Bangla - প্রেমের গল্প

প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচ

Spread the love

প্রীতম


শিয়ালদহ স্টেশনের বিকেলের চেনা ব্যস্ততা। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়ালে যে শব্দটা ওঠে—লোকের হাঁটার, announcements-এর কণ্ঠস্বর, ভ্যাপসা গরমে বাতাসের কম্পন—সেইসব কৌশিকের কাছে নতুন কিছু নয়। গত ছয় মাস ধরে, রোজ এই সময়েই, সে দাঁড়ায় একই জায়গায়—একটা পুরনো চায়ের দোকানের পাশের হলুদ রঙের খুঁটির সামনে। তার রুটিন প্রায় যন্ত্রের মতো: অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রাম ধরে স্টেশন, তারপর সেই নির্দিষ্ট কোচে উঠে বাড়ি ফেরা।

কিন্তু আজ কৌশিকের মন একটু অস্থির। সে ঠিক জানে না কেন। হয়তো কারণ, গত তিন দিন ধরে সে যার মুখ খুঁজছিল, সেই মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছে না।

মেয়েটির নাম জানে না কৌশিক। তারা কোনোদিন কথাও বলেনি।
তবু কৌশিক ঠিক জানে, ওই মেয়েটি ঠিক বিকেল পাঁচটা দশে প্ল্যাটফর্মে আসে। পরনে সবসময় সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ, চুল বাঁধা থাকে খোঁপায়, আর হাতে একটা পুরনো বই। প্রথম যেদিন তাকে দেখেছিল কৌশিক, সে ছিল ‘ঘরে বাইরে’ বইটা পড়তে পড়তে হাঁটছিল—সেই দৃশ্যটা যেন স্থির হয়ে আছে কৌশিকের মনে। মেয়েটির চোখ ছিল শান্ত, যেন শহরের সব কোলাহল থেকে নিজেকে আলাদা করে রেখেছে সে।

তিন দিন হলো, সে আসছে না।

আজ চা হাতে নিয়ে কৌশিক বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। পাঁচটা বেজে সাত। এখনও যদি আসে…
পাঁচটা দশ… পনেরো… কুড়ি।

না, আজও এল না।

কৌশিক ধীরে ধীরে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যায়। কোচে উঠে জানালার ধারে বসে পড়ে। সেই জায়গাটা যেখান থেকে প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচটা দেখা যায় স্পষ্টভাবে। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে পর্যন্ত, কৌশিক তাকিয়ে থাকে। মনটা খালি খালি লাগে।

“সেই মেয়েটি কি অসুস্থ?” — নিজেকে প্রশ্ন করে।

আরো একবার দেখতে চাইছিল সে। শুধু চোখে চোখ রাখতে, জানাতে চাইছিল কিছু—নাকি নিজেকেই বোঝাতে চাইছিল যে এই শহরে তার একটুখানি জায়গা আছে, যে জায়গা শুধু তাকেই মনে রাখে?

ট্রেন ছাড়ে।

কৌশিক হঠাৎই ভাবতে থাকে, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? একটা অচেনা মেয়েকে নিয়ে এত ভাবা কি যুক্তিসংগত?

অথচ সব কিছু ভেবে দেখলে, সেই মেয়েটিই তো ছিল তার এই অফিসের ক্লান্ত দিনগুলোর একমাত্র চমক। তার মুখে কৌতূহলের হাসি, চোখে যেন অদেখা গল্পের খেলা—তাতে কৌশিকের অফিসফেরতা একঘেয়েমি ফিকে হয়ে যেত।

বাড়ি ফিরে কৌশিক কিছুতেই মন বসাতে পারে না। সে মোবাইল নিয়ে বসে পড়ে। মনে মনে ভাবে—স্টেশনের আশেপাশে কি কেউ তার ছবি তুলে ফেলেছিল? কোনো সামাজিক মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে?

“মেয়েটি কি নিয়মিত এই রুটেই যাতায়াত করে?”
“নাকি সে এখন আর আসে না?”
“তার কোনো বাধা তৈরি হয়েছে কি?”

এইসব ভাবতে ভাবতেই সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। আগামীকাল সে একটু আগে যাবে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকবে—যতক্ষণ না মেয়েটি আসে, বা যতক্ষণ না তার মন থেকে সরে যায় এই অজানা আকর্ষণ।

পরদিন, কৌশিক আরও পনেরো মিনিট আগে পৌঁছে যায় স্টেশনে। ব্যাগে আজ সে বই এনেছে—‘পথের পাঁচালি’। মনে মনে ভাবে, মেয়েটি যদি আসে, তবে বইটা দেখে সে হয়তো হাসবে।

ঘড়ির কাঁটা ঠিক পাঁচটা দশে আসে।
কৌশিক উঠে দাঁড়ায়। চোখ যায় প্ল্যাটফর্মের শেষ দিকে।
হ্যাঁ…!

সাদা সালোয়ারে মেয়েটি হেঁটে আসছে। চুল আজ খোলা, হাতে নেই বই—তবে মুখে সেই চেনা নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি। কৌশিকের হৃদস্পন্দন যেন আটকে যায় কিছুক্ষণ।

মেয়েটি একবার তাকায় তার দিকে।

কৌশিক জানে, এই মুহূর্তটা যদি সে মিস করে, তাহলে এই সম্পর্ক আর এগোবে না।
সে এগিয়ে যায়।
এক ধাপ… দুই ধাপ…

হঠাৎ announcement হয়—“Local to Sonarpur is arriving shortly on platform number five.”

লোকজন নড়েচড়ে বসে, ভিড় বাড়ে। কৌশিক কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। মেয়েটিকে চোখে হারায় সে।

ট্রেন আসে। থামে। দরজা খোলে। কৌশিক কোচের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে খোঁজে।

সেই মুহূর্তেই সে দেখে—মেয়েটি দাঁড়িয়ে ঠিক তার বিপরীত পাশে, জানালার ধারে। চোখে তাকিয়ে আছে।

এই প্রথম… তাদের চোখে চোখ পড়ে।
দুজনেই ধীরে হাসে।

এই মুহূর্তটা হয়তো কেবল কয়েক সেকেন্ডের, কিন্তু কৌশিক জানে—এই চাহনির গভীরতাই আজকের ক্লান্ত দিনটিকে অর্থ দেয়।

ট্রেন চলতে শুরু করে।

কৌশিক জানে, এটা শুরু—এক অদ্ভুত, অনামা, চোখের ভাষায় বলা প্রেমের গল্পের।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কৌশিকের মনে পড়ে যায় সেই চাহনির কথা। চোখে চোখ রেখে সেই হাসিটা… যেন দুজনেই কিছু না বলেই অনেক কিছু বলে ফেলেছিল। সারা রাত ঘুম আসেনি তার। বালিশের পাশে রাখা পথের পাঁচালি বইটার পাতায় মাঝে মাঝে চোখ রাখছিল, কিন্তু পড়া হচ্ছিল না।

আজ সে একটু ভিন্নভাবে প্রস্তুতি নেয়। নতুন করে ইস্ত্রি করা শার্ট পরে, চুল আঁচড়ে নেয় যত্ন করে। অফিসে গেলেও মন পড়ে থাকে সন্ধ্যার দিকে। সে বারবার ঘড়ি দেখে, সময় যেন আজ একটু বেশি ধীরে চলে।

অফিস শেষে সে স্টেশনে আসে যথারীতি, কিন্তু আজ ভিড়টা যেন একটু বেশিই। পাঁচটা দশে দাঁড়িয়ে সে চোখ রাখে সেই চেনা প্রান্তে—আবারও সাদা সালোয়ার। মেয়েটি এসেছে। কৌশিকের বুকের মধ্যে ছোট্ট শব্দ করে কিছু কাঁপে।

মেয়েটির আজ চোখে কাজল নেই, তবে মুখটা অন্যরকম—একটু গম্ভীর। তার কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, আর হাতে একটা ছোট্ট নোটবুক ধরা। কৌশিক অবাক হয়ে ভাবে—সে কি এবার তাকে লক্ষ্য করছে?

