অভীক ভট্টাচার্য
পর্ব ১: পুলকের আগমন
মেঘমল্লার হাউজিং-এর D ব্লকের চতুর্থ তলার ৪২০ নাম্বার ফ্ল্যাটে এক আশ্চর্য বিকেলে ঢুকল নতুন ভাড়াটে—পুলক চ্যাটার্জি। বয়স পঁয়ষট্টির ঘরে, চুলে পাক ধরেছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর কাঁধে একটা জীর্ণ রেক্সিনের ব্যাগ। তবে যে জিনিসটা প্রথমেই নজর কাড়ল তা হলো তাঁর বুকের উপর ঝোলানো একটা প্ল্যাকার্ড:
“I AM RETIRED BUT STILL DANGEROUS.”
তীর্থ তখন অফিস থেকে ফিরছে। জলের বোতলটা সবে ফ্রিজে ঢুকিয়েছে, দরজার সামনে শব্দ পেয়ে তাকাতেই দেখে ওই প্রবীণ ভদ্রলোক তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।
—“তুমি তীর্থ তো? আমি তোমার নতুন রুমমেট—পুলক চ্যাটার্জি। এক্স-কোড নেম: রেড কোবরা।”
তীর্থ মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
—“কোড নাম?”
—“কোড নাম, হ্যাঁ। আমি সিআইএর সাবেক এজেন্ট। তবে এখন অবসর নিয়েছি। কিন্তু সাবধান—শত্রুরা এখনও খুঁজছে আমাকে।”
তীর্থ বুঝল, কেলো! বাড়িওয়ালা জয়ন্ত কাকু নাকি বলেছিল ভালো মানুষ, একটু একা থাকেন, টেনশন নেওয়ার কিছু নেই।
পুলকবাবু ইতিমধ্যেই ঘরের এক কোণে বসে ব্যাগ থেকে নানা জিনিস বের করতে শুরু করেছেন—একটা বাইনোকুলার, তিনটে খালি কাঁচের শিশি, একটা রাবার পাখি, আর একটা অদ্ভুত যন্ত্র যেটা থেকে মাঝে মাঝে “পিক পিক” শব্দ বেরোচ্ছে।
তীর্থ কাঁপা গলায় বলল, “এগুলো কি?”
পুলকবাবু জবাব দিলেন, “এগুলো আমার সরঞ্জাম। ওটা মাইক্রো ওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি ট্র্যাপার। এর আওতায় কেউ কথা বললে আমি শুনতে পাই। পাশের ফ্ল্যাটের তৃষা ম্যাডামের কণ্ঠও আমি পরীক্ষামূলকভাবে ধরেছি। চমৎকার ভোকাল রেঞ্জ।”
তীর্থ: “আপনি এটা করছেন কেন?”
পুলকবাবু: “ওরা সন্দেহজনক। গত পরশু রাতে ওনার ফ্ল্যাট থেকে তিনবার ঘুঘুর ডাক পেয়েছি। কলকাতার মাঝে ঘুঘু আসে না—মানে কিছু একটা তো ঘটছে। হয় কনস্পিরেসি, নয়তো—বায়োলজিক্যাল অস্ত্র!”
তীর্থ চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
পরদিন সকালে আবাসনের গেটম্যান সঞ্জু দা এসে খবর দিলেন—“ভাই, তোমার ওই নতুন রুমমেট তো গতরাতে পার্কিং লটে ক্যাম্পিং করছিল! বলে, ‘এখানে কেউ অজানা বস্তু ফেলেছে।’ শেষে কাগজের ঠোঙা দিয়ে একটা ‘বোমা’ উদ্ধার করল, যেটা আসলে ছিল মোমো প্যাকেট!”
আরও মজার কথা—পুলকবাবু এখন আবাসনের ‘গোপন গোয়েন্দা পরিষেবা’ খুলেছেন। কেউ চাবি হারালে বা কেউ ফোনে কারো প্রেমের কথা শুনে ফেলতে চাইলে তিনি নাকি সাহায্য করবেন। বিনিময়ে শুধু চান—“মাসে একবার বিরিয়ানি।”
তীর্থের অফিসের কলিগরাও জানতে পেরেছে নতুন ‘রুমমেটের কাণ্ড’। ওরা এখন তীর্থকে ‘এজেন্ট জিরো’ বলে ডাকছে। তৃষা ম্যাডাম ইতিমধ্যেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন—“আর যদি কেউ আমার ঘর ‘মনিটর’ করে, আমি পুলিশ ডাকব।”
কিন্তু তাতে পুলকবাবুর বিন্দুমাত্র বিকার নেই। তিনি বলছেন—“ডোন্ট ওয়ারি। আমি আমার নতুন মিশনে আছি—‘অপারেশন আবাসন।’ মেঘমল্লারে কেউ ষড়যন্ত্র করছে, আমি প্রমাণ করে ছাড়ব!”
তীর্থ মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে ফেলে। এই মানুষটার পাগলামির মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে। কিছু বলার থাকে না, শুধু একটাই ভাবনা মাথায় ঘোরে—
“এবার তো জীবনেই স্থিরতা আসবে না!”
পর্ব ২: চায়ের কাপ ও চুপি চুপি ষড়যন্ত্র
তীর্থ ঠিক করেছিল, এ সপ্তাহটা শান্তিতে অফিস করবে। সকালে উঠে চা খাবে, বাসে না উঠে উবের নেবে, আর ফ্ল্যাটে ফিরেই পুলকবাবুর সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবে।
কিন্তু সকালটা শুরুই হলো কফির কাপের জায়গায় ডিটেকশন সিরাম দিয়ে।
—“চা খাবেন?” তীর্থ জিজ্ঞেস করতেই পুলকবাবু বললেন, “আজ চা নয়, তোমার জন্য বিশেষ পানীয় তৈরি করেছি—রহস্য ফাঁস সিরাম। এটা খেলেই তোমার চারপাশে কে মিথ্যে বলছে বুঝে যাবে। হালকা গন্ধটা উপেক্ষা করো, এটা মূলত কাঁচা মেথি আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বানানো।”
তীর্থ কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আপনি খেলেন?”
পুলকবাবু চুপ। তারপর গভীরভাবে বললেন, “আমি তো জানি কে সত্যি আর কে মিথ্যে। আমি খেলেই বা কী হবে?”
চায়ের বদলে রহস্য পানীয়—তীর্থ বুঝে গেল সপ্তাহটা আগেই শেষ হয়ে গেছে।
আবাসনে তখন ভোরের ব্যস্ততা।
বাচ্চারা স্কুলবাস ধরছে, বুড়োরা হাঁটতে বেরোচ্ছে, আর তৃষা ম্যাডাম তাঁদের রোজকার মতো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে ক্লাস নিচ্ছেন— “আজ আমারা শিখব ‘Passive Voice’। First sentence: He eats fish…”
এদিকে পুলকবাবু ব্যালকনি থেকে বাইনোকুলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কার ওপর নজর রাখছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “তীর্থ, তৃষা ম্যাডামের চুল আজ খোলা। এর মানে আজ তাঁর মুড ভালো। আর মুড ভালো থাকলে মানুষ সাধারণত কিছু লুকাতে চায় না—তবে…”
—“তবে?” তীর্থ মুখে বিস্কুট পুরে বলে।
—“তবে যদি ওনার মুড ভালো থাকে, আর চুল খোলা থাকে, তবু তিনি ব্যালকনিতে না এসে ঘরের মধ্যে ফোনে কথা বলেন—তবে বুঝতে হবে, কেউ কিছু লুকাচ্ছে।”
তীর্থ বোঝে না সে হেসে উঠবে, না হাউমাউ করে উঠবে। তবে ওর মন বলে—একদিন এই মানুষটিই হয়ত সত্যি কিছুর গোড়ায় পৌঁছে যাবে, আর পুলিশ এসে তাকে বলতে বাধ্য হবে—“পুলকবাবু, আমরা আপনার কাছে ঋণী।”
কিন্তু বাস্তবে তখনই বাড়ির সামনে আসে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রতন কাকু। সাদা ধুতি, গায়ে গরম ফতুয়া, মুখে হাঁ হাঁ হাওয়া ঢুকে পড়েছে।
—“কাল রাতের পুলকবাবুর কান্ড জানো? আমাদের ডোরবেলের বোতামে লাল রঙের স্টিকার লাগিয়ে দিয়ে গেছেন! বলছেন, আমি সন্দেহভাজন!”
পুলকবাবু পাশ থেকে হেসে বলেন, “ওটা ‘লেভেল ওয়ান টার্গেট’ ট্যাগ, মিস্টার রতন। আমি জানি আপনি ডায়বেটিক, তবু রাত তিনটেয় বালকনিতে গিয়ে লাড্ডু খেলেন কেন?”
রতন কাকু থতমত খেয়ে বললেন, “আমি… আমি… গ্যাস হচ্ছিল। একটু হাওয়া খেতে গেছিলাম।”
পুলক: “আচ্ছা, গ্যাস হলে মানুষ লাড্ডু খায়?”
এরপর শুরু হয় ঝগড়া, তর্ক, এবং শেষমেশ মোড়ানো গজা দিয়ে একে অপরকে “ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করো” ধরণের বাক্যবাণ।
তীর্থ অফিসে গিয়ে দিনভর শুধু একটাই গল্প করে—“আমার রুমমেট পুলকবাবু আজ রতন কাকুকে ‘লাড্ডু-আতঙ্কবাদী’ বলেছে!”
কলিগরা হাসতে হাসতে বলে, “তুই সিরিয়াসলি একটা ওয়েবসিরিজ লিখে ফেল—’Spy Grandpa in Kolkata’!”
সন্ধ্যাবেলা তীর্থ বাড়ি ফেরে। দেখে পুলকবাবু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন দিয়ে কী যেন শোনার ভান করছেন।
—“কি করছেন?”
—“ওয়্যারলেস ইন্টারসেপ্ট করছি। বাচ্চারা যে খেলছে, তাদের মধ্যেও ষড়যন্ত্র লুকিয়ে থাকতে পারে। ছোটরাও আজকাল ইনটেলিজেন্স চালায়—ইনস্টাগ্রামে!”
তীর্থ হেসে মাথা নাড়ায়।
—“আপনি জানেন, আপনি একটু গেঁয়ো পাগল টাইপ দেখায়?”
—“হু… গেঁয়ো পাগলদেরই একদিন ইতিহাস মনে রাখে, তীর্থ। অপেক্ষা করো… অপারেশন আবাসনের প্রথম ফেজ শেষ। কাল থেকে শুরু হবে ফেজ টু: ‘চুপিচুপি ষড়যন্ত্র!’”
তীর্থের মনে প্রশ্ন জাগে—“ওটা কি আবার কী?”
পর্ব ৩: পার্সেল, পায়রা, আর পুলকের প্ল্যান
পরদিন সকালটা অদ্ভুত এক শান্তিতে শুরু হয়েছিল। তীর্থ ঘুম থেকে উঠে দেখে পুলকবাবু ঘরে নেই। গ্যাসের চুলায় দুধ ফুটছে, পাস্তা ভিজে আছে জলে—সবকিছু ঠিকঠাক। তার মানে পুলকবাবু কোথাও মিশনে নেই, বাড়িতে নেই, মানে আপাতত বিপদ নেই।
তীর্থ আরাম করে মোবাইলে স্ক্রল করছিল, এমন সময় দরজার ঘণ্টা বাজল।
—“কে?”
—“ডেলিভারি, স্যার! এক্সপ্রেস পার্সেল!”
তীর্থ দরজা খুলে দেখে এক যুবক একটা ব্রাউন রঙের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।
প্যাকেটের ওপর লেখা—
TO: AGENT RED COBRA
FROM: HQ-SUNDARPUR BASE
INSTRUCTIONS: TOP SECRET. OPEN IN PRIVATE. SELF-DESTRUCT AFTER 10 MINUTES
তীর্থ চোখ কপালে। এইবার নিশ্চিত, লোকটা পুরো সিনেমার মধ্যে ঢুকে গেছে।
তবে কিছু না ভেবে সে পার্সেলটা পুলকবাবুর টেবিলের ওপর রাখে। তখনই ঘরে ঢোকে স্বয়ং Red Cobra, অর্থাৎ পুলক চ্যাটার্জি।
চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে রাবারের দস্তানা, কোমরে ঝোলানো পাউচ থেকে বের করছে এক জং ধরা কাঁচি।
—“স্টেপ ব্যাক, তীর্থ। এটা বিস্ফোরকও হতে পারে। HQ থেকে এসেছে। আমাকে আগেই বলা হয়েছিল ‘অপারেশন পায়রা’ শুরু হবে এই সপ্তাহে।”
—“পায়রা?” তীর্থের কণ্ঠে বিস্ময়।
পুলকবাবু চোখ তুলে বললেন, “তুমি পায়রাদের হালকা করে নিচ্ছো। জানো, ১৯৭২ সালে চীনের গুপ্তচররা একাধিক পায়রার পেটে ক্যামেরা বসিয়ে দিল্লিতে ঢুকিয়েছিল? আমাদের এখানে পায়রা শুধু ফ্ল্যাটের বারান্দা নোংরা করে না—ওরা খবরও বয়ে আনে।”
তীর্থ মুখ চেপে হাসি আটকায়। এইবার নিশ্চিত, Red Cobra গল্পে নয়, জীবনেই থাকেন।
প্যাকেটটা খোলা হলো। ভিতরে যা পাওয়া গেল—
১. একটা ছোট ডায়রি
২. তিনটে লাল মারকার
৩. একটা চিঠি—জমাকাল ২০০৭, ঠিকানাহীন, লেখক: “Unknown Friend”
পুলকবাবু ডায়রি খুলে পাতা উল্টে দেখে বলতে শুরু করলেন—
—“এটা আমার পুরনো লোকেশন কোড। এখানে লেখা আছে সেইসব ফ্ল্যাটের নম্বর, যাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। D-102, F-305, আর C-218। এবার বুঝছো কেন বলেছিলাম—মেঘমল্লারে ষড়যন্ত্র চলছে?”
তীর্থ উত্তর দেয় না। সে জানে, যুক্তির কোনো জায়গা এখানে নেই।
—“এখন কী করবেন?”
—“তিন ফ্ল্যাটে নজরদারি শুরু করব। আগে পায়রা পাঠাতে হবে। আমি D-102 এর ব্যালকনিতে একদিন একটা পায়রার খোপ বানিয়ে এসেছিলাম। আজই ওটা অ্যাক্টিভেট করব। পায়রারা মিথ্যে বলে না, তীর্থ। ওদের চোখ অনেক কিছু দেখে ফেলে!”
তীর্থ: “আপনার কাছে পায়রা আছে?”
পুলকবাবু হেসে বলেন, “আছে না বলেই সমস্যায় পড়েছি। ভাবছি ছাদে গিয়ে কিছু দানা ফেলি। আসলে গুপ্তচররা সবসময় যন্ত্রে বিশ্বাস করে না, প্রকৃতিকে ব্যবহার করে।”
এদিকে আবাসনের লোকজন ধীরে ধীরে এই ঘটনা জানতে শুরু করেছে।
তৃষা ম্যাডাম একদিন সরাসরি তীর্থকে বললেন—“আপনার রুমমেটকে বোঝান, পায়রার পেটে ক্যামেরা বসানো আর ব্যালকনিতে ঝাঁকি দিয়ে ওদের পাঠানো এক জিনিস নয়।”
তীর্থ মুখ নিচু করে শুধু বলল, “আমি চেষ্টা করছি।”
এদিকে পুলকবাবু নিজের হাতে একটা ‘গুপ্ত ফর্ম’ বানিয়ে আবাসনের সবাইকে ধরতে শুরু করলেন—
“আপনি কি গত ৭২ ঘন্টায় সন্দেহজনক শব্দ শুনেছেন?”
“আপনার ফ্ল্যাটে কেউ পায়রাকে বরণ করেছেন কি?”
“আপনি কি দিনে ৩ বারের বেশি মোবাইল চার্জ করেন?”
(এটাই নাকি গোয়েন্দাদের চিহ্ন!)
শেষমেশ, রাত দশটায় তীর্থ দেখে পুলকবাবু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পায়রার মত মুখে “গু গুউউউ” শব্দ করছেন।
তীর্থ ফিসফিসিয়ে বলে—
—“কি করছেন আপনি?”
—“আমি ভাষা শিখছি। পায়রাদের ভাষা। জানো, ওরা রাত্রে কথা বলে…”
তীর্থ দরজা বন্ধ করে নিজের বিছানায় গিয়ে গা ঢাকা দেয়।
ওর মাথায় একটাই কথা ঘোরে—
“এই মানুষটা পাগল নয়। এটা ওর পুরো একটা মিশন। মেঘমল্লার আবাসন হয়তো ইতিহাসে জায়গা করে নেবে—এবং তা হবে শুধুমাত্র Agent Red Cobra-র জন্য!”
পর্ব ৪: টেরেসে ট্র্যাপ আর তৃষার টেনশন
মেঘমল্লার হাউজিং-এর ছাদটা সকালবেলা একটু ফাঁকা থাকে। কেউ দড়ি শুকোতে আসে না, কুকুর নিয়ে হাঁটে না—শুধু কয়েকটা কাজের মাসি দোতলার কাপড়গুলো নামাতে আসে। সেই ফাঁকা ছাদের এক কোণে আজ স্থাপন হয়েছে ‘অপারেশন পায়রা’র হেডকোয়ার্টার।
পুলকবাবু কালো টেপ দিয়ে ছাদে এক ঘর মতো জায়গা বানিয়ে ফেলেছেন। মাঝে রাখা আছে:
- এক বাটি মুড়ি
- এক প্লাস্টিক পায়রা (শিল্পকলার নমুনা, যার চোখে বসানো ছিদ্রযুক্ত বোতামের ঢাকনা)
- আর একটি পুরনো মোবাইল, যার ক্যামেরা রেডি করে স্কচ টেপে আটকে ছাদের রেলিংয়ে বাঁধা
তীর্থ ছাদে উঠে এসে দেখে, এই কাণ্ডটা কেউ দেখে ফেললে পুলিশ নয়—আবাসনের প্রেসিডেন্ট একেবারে AGM-এ মামলা গড়াবে।
—“আপনি আবার এইসব কী করছেন?”
—“টেরেসে ট্র্যাপ বসাচ্ছি। এই অঞ্চলে একটা বিশেষ পায়রা ঘোরাফেরা করছে। তার ঠোঁটে আমি একটা কাগজ বাধা দেখতে পেয়েছি। ওটাই হয়তো মেসেজ। আমি চাই ওটা এখানে এসে মুড়ি খাক—আর আমি ছবি তুলব।”
তীর্থর মাথায় হাত।
—“পায়রার ঠোঁটে চিরকুট! আপনি সিনেমা বেশি দেখেন না তো?”
—“না। আমি সিনেমা দেখি না, সিনেমা আমাকে দেখে। তাছাড়া, গোয়েন্দাগিরি মানেই অলৌকিক কিছু নয়, ছোট ছোট জিনিসেই লুকিয়ে থাকে রহস্য।”
এত কথার পর তীর্থ একটাই কথা বলল, “আমি নিচে যাচ্ছি, কেউ দেখে ফেললে আমাকে বাদ দিও।”
এদিকে তৃষা ম্যাডামের জীবন অশান্ত হয়ে উঠেছে।
গতকাল রাতে তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলেন, হঠাৎ তার মোবাইল স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে ওঠে—
“We are watching you. – RC”
তিনি প্রথমে ভাবেন এটি হয়তো র্যান্ডম হোয়াটসঅ্যাপ স্প্যাম, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন… RC মানে Red Cobra!
পরদিন সকালেই তিনি এসে তীর্থকে ধরে বলেন—
—“এইবার সত্যিই বারণ করুন আপনার রুমমেটকে। উনি যদি আবার এমন কিছু করেন, আমি সোজা থানায় যাব।”
তীর্থ চোখ বড় করে বলল, “আপনাকে মেসেজ পাঠিয়েছে?”
—“হ্যাঁ! আমি নাকি সন্দেহভাজন… আমি কি পরমাণু পরীক্ষা করি নাকি?”
তীর্থ এরপর পুলকবাবুকে গিয়ে সাফ জানায়—
—“এইসব বন্ধ করুন। মানুষ ভয় পাচ্ছে। আপনি যেটা করছেন সেটা দুষ্টু নয়—সরাসরি মন খারাপ করানোর মতো।”
পুলকবাবু একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
—“তীর্থ, তুমি বুঝবে না। কিছু লোক ভাবে আমি পাগল, কিছু ভাবে আমি বিরক্তিকর। কিন্তু আমার কাছে এটা দায়িত্ব। তুমি কি জানো না, গোয়েন্দারা সবসময় একা থাকে?”
তীর্থের মনে একটু গিল্টি লাগে।
তারপর পুলকবাবু ধীরে ধীরে বলেন—
—“আমি জানি, তৃষা আমাকে সন্দেহ করে। আমি জানি, রতন কাকু আমার নামে নিচু গলায় কথা বলেন। কিন্তু একজন Red Cobra হার মেনে বসে না। আমার কাছে প্রমাণ আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
সেই রাতে ছাদে আবার দেখা যায় পুলকবাবুকে।
তিনি তাঁর পায়রা-ট্র্যাপের সামনে বসে আছেন, এক হাতে চা, আর এক হাতে ডায়েরি।
হঠাৎ রেলিংয়ের ওপারে সত্যিকারের এক পায়রা এসে বসে! ঠোঁটে যেন কিছুর ছায়া!
পুলকবাবু ধীরে মোবাইল ক্যামেরা চালু করেন…
হাত বাড়াতেই পায়রা উড়ে যায়।
কিন্তু ক্যামেরায় একটা ছবি ধরা পড়ে—ছোট্ট একটা কাগজ, তাতে লেখা—
“AGENT RC – FINAL WARNING. STOP OR BE STOPPED.”
পুলকবাবু চোখ কুঁচকে তাকান। তীর্থ নিচে ঘুমোচ্ছে। আর মেঘমল্লার হাউজিং-এর ওপর, যেন এক নতুন ছায়া নামছে।
পর্ব ৫: রাতের রেড অ্যালার্ট
রাত তখন পৌনে বারোটা।
মেঘমল্লার হাউজিং নিস্তব্ধ—শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের ডেকে ওঠা, আর দূরে ট্রেনের হুইসেল।
তীর্থ কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ তার ফোন কাঁপতে কাঁপতে স্ক্রিনে জ্বলে উঠল:
“ALERT CODE: RED. MISSION ACTIVE. COME TO ROOFTOP.” – RC
তীর্থ ঘুমচোখে ফোনটা দেখে মাথা চেপে ধরল—“এই লোকটা নিদ্রাও কেড়ে নিচ্ছে!”
কিন্তু কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। সে চুপচাপ ছাদে উঠে গেল।
ছাদে গিয়ে দেখে পুলকবাবু পুরো প্রস্তুত—গায়ে কালো সোয়েটার, হাতে হেডল্যাম্প, কোমরে ঝোলানো ছোট টর্চ, সামনে রাখা খাতা-কলম, আর একটি কুকুরের খেলনা।
—“তীর্থ, অপারেশন রেড অ্যালার্ট শুরু। পায়রার পাঠানো চিঠি পেলাম। কেউ আমাকে সতর্ক করেছে।”
—“আমি তো বলেছিলাম আপনাকে থামতে।”
—“তুমি বলেছো, কিন্তু চিঠিটা কেউ পাঠিয়েছে—যে জানে আমি RC। সেটা তোমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।”
তীর্থ এবার একটু চমকে যায়।
পুলকবাবু চোখ ছোট করে বলেন, “তিনটি ফ্ল্যাট এখন সন্দেহের তালিকায়। D-102, F-305, আর… C-218। আজ রাতে আমি গোপনে তিনটিই পর্যবেক্ষণ করব। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে?”
তীর্থ হাসতে হাসতে বলে, “আমি তো ঘুমাতে এসেছিলাম, গুপ্তচরবৃত্তি করতে নয়।”
পুলক: “ঘুম সবসময় সত্যিকে ঢেকে রাখে, তীর্থ। কিন্তু আজ… সত্যি জেগে উঠবে।”
প্রথম লক্ষ্য: D-102
ওই ফ্ল্যাটে থাকেন মিসেস মজুমদার, একজন বৃদ্ধা যিনি সন্ধ্যে ৭টার পর কখনো বের হন না।
তবে পুলকবাবু বলেন, “ওই সময়টাই আসল। আমি দেখেছি উনি জানালায় গা ঢাকা দিয়ে কারও সঙ্গে ইশারায় কথা বলেন।”
তীর্থ ফিসফিসিয়ে বলে, “ওনার তো বাতের ব্যথা আছে!”
পুলক: “আরও তো প্রমাণ হল! বাতের ব্যথা মানেই চোট খাওয়া লোক। গুপ্তচরদের চিহ্ন!”
তারা ছাদ থেকে বাইনোকুলারে দেখে, সত্যিই মিসেস মজুমদার জানালার ধারে বসে কেউ একজনের দিকে তাকিয়ে হাত তুলছেন। কিন্তু সেটা যে পাশের ফ্ল্যাটের কলাপসিবল গেটটা ঠিকঠাক বন্ধ কি না দেখতে তিনি হাত নাড়ছেন—তা বোঝা সহজ।
পুলকবাবু বলেন, “তুমি সন্দেহ করো না। বিশ্বাস করো না। শুধু পর্যবেক্ষণ করো।”
পরবর্তী লক্ষ্য: F-305
এই ফ্ল্যাটে থাকেন নবদম্পতি। রাত প্রায় একটা বাজে, কিন্তু ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে।
তীর্থ বলে, “নতুন বিয়ে হয়েছে, এটা তো স্বাভাবিক।”
পুলকবাবু বলেন, “না। আজকে বুধবার। আর আমি নিশ্চিত—তারা প্রতিরাতে নির্দিষ্ট ছন্দে আলো নিভিয়ে আবার জ্বালায়। এটা মর্স কোড হতে পারে।”
তীর্থ এবার বুঝে যায়—এখন আর যুক্তি খাটে না।
আলো একবার নিভে, দুইবার জ্বলে।
পুলকবাবু বলেন, “দেখলে? এক নিভে, দুই জ্বলে মানে M। তিন জ্বলে মানে E… ME… পরেরটা কী আসে দেখি…”
ঠিক তখনই আলো নিভে যায় চিরতরে।
পুলক: “অহো! নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছে আমরা দেখছি! হ্যাঁ, ME…G…H…MALLAR… বোঝোনি? তারা আমাদের হাউজিং-এর নাম লিখছিল। এটা ভেতরের সংকেত।”
তীর্থ: “মানে কেউ আবাসন থেকেই…?”
পুলক: “ঠিক তাই। ‘অপারেশন ইনসাইডার’ শুরু করতে হবে।”
শেষ লক্ষ্য: C-218
এই ফ্ল্যাটে থাকে রতন কাকু। পুলকবাবুর চিরশত্রু।
তারা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে C ব্লকের দিকে এগোয়। হঠাৎ পুলকবাবু থামলেন।
—“তীর্থ, গন্ধ পাচ্ছো?”
—“কিসের?”
—“বোমার নয়, সন্দেহের গন্ধ!”
ঠিক তখনই, C-218-এর দরজা খোলে।
রতন কাকু বেরিয়ে এসে বলেন, “এই রাত্তিরে ফ্ল্যাটের বাইরে কী করছেন?”
পুলকবাবু বলে, “আপনার জন্যই এসেছি। আমার প্রশ্ন: আপনার ফ্রিজে কেন তিন কেজি সন্দেশ রাখা আছে, অথচ আপনি ডায়বেটিক?”
রতন কাকু থতমত।
তীর্থ বলে, “পুলকবাবু, এটাই কি আপনার রেড অ্যালার্ট?”
পুলকবাবু ফিসফিসিয়ে বলে, “না। রেড অ্যালার্ট তো তখনই শুরু হবে, যখন আমি আবিষ্কার করব… কে আমার ছদ্মনাম ফাঁস করল।”
আর ঠিক তখনই, পুলকবাবুর ফোনে একটা নতুন মেসেজ আসে—
“You are close, Red Cobra. But not close enough.”
পর্ব ৬: চায়ের কাপ ও চূড়ান্ত চক্রান্ত
রাতের মেসেজটা পুলক চ্যাটার্জিকে ঘুমোতে দিল না।
“You are close, Red Cobra. But not close enough.”—এই ছয়টি শব্দ যেন ওর মাথায় ঢুকে ব্যারিকেড তৈরি করে ফেলল।
সে জানে, এই মেসেজ কোনো সাধারণ ফাজলামি নয়। এটা তার মতো কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
অর্থাৎ, আবাসনের মধ্যেই কেউ আছে যে জানে ও আসলে Red Cobra। এবং তার উপর কড়া নজর রাখছে।
সকালে তীর্থ উঠে দেখে, পুলকবাবু রান্নাঘরে বসে একটা টিনের বক্সের ওপর পেন কাগজ নিয়ে লিখছেন।
—“কি লিখছেন?”
—“চা-ক্রিয়া। চা এবং চক্রান্তের যোগসূত্র।”
তীর্থ মুখ বাঁকিয়ে বলে, “এটা আবার নতুন কী?”
পুলক গম্ভীর হয়ে বলে, “গত এক সপ্তাহে আবাসনের অন্তত তিনটি ফ্ল্যাটে ‘বিশেষ চা পার্টি’ হয়েছে—যেখানে অতিথিদের একটা করে চায়ের কাপ দেওয়া হয়, কিন্তু সবার হাতে একই কাপ ফিরে আসে না। এই রোটেশন প্যাটার্নটা সন্দেহজনক।”
তীর্থ হেসে ফেলে, “এটা কি চায়ের কাপ না কালো টাকায় লেনদেন?”
পুলক চুপ করে যায়।
তারপর বলে, “আজ আমি নিজে এক কাপ চায়ে বিষ মেশাব।”
তীর্থ আঁতকে উঠে, “কি??”
—“না না, মরণ বিষ নয়। একটা বিশেষ গন্ধযুক্ত পাতি লঙ্কার নির্যাস। যার গন্ধ আমি নিজেই চিনতে পারি। ওই কাপটা কার হাতে যায়, বুঝব কে আমার বিরুদ্ধে আছে।”
তীর্থ মুখে হাত চাপা দেয়—এই লোক বোধহয় এবার অ্যারেস্ট হতেই চলেছে।
এদিকে তৃষা ম্যাডামের মাথায় অন্য টেনশন।
গত রাতে মোবাইলে যে বার্তা এসেছিল, সেটা আজ সকালে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে উধাও!
আর আজ সকালে দরজার বাইরে পাওয়া গেছে একটা ছোট প্যাকেট—
ভেতরে একটি লাল কাপ, এবং একটি নোট—
“Let’s have a clean cup. – RC”
তৃষা এবার আর সহ্য করতে পারলেন না। সোজা গিয়ে হাজির হলেন তীর্থর দরজায়।
—“Enough is enough! আমি জানি এই RC আপনার রুমমেট। উনি কেন আমাকে হ্যারাস করছেন?”
তীর্থ একরকম দুঃখী মুখে বলল, “তৃষাদি, আপনি প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন। উনি আসলে নিজের একা থাকার দুঃখটাকে মিশন বানিয়ে ফেলেছেন। ওঁর জীবনে গল্প ছাড়া কিছু নেই।”
তৃষা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন,
—“আমিও একা। কিন্তু আমি তো জানালায় ক্যামেরা বসাই না।”
তীর্থ বলল, “ও নিজে জানে না, কীসে খুঁজছে। শুধু চায় কেউ ওর কথা বিশ্বাস করুক।”
সন্ধ্যাবেলায় আবাসনের কমন রুমে একটা ছোট্ট চা পার্টির আয়োজন হয়।
রতন কাকু, তৃষা, তীর্থ, পুলকবাবু, এমনকি সঞ্জু দাও এসে হাজির।
পুলকবাবু নিঃশব্দে নিজের ব্যাগ থেকে চায়ের কাপ বার করে দেন—সবাইকে দিয়ে যান এক এক করে।
কেউ কিছু টের পায় না।
কিন্তু ঠিক তখনই, হালকা গন্ধে পুলকবাবুর নাক টনটন করে উঠল।
হ্যাঁ! ওই গন্ধ! পাতি লঙ্কার নির্যাসের গন্ধ!
তিনি ধীরে পেছন থেকে ঘুরে তাকান…
তৃষা কাপ হাতে, মুখ নিচু করে বলছেন,
—“আজকের চা সত্যিই অন্যরকম। একটু ঝাঁঝালো, কিন্তু খারাপ লাগছে না।”
পুলকবাবুর চোখ সরু হয়ে আসে।
তীর্থ পাশে দাঁড়িয়ে, পুলকের দিকে তাকিয়ে ছোট করে ফিসফিসায়—
—“মানে ও-ই…?”
পুলক ধীরে বলে,
—“হয়তো ও-ই আমার কাহিনির শেষ কড়ি। হয়তো ও-ই আমার প্রোটাগনিস্ট—নাকি অ্যান্টাগনিস্ট?”
পার্টি শেষে তৃষা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে পুলকবাবুর দিকে।
—“আপনি কি এখনো মনে করেন আমি ষড়যন্ত্র করছি?”
পুলক চুপ করে থাকে।
তৃষা বলেন, “আপনার ষড়যন্ত্রে আমি থাকলে গল্প মজার হতো… কিন্তু আমি থাকলে আপনার গল্প শেষ হয়ে যেত।”
এই বলে তৃষা চলে যান।
পুলক চুপচাপ নিজের খাতায় লিখে ফেলেন—
পর্ব ৭: সিক্রেট সোসাইটি ও সিঁড়ির ছায়া
পুলক চ্যাটার্জির ডায়েরির পাতায় একটা নতুন নাম উঠে এল—
“মেঘমল্লার ইনভিজিবল সোসাইটি (MIS).”
ডায়েরির নোট বলছে:
“আবাসনের ভেতরে গোপনে কাজ করছে এক গোপন গোষ্ঠী। লক্ষ্য—সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা, রহস্যজনক ‘আনন্দ প্রকল্প’-এর আড়ালে।”
তীর্থ এই নোট দেখে বলল,
—“এবার আপনি একেবারে গোপন সংঘের দিকে চলে গেলেন?”
পুলক গম্ভীর মুখে বলল,
—“এটা কোনো সিনেমা না, এটা বাস্তব। গত তিন মাসে তিনজন আবাসিক নিজেদের ফ্ল্যাটে ‘আনন্দ প্রকল্প’-এর অংশ হিসেবে এক রহস্যময় লিফলেট পেয়েছেন। কেউ জানে না কে দিয়ে গেছে, কেউ মনে রাখে না কবে এসেছে।”
—“এটা তো অনলাইন বিজ্ঞাপনও হতে পারে।”
—“তুমি এখনো বোঝোনি, তীর্থ। এই লিফলেট একবার কারও ঘরে গেলেই তার রুটিন পালটে যায়। তারা সকালের হাঁটাহাঁটি বাদ দেয়, বিকেলে আড্ডা এড়িয়ে চলে। রাতে আলো নিভিয়ে রাখে। কেউ কেউ তো বলে তাদের স্বপ্নেও লাল আলোর ঘর দেখা যায়।”
তীর্থ ভুরু কুঁচকে বলল,
—“আপনি কীভাবে জানলেন?”
—“আমি তিনজনের ডাস্টবিন ঘেঁটে তিন কপি লিফলেটের টুকরো পেয়েছি। একেকটায় লেখা ছিল—
‘আনন্দ প্রকল্পে স্বাগতম। আপনি বেছে নিয়েছেন নিষ্ক্রিয়তায় সক্রিয় হওয়ার পথ।’
—“এটা তো কিছুটা ইনসপিরেশনাল পোস্টার টাইপ শোনাচ্ছে।”
—“তাই তো! এটাই ওদের কৌশল।”
রাত ১১টা।
তীর্থ পড়াশোনা করছিল।
হঠাৎ পুলকবাবু চুপিচুপি এসে বলে,
—“চলো, আজ ‘স্টেয়ারকেস শ্যাডো ট্র্যাকিং’ করতে হবে।”
—“মানে?”
—“সিঁড়িতে একটা বিশেষ ছায়া দেখা গেছে। রাত ১০টার পর সেটি নিয়ম করে তিনতলার করিডোরে এসে দাঁড়ায়। কেউ জানে না কে ওটা, কেউ মুখ দেখতে পায় না। আমি সন্দেহ করছি—এটাই সোসাইটির একজন মেসেঞ্জার।”
তীর্থ বিরক্ত গলায় বলে,
—“দেখুন, রোডলাইটের নিচে দাঁড়ালে নিজের ছায়াও ভয়ঙ্কর লাগে। আপনি প্লিজ অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দেবেন না।”
—“তুমি থাকো আমার পেছনে। আমি যাই প্রথমে।”
তারা সিঁড়ির কোণে পৌঁছায়। রাতের নিস্তব্ধতা যেন মেঘমল্লারে গাঢ় ছায়া ফেলেছে।
দূরে কোনও একটা টিন কাঁপছে, আর গ্যাসের চুলা থেকে আসা কুকুরের শব্দ কানে বাজে।
হঠাৎ—
তারা দেখে একটা ছায়া।
একটি লম্বা আকৃতি, দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে।
পুলকবাবু ধীরে মোবাইল বার করেন, ফ্ল্যাশ না দিয়ে ভিডিও চালু করেন।
তীর্থ কাঁপা গলায় বলে,
—“ওটা কি…?”
—“হ্যাঁ, এটা MIS-এর ‘সিঁড়ির দূত’। চল, দেখি কাছ থেকে…”
কিন্তু ঠিক তখনই ছায়াটা নড়ে ওঠে!
এক লম্বা পাগলা দৌড়, ছুটে নেমে যায় নিচে, আর সঙ্গে একটা কাগজ ফেলে যায়।
পুলকবাবু তৎক্ষণাৎ কাগজটা হাতে নেন।
চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়েন—
“তোমার খোঁজ সত্যি, Red Cobra। কিন্তু মনে রেখো—আলো যখন বেশি জ্বলে, ছায়াও তখন ঘন হয়।
– MIS”
পুলক থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।
তীর্থ ফিসফিস করে,
—“মানে ওরা আপনাকে চিনে গেছে।”
পুলক আস্তে করে বলে,
—“আমিও ওদের চিনেছি।”
—“কে ওরা?”
—“ওরা এই আবাসনের ভেতরের মানুষ, যাদের নাম কারোর মুখে নেই।
তাদের গল্প শুরু হয়নি, কিন্তু আমি সে গল্প লিখব।”
পর্ব ৮: লিফটের লুকোচুরি ও লাল আলো
মেঘমল্লার হাউজিং-এর লিফট সাধারণত খুব একটা ভরসাযোগ্য নয়। মাঝে মাঝেই আটকে যায়, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, আবার নিজের ইচ্ছেমতো চলেও যায়।
কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে নতুন এক রহস্য শুরু হয়েছে—রাত ১টা ২০-র পর লিফট নিচে না গিয়ে বারবার ৩ তলায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ ডাক না দিলেও, কেউ চড়েও না—তবু দরজা খোলে, আবার বন্ধ হয়ে যায়।
তীর্থ প্রথমে ভেবেছিল এটা যান্ত্রিক সমস্যা, কিন্তু পুলকবাবুর হাতে যেই বিষয়টি পৌঁছল, সেই মুহূর্ত থেকে সেটা হয়ে উঠল—
“মিশন লাল আলো”।
রাত তখন ১টা ১৫।
তীর্থ ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, হঠাৎই দরজায় টোকা—
টক টক টক।
দরজা খুলে দেখে—পুলক চ্যাটার্জি কালো কাপড় পরে দাঁড়িয়ে, গলায় হেডফোন, কোমরে পেন-লাইট, হাতে ছোট ডায়েরি।
—“সময় এসে গেছে। আজ রাতে আমরা যাব ৩ তলায়, এবং ধরব লিফটের সত্যিকারের ব্যবহারকারীকে।”
তীর্থ আধো ঘুমে বলে, “আপনি কি নিশ্চিত এটা ভূতের গল্প নয়?”
—“ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো সেই মানুষ, যে চুপচাপ নিজের ছায়ার পেছনে লুকিয়ে থাকে।”
১টা ১৯ বাজে।
দুজনেই লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ৩ তলার লিফটের সামনে।
চারপাশে নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে দোতলার বুড়ো ঘড়ি ‘টিক-টিক’ করে উঠে।
১টা ২০।
লিফট একা একা ওঠে।
দরজা খোলে।
ভেতরে কেউ নেই।
তীর্থ ফিসফিস করে বলে, “এটা যান্ত্রিক সমস্যা…”
পুলক থামিয়ে দেয়—“না, দেখো!”
হঠাৎ লিফটের ভেতরের লাইট ফ্লিক করে জ্বলে ওঠে, এবং সেই আলো লালচে হয়ে যায়!
পুলক মোবাইল ক্যামেরা অন করে এগিয়ে যায়।
তখনই—
একটি ছায়া ঝট করে দৌড়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়, তারপর পাশের সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়।
পুলক লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
তীর্থ ভয় পেলেও তাকে অনুসরণ করে।
ভেতরে পড়ে আছে একটি ছোট কার্ড।
তাতে লেখা—
“তুমি যতই খুঁজো, ততই হারাবে। MIS তোমাকে দেখতে পায়। এবার খেলার পালা শেষ।”
পরদিন সকালে পুলকবাবুর মন খুব শান্ত।
তীর্থ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“আপনার মুখে আজ এত প্রশান্তি কেন?”
পুলক হেসে বলল,
—“কারণ কেউ আমায় এতদিন খেলায় রেখেছিল, আজ আমিই সেই খেলার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছি।”
—“মানে?”
—“ওরা চায় আমি থেমে যাই। কিন্তু আমি জানি, লাল আলো আসলে ভয় দেখানোর উপায়। আমি ভয় পাচ্ছি না, মানেই ওদের প্রথম হার।”
তীর্থ জানে না পুলক যা বলছে তা বিশ্বাস করবে কি না।
কিন্তু ওই লিফটের দরজা, ওই লাল আলো—সেই অদ্ভুত মুহূর্ত যেন মাথা থেকে নামছে না।
সন্ধ্যায় আবাসনের মিটিং।
রতন কাকু বললেন, “আমরা সবাই চাই Red Cobra একটু বিশ্রাম নিক।”
তৃষা বললেন, “না, আমি চাই উনি চালিয়ে যান। মাঝে মাঝে পাগলদের মতো লোক দরকার হয়, যারা অন্যরকম দেখে।”
সবার মাঝে পুলক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন—
—“এই আবাসন আর আমার মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আর MIS যদি আমার পিছনে থাকে, আমি জানি… আমি ঠিক রাস্তায় আছি।”
শেষে, ডায়েরির পাতায় পুলক লিখলেন—
“পরবর্তী লক্ষ্য: MIS-এর সদস্য সংখ্যা। কারা তারা? কী তাদের উদ্দেশ্য?
এবং আমি তৃষাকে বিশ্বাস করতে পারি তো?”
পাসের ঘরে তীর্থ ঘুমোচ্ছে।
আর মেঘমল্লারের ছাদে, কোনো এক অদৃশ্য ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে এক নতুন লাল কাগজ…
পর্ব ৯: রেড ডায়েরি ও রহস্যের রসগোল্লা
পুলক চ্যাটার্জি আজ সকাল থেকেই অদ্ভুত রকম চুপচাপ।
নাহ, এই চুপচাপ মানে সেই দার্শনিক স্তব্ধতা নয়—এই চুপচাপ মানে প্ল্যানের আগে ঝড় ওঠার প্রস্তুতি।
তীর্থ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
—“আপনার কি জ্বর?”
—“না।”
—“তাহলে গলা গেল?”
—“না।”
—“তাহলে চুপচাপ কেন?”
পুলক নিচু গলায় বলে,
—“তোমার পছন্দের রসগোল্লার ভেতরেও যদি বিস্ফোরক থাকে, তবে কী করবে?”
তীর্থ কেঁপে উঠে বলে,
—“বিস্ফোরক মানে?”
পুলক চোখ তুলে বলে,
—“আজ সকালে C-218-এর সামনে আমি একটা বাক্স পেয়েছি। তাতে লেখা—
‘For Mr. RC. With sugar & secrets.’
ভেতরে রসগোল্লা, আর নিচে একটা লাল ডায়েরি।”
ডায়েরি খুলতেই পুলকবাবুর চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে।
প্রথম পাতাতেই লেখা—
“মেঘমল্লার ইনভিজিবল সোসাইটি (MIS)
গোপন নথিপত্র: শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য”
তীর্থ তোতলাতে তোতলাতে বলে,
—“এটা কি সত্যি?”
পুলক বলে,
—“ডায়েরিতে আবাসনের চারজন সদস্যের নাম আছে।
১. D-102 – মিসেস মজুমদার
২. F-305 – অনিকেত ও শ্রীপর্ণা
৩. C-218 – রতন কাকু
৪. B-112 – … তৃষা সেন!”
তীর্থ চুপ মেরে যায়।
পুলক আবারও বলেন,
—“তৃষা! ওর নাম আছে! আমি তো সন্দেহ করতামই… এখন প্রমাণও মিলল।”
তীর্থ দ্বিধা নিয়ে বলে,
—“কিন্তু এই ডায়েরিটা যদি ফাঁদ হয়?”
পুলক বলেন,
—“তাহলেই তো প্রমাণ হবে, MIS জানে আমি খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এবার শুধু টাইমিং ঠিক করতে হবে। আজ রাতে আমি চারটে ফ্ল্যাটে গোপন পত্র দিয়ে আসব।”
—“কি লেখা থাকবে?”
—“একটাই লাইন—
‘Red Cobra is watching.’”
সেই রাতে পুলকবাবু একেবারে গুপ্তচর স্টাইলে বেরোলেন।
কালো টুপির নিচে টর্চ, স্যান্ডো ব্যাগে চিরকুট।
তীর্থ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিল—একটা ছায়া ধীরে ধীরে A ব্লক থেকে C ব্লক পর্যন্ত হেঁটে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর, পুলক ফিরে এসে বললেন—
—“সব পত্র পৌঁছে গেছে। এবার দেখব কারা কিভাবে রিঅ্যাক্ট করে।”
পরদিন সকালে ঘটে এক অদ্ভুত কাণ্ড।
মেঘমল্লার হাউজিং-এর লিফটের বাইরে দেখা যায় এক পোস্টার—
“AGM CANCELLED. MIS DECLARED NON-EXISTENT.
STOP THIS NONSENSE OR WE CALL THE POLICE.”
পুলক চুপ করে থাকেন।
তীর্থ বলে,
—“মানে… মিটিংই বাতিল? কে লাগাল এই পোস্টার?”
পুলক ঠান্ডা গলায় বলেন,
—“MIS-এর কেউই। কিন্তু এটা ওদের ভয়ের চিহ্ন।
তারা এখন মুখ লুকোচ্ছে। কারণ Red Cobra জানে।”
তীর্থ আবার দ্বিধায় পড়ে।
সত্যিই কি সবটা মিথ্যে নয়?
সন্ধ্যায় তৃষা এক কাপ চা হাতে এসে দাঁড়ালেন পুলকবাবুর সামনে।
—“এই ডায়েরির কাহিনি আমিও শুনেছি। অনেকেই বলছে আপনি সবার নামে গুপ্তচরগিরির গল্প বানাচ্ছেন।”
পুলক শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেন,
—“আপনি কি MIS-এর সদস্য?”
তৃষা হেসে বলেন,
—“আমি হয়তো আছি, হয়তো নেই।
কিন্তু আপনি কি Red Cobra না একা বুড়ো, সেটা আগে ঠিক করুন।”
পুলক কিছু বলেন না।
তৃষা চলে যাওয়ার সময় একটুখানি ঘুরে বলেন,
—“আর হ্যাঁ… আমি রসগোল্লা খাই না। যেটা আপনি খেলেন, সেটা আমি পাঠাইনি।”
পুলকের হাত থেকে কাপটা পড়ে যায়।
ফ্ল্যাট নাম্বার ৪২০ – পর্ব ১০: শেষ ফাঁদ, শেষ ফালতু, আর একটা নতুন শুরুর নাম
রাত ১১টা।
পুলক চ্যাটার্জি নিজের টেবিলে বসে আছেন। সামনে সেই লাল ডায়েরি, পাশেই পড়ে থাকা রসগোল্লার খালি কৌটো, আর মুখে সেই একই চুপচাপ হাসি।
তীর্থ ধীরে এসে বলে,
—“আজ আপনি একটু বেশি চুপচাপ।”
পুলক মুচকি হেসে বলে,
—“কখনো কখনো শেষ ফাঁদটা পাতা হয় শব্দহীন। জানো, আজ আমি বুঝতে পেরেছি—MIS আসলে কোনো সংঘ নয়। ওটা একটা ধারণা। ওটা ভয়। আর আমি সেই ভয়টাকেই ধাওয়া করছিলাম।”
তীর্থ অবাক হয়ে বলে,
—“মানে সবটাই…?”
—“না না, সবটা না। MIS নামে কেউ বা কিছু ছিলই। কিন্তু কে ছিল, সেটা জানা হয়নি। তার মানে এই নয় যে আমি ব্যর্থ।”
—“তৃষা ম্যাডাম বলেছিলেন তিনি রসগোল্লা পাঠাননি।”
—“হ্যাঁ। তার মানে, কেউ অন্য কেউ আমাকে খেলা দেখাচ্ছিল। হয়তো রতন, হয়তো সঞ্জু দা, কিংবা হয়তো… তুমি নিজেই!”
তীর্থ হেসে ফেলে।
—“আপনার গল্পে আমিও সন্দেহভাজন?”
পুলক গভীর গলায় বলে,
—“আমার গল্পে সবাই সন্দেহভাজন। এটাই গল্পের সৌন্দর্য।”
পরদিন মেঘমল্লার হাউজিং-এর দেওয়ালে এক ব্যানার ঝোলানো হলো—
“আবাসনবাসীর আবেদনে সাড়া দিয়ে – Red Cobra Night Walks বন্ধ ঘোষণা।”
লোকে হাসছে, কেউ কেউ মুচকি হেসে বলছে, “বুঝেছে বুড়ো,” কেউ আবার বলছে, “ভালোই তো ছিল! কিছুটা মজাই পেতাম।”
তীর্থ পুলকবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,
—“আপনার দুঃখ লাগছে?”
পুলক উত্তর দেয়,
—“না রে। একজন গুপ্তচর কখনো খেলা শেষ করে না, সে শুধু মঞ্চ বদলায়। এখন আমার মিশন হবে—সন্ধ্যে ৬টায় আবাসনের টেরেসে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া আর খবরের কাগজ পড়া। চুপচাপ।”
—“এবারে কোনো কৌশল থাকবে না তো?”
—“ওহ, থাকবে! খবরের কাগজের মাঝের পাতায় আমি নিজেই গোপন চিঠি রাখব। কিন্তু সে কথা আর কাউকে বলব না।”
তীর্থ হেসে বলে,
—“আপনি জানেন তো, আপনি পাগল?”
পুলক উত্তর দেয়,
—“না। আমি Red Cobra। পাগল হলে গল্প শেষ হয়ে যেত, আর আমি তো গল্পই শুরু করেছি।”
একদিন সন্ধ্যায় তৃষা ম্যাডাম এক কাপ চা নিয়ে এসে পুলকের পাশে বসলেন।
—“আজ আর কাউকে সন্দেহ করছেন না?”
—“না। আজ সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। এমনকি MIS-কে-ও।”
তৃষা হাসলেন।
—“আপনি জানেন, আপনি ফালতু?”
—“জানি। কিন্তু ফালতুগুলো না থাকলে জীবনের গল্পগুলো কেবল খড়খড়ে হয়।”
তাদের দু’জনের সামনে পড়ে আছে রোদ পড়ে আসা একটা চুপচাপ ব্যালকনি।
আর দূরে এক পায়রা উড়ে যাচ্ছে।
শেষ লাইন (Red Cobra-র হাতে লেখা):
“আমার মিশন শেষ নয়, শুধু বিরতি।
কারণ প্রত্যেকটা আবাসনে একটা ৪২০ থাকে, আর সেখানেই শুরু হয় গল্পের আসল বোকামো।
আর বোকামোই তো সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তার ছদ্মবেশ।”
শেষ




