শ্রেয়া বসু
এক
বইমেলার বিকেলগুলো যেন সবসময় একটু বেশি রঙিন হয়। মাঠের একপাশে রোদের ঝিলিক আর মানুষের ভিড় মিলেমিশে এক অদ্ভুত উষ্ণ আবহ তৈরি করে। সেই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কলকাতা বইমেলা তখন সেন্ট্রাল পার্কে, আর সেদিন ছিল জানুয়ারির শেষ শুক্রবার। ঋতা সেদিন প্রথমবারের মতো একা এসেছিল বইমেলায়। নিজের জগতে ডুবে থাকা এই তরুণী কোনও বন্ধুকে জানায়নি আসার কথা, অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল চুপচাপ, আর একটা নীলখামে পুরে নিজের পুরোনো ‘পছন্দের বইয়ের তালিকা’ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। স্টলগুলোতে ঘুরে ঘুরে দেখে, তালিকা মিলিয়ে বই কেনে। এমন সময়ে, ঠিক D-14 নাম্বার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার চোখে পড়ে ছেলেটাকে। ছেলেটা সেদিন পড়ছিল বিভূতিভূষণের “মৌরীফুল” — তার খুব প্রিয় বই। একটা অদ্ভুত সংযোগ অনুভব করে ঋতা। অচেনা হলেও, সাহস করে বলে ফেলে, “এই বইটা তুমি প্রথমবার পড়ছো?” ছেলেটা তাকায়, মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলে, “না, চতুর্থবার।” সেই মৃদু হাসিতে যেন ঋতা আটকে যায়। এরপর কীভাবে যেন কথোপকথন গড়ায় — বইয়ের চরিত্র, লেখকের ভাষা, ছোটগল্প বনাম উপন্যাস, কিশোর সাহিত্য থেকে বয়ঃসন্ধির পাঠ — যেন দুজনেই সেই পনেরো মিনিটে নিজেদের সমস্ত বই-জগত খুলে ফেলে দেয় একে অন্যের সামনে।
তারা দাঁড়িয়েছিল ঠিক স্টলের বাঁদিকে, যেখানে সূর্যের আলো একটু তেরছা হয়ে পড়ে। সেই আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল দুটো মানুষ—একজন পরনে হালকা বাদামি কুর্তি, গলায় মেঘরঙা স্কার্ফ; আর অন্যজন ছেঁড়া জিন্সের সাথে নীল চেক শার্ট, চোখে সামান্য ক্লান্তি আর কণ্ঠে অভ্যস্ত সংযম। নাম, ফোন নম্বর বা ঠিকানা কিছুই বিনিময় হয়নি, যেন না বললেই ভালো। অনিমেষ বলেছিল, “তুমি কি বিশ্বাস করো বই কারো জীবন বদলে দিতে পারে?” ঋতা বলেছিল, “হ্যাঁ, বদলাতে পারে, যদি তুমি বইটা ঠিক সময়ে পড়ো।” সেই সময়, চারপাশে ভিড় ছিল, ঘোষণা হচ্ছিল—“স্টল বন্ধ হতে চলেছে”—কিন্তু তাদের দুজনের দৃষ্টি শুধু একে অপরের চোখে আটকে ছিল। কোনও প্রেমপ্রস্তাব বা নাটকীয়তা ছিল না—তবে ছিল এক অদ্ভুত নিরবতা, যা ছুঁয়ে গিয়েছিল তাদের হৃদয়ের এক গভীর অংশ। বইমেলা শেষ হতেই তারা দুজনই ধীরে ধীরে ভিন্ন পথে হেঁটে যায়। ঋতা পেছনে ফিরে দেখেছিল, কিন্তু ছেলেটি তাকায়নি। অথবা তাকিয়েও চোখ মেলাতে পারেনি।
তারপর থেকে দশটি বছর কেটে গেছে। ঋতা প্রতিবছর সেই একই দিনে, একই সময় সেই একই স্টলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, এটি হয়তো পাগলামি। কিন্তু তার বিশ্বাস, যদি বাস্তব সত্যি হয়ে ওঠে কোনও কল্পনার হাত ধরে, তাহলে সেই মুহূর্ত ফিরে আসতে পারে। সে ভিড়ের মধ্যে অনেক মুখ দেখে—কখনো মনে হয়, ওই তো! কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে, না, ভুল। বন্ধুরা বলে, “তুই এখনও ভুলিসনি?” —সে হেসে বলে, “সবকিছু ভুলে যাওয়া যায় না।” প্রতি বছর সে একটি করে বই কেনে সেই স্টল থেকে, যতটা না প্রয়োজন থেকে, তার চেয়েও বেশি স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। তার নীলখামে সেই পুরোনো তালিকাটা এখনো আছে, মাঝে মাঝে নতুন বই যোগ হয়, কিছু বাদ পড়ে যায়। কিন্তু ওই একটা পনেরো মিনিট, আর সেই ছেলেটার হাসিটা—আজও তার মনে গেঁথে আছে, যেন এক অসমাপ্ত অধ্যায়, যার পরবর্তী পৃষ্ঠা এখনো লেখা হয়নি।
দুই
বছর গড়িয়ে যায়, বইমেলার তারিখ বদলায়, স্টলের নম্বর বদলায়, কিন্তু ঋতার অভ্যেস বদলায় না। প্রতি জানুয়ারির শেষ শুক্রবার, সে একা একা আসে বইমেলায়—ঠিক সেই সময়ে, বিকেল চারটা নাগাদ। এই ছোট্ট অভ্যেসটাকে সে কখনো নিজের জীবনের কোনও নাটকীয়তা ভাবেনি, বরং এটিকে সে তার নিজস্ব নীরব এক পর্ব মনে করে, যেখানে বাস্তব আর স্মৃতি একসঙ্গে হেঁটে যায়। বন্ধুরা, সহকর্মীরা, এমনকি তার মা-বাবাও জানে না এই যাত্রার উদ্দেশ্য। মধুবনী, অফিসের সহকর্মী, একবার বলেছিল—”ঋতা, তোর এই রহস্যময় বইমেলা-যাত্রা একদিন গল্প হয়ে যাবে!” ঋতা হেসে বলেছিল—”হয়তো গল্প হয়েই আছে এতদিন!” কিন্তু সে জানে, গল্প নয়, এই তো তার বাস্তব, একটিমাত্র পনেরো মিনিটের জায়গা যেখানে সে বারবার ফিরে আসে—নতুন আশায়, কিন্তু পুরোনো দৃশ্যপটে। তার মনে পড়ে, প্রথম বছর অনিমেষ না আসায় সে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বছরেও না দেখে সে বুঝে যায়—এটা কোনও সহজ কাকতাল নয়।
তবুও, প্রতিবার সে ভাবে—এই বছর হয়তো ফিরবে। সেই বিশ্বাসটুকু যেন একটা নরম কুয়াশার মতো জমে থাকে হৃদয়ের কোণে। বছরের অন্যদিনগুলোতে সে যতটা যুক্তিবাদী, সেই বিশেষ দিনে সে ঠিক উল্টোটা—একটা একান্ত অবাস্তব স্বপ্নের ভিতর নিজেকে মুড়ে রাখে। সে প্রতিবার সেই পুরোনো D-14 স্টল খুঁজে নেয়, যদিও স্টলের নম্বর এখন বদলে গেছে, এবং সেখানে নতুন নাম, নতুন চেহারা। রঞ্জন স্যার, যিনি এই স্টলের তত্ত্বাবধানে আছেন, মাঝে মাঝে বলেন, “আসছেন তো আবার আমাদের স্টলে, ম্যাডাম? আপনার মতো পাঠক খুব কম আসে।” ঋতা মুচকি হেসে উত্তর দেয়—“এখানে এলেই যেন মনটা শান্ত হয়ে যায়।” রঞ্জন স্যার জানেন না যে এই মেয়েটি প্রতি বছর আসে একই লোকের জন্য অপেক্ষা করতে, অথবা হয়তো আন্দাজ করেন, কিন্তু বলেন না। দোকানের কর্মচারীরাও চিনে গেছে ঋতাকে। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলে—“ম্যাডাম, আপনার সেই গল্পের নায়ক যদি হঠাৎ এসে হাজির হয়?” তখন সে শুধু হাসে, কারণ সে জানে, সত্যিকারের অপেক্ষা কখনও হাস্যকর হয় না।
ঋতার কাছে এই বার্ষিক যাত্রাটি এক রকম রিচ্যুয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আগে থেকে ছুটি নেয় অফিস থেকে, মেট্রো ধরে সেন্ট্রাল পার্ক নামে নামে হাঁটে একটু ধীর গতিতে, যেন পা বাড়ালেই স্মৃতির রাজ্যে প্রবেশ করছে। সে ক্যাফেটেরিয়া ঘুরে দেখে, ঝালমুড়ি খায় না—যদিও ছোটবেলায় পছন্দ করত। তার চোখ শুধু ঘোরে স্টলের আশপাশে—নতুন কোনও মুখ, কোনও চেনা চোখ, সেই কণ্ঠস্বর… যা হয়তো বলবে—“এই বইটা এখনও কিনো না?” কিন্তু তা হয় না। তারপর সেদিন শেষ হয়। সে প্রতিবার একটা বই কিনে নেয়, হয়তো অনিমেষের পছন্দের কোনও লেখকের, অথবা সেই বই যেটা তাদের কথোপকথনে এসেছিল সেই পনেরো মিনিটে। তারপর রাতের বেলায় বাড়ি ফিরে সে সেই বইয়ের প্রথম পাতায় ছোট করে লেখে—“বইমেলা—অপেক্ষার দিন, বছর: ২০১৭” কিংবা “২০১৯”… এইভাবে বছর চলে যায়, পাতা ভরে যায়, কিন্তু একটি মুখ, একটি কণ্ঠস্বর, একটি বিকেল—তা এখনও ফেরে না। তবুও সে ফেরে—কারণ সে জানে, সব গল্পের পরিণতি হয় না; কিছু গল্প শুধু অপেক্ষা হয়ে থাকে—একটা ঘ্রাণের মতো, একটা ধ্বনির মতো, একটা ছায়ার মতো।
তিন
অনিমেষ দত্ত সেই পনেরো মিনিটকে কোনও দিন ভুলতে পারেনি। বছর দশেক কেটে গেলেও তার স্মৃতির মেঘলা আকাশে এখনো স্পষ্ট সেই বিকেলের আলো। বইমেলার সেই মুহূর্তটাকে সে এক ধরনের দৈব যোগসূত্র বলে মনে করে, যেখানে কথা কম হলেও অনুভূতি গভীর ছিল, আর পরিচয়ের অভাব সত্ত্বেও একটা আত্মিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপর? কেন সে আর ফিরল না? সে কি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়েছিল সেই স্টল, সেই মাঠ, সেই মেয়েটিকে? আদৌ কি ফিরতে চায়নি? সত্যিটা আরও নির্মম। সে ফিরে যেতে চেয়েছিল — প্রথম বছর পরেই ঠিক করেছিল আবার যাবে, ঠিক সেই বিকেলে। কিন্তু সেবারই হঠাৎ বাবার স্ট্রোক হয়। হাসপাতালে ছোটাছুটি, দায়িত্ব, আর শেষে বাবার মৃত্যু—সব মিলে সেই বইমেলা আর তার জন্য ফেরেনি। সময় পেরোতে থাকে, জীবনের অভ্যাস বদলায়, সংসারের ভার বেড়ে যায়, কিন্তু পনেরো মিনিটের সেই রঙিন মুহূর্ত ঠিক আগের মতোই থেকে যায় তার স্মৃতিতে—অক্ষত, নির্মল।
এরপর কয়েক বছর ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। লেখালিখি ছিল অনিমেষের আত্মার পরত; ছোট ছোট কবিতা আর গল্প লিখত কলেজে পড়ার সময় থেকেই। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সংসার চালাতে চাকরি খুঁজতে হয় তাকে—প্রথমে একটা শিক্ষানবিশ কনটেন্ট রাইটিং কোম্পানিতে, তারপর ধাপে ধাপে ছোট একটা প্রিন্ট মিডিয়ায়। লেখালিখির সাধনা চাপা পড়ে যায় বিল পেমেন্ট, সংসার চালানো আর বাস্তবতার দাবদাহে। কিন্তু তারপরও সে মাঝে মাঝে রাতে তার ডায়েরি খুলে বসত। ডায়েরির এক পাতায় সে লিখেছিল—“একটি বিকেল, একটি নামহীন মেয়ে, একটি অসমাপ্ত আলাপ… এই হাওয়ার ভিতরে এখনো তার কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়ায়।” সেই মেয়েটির নামটা পর্যন্ত সে জানতে পারেনি, কিন্তু তার মুখ, চোখ, স্কার্ফের রং—সবই ক্যানভাসের মতো আঁকা আছে তার মনের মধ্যে। বহুবার অনিমেষের ইচ্ছে হয়েছে সেই স্টলে ফিরে যেতে। কিন্তু প্রতিবার কিছু না কিছু বাধা এসে দাঁড়িয়েছে—অফিসের ডেডলাইন, অসুস্থ মা, নিজের মানসিক অস্থিরতা, অথবা নিছক দ্বিধা।
তবে সে ভুলে যায়নি। সেই মেয়েটির উপস্থিতি তার লেখার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। অনিমেষ যে দু’একটা গল্প লিখেছে ছোট পত্রিকায়, তার মধ্যে একটি গল্প ছিল—“পনেরো মিনিট”। এক তরুণী আর এক তরুণের হঠাৎ দেখা, কয়েক মিনিটের সংলাপ, তারপর বিচ্ছিন্নতা—কিন্তু কোথাও একটা গভীর সংযোগ। এই গল্প পড়েই একজন পাঠক মন্তব্য করেছিল—“আপনার লেখায় সত্যিই একজনকে হারানোর ব্যথা লুকানো আছে।” অনিমেষ তখন বুঝেছিল, সে যতই ভুলে যেতে চায়, কিছু কিছু অনুভূতি এত সহজে মুছে যায় না। একদিন হঠাৎ, সে তার নিজের লেখায় সেই বিকেলের কথা লিখে ফেলে। আর তখনই সে ভাবতে শুরু করে—”সে কি এখনও বইমেলায় যায়? সে কি অপেক্ষা করে আমার জন্য?” সেই প্রশ্নটা যেন তার রাতগুলোতে নিঃশব্দে পাশে বসে থাকে। কিন্তু সে তখনও সাহস করে উঠতে পারেনি। বুকের মধ্যে একটা অদৃশ্য ভার ছিল—যদি সে না আসে? যদি সে এসে আবার হারিয়ে যায়? কিংবা যদি মেয়েটি এসে থাকেও, কিন্তু তাকে দেখেই চলে যায়? অনিমেষ জানত না—একটা পনেরো মিনিটের স্মৃতি কাউকে কতখানি শক্ত করে বাঁধতে পারে, আর কতখানি দুর্বল করে দিতে পারে। তবুও তার ভিতরে একটা কুড়িয়ে রাখা আলোর মতো জ্বলতে থাকে—একদিন সে যাবে, একদিন দেখা হবে আবার। ঠিক যেখানে সেই মুহূর্তটি রেখে এসেছিল, ঠিক সেই সময়টায়।
চার
D-14 নম্বর স্টলটি এখন আর সেই নম্বর থাকে না, কিন্তু ঋতা প্রতিবার খুঁজে নেয়—নতুন মানচিত্র, নতুন নামের স্টল, তবুও পুরোনো স্থান। এই স্টলটি বাংলা ছোটো প্রকাশনাগুলোর মধ্যে একটি, যেখানকার পরিবেশ বরাবরই একটু ধীর, একটু নিরিবিলি। সেদিনও যেমন ছিল, স্টলের একপাশে পুরনো কাঠের টেবিল, তার ওপর বইয়ের স্তূপ, পেছনে পলিথিনে মোড়ানো কিছু প্যাকেট, আর টালির নিচে ঝোলানো বাতির নিচে একজন ধূসর দাড়িওয়ালা মানুষ বসে থাকেন — রঞ্জন স্যার। ষাট পেরিয়ে যাওয়া মানুষটি এই প্রকাশনার সাথে জড়িত বহু বছর ধরে। তাঁর মুখে সারাক্ষণ একরকম প্রশান্তি লেগে থাকে, আর চোখে থাকে এক জ্ঞানী পাঠকের ধৈর্য। তিনিই প্রথম খেয়াল করেছিলেন, এই মেয়েটি প্রতিবছর আসে এক নির্দিষ্ট দিন, নির্দিষ্ট সময়, একা। প্রথম কয়েক বছর কিছু না বললেও পরে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন—”আপনি প্রতি বছর এই দিনে আমাদের স্টলে আসেন, না কি আমি ভুল বলছি?” তখন ঋতা একটু হেসে বলেছিল, “আসলে এই জায়গাটার সাথে আমার একটু অতীত জড়িয়ে আছে।” সেই থেকে রঞ্জন স্যার বুঝে যান—এই আসাটা শুধুই বই কেনা নয়, কিছু অপেক্ষাও বটে।
স্টলের বাকি কর্মচারীরাও এখন চিনে ফেলেছে ঋতাকে। রাহুল, একুশ-তেইশের এক ছেলেটা, প্রথম প্রথম মজা করে বলত, “ম্যাডাম, কাউকে খুঁজছেন বুঝি?” এখন সে আর প্রশ্ন করে না, বরং ঋতার জন্য নতুন বই এনে সামনে রেখে দেয়। চঞ্চলাদি, যিনি বিক্রির কাজ দেখেন, প্রায়ই বলেন, “আপনার মতো পাঠক এখন আর কোথায় আছে!” —কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও বুঝে ফেলেছেন, এই পাঠক কেবল বই পড়তে আসেন না। স্টলের সামনে একটা বেঞ্চ আছে, সেখানে বসে থাকে মাঝে মাঝে ঋতা। তার চুপচাপ বসে থাকা দেখে অন্য পাঠকরা ভাবে হয়তো সে লেখক, কিংবা সাংবাদিক। কিন্তু কেউ জানে না সে বসে আছে কারো জন্য। রঞ্জন স্যার একবার বলেছিলেন—”মানুষ তো বইয়ের পাতার ভেতর থেকেও কাউকে খোঁজে, আপনি হয়তো এমন কাউকেই খুঁজছেন।” ঋতা কিছু বলেনি, শুধু মৃদু হেসেছিল।
এই স্টলের পরিবেশটাই এমন, যেখানে সময় থেমে থাকে। ঝালমুড়ির ঠোঙা হাতে কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে বইয়ের নাম দেখে, কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে গল্পের পাতা উল্টায়। কিন্তু সেইসব মুখের ভিড়ে ঋতা খুঁজে ফেরে একটি মাত্র মুখ। মাঝে মাঝে এমন কেউ আসে, যার গড়ন বা চোখের অভিব্যক্তি যেন সেই পুরোনো ছেলেটার মতো—তখন তার বুক ধক করে ওঠে, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে—না, তিনি নন। স্টলের লোকেরা বুঝতে পারে না, ঋতা ঠিক কাকে খোঁজে, কেমন দেখতে মানুষটিকে, কী তার পরিচয়। এমনকি রঞ্জন স্যারও একবার বলেছিলেন—”কাউকে না জেনে চেনা, এটাই তো সবচেয়ে দুর্লভ প্রেম।” কথাটা শুনে ঋতা চমকে গিয়েছিল। প্রেম? সে তো কখনো প্রেমের কথা ভাবেনি। কিন্তু গভীরে গিয়ে ভাবে—তাহলে এই দশ বছরের ফিরে আসাটা কী? এটা কি বইয়ের প্রতি ভালবাসা? না কি সেই পনেরো মিনিটের মানুষটির প্রতি? সে জানে না। কিন্তু এটুকু জানে—যতদিন সে ফিরে আসে, স্টলের মানুষগুলো যেন তার এই নীরব যাত্রার সাক্ষী হয়ে থাকেন। বইয়ের ভাঁজে যেমন পুরোনো গোলাপ রেখে দেওয়া যায়, তেমনি এই স্টলের ছায়াতলে রেখে গেছে সে এক পুরোনো বিকেলের স্বপ্ন।
পাঁচ
সেই বছর ঋতা বইমেলায় এল আরও একটু আগে। বাতাসে ছিল জানুয়ারির মৃদু শীত, আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। স্টলের কাছে পৌঁছে সে দেখে রঞ্জন স্যার বসে আছেন যথারীতি, পাশে রাহুল বই সাজাচ্ছে। স্টলের মাঝামাঝি একটা টেবিলে রাখা ছিল কিছু নতুন ছোট গল্পের বই—কম পরিচিত লেখকদের লেখা। হঠাৎ একটা বইয়ের নাম তার চোখে পড়ে—“পনেরো মিনিট”। নামটা দেখে বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। সে ধীরে ধীরে বইটা হাতে তোলে, মলাটে একজন ছায়ামূর্তির রূপরেখা, আর নিচে লেখা—অনিমেষ দত্ত। চোখ আটকে যায় লেখকের নামটাতে। হাতে ধরে পাতার পর পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে পড়তে থাকে প্রথম গল্পটাই—যেখানে এক বইপ্রেমিক মেয়ে আর এক ছেলের হঠাৎ দেখা হয় একটি স্টলে, বইয়ের সূত্রে আলাপ, এক ছোট্ট সংলাপ, তারপর বিচ্ছিন্নতা। গল্পটা যেন আয়নার মতো প্রতিফলিত করে তার সেই পনেরো মিনিটের স্মৃতিকে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অনুভূতি—সব যেন চেনা। এটা কি কাকতাল? নাকি অনিমেষ সত্যিই সেই ছেলেটি?
পড়ে শেষ করে সে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। রাহুল এসে বলে—“ম্যাডাম, বইটা নেবেন?” ঋতা বলে—“হ্যাঁ, এটা তো আমার গল্প।” টাকা দিয়ে বইটা কিনে নেয়, যেন সেই বইয়ের ভেতর সে নিজেকেই ফিরে পেয়েছে। স্টলের পেছনে দাঁড়িয়ে সে আবার বইটা উল্টায়, দেখে শেষে লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: “অনিমেষ দত্ত, লেখালিখির জগতে নবীন। বারাসাতে থাকেন, ছোটদের জন্য লেখেন, আর মাঝে মাঝে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও। ই-মেইল: animesh.dutta.writer@**”। ঠিকানা নেই, ফোন নম্বরও না—শুধু ই-মেইল। কী করবে সে? ইমেইল করবে? লিখবে কিছু? নিজেকে চিনিয়ে দেবে? ভেবে সে অস্থির হয়ে পড়ে। দশ বছর ধরে যে মুখ খুঁজে ফেরে, আজ তার সামান্য ছায়া পেয়েও দ্বিধায় পড়ে যায় সে। কিন্তু একটা অদৃশ্য টান অনুভব করে বুকের গভীরে। কেমন করে কেউ নিজের জীবনের গল্পকে অন্য কারও লেখায় পড়ে—আর বিশ্বাস করে, হ্যাঁ, এটা আমারই!
রাতে বাড়ি ফিরে সে বারান্দায় বসে, বইটা কোলে রেখে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ল্যাপটপ খুলে একটি মেইল লেখে। কিন্তু ঠিক কী লিখবে—তা বুঝে উঠতে পারে না। নিজের পরিচয় দেবে কি? নাম বলবে? না কি শুধু ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেবে সে কে? অবশেষে মেইলটা এমনভাবেই লেখে যেন সেটি এক কবিতার মতো—“তুমি কি জানো, কতটা দূর যেতে হয় ফিরে আসার জন্য? আমি প্রতি বছর যাই, এক বিকেলে, যেখানে সময় থেমে আছে। তোমার গল্প পড়ে মনে হলো, তুমি থেমে আছো আমার সাথেই। যদি সত্যি হও—তবে জেনে রেখো, আমি এখনও দাঁড়িয়ে আছি সেই পুরোনো স্টলের পাশে, সেই পুরোনো স্কার্ফ গলায় জড়িয়ে।”
তুমি কি ফিরে আসবে?”
সেই মেইল পাঠিয়ে সে চুপচাপ বসে থাকে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায় রাত বারোটার দিকে। শহরের উপর ভেসে আসে হালকা ট্র্যাফিকের আওয়াজ, কিন্তু তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—এই অসমাপ্ত গল্প কি এবার সম্পূর্ণ হবে? নাকি লেখকের মতো পাঠকও হারিয়ে যাবে নিজের কল্পনায়? সে জানে না, কিন্তু অনুভব করে—এই রাতে তার বুকের ভেতরে একটা পাতা উল্টেছে। যেন গল্পটা এবার নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে।
ছয়
বইমেলার সেই দিনের পর থেকে রিমঝিম যেন পুরনো দিনগুলোর রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল, অতীত হঠাৎ করে যেন তার সামনে হাজির হয়েছে, এক অপূর্ব চেনা সুবাসের মতো। তিথির সঙ্গে দেখা হবার পর, সে সেই পনেরো মিনিটের পুরনো স্মৃতিকে এখনকার বাস্তবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিল বারবার। তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কম্পন — যেন কোনো বিশাল ভুল সে একদিন করে ফেলেছিল, আর আজ, এতগুলো বছর পর, সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছে সে। তিথি এখন অন্যরকম — চোখে পরিণত বোধ, কথায় এক ধরণের সংযম, আর চাহনিতে এক নিঃশব্দ আর্তি। তারা বসেছিল বইমেলার এক কোণে, স্টলের পেছনের বাঁধানো বেঞ্চটায়। চারপাশে বইপ্রেমীদের ভিড়, স্টলের চিৎকার, গরম কাগজে মোড়া ফুচকার গন্ধ — সবকিছু মিলিয়ে যেন এক মোহময় পটভূমি তৈরি করছিল তাদের কথোপকথনের জন্য। তিথির চোখে স্পষ্টই ছিল এমন কিছু না বলা প্রশ্ন, যা শুধু সময়ের ফাঁকে জমে থাকা অনুভব দিয়ে বোঝা যায়। রিমঝিম বলেছিল, “তুই তো বুঝলি না সেদিন…” তিথি মাঝখানে থামিয়ে বলেছিল, “আমি ভয় পেয়েছিলাম রিমঝিম… ভয় পেয়েছিলাম, যদি আবার হারিয়ে ফেলি।” কথা থেমে গিয়েছিল দুজনের মধ্যে। বহুদিনের জমে থাকা নীরবতা যেন এক মুহূর্তে মিশে গেল বইমেলার হাওয়ায়।
পরের কয়েকদিন রিমঝিম বারবার ফিরে যাচ্ছিল বইমেলার সেই বিকেলের কথায়। তার প্রতিটি মুহূর্ত এখন জুড়ে ছিল তিথির কথা। সে যে এতগুলো বছর ধরে এই একটি বিকেলের অপেক্ষায় ছিল, সেটা রিমঝিম ঠিক বুঝতে পারছিল না — কষ্টে, ভালোবাসায়, না কী নিছক কোনো অসমাপ্ত গল্পের আকর্ষণে। সেই রাতে ঘরে ফিরে তার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, সে বারবার ভাবছিল তিথির চোখের কথা, সেই পুরনো “পাপাই”-ডাকা স্বরে লুকিয়ে থাকা উষ্ণতার কথা। অথচ সে কিছুই জানতে পারেনি তিথির জীবন সম্পর্কে — এখন সে কোথায় থাকে, কী করে, তার পরিবার বা বন্ধুদের কথা। তিথি শুধু বলেছিল, “আমি তো প্রতিদিন আসি না… শুধু এই দিনটায়, এই স্টলের সামনে।” এই সংলাপটার মধ্যে ছিল একরাশ আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা, যা রিমঝিমকে তছনছ করে দিয়েছিল। সে নিজেকে দোষ দিচ্ছিল — সেই সময়ের সাহস না দেখানোর জন্য, তিথির হাতটা না ধরার জন্য, এমনকি পরের দিন ফোন না করার জন্য। অথচ জীবন তাকে অন্যদিকে টেনে নিয়েছিল — নতুন শহর, নতুন চাকরি, নতুন সম্পর্ক… কিন্তু কোথাও যেন তিথি ঠিক তার মনের এক কোণে গেঁথে রয়ে গিয়েছিল, ঠিক যেমন পছন্দের কোনো পুরনো কবিতার লাইন।
এখনকার রিমঝিম অনেকটাই পরিণত, কিন্তু তিথির উপস্থিতিতে সে যেন আবার সেই কলেজপড়ুয়া লাজুক ছেলেটায় ফিরে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, সময় চলে গেলেও কিছু অনুভূতির মৃত্যু হয় না। এই অনুভূতিগুলোই মানুষকে জীবন্ত রাখে, কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাস্তবের বাঁধা পেরিয়ে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, তিথির সঙ্গে আরও দেখা করতে হবে — না শুধু কথা বলার জন্য, বরং নিজেকে আর একবার বোঝার জন্য। হয়তো এবার সে সাহস দেখাতে পারবে, হয়তো এবার সে বলতে পারবে সেই পনেরো মিনিট তার জীবনের সবচেয়ে তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মুহূর্ত ছিল। আর এই সাহসের প্রথম ধাপ হিসেবে, রিমঝিম বইমেলার শেষ দিন আবার সেই স্টলে যেতে চায় — যেখান থেকে দশ বছর আগে শুরু হয়েছিল এক অসমাপ্ত গল্প। এই সিদ্ধান্তে সে যেন নিজেকে খুঁজে পায় নতুন করে, নিজের ভিতরের সেই অপেক্ষার মানুষটিকে চিনে নেয় স্পষ্টভাবে। এখন তার আর কোনো দ্বিধা নেই — যদি তিথি আসে, সে এবার আর চুপ থাকবে না।
সাত
বিকেলের আলোটা বইমেলার রঙিন ভিড়ের ভেতর একটু অন্যরকম লাগছিল। পুকুরঘাটের ধারে বসে থাকা অনিন্দিতা একরকম ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েছিল — চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে এসেছে, অথচ তার খেয়াল নেই। বুকের ভেতর হালকা হুল বেঁধে থাকা স্মৃতিটা আজ অনেক বেশি জ্বলে উঠছে। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল — স্ক্রিনে একটা অচেনা নাম্বার। সাধারণত এমন অজানা নম্বর সে ধরেনা, কিন্তু আজ যেন অন্তরের এক কৌতূহল তাকে ফোনটা ধরতে বলল। ওপার থেকে একটি শান্ত, গভীর পুরুষকণ্ঠ — “হ্যালো, অনিন্দিতা বলছেন?” সে একটু চমকে উঠে উত্তর দিলো, “জি, আপনি?” কণ্ঠটা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আমার নাম অরণ্য। আমি… আমি হয়তো সেই মানুষ, যাকে আপনি বইমেলায় খুঁজে ফিরেছেন।” নিঃশব্দ হয়ে গেলো চারপাশ — চায়ের দোকান, পুকুরের ঢেউ, হাওয়ার শব্দ সব যেন এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ।
অনিন্দিতা কিছুক্ষণ কিছু বলতে পারেনি। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে, হাত কাঁপছে সামান্য, চোখে জল এসে গেছে অজান্তে। সে ফিসফিস করে বলল, “আপনি… কীভাবে জানলেন আমি…” অরণ্যের কণ্ঠে হালকা হাসির সুর, “বছর পাঁচেক আগে বইমেলায় গিয়েছিলাম, অনেক দিন পরে। হঠাৎ এক বিকেলে দেখলাম আপনি দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেই স্টলে। সাহস করে এগিয়ে যাইনি। তারপর প্রতি বছর গেছি, কিন্তু আপনার দেখা পাইনি। গতকাল আবার গিয়েছিলাম। আপনাকে দেখলাম না। কিন্তু ওই স্টলের মালিক এক বুড়ো মানুষ, তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, আপনি প্রতি বছর ঠিক ওই সময়েই আসেন। আমার নম্বরটা ওঁকে দিয়ে গেছিলাম, যদি কোনোদিন আপনি কিছু বলেন… কাল আপনি নাকি তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলেছিলেন?” অনিন্দিতার মনে পড়ে গেল — সে স্টলের বুড়ো মানুষটিকে বলেছিল, “এইখানে একটা ছেলে একবার এসেছিল… আপনি চিনতেন?” উত্তর না পেয়ে চলে এসেছিল। আজ বুঝতে পারল, তিনিও হয়তো অরণ্যকে চিনতেন। অনেক কথার পর, অবশেষে অরণ্য জানতে চাইল, “আমরা কি দেখা করতে পারি? আবার? এই শনিবার, ঠিক দশ বছর পরে?” কিছুক্ষণের নীরবতা, তারপর অনিন্দিতার ঠোঁটে এক বিনীত হাসি — “হ্যাঁ। আবার দেখা হোক… বইমেলায়।”
শনিবার আসতে যেন মাস পার হয়ে গেল। সকাল থেকেই অনিন্দিতার মনে একটা উন্মাদনা কাজ করছিল। কী বলবে? অরণ্যকে ঠিক চিনতে পারবে তো? আর যদি সে পাল্টে গিয়ে থাকে? কিংবা সে নিজেই এত পাল্টে গেছে যে ছেলেটা আর চিনতেই না পারে? কিন্তু সমস্ত দোলাচলের মাঝে একটা বিশ্বাস তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই স্টলের সামনে — ঠিক দুপুর বারোটা। হাওয়ার মাঝে পুরনো পাতা উড়ছে, কিশোরীরা হাসছে, বইয়ের পাতার গন্ধ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। স্টলের একপাশে হালকা ভিড়। তারপর হঠাৎ সে টের পেল — কোনো একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে দেখল — এক চেনা অবয়ব, একটু বদলে যাওয়া মুখ, কিন্তু সেই চাহনি, সেই চোখের গাম্ভীর্য, সেই অরণ্য। ছেলেটা ধীরে এসে দাঁড়াল তার সামনে, বলল, “তুমি ঠিক দশ বছর আগে যেমন ছিলে, আজও তেমনি।” অনিন্দিতা হেসে ফেলল, “আর তুমি? তুমিও বদলাওনি। শুধু একটু সাহসী হয়ে উঠেছ।” দুজনেই হেসে উঠল, বইমেলার ভেতর যেন সেই পনেরো মিনিট আবার ফিরে এল — কিন্তু এবার তা চলবে অনেক, অনেকটা সময়।
আট
বইমেলার সেই শেষ বিকেলে কলকাতার আকাশে ছিল এক অদ্ভুত রঙের খেলা। রোদ আর মেঘের লুকোচুরি যেন এক সঙ্গীত রচনা করছিল, ঠিক তেমনি করেই আনুশকা নিজের অন্তরের ভিতরও অনুভব করছিল এক আশ্চর্য সুর। সেদিন আর কেউ ছিল না স্টলের সামনে, বইপত্রও বেশিরভাগ বিক্রি হয়ে গিয়েছে, শুধু ঝুলে থাকা কয়েকটা ব্যানার আর ধুলো ধরা কিছু পুরোনো বই যেন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই প্রতীক্ষার। আনুশকা সেই পুরনো বেঞ্চিটার ওপর বসে পড়ে, মনে মনে ভাবছিল অতীতের কথা—প্রথম দেখা, সেই পনেরো মিনিটের কথা, আর তারপর এই এক দশকের প্রতীক্ষা। তার চারপাশে তখন মেলা গুটিয়ে যাওয়ার শব্দ, ভাঙা মাইক, বাঁশের কাঠামো খুলছে কিছু শ্রমিক, আর শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে বইয়ের সেই জাদুকরী আবহ। তবুও আনুশকা তাকিয়ে ছিল সামনের পথটায়—যেন এই বুঝি আবার পেছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ডাক দেবে, ‘এই, তুমি কি আমায় চিনতে পেরেছ?’
ঠিক তখনই সে শুনল পেছন থেকে হাঁটুর কাছে নেমে আসা এক শান্ত কণ্ঠস্বর—“এখনও কি বইয়ের খোঁজে আসো, নাকি স্মৃতির খোঁজে?” আনুশকা ধীরে ঘুরে তাকালো। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সেই মুখ—একটু বড়ো দাড়ি, চোখে চশমা, কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ, মুখে সেই পুরনো, স্নিগ্ধ হাসি। সাম্য! তার মুখটা যেন সময়ের চিহ্ন নিয়ে বদলে গেলেও, চোখ দুটো ঠিক একই আছে—সেই আত্মবিশ্বাসী, শান্ত চোখ, যা পনেরো মিনিটের মধ্যে একজন অচেনা মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে দিতে পারে। আনুশকা কিছুক্ষণের জন্য কিছু বলতেই পারল না। তারপর হঠাৎ করে তার গলা যেন ফিরে এলো—“তুমি? সত্যিই তুমি?” সাম্য মাথা নেড়ে হাসল, “হ্যাঁ, আমি। অনেক বছর ধরে আমিও এসেছি এই স্টলে, শুধু এই ভেবেই, যদি দেখা হয় আবার কখনো।” দুজনেই তখন বসে পড়ল বেঞ্চিতে, একে অপরের চোখে তাকিয়ে থাকল অনেকটা সময়। আর কোনো শব্দ ছিল না, শুধু পাশে বাতাসে ওড়ানো পাতা, আর পেছনে ভাঙা মেলার শেষ সুর।
সেই বিকেলে তারা একসঙ্গে অনেক কথা বলল—কে কোথায় ছিল এতদিন, কী কী বদলেছে জীবনে, কীভাবে মনে রেখেছে একজন আরেকজনকে এতদিন ধরে। সাম্য জানিয়েছে, সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, আর আনুশকা একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করে—কিন্তু তাদের জীবন যেন থেমে ছিল সেই বইমেলার বিকেলে। “জানো,” সাম্য বলল, “আমি বিশ্বাস করতাম, বাস্তবের থেকেও কল্পনার গভীরতা বেশি। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, আমি বুঝতে পারছি—যা বাস্তব, তা-ই আসলে সবথেকে জাদুকরী।” আনুশকা তখন হাত বাড়িয়ে সাম্যর হাত ধরল—একটু থেমে, একটু কাঁপা কাঁপা আঙুলে। “আমরা কি আবার শুরু করতে পারি?” সে জিজ্ঞাসা করল। সাম্য একটু হাসল, মাথা নাড়ল—“এই বইমেলাতেই তো আমাদের গল্পের প্রথম অধ্যায় লেখা হয়েছিল। আজ, দশ বছর পর, আমরা লিখতে পারি দ্বিতীয় অধ্যায়টা।” সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠেছিল, বইমেলার স্টলগুলো অন্ধকারে মিশে যাচ্ছিল, আর দুই প্রাচীন প্রেমিক সেই বেঞ্চে বসে নিজেদের হৃদয়ের পৃষ্ঠা খুলে ফেলছিল—নতুন করে, আবার, এক বিকেলের জাদুতে।
***
				
	

	