মেয়েটি ধীরে ধীরে হাঁটছে। হঠাৎ একটা ঝটকা দেয় ভিড়। কৌশিক একটু হোঁচট খায়, কিন্তু সামলে নেয়। মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরায় না। এক সময় তারা কাছাকাছি আসে। খুব কাছাকাছি।

দুজনের মাঝে তখন এক হাত ফাঁকা জায়গা।

কৌশিকের বুক ধুকপুক করে। কিছু বলবে কি?

ঠিক তখনই মেয়েটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। কৌশিক অবাক হয়ে নেয় কাগজটা। কিছু বলতে যাবার আগেই ট্রেনের সাইরেন বাজে। মেয়েটি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় এবং কোচে উঠে পড়ে।

কৌশিক হতবাক। কি হলো এটা?

সে কাগজটা দেখে। ছোট্ট একটা হাতের লেখা—

“তোমার চেহারায় একটা প্রশ্ন থাকে, চোখে একটা গল্প।
আমিও প্রতিদিন খুঁজি তোমায়।
তবে কথা নয়—এই গল্পটা চুপিচুপি হোক, যদি চাও।”

নিচে লেখা—”P.N.5″

কৌশিকের ঠোঁটে হাসি আসে। মেয়েটি তো তাকে দেখছে অনেকদিন ধরেই!
সে শুধু তাকিয়ে থেকেছে, আর মেয়েটি তাকে বুঝে ফেলেছে এতদিনে।

কিন্তু “P.N.5”?

প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচ? নাকি এটা মেয়েটির নামের আদ্যক্ষর? না কি শুধুই সংকেত?

সেই রাতে কৌশিক নিজের পুরনো খাতাটা খুঁজে বের করে। অনেকদিন কিছু লেখেনি। আজ আবার কলম ধরল।

একটা পাতায় লিখল—

“যদি কথা না হয়, চোখে চোখে হোক,
যদি নাম না জানি, তবু প্রেম হোক।
তুমি চাইলে, আমিও চুপচাপ চলব এই গল্পের পথে।”

পরের দিন সেই পাতাটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে রাখে।

আজ সে মেয়েটির কোচেই উঠবে—ঠিক পাশের দরজায় দাঁড়াবে।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাগজটা সে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেবে।

তবে কি এই সম্পর্ক সত্যিই কিছু হতে চলেছে?

প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে আজ একটু বেশি আলো। মেঘ সরে গিয়েছে, আকাশ ঝকঝকে, আর কৌশিকের মনটাও যেন খানিকটা পরিষ্কার। ছ’মাস ধরে রোজ যে মেয়েটিকে দেখে আসছিল, তার সঙ্গে হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার পরে, আর তার হাতে লেখা ছোট্ট চিরকুট পাওয়ার পরে, আজ প্রথমবার কৌশিক সাহস করে কিছু দিতে চলেছে।

ভাঁজ করে রাখা কাগজটা তার বুকপকেটে। ভেতরে একটা কবিতা—না, আসলে তার মনের কথা।

সকালে বেরোনোর সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে একটু হেসেছিল কৌশিক। স্রেফ চোখের ভাষায়, একটা অচেনা সম্পর্ক গড়ে উঠছে—তাও কি সম্ভব?

স্টেশনে পৌঁছে আজ একটু দেরি করে চা খায়। তারপর সেই পুরোনো হলুদ খুঁটির পাশে এসে দাঁড়ায়। সময় দেখে—পাঁচটা সাত।

তিন মিনিট বাকি।

এই তিন মিনিটের মধ্যে তার মাথার মধ্যে যেন হাজারটা কথা ঘুরছে।

“সেই মেয়ে আসবে তো?”
“আবার কিছু দেবে?”
“না কি আজ কিছু বলবে?”
“নাকি, আজ না আসলে সব শেষ?”

ঠিক তখনই লোকজনের ভিড় খানিকটা সরে গেলে সে দেখতে পায়—মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে একটু দূরে, ব্যাগটা কাঁধে, আর চুল আজ খোঁপায় গোঁজা। মুখটা শান্ত, একটুও অবাক নয়। বরং যেন কৌশিকের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে।

সে কি চিনেছে কৌশিককে আগেই?

আজও তার হাতে একটা ছোট নোটবুক। কিন্তু চোখ আজ কৌশিকের উপর স্থির। যেন বলছে—“তুমি দেবে তো কিছু?”

কৌশিক ধীরে ধীরে এগোয়। দুইজনের মাঝে আর কয়েক পা দূরত্ব।

সে বুকপকেট থেকে কাগজটা বের করে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। কিছু না বলে।

মেয়েটি থামে, কাগজটা নেয়। চোখের ইশারায় বলে—”তোমার লেখা?”

কৌশিক মাথা নাড়ে।

মেয়েটি হাসে, ভাঁজ খুলে পড়ে। চোখে একরকম আলো ঝলকে ওঠে।

তারপর সে পকেট থেকে আরেকটা কাগজ বার করে দেয় কৌশিককে।

আজকের চিঠিতে লেখা—

“প্রেমে মুখের ভাষা না থাকলেও, চোখে সব লেখা থাকে।
তোমার চোখে আমি নিজেকে খুঁজি।
তুমি কি ঠিক করেছ?
এই পথটাতে হাঁটবে আমার সঙ্গে?”

কৌশিক বুঝে যায়—এটা খেলার শুরু নয়, বরং এক নীরব যাত্রার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা।

ট্রেন এসে যায়। তারা দুজনেই পাশাপাশি হাঁটে। একসঙ্গে এক কোচে উঠে পড়ে, কিন্তু পাশে বসে না। উল্টো দুই জানালার ধারে, মুখোমুখি।

একবারও মুখে কোনো কথা হয় না।

কিন্তু দুই চোখের মধ্যে কথা হয় একরাশ। যেন দুটি নৌকা ভাসছে একই নদীতে, শুধু মাঝখানে একটা স্রোত আছে।

স্টেশন ছেড়ে ট্রেন ছুটছে, আর তারা তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। কখনো জানালার বাইরে, কখনো চোখে চোখে।

ট্রেনের গতি বাড়ে, কিন্তু সময় যেন স্থির।

সন্ধ্যার আলো পড়ে মুখে, জানালায় কাচে প্রতিচ্ছবি হয়। মেয়েটির চোখ তখন নিচের দিকে, কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিচ্ছে নোটবুকে।

হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ায়।
কৌশিক একটু চমকে যায়।

মেয়েটি এক ধাপ এগিয়ে এসে কৌশিকের সামনে দাঁড়ায়।
একটু ঝুঁকে কানে কানে বলে—

“আমার নাম অনিন্দিতা।
তোমার?”

কৌশিক কিছুক্ষণ থমকে থাকে। তারপর তার চোখে চোখ রেখে বলে—

“কৌশিক।”

অনিন্দিতা হালকা মাথা নাড়ে। তারপর আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে।

ট্রেন থামে। অনিন্দিতা উঠে পড়ে। নামার আগে আবার একবার তাকায় কৌশিকের দিকে।

চোখে একটাই কথা—”আমি থাকব, তুমি থাকো?”

কৌশিক মাথা নাড়ায়। জানে, এই প্ল্যাটফর্ম, এই ট্রেন, এই চোখের ভাষা—সবটা নতুন করে জীবনের অর্থ তৈরি করছে।

আর ততক্ষণে তার বুকের মধ্যে নতুন একটা কল্পনা গজিয়ে উঠছে—পরবর্তী চিঠির জন্য।

অফিস থেকে ফিরেই কৌশিক আজ প্রথমবার জানলা খুলে বসে। তার ফ্ল্যাটটা যাদবপুরের এক পুরনো বিল্ডিং-এর তিন তলায়। জানলার বাইরে একটা কাঁঠালগাছ, তাতে সন্ধ্যার পাখি বসে। অনেকদিন পরে সে শহরের শব্দ শুনছে নতুন করে—হর্ন, রিকশার ঘন্টি, দূর থেকে আসা ট্রেনের হুইসেল।

তার মনে আজ একটা অন্যরকম প্রশান্তি।
অনিন্দিতা।
মেয়েটির নাম আজ সে জানল।
অনিন্দিতা—মানে যে অন্ধকার নয়। নামটাও যেন ওর মতোনই। চোখের মধ্যে একরাশ আলো, অথচ মুখে চুপচাপ এক গভীরতা।

কৌশিক নিজের খাতাটা খুলে নতুন করে লিখতে শুরু করে। কিছু না ভেবেই কলম চলে যায় এক পঙক্তি থেকে আরেক পঙক্তিতে। তার লেখা আজ যেন কারোর উদ্দেশে নয়, বরং কারোর স্পর্শে। অনিন্দিতার চোখের ভাষা যেন তাকে লেখার শক্তি দিয়েছে।

পরদিন কৌশিক খাতার একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ভাঁজ করে পকেটে রাখে। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ‘চিঠি খেলা’ সে চালিয়ে যাবে, যতদিন অনিন্দিতা চায়।

স্টেশনে পৌঁছে দেখে আজ একটু বেশি ভিড়। পাঁচটা সাত মিনিট বাজে। কৌশিক নিজের জায়গা নিয়ে নেয়।

পাঁচটা দশ।

দূরে সাদা কামিজ আর লাল ঝোলা ব্যাগ নিয়ে অনিন্দিতা হাঁটছে ধীরে ধীরে। আজ তার মুখে একরকম গম্ভীর ভাব।

কৌশিক ভাবছিল, কালকের কথোপকথনের পর আজ একটু চোখের হাসি দেখবে। কিন্তু অনিন্দিতা আজ যেন কিছু ভাবনায় ডুবে আছে।

সে এসে কৌশিকের সামনে দাঁড়ায়। দুজনেই একটু চুপ।

কৌশিক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে তার হাতে দেয়।

অনিন্দিতা কাগজটা নেয়, পড়ে। তারপর একটানা তাকিয়ে থাকে কৌশিকের চোখে।

— “তুমি কি মনে করো… এইভাবে, না বলেই, একে অপরকে চেনা যায়?”

প্রথমবার!
অনিন্দিতা মুখে কথা বলল।

কৌশিক একটু থমকে যায়। তারপর ধীরে মাথা নাড়ে।

— “হয়তো বলা নয়, বোঝার খেলাই সত্যি। কথা তো সবাই বলে, কিন্তু চোখ যদি মেনে না নেয়, কথার মূল্য থাকে না।”

অনিন্দিতা মৃদু হাসে।

— “বেশ বলেছ। কিন্তু আমি একটু ভয়ে আছি, কৌশিক। যদি এটা কোনো ফাঁদ হয়?”

— “কোনো ফাঁদ নয়। যদি হয়, তাহলে আমি প্রথমেই ধরা পড়তে রাজি।”

দুজনেই একটু হেসে ফেলে।
ট্রেন আসে। তারা পাশাপাশি বসে।

আজ তারা একে অপরকে দেখে না। বরং বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কৌশিক বলে, “অনিন্দিতা, তোমার কোনো ফোন নম্বর… মানে, যদি কোনোদিন এই ট্রেন না মেলে?”

অনিন্দিতা চুপ থাকে। তার মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়।

— “আমি চাই না, এই গল্পটা মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে যাক। এই নীরবতার একটা ছন্দ আছে। আমরা যদি ফোনে কথা বলতে শুরু করি, তবে হয়তো এই চোখের ভাষাটা হারিয়ে যাবে।”

কৌশিক চুপ করে থাকে।

বুঝে যায়—এই সম্পর্ক খুব যত্নের, খুব ভঙ্গুর।

কিন্তু সে অনিন্দিতার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।

— “ঠিক আছে, তবে আজ থেকে এই ট্রেনটাই আমাদের কথা বলার মাধ্যম। যে দিন তুমিও চাও, আমি নেমে যাব। কথা না বলে, চোখে চোখ রেখে।”

অনিন্দিতা ধীরে মাথা নাড়ে।

— “তুমি একটা চিঠি লিখে রেখো প্রতিদিন। আমি নেব কি না, সেটা আমার ইচ্ছা। আজ আমি দিচ্ছি না কিছু। শুধু নিলাম। কারণ অনেক প্রশ্ন আজও আমার মাথায় ঘুরছে।”

— “যেমন?”

— “যেমন, তুমি আমার চোখে কি দেখেছ যে এত চিঠি লিখছ?”

কৌশিক এক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর বলল,

— “তোমার চোখে আমি নিজেকে দেখেছি। আর নিজের ভেতরে যা খুঁজে পাই না, তা তোমার চোখে পেয়েছি। এটুকুই।”

অনিন্দিতা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,

— “আমার নাম অনিন্দিতা। কিন্তু তুমি আমায় ডাকতে পারো P.N.5 নামে। ঠিক যেমন তোমার গল্পে প্রথম এসেছিলাম।”

ট্রেন থামে। আজ অনিন্দিতা আগে নামেনি। বরং কৌশিক নামে।

নেমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে বলে,
— “আগামীকাল আবার চিঠি থাকবে। তুমি যদি চাও, নিতে পারো। নইলে বাতাসে উড়িয়ে দেব।”

ট্রেন চলে যায়।

কৌশিক একা দাঁড়িয়ে থাকে প্ল্যাটফর্মে। তার মুখে কোনো হতাশা নেই। বরং এক ধরনের আশ্বাস। জানে—এই প্রেম ধীরে গড়ে উঠছে। চোখে চোখ রেখে, চিঠির পঙক্তিতে ভর করে, নীরবতার ভাষায়।

পরদিন সকাল থেকেই কৌশিকের মাথায় একটা চিঠি ঘুরছে। না, সে চিঠিটা এখনও লেখেনি, কিন্তু লেখা হয়ে গেছে তার মনের ভেতর অনেক আগেই। গতরাতে ঘুমনোর আগে বারবার ভেবেছে—আজকে কী লিখবে? আগের দিনের মতো কবিতা নয়। আজ সে চাইছে একটা গল্প বলবে।
নিজের গল্প নয়, বরং ওদের দুজনের গল্প, যেটা এখনো লেখা হয়নি, কিন্তু শুরু হয়েছে এক চোখের চাহনি থেকে।

চিঠির শুরুতে সে লিখল—

“অনিন্দিতা,
তুমি যদি কখনও না আসো, আমি প্ল্যাটফর্মে ঠিক তবুও দাঁড়িয়ে থাকব।
কারণ সব প্রেমকে পৌঁছাতে হয় না, কিছু প্রেম শুধু অপেক্ষার মতোই থাকে।
তবু যদি এসো, আজকের চিঠিতে আমি তোমায় একটা গল্প বলব।
তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দিনটার গল্প।”

চিঠিটা সে ভাঁজ করে রাখল। বুকের পকেটে নয়, এবার সে রাখল ট্রেনের টিকিটের ভেতর। যেন সেটা একটা যাত্রার পাস—শুধু গন্তব্য জানা নেই।

স্টেশনে পৌঁছে সে দেখে আজ ব্যতিক্রমী ভিড়। রেললাইন মেরামতির কারণে অন্য ট্রেনের যাত্রীও এখানে জমে উঠেছে। কিন্তু কৌশিক নিজের জায়গা নেয় যথারীতি। মাথা নিচু করে বই বের করে—আজ রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’।

পাঁচটা সাত।
পাঁচটা নয়।
পাঁচটা দশ।

আজ মেয়েটি এখনও আসেনি।
তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ে।

পাঁচটা বারো মিনিট।
হঠাৎ একটা হাত ধীরে তার সামনে বাড়িয়ে দেয়।

কৌশিক তাকিয়ে দেখে—অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে।

আজ সে একদম কাছে। মুখে একরাশ ক্লান্তি, কিন্তু চোখে সেই পরিচিত আলো। হাতে নেই চিঠি বা বই—শুধু একটা ছোট কাগজের ঠোঙা, যেখানে কিছু মুড়ি আর মাখা চানাচুর।

— “খাবে?”
প্রথম প্রশ্নটা আসে অনিন্দিতার মুখ থেকে।

কৌশিক হাসে। — “তুমি আজ দেরি করলে।”
— “জানি। আমার অফিসে আজ একটা রিপোর্ট জমা দেওয়ার ছিল। দৌড়ে এসেছি। পাছে তুমি ভেবে বসো, আমি আর আসবো না।”

কৌশিক মুচকি হাসে। — “তুমি আসবে, আমি জানতাম।”

ওরা দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়ায়। ভিড়ের মাঝে একটু দূরে। মুড়ি ভাগ করে খায়।

হঠাৎ কৌশিক বলে—
— “আজকের চিঠি ট্রেনের টিকিটের ভেতর।
তুমি নিতে চাইলে, আমি জানালার পাশে রেখে দেব।
যদি না চাও, আমি আবার নিয়ে যাব। কোনও অভিযোগ থাকবে না।”

অনিন্দিতা কিছু বলে না।

ট্রেন আসে।

ওরা পাশাপাশি এক কোচে ওঠে, কিন্তু বসে না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
ভেতরে কৌশিকের হাত টিকিটের খাঁজে রাখা সেই চিঠির দিকে।

স্টেশন ছেড়ে দেয় ট্রেন।

হাওয়ার মধ্যে চুল উড়ে যাচ্ছে অনিন্দিতার। চোখে জল নেই, কিন্তু একরকম বিস্ময় আছে।

— “তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো, এমন সম্পর্ক থাকতে পারে?”
— “আমি বিশ্বাস করি, দুটো মানুষ চাইলে, একটুও ছুঁয়ে না থেকেও, তারা অনেক কিছু গড়ে তুলতে পারে। একটা সম্পর্ক শুধু দেখা বা ছোঁয়ার নয়—শুধু বোঝার, জানার।”

অনিন্দিতা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। তারপর হালকা গলায় বলে—
— “তাহলে আমি আজ তোমার চিঠিটা নিচ্ছি। তবে শর্ত আছে।”

— “শর্ত?”

— “কাল আমি আসব না। না কোনো কারণে, না কোনো অভিমান থেকে। শুধু দেখে নিতে চাই, তুমি ঠিক কী করো আমার অনুপস্থিতিতে।”

কৌশিক চুপ করে থাকে। তারপর বলল—

— “আমি চিঠিটা তবুও লিখে রাখব। হয়তো রেখে দেব জানালায়। বাতাস যদি নিয়ে যায়, নিয়েই যাক।”

ট্রেন থামে।

অনিন্দিতা নেমে পড়ে। কৌশিক দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে তাকায়।

এই প্রথম, অনিন্দিতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় না। চলে যায়।

কৌশিক দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। হাতে টিকিট নেই, চিঠিও নেই।

সেদিন রাতে সে লেখে—

“আজ তুমি থাকবে না জেনে,
তোমার ছায়ার সঙ্গেই সময় কাটাবো।
কোনো ছোঁয়া নেই, তবুও উষ্ণতা বুকে রাখবো।
এটাই প্রেম—না কি?”

সকালের সূর্যটা আজ কৌশিকের জানালায় ঢুকেও যেন আলো দেয় না। অনিন্দিতা আগেই বলে দিয়েছিল—সে আজ আসবে না। কোনো কারণ নেই, কোনো অভিমান নেই। শুধু দেখতে চায়, অনুপস্থিতি কী ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষার পাশে।

কৌশিক চুপ করে বসে থাকে নিজের লেখার খাতার সামনে। আজকের চিঠি সে আগেই লিখে রেখেছে। কিন্তু জানে, অনিন্দিতা পড়বে না।

তবুও লিখেছে।
কারণ কিছু প্রেমে উত্তর পাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু প্রশ্ন তোলা গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের চিঠিতে সে লিখেছে—

“তোমার না-থাকাটাও উপস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় আমার পাশে।
আজ তুমি নেই, অথচ সমস্ত ট্রেনজুড়ে শুধু তুমিই।
তুমি যদি কখনো ফিরে না আসো, আমি তবুও জানালার ধারে বসে থাকব—
এই চিঠিটা নিয়ে।”

চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দেয় বুকপকেটে।
আজ সে জানে, কাউকে দেবে না, শুধু জানালায় রেখে আসবে।
বাতাস নিক, কিংবা ট্রেনের ধাক্কায় খসে যাক প্ল্যাটফর্মে—এটাই চেয়েছে অনিন্দিতা।

স্টেশনে পৌঁছে কৌশিক আরও একটু বেশি সতর্ক। অনিন্দিতাকে খুঁজে না পেলেও তার চিহ্ন যেন আজ চারদিকে ছড়িয়ে আছে।
হলুদ খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্য করে—আজ মেয়েটা নেই।
ঠিক যেমনটা বলেছিল।

কিন্তু তার জায়গাটা খালি।
আর সেই খালি জায়গা যেন আজ সবচেয়ে বেশি ভরপুর।

কৌশিক ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে।

সে মনে করে প্রথম দিনের সেই চাহনি, পরের দিনের চিঠি, মুড়ি ভাগ করে খাওয়া বিকেল, আর সেই নাম—P.N.5।

আসলে নাম নয়, ও যেন এক ধরণের সংকেত।
নীরবতার, নির্ভরতার, না-বলা কথার।

ট্রেন আসে। কৌশিক জানালার ধারে বসে।
পকেট থেকে চিঠিটা বের করে ধীরে ভাঁজ খুলে রাখে জানালার কিনারায়।

একটু বাতাসে কাঁপে চিঠির কাগজ।

কৌশিক চুপচাপ বসে থাকে।
চোখে জল নেই, কিন্তু একটা ভারী অনুভূতি বুকের মধ্যে।

হঠাৎ ট্রেনের একটা মোচড় লাগে, আর চিঠিটা উড়ে যায় জানালার বাইরে।

সে চোখ মেলে তাকায়। কাগজটা হাওয়ার মধ্যে ভাসছে, ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মের দিকে নামে।

সে জানে না কাগজটা কেউ কুড়িয়ে পাবে কিনা।
তবে জানে—যদি ভাগ্যচক্রে, বাতাসে, কিংবা কাকতালীয়তায়, সেটা অনিন্দিতার হাতে পৌঁছায়, সে বুঝবে, আজকের অনুপস্থিতি কৌশিক কীভাবে বহন করেছে।

ট্রেন ছুটে চলে।

জানালার পাশে কৌশিক বসে থাকে, চোখে ধরা পড়ে না এমন এক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে।

— “তুমি নেই, তাই যেন সবচেয়ে বেশি আছো।”
মনে মনে এই কথাটা বলে সে।

রাতের দিকে, কৌশিক নিজের খাতায় একটা লাইন লেখে—

“আজ তুমি ছিলে না।
তবুও তোমার ছায়া ঠিক আমার পাশে বসেছিল।”

দুদিন পর আবার দেখা হবে, অনিন্দিতা কি ফিরে আসবে?

সেই রাতে হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ আসে—নাম্বারটা অচেনা।
মেসেজে লেখা:

“আমার ঠিক পাশে এক মহিলা আপনার চিঠিটা কুড়িয়ে পেয়েছেন।
তিনি ভেবেছিলেন প্রেমপত্র, তাই আমায় দেখান।
আমি চিঠির ভিতর আপনার নাম খুঁজে পাইনি।
তবু জানি, এটা আমারই জন্য লেখা।
ভালো থেকো জানালার ধারে।
আমি ফিরে আসব।”

কৌশিক হাসে।

চোখে জল আসে না, কিন্তু বুকটা হালকা হয়।

সে জানে—চিঠির মতো প্রেমও বাতাসে ভাসে।
ঠিক সময়ে পৌঁছায়, ঠিক মানুষটার কাছে।

পরদিন সকালে কৌশিক ঘুম থেকে উঠে জানালার বাইরে তাকায়। কুয়াশা জমেছে হালকা, রোদের আলো একটুখানি ফোটার চেষ্টা করছে। মাথার ভেতরে বারবার ঘুরছে কাল রাতের সেই মেসেজটা।

“আমি ফিরে আসব।”
এত কম শব্দ, অথচ এত শক্তিশালী।

সে জানে না, মেসেজটা সত্যিই অনিন্দিতার পাঠানো কিনা। কিন্তু সে জানে, এটা তারই ভাষা। এতটুকু কথা যে বলতে পারে, সে নিশ্চয়ই চোখে চোখ রেখে এতদিন যা বলেছে, সেগুলোও সত্যি।

আজ কৌশিক আর চিঠি লেখেনি। আজ সে শুধু নিয়ে যাবে নিজের দেখা—যেভাবে দেখা যায় কাছের কাউকে, চোখে নয়, মনে।

স্টেশনে পৌঁছে কৌশিক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে না। বরং আজ একটু দূরে, সেই পুরনো হলুদ খুঁটির ঠিক উল্টোদিকে একটা পিলারের পাশে। সে নিজের ভেতরকার অপেক্ষাকে যেন একটু ধৈর্যের চাদরে মুড়ে রাখছে।

পাঁচটা দশ বাজে।

তার চোখে আজ কোনো উৎকণ্ঠা নেই। শুধু নির্ভরতা।

তখনই সে দেখে, ভিড়ের মাঝখান দিয়ে কেউ হেঁটে আসছে ধীরে ধীরে। সাদা-নীল প্রিন্টের সালোয়ার, কাঁধে লাল ব্যাগ, চুল খোলা।

অনিন্দিতা।

সে আজও কারো দিকে তাকায় না। বরং একটা সোজা পথ ধরে হাঁটে—সরাসরি কৌশিকের কাছে এসে থামে।

চোখে চোখ। কোনো শব্দ নেই।

তারপর হঠাৎ সে বলে,
— “তুমি কি জানালে চিঠি রেখে দিয়েছিলে?”

কৌশিক মাথা নাড়ায়।

— “তুমি পেয়েছিলে?”

অনিন্দিতা হালকা হাসে।
— “না, আমি পাইনি। তবে পেয়েছিল এক বয়স্ক মহিলা, সে পাশের ট্রেনে উঠেছিল। চিঠিটা পড়ে সে ভাবল ওর স্বামীর প্রেমিকা লিখেছে। পরে যখন তার নাতনী সেটা দেখে পড়ে, তখন বলল—এটা তো কাউকে ভালোবাসার কবিতা। তখনই সে তোমার নাম না পেয়ে ভাবল, হয়তো ভুল হাতে গেছে।”

— “তাহলে তুমি কীভাবে বুঝলে এটা তোমার জন্য?”

— “কারণ আমি জানি, আমি ছুঁয়ে ফেলেছি তোমার চিন্তা। তাই চিঠিটাও আমারই জন্য লেখা।”

দুজনেই চুপ।

স্টেশনে এক announcements বেজে ওঠে—
“Ladies first class coach will stop near platform pillar C2…”

কৌশিক বলে,
— “তুমি কি আজ চিঠি চাও?”

অনিন্দিতা একটুও ভাবল না, বলল,
— “না। আজ আমি শুধু তোমার পাশে বসতে চাই।”

ট্রেন আসে। দুজন পাশাপাশি কোচে ওঠে। ভিড় তেমন নেই। একটানা জানালার ধারে বসে পড়ে তারা।

অনিন্দিতা বলে,
— “আমার নাম তুমি জানো। কিন্তু আমার গল্পটা জানো না।”
কৌশিক চুপ করে।

— “আমি একটা ভাঙনের ভেতর দিয়ে এসেছি। একসময় খুব বিশ্বাস করতাম, কোনো না-কথার প্রেমও গভীর হয়। কিন্তু সেখানে আমি একা ছিলাম, আর ও ছিল অন্য কারো জন্য অপেক্ষমাণ।”

কৌশিক ধীরে বলে,
— “তুমি ভয় পাও—এই গল্পটাও যদি সেইরকম হয়?”

— “হ্যাঁ। আমি ভয় পাই। কিন্তু তার থেকেও বেশি ভয় পাই, যদি এই নীরবতাটা শেষ হয়ে যায়।”

— “তাহলে চলো, আজ কোনো চিঠি নয়, কোনো গল্প নয়। শুধু আমি আর তুমি—একটা ট্রেনের জানালার পাশে বসে থাকি। ঠিক যেমন আছি।”

অনিন্দিতা জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
— “তুমি জানো? আমি এই ট্রেনে ওঠা শুরু করেছিলাম আমার পুরনো রুটিনটা ভাঙার জন্য। আমি চেয়েছিলাম নিজেকে নতুন করে চিনতে। আর ঠিক তখনই তুমি।”

— “তুমি কি জানালে আগে কখনো কাউকে এমনভাবে দেখেছ?”

অনিন্দিতা মৃদু মাথা নাড়ে।

— “তুমি?”

— “না। আমি কাউকে এভাবে দেখিনি, এভাবে চিঠি দিইনি, এভাবে চোখে চোখ রেখেও এত কথা বলিনি।”

অনিন্দিতা এবার আস্তে আস্তে তার ব্যাগ খুলে একটা কাগজ বার করে।

— “এই চিঠিটা আমি অনেকদিন আগে লিখেছিলাম। কারোর জন্য নয়। নিজের জন্য। যদি কখনো এমন কেউ আসে, যার চোখে আমি নিজের শান্তি খুঁজে পাই, তার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। আজ তোমাকে দিতে চাই।”

কৌশিক ধীরে কাগজটা নেয়। খুলে দেখে একটাই লাইন:

“যদি তুমি থেকে যাও, আমি ফিরবো—আমার সমস্ত না-বলা গল্প নিয়ে।”

ট্রেন থামে।
আজ কৌশিক নামল না।
অনিন্দিতা উঠে দাঁড়ায়।

কিন্তু যাবার আগে বলে,
— “কাল আমি আবার আসব।
তবে এবার একটা সত্যি চিঠি চাই।
তোমার পুরোটাই লিখে দিও। তোমার ভয়, তোমার ইচ্ছে, তোমার প্রথম প্রেম—সব। আমি জানতে চাই, আমার পাশে যে বসে থাকে, তার ভেতরটা ঠিক কেমন?”

কৌশিক তাকিয়ে থাকে।

তাকে মনে হয়, এই ট্রেনটার কোনো গন্তব্য নেই।
এটা কেবল এক সম্পর্কের লাইনে চলা গল্প।
যেখানে গতি আছে, ছোঁয়া নেই। শব্দ আছে, কিন্তু উচ্চারণ নেই।

সকালে কৌশিক খাতার পাতায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আজকের চিঠি যে অন্যরকম হতে চলেছে, সেটা সে জানে। অনিন্দিতা চেয়েছে একটা সত্যি চিঠি—সব ভয়, সব ইচ্ছের খোলামেলা প্রকাশ।

এতদিন যা সে ভেবেছে, বুঝেছে, কিন্তু কোনোদিন মুখে বলেনি—আজ সেইসবকিছুকে শব্দ দিতে হবে।

চোখ বুঁজে কলম তোলে। লিখতে শুরু করে—

“অনিন্দিতা,

এই চিঠিটা আর প্রেমিকের কবিতা নয়,
এটা আমার নিজের খোলস থেকে বেরোনোর দিন।

তুমি যখন আমাকে প্রথম দেখেছিলে, আমি হয়তো সাধারণ একজন মানুষই ছিলাম—অফিস ফেরত, ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ। কিন্তু আসলে আমি তখন এক একটা দিন টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে ছিলাম।
প্রেমে আমি একবার হেরেছিলাম।
তখনকার সম্পর্কটা শেষ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ।
কেউ কিছু বলেনি, বোঝায়নি—শুধু হঠাৎ একদিন চিঠি আর ফোন সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একটা ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে—যেখানে আর কোনো ট্রেন ঢুকবে না, তেমনটাই মনে হতো।

তারপর অনেক বছর কাটে।
নিজেকে আমি কাজে ডুবিয়ে রাখি।
বন্ধুদের আড্ডায় গা দিই না, পারিবারিক প্রশ্ন এড়িয়ে চলি।
আমার ভেতরে এক ধরনের নির্জনতা জমে ওঠে।

তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন বিকেলে, যখন তুমি বই পড়ছিলে।
আমি প্রথমে চমকে উঠেছিলাম, কারণ আমার হারিয়ে যাওয়া সাহস তোমার চোখে ছিল।
তুমি আমার দিকেও তাকাওনি, তবুও আমার চোখ আটকে গিয়েছিল তোমার মুখে।

আমি তোমাকে খুঁজতে শুরু করলাম না—তোমাকে খুঁজে পাওয়া শুরু হয়ে গেল।
তুমি রোজ ঠিক সময়ে আসতে, আর আমি প্রতিদিন একটু একটু করে সাহস খুঁজে পেতাম।

তোমার চোখে আমি সেই আলোটা দেখেছি, যা কোনো এক সময় আমারও ছিল।
তুমি শুধু অচেনা নয়, তুমি আমার নিজেরও অনেকটা।

তুমি আমাকে চিঠি লিখতে শিখিয়েছো, আমি নিজেকে বলতে শিখেছি।

তাই আজ বলছি—
আমি ভয় পাই, যদি তুমি একদিন ফিরে না আসো।
আমি ভয় পাই, যদি এই সম্পর্ক একতরফা হয়ে যায়।
তবে তার থেকেও বড় ভয়—তোমার পাশে বসেও যদি কিছু না বলতে পারি, সেই নীরবতাই আমার শেষ হবে।

তোমার নাম অনিন্দিতা, মানে অন্ধকারহীন।
আর আমি, আমি চাই তোমার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে আলোকিত করতে।

তুমি যদি একদিন চলে যাও, আমি জানি—আমার বুকের ভেতর একটা জানালা খোলা থাকবে, যেখানে প্রতিদিন হাওয়া আসবে তোমার পাঠানো গল্প হয়ে।

তুমি বলেছিলে সত্যি কথা চাই, তাই এই চিঠি।
নাও।”

চিঠি শেষ করে ভাঁজ করে রাখে কৌশিক। বুকের পকেটে নয়, আজ সে ব্যাগে রাখে।
একটা নির্দিষ্ট ওজনের মতো বোধ হয় যেন—এই চিঠির গুরুত্ব একটু বেশিই।

স্টেশনে পৌঁছে সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় সেই জায়গাটায় যেখানে এখনকার ‘তাদের’ দেখা হয়—হলুদ খুঁটির পাশের সিঁড়ির গা ঘেঁষা ছায়াময় কোণ।
পাঁচটা সাত।
পাঁচটা দশ।

এবার আর কাউকে খুঁজতে হয় না।

অনিন্দিতা আসে। একরাশ বাতাস নিয়ে, কাঁধে চেনা ব্যাগ, মুখে একটা শান্ত প্রত্যাশা।

আজ আর কোনো ‘হাই’, কোনো প্রশ্ন নেই।

সে সোজা গিয়ে কৌশিকের পাশে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
— “চিঠি এনেছো তো?”

কৌশিক ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করে দেয়।

অনিন্দিতা নেয় না।

সে বলে,
— “আজ আমায় পড়ে শোনাও। আমি চাই, তোমার মুখ থেকে শুনি, তুমিই কে। লেখায় আমি অনেক পেয়েছি। কিন্তু তোমার কণ্ঠে তোমার গল্পটা শুনতে চাই।”

কৌশিক একটু থমকে যায়।
তারপর আস্তে করে ভাঁজ খুলে, ট্রেনের শব্দের মধ্যেও স্পষ্ট গলায় পড়তে শুরু করে।

প্রথম শব্দটা উচ্চারণ করতেই, অনিন্দিতা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
তার মুখে হালকা হাসি, চোখে এক বিন্দু জল।

কৌশিক পড়ে চলে—একটার পর একটা লাইন।
না থেমে, না ভুল করে।

শেষ লাইনে এসে একটু থেমে যায় সে—“তুমি বলেছিলে সত্যি কথা চাই, তাই এই চিঠি। নাও।”

তারপর নিচু গলায় বলে,
— “এটাই আমি। খুঁতসহ, তবু খোলা।”

অনিন্দিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর ধীরে বলে,
— “তুমি ভাবছো, আমি এবার কী বলবো?”

— “হ্যাঁ।”

— “তাহলে শোনো—
আমি তোমায় ভয় পাই।
কারণ তুমি যা লেখো, তা বিশ্বাস করো।
আর আমি এখনো নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না।
তবে আমি চেষ্টা করছি।
তোমার পাশে দাঁড়িয়ে, আমি একটু একটু করে নিজেকে চিনছি।
তাই এই গল্পটা শেষ হতে দিও না।
তোমার চিঠিগুলো, আমার না-বলা কথার পাশে রেখে দিও।
একদিন আমি হয়তো নিজে থেকে সব বলে দেবো।”

ট্রেন এসে যায়।

আজ তারা পাশাপাশি জানালার ধারে বসে।
কোনো কথা হয় না।

শুধু বাতাসে ভাসে একটা সত্যি চিঠির গন্ধ।
যেটা পড়া হয়ে গেছে, শোনা হয়ে গেছে—এখন শুধু থেকে যাওয়ার পালা।

কৌশিকের সকাল আজ কিছুটা চুপচাপ। চিঠি পড়ে শোনানো, আর অনিন্দিতার সেই স্বীকারোক্তি—“আমি তোমায় ভয় পাই”—এইসব মিলিয়ে আজ তার ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি।

ভয়—এই শব্দটা ওদের গল্পে আগেও এসেছে। কৌশিক নিজের ভয় চিঠিতে লিখেছে। আর অনিন্দিতা মুখে স্বীকার করেছে।
কিন্তু আজকের সকালটায় কৌশিক অনুভব করে—ভয়ের মধ্যে থেকেও একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে।
ভয়ের ভেতরেও প্রেম থাকতে পারে।
ভয়ের পাশে দাঁড়িয়েই হাত ধরা যায়।

সকালের অফিসটা খুব জটিল যায়। ম্যানেজার নতুন প্রজেক্টের কথা বলছে, যার জন্য হয়তো কৌশিককে অন্য শহরে যেতে হতে পারে। তাও একমাসের জন্য।
কলকাতার বাইরে—অন্ধ্রপ্রদেশের কোনো ছোট শহর।

কৌশিক কথা না বাড়িয়ে শুধু বলে,
— “আমি একটু ভাবতে চাই।”
ম্যনেজার বলে,
— “আজ সন্ধ্যার মধ্যে জানাও।”

চাপ বাড়ে না, কিন্তু কিছু যেন বুকের ভেতরে দম আটকে রাখে।

স্টেশনে যাবার সময় আজ একটু দেরি হয়ে যায় কৌশিকের। প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে সে প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়ায় সেই চেনা জায়গাটায়।
পাঁচটা বারো বাজে।

অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে আছে—চুপচাপ।
চোখে কোনো রাগ নেই, কিন্তু কিছু একটা যেন বুঝে ফেলেছে।

— “আজ দেরি করলে?”
— “হ্যাঁ, অফিসে কিছু চাপ ছিল।”
— “তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, শুধু চাপ নয়, দ্বিধাও আছে।”

কৌশিক এবার আর এড়িয়ে যায় না। বলে,
— “হয়তো আমাকে একমাসের জন্য বাইরে যেতে হতে পারে। কাজের প্রয়োজনে। কিন্তু আমি ঠিক জানি না, রাজি হবো কি না।”

অনিন্দিতা তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,
— “তুমি যেতে চাও?”
— “না। কিন্তু কাজের জায়গায় সব সময় চাওয়া–না-চাওয়ার উপর চলে না।”

একটু চুপ। ট্রেনের আগমনের শব্দ দূর থেকে আসছে।

অনিন্দিতা এবার একটু ধীরে বলে,
— “তুমি কি জানো, আমি প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচ কেন বেছে নিয়েছিলাম?”
কৌশিক মাথা নাড়ায়—না।

— “কারণ পাঁচ নম্বরটা আমার কাছে শেষের নম্বর। আমি ছোটবেলা থেকে প্ল্যাটফর্ম গুনতাম। পাঁচ মানেই শেষ স্টপেজ। আমি চেয়েছিলাম আমার অপেক্ষার শেষ এখানেই হবে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আর কেউ আসবে না।
কিন্তু তুমি এলে।

আর আজ তুমি বলছো—তোমাকে যেতে হতে পারে।
তুমি যদি যাও, তবে আমি ঠিক আবার ফিরে আসব কি না, জানি না।”

কৌশিক চমকে ওঠে।
— “তুমি কি বলছো, আমি একমাসের জন্য গেলেই এই গল্প শেষ?”

— “না, আমি বলছি, আমি জানি না আমি অপেক্ষা করতে পারব কি না। কারণ আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। তুমি তো জানো, আমার অতীতটা সহজ ছিল না। আমি প্রতিদিন একটু একটু করে ভরসা তৈরি করছি।
তুমি যদি এবার আমার সামনে থেকেও দূরে যাও, আমি হয়তো আবার নিজেকে গুটিয়ে নেব।”

ট্রেন এসে গেছে। ভিড় অনেক বেশি।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

তারপর কৌশিক বলে,
— “তোমার কি মনে হয়, আমি তোমার থেকে দূরে থাকতে পারি?
তুমি কি ভাবো, আমি এই চিঠিগুলোর পথ ভুলে যাব?”

অনিন্দিতা তাকায়। তারপর বলে,
— “তুমি যদি যাও, তবে একটাই অনুরোধ—
আমার জন্য কোনো চিঠি রেখো না।
আমার জানালার ধারে কেউ যদি বসেই থাকে, তবে তার মনে যেন কোনো প্রেত্মায় ছায়া না থাকে।
আমি চাই, তুমি থাকলে পুরোপুরি থাকো।
না হলে, চুপচাপ যাও।
তোমার মতো করে, নিঃশব্দে।”

কৌশিকের চোখে জল আসে না, কিন্তু গলা শুকিয়ে যায়।

ট্রেন ছাড়ে।

আজ তারা একই কোচে ওঠে না।

দুজনেই আলাদা জানালায় বসে।

কৌশিক জানে না, তার সামনের দিনগুলো কেমন হবে।

তবে আজ, এই মুহূর্তে, তার ভেতরে একটাই স্পষ্ট সত্য—

অনিন্দিতা তাকে পালাতে বলছে না, থামতেও বলছে না—
সে চাইছে কৌশিক নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিক, এবং সেই সিদ্ধান্তে তাকে হারিয়ে ফেললেও যেন সত্যিকারের থাকে।

রাতটা কৌশিক নিজের খাতার সামনে বসে কাটায়।
আজ কোনো চিঠি লেখে না।

শুধু একটা লাইন লেখে পেন্সিল দিয়ে—

“যদি আমি থাকি, তবে পুরোটাই থাকব।
আর যদি না থাকি, তবে তোমার চিঠির পাতায় আর একটাও শব্দ থাকবেনা আমার।”

১০

সন্ধ্যে নামছে ধীরে ধীরে। আকাশে রং বদলাচ্ছে, ট্রেনের শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে শহরের কোলাহল।

কৌশিক আজ অফিসে বসে চুপ করে আছে। কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ, কিন্তু মন অন্য কোথাও। গতকালের কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসছে মনে—অনিন্দিতার চোখে সেই ভয়ের ছায়া, তার বলা শেষ কথাগুলো—

“আমি চাই, তুমি থাকলে পুরোপুরি থাকো। না হলে, চুপচাপ যাও।”

বাইরের শহরে কাজের প্রস্তাবটা সে আজ সরাসরি ফিরিয়ে দিয়েছে। কোনো অজুহাত খোঁজেনি। শুধু বলেছে—“আমার দরকার নেই। এখানে কিছু অসম্পূর্ণ আছে।”

তারপর সে বেরিয়ে পড়ে। সময় একটু আগেই, কিন্তু আজ সে চায় প্ল্যাটফর্মে প্রথম পৌঁছাতে। আগে থাকতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে।

আজ সে কোনো চিঠি নিয়ে যায়নি। কোনো কবিতা নয়, কোনো গল্প নয়। আজ সে শুধু নিয়ে গেছে নিজের উপস্থিতি—যা অনিন্দিতা চেয়েছিল সত্যিকারের।

পাঁচটা পাঁচ।

প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে ভিড় একটু কম। বিকেলের হাওয়া বইছে হালকা গন্ধ নিয়ে। চায়ের কাপ হাতে কৌশিক দাঁড়িয়ে থাকে তার চেনা জায়গায়।

পাঁচটা দশ।

দূরে দেখা যায় এক পরিচিত অবয়ব।

সাদা ও নীল জামদানি, খোলা চুল, মুখে শান্তি।

অনিন্দিতা।

সে এগিয়ে আসে ধীরে, চোখ কৌশিকের চোখে।
আজ কোনো চিঠির আদানপ্রদান নেই, কোনো সংকোচ নেই।

কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
— “তুমি কি গেছো?”
কৌশিক মাথা নাড়ে।
— “না। আমি থেকেছি। তোমার জন্য নয়, আমার নিজের জন্য। আমি বুঝেছি, আমি যদি যাই, তবে আমি নিজেকেই রেখে যাব।”
অনিন্দিতা একটু হেসে বলে,
— “তাহলে এখন আমি একটা চিঠি চাই।”
— “চিঠি আনিনি।”
— “তাহলে?”
— “তোমার দিকে তাকিয়ে বলব, এই প্রথম মুখে। আমি তোমায় ভালোবাসি, অনিন্দিতা।”

অনিন্দিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে জল নেই, কিন্তু তীব্র কিছু কেঁপে ওঠে তার চোখে। তারপর বলে,
— “তোমার এই কথাটার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি।
তোমার চিঠিগুলো ভালোবাসায় ভরপুর ছিল, কিন্তু একটা কথাও ছিল না যা মুখে বলা যায়।
আজ তুমি বললে।
এটাই আমার গল্পের শেষ চিঠি।”

ট্রেন আসে।

আজ তারা পাশাপাশি বসে, আর কেউ কিছু বলে না।

দুজনের মাঝখানে কোনো শব্দ নেই, তবু যেন বহু কথা বলা হয়ে যায়।

হাওয়ায় চুল উড়ে আসে অনিন্দিতার মুখে, কৌশিক সেটা সরিয়ে দেয় আলতো করে।

এই প্রথম—একটি স্পর্শ।

চোখে চোখ রেখে দুজনেই হাসে।

যেন স্বপ্ন নয়, বাস্তবও নয়—একটা মাঝখানে তৈরি হওয়া নিজেদের জগৎ।

স্টেশনে ট্রেন থামে।

অনিন্দিতা বলে,
— “আমি নেমে যাব, কিন্তু আবার উঠব কাল।
এই ট্রেনটাই তো আমাদের কথা বলার জায়গা।
তুমি যদি কোনোদিন না চাও উঠতে, শুধু একটা চিঠি রেখে যেও।
আমি পড়ে যাব।”

কৌশিক বলে,
— “তবে একটা শেষ প্রশ্ন—
তুমি কি এখনো ভয় পাও?”

অনিন্দিতা বলে,
— “ভয় পাই। কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভয়টাও আমার নিজের হয়ে উঠেছে।
তাই আর পালাতে ইচ্ছে করে না।”

ট্রেন ছেড়ে যায়।

প্ল্যাটফর্মে শুধু পড়ে থাকে কৌশিকের মুখে এক প্রশান্তি।

সে জানে, সব প্রেম চিঠি দিয়ে শুরু হয় না, আর সব চিঠিরই উত্তর লাগে না।

কিন্তু কিছু প্রেম—চোখের ভেতর লেখা থাকে, ট্রেনের জানালায় বসে ভেসে যায়, প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে দাঁড়িয়ে গল্প হয়ে ওঠে।

শেষ

1000024511.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *