Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - সামাজিক গল্প

ফেরিওয়ালার অ্যাপ

Spread the love

তন্ময় বাগচী


ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শহরের রাস্তায় এক অদ্ভুত নীরবতা থাকে। বড় বড় বহুতল ভবনের কাঁচে তখনও আলো এসে পড়েনি, ট্রাফিক সিগন্যালগুলো লাল-সবুজ ঝলকাচ্ছে কিন্তু গাড়ি তেমন নেই। এই আধো-অন্ধকার, আধো-নিস্তব্ধ সময়ে রাস্তার ধারে এক মাঝবয়সী মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এসে থামে পরিচিত জায়গায়—ফুটপাতের সেই চওড়া জায়গাটিতে যেখানে তার ছোট্ট দোকান বসে প্রতিদিন। তার হাতে কয়েকটা বড় ব্যাগ, যেগুলোতে সাজানো আছে দোকানের মাল—চামড়ার মানিব্যাগ, সস্তা প্লাস্টিকের পার্স, মোবাইল কভার, চাবির রিং, ছোটখাটো অলংকার আর ঘড়ি। ব্যাগ নামিয়ে সে প্রথমে একবার চারপাশে তাকায়। রিকশাওয়ালারা তখনও ঘুমাচ্ছে, পানের দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেবল ভোরের খবরের কাগজওয়ালারা ব্যস্ত সাইকেল চালিয়ে শহরের প্রতিটি মোড়ে। ফেরিওয়ালা ব্যাগ থেকে একটি মলিন কাপড় বার করে যত্ন করে জায়গাটা মুছে নেয়, তারপর ধীরে ধীরে তার মালপত্র সাজাতে শুরু করে। প্রতিদিনের মতোই আজও সে ভোর থেকে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ জানে—শহর জেগে ওঠার আগে দোকানটা দাঁড় করাতে না পারলে দিনের খদ্দের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

তার জীবনের সরলতা আর পরিশ্রম চোখে পড়ার মতো। সূর্য ওঠার আগেই সে বের হয়, দিনের শেষে রাত নামা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। ঘামের বিনিময়ে তার সংসার চলে, আর সেই সংসারই তার শক্তি। খদ্দেররা আসে নানা রকম—কেউ অফিসযাত্রী, কেউ কলেজের ছাত্রছাত্রী, কেউ বা দূর থেকে আসা পর্যটক। প্রত্যেককে সে হেসে অভ্যর্থনা জানায়, দামাদামির সময় রাগ না করে ধৈর্য ধরে বোঝায়—“ভাই, এরচেয়ে কমে আর পাওয়া যাবে না।” জীবনে তার চাহিদা খুব বেশি নয়। ছোট্ট ভাড়া বাড়ি, দুই সন্তান আর স্ত্রীর মুখের হাসিই তার মূল সম্পদ। কিন্তু প্রতিদিনের অনিশ্চয়তা তাকে কুরে কুরে খায়। পুলিশ যদি হঠাৎ এসে তাড়িয়ে দেয়, কিংবা খারাপ আবহাওয়ার কারণে যদি দিনটা ফাঁকা যায়, তাহলে সন্ধ্যায় খাওয়ার টাকাটুকু জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও সে হাল ছাড়ে না। তার বিশ্বাস—যতদিন শরীর চলছে, ততদিন না খেয়ে মরতে হবে না। আর তার শরীর যেন এক অদম্য যন্ত্র—অভ্যাসে গড়া শক্ত হাত, রোদে পোড়া গায়ের রং, আর অদম্য ধৈর্য।

ফুটপাতের সকাল তার কাছে কেবল রোজকার জীবনযাত্রার অংশ নয়, বরং এক ধরণের সংগ্রামের প্রতীক। প্রতিটি সকাল মানে নতুন আশা, নতুন খদ্দেরের আশ্বাস, আবার নতুন ভয়ের ছায়া—আজকের দিনটা কেমন যাবে? হয়তো বিক্রি ভালো হবে, হয়তো খুব একটা হবে না। তার চোখে ফুটপাত শুধু পাথরের চওড়া ফালি নয়, বরং জীবনের রণক্ষেত্র। শহরের ব্যস্ততা যখন বাড়তে থাকে, গাড়ির হর্ন বাজতে থাকে, মানুষের ভিড় ঘন হয়ে ওঠে, তখনই আসল লড়াই শুরু হয়। তাকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়, হাসিমুখে ডাকতে হয়—“দেখুন ভাই, মোবাইল কভার! মানিব্যাগ, ঘড়ি, সস্তায় পাবেন!” তবুও সে ভিতরে ভিতরে জানে—আজকের আয় যদি ঠিকঠাক হয়, তাহলে ছেলেকে স্কুলে বই কিনে দিতে পারবে; যদি না হয়, তবে স্ত্রীকে আবার বলতে হবে একটু অপেক্ষা করতে। প্রতিদিনের এই টানাপোড়েনই তাকে নতুন করে শক্ত করে, আবার ক্লান্তও করে তোলে। আর এভাবেই ভোরের প্রথম আলো থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত ফুটপাতের সকাল তার জীবনের অটল সঙ্গী হয়ে থাকে।

দিনের আলো যত গাঢ় হয়, ফেরিওয়ালার মাথার ভেতর টাকার হিসেব যেন ততই ঘুরপাক খায়। প্রতিদিন সকালবেলা দোকান সাজানোর পর থেকেই তার মনের ভেতরে অদৃশ্য এক খাতা খুলে যায়, যেখানে সারি সারি খরচ জমে থাকে। আজ কতটা বিক্রি হলো, তার থেকে কতটা আসলে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে—এই হিসেব মিলানোই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ভাড়া বাড়ির মালিক মাসের প্রথম সপ্তাহ এলেই দরজায় এসে দাঁড়ায়, কড়া গলায় বলে—“ভাড়া মেটান, না হলে বেরিয়ে যান।” দোকানের মাল কেনার জন্য যে টাকা লাগে, সেটা তো আরও বড় ঝামেলা। পাইকারি বাজার থেকে প্রতিদিন বা সপ্তাহে একবার নতুন মাল কিনে আনতে হয়, আর সেটা না হলে দোকান ফাঁকা হয়ে যায়, খদ্দেরও কমে যায়। অথচ পাইকারি বাজারে কাউকে ক্রেডিটে মাল দেয় না, নগদ টাকা গুনতে হয়। একদিকে সংসারের চাপ, অন্যদিকে ব্যবসার টানাপোড়েন—সব মিলে সে যেন প্রতিদিন অদৃশ্য দড়ির ওপর হাঁটে। ভোরে দোকান সাজাতে বসে আর রাতে দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই সে বুঝে যায়—দিনভর রোদে দাঁড়িয়ে থাকলেও মাথার ভেতর টাকার চিন্তা কখনোই নামতে চায় না।

এই টানাপোড়েনকে আরও তীব্র করে তোলে পুলিশ আর প্রতিযোগিতা। ফুটপাতের ব্যবসা বৈধ নয়, সবাই জানে সেটা, তাই পুলিশের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হয় সবসময়। হঠাৎ যদি টহল আসে, আর পুলিশ খাতার পাতায় নাম লিখে ফেলে, তাহলে গুনতে হবে টাকা—“বাবু, কিছু না দিলে কিন্তু দোকান সরিয়ে দেব।” প্রতিবারই বুকের ভেতরটা ধকধক করে ওঠে। কিছু না কিছু টাকা আলাদা করে রাখতে হয় কেবল এই অদৃশ্য খাতির খরচের জন্য। অথচ সেই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের ভালো খাবার কেনা যেত, বা স্ত্রীর জন্য নতুন শাড়ি। উপরন্তু, চারপাশে যত ফেরিওয়ালা আছে, তাদের সবার সঙ্গেই প্রতিযোগিতা। পাশের দোকান যদি একই জিনিস একটু কম দামে দেয়, খদ্দের তৎক্ষণাৎ সেদিকেই ছুটে যায়। তখন ফেরিওয়ালার সামনে আর কোনো পথ থাকে না—কিংবা লাভ কমিয়ে দিয়ে বিক্রি করা, নইলে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু না পাওয়া। লাভের অঙ্ক ক্রমেই ছোট হয়ে আসে, অথচ খরচের পাহাড় বড় হতে থাকে। তবুও হাল ছাড়ে না সে। ভেবে নেয়—আজ যদি কম আয় হয়, কাল হয়তো একটু ভালো হবে। এই অদ্ভুত আশাবাদই তাকে ঠেলে নিয়ে যায় প্রতিদিনের পরিশ্রমের দিকে।

বাড়ি ফিরে রাতের খাওয়ার টেবিলে বসে স্ত্রী যখন দিনের আয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ফেরিওয়ালা তখন মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করে, যদিও ভেতরে ভেতরে সে জানে হিসেব মোটেও মেলে না। ছেলেটি নতুন স্কুলব্যাগ চেয়েছে, মেয়েটি পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত বই কিনতে চাইছে—এইসব ছোট ছোট চাহিদা তার কানে বাজতে থাকে। স্ত্রীও বোঝে টাকার টানাপোড়েন, কিন্তু তবুও সংসারের হাল তো তিনিই সামলান। অনেকসময় তাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়, আবার পরক্ষণেই মিল হয়ে যায়, কারণ দুজনেই জানে—এই লড়াই একসাথে না করলে এগোনো যাবে না। ফেরিওয়ালা প্রতিদিন প্রতিজ্ঞা করে—“আগামীকাল থেকে আরও বেশি খাটব, আরও বেশি বিক্রি করব।” কিন্তু ভোর হলেই আবার নতুন করে শুরু হয় সেই চক্র—মাল কেনা, পুলিশকে খুশি করা, খদ্দের টানতে ডাকা, আর শেষে সামান্য কিছু টাকা হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরা। টাকার টানাপোড়েন যেন তার জীবনের স্থায়ী ছায়া, যা দূর থেকে সবসময় তাকে অনুসরণ করে চলে। তবুও সেই ছায়ার মাঝেই সে আলো খুঁজে ফেরে—পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, আর একদিন হয়তো একটু নিশ্চিন্ত জীবন পাওয়ার স্বপ্ন দেখাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।

দিনটা ছিল একেবারেই সাধারণ, আগের দিনের মতোই। ফুটপাতের সেই জায়গায় ফেরিওয়ালা ভোরবেলা দোকান সাজিয়ে দাঁড়িয়েছিল, চারদিকে ভিড় জমতে শুরু করেছে। অফিসগামী মানুষজন ব্যস্তভাবে হাঁটছে, হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন, যেন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে সবাই। ফেরিওয়ালা তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকার চেষ্টা করছে—“দেখুন ভাই, মানিব্যাগ, ঘড়ি, মোবাইল কভার—সব আছে।” দুপুরের দিকে এসে তার সামনে দাঁড়াল এক তরুণ, বয়সে হয়তো বিশ-বাইশ, পিঠে ব্যাগ ঝোলানো, চোখে নতুন যুগের আত্মবিশ্বাস। সে বেশ কিছুক্ষণ দোকানের জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করল, তারপর হাসিমুখে বলল—“কাকা, আপনার দোকানটা অ্যাপে রাখলে ভালো হয়।” কথাটা শুনে ফেরিওয়ালা চমকে উঠল। তার কাছে ‘অ্যাপ’ শব্দটা তখনও আধো-অন্ধকারে মোড়া এক রহস্য। সে মৃদু হেসে বলল—“সে আবার কী জিনিস? দোকান কি মোবাইলের ভেতরে বসানো যায় নাকি?” তরুণ মজা পেয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগল—এখন শহরের মানুষ অনেকেই অনলাইনে জিনিস কেনে, মোবাইলের অ্যাপে দোকান খোলা যায়, সেখান থেকে খদ্দেররা অর্ডার দেয়, আর ফেরিওয়ালার মতো দোকানিরা বাড়তি বিক্রি পায়। ফেরিওয়ালা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, যদিও অর্ধেকই বুঝতে পারছিল না। তবুও তার মনে অদ্ভুত কৌতূহল জন্ম নিল—যদি সত্যিই এমন কিছু হয়, তবে কি তার জীবন বদলে যেতে পারে?

এই কথোপকথনের পর থেকে ফেরিওয়ালার মনে যেন নতুন এক দরজা খুলে গেল। দোকান গুটিয়ে রাতের দিকে বাড়ি ফেরার সময় সে চিন্তা করছিল সারাটা পথ—অ্যাপ জিনিসটা আসলে কী? কাগজে তো সে প্রায়ই পড়েছে, শহরের বড় বড় কোম্পানি, রেস্তরাঁ, ট্যাক্সি সবকিছুই নাকি এখন মোবাইলের ভেতর চলে এসেছে। কিন্তু সেসব তো বড়লোকের কাজ, তার মতো ফুটপাতের ফেরিওয়ালার সঙ্গে সেগুলোর মিল কোথায়? অথচ তরুণটির কথায় এমন একটা আন্তরিকতা ছিল, যা তাকে নাড়া দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে রাতের খাবারের সময় স্ত্রীকে সে কথাটা বলল। স্ত্রী হেসে উড়িয়ে দিল—“তুমি আবার এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? মোবাইলের ভেতর দোকান বসানো যায় নাকি!” কিন্তু ফেরিওয়ালা থেমে থাকল না। ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজের পুরোনো মোবাইলটা হাতে নিয়ে কয়েকবার স্ক্রিন টিপল, কিন্তু কিছুই বুঝল না। বয়সের কারণে পড়াশোনার সুযোগ সে পায়নি, প্রযুক্তির ভাষা তার কাছে যেন অন্য গ্রহের মতো। তবুও মনে মনে ঠিক করল—যেভাবেই হোক, কাল আবার সেই তরুণ এলে আরও ভালোভাবে জেনে নেবে।

পরদিন সকালবেলা ফেরিওয়ালা দোকান সাজানোর সময় বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিল, যেন অপেক্ষা করছে সেই তরুণের জন্য। দুপুরের দিকে তরুণ আবার এল, এবার কিছু কিনলও। ফেরিওয়ালা সুযোগ বুঝে বলল—“বাবা, তুমি যে গতকাল বললে, দোকানটা নাকি অ্যাপে রাখতে হয়, সেটা কীভাবে হয়?” তরুণ এবার সিরিয়াস হয়ে নিজের ফোন বের করল। স্ক্রিনে নানা রঙিন আইকন, ঝকঝকে ছবি দেখে ফেরিওয়ালার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। তরুণ ধৈর্য ধরে ব্যাখ্যা করতে লাগল—কীভাবে দোকান রেজিস্টার করতে হয়, নাম লিখতে হয়, ছবি তুলতে হয়, দাম লিখতে হয়। ফেরিওয়ালা অর্ধেক বুঝল, অর্ধেক বুঝল না, কিন্তু মনে হলো যেন এক অচেনা মোড়ে দাঁড়িয়ে গেছে সে—যেখানে সামনে নতুন রাস্তা, অচেনা ভবিষ্যৎ। সেই রাতে বিছানায় শুয়ে ফেরিওয়ালা দীর্ঘক্ষণ চোখ মেলেই থাকল। তার মাথায় ঘুরছিল একই চিন্তা—“যদি সত্যিই দোকানটা মোবাইলের ভেতরে বসানো যায়, তাহলে হয়তো আর শুধু ফুটপাথের খদ্দেরের ওপর ভরসা করতে হবে না। শহরের অন্য প্রান্ত থেকেও মানুষ কিনবে। তাহলে হয়তো টাকার টানাপোড়েনটা একটু কমবে।” কৌতূহলের সঙ্গে মিশল ভয়, কিন্তু এই অচেনা মোড়ই যেন তার জীবনে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত বয়ে আনল।

কয়েকদিন ধরে মাথার ভেতর সেই একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল—অ্যাপ নামক জিনিসটা কেমন করে কাজ করে! তরুণটির কথাগুলো যেন অদ্ভুত এক আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল ফেরিওয়ালার ভেতরে। অবশেষে এক বিকেলে দোকান গুটিয়ে ফেরার পথে সে সিদ্ধান্ত নিল—যা হোক একটা স্মার্টফোন কিনতেই হবে। তার পুরোনো বাটনওয়ালা মোবাইল দিয়ে তো এ কাজ সম্ভব নয়। পকেটে জমা সামান্য সঞ্চয় নিয়ে সে গেল নিকটস্থ ইলেকট্রনিক্স দোকানে। ঝকঝকে কাঁচের শো-কেসে সারি সারি উজ্জ্বল স্মার্টফোন দেখে তার চোখ ঝলসে গেল। দাম শুনে বুক কেঁপে উঠল—কোনোটা দশ হাজার, কোনোটা কুড়ি হাজার। সেসব তার সাধ্যের বাইরে। অবশেষে দোকানদার তাকে একটা পুরোনো রিফার্বিশড ফোন দেখাল, যার স্ক্রিনে ছোটখাটো আঁচড় থাকলেও ভেতরে সব ফিচারই কাজ করে। দাম তুলনামূলক কম—মাত্র আড়াই হাজার। অনেক ভেবেচিন্তে সে সেই ফোনটাই কিনল। হাতে ফোনটা নেওয়ার সময় যেন মনে হলো, একটা নতুন জগতে প্রবেশ করল সে, এমন এক জগতে যেখানে হয়তো তার ভাগ্যের দরজা খুলে যেতে পারে।

কিন্তু ফোন কেনাই তো শেষ নয়, বরং আসল লড়াই শুরু হলো সেখান থেকে। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই দেখা গেল অজস্র আইকন—সবই তার কাছে নতুন, সবই যেন ভিন্ন ভাষায় লেখা। প্রথমদিন সে হতবাক হয়ে শুধু স্ক্রিনের আলো দেখেই বসে রইল। রাতে বাড়ি ফিরে ছেলে-মেয়েকে ডাকল। ছেলে স্কুলে পড়ে, মোবাইলের খেলায় বেশ অভ্যস্ত। ছেলেই তাকে প্রথম দেখাল কীভাবে গুগল প্লে-স্টোর খুলতে হয়, সেখান থেকে অ্যাপ খুঁজে বের করতে হয়। প্রথমবার যখন ফেরিওয়ালার চোখের সামনে একের পর এক অ্যাপ ভেসে উঠল, তার মনে হলো যেন এক জাদুর বাক্স খুলে গেল। “এত কিছু থাকে মোবাইলের ভেতরে!”—বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে গেল। ছেলে-ছেলেরা হেসে বলল, “এখন সবকিছুই তো মোবাইলেই হয় বাবা।” কয়েকদিনের মধ্যে প্রতিবেশী তরুণরা মিলে তাকে শেখাল কীভাবে নাম লিখে রেজিস্টার করতে হয়, দোকানের ছবি তুলে আপলোড করতে হয়, দাম ঠিক করতে হয়। প্রতিটি ধাপ শিখতে গিয়ে ফেরিওয়ালার মনে হচ্ছিল সে আবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে—তবে এবার বইয়ের পাতা নয়, বরং আঙুলের ছোঁয়ায় শেখা হচ্ছে নতুন অক্ষর।

ধীরে ধীরে তার দোকান অনলাইনে জায়গা পেল। প্রথমবার যখন স্ক্রিনে নিজের দোকানের নাম আর ছবিগুলো ভেসে উঠল, তখন ফেরিওয়ালার বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি অনুভূত হলো। মনে হলো, ফুটপাতের ছোট্ট দোকানটা যেন হঠাৎ করে শহরের সীমা পেরিয়ে পুরো দুনিয়ার সামনে হাজির হয়েছে। অজানা এক আনন্দ তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বন্ধুদের সে বলল, “দেখো, আমার দোকান এখন মোবাইলের ভেতরেও আছে।” তারা হেসে বলল, “কাকা, এবার আপনিও ডিজিটাল।” প্রতিদিন সন্ধ্যায় দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফিরেই সে ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকত, নতুন নতুন জিনিস বোঝার চেষ্টা করত। চোখে ঝাপসা দেখলেও চশমা পরে ধৈর্য ধরে স্ক্রিনের অক্ষর পড়ত। মাঝেমধ্যে ভুলে অন্য বাটনে চাপ দিয়ে ভয় পেত, মনে হতো সব নষ্ট হয়ে গেল বুঝি। কিন্তু ছেলেরা ধৈর্য ধরে আবার ঠিক করে দিত। ধীরে ধীরে ভয় কেটে গেল, জায়গা নিল আত্মবিশ্বাস। এখন তার কাছে ফোনটা শুধু যোগাযোগের যন্ত্র নয়, বরং জীবনের নতুন অধ্যায়ের চাবিকাঠি। এই ছোট্ট ডিভাইসটিই তার কাছে হয়ে উঠল সত্যিকারের এক জাদুর বাক্স, যা হয়তো একদিন তার টানাপোড়েন ভরা জীবনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবে।

প্রথম অর্ডার পাওয়ার অভিজ্ঞতা ফেরিওয়ালার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দিনের পর দিন মোবাইলের পর্দার দিকে তাকিয়ে থেকেও কোনো নোটিফিকেশন না আসায় তার মনে সন্দেহ জন্মেছিল—হয়তো এই প্রযুক্তি শুধু শিক্ষিত আর ধনী লোকদের জন্য, তার মতো সাধারণ ফুটপাতের ফেরিওয়ালার কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু এক ভোরে, দোকান খোলার আগেই মোবাইল কেঁপে ওঠে—একটা মৃদু শব্দ, যার অর্থ সে প্রথমে বুঝতেই পারেনি। পরে প্রতিবেশী এক তরুণ এসে বলল, “কাকা, অর্ডার এসেছে! এখনই জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে হবে।” বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠল তার। সেই মুহূর্তে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। একদিকে ভয়—কিছু ভুল হবে না তো, ঠিকঠাক পৌঁছাবে তো? আরেকদিকে আনন্দ—এতদিন যেটাকে অবাস্তব ভেবেছিল, তা যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। অর্ডারের জিনিস সাজাতে সাজাতে তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত ঝিলিক, যেন জীবনের অন্ধকার গলি থেকে হঠাৎ আলো এসে পড়েছে।

যখন গ্রাহক এসে তাকে জিনিসপত্র বুঝে নিল, ফেরিওয়ালার ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে গেল। টাকা হাতে পাওয়ার পর মনে হল, এ শুধু সামান্য আয় নয়—এ এক নতুন দিগন্তের দরজা। আজকের এই ছোট্ট লেনদেন তাকে এমন এক জগতে ঢুকিয়ে দিল, যেখানে আর ফুটপাতের সীমাবদ্ধতার ভেতর আটকে থাকতে হবে না। সেই গ্রাহক হেসে বলল, “ধন্যবাদ কাকা, আপনার দোকান অ্যাপে দেখে ভালো লাগলো।” এই একটি বাক্যই যেন তার ক্লান্ত শরীরের সব ক্লান্তি দূর করে দিল। এতদিন যারা তাকে শুধুই ফুটপাতের এক সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখেছে, হঠাৎ তার চোখে নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি হতে লাগল—একজন ছোট ব্যবসায়ী, যে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে। দোকানের পাশে দাঁড়ানো অন্যান্য ফেরিওয়ালারাও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। তাদের মনে প্রশ্ন—আসলে কীভাবে সম্ভব হল এই কাজ? আর তার মনে জন্ম নিল এক নতুন বিশ্বাস—যদি আজ প্রথম অর্ডার আসতে পারে, তবে কাল হয়তো দশটা আসবে, আর পরশু হয়তো শতটা।

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে সে স্ত্রী আর সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। দিনের শেষে আয়ের হিসাব খুব বড় কিছু ছিল না, কিন্তু গর্ব ছিল অসীম। স্ত্রী প্রথমে বুঝতে পারছিল না কেন সে এত খুশি, কিন্তু যখন শোনল যে মোবাইলের অ্যাপ দিয়ে আজ প্রথমবারের মতো একজন ক্রেতা তাকে খুঁজে পেয়েছে, তার চোখেও আনন্দের অশ্রু ঝরল। বাচ্চারা খুশিতে লাফাতে লাগল—“বাবা, এখন তোমার দোকান মোবাইলে!” সেই আনন্দময় মুহূর্তে ফেরিওয়ালা বুঝতে পারল, এ শুধু ব্যবসার নতুন পথ নয়—এ তার পরিবারের স্বপ্ন পূরণের শুরু। একসময় সে ভাবত, তার জীবন শুধু বেঁচে থাকার লড়াই, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে লড়াইয়ের বাইরে নতুন একটা গল্প শুরু হয়েছে। যে গল্পে আশা আছে, আত্মবিশ্বাস আছে, আর আছে প্রযুক্তির আলো, যা তার মতো অগণিত ছোট ব্যবসায়ীর জীবনে একদিন নতুন ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি হয়ে দাঁড়াবে।

প্রথম অর্ডারের সাফল্যের পর ফেরিওয়ালা ভেবেছিল সবকিছু যেন এখন আর সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব ছিল অনেক কঠিন। প্রতিদিনই নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে লাগল সে। কখনও দোকানে বসে অর্ডারের অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ ইন্টারনেট চলে যায়, আর মোবাইলের পর্দা হয়ে ওঠে নিস্তব্ধ। ডেলিভারির জন্য ঠিক করা সময়ে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না, অথবা ভুল লোকেশনে তথ্য চলে যায়। একবার এমনও হয়েছিল যে, গ্রাহক অভিযোগ জানাল—“আপনার জিনিস দেরিতে এসেছে, আমি আর নিতে পারছি না।” সেই রাতে ফেরিওয়ালার মন ভেঙে গিয়েছিল। এত কষ্ট করে প্রস্তুতি নেওয়া, জিনিস সাজানো, তারপরও গ্রাহক যদি খুশি না হয়—তাহলে কি তার স্বপ্ন আবার ভেঙে যাবে? কিন্তু ভোরে সূর্যের আলোয় বসে থাকতে থাকতে সে নিজেকে বোঝাল, প্রতিটি লড়াই আসলে নতুন অভিজ্ঞতা। ঠিক যেমন ফুটপাথে বসে পুলিশ তাড়ানোর ভয়কে সামলে সে এতদিন টিকে থেকেছে, তেমনি নতুন এই প্রযুক্তির জগতেও তাকে ধৈর্য ধরতে হবে।

ডেলিভারি সমস্যাগুলো আরও বড় আকারে ধরা দিল যখন কয়েকজন অর্ডার দিয়ে পরে বাতিল করল। একদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল, কিন্তু গ্রাহক এল না। ঘামে ভিজে দোকানে বসে থাকতে থাকতে তার চোখে ক্লান্তি জমতে লাগল। সেই মুহূর্তে পাশের ফেরিওয়ালারা মুচকি হেসে বলল, “দেখলি তো, এসব অ্যাপ-ট্যাপ তোমার মতো লোকের জন্য না।” কথা শুনে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল, কিন্তু সে চুপ রইল। বাড়ি ফিরে বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখে সে আবার সাহস পেল। পরদিন থেকে ঠিক করল—এবার থেকে গ্রাহকের সঙ্গে আগেই ফোনে কথা বলে নেবে, অর্ডারের সব ডিটেলস পরিষ্কার করবে। প্রতিবেশী এক তরুণ তাকে আরও সাহায্য করল—কীভাবে লোকেশন ট্র্যাক করতে হয়, কীভাবে গ্রাহকের সঙ্গে দ্রুত মেসেজ আদানপ্রদান করতে হয়। ধীরে ধীরে সে শিখতে লাগল, প্রতিটি ব্যর্থতাই আসলে শেখার সুযোগ। জীবনের মতোই ব্যবসায়ও ঝড় আসে, কিন্তু যারা টিকে থাকতে জানে, তারাই সফল হয়।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এল তখন, যখন কয়েকজন গ্রাহক ভুল বোঝাবুঝির কারণে তাকে খারাপ রিভিউ দিল। একজন বলল, “পণ্যের মান ভালো না।” অথচ সে জানত, তার দেওয়া জিনিসে কোনো খুঁত নেই। রাতে মোবাইল হাতে নিয়ে রিভিউ পড়তে পড়তে তার মন ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু সেদিন তার ছেলে এসে বলল, “বাবা, তুমি যদি হাল ছাড়ো, তাহলে এই মোবাইলটা কেনা আর শিখে নেওয়ার এত পরিশ্রম সব বৃথা যাবে।” কথাটা যেন বুকের ভেতর শক্তি ঢেলে দিল। সে বুঝল, মানুষ সবসময় বুঝবে না, অনেক সময় অন্যায় অভিযোগও আসবে, কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই এগোতে হবে। আবারও নতুন উদ্যমে দোকান সাজাল, গ্রাহকদের হাসিমুখে স্বাগত জানাতে শুরু করল। কয়েকজন পুরনো ক্রেতা তার প্রতি আস্থা রাখল, নতুন ক্রেতারাও ধীরে ধীরে আসতে লাগল। প্রতিটি সমস্যার ভেতর লড়াই করে সে টিকে থাকল। এ লড়াই শুধু ব্যবসার জন্য নয়—এ লড়াই তার অস্তিত্বের, তার পরিবারের ভবিষ্যতের, আর হাজারো ছোট ব্যবসায়ীর আশা হয়ে ওঠার পথে একেকটি পদক্ষেপ।

ফেরিওয়ালার জীবনে প্রযুক্তির আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের ভেতরেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করল। প্রথমদিকে স্ত্রী ভয় পেত—এই নতুন মোবাইল, অ্যাপ আর ইন্টারনেট কি সত্যিই তাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য? তার চোখে মোবাইল মানেই বিল, খরচ আর অচেনা জগৎ। কিন্তু ধীরে ধীরে সে দেখল, প্রতিদিনের আয়ে যেন একটু একটু করে বৃদ্ধি হচ্ছে। আগে যেখানে মাস শেষে ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হত, সেখানে এখন কিছুটা হলেও স্বস্তি আসছে। সন্তানদের স্কুলের ফি দিতে গিয়ে যে দুশ্চিন্তায় রাত জেগে থাকতে হত, এখন তা আর হচ্ছে না। একদিন যখন ছেলে এসে গর্বভরে বলল—“আমার বাবার দোকান মোবাইলে আছে”—স্ত্রীর চোখে ভেসে উঠল গর্ব আর আনন্দের অশ্রু। এই ছোট্ট পরিবর্তন যেন সংসারের ভেতর নতুন আশার বীজ বপন করল।

সন্তানদের জীবনেও এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করল। আগে বই-খাতা কেনার সময় তাদের মায়ের মুখে দুশ্চিন্তা থাকত, অনেক সময় চাহিদা পূরণ হতো না। কিন্তু এখন ফেরিওয়ালা যতই পরিশ্রম করুক, তার মনে হয় এই পরিশ্রম ফল দিচ্ছে। বাচ্চাদের মুখে হাসি, তাদের ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ হতে দেখে সে নতুন উদ্যমে কাজ করে। তার মেয়ে একদিন বলে উঠল—“বাবা, তুমি যদি এভাবে টাকা জমাতে থাকো, আমি বড় হয়ে কলেজে পড়তে চাই।” এই কথাটা তার মনে অদ্ভুত সাহস জাগায়। আগে সে শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়ত, এখন লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নও দেখতে শিখেছে। তার সন্তানরা যখন পাশের বাড়ির বাচ্চাদের মতো নতুন পোশাক পরে স্কুলে যেতে পারে, কিংবা টিফিনে ভালো কিছু নিতে পারে, তখন ফেরিওয়ালার মনে হয়, সে শুধু নিজের নয়, পরিবারের ভেতরেও সম্মান ফিরিয়ে আনছে।

স্ত্রীর মনেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে লাগল। একসময় সে ভাবত, তার স্বামী হয়তো সারাজীবন ফুটপাতেই থেকে যাবে। কিন্তু এখন সে দেখছে, অ্যাপের মাধ্যমে তার স্বামীর দোকান এক নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সংসারের চাহিদা মিটে যাচ্ছে, বাড়ির পরিবেশে হাসি-খুশি বেড়ে উঠছে। প্রতিবেশীরাও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার স্বামী কেমন করে মোবাইল ব্যবহার করে ব্যবসা করছে?” তখন স্ত্রী গর্বভরে বলে, “সে শিখে নিয়েছে, হাল ছাড়েনি।” এই গর্ব তার চোখে এক নতুন আলো জ্বালায়। আগে সংসারের টানাপোড়েনের কারণে তাদের মধ্যে ছোটখাটো মনকষাকষি হতো, এখন সেই জায়গায় এসেছে বোঝাপড়া আর সহযোগিতা। ফেরিওয়ালা নিজেও বুঝতে পারল—পরিবার শুধু আশ্রয় নয়, তার শক্তির উৎসও বটে। প্রযুক্তির এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক স্বস্তি নয়, পারিবারিক বন্ধনকেও আরও দৃঢ় করল। এভাবে পরিবারে আসা এই ছোট ছোট পরিবর্তনই তাকে প্রতিদিন নতুনভাবে লড়াই করার সাহস জোগাতে লাগল।

শহরের ব্যস্ত ফুটপাথে যেখানে প্রতিদিন একই ভিড়, একই হট্টগোল, সেখানে ফেরিওয়ালার দোকানটাকে হঠাৎ যেন আলাদা করে চেনা যায়। আগে যেখানে সে সামান্য কিছু বিক্রি করে দিনে কষ্টে সংসার চালাত, এখন তার দোকানে গ্রাহকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কেউ কেউ আসছে সরাসরি, আবার কেউ আসছে মোবাইলের অর্ডার দেখে। আশেপাশের ফেরিওয়ালারা লক্ষ্য করতে শুরু করল—যেখানে তাদের দিনে বিক্রি আগের মতোই সীমিত, সেখানে এই লোকটার দোকান যেন একটু একটু করে জমে উঠছে। প্রথমে তারা ভেবেছিল হয়তো ভাগ্য তার সহায় হয়েছে, অথবা কোনো বিশেষ চেনাজানা আছে। কিন্তু যখন দেখল প্রতিদিন সে অর্ডারের নোটিফিকেশন পাচ্ছে, গ্রাহক এসে নাম ধরে ডাকছে, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগল—আসলে কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এই সাফল্য?

এই কৌতূহল ধীরে ধীরে আরও বড় রূপ নিতে লাগল। পাশের দোকানের এক প্রবীণ ফেরিওয়ালা একদিন মজা করে বলল, “ওরে ভাই, তুই কি যাদু শিখেছিস নাকি? এত ক্রেতা তোর দোকানে কেমন করে আসে?” অন্যরা হেসে উঠল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরেও লুকিয়ে ছিল হিংসে আর অবাক হওয়া। এক তরুণ ফেরিওয়ালা আর দেরি করতে না পেরে একদিন সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, “কাকা, সত্যি বলুন তো, আপনার দোকান কি মোবাইলের ভেতরে চলে গেছে?” ফেরিওয়ালা হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ রে, মোবাইলেই দোকান খুলেছি। যে কেউ চাইলেই অর্ডার দিতে পারে।” এই উত্তর শুনে সবার মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। তারা এতদিন ভেবেছিল মোবাইল শুধু ফোন করার বা ভিডিও দেখার জিনিস, কিন্তু ব্যবসার জন্য এটি ব্যবহার করা যায়—এ ধারণা তাদের কাছে একেবারেই নতুন ছিল।

পাড়া-প্রতিবেশীর এই নজর একদিকে তাকে গর্বিত করল, অন্যদিকে একটা চাপও তৈরি করল। কারণ সবাই এখন তার কাছ থেকে জানতে চাইছে—কীভাবে অ্যাপ ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে দোকান রেজিস্টার করতে হয়। কেউ কেউ এসে বলছে, “আমাদেরও শেখাও, আমরাও চেষ্টা করব।” ফেরিওয়ালা বুঝতে পারল, তার এই পথচলা শুধু তার ব্যক্তিগত লড়াই নয়, বরং আরও অনেকের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। সে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে অন্যদের শেখাতে শুরু করল—কীভাবে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে অর্ডার ম্যানেজ করতে হয়। একসময় যে লোকটা প্রযুক্তির নাম শুনেই ভয় পেত, সেই লোক আজ অন্যদের শিক্ষক হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তন দেখে তার নিজেরও বিস্ময় লাগে। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগে যখন পাশের ফেরিওয়ালারা বলে—“তুই পথ দেখিয়েছিস, আমরা এখন হাল ছাড়ব না।” তখন সে বুঝতে পারে, তার ছোট্ট সাফল্য এখন আশেপাশের অগণিত মানুষের স্বপ্নের আলো হয়ে উঠছে।

ফেরিওয়ালা একসময় ভেবেছিল এই মোবাইল অ্যাপ কেবল তার জন্যই আশীর্বাদ, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল—এটা পুরো সমাজের ছোট ব্যবসায়ীদের জন্যও এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। প্রতিদিন ফুটপাথে বসে সে দেখত—তার পাশের দর্জি দিনের পর দিন অর্ডারের অভাবে হতাশ হয়ে বসে থাকে, কিংবা ফলওয়ালা সন্ধ্যার পর বেচাকেনা না হওয়ায় অনেক ফল নষ্ট করে ফেলে। আবার বইওয়ালা ছেলেটি দিনের শেষে কষ্ট করে দু-চারটে বই বিক্রি করে, অথচ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর মতো সুযোগ তার নেই। এই দৃশ্যগুলো দেখে ফেরিওয়ালার মনে হল, যদি তার মতো তারাও মোবাইলের জগতে প্রবেশ করতে পারে, তবে তাদের দুঃখও কমবে। তাই একদিন রাতে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সে স্থির করল, এবার থেকে শুধু নিজের দোকান নয়, অন্যদেরও শেখাবে কেমন করে অ্যাপ ব্যবহার করতে হয়।

ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠল এক ধরনের পথপ্রদর্শক। এক বিকেলে পাশের দর্জি এসে লাজুকভাবে বলল, “ভাই, তুই কি আমাকেও শেখাবি? আমার দোকানে লোকজন আসে না, আমি যদি অ্যাপে যাই, তাহলে হয়তো ভালো হবে।” ফেরিওয়ালা তাকে নিজের পুরোনো স্মার্টফোনটা ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে সাহায্য করল। কিছুদিনের মধ্যেই দর্জিরও অর্ডার আসতে শুরু করল—কেউ প্যান্টের চেইন লাগাতে চাইছে, কেউ ব্লাউজের ফিটিং করতে চাইছে। দর্জির চোখে তখন সেই একই আনন্দের ঝিলিক দেখা গেল, যা ফেরিওয়ালার চোখে প্রথম অর্ডারের দিন ছিল। এরপর ফলওয়ালাও এগিয়ে এল। সে শিখে নিল কীভাবে প্রতিদিনের ফলের ছবি তুলে অ্যাপে দিতে হয়, কীভাবে দ্রুত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। এভাবে একজনের পর একজন তার কাছে আসতে লাগল। সে আর শুধু ফেরিওয়ালা রইল না, হয়ে উঠল এলাকার ছোট ব্যবসায়ীদের ভরসার জায়গা।

ধীরে ধীরে তৈরি হতে লাগল এক নতুন কমিউনিটি। যেখানে আগে সবাই কেবল নিজের দোকানের আয়-রোজগার নিয়ে চিন্তিত থাকত, সেখানে এখন তারা একে অপরকে সাহায্য করতে শুরু করল। বইওয়ালা তরুণ ছেলেটি এখন অনলাইনে বই বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছে। ফলওয়ালা আর খাবার নষ্ট করে না, দর্জিও নতুন গ্রাহক পাচ্ছে। সবাই মিলে একে অপরের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়—কোন গ্রাহকের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করলে ভালো রিভিউ পাওয়া যায়, কোন সময়ে পোস্ট করলে বেশি অর্ডার আসে। এই সমবেত প্রয়াস ফুটপাথের ছোট ব্যবসাগুলোকে এক নতুন রূপ দিল। ফেরিওয়ালা বুঝতে পারল, তার ছোট্ট সাহসিকতা এখন এক বিশাল পরিবর্তনের শেকড় গেড়ে দিয়েছে। একদিন সে যখন দেখল ফুটপাত জুড়ে হাসিমুখে সবাই মোবাইল হাতে নিয়ে ব্যবসা করছে, তখন মনে হল—এই পথ আর তার একার নয়, বরং সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এই কমিউনিটির ভেতরই জন্ম নিল নতুন এক শক্তি, যেখানে পরিশ্রম আর প্রযুক্তি একসাথে মিলে বদলে দিচ্ছে ছোট মানুষের জীবন।

১০

যে মানুষ একসময় ফুটপাথে বসে কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রামে দিন কাটাত, সেই মানুষই একদিন হয়ে উঠল শহরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ফেরিওয়ালার গল্প ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। স্থানীয় এক সাংবাদিক তার দোকানে এসে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলল—কীভাবে সে মোবাইল ব্যবহার শিখল, কীভাবে প্রথম অর্ডার পেল, কীভাবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে একটা নতুন কমিউনিটি গড়ে তুলল। কয়েকদিন পর সংবাদপত্রে বেরোল বড় শিরোনাম—“অ্যাপের ফেরিওয়ালা বদলাচ্ছে ফুটপাতের ব্যবসার ভবিষ্যৎ।” সেই খবর শহরের হাজারো ছোট ব্যবসায়ীর চোখে নতুন স্বপ্ন জাগাল। যারা ভেবেছিল প্রযুক্তি কেবল বড় দোকানদার আর ধনীদের হাতিয়ার, তারা হঠাৎ করে দেখল—একজন সাধারণ মানুষও প্রযুক্তিকে নিজের জীবনের হাতিয়ার করতে পারে। ফেরিওয়ালা নিজে অবাক হয়ে দেখল, পথচারীরা তাকে নতুন চোখে দেখছে, কেউ এসে হাত মেলাচ্ছে, কেউ বা বলছে, “কাকা, আপনার গল্প আমাদের সাহস জোগাচ্ছে।”

এই স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল তার দায়িত্বও। আশেপাশের ছোট ব্যবসায়ীরা এখন তাকে শুধু সহকর্মী নয়, পথপ্রদর্শক হিসেবেই দেখছে। অনেক দূরের মানুষও এসে তার সঙ্গে কথা বলে, জানতে চায় অ্যাপে দোকান রেজিস্টার করার নিয়ম, ব্যবসা চালানোর কৌশল। ফেরিওয়ালা কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। সে বলে, “আমি যা শিখেছি, তোমাদেরও শেখাবো। আমরা যদি সবাই একসাথে এগোই, তবে আর কেউ অবহেলিত থাকবে না।” ধীরে ধীরে তার দোকান যেন এক ছোট্ট কেন্দ্র হয়ে উঠল—যেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ আসছে, শিখছে, স্বপ্ন দেখছে। এমনকি কিছু স্কুল-কলেজ থেকেও তাকে ডাকা হল, ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রেরণার কথা বলতে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে বলল, “আমি বিশেষ কেউ নই, আমি কেবল একজন ফেরিওয়ালা। তবে আমি হাল ছাড়িনি। তোমরা যদি হাল না ছাড়ো, তোমাদের জীবনও বদলাতে পারে।” সেই সরল অথচ শক্তিশালী বাক্যগুলো মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে গেল।

শহরের মানুষ তাকে নতুন নামে ডাকতে শুরু করল—“অ্যাপের ফেরিওয়ালা।” এই নামের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ যাত্রা। তার গল্প শুধু ব্যবসার সাফল্যের নয়, বরং আশার, লড়াইয়ের, আর বিশ্বাসের গল্প। ফুটপাতের রোদ-বৃষ্টি, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের মাঝেও এক টুকরো আলোর সন্ধান সে খুঁজে পেয়েছিল, আর সেই আলো ভাগ করে নিয়েছিল সবার সঙ্গে। তার যাত্রা প্রমাণ করল, ছোট মানুষও বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, আর মানুষের মুখে মুখে তার গল্প ছড়িয়ে পড়তে লাগল। হাজারো ছোট ব্যবসায়ী তার গল্প শুনে আবার সাহস পেল, আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ফেরিওয়ালা তখন বুঝল—এটাই তার জীবনের আসল জয়। কারণ সে শুধু নিজের সংসার টিকিয়ে রাখেনি, বরং হয়ে উঠেছে এক অনুপ্রেরণার আলো, যা চিরকাল জ্বলতে থাকবে শহরের প্রতিটি কোণে, প্রতিটি মানুষের মনে।

সমাপ্ত

 

1000064454.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *