Bangla - প্রেমের গল্প

ফিল্ড ট্রিপের আকস্মিকতা

Spread the love

অর্পিতা দত্ত


কলেজের বার্ষিক ফিল্ড ট্রিপের ঘোষণা হতেই যেন এক ঝড় বয়ে গেল ক্লাসের ভেতর। যে ক্লাসরুমের বাতাস এতদিন ধরে শুধু পাঠ্যবই আর ল্যাবরিপোর্টের ভারে ভারী হয়ে থাকত, সেদিন সেখানে উচ্ছ্বাসের গুঞ্জন। সবাই ব্যস্ত নিজের মতো করে পরিকল্পনা করতে—কে কোন ব্যাগ নেবে, কে কী পোশাক পরবে, কোথায় ছবি তুলবে। এই উত্তেজনার ভিড়েই নিঃশব্দে বসে ছিল শ্রেয়সী।

শ্রেয়সী সবসময়ই একটু গম্ভীর মেয়ের মতো। সহপাঠীদের চোখে সে পড়াশোনায় সিরিয়াস, অন্তর্মুখী, প্রায় অদৃশ্য এক ছায়ার মতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারও কেমন এক তৃষ্ণা ছিল—কলেজ জীবনের এমন এক ভ্রমণে অংশ নেবে, যা হয়তো মনে থাকবে সারাজীবন।

যাত্রার দিন সকালে হাওড়া স্টেশন যেন মেলা। ছাত্রছাত্রীদের হইচই, ট্রলি ব্যাগের শব্দ, চায়ের ভাঁড়ের ধোঁয়া—সব মিলে উৎসব। ভিড় ঠেলে সিট খুঁজতে খুঁজতে শ্রেয়সী একটু বিপদেই পড়ল। ঠিক তখনই এক অচেনা কণ্ঠ ভেসে এলো—
“এই দিকটা ফাঁকা আছে, চাইলে বসতে পারেন।”

চোখ তুলে দেখল লম্বা এক ছেলে, হালকা নীল শার্ট, মুখে বিনয়ী হাসি। নাম অর্ক। শ্রেয়সী দ্বিধা করল, তারপর জানলার ধারে বসে পড়ল। ট্রেন চলতে শুরু করতেই বাইরের শহর গলে গিয়ে সবুজ মাঠে পরিণত হলো। দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর অর্ক নিজেই বলল,
“তুমি তো আমাদের ক্লাসেই, তাই না? তোমার নাম শ্রেয়সী?”

শ্রেয়সী একটু বিস্মিত, “তুমি চিনলে কীভাবে?”
অর্ক হেসে উত্তর দিল, “তুমি ল্যাবে সবসময় নোট খুব সুন্দর করে লেখো। সেটা মনে ছিল।”

শ্রেয়সীর গাল হালকা লাল হয়ে উঠল। জীবনে প্রথমবার মনে হলো, তার ছোট্ট অভ্যাসটাও কারও চোখ এড়ায়নি।

ট্রেন এগোতে লাগল। জানলার কাচে ভেসে উঠল বৃষ্টির ফোঁটা, চারপাশে হালকা শীতলতা। অর্ক চা কিনে আনল দু’জনের জন্য। শ্রেয়সী প্রথমে অস্বস্তি পেল, কিন্তু এক চুমুক দিতেই ভাঁড়ের গরম চা আর ভিজে বাতাসের মিলনে অদ্ভুত এক শান্তি পেল।

ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠল। পড়াশোনার বাইরে গান, বই, সিনেমা—সবকিছুতেই তাদের মিল আছে। শ্রেয়সী টের পেল, অনেকদিন পর কারও সঙ্গে এত খোলামেলা কথা বলছে সে।

বিকেলের দিকে ট্রেন ছোট ছোট স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছিল। বাইরের আকাশে মেঘ জমেছে, দূরে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের রেখা। শ্রেয়সী জানালার কাচে মুখ ঠেকিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। অর্ক হঠাৎ বলল,
“তুমি কি জানো, ভ্রমণের আসল সৌন্দর্য কোথায়?”
শ্রেয়সী ঘুরে তাকাল, “কোথায়?”
“যাদের সঙ্গে ভ্রমণ করি, তাদের চোখে।”

মুহূর্তের জন্য দু’জনের দৃষ্টি একে অপরের সঙ্গে আটকে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই পাশের বন্ধুরা হৈচৈ শুরু করায় মুহূর্তটা ভেঙে গেল। শ্রেয়সী মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল—এমন অদ্ভুত টান কি সে আগে কোনোদিন অনুভব করেছে?

রাতের দিকে ট্রেন যখন ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছল, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হোস্টেল-ডরমিটরির মতো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকল। শ্রেয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে গেল, অর্ক অন্য ছেলেদের সঙ্গে।

কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে শ্রেয়সী ভেবেছিল—আজকের যাত্রা কেবল গাছপালা বা রিপোর্টের জন্য নয়, হয়তো শুরু হলো অন্য কোনো আবিষ্কারেরও।

ক্যাম্পের প্রথম সকাল। ভোরের শিশিরে ভিজে চারদিক যেন ঝলমল করছে। অস্থায়ী ডরমিটরির ছাদে টুপটাপ ফোঁটা পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল শ্রেয়সীর। সে ধীরে ধীরে জানলার দিকে এগিয়ে গেল। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পাহাড়ের মাথা, দূরে পাখির ডাক, আর ভোরের আলোয় নরম সবুজ—মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো ছবির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।

রুমের ভেতরে বান্ধবীরা তখনও আধো ঘুমে। কেউবা ব্যস্ত চুল বাঁধছে, কেউ মোবাইলে গান চালিয়েছে। শ্রেয়সী চুপ করে ব্যাগ থেকে ফাইল আর নোটবুক বের করল। তার মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটায় কিছু আলাদা ঘটতে পারে।

প্রাতঃরাশের পর টিচাররা সবাইকে ডেকে পাঠালেন। বড় মাঠে সারি করে দাঁড় করিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। প্রতিটি গ্রুপকে আলাদা জায়গায় পাঠানো হবে নমুনা সংগ্রহের জন্য। শ্রেয়সী যখন নিজের নাম খুঁজছিল, অবাক হয়ে দেখল—অর্ক তার গ্রুপেই আছে। এক অদৃশ্য টান যেন আবার তাদের একসঙ্গে বেঁধে দিল।

গ্রুপটা বেরোল কাছের বনের দিকে। সরু রাস্তা, দুইপাশে গাছের সারি, বাতাসে মাটির গন্ধ। হাতে নোটবুক আর ব্যাগ নিয়ে সবাই হইচই করতে করতে এগোচ্ছিল। অর্ক শ্রেয়সীর পাশে এসে হাঁটতে শুরু করল। হালকা হেসে বলল,
“কাল তোমার সঙ্গে ট্রেনযাত্রাটা দারুণ কাটল। আজ কাজ করতে গিয়ে আবার টিমমেট হলাম।”
শ্রেয়সী মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হয়তো কাকতালীয়।”
অর্ক বলল, “কাকতালীয় নাকি পরিকল্পনা—ওটা সময়ই বলবে।”

শ্রেয়সী তার কথার ভঙ্গিতে একটু চমকে গেল। এত হালকা অথচ এত গভীরভাবে কেউ কোনোদিন কথা বলেনি তার সঙ্গে।

বনের ভেতরে ঢুকতেই তারা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কে কোন গাছের পাতা কেটে রাখবে, কে কী লিখে রাখবে—সবকিছু ভাগ করে দেওয়া হলো। শ্রেয়সী একটা অচেনা ফুল হাতে নিয়ে বলল,
“দেখো, এর গন্ধটা কী অদ্ভুত।”
অর্ক ঝুঁকে এসে ফুলটা শুঁকল। চোখে একরাশ বিস্ময়।
“মনে হচ্ছে যেন বৃষ্টির গন্ধ আর মাটির গন্ধ একসঙ্গে মিশেছে।”
শ্রেয়সীর ঠোঁটে অনিচ্ছাকৃত হাসি ফুটে উঠল।

দুপুর নাগাদ সবাই এক খোলা মাঠে জড়ো হলো। ব্যাগ থেকে টিফিন বের করা হলো। সবাই মিলে খেতে খেতে গল্প-ঠাট্টা। হঠাৎ এক ঝোড়ো হাওয়ায় শ্রেয়সীর চুল উড়ে এসে চোখ ঢেকে দিল। অর্ক হাত বাড়িয়ে তার কপাল থেকে চুলটা সরিয়ে দিল। মুহূর্তটা যেন সময় থমকে যাওয়ার মতো। শ্রেয়সী কিছু বলতে পারল না, শুধু লজ্জায় চোখ নামিয়ে রইল।

ফিরে আসার পথে ছোট্ট এক ঝর্ণার ধারে সবাই থামল। পানির শব্দে চারদিক মুখর। শ্রেয়সী পাথরের উপর বসে জুতো খুলে পা ডুবিয়ে দিল ঠান্ডা জলে। অর্ক পাশে এসে বসে বলল,
“তুমি জানো, আমি সবসময় ভেবেছিলাম এ রকম ট্রিপ কেবল পড়াশোনার জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এর ভেতরে আরও কিছু আছে।”
শ্রেয়সী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল।
“কী রকম কিছু?”
অর্ক হেসে বলল, “যা কেবল অনুভব করা যায়, বলা যায় না।”

শ্রেয়সী চুপ করে গেল। ভেতরে কোথাও যেন হালকা কাঁপুনি ছড়াল।

সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফেরার পর গিটার নিয়ে কয়েকজন বসেছিল। ক্যাম্পফায়ার জ্বলল, চারপাশে গান। অর্ক হঠাৎ শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি গান গাও?”
শ্রেয়সী ইতস্তত করে বলল, “শুধু নিজের মনে।”
অর্ক গিটারটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আজ চেষ্টা করো। আমি বাজাব।”

সবার অনুরোধে শ্রেয়সী অবশেষে গান শুরু করল—
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…”
গলার সুর ভেসে গেল রাতের অন্ধকারে। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শ্রেয়সীর চোখ অনিচ্ছাকৃতভাবে অর্কর দিকে গিয়ে আটকে রইল। গিটার বাজানো আর চোখের দৃষ্টি যেন একই সুরে বাঁধা।

গান শেষ হতেই হাততালিতে ভরে উঠল চারদিক। শ্রেয়সী লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা কথা স্পষ্ট হয়ে উঠল—এই ভ্রমণ শুধুই শিক্ষার জন্য নয়, এর ভেতরে আরও কিছু আছে, যা সে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছে।

রাতে ডরমিটরিতে ফিরে বান্ধবীরা মজা করে বলল,
“শ্রেয়সী, আজ তো তুমি সবাইকে অবাক করে দিলে!”
শ্রেয়সী হেসে উড়িয়ে দিলেও ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল, আজকের দিনটা তাকে বদলে দিল।

অন্যদিকে অর্ক নিজের ডায়েরিতে লিখল—
“আজ বুঝলাম, এই ভ্রমণ শুধু গাছপালা চেনা নয়। শ্রেয়সীর চোখে আমি এক অন্য পৃথিবী দেখছি।”

পরের দিন সকাল থেকেই টেনশন যেন একটু অন্যরকম ছিল। টিচাররা জানালেন, আজ সবাইকে আলাদা আলাদা গ্রুপে ভাগ করে পাহাড়ি ঝোপঝাড়ে যেতে হবে। কাজটা ছিল বেশ কঠিন—অপরিচিত পরিবেশ, সরু খাড়া রাস্তা আর চারপাশে বন্য প্রকৃতি। কেউ কেউ উত্তেজিত, কেউবা ভয় পাচ্ছিল।

শ্রেয়সী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যখন বেরোল, তখনো তার কানে বাজছিল গত রাতের গান আর হাততালির শব্দ। ভিড়ের মধ্যে অর্ককে দেখেই হালকা হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। অর্কও কাছে এসে বলল,
“আজকের দিনটা মনে রাখার মতো হবে, দেখো।”

দলটা বেরোল সরু পাথুরে পথ ধরে। বাতাসে শুকনো পাতার গন্ধ, দূরে পাখির ডাক, আর গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রোদের ঝলকানি। শ্রেয়সী আর অর্ক পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কখন যে দল থেকে একটু পিছিয়ে গেল বুঝতেই পারেনি।

তাদের সামনে এক জটলা—কেউ ঔষধি গাছ সংগ্রহ করছে, কেউ ছবি তুলছে। ঠিক সেই সময় শ্রেয়সীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মেঘলা এগিয়ে এসে মজা করে বলল,
“এই যে, তোমরা দু’জন আবার একসঙ্গে? শ্রেয়সী, তুই আমাদের দলে থাকবি নাকি অর্কর সঙ্গেই সারাদিন?”

কথাটা হালকা খুনসুটি হলেও অর্কের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সে ঠান্ডা গলায় বলল,
“ঠিক আছে, তুমি ওদের সঙ্গেই থাকো। আমি একাই ম্যানেজ করব।”

শ্রেয়সী থমকে গেল।
“অর্ক, এটা তুমি কী বলছো? এটা তো গ্রুপের কাজ।”
অর্ক মুখ ফিরিয়ে নিল, “হয়তো আমি বাড়তি হয়ে যাচ্ছি।”

মুহূর্তেই চারপাশের রোদ যেন ম্লান হয়ে গেল। শ্রেয়সীর ভেতরে রাগ আর কষ্ট মিশে ঢেউ তুলল। সে কিছু না বলে অন্যদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল।

বিকেলে যখন সবাই প্রেজেন্টেশনের জন্য নোট বানাচ্ছিল, তখনও অর্ক আর শ্রেয়সী প্রায় কথা বলেনি। অর্ক ব্যস্ত নিজের কাগজপত্রে, শ্রেয়সীও মাথা গুঁজে লিখছিল। আশেপাশের বন্ধুরা বুঝতেই পারছিল না, তাদের মধ্যে কী ঘটছে।

রাতে ক্যাম্পফায়ারের সময় সবাই গিটার নিয়ে গান ধরল। নাচ-গান, হাসি-ঠাট্টা—সব চলছিল। শ্রেয়সী সেই ভিড়েও একা লাগছিল। আগের দিনের মতো আনন্দ পাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, অর্ক কেন এমন আঘাতের মতো কথা বলল?

অন্যদিকে, অর্ক আগুনের পাশে বসে চুপচাপ গিটার টানছিল, কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলছিল না। তার মনে হচ্ছিল, শ্রেয়সী হয়তো সত্যিই তাকে গুরুত্ব দেয় না।

রাত গভীর হলে শ্রেয়সী জানলার পাশে দাঁড়াল। আকাশে তারা ভরা, দূরে পাহাড়ের কালো ছায়া। মনে হচ্ছিল, এই সুন্দর রাতও যেন এক অদৃশ্য ভারে ঢেকে গেছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করল—“এটা কি কেবল বন্ধুত্ব? নাকি আমি সত্যিই অর্ককে হারানোর ভয় পাচ্ছি?”

অন্যদিকে, অর্ক ডায়েরিতে লিখল—
“কেন যেন আমি বারবার মনে করি, শ্রেয়সী আমাকে ভুলে যাবে। হয়তো ওর বন্ধুদের ভিড়ে আমার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু আমি কি এত সহজে ওকে ছেড়ে দিতে পারব?”

সেই রাতে দু’জনেই অস্থির ঘুমে কাটাল। সম্পর্কের প্রথম টানাপোড়েন যেন তাদের সামনে নতুন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল—ভুল বোঝাবুঝি কি তাদের দূরে সরিয়ে দেবে, নাকি আরও কাছে টেনে আনবে?

সকালের আলো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছিল, বাতাসে কুয়াশার গন্ধ। ক্যাম্পে তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেছে, আজকের কাজ ছিল নদীর ধারে মাঠ সার্ভে। শ্রেয়সী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু মন যেন অদৃশ্য ভারে চেপে আছে। আগের রাতের ঘটনাটা বারবার মাথায় ঘুরছিল।

অর্ককে দেখেই তার বুক কেঁপে উঠল। ছেলেটা ব্যস্ত অন্যদের সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু চোখের কোণে বিষণ্ণতা স্পষ্ট। শ্রেয়সী নিজেকে সামলে নিল। ভাবল—আজ না হলে আর কখনোই নয়।

দলটা নদীর ধারে পৌঁছল। জল চকচক করছে রোদের আলোয়, বাতাসে ভিজে গন্ধ। সবাই ব্যস্ত নমুনা সংগ্রহে, নোট লিখছে। সেই ফাঁকে শ্রেয়সী অর্ককে আলাদা করে ডাকল।

“অর্ক, একবার কথা হবে?”
অর্ক অবাক হয়ে তাকাল। তার চোখে অনিশ্চয়তা।
“কী নিয়ে?”
শ্রেয়সী নিঃশ্বাস ফেলল, “গতকাল তুমি যে কথাগুলো বলেছিলে, সেগুলো আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। আমি চাই না তুমি ভাবো আমি তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। বরং আমি…” সে থেমে গেল, গলার স্বর কেঁপে উঠল।

অর্ক ধীরে ধীরে বলল, “আমিও চাইনি তোমাকে কষ্ট দিতে। আমি শুধু ভয় পাই…তুমি আমাকে ভুলে যাবে, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবে।”

শ্রেয়সী চুপ করে তার চোখের দিকে তাকাল। তারপর নরম গলায় বলল,
“যাদের কাছে আমরা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, তারা কখনো হারায় না। তুমি সেটা বোঝো না?”

অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। সেই হাসি শ্রেয়সীর বুকের ভেতর জমে থাকা সব অভিমান গলিয়ে দিল।

দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়াল নদীর ধারে। দূরে সহপাঠীদের হাসি-চিৎকার ভেসে আসছিল, কিন্তু তাদের চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা। শ্রেয়সীর মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে পৃথিবীটা কেবল তাদের দু’জনের জন্যই থেমে গেছে।

ফিরতি পথে নৌকায় বসে অর্ক বলল,
“তুমি জানো, আমি কতদিন ধরে এই ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম? কিন্তু ভাবিনি এখানে এসে তোমার মতো কাউকে এতটা কাছের পাব।”
শ্রেয়সী কিছু না বলে নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“হয়তো ভ্রমণ আমাদের এমন কিছু দেখায়, যা আমরা খুঁজতেই যাই না। এই টানটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না।”

অর্ক মুচকি হেসে বলল, “তাহলে এটাকে ব্যাখ্যা করো না। শুধু অনুভব করো।”

সন্ধ্যায় ক্যাম্পে ফেরার পর গিটার আবার বাজল। এবার অর্ক বাজাচ্ছিল, আর শ্রেয়সী পাশে বসেছিল। কেউ গান চাইলে সে মৃদু গলায় গাইতে শুরু করল। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চারপাশে হাসি-আনন্দ চলছিল, অথচ শ্রেয়সী–অর্কর চোখে যেন কেবল একে অপরই প্রতিফলিত হচ্ছিল।

রাতে শ্রেয়সী ডরমিটরির জানলা খুলে দাঁড়িয়েছিল। আকাশে অগণিত তারা, দূরে পাহাড়ের কালো অবয়ব। মনে হচ্ছিল, তার জীবনও যেন নতুন কোনো নক্ষত্র খুঁজে পেয়েছে।

অন্যদিকে, অর্ক তার ডায়েরিতে লিখছিল—
“আজ আমি বুঝলাম, শ্রেয়সী কেবল বন্ধু নয়। ও আমার নিঃশ্বাসের মতো। আমি তাকে হারাতে চাই না, কোনোদিনই না।”

সে রাতে দু’জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তবে অভিমান আর দ্বিধার জায়গায় এবার জেগে উঠল নতুন স্বপ্নের আলো।

শেষ দিনের সকালটা ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতিতে ভরা। ক্যাম্পে সবাই ব্যস্ত ব্যাগ গোছাচ্ছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউবা শেষবারের মতো পাহাড়-ঝর্নার দৃশ্য চোখে ভরে নিচ্ছে। চারদিনের একসঙ্গে থাকা, গান, আড্ডা, গবেষণা—সবকিছুই আজ শেষ হয়ে যাবে ভেবে যেন হালকা বিষণ্ণতা নামল সবার চোখেমুখে।

শ্রেয়সী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, কুয়াশার আড়াল থেকে রোদ উঠতে দেখছিল। তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপা দুঃখ। মনে হচ্ছিল, অর্ককে আর এভাবে প্রতিদিন কাছে পাওয়া যাবে না। এই ভ্রমণ কি শুধু কয়েকটা স্মৃতি হয়েই থাকবে?

অর্কও ব্যাগ গোছাতে গোছাতে চুপচাপ ছিল। তার সঙ্গীরা যখন মজা করছে, হাসছে, সে যেন ভিন্ন এক জগতে। চোখে বারবার ভেসে উঠছিল শ্রেয়সীর মুখ, তার মৃদু হাসি, গান গাওয়ার সময়ের সেই সুরেলা কণ্ঠ।

দুপুরে ট্রেন ধরার আগে সবাই শেষবার মাঠে জড়ো হলো। শিক্ষকরা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। ছবি তোলার হিড়িকে ভিড় জমল। শ্রেয়সী আর অর্কও একই ফ্রেমে এলো, কিন্তু একে অপরের চোখে তাকাতে পারল না।

ট্রেনে ফেরার সময় তারা পাশাপাশি সিট পেল। চারপাশে হৈচৈ, গান, গল্প—কিন্তু তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা। অর্ক বারবার মনে করছিল, কিছু একটা বলতে হবে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। শ্রেয়সীও জানত, এই নীরবতা যদি ভাঙা না যায়, তবে হয়তো দূরত্ব তৈরি হবে।

অবশেষে শ্রেয়সী নিজেই মুখ খুলল।
“অর্ক, তুমি কি মনে করো এই ক’দিন শুধু ভ্রমণের আবহ ছিল? নাকি এর ভেতরে কিছু অন্য রকম?”

অর্ক থমকে গেল। তারপর আস্তে বলল,
“আমি জানি না এটাকে কী নামে ডাকব, কিন্তু আমি জানি, তোমাকে ছাড়া আর কোনো ভ্রমণ আমার পূর্ণ হবে না।”

শ্রেয়সীর চোখে জল এসে গেল। জানলার বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই তাদের অনুভূতির সাক্ষী।

স্টেশনে পৌঁছেই ভিড়ের মধ্যে সবাই ছড়িয়ে গেল। বন্ধুদের বিদায়, হাসি, আলিঙ্গন—সব মিলিয়ে এক অস্থিরতা। শ্রেয়সী যখন ব্যাগ নিয়ে এগোচ্ছিল, পিছন থেকে অর্ক ডেকে উঠল,
“শ্রেয়সী—”

সে ঘুরে তাকাল।
অর্ক ভিড়ের মাঝেই বলল, “কলেজে দেখা হবে… প্রতিদিন। আর এবার তোমাকে হারাতে দেব না।”

শ্রেয়সী কিছু বলল না। শুধু মৃদু হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। সেই হাসিতে ছিল এক নীরব প্রতিশ্রুতি।

কলেজে ফিরেই ব্যস্ত রুটিন শুরু হলো। ল্যাব, ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট—সব যেন আগের মতো। কিন্তু শ্রেয়সীর কাছে সবকিছুই নতুন লাগছিল। করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া অর্ক, লাইব্রেরিতে একই টেবিলে বসা, ক্যান্টিনে একসঙ্গে চা ভাগ করা—সবই যেন তাদের সম্পর্ককে ধীরে ধীরে নতুন রূপ দিচ্ছিল।

একদিন শ্রেয়সী ক্যান্টিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ক এসে পাশে দাঁড়াল। বলল,
“তুমি জানো, সেই ট্রিপটাই আমার জীবন বদলে দিল।”
শ্রেয়সী হেসে বলল, “আমারও।”

মুহূর্তটুকু ছিল ছোট, কিন্তু সেই ছোট্ট মুহূর্তেই তারা বুঝে গেল—এখন আর ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই।

রাতে শ্রেয়সী ডায়েরির পাতায় লিখল—
“প্রেম কখনো পরিকল্পনা করে আসে না। ঠিক যেমন আসে এক ফিল্ড ট্রিপের ভিড়ের মাঝে, এক ট্রেনযাত্রার জানলায়, এক ঝর্ণার ধারে দাঁড়িয়ে। অর্ক আমার সেই আকস্মিক আবিষ্কার, যাকে ছাড়া আর কোনো ভ্রমণ পূর্ণ হতে পারে না।”

অন্যদিকে অর্কও লিখল—
“শ্রেয়সী আমার কাছে শুধু এক মেয়ের নাম নয়। সে আমার সুর, আমার আলো, আমার ভয় আর আমার সাহস। এই গল্পের শেষ নেই—এটা কেবল শুরু।”

কলেজে ফেরা মানেই আবার নতুন ছন্দ—ক্লাস, প্রজেক্ট, ল্যাব, পরীক্ষা। ট্রিপের হইচই যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শ্রেয়সী ও অর্কর ভেতরে জমে থাকা অনুভূতি আরও স্পষ্ট হচ্ছিল।

তবে ভিড়ের ভেতর সবকিছু সহজ ছিল না। শ্রেয়সীর বান্ধবীরা শুরু করল ঠাট্টা—
“এই যে শ্রেয়সী, তুই নাকি ফিল্ড ট্রিপ থেকে নতুন ‘বন্ধু’ নিয়ে ফিরেছিস?”
শ্রেয়সী লজ্জা পেয়ে এড়িয়ে যেত, কিন্তু ভিতরে কোথাও একটা অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল।

অন্যদিকে, অর্করও কিছু বন্ধুরা খোঁচা মারত—
“ওই যে, তোর গান-গল্পের সঙ্গী কোথায়? এখন তো ক্লাসে একসঙ্গেই বসিস।”
অর্ক প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও, পরে মনে হতো—শ্রেয়সী হয়তো এসব শুনে বিরক্ত হচ্ছে।

একদিন ল্যাবে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে তারা দু’জন পাশাপাশি কাজ করছিল। শ্রেয়সী মন দিয়ে নোট নিচ্ছিল, অর্ক যন্ত্রপাতি সামলাচ্ছিল। হঠাৎ মেঘলা এসে জিজ্ঞেস করল,
“শ্রেয়সী, আজ তুই আমাদের সঙ্গে লাইব্রেরিতে যাবি তো? নাকি অর্কর সঙ্গে বিশেষ পরিকল্পনা আছে?”

চারপাশে কয়েকজন হেসে উঠল। শ্রেয়সীর গাল লাল হয়ে গেল। সে বিরক্ত স্বরে বলল,
“এমন বাজে কথা বলছো কেন?”

অর্ক সেটা শুনে ভেতরে ভেতরে চুপ করে গেল। তার মনে হলো, হয়তো সত্যিই শ্রেয়সী এসব নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। ক্লাস শেষে সে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল। শ্রেয়সী ডাকতে গিয়েও থেমে গেল—দু’জনের মধ্যে হালকা দূরত্ব তৈরি হলো।

পরের সপ্তাহে কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। শ্রেয়সী গান গাইবার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল, আর অর্ক গিটার বাজাবে। রিহার্সালে তারা একসঙ্গে বসত, কিন্তু আগের মতো খোলামেলা আলাপ আর হতো না।

রিহার্সালের একদিন, শ্রেয়সী মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অর্ক গিটার বাজাচ্ছিল, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও। সুর কেটে যাচ্ছিল বারবার। শ্রেয়সী বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি মন দিয়ে বাজাচ্ছো না কেন?”
অর্ক তাকাল, “তাহলে তুমি অন্য কাউকে নিয়ে বাজাও।”

শ্রেয়সীর বুক হুহু করে উঠল। সে কিছু না বলে মাইক্রোফোন নামিয়ে চলে গেল।

রাতটা অস্থিরতায় কাটল দু’জনের। শ্রেয়সী বিছানায় শুয়ে ভাবছিল, “আমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছি? এটা কি সত্যিই প্রেম?” অন্যদিকে অর্ক জানালার ধারে বসে গিটার ছুঁয়ে বলল, “কেন আমি এত সহজে রাগ করি? আমি কি তাকে হারাতে চাইছি?”

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন এলো। হলঘরে ভিড় জমেছে। আলো-আঁধারির মধ্যে মঞ্চ ঝলমল করছে। শ্রেয়সী ভেতরে ভেতরে নার্ভাস ছিল। মঞ্চে উঠতেই সে লক্ষ্য করল—অর্ক পাশে বসে গিটার নিয়ে প্রস্তুত, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত গম্ভীরতা।

গান শুরু হলো। শ্রেয়সী গাইল—
“তুমি রবে নিরবে, হৃদয়ে মম…”
অর্ক গিটার বাজাচ্ছিল নিখুঁত সুরে। তাদের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য মিলল। সুর আর কণ্ঠ মিলে যেন পুরো হলঘরকে ভরিয়ে দিল। শ্রোতারা হাততালি দিল, কিন্তু দু’জনের মনে হচ্ছিল—এই সুর আসলে একে অপরের জন্যই।

অনুষ্ঠান শেষে ভিড়ের মধ্যে অর্ক শ্রেয়সীর পাশে এসে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে বলল,
“আজ বুঝলাম, আমি তোমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।”
শ্রেয়সীর চোখে জল চলে এলো। সে ফিসফিস করে বলল,
“আমিও।”

তাদের সম্পর্ক নতুন করে দৃঢ় হলো। তবুও বাইরের জগৎ সহজ ছিল না। গসিপ, বন্ধুর খোঁচা, পড়াশোনার চাপ—সবকিছু তাদের পরীক্ষা নিচ্ছিল। কিন্তু এবার তারা একসঙ্গে দাঁড়াতে শিখল।

শ্রেয়সী ডায়েরিতে লিখল—
“প্রেম মানেই শুধু সুন্দর মুহূর্ত নয়। এর ভেতরে থাকে পরীক্ষা, অভিমান, ভয়। কিন্তু যদি কেউ সত্যিই তোমার হয়, তবে সেই সবকিছুর মধ্যেই থাকে টিকে থাকার শক্তি।”

অর্কও লিখল—
“আজ থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কোনো অভিমান আমাকে ওর থেকে দূরে সরাবে না। শ্রেয়সী আমার সবচেয়ে বড় সাহস।”

শীত পড়তে শুরু করেছে। কলেজের করিডোরে সকালের কুয়াশা জমে থাকছে, ক্যান্টিনে চা-ভাজির গন্ধে গরম ধোঁয়া উড়ছে। শ্রেয়সী আর অর্কর দিনগুলো ধীরে ধীরে অন্য রকম ছন্দে বাঁধা পড়ছিল। এখন আর শুধু ট্রিপের স্মৃতি নয়, প্রতিদিনের দেখা, একসঙ্গে ক্লাস, কিংবা লাইব্রেরির নির্জন কোণে পড়াশোনা—এসবই যেন তাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করে তুলছিল।

কিন্তু ভিড়ের চোখ বড় কঠিন। বন্ধুরা খোঁচা দিতেই থাকে—
“এই তো, নতুন জুটি! কবে টিফিন ভাগাভাগি শুরু করবে?”
কেউবা মজা করে বলত, “পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও একসঙ্গে লিখতে শুরু করো।”

শ্রেয়সী এসব শুনে লজ্জা পেত, কিন্তু অর্কর মনে হতো—এটা শুধু মজা নয়, এর আড়ালে আছে চাপ। সে ভয় পেত, শ্রেয়সী হয়তো এসব নিয়ে বিরক্ত হবে।

একদিন লাইব্রেরিতে তারা একসঙ্গে বসেছিল। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে পড়াশোনা করছিল, কিন্তু চারপাশের ফিসফিসানি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। দু’জন মেয়ে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলল,
“দেখেছিস, এরা আবার একসঙ্গে? ট্রিপটা মনে হয় কিছু বিশেষ করে দিয়েছে।”
শ্রেয়সীর হাতের কলম থমকে গেল। অর্ক তাকিয়ে বুঝল, তার মুখ ভারী হয়ে গেছে।

বিকেলে ক্যান্টিনে বসে শ্রেয়সী হঠাৎ বলল,
“অর্ক, আমাদের নিয়ে সবাই এত কথা বলে কেন? আমি মাঝে মাঝে খুব অস্বস্তি বোধ করি।”
অর্ক একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিল,
“কারণ আমরা আলাদা হয়ে গেছি। ভিড়ের মধ্যে যাদের টান আলাদা হয়, তারা সবসময় নজরে পড়ে।”
শ্রেয়সী অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু আমি চাই না আমাদের সম্পর্কটা গসিপে ঢাকা পড়ুক।”

অর্ক টেবিলের উপর হাত রেখে বলল,
“তাহলে আমাদের আরও শক্ত হতে হবে। বাইরে কী বলছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভেতরে আমরা একে অপরের কাছে সত্য হলে সবকিছু সহজ হবে।”

শীতের ছুটির আগে পরীক্ষা শুরু হলো। পড়াশোনার চাপ হঠাৎ বেড়ে গেল। শ্রেয়সী লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছিল, অর্কও ব্যস্ত নিজের প্রস্তুতিতে। তবু তারা প্রতিদিন কয়েক মিনিট হলেও দেখা করত। করিডোরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট আলাপ, বা একসঙ্গে চা—এসবই যেন অক্সিজেন হয়ে উঠেছিল।

একদিন রাত করে পড়াশোনা শেষে শ্রেয়সী হোস্টেলে ফিরছিল। হঠাৎ ফোনে মেসেজ এল—অর্ক লিখেছে,
“তুমি ঠিকঠাক পৌঁছালে জানিও। রাত অনেক হয়েছে।”
শ্রেয়সীর ঠোঁটে অজান্তেই হাসি ফুটল। সে উত্তর দিল,
“পৌঁছে গেছি। চিন্তা কোরো না।”
তারপর ডায়েরিতে লিখল—
“যে চিন্তা করে, যে খেয়াল রাখে, সেই তো আসল আপন। অর্ক আমার আপন হয়ে উঠছে।”

তবে চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হলো ফাইনাল পরীক্ষার সময়। শ্রেয়সী পড়াশোনায় সবসময় সিরিয়াস, কিন্তু অর্ক কিছুটা নির্লিপ্ত। শ্রেয়সী তাকে বারবার বলত,
“অর্ক, তুমি যদি মন দিয়ে পড়ো না, তাহলে নম্বর কমে যাবে।”
অর্ক হেসে উড়িয়ে দিত, “তুমি আছো তো, আমাকে বাঁচাবে।”

কিন্তু পরীক্ষার প্রথম পেপারে অর্ক সত্যিই ভালো করতে পারল না। ফলাফল দেখে তার মুখ ভারী হয়ে গেল। বন্ধুরা মজা করে বলল,
“প্রেম করলে পড়াশোনা থাকে নাকি? তাই অবস্থা খারাপ।”
অর্ক এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল, তারপর রাগী গলায় বলল,
“আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে না।”

শ্রেয়সী এসব দেখে কষ্ট পেল। পরীক্ষার শেষে সে অর্ককে ডেকে বলল,
“তুমি কেন রাগ করলে? মজা করছিল ওরা।”
অর্ক গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
“তুমি বুঝবে না শ্রেয়সী। সবাই ভাবে আমি শুধু তোমার ওপর ভর করে আছি। আমি চাই না তুমি কখনো লজ্জা পাও।”

শ্রেয়সী বিস্মিত, “আমি কেন লজ্জা পাব?”
অর্ক ধীরে ধীরে বলল, “কারণ আমি হয়তো তোমার সমান হয়ে উঠতে পারছি না।”

কথাটা শ্রেয়সীর বুকের ভেতর গভীর দাগ কাটল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল,
“অর্ক, প্রেম মানে সমান নম্বর আনা নয়। প্রেম মানে একে অপরকে শক্তি দেওয়া। তুমি যদি সত্যিই আমাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবো, তবে তোমাকে নিজের ওপর ভরসা রাখতে হবে।”

অর্কের চোখ ভিজে উঠল। সে আস্তে বলল,
“আমি চেষ্টা করব, শ্রেয়সী।”

ফাইনাল পরীক্ষার পর কিছুটা অবসর এল। কলেজে আবার চেনা ছন্দ ফিরে এল—সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, আড্ডা। শ্রেয়সী আর অর্ক একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে নতুন সাহস পেল।

একদিন কলেজের মাঠে বসে শ্রেয়সী বলল,
“অর্ক, আমরা অনেক কথা বলি, কিন্তু একটা জিনিস এখনো বলিনি।”
অর্ক অবাক হয়ে তাকাল, “কী?”
শ্রেয়সী হেসে উত্তর দিল,
“আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাই।”

অর্ক মৃদু হেসে তার হাত ধরল।
“আমিও পাই। কিন্তু ভয় থাকলেই তো বোঝা যায় আমরা সত্যিই একে অপরকে চাই।”

সেদিন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, মাঠ ভিজে যাচ্ছিল শীতের শিশিরে। চারপাশে বন্ধুরা খেলে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু শ্রেয়সী আর অর্কর কাছে পৃথিবী থমকে গিয়েছিল।

তাদের সম্পর্ক নতুন এক স্তরে পৌঁছল—যেখানে ভয় আছে, চাপ আছে, কিন্তু তার থেকেও বড় আছে আস্থা।

শীত গিয়ে গ্রীষ্ম আসছিল। কলেজের পরীক্ষা শেষ, নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। শ্রেয়সী ও অর্কর সম্পর্ক এখন অনেকটা স্থিতিশীল—বন্ধুরা আর শুধু মজা করত না, সবাই মেনে নিয়েছিল যে তারা একে অপরের কাছাকাছি। কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জও এসে দাঁড়াল—পরিবার আর ভবিষ্যতের চিন্তা।

শ্রেয়সীর বাড়ি কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা স্কুলশিক্ষক, মা গৃহিণী। তারা সবসময়ই চাইতেন, মেয়েটা ভালো পড়াশোনা করে মাস্টার্স করবে, চাকরি করবে। প্রেম বা সম্পর্ক নিয়ে কোনো কথা হয়নি কখনো। শ্রেয়সী জানত, তারা যদি শুনে ফেলে যে সে কারও সঙ্গে এতটা কাছাকাছি, তাহলে হয়তো একদিন কঠিন প্রশ্ন করবে।

অন্যদিকে, অর্কর পরিবার একটু ভিন্ন। বাবা ব্যবসায়ী, মা কলেজশিক্ষিকা। অর্কর জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খানিকটা স্বাধীন—সে গান ভালবাসত, ভ্রমণ ভালবাসত, আর পড়াশোনার চাপকে কখনো খুব গুরুত্ব দিত না। পরিবার তার ইচ্ছেকে মানত, তবে প্রত্যাশাও ছিল যে অর্ক একদিন বাবার ব্যবসা সামলাবে।

একদিন শ্রেয়সী বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে কাজ করছিল। মা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
“কলেজে ট্রিপ কেমন কাটল?”
শ্রেয়সী চমকে গেল, কিন্তু নিজেকে সামলে বলল,
“ভালোই… অনেক কিছু শিখেছি।”
মা তাকালেন, “শুনলাম তোমাদের ক্লাসে এক ছেলে গিটার বাজায়, নাম কী যেন… অর্ক?”
শ্রেয়সীর হাত থেকে কাঁচা সবজি প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। সে দ্রুত উত্তর দিল,
“হ্যাঁ, আছে তো… খুব ভালো বাজায়।”
মা মৃদু হাসলেন, “গান-বাজনা ভালো, তবে পড়াশোনায় মন রাখতে হবে।”

শ্রেয়সী জানল, পরিবারের সামনে নিজের অনুভূতি নিয়ে এত সহজে কিছু বলা যাবে না।

অন্যদিকে, অর্ক একদিন শ্রেয়সীকে বলল,
“শোনো, আমার বাবা চায় আমি একদিন ওনার ব্যবসায় ঢুকি। আমি জানি না আমি সেটা চাই কিনা।”
শ্রেয়সী অবাক, “তাহলে তুমি কী করতে চাও?”
অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আমি আসলে গানকেই চাই। আমি চাই একদিন নিজের ব্যান্ড তৈরি করতে, মঞ্চে দাঁড়াতে। কিন্তু সেটা কি বাস্তবসম্মত?”

শ্রেয়সী চুপ করে গেল। তার ভেতরে ভয় জেগে উঠল—যদি অর্কর স্বপ্ন আর তার নিজের জীবনের লক্ষ্য একসময় মেলে না?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হলো। শ্রেয়সী পড়াশোনায় মন দিচ্ছিল, মাস্টার্সের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অর্ক ব্যস্ত ছিল সঙ্গীতে।

একদিন শ্রেয়সী লাইব্রেরিতে পড়ছিল। অর্ক এসে বলল,
“তুমি প্রতিদিন এত পড়ছো, আমার সঙ্গে সময় কাটাও না।”
শ্রেয়সী বিরক্ত হয়ে বলল,
“অর্ক, সবসময় গান আর আড্ডা দিয়ে জীবন চলে না। আমাদের ভবিষ্যত আছে।”
অর্ক চুপ করে গেল, তারপর বলল,
“তাহলে কি আমি তোমার ভবিষ্যতের সঙ্গে মানানসই নই?”

কথাটা শ্রেয়সীর বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধল। সে কিছু বলল না, শুধু বই বন্ধ করে চলে গেল।

রাতে শ্রেয়সী বিছানায় শুয়ে চোখের জল মুছছিল। তার মনে হচ্ছিল, অর্ককে হারানোর ভয় সত্যিই যদি সত্য হয়, তবে তার কারণ শুধু ভিড় নয়, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাও।

অন্যদিকে, অর্কও ডায়েরিতে লিখছিল—
“আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু যদি আমার স্বপ্নই ওর কাছে বোঝা হয়, তাহলে কি এই সম্পর্ক টিকবে?”

কয়েকদিন তারা একে অপরের সঙ্গে খুব কম কথা বলল। করিডোরে চোখাচোখি হলে শুধু ছোট্ট হাসি, কোনো আলাপ নেই।

এক বিকেলে শ্রেয়সী কলেজের মাঠে একা বসে ছিল। হঠাৎ অর্ক এসে পাশে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমরা কি একে অপরকে ভুল পথে বোঝাচ্ছি?”
শ্রেয়সী তাকাল, চোখ ভিজে।
“হয়তো। কিন্তু আমি চাই তুমি তোমার স্বপ্ন ত্যাগ করো না। আমি শুধু চাই তুমি ভেবে দেখো, আমাদের দু’জনের স্বপ্ন কি একসঙ্গে হাঁটতে পারে?”

অর্ক মৃদু হেসে বলল,
“হয়তো পারে। হয়তো আমরাই তাকে একসঙ্গে হাঁটাতে পারব।”

সেদিন সূর্যাস্তের আলোয় মাঠ ভিজে যাচ্ছিল। তাদের চোখে আবার সেই পুরনো বিশ্বাস ফিরে এলো—দ্বন্দ্ব আছে, ভয় আছে, কিন্তু সম্পর্ক টিকে থাকবে যদি তারা একে অপরকে বুঝতে শেখে।

শ্রেয়সী ডায়েরিতে লিখল—
“প্রেম মানে শুধু একসঙ্গে থাকা নয়। প্রেম মানে ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নকে একই আকাশের নিচে জায়গা দেওয়া।”

অর্ক লিখল—
“আমার গান যদি আমার শ্বাস হয়, তবে শ্রেয়সী আমার আলো। আমি চাই, এই দুটো কখনো আলাদা না হয়।”

গ্রীষ্মের বিকেলগুলোতে কলেজের আঙিনা গরমে ঝলমল করছিল। শ্রেয়সী ব্যস্ত ছিল মাস্টার্সের এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতিতে, আর অর্ক তার ব্যান্ডের রিহার্সালে। তাদের দেখা হচ্ছিল আগের থেকে কম, কথাও কমে যাচ্ছিল। তবু ভেতরে ভেতরে দু’জনেই জানত—একটি অদৃশ্য সুতোতে তারা বাঁধা।

কিন্তু সেই সুতোটাই একদিন হঠাৎ টান খেয়ে ছিঁড়ে যাওয়ার মতো হলো।

সেদিন কলেজের ক্যান্টিনে শ্রেয়সী বান্ধবীদের সঙ্গে বসেছিল। হঠাৎই সে দেখল, অর্ক পাশের টেবিলে অন্য বিভাগের এক মেয়ের সঙ্গে বেশ হাসাহাসি করছে। মেয়েটি গিটার হাতে কিছু লিখছে, অর্ক তাকে শেখাচ্ছে। দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্য।

শ্রেয়সীর বুকের ভেতর কেমন যেন ঝড় উঠল। সে কিছু না বলে উঠে চলে গেল। কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি আড়াল করতে পারল না—অভিমান, রাগ আর একধরনের অজানা ভয়।

সেদিন রাতে অর্ক ফোন করল।
“শ্রেয়সী, তুমি আজ ক্যান্টিন থেকে এভাবে চলে গেলে কেন?”
শ্রেয়সী গলা শক্ত করে বলল,
“তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলার সময় পাও না? তাই অন্যদের সঙ্গে বসে হাসি-ঠাট্টা করছ?”
অর্ক অবাক, “তুমি কী বলছো? ও মেয়েটা আমাদের ব্যান্ডে নতুন যোগ দিয়েছে। গান লিখছে, আমি শুধু সাহায্য করছিলাম।”
শ্রেয়সী ঠান্ডা স্বরে বলল, “তাহলে তোমার গান, তোমার ব্যান্ডই এখন সব। আমার জন্য আর সময় নেই।”

অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“শ্রেয়সী, তুমি আমাকে ভুল বোঝছো।”
কিন্তু শ্রেয়সী তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে। সে ফোন কেটে দিল।

কয়েকদিন কথা হলো না। শ্রেয়সী পড়াশোনায় ডুবে গেল, কিন্তু মন বসছিল না। অর্কর ফোন এলে সে ধরত না, মেসেজের উত্তর দিত না। তার বান্ধবীরা লক্ষ্য করল, শ্রেয়সী কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, অর্ক ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। সে ডায়েরিতে লিখল—
“আমি চেয়েছিলাম ওকে স্বপ্নের অংশীদার করতে। অথচ আজ মনে হচ্ছে, আমার স্বপ্নই আমাকে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।”

একদিন করিডোরে হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হলো। শ্রেয়সী পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, অর্ক হাত ধরে দাঁড় করাল।
“শ্রেয়সী, আমরা কি একবার শান্তভাবে বসে কথা বলতে পারি না?”
শ্রেয়সী চোখে জল নিয়ে বলল,
“কথা বলে কী হবে অর্ক? তুমি তোমার জগতে চলে যাচ্ছো, আমি আমার জগতে। আমাদের মাঝের এই দূরত্ব আর পূরণ হবে না।”

অর্ক ভাঙা গলায় বলল,
“তুমি কি আমাকে একবারও বিশ্বাস করবে না?”
শ্রেয়সী ঠোঁট কামড়ে চুপ করে গেল। তারপর হাত ছাড়িয়ে চলে গেল।

ক্লাসরুমের কোণে বসে শ্রেয়সী ডায়েরিতে লিখল—
“ভালোবাসা কি এত সহজে ভেঙে যায়? নাকি আমি-ই দুর্বল? আমার মনে হয়, আমি অর্ককে হারাচ্ছি।”

অন্যদিকে অর্ক একা গিটার বাজাচ্ছিল। সুর এলোমেলো, বেসুরো। তার মনে হচ্ছিল, শ্রেয়সী যদি সত্যিই দূরে সরে যায়, তবে গান তার কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে।

পরের সপ্তাহে কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। শ্রেয়সী এবার অংশ নেয়নি, কিন্তু অর্কর ব্যান্ড মঞ্চে উঠল। আলো-আঁধারির মধ্যে অর্ক গিটার হাতে দাঁড়াল। গানের শুরুতেই তার চোখ খুঁজে বেড়াল শ্রেয়সীকে। শ্রোতাদের ভিড়ের মধ্যে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে।

গান শুরু হলো—
“কেন যে দূরে গেলে তুমি, কেন যে ভাঙলে বাঁধন…”

শ্রেয়সীর বুক কেঁপে উঠল। অর্ক যেন গান দিয়ে তার কাছে পৌঁছতে চাইছিল। কিন্তু অভিমান তখনো তাকে আটকে রেখেছিল।

অনুষ্ঠান শেষে অর্ক এগিয়ে এসে বলল,
“আমি আজকের গানটা শুধু তোমার জন্য গেয়েছিলাম।”
শ্রেয়সী চোখ নামিয়ে বলল,
“আমি জানি না আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারব কিনা।”

অর্কর চোখে ভেসে উঠল নিঃশব্দ কান্না।

সেদিন রাতে দু’জনেই আলাদা দিক থেকে একই আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। তারার নিচে দু’জনের বুকেই একই প্রশ্ন—
এই কি সত্যিই শেষ?

শরতের বিকেল। কলেজের মাঠে কাশফুল দুলছে, আকাশে হালকা সাদা মেঘ। সেমিস্টার প্রায় শেষের পথে। ভেতরে ভেতরে শ্রেয়সী আর অর্ক দু’জনেই ক্লান্ত—অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি, দূরত্ব যেন তাদেরকে অচেনা করে তুলেছে। অথচ হৃদয়ের গভীরে তারা দু’জনেই জানত—এভাবে দূরে সরে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

শ্রেয়সী একদিন লাইব্রেরির জানলার ধারে বসে ছিল। বইয়ের ওপর চোখ ছিল, কিন্তু মন কোথাও ছিল না। হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াল মেঘলা।
“তুই এখনও অর্ককে এড়িয়ে যাচ্ছিস?”
শ্রেয়সী দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আমি জানি না ওকে বিশ্বাস করা উচিত কিনা।”
মেঘলা মৃদু হেসে বলল, “শ্রেয়সী, প্রেম মানে বিশ্বাস। যদি বিশ্বাসই না করিস, তাহলে এত দূর এসে দাঁড়ানোর মানেটা কী?”

কথাটা শ্রেয়সীর বুকের ভেতর গভীরভাবে বিঁধল। সে জানল, আর দেরি করলে হয়তো সত্যিই সম্পর্কটা ভেঙে যাবে।

সেদিন সন্ধ্যায় কলেজের সাংস্কৃতিক ক্লাব একটা ছোট্ট আড্ডার আয়োজন করেছিল। ভিড়ের মধ্যে অর্ক গিটার নিয়ে বসেছিল, কিন্তু বাজাচ্ছিল না। চোখ বারবার দরজার দিকে যাচ্ছিল—শ্রেয়সী আসবে কি না সেই অপেক্ষা।

হঠাৎই দরজা খুলে শ্রেয়সী ঢুকল। সাদা কুর্তি, খোলা চুল, মুখে গম্ভীরতা। অর্ক তাকিয়ে রইল। তাদের চোখ মিলতেই এক নিঃশব্দ কাঁপুনি বয়ে গেল চারপাশে।

শ্রেয়সী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,
“আমাদের মধ্যে যা হয়েছে, সেটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি, আর তুমি আমাকে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করোনি।”
অর্ক গিটার নামিয়ে রাখল। গলায় চাপা কষ্ট নিয়ে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজে থেকে বুঝবে। কিন্তু বুঝলাম, প্রেমে কিছু কথা বলা দরকার।”

শ্রেয়সীর চোখে জল এসে গেল।
“অর্ক, আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাই। তাই হয়তো এত তুচ্ছ ব্যাপারেও সন্দেহ করি।”
অর্ক আস্তে এগিয়ে এসে বলল,
“তাহলে হারিও না। আমি কোথাও যাচ্ছি না, আমি আছি তোমার জন্য।”

দু’জনের চোখে জল, অথচ ঠোঁটে এক মৃদু হাসি। ভুল বোঝাবুঝি যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।

পরের দিন কলেজের মাঠে আবার তারা একসঙ্গে হাঁটছিল। চারপাশে শরতের সোনালি আলো। শ্রেয়সী বলল,
“তুমি যদি একদিন সত্যিই মঞ্চে গিটার বাজাও, আমি প্রথম সারিতে বসে গান গাইব।”
অর্ক হেসে বলল,
“আর তুমি যদি গবেষণায় বড় কিছু করো, আমি হবো তোমার সবচেয়ে বড় শ্রোতা।”

দু’জনের স্বপ্ন আলাদা, কিন্তু তারা বুঝে গেল—এক আকাশের নিচে দুটো স্বপ্নও পাশাপাশি হাঁটতে পারে।

সেমিস্টারের শেষে পরীক্ষার দিনগুলো কেটে গেল। ফল বেরোল—শ্রেয়সী প্রথম বিভাগে উজ্জ্বলভাবে পাশ করল, আর অর্কও যথেষ্ট ভালো নম্বর পেল। সবাই অবাক, কারণ অনেকেই ভেবেছিল অর্ক হয়তো পিছিয়ে যাবে। শ্রেয়সীর উৎসাহই তাকে নতুন করে গড়ে তুলেছিল।

পরীক্ষা শেষে কলেজ প্রাঙ্গণে বিদায় সমারোহ হলো। ব্যানার, আলো, গান—সব মিলিয়ে আবেগঘন পরিবেশ। মঞ্চে একে একে সবাই স্মৃতি শেয়ার করছিল।

অর্ক গিটার নিয়ে উঠল। বলল,
“এই কলেজ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে—বন্ধুত্ব, স্বপ্ন, আর সবচেয়ে বড় কথা, এমন একজনকে, যিনি আমাকে নিজের মতো করে চিনেছেন।”

শ্রেয়সীর বুক কেঁপে উঠল। ভিড়ের মধ্যে সে অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক গিটার বাজাতে শুরু করল—
“তুমি রবে নিরবে, হৃদয়ে মম…”

চারপাশ নিস্তব্ধ। শ্রেয়সীর চোখে জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি ছিল। সেই মুহূর্তে সে বুঝল, এই সম্পর্ক আর ভাঙবে না।

বছর কেটে যাবে, সময় বদলাবে, তারা হয়তো আলাদা পথে হাঁটবে—কেউ মাস্টার্সে, কেউ সঙ্গীতে—কিন্তু আজকের এই প্রতিশ্রুতি থাকবে তাদের ভেতরে।

শ্রেয়সী ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল—
“প্রেম কখনো পরিকল্পনা করে আসে না। প্রেম আসে হঠাৎ, এক ফিল্ড ট্রিপের ভিড় থেকে, এক ট্রেনযাত্রার জানলা থেকে, এক ঝর্ণার ধারে বসে। আর সেই আকস্মিকতাই জীবনকে সবচেয়ে সুন্দর করে তোলে।”

অর্ক তার ডায়েরিতে লিখল—
“শ্রেয়সী আমার গান, আমার আলো। যতদিন আমি গিটার বাজাবো, ততদিন ওর নাম সুর হয়ে থাকবে।”

ট্রিপ থেকে শুরু হওয়া সেই আকস্মিক যাত্রা অবশেষে পৌঁছল এক পূর্ণতায়। তারা জানল—প্রেম মানে ঝড়ঝাপটা, ভয়, ভুল বোঝাবুঝি—সব মিলে একটি দীর্ঘ যাত্রা। আর সেই যাত্রাই জীবনকে অর্থ দেয়।

 সমাপ্ত

WhatsApp-Image-2025-08-28-at-4.13.02-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *