Bangla - প্রেমের গল্প

ফিরে এসো, শ্রুতি

Spread the love

নন্দিতা রায়


বৃষ্টিভেজা ব্যাঙ্গালোরের সন্ধ্যা তখন গা ছমছমে করে তুলেছিল, যখন অর্ণব সেনের ফোনটা বেজে উঠেছিল। সে তখন একটি ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে পিক্সেল শিফট ঠিক করছিল। কিন্তু সেই একটানা বেজে চলা ফোনের শব্দ যেন আচমকা একটা অজানা সঙ্কেত হয়ে ঢুকে পড়ে তার শরীরের ভেতর। স্ক্রিনে নামটা দেখে মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে যায়—‘ডা. অনিরুদ্ধ রায়’। সে বুঝে যায় কিছু একটা ভুল হয়েছে। ফোন ধরতেই ওপার থেকে ভারী গলায় খবরটা আসে—“আমার দুঃখিত অর্ণব, তোমার মা আমাদের মাঝে নেই।” কথাটা যেন স্থির বাতাসের মতো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কিচ্ছু বলতে পারে না অর্ণব। এত ব্যস্ততায় গা ভাসানো একটা জীবনের ভেতর হঠাৎ যেন থেমে যায় সব কিছু। মা… যে একমাত্র মানুষ ছিল যার সঙ্গে কোনো কথা না বললেও মনে হতো পাশে কেউ আছে। যাকে ফোন করে শুধু নিঃশব্দ থাকলেও শান্তি পাওয়া যেত, তার জন্য এখন আর কোনো সময় অবশিষ্ট নেই।
অর্ণব কলকাতায় ফেরে একরকম অসাড় মানসিক অবস্থায়। সাদা কাপড়ে ঢাকা মা’র মুখটা দেখে মনে পড়ে যায় কতদিন দেখা হয়নি। কেবল ভিডিও কল, দূর থেকে কথোপকথন, আর মাঝে মাঝে পাঠানো কিছু ওষুধের ছবি—এই ছিল গত এক বছরের সম্পর্ক। সৎকার শেষে সে ফিরে আসে তাদের পুরনো ফ্ল্যাটে, যেখানে এখনো মায়ের শেষ ব্যবহৃত কাপটা পড়ে আছে, বিছানার পাশে রাখা টাকবই, বাতাসে যেন তার গন্ধ মিশে আছে। অর্ণব একা বসে থাকে ঘরের ভেতর, বাতি জ্বালায় না। বৃষ্টির শব্দ, ঘড়ির কাঁটা আর হালকা অন্ধকার যেন একসঙ্গে তার শোকের শরীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ঘরের তাক ঘেঁটে পুরনো জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে পায় এক কাঠের বাক্স—মায়ের হাতের লেখা তাতে, “স্মৃতির জন্য রেখো”। কৌতূহলে ঢাকনা খুলতেই চোখে পড়ে এক পুরনো ডায়রি—পাতাগুলো বাদামী, কিছুটা পুড়ে যাওয়া ধরণের, পাতার কোণায় মায়ের হাতের অক্ষরে লেখা, “শ্রুতি মিত্র, ২০০৯”।
ডায়রিটা খুলেই অর্ণব থমকে যায়। প্রথম পাতায় লেখা, “তাকে বলা হয়নি বলে, নিজেকে বলতে শিখি”—নামহীন এক কবিতা। কালি ম্লান, কিন্তু অক্ষরগুলোর গভীরতা অর্ণবকে মুহূর্তে নিয়ে যায় বহু বছর পেছনে। সে চোখ বন্ধ করে বসে পড়ে। শ্রুতি… সে কি সেই কলেজের মেয়ে? শান্ত চেহারার, কাঁচের ফ্রেমের চশমা পরে যে লাইব্রেরির কোণায় বসে কবিতা পড়ত? কখনও ক্লাসে জোরে কিছু বলেনি, কখনও চোখে চোখ রেখে কিছু দাবি করেনি, অথচ এক অদ্ভুত নিরবতা নিয়ে তার আশেপাশে থাকত? অর্ণব তখন কলেজে ছিল ব্যস্ত, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনায় মগ্ন। ছেলেদের দলে মজা, আড্ডা, কেরিয়ার—এই নিয়েই দিন কেটে যেত। শ্রুতির উপস্থিতি ছিল যেন নিঃশব্দ ছায়ার মতো, যা ছিল কিন্তু কোনোদিন গুরুত্ব পায়নি।
ডায়রির পরের পাতায় লেখা আরও কয়েকটি কবিতা। “চোখে পড়া মানেই চেনা নয়”, “তোর পাশে বসতাম বলে নয়, আমার মন তো তোকে চেনার চেষ্টায় বসেছিল”—এমন সব লাইন পড়ে অর্ণব ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে, এই ডায়রিটা শুধুই কবিতার খাতা নয়, এটা কারও না বলা ভালোবাসার দলিল। শ্রুতি তার কলেজজীবনের কোনো এক নিঃশব্দ প্রেমিকা ছিল, যার অনুভব অর্ণব কখনো বোঝেনি। প্রশ্ন উঠতে থাকে—এই ডায়রি কীভাবে মায়ের কাছে এল? মা কি জানতেন কিছু? অর্ণব ডায়েরির প্রতিটি পাতায় নিজের মুখ খুঁজে পায়, নিজের উপেক্ষা খুঁজে পায়, নিজের ব্যর্থতা খুঁজে পায়। একটা অজানা ভার এসে বসে তার বুকে। নিজের অজান্তেই সে বলে ওঠে—“শ্রুতি, তুই এইভাবে আমাকে ডাকছিলি, আর আমি কিছুই শুনিনি?” বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ে চলেছে, কিন্তু ঘরের ভেতর, অর্ণবের মধ্যে শুরু হয় এক নিঃশব্দ ঝড়।
ডায়রির পাতাগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে অর্ণবের মনে হতে থাকে যেন প্রতিটি শব্দ কোনো চেনা সুরে বাজছে, যেন এসব শুধু লেখা নয়, জীবনেরই রক্ত-মাংস হয়ে উঠে আসছে। দ্বিতীয় পাতায় লেখা ছিল—”যাকে ভালোবেসে কোনোদিন কিছু বলা হয়নি, তার মুখে অন্য কারো নাম শুনলে বুকের ভেতর কি অদ্ভুত শূন্যতা জমে!” অর্ণব বসে থাকে বিছানার কোণায়, হাতের ডায়েরিটা খোলা, কিন্তু চোখ তার ঘরের দেয়ালের দিকে স্থির। এই লাইনগুলো কার উদ্দেশ্যে লেখা, তা সে এখন বেশ স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছে। কলেজের সেই শ্রুতি—তাকে নিয়ে আজ অবধি কোনো বিশেষ স্মৃতি না থাকলেও, এখন এই লেখাগুলো সেই পুরনো দিনে অদ্ভুতরকম আলো ফেলতে শুরু করেছে। সময়ের পাল্লায় যাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, তারই লেখা এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে—তাকে কোনোদিন ভালো করে দেখা হয়নি, অথচ সে এত গভীরে ছিল?
শ্রুতি ছিল একরকম ছায়ার মতো, নিঃশব্দভাবে পাশে থাকা, সবকিছুর মধ্যে থেকেও নিজের জগতে ডুবে থাকা এক মেয়ে। লাইব্রেরির কোণার টেবিলে বই নিয়ে বসে থাকত সে, কখনও একা, কখনও দু’একজন সহপাঠিনী পাশে, কিন্তু মুখে কথা খুব কম। অর্ণবের স্মৃতিতে উঠে আসে—একদিন কোনো কারণে শ্রুতির খাতা পড়েছিল তার হাতে, সেখানে একটা কবিতা ছিল, “চুপ করেই পাশে থাকি, হয়ত তুই এইভাবেই অভ্যস্ত”, তখন সে ভেবেছিল, এমন আবেগমূলক ছেলেমানুষি আজকাল কে লিখে! আজ সেই কথাগুলোর গভীরতা যেন কেটে কেটে প্রবেশ করছে তার ভেতর। ডায়েরিতে একটি পৃষ্ঠায় শ্রুতি লিখেছে—”তুই যখন হাসিস, তখন নিজের সব ভয় ভুলে যাই। কিন্তু তুই যখন তাকাস না, তখন মনে হয় আমি অদৃশ্য।” অর্ণবের গলার নিচে যেন একটা ভার আটকে থাকে।
ডায়েরির মাঝে একটি জায়গায় পায় একটি ছোট স্কেচ—কলেজ ক্যাম্পাসের এক কোণা, গাছতলায় এক ছেলে দাঁড়িয়ে, আর কিছু দূরে এক মেয়ে দূর থেকে তাকিয়ে আছে। স্কেচের নিচে লেখা—“তাকে কিছু না বলেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম, কারণ জানতাম, বললেও কিছু বদলাবে না।” অর্ণব থমকে যায়। সেই গাছতলা, সেই পাথরের বেঞ্চ, সেই ক্যাম্পাস তো তার খুব চেনা। সেই ছেলেটি… সে কি নিজেই? সে কোনোদিন কি এমনভাবে কারো চোখে ছিল? শ্রুতির লেখা থেকে স্পষ্ট হয় যে সে বহুদিন ধরে, নিঃশব্দে, তার প্রতি গভীর অনুভব পুষে রেখেছিল। কিন্তু কোনোদিন প্রকাশ করেনি। অথবা, প্রকাশ করার চেষ্টা করলেও অর্ণব কখনো শুনতে চায়নি। হয়ত ব্যস্ত ছিল নিজের স্বপ্নে, হয়ত এতটাই আত্মকেন্দ্রিক ছিল যে শ্রুতির মতো কারো অনুভব চোখে পড়েনি।
আরেকটি পাতায় লেখা ছিল, “একদিন ওর মা আমার হাতে এক কাপ চা দিয়েছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল, যদি ওর জীবনে কখনো জায়গা পাই, তবে এমন মায়াই হয়ত আমাকে জায়গা করে দিত।” অর্ণব ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে। মা কি জানতেন? তার মনে পড়ে, কলেজ ফেস্টের এক সন্ধ্যায় মা ক্যাম্পাসে এসেছিলেন, এবং সেই দিন শ্রুতি চুপচাপ একটা কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল। মা বলেছিলেন—”ও মেয়েটা খুব ভালো, শান্ত স্বভাবের, তোদের মধ্যে কেউ বন্ধুত্ব করলে ভালো হতো”। তখন অর্ণব হেসে বলেছিল, “ও তো কিছু বলে না মা, বরং একটু… অদ্ভুত।” আজ মনে হচ্ছে, অদ্ভুত না, শ্রুতি শুধু একটু আলাদা ছিল—যার ভালোবাসা উচ্চস্বরে প্রকাশের নয়, বরং লেখায়, নীরবতায়, আর চোখের কোনায় ফুটে উঠত। ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন শ্রুতির হৃদয়ের একেকটা দরজা খুলে দিচ্ছে অর্ণবের সামনে। সে এখন আর নিজের পরিচিত জীবন নিয়ে ভাবতে পারছে না। একরাশ না বলা অনুভব, ভুলে যাওয়া দৃষ্টিপথ, আর অস্পষ্ট এক মায়ার স্মৃতি তাকে চেপে ধরছে। বাইরে তখনও থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে, আর ঘরের নিঃশব্দতা যেন সেই শ্রুতির অতৃপ্ত ভালোবাসার প্রতিধ্বনি হয়ে অর্ণবের কানে বাজছে।
অর্ণব পরদিন সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে ছিল, কিন্তু তার চোখে কোনো দৃশ্য ছিল না—ছিল শুধুই একেকটা পাতা উল্টে পড়া ডায়েরির শব্দ আর চেনা-অচেনা স্মৃতির দোলা। শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল, রাস্তায় রিকশা চলছিল, হকারদের ডাকে ভোর ভেঙে উঠছিল, অথচ তার ভেতরের সময় যেন অন্য ঘড়িতে চলছিল—২০০৯ সালের সেই কলেজজীবনের নিঃশব্দ দিনগুলোর ঘড়ি। এখন যখন পিছন ফিরে তাকায়, তখন বুঝতে পারে—তাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট মুহূর্তে শ্রুতি ছিল, অথচ অর্ণব তাকে দেখেনি কোনোদিন সত্যিকারভাবে। ক্লাসে একসঙ্গে বসা, গ্রুপ প্রেজেন্টেশনে নীরব পাশে থাকা, লাইব্রেরিতে পড়ে থাকা বইয়ের পাশে দেখা পাওয়া, অথবা সামান্য হাসিমুখে ‘হাই’ বলে চলে যাওয়া—এইসব মুহূর্ত তখন যতোটা সামান্য মনে হয়েছিল, আজ মনে হচ্ছে প্রতিটি ছিল একেকটা স্পর্শযোগ্য চিহ্ন।
তার মনে পড়ে, একবার শ্রুতি এক কবিতার বই উপহার দিয়েছিল কলেজের সাহিত্য মেলায়, বইয়ের পেছনে লেখা ছিল—“ভালোবাসা সবসময় শব্দে বলা যায় না।” অর্ণব তখন ভাবেনি সেটা ব্যক্তিগত কোনো ইঙ্গিত হতে পারে, ভাবেছিল ও বুঝি বইয়ের ভূমিকায় লেখকের কিছু লাইনের অনুকরণে লিখেছে। সেই বইটা সে পড়েওনি, হয়তো ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিল, কিংবা কোনো বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিল। এখন ডায়েরির কবিতাগুলোর ভাষা সেই কথাটাকেই স্পষ্ট করে তোলে। “তোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, ভেতরে এক ঝড় বয়ে যায়—তুই টের পাও না, আমি কিছু বলি না”—এই লাইনগুলো তার ভিতরটাকে কাঁপিয়ে দেয়। সে ভাবে, শ্রুতি তো কোনোদিন জোর করেনি, কোনো দাবি তোলেনি—তবু এতটা ভালোবাসা পুষে রেখেছিল তার ভেতর?
তার স্মৃতিতে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে আরও কিছু মুহূর্ত। একবার ক্লাস শেষে বৃষ্টি নামছিল, সবাই দৌড়ে দৌড়ে ছাতা খুলে নিচ্ছিল, শ্রুতি একা দাঁড়িয়ে ছিল ছাতাহীন, তার চোখে তাকিয়েছিল কিছু বলতে চেয়ে। অর্ণব ব্যস্ততায় সেদিন সোজা রিকশা ডেকে উঠে গিয়েছিল, এখন মনে হয়, যদি একবার তাকাত, একটা ইশারা বুঝত, হয়তো সবকিছু বদলে যেত। কলেজ জীবনের আড্ডা, প্রেম, সম্পর্ক—সবই ছিল অর্ণবের চারপাশে, কিন্তু শ্রুতি ছিল তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাঠক, যে কোনো নাটকে অভিনয় করেনি, কিন্তু নীরবে ভালোবেসেছে।
ডায়েরির একটি পাতায় শ্রুতি লিখেছে—“আজ ক্লাসে ওর মুখে অন্য একজন মেয়ের নাম শুনে বুকের ভেতর একটা অজানা কষ্টের শব্দ হল। বলার ছিল না কিছু, ছিল না কোনো অধিকার—তবুও মন বলল, আমি তো ওকে নিজের মতো করে ভালোবেসেছিলাম। কেন এমন হল?” অর্ণবের মনে পড়ে যায়—একদিন কলেজ ক্যান্টিনে সে মজার ছলে এক সিনিয়র মেয়ের নাম বলে কিছু বলেছিল, হয়তো তখন হাসির জন্য বলেছিল, কিন্তু সেই কথাটা শ্রুতি যদি শুনে থাকে, তাহলে তার মনে কী কষ্ট হয়েছিল! এত বছর পরে, সেই কথার প্রতিধ্বনি আজ অর্ণবের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে। তার বুকের ভিতর একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—তাকে নিয়ে যে অনুভব কেউ একসময় এতটা নিঃশব্দে বহন করেছে, তার কোনো উত্তর কি সে কখনো দিয়েছে? না, সে তো কোনোদিন বুঝতেই পারেনি। এখন মনে হচ্ছে, কলেজজীবনের সবচেয়ে গভীর সত্যিটাই হয়তো সে কখনও চিনতেই পারেনি।
বিকেলটা ছিল থমথমে, আকাশে মেঘ জমছিল, হাওয়া বইছিল ধীরে ধীরে, যেন সময়ও ভার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ণবের পুরনো ঘরের জানালায়। সে তখন ডায়েরির একেকটি পাতার মাঝে নিজের ভুলে যাওয়া অতীত খুঁজে ফিরছিল, আর নিজের ভিতরের এক অপরিচিত চেহারার মুখোমুখি হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই পাতার মাঝখানে ভাঁজ করে রাখা একটি চিঠি চোখে পড়ে—হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় পরিচিত অক্ষরে লেখা, মায়ের হাতের লেখা। ওপরে লেখা—“অর্ণব, যদি কোনোদিন এই ডায়েরিটা পড়িস, তাহলে এটুকু জেনে নিস, আমি সব জানতাম।” অর্ণব কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে পড়ে, যেন মায়ের সেই শেষ উচ্চারণ আজ মৃত অবস্থাতেও তাকে স্পর্শ করছে।
মা লিখেছেন, “তুই অনেক বড় হয়েছিস, তোর নিজের পথ, নিজের জীবন। কিন্তু ভালোবাসা কখনো সময় বা ক্যারিয়ার দিয়ে মাপা যায় না। আমি ওর চোখে তোকে দেখেছি, যে চোখ কিছু চায় না, শুধু তোর আশেপাশে থেকে ভালোবাসতে জানে। আমি জানি, তুই তখন তোর মতো ছিলি, কিন্তু তোর পাশে দাঁড়িয়ে একজন মেয়ে নিঃশব্দে তোকে ভালোবেসেছে, আর তুই তা কখনো বুঝিসনি।” অর্ণবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মা কি সব জানতেন? শ্রুতি কি কখনো সরাসরি কিছু বলেছিল? না কি সেই মায়ের অনুভব ছিল এত সূক্ষ্ম, যা কেউ বুঝতেও পারেনি? চিঠির শেষে লেখা ছিল, “তুই তো এখন খুব বড় জায়গায় চলে গেছিস, ব্যস্ত, প্রতিষ্ঠিত—কিন্তু জীবনের সবচেয়ে ছোট, অব্যক্ত মুহূর্তগুলোই সবচেয়ে গভীর হয়ে রয়ে যায়। একদিন যদি এই ডায়েরিটা তোকে কিছু শেখায়, তা যেন হয়—শ্রুতির ভালোবাসার মূল্য।”
চিঠি পড়া শেষ করে অর্ণব স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। বারান্দার বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, যেন আকাশও এক সাথী হয়ে উঠেছে সেই নীরবতায়। তার মনে পড়ে, মা বহুবার বলতেন, “ভালোবাসা বলে কয়ে আসে না রে বাবা, অনেক সময় সেটা চুপচাপ তোর চারপাশে হাঁটে।” তখন সে এসব কথাকে বড়দের আবেগ বলে এড়িয়ে যেত। এখন সেই কথাগুলো যেন হূদয়ের ভেতর সশব্দে ধাক্কা দেয়। সে ভাবে, মা কি সযত্নে ডায়েরিটা রেখে দিয়েছিলেন এই দিনের জন্য? যে দিন তার ভিতরের দম্ভ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, যে দিন সে অনুভব করবে—সব কিছু পাওয়ার পরও কিছু না পাওয়া থেকে যায়।
তার মনে হয়, যদি মাকে একবার জিজ্ঞেস করা যেত, কবে বুঝেছিলেন মা শ্রুতির অনুভব? কীভাবে শ্রুতি ডায়েরি পৌঁছে দিয়েছিল? কোনভাবে কি সে চেয়েছিল অর্ণব একদিন এই সত্য জানুক? অথবা, মা নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা পৌঁছে দেওয়ার? কোনো উত্তর মেলেনা, শুধু অনুতাপ আর কৃতজ্ঞতায় মেশানো এক অনুভব মনের ভেতর চেপে বসে। মায়ের চিঠির শেষে একটুকরো বাক্য আলাদা করে লেখা ছিল—“তাকে খুঁজে পেতে চাইলে সময়ের অপেক্ষা করিস না, কারণ সময় শুধু এগিয়ে চলে, কিন্তু ভালোবাসা অপেক্ষা করে না।” অর্ণব সেই লাইনটা পড়ে ফেলে না, বারবার পড়ে, যেন মায়ের শেষ কথা তাকে এখন নতুন করে বাঁচার নির্দেশ দিচ্ছে।
রাত গভীর হয়ে এসেছে, ঘরের আলো নিভিয়ে অর্ণব জানালার পাশে বসে থাকে। বাইরের অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আলগোছে বৃষ্টি পড়ছে, গাছের পাতার শব্দে যেন মনে হচ্ছে কোনো পুরনো দিন ফিরে ফিরে ডাকছে তাকে। ডায়েরির প্রতিটি লাইন এখন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হয়ে উঠেছে। সেই চিঠি, মায়ের স্বীকারোক্তি, আর শ্রুতির গভীর অথচ নিঃশব্দ ভালোবাসা তার হৃদয়ের ভেতর অস্থির ঝড় তৈরি করেছে। অর্ণব জানে, এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে হবে না—তাকে জানতে হবে শ্রুতি এখন কোথায়, কেমন আছে, কেমন করে এতটা অনুভব নিয়ে বেঁচে আছে। যে মেয়েটি একসময় তার জীবনের পাশে নিঃশব্দ ছায়া হয়ে হেঁটেছিল, তাকে আজ খুঁজে না পেলে নিজের এই বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যাবে। সে প্রথমে খুঁজতে শুরু করে পুরনো কলেজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ, পুরনো গ্রুপ ফটো, কিন্তু শ্রুতির কোনো সাম্প্রতিক চিহ্ন সেখানে নেই।
পরদিন সকালে সে গিয়ে হাজির হয় তার কলেজ ক্যাম্পাসে। গেটের প্রাচীন ধাতব কাঠামো দেখে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে, যেন জীবনের কোনও কিশোর অধ্যায় আজও এখানে অপেক্ষা করে আছে। সে হাঁটে সেই পুরনো করিডোর দিয়ে, যেখানে শ্রুতি প্রায়ই বই নিয়ে একা বসে থাকত, লাইব্রেরির সেই নির্জন টেবিলে গিয়ে বসে—যেখানে এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নীরবতায় ডুবে আছে। লাইব্রেরিয়ান, যিনি বহু বছর ধরে এখানে কাজ করছেন, তার সঙ্গে কথা বলে শ্রুতির পুরনো রেজিস্ট্রেশন খোঁজে। এক পুরনো খাতায় পাওয়া যায়—“Shruti Mitra, English Literature, Batch 2009”। ঠিকানার ঘরে দেওয়া—বেলঘরিয়া, কাঁচরাপাড়া রোড। নতুন আশা নিয়ে অর্ণব সেদিকেই রওনা দেয়, বুকের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে যে সে হয়তো সত্যিই তাকে খুঁজে পেতে চলেছে।
বেলঘরিয়ার সেই পুরনো বাড়ি এখন বেশ জরাজীর্ণ। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সে দেখে বাড়িটা এখন ভাড়া দেওয়া হয়েছে অন্য পরিবারকে। সাহস করে দরজায় কড়া নাড়তেই এক মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খোলেন, এবং জানিয়ে দেন—“মিত্র পরিবার বহু বছর আগে এই জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়েটি, শ্রুতি, শেষবার এসেছিল তার বাবার মৃত্যুর সময়, তারপর আর কেউ ওকে দেখেনি।” সেই মহিলার গলায় করুণার স্পর্শ ছিল—যেন তিনিও জানতেন, যে মেয়েটির কথা অর্ণব খুঁজছে, সে কেমন একা ছিল। অর্ণব ফিরে এসে আবার কলেজের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে। একসময় পায় তার পুরনো বন্ধু রাজর্ষির নম্বর, যে কলেজে শ্রুতির কবিতা পড়ে একবার অর্ণবকে বলেছিল—“ভালো লাগবে পড়ে দ্যাখ”—যা সে তখন এড়িয়ে গিয়েছিল।
রাজর্ষির সঙ্গে ফোনে কথা হয় সন্ধ্যেবেলা। কণ্ঠস্বরের ওপারে রাজর্ষি প্রথমে অবাক হয় অর্ণবের আগ্রহ দেখে। “তুই হঠাৎ শ্রুতির কথা জিজ্ঞেস করছিস?” সে বলে, “হ্যাঁ, ও খুব ভালো লিখত, কিন্তু খুব চুপচাপ ছিল। তোর কথা বলত না কখনও, কিন্তু মনে হত তোকে নিয়েই কিছু একটা গভীর ভাবনা তার ছিল।” রাজর্ষি জানায়, শ্রুতি কলেজের পর একটা সময় শান্তিনিকেতনে চলে গিয়েছিল। সৃজনশীল লেখালেখি, চিত্রাঙ্কন, আর সাহিত্য নিয়ে মগ্ন হয়ে উঠেছিল। তবে, সে এখন কোথায় আছে, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু কেউ জানে না। “শুনেছি,” রাজর্ষি বলে, “ও ফোন রাখেনি, চিঠিও কারও উত্তর দেয় না—একেবারে একা থাকতে শুরু করেছে।” অর্ণবের শরীর শিউরে ওঠে—এই কি সেই মেয়েটি, যে তার নিঃশব্দ ভালোবাসার স্মৃতি বুকে নিয়ে পৃথিবীর ভিড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে? সে ভাবে—সময় আর দেরি করা যাবে না। তাকে যেতে হবে শান্তিনিকেতন, সেখানে শ্রুতির পদচিহ্ন খুঁজে পেতেই হবে। নিজের অনুপস্থিতির যন্ত্রণাকে যদি কিছুটা লাঘব করতে চায়, তাহলে এই যাত্রা তাকে করতেই হবে। বাইরে তখন আবার বৃষ্টি পড়ে, আর অর্ণব জানে—তার নতুন পথচলা শুরু হল আজ থেকে।
সেদিন সকালে অর্ণব যখন শ্রুতির খোঁজে বেরোল, তার মনে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছিল—একধরনের আশঙ্কা ও প্রত্যাশার মিশেল। সে ফোনে শ্রুতির নাম খুঁজে বের করল, খুঁজল সোশ্যাল মিডিয়ায়, এমনকি পুরনো কলেজ গ্রুপেও পোস্ট করল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে মীনা নামে এক মেয়ের ইনবক্সে একটুখানি উত্তর এল—”তুমি অর্ণব? শ্রুতির খোঁজে আছো?” এই একটা বাক্যেই যেন দীর্ঘ দশ বছর ঘোলাটে অতীত হঠাৎ স্বচ্ছ হয়ে উঠল। মীনা জানিয়েছিল, শ্রুতি এখন শান্তিনিকেতনে থাকেন, একটি ছোট লাইব্রেরির দায়িত্বে। সে একা থাকে, লেখালেখি করে, কিছুটা নিজের মতো। অর্ণব বিশ্বাস করতে পারছিল না। শ্রুতি, যে একসময় তার খুব কাছেই ছিল অথচ অজানায় হারিয়ে গিয়েছিল, সে এখনও কোথাও নিঃশব্দে আছে! সে স্থির করল, দেরি না করে চলে যাবে শ্রুতির কাছে, অন্তত একবার, তার চোখে চোখ রেখে বলবে—সে জানে এখন শ্রুতির অনুভব কী ছিল।
পরদিন সকালে অর্ণব কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের ট্রেনে উঠল। জানালার ধারে বসে থাকা সেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চোখে ছিল ধুলো ধরা বিস্ময়। শাল-পলাশের রাস্তা পেরিয়ে ট্রেন যখন শান্তিনিকেতন পৌঁছল, তার হৃদপিন্ড তখন অন্য এক রেলগাড়ির মতো শব্দ করছিল। সে রিকশা করে পৌঁছাল সেই লাইব্রেরির ঠিকানায়, যেটা মীনা দিয়েছিল। ছিমছাম এক কাঠের বাড়ি, সামনে নাম লেখা—“মেঘেদের ঘরবাড়ি পাঠাগার।” দরজার পাশে ছোট এক ঘণ্টি টিপতেই দরজা খুলে এক মৃদু মুখের নারী বের হলেন—সাদা ছাপা সালোয়ার, চোখে মোটা চশমা, কপালে লাল টিপ। বয়সে একদমই বদলায়নি, শুধু যেন আগের চেয়েও বেশি নীরব। শ্রুতি এক মুহূর্ত থেমে থাকল, তারপর তার গলাটা একটু কাঁপতে কাঁপতে বলল, “অর্ণব?”
কোনো সংলাপই যথেষ্ট ছিল না। দশ বছরের ফাঁক কোনও কথায় ভরাট করা যায় না, শুধুই চোখের ভাষায়। অর্ণব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। শ্রুতি তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল—লাল রঙের কুশনে ভরা এক বইয়ের ঘরে। চারদিক বই আর কাঠের গন্ধে ভরা, যেন শ্রুতির হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না। এরপর শ্রুতি নিজেই ধীরে বলে উঠল, “আমি জানতাম না তুমি একদিন আসবে। ভাবতাম তুমি তো জানতেই পারোনি কিছু।” অর্ণব গলা শুকিয়ে ফেলো গলায় বলল, “আমি কিছুই জানতাম না শ্রুতি। মায়ের ডায়রির পাতায় তোমার নামটা যখন প্রথম পড়ি, মনে হল আমি জীবনের একটা পুরো অধ্যায় হারিয়েছি।” শ্রুতি হেসে বলল, “তোমার মা জানতেন… উনি আমায় একদিন বলেছিলেন—অর্ণব কখনো সময়ের সঙ্গে ভুলে যাবে না।”
দিনটা যেন হিমে মোড়া ছিল, অথচ ভেতরে ছিল এক উষ্ণতা। শ্রুতি চা করে আনল, দুজনে বসে থাকল পুরনো দিনের মতো—কোনো স্মৃতি ফুঁড়ে উঠে এলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল সামনের জানালায়, যে জানালা দিয়ে তারা একদিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত আলাদা আলাদা ভাবে। অর্ণব লক্ষ করল শ্রুতির হাতে আজও সেই আঙুরলতার বালা আছে, যেটা কলেজ বার্ষিকীতে অর্ণব উপহার দিয়েছিল, তখন শ্রুতি কিছু বলেনি শুধু একবার মৃদু হেসেছিল। সেই হাসি আজও বদলায়নি। সময় হয়ত অনেক কিছু বদলে দেয়, কিন্তু কিছু অভিমান, কিছু ভালোবাসা, কিছু অপূর্ণতা থেকে যায় চিরকাল একরকম। অর্ণব জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী, শ্রুতি তাকে মাফ করবে কিনা বা আগের মতো হবে কি না—কিন্তু সে জানে, এই মুহূর্তে তারা দুজনে আবার একসাথে বসে আছে, এবং মেঘেদের ঘরবাড়ি পাঠাগারের ভেতর বইয়ের পাতায় ভেসে আসছে নতুন এক গল্পের শুরু।
বৃষ্টির সন্ধ্যাবেলা কলকাতার কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। অর্ণব সেই সন্ধ্যায় শ্রুতির পুরোনো কলেজের পথে হাঁটছিল, কাঁধে তার ছোট্ট ব্যাগ, চোখে বিষণ্ণতা। কলেজের গেটটা ছিল আগের মতোই—পুরনো লোহার তৈরি, যার গায়ে ধুলোমাখা অক্ষরে লেখা ‘কলকাতা ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যানিটিজ’। অর্ণব ভেতরে ঢুকে পড়ে এক নিঃশব্দ যাত্রায়, যেন স্মৃতির ধ্বংসস্তূপে হাঁটছে সে। করিডোরে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে শ্রুতির হাসি, তার কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট টোটব্যাগ, আর লাইব্রেরির কর্নারে বসে লেখা কবিতার খাতা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেদিনের সে একটি নীরব প্রেমিক, যে ভালোবাসা বুঝে ওঠার আগেই তা হারিয়ে ফেলেছিল। কলেজের চত্বরে এখন নতুন ছাত্রছাত্রী, কিন্তু অর্ণব যেন অন্য এক সময়ের ঘোরে। সেই পুরোনো রিডিং রুমের এক কোণে এখনও টেবিলটা পড়ে আছে, যার নিচে একদিন শ্রুতি তার প্রথম কবিতাটি রেখে গিয়েছিল অর্ণবের জন্য। কিন্তু অর্ণব কখনও তা খুঁজে পায়নি। আজ তার আঙুল যেন নিজে থেকে ছুঁয়ে ফেলল সেই টেবিলের নিচে সাঁটানো হলুদে হয়ে যাওয়া কাগজটি, যেটি একটি কবিতা ছিল—“যদি ফিরে আসো, হাতটা ধরো, আমি অপেক্ষা করে থাকব, কোন এক বিকেলের আলোয়।”
সেই সন্ধ্যায় অর্ণবের মধ্যে কিছু চিরতরে বদলে গেল। সে বুঝতে পারল, ভালোবাসা কখনও মরে না—শুধু নিঃশব্দে অপেক্ষা করে, একটি চেনা মুখের জন্য, একটি অচেনা সাহসের জন্য। সে রাতেই সে ফিরে গেল শ্রুতির সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের ঠিকানায়, যেটা মীনার থেকে সংগ্রহ করেছিল আগেই। দরজায় দাঁড়িয়ে তার হাতে কাঁপছিল, বুকের ভিতরে এক অজানা সুর গুঞ্জন করছিল। দরজা খুলল এক বয়স্ক মহিলা, যিনি শ্রুতির কেয়ারটেকার বলে জানালেন। শ্রুতি এখন আর এখানে থাকে না, প্রায় দুই বছর আগেই সে এই শহর ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, তিনি জানেন না। অর্ণবের মন যেন হঠাৎ শূন্যতায় ডুবে গেল। জীবনের সমস্ত অনুশোচনা, অপূর্ণতা আর না-পাওয়ার ব্যথা সেই মুহূর্তে একসাথে এসে চেপে বসল তার উপর। তিনি সেই কেয়ারটেকারের কাছে অনুরোধ করলেন যদি শ্রুতির রেখে যাওয়া কোনো চিঠি বা বই থেকে যায়, তবে তিনি তা দিতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণ পর মহিলা একটা পুরনো খাম এনে দিলেন—ভেতরে একটি ছবি আর একটি পাণ্ডুলিপির কিছু পাতা ছিল। ছবিটিতে শ্রুতি ছিল সমুদ্রের ধারে, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে, তার কাঁধের উপর এক ঝাঁক চুল উড়ছে বাতাসে। নীচে লেখা ছিল, “যদি কেউ পড়ে এই লেখা, জানবে আমি অপেক্ষা করেছি।”
ছবির পেছনের লেখাগুলো পড়ে অর্ণব চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। শ্রুতির লেখা প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের গহীনে নেমে যাচ্ছিল। সে অনুভব করল যে, শ্রুতি তাকে কখনও দোষ দেয়নি, কেবল চেয়েছিল একটিবার তার অনুভব জানাতে। অর্ণব সেই মুহূর্তে নিজেকে দোষী ভাবল না, বরং উপলব্ধি করল—তারা দুজনই ছিল একে অপরের অলিখিত অধ্যায়। কিন্তু জীবন তাদের সেই অধ্যায় পড়তে দেয়নি সময়মতো। অর্ণব সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিল, সে খুঁজে বের করবে শ্রুতিকে—না পাওয়ার পেছনে নয়, বরং শ্রুতির সেই গভীর অনুভবকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য। তার সেই রাতের ঘুম এল না, কিন্তু স্বপ্ন এলো অনেক। স্বপ্নে সে দেখল শ্রুতি দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের ধারে, তাকে ডাকছে নীরব চোখে, আর বাতাসে ভাসছে সেই পুরোনো কবিতার লাইন—“তুমি যদি কখনও ফিরে আসো, আমি হারিয়ে যাবো না।”
পরদিন সকালে সে তার ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনে উঠল। গন্তব্য কোথায়, সে জানে না ঠিক। কিন্তু এইবার সে দেরি করবে না। শ্রুতি যেখানেই থাকুক, অর্ণব জানে—তারা দুজন একে অপরের জীবনে অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে থাকতে পারে না। এই যাত্রা শুধুই খোঁজার নয়, এই যাত্রা তার নিজের ভেতরের ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনার, শ্রুতির চোখে তাকিয়ে সেই না-বলা কথাগুলো বলার। ব্যস্ত জীবনের কর্পোরেট কোণায় বসে থাকা সেই নিঃস্পৃহ অর্ণব আজ আর নেই। এখন তার বুকের ভেতরে শ্রুতির কবিতা গুনগুন করে বাজে, তার কাঁধের উপর অদৃশ্য হাত রাখে এক নীরব প্রেমিকা—ফিরে এসো, শ্রুতি।
শীতল বিকেলের আলোয় ঘেরা বারান্দায় বসে অর্ণব ডায়েরির পাতাগুলি উল্টে যেতে যেতে হঠাৎ এক পাতায় থেমে গেল। পাতাটির উপরের দিকে ছোট করে লেখা—”শেষ কবিতা, যেদিন তাকে শেষবার দেখেছিলাম।” তারিখটা ছিল অর্ণবের কলেজ ছাড়ার দিন। অর্ণব অনুভব করল, যেন শব্দগুলো কাঁপছে; যেন প্রতিটি ছত্রে জমে আছে এক অস্ফুট কান্না। সেই কবিতায় শ্রুতি লিখেছিল, “সে জানে না, আমি তাকিয়ে ছিলাম জানালার গ্লাসের আড়াল থেকে; সে জানে না, আমি তার জন্য অপেক্ষা করেছি সেই পুরনো পাড়ার চায়ের দোকানে আরও অনেক সন্ধ্যে, জানার আশায় সে বুঝতে পেরেছে কি না কিছুই।” অর্ণবের হৃদয়ে ব্যথার হালকা ঝাঁকুনি লাগল। তার ভিতরে একটা প্রশ্ন গুঞ্জন তুলল—শ্রুতি কি তখনই চলে গিয়েছিল তার জীবনের বাইরে নাকি সে অপেক্ষায় ছিল, একটি শেষ ডাকে? এইসব ভেবে সে ব্যাগ গুছিয়ে মায়ের ঘরে রাখা কিছু পুরনো কাগজ ঘাঁটতে লাগল। একটি খামে পেয়ে গেল শ্রুতির পাঠানো একটি চিঠি, যেটি মায়ের কাছে এসেছিল বহু বছর আগে কিন্তু কখনও অর্ণবের হাতে পৌঁছায়নি। খামের উপরে লেখা—”অর্ণবের জন্য, যদি কখনও সে জানতে চায়।” অর্ণব ধীরে ধীরে খাম খুলল, চিঠির প্রথম লাইন ছিল, “আমি জানি, তুমি আর কখনও ফিরে আসবে না, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম তুমি জানো—তোমাকে ভালোবেসেছিলাম নিঃশব্দে, অথচ সম্পূর্ণভাবে।” অর্ণব থমকে গেল, মনে হল, যেন কোন ঘুমন্ত অনুভূতি দীর্ঘকাল পরে জেগে উঠল তার ভিতরে।
সেই রাতে অর্ণব ঘুমাতে পারল না। বারবার ফিরে আসছিল চিঠির প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি কল্পনা। শ্রুতি বলেছিল, সে জানে অর্ণব ব্যস্ত হবে, বড় হবে, শহর বদলাবে, হয়ত কাউকে ভালোও বাসবে। তবু শ্রুতি অপেক্ষা করবে—নিজের মধ্যে, নিজের ভাষায়, কবিতার অক্ষরে। অর্ণবের মনে হল সে এক ভয়ংকর ভুল করেছিল, যা শুধরে নেবার সময় হয়ত পেরিয়ে গেছে, অথবা হয়ত এখনও কিছু বাকি আছে, যদি শ্রুতি এখনও কোথাও থাকে, কারও স্ত্রী না হয়ে, নিজের মধ্যেই বাঁচে। অর্ণব আবার একবার চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল, স্মৃতির ভিতর ঢুকে পড়ল সেই শিলচর কলেজের পুরনো দিনগুলোয়—যেখানে শ্রুতি আর সে হয়ত হাঁটত পাশাপাশি, অথচ দূরত্বে বাঁধা থাকত। সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করল, জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি সত্যিই কিছু অনুভব করোনি? নাকি তুমি নিজেই বুঝতে পারনি?” অর্ণব নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না। সে প্রথমবার নিজের অতীতকে স্পষ্ট করে দেখতে চাইল, সেইসব অভিমানের ধুলো ঝেড়ে বের করে আনতে চাইল সত্যিকারের শ্রুতিকে—যে তার না বলা ভালোবাসার পাতায় পাতায় লুকিয়ে ছিল।
পরদিন সকালে অর্ণব ঠিক করল, সে খুঁজবে শ্রুতিকে। তার খোঁজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে কলেজের পুরনো বন্ধুদের ইনবক্স ঘেঁটে চলল। রাজর্ষির নম্বর সে খুঁজে পেল এক পুরনো ফেসবুক কমেন্টে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করল। রাজর্ষি প্রথমে একটু দ্বিধা করলেও পরে বলল, “শ্রুতি এখন কলকাতার কাছে, শান্তিনিকেতনের এক স্কুলে পড়ায়, আমি শেষবার ওকে বছর দুয়েক আগে দেখেছিলাম। তখনও একা ছিল।” এই একখানা বাক্য যেন আলো ঢেলে দিল অর্ণবের মনের গভীরে। সে নিজেকে বোঝাল, “এটা শেষ সুযোগ। হয়ত আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি, কিন্তু কখনওই খুব দেরি হয়ে যায় না, যদি ভালোবাসা সত্যি হয়।” সে সঙ্গে সঙ্গেই একটি ট্রেনের টিকিট বুক করল শান্তিনিকেতনের জন্য। আর সব প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা, সংশয়কে পিছনে ফেলে একটিই লক্ষ্য রাখল—শ্রুতির সামনে দাঁড়িয়ে বলা, “আমি ভুল করেছিলাম, কিন্তু এখন ফিরে এসেছি—তোমার কাছে, শ্রুতি।”
ট্রেনের জানালার পাশের সিটে বসে অর্ণব বাইরে তাকিয়ে রইল। প্রকৃতি বদলাচ্ছিল, সবুজ পেরিয়ে হলুদ ধানক্ষেত, তারপর লালমাটির পথ। তার মনে হচ্ছিল, এই বদল তার ভেতরেরও। সে আর সেই নিরাসক্ত কর্মব্যস্ত মানুষটি নয়, যে অনুভূতিকে দূরে ঠেলে নিজের মতো এগিয়ে চলেছিল। এখন সে একজন মানুষ, যে এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে চলেছে নিজের অনুচ্চারিত ভালোবাসার কাছে। অর্ণব জানত না, শ্রুতি তাকে চিনবে কিনা, ক্ষমা করবে কিনা, অথবা আদৌ কথা বলবে কিনা। কিন্তু সে জানত, কিছু না বলার মতো দুঃখের চেয়ে সব বলে হারানোর যন্ত্রণা অনেক সহজ। শেষবারের মতো, সে বলতে চায়, “ফিরে এসো, শ্রুতি।” আর তার হৃদয়ের প্রতিটি শব্দে বাজছিল সেই কবিতার চরণ—”আমি অপেক্ষা করব, যদি তুমি একদিন বুঝতে চাও, কতটা নিঃশব্দে ভালোবেসেছিলাম তোমায়।”
মিঠুনের হাতে সেই চিঠিটি তুলে দেওয়ার মুহূর্তটি যেন সময়কে থমকে দিল। সে জানত না কী লিখতে চলেছে শ্রুতি, জানত না কেন এত বছর বাদে হঠাৎ এই চিঠি, শুধু জানত এই কাগজের পাতাগুলোর মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে তার একাকিত্বের উত্তর। চিঠির খামটা খুলতেই একটুকরো পুরনো, শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাঁপড়ি পড়ে যায় মেঝেতে—ঠিক যেন সেই প্রেমের মতন, যা ছিল বলার আগেই থেমে গিয়েছিল। চিঠির অক্ষরগুলো একটু বিবর্ণ, কিন্তু মিঠুন পড়তে পারল—”মিঠুন, জানি তুমি কখনো জানতে পারোনি, কিন্তু আমি তোমার পাশে বসতাম শুধু এই আশায়, যদি কখনো চোখাচোখি হয়, যদি তুমি বুঝে ফেলো কিছু… কিন্তু তুমি তো তখন ব্যস্ত ছিলে তোমার স্বপ্ন নিয়ে, আমি শুধু চুপচাপ ভালোবেসে গেছি তোমাকে।” মিঠুনের গলা শুকিয়ে আসে। তার বুকের ভেতর একটা ভারী পাথরের মত কিছু চেপে বসে। সে টেবিলে বসে এক নিশ্বাসে চিঠিটা পড়ে ফেলে, যেন প্রতিটি শব্দ তার হারানো অতীতকে জীবন্ত করে তোলে। শ্রুতি লিখেছে কেমনভাবে সে মিঠুনকে অনুসরণ করত সেমিনারে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে—তবে দূর থেকে। নিজের অনুভূতিকে কখনো সাহস করে ভাষা দিতে পারেনি সে। মিঠুন বুঝতে পারে, তার জীবন থেকে যে মিষ্টি অনুভবগুলো মুছে গেছিল, সেগুলো আসলে শ্রুতির অনুভবেই লুকিয়ে ছিল।
চিঠির শেষে ছিল একটি লাইন—”যদি একদিন তুমি পড়ো এটা, যদি একদিন তুমি জানতে চাও আমি কোথায়, তাহলে শুধু একবার ফিরে এসো আমাদের পুরোনো কলেজ ক্যাম্পাসে।” মিঠুন যেন স্থির হয়ে যায়। তার সমস্ত অস্তিত্বে একধরনের বিদ্যুৎ ছুটে যায়, একদিকে অপরাধবোধ, আরেকদিকে আকুলতা। শ্রুতি তাকে কখনো জানায়নি, অথচ তার ভালোবাসা এই দীর্ঘ সময়েও অদৃশ্য থেকে যায়নি। মিঠুন ফিরে তাকায় সেই গোলাপের দিকে, তার মনে পড়ে কলেজের শেষদিনে শ্রুতি বলেছিল, “তোমার জন্য একটা উপহার ছিল, কিন্তু দেইনি…” তখন সে গুরুত্ব দেয়নি কথাটাকে। এখন বুঝতে পারছে সেই উপহারটা ছিল এই ভালোবাসা, যা এতদিন তার অজানায় থেকেছে। রাতে ঘুমাতে পারল না মিঠুন। ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যস্ত প্রজেক্ট, টার্গেট, ক্লায়েন্ট সব যেন দূরে সরে যায়। বারবার চোখে ভেসে আসে শ্রুতির মুখ—সেই শান্ত মেয়েটি, যার চোখে ছিল হাজারটা না বলা কথা।
পরদিন সকালেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অফিসে জানিয়ে দেয়, সে কিছুদিনের জন্য ভারত যাচ্ছে। মিঠুনের বাবাও অবাক, ছেলে যে এমন তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবে ভাবেননি। কিন্তু মিঠুন জানে, কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। বিমান থেকে নামার পর কলকাতার ভ্যাপসা গরম আর পরিচিত গন্ধ যেন একধরনের স্বস্তি এনে দেয় তাকে। সে যায় পুরনো কলেজে—সেই গেট, সেই মেহগনি গাছ, সেই লাইব্রেরি—সব কিছু একই আছে, শুধু ছাত্রছাত্রীরা বদলে গেছে। আর আছে তার ভেতরে এক টান, এক আকর্ষণ যা শ্রুতির রেখে যাওয়া কথাগুলোর প্রতি। পুরনো লাইব্রেরির কোণার বেঞ্চটায় বসে সে অপেক্ষা করে, জানে না আদৌ আসবে কি না শ্রুতি। সময় গড়ায়। বিকেলের আলো নরম হয়ে আসে, হাওয়ায় কাঁচা মেঘের গন্ধ। ঠিক তখনই, দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসে একজন মহিলা, পরনে হালকা সাদা শাড়ি, চোখে চশমা, কাঁধে একটা নীল ব্যাগ। মিঠুন এক মুহূর্তে চিনে ফেলে—শ্রুতি। আর যেন কিছু বলার থাকে না তাদের। চোখে চোখ পড়তেই সমস্ত বছরগুলো, সমস্ত চিঠি, সমস্ত নীরবতা ভেসে যায় বাতাসে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, ঠিক যেমনটা তারা একসময় লাইব্রেরিতে করত। মিঠুন বলে, “আমি দেরি করে ফেলেছি, শ্রুতি…” শ্রুতি হেসে বলে, “তুমি তো এসেছ, সেটাই যথেষ্ট।” এই বাক্যটুকুই যেন জয় করে নেয় মিঠুনের সমস্ত আফসোসকে। এতদিনের জমানো অনুভব, হারিয়ে যাওয়া সময়, সেসব আর ফিরে পাওয়া যায় না—তবে তারা পারে নতুন করে শুরু করতে। শ্রুতি জানায়, সে এখন একটা ছোট স্কুলে পড়ায়, বিয়ে করেনি। মিঠুন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এই মেয়েটা—যে ভালোবেসেছে চুপচাপ, অপেক্ষা করেছে কষ্ট নিয়ে, আজো তার সেই চাহনি একই রকম স্নিগ্ধ। সূর্য ডুবে যায় ধীরে ধীরে, কলেজ ক্যাম্পাসের বাতিগুলো জ্বলে ওঠে, আর তাদের মুখে ফিরে আসে সেই চেনা আলো, যেখানে শুধুই ভালোবাসা, আর কিছু নয়।
১০
শ্রুতি বসে ছিল জানালার পাশে, হাতের কাপে ধোঁয়া ওঠা চা, জানালার বাইরের আকাশটা হালকা মেঘে ঢাকা। কলেজে পড়ার সময় যে রুমটা ছিল তার, এখন সেটাই তার নিজের স্টুডিও। দেয়ালে জড়ানো সাদা ক্যানভাস, নিচে রাখা রঙের টিউব আর ব্রাশের ছড়াছড়ি। তার চোখে তখনও সেই চিঠির শব্দগুলো ঘুরছে — অরিত্রর হাতের লেখা, যেটা সে ভেবেছিল আর কোনোদিন দেখবে না। “যদি আবার তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি, কিছু বলার থাকলে বলো, না থাকলেও চুপ থেকে আমার চোখে তাকাও— আমি বুঝে নেবো।” দশ বছর পরে একটা চিঠি, তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা আবার এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
অরিত্র যে শহরে এসেছে, এটা সে জেনেছে সামাজিক মাধ্যমে এক বন্ধুর পোস্ট থেকে। আগে হলে হয়তো স্বপ্নেও ভাবতো না আবার ওর সঙ্গে দেখা হবে, কিন্তু এই চিঠিটা যেন সব হিসেব উল্টে দিলো। সে নিজেকে প্রশ্ন করছিল—যদি আবার দেখা হয়, যদি সত্যিই সে তার ভালোবাসা নিয়ে ফিরে আসে, তাহলে কী করবে সে? আরেকবার নিজেকে সেই অনিশ্চয়তা আর আবেগের মধ্যে ফেলবে? নাকি যেটুকু স্মৃতি নিয়ে শান্তিতে ছিল, সেটাই ধরে রাখবে? কিন্তু সে জানে, অরিত্রর চোখে তাকালে সব প্রশ্ন নিঃশব্দে গলে যাবে, ঠিক যেমনটা হতো কলেজ ক্যান্টিনে বসে থাকা মুহূর্তগুলোতে।
ওদিকে অরিত্র, এক পুরনো বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটছে ধূপগুড়ি রোডের পাশের গলিপথ দিয়ে। হাতে ধরা ডায়েরিটা—যেটা ছিল তার মায়ের, আর যেটার ভাঁজে একেকটা পাতায় লেখা ছিল শ্রুতির প্রতি অরিত্রর অনুভব, কিন্তু সেই সময় সাহস হয়নি বলে বলা হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর ডায়েরিটা পড়ে সে বুঝেছিল কতটা গভীর ছিল তার অনুভব, আর কতটা না বলা কথা জমে ছিল তার মধ্যে। মা বুঝেছিলেন, শ্রুতি ছিল তার জীবনের এমন এক অধ্যায়, যেটা কোনোদিন বন্ধ হয়নি, শুধু পৃষ্ঠাগুলো উল্টে যাওয়া বন্ধ ছিল। অরিত্র এবার নিজেকে আর থামাতে চায় না।
শেষ বিকেলের আলোয় তারা মুখোমুখি হলো শহরের এক পুরনো বইয়ের দোকানে, ঠিক যেখান থেকে শ্রুতি একদিন একটা কবিতার বই কিনে নিয়েছিল। দুজনেই থেমে গেল, চুপচাপ তাকিয়ে থাকল একে অপরের চোখে। কোনো অভিযোগ নেই, কোনো কৈফিয়ত নেই, শুধু দুটো চোখের গভীরে জমে থাকা বছরখানেকের কথা। শ্রুতি শুধু বলল, “তুমি দেরি করে এসেছো, কিন্তু চিঠিটা ঠিক সময়ে এসেছিল।” অরিত্র ধীরে উত্তর দিল, “এইবার আমি থামবো না। তুমি যদি চাও, আবার শুরু করতে পারি।” শ্রুতি একটুখানি হাসল—একটা দীর্ঘ অভিমানের, একটুকু ভরসার, আর ভেতর থেকে উঠে আসা এক নিষ্পাপ ভালোবাসার হাসি। সেই মুহূর্তে তারা বুঝে গেল, কিছু প্রেম কখনও হারায় না—শুধু একটু ঘুরে ফিরে, একদিন ঠিকই ফিরে আসে।
_____

1000050799.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *