Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প

ফেরিওয়ালার স্বপ্ন

Spread the love

মৃণাল সেনগুপ্ত


শীতের কুয়াশাঘেরা সকাল। কাটিয়াতলা গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে এক চেনা হুইলগাড়ি—লোহার চাকা ঘষটে ঘষটে আওয়াজ তুলছে, আর গাড়ির উপরে বাঁশের ঝুড়ি ভর্তি পুরোনো বইয়ের স্তূপ। হুইলগাড়িটা ঠেলে নিয়ে চলেছে মধু, যাঁর পুরো নাম মধুসূদন পাল—গ্রামেরই সন্তান, বয়স প্রায় পঁইচাল্লিশ, গায়ে সাদা ধুতি, গায়ে উলের পাতলা চাদর, পায়ে ছেঁড়া চটি, আর কাঁধে ঝোলানো একটা ছাপানো কাপড়ের ব্যাগ, যাতে থাকে তার দিনভর খরিদ্দারদের টাকা-পয়সা, খাতা আর তার সবচেয়ে প্রিয় কলমটা। গায়ে যেন একটা শান্ত সুবাস মেখে থাকে মধুর—পুরোনো কাগজের গন্ধ, সময়ের গন্ধ। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা তাকে চেনে, পুকুরের মাছেরা যেন তার গলার আওয়াজ শুনে মুখ তোলে। এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সে বই ফেরি করে বেড়াচ্ছে – বহন করে নিয়ে যাচ্ছে শুধু কাগজের গাঁথুনি নয়, স্বপ্নের ছোট ছোট বীজ। ফেরিওয়ালাদের মধ্যে মধু একটু আলাদা। অন্যেরা হাঁক দেন “লাউ, ঝিঙে, বেগুন!” আর মধু হাঁকেন — “চোখ খুলো, গল্প পড়ো, ভূতের বই, রূপকথা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, উপন্যাস!” তার গলার আওয়াজে একটা ছন্দ থাকে, একটা মায়া থাকে। যারা বই পড়ে না, তারাও একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকায় — কী যেন এক অতীতের আওয়াজ যেন ভেসে আসে তার কণ্ঠ থেকে।

মধুর এই জীবন শুরু হয়েছিল প্রায় আঠারো বছর বয়সে, যখন তার বাবা মারা যান। বাবাও ফেরিওয়ালা ছিলেন, তবে ছেঁড়া খাতা, পুরোনো ম্যাগাজিন আর দোয়েল-ছাপানো নোটবই নিয়ে ঘুরতেন। মধু স্কুলে পড়াশোনায় ভালো ছিল, কিন্তু অভাব আর সংসারের চাপে মাধ্যমিকের পরেই তাকে পড়া ছাড়তে হয়। সেই তখনই বাবার হুইলগাড়িটা ধরে নেয় সে। শুরুতে কষ্ট হয়েছিল—কে বই কিনবে! সবাই তো মোবাইলের যুগে, কে আর পুরোনো পাতার ঘ্রাণে ডুবে থাকে? কিন্তু মধু হাল ছাড়েনি। সে বিশ্বাস করত, বইয়ে আলো থাকে, আর আলো একবার চোখে লাগলে সে ছড়িয়ে পড়ে জীবনজুড়ে। একবার সে বীরপুর গ্রামে এক ভ্যানে বই নিয়ে গেছিল। কেউ না কিনলেও, এক দুধওয়ালার মেয়ে “ছোটদের ভূতের বই” দেখে চুপিচুপি তাকে বলে — “আপনি পরের বার রাজার গল্প আনবেন?” মধুর মনে হয়েছিল, সে যেন সেদিন এক নক্ষত্র হাতে পেয়েছে। সেই দিন থেকে, সে শুধু বই ফেরি করে না—সে ফেরি করে স্বপ্ন, কৌতূহল, আর প্রশ্ন করার সাহস। বাজারে গেলে কেউ কেউ মজা করে বলে—“বই বেচে ক’জন টিকে আছে রে মধু?” সে হেসে উত্তর দেয়—“আমি বই বিক্রি করি না দাদা, আলো বিক্রি করি!” তখন সবাই মুচকি হেসে বলে—“আলো ফেরিওয়ালা মধু!” সেই নামটাও কোথা থেকে যেন জুড়ে গেছে তার গায়ে।

সেই দিনের সকালটিও ছিল অন্য সব দিনের মতোই, কিন্তু মধুর চোখে আজ একটু অন্যরকম তৃষ্ণা। সে আজ নিয়ে এসেছে কিছু বিশেষ বই—রূপকথার গল্প, ছোটদের বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, পুরোনো বাংলা উপন্যাস। মুন্না নামে এক ছেলে, যে প্রতিদিন মধুর গাড়ির পেছনে ছায়ার মতো ছুটে বেড়ায়, আজও এসেছে। তার পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়ে জুতো নেই, কিন্তু চোখে অবাক দ্যুতি। মধু তাকে দেখে হেসে বলে, “আজকে একটা নতুন বই এনেছি রে—আলোয় ভেসে যাওয়া গ্রামের গল্প, যেখানে ছেলেরা আকাশে উড়ে বেড়ায়। পড়বি?” মুন্না লাজুক মুখে মাথা নাড়ে, কিন্তু হাতে নেয় বইটা, যেন এক খনির হীরের টুকরো। মধু তখন জানে—সে আজও হেরে যায়নি, বই আজও মানুষকে নাড়া দিতে পারে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন কৃষক, এক বৃদ্ধা, আর এক চা বিক্রেতা তাকিয়ে থাকেন — একদম চুপচাপ — যেন কেউ সঙ্গীত শুনছে, কিংবা প্রাচীন কোনো আখ্যান শুনছে। মধু তখনো জানে না, তার এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই একদিন তাকে পৌঁছে দেবে তার সেই স্বপ্নের কাছাকাছি — একটা নিজের গড়া পাঠাগার, যেখানে কোনো শিশু শুধু দরিদ্র বলে বইয়ের আলো থেকে বঞ্চিত হবে না।

হাটবারের দুপুর গড়িয়ে বিকেলে রোদ যখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসে, তখন মধুর হুইলগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে কাটিয়াতলা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সামনের মাঠে। স্কুল তখন বন্ধ, কিন্তু মাঠে কিছু ছেলেমেয়ে খেলছে—টায়ার গড়িয়ে দিচ্ছে, গাছে চড়ছে, আর মাটিতে দাগ কেটে পিঠে চড় খেলার রণকৌশল সাজাচ্ছে। মধু সেই মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়—“আলো চাই? গল্প চাই? ভূতের বই, রাজার বই, পাখির গল্প, পুতুলের উপন্যাস!” একটু বাদেই তার চারপাশে জড়ো হয় পাঁচ-সাতটা শিশু, যারা জানে যে এই ফেরিওয়ালার কাছ থেকে শুধু বইই পাওয়া যায় না—মেলে একরাশ কল্পনা আর গল্প শোনার আনন্দ। তাদের মধ্যে আবার থাকে মুন্না—চুপচাপ, চোখে গভীর এক জিজ্ঞাসা, কিন্তু মুখে চিরকালীন স্তব্ধতা। সে বই দেখে, নাড়াচাড়া করে, কিন্তু কিনে না। মধু এই অভ্যেস জানে, তাই প্রতিদিন তার জন্যে একটা না-বিক্রি হওয়া বই রেখে দেয়। সে বিশ্বাস করে, কোনো না কোনো বই মুন্নাকে ছুঁয়ে যাবে, বদলে দেবে তার ভেতরের কিছু।

সেদিন মুন্না হাতে তুলে নিয়েছিল একটা পুরোনো গল্পসংকলন—‘ছোটদের বিজ্ঞান বিস্ময়’। বইটার পাতাগুলো অনেকটাই হলুদ হয়ে গেছে, বাঁধাই আলগা, কিন্তু ছবিগুলো এখনো টানাটানিতে চমকে দেয়। তাতে ছিল — জলবাহিত বিদ্যুৎ, গ্রাম্য সৌরশক্তি, মাটির ব্যাটারির কথা। মুন্না বইটা খুলেই চুপ করে যায়। তার পাশে দাঁড়ানো আরও দুই শিশু বলে ওঠে, “এই বইটা পড়ে কী হবে? এগুলো তো আমাদের কাজে আসে না!” কিন্তু মধু নরম কণ্ঠে বলে, “তোমাদের বাড়িতে টর্চ আছে না? জানো কি, একেকটা ব্যাটারির ভেতরে এমন কিছু রাসায়নিক থাকে, যা একসাথে মিলেই আলো দেয়?” বাচ্চাগুলোর চোখ বিস্ময়ে গোল হয়। মধু আরও বলে, “জানো, এই বইটা পড়লে তুমি নিজের টর্চ নিজেই বানাতে পারবে একদিন। মুন্না পারবে না তুমি?” মুন্না কিছু বলে না, শুধু মাথা নাড়ায়। তারপর হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে—“দাদু, আপনি নিজে এত কিছু জানেন, আপনি কী করে শিখেছেন? আপনি তো স্কুলে পড়েননি?” প্রশ্নটা যেমন সরল, তেমনই তীক্ষ্ণ। মধু থেমে যায়, যেন বুকের ভেতর কোথাও খোঁচা লাগে। তার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে যায়, সে বলে—“জানে রে মুন্না, আমি অনেকগুলো স্কুলে গেছি—এই বইগুলোই আমার স্কুল, আমার শিক্ষক। কাগজের পাতায় মুড়িয়ে আমি পৃথিবী দেখেছি, সমুদ্র পেরিয়েছি, আকাশের তারা গুনেছি।” বাচ্চারা তখন গোল হয়ে বসে পড়ে তার সামনে, যেন এক অলিখিত ক্লাস শুরু হয় মাঠের এক কোণে।

সন্ধে নামার আগেই মধু হুইলগাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে মুন্নার চোখে। ওই প্রশ্নটা—“আপনি কীভাবে জানলেন?”—তার ভেতরে আলোড়ন তোলে। সে জানে, বই শুধু জ্ঞান দেয় না, জাগায় কৌতূহল, জন্ম দেয় প্রশ্ন করার সাহস। আর সেই সাহসই বদলে দিতে পারে জীবন। সে ভাবে—গ্রামে তো এরকম মুন্না আরও অনেক আছে, যারা বইয়ের খোঁজ পায় না, আলো পায় না, শুধু পায় শ্রম, ধুলো আর নিরুত্তর দারিদ্র্য। যদি একটা ছোট পাঠাগার থাকত, যেখানে এদের বই পড়তে দেওয়া যেত, কেউ গল্প পড়ে শোনাত, তাহলে? সে জানে, এ স্বপ্ন বড়; জমি নেই, ঘর নেই, পয়সাও নেই। কিন্তু তার বাবাও তো একদিন বলেছিল—“স্বপ্ন ছোট চাকরির সঙ্গে নয়, বড় মন আর বড় সাহসের সঙ্গে জন্মায়।” সেই রাতে, কুপিবাতির নিচে বসে মধু একটা পুরোনো রেজিস্টার খোলে—প্রথম পাতায় লেখে, “গ্রাম্য জ্ঞানধারা পাঠাগার: স্বপ্নের খসড়া শুরু।” বইয়ের ফেরিওয়ালা তখন ঠিক করে নেয়—এবার সে শুধু ফেরি করবে না, গড়ে তুলবে এক আলোঘেরা ঠিকানা, মুন্নাদের জন্য।

পরের কয়েক সপ্তাহেও মুন্না প্রতিদিন স্কুল মাঠে আসে। তার চোখে এক অদ্ভুত বদল মধু লক্ষ করে — আগের মতো শুধু বই নাড়াচাড়া করে না, এখন সে প্রতিটা ছবির নিচের লেখা পড়ে বোঝার চেষ্টা করে, মধুকে প্রশ্ন করে — “সৌরশক্তি কি সত্যিই ছাতার মতো লাগানো যায়?” কিংবা “গ্রামে কীভাবে বিদ্যুৎ বানানো যায়?” মধুর মুখে তখন হাসি ফোটে, কিন্তু সে জানে, এসব প্রশ্ন আসা মানেই মন জাগছে, খোলামেলা ভাবনার দরজা খুলছে। মধু এবার শুধু বই বেচে না — সে গল্প বলার পাশাপাশি বাচ্চাদের বই পড়ে শোনায়, বোঝায় সহজভাবে। স্কুলের মাঠের একটা কোণ যেন অলিখিত পাঠশালায় রূপ নেয় — যেখানে টিফিনের ফাঁকে বা খেলার বিরতিতে শিশুরা এসে বসে পড়ে তার চারপাশে। একদিন মুন্না একটা পুরোনো পেন্সিল আর খাতার পাতায় কিছু আঁকতে আঁকতে জিজ্ঞেস করে, “দাদু, আপনি কবে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন?” প্রশ্নটা যেন অতি সাধারণ, অথচ মধুর বুক কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণের নীরবতার পর সে বলে, “মাধ্যমিকের পরেই, মুন্না। তখন সংসার ছিল, কাজ ছিল, কিন্তু বই ছাড়িনি, পড়া ছাড়িনি।” তখন মুন্না বলে, “তাহলে তো আপনি স্কুলে না পড়ে মন্ত্রীদের থেকেও বেশি জানেন!”

মধু হেসে ওঠে, কিন্তু মুন্নার চোখের ওই সত্যভরা বিস্ময় তাকে ছুঁয়ে যায়। সেই দিন সন্ধ্যায়, হুইলগাড়ি ঠেলে নিয়ে ফেরার সময় তার মনে হয়, মুন্নার কথাটা কেবল খুশির ছিল না—সেই প্রশ্নের ভেতরে ছিল অনেকটা বেদনা, অনেকটা আশা। গ্রামের শিশুরা কেন পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকবে? তারা শুধু লাঙল ধরবে, চাষ করবে, ফ্যাক্টরিতে মজুর হবে—এই নিয়তি কি শুধু অর্থের অভাবে? বই যদি তাদের কাছে পৌঁছাত, আলো যদি ঢুকত সেই অন্ধ বাড়িগুলোতে, তাহলে হয়তো এই মুন্নারাও স্বপ্ন দেখত ইঞ্জিনিয়ার হবার, বিজ্ঞানী হবার, লেখক হবার। সেই রাতে মধু নিজের মাটির ঘরে বসে একটা পুরোনো খাতায় লেখে—“গ্রামে একটা পাঠাগার গড়ব। বাঁশ আর টিন দিয়ে হলেও হবে, পাঁচটা শিশু এলে শুরু করব।” সে রেজিস্টারের দ্বিতীয় পাতায় একটানা খরচের তালিকা তৈরি করে—বাঁশ, দড়ি, টিন, দাওয়া, কাঠের তাক, পুরোনো মাদুর। তার মাথায় তখন শুধু একটাই ছবি—এক ছোট ঘর, বইয়ের তাক ভর্তি পুরোনো বই, আর ভিতরে বসে একদল মুন্না, চোখে আলো, হাতে বই, মুখে প্রশ্ন।

পরদিন সকালে মধু বাজারে গিয়ে দোকানিদের জিজ্ঞেস করে — কারো বাড়িতে পুরোনো কাঠ পড়ে আছে কিনা, ভাঙা তাক, মাদুর কিংবা পুরোনো চৌকি। অনেকে অবাক হয় — “তুই তো বই ফেরিওয়ালা, পাঠাগার কেন বানাবি?” কেউ হাসে, কেউ কটাক্ষ করে — “তুই মাদার টেরেসা নাকি?” কিন্তু কিছু দোকানদার তাকে জিজ্ঞেস না করেই তিনটা বাঁশ, একখানা মাদুর আর কয়েকটা কাঠের টুকরো দিয়ে দেয়। মুন্নার মা-ও জানতে পেরে বলে—“দাদা, আমার ঘরের একটা খালি কোণ আছে, আপনি চাইলে ওখানে কিছুদিন বই রাখতে পারেন।” মধু অভিভূত হয়ে যায়। ফেরিওয়ালার একা স্বপ্ন যেন ধীরে ধীরে অন্যদের মধ্যেও দোলা দিতে শুরু করেছে। তবে সে জানে, এর পথ সহজ নয়। পঞ্চায়েতের দৃষ্টি এড়ানো যাবে না, গ্রামের কিছু উচ্চবিত্ত পরিবার ভাববে সে গাঁজাখুরি স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তবু সে শুরু করতে চায়—কারণ মুন্না শুধু বই পড়ছে না, এখন সে নিজেরও স্বপ্ন আঁকছে। সেই সন্ধ্যায় মুন্না প্রথমবার মধুর কাছে বসে বলে—“দাদু, আমি যদি বড় হয়ে আপনাকে সাহায্য করি, তাহলে পাঠাগারটা বড় হবে না?” মধু কিছু বলে না, শুধু মুন্নার মাথায় হাত রাখে। তার চোখ তখন দূরে তাকানো—একটা অদেখা ঘরের দিকে, যেখানে বইয়ের পাতাগুলো শব্দ ছাড়াই বয়ে চলেছে এক অদৃশ্য নদীর মতো।

পৌষের শুরু, সকালে কুয়াশা, আর সন্ধ্যায় ঘন অন্ধকার নেমে আসে গ্রামের গায়ে। মধু এখন প্রতিদিনের ফেরির শেষে বাড়ি ফিরে জেগে থাকে আরও কিছুক্ষণ, হাতে লাল কালি আর পুরোনো খাতা—তার রাত্রিকালীন হিসেবের সঙ্গী। দিনের বই বিক্রির আয় থেকে সে আলাদা করে রাখে তিন থেকে পাঁচ টাকা, যতটা পারে। সেই টাকাগুলো সে পুরোনো টিনের এক বাক্সে জমায়, যার ঢাকনায় সে নিজেই লিখে রেখেছে—“গ্রাম্য জ্ঞানধারা পাঠাগার: স্বপ্নের তহবিল।” টিনটা তার বিছানার নিচে রাখা, যেন কোনও পবিত্র বস্তু, যার অস্তিত্ব কেবল তারই জানা। প্রতিদিন রাতে সে হিসেব করে, আজ কতটা এগোল তার স্বপ্নের কিস্তি। কাঠের খণ্ড, দড়ি, বাঁশ, মাদুর—একটি একটি করে জোগাড় করছে সে। মুন্নার মায়ের ঘরের কোণে এখন কিছু পুরোনো বই রাখা হয়েছে। প্রথমে কয়েকটা, পরে আরও বেশ কিছু—যেগুলো গ্রামবাসী নিজেরাই দিয়েছে মধুর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। কেউ পুরোনো পাঠ্যবই, কেউ ছোটগল্প সংকলন, আবার কেউ দেবসাহিত্য—যা হোক, সবাই কিছু না কিছু দিতে চায়।

একদিন সকালে মধু শুনতে পেল গ্রামের মাঠে অনেকে গুঞ্জন করছে। কেউ কেউ বলছে—“মধু নাকি একটা পাঠাগার বানাচ্ছে, এই যে সব জায়গায় বই দিয়ে বেড়ায়, এবার বুঝি নিজের দোকান খোলার ধান্দা করছে।” কিছু কুৎসিত হাসিও শোনা গেল, “আরে বই বেচে তো কেউ স্বপ্ন দেখে না ভাই! মধু পাগল হয়ে গেছে মনে হয়।” প্রথমে মধুর কানে এইসব শব্দ ঢুকলে তার বুকটা একটু হিম হয়ে যায়। কিন্তু সে জানে, স্বপ্ন মানেই একটু ব্যতিক্রম হওয়া, আর ব্যতিক্রম মানেই প্রশ্ন উঠবে, চোখ রাঙানো হবে। সে চুপ করে থাকে, উত্তর দেয় না কারো। তবে, এই ঘটনার দিনেই, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাই হরিপদবাবু তার হুইলগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “শুনেছি তুমি একটা পাঠাগার তৈরি করছো? খুব ভালো করছো মধু। আমি যদি কিছু সাহায্য করতে পারি, জানিও। আমারও কিছু পুরোনো বই আছে।” মধু অবাক হয়ে যায়। সে ভাবে, একটাও যদি হৃদয় তার এই স্বপ্নে আস্থা রাখে, তবেই সেই স্বপ্ন দাঁড়িয়ে যাবে। মুন্নাও এখন প্রতিদিন তাকে সঙ্গ দেয়, মাঝে মাঝে বই ফেরিতেও সাহায্য করে। সে নিজের হাতে বই মোড়ায়, পাতা উল্টে দেখে কোন বই ভালো অবস্থায় আছে, কোনটা পাঠাগারের জন্য রাখা যাবে।

একদিন বিকেলে মুন্না বলল—“দাদু, আমাদের পাঠাগারে একটা নাম দিন না! শুধু পাঠাগার বললে ঠিক লাগে না।” মধু একটু ভেবে বলে—“আচ্ছা, ‘গ্রাম্য জ্ঞানধারা’ কেমন?” মুন্নার চোখ চকচক করে ওঠে। সে যেন গর্বের সঙ্গে বারবার নামটা উচ্চারণ করে—“গ্রাম্য জ্ঞানধারা… গ্রাম্য জ্ঞানধারা…”। এরপরের দিনগুলিতে মধু গাড়ির গায়ে একটা পোস্টার লাগায়, হাতে লেখা, রঙিন কাগজে—“আপনার পুরোনো বই দান করুন। আমাদের স্বপ্ন—‘গ্রাম্য জ্ঞানধারা পাঠাগার’। আপনার একটা বই কাউকে আলো দেখাতে পারে।” এই পোস্টার দেখে প্রথমে কয়েকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, পরে মুচকি হাসে। কিন্তু পরদিন বাজারের এক কাপড় দোকানদার এসে বলে—“মধু, আমার ছেলের ইংরেজি গল্পের বইগুলো পড়ে পড়ে পুরোনো হয়ে গেছে, নিয়ে যাবি?” আবার এক মুদি দোকানদার বলে, “একটা আলমারি খালি পড়ে আছে, চাইলে তোর পাঠাগারে নিয়ে যাস।” মধু যেন নিজের চোখ-কান বিশ্বাস করতে পারে না। এতদিন সে একা ছিল, একা বই ফেরি করত, এখন তার স্বপ্নে একে একে মানুষ যোগ দিচ্ছে। বাঁশ-টিন, মাদুর আর বইয়ের স্তূপের মাঝখানে সে বুঝতে পারে—পাঠাগার শুধু একঘর বইয়ের ঠাঁই না, পাঠাগার হচ্ছে বিশ্বাসের জমি, যেখানে আলোর বীজ রোপণ করা যায়।

পাঠাগারের কাজ প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে। মুন্নার মায়ের ঘরের এক কোণ থেকে মধু বইগুলো স্থানান্তর করেছে একটা খোলা জায়গায় — স্কুলের পাশেই এক পরিত্যক্ত খালি জায়গা, যেখানে একসময় গ্রামের পূজোর অস্থায়ী প্যান্ডেল গড়ত যুবকেরা। সেই জায়গাটাই সে বেছে নিয়েছে — কারণ এখানে ছেলেমেয়েরা খেলতে আসে, রাস্তা থেকেও দেখা যায়, আর গাছের ছায়াও মেলে। বাঁশের খুঁটি পুঁতে, টিনের ছাউনি বসিয়ে একখানা কাঠের ফ্রেম বানিয়েছে স্থানীয় দর্জি মধুসূদন তার নিজের হাতে, বিনা পারিশ্রমিকে। দড়ি দিয়ে পাটের পর্দা টাঙানো হয়েছে। ভেতরে তিনটে কাঠের তাক, একখানা মাদুর আর মাঝখানে বসার জন্য ছেঁড়া চটের টুকরো বিছানো। পাঠাগার এখন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তব — একটি নির্দিষ্ট জায়গা, যার নাম রাখা হয়েছে ঢাউস অক্ষরে—“গ্রাম্য জ্ঞানধারা পাঠাগার”। কিন্তু সাফল্যের এই মুহূর্তেই শুরু হলো শনি-ভরানো ঝড়। সেই দিন বিকেলে হঠাৎ দু’জন পঞ্চায়েত সদস্য এসে হাজির — মুখ গম্ভীর, চোখে সন্দেহ। “মধু, তুমি তো বই ফেরিওয়ালা ছিলে, এখন জমি দখল করে পাঠাগার করছো? সরকারি অনুমতি কোথায়? এই জায়গা তো গ্রামসভা ব্যবহারের জন্য রাখা!” একজন বলেন। মধু কেঁপে যায় একটু। সে সবকিছু খুলে বলে — কোথা থেকে বই এল, কে সহায়তা করেছে, উদ্দেশ্য কী — কিন্তু তাদের মন গলে না। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে চলে যায়—“আগামী সপ্তাহে পঞ্চায়েতে উঠবে বিষয়টা, যদি ঠিক মনে না হয়, ভেঙে দিতে হবে পাঠাগার।”

মধুর মুখ শুকিয়ে আসে। রাতে ঘুম আসে না। তার মনে হয় যেন কারা এসে ঘরের দরজা ধাক্কাচ্ছে, কে যেন তার সেই ছোট ঘরটায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। পরদিন সকালেই মুন্নার মা তাকে বলে—“ঘাবড়াবেন না দাদা, আমি গিয়ে পঞ্চায়েতে বলব। এটা আমার জমি, আমার ছেলেমেয়ের ভালোর জন্যই তো করছেন।” মধু কৃতজ্ঞতায় চোখ সরিয়ে নেয়। কিন্তু সে জানে, সরকারি নিয়মের ফাঁক অনেক শক্ত — আর তার হাতে নেই কাগজ, নেই ক্ষমতা। সেইদিন স্কুলের হরিপদ মাস্টারমশাই আবার এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “আমি চাইলে আমার নামেই জমা পড়তে পারে বিষয়টা। তবে তোমার মতো একজন মানুষকে আমরা হারাতে দেব না। আমি পঞ্চায়েতে কথা বলব।” ধীরে ধীরে গ্রামের আরও কিছু মানুষ পাশে দাঁড়ায়। মুদি দোকানদার, কাপড়ওয়ালা রমেশ, এমনকি মোবাইল রিচার্জের দোকানের রবিনও বলে—“দাদা, আপনিই তো আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করছেন, কে যেন বলেছে, আপনি টাকা তুলছেন! যদি কারও সন্দেহ হয়, আমরা গিয়ে বলব।”

সপ্তাহ ঘুরে আসে, পঞ্চায়েতে বসে আলোচনা। মধু নিজে উপস্থিত থাকে না, শুধু প্রার্থনার মতো চুপ করে বসে থাকে বাড়িতে। দুপুরের পর হরিপদবাবু এসে বলে—“খবর ভালো। পঞ্চায়েত রাজি হয়েছে, তবে শর্ত দিয়েছে—কোনও রাজনৈতিক রঙ হবে না, আর কেউ চাইলে বই পড়ার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।” মধুর চোখ ভিজে আসে। তার পাঠাগার বেঁচে গেল। বিকেলে সে গিয়ে নিজ হাতে পাঠাগারের দরজায় একটা সাদা কাগজ সাঁটে, তাতে লেখে—“এখানে বই পড়া একান্ত নিখরচা, সকলের জন্য উন্মুক্ত। কোনও ভেদাভেদ নেই — শুধু জানার ইচ্ছা থাকলেই আসুন।” সেই দিন থেকে শিশুরা এখন আর লুকিয়ে আসে না, তারা গর্ব করে বন্ধুদের ডাকে — “চল, মধু দাদুর পাঠাগারে যাই!” মুন্না তো এখন পাঠাগারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সে আস্তে আস্তে দায়িত্বও নেয় — বই সাজানো, নাম-খাতায় কারা কী পড়ল তা লেখা, এমনকি মাঝে মাঝে সে নিজেই ছোটদের গল্প পড়ে শোনায়। আর মধু জানে, এই সব বাঁধা, অভিযোগ, কুৎসা—এসবই সেই গল্পেরই অংশ, যেটা শেষ হয় একটাই বাক্যে—“একটা ফেরিওয়ালা ছিল, যে স্বপ্ন দেখেছিল। আর তার স্বপ্ন একটা ঘরে দাঁড়ায়, যেখানে ছেলেমেয়েরা শুধু বই পড়ে না, তারা স্বপ্ন দেখতে শেখে।”

পাঠাগারের উদ্বোধন হয় একেবারে অনাড়ম্বরভাবে — না ছিল কোনো ফিতে কাটা, না ছিল মাইক, না ছিল পোস্টার। তবুও সেই দিনটি কাটিয়াতলার ইতিহাসে এক অদ্ভুত রকমের আলো বয়ে আনে। সকালবেলায় হালকা রোদ, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের দাগ টিনের ছাউনিতে পড়ছে, আর পাঠাগারের সামনের মাটিতে বসে আছে সাতটি শিশু — তাদের চোখে একরাশ কৌতূহল, বুকভরা অচেনা উত্তেজনা। মধু হাতে ধরে রেখেছে একটি পুরোনো গল্পের বই—‘টুনটুনি ও রাজা’। বইটির পাতা কিছুটা পুরোনো, তবুও তার ভেতরে যে জগৎ আছে, তা একবার খুললেই খুলে পড়ে সময়ের খোলস। মুন্না তার ডানপাশে বসে, বাকি ছেলেমেয়েদের সে নিজেই ডেকে এনেছে—“আয় না, দাদু আজ গল্প পড়বে!” কাঁথা পাতা মাদুরের উপর বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো একবার অন্যের মুখের দিকে, আরেকবার মধুর দিকে তাকাচ্ছে। মধুর গলা তখন নরম, ধীর, ছন্দে ভরা—সে শুরু করে, “এক ছিল টুনটুনি, ছোট্ট পাখি, কাঁচা ডানা, চঞ্চল মন…”। কথাগুলো বই থেকে বেরিয়ে যেন ওড়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের মনের আকাশে ভেসে ওঠে। কেউ হেসে ওঠে, কেউ চোখ বড় করে, আবার কেউ নিজের বুকের কাছে বইটা টেনে ধরে যেন ওটা এখন তারই সম্পদ।

একটা ঘন্টা কেটে যায়, আরেকটা গল্প পড়া হয়—এইবার “বীরবল ও রাজা আকবর”-এর গল্প। এবার কৌতূহল আরও বাড়ে। একজন বলে—“আচ্ছা, বীরবল সব জানত কীভাবে?” আরেকজন বলে—“আমি বড় হয়ে ওর মতো বুদ্ধিমান হব।” মধু হেসে বলে—“বুদ্ধি আসে বই পড়ে, আর মন খোলে গল্প শুনে।” তারপর সে একে একে সবাইকে বই ধরিয়ে দেয়—যারা পড়তে পারে তারা পড়ে, যারা পারে না তারা মুন্নার পাশে বসে। মুন্না এখন আর সেই চুপচাপ ছেলেটা নেই, সে এখন গল্পের একজন কণ্ঠস্বর। সে পড়ে শোনায়, ভাবে, প্রশ্ন করে—যেন এই পাঠাগারের হৃদয় এখন তারই কাঁধে। হরিপদবাবুও আসেন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখে যান এই স্বপ্নের যাত্রা। যাওয়ার সময় বলেন, “মধু, তুমি শুধু পাঠাগার করো নি, তুমি একেকটা জীবন জাগাচ্ছ।” এই কথা শুনে মধুর চোখের কোণে জল জমে, কিন্তু সে কিছু বলে না। ভিতরে ভিতরে সে জানে, সে তার স্বপ্নের প্রথম পৃষ্ঠা খুলে ফেলেছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলে বাচ্চারা একে একে বাড়ি ফেরে। পাঠাগারের দরজায় তালা দিতে দিতে মধু তাকিয়ে থাকে খোলা মাটির দিকে, যেখানে এখনও বসে আছে কয়েকটা শিশুর পায়ের ছাপ, পড়ে আছে ছেঁড়া চটি, আর জমে আছে শিশুর কণ্ঠে বলা কিছু প্রশ্ন—“রাজারা কি সব ভালো মানুষ ছিল?”, “টুনটুনি উড়তে পারত কত দূর?”, “আচ্ছা, আপনি কীভাবে এত বই পেলেন?” সেদিন রাতে মধু ঘরে ফিরে তার সেই টিনের বাক্সটা খোলে না। কারণ আজ তার কিছু জমা করার নেই—আজ সে পেয়েছে। যে আনন্দ শিশুদের চোখে সে দেখেছে, যে বিস্ময় সে অনুভব করেছে—তা কোনও টাকার মূল্যে মাপা যায় না। বিছানায় শুয়ে, খোলা জানালা দিয়ে তার চোখ পড়ে আকাশের দিকে। আজও তার বাবার স্মৃতি ফিরে আসে—সেই পুরোনো কাগজের গন্ধ, ছোটগাড়ির চাকা, মাঠের গলা চিরে হেঁকে ওঠা—“পুরোনো বই, নতুন স্বপ্ন!” মধু মনে মনে বলেন, “দেখলে বাবা? আমি তোমার ফেরিওয়ালার পেশা ছাড়িনি, শুধু তাকে একটু অন্যভাবে সাজিয়েছি।”

পাঠাগারের প্রথম দিন থেকে কয়েক মাস চলে গেছে। মধু দেখতে পায়, গ্রামটিতে এক অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সকালবেলা, যেদিন তার হুইলগাড়ি বাজারে ফেরি করতে যায়, তখন গ্রামবাসীরা আর কটাক্ষ করে তাকায় না। কেউ কেউ এখন হেসে হেসে তাকে শুভেচ্ছা জানায়, “মধু দাদা, পাঠাগারের খবর কী?” বা “আজ কী নতুন বই এনেছো?” মধু জানে, এটি কেবল পাঠাগারের কাজ নয়, তার ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো গ্রামের চোখে নতুন কিছু সৃষ্টি করেছে। তবে, এই পরিবর্তনের পেছনে যতই প্রশংসা থাকুক, কিছু বিরোধও রয়েছে। এখনও কিছু লোক আছেন, যারা বিশ্বাস করে না যে একটি সাধারণ বই ফেরিওয়ালার উদ্যোগ এতটা সফল হতে পারে। পঞ্চায়েতের কিছু সদস্য এখনও সন্দেহজনক চোখে দেখে মধুকে, মনে মনে ভাবছে, “এটা কী এক টেক্কা নয় তো?” কিন্তু মধু কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে চায় না। তার স্বপ্ন তো শুধু পাঠাগার নিয়ে নয়, বরং এক একটি শিশুর চোখে স্বপ্নের দীপ জ্বালানোর।

মুন্না এখন একজন দায়িত্বশীল পাঠাগার সহকারী হয়ে উঠেছে। স্কুলের পড়াশোনায় সে ভালো করছে, কিন্তু বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা কখনো কমেনি। একদিন মধু দেখল, মুন্না স্কুলের ছুটির পরে পাঠাগারের দরজায় দাঁড়িয়ে। “দাদু, আজকে নতুন গল্পের বই আনবো কি?” মুন্নার মুখে সেই আগের মতো প্রশ্ন, কিন্তু এখন তার চোখে অন্য এক ধরনের আস্থাও ছিল। মধু বলল, “এবার নিজে বই বেছে নাও, মুন্না। তুমি যেভাবে গল্প পড়ো, এবার সেই গল্পগুলো অন্যদের শোনাবে।” মুন্না আনন্দে ঝলমলিয়ে ওঠে। সে তার পছন্দের বইগুলো নিয়ে আসে, আবার নতুন রকমের বই নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। কিন্তু যে বড় স্বপ্নটি মধু দেখতে শুরু করেছে, তা হলো—মুন্না একদিন তার মতো হয়ে উঠবে। সে জানে, সঠিক সময় আসবে, যখন মুন্না নিজে একটি পাঠাগার খুলবে, তার নিজের গ্রামে।

একদিন হঠাৎ মধুর মনে হল, পাঠাগারের পরিধি বাড়ানোর সময় এসেছে। প্রথমে কিছু মুদির দোকানে, তারপর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছেও সে জিজ্ঞেস করতে থাকে—“আপনারা কী জানেন, গ্রামে পাঠাগার আরও বড় করলে আমাদের সকলের উপকার হবে।” দুধ বিক্রেতা রামলাল, মুদি দোকানদার রবিন, এবং স্থানীয় ফল বিক্রেতা অমল—সবাই মধুর কাছে আসে, নিজের সামান্য কিছু দিয়ে সাহায্য করতে চায়। অমল তার পুরোনো বইগুলো এনে দেয়, রবিন কয়েকটা নতুন ম্যাগাজিন পাঠাতে শুরু করে। এইভাবে পাঠাগারের সংগ্রহ আরো সমৃদ্ধ হতে থাকে। মুন্নাও তখন শিক্ষার্থী হিসেবে এখানে পড়াশোনা করতে আসা ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর কাজে যুক্ত হতে শুরু করে। পাঠাগারের ভবিষ্যৎ তার হাতেও রয়েছে—এটা এখন শুধু মধুর স্বপ্ন নয়, মুন্নারও এক নতুন দিগন্ত।

মধু প্রতিদিন নতুন বই, পত্রিকা আর উপন্যাস নিয়ে ফেরি করতে বেরিয়ে আসে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে পাঠাগারের কাজে। সে জানে, একদিন তার বইয়ের ফেরির গাড়ি আর বইয়ের স্তুপের স্থান এই গ্রাম থেকে চিরকাল চলে যাবে, কিন্তু তার তৈরি করা পাঠাগার বেঁচে থাকবে—এটা হবে তার জীবনের বড় অর্জন। মধু হুইলগাড়ি ঠেলে নিয়ে আসতে থাকে, আর গ্রামবাসীরা যে শুধু তার বইয়ের প্রতি আগ্রহী না, এখন তারা তার স্বপ্নের সঙ্গী। আর এই দৃশ্য দেখে, মধুর মনে হয়—যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তার স্বপ্নগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাবে, এমনকি তার মতো ফেরিওয়ালাও একদিন আলো ফিরিয়ে দিতে পারবে।

বছর ঘুরে বসন্ত আসে। গাছের পাতায় নতুন কুঁড়ি, বাতাসে ধুলো কমে, আর কাটিয়াতলা গ্রামের মানুষজনের মুখেও যেন একটা প্রশান্তির রেখা। “গ্রাম্য জ্ঞানধারা পাঠাগার” এখন গ্রামের গর্ব—বাচ্চারা সেখানে প্রতিদিন যায়, কেউ চুপ করে বই পড়ে, কেউ জোরে পড়ে শোনায়। বিকেলে একবার না গেলেই কারও যেন দিনটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। হরিপদ মাস্টারমশাই মাঝেমাঝেই এসে বইয়ের তালিকা লেখেন, পুরোনো পাঠ্যক্রমে কীভাবে এই বইগুলো কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবেন। কিন্তু পাঠাগারের কেন্দ্রে, যার হাত ধরে এই পুরো স্বপ্নটা গড়ে উঠেছিল—সে মধু, আজকাল কিছুটা নীরব, কিছুটা ক্লান্ত। ফেরিওয়ালা জীবনের বোঝা, বয়সের ভার আর বই বয়ে ফেরার ক্লান্তি তাকে নিঃশব্দে ছুঁয়ে ফেলছে। একদিন রাতে, চুপচাপ বসে থাকা মুন্নাকে সে বলে, “তুই তো এখন সব বুঝিস রে… যদি একদিন আমি না থাকি?” প্রশ্নটা শুনে মুন্না চমকে ওঠে—“আপনি কী বলছেন দাদু? আপনি না থাকলে কে পড়াবে?” মধু একটুখানি হাসে, চোখ সরিয়ে নেয়। সে জানে, যে আলো সে বই ফেরি করে ছড়িয়ে দিয়েছে, তা জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব এবার মুন্নার কাঁধে তুলে দিতে হবে।

সেই রাতেই মধু একটা সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সে হরিপদবাবু, রমেশ, রবিন আর মুন্নার মা-কে ডেকে পাঠায় পাঠাগারে। সবার সামনে একটা ছোট তালা ও চাবি তুলে ধরে, সে বলে, “আজ থেকে এই পাঠাগার মুন্নার। আমি আর পারছি না রোজ আসতে, রোজ বই তুলতে, নাম লিখতে। কিন্তু মুন্না পারবে। ও জানে এই পাঠাগার কেন তৈরি হয়েছে, কারা আসত, কীভাবে বই বাছতে হয়।” মুন্না কিছু বলতে পারে না, সে শুধু চাবিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ ভিজে আসে। হরিপদবাবু মুচকি হেসে বলেন, “এমন গুরুদক্ষিণা তো খুব কম ছেলেই পায়।” তারপর মধু আস্তে করে বলে, “তুই তো জানিস, আমি কখনো কোনও বড় চাকরি করিনি, বড় শহরে যাইনি। শুধু বই ফেরি করতাম, আর স্বপ্ন বেচতাম। আজ আমি সেই স্বপ্নটাই তোকে দিয়ে গেলাম।” তখন গ্রামের অন্যান্য মানুষরা মাথা নোয়ায়—একজন ফেরিওয়ালা, যার কাছে চাকরি ছিল না, বড় নাম ছিল না, কিন্তু ছিল বড় মন—সে একটা প্রজন্মকে আলো দেখিয়ে দিল।

শেষ বিকেলে, পাঠাগারের সামনে একটা ছবি তোলা হয়—মধু দাঁড়িয়ে, পাশে মুন্না, পেছনে সেই বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো বোর্ডে লেখা “গ্রাম্য জ্ঞানধারা পাঠাগার।” ছবিটা পরে হরিপদবাবু ছাপিয়ে পাঠাগারের ভেতর দেয়ালে টাঙিয়ে দেন। সেইদিন রাতে মধু বাড়িতে ফিরে খাটে বসে পুরোনো রেজিস্টারটা খোলে—সেই যেটায় প্রথম লিখেছিল, “গ্রাম্য জ্ঞানধারা: স্বপ্নের খসড়া শুরু।” সে তার পাশে লেখে, “আজ পাঠাগারের চাবি হস্তান্তরিত—মুন্নার হাতে। স্বপ্ন এখন তার।” তার পর দিন থেকেই, মধু আর ফেরি করতে বেরোয় না। সে জানে, তার কাজ শেষ—আর এটাই সবচেয়ে বড় সার্থকতা। বইয়ের ফেরিওয়ালা এখন আর শুধুই ফেরিওয়ালা নয়, সে হয়ে গেছে গ্রামের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়, যার গল্প অন্যেরা বলবে—হয়তো সেই পাঠাগারেই, তারই বইগুলো পড়ে।

_

1000041049.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *