগালো যাতে ফোন একসাথে খুলে রাখা যায়। ওদিকে অনিরুদ্ধ শাওয়ারে ঢুকে পড়ল, আর সঞ্চিতা ঝটপট ফোনটাকে ফ্লাইট মোড করে দিল — যাতে হঠাৎ কোনো কল বা মেসেজ না আসে।

এরপর শুরু হল চেষ্টা —
আরও একবার সে পাসওয়ার্ড দিতে গেল — এবার আন্দাজ করল “143143” — অর্থাৎ I Love You I Love You।
ভুল।

“তবে কি ‘123143’? বা হয়তো ‘241143’ — মানে ২৪শে নভেম্বর, তাদের প্রথম কফি ডেট!”

সব ভুল।

হঠাৎ তার মাথায় এল এক বুদ্ধি —
অনিরুদ্ধ যখন কখনো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই যে আমার পৃথিবী, পাসওয়ার্ড জানতেও পারবি না!”, তখন ‘পৃথিবী’ কথাটা দিয়ে কি কিছু কোড বানানো হয়েছে?

সে আবার ট্রাই করল:
P-R-I-T-H-I-B-I → মানে 7 অক্ষর। তবু একবার 7748424 দিয়ে দেখে।
ফের ভুল!

ফোন আবার লকড ১ মিনিটের জন্য।

হঠাৎ হঠাৎ কাঁপা হাতে সে একটা চেষ্টা করে — অনিরুদ্ধের জুতো সাইজ হলো ৮। ওর সবচেয়ে পছন্দের ক্রিকেটার ধোনি, যার জার্সি নাম্বার ৭। বিয়ে করেছিল ওদের ৩০ বছর বয়সে। তো একবার দিল — 783030।

ফোন খুলে গেল।

সঞ্চিতা হাঁ করে তাকিয়ে রইল!
এই পাসওয়ার্ডটা সত্যি খুলে গেল?

সে কিছুক্ষণের জন্য হতবাক। তারপর ধীরে ধীরে হোয়াটসঅ্যাপ খুলল।
টপে চ্যাট — “Misti Mon”।

সে ট্যাপ করল।

ওপেন হতেই চ্যাট খুলে গেল —
সেখানে যা লেখা আছে, তাতে সঞ্চিতা প্রথমে চমকে গেল, তারপর ঠোঁটে এল এক চাপা হাসি।

— “আজকের পটল আলুভাজাটা সুপার হয়েছে, রেসিপিটা পাটিয়ে দিস।”
— “তোর বাসায় বানানো দইচিঁড়ে আবার খেতে ইচ্ছে করছে।”
— “ভাল্লাগে রে, তোর বউয়ের হাতের রান্না!”
— “ওকে বলিস, একদিন আমার বউকে শেখাতে!”

আরও কিছু চ্যাট —
— “তোর বউ কীভাবে পেঁয়াজ না দিয়ে এমন সুস্বাদু চিংড়ি মালাইকারি বানায়, বুঝতে পারি না!”

সঞ্চিতা একটু হেসে ফেলল।
এ তো আসলে রেসিপি ক্লাব!
আর ‘মিষ্টি মন’ নামটা সেই বন্ধু দীপ্ত, যে নিজের বউয়ের কাছে স্বীকার করতে পারে না যে অন্যের বউয়ের হাতের রান্না বেশি ভালো লাগছে!

হঠাৎ করে অনিরুদ্ধ স্নানঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল —
“সঞ্চু! আমার তোয়ালে দে তো, ভুলে ঢুকে গেছি।”

সঞ্চিতা চট করে ফোন রেখে আবার চার্জার লাগিয়ে দিল।
তারপর তোয়ালে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল —
“তুমি তো সত্যিই একটা… ছোটদের রান্নাঘরের মাস্টারচেফ হয়ে গেছ!”

অনিরুদ্ধ ভেজা মাথায় তাকিয়ে হেসে বলল —
“তুই যে আমার রান্নাঘরের রানী, সেটা তো সবাইকে জানাই!”

সেই রাতে সঞ্চিতা বিছানায় শুয়ে ফোনটা নিজের দিকে তাক করে বলল —
“তোমার পাসওয়ার্ড আমি পেয়েছি। কিন্তু তুমি যেভাবে আমার রেসিপির ফ্যান ক্লাব খুলে রেখেছো, সেটা বুঝে আজ আমি রাগ করিনি।”

তারপর সে নিজেই এক চিঠি লিখল ফোনের নোটে —
“মিষ্টি মন, তোমার যেটা সবচেয়ে মিষ্টি — সেটা হলো আমার রান্না নিয়ে তোমার শ্রদ্ধা। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, পরের বার যদি নিজের বউকে শেখাতে বলো, তাহলে আমি ফ্রিজে তালা মারব।”

***

সেদিন রাতটা আর পাঁচটা রাতের মতো ছিল না।
সঞ্চিতা বিছানায় শুয়ে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, “এই মানুষটা এত বছর ধরে আমার পাশে আছে, অথচ আমার অজান্তেই একটা গোপন ‘রান্না রিভিউ ক্লাব’ চালায়?”

এটা কোনো অপরাধ নয়, তবু কেন যেন ভেতরটা একটু ‘ঘুরঘুর’ করছে।
বিশেষ করে যখন অন্য কেউ আমার রান্না নিয়ে ‘মিষ্টি মন’ হয়ে প্রশংসা করে, আর সেটা আমার সামনে বলা হয় না— তখন তো জিজ্ঞেস করতেই হয়—

“আর কী কী লুকানো আছে অনিরুদ্ধর মোবাইলে?”

পরদিন সকালে অনিরুদ্ধ অফিস চলে যাওয়ার পর সঞ্চিতা ঠিক করল, এবার সে আর পাসওয়ার্ড বা চ্যাট পড়ে সন্দেহ করবে না, বরং সরাসরি অনুসন্ধানে নামবে।

না, এই অনুসন্ধান আর ফোনে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
এবার সে ঢুকবে… “রন্ধন রহস্য সংঘ”-এর গোপন জগতে!

সন্ধ্যাবেলা, সঞ্চিতা তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেল — মৌসুমী, যার স্বামী অপু অনিরুদ্ধর খুব কাছের বন্ধু। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, অপুর ফোনেও সঞ্চিতা আগেই একবার “Foodie-Queen” নামে একটা চ্যাট দেখেছিল।

সে খুব কৌশলে বলল,
— “তুই কি জানিস অপু রান্না নিয়ে কোনো ক্লাবে আছে?”

মৌসুমী চমকে বলল,
— “তোর কাছে কি অপু নিজের সেই ‘গোপন ক্লাব’-এর কথা বলেছে? ও তো বলে, সেটা নাকি শুধু ‘ঘর জামাইদের জন্য রান্নার প্রতিশোধ সংঘ’!”

সঞ্চিতা চোখ বড় করে বলল,
— “মানে?”

— “মানে, এই ক্লাবটা হচ্ছে একদল অফিসফেরত ক্লান্ত পুরুষের খাবার-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার জায়গা। কেউ কারোর স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলে না, শুধু বলে— ‘আজ মশলা কম’, ‘ভাজা কাঁচা’, ‘পান্তা ভেজা’। তারপর একজনের বউ যদি ভালো কিছু রান্না করে, তখন সেটা নিয়ে একটা বিস্তৃত রিভিউ হয়। কেউ আবার রেটিংও দেয়— ১০-এর মধ্যে ৭.৫!”

সঞ্চিতা এবার পুরোপুরি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল।
একটা আস্ত “গোপন রান্না বিশ্লেষক ক্লাব”, যেখানে স্বামীরা নিজেদের জীবনের রান্না-ট্র্যাজেডি ও কমেডি নিয়ে আলোচনা করে!

সেদিন রাতেই সে ঠিক করল— এই ক্লাবে ঢুকতেই হবে!

পরদিন অনিরুদ্ধ অফিসে যাওয়ার পর, সঞ্চিতা মোবাইল খুলে আবার চ্যাট ঘাঁটল।

এইবার শুধু “Misti Mon” নয় — একের পর এক নতুন নতুন নাম চোখে পড়ল:

“Masala Suraj”

“JolBhora Jibon”

“Salt-Free Satyajit”

“Kacha-Lonka Kunal”

চ্যাট খুলতেই হাসির খোরাক শুরু —
“আজকের লুচি এত শক্ত, মনে হল ছাতা বানালে বৃষ্টি ঢুকবে না!”
“আমার দুধপিঠে খেতে গিয়ে দাঁত ভেঙে গেল— পিঠে তো নয়, যেন পাথরে গাঁজা পিষেছে!”
“মনে হয় বউ আমার ওপর অভিমান করে আলুর দমে আলুই দেয়নি!”

আর সেখানেই অনিরুদ্ধের ম্যাসেজ:
— “আজ আমার কপালে পরিজ কপালে পড়েছে, তবে বউয়ের তেলছাড়া চিংড়িটা জিতে নিল ৯.২ পয়েন্ট।”

সঞ্চিতা এবার ফোন ফেলে রেখে নিজের হাসি সামলাতে পারল না।
ওর চোখে জল এসে গেল— আনন্দে, বিস্ময়ে, আর একটা নিঃশব্দ দাম্পত্য নাটকে নায়িকা হওয়ার গর্বে।

কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনে হল,
“আমি যদি ক্লাবের সদস্য হই— মানে গোপনে না, খোলাখুলিভাবে— তাহলে কেমন হয়?”

সেদিন বিকেলবেলা, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে অনিরুদ্ধর পাশে বসল।
— “তুমি একটা কথা বলো তো, তুমি কি কোনো ‘সিক্রেট ক্লাব’-এ আছো?”

অনিরুদ্ধ থমকে গেল।
— “তুই কী বলছিস!”

— “মানে, আমি শুনেছি কিছু পুরুষ নিজেদের রান্না-অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলে একটা ক্লাবে। সেখানে রেটিং-শেটিংও চলে…”

অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।
— “তা বললেই হত! আমি ভাবলাম কি জানি কী শুনেছিস! আরে এটা তো শুধু মজা করে, আমাদের একটা ছোট্ট WhatsApp গ্রুপ— ‘রন্ধন রহস্য সংঘ’। কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। শুধু রান্না নিয়ে মজা করি, জানিস না? তোদের রান্নার মূল্যায়নই তো করি!”

সঞ্চিতা কপট রাগে বলল,
— “বউকে না জানিয়ে রেটিং দেওয়া যায়?”
— “তাহলে তো আমিও একটা গ্রুপ খুলে বলি— আজ পায়ে গন্ধ ১০-এর মধ্যে ৮!”

অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
— “তুই চাইলে ক্লাবেই ঢুকতে পারিস! নতুন একটা শাখা খোল— ‘রন্ধন রহস্য সংঘ: বউ এক্সটেনশন।’”

সঞ্চিতা এবার শান্তভাবে বলল,
— “না, আমি তোদের পুরোনো গ্রুপেই ঢুকতে চাই। আমি জানি আমি কী রান্না করি। কিন্তু আমি দেখতে চাই, তোরা কীভাবে বলিস— সরষে ইলিশে সরষে কম, আর চিংড়িতে চিংড়ি বেশি!”

অনিরুদ্ধ সেদিন রাতে এক দমে বলল,
— “ঠিক আছে, কাল থেকে তুই আমাদের ক্লাবের সম্মানিত মেম্বার!”

এভাবেই শুরু হলো সঞ্চিতার “গোপন রন্ধন অভিযানে” নতুন অধ্যায়।

সে একদিন ক্লাবে লিখল,
— “আজ আমি বানিয়েছি পাটিসাপটা। স্বামীর রিভিউ: মুখে দিলে গলে যায়, কিন্তু সারা মুখে গলে ছড়িয়ে পড়ে!”

সবাই হেসে কাবু!
Masala Suraj লিখল:
— “বাহ! এই রিভিউটা তো Oscar-worthy!”

Salt-Free Satyajit লিখল:
— “তোমার রান্নার প্রশংসা শুনে আমার বউ এখন কপালে হাত দিয়েছে। বলছে, ‘তুইও যদি এমন কাউকে বিয়ে করতে পারতিস!’”

সেদিন রাতে অনিরুদ্ধ বলল,
— “তুই আমাদের ক্লাবের রেটিং ছাড়িয়ে গেছিস!”

সঞ্চিতা বলল,
— “এবার বুঝেছো, কেন তোমার পাসওয়ার্ড ভাঙতে হয়েছিল?”

অনিরুদ্ধ বলল,
— “তোর পাসওয়ার্ড? সেটা তো আমার রাঁধুনির হৃদয়। আমি তো প্রতিদিন তোর রান্নাতেই লগ-ইন করি!”

***

সকালে ঘুম ভাঙার পর অনিরুদ্ধের মুখ ছিল একদম থমথমে। সঞ্চিতা পাশে চা নিয়ে বসতেই বলল,
— “কী রে? আবার কেউ তোর পেঁয়াজহীন ডিম কারির দুঃখগাথা পোস্ট করেছে নাকি?”

অনিরুদ্ধ কোনো উত্তর দিল না। শুধু বলল,
— “আজকে ক্লাবের ভেতরে একেবারে যুদ্ধ লেগে গেছে। বিষয়বস্তু— আচার!”

সঞ্চিতা হেসে ফেলল।
— “আচার নিয়ে যুদ্ধ? মানে কার বউয়ের আচার বেশি ঝাল না বেশি প্রেমে ভরা, সেটা নিয়ে?”

অনিরুদ্ধ গম্ভীর মুখে বলল,
— “বেশি প্রেমে ভরা নয়, কারটা বেশি জমেছে! কাল রাতে দীপ্তর বউ একটা পাকা কাঁচামরিচের আচার বানিয়ে ওর ঝুলিতে দিয়ে দিয়েছে। সে আবার ‘রন্ধন রহস্য সংঘ’-এ পোস্ট করে রেটিং চাইছে! অথচ জানিস, ওই একই রেসিপি আমি তোকে শিখিয়েছিলাম মাসখানেক আগে! ওই ক্লাবেই তোকে রেটিং দিয়েছিলাম ৯.৭।”

সঞ্চিতা এক গাল হেসে বলল,
— “এখন বুঝেছো, কেন রান্নার পিছনে নারীদের গোপন অস্তিত্ব থাকে? ওটা নকল করলে ভজঘট হবেই!”

অনিরুদ্ধ মুখ গম্ভীর করে ফোন খুলে দেখাল ক্লাবের মেসেজ—
“Suraj: আজকের মরিচ আচার খেয়ে মনে হল শয়তানের আত্মা ঢুকেছে জিভে। ৯.৯/১০”
“Salt-Free Satyajit: এইটা যদি হোমমেড হয়, আমি কাল থেকে মাটি খাওয়া ছেড়ে দেব।”
“Masala Suraj: আগুন খেয়ে বেঁচে যাওয়াই একমাত্র রেটিং!”

অনিরুদ্ধের চ্যাট:
“Oniruddho: কিন্তু বন্ধুরা, এই একই রেসিপি মাসখানেক আগে আমি আমার বউয়ের হাত থেকে খেয়েছি, তখন তো রেটিং ছিল ৯.৭! তাহলে একই জিনিসে ৯.৯ হয় কী করে?”

এই ম্যাসেজের পরেই শুরু হয় ক্লাবের মধ্যে “আচার-আক্রোশ”।

দীপ্তর পাল্টা লেখা:
— “তুই তাহলে বলতে চাস, আমার বউ আমাকে নকল আচার খাইয়ে দিয়েছে?”

— “নকল নয়, রেসিপি চুরি। সেও ক্লাবের ‘মিষ্টি মন’ ম্যাসেঞ্জারে আমার বউয়ের পাঠানো রেসিপিই কপি করেছে।” — অনিরুদ্ধ স্পষ্ট করে জানাল।

মূহূর্তে সব ঝামেলা!

এদিকে ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী, যে রেসিপির উৎস নিয়ে বিতর্ক ওঠে, সেটার জন্য রন্ধন রাউন্ডে মুখোমুখি হতেই হয়।

তাই ঘোষণা হলো —
“আচার যুদ্ধ” — লাইভ টেস্টিং রাউন্ড হবে আগামী শনিবার, অনিরুদ্ধের বাড়িতে।
উপস্থিত থাকবেন ক্লাবের সব সদস্য ও তাদের বউরা।

এই খবর শুনে সঞ্চিতা তো একেবারে লাফিয়ে উঠল।

— “মানে! আমার ঘরে আচার যুদ্ধে আমি নিজেই কনটেস্টেন্ট! এই প্রথম ক্লাবে আমি আনঅফিশিয়াল থেকে অফিশিয়াল কনটেস্টেন্ট!”

অনিরুদ্ধ চিন্তিত গলায় বলল,
— “তোর ওপর ভরসা আছে, কিন্তু দীপ্তর বউ ওরকম চাঁচাছোলা মহিলা নয়, রান্নার কুটিল রাজনীতি করে।”

— “আমার সাথেই রাজনীতি! আমি এমন আচার বানাব, একটামাত্র চিমটি খেয়ে লোকেরা ‘তেলাকুচো’ বলে কান্না করবে!”

তিন দিনব্যাপী আচার প্রস্তুতি শুরু হলো।

• প্রথম দিন: লঙ্কা বাছা
• দ্বিতীয় দিন: মশলা কাঁটা
• তৃতীয় দিন: প্রলেপ দেওয়া, রোদে দেওয়া, পাত্রে ঢালা।

সঞ্চিতা একেবারে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতিতে তৎপর।

সে ইউটিউব থেকে বিশেষ পদ্ধতির রেসিপি দেখল — ‘কাচি মরিচের টান্টান ঝাল, মেথি বেটে রস মিশিয়ে এমন একটানা খোঁচা!’
তারপর নিজের মতো একটুকু টুইস্ট দিল — এক চিমটি গুড়!
ঝাল ও মিষ্টির সঠিক ব্যালান্স।

রন্ধন রহস্য সংঘের রেটিং দেওয়ার দিন উপস্থিত হলো।

শনিবার সকাল— যুদ্ধের দিন।

অনিরুদ্ধের ডাইনিং টেবিলে সাজানো —

একদিকে সঞ্চিতার আচার: “রহস্য রসায়ন”

আরেকদিকে দীপ্তর বউয়ের আচার: “আগুনে চুম্বন”

সব সদস্য এসে উপস্থিত— মুখ গম্ভীর।

প্রথম টেস্টিং করল Salt-Free Satyajit।
সে এক চামচ সঞ্চিতার আচারে মুখ দিল—
চোখ বড় বড় করে তাকাল, তারপর বলল,
— “এটা… এটা তো… একেবারে ‘পাকা প্রেমের পাঁকাল মাছ’! মুখে দিয়েই আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। একদম ঝালে প্রেমে ঝাঁপ।”

পরেরজন Masala Suraj — দীপ্তর বউয়ের আচার খেল।

— “মনে হচ্ছে রামগরুড়ের ঝাল কান্না! ভালো, কিন্তু… একটু বেশি নাটকীয়।”

রেটিং চলল —

সঞ্চিতার আচার: ৯.৯৫/১০

দীপ্তর বউয়ের আচার: ৯.৩/১০

উজ্জ্বল জয় ঘোষণা করা হলো সঞ্চিতা দাশগুপ্তকে!

সবাই চিৎকার করে বলল —
— “তোমার আচারেই লুকিয়ে আছে ক্লাবের নতুন রহস্য— মিষ্টির পিছনের ঝাল, আর ঝালের নিচে এক চিমটি গুড়!”

দীপ্তর বউ গম্ভীর মুখে হাসল —
— “রান্না চুরি নয়, ভালো রান্না শেখা যায়। আজ থেকে আমি সঞ্চিতার কাছে শিখব।”

সঞ্চিতা হেসে বলল —
— “আর আমি শেখাব— কিভাবে আচার বানাতে গিয়ে ‘আচরণ’ বজায় রাখতে হয়!”

সেদিন রাতে, অনিরুদ্ধ সঞ্চিতাকে চুপচাপ বলল,
— “তুই আসলে এই ক্লাবের রাণী হয়ে গেছিস। এখন ক্লাবের নাম পাল্টাতে হবে— ‘রন্ধন রহস্য সংঘ ও রানী সঞ্চিতা’!”

সঞ্চিতা হেসে উত্তর দিল,
— “না রে! ক্লাবের রানী হতে চাই না, আমি শুধু চাই— পাসওয়ার্ডেও লেখা থাক ‘মিষ্টি মন’, আর রান্নাতেও ঝলমল করুক আসল মনের রেসিপি।”

***

অনিরুদ্ধর হঠাৎ ঘুম ভাঙল চিৎকারে। পাশ থেকে সঞ্চিতা চিৎকার করে বলছে,
— “তুই গতকাল রাত ১২টায় খোলা বাসন থেকে চিংড়ি খেয়েছিস?”

অনিরুদ্ধ চোখ কচলে বলল,
— “কি! মানে আমি… খেয়েছি? কার বাসন?”

— “আমার ‘রন্ধন রহস্য সংঘ’-এর জন্য বানানো স্পেশাল ‘চিংড়ি মালাইকারি ৫.০’! যেখানে আমি গুড় আর গোলমরিচের সিম্ফোনি বসিয়েছিলাম।”

অনিরুদ্ধ মুখ নিচু করে বলল,
— “আমি তো জানতাম না… ওইটা রিভিউ-এর জন্য। আর ফ্রিজে ছিল না তো!”

সঞ্চিতা রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
— “একটা খাবার যতটা না মুখের, তার চেয়েও বেশি মনোযোগের। আর তুই মুখে দিয়ে দিলি, ‘মন’ রাখলিই না!”

এই নিয়ে ক্লাবে আজ আলোড়ন শুরু হয়ে গেল।

কিন্তু সেদিনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল এক নতুন সদস্যের আগমন—
ডায়েটিশিয়ান দীপ্তা দে — Salt-Free Satyajit-এর ছোটবেলার বান্ধবী, যিনি এখন অফিসে লাঞ্চ বক্স এনালাইসিস থেকে শুরু করে রেসিপি ডিজিটাল ক্যালরি কাউন্ট করেন।

তিনি সোজা ক্লাবে ঢুকে বললেন,
— “আপনারা যতই চিংড়ির গুণগান করেন, জানেন কি এক চামচ চিংড়ি মালাইকারিতে আছে প্রায় ৮৯০ ক্যালরি?”

সাথে সাথে চ্যাটে নেমে এল ‘ডায়েট আতঙ্ক’।

রাত সাড়ে দশটায় WhatsApp গ্রুপে একটা নতুন পোল চালু হয়—

“আপনি কি এখন থেকে Diet Review চান?”

হ্যাঁ (সেই সাথে ক্যালরি কাউন্ট সহ রেটিং)

না (রান্না মানেই স্বাদের উৎসব)

Suraj বলল:
— “আমি যদি আমার স্ত্রীর ভুনা খাসি খেয়ে রেটিং না দিতে পারি ক্যালরির ভয়ে, তাহলে ক্লাবের নাম বদলে ‘সন্তাপ সংঘ’ রাখা হোক!”

Salt-Free Satyajit বলল:
— “ডায়েট থাকা মানেই বেঁচে থাকা। আমি আজ থেকে জলপানই রিভিউ করব।”

সঞ্চিতা প্রথমে কিছু বলেনি। কিন্তু তার ভেতরে হালকা রাগ জন্ম নিচ্ছে।

কীভাবে একটা রান্না ক্লাব, যেখানে নুন-ঝাল-মিষ্টি মিশে জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়, সেখানে ঢুকে পড়ছে “ওটস আর কেটো’র জুজু”।

দুপুরে সঞ্চিতা ক্লাবে একটা ছবি দিল—
এক প্লেট ধোঁয়া ওঠা চিংড়ি মালাইকারি আর পাশে একটা ছোট্ট কাগজে লেখা:

“এ রান্নায় যতটা চিংড়ি, তারচেয়েও বেশি প্রেম। ক্যালরি নয়, ক্যারিশমা দেখুন।”

ছবির নিচে ম্যাসেজ:

— “ডায়েট যদি হয় ডেটের বাধা, তাহলে আমি রান্নাকেই প্রেম বলে মানি।”

গ্রুপে প্রশংসার ঝড় বয়ে গেল!

Masala Suraj:
— “এই ম্যাসেজে মশলার চেয়েও ঝাঁজ আছে।”

Salt-Free Satyajit:
— “আমি আজ একটা পছন্দের জিনিস খেলাম— ‘ভেজানো রাগ’।”

এদিকে দীপ্তা দে মৃদু হেসে লিখলেন,
— “এই ক্লাব রান্নার, ডায়েটের নয়— বুঝেছি। আমি সরছি, কিন্তু যাবার আগে বলে যাই, আপনি যদি একদিন নিজেই নিজের হৃদয় শুনতে চান, তখন দেখবেন আপনার রান্নার গন্ধ আপনাকে ডাকছে— ডায়েট নয়।”

সন্ধ্যাবেলায়, সঞ্চিতা ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। সামনে একবাটি লাল রঙের চিংড়ির ঝোল।

অনিরুদ্ধ এসে বসে বলল,
— “আজকের রান্না আবার ওই… প্রাইভেট রিভিউয়ের জন্য?”

সঞ্চিতা মাথা নেড়ে বলল,
— “না, আজকের রান্না তোর জন্য। শুধু তোকে খাওয়াব বলে করেছি। ক্লাবের কেউ জানবেও না।”

অনিরুদ্ধ চোখ বড় বড় করে বলল,
— “তাহলে তো এটাই তোদের নতুন পাসওয়ার্ড!”

সঞ্চিতা চুপচাপ একগাল হেসে বলল,
— “আমার তোকে দরকার ফোন ছাড়াই, ক্লাব ছাড়াই— শুধু একটা চামচ দিয়ে, আমার রান্না খাওয়ার মতো করে।”

অনিরুদ্ধ চিংড়ি মুখে দিয়ে বলল,
— “এই চিংড়ি শুধু ঝাল না, এ তো প্রেমে ঝলসানো।”

সঞ্চিতা একবার তাকিয়ে বলল,
— “তাই তো বলি, প্রেম আর রান্না— দুটোই পাসওয়ার্ড ছাড়াই চলুক।”

ডায়েট কনফ্লিক্ট মেটার পর, ক্লাব নতুনভাবে শুরু হলো। এবার সেখানে থাকলো দুটো ভাগ—

‘রসনাঘটক রেটিং’

‘হৃদয়ঘন ক্যালরি রিপোর্ট’

তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো— ক্লাবের লোগোতে এবার লেখা হলো:

“এখানে রান্না শুধু রেটিংয়ের জন্য নয়, সম্পর্কের জন্য।”

এবং নিচে ছোট করে:

“Founder Couple: অনিরুদ্ধ ও সঞ্চিতা”

***

সঞ্চিতা চমকে উঠল। সকালবেলায় কফি বানিয়েছিল তো সে-ই। তার মানে কফির ছবি তুলেছে অনিরুদ্ধ? কিন্তু সেটা তো ঘরের মগ না। আরও খুঁটিয়ে দেখে মনে হল, সেটা কোনও ক্যাফের কাপ। নিচে কাপের গায়ে লেখা ছিল — ‘Bean There Done That Cafe’.

সঞ্চিতা সেই মুহূর্তেই গুগল করল — ‘Bean There Done That Cafe’।

লোকেশন: পার্ক স্ট্রিট।

গতকাল সন্ধ্যায় তো অনিরুদ্ধ বলেছিল অফিসে অনেক কাজ, তাই দেরি হবে। তাহলে সে এখানে কফি খেতে গিয়েছিল? কার সঙ্গে?

সঞ্চিতা ভাবল, সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে অনিরুদ্ধ নিশ্চয়ই বলবে, “বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম।” কিন্তু এমন রহস্যময় লাইন আর লক ইমোজি — তার মানে তো আরও গভীর কিছু!

সেই দিন দুপুরে, সে অনিরুদ্ধর ল্যাপটপে চোখ রাখতে গিয়ে খেয়াল করল, WhatsApp Web লগ ইন করা ছিল। সে একটু কৌতূহলী হয়ে স্ক্রল করতে করতে দেখল, একটি চ্যাট — “Smiling Shruti”।

সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চিতার মস্তিষ্কে যেন ঘণ্টা বাজল। Shruti? কে এই শ্রুতি?

চ্যাট ওপেন করতে গিয়ে দেখল — “Login from phone only.” সে জানত, এবার তাকে চালাকি করে তথ্য খুঁজে বার করতে হবে। গোয়েন্দা সঞ্চিতা সক্রিয় হয়ে উঠল।

সন্ধ্যায় অনিরুদ্ধ যখন স্নান করতে গিয়েছিল, সঞ্চিতা তার ফোনটা নিয়ে ফেস আনলক করল। আগেই কয়েকবার চেষ্টা করে মুখের একটা কোণ ঠিকমতো ধরে ফেলেছিল সে। আর সেদিন ঠিকই খুলে গেল ফোন।

WhatsApp খুলে শ্রুতির চ্যাট — খালি নয়। অনেক স্টিকার, মেসেজ, গান শেয়ার করা। এক জায়গায় শ্রুতি লিখেছে — “আজকের কফিটা ছিল অসম্ভব ভাল! কিন্তু তোমার টাই আরও বেশি স্টাইলিশ”

তারপর অনিরুদ্ধর রিপ্লাই — “তুই থাকলে যে কোনো কফি ভাল হয়ে যায়। কিন্তু কেউ জানুক না। Secret Story থাক Secret ই!”

সঞ্চিতা চুপচাপ মেসেজগুলো পড়ে ফেলল। তার বুক ধকধক করতে লাগল। সে তখনো ঠিক বুঝতে পারছে না — এটা নিছক বন্ধুত্ব? না তার চেয়েও কিছু বেশি?

রাতে অনিরুদ্ধ যখন টিভি দেখছিল, সঞ্চিতা হঠাৎ বলে ফেলল — “আজ ‘Bean There Done That’-এ গিয়েছিলি?”

অনিরুদ্ধ থমকে তাকাল। — “তুই জানলি কীভাবে?” — “ইনস্টা স্টোরি। আর শ্রুতি তো তোর টাই-এর প্রশংসা করেছেই।”

অনিরুদ্ধ চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল — “শোন, তুই যা ভাবছিস, ব্যাপারটা তা না। শ্রুতি আমার কলেজের পুরনো বন্ধু। হঠাৎ অফিসের কাছেই দেখা হল, ওর কাছেই ক্যাফেটার নাম শুনলাম, তাই গেলাম। ভালো লেগেছিল বলে ছবি দিয়েছিলাম। তাতে লক ইমোজি দিলাম কারণ ক্যাফেটা যেন সবাই না জানে — ওটাই ভাবছিলাম।”

সঞ্চিতা শুনে বলল — “তুই কি বুঝিস না, লক ইমোজি আর ‘Some things taste better when not shared’— এই লাইন মানে কি দাঁড়ায়? আমি তো শিউর ছিলাম… তুই কিছু লুকোচ্ছিস।”

অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল — “আমার দোষ আছে। লুকিয়ে গেছি, কারণ জানি তুই এ নিয়ে জেরা করবি। কিন্তু আমার আর শ্রুতির মধ্যে কিছু নেই। তুই চাইলে আমি ওকে ব্লক করে দেব, এমনকি ইনস্টাও ডিলিট করব।”

সঞ্চিতা একটু নরম হয়ে বলল — “আমি এসব চাই না। আমি চাই, তুই সব শেয়ার করিস। এমনকি কফি খেতে গেলে সেটা নিয়েও। আমার ভরসা পাসওয়ার্ডে নয়, বিশ্বাসে। কিন্তু সেটা ভাঙলে তো আমি খুঁজতেই থাকব… আর ধীরে ধীরে সন্দেহই হয়ে যাবে সব কিছু।”

অনিরুদ্ধ মাথা নিচু করে বলল — “তুই ঠিক বলছিস। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি — এবার থেকে আর গোপন কিছু করব না। আর শ্রুতিকে শুধু তুই না, তোর আচার রেসিপির ফ্যান হিসেবেই রাখব, কারণ ও সেই ক্লাবেই অ্যাড হতে চায়!”

সঞ্চিতা হেসে ফেলল। “ও তাই বলেছ? তাহলে ঠিক আছে, রেসিপি শেয়ার করা যাবে, কিন্তু টাই-এর প্রশংসা আমার একার অধিকার!”

সেদিন রাতেই অনিরুদ্ধ ইনস্টাগ্রামে একটা নতুন স্টোরি দিল: “Some tastes are best when shared with the one who spices your life.”

আর নিচে ট্যাগ — @SpiceQueenSanchita

সঞ্চিতা ফোনে স্টোরিটা দেখে মুচকি হাসল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা রাখল অনিরুদ্ধের কাঁধে। এই প্রথমবার, তার মনে হল, হয়তো সত্যিই পাসওয়ার্ডের থেকেও বড় জিনিস — মন খুলে বলা।

***

সঞ্চিতা সকালে চোখ খুলেই দেখল, মোবাইল স্ক্রিনে একগাদা নোটিফিকেশন। বেশিরভাগই ইনস্টাগ্রাম আর ইউটিউব থেকে। রাতের স্টোরিতে অনিরুদ্ধ তাকে ট্যাগ করেছিল, আর সেই থেকেই যেন ঝড় বয়ে গেছে!

“SpiceQueenSanchita” — এই ইউজারনেম এখন হঠাৎ করেই ট্রেন্ডিং হয়েছে। কফি কাপের স্টোরির রিপোস্ট, কমেন্টে কিউরিওসিটি: “ভাই, এই SpiceQueen কে?” আর সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ — একটি জনপ্রিয় ইউটিউব রান্নার চ্যানেল “MasalaMirchi” ইনবক্সে লিখেছে:

“Hi Sanchita! We loved your food blog snippets and your Insta story. Would you be interested in participating in our upcoming reality cooking challenge – ‘Kolkata Cooks Kaun?’”

সঞ্চিতা প্রথমে ভেবেছিল মজা করছে কেউ। কিন্তু ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল যাচাই করে দেখল, সত্যিই সেই চ্যানেল। সঙ্গে ডেট, লোকেশন আর ডিটেইলস।

অভিনব কনসেপ্ট: ৫ জন হোম কুক, ৫ দিনের রিয়েলিটি কুকিং শো, প্রতি দিন আলাদা থিম, একেকটা অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ — আর ফাইনালে একটাই জয়ী।

সঞ্চিতা উত্তেজনায় নেচে উঠল। অনিরুদ্ধকে ডেকে বলল — “দেখ! আমি রিয়েলিটি শোতে ডাক পেয়েছি!”

অনিরুদ্ধ চোখ বড় বড় করে বলল — “কি বলিস! সত্যি? তুই তো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছিস রে!”

সঞ্চিতা বলল — “তুইই তো SpiceQueen বানালিস! এখন এই রান্নার লড়াই জিততেই হবে!”

শোয়ের প্রথম দিনের থিম ছিল “Street Food Reimagined” — মানে রাস্তার খাবারকে নতুন কায়দায় উপস্থাপন করা। সঞ্চিতার চ্যালেঞ্জ ছিল — ঝাল ঠোঙা।

কিন্তু twist ছিল — এই ঠোঙা বানাতে হবে zero-oil, modern plating-এ।

সঞ্চিতা প্রথমে একটু চিন্তিত হল। ঝাল ঠোঙা মানেই তো তেলে ভাজা মুড়ি, চানা, চানাচুর আর পাতি লেবু। কিন্তু zero-oil? উফফ!

সে ফ্রুটস, স্প্রাউটস, মিক্সড রোস্টেড পাপড়ি আর তেঁতুল-জুস-ভিত্তিক হালকা চাটনি দিয়ে একটা ফিউশন বানাল — নাম দিল: “Tropical Tongue-Tornado”

সবার চোখ কপালে। ঠোঙা বানানো হয়েছে কলাপাতার কাপে, সাথে ছোট বাঁশের চামচ। উপরে ঝাল লঙ্কা পাউডার ছড়ানো, কিন্তু স্বাদে টুইস্ট — মধু আর অরেঞ্জ জেস্ট।

জাজরা একবার মুখে দিয়েই চমকে উঠল। এক মহিলা বললেন — “এটা তো একেবারে জিভের আগুন! কিন্তু অদ্ভুতভাবে টেস্টি!”

রাত্তিরে শো সম্প্রচার হওয়ার পরেই সঞ্চিতার ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার এক লাফে বেড়ে গেল। SpiceQueen এখন আসলেই রান্নার রাণী হয়ে উঠছে।

অনিরুদ্ধ বাড়িতে বসেই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পেল শ্রুতি থেকে:

“Dude, your wife is lit! That Tongue-Tornado recipe is now viral in our office group!”

অনিরুদ্ধ মুচকি হেসে রিপ্লাই দিল: “I know! She’s spicier than I thought.”

সঞ্চিতা অনিরুদ্ধর ফোনে এই মেসেজ দেখে ফেললেও, এবার আর রেগে গেল না। বরং হেসে বলল — “ভালো, এবার অফিসেও আমার রেসিপির গুণগান হচ্ছে!”

দ্বিতীয় দিনের চ্যালেঞ্জ ছিল সবচেয়ে অদ্ভুত — রান্নার সাথে একটা র‍্যাপ গান বানাতে হবে, যেটা রান্নার প্রক্রিয়া বোঝাবে। কনটেস্টের নাম — “Wrap Your Rap”!

সঞ্চিতা প্রথমে ভাবল, সে তো গান গাইতেই জানে না, র‍্যাপ তো দূরের কথা! কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। অনিরুদ্ধর সাহায্যে সে লিখল এক মজার র‍্যাপ:

“Cut it, slice it, mix that spice, Add a little lemon, just a pinch of nice. No oil, just boil, taste will spoil, Serve it cool, this Queen don’t toil!”

সে র‍্যাপ করল আর এক হাতে বানাল ফিউশন পটলের মোড়কে স্টাফড বাদাম-নারকেল কাবাব। একসাথে স্বাদ আর বিনোদন! সঞ্চিতা পেয়েও গেল দিনের সেরা স্কোর।

তৃতীয় দিনে ছিল Blindfold Challenge — চোখ বাঁধা অবস্থায় সবজি চিনে রান্না করতে হবে।

সঞ্চিতা নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে চিনে ফেলল ধনে পাতা, টমেটো, কাঁচা লঙ্কা — এক এক করে। তারপর তার ইনস্টিংক্ট দিয়ে বানাল — “Green Mystery Curry”।

এতখানি ঝুঁকি সত্ত্বেও, জাজরা বলল — “This dish smells like home and tastes like heaven!”

চতুর্থ দিনে প্রতিযোগীদের বলা হয়েছিল — রান্নার সাথে একটা গল্প বলো।

সঞ্চিতা বলল — “আমার ঠাকুরমা চুপি চুপি ভাতে মরিচ চটকে দিতেন। সেই ঝাল ছিল জীবনের প্রথম রোমাঞ্চ। আজ আমি সেই ঝালের উত্তরাধিকার!”

সে বানাল — “Legacy Lava Rice” — খুদের ভাতে জ্বাল দেওয়া শুকনো লঙ্কা তেল ছাড়া রোস্ট করে, লেবু পাতার ফ্লেভারে। সঙ্গে পুদিনা পাতার চাটনি।

এই দিন ছিল সবচেয়ে চমকপ্রদ। প্রতিটি প্রতিযোগীকে রান্না করতে হবে একজন প্রিয়জনের সাথে। সঞ্চিতা বেছে নিল অনিরুদ্ধকে।

অনিরুদ্ধ প্রথমে ভয় পেয়ে গেল — “আমাকে দিয়ে রান্না?!”

সঞ্চিতা বলল — “তুই শুধু কাটিং কর, আমি রেস্ট সামলে নেব। আর ভুল করলেও, আমি আছি।”

তারা একসাথে বানাল — “Password Pulao” — প্রতিটি লেয়ার একেকটা রহস্যর মতন, উপরে ঝাল লঙ্কা দিয়ে গার্নিশ, মাঝে টমেটো রসের কোডিং, আর নিচে মিষ্টি আনারসের রস — যেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।

জাজদের চোখ কপালে উঠল। একজন বললেন — “এটা তো একেবারে গল্পের মত খাবার!”

শেষমেশ ফলাফল ঘোষণা হল:

SpiceQueenSanchita – Winner of Kolkata Cooks Kaun!

সেদিন রাতে সঞ্চিতা ব্যালকনিতে বসে ছিল কফির কাপ হাতে। পাশে অনিরুদ্ধ। তারা দু’জনেই চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ অনিরুদ্ধ বলল —

“তুই জানিস, তোর রান্না শুধু স্বাদে নয়, গল্পেও মাখানো। পাসওয়ার্ড তো এখন জানতেই চাই না, কারণ তোর সব গল্পই আমার সাথে ভাগ হয়ে গেছে।”

সঞ্চিতা হেসে বলল — “আর আমি জানি, তুই আমার রান্নার সবচেয়ে বড় রহস্য — একটু ধৈর্য্য, এক চিমটে ভালোবাসা, আর আধখানা খুশির হাসি।”

***

সঞ্চিতার জীবনে এখন এমন এক সময় চলছে, যেটা ঠিক “মরিচের গুঁড়ো-মাখা পাতিলেবু”—একটু ঝাঁজ, একটু টক, কিন্তু সবটা জিভে জল এনে দেওয়া! রান্নার রিয়েলিটি শো জিতে, SpiceQueen নামে ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হয়ে, আর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে স্পন্সরশিপ পেয়ে সে যেন খুদের রান্নাঘর থেকে ছুটে বেড়াচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়ার পাতিলে!

কিন্তু এতসব মশলাদার জীবনেও একদিন আসে যখন কেউ চায় একটা “ঝালমুড়ি পার্টি” একটু বেশি রহস্যে মাখানো হোক।

সেদিন সকালে সঞ্চিতা দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়, ল্যাপটপে স্পনসরশিপ চুক্তির ইমেইল পড়ছিল। হঠাৎ এক ছোট্ট গোলাপি রঙের খাম এসে পড়ল তার দরজার সামনে।

খামে লেখা —
“আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে এক গোপনীয় পার্টিতে।
থিম: ‘Unlock The Secret’.
স্থল: ঠিকানা পরে জানানো হবে।
ড্রেস কোড: স্মার্ট ক্যাজুয়াল + একটি ‘গোপন পাসওয়ার্ড’ নিয়ে আসতে হবে।
সময়: শনিবার, রাত ৭টা।”

সঞ্চিতা প্রথমে ভাবল এটা নিশ্চয় কোনো প্রাঙ্ক। কিন্তু ঠিক তখনই অনিরুদ্ধ অফিস থেকে ফিরে বলল, “তোমার জন্য একটা ইনভাইটেশন এসেছে। আমার ইনবক্সেও এসেছে। ওই একই থিম — ‘Unlock The Secret’।”
সে চোখ গোল করে বলল, “তুইও আমন্ত্রিত?”
“হ্যাঁ! আর ভাব, তোমাকে ‘SpiceQueen’ বলে চিহ্নিত করে পাঠানো হয়েছে!”

সঞ্চিতা এবার চিন্তায় পড়ে গেল। এটা কি নতুন কোনো ক্যাম্পেইন? না কি অন্য কিছু?
অনিরুদ্ধ বলল, “চল, আমরা একটা পাসওয়ার্ড পার্টি নিজেরাই আয়োজন করি। এতে যদি কেউ কিছু গোপন খোঁজে, তা-ও খুঁজুক! আমরা সবাইকে নিজেদের সিক্রেট-সহ হাজির হতে বলি।”

সঞ্চিতা ঠিক করল, শনিবার দুপুরে নিজেদের বাড়িতে পার্টি দেবে। নাম রাখল —
“Spice & Secrets: The Password Party”

আমন্ত্রণ গেল কলোনির প্রায় সব বন্ধুকে — রানু বউমা, অফিস কলিগ রাধিকা, অনিরুদ্ধের কলেজ বন্ধু সায়ন, পাড়ার সেই গম্ভীর সৌমেন কাকু, এমনকি সেই বিতর্কিত রাধুনিদের ছোট টিমও।

শর্ত একটাই —
“পার্টিতে ঢোকার সময় প্রতিটি অতিথিকে বলতে হবে এক গোপন পাসওয়ার্ড — যেটা জীবনের কোনও বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত।”

ঘর সাজানো হল কাগজের ঝালর, ঝোলানো পেঁয়াজের মালা, আর এক কোণে রাখা হল সঞ্চিতার নিজস্ব পাসওয়ার্ড বক্স — যেটাতে সবাই নিজের গোপন পাসওয়ার্ড লিখে রাখবে (অবশ্যই মজার ভাবে)।

রান্নায় থাকল —

‘রহস্য রোল’ (ডিমে মোড়া চিংড়ি ভাজা)

‘গোপন গোলাপজল শরবত’

‘পাসওয়ার্ড পোলাও’

‘ফায়ারওয়াল ফুচকা’

শনিবার, রাত ঠিক ৭টায়, অতিথিরা একে একে এসে হাজির। পার্টির গেটেই সবাইকে বলার জন্য বলা হচ্ছিল —
“আপনার জীবনের এক সিক্রেট পাসওয়ার্ড কী?”

প্রথমে এল রাধিকা। বলল,
“আমার পাসওয়ার্ড? ‘Barfi1989’ — কারণ আমি বরফি খেতে গিয়ে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম!”

রানু বউমা একটু ইতস্তত করে বললেন,
“আমারটা ‘Saree700’ — কারণ আমার বিয়ের শাড়ির দাম ছিল ৭০০ টাকা, আর আজও সেটা আমার ধন।”

সবাই হেসে উঠল।

সায়ন বলল,
“Mine is ‘Resign2022’ — কারণ ওই বছর আমি চাকরি ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলাম।”

অবশেষে এল সৌমেন কাকু। সবাই জানে উনি ভীষণ রহস্যময়। পাসওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করতেই বললেন —
“আমার পাসওয়ার্ড? সেটা তো আমি এখানে বলব না। তবে সেটা আমি একসময় লিখেছিলাম…এক ডায়েরিতে।”

সবাই এক মুহূর্ত থেমে গেল।
“ডায়েরি?”
“হ্যাঁ, সেটা একসময় হারিয়ে যায়। আর তাতে ছিল এমন কিছু কথা যা হয়তো কারও জীবন বদলে দিতে পারত।”

সঞ্চিতার মনে পড়ে গেল —
সেই দিনের কথা, যখন সে প্রথম অনিরুদ্ধের ফোনের পাসওয়ার্ড জানার জন্য গোয়েন্দাগিরি করছিল। তখনও তো একটা পুরনো ডায়েরি মিলেছিল শোকেসে, তবে পাতাগুলো খালি মনে হয়েছিল!

এবার সে নতুন করে চিন্তায় পড়ল।

পার্টির শেষদিকে, যখন সবাই গরম চা হাতে ব্যালকনিতে গল্প করছিল, সঞ্চিতা হঠাৎ মোবাইলে একটা WhatsApp মেসেজ পেল —
“তুমি যতটা ভাবছো, তার থেকেও বড় পাসওয়ার্ড লুকানো আছে ওই ডায়েরিতে। সেটা শুধু তোমার নয়, অনেকের।”

মেসেজ পাঠিয়েছে এক নামহীন নম্বর থেকে।
সঙ্গে ছিল একটা ছবি — পুরনো ডায়েরির কভারে লেখা:
“জানলে কী করবে? খুললেই সব বদলে যাবে!”

সঞ্চিতা চমকে গেল।
এই পার্টি তো শুরু হয়েছিল মজা করে, আর এখন যেন জীবনের কোন অজানা অধ্যায় খুলতে চলেছে। অনিরুদ্ধ বলল… সঞ্চিতা অনিরুদ্ধকে চুপিসারে বলল,
“ডায়েরিটা নিয়ে তোকে কিছু বলার আছে?”
অনিরুদ্ধ চায়ের চুমুক দিয়ে বলল,
“তুই আসলে কখনোই শুধু রান্নার রানী ছিলি না, তুই আসলে একজন গল্পের গোপন রক্ষক।”

***

সকালবেলা।
সঞ্চিতা চোখ মেলতেই প্রথম যে কথাটা মনে পড়ল — সেটা হচ্ছে “ডায়েরি”।

না, আর কালবিলম্ব নয়।
এবার সত্যিই তাকে ডায়েরির পাতাগুলো খুলতেই হবে।

চোখে ঘুম লেগে থাকলেও সোজা চলে গেল শোকেসের ডান দিকের দেরাজে। ঠিক যেখানে বছরখানেক আগে একটা পুরনো চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি সে পেয়েছিল — ভেবেছিল ফাঁকা।

কিন্তু…
গতকালকার WhatsApp মেসেজের পর বুঝে গিয়েছে — এই ফাঁকা পাতার মাঝেই লুকিয়ে আছে এক কৌতুকময় জীবনবোধের গুপ্ত কোড।

পাতা খুললেই বিস্ময়!

ডায়েরি খুলেই প্রথম পাতায় লেখা —

“প্রিয় অনিরুদ্ধ, যদি এটা পড়ে ফেলিস, তাহলে জানিস — তোর বউ এখনো আমার ফোনের পাসওয়ার্ড খুঁজছে।
হা হা হা!
কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস — পাসওয়ার্ড যতই লুকিয়ে রাখিস, যদি সে তোর রান্না ভালোবাসে, তো সব মাফ।”

শুভেচ্ছায়, ভবিষ্যতের তুই!

সঞ্চিতা বিস্ময়ে পড়ে গেল।
“এইটা…অনিরুদ্ধ নিজেই লিখেছিল?”

পরের পাতায় লেখা —
“পাসওয়ার্ড-গল্পের সূচনা: কিছু দিন, কিছু পাঁকা চালাকপনা।”

কিছু মাস আগে, যখন সঞ্চিতা সবসময় ফোন লুকিয়ে দেখতে চাইত, অনিরুদ্ধ খেয়াল করেছিল।
সে একদিন ঠিক করে — একটা মজা করবে।
নিজের পুরনো ডায়েরিতে সে প্রতিদিন ছোট ছোট নোট লিখত, কীভাবে সঞ্চিতা তার ফোন আনলক করার চেষ্টা করছে!

“আজ সে বলল — তোমার ফোনে Uber app নেই কেন?
আমি বললাম, আছে তো।
সে বলল, দেখাও!
আমি বুঝে গেলাম, ওর আসল উদ্দেশ্য — UNLOCK SCREEN!”

“আজ সে বলল — তোমার আমাজন অর্ডার করে দিই?
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ করো।
ও বলল — তোমার মোবাইল দাও, দেখি!”

“আজ আমি তার জন্য বানালাম এক special ringtone — যদি সে শুনে ভাবে কোনো মেয়ে কল করছে।
নাম দিলাম — ‘Asha Bhabi Calling’!”

সঞ্চিতা এত পড়ে পড়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বিছানায়।
“এই অনিরুদ্ধ! এইসব চালাকি করেছিস, আমাকে ধোঁকা দিতে?”
অনিরুদ্ধ দাড়িয়ে বলল,
“তুই তো বলেছিলি, বিয়ে মানে সারাজীবনের খেলা। আমি তো শুধু সেই খেলায় একটু spice যোগ করলাম।”

ডায়েরির একেবারে শেষ পাতায় লেখা —
“আমার ফোনের পাসওয়ার্ড? সেটা একমাত্র সঞ্চিতা জানবে — যখন সে বুঝবে, পাসওয়ার্ড শুধু ফোন খুলতে নয়, সম্পর্ক জোড়ার জিনিস।”

সঙ্গে একটা কাগজ সাঁটা ছিল।
তাতে লেখা —

> Phone Password: Misti2020

(Misti — কারণ সঞ্চিতার ডাকনাম।
2020 — কারণ ওই বছরই তারা বিয়ে করেছিল।)

সঞ্চিতা মোবাইল খুলে পাসওয়ার্ড টাইপ করতেই খুলে গেল ফোন।
হোম স্ক্রিনে লেখা —
“বউ যখন গোয়েন্দা হয়, তখন পাসওয়ার্ডও হেসে খোলে!”

সেদিন বিকেলে সঞ্চিতা এক নতুন ভিডিও বানাল, শিরোনাম —
“Password পেয়ে গেছি! কিন্তু সত্যিকারের Unlock হলো ভালোবাসায়!”

ভিডিওতে সে হাসতে হাসতে বলল,
“মেয়েরা পাসওয়ার্ড খুঁজে বের করতেই পারে। কিন্তু আমাদের আসল উদ্দেশ্য ফোন খোলা নয়, মন খোলা! আর যদি তুমি সব লুকিয়ে রাখো, তাও যেন একটা জায়গা থাকে — যেখানে শুধু আমরা থাকি, বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে।”

ভিডিও পোস্ট করার মিনিট দশেকের মধ্যেই কমেন্টের বন্যা —

“আমার বউ এখনই ফোনটা ছিনিয়ে নিল!”

“ভাই, পাসওয়ার্ড বদলাও! তুমি ধরা পড়বে!”

“এই গল্পটা Netflix সিরিজ হওয়া উচিত!”

অনিরুদ্ধ আর সঞ্চিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকাল।
সঞ্চিতা বলল,
“আচ্ছা, তুই যদি চিরকাল কিছু লুকিয়ে রাখতে চাই, আমি কীভাবে বুঝব?”
অনিরুদ্ধ বলল,
“তুই না বোঝার ভান করবি — কারণ তোর হাসিতে আমার গোপন সব খুলে যায়।”

ওরা দু’জনে হেসে উঠল।
হয়তো এটুকুই…
সবচেয়ে গোপন পাসওয়ার্ড — বিশ্বাস আর একটু হাসি।

—শেষ—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *